উনিশে ডিসেম্বর মরশুমের শীতলতম রাত – ৭
৭
রাত তখন অনেক। অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়ে ছটফট করার পর চোখটা লেগে এসেছিল সুরজিতের। এখন মধ্যরাত। ইলেকট্রিসিটি আছে বটে, তবে তার অস্তিত্ব নিতান্তই ক্ষীণ। পাখার স্পিড দেখেই তা আন্দাজ করা যায়। প্রায় গোল উজ্জ্বল চাঁদটা এখন নিমগাছের মগডালের উপর থেকে উঁকি মারছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। মাঝেসাজে বাড়ির পিছনের অংশ থেকে শেয়াল ডেকে উঠছে, আর পাথুরে নদীর ছলাৎ ছলাৎ শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।
সুরজিৎ বারবার এপাশ ওপাশ করে চলেছে, কীসের যেন একটানা গোঙানির মতো শব্দে ঘুমটা ভেঙে যাচ্ছে বারবার। আর শব্দটা আসছে খুব কাছ থেকেই।
প্রথমটা অতটা খেয়াল করেনি সে, পরে ঘুমটা আলগা হয়ে এলে সুরজিৎ স্পষ্ট বুঝতে পারল শব্দটা হল বেড়ালের কান্না। আর সেটা আসছে, তার ঘরের মধ্যে থেকেই। ঘরটা বিশাল বড়, অন্ধকারে পুরোটা দেখাও যায় না। পুরোনো আমলের উঁচু সিলিং, বড় বড় জানলা দরজা, এসব এখনকার দিনে ভাবাই যায় না। আধো ঘুম আধো জাগা অবস্থায় সুরজিতের মনে হল, বিড়ালটা মনে হয়, সারা ঘরময় ঘুরে চলেছে, কান্নার শব্দটা সারা ঘরে ঘুরছে।
কিছুক্ষণ পর ঘুমটা পুরোপুরি ভেঙে গেল, সব ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল। হ্যাঁ নিশ্চিত এটা বেড়ালেরই কান্না। কিন্তু বিড়াল কই, সেটাকে তো চোখে দেখা যাচ্ছে না, শুধু ওই বিরক্তিকর শব্দটা একটানা হয়ে চলেছে। সুরজিতের গলা শুকিয়ে এল। জোরে জোরে গরম নিশ্বাস বেরুতে লাগল নাক দিয়ে। দেহ অবশ, হাত পায়ে যেন কোনো জোর নেই। দেহটাকে তুলে যে উঠে বসবে, এটুকু ক্ষমতাও যেন তার নেই। বুকের উপর যেন ভারী পাথর চাপানো।
বিড়ালটা একই রকম অপার্থিব স্বরে কেঁদেই চলেছে। বিছানা থেকে ওঠার দরকার, নয়তো এই কান্না থামবে না। কিন্তু এই মুহূর্তে বিছানা ছেড়ে এক মুহূর্তও নড়বার উপায় নেই ওর।
ঠিক কতক্ষণ একভাবে জেগে শুয়েছিল, সুরজিতের খেয়াল নেই। একটা অস্পষ্ট ধস্তাধস্তির শব্দে ঘোরটা কেটে গেল। জীবনের সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে সবে উঠতে যাবে, এমন সময়ে বিড়ালটার একটা মর্মান্তিক আর্তনাদে বুক কেঁপে উঠল ওর। ব্যস, তারপরই সব চুপ, আর কোনো শব্দ নেই।
কোনো রকমে বিছানা ছেড়ে দেওয়াল হাতড়ে, সুইচ টিপে আলো জ্বেলে, সুরজিৎ মেঝেতে যা দেখল, তাতে তার রক্ত হিম হয়ে গেল। হৃৎপিণ্ড মনে হয় কিছুক্ষণের জন্য কাজ করা বন্ধ করে দিল। আলো জ্বলতেই মেঝেতে চোখ পড়ল, একটা খয়েরি রঙের বিড়াল খাটের পাশে মেঝেতে মরে পড়ে আছে। বিড়ালটার গলা কেটে সেখান দিয়ে রক্ত বেরিয়ে মেঝেতে গড়াচ্ছে। দেখেই গা গুলিয়ে ওঠে।
আতঙ্কের এখানেই শেষ নয়, দেওয়ালের এক কোণে চোখ যেতেই এমন একটা দৃশ্য চোখে পড়ল, তাতে সুরজিতের আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হওয়ার জোগাড় হল। দেওয়ালের এক কোণে আধো অন্ধকারের মাঝে একভাবে দাঁড়িয়ে আছে রামবিলাস। হাতে তার মাছ কাটার বটি, আর সেখান থেকে টপ টপ করে রক্ত পড়ছে। সদ্যমৃত বিড়ালটার টাটকা রক্ত।
সেই পরিস্থিতিতে এমন দৃশ্য দেখলে যেকোনো লোক হয়তো সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলত। কিন্তু সুরজিৎ কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিল। একঝলক দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল সে, সেটি হাট করে খোলা। দরজা বন্ধ করে ঘুমানো তার বরাবরের অভ্যাস। তবে কাল কি বন্ধ করেনি? ভুলে গেছিল? তা নাহলে রামবিলাস ঘরে ঢুকল কী করে? আর এভাবে বিড়ালটাকে মেরেই বা ফেলল কেন সে? সেকি উন্মাদ? নাকি অন্য কিছু।
সুরজিৎ চিরকাল বাস্তববাদী মানুষ, জাগতিক ব্যাপার ছেড়ে অন্যান্য অলৌকিক ব্যাপার নিয়ে তার এতকালে মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু চারপাশে যা দেখছে, যা বুঝছে তাতে করে তার নিজের বিশ্বাসের মূল ভিত্তি যেতে বসেছে।
রামবিলাস তখনও একইভাবে সেখানে দাঁড়িয়ে। বেশ খানিকক্ষণ ওইভাবেই দাঁড়িয়ে থেকে সে অদ্ভুত গম্ভীর স্বরে বলল— “উ বিল্লিকা হাল চাল কুছ ঠিক নাহি থা! মার দিয়া সালে কো… আপ শো যাইয়ে বাবু!”
আর শো যাইয়ে! সুরজিতের কথা বলার মতো অবস্থা তখন নেই। শুয়েও আর বিশেষ লাভ নেই, ঘুমের যা বারোটা বাজার ততক্ষণে বেজে গেছে।
গায়ের চাদরটাকে ভালো করে জড়িয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দার চেয়ারে এসে বসল সুরজিৎ। আকাশের চাঁদ পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। পুব আকাশ ফর্সা হতে আর বিশেষ দেরি নেই।