উনিশে ডিসেম্বর মরশুমের শীতলতম রাত – ৮
৮
পরের দিন ছিল রবিবার। ছুটির দিন। হারাধনবাবু সকাল সকাল এসে হাজির হয়েছেন। সুরজিৎ তখন বারান্দায় চায়ের কাপ হাতে নিয়ে একমনে ভেবে চলেছে, কাল রাতে শোয়ার সময় সে সত্যিই ঘরের দরজা বন্ধ করেছিল, নাকি ভুলে গেছিল!
— কী ব্যাপার সরকারিবাবু? আপনাকে এত ডিসটার্বড লাগছে কেন? চেয়ারে বসেই জানতে চাইলেন হারাধন বাবু।
চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়ে সুরজিৎ কালকের সব কথা খুলে বলল তাকে।
সবটা শুনে হারাধনবাবুর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল। — “বটে! তাহলে এই কোয়ার্টার বাংলোয় সত্যিই কিছু আছে বলছেন? হিমু বড়ুয়ার অতৃপ্ত আত্মা আজও এখানে গুমরে মরে?”
সুরজিৎ কিছুক্ষণ পাথরের মতো বসে রইল। একেই কাল থেকে যা যা ঘটে চলেছে, তাতে তার মাথার ঠিক নেই। তার উপর হারাধনবাবুর এই অদ্ভুত রহস্যময় হেঁয়ালি!
— আপনাকে জোড় হাতে অনুরোধ করছি হারাধনবাবু। আপনি যদি এ-বাড়ি সম্পর্কে কিছু জেনে থাকেন, দয়া করে আমায় জানান। আমি হেড অফিসে কথা বলে, থাকার আস্তানাটা বদলাব। এই ঝামেলা মাথায় নিয়ে এখানে থাকব না। আমার বাড়িতে বউ-বাচ্চা আছে যে।
হারাধন বাবু সহাস্যে বললেন— “রোসো ভায়া রোসো! এসব ব্যাপারে জানতে গেলে আগে পিছের আরও কয়েকটা কথা শুনতে হবে যে।”
— বেশ তো, যা বলার বলুন আমি শুনতেই তো চাইছি।
— এখানে তো হবে না। চলুন। খানিক নদীর ধারে হেঁটে আসি। ঘুরতে ঘুরতে সব কথা হবে। চা-টা না হয় আজ বাইরেই খেয়ে নেব।
রামবিলাসকে দরজাটা বন্ধ করে দেওয়ার হুকুম দাখিল করে সুরজিৎ আর হারাধনবাবু বেরিয়ে গেলেন।
সকাল বেলার পলাশপুর দারুণ মনোরম। স্বচ্ছ, নদীর জল, বড় বড় মসৃণ পাথর খণ্ডগুলোকে পরম যত্নে বুকে লালন করে বয়ে চলেছে। নির্মেঘ আকাশের সূর্যের আলো পড়ে চারপাশ রুপোর মতো ঝকঝক করছে।
— বাংলার রাজনীতি সম্পর্কে তোমার পড়াশুনা কদ্দুর?
এরকম সময়ে হারাধনবাবুর এরকম একটা প্রশ্নে অবাক হয়ে গেল সুরজিৎ। বলল— “রাজনীতি নিয়ে তেমন কোনো মতামত আমার নেই হারাধনবাবু!”
— উঁহু! আমি বর্তমান রাজনীতির কথা বলছি না ভায়া। এখনকার বাংলার রাজনীতির যা ছিরি, ও নিয়ে আর কথা না বলাই ভালো। আমি বলছি নকশাল আমলে বাংলার রাজনীতির কথা।
সুরজিতের বাবা একসময়ে কট্টর নকশাল নেতা ছিলেন বটে, তবে সেসব ভাবধারা নিজের ছেলের মনে আরোপ করেননি। কাজেই সুরজিতের এসব ব্যাপারে সেরকম কোনো ধারণাই নেই। সে বলল— “সত্যি বলতে কী হারাধনবাবু, এ-ব্যাপারে খুব বেশি কিছু আমিও জানি না। যেটুকু জানি তা হল, ওই সময় একদল বামপন্থী বাঙালি ছেলে অস্ত্র হাতে রাজনীতির ময়দানে নেমেছিল, প্রকাশ্যে খুন, জখম, গুপ্ত হত্যা কোনো কিছুই বাদ ছিল না। এরপরে পুলিশের নির্বিচারে হত্যা আর ধর পাকড়ের ফলে, এই আন্দোলন বন্ধ হয়।”
হারাধনবাবুর হাঁটার গতি কমে আসে। — “দুঃখ কী জানেন সরকারিবাবু, আপনার প্রজন্মের অনেকেই নকশালদের ব্যাপারে বলতে গেলে এটুকুই শুধু বলতে পারবে, হয়তো বা এটুকুও পারবে না। কিন্তু ক’দিনই বা আগের কথা বলুন? একদল দামাল তরতাজা শিক্ষিত যুবক কীসের নেশায় মাতাল হয়ে এই পথে নেমেছিল, কী ছিল তাদের লক্ষ্য, কেমন ছিল তাদের প্রতিবাদের ভাষা, এসব নিয়ে আজকাল আর কেউ মাথাও ঘামায় না। রাজনীতি মানেই আজকাল শুধু দলাদলি আর স্বার্থ সিদ্ধি।”
সুরজিৎ বলল— নকশাল আমলের বাংলার রাজনীতিই কি আপনার গবেষণার বিষয়বস্তু?
— বলতে পারেন। তবে রাজনীতিটুকুই সব নয়। এই পথের বলি, কিছু মানুষকে নিয়েই আমার গবেষণা। এমনই একজন মানুষ হিমু বড়ুয়া।
— কিন্তু এর সঙ্গে আমার কোয়ার্টার বাংলোর কী সম্পর্ক হারাধনবাবু?
— আছে, সরকারিবাবু, সম্পর্ক আছে। আছে বলেই এই বয়েসেও আমি নিজে এই পলাশপুরে ছুটে এসেছি। এখানে না এসে, ওই বাড়ি নিজের চোখে না দেখলে আমার গবেষণা যে সম্পূর্ণ হবে না।
সুরজিৎ অবাক হয়ে হারাধনবাবুর কথা শুনতে থাকে। কিন্তু মাথায় ঢোকে না অনেক কিছুই। ওর মনের অবস্থা দেখে হারাধনবাবু বলেন— “আমি জানি সরকারিবাবু, আমার অনেক কথাই আপনি হয়তো বুঝতে পারছেন না। না বোঝারই কথা। তবে একটু ধৈর্য ধরে যদি আমার কথাগুলো শোনেন, হয়তো সবটা আপনার কাছেও এই দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে উঠবে।”
সুরজিতের, হারাধনবাবুর কথা শুনতে কোনো আপত্তি নেই। সে আগ্রহ ভরে জানতে চাইল।
হারাধনবাবু খানিকটা সময় নিলেন দম নেওয়ার জন্য। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলা, ওঁর বয়েসে, যথেষ্ট শ্রমসাধ্য কাজ। খানিকক্ষণ পরে বললেন— “পুরো ব্যাপারটা জানতে গেলে তোমায় দুটো গল্প শুনতে হবে সরকারি বাবু। প্রথম গল্পের সময়কাল আনুমানিক দেশ স্বাধীন হওয়ার দশ পনেরো বছর আগের। কলকাতার প্রভাবশালী উচ্চবিত্ত জমিদার বাড়ির ছোট ছেলে সত্যনারায়ণ রায় বর্মন। কলকাতা ছেড়ে পলাশপুরে এসে তৈরি করলেন এই প্রাসাদসম অট্টালিকা। উদ্দেশ্য স্বাস্থ্যোদ্ধার। সেসময়ে স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য অনেক বাঙালি এখানে এসে থাকতে শুরু করেছিল, সে কথা আগেই বলেছি। সত্যনারায়ণ তাদেরই একজন।
কিন্তু ভাগ্য বিরূপ! এই বাড়ি তৈরির কিছু কালের মধ্যেই রায় বর্মন পরিবারের উপর কোনো এক দুর্যোগ নেমে আসে। পরিবারের অনেকেই মারা যান। রায় বর্মন পরিবারের কয়েকজন, মাত্র কয়েকবারই এই বাড়িতে থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন। তারপর থেকে ওই বাড়ি আজ পর্যন্ত এরকম ফাঁকাই পড়ে আছে। কোনো রক্ষণাবেক্ষণ নেই, কিচ্ছু নেই, হালে সরকারি অফিস বাংলো তৈরির তাগিদে সামনের অংশটা খানিক মেরামত করে বাসযোগ্য করে তোলা হয়েছে।
এতগুলো বছর বাড়িটা পরিত্যক্ত হয়ে ফাঁকা পড়ে রইল, কোনো দাবিদার নেই, কেউ নেই। অন্য কোনো জায়গা হলে হয়তো চোর ছ্যাচরের আড্ডাখানা, বা অসামাজিক কাজকর্মের আঁতুড়ঘর হয়ে উঠত। কিন্তু পলাশপুর অন্যরকম জায়গা। এখানে এতগুলো বছর এই বাড়ি ফাঁকা এবং পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে রইল।”
এই পর্যন্ত বলে, হারাধনবাবু আবার একটু থামলেন। সুরজিৎ একমনে ওর কথা শুনে চলেছে। কিছুটা পথ নিঃশব্দে হেঁটে, হারাধনবাবু আবার বলতে শুরু করলেন— “এবার চলে আসুন আরও কুড়ি বছর পর। বাংলা রাজনীতির এক চরম বিক্ষুব্ধ সময়। ঘরে ঘরে শিক্ষিত তরুণের দল ক্ষেপে উঠেছে এক অজানা রক্তের নেশায়। পুঁজিপতি সাম্রাজ্য নিপাত যাক, এই মন্ত্রে বুক বেঁধেছে তারা। গোপন আস্তানায় তৈরি হয়েছে বোমা। চাকু ধরা, বন্দুক চালানো অভ্যেস করেছে মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরের সুসন্তানেরা। চরমতম বামপন্থী মতাদর্শে দীক্ষিত হয়ে, চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শ্রেণি শত্রুদের ধ্বংস করার ব্রত নিয়েছে। চারু মজুমদার, সুশীতল রায়চৌধুরী, কানু সান্যাল প্রভৃতি কমরেডদের ডাকে উদ্বুদ্ধ হয়ে একদল বাঙালি যুবক তখন খুনের নেশায় মত্ত। বুকপকেটে মাও সে তুংয়ের ছবি, বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে লেলিন। বাপ-মায়েরা চোখের সামনে দেখেছে, তাদের আদরের ছেলে, কীভাবে রাজনীতির নামে ধীরে ধীরে সন্ত্রাসবাদীদের দলে নাম লেখাতে লেগেছে।”
হারাধনবাবুর মুখ আকাশের দিকে উঁচু। কথাগুলো উনি বলছেন অন্তর থেকে। যেন বহুকালের পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করে পেড়ে নিয়ে আসছেন আকাশের বুক থেকে। সুরজিৎ মন্ত্রমুগ্ধের মতো কথাগুলো শুনে চলেছে।
— জানেন সরকারিবাবু, আজ এতগুলো বছর পরে, রাজ্যের রাজনীতির দিকে তাকিয়ে দেখলে সত্যিই মনে হয়, সে যুগের ওই একদল দামাল ছেলের আত্মবলিদান নিতান্তই নিরর্থক ছিল। কী লাভ হল বলুন তো? আর সত্যি বলতে কি, কয়েক বছর পরেই বোঝা গেল, কয়েকটা অন্তঃসারশূন্য ফাঁপা আদর্শবাদ দিয়ে, বিপ্লব চলে না। একটা সময় বোঝা গেল এত কিছু করেও কোনো লাভ হল না, দিকভ্রষ্টর মতো ছুটোছুটি হল শুধু। শেষকালে অবস্থা এমন দাঁড়াল, কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু অঞ্চল, আর সাধারণের বাসযোগ্য রইল না। চারু মজুমদার চেয়ে ছিলেন এই বিপ্লবকে শুধু গ্রাম বাংলার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, একে ছড়িয়ে দিতে হবে শহরের প্রাণকেন্দ্রে। তিনি রচনা করলেন তাঁর বিখ্যাত বই ‘হিস্টরিক এইট ডকুমেন্টস্’ বা ‘আট দলিল’ যা ছিল নকশাল মতাদর্শের মূল ভিত্তি। আশ্চর্যজনকভাবে সবথেকে বেশি সাড়া মিলল তৎকালীন কলকাতার নামকরা সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। এই নকশাল মুভমেন্টের মতাদর্শ শিক্ষিত বাঙালি ছাত্র সমাজের মধ্যে প্রবল জনপ্রিয় হয়ে উঠল। বললে আপনি বিশ্বাস করবেন না সরকারিবাবু, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি কলেজ, সর্বোচ্চ লেখাপড়া বন্ধ করে, নকশাল আন্দোলনের আঁতুড়ঘর বানিয়ে ফেলা হল। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে গোপনে তৈরি হতে লাগল বোমা। শ্রেণি শত্রুদের খতম করো, এই স্লোগান নিয়ে আন্দোলনকারীরা পথে পথে খুন করে বেড়াতে লাগল, উচ্চবিত্ত ভূস্বামীদের, এমনকি ডাক্তার, উকিল-ব্যারিস্টার, কলেজের প্রিন্সিপাল পর্যন্ত কেউ বাদ গেল না। হাহাকার পড়ে গেল চতুর্দিকে।
এর পরে রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নিল, এই সন্ত্রাসবাদীদের কঠোরভাবে দমন করা প্রয়োজন। কোনো আবেদন-নিবেদন নীতি নয়, পুলিশকে স্পষ্টভাবে হুকুম দেওয়া হল, নকশাল আন্দোলনের সাথে যুক্ত যে কাউকে পেলেই তৎক্ষণাৎ গ্রেপ্তার করতে ও প্রয়োজনে নির্বিচারে হত্যা করতে। যাদবপুর, শিবপুর ময়দান, বরানগর সব একেকটা ফায়ারিং স্কোয়াড তৈরি হল গোপনে। নির্বিচারে হত্যা চলতে লাগল। খবরের কাগজে ছাপল এনকাউন্টার। পুলিশের তখন সময় নেই, কে নকশাল আর কে নকশাল নয় তা প্রমাণ করে খুঁজে বার করার। অর্থাৎ কোনো রিস্ক না নিয়ে, শিক্ষিত বাঙালি যুবক দেখলেই, নির্বিচারে গ্রেফতার করা হতে লাগল।
শহরের সব অ্যাক্টিভ কমরেডদের কাছে খবর গেল, পার্টির অবস্থা খারাপ, বাঁচতে চাইলে আন্ডারগ্রাউন্ডে যাও। চারপাশে তখন পরিত্রাহি রব। পুলিশের চেয়ে নিষ্ঠুর জাত যেন আর কিছু নেই। শুধুমাত্র নকশাল এই সন্দেহ করে কত যে সাধারণ নিরপরাধ বাঙালি যুবককে তারা কুকুরের মতো গুলি করে মেরেছে তার ইয়ত্তা নেই।
বিজয়গড়ের গোপন আস্তানায় একদিন খবর গেল, পুলিশ আসছে। এক্ষুনি রেড হবে। সেই দিন মাঝরাতে বিজয়গড়ের গোপন আস্তানা থেকে অ্যারেস্ট হল হিমু বড়ুয়া। কট্টর নকশালপন্থী ছাত্র যুবনেতা। কিন্তু পুলিশ তাকে ধরে রাখতে পারল না। এনকাউন্টার স্কোয়াডে নিয়ে যাওয়ার পথে বেমালুম ভ্যানিশ হয়ে গেল সে। গুলি ছোড়া হয়েছিল তার দিকে লক্ষ করে, কিন্তু গুলি তার গায়ে না লাগে, লেগেছিল পায়ে। সেই অবস্থায় এক পায়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে পুলিশের নাগাল ছাড়িয়ে পালিয়ে গিয়েছিল হিমু বড়ুয়া।
সুরজিৎ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল— “এত কথা আপনি জানলেন কেমন করে হারাধনবাবু?”
হারাধনবাবু একটু হেসে নিয়ে বললেন— “অনেকদিন এই ব্যাপার নিয়ে পড়াশোনা করছি সরকারিবাবু। পলাশপুরের এই রায় বর্মন বাড়িতে এসে, আমার রিসার্চ ওয়ার্ক কমপ্লিট করব।”
— কেন বলুন তো? এই বাড়িতে ঠিক কী হয়েছিল?
— ঠিক কী হয়েছিল তা আমিও জানি না। কেউই জানে না। তবে যেটুকু জানি, আপনাকে বলছি শুনুন। পুলিশের তাড়া খেয়ে নকশালপন্থী নেতারা তখন বাংলা ছেড়ে যেদিকে পারল পালাল। তার মধ্যে অনেকেই এসে ভিড়ল এই পলাশপুরে। একে এই পাণ্ডববর্জিত জায়গা। থানা-পুলিশের সেরকম হাঙ্গামা নেই। তার উপর এই ফাঁকা রায় বর্মন বাড়ি। এমনিতেই যেখানে খুব একটা কেউ আসে না। কাজেই বছরখানেকের মধ্যে এই রায় বর্মন বাড়ি হয়ে উঠল, কয়েকজন পুলিশে খেদানো নকশাল নেতার মাথাগোঁজার নিরাপদ স্থান।
— “কিন্তু সে না হয় হল”, বলল সুরজিৎ। “কিন্তু সেই হিমু বড়ুয়ার অতৃপ্ত আত্মা এখনও এই বাড়িতে কেন?”
— কারণ আর কিছুই না। এই বিষয় নিয়ে রিসার্চ করতে করতে আমি জানতে পেরেছি, হিমু বড়ুয়াকে এই বাড়িতেই নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল।
— “সেকি? কে করে ছিল? কেন?” সুরজিৎ জানতে চায়।
— কে করেছিল? তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে পুলিশ করেনি এটুকু নিশ্চিত। আর কেন করেছিল? সেটাও একটু এই বিষয় নিয়ে ভাবনা চিন্তা করলে সহজেই অনুমান করা যায়। যাক গে সে কথা। যা বলছিলাম তাই বলি— হিমু এসে দেখল তার দুই সাগরেদ আগে থেকেই সে বাড়িতে এসে উঠেছে। তিনজনেই ছিল হরিহর আত্মা, এবং একে অপরের সব সুকর্ম দুষ্কর্মের সাক্ষী। এ-বাড়ির খোঁজ হিমুই ওদের জানিয়েছিল। পার্টি আণ্ডারগ্রাঊণ্ডে গেলে এই পলাশপুরের রায় বর্মন বাড়িতে এসে লুকোতে হবে এমনটা আগে থেকেই প্ল্যান করা ছিল, হিমু ছিল সাচ্চা কমরেড। কখন যে নিজেদের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আর দলাদলি শুরু হয়ে গেছে, সে তা টেরই পাইনি। টের যখন পেল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। এক দারুণ শীতের রাতে, হঠাৎই সে আবিষ্কার করল তার দুই বিশ্বস্ত বন্ধু দু-দিক থেকে তার দিকে রিভালবার তাক করে রেখেছে। ব্যস আর কিছুক্ষণের অপেক্ষা। তারপরেই মৃত্যু। গলার কাঁটাকে পুরোপুরি নির্মূল করে, রাজনীতির ভূত ঘাড় থেকে নামিয়ে, দুই বন্ধু ভেক ধরে আবার গা-ঢাকা দিল কলকাতায়। ক্রমে উত্তপ্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এল, যে যার স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে ফিরে গেল। হিমু বড়ুয়াদের মতো অভাগা আদর্শবাদীদের দল পচে গলে ক্রমশ শেষ হয়ে যেতে লাগল পলাশপুরের মতো আরও হাজারো নির্জন স্থানে।
— “এই দুই বন্ধু কারা?” জানতে চাইলেও সুরজিৎ।
— একজনের নাম হীরক ঘোষ। আরেকজন…
আরেকজনের নাম না বলে হারাধনবাবু তার ঝোলা ব্যাগের ভেতর থেকে একটা পুরোনো ঝুরঝুরে ডায়েরি বের করলেন। ডায়েরির পাতা উলটাতে উলটাতে তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল বেশ কয়েকটি পুরোনো সাদা-কালো ছবি। তার মধ্যে দুটো ছবির দিকে তাকিয়ে সুরজিতের মাথা ঘুরে গেল বোঁ করে। এ যে অবিকল সেই ছবি। সেই ছবি, যা তার ছেলে বলাই এঁকেছিল। বলাইয়ের আঁকা শেষ ছবি। যে ছবিগুলো দেখে তার বাবা…
হারাধনবাবু খেয়াল করেন সুরজিৎ একদৃষ্টিতে ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, পাঞ্জাবির কলার এরইমধ্যে ঘামে ভিজে গেছে, হাত দুটো থর থর করে কাঁপছে যেন।
— কী ব্যাপার সরকারিবাবু? ছবিগুলো দেখে কীরকম যেন চমকে উঠলেন মনে হল?
নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে সুরজিৎ বলল— “না না কিছু না। এ ছবি কীসের ছবি হারাধনবাবু?”
ছবিগুলোর দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে উনি বললেন— “এই হল সেই সময়ে রায় বর্মন বাড়ির ছবি। অনেক কষ্টে এগুলো জোগাড় করেছি। এই দেখুন, এই হল বাড়ির মূল ফটক। এখন যা দেখছেন এর তো কিছুই অবশিষ্ট নেই। এই হল ফটকের ভেতরে বাড়ির মূল অংশ। আর এই দিকে দেখুন এই যে এই ছবিটাতে, এই হল বাড়ির ভিতরের অংশ, বড় উঠোন, তার পাশে সিঁড়ি উঠে গেছে। আর এই হল দোতলা ঘর। খুব সম্ভবত এই ঘরেই নকশাল নেতারা আস্তানা গেড়ে ছিল।”
সুরজিতের মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। হাত-পা অসাড় হয়ে এসেছে। নিয়তির কী নিদারুণ পরিহাস! এই ছবির অবিকল প্রতিলিপি, তার বাড়ির আলমারিতে এখনও তোলা। তার নিজের ছেলের হাতে আঁকা। ছবিগুলোর দিকে তাকালেই বুকটা কেমন মুচড়ে উঠছে সুরজিতের। এ-কথা সে ভুলতে পারে না, এই ছবিগুলো হাতে নিয়েই তার বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। কী এমন আছে এই ছবিগুলোতে? আশ্চর্যজনকভাবে, ওই একই ছবি আজ হারাধনবাবুর ডায়েরিতে।
হারাধন বাবু পকেট থেকে রুমাল বের করে চশমার কাচ দুটো মুছতে মুছতে বললেন— সেই রাজাও আর নেই, সেই রাজনীতিও নেই। কিন্তু হিমু বড়ুয়ার অতৃপ্ত আত্মা বোধ করি আজও এই জায়গা ছেড়ে যেতে পারেনি। তার বিশ্বাসঘাতক দুই বন্ধুর প্রতি অব্যক্ত ঘৃণা, অপ্রকাশের ভাষায় আজও গুমরে কাঁদে পলাশপুরের এই কোয়ার্টার বাংলোর চার দেওয়ালের মাঝে।