উনিশে ডিসেম্বর মরশুমের শীতলতম রাত – ৯
৯
সেদিন বাড়ি ফিরে এসে আর কারো সঙ্গে ভালো করে কথা বলতে পারেনি সুরজিৎ। না রামবিলাসের সঙ্গে কথা বলেছে, না হারাধনবাবুর সঙ্গে। ছবিগুলো হাতে নিয়ে বসে থেকেছে সারাটা দিন।
কলকাতা, নকশাল আন্দলন, পলাশপুর, জমিদার বাড়ি, হিমু বড়ুয়া, এই কোয়ার্টার বাংলো, রামবিলাস, সব মাথার মধ্যে জট পাকিয়ে গেছে। তার ছেলের আঁকা ছবিগুলো তার মোবাইলে সেভ করা ছিল। এই ছবিগুলোর সঙ্গে সেগুলো মিলিয়ে ভালো করে পরীক্ষা করল সুরজিৎ। অনেক খুঁটিয়ে দেখলে মনে হয়, এগুলো থেকেই ওই ছবিগুলো কপি করে আঁকা। অনেকক্ষণ ধরে ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে সুরজিৎ আরও একটা ব্যাপার লক্ষ করল, তিনটি ছবি যেন একটা পথের নির্দেশ করছে। প্রথমে দেখানো হচ্ছে মেইন গেট, গেট পেরিয়ে রাস্তা চলে গেছে বাড়ির বাগানের পেছনের দিকে। দ্বিতীয় ছবিতে দেখা যাচ্ছে বাড়ির মাঝের অংশ এবং দোতলার একটি ঘর। আর তৃতীয় ছবি ইঙ্গিত করছে বাড়ির পিছনের দিকটাকে। পিছনের বাগান, জঙ্গল, ভাঙ্গা মন্দির এমনকি পাথরের তৈরি একটা বড় ফোয়ারাও চোখে পড়ছে। আর দেখা যাচ্ছে পুরোনো আমলের একটা বড় ইঁদারা।
মনে মনে ঠিক করে ফেলেছে। হারাধনবাবুকে সঙ্গে নিয়ে এই বাড়ি ভালো করে খুঁজে দেখবে সুরজিৎ। একা দেখা সম্ভব নয়, হারাধনবাবুকে পাশে চাই। উনি অনেক বছর ধরে এসব নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, ঘেটেছেন। উনি পাশে থাকলে সুবিধা হবে। গোটা বাড়িটা ঘুরে খুঁজে দেখলে, আদৌ কিছু পাওয়া যাবে কিনা তা সুরজিৎ জানে না। হিমু বড়ুয়ার অতৃপ্ত আত্মা যদি আজও এই বাড়িতে থেকে থাকে, তাহলে কীভাবে সেই আত্মার মুক্তি ঘটবে, তাও তার অজানা। তবে হারাধনবাবুর সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে। তিনি কোনো একটা নির্দিষ্ট পথ ধরে এগোতে চাইছেন। কাজেই সুরজিৎ আপাতত সেই পথেই হাঁটবে। দেখাই যাক না একবার। সারাটা জীবন তো বাস্তবের পেছনে ছুটে চলেছে, একবার না হয় অবাস্তব অলৌকিকতার পেছনে ছুটে দেখা যাক।
আজ সারাটা দিন একটা ঘোরের মধ্যে কেটে গেছে। একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে, অ্যাশট্রেটা ফিল্টারে ভরিয়ে ফেলেছে সুরজিৎ। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। খাওয়া-দাওয়াও খুব একটা যুত করে হয়নি আজ। রামবিলাসের হাবভাব দিন দিন আরও যেন সন্দেহজনক হয়ে উঠছে। ওর চোখের ভাষা যেন কিছু একটা বলতে চায়। আচমকা একবার ওর চোখের দিকে তাকালেই আজকাল বুকটা কেমন যেন ছ্যাঁত করে ওঠে সুরজিতের।
— “বাবু চায়।” রামবিলাসের বিটকেল শব্দে, পিছনে ফিরে তাকাল সুরজিৎ।
মুখে গরম চা-টা উদরস্ত করে, সিগারেটের প্যাকেটটা পাঞ্জাবির পকেটে ভরে, আর গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে সুরজিৎ বাইরের দিকে পা বাড়াল। চিন্তাভাবনায় মাথাটা গরম হয়ে আছে। একটু কয়েক পা ঘুরে না এলেই নয়।
পঞ্চাননতলা শিব মন্দির পর্যন্ত যেতে না যেতেই হারাধনবাবুর দেখা পাওয়া গেল। ভদ্রলোক আসছিলেন খুব সম্ভবত সুরজিতের কোয়ার্টার বাংলোয়।
এ-কথা সে-কথা বলার পর, সুরজিৎ বলল— “হারাধনবাবু আমি ঠিক করেছি থানায় যাব।”
— থানায়?
— হ্যাঁ, রামবিলাসের আচরণ আমার ক্রমে ক্রমে ক্রমশ অস্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে। এইরকম একজন লোকের সঙ্গে সারাদিন সারারাত এক বাড়িতে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। আমি মেইল করে হেডঅফিসে জানাতেই পারি তাহলে বেচারার একদিনে চাকরিটা যাবে। আপনি ভাবুন হারাধনবাবু, যে লোক মাঝরাত্তিরে বন্ধ ঘরের ভেতর ঢুকে বটি হাতে বিড়াল কুপিয়ে খুন করতে পারে, তার সঙ্গে সারাদিন, সারারাত এক বাড়িতে থাকা কি নিরাপদ?
হারাধন বাবুর কপালে ভাঁজ। কিছুক্ষণ চিন্তা করে তিনি বললেন— “বেশ যাবেন। আমাকেও বলবেন না হয়, আমিও সঙ্গে যাব।”
সুরজিৎ মনে মনে অনেকটা আশ্বস্ত হল। সত্যিই এমন সময় হারাধনবাবুকে পাশে না পেলে পাগলই হয়ে যেত সে। আর একমুহূর্তও পলাশপুরে থাকতে পারত না। তিনি যেন দেবদূত হয়ে সুরজিতের পাশে পাশে রয়েছেন।