ছান্দোগ্য উপনিষদ
সূচনা
সুপ্রসিদ্ধ ঋষি বৈশম্পায়নের নয় জন শিষ্যের মধ্যে একজনের নাম তাণ্ড্য। ঋষি তাণ্ড্য সামবেদের একটি শাখার প্রবর্তক। এ-শাখার নাম তাণ্ড্য শাখা। এ-শাখার অন্তর্গত একখানা ব্রাহ্মণ গ্রন্থের নাম ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণ। যাঁরা ছন্দ অর্থাৎ বেদগান করেন তাঁদের নাম ‘ছন্দোগ’। ছন্দোগদিগের ধর্ম ও শাস্ত্রকে ‘ছান্দোগ্য’ বলা হয়।
সামবেদীয় ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণের দশটি অধ্যায় আছে। তার শেষ আটটি অধ্যায়ই ছান্দোগ্য উপনিষদ নামে পরিচিত। প্রত্যেকটি অধ্যায়ই স্বতন্ত্র ও স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে বিষয়গত ভাগ করলে দেখা যায় যে, প্রথম পাঁচ অধ্যায়ে কর্মাঙ্গ উপাসনার কথা বলে ষষ্ঠ অধ্যায় থেকে প্রকৃত ব্রহ্মোপদেশ আরম্ভ করা হয়েছে। উদ্দেশ্য হল এরূপ কর্মাঙ্গ উপাসনাদ্বারা চিত্তের মলিনতা ও চাঞ্চল্য দূর হওয়ার পর ব্রহ্ম বিষয়ে উপদেশ দিলে তা কার্যকরী হতে পারে। পণ্ডিত দুর্গাচরণ সাংখ্যতীর্থের মতে— এই উপনিষদের ভাষা সরল, ভাব গম্ভীর, যেমন আখ্যায়িকাগুলি উত্তমরূপে সাজান, আবার উপদেশগুলিও মধুর। সাধারণ লোকের করণীয় কর্ম হতে আরম্ভ করে জ্ঞানীদের উপযোগী ব্রহ্মতত্ত্ব পর্যন্ত এখানে অতি সুন্দরভাবে আলোচিত হয়েছে। এই উপনিষদে ‘সত্যকাম-জাবালা’ ইত্যাদি কাহিনী আছে যাদের মাধ্যমে নানা তত্ত্বকথার অবতারণা করা হয়েছে।
বৃহদারণ্যক উপনিষদের ন্যায় ছান্দোগ্য উপনিষদও আকারে বৃহৎ এবং সামগ্রিক চিন্তাধারায় পুষ্ট। তাই ব্রহ্মতত্ত্ব ছাড়াও সামগ্রিক জীবনের আলেখ্য এতে চিত্রিত আছে। পুরাতত্ত্ববিদিগের মতে ছান্দোগ্য এবং বৃহদারণ্যক এই দুইখানা উপনিষদই অতি প্রাচীন। তাঁরা বলেন, অন্যান্য উপনিষদের অন্তর্গত সত্যসমূহ অনেকাংশেই এই দুখানা থেকে সংগৃহীত। সুতরাং ভারতীয় ব্রহ্মবাদের প্রাচীনতম আকার দেখতে হলে ছান্দোগ্য ও বৃহদারণ্যক উপনিষদ অধ্যয়ন করা একান্ত আবশ্যক।
প্রাচীন ভাষ্যকারদের মধ্যে শংকর, রঙ্গরামানুজ ও মধ্ব উপনিষদটির ভাষ্য রচনা করেছেন। বর্তমান কালে রাধাকৃষ্ণন প্রমুখ অনেক মনীষী উপনিষদখানির অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করেছেন।
শান্তিপাঠ
ওঁ আপ্যায়ন্তু মমাঙ্গানি বাক্ প্রাণশ্চক্ষুঃ শ্রোত্রমথো
বলমিন্দ্রিয়াণি চ সর্বাণি। সর্বং ব্রহ্মৌপনিষদম্।
মাহহং ব্রহ্ম নিরাকুর্যাং মা মা ব্রহ্ম নিরাকরোৎ,
অনিরাকরণমস্তু, অনিরাকরণং মেহস্তু। তদাত্মনি
নিরতে য উপনিষৎসু ধৰ্মাস্তে ময়ি সন্তু, তে ময়ি সন্তু।।
ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ ওঁ শান্তিঃ।।
সান্বয় অনুবাদ : মম অঙ্গানি (আমার অঙ্গসমূহ) বাক্ প্রাণঃ চক্ষুঃ শ্রোত্রম্ অথো বলম্ (বাগিন্দ্রিয়, চক্ষু, কর্ণ এবং বল), সর্বাণি ইন্দ্রিয়াণি চ (এবং সকল ইন্দ্রিয়) আপ্যায়ন্ত (পুষ্টিলাভ করুক)। সর্বম্ ঔপনিষদং ব্রহ্ম (সমস্তই উপনিষদ প্রতিপাদ্য ব্ৰহ্ম)। অহম্ ব্রহ্ম মা নিরাকুর্যাম্ (আমি যেন ব্রহ্মকে অস্বীকার না করি)। ব্রহ্ম মা মা নিরাকরো (ব্রহ্ম যেন আমাকে প্রত্যাখ্যান না করেন), অনিরাকরণম্ অস্তু (ব্রহ্মের নিকট আমার অপ্রত্যাখ্যান হউক), মে (আমার নিকট) [ব্রহ্মণঃ] অনিরাকরণম্ অস্তু (ব্রহ্মের অপ্রত্যাখ্যান হউক), উপনিষৎসু (উপনিষদসমূহে) যে ধর্মাঃ [সন্তি] (যে সকল ধর্ম আছে) তে (তাহারা) তৎ-আত্মানি নিরতে ময়ি (সেই আত্মাতে নিরত আমাতে) সন্তু (হউক), তে ময়ি সন্তু (তাহারা আমাতে হউক) ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ (আমাদের ত্রিবিধ বিঘ্নের শান্তি হউক)।
সরলার্থ : আমার সমস্ত অঙ্গ এবং বাক্, প্রাণ, চক্ষু, কর্ণ, বল ও সমস্ত ইন্দ্ৰিয় পুষ্টিলাভ করুক। সমস্তই উপনিষদ প্রতিপাদিত ব্রহ্ম। আমি যেন ব্রহ্মকে অস্বীকার না করি, ব্রহ্মও যেন আমাকে প্রত্যাখ্যান না করেন। তাঁহার ও আমার নিয়ত সম্বন্ধ বিদ্যমান থাকুক। উপনিষদে যে সকল ধর্মের কথা বলা হইয়াছে আত্মনিষ্ঠ আমাতে সেই ধর্মসমূহ প্রকাশ লাভ করুক। আমাদের সকল বিঘ্নের শান্তি হউক।