ছান্দোগ্য উপনিষদ – তৃতীয় অধ্যায়
তৃতীয় অধ্যায়
প্ৰথম খণ্ড – মধুবিদ্যা—আদিত্যাদিতে মধ্বাদি কল্পনা (১)
১৮৭. অসৌ বা আদিত্যো দেবমধু তস্য দ্যৌরেব তিরশ্চীনবংশোহন্তরিক্ষ
অপূপো মরীচয়ঃ পুত্রাঃ ॥ ১
অন্বয় : অসৌ বৈ আদিত্যঃ দেবমধু (দেবগণের মধু); তস্য (তাহার) দ্যৌঃ এব (দ্যুলোকেই) তিরশ্চীনবংশঃ (তির্যকভাবে অবস্থিত বংশ; তির্যঞ্চ শব্দ হইতে); অন্তরিক্ষম্ অপূপঃ (পিষ্টক, মধুপিষ্টক); মরীচয়ঃ (মরীচি অর্থাৎ কিরণসমূহ) পুত্রাঃ (ভ্রমরের পুত্রগণ)।
সরলার্থ : ঐ আদিত্য দেবগণের মধু; দ্যুলোক তাহার অবলম্বন বক্রাকার বংশ-খণ্ড; অন্তরিক্ষই মধুচক্র; কিরণসমূহই (মৌমাছির) শাবক।
১৮৮. তস্য যে প্রাঞ্চো রশ্ময়স্তা এবাস্য প্রাচ্যো মধুনাড্যঃ। ঋচ এব মধুকৃত ঋগ্বেদ এব পুষ্পং তা অমৃতা আপস্তা বা এতা ঋচঃ ॥ ২
১৮৯. একমৃগ্বেদমভ্যতপংস্তস্যাভিতপ্তস্য যশস্তেজ ইন্দ্রিয়ং বীর্যমন্নাদ্যং রসোহায়ত ॥ ৩
অন্বয় : তস্য (তাহার) যে (যে সমুদয়) প্রাঞ্চঃ রায়ঃ (পূর্বদিকে অবস্থিত রশ্মিসমূহ), তাঃ এব (সেই সমুদয়ই) অস্য (ইহার) প্রাচ্যঃ (পূর্বদিকের) মধুনাড্যঃ (মধুর নাড়ীসমূহ; মধুর আধারভূত ছিদ্রসমূহ); ঋচঃ এব (ঋকমন্ত্রসমূহই) মধুকৃতঃ (মধুকরগণ)। ঋগ্বেদঃ এব (ঋগ্বেদই) পুষ্পম্ (পুষ্প; মধুসংগ্রহের স্থান)। তাঃ আপঃ (সেই জলীয় পদার্থসমূহ) অমৃতাঃ (অমৃত অর্থাৎ পুষ্পের মধু)। তাঃ বৈ এতা ঋচঃ (সেই সমুদয় ঋক্) ঋগ্বেদম্ (এই ঋগ্বেদকে) অভ্যতপন্ (অভিতপ্ত করিয়াছিল)। তস্য অভিতপ্তস্য (অভিতপ্ত সেই ঋগ্বেদের, এখানে ঋগ্বেদ হইতে) যশঃ তেজঃ ইন্দ্ৰিয়ম্ (ইন্দ্রিয়শক্তি) বীর্যম্ অন্নাদ্যম্ (খাদ্য) রসঃ অজায়ত (উৎপন্ন হইয়াছিল)।
সরলার্থ : (২য় ও ৩য় মন্ত্র)—তাহার পূর্বদিকের কিরণসমূহই পূর্বদিকের মধুনাড়ী, ঋমন্ত্রই মধুকর; ঋগ্বেদই পুষ্প; যজ্ঞগ্নিতে নিক্ষিপ্ত জলীয় পদার্থই অমৃত (পুষ্পের মধু); ঋমন্ত্রসমূহ ঋগ্বেদকে উত্তপ্ত করিয়াছিল। সেই উত্তপ্ত ঋগ্বেদ হইতে যশ, তেজ, ইন্দ্রিয়সামর্থ্য, বীর্য এবং অনুরূপ রস উৎপন্ন হইয়াছিল।
মন্তব্য : ‘অন্নাদ্য’ শব্দের বহু অর্থ হইতে পারে—(১) অনুরূপ আদ্য; আদ্য= ভক্ষণীয় বস্তু (শংকর), (২) অন্ন প্রভৃতি, (৩) অন্ন এবং অন্ন ভোজন (Whitney এবং Lanmun), (৪) মোক্ষমূলার বলেন, অন্নাদ্য অর্থ স্বাস্থ্য বা ভোজন করিবার শক্তি হইতে পারে। (৫) অন্নাদ—অন্নভোক্তা, সুতরাং অনাদ্য—অন্নভোক্তৃত্ব, (৬) ভোগ্য এবং ভক্ষ্য (মহাভারতে নীলকণ্ঠের টীকায়)।
১৯০. তদ্ব্যক্ষরত্তদাদিত্যমভিতোহশ্রয়ত্তদ্বা এতদ্যদেতদাদিত্যস্য রোহিতং রূপম ॥ ৪
অন্বয় : তৎ (যশ আদি) ব্যক্ষরৎ (বিশেষরূপে রক্ষিত হইল); তৎ (তাহা) আদিত্যম্ অভিতঃ (আদিত্যের অভিমুখে) অশ্রয়ৎ (আশ্রয় করিল)। তৎ (তাহা) বৈ এতৎ (এই), যৎ (যাহা) এতৎ আদিত্যস্য (আদিত্যের) রোহিতম্ রূপম (লোহিত বর্ণ)।
সরলার্থ : ঐসব রস ক্ষরিত হইয়া আদিত্যের দিকে গিয়া আশ্রয় নিল। এইজন্যই আদিত্যের বর্ণ লোহিত।
দ্বিতীয় খণ্ড – মধুবিদ্যা—আদিত্যাদিতে মধ্বাদি কল্পনা (২)
১৯১. অথ যেহস্য দক্ষিণা রায়স্তা এবাস্য দক্ষিণা মধুনাড্যো যংয্যে মধুকৃতো যজুর্বেদ এব পুষ্পং তা অমৃতা আপঃ ॥ ১
অন্বয় : অথ যে (যাহা) অস্য (ইহার, আদিত্যের) দক্ষিণাঃ রায়ঃ (দক্ষিণ দিকস্থিত রশ্মিসমূহ), তাঃ এব (সেই সমুদয়ই) অস্য (আদিত্যরূপ মধুচক্রের) দক্ষিণাঃ (দক্ষিণদিকের) মধুনাড্যঃ (মধুনাড়ীসমূহ); যজুংষি এব (যজুর্মন্ত্রসমূহই) মধুকৃতঃ (মধুকরসমূহ); যজুর্বেদঃ এব পুষ্পম্; তাঃ আপঃ (সেই যজ্ঞীয় জল) অমৃতাঃ (পুষ্পের অমৃত)।
সরলার্থ : আর সূর্যের দক্ষিণ দিকের রশ্মিসমূহ ইহার দক্ষিণ মধুনাড়ী; যজুর্মন্ত্র- গুলি ইহার মধুকর; যজুর্বেদই ইহার পুষ্প; সেইসব (যজ্ঞীয়) জলই (পুষ্পের) অমৃত।
১৯২. তানি বা এতানি যজুংষ্যেতং যজুর্বেদমভ্যতপংস্তস্যাভিতপ্তস্য যশস্তেজ ইন্দ্রিয়ং বীর্যমনাদ্যং রসোহজায়ত ॥ ২
অন্বয় : তানি বৈ এতানি (সেই এই সমুদয়) যভূষি (যজুর্মন্ত্রসমূহ) এতম্ যজুর্বেদম্ (এই যজুর্বেদকে) অভ্যতপন্ (অভিতপ্ত করিয়াছিল)। তস্য অভিতপ্তস্য (সেই অভিতপ্ত যজুর্বেদ হইতে) যশঃ তেজঃ ইন্দ্ৰিয়ম্ বীর্যম্ অন্নাদ্যম্ রসঃ অজায়ত (৩।১।৩ টীকা)।
সরলার্থ : সেই যজুর্মন্ত্রগুলি যজুর্বেদকে উত্তপ্ত করিয়াছিল। উত্তপ্ত যজুর্বেদ হইতে যশ, তেজ, ইন্দ্ৰিয়—সামর্থ্য, বীর্য ও অনুরূপ রস উৎপন্ন হইয়াছিল।
১৯৩. তদ্ব্যক্ষরত্তদাদিত্যমভিতোহশ্রয়ত্তদ্বা এতদ্যদেতদাদিতস্য শুক্লং রূপম্ ॥ ৩
অন্বয় : তৎ (যশ আদি) ব্যক্ষরৎ; তৎ আদিত্যম্ অভিতঃ অশ্রয়ৎ; তৎ বৈ এতৎ, তৎ এতৎ আদিতস্য শুক্লম্ রূপম্ (৩।১।৪ টীকা)।
সরলার্থ : সেই সব (যশ আদি) রস ক্ষরিত হইল। তাহা আদিত্যের অভিমুখে গিয়া আশ্রয় নিল। ইহাতেই আদিত্যের এই শুক্ল রূপ
তৃতীয় খণ্ড – মধুবিদ্যা—আদিত্যাদিতে মধ্বাদি কল্পনা (৩)
১৯৪. অথ যেহস্য প্রত্যঞ্চো রায়স্তা এবাস্য প্রতীচ্যো মধুনাড্যঃ সামান্যেব মধুকৃতঃ সামবেদ এব পুষ্পং তা অমৃতা আপঃ ॥ ১
অন্বয় : অথ যে অস্য প্রত্যঞ্চাঃ (পশ্চিমদিকস্থিত) রশ্ময় তাঃ এব অস্য প্রতীচ্যঃ মধুনাড্যঃ; সামানি এব (সামমন্ত্রসমূহই)) মধুকৃতঃ; সামবেদ এব পুষ্পম্; তাঃ অমৃতাঃ আপঃ (৩।২। ১ দ্রঃ)।
সরলার্থ : আর এই আদিত্যের পশ্চিমদিকের রশ্মিসমূহই ইহার পশ্চিম মধুনাড়ী, সাম মন্ত্রসমূহই মধুকর; সামবেদই পুষ্প; সেই সব যজ্ঞীয় জল পুষ্পের মধু
১৯৫. তানি বা এতানি সামান্যেতং সামবেদমভ্যতপংস্তস্যাভিতপ্তস্য যশস্তেজ ইন্দ্রিয়ং বীর্যমনাদ্যং রসোহজায়ত ॥ ২
অন্বয় : তানি বৈ এতানি সামানি এতম্ সামবেদম্ (এই সামবেদকে) অভ্যতপন্; তস্য অভিতপ্তস্য যশঃ তেজঃ ইন্দ্ৰিয়ম্ বীর্যম্ অন্নাদ্যম্ রসঃ অজায়ত (৩। ১।৩ দ্রঃ)।
সরলার্থ : সেই সামমন্ত্রগুলি সামবেদকে উত্তপ্ত করিয়াছিল; উত্তপ্ত সামবেদ হইতে যশ, তেজ, ইন্দ্ৰিয়-সামর্থ্য, বীর্য ও অনুরূপ রস উৎপন্ন হইয়াছিল।
১৯৬. তদ্ব্যক্ষরত্তদাদিত্যমভিত্যেহশ্রয়ত্তদ্বা এতদ্যদেতদাদিত্যস্য কৃষ্ণং রূপম্ ॥ ৩
অন্বয় : তৎ ব্যক্ষরৎ। তৎ আদিত্যম্ অভিতঃ অশ্রয়ৎ। তৎ বৈ এতৎ যৎ এতৎ আদিত্যস্য কৃষ্ণম্ রূপম্ (৩।১।৪ টীকা দ্রঃ)।
সরলার্থ : সেই সমস্ত (যশ আদি) রস ক্ষরিত হইল; তাহার পর তাহা আদিত্যের অভিমুখে গিয়ে আশ্রয় নিল। ইহাতেই আদিত্যের কৃষ্ণবর্ণ রূপ।
চতুর্থ খণ্ড – মধুবিদ্যা—আদিত্যাদিতে মধ্বাদি কল্পনা (৪)
১৯৭. অথ যেহস্যোদঞ্চো রশ্ময়স্তা এবাস্যোদীচ্যো মধুনাড্যোহথর্বাঙ্গিরস এব মধুকৃত ইতিহাসপুরাণং পুষ্পং তা অমৃতা আপঃ ॥ ১
অন্বয় : অথ যে অস্য উদঞ্চঃ রায়ঃ (উত্তরদিকস্থ রশ্মিসমূহ), তাঃ এব অস্য উদীচ্যঃ মধুনাড্যঃ; অথর্বাঙ্গিরসঃ (অথবা ও অঙ্গিরা নামক ঋষিগণ কর্তৃক দৃষ্ট মন্ত্রসমূহ) এব মধুকৃতঃ; ইতিহাসপুরাণম্ (ইতিহাস ও পুরাণ) পুষ্পম্; তাঃ অমৃতাঃ আপঃ (৩।২।১ টীকা)।
সরলার্থ : তাহার পর আদিত্যের উত্তরদিকের যে রশ্মিসমূহ, তাহারাই ইহার উত্তর মধুনাড়ী; অথর্বাঙ্গিরস মন্ত্রসমূহই মধুকর; ইতিহাস ও পুরাণই পুষ্প; সেই যজ্ঞীয় জলই পুষ্পের অমৃত
মন্তব্য : অথবা একজন ঋষি; ঋগ্বেদে বহুস্থলে ইঁহার বিষয় উল্লিখিত হইয়াছে। ইনিই প্রথমে অরণিকাষ্ঠ হইতে অগ্নি উৎপন্ন করিয়া যজ্ঞ সম্পন্ন করেন (৬। ১৫। ১৭; ৬।১৬।১৩ ইত্যাদি)। অঙ্গিরার নামও ঋগ্বেদে বহুস্থলে পাওয়া যায়। কথিত আছে অঙ্গিরাই প্রথমে যজ্ঞ প্রবর্তন করেন (১০।৬৭।২; ১।৮৩।৪ ইত্যাদি)। অগ্নি যে কাষ্ঠে লুক্কায়িত থাকে অঙ্গিরা ইহা আবিষ্কার করিয়াছিলেন (৫।১১।৬)। অথবা ও অঙ্গিরা এই উভয় ঋষির কার্যই প্রায় এক প্রকার। এ জন্যই বোধ হয় উভয়ের নামে এক শব্দ হইয়াছে। অথবা ও অঙ্গিরা যে সব মন্ত্রের দ্রষ্টা, তাহাদের নাম ‘অথর্বাঙ্গিরস’। ব্রাহ্মণ (তৈঃ ব্রাঃ ১২।৮।২; শঃ ব্রাঃ ১১।৫।৬।৭); আরণ্যক (তৈঃ আঃ ২।৯,১০); উপনিষদাদি গ্রন্থে (বৃঃ উঃ ২।৪।১০, ৪।১।২ ইত্যাদি, তৈঃ উঃ ২।৩।১) ইহার উল্লেখ আছে। উত্তরকালে ইহাই অথর্ববেদ নামে পরিচিত হইয়াছে। ৭।১।২ মন্ত্রের অংশে আথবর্ণ শব্দের মন্তব্য দ্রষ্টব্য।
১৯৮. তে বা এতেহথর্বাঙ্গিরস এতদিতিহাসপুরাণমভ্যতপংস্তস্যাভিতপ্তস্য যশস্তেজ ইন্দ্রিয়ং বীর্যমন্নাদ্যং রসোঽজায়ত ॥ ২
অন্বয় : তে বৈ এতে অথর্বাঙ্গিরস এতৎ ইতিহাসপুরাণম্ (এই ইতিহাসপুরাণকে অভ্যতপন্। তস্য অভিতপ্তস্য যশঃ তেজঃ ইন্দ্রিয়ম্ বীর্যম্ অন্নাদ্যম্ রস অজায়ত (৩।১।৩ টীঃ)।
সরলার্থ : সেই অথর্বাঙ্গিরস মন্ত্রসমূহ ইতিহাস-পুরাণকে উত্তপ্ত করিয়াছিল। অভিতপ্ত সেই ইতিহাস-পুরাণ হইতে যশ, তেজ, ইন্দ্রিয়সামর্থ্য, বীর্য ও অনুরূপ রস উৎপন্ন হইয়াছিল।
১৯৯. তদ্ব্যক্ষরত্তদাদিত্যমভিতোহশ্রয়ত্তদ্বা এতদ্যদেতদাদিত্যস্য পরং কৃষ্ণং রূপম্ ॥ ৩
অন্বয় : তৎ ব্যক্ষরৎ; তৎ আদিত্যম্ অভিতঃ অশ্রয়ৎ। তৎ বৈ এতৎ, যৎ এতৎ আদিত্যস্য পরম্ (গভীর) কৃষ্ণম্ রূপম্ (৩।১।৪ টীঃ)।
সরলার্থ : যশ আদি রস ক্ষরিত হইল। তাহার পর তাহা আদিত্যের অভিমুখে গিয়া আশ্রয় নিল। আদিত্যের যে গভীর কৃষ্ণরূপ, তাহা ইহাই।
পঞ্চম খণ্ড – মধুবিদ্যা—আদিত্যাদিতে মধ্বাদি কল্পনা (৫)
২০০. অথ যেহস্যোা রশ্ময়স্তা এবাস্যোর্ধ্বা মধুনাড্যো গুহ্যা এবাদেশা মধুকৃতো ব্রহ্মৈব পুষ্পং তা অমৃতা আপঃ ॥ ১
অন্বয় : অথ যে অস্য ঊর্ধ্বাঃ রশ্ময়ঃ, তাঃ এব অস্য ঊর্ধ্বাঃ মধুনাড্যঃ; গুহ্যাঃ এব আদেশাঃ (গুহ্য উপদেশসমূহই) মধুকৃতঃ; ব্রহ্ম (প্রণবশঙ্করের মতে) এব পুষ্পম্; তাঃ অমৃতাঃ আপঃ (৩।২।১ টীকা)।
সরলার্থ : তাহার পর আদিত্যের ঊর্ধ্বদিকের যে সকল রশ্মি, সেই সবই ইহার ঊর্ধ্ব মধুনাড়ী; গুহ্য উপদেশসমূহ মধুকর; ব্রহ্মই (অর্থাৎ প্রণবই) পুষ্প; সেই যজ্ঞীয় জলই (পুষ্পের) অমৃত
২০১. তে বা এতে গুহ্যা আদেশা এতদ্ ব্ৰহ্মাভ্যতপংস্তস্যাভিতপ্তস্য যশস্তেজ ইন্দ্রিয়ং বীর্যমনাদ্যং রসোহজায়ত ॥ ২
অন্বয় : তে বৈ এতে গুহ্যা আদেশাঃ এতৎ ব্রহ্ম (এই প্রণবকে) অভ্যতপন্; তস্য অভিতপ্তস্য যশঃ তেজঃ ইন্দ্রিয়ম্ বীর্যম্ অনাদ্যম্ রসঃ অজায়ন্ত (৩।১।৩)।
সরলার্থ : সেই গুহ্য উপদেশসমূহ এই প্রণবকে উত্তপ্ত করিয়াছিল। সেই উত্তপ্ত প্রণব হইতে যশ, তেজ, ইন্দ্রিয়-সামর্থ্য ও অনুরূপ রস উৎপন্ন হইল।
২০২. তদ্ব্যক্ষরত্তদাদিত্যমভিতোহশ্রয়ত্তদ্বা এতদ্যদেতদাদিত্যস্য মধ্যে ক্ষোভত ইব। ৩
অন্বয় : তৎ ব্যক্ষরৎ; তৎ আদিত্যম্ অভিতঃ অশ্রয়ৎ। তৎ বৈ এতৎ, যৎ এতৎ আদিত্যস্য মধ্যে ক্ষোভতে ইব (যেন স্পন্দিত হইতেছে) (৩।১।৪ টীকা)।
সরলার্থ : যশ আদি রস ক্ষরিত হইল এবং তাহা আদিত্যের অভিমুখে আশ্রয় নিল। আদিত্যের মধ্যে যাহা স্পন্দিত হইতেছে বলিয়া মনে হয়, তাহা ইহাই।
২০৩. তে বা এতে রসানাং রসা বেদা হি রসাস্তেষামেতে রসাস্তানি বা এতান্যমৃতানামমৃতানি বেদা হ্যমৃতাস্তেষামেতান্যমৃতানি ॥ ৪
অন্বয় : তে (সেই সমুদয় অর্থাৎ সূর্যের লোহিতাদি রূপ) বৈ এতে (এই সমুদয় রসানাম্ (রসসমূহের) রসাঃ (রসসমূহ), বেদাঃ (বেদসমূহ) হি রসাঃ; তেষাম্ (তাহাদিগের) এতে রসাঃ; তানি বৈ এতানি (সেই এই সমুদয়, লোহিতাদি রূপসমূহ) অমৃতানাম্ (অমৃতসমূহের) অমৃতানি (অমৃতসমূহ)। বেদাঃ হি অমৃতাঃ, তেষাম্ এতানি অমৃতানি।
সরলার্থ : সূর্যের সেই লোহিতাদি রূপসমূহ রসেরও রস (অর্থাৎ সারবস্তুরও সার)। কারণ বেদসমুদয়ই রস (সারবস্তু) আর সেই সব রূপ তাহাদেরও রস। লোহিতাদি রূপ অমৃতেরও অমৃত, কারণ বেদসমূহই অমৃত, আর এইসব রূপ বেদসমূহেরও অমৃত।
ষষ্ঠ খণ্ড – মধুবিদ্যা—প্রথমামৃত বসুগণের ভোগ্য
২০৪. তদ্ যৎ প্রথমমমৃতং তদ্বসব উপজীবন্ত্যগ্নিনা মুখেন না বৈ দেবা অশন্তি ন পিবন্ত্যেতদেবামৃতং দৃষ্ট্বা তৃপ্যন্তি ॥ ১
অন্বয় : তৎ (সেই) যৎ যে প্রথমম্ অমৃতম্ (প্রথম অমৃত অর্থাৎ আদিত্যের লোহিতরূপ) তৎ (তাহাকে) বসবঃ (বসুগণ) উপজীবন্তি (উপভোগ করেন) অগ্নিনা মুখেন (অগ্নি প্রমুখ হইয়া); ন (না) বৈ দেবাঃ (দেবগণ) অশন্ত (ভোজন করেন), না পিবন্তি (পান করেন); এতৎ এব অমৃতম্ (এই অমৃতকে) দৃষ্ট্বা (দেখিয়া) তৃপ্যন্তি (তৃপ্তি লাভ করেন)।
সরলার্থ : সেই যে প্রথম অমৃত অর্থাৎ সূর্যের লোহিত রূপ বসুগণ অগ্নির মুখ দিয়া তাহা উপভোগ করেন। কিন্তু বস্তুত দেবগণ ভোজনও করেন না, পানও করেন না; এই অমৃত দেখিয়াই তাঁহারা তৃপ্ত হন।
মন্তব্য : ‘বসবঃ’ ইত্যাদি— অনেক দেবতা আছেন যাঁহারা পৃথক পৃথক্ ভাবে উক্ত হন না; ইঁহারা সমষ্টিভাবে পরিচিত। এই শ্রেণীর দেবতার নাম ‘গণদেবতা’। বসু, রুদ্র, আদিত্য ইত্যাদিরা এই শ্রেণীর অন্তর্গত। ‘বসু’র অনেক অর্থ হইতে পারে, যেমন— যিনি উজ্জ্বল, যিনি ধনদান করেন, যিনি আচ্ছাদন বা আশ্রয় প্রদান করেন ইত্যাদি। ঋগ্বেদে আদিত্য, মরুৎ, অশ্বিদ্বয়, ইন্দ্র, ঊষা, রুদ্র, বায়ু, বিষ্ণু প্রভৃতি দেবতাদিগকে বসু বলা হইয়াছে। মহাভারতাদি গ্রন্থে শিব ও কুবেরও বসু নামে খ্যাত। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, শতপথ ব্রাহ্মণ, বৃহদারণ্যক উপনিষৎ প্রভৃতি গ্রন্থের মতে বসুগণের সংখ্যা আট। বিষ্ণুপুরাণে অষ্টবসুর নাম এই—আপ, ধ্রুব, সোম, ধব বা ধর, অনিল, অনল বা পাবক, প্রত্যুষ এবং প্রভাস। ব্রাহ্মণাদি গ্রন্থের মতে বসুগণ পৃথিবীর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। ঋগ্বেদের মতে ইন্দ্র বসুগণের নেতা (৭।৩৫।৬; ৭।১০।৪)। কিন্তু পরবর্তী কালে অগ্নিকেই ইঁহাদিগের নেতা বলা হইয়াছে : ‘অগ্নিনা এব মুখেন’ ইত্যাদি। অগ্নি বসুগণের নেতা, সেইজন্য বলা হইয়াছে ‘অগ্নিনা এক মুখেন’।
২০৫. ত এতদেব রূপমভিসংবিশন্ত্যেতস্মাদ্রপাদদ্যন্তি ॥ ২
অন্বয় : তে (সেই দেবগণ) এতৎ এব রূপম্ (এই রূপকেই অর্থাৎ এই রূপেই অভিসংবিশন্তি (প্রবেশ করেন); এতস্মাৎ রূপাৎ (এই রূপ হইতে) উদ্যন্তি (উদিত হন, বহির্গত হন)।
সরলার্থ : সেই দেবগণ (সূর্যের) এই লোহিত রূপে প্রবেশ করেন এবং সেই রূপ হইতেই উত্থিত হন
মন্তব্য : ‘অভিসংবিশন্তি’ ও ‘উদ্যন্তি’ ইত্যাদি—শঙ্কর এই অংশের এইরূপ অর্থ করিয়াছেন : রূপম্ অভিরূপকে লক্ষ্য করিয়া। অভিসংবিশন্তি—উদাসীন হন। রূপাৎ রূপ অর্থাৎ অমৃত ভোগ করিবার জন্য। উদ্যন্তি—উৎসাহশীল হন। তাহা হইল এই অংশের অর্থ এইরূপ হইবে দেবগণ এই রূপকে লক্ষ্য করিয়া (রূপম্ অভি) উদাসীন থাকেন (সংবিশন্তি) এবং এই রূপকে ভোগ করিবার জন্য (এতস্মাৎ রূপাৎ) উৎসাহশীল হন (উদ্যন্তি)। শঙ্কর এস্থলে এইরূপ বিচার করিয়াছেন—তাঁহারা কি নিরুদ্যম হইয়া অমৃত ভোগ করেন? না, তাহা নহে। তবে কি প্রকারে? এই লোহিত রূপকে লক্ষ্য করিয়া তাঁহারা এইরূপ মনে করেন, ‘আমাদের এখন ভোগের অবসর নাই’; তখন তাঁহারা উদাসীন হইয়া থাকেন। আবার তাঁহাদের যখন অমৃত ভোগের সময় উপস্থিত হয়, তখন তাঁহারা উৎসাহবান হন। কেহ কেহ ইহার অন্যপ্রকার অর্থও করিয়াছেন (১) তাঁহারা এই রূপে লীন হয় এবং এই রূপ হইতেই পুনরায় উত্থিত হন। (২) (এই রূপ ভোগ করিবার জন্য) তাঁহারা এই রূপে প্রবেশ করেন এবং (রূপ ভোগ করিয়া) এই রূপ হইতে বহির্গত হন।
২০৬. স য এতদেবমমৃতং বেদ বসুনামেবৈকো ভূত্বাগ্নিনৈব মুখেনৈতদেবামৃতং দৃষ্ট্বা তৃপ্যতি স এতদেব রূপমভিসংবিশত্যেতস্মাদৃরূপাদুদেতি ॥ ৩
অন্বয় : সঃ যঃ (যে, ২।১১।২ মন্তব্য) এতৎ [অমৃতম্] (এই অমৃতকে) এবম্ (এই প্রকারে) অমৃতম্ বেদ (জানেন) বসুনাম্ (বসুগণের মধ্যে) এব একঃ ভূত্বা (হইয়া) অগ্নিনা এব মুখেন (১ম মন্ত্র) এতৎ এব অমৃতম্ দৃষ্ট্বা তৃপ্যতি; স এতৎ এব রূপম্ অভিসংবিশতি (প্রবেশ করে) এতস্মাৎ রূপাৎ উদেতি (উত্থিত হয়)।
সরলার্থ : যে ব্যক্তি এই অমৃতকে এইরূপ জানেন, তিনি বসুগণেরই একজন হন এবং অগ্নিপ্রমুখ হইয়া এই অমৃত দেখিয়াই তৃপ্তি লাভ করেন। তিনি এই রূপেই প্রবেশ করেন এবং এই রূপ হইতেই উত্থিত হন।
২০৭. স যাবদাদিত্যঃ পুরস্তাদুদেতা পশ্চাদস্তমেতা বসুনামেব তাবদাধিপতা স্বারাজ্যং পযের্তা ॥ ৪
অন্বয় : সঃ (সেই ব্যক্তি) যাবৎ (যে পর্যন্ত) আদিত্যঃ পুরস্তাৎ উদেতা (যিনি উদিত হন কিংবা উদিত হইবেন), পশ্চাৎ (পশ্চিম দিকে) অস্তম্ + এতা (অস্ত গমনকারী, কিংবা অস্তগমন করিবে), বসুনাম্ এব (বসুগণের তাবৎ (তাবৎকাল পর্যন্ত) আধিপত্যম্ (আধিপত্যকে) স্বারাজ্যম্ (স্বাধীনতাকে) পরি + এতা (যিনি প্রাপ্ত হন কিংবা প্রাপ্ত হইবেন)। [কেহ কেহ বলেন, স্বারাজ্যম্ = স্বর্গরাজ্য, স্বঃ + রাজ্যম্]।
সরলার্থ : যতকাল সূর্য পূর্বদিতে উদিত হইবে এবং পশ্চিম দিকে অস্ত যাইবে, ততকাল সেই ব্যক্তি বসুদিগের মত আধিপত্য ও স্বারাজ্য লাভ করিবেন।
মন্তব্য : ‘সঃ যাবৎ ইত্যাদি। আমরা দেখিতেছি, সূর্য পূর্বদিকে উদিত হইয়া পশ্চিম দিকে অস্ত যাইতেছে। যতদিন এই প্রকার ঘটিবে ততদিন বসুগণ রাজত্ব করিবেন। আর যাঁহারা সূর্যের প্রথম অমৃতের বিষয় জানেন, তাঁহারাও ততদিন বসুদিগের ন্যায় আধিপত্য ও স্বাধীনতা পাইবেন।
সপ্তম খণ্ড – মধুবিদ্যা—দ্বিতীয়ামৃত রুদ্রদেবগণের ভোগ্য
২০৮. তথ যদ্বিতীয়মমৃতং তদুদ্রা উপজীবন্তীন্দ্রেণ মুখেন ন বৈ দেবা অশান্তি ন পিবন্ত্যেতদেবামৃতং দৃষ্ট্বা তৃপ্যন্তি ॥ ১
অন্বয় : অথ যৎ দ্বিতীয়ম্ অমৃতম্ (দ্বিতীয় অমৃত অর্থাৎ শুরুরূপ), তৎ রুদ্রাঃ উপজীবন্তি ইন্দ্রেণ মুখেন (ইন্দ্ৰপ্ৰমুখ হইয়া) ন বৈ দেবাঃ অশ্নন্তি, ন পিবন্তি, এতৎ এব অমৃতম্ দৃষ্ট্বা তৃপ্যন্তি (৩।৬।১ টীকা)।
সরলার্থ : আর আদিত্যের যে দ্বিতীয় অমৃত অর্থাৎ শুরুরূপ তাহা রুদ্রগণ ইন্দ্রের মুখ দিয়া উপভোগ করেন। কিন্তু বস্তুত দেবগণ আহারও করেন না, পানও করেন না; এই অমৃত দেখিয়াই তাঁহারা তৃপ্ত হন।
মন্তব্য : রুদ্রদেবও গণদেবতা; ইহাদিগের পিতার নাম রুদ্র। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ (২।১৮), শতপথ ব্রাহ্মণ (৪।৫।৭।২, ১১।৬।৩।৫) প্রভৃতি গ্রন্থের মতে রুদ্রগণের সংখ্যা ১১, কিন্তু তৈত্তিরীয় সংহিতাতে ৩৩ জন রুদ্রের উল্লেখ আছে (১।৪।১১।১)। মরুৎগণকেও কখন কখন ‘রুদ্রাঃ’ বলা হয় (ঋঃ ১।৩৯।৪, ৭ ইত্যাদি)। কিন্তু সাধারণত রুদ্রগণ ও মরুৎগণ পৃথক পৃথক দেবতা। ইন্দ্র রুদ্রগণের নেতা।
২০৯. ত এতদেব রূপমভিসংবিশস্ত্যেতস্মাদ্রপাদদ্যন্তি ॥ ২
অন্বয় : তে এতৎ এব রূপম্ অভিসংবিশন্তি, এতস্মাৎ রূপাৎ উদ্যন্তি (৩।৬।২)।
সরলার্থ : দেবগণ সূর্যের এই শুরুরূপে প্রবেশ করেন এবং এই রূপ হইতে উত্থিত হন।
২১০. স য এতদেবমমৃতং বেদ রুদ্রাণামেবৈকো ভূত্বেন্দ্রেণৈব মুখেনৈতদেবামৃতং দৃষ্ট্বা তৃপ্যতি স এতদেব রূপমভিসংবিশত্যেতস্মাদ্রপাদুদেতি ॥ ৩
অন্বয় : সঃ যঃ এতত্ এবম্ অমৃতম্ বেদ’ রুদ্রাণাম্ এব (রুদ্রগণের মধ্যে) একঃ ভূত্বা ইন্দ্রেণ এর মুখেন এতৎ এর অমৃতম্ দৃষ্ট্বা তৃপ্যতি; সঃ এতৎ এব রূপম্ অভিসংবিশতি, এতস্মাৎ রূপাৎ উদেতি। (৩।৬।৩ টীকা)।
সরলার্থ : যিনি এই অমৃতকে এইরকম জানেন, তিনি রুদ্রগণের একজন হন এবং ইন্দ্ৰপ্ৰমুখ হইয়া এই অমৃত দেখিয়াই তৃপ্ত হন। তিনি এই রূপেই প্রবেশ করেন এবং এই রূপ হইতে বাহির হন
২১১. স যাবদাদিত্যঃ পুরস্তাদুদেতা পশ্চাদস্তমেতা দ্বিস্তাবদ্দক্ষিণত উদেতোত্তরতোহস্তমেতা রুদ্রাণামেব তাবদাধিপত্যং স্বারাজ্যং পৰ্যেতা ॥ ৪
অন্বয় : সঃ যাবৎ আদিত্যঃ পুরস্তাৎ উদেতা, পশ্চাৎ অস্তমেতা, দ্বিস্ + তাবৎ (দ্বিগুণ) দক্ষিণতঃ (দক্ষিণ দিকে) উদেতা, উত্তরতঃ (উত্তরদিকে) অস্তমেতা; রুদ্রাণাম্ এব তাবৎ আধিপত্যম্ স্বারাজ্যম্ পর্যেতা (৩।৬।৪ টীকা)।
সরলার্থ : যতকাল সূর্য পূর্বদিকে উদিত হইবেন এবং পশ্চিমদিকে অস্ত যাইবেন, তাহার দ্বিগুণ কাল দক্ষিণদিকে উদিত হইবেন ও উত্তরে অস্ত যাইবেন। সেই বিদ্বান ব্যক্তি ততদিন (অর্থাৎ সেই দ্বিগুণ পরিমিত কাল) রুদ্রগণের মত আধিপত্য এবং স্বারাজ্য লাভ করিবেন।
মন্তব্য : ‘দ্বিস্তাবৎ’ ইত্যাদি— যে বেদির পরিমাণ সাধারণ বেদির দ্বিগুণ তাহাই দ্বিস্তাবা বেদি। ‘সূর্য দক্ষিণ দিকে উদিত হইবেন’ ইত্যাদি বিষয়ে মন্তব্য ৩।১১ অংশের পরে দ্রষ্টব্য।
অষ্টম খণ্ড – মধুবিদ্যা—তৃতীয়ামৃত আদিত্য দেবগণের ভোগ্য
২১২. অথ যস্তৃতীয়মমৃতং তদাদিত্যা উপজীবন্তি বরুণেন মুখেন ন বৈ দেবা অশান্তি না পিবন্ত্যেতদেবামৃতং দৃষ্ট্বা তৃপ্যন্তি ॥ ১
অন্বয় : অথ যৎ তৃতীয়ম্ অমৃতম্ (অর্থাৎ কৃষ্ণরূপ) তৎ আদিত্যাঃ (আদিত্যগণ উপজীবন্তি বরুণের মুখেন (বরুণপ্রমুখ হইয়া)। ন বৈ দেবাঃ অশ্নন্তি. ন পিবন্তি— এতৎ এব অমৃতম্ দৃষ্ট্বা তপ্যন্তি (৩।৬।১ টীকা)।
সরলার্থ : আর সূর্যের যে তৃতীয় অমৃত অর্থাৎ কৃষ্ণবর্ণরূপ, আদিত্যগণ বরুণপ্রমুখ হইয়া তাহা উপভোগ করেন; (কিন্তু বস্তুত) দেবতারা ভোজনও করেন না পানও করেন না, তাঁহারা এই অমৃত দেখিয়াই তৃপ্ত হন।
মন্তব্য : আদিত্যগণও এক শ্রেণীর গণদেবতা। আদিত্যগণ অদিতির পুত্র। ঋগ্বেদের এক জায়গায় (২।২৭।১) মিত্র, অর্যমা, ভগ, বরুণ, দক্ষ এবং অংশ—এই ছয়জনকে অদিতির পুত্র বলা হইয়াছে। অন্য জায়গায় সপ্ত আদিত্যের কথা বলা হইয়াছে। (৯।১১৪।৩)। দশম মণ্ডলে এক জায়গায় (৭২।৮,৯) আছে যে অদিতির দেহ হইতে আট পুত্র উৎপন্ন হইয়াছিল; অষ্টম পুত্রের নাম মার্তণ্ড। অথর্ববেদের মতে অদিতির আট পুত্র (৮।৯।২১)। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণেও (১।১।৯।১) অদিতির আট পুত্রের কথা আছে; তাহাদের নাম—মিত্র, বরুণ, ধাতা, অর্যমা, অংশ, ভগ, ইন্দ্র এবং বিবস্বান্। সায়ণ ঋভাষ্যে এই ছয়জনের নামই উদ্ধৃত করিয়াছেন। শতপথ ব্ৰাহ্মণে দুই জায়গায় (৬।১।২।৮, ১১।৬।৩।৮) বলা হইয়াছে যে, আদিত্যের সংখ্যা বার। ঐতরেয় ব্রাহ্মণের মতেও (১।২।৪) দ্বাদশ আদিত্য। সংহিতা যুগের পরে দ্বাদশ আদিত্যকে দ্বাদশ মাসের অধিপতিরূপে গ্রহণ করা হইয়াছে।
২১৩. ত এতদেব রূপমভিসংবিশন্ত্যেত মাদ্রপাদদ্যন্তি ॥ ২
অন্বয় : তে এতৎ এব রূপম্ অভিসংবিশন্তি, এতস্মাৎ রূপাৎ উদ্যন্তি (৩।৬।৩ টীকা)।
সরলার্থ : আদিত্যগণ এই রূপেই প্রবেশ করেন এবং এই রূপ হইতেই বাহির হন। ২১৪. স য এতদেবমমৃতং বেদাদিত্যানামেবৈকো ভূত্বা বরুণেনৈব মুখেনৈত
দেবামৃতং দৃষ্ট্বা তৃপ্যতি স এতদেব রূপমভিসংবিশত্যেতমা – পাদুদেতি ॥ ৩
অন্বয় : সঃ যঃ এতৎ এবম্ অমৃতম্ বেদ, আদিত্যানাম্ (আদিত্যগণের) এব একঃ ভূত্বা বরুণেন এব মুখের এতৎ এব অমৃতম্ দৃষ্ট্বা তৃপ্যতি। সঃ এতৎ এব রূপম্ অভিসংবিশতি, এতস্মাৎ রূপাৎ উদেতি (৩।৬।৩ টীকা)।
সরলার্থ : যিনি এই অমৃতকে এই রকম জানেন, তিনি আদিত্যগণের একজন হন এবং বরুণপ্রমুখ হইয়া এই অমৃত দেখিয়াই তৃপ্ত হন। তিনি এই রূপে প্রবেশ করেন এবং এই রূপে হইতেই বাহির হন।
২১৫. স যাবদাদিত্যো দক্ষিণত উদেতোত্তরতোহস্তমেতা দ্বিস্তাবৎ পশ্চাৎ উদেতা পুরস্তাদস্তমেতাদিত্যানামেব তাবদাধিপত্যং স্বারাজ্যং পর্যেতা ॥৪
অন্বয় : সঃ যাবৎ আদিত্যঃ দক্ষিণতঃ উদেতা, উত্তরতঃ অস্তমেতা, দ্বিস্ + তাবৎ পশ্চাৎ উদেতা, পুরস্তাৎ অস্তমেতা। আদিত্যানাম্ এব তাবৎ আধিপত্যম্ স্বারাজ্যম্ পর্যেতা (৩।৬।৪ টীকা)। [‘সূর্য পশ্চিমদিকে উদিত হইবেন’ ইত্যাদি বিষয়ে মন্তব্য ৩।১১ অংশের পরে দ্রষ্টব্য]।
সরলার্থ : যতকাল আদিত্য দক্ষিণদিকে উদিত হইবেন এবং উত্তর দিকে অস্ত যাইবেন তাহার দ্বিগুণকাল পশ্চিমদিকে উদিত হইবেন ও পূর্বদিকে অস্ত যাইবেন। সেই বিদ্বান ব্যক্তি ততদিন (অর্থাৎ সেই দ্বিগুণ পরিমিতকাল) আদিত্যগণের মতই আধিপত্য ও স্বারাজ্য লাভ করিবেন।
নবম খণ্ড – মধুবিদ্যা—চতুর্থামৃত মরুৎদেবগণের ভোগ্য
২১৬. অথ যচ্চতুর্থমমৃতং তন্মরুত উপজীবন্তি সোমেন মুখেন ন বৈ দেবা অশন্তি ন পিবন্ত্যেতদেবামৃতং দৃষ্ট্বা তৃপ্যন্তি ॥ ১
অন্বয় : অথ যৎ চতুর্থম্ অমৃতম্ তৎ মরুতঃ (মরুৎগণ) উপজীবন্তি সোমেন মুখেন (সোমপ্রমুখ হইয়া)। ন বৈ দেবা অশন্তি, ন পিবন্তি এতৎ এব অমৃতম্ দৃষ্ট্বা তৃপ্যন্তি (৩।৬।১ টীকা)।
সরলার্থ : আর সূর্যের যে চতুর্থ অমৃত (অর্থাৎ অতিকৃষ্ণ রূপ), তাহা মরুৎগণ সোমপ্রমুখ হইয়া উপভোগ করেন। (কিন্তু বস্তুত) দেবতারা ভোজনও করেন না, পানও করেন না; তাঁহারা ইহা দেখিয়াই তৃপ্ত হন।
মন্তব্য : মরুৎগণও গণদেবতা। রুদ্র ইহাদিগের পিতা। ঋগ্বেদে কোন কোন স্থানে ইহাদিগকে রুদ্রিয়ানঃ (১।৩৮।৭ ইত্যাদি) এবং কোন কোন স্থানে (১।৩৯।৪,৭ ইত্যাদি) রুদ্রাণঃ বলা হইয়াছে। কোন কোন স্থানে বলা হইয়াছে ইহাদিগের সংখ্যা ‘ত্রিসপ্ত’ অর্থাৎ ৩ × ৭ ২১ (ঋক্ ১।১৩৩।৬; অথর্ব ১৩।১।১৩) এবং কোথাও বা বলা হইয়াছে ত্রিষষ্টি অর্থাৎ ৩ × ৬০ = ১৮০।
২১৭. ত এতদেব রূপমভিসংবিশন্ত্যেত মাদ্রপাদদ্যন্তি ॥ ২
অন্বয় : তে এতৎ এব রূপম্ অভিসংবিংশন্তি, এতস্মাৎ রূপাৎ উদ্যন্তি (৩।৬।২)। সরলার্থ : মরুগণ এই চতুর্থ রূপে প্রবেশ করিয়া এই রূপ হইতেই বাহির হন। ২১৮. স য এতদেবমমৃতং বেদ মরুতামেবৈকো ভূত্বা সোমেনৈব মুখেনৈতদেবামৃতং দৃষ্ট্বা তৃপ্যতি স এতদেব রূপমভিসংবিশত্যে- তস্মাদ্ৰুপাদুদেতি ॥ ৩
অন্বয় : সঃ যঃ এতৎ এবম্ অমৃতম্ বেদ, মরুতাম্ (মরুৎগণের) এব একঃ ভূত্বা সোমেন এব মুখেন এতৎ এব অমৃতম দৃষ্ট্বা তৃপ্যতি; সঃ এতৎ এব রূপম্ অভিসংবিশতি, এতস্মাৎ রূপাৎ উদেতি (৩।৬।৩ টীকা)।
সরলার্থ : যিনি এই রকম জানেন তিনি মরুৎগণের একজন হন এবং সোমপ্রমুখ হইয়া এই অমৃত দেখিয়াই তৃপ্ত হন। তিনি এই রূপের মধ্যে প্রবেশ করেন এবং এই রূপ হইতে বাহির হন।
২১৯. স যাবদাদিত্যঃ পশ্চাদুদেতা পুরস্তাদস্তমেতা দ্বিস্তাবদুত্তরত উদেতা দক্ষিণতোহস্তমেতা মরুতামেব তাবদাধিপত্যং স্বারাজ্যং পর্যেতা ॥ ৪
অন্বয় : সঃ যাবৎ আদিত্যঃ পশ্চাৎ উদেতা, পুরস্তাৎ অস্তমেতা, দ্বিঃ + তাবৎ উত্তরতঃ উদেতা, দক্ষিণতঃ অস্তমেতা; মরুতাম্ এব তাবৎ আধিপত্যম্ স্বারাজ্যম্ পর্যেতা (৩।৬।৪ টীকা)। [‘সূর্য উত্তরদিকে উদিত হইবেন’ ইত্যাদি বিষয়ে মন্তব্য ৩।১১ অংশের পরে দ্রষ্টব্য]
সরলার্থ : যে পরিমাণ কাল সূর্য পশ্চিম দিকে উদিত হইবেন ও পূর্বদিকে অস্ত যাইবেন, তাহার দ্বিগুণ কাল উত্তরদিকে উদিত হইবেন ও দক্ষিণদিকে অস্ত যাইবেন। ততকাল সেই বিদ্বান ব্যক্তি মরুৎগণের মত আধিপত্য ও স্বারাজ্য লাভ করিবেন।
দশম খণ্ড – মধুবিদ্যা—পঞ্চমামৃত সাধ্যদেবগণের ভোগ্য
২২০. অথ যৎ পঞ্চমমমৃতং তৎ সাধ্যা উপজীবন্তি ব্রহ্মণা মুখেন ন বৈ দেবা অশন্তি ন পিবন্ত্যেতদেবামৃতং দৃষ্ট্বা তৃপ্যন্তি ॥ ১
অন্বয় : অথ যৎ পঞ্চমম্ অমৃতম্, তৎ সাধ্যাঃ (সাধ্যগণ) উপজীবন্তি বহ্মণা মুখেন (ব্রহ্মপ্রমুখ হইয়া)। ন বৈ দেবাঃ অশন্তি, ন পিবন্তি, এতৎ এবং অমৃতম্ দৃষ্ট্বা তৃপ্যন্তি (৩।৬।১ টীকা)।
সরলার্থ : আর সূর্যের যে পঞ্চম অমৃত (অর্থাৎ মধ্যবর্তী চঞ্চল রূপ), সাধ্যগণ ব্রহ্মের মুখ দিয়া তাহা উপভোগ করেন। তবে দেবতারা ভোজনও করেন না, পান করেন না। তাহারা এই অমৃত দেখিয়াই তৃপ্ত হন।
মন্তব্য : সাধ্যগণও গণদেবতা। ঋগ্বেদের ১০।৯০।১৬ মন্ত্রে ইহাদিগের উল্লেখ আছে। উহার ব্যখ্যায় যাস্ক সাধ্যদের ‘দুস্থানঃ দেবগণঃ’ বলিয়াছেন। ভুবলোকে ইহাদিগের বসতি। মনুর মতে ইহারা একশ্রেণীর সূক্ষ্ম দেবতা; বিরাটের পুত্র সোমসদ্গণ ইহাদের পিতা।
২২১. ত এতদেব রূপমভিসংবিশন্ত্যেত মাদ্রুপাদুদ্যন্তি ॥ ২
অন্বয় : তে এতৎ এব রূপম্ অভিসংবিশন্তি; এতস্মাৎ রূপাৎ উদ্যন্তি (৩।৬।২)। সরলার্থ : তাঁহারা (সাধ্যগণ) এই পঞ্চম রূপে প্রবেশ করেন এবং এই রূপে হইতে বাহির হন।
২২২. স য এতদেবমমৃতং বেদ সাধ্যানামেবৈকো ভূত্বা ব্ৰহ্মণৈব মুখেনৈতদেবামৃতং দৃষ্ট্বা তৃপ্যতি স এতদেব রুপম্ অভিসংবিশত্যেতস্মাদ্রুপাদুদেতি ॥ ৩
অন্বয় : সঃ যঃ এতৎ এবম্ অমৃতম্ বেদ, সাধ্যানাম্ (সাধ্যগণের মধ্যে) এর একঃ ভূত্বা ব্রহ্মণা এব মুখেন এতৎ এব অমৃতম্ বেদ, সাধ্যানাম্ (সাধ্যগণের মধ্যে) এব একঃ ভূত্বা ব্রহ্মণা এব মুখেন এতৎ এব অমৃতম্ দৃষ্ট্বা তৃপ্যতি; সঃ এতৎ এব রূপম্ অভিসংবিশতি, এতস্মাৎ রূপাৎ উদেতি (৩।৬।৩ টীকা)।
সরলার্থ : যিনি এই অমৃতকে এই রকম বলিয়া জানেন, তিনি সাধ্যগণের একজন হন এবং ব্রহ্মপ্রমুখ হইয়া এই অমৃত দেখিয়াই তৃপ্ত হন। তিনি এই রূপে প্রবেশ করেন এবং এই রূপ হইতে বাহির হন।
২২৩. স যাবদাদিত্য উত্তরত উদেতা দক্ষিণতোহস্তমেতা দ্বিস্তাবদূর্ধ্ব উদেতার্বাঙস্তমেতা সাধ্যানামেব তাবদাধিপত্যং স্বারাজ্যং পর্যেতা ॥ ৪
অন্বয় : সঃ যাবৎ আদিত্যঃ উত্তরতঃ উদেতা, দক্ষিণতঃ অস্তমেতা, দ্বি + তাবৎ ঊর্ধ্বম (ঊর্ধ্বদিকে) উদেতা, অর্বাঙ্ (অধোভাগে) অস্তমেতা; সাধ্যানাম্ এব তাবৎ আধিপত্যম্ স্বারাজ্যম্ পর্যেতা (৩।৬।৫ টীকা)। [‘সূর্য ঊর্ধ্বদিকে উদিত হইবেন’ ইত্যাদি বিষয়ে মন্তব্য ৩।১১ অংশের পরে দ্রষ্টব্য]।
সরলার্থ : যতকাল সূর্য উত্তর দিকে উদিত হইবেন এবং দক্ষিণ দিকে অস্ত যাইবেন, তাহারা দ্বিগুণকাল ঊর্ধ্বদিকে উদিত হইবেন এবং অধোদিকে অস্ত যাইবেন। ততকাল অর্থাৎ এই দ্বিগুণ পরিমিতকাল সেই বিদ্বান ব্যক্তি সাধ্যগণের মতই আধিপত্য ও স্বারাজ্য পাইবেন।
একাদশ খণ্ড – মধুবিদ্যার উপসংহার
২২৪. অথ তত ঊর্ধ্ব উদেত্য নৈবোদেতা নাস্তমেতৈকল এর মধ্যে স্থাতা তদেষ শ্লোকঃ ॥ ১
অন্বয় : অথ ততঃ (সেই স্থান হইতে) ঊর্ধ্বঃ (ঊর্ধ্বদিকে) উদেত্য (উদিত হইয়া, উত্থিত হইয়া) ন (না) এর উদেতা ন অস্তমেতা (৩।৬।৪ টীকা); একলঃ (একাকী) এব মধ্যে স্থাতা (স্থাতৃ, যিনি অবস্থান করেন বা করিবেন)। তৎ (সেই বিষয়ে) এষঃ (এই) শ্লোকঃ। [আনন্দগিরি বলেন ‘স্থাতা’ শব্দ ক্রম মুক্তিসূচক]।
সরলার্থ : তাহারা পর যখন সূর্য ঊর্ধ্বদিকে উদিত হইবেন তখন আর উদিতও হইবেন না বা অস্তও যাইবেন না; একাকীই মধ্যস্থলে থাকিবেন। এবিষয়ে এই শ্লোক আছে—
২২৫. ন বৈ তত্র ন নিম্নোচ নোদিয়ায় কদাচন।
দেবাস্তেনাহং সত্যেন মা বিরাধিষি ব্রহ্মণেতি ॥ ২
অন্বয় : ন বৈ (নিশ্চয়ই)। তত্র (সেই স্থলে) ন (না) নিম্নোচ (অস্ত গিয়াছে); ন উদিয়ায় (উদিত হইয়াছেন) কদাচন (কখন); দেবাঃ (হে দেবগণ) তেন [সত্যেন] (সেই সত্য বাক্য দ্বারা) অহম্ (আমি) সত্যেন মা (না) বিরাধিষি (বিচ্ছিন্ন হই) ব্রহ্মণা (ব্রহ্ম দ্বারা; এস্থলে ব্রহ্ম হইতে) ইতি।
সরলার্থ : সেই ব্রহ্মলোকে উদয়াস্ত নাই। সূর্য সেখানে অস্তও যান নাই, কখন উদিতও হন নাই। হে দেবগণ, এই সত্যের দ্বারা আমি যেন ব্রহ্মলাভে বঞ্চিত না হই অর্থাৎ এই সত্যের বলে আমি যেন ব্রহ্মলাভ করিতে পারি (কিংবা আমার কথা যদি সত্য না হয়, আমি যেন ব্রহ্মলাভে বঞ্চিত হই)।
২২৬. ন হ বা অমা উদেতি ন নিম্নোচতি সবৃদ্দিবা হৈবাস্মৈ ভবতি।
য এতামেবং ব্রহ্মোপনিষদং বেদ ॥ ৩
অন্বয় : ন (না) হ বৈ অস্মৈ (ইহার পক্ষে) উদেতি (উদিত হন) ন নিম্নোচতি (অস্ত যান), সকৃৎ (সর্বদা) দিবা হ এব অস্মৈ ভবতি (হয়), যা (যিনি) এতাম্ (এই) এবম্ (এই প্রকারে) বহ্মোপনিষদম্ (এই ব্রহ্মোপনিষদকে) বেদ (জানেন)।
সরলার্থ : যিনি এই ব্রহ্মোপনিষদকে এই রকম ভাবে জানেন, তাঁহার পক্ষে সূর্য উদতিও হন না, অস্তও যান না; তাঁহার কাছে সর্বদাই দিন।
২২৭. তদ্বৈত ব্রহ্মা প্রজাপতয় উবাচ প্রজাপতির্মনবে মনুঃ প্রজাভ্যস্ত-দ্বৈতদুদ্দালকায়ারুণয়ে জ্যেষ্ঠায় পুত্রায় পিতা ব্রহ্ম প্রোবাচ ॥ ৪
অন্বয় : তত্ হ এতৎ (সেই মধুবিজ্ঞানকে) ব্রহ্মা প্রজাপতয়ে (প্রজাপতিকে) উবাচ (বলিয়াছিলেন), প্রজাপতিঃ মনবে (মনুকে), মনুঃ প্রজাভ্যঃ (সন্তানদিগকে); তত্ হ এতৎ উদ্দালকায় আরুণয়ে (অরুণ-পুত্র উদ্দালককে) জ্যেষ্ঠায় পুত্রায় (জ্যেষ্ঠ পুত্রকে) পিতা ব্ৰহ্ম (ব্রহ্মবিদ্যাকে) প্র + উবাচ।
সরলার্থ : সর্বপ্রথমে ব্রহ্মা প্রজাপতিকে এই মধুবিজ্ঞান বলিয়াছিলেন; তারপর প্রজাপতি মনুকে, মনু নিজের সন্তানদের এবং পিতা বরুণ জ্যেষ্ঠপুত্র উদ্দালক আরুণিকে এই ব্ৰহ্মবিদ্যা বলিয়াছিলেন।
২২৮. ইদং বাব তজ্জ্যেষ্ঠায় পুত্রায় পিতা ব্রহ্ম প্ৰয়াৎ প্রণায্যায় বান্তেবাসিনে ॥ ৫
অন্বয় : ইদম্ বাব তৎ [ব্রহ্ম] (সেই ব্রহ্মবিদ্যাকে) জ্যেষ্ঠায় পুত্রায় (জ্যেষ্ঠপুত্রকে পিতা ব্রহ্ম প্রব্রুয়াৎ (বলিলেন) প্রণায্যায় (প্রণায্য’কে, প্রিয় ব্য উপযুক্ত ব্যক্তিকে) বা অন্তেবাসিনে (শিষ্যকে; যে শিষ্য গুরুর কাছে বাস করে তাহার নাম ‘অন্তেবাসী’)। [প্রাণায্য স্থলে ‘প্রণায্য’— বৈদিক প্রয়োগ।
সরলার্থ : এই ব্রহ্মবিদ্যা পিতা জ্যেষ্ঠপুত্রকে উপদেশ দিবেন অথবা গুরু প্রিয় শিষ্যকে বলিবেন।
২২৯. নান্যস্মৈ কস্মৈচন যদ্যপ্যমা ইমামদ্ভিঃ পরিগৃহীতাং ধনস্য পূর্ণাং দদ্যাদেতদেব ততো ভূয় ইত্যেতদেব ততো ভূয় ইতি ॥ ৬
অন্বয় : ন (না) অন্যস্মৈ কস্মৈচন (অন কাহাকেও), যদ্যপি অস্মৈ (ইঁহাকে) ইমাম্ (এই পৃথিবী) অদ্ভিঃ (জলদ্বারা) পরিগৃহীতাম্ (বেষ্টিতা) ধনস্য পূর্ণাম্ (ধনপূর্ণা দদ্যাৎ (দান করে); এতৎ (এই মধুবিদ্যা) এব ততঃ (ইহা অপেক্ষা) ভূয়ঃ (অধিক) ইতি— এতৎ এব ততঃ ভূষঃ ইতি (দ্বিরুক্তি সমাপ্তি-সূচক কিংবা গুরুত্ব-প্রকাশক)।
সরলার্থ : অন্য কাহাকেও এই বিদ্যা বলিবে না; যদি ইঁহাকে (অর্থাৎ গুরুকে) কেহ সমুদ্রবেষ্টিত ধনপূর্ণ পৃথিবীও দান করে তাহা হইলেও নয়। কারণ এই বিদ্যা সমস্ত কিছু হইতেই শ্রেষ্ঠ।
মন্তব্য : এই অধ্যায়ের ষষ্ঠ খণ্ড হইতে আরম্ভ করিয়া একাদশ খণ্ড পর্যন্ত সূর্যের নানাদিকে উদয়ের কথা বলা হইয়াছে, যথা :
সূর্য পূর্বদিকে উদিত হইবেন এবং পশ্চিমদিকে অস্ত যাইবেন—এই সময়ে বসুগণের আধিপত্য (৩।৬)। ঐ সময়ের দ্বিগুণ পরিমিতকাল সূর্য দক্ষিণ দিকে উদিত হইবেন এবং উত্তর দিকে অস্ত যাইবেন। সেই সময়ে রুদ্রগণের আধিপত্য (৩।৭)। তাহার দ্বিগুণ পরিমিতকাল সূর্য পশ্চিমদিকে উদিত হইবেন এবং পূর্বদিকে অস্ত যাইবেন। তখন আদিত্যগণের আধিপত্য (৩।৮)। আবার তাহার দ্বিগুণ পরিমিতকাল সূর্য উত্তরদিকে উদিত হইবেন এবং দক্ষিণদিকে অস্ত যাইবেন। ঐ সময়ে মরুরুগণের আধিপত্য (৩।৯)। তাহারও দ্বিগুণ পরিমিতকাল সূর্য ঊর্ধ্বদিকে উদিত হইবেন এবং অধোদিকে অস্ত যাইবেন। তখন হইবে সাধ্যগণের আধিপত্য (৩।১০)। তারপর সূর্যের উদয়ও নাই, অস্তও নাই। উদয়াস্ত-বিহীন হইয়া তিনি চিরকাল মধ্যস্থলে থাকিবেন। ইহাই প্রকৃত জ্ঞান। এই জ্ঞানই ব্রহ্মলাভের অবস্থা। ব্রহ্মজ্ঞ আত্মা অনুভব করেন যে, সূর্যের উদয়াস্ত নাই, তাই তাঁহাদের কাছে সর্বদাই দিন (৩।১১)।
ঋষি যাহা বলিয়াছেন, তাহার এই প্রকার অর্থ হইতে পারে :
(১) বর্তমান যুগ ‘বসুযুগ’। এই যুগে সূর্য পূর্বদিকে উদিত হইয়া পশ্চিমদিকে অস্ত যাইতেছেন। সমস্ত বসুযুগের পরিমাণকে আমরা এক যুগ ধরিয়া লইব। (২) বসুযুগ অনন্তকাল স্থায়ী হইবে না। নির্দিষ্ট সময়ে ইহার প্রলয় হইবে। এই প্রলয়ের পর ‘রুদ্রযুগ’ আরম্ভ হইবে। রুদ্রযুগের পরিমাণ বসুযুগের দ্বিগুণ, সংক্ষেপে বলা যাইতে পারে ইহার পরিমাণ দুই। এই যুগে সূর্য দক্ষিণদিকে উদিত হইয়া উত্তরদিকে অস্তগত হইবেন। নূতন কল্পে সবই নূতন হইতে পারে। তখন সূর্যও যে নূতন দিকে উদিত হইবেন, ইহাতে আশ্চর্যের কিছুই নাই। বর্তমানে সূর্য পূর্বদিকে উদিত হইয়া পশ্চিমদিকে অস্ত যাইতেছেন। আমরা কি এমন কল্পনা করিতে পারি না যে, এক সময়ে সূর্য পৃথিবীর দক্ষিণদিকে উদিত হইয়া উত্তরদিকে অস্ত যাইবেন? অবশ্য সূর্যোদয়ের দিককেই যদি পূর্বদিক বলিতে হয়, তাহা হইলে তখনও সেই দক্ষিণ দিককেই পূর্ব বলিতে হইবে। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, এখন আমরা যাহাকে দক্ষিণ দিক বলিতেছি, রুদ্রযুগে সেই দিকই সূর্যোদয়ের দিক হইবে। (৩) রুদ্রযুগের প্রলয়ের পর আদিত্য-যুগ আসিবে। ঐ যুগে সূর্য পশ্চিম দিকে উদিত হইয়া পূর্বদিকে অস্তগত হইবেন। উহার স্থায়িত্বকাল রুদ্রযুগের দ্বিগুণ অর্থাৎ বসুযুগের চতুর্গুণ। সুতরাং ঐ যুগের পরিমাণ চার। (৪) আদিত্যযুগের পর ‘মরুৎযুগ’। ঐ যুগে সূর্য উত্তর দিকে উদিত হইয়া দক্ষিণ দিকে অস্ত যাইবেন। আদিত্যযুগের দ্বিগুণ অর্থাৎ বসুযুগের আট গুণ কাল স্থায়ী হইবে— সংক্ষেপে উহার পরিমাণ আট। (৫) মরুতযুগের পর ‘সাধ্যযুগ’। ঐ যুগে সূর্য ঊর্ধ্বদিকে উদিত হইয়া অধোদিকে অস্তগত হইবেন। তাহার স্থায়িত্বকাল মরুৎযুগের দ্বিগুণ অর্থাৎ বসুযুগের ষোলগুণ—সংক্ষেপে উহার পরিমাণ ষোল। (৬) পূর্বোক্ত পাঁচটি কল্পের মোট পরিমাণ ১ + ২ + ৪ + ৮ + ১৬ = ৩১ অর্থাৎ একত্রিশ বসুযুগ। সাধ্যযুগই যুগগুলির মধ্যে শেষ যুগ। সাধ্যযুগের পর কালসাপেক্ষ আর কোন যুগের আবির্ভাব হইবে না। তখন দিবারাত্রি, সংবৎসরাদি বলিলে যাহা বুঝি, সেই সমস্ত কিছুই থাকিবে না, কারণ তখন সূর্যের উদয় বা অস্ত কিছুই থাকিবে না। ঐ কাল- নিরপেক্ষ লোকই ব্রহ্মলোক; ঐ লোক চির-জ্যোর্তিময়; সূর্য অনন্তকাল সেখানে জ্যোতি দিবেন। যিনি ব্রহ্মোপনিষৎ জানেন, তিনি সেই ব্রহ্মলোকই লাভ করেন।
এই উপনিষদের মতে বসু, রদ্রু, আদিত্য, মরুৎ, সাধ্য— এই পাঁচটি লোকে সূর্যের উদয়াস্ত আছে। কিন্তু তাহা অনন্তকালের জন্য নয়। বসুলোকে নির্দিষ্টকাল সূর্যের উদয়াস্ত হইবে, তাহার পর সূর্য আর সেখানে প্রকাশিত হইবেন না। রুদ্রলোক, আদিত্যলোক এবং অন্যান্য লোকেও তারাই। কিন্তু পৌরাণিক মত অন্য রকম। পুরাণে আছে—সুমেরু পর্বতের চতুর্দিকে সূর্য প্রদক্ষিণ করিতেছেন। ঐ পর্বতের পূর্বদিকে ইন্দ্রের অমরাবতী, দক্ষিণদিকে যমের সংযমনী পুরী, পশ্চিমদিকে বরুণের সুখাপুরী এবং উত্তরদিকে সোমের বিভাপুরী। এই জন্য ভিন্ন ভিন্ন পুরীতে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে দিবা- রাত্রি হইতেছে। যখন অমরাবতীতে মধ্যাহ্ন, তখন সোমপুরীতে সূর্যাস্ত, ঈশান—কোণে অপরাহ্ন, অগ্নিকোণে পূর্বাহ্ন, সংযমনীতে সূর্যোদয়, নৈঋত কোণে অপররাত্র, বরুণপুরীতে মধ্যরাত্র, এবং বায়ুকোণে পূর্বরাত্র। এইরূপ যখন সংযমনীতে মধ্যাহ্নকাল, তখন অমরাবতীতে সূর্যাস্ত, অগ্নিকোণে অপরাহ্ন, নৈঋতে পূর্বাহ্ন, সুখাতে সূর্যোদয়, বায়ুতে অপররাত্র, বিভাতে মধ্যরাত্র এবং ঈশানে পূর্বরাত্র। সূর্য যখন সমান গতিতে মেরুর চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করিতেছেন, তখন সব পুরীতেই সূর্য সমান সময় থাকিবেন। কোনটিতে উদয় ও অস্ত কিছু আগে, কোনটিতে পরে, এইটুকু যাহা পার্থক্য। কোন জায়গায় একগুণ, কোথাও দ্বিগুণ, কোথাও চতুর্গুণ কাল থাকিবেন ইহা হইতে পারে না। সুতরাং উপনিষদের মতের সহিত পুরাণের মতের কিছু পার্থক্য রহিয়াছে।
দ্রাবিড়াচার্য প্রমুখ ব্যাখ্যাকারগণ ঐ দুই মতের সামঞ্জস্য করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। শঙ্করাচার্যও ইঁহাদের অনুসরণ করিয়াছেন। ইঁহারা বলেন ‘উদয়’ অর্থ ‘দৃষ্টিগোচর হওয়া’, ‘অস্ত’ অর্থ ‘দৃষ্টির অতীত হওয়া’। দ্রষ্টা নাই অথচ সূর্য দৃষ্টিগোচর হইল ইহা অর্থশূন্য কথা। ‘অমরাবতীতে সূর্যের উদয় হইল’ ইহার অর্থ ‘অমরাবতীর লোক সূর্য দর্শন করিল। আমরাবতীতে যদি লোক না থাকে তাহা হইলে আমরা বলিতে পারি না যে, ‘আমরাবতীর লোক সূর্য দর্শন করিল’। সুতরাং যেখানে প্রাণী আছে, সেখানেই উদয়াস্তের কথা বলা যায়; যেখানে প্রাণী নাই সেখানে উদয়াস্তের অর্থ নাই। এই যে অমরাবতী প্রভৃতি পুরীর কথা বলা হইয়াছে, তাদের কোনটিই অনন্তকাল স্থায়ী নয়। নির্দিষ্টকাল হইতে প্রাণী বাস করিবে, তাহার পর ইহা জনশূন্য হইবে। যত দিন লোকের বাস ততদিনই এই সকল স্থানে সূর্যের উদয়াস্ত যখন লোক থাকিবে না তখন ওই সব পুরীতে উদয়াস্তও হইবে না। তাই অমরাবতী যদি এক যুগ স্থায়ী হয়, তবে সেখানে সূর্য একযুগ উদিত ও অস্তমিত হইবেন। সংযমনপুরী যদি ইহার দ্বিগুণকাল স্থায়ী হয়, তাহা হইলে সূর্য ঐ পুরীতে দুই যুগকাল উদিত ও অস্তমিত হইবেন। উপনিষদে এই অর্থেই বলা হইয়াছে যে, বসুরাজ্যে সূর্য যতকাল প্রকাশিত থাকিবেন, রুদ্ররাজ্যে প্রকাশিত থাকিবেন তাহার দ্বিগুণকাল।
উপনিষদে আরও বলা হইয়াছে যে, সূর্য এক রাজ্যে পূর্বদিকে উদিত হইয়া পশ্চিমদিকে অস্ত যাইবেন, অন্য রাজ্যে দক্ষিণদিকে উদিত হইয়া উত্তরদিকে অস্তগত হইবেন ইত্যাদি। শঙ্করাচার্য ইহার এইরূপ ব্যাখ্যা দিয়াছেন- সূর্য যেদিকে উদিত হন, সেই দিকের নামই পূর্ব এবং যে দিকে অস্তগত হন সেই দিকের নাম পশ্চিম। সুতরাং সর্ব দেশেই সূর্য পূর্বদিকে উদিত হইয়া পশ্চিমদিকেই অস্তগত হন। সংযমনী পুরীতেও সূর্য পূর্বদিকেই উদিত হন এবং পশ্চিমদিকে অস্তমিত হন। কিন্তু আমরা সংযমনী পুরীর অধিবাসী নহি; আমরা অন্যত্র বাস করিতেছি। আমাদের মনে হইতেছে যে, সূর্য যেন ঐ পুরীতে দক্ষিণদিকেই উদিত হইতেছেন এবং উত্তরদিকেই অস্ত যাইতেছেন।
সূর্য কি ভাবে ঊর্ধ্বদিকে উদিত হইয়া অধোদিকে অস্তগত হন, শঙ্করাচার্যের মতে তাহার ব্যাখ্যা এই— ইলাবৃত দেশ পর্বতাকীর্ণ; ঐ সব পর্বতের জন্য সেখানকার লোক সহজে সূর্যকে দেখিতে পায় না। কেবল পর্বতের উপরের দিকে ছিদ্রপথে সূর্যরশ্মি ইলাবৃত প্রদেশে প্রবেশ করে। এই জন্যই মনে হয় সূর্য সেই দেশে যেন উর্ধ্বদিকেই উদিত হন এবং অধোদিকে অস্তগমন করেন।
পৌরাণিকগণ সূর্যের গতি ও ইন্দ্রপুরী প্রভৃতির যে বর্ণনা দিয়াছেন। শঙ্করাচার্য প্রভৃতি সেই মতই গ্রহণ করিয়া উপনিষদের এই অংশ ব্যাখ্যা করিয়াছেন। কিন্তু উপনিষদের যুগে এই পৌরাণিক মত প্রচলিত ছিল কিনা, তাহা নিশ্চিতরূপে বলা যায় না। আর ইঁহারা যে ব্যাখ্যা দিয়াছেন তাহাও কষ্টকল্পনা বলিয়া মনে হইবে।
দ্বাদশ খণ্ড – গায়ত্রী-অবলম্বনে ব্ৰহ্মচিন্তা
২৩০. গায়ত্রী বা ইদং সর্বং ভূতং যদিদং কিঞ্চ বাগ্ বৈ গায়ত্রী বাগ্ বা ইদং সর্বং ভূতং গায়তি চ ত্ৰায়তে চ ॥ ১
অন্বয় : গায়ত্রী বৈ ইদম্ সর্বম্ ভূতম্ (এই সমুদয় ভূত), যৎ ইদম্ কিঞ্চ (এই যাহা কিছু); বাক্ বৈ গায়ত্রী, বাক্ বৈ ইদম্ সর্বম্ ভূতম্ গায়তি চ (গান করে) ত্রায়তে চ (এবং ত্রাণ করে)।
সরলার্থ : এই সকল বস্তু ও প্রাণী জগৎ যাহা কিছু আছে সেই সবই গায়ত্ৰী। বাক্যই গায়ত্রী; কারণ বাক্যই সকল বস্তু ও প্রাণীকে গান (অর্থাৎ বর্ণনা) করিয়া থাকে এবং ইহাদের ত্রাণ করে।
মন্তব্য : গায়ত্রী একটি ছন্দ, এই ছন্দে রচিত মন্ত্রকেও গায়ত্ৰী বল হয়। ‘তৎসবিতুর্বরেণ্যম্’ ইত্যাদি মন্ত্রকে (ঋগ্বেদ ৩।৬২।১০) বিশেষভাবে গায়ত্ৰী বলা হইয়া থাকে। আধুনিক ভাষাতত্ত্বজ্ঞ পণ্ডিতগণ অনেকে বলেন ‘গা’ ধাতু হইতে ‘গায়ত্রী’ হইয়াছে। উপনিষদের ঋষি বলিতেছেন— ইহা ‘গৈ’ ও ‘ত্রা’ ধাতু হইতে নিষ্পন্ন। গৈ = গান করা; ত্রা = ত্রাণ করা।
২৩১. যা বৈ সা গায়ত্রীয়ং বাব সা যেয়ং পৃথিব্যস্যাং হীদং সর্বং ভূতং প্রতিষ্ঠিতমেতামেব নাতিশীয়তে ॥ ২
অন্বয় : যা (যাহা) বৈ সা গায়ত্রী, ইয়ম্ (এই পৃথিবী) বাব সা (তাহা)— যা (যাহা ইয়ম্ পৃথিবী। অস্যাম্ (এই পৃথিবীতে) হি ইদম্ সর্বম্ ভূতম্ (এই সমুদয় ভূত) প্রতিষ্ঠিতম্। এতাম্ (এই পৃথিবীকে) এব ন (না) অতিশীয়তে (অতিক্রম করে)।
সরলার্থ : এই যে গায়ত্রী তাহাই এই পৃথিবী অর্থাৎ সেই গায়েত্রীই এই পৃথিবী। কারণ সর্বভূতই এই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত; কেহই ইহাকে অতিক্রম করিতে পারে না। ২৩২. যা বৈ সা পৃথিবীয়ং বাব সা যদিদমস্মিন্ পুরুষে শরীরমস্মিন্ হীমে প্রাণাঃ প্রতিষ্ঠিতা এতদেব নাতিশীয়ন্তে ॥ ৩
অন্বয় : যা বৈ সা পৃথিবী, ইয়ম্ বাব সা— যৎ (যাহা) ইদম্ (এই) অস্মিন্ পুরুষে (এই পুরষে) শরীরম্। অস্মিন্ হি ইমে প্রাণাঃ প্রতিষ্ঠিতাঃ, এতৎ এব ন অতিশীয়ন্তে (অতিক্রম করে)।
সরলার্থ : যাহা সেই পৃথিবী, পুরুষে তাহাই শরীর (অর্থাৎ পৃথিবীই এই পুরুষাশ্রিত শরীর); করণ এই শরীরে প্রাণসমূহ প্রতিষ্ঠিত এবং ইহারা কেহই শরীরকে অতিক্রম করিতে পারে না।
২৩৩. যদ্ বৈ তৎ পুরুষে শরীরমিদং বাব তদ্যদিদমস্মিন্নন্তঃপুরুষে হৃদয়মস্মিন্ হীমে প্রাণাঃ প্রতিষ্ঠাতা এতদেব নাতিশীয়ন্তে ॥ ৪
অন্বয় : যৎ (যাহা) বৈ তৎ (সেই) পুরুষে শরীরম্ ইদম্ (ইহা) বাব তৎ (তাহা) যৎ ইদম্ অস্মিন্ অন্তঃপুরুষে (এই পুরুষের অভ্যন্তরে) হৃদয়ম্। অস্মিন্ (এই শরীরে) হি ইমে (এই সমুদয়) প্রাণাঃ প্রতিষ্ঠিতাঃ। এতৎ (এই হৃদয়কে) এব ন (না) অতিশীয়ন্তে (৩য় মঃ দ্রঃ)।
সরলার্থ : যাহা এই পুরুষাশ্রিত শরীর তাহাই পুরুষের অভ্যন্তরস্থ হৃদয়; কারণ প্রাণসমূহ এই শরীরে প্রতিষ্ঠিত; ইহারা কেহই এই হৃদয়কে অতিক্রম করে না।
২৩৪. সৈষা চতুষ্পদা ষডুবিধা গায়ত্রী তদেতদৃচাভ্যনূক্তম্ ॥ ৫
অন্বয় : সা এষা (সেই এই) চতুষ্পদা (চারি চরণবিশিষ্টা) ষডুবিধা (ছয় প্রকার গায়ত্রী। তৎ এতৎ (সেই তাহা) ঋচা (ঋমন্ত্রেও; ঋগ্বেদ ১০।৯০।৩) অভ্যনূক্তম্ (ইহা উক্ত হইয়াছে)।
সরলার্থ : এই গায়ত্রীর চারিটি চরণ এবং ইহা ছয় প্রকার; ঋমন্ত্রেও ইহা উক্ত হইয়াছে।
মন্তব্য : গায়ত্রী ছন্দে চব্বিশটি অক্ষর; ইহাকে চারি চরণে ভাগ করিলে, প্রতি চরণে ছয়টি অক্ষর হয়। বাক্, সর্বভূত, পৃথিবী, শরীর, হৃদয়, প্রাণ— এই ছয়টি অক্ষরের একত্ব দেখান হইয়াছে।
২৩৫. তাবানস্য মহিমা ততো জ্যায়াশ্চ পুরুষঃ।
পাদোহস্য সর্বা ভূতানি ত্রিপাদস্যামৃতং দিবীতি ॥ ৬
অন্বয় : তাবান্ (সেই পরিমাণে) অস্য (ইহার) মহিমা; ততঃ (তাহা অপেক্ষা) জ্যায়ান্ চ (মহান্) পূরুষঃ (পুরুষ); পাদঃ (এক পাদ) অস্য সর্বা (বৈদিক প্রয়োগ সর্বাণি সমুদয়) ভূতানি (ভূতসমূহ); ত্রিপাৎ (তিন পাদ) অস্য অমৃতম্ (অমৃতস্বরূপ) দিবি (স্বর্গে) ইতি।
সরলার্থ : ইহার মহিমা এই প্রকার; পুরুষ ইহা অপেক্ষাও (অর্থাৎ এই মহিমা অপেক্ষাও) শ্রেষ্ঠ। সর্বভূত ইহার এক পাদ; অবশিষ্ট তিন পাদ স্বর্গে অমৃতরূপে প্রতিষ্ঠিত।
মন্তব্য : এই অংশ পুরুষসুক্ত হইতে গৃহীত হইয়াছে (ঋক্ ১০।৯০।৩)। ইহার প্রথম চারি মন্ত্রের অনুবাদ এই : (১) পুরুষের সহস্র মস্তক, সহস্র চক্ষু, সহস্ৰ পদ; তিনি পৃথিবীকে সর্বত্র পরিবেষ্টন করিয়া দশ অঙ্গুলী পরিমাণ ঊর্ধ্বে রহিয়াছেন। (২) যাহা হইয়াছে ও যাহা হইবে সবই সেই পুরুষ। (৩) এই প্রকার তাঁহার মহিমা; কিন্তু পুরুষ ইহা অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ। (৪) তিন পাদ লইয়া তিনি ঊর্ধ্বে উঠিলেন, আর এক পাদ এই স্থলে রহিল বা উৎপন্ন হইল। তারপর তিনি ভোজনকারী ও ভোজনরহিত সমস্ত বস্তুতে (অর্থাৎ চেতন, অচেতন সমস্ত কিছুতে) পরিব্যাপ্ত হইলেন। উপনিষদের এই স্থলে গায়ত্রীকে পুরুষরূপে কল্পনা করা হইয়াছে।
২৩৬. যদ্ বৈ তদ্ ব্রহ্মেতীদং বাব তদ্ যোহয়ং বহির্ধা পুরুষাদাতাশো যো বৈ স বহির্ধা পুরুষাদাকাশঃ ॥ ৭
অন্বয় : যৎ (যাহা) বৈ তৎ (তাহা) ব্রহ্ম ইতি, ইদম্ (ইহা) বাব তৎ— যঃ (যাহা) অয়ম্ (এই) বহির্ধা (বহিঃ + ধা, বহির্দেশে অবস্থিত) পুরুষাৎ (পুরুষ হইতে) আকাশঃ।
সরলার্থ : এই যে ব্রহ্ম, ইনিই পুরুষদেহের বাহিরের দিকে অবস্থিত আকাশ।
২৩৭. অয়ং বাব স যোহয়মন্তঃপুরুষ আকাশো যো বৈ সোহন্তঃপুরুষ আকাশঃ ॥ ৮
অন্বয় : অয়ম্ বাব সঃ—যঃ অয়ম্ অন্তঃ + পুরুষে (পুরুষের অভ্যন্তরে) আকাশঃ যঃ (যাহা) বৈ সঃ (সেই) অন্তঃপুরুষে আকাশঃ।
সরলার্থ : পুরুষের দেহের বাহিরে স্থিত আকাশও যাহা, দেহের অভ্যন্তরে স্থিত আকাশও তাহাই।
২৩৮. অয়ং বাব স যোহয়মন্তহৃদয় আকাশস্তদেতৎ পূৰ্ণমপ্রবর্তি পূর্ণামপ্রবর্তিনীং শ্রিয়ং লভতে য এবং বেদ ॥ ৯
অন্বয় : [যঃ বৈ সঃ অন্তঃপুরুষে আকাশঃ] অয়ম্ বাব সঃ—যঃ অয়ম্ অন্ত+হৃদয়ে (হৃদয়ের অভ্যন্তরে) আকাশঃ। তৎ এতৎ (সেই এই) পূর্ণম্ অপ্রবর্তনশীল, অপরিবর্তনীয়)। পূর্ণাম্ অপ্রবর্তিনীম্ শ্রিয়ম্ (পূর্ণ অপরিবর্তনশীল সম্পদকে) লভতে (লাভ করে) যঃ এবম্ (এই প্রকার) বেদ (জানেন)।
সরলার্থ : পুরুষের অভ্যন্তরে যে আকাশ, তহার হৃদয়েও সেই আকাশ। এই হৃদয়স্থ আকাশ পূর্ণ ও অপরিবর্তনীয়। ইহা যিনি জানেন তিনি পূর্ণ ও অপরিবর্তনীয় সম্পদ লাভ করেন।
ত্রয়োদশ খণ্ড – পঞ্চপ্রাণ ও পঞ্চদ্বারপাল—অন্তর্জ্যোতি ও বহির্জোতির একতা
২৩৯. তস্য হ বা এতস্য হৃদয়স্য পঞ্চ দেবষয়ঃ স যোহস্য প্ৰাঙ্গুষিঃ স প্রাণস্তচ্চক্ষুঃ স আদিত্যস্তদেতত্তেজোহন্নাদ্যমিত্যুপাসীত তেজস্বী অন্নাদো ভবতি য এবং বেদ ॥ ১
অন্বয় : তস্য হ বৈ এতস্য হৃদয়স্য (সেই এই হৃদয়ের) পঞ্চ দেবসুষয়ঃ (দেবতাদিগের দ্বার; দেব = ইন্দ্ৰিয়; সুষি = রন্ধ্র); সঃ যঃ (সেই যে) অস্য (ইহার প্রাঙ্গুষিঃ (পূর্বদ্বার)— সঃ প্রাণঃ, তৎ চক্ষুঃ, স আদিত্যঃ। তৎ এতৎ (সেই ইহা) তেজঃ অন্নাদ্যম্ (৩।২।৩ টীকা) ইতি উপাসীত (উপাসনা করিবে)। তেজস্বী অন্নাদঃ (অন্নভোক্তা) ভবতি (হয়) যঃ এবম্ বেদ।
সরলার্থ : এই হৃদয়ে দেবতাদিগের (ইন্দ্রিয়গণের) পাঁচটি দ্বার আছে। হৃদয়ের যে পূর্বদ্বার, তাহাই প্রাণ, তাহাই চক্ষু, তাহাই আদিত্য। ইহাকে তেজ ও অন্নের আদিরূপে উপাসনা করিবে। যিনি ইহা জানেন, তিনি তেজস্বী ও অন্নভোক্তা হন।
মন্তব্য : শরীরস্থ বায়ুকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করা হইয়াছে— (১) হৃদয়স্থ বায়ুর নাম প্রাণ, (২) নিম্নগামী অর্থাৎ মলদ্বারের বায়ুর নাম অপান, (৩) নাভিস্থিত বায়ুর নাম সমান, (৪) কণ্ঠস্থিত বায়ুর নাম উদান, (৫) সর্বশরীরে ব্যাপ্ত যে বায়ু তাহার নাম ব্যান। (১।৩।৩ মন্ত্রের মন্তব্য দ্রষ্টব্য)।
২৪০. অথ যোহস্য দক্ষিণঃ সুষিঃ স ব্যানস্তম্ভ্রোত্রং স চন্দ্রমাস্তদেতক্ষ্মীশ্চ যশশ্চেত্যুপাসীত শ্ৰীমান্ যশস্বী ভবতি য এবং বেদ ॥ ২
অন্বয় : অথ যঃ অস্য দক্ষিণঃ (দক্ষিণদিকস্থ) সুষিঃ (রন্ধ্র) সঃ ব্যানঃ, তৎ শ্রোত্রম্; সঃ চন্দ্রমাঃ; তৎ এতৎ শ্ৰীঃ চ যশঃ চ ইতি উপাসীত। শ্রীমান্ যশস্বী ভবতি (হন) যঃ এবম্ বেদ।
সরলার্থ : আর হৃদয়ের যে দক্ষিণ দ্বার, তাহাই ব্যান, তাহাই কৰ্ণ, তাহাই চন্দ্ৰ। ইহাকে শ্রী ও যশরূপে উপাসনা করিবে। যিনি ইহা জানেন, তিনি শ্রীমান্ ও যশস্বী হন।
২৪১. অথ যোহস্য প্রত্য সুষি সোহপানঃ সা বাক্ সোহগ্নিস্তদেতদ্ ব্ৰহ্মবচসম্ অন্নাদ্যমিত্যুপাসীত ব্রহ্মবচস্যন্নাদো ভবতি য এবং বেদ ॥ ৩
অন্বয় : অথ যঃ অস্য প্রত্যঙ্গুষিঃ (পশ্চিমভাগস্থ রন্ধ্র) সঃ অপানঃ, সা বাক্, স অগ্নিঃ। তৎ এতৎ ব্রহ্মবর্চসম্ (২।১৬।২ টীকা) অন্নাদ্যম্ (৩।১।৩ মন্তব্য) ইতি উপাসীত ব্রহ্মবচসী (ব্রহ্মতেজোযুক্ত) অন্নাদঃ ভবতি যঃ এবম্ বেদ।
সরলার্থ : তাহার পর হৃদয়ের যে পশ্চিম দ্বার তাহাই অপান, তাহাই বাক্ এবং তাহাই অগ্নি। ইহাকে ব্রহ্মবর্চস এবং অনাদ্যরূপে উপাসনা করিবে। যিনি ইহা জানেন, তিনি ব্রহ্মতেজযুক্ত ও অন্নান্দ হন।
২৪২. অথ যোহস্যোদঙ্গুষিঃ স সমানস্তন্মনঃ স পর্জন্যস্তদেতৎ কীর্তিশ্চ ব্যুষ্টিশ্চেত্যুপাসীত কীর্তিমান্ ব্যুষ্টিমান্ ভবতি য এবং বেদ ॥ ৪
অন্বয় : অথ যঃ অস্য উদঙ্গুষিঃ (দক্ষিণদিকের দ্বার) সঃ সমানঃ তৎ মনঃ সঃ পর্জন্যঃ। তৎ এতৎ কীতিঃ চ ব্যুষ্টিঃ (বি-উষ্টি; কান্তি), চ ইতি উপাসীত। কীর্তিমান্ ব্যুষ্টিমান্ (কান্তিযুক্ত) ভবতি যঃ এবম্ বেদ।
সরলার্থ : এই হৃদয়ের যে উত্তরদ্বার তাহা সমান নামক বায়ু, তাহা মন, তাহা পর্জন্য (বরুণদেব)। ইহাকে কীর্তি ও কান্তিরূপে উপাসনা করিবে। যিনি ইহা জানেন, তিনি কীর্তিমান ও কান্তিমান হন।
২৪৩. অথ যোহস্যোঃ সুষিঃ স উদানঃ স বায়ুঃ স আকাশস্তদেতদোজশ্চ মহশ্চেত্যুপাসীতৌজস্বী মহস্বান্ ভবতি য এবং বেদ ॥ ৫
অন্বয় : অথ যঃ অস্য ঊর্ধ্বঃ সুষিঃ, সঃ উদানঃ, সঃ বায়ুঃ স আকাশঃ। তৎ এতৎ ওজঃ চ মঃ (গৌরব, মহত্ত্ব) চ ইতি উপাসীত। ওজস্বী মহস্বান্ (মহত্ত্বযুক্ত) ভবতি যঃ এবম্ বেদ।
সরলার্থ : হৃদয়ের যে উর্ধ্বদিকের দ্বার তাহাই উদান, তাহাই বায়ু, তাহাই আকাশ। ইহাকে ওজ (বল) ও মহত্ত্বরূপে উপাসনা করিবে। যিনি এই প্রকার জানেন তিনি ওজস্বী ও মহত্ত্বযুক্ত হন।
২৪৪. তে বা এতে পঞ্চ ব্রহ্মপুরষাঃ স্বর্গস্য লোকস্য দ্বারপাঃ স য এতানেব পঞ্চ ব্রহ্মপুরুষান্ স্বর্গস্য লোকস্য দ্বারপান্ বেদাস্য কুলে বীরো জায়তে প্রতিপদ্যতে স্বর্গং লোকং য এতানেবং পঞ্চ ব্রহ্মপুরুষান্ স্বর্গস্য লোকস্য দ্বারপান্ বেদ ॥ ৬
অন্বয় : তে বৈ এতে (সেই এই সমুদয়) পঞ্চ ব্রহ্মপুরুষাঃ (ব্রহ্মের অধীন পুরুষ)) স্বর্গস্য লোকস্য (স্বর্গলোকের) দ্বারপাঃ (দ্বারপালসমূহ)। সঃ যঃ এতান্ এবং পঞ্চ ব্রহ্মপুরুষান্ স্বর্গস্য লোকস্য দ্বারপান্ বেদ, অস্য কুলে বীরঃ জায়তে, প্রতিপদ্যতে (প্রাপ্ত হয়) স্বর্গম্ লোকম্, যঃ এতান্ পঞ্চ ব্রহ্মপুরুষান্ স্বর্গস্য লোকস্য দ্বারপান্ বেদ।
সরলার্থ : এই পঞ্চ ব্রহ্মপুরুষ স্বর্গলোকের দ্বারপাল। যিনি স্বর্গলোকের দ্বারপাল রূপী এই পঞ্চ পুরুষকে জানেন তাঁহার কুলে বীর পুত্র জন্মলাভ করে। যিনি স্বর্গের দ্বারপাল পঞ্চ ব্রহ্মপুরুষকে এই ভাবে জানেন, তিনি স্বর্গলোক লাভ করেন।
২৪৫. অথ যদতঃ পরো দিবো জ্যোতিদীপ্যতে বিশ্বতঃ পৃষ্ঠেষু সর্বতঃ পৃষ্ঠেযু অনুত্তমেষুত্তমেষু লোকেম্বিদং বাব তদ্ যদিদমস্মিন্নন্তঃপুরুষে জ্যোতিঃ। তস্যৈষা দৃষ্টির্যত্রৈতদস্মিঞ্ছরীরে সংস্পর্শেনোঞ্চিমানং বিজানাতি তস্যৈষা শ্রুতির্যত্রৈত কর্ণাবপিগৃহ্য নিনদমিব নদথুরিবাগ্লেরিব জ্বলত উপশৃ- ণোতি তদেতদ্দৃষ্টং চ শ্রুতং চেত্যুপাসীত চক্ষুষ্যঃ শুতো ভবতি য এবং বেদ য এবং বেদ ॥ ৭
অন্বয় : অথ যৎ অতঃ (ইহা অপেক্ষা) পরঃ (শ্রেষ্ঠ) দিবঃ (দ্যুলোক অপেক্ষা) জ্যোতিঃ দীপ্যতে (দীপ্তি পায়) বিশ্বতঃ পৃষ্ঠেযু (বিশ্বের উপরে) সর্বতঃ পৃষ্ঠেযু (সকলের উপরে) অনুত্তমেষু (যাহা অপেক্ষা উত্তম নাই, তাহাই অনুত্তম, সর্বোত্তম) উত্তমেষু (শ্রেষ্ঠ) লোকেষু (লোকসমূহে) ইদম্ (এই) বাব তৎ যৎ ইদম্ অস্মিন্ অন্তঃপুরুষে (পুরুষের অভ্যন্তরে) জ্যোতিঃ।
তস্য (তাহার) এষা (এই) দৃষ্টিঃ (চাক্ষুষ প্রমাণ) যত্র (যখন) এতৎ (এই প্রকার; বিজানাতি ক্রিয়ার বিং) অস্মিন্ শরীরে সংস্পর্শেন (সংস্পর্শ দ্বারা) উষ্ণিমানম্ (উষ্ণত্বকে বিজানাতি (জানা যায়)। তস্য এষা শ্রুতিঃ (শ্রবণেন্দ্রিয়ের প্রমাণ) যত্র এতৎ কর্ণো (কর্ণদ্বয়কে) অপিগৃহ্য (আচ্ছাদন করিয়া) নিনদম্ ইব (নিনাদের ন্যায়, রথধ্বনির ন্যায়) নদথুঃ ইব (বৃষভধ্বনির ন্যায়) অগ্নেঃ ইব জ্বলতঃ (প্রজ্বলিত অগ্নির শব্দের ন্যায় উপশৃণোতি (শ্রবণ করা যায়)। তৎ (সেই) এতৎ দৃষ্টম্ চ (দৃষ্টিগোচর; দর্শনীয়) শুতম্ চ (শ্রুতিগোচর, বিখ্যাত) ইতি উপাসীত। চক্ষুষ্যঃ (দর্শনীয়) শ্রুতঃ (বিখ্যাত) ভবতি যঃ এবম্ বেদ, যঃ এবম্ বেদ (দ্বিরুক্তি সমাপ্তিসূচক)।
সরলার্থ : তাহার পর, এই দ্যুলোক অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, বিশ্বের উপর, সমস্ত কিছুর উপর, সর্বোত্তম লোকে, উত্তমলোকে যে জ্যোতি দীপ্তি পাইতেছে— সেই জ্যোতি এবং এই পুরুষের অভ্যন্তরে যে জ্যোতি— এই উভয় জ্যোতি একই জ্যোতি।
এ বিষয়ে চাক্ষুষ প্রমাণ এই — হস্ত দ্বারা শরীরকে স্পর্শ করিলে শরীরের উষ্ণতা জানা যায়। এ বিষয়ে শ্রুতিপ্রমাণ (অর্থাৎ শ্রবণেন্দ্রিয়ের প্রমাণ) এই—কান দুইটি ঢাকিয়া রাখিলে রথধ্বনির মত শব্দ, ঋষভধ্বনির মত ধ্বনি এবং জ্বলন্ত অগ্নির শব্দের মত শব্দ শোনা যায়। ইহাকে দৃষ্ট ও শ্রুতরূপে উপাসনা করিবে। যিনি এই প্রকার জানেন, তিনি দর্শনীয় এবং লোকপ্রসিদ্ধ হন।
মন্তব্য : শরীরের যে উত্তাপ, তাহা কোথা হইকে আসে? ঋষি মনে করেন, ‘হৃদয়স্থ ব্রহ্মই এই উত্তাপের কারণ’। দৃষ্টি—চাক্ষুষ প্রমাণ। ইহার ব্যাখ্যায় শঙ্কর ত্বগিন্দ্রিয় ও দর্শনেন্দ্রিয় উভয়ই ব্যবহার করিয়াছেন।
চতুর্দশ খণ্ড – শাণ্ডিল্য-বিদ্যা
২৪৬. সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম তজ্জলানিতি শান্ত উপাসীত। অথ খলু ক্রতুময়ঃ পুরুষো যথাক্রতুরস্মিঁল্লোকে পুরুষো ভবতি তথেতঃ প্ৰেত্য ভবতি স ত্রুতুং কুর্বীত ॥ ১
অন্বয় : সর্বম্ (সমুদয়) খলু (নিশ্চয়ই) ইদম্ (এই) ব্রহ্ম। তজ্জলান্ (তাহা হইতে উৎপন্ন হইয়াছে, তাহাতে লীন হয় এবং তাহাতেই জীবিত থাকে) ইতি শান্তঃ (শান্তভাবে) উপাসীত (উপাসনা করিবে)। অথ (আর) খলু ক্রতুময়ঃ (কতুময়; কতু সঙ্কল্প, অধ্যবসায় বা কর্ম) পুরুষঃ। যথাক্রতুঃ (যেমন ক্রতুযুক্ত) অস্মিন্ লোকে (এই লোকে) পুরুষঃ ভবতি (হয়) তথা (সেই প্রকার) ইতঃ (এই লোক হইতে) প্ৰেত্য (মৃত হইয়া) ভবতি। সঃ ব্রুতুম্ কুর্বীত (করিবে)।
সরলার্থ : এই সবকিছুই ব্রহ্ম, কারণ সমস্ত কিছু তাঁহা হইতেই উৎপন্ন হয়, তাঁহাতেই লীন হয় এবং তাঁহাতেই জীবিত থাকে। এইভাবে শান্ত হইয়া উপাসনা করিবে। মানুষমাত্রেই সঙ্কল্পযুক্ত; এই পৃথিবীতে মানুষের যেমন সঙ্কল্প, অধ্যবসায় বা কর্ম হইবে, এই পৃথিবী বা দেহ ছাড়িয়া যাইবার পরও সেই রকমই হয়। (সুতরাং) এইভাবে ভাবিত হইয়া উপাসনা করিবে।
মন্তব্য : তজ্জলান—তৎ + জ + ল + অন্। তাহা হইতে অর্থাৎ ব্রহ্ম হইতে যাহার উৎপত্তি তাহা তজ্জম্ (তৎ + জন্ হইতে), যাহা তাহাতে লীন হয় তাহা তল্লম্ (তৎ + লী হইতে), যাহা তাহাতে জীবিত থাকে তাহা ‘তদনম্’ (তৎ + অন্ হইতে)।
২৪৭. মনোময়ঃ প্রাণশরীরো ভারূপঃ সত্যসঙ্কল্প আকাশাত্মা সর্বকর্মা সর্বকামঃ সর্বগন্ধঃ সর্বরসঃ সর্বমিদমভ্যাত্তোহবাক্যনাদরঃ ॥ ২
অন্বয় : মনোময়ঃ প্রাণশরীরঃ (প্রাণই যাহার শরীর) ভারূপঃ (জ্যোতিস্বরূপ সত্যসঙ্কল্পঃ, আকাশাত্মা (যাঁহার আত্মা আকাশের ন্যায় সর্বব্যাপী, অখণ্ড ও রূপাদিবিহীন) সর্বকর্মা (সমুদয় কর্মের কর্তা বা আধার) সর্বকামঃ (সমুদয় কামনার আধার বা উৎপাদক) সর্বগন্ধঃ (সমুদয় গন্ধের আধার বা উৎপাদক) সর্বরসঃ (সর্বরসের আধার বা উৎপাদক)। সর্বম্ ইদম্ (এই সমুদয়কে) অভ্যাত্তঃ (পরিব্যাপ্ত)। অবাকী (বাগিন্দ্রিয়রহিত) অনাদরঃ (অনপেক্ষ, ব্যগ্রতারহিত; কারণ নিত্যতৃপ্ত ঈশ্বরের পক্ষে ব্যগ্রতা বা আসক্তি থাকা সম্ভব নহে)।
সরলার্থ : যিনি মনোময়, প্রাণই যাঁহার শরীর, যিনি জ্যোতিঃস্বরূপ ও সত্য- সংকল্প, যিনি আকাশের ন্যায় (সর্বব্যাপী, অখণ্ড ও রূপাদিবিহীন), যিনি সর্বকর্মা, সর্বকাম, সর্বগন্ধ ও সর্বরস, যিনি সমস্ত কিছুতে পরিব্যাপ্ত হইয়া রহিয়াছেন, যিনি বাগিন্দ্রিয়রহিত ও অনপেক্ষ
২৪৮. এষ ম আত্মান্তহৃদয়েহণীয়ান্ ব্ৰীহেবা যবাদ্বা সর্ষপাদ্বা শ্যামাকাদ্বা শ্যামাকতণ্ডুলাদ্বা এষ ম আত্মান্তহৃদয়ে জ্যায়ান্ পৃথিব্যা জ্যায়ানন্তরিক্ষাজ্জ্যায়ান্দিবো জ্যায়ানেভ্যো লোকেভ্যঃ ॥ ৩
অন্বয় : এষঃ (ইনি) মে (আমার) আত্মা অন্তঃ + হৃদয়ে (হৃদয়ের অভ্যন্তরে অণীয়ান্ (অণুতর সূক্ষ্মতর) ব্রীহেঃ বা (ব্রীহি অপেক্ষা) যবাৎ বা (যব অপেক্ষা) সর্যপাৎ বা (সর্ষপ অপেক্ষা) শ্যামাকাৎ বা (শ্যামাক নামক শস্য অপেক্ষা) শ্যাসাক-তণ্ডুলাৎ বা (শ্যামাক শস্যের তণ্ডুল অপেক্ষাও)। এষঃ মে আত্মা অন্তর্ + হৃদয়ে জ্যায়ান্ (মহান্) পৃথিব্যাঃ (পৃথিবী অপেক্ষা) জ্যায়ান্ অন্তরিক্ষাৎ (অন্তরিক্ষ অপেক্ষা) জ্যায়ান্ দিবঃ (দ্যুলোক অপেক্ষা) জ্যায়ান্ এভ্যঃ লোকেভ্যঃ (এই সমুদয় লোক অপেক্ষা)।
সরলার্থ : হৃদয়ের অভ্যন্তরে আমার এই আত্মা ব্রীহি অপেক্ষা সূক্ষ্ম, ইনি যব, সর্ষপ, শ্যামাক, এমন কি শ্যামাক তণ্ডুল অপেক্ষাও সূক্ষ্ম। হৃদয়ের অভ্যন্তরে আমার আত্মা পৃথিবী অপেক্ষা মহান, অন্তরিক্ষ অপেক্ষা মহান, এই সমুদয় লোক অপেক্ষাও মহান।
২৪৯. সর্বকর্মা সর্বকামঃ সর্বগন্ধঃ সর্বরসঃ সর্বমিদমভ্যাত্তোহবাক্যনাদর এস ম আত্মান্তহৃদয় এতদ্ ব্রহ্মেতমিতঃ প্রেত্যাভিসম্ভবিতাস্মীতি যস্য স্যাদদ্ধা ন বিচিকিৎসাস্তীতি হ স্মাহ শাণ্ডিল্যঃ শাণ্ডিল্যঃ ॥ ৪
অন্বয় : সর্বকর্মা সর্বকামঃ সর্বগন্ধঃ সর্বরসঃ সর্বম্ ইদম্ অভ্যান্তঃ, অবাকী অনাদরঃ (২য় মঃ টীঃ); এষঃ মে আত্মা অন্তঃ + হৃদয়ে (৩য় মঃ টীঃ) এতৎ (ইহাই) ব্রহ্ম। এতম্ (ইহাকে) ইতঃ (ইহলোক হইতে বা এই দেহ হইতে) প্রেত্য (গমন করিয়া) অভিসম্ভবিতাস্মি (প্রাপ্ত হইবে)। যস্য, (যাহার) স্যাৎ (থাকিতে পারে, আছে) অদ্ধা (বিশ্বাস), ন (না) বিচিকিৎসা (সংশয়) অস্তি (আছে) ইতি হ ম আহ (আহম= বলিয়াছেন) শাণ্ডিল্যঃ।
সরলার্থ : যিনি সর্বকর্মা, সর্বকাম, সর্বগন্ধ, সর্বরস, যিনি সবকিছু পরিব্যাপ্ত করিয়া রহিয়াছেন, যিনি বাক্রহিত, তিনিই আমার আত্মা এবং আমার হৃদয়ের অভ্যন্তরে ইনিই ব্রহ্ম। ইহলোক (বা এই দেহ। হইতে যাইয়া তাঁহাকেই পাইব। যাঁহার এই রকম স্থির বিশ্বাস আছে, তাহার কোন সংশয় নাই) [অর্থান্তর—যিনি মনে করেন, ‘আমি মৃত্যুর পর ব্রহ্মলাভ করিব’, এ বিষয়ে যাঁহার কোন সন্দেহ নাই তিনি ব্ৰহ্মলাভ করিবেন]। শাণ্ডিল্য (ইহাই বলিয়াছেন), শাণ্ডিল্য (ইহাই বলিয়াছেন)।
মন্তব্য : শাণ্ডিল্য—শাণ্ডিলের অপত্য। প্রাচীন গ্রন্থে বহুস্থলে শাণ্ডিল্যের নাম পাওয়া যায়। (শতপথ ব্রাহ্মণ ৯।৪।৪।১৭, ৯।৫।২।১৫ ইত্যাদি; বৃহঃ উপ ২।৬— এর অনেক মন্ত্রে)। ইঁহারা সকলেই যে এক শাণ্ডিল্য তাহা মনে হয় না।
শতপথ ব্রাহ্মণেও (১০।৬।৩।১-২) এই শাণ্ডল্যবিদ্যা বিবৃত হইয়াছে। নিম্নে ইহার অনুবাদ দেওয়া গেল : ‘সত্যই ব্রহ্ম’—এইরূপে উপাসনা করিবে। তাহার পর এই পুরুষ ক্রতুময়। সে যে প্রকার ক্রতুমান হইয়া এই লোক হইতে গমন করে, সেই প্রকার কতুমান হইয়াই মৃত্যুর পর সেই লোক প্রাপ্ত হয়। সে আত্মাকে উপাসনা করিবে—এই আত্মা মনোময়, প্রাণশরীর, ভারূপ, আকাশাত্মা, কামরূপী, মনের ন্যায় বেগবান, সত্যসঙ্কল্প, সত্যধূতি, সর্বগন্ধ. সর্বরস, সর্বদেশের প্রভু, সর্বদেশে অনুব্যাপ্ত বাগিন্দিয়রহিত, অনাদর (অর্থাৎ উদাসীন)। যেমন ব্রীহি বা যব, বা শ্যামাক, বা শ্যামাকতণ্ডুল তেমনি এই দেহস্থ হিরন্ময় পুরুষ। ধূমরহিত জ্যোতির ন্যায়, ইহা দ্যুলোক অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, এই পৃথিবী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, সমুদয় প্রাণিজগৎ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ তিনি প্রাণের আত্মা (প্রাণ), ইনিই আমার আত্মা। ইহলোক হইতে গমন করিয়া এই আত্মাকেই লাভ করিব। যাহার এই প্রকার নিশ্চয় বিশ্বাস আছে, (ব্রহ্মপ্রাপ্তি বিষয়ে) তাহার কোন সন্দেহ নাই। শাণ্ডিল্য ইহাই বলিয়াছেন এবং ইহা এই প্রকারই।
পঞ্চদশ খণ্ড – পুত্রের মঙ্গলকামনায় বিরাটকোশের চিন্তা
২৫০. অন্তরিক্ষোদর কোশো ভূমিবুধ্নো ন জীর্যতি। দিশো হস্য স্ৰক্তয়ো দ্যৌরস্যোত্তরং বিলম্। স এষ কোশো বসুধানর্স্তস্মিন্ বিশ্বমিদং শ্রিতম্ ॥ ১
অন্বয় : অন্তরিক্ষ + উদরঃ (অন্তরিক্ষ যাহার উদর) কোশঃ ভূমি বুধ্নঃ (ভূমি যাহার নিম্নভাগ বা মূল; বুধ্ন—মূল) ন (না) জীর্যতি (জীর্ণ হয়)। দিশঃ (দিকসমূহ) হি অস্য (এই কোশের) সক্তয়ঃ (স্রক্তি; কোণ বা পার্শ্বসমূহ), দ্যৌঃ (দ্যুলোক) অস্য উত্তরম্ বিলম্ (ঊর্ধ্বদিকের রন্ধ্র)। সঃ এষঃ কোশঃ (সেই কোশ) বসুধানঃ (বসু অর্থাৎ সম্পত্তির আধার); তস্মিন্ (তাহাতে) বিশ্বম্ ইদম্ (এই বিশ্বভুবন) শ্রিতম্ (আশ্রিত, স্থিত)।
সরলার্থ : এই যে কোশ—অন্তরিক্ষ ইহার উদয়, ভূমি ইহার নিম্নভাগ, ইহা কখন জীর্ণ হয় না। দিসমূহ ইহার পার্শ্ব (বা কোণ), অন্তরিক্ষ ইহার উপরের দিকের মুখ। এই কোশ এক ধনভাণ্ডার, এই বিশ্বভুবন ইহাতে অবস্থিত।
২৫১. তস্য প্রাচী দিক্ জুহূর্নাম সহমানা নাম দক্ষিণা রাজ্ঞী নাম প্রতীচী সুভূতা নমোদীচী তাসাং বায়ুর্বৎসঃ স য এতমেবং বায়ুং দিশাং বৎসং বেদ না পুত্ররোদং রোদিতি সোহহমেতমেবং বায়ুং দিশাং বৎসং বেদ মা পুত্ররোদং রুদম্ ॥ ২
অন্বয় : তস্য (তাহার) প্রাচী (পূর্ব) দিক্ জুহুঃ নাম; সহমানা নাম দক্ষিণা (দক্ষিণদিক); রাড্ডী নাম প্রতীচী (পশ্চিমদিক); সুভূতা নাম উদীচী (উত্তরদিক)। তাসাম্ (তাহাদিগের) বায়ুঃ বৎসঃ। সঃ যঃ (৩।৬।৩ মন্তব্য দ্রঃ) এতম্ (ইহাকে) এবম্ (এই প্রকার) বায়ুম্ (বায়ুকে) দিশাম্ (দিকসমূহের) বৎসম্ (বৎসরূপে) বেদ (জানেন), ন (না) পুত্ররোদম্ (পুত্রের মৃত্যুর জন্য রোদন) রোদিতি (রোদন করেন)। সঃ (সেই অর্থাৎ এই প্রকার অভিলাষী) অ (আমি) এতম্ এবম্ বায়ুম্ দিশাম্ বৎসম্ বেদ (জানি), মা (না) পুত্ররোদম্ (রোদন করি)।
সরলার্থ : এই কোশের পূর্বদিকে ‘জুহূ’, দক্ষিণদিক ‘সহমানা’, পশ্চিমদিক ‘রাজ্ঞী’ এবং উত্তরদিক ‘সম্ভুতা’। বায়ু ইহাদের বৎস। যিনি বায়ুকে দিকসমূহের বৎস বলিয়া জানেন, তাঁহাকে পুত্রবিয়োগের জন্য রোদন করিতে হয় না। আমি বায়ুকে দিকসমূহের বৎস বলিয়া জানি, আমাকে যেন পুত্রবিয়োগের জন্য রোদন করিতে না হয়।
মন্তব্য : শঙ্কর ‘জুহূ’, ‘সহমানা’, ‘রাজ্ঞী’ এবং ‘সুভূতা’, এই কয়েকটি কথার এইরকম ব্যাখ্যা দিয়াছেন—পূর্বমুখ হইয়া লোকে হোম করে (জুহ্বতি), এই জন্য পূর্বদিক জুহূ। যমপুরী দক্ষিণদিকে; এই যমপুরীতে পাপিগণ দুঃখ সহ্য করে (সহন্তে), এই জন্য দক্ষিণদিক ‘সহমানা’। রাজা বরুণ পশ্চিমদিকের অধিপতি, এইজন্য পশ্চিমদিক রাজ্ঞী (দিক্ শব্দ শ্রীলিঙ্গ)। সন্ধ্যাকালে পশ্চিম আকাশ রক্তবর্ণ (রাগ) ধারণ করে, এজন্যও পশ্চিম আকাশকে রাজ্ঞী বলা যাইতে পারে। ভূতিমান্ অর্থাৎ ঐশ্বর্যশালী কুবেরাদি উত্তরদিকের অধিপতি, এইজন্য উত্তরদিক সুভূতা।
২৫২. অরিষ্টং কোশং প্রপদ্যেহমুনাহমুনাহমুনা প্রাণং প্রপদ্যেহমুনাহমুনা অমুনা ভূঃ প্রপদ্যেহমুনাহমুনাহমুনা ভূবঃ প্রপদ্যেহমুনাহমুনাভুহমুনা স্বঃ প্রপদ্যেহমুনাহমুনাহমুনা ॥ ৩
অন্বয় : অরিষ্টম্ কোশম্ (অবিনাশী কোশকে) প্রপদ্যে (প্রাপ্ত হই) অমুনা, অমুনা অমুনা (অমুকের সহিত; পুত্রের নাম তিনবার উচ্চারণ করিতে হয়, সেইজন্য ‘অমুনা’ তিনবার বলা হইয়াছে)। প্রাণম্ প্রপদ্যে অমুনা অমুনা অমুনা। ভূঃ (পৃথিবীকে) প্ৰপদ্যে অমুনা অমুনা অমুনা। ভুবঃ (ভুবর্লোককে, অন্তরিক্ষকে) প্রপদ্যে অমুনা, অমুনা, অমুনা। স্বঃ (দ্যুলোককে) প্রপদ্যে অমুনা, অমুনা, অমুনা।
সরলার্থ : আমি অমুকের, অমুকের, অমুকের সহিত (এই স্থলে তিনবার পুত্রের নাম করিতে হইবে) অবিনশ্বর কোশের শরণ নিতেছি। অমুকের, অমুকের, অমুকের সহিত প্রাণের শরণ নিতেছি। অমুকের, অমুকের, অমুকের সহিত লোকের শরণ নিতেছি। অমুকের, অমুকের, অমুকের সহিত ভুবর্লোকের শরণ নিতেছি। অমুকের, অমুকের, অমুকের সহিত স্বর্গলোকের শরণ নিতেছি।
২৫৩. স যদবোচং প্রাণং প্রপদ্য ইতি প্রাণো বা ইদং সর্বং ভূতং যদিদং কিঞ্চ তমেব তৎ প্রাপৎসি ॥ ৪
অন্বয় : সঃ (সেই যে ‘আমি’) যৎ (যে) অবোচম (বলিয়াছি—) প্রাণম্ প্ৰপদ্য ইতি — প্রাণঃ বৈ ইদম্ সর্বম্ ভূতম্ যৎ (যাহা) ইদম্ (এই) কম্ + চ (কিছু)। তম্ এব তাহাকেই তৎ (সেইজন্য) প্রাপৎসি (শরণ লাভ করিয়াছি)।
সরলার্থ : আমি যে বলিয়াছি ‘প্রাণের শরণ নিতেছি’ (তাহা এইজন্য যে) সমস্ত জীবজগৎ— যাহা কিছু আছে— সে সবই প্রাণ। সেইজন্য তাহারই আশ্রয় লইয়াছি।
২৫৪. অথ যদবোচং ভূঃ প্রপদ্য ইতি পৃথিবীং প্রপদ্যেহন্তরিক্ষঃ প্রপদ্যে দিবং প্রপদ্য ইত্যেব তদবোচম্ ॥ ৫
অন্বয় : অথ যৎ অবোচম্ ভূঃ প্রপদ্যে ইতি—পৃথিবীম্ প্রপদ্যে, অন্তরিক্ষম্ প্ৰপদ্যে, দিবম্ (দ্যুলোককে) প্রপদ্যে ইতি এব তৎ (তাহাই) অবোচম্।
সরলার্থ : তাহার পর যে বলিয়াছি ‘ভূলোকের শরণ লই’—তাহা এই অর্থে বলিয়াছি যে, আমি ভূলোকের, অন্তরিক্ষের এবং দ্যুলোকের শরণ নিতেছি।
২৫৫. অথ যদবোচং ভুবঃ প্রপদ্য ইত্যগ্নিং প্রপদ্যে বায়ুং প্রপদ্য আদিত্যং প্রপদ্য ইত্যেব তদবোচম্ ॥ ৬
অন্বয় : অথ যৎ অবোচম্ ভুবঃ প্রপদ্যে ইতি অগ্নিম্ প্রপদ্যে বায়ুম্ প্ৰপদ্যে, আদিত্যম্ প্রপদ্যে ইতি এব তৎ (তাহাই) অবোচম্ (৩য়, ৪র্থ মঃ)।
সরলার্থ : তাহার পর যে বলিয়াছি ‘ভুবর্লোকের শরণ লই’—তাহাতে ইহাই (অৰ্থাৎ তাহা এই অর্থে) বলিয়াছি যে, ‘অগ্নির, বায়ুর এবং আদিত্যের শরণ নিলাম।
২৫৬. অথ যদবোচং স্বঃ প্রপদ্য ইতি ঋগ্বেদং প্রপদ্যে যজুর্বেদ প্রপদ্যে সামবেদং প্রপদ্য ইত্যেব তদবোচং তদবোচম্ ॥ ৭
অন্বয় : অথ যৎ অবোচম্ স্বঃ প্রপদ্যে ইতি—ঋগ্বেদম্ প্রপদ্যে, যজুর্বেদম্ প্ৰপদ্যে, সামবেদম্ প্রপদ্যে ইতি এব তৎ (তাহাই) অবোচম্ তৎ অবোচম্ (দ্বিরুক্তি সমাপ্তিসূচক বা উপাসনার আদরার্থ) (৩য়, ৪র্থ মঃ)।
সরলার্থ : তাহার পর যে বলিয়াছি ‘স্বর্গলোকের শরণাপন্ন হই’—তাহাতে ইহাই (অর্থাৎ তাহা এই অর্থে) বলিয়াছি যে, ‘ঋগ্বেদের, যজুর্বেদের এবং সামবেদের শরণ লইতেছি’।
ষোড়শ খণ্ড – নিজ জীবনের দীর্ঘত্ব—কামনায় পুরুষযজ্ঞ
২৫৭. পুরুষো বাব যজ্ঞস্তস্য যানি চতুর্বিংশতিবর্ষাণি তৎ প্রাতঃসবনং চতুর্বিংশত্যক্ষরা গায়ত্রী গায়ত্রং প্রাতঃসবনং তদস্য বসবোহন্বায়ত্তাঃ প্রাণা বাব বসব এতে হীদং সর্বং বাসয়ন্তি ॥ ১
অন্বয় : পুরুষঃ বা যজ্ঞঃ (যজ্ঞস্বরূপ)। তস্য যানি চতুর্বিংশতি বর্ষাণি (তাহার যে চব্বিশ বৎসর), তৎ (তাহা) প্রাতঃসবনম্ (২।২৪।১ টীকা দ্রঃ); চতুর্বিংশতি + অক্ষরা (চব্বিশ অক্ষর যুক্ত) গায়ত্রী (গায়ত্রীছন্দ); গায়ত্রম্ (গায়ত্রীছন্দ যুক্ত) প্রাতঃসবনম্। তৎ [অন্বায়ত্তাঃ] (এই প্রাতঃসবনের অনুগত) অস্য (এই পুরুষযজ্ঞের) বসবঃ (বসুগণ) অন্বায়ত্তাঃ প্রাণাঃ (প্রাণসমূহ বাগাদি ইন্দ্রিয়) বাব বসবঃ; এতে (এই প্ৰাণসমূহ) হি (যেহেতু) ইদম্ সর্বম (এই সমুদয়কে) বাসয়ন্তি (বাস করায়)।
সরলার্থ : পুরুষই যজ্ঞ। তাহার (জীবনের প্রথম) চব্বিশ বৎসর প্রাত সবনস্থানীয়; কারণ গায়ত্রীর চব্বিশটি অক্ষর এবং প্রাতঃসবনে গায়ত্রীছন্দের মন্ত্র উচ্চারণ করা হয়। বসুগণ এই যজ্ঞের প্রাতঃসবনের অনুগত প্রাণসমূহই এই বসু, কারণ ইহারাই এই সমুদয় চরাচর ভূতবর্গকে বাস করিয়া থাকে।
মন্তব্য : এখানে পুরুষকে যজ্ঞরূপে কল্পনা করিয়া উপাসনা করা হইতেছে। ঋষি বলিতেছেন— যে ‘বাস’ করায় তাহার নাম ‘বসু’। প্রাণ দেহে থাকিলেই সকলে জীবনধারণ করিতে সমর্থ হয় এবং বাস করিতে পারে। সুতরাং প্রাণ সকলকে বাস করায়; এই জন্য প্রাণই বসু।
২৫৮. তং চেদেতস্মিন্ বয়সি কিঞ্চিদুপতপেৎ স ব্লুয়াৎ প্রাণা বসব ইদং মে প্রাতঃসবনং মাধ্যন্দিনং সবনমনুসন্তনুতেতি মাহং প্রাণানাং বসূনাং মধ্যে যজ্ঞো বিলোপ্সীয়েত্যুদ্ধৈব তত এত্যগদো হ ভবতি ॥ ২
অন্বয় : তম্ (তাহাকে) চেৎ (যদি) এতস্মিন্ বয়সি (এই বয়সে; এই চব্বিশ বৎসরের মধ্যে) কিম্ + চিৎ (কিছু; ব্যাধি প্রভৃতি) উপতপেৎ (উপতপ্ত করে) সঃ ব্লুয়াৎ (বলিবে)—প্রাণাঃ (হে প্ৰাণসমূহ), বসবঃ (হে বসুগণ) ইদম্ মে প্রাতঃসবনম্ (এই আমার প্রাতঃসবনকে; অর্থাৎ জীবনের প্রথম অংশকে) মাধ্যন্দিনম্ সবনম্ (মাধ্যন্দিন সবন পর্যন্ত অর্থাৎ মধ্য জীবন পর্যন্ত) অনুসন্তনুত সম্যরূপে বিস্তৃত কর) ইতি। মা (না) অহম্ (আমি) প্রাণানাম্ বসুনাম্ মধ্যে (প্রাণরূপ বসুগণের মধ্যে) যজ্ঞঃ (যজ্ঞ অর্থাৎ আমি বিলোপ্সীয়— (যেন বিলুপ্ত হই) ইতি তৎ + হ + এব ততঃ প্রতি (উত্থিত হয়); ততঃ (সেই ব্যাধি হইতে) অগদঃ (নীরোগ) হ (ভবতি) (হয়)।
সরলার্থ : এই বয়সে (অর্থাৎ প্রথম চব্বিশ বৎসরের মধ্যে) যদি কোন ব্যাধি তাহাকে যন্ত্রণা দেয়, তবে সে বলিবে—’হে প্ৰাণসমূহ হে বসুগণ, আমার এই প্রাতঃসবনকে (অর্থাৎ জীবনের প্রথম অংশকে) মাধ্যন্দিন সবন পর্যন্ত (অর্থাৎ মধ্যজীবন পর্যন্ত) বিস্তৃত করিয়া দাও। যজ্ঞরূপী আমি যেন প্রাণরূপী বসুগণের মধ্যে বিলুপ্ত না হই। ইহা বলিলে সে সেই ব্যাধি হইতে মুক্ত হইয়া নিশ্চয়ই নীরোগ হয়।
মন্তব্য : প্রাতঃসবনকে মাধ্যন্দিন সবন পর্যন্ত বিস্তৃত করার অর্থ জীবনের প্রথম অংশকে মধ্যজীবনের সহিত সম্মিলিত করা অর্থাৎ প্রথম চব্বিশ বৎসর জীবনধারণ করিয়া মধ্যবয়সে উপনীত হওয়া।
২৫৯. অথ যানি চতুশ্চত্বারিংশদ্বর্ষাণি তন্মাধ্যন্দিনং সবনং চতুশ্চত্বারিংশদক্ষরা ত্রিষ্টুপ ত্রৈষ্টুভং মাধ্যন্দিনং সবনং তদস্য রুদ্রা অন্বায়ত্তাঃ প্রাণাঃ বাব রুদ্রা এতে হীদং সর্বং রোদয়ন্তি ॥ ৩
অন্বয় : অথ যানি (যে) চতুঃ + চত্বারিংশৎ বর্ষাণি (চুয়াল্লিশ বৎসর) তৎ (তাহা) মাধ্যন্দিনম্ সবনম্। চতুঃ চত্বারিংশৎ অক্ষরাঃ (চুয়াল্লিশটি অক্ষর) ত্রিষ্টুপ্ (ত্রিষ্টুছন্দ), ত্রৈষ্টুভম্ (ত্রিষ্টুভ্ছন্দোযুক্ত মাধ্যন্দিনম্ সবনম্। তৎ (তাহার অর্থাৎ মাধ্যন্দিন সবনের অনুগত) অস্য (এই পুরুষযজ্ঞের) রুদ্রাঃ অন্বায়ত্তাঃ প্রাণাঃ বাব রুদ্রাঃ এতে (এই প্ৰাণসমূহ) হি (যেহেতু) ইদম্ সর্বম্ (এই সমুদয়কে) রোদয়ন্তি (রোদন করায়)।
সরলার্থ : তাহার পর যে চুয়াল্লিশটি বৎসর, তাহা মাধ্যন্দিন সবনের মত। কারণ ত্রিষ্টুভ্ছন্দে চুয়াল্লিশটি অক্ষর আছে এবং মাধ্যন্দিন সবনে ত্রিষ্টুভ্ছন্দের মন্ত্র উচ্চারিত হয়। রুদ্রগণ এই মাধ্যন্দিন সবনের অনুগত। প্রাণসমূহই রুদ্র, কারণ প্রাণসমূহই সমস্তকে (জগৎকে) রোদন করাইয়া থাকে।
মন্তব্য : মধ্যম বয়সে প্রাণসমূহ ক্রুর বা নিষ্ঠুর হয়। তখন তাহারা অপরকে দুঃখ দেয় এবং রোদন করাইয়া থাকে। এইজন্যই এখানে প্রাণকে রুদ্র (ক্রূর) বলা হইয়াছে (শংকর)।
২৬০. তং চেদেতস্মিন্ বয়সি কিঞ্চিদুপতপেৎ স ব্রুয়াৎ প্রাণা রুদ্রা ইদং মে মাধ্যন্দিনং সবনং তৃতীয়সবনমনুসন্তনুতেতি মাহং প্রাণানাং রুদ্রাণাং মধ্যে যজ্ঞো বিলোপ্পীয়েত্যুদ্ধৈব তত এত্যগদো হ ভবতি ॥ ৪
অন্বয় : তম্ চেৎ এতস্মিন্ বয়সি কিঞ্চিৎ উপতপেৎ, সঃ ব্রুয়াৎ প্রাণঃ রুদ্রাঃ ইদম্ মে মাধ্যন্দিনম্ সবনম্ (আমার এই মাধ্যন্দিন সবনকে অর্থাৎ মধ্যজীবনকে তৃতীয়সবনম্ (তৃতীয়সবন পর্যন্ত অর্থাৎ জীবনের তৃতীয় অংশ পর্যন্ত) অনু-সন্তনুত ইতি। মা অহম্ প্রাণানাম্ রুদ্রাণাম্ মধ্যে (প্রাণরূপী রুদ্রগণের মধ্যে) যজ্ঞঃ বিলোপ্সীর ইতি। উৎ হ এব ততঃ এতি অগদঃ হ ভবতি (৩। ১৬।২ টীকা)।
সরলার্থ : যদি মধ্য বয়সে (ব্যাধি বা অপর) কিছু তাহাকে সন্তাপ দেয়, সে বলিবে— ‘হে প্ৰাণসমূহ, হে রুদ্রগণ, এই মাধ্যন্দিন সবনকে (অর্থাৎ আমার এই মধ্যজীবনকে) তৃতীয় সবন পর্যন্ত (অর্থাৎ শেষ জীবন পর্যন্ত) বিস্তৃত কর। যজ্ঞরূপী আমি যেন প্রাণরূপী রুদ্রগণের মধ্যে বিলুপ্ত না হই (অর্থাৎ মধ্যজীবনে আমার যেন মৃত্যু না হয়)। ইহা বলিলে সে ব্যাধি হইতে মুক্ত হইয়া নিশ্চয়ই নীরোগ হয়।
২৬১. অথ যান্যষ্টাচত্বারিংশদ্বর্ষাণি তৎ তৃতীয়সবনমষ্টাচত্বরিংশদক্ষরা জগতী জাগতং তৃতীয়সবনং তদস্যাদিত্যা অন্বায়ত্তাঃ প্রাণা বাবাদিত্যা এতে হীদং সর্বমাদদতে ॥ ৫
অন্বয় : অথ যানি অষ্টাচত্বারিংশৎ বর্ষাণি যে (আটচল্লিশ বৎসর) তৎ (তাহা) তৃতীয়সবনম্; অষ্টাচত্বারিংশৎ অক্ষরা (আটচল্লিশ অক্ষরযুক্ত) জগতী (জগতীছন্দ), জাগতম্ (জগতীছন্দোযুক্ত) তৃতীয়সবনম্। তৎ (তাহার অর্থাৎ তৃতীয় সবনের অনুগত)) অস্য আদিত্যাঃ অন্বায়ত্তাঃ। প্রাণাঃ বাব আদিত্যাঃ। এতে হি ইদম্ সর্বম্ (এই সমুদয়কে) আদদতে (গ্রহণ করে)।
সরলার্থ : তাহার পর যে আটচল্লিশ বৎসর তাহাই তৃতীয় সবনের তুল্য; কারণ জগতীছন্দে আটচল্লিশটি অক্ষর আছে এবং তৃতীয় সবনে জগতীছন্দের মন্ত্র উচ্চারিত হয়। আদিত্যগণ এই তৃতীয় সবনের অনুগত। প্রাণসমূহই আদিত্য, কারণ ইহারাই শব্দ ইত্যাদির বিষয়কে ‘আদান’ অর্থাৎ গ্রহণ করিয়া থাকে।
২৬২. তং চেদেতস্মিন্ বয়সি কিঞ্চিদুপতপেৎ স ব্লুয়াৎ প্রাণা আদিত্যা ইদং মে তৃতীয়-সবনমায়ুরনুসন্তনুতেতি মাহং প্রাণানামাদিত্যানাং মধ্যে যজ্ঞো বিলোপ্সীয়েত্যুদ্ধৈব তত এত্যগদো হৈব ভবতি ॥ ৬
অন্বয় : তম্ চেৎ এতস্মিন্ বয়সি কিঞ্চিৎ উপতপেৎ, সঃ ব্লুয়াৎ প্রাণাঃ আদিত্যাঃ ইদম্ মে তৃতীয়সবনম্ আয়ুঃ (পূর্ণায়ু পর্যন্ত) অনু-সম্ + তনুত ইতি। মা অহম্ প্রাণানাম্ আদিত্যানাম্ মধ্যে যজ্ঞঃ বিলোপ্সীয় ইতি। উৎ হ এব ততঃ এতি অগদঃ হ এব ভবতি (৪মঃ দ্রঃ)।
সরলার্থ : এই বয়সে তাহাকে যদি (ব্যাধি বা অন্য) কিছু সন্তপ্ত করে, সে এই মন্ত্র বলিবে—’হে প্ৰাণসমূহ, হে আদিত্যগণ, আমার জীবনরূপী তৃতীয় সবনকে পূর্ণায়ু পর্যন্ত বিস্তৃত কর। যজ্ঞরূপী আমি যেন প্রাণরূপী আদিত্যগণের মধ্যে বিলুপ্ত না হই তাহা হইলে সে ব্যাধি ইত্যাদি হইতে মুক্ত হইয়া নিশ্চয়ই নীরোগ হইবে।
২৬৩. এতদ্ধ স্ম বৈ তদ্ বিদ্বানাহ মহিদাস ঐতরেয়ঃ স কিং ম এতদুপতপসি যোহাহমনেন ন প্রেষ্যামীতি স হ ষোড়শং বর্ষশতমজীবৎ প্র হ ষোড়শ বর্ষশতং জীবতি য এবং বেদ ॥ ৭
অন্বয় : এতৎ (এই তত্ত্ব) হ বৈ তৎ (সেই; তৎ এতৎ বিদ্বান্—এই প্রকার অন্বয়, কিংবা তৎ + বিদ্বান্ তাহার জ্ঞাতা) বিদ্বান্ (জানিয়া) আহম (বলিয়াছিলেন) মহিদাসঃ ঐতরেয়ঃ (ইতরা নাম্নী নারীর অপত্য মহিদাস)—সঃ (সেই তুমি) কিম্ (কেন) মে (আমাকে, আমার দেহকে) এতৎ (এই প্রকারে) উপতপসি (সন্তপ্ত করিতেছ?) যঃ অহম্ (যে আমি) অনেন (ইহা অর্থাৎ এই ব্যাধি দ্বারা) ন প্রেষ্যামি (মরিব) ইতি। সঃ হ ষোড়শম্ বর্ষশতম্ (১১৬ বৎসর) অজীবৎ (জীবনধারণ করিয়াছিল)। হ ষোড়শম্ বর্ষশ- তম্ প্র জীবীত (জীবন ধারণ করে) যঃ এবম্ বেদ
সরলার্থ : ইতরার পুত্র মহিদাস এই তত্ত্ব জানিয়া বলিয়াছিলেন—’তুমি কেন আমাকে এইভাবে সন্তপ্ত করিতেছ? আমি ত ইহাতে মরিব না।’ তিনি ১১৬ বৎসর জীবনধারণ করিয়াছিলেন। যিনি ইহা জানেন তিনি ১১৬ বৎসর বাঁচেন।
মন্তব্য : মহিদাসঃ ঐতরেয়ঃ—শঙ্কর ও সায়ণ বলেন যে, ‘ইতরা’ নারীর অপত্য—এই অর্থে ‘ঐতরেয়’। কেহ কেহ বলেন ‘ঐতরেয়’ অর্থ ‘ইতর’ নামক পুরুষের অপত্যও হইতে পারে (Vedic Index; M. W. অভিধান)।
সপ্তদশ খণ্ড – পুরুষযজ্ঞ—দেবকীনন্দন কৃষ্ণ
২৬৪. স যদশিশিষতি যৎ পিপাসতি যত্ন রমতে তা অস্য দীক্ষাঃ ॥ ১
অন্বয় : সঃ (সেই যজ্ঞরূপী পুরুষ) যৎ (যে) অশিশিষতি (ভোজন করিতে ইচ্ছা করে), যৎ পিপাসতি (পান করিতে ইচ্ছা করে), যৎ ন রমতে (আনন্দ উপভোগ করে না), তাঃ (সেই সমুদয়) অস্য (এই পুরুষের) দীক্ষাঃ (জীবনযজ্ঞের দীক্ষা)।
সরলার্থ : পুরুষ যে ভোজন করিতে ইচ্ছা করে, পান করিতে ইচ্ছা করে এবং আনন্দ উপভোগ হইতে বিরত থাকে—এই সবই (জীবনযজ্ঞের দীক্ষা)
২৬৫. অথ যদশাতি যৎ পিবতি যদ্ রমতে তদুপসদৈরেতি ॥ ২
অন্বয় : অথ (তাহার পর) যৎ অশ্নাতি (ভোজন করে) যৎ পিবতি (পান করে) যৎ রমতে, তৎ উপসদৈঃ (উপসদসকলের সহিত) এতি (লাভ করে, সাম্য লাভ করে)। সরলার্থ : তাহার পর পুরুষ যে ভোজন করে, পান করে এবং সুখ অনুভব করে, তাহা উপসদসমূহের তুল্য।
মন্তব্য : উপসদৈঃ—’উপসদ’ জ্যোতিষ্টোম যজ্ঞের এক অংশ। দীক্ষার সময়ে ভোজনাদি নিষেধ; উপসদের সময়ে দুগ্ধাদি পানের বিধি আছে।
২৬৬. অথ যদ্ধসতি যক্ষতি যন্মৈথুনং চরতি স্তুতশত্রৈরেব তদেতি ॥ ৩
অন্বয় : অথ যৎ হসতি (হাস্য করে), যৎ জক্ষতি (ভোজন করে) যৎ মৈথুনম্ (মিথুনের ভাব) চরতি (আচরণ করে), স্তুতশত্রৈঃ (স্তুত ও শস্ত্রের সহিত; ‘স্তুত’ ও ‘শস্ত্র’ যজ্ঞের অংশবিশেষ) এব তৎ (হাস্যাদি) এতি (‘সাদৃশ্য’ লাভ করে)।
সরলার্থ : তাহার পর পুরুষ যে হাসে, খায় এবং মিথুনভাবে আচরণ করে, তাহা স্তুত ও শস্ত্র নামে যজ্ঞাংশের তুল্য।
২৬৭. অথ যত্তপো দানমার্জবমহিংসা সত্যবচনমিতি তা অস্য দক্ষিণাঃ ॥ ৪
অন্বয় : অথ যৎ তপঃ দানম্ আর্জবম্ (সরলতা) অহিংসা সত্যবচনম্ ইতি -তাঃ (এই সমুদয়) অস্য (পুরুষরূপী যজ্ঞের) দক্ষিণাঃ।
সরলার্থ : তাহার পর তপস্যা, দান, সরলতা, অহিংসা এবং সত্যবাদিকা পুরুষরূপী যজ্ঞের দক্ষিণা।
২৬৮. তস্মাদাহুঃ সোষ্যত্যসোষ্টেতি পুনরুৎপাদনমেবাস্য তন্মরণমেবা-বভূথঃ ॥ ৫
অন্বয় : তস্মাৎ (সেইজন্য) আহুঃ (বলা হয়)— সোষ্যতি (প্রসব করিবে বা সোম অভিষব করিবে), অসোষ্ট (প্রসব করিয়াছে বা সোম অভিষব করিয়াছে) ইতি; পুনঃ (আবার) উৎপাদনম্ (উৎপত্তি) এব অস্য (মানবের বা যজ্ঞের)। তৎ মরণম্ এব (মানবের মৃত্যুই) অবভূথঃ (যজ্ঞসমাপ্তির পর স্নান ও যজ্ঞপাত্রাদি (ধৌতকরণ)।
সরলার্থ : সেইজন্য (উভয়ের বিষয়েই) লোকে বলে সন্তান প্রসব করিবে বা সোম অভিষব করিবে, সন্তান উৎপন্ন করিয়াছে বা সোম অভিষব করিয়াছে। আবার (উভয়ের বিষয়েই বলা যাইতে পারে)— ইহাই এর উৎপত্তি। সেই পুরুষের মৃত্যুই ‘অবভূত্থ’ (অর্থাৎ যজ্ঞসমাপ্তির পরা স্নান)।
মন্তব্য : ‘সোষ্যতি’ এবং ‘অসোষ্ট’ শব্দদ্বয়ের দুইটি করিয়া অর্থ। কোন প্রসূতির সম্বন্ধে প্রযুক্ত হইলে ইহাদের অর্থ যথাক্রমে ‘প্রসব করিবে’ এবং ‘প্রসব করিয়াছে। যজ্ঞ সম্বন্ধে উক্ত হইলে অর্থ ‘সোম অভিষব করিবে’ এবং ‘সোম অভিষব করিয়াছে’। মানুষের পক্ষে ইহারা জন্ম বুঝায়, যজ্ঞের সম্বন্ধে বুঝায় সোমরসের উৎপত্তি।
পুনঃ উৎপাদনম্ এব—ইহার অর্থ সম্বন্ধে মতভেদ আছে। ভিন্ন ভিন্ন অর্থ এই— (১) পুনঃ অর্থ পুনর্বার যজ্ঞবিষয়ে যে ‘সোষ্যতি’ ও ‘অসোষ্ট’ ব্যবহৃত হয়, তাহাই মানুষের পক্ষে উৎপাদনম্ (জন্ম), অর্থাৎ একই বাক্যের অর্থ সোমের উৎপত্তি, আবার মানুষের উৎপত্তি। এখানে উৎপত্তি বিষয়ে মানুষের সাদৃশ্য রহিয়াছে। (২) পুনঃ উৎপাদনম্—নবজন্ম। (৩) মানুষের নিজের জন্ম হইল উৎপত্তি বা প্রথম উৎপত্তি। যখন তাহার পুত্র হয় তখন সে নিজেই যেন পুত্ররূপে আবার জন্মায়। তাই তাহাকে তাহার পুনর্বার উৎপত্তি বলা যায়। (৪) তাহা পিতা হইতে উৎপাদন বা জন্মলাভের পর মাতা হইতে উৎপাদন বা জন্মলাভ।
ঋষি মানবজীবনের বিশেষ বিশেষ ঘটনার সহিত যজ্ঞসংক্রান্ত বিশেষ বিশেষ ঘটনার সাদৃশ্য দেখাইয়াছেন। কিন্তু এস্থলে কেবল যে ঘটনারই সাদৃশ্য রহিয়াছে, তাহা নহে, ভাষারও সাদৃশ্য রহিয়াছে। উভয়ের বিষয়ই ‘সোষ্যতি’ এবং ‘অসোষ্ট’ ব্যবহার করা যাইতে পারে; আবার ‘উৎপাদন` শব্দও উভয়ের বিষয়েই ব্যবহৃত হইয়া থাকে। ‘পুনঃ’ শব্দর অর্থ ‘আবার’, ‘এবং’ ইত্যাদি।
২৬৯. তদ্ধৈতঘোর আঙ্গিরসঃ কৃষ্ণায় দেবকীপুত্রায়োক্তোবাচাপিপাস এব স বভূব সোহন্তবেলায়ামেতৎ ত্রয়ং প্রতিপদ্যেতাক্ষিতমস্যচ্যুতমসি প্রাণসংশিতমসীতি তত্ৰৈতে দ্বে ঋচৌ ভবতঃ ॥ ৬
অন্বয় : তত্ হ এতৎ (সেই এই তত্ত্বকে) ঘোরঃ আঙ্গিরস : (অঙ্গিরা বংশোদ্ভব ঘোর নামক ঋষি) কৃষ্ণায় দেবকীপুত্রায় (দেবকীনন্দন কৃষ্ণকে) উক্তা (বলিয়া) উবাচ (উপদেশ দিয়াছিলেন) অপিপাসঃ পিপাসাবিহীন, নিঃস্পৃহ) এব সঃ (কৃষ্ণ) বভূব (হইয়াছিলেন)। সঃ (মানুষ) অন্তবেলায়ম্ (মৃত্যুকালে এতৎ ত্রয়ম্ (এই তিন মন্ত্রকে প্রতিপদ্যেত (শরণ গ্রহণ করিবে)—অক্ষিতম্ (অক্ষয়) অসি (হও); অচ্যুতম্ (অচ্যুত, অপরিবর্তনীয়) অসি; প্রাণ-সংশিতম্ (প্রাণের সূক্ষ্মতত্ত্ব) অসি ইতি। তত্র (সে বিষয়ে) এতে দ্বৌ ঋচৌ (এই দুই ঋক্) ভবতঃ।
সরলার্থ : ঘোর আঙ্গিরস ঋষি দেবকীনন্দন কৃষ্ণকে এই তত্ত্ব উপদেশ দিয়াছিলেন। (ইহা শুনিয়া) কৃষ্ণ (সর্ববিষয়ে) নিঃস্পৃহ হইয়াছিলেন। (ঘোর আঙ্গিরস বলিয়াছিলেন) মৃত্যুকালে মানুষ এই তিন মন্ত্র উচ্চারণ করিবে— তুমি অক্ষয়, তুমি অচ্যুত, তুমি প্রাণসংশিত। এ বিষয়ে এই দুইটি ঋক্ আছে—
মন্তব্য : এই মন্ত্রে দেবকীনন্দন কৃষ্ণের উল্লেখ রহিয়াছে। ইনিই মহাভারতের কৃষ্ণ কিনা সে বিষয়ে মতভেদ আছে। ঋগ্বেদেও কৃষ্ণ নামে এক ঋষির নাম পাওয়া যায়। আঙ্গিরস কৃষ্ণ ৮।৮৫ সংখ্যক (বালখিল্য মন্ত্র বাদ দিলে ৮।৭৪) মন্ত্রের রচয়িতা। সেন্টপিটার্সবর্গ অভিধানের মতে এই আঙ্গিরস কৃষ্ণ এবং দেবকীনন্দন কৃষ্ণ একই কৃষ্ণ। প্রাণ—সংশিতম্—শঙ্করের মতে ইহার অর্থ ‘প্রাণের সূক্ষ্মতত্ত্ব’। ‘সংশিত’ অর্থ তীক্ষ্ণকৃত। ‘প্রাণসংশিত’ অর্থ প্রাণ দ্বারা তীক্ষ্ণকৃত অর্থাৎ সঞ্জীবিত। মৃত্যুর পর দেহ নষ্ট হইয়া যায় বটে, কিন্তু অক্ষয় অচ্যুত অবিনশ্বর একটি বস্তু বর্তমান থাকে। ইহারই নাম আত্মা। এই বস্তুকেই এখানে প্রাণসংশিত, অর্থাৎ ‘মৃত্যুর পর যাহা থাকে তাহা প্রাণ দ্বারা সঞ্জীবিত।” কেহ কেহ ‘প্রাণসংশিতম্’ স্থলে ‘প্রাণশংসিতম্’ পাঠ গ্রহণ করিয়া ইহার অর্থ করেন প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয়তর বা সুখকর।
২৭০. আদিপ্রত্নস্য রেতসো জ্যোতিস্পশ্যন্তি বাসরম্ পরো যদিধ্যতে দিবি উদ্বয়ন্তমসস্পরি জ্যোতিঃ পশ্যন্তা উত্তরং স্বঃ পশ্যন্ত উত্তরং দেবং দেবত্রা সূর্যমগন্ম জ্যোতিরুত্তমমিতি জ্যোতিরুত্তমমিতি ॥ ৭
অন্বয় : (১) আৎ + ইৎ (সায়ণের মতে আদিৎ অনন্তর। শঙ্করের মতে ‘ৎ’ এবং ‘ইৎ’ অর্থশূন্য অংশ, কেবল উচ্চারণের জন্য ব্যবহৃত হইয়াছে; অবশিষ্ট থাকে আ; এই আ ‘পশ্যন্তি’ ক্রিয়ার সহিত যুক্ত) প্রত্নস্য (পুরাতন) রেতসঃ (জগতের বীজভূত সত্তার) জ্যোতিঃ (প্রকাশ) পশ্যন্তি (দর্শন করেন; আ পশ্যন্তি— চতুর্দিকে দর্শন করেন বাসরম্ (দিবালোকের ন্যায় সর্বব্যাপী) পরঃ (সর্বশ্রেষ্ঠ), যৎ (যাহা) ইধ্যতে (দীপ্তি পায়) দিবি (দ্যুলোকে; শঙ্করের মতে ‘পরব্রহ্মে’) [ঋগ্বেদ ৮।৬।৩০]। (২) উৎ (+ অগন্ম, বেদার্থযত্নের মতে উৎ + পশ্যন্তি) বয়ম্ (আমরা) তমসঃ পরি (অন্ধকারের উপরে) জ্যোতিঃ পশ্যন্তঃ (দর্শন করিয়া), উত্তরম্ (শ্রেষ্ঠ) স্বঃ (স্বীয় আত্মাতে বর্তমান) পশ্যন্তঃ উত্তরম্ দেবম্ (দেবতাকে; দ্যুতিযুক্তকে) দেবত্রা (দেবগণের মধ্যে) সূর্যম্ অগন্ম (লাভ করিয়াছি; বৈদিক প্রয়োগ) জ্যোতিঃ উত্তমম্ (সর্বশ্রেষ্ঠ জ্যোতিকে) ইতি জ্যোতিঃ উত্তমম্ ইতি (দ্বিরুক্তি) [ঋগ্বেদ ১।৫০।১০]।
সরলার্থ : যে জ্যোতি দ্যুলোকে (কিংবা পরব্রহ্মে) দীপ্তি পাইতেছে, (ব্ৰহ্মবিদ্গণ) জগতের বীজরূপী এবং দিবালোকের মত সর্বব্যাপী, পুরাতন ও জগৎকারণ সেই পরমজ্যোতি দেখেন। অজ্ঞানরূপ অন্ধকারের অতীত যে শ্রেষ্ঠ জ্যোতি, তাহাকে নিজের হৃদয়ে নিহিত শ্রেষ্ঠ জ্যোতিরূপে দেখিয়া আমরা দেবগনের মধ্যে দ্যুতিমান পরমেশ্বর সর্বোঙম জ্যোতিকেই লাভ করিয়াছি।
মন্তব্য : ১। ৫০।১০ ঋকে ‘স্বঃ পশ্যন্তঃ উত্তরম্’ অংশ নাই; উপনিষদে ইহা সংযোগ করা হইয়াছে। ঋগ্বেদে এই অংশের অর্থ এই— ‘(রজনীর) অন্ধকারের উপরিভাগে যে শ্রেষ্ঠ জ্যোতি (বিরাজমান), সেই জ্যোতি দর্শন করিয়া আমরা দেবগণের মধ্যে দ্যুতিমান সূর্যকে— সেই জ্যোতিকে লাভ করিয়াছি।’ উপরোক্ত ঋক্টি যজুর্বেদে ও অথর্ববেদে কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত আকারে গৃহীত হইয়াছে।
অষ্টাদশ খণ্ড – মন, আকাশ প্রভৃতিতে ব্ৰহ্মদৃষ্টি
২৭১. মনো ব্রহ্মেত্যুপাসীতেত্যধ্যাত্মমথাধিদৈবতমাকাশো ব্রহ্মেত্যুভয়মাদিষ্টং ভবত্যধ্যাত্মং চাধিদৈবতং চ ॥ ১
অন্বয় : মনঃ ব্রহ্ম ইতি উপাসীত (উসাসনা করিবে) ইতি অধ্যাত্মম্ (ইহাই অধ্যাত্ম অর্থাৎ দেহসংক্রান্ত উপাসনা)। অথ (অনন্তর) অধিদৈবতম্ (অধিদৈবত অর্থাৎ দেবতা- সংক্রান্ত উপাসনা)—অকাশঃ ব্রহ্ম ইতি। উভয়ম্ (উভয়) আদিষ্টম্ (উপদিষ্ট) ভবতি (হইল) অধ্যাত্মম্ চ অধিদৈবতম্ চ।
সরলার্থ : ‘মনই ব্রহ্ম’ এইরূপ উপাসনা করিবে—ইহাই দেহসংক্রান্ত (অধ্যাত্ম) উপাসনা। এইবার দেবতাসংক্রান্ত (অধিদৈবত) উপাসনা বলা হইতেছে—’আকাশই ব্রহ্ম’। অধ্যাত্ম ও অধিদৈবত উভয় উপাসনাই বলা হইল।
২৭২. তদেতচ্চতুষ্পাদ্ ব্রহ্ম বাক্ পাদঃ প্রাণঃ পাদশ্চক্ষুঃ পাদঃ শ্রোত্রং পাদ ইত্যধ্যাত্মমথাধিদৈবতমগ্নিঃ পাদো বায়ুঃ পাদ আদিত্যঃ পাদ্যো দিশঃ পাদ ইত্যুভয়মেবাদিষ্টং ভবত্যধ্যাত্মং চৈবাধিদৈবতং চ ॥ ২
অন্বয় : তৎ এতৎ (সেই এই) চতুষ্পাৎ (চারিপদ-বিশিষ্ট) বন্ধ-বাক্ পাদঃ (একপাদ); প্রাণঃ পাদঃ; চক্ষুঃ পাদঃ; শ্রোত্রম্ পাদঃ ইতি অধ্যাত্মম্। অথ অধদৈবতম্— অগ্নিঃ পাদঃ; বায়ুঃ পাদঃ; আদিত্যঃ পাদঃ; দিশঃ (দিকসমূহ) পাদঃ ইতি। উভয়ম্ এব আদিষ্টম্ ভবতিঅধ্যাত্মম্ চ এব অধিদৈবতম্ চ।
সরলার্থ : এই ব্রহ্ম চতুষ্পাদ—বাগিন্দ্রিয় একপাদ, প্রাণ (অর্থাৎ ঘ্রাণেন্দ্রিয়) একপাদ, চক্ষু একপাদ এবং কর্ণ একপাদ। ইহাই অধ্যাত্ম উপাসনা। এইবার অধিদৈবত উপাসনা বলা হইতেছে—অগ্নি, বায়ু, আদিত্য এবং দিসমূহ প্রত্যেকে একপাদ। অধ্যাত্ম ও অধিদৈবত—উভয় উপাসনাই বলা হইল।
২৭৩. বাগেব ব্রহ্মণশ্চতুর্থঃ পাদঃ সোহগ্নিনা জ্যোতিষা ভাতি চ তপতি চ ভাতি চ তপতি চ কীৰ্তা যশসা ব্রহ্মবর্চসেন য এবং বেদ ॥ ৩
অন্বয় : বাক্ এব ব্রহ্মণঃ (ব্রহ্মের) চতুর্থঃ পাদঃ। সঃ (সেই বাক্যরূপ পাদ) অগ্নিনা জ্যোতিষা (অগ্নিরূপ জ্যোতি দ্বারা) ভাতি চ (দীপ্তি পায়) তপতি চ (তাপ দান করে)। ভাতি চ তপতি চ কীর্ত্যা (কীর্তিদ্বারা) যশসা (যশ দ্বারা) ব্রহ্মবর্চসেন (বেদজ্ঞানজনিত তেজ দ্বারা, ২।১৬।২ মন্তব্য) যঃ (যিনি) এবম্ (এই প্রকার) বেদ (জানেন)।
সরলার্থ : বাক্ ব্রহ্মের চতুর্থ পাদ। বাপ সেই চরণ অগ্নিরূপ জ্যোতিতে দীপ্তি পায় এবং তাপ দেয়। যিনি ইহা জানেন তিনি কীর্তি, যশ ও বেদজ্ঞানের তেজে দীপ্তি পান এবং তাপ দেন।
২৭৪. প্রাণ এব ব্রহ্মণশ্চতুর্থঃ পাদঃ স বায়ুনা জ্যোতিষা ভাতি চ তর্পিত চ ভাতি চ তপতি চ কীৰ্তা যশসা ব্রহ্মবর্চসেন য এবং বেদ ॥ ৪
অন্বয় : প্রাণঃ (ঘ্রাণেন্দ্রিয়) এব ব্রহ্মণঃ চতুর্থঃ পাদঃ। সঃ বায়ুনা জ্যোতিষা (বায়ুরূপ জ্যোতি দ্বারা) ভাতি চ তপতি চ। ভাতি চ তপতি চ কীৰ্তা যশসা ব্ৰহ্মবর্চসেন, যঃ এবম্ বেদ (৩য় মন্ত্রের টীকা)।
সরলার্থ : প্রাণই (অর্থাৎ ঘ্রাণেন্দ্রিয়ই) ব্রহ্মের চতুর্থ পাদ। প্রাণরূপী সেই পাদ বায়ুরূপ জ্যোতিতে দীপ্তি পায় এবং তাপ দেয়। যিনি ইহা জানেন তিনি কীর্তি, যশ ও ব্রহ্মতেজে দীপ্তি পান এবং তাপ দেন।
২৭৫. চক্ষুরেব ব্রহ্মণশ্চতুর্থঃ পাদঃ স আদিত্যেন জ্যোতিষা ভাতি চ তপতি চ ভাতি চ তপতি চ কীৰ্তা যশসা ব্রহ্মবর্চসেন য এবং বেদ ॥ ৫
অন্বয় : চক্ষুঃ এব ব্রহ্মণঃ চতুর্থঃ পাদঃ। সঃ আদিত্যেন জ্যোতিষা (আদিত্যরূপ জ্যোতি দ্বারা) ভাতি চ তপতি চ। ভাতি চ তপতি চ কীৰ্তা যশসা ব্রহ্মবর্চসেন যঃ এবম্ বেদ (৩য় মন্ত্রের টীকা)।
সরলার্থ : চক্ষুই ব্রহ্মের চতুর্থ পাদ। চক্ষুরূপ সেই পাদ আদিত্যরূপ জ্যোতিতে দীপ্তি পায় এবং তাপ দেয়। যিনি ইহা জানেন, তিনি কীর্তি, যশ ও ব্রহ্মতেজে তেজস্বী হন এবং তাপ দেন।
২৭৬. শ্রোত্রমেব ব্রহ্মণশ্চতুর্থঃ পাদঃ স দিভির্জ্যোতিষা ভাতি চ তপতি চ ভাতি চ তপতি চ কীৰ্তা যশসা ব্রহ্মবর্চসেন য এবং বেদ য এবং বেদ ॥ ৬
অন্বয় : শ্রোত্রম্ এব ব্রহ্মণঃ চতুর্থঃ পাদঃ। সঃ দিভিঃ জ্যোতিষা (দিপ জ্যোতিদ্বারা) ভাতি চ তপতি চ। ভাতি চ তপতি চ কীৰ্তা যশসা ব্রহ্মবর্চসেন যঃ এবম্ বেদ, যঃ এবম্ বেদ (দ্বিরুক্তি সমাপ্ত্রিচক)।
সরলার্থ : কর্ণই ব্রহ্মের চতুর্থ পাদ। কর্ণরূপ এই পাদ দিপ জ্যোতিতে দীপ্তি পায় ও তাপ দেয়। যিনি ইহা জানেন তিনি কীর্তি, যশ ও ব্রহ্মতেজে তেজস্বী হন এবং তাপ দেন।
ঊনবিংশ খণ্ড – আদিত্যে ব্ৰহ্মদৃষ্টি
২৭৭. আদিত্যো ব্রহ্মেত্যাদেশস্তস্যোপব্যাখ্যানমসদেবেদমগ্র আসীত্তৎ সদাসীত্তৎ সমভবৎ তদাণ্ডং নিরবর্তত তৎ সংবৎসরস্য মাত্ৰামশয়ত তন্নিরভিদ্যত তে আণ্ডকপালে রজতং চ সুবর্ণং চাভবতাম্ ॥ ১
অন্বয় : আদিত্যঃ ব্রহ্ম ইতি আদেশঃ (এই উপদেশ); তস্য উপব্যাখ্যানম্ (ব্যাখ্যা) অসৎ এব (অসৎই; নামরূপবিহীন) ইদম্ (এই জগৎ) অগ্রে (পূর্বে) আসীৎ (ছিল)। তৎ (তাহা) সৎ (সূক্ষ্ম সত্তাবান্) আসীৎ (হইল)। তৎ সম্ + অভবৎ (সম্ভূত হইল); তৎ আণ্ডম্ (বৈদিক প্রয়োগ, অণ্ডম্) নিরবর্তত (পরিণত হইল); তৎ সম্বৎসরস্য (এক বৎসরের) মাত্রাম্ (পরিমাণে) অশয়ত (নিশ্চল অবস্থায় রহিল, যেমন লোকে শয়ন করিয়া থাকে); তৎ নিরভিদ্যত (বিভক্ত হইল); তে (সেই দুই) আণ্ডকপালে (অণ্ডের দুইভাগ, কপাল— ডিম্বের খোসা) রজতম্ চ (রজতময়) সুবর্ণম্ চ (সুবর্ণময়) অভবতাম্ (হইল)।
সরলার্থ : আদিত্যই ব্ৰহ্ম— ইহাই উপদেশ। ইহার বিস্তৃত ব্যাখ্যা এই—এই (জগৎ) পূর্বে অসৎ বা নামরূপহীন ছিল। তাহা সৎ (অর্থাৎ সূক্ষ্ম সত্তাবান্) এবং ডিম্বরূপে পরিণত হইল। এক বৎসরকাল স্পন্দনহীন অবস্থায় থাকিয়া সেই ডিম্ব বিভক্ত হইল। ডিম্বের একভাগ রজতময়, অপরভাগ সুবর্ণময় হইল।
২৭৮. তদ্ যদ্ৰজতং সেয়ং পৃথিবী, যৎ সুবর্ণং সা দ্যৌযজ্জরায়ু তে পর্বতা যদুল্বং সমেঘো নীহারো যা ধমনয়স্তা নদ্যো যদ্বাস্তেয়মুদকং স সমুদ্রঃ ॥ ২
অন্বয় : তৎ যৎ (সেই যে) রজতম্, সা (তাহা) ইয়ম্ পৃথিবী (এই পৃথিবী); (যাহা সুবর্ণম্, সা দ্যৌঃ (দ্যুলোক); যৎ জরায়ুঃ তে (তাহা) পর্বতাঃ; যৎ উল্বম্ (সূক্ষ্মগর্ভবেষ্টন) সমেঘঃ (মেঘসহ) নীহারঃ (হিম); যাঃ (যাহা) ধমনয়ঃ (ধমনীসমূহ) তাঃ (তাহা) নদ্যঃ (নদী সমুদয়); যৎ বাস্তেয়ম্ (বস্তিতে অর্থাৎ মূত্রাশয়ে উৎপন্ন উদকম্ (জল) সঃ (তাহা) সমুদ্ৰঃ।
সরলার্থ : সেই রজতময় অংশ এই পৃথিবী, সুবর্ণময় অংশ দ্যুলোক, জরায়ু হইল পর্বতসমূহ, উল্ব (অর্থাৎ সূক্ষ্মগর্ভ—বেষ্টন) মেঘ ও তুষার, ধমনী নদীসমূহ আর বস্তি- প্রদেশের জলই হইল সমুদ্র।
২৭৯. অথ যত্তদজায়ত সোঽসাবাদিত্যস্তং জায়মানং ঘোয়া উলূলবোহনূদতিষ্ঠন্ সর্বাণি চ ভূতানি সর্বে চ কামাস্তস্মাত্তস্যোদয়ং প্রতি প্রত্যায়নং প্রতি ঘোষা উলূলবোহনূতিষ্ঠন্তি সর্বাণি চ ভূতানি সর্বে চ কামাঃ ॥ ৩
অন্বয় : অথ যৎ তৎ (এই যাহা) অজায়ত (জন্মাইল), সঃ অসৌ (এই) আদিত্যঃ। তম্ জায়মানম্ [অনু] (তাঁহাকে জাত হইতে দেখিয়া) ঘোষাঃ (শব্দ) উলূলবঃ (উলূলু, উলু উলু এই ধ্বনি) অনু-উৎ + অতিষ্ঠন্ (উত্থিত হইয়াছিল) সর্বাণি চ ভূতানি (সমুদয় ভূত) সর্বে চ কামাঃ (সমুদয় কাম্যবস্তু)। তস্মাৎ (সেই জন্য) তস্য উদয়ম্ প্রতি (তাহার উদয়কে লক্ষ করিয়া) প্রতি+অয়নম্ প্রতি (অস্তগমনকে লক্ষ করিয়া) ঘোষাঃ উলূলবঃ অনূতিষ্ঠন্তি (উৎপন্ন হয়) সর্বাণি চ ভূতানি, সর্বে চ কামাঃ
সরলার্থ : তারপর উৎপন্ন হইল এই সূর্য। তিনি উৎপন্ন হইলে ‘উলু উলু ধ্বনি উঠিল এবং সমুদয় ভূত ও কাম্যবস্তু উৎপন্ন হইল। এই জন্য সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় উলুধ্বনি এবং সকল জীব ও কাম্যবস্তু উত্থিত হয়।
মন্তব্য : উলূলবঃ— শঙ্করাচার্য বলেন উলূলবঃ = ‘উরূরবঃ’ অর্থ বিস্তীর্ণরবঃ। আনন্দগিরির অর্থ দেশবিশেষে প্রসিদ্ধ উৎসবধ্বনি। অথর্ববেদে অনুরূপ অর্থে উলূলয়ঃ (উলুলি শব্দ) ব্যবহৃত হইয়াছে। চতুর্থ মন্ত্রে সাধবঃ ঘোষাঃ (অর্থাৎ মঙ্গলধ্বনি) ব্যবহৃত হইয়াছে। এইসব বিবেচনা করিয়া মনে হয় ‘উলূলবঃ’ শব্দের অর্থ মঙ্গলধ্বনি।
২৮০. স য এতমেবং বিদ্বানাদিত্যং ব্রহ্মেত্যুপাস্তেহভ্যাশো হ যদেনং সাধবো ঘোষা আ চ গচ্ছেয়ুরূপ চ নিম্রেড়েরন্নিম্রেড়েরন্ ॥ ৪
অন্বয় : সঃ যঃ (যে কেহ) এতম্ (ইহাকে) এবম্ (এই প্রকার) বিদ্বান্ (জানিয়া) আদিত্যম্ (আদিত্যকে) ব্রহ্ম ইতি (ব্রহ্ম এইরূপে) উপাস্তে (উপাসনা করে), অভ্যাশঃ (শীঘ্র; কিংবা ‘ফল’) হ যৎ এনম্ (ইহাকে, ইহার নিকটে) সাধবঃ ঘোষাঃ (মঙ্গলধ্বনি) আ চ গচ্ছেয়ুঃ (উপস্থিত হয়) উপ চ নিম্রেড়েরন (উপ + নি + মেডু + ঈরন্ = সুখী করে) নিমেড়েরন্।
সরলার্থ : যিনি সূর্যদেবকে এইরকম জানিয়া তাঁহাকেই ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, সরল মঙ্গলধ্বনি যাইয়া তাঁহাকে সুখ দেয়।