ছান্দোগ্য উপনিষদ – চতুর্থ অধ্যায়
চতুর্থ অধ্যায়
প্ৰথম খণ্ড – জানশ্রুতি পৌত্রায়ণ ও রৈব্বের আখ্যায়িতা (১)
২৮১. জানশ্রুতিই পৌত্রায়ণঃ শ্রদ্ধাদেয়ো বহুদায়ী বহুপাক্য আস স হ সর্বত আবসথান্ মাপয়াঞ্চক্রে সর্বত এব মেহন্নমৎস্যন্তীতি ॥ ১
অন্বয় : জানশ্রুতিঃ হ পৌত্রায়ণঃ (জনশ্রুতের বংশধর এবং প্রপৌত্র) শ্ৰদ্ধাদেয়ঃ (যিনি শ্রদ্ধায় সহিত দান করেন) বহুদায়ী (যিনি বহু দান করেন) বহুপাক্যঃ (ভোজন করাইবার জন্য যিনি বহু পাক করান) আস (ছিলেন)। সঃ (তিনি) হ সর্বতঃ (সর্বদিকে) আবসথান্ (পান্থশালাসমূহকে) মাপয়াঞ্চক্রে (প্রস্তুত করাইয়া ছিলেন) সর্বতঃ এব মে অন্নম্ (আমার অন্নকে) অৎস্যন্তি (অদ্; ভক্ষণ করিবে) ইতি।
সরলার্থ : জানশ্রুতি পৌত্রায়ণ শ্রদ্ধা সহকারে বহু দান করিতেন। (অতিথিদিগকে ভোজন করাইবার জন্য) তিনি বহু অন্ন পাক করাইতেন। ‘সকলে আমার অন্ন ভোজন করিবে’— এই উদ্দেশ্যে তিনি সর্বত্র পান্থশালা নির্মাণ করাইয়াছিলেন।
মন্তব্য : জানশ্রুতি পৌত্রায়ণঃ ইহার নানা অর্থ হইতে পারেঃ (ক) জনশ্রুতের বংশধর ও প্রপৌত্র। (খ) পুত্রায়ণ—গোত্রীয় জানশ্রুতি; জানশ্রুতি–জানশ্রুতের পুত্র।
২৮২. অথ হ হংসা নিশায় মতিপেতুস্তদ্ধৈবং হংসো হংসমভ্যুবাদ হো হোহয়ি ভল্লাক্ষ ভল্লাক্ষ জানশ্রুতেঃ পৌত্রায়ণস্য সমং দিবা জ্যোতিরাততং তন্মা প্রসাঙ্ক্ষীস্তত্ত্বা মা প্রধাক্ষীরিতি ॥ ২
অন্বয় : অথ হ হংসাঃ নিশায়াম্ (রাত্রিতে) অতিপেতুঃ (উড়িয়া গেল; শঙ্করের মতে ‘পতিত হইল’ অর্থাৎ জানশ্রুতির দৃষ্টিপথে পতিত হইল)। তৎ (সেই সময়ে) হ এবম্ (এই প্রকার) হংসঃ (এক হংস) হংসম্ (অপর হংসকে) অভ্যুবাদ (সম্বোধন করিয়া বলিল) হো! হো! অয়ি! (সম্বোধনসূচক অব্যয়) ভল্লাক্ষ! ভল্লাক্ষ! জানশ্রুতেঃ পৌত্রায়ণস্য (জানশ্রুতি পৌত্রায়ণের) সমম্ দিবা (দ্যুলোকের ন্যায়, আকাশের ন্যায়, বা দিবসের ন্যায়) জ্যোতিঃ আততম্ (বিস্তৃত হইয়াছে); তৎ (তাহাকে) মা (না) প্রসাঙ্ক্ষীঃ (স্পর্শ করিবে), তৎ (সেই জ্যোতি) ত্বা (তোমাকে) মা প্রধাক্ষীঃ (যেন দগ্ধ করে) ইতি (এইজন্য)।
সরলার্থ : এক রাত্রিতে একদল হাঁস উড়িয়া যাইতেছিল। একটি হাঁস অগ্রগামী আর একটি হাঁসকে বলিল— ভল্লাক্ষ, ভল্লাক্ষ, জানশ্রুতি পৌত্রায়ণের জ্যোতি আকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত রহিয়াছে; ইহা স্পর্শ করিও না; ইহা যেন তোমাকে দগ্ধ না করে।
মন্তব্য : ‘ভল্লাক্ষ’—কেহ কেহ বলেন, ভল্লাক্ষ (ভদ্রাক্ষ) যাহাদিগের দৃষ্টি শুভ; বিদ্রূপচ্ছলেও এই শব্দ এখানে ব্যবহৃত হইতে পারে।
২৮৩. তমু হ পরঃ প্রত্যুবাচ কম্বর এনমেতৎ সন্তং সযুত্থানমিব রৈক্কমাথেতি যো নু কথং সযুগ্বা রৈক্ব ইতি ॥ ৩
অন্বয় : তম্ উ হ (তাহাকে) পরঃ (অপর জন) প্রতি + উবাচ (উত্তর করিল) কম্বরে (কম্ = কাহাকে, অরে সম্বোধনে) এনম্ (ইহাকে) এতৎ সন্তম্ (যিনি এই প্রকার তাঁহাকে, সন্তম্— সৎ) সযুগ্বানম্ ইব রৈক্বম্ (শকটের সহিত বর্তমান রৈক্কের ন্যায়)। আথ (বলিতেছ) ইতি। যঃ (যে রৈক্ব ‘তে মা কর্তৃক উক্ত হইয়াছেন’। নু কথম্ (কি প্রকার) সযুগ্ধা (শকট সহ বর্তমান) রৈক্বঃ ইতি।
সরলার্থ : দ্বিতীয় হংস বলিল— ‘এই ব্যক্তি এমন কে যে ইহার বিষয় এইরূপ বলিতেছ? এ যেন শকটবান্ রৈক্ব! প্রথম হংস জিজ্ঞাসা করিল— ‘তুমি যে শকটবান্ রৈক্কের কথা বলিতেছ, সে কে?’
মন্তব্য : যুগ্ধা = শকট; যুগ অর্থাৎ যোয়াল বহন করে এইজন্য অশ্ব ও বলীবর্দকে যুগ্য বলা হয়; যাহার যুগ্য আছে তাহা যুগ্ধা, যুগ্মন্ শব্দ; যুগ্বার সহিত বর্তমান সযুগ্ধা।
এতৎ সন্তম্— শঙ্করের মতে এতৎ এই বাক্য, আথ ক্রিয়ার কর্ম। ‘সন্তম্’ = মাহাত্ম্যযুক্ত, তিনি এইরূপ অর্থ করেন— এ একজন নিকৃষ্ট রাজা, ইহার কি মাহাত্ম্য আছে যে ইহাকে রৈকের সহিত তুলনা করিতেছ?
২৮৪. যথা কৃতায়বিজিতায়াধরেয়াঃ সংযন্ত্যেবমেনং সর্বং তদভিসমৈতি যৎ কিঞ্চ প্রজা সাধু কুর্বন্তি। যস্তদ্বেদ যৎ স বেদ স ময়ৈতদুক্ত ইতি ॥ ৪
অন্বয় : যথা (যেমন) কৃতায়বিজিতায় (‘কৃত’ নামক ‘অয়’ অর্থাৎ পাশা, যে জয় করে— তাহার জন্য) অধরেয়াঃ (নিম্ন—অঙ্কবিশিষ্ট পাশা) সংযন্তি (অধীন হয়), এবম্ (এই প্রকার) এনম্ (ইহাকে) সর্বম্ তৎ (সেই সমুদয়) অভিসমৈতি (এই রৈকের অধীন হয়)—যৎ কিঞ্চ (যাহাকিছু) প্রজাঃ লোকসমূহ) সাধু কুর্বন্তি (সাধু কর্ম করে)। যঃ (যে ব্যক্তি) তৎ (তাহা) বেদ (জানে), যৎ (যাহা) সঃ (রৈক্ব) বেদ, সঃ (সে ব্যক্তি) ময়া (আমা কর্তৃক) এতৎ (এই প্রকার) উক্তঃ (উক্ত হইয়াছে) ইতি।
সরলার্থ : দ্বিতীয় হাঁস বলিল— ‘কৃত নামক পাশা জয় করিলে যেমন কম অঙ্কের পাশাগুলিও তাহার মধ্যে আসিয়া যায় অর্থাৎ তাহার অধীন হয়, তেমনি এই সমস্তই— লোকে যাহা কিছু কাজ করে সবই—সেই রৈক্টের অধীন হয়। রৈক্ব যাহা জানেন যে ব্যক্তি তাহা জানে, আমি তাহার সম্বন্ধেও ইহাই বলি (অর্থাৎ রৈত্বের মত জ্ঞানী ব্যক্তির বিষয়েও আমি একই কথা বলি)। ‘
২৮৫. তদু হ জানশ্রুতিঃ পৌত্রায়ণ উপশুশ্রাব স হ সঞ্জিহান এব ক্ষত্তারমুবাচাঙ্গারে হ সযুগ্বানমিব রৈক্কমাথেতি যো নু কথং সযুগ্ধা রৈক ইতি ॥ ৫
২৮৬. যথা কৃতায়বিজিতায়াধরেয়াঃ সংযন্ত্যেবমেনং সর্বং তদভিসমৈতি যৎ কিঞ্চ প্রজাঃ সাধু কুর্বন্তি যস্তদ্বেদ যৎ স বেদ স ময়ৈতদুক্ত ইতি ॥ ৬
অন্বয় : তৎ (হংসদ্বয়ের কথোপকথন) উ হ জানশ্রুতিঃ পৌত্রায়ণঃ উপশুশ্রাব (শ্রবণ করিয়াছিলেন)। সঃ হ (তিনি) সঞ্জিহানঃ (শয্যা বা নিদ্রা ত্যাগ করিয়া) এব ক্ষত্তারম্ (দ্বাররক্ষককে) উবাচ (বলিলেন)— অঙ্গ (হে বৎস) অরে! হ সযুগ্বানম্ ইব রৈক্বম্ আথ ইতি। যঃ নু কথম্ স-যুগ্বা রৈক্বঃ ইতি (৩য় মন্ত্রের টীকা)। যথা কৃতায়-বিজিতায় অধরেয়াঃ সংযন্তি, এবম্ এনম্ সর্বম্ তৎ অভিসমৈতি— যৎ কিঞ্চ প্রজাঃ সাধু কুর্বন্তি। যঃ তৎ বেদ, যৎ সঃ বেদ, সঃ ময়া এতৎ উক্তঃ ইতি (৪র্থ মন্ত্রের টীকা)।
সরলার্থ : (৫ম ও ৬ষ্ঠ মন্ত্র)— জানশ্রুতি পৌত্রায়ণ উহা শুনিতে পাইলেন। প্রাতে শয্যা হইতে উঠিয়া তিনি দ্বারপালকে বলিলেন— বৎস শোন, দুইট হাঁসের মধ্যে কথা হইতেছিল; এক হাঁস বলিল, ‘তাঁহার বিষয় এমনভাবে বলিতেছে সে যেন শকটবান্ রৈক্ব!’ অপর হাঁস জিজ্ঞাসা করিল, ‘তুমি যে শকটবান্ রৈক্বের কথা বলিলে, সে কে?’ প্রথম হাঁস তাহার উত্তরে বলিল, ‘কৃত নামে পাশা জয় করিলে যেমন নিম্নাঙ্ক পাশাগুলিও তাহার অধীন হয়, তেমনি এসমস্তই লোকে যাহা কিছু সৎ কর্ম করে সেই সবই— রৈক্কের আয়ত্ত হয়। রৈকের মত যিনি জ্ঞানী তাঁহার বিষয়েও এই কথাই বলি।
২৮৭. স হ ক্ষত্তান্বিষ্য নাবিদমিতি প্রত্যেয়ায় তং হোবাচ যত্রারে ব্রাহ্মণস্যান্বেষণা তদেনমৰ্ছেতি ॥ ৭
অন্বয় : সঃ হ ক্ষত্তা অন্বিষ্য (অনুসন্ধান করিয়া) ন অবিদম্ (প্রাপ্ত হইয়াছি) ইতি (এই মনে করিয়া) প্রতি + আ + ইয়ায় (ফিরিয়া আসিল)। তম্ হ (সেই দ্বারপালকে) উবাচ (বলিলেন) যত্র (যেখানে) অরে ব্রাহ্মণস্য (ব্রাহ্মণকে, কর্মে ষষ্ঠী) অন্বেষণা (অনুসন্ধান করিতে হয়), তৎ (সেই স্থলে) এনম্ (ইহাকে অর্ছ (গমন কর, অন্বেষণ কর) ইতি।
সরলার্থ : (রৈকের অনুসন্ধান করিবার জন্য জানশ্রুতি সেই দ্বারপালকে আদেশ করিলেন)। দ্বারপাল অনুসন্ধান করিয়া ফিরিয়া আসিল এবং বলিল— ‘আমি তাঁহাকে পাইলাম না।’ জানশ্রুতি তাহাকে বলিলেন— ‘যেখানে ব্রাহ্মণের অন্বেষণ করিতে হয়, সেখানে (অর্থাৎ অরণ্যে বা নির্জন প্রদেশে) গিয়া তাহাকে অনুসন্ধান কর।’
২৮৮. সোহধস্তাচ্ছকটস্য পামানাং কষমাণুপোপবিবেশ তং হাত্যূবাদ ত্বং নু ভগবঃ সযুগ্বা রৈক্ব ইত্যহং হারা ৩ ইতি হ প্রতিজজ্ঞে স হ ক্ষত্তাহবিদমিতি প্রত্যেয়ায় ॥ ৮
অন্বয় : সঃ অধস্তাৎ (অধোভাগে) শকটস্য (শকটের) পামানম্ (পামন্; খোস- পাঁচড়া) কষমাণু (চুলকাইতেছে এমন লোককে) উপ (সমীপে) উপবিবেশ (উপবেশন করিল)। তম্ হ (তাহাকে) অভ্যুবাদ (বলিল)— ত্বম্ (আপনি) নু (কি) ভগবঃ (প্রাচীন ব্যবহার—ভগবান্) সযুগ্ধা (শকটবান্) রৈক্ব? ইতি। অহম্ (আমি) হি অরা ৩ (অরে সম্বোধনে) ইতি প্রতিজজ্ঞে (উত্তর করিল)। সঃ হ ক্ষত্তা (দ্বারপাল) অবিদম্ (জানিয়াছি) ইতি প্রতি + আ + ইয়ায় (প্রত্যাগমন করিল)।
সরলার্থ : শকটের নীচে বসিয়া একজন লোক খোস চুলকাইতেছিল। দ্বারপাল তাহার নিকট বসিল। তারপর তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল— ‘ভগবন্, আপনিই কি শকটবান্ রৈক্ব?” তিনি উত্তর করিলেন, “ওহে আমিই সে।’ জানিতে পারিয়াছি, এই মনে করিয়া দ্বারপাল ফিরিয়া আসিল।
মন্তব্য : ‘অরা’ শব্দের শেষ স্বর পুত; এই জন্য ইহার পর ৩ লেখা হইয়াছে। রৈক্ব ‘খোস’ চুলকাইতেছিলেন। এই অবস্থায় লোকে স্বভাবত গতস্বরেই উত্তর দিয়া থাকে।
দ্বিতীয় খণ্ড – জানশ্রুতি পৌত্রায়ণ ও রৈত্বের আখ্যায়িকা (২)
২৮৯. তদু হ জানশ্রুতিঃ পৌত্রায়ণঃ ষট্ শতানি গবাং নিষ্কমশ্বরীরথ তদাদায় প্রতিচক্রমে তং হাভ্যুবাদ ॥ ১
অন্বয় : তৎ (তাহার পর; বা সেই জন্য) উ হ জানশ্রুতিঃ পৌত্রায়ণঃ ষশতানি (ছয় শত) গবাম্ (গোসমূহের), নিষ্কম্ (সুবর্ণময় কণ্ঠহার) অশ্বতরীরথম্ (অশ্বতরীযুক্ত রথ) তৎ (এই সমুদয়; বা সেই স্থলে) আদায় (লইয়া) প্রতিচক্রমে (গমন করিলেন)। তম্ হ (তাহাকে) অভ্যুবাদ (বলিলেন)—
সরলার্থ : তাহার পর জানশ্রুতি পৌত্রায়ণ ছয়শত গাভী, সোনার হার এবং অশ্বতরীযুক্ত রথ লইয়া সেখানে গেলেন এবং রৈক্বকে বলিলেন—
২৯০. রৈক্কেমানি ষট্ শতানি গবাময়ং নিষ্কোহয়মশ্বতরীরথোহনু ম এতাং ভগবো দেবতাং শাধি যাং দেবতামুপাস ইতি ॥ ২
অন্বয় : রৈক্ব! ইমানি (এই সমুদয়) ষট্তানি গবাম্ (ছয়শত গাভী), অয়ম্ (এই) নিষ্কঃ অয়ম্ অশ্বতরীরথঃ অনু মে(আমাকে) এতাম্ [দেবতাম্] (এই দেবতাকে) ভগবঃ (ভগবান্) দেবতাম্ [অনু] শাধি (উপদেশ দান করুন), যাম্ দেবতাম্ (যে দেবতাকে) উপাসে (উপাসনা করেন) ইতি।
সরলার্থ : হে রৈক্ব, আপনার জন্য এই ছয়শত গাভী, এই হার এবং এই রথ আনা হইয়াছে। আপনি যে দেবতার উপাসনা করেন আমাকে সেই দেবতার বিষয়ে উপদেশ দিন।
২৯১. তমু হ পরঃ প্রত্যুবাচাহ হারেত্বা শূদ্র তবৈব সহ গোভিরস্থিতি তদু হ পুনরেব জানশ্রুতি পৌত্রায়ণঃ সহস্রং গবাং নিষ্কমশ্বতরীরথং দুহিতরং তদাদায় প্রতিচক্রমে। ৩
অন্বয় : তম্ (জানশ্রুতিকে) উ হ পরঃ (অপরজন, রৈক্ব) প্রতি + উবাচ (উত্তর করলেন)— অহ (ওহে) হার + ইত্বা (হারসহ শকট; ইত্বা রথ, যাহাতে গমন করা যায়) শূদ্র! তব এব (তোমারই) সহ গোভিঃ (গাভীগণ সহ) অস্তু (থাকুক) ইতি। তৎ (তাহার পর, কিংবা সেই জন্য) উ হ পুনঃ এব (পুনর্বার) জানশ্রুতিঃ পৌত্রায়ণঃ সহস্রম্ গবাম্ (এক হাজার গাভীকে), নিষ্কম্, অশ্বতরীরথম্ দুহিতরম্ (‘নিজ’ দুহিতাকে) তৎ (সেই স্থানে, কিংবা তাহার জন্য) আদায় প্রতিচক্রমে।
সরলার্থ : রৈক্ব তাঁহাকে বলিলেন— ‘ওহে শূদ্র, এই হার, এই রথ, এই সব গাভী তোমারই থাকুক।’ তখন জানশ্রুতি পৌত্রায়ণ এক হাজার গাভী, সোনার হার, অশ্বতরীযুক্ত রথ এবং কন্যাকে নিয়া আবার সেখানে গেলেন।
মন্তব্য : দুহিতরম্—যে দুগ্ধ দোহন করে। যাস্ক বলেন, ‘দুহিতা দুহিতা দূরে-হিতা দোগ্বের্বা। বিবাহের পর দূরে প্রেরণ করা হয় কিংবা দুগ্ধ দোহন করে, এই অর্থে দুহিতা। পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ উহার ভিন্ন ভিন্ন অর্থ করিয়াছেন— (১) যে দুগ্ধ দোহন করে; অতি প্রাচীনকালে কন্যাগণই দুগ্ধ দোহন করিত, এই জন্য তাহাদিগের নাম দুহিতা; (২) যে মাতার দুগ্ধ পান করে; (৩) যে দুগ্ধ দ্বারা সন্তান পোষণ করে।
এই উপনিষদে দুই স্থলে (৪।২।৩,৫) জানশ্রুতিকে শূদ্র বলিয়া সম্বোধন করা হইয়াছে। অথচ রৈক্ব ইহাকেই ব্রহ্মবিদ্যা শিক্ষা দিয়াছিলেন। ইহাতে কেহ কেহ বলিতে পারেন যে, তবে শূদ্রের ব্রহ্মবিদ্যায় অধিকার আছে। এই মত খণ্ডন করিবার জন্য দর্শনিকগণ এবং শাস্ত্রকারগণ নানা উপায় অবলম্বন করিয়াছেন। বেদান্ত দর্শনে দুইটি সূত্রে (রামানুজভাষ্যে ১।৩।৩৪, ৩৫) এ বিষয়ে আলোচনা করা হইয়াছে। দর্শনকারের মতে ‘শূদ্র’ শুচ শব্দ এবং দ্র-ধাতু হইতে নিষ্পন্ন। ভাষ্যকারগণ বলেন, জানশ্রুতি শোকে দ্রুত গমন করিয়াছিলেন, কিংবা শোকে দ্রবীভূত হইয়াছিলেন, কিংবা শোকার্ত হইয়া রৈকের নিকট দ্রুত গমন করিয়াছিলেন, কিংবা শোক তাঁহাতে দ্রুত প্রবেশ করিয়াছিল, এই জন্য জানশ্রুতিকে শূদ্র বলিয়া অভিহিত করা হইয়াছে। শঙ্করাচার্য বলেন—এখানে ‘শূদ্র শব্দের অবয়বার্থই গ্রহণ করা উচিত, রূঢ়ি অর্থ গ্রহণ করা যাইতে পারে না।
২৯২. তং হাভ্যুবাদ রৈক্বেদং সহস্রং গবাময়ং নিষ্কোহয়মশ্বতরীরথ ইয়ং জায়াহয়ং গ্রামো যস্মিন্নাসেহন্বেব মা ভগবঃ শাধীতি ॥ ৪
অন্বয় : তম্ (তাঁহাকে, রৈক্বকে) হ অভি + উবাদ (বলিলেন)—রৈক্ব! ইদম্ সহস্রম্ গবাম্, অয়ম্ নিষ্কঃ অয়ম্ অশ্বতরীরথঃ ইয়ম্ (এই) জায়া, অয়ম্ গ্রামঃ যস্মিন্ (যে গ্রামে) আসে (আপনি বাস করেন)। অনু এব মা ভগবঃ শাধি ইতি (২য় মন্ত্র দ্রঃ)।
সরলার্থ : জানশ্রুতি রৈক্বকে বলিলেন, ‘হে রৈক্ব, এক হাজার গাভী, স্বর্ণময় হার,অশ্বতরীযুক্ত রথ, এই জায়া এবং আপনি যে গ্রামে বাস করেন তাহাও আপনাকে (উপহার দিতেছি)। আপনি আমাকে শিক্ষা দিন।’
২৯৩. তস্যা হ মুখমুপোদ্গৃহনুবাচাজহারেমাঃ শূদ্রানেনৈব মুখেনালাপয়িষ্যথা ইতি তে হৈতে রৈকুপর্ণা নাম মহাবৃষেষু যত্রামা উবাস তস্মৈ হোবাচ ॥ ৫
অন্বয় : তস্যাঃ (জানশ্রুতির দুহিতার) হ মুখম্ উপ + উৎ + গৃহ্নন্ (হস্ত দ্বারা মুখ ধরিয়া) উবাচ (বলিলেন)—আজহার (আনিয়াছ) ইমাঃ (এই সমুদয়) শূদ্র! অনেন এব মুখেন (এই ‘কন্যার মুখ দ্বারাই) আলাপরিষ্যথাঃ (কথ বলাবেই) ইতি। তে হ এতে (সেই এই সমুদয়) রৈত্বপর্ণাঃ নাম (রৈকপর্ণা নামক গ্রামসমূহ) মহাবৃষেষু (মহাবৃষ প্রদেশে) যত্র (যেখানে) অস্মৈ (জানশ্রুতির জন্য অর্থাৎ তাহাকে উপদেশ দিবার জন্য) উবাস (বাস করিয়াছিলেন)। তস্মৈ (জানশ্রুতিকে) হ উবাচ (বলিলেন)।
সরলার্থ : (হাত দিয়া) সেই কন্যার মুখ তুলিয়া ধরিয়া রৈক্ব বলিলেন ‘হে শূদ্র, তুমি এই সব আনিয়াছ; (কিন্তু একমাত্র) এই মুখ দিয়াই (অর্থাৎ এই কন্যার মুখ দিয়াই) আমাকে কথা বলাইতেছ।’ মহাবৃষ প্রদেশে রৈক্বপর্ণ নামে গ্রামগুলিতে রৈক্ব জানশ্রুতিকে উপদেশ দিবার জন্য বাস করিলেন। তিনি তাঁহাকে বলিলেন—
মন্তব্য : (১) মোক্ষমুলার বলেন, উপোৎগৃহন্—মুখ খুলিয়া (বয়স জানিবার জন্য)। শঙ্করের মতে— ‘অবগত হইয়া’ অর্থাৎ ‘কন্যার মুখকে বিদ্যাদানের উপযুক্ত দ্বার বলিয়া অবগত হইয়া।’ রৈক্ব আদর করিয়া কন্যার মুখ ধরিয়াছিলেন—ইহাই প্ৰকৃত অর্থ বলিয়া মনে হয়
(২) অনেন এব মুখেন আলাপয়িষ্যথাঃ— এই কন্যার মুখ দ্বারাই আমাকে কথা বলাইতেছ। আর একাধিক অর্থ হইতে পারে— (ক) গবাদি লাভ করিয়াও আমি উপদেশ দিতে প্রস্তুত হই নাই; এখন তুমি কন্যা প্রদান করিতেছ। এই কন্যার মুখই আমাকে উপদেশ দেওয়াইয়া লইবে। অর্থাৎ এই কন্যার মুখ দেখিয়াই, এই কন্যা লাভ করিয়াই আমি উপদেশ দিব। (খ) এই কন্যার মুখ হইতেই যেন উপদেশ নিঃসৃত হইবে, আমি উপলক্ষ্য মাত্র। (গ) এই উপায় দ্বারাই অর্থাৎ কন্যাসম্প্রদান দ্বারাই; মুখ— উপায়।
(৩) ‘মহাবৃষ’ একটি জাতির নাম। ইহার যে দেশে বাস করিত সে দেশের নামও মহাবৃষ। অথর্ববেদ, বৌধায়ন শ্রৌতসূত্র (২।৫) এবং জৈমিনীয় ব্রাহ্মণে (১০।৪০।২) ইহাদিগের উল্লেখ আছে। অথর্ববেদের একটি মন্ত্রে বর্ণনা করা হইয়াছে যে, ‘তক্মা’ নামক একটা ব্যাধি মহাবৃষ জাতির একটি বিশেষ ব্যাধি (৫।২২)। মোক্ষমুলার মনে করেন, তক্মা এব প্রকার চর্মরোগ। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, ‘পামা’ রোগগ্রস্ত রৈক্বও ঐ প্রদেশেই বাস করিতেন।
তৃতীয় খণ্ড – রৈত্ব কথিত সম্বর্গবিদ্যা—বায়ু ও প্রাণের প্রাধান্য
২৯৪. বায়ুর্বাব সংবর্গো যদা বা অগ্নিরুদ্বায়তি বায়ুমেবাপ্যেতি যদা সূর্যোহতমেতি বায়ুমেবাপ্যেতি যদা চন্দ্রোহতমেতি বায়ুমেবাপ্যেতি ॥ ১
অন্বয় : বায়ুঃ বাব সংবর্গঃ (যে গ্রাস করে, বা গ্রহণ করে; সর্বগ্রাস)। যদা (যখন) বৈ অগ্নিঃ উত্থায়তি (নির্বাপিত হয়), বায়ুম্ এব + অপি + এতি (লীন হয়); যদা সূর্যঃ অস্তম্ এতি (অস্তগত হয়) বায়ুম্ এব অপি + এতি; যদা চন্দ্রঃ অস্তম্ এতি, বায়ুম্ এব অপি + এতি।
সরলার্থ : বায়ুই সর্বগ্রাস (অর্থাৎ সকলকে গ্রাস করে)। যখন অগ্নি নির্বাপিত হয়, তখন তাহা বায়ুতেই লীন হয়। যখন সূর্য অস্তমিত হয়, তখন তাহা বায়ুতেই লীন হয়। যখন চন্দ্র অস্তমিত হয়, তখন বায়ুতেই লীন হয়।
২৯৫. যদাপ উচ্ছ্বষ্যন্তি বায়ুমেবাপিযন্তি বায়ুৰ্য্যেবৈতান্ সর্বান্ সংবৃক্ত ইত্যধিদৈবতম্ ॥ ২
অন্বয় : যদা আপঃ (জল) উৎশষ্যন্তি (শুষ্ক হয়) বায়ুম্ এব অপি যন্তি (গমন করে); বায়ুঃ হি এব এতান্ সর্বান্ (এই সমুদয়কে) সংবৃক্তে (সংবরণ করে, বিনাশ করে), ইতি অধিদৈবতম্ (দেবতাবিষয়ক উপাসনা)।
সরলার্থ : যখন জল শুকাইয়া যায় তখন তাহা বায়ুতেই মিশায়; বায়ু এই সব কিছুকেই গ্রাস করে। ইহাই অধিদৈবত অর্থাৎ দেবতাবিষয়ক উপাসনা।
২৯৬. অথাধ্যাত্মং প্রাণো বাব সংবর্গঃ স যদা স্বপিতি প্রাণমেব বাগপ্যেতি প্রাণং চক্ষুঃ প্রাণং শ্রোত্রং প্রাণং মনঃ প্রাণো হোবৈতান্ সর্বান্ সংবৃক্ত ইতি ॥ ৩
অন্বয় : তথ অধ্যাত্মম্ (দেহসংক্রান্ত উপাসনা)—প্রাণঃ বাব সংবর্গঃ (১ মঃ)। সঃ (সে অর্থাৎ পুরুষ) যদা স্বপিতি (নিদ্রিত হয়) প্রাণম্ এব বাক্ অপি + এতি; প্রাণম্ চক্ষুঃ, প্রাণম্ শ্রোত্রম্, প্রাণম্ মনঃ। প্রাণঃ হি এব এতান্ সর্বান্ সংবৃক্তে ইতি (১ম ও ২য় মন্ত্রের টীকা দ্রষ্টব্য)।
সরলার্থ : ইহার পর অধ্যাত্ম (অর্থাৎ দেহবিষয়ক) উপাসনা—প্রাণই সর্বগ্রাস; কারণ যখন পুরুষ নিদ্রিত হয় তখন বাক্, চক্ষু কর্ণ এবং মন, এই সবই প্রাণে প্রবেশ করে। প্রাণই এই সবকে গ্রাস করে।
২৯৭. তৌ বা এতৌ সংবর্গৌ বায়ুরেব দেবেষু প্রাণঃ প্রাণেষু ॥ ৪
অন্বয় : তৌ (সেই) বৈ এতৌ (এই) দ্বৌ (দুই) সংবর্গৌ (দুই সংবর্গ, ১ম মন্ত্ৰ দ্ৰঃ)- বায়ুঃ এব দেবেষু দেবগণের মধ্যে); প্রাণ প্রাণেষু (প্রাণ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সমূহের মধ্যে)।
সরলার্থ : এই দুই-ই সর্ব গ্রাস—দেবতাদের মধ্যে বায়ু এবং ইন্দ্রিয়গণের মধ্যে প্ৰাণ।
২৯৮. অথ হ শৌনকং চ কাপেয়মভিপ্রতারিণং চ কক্ষসেনিং পরিবিষ্যমাণৌ ব্রহ্মচারী বিভিক্ষে তস্মা উ হ ন দদতুঃ ॥ ৫
অন্বয় : অথ হ শৌনকম্ চ কাপেয়ম্ (কপি-গোত্রোৎপন্ন শৌনককে), অভিপ্রতারিণম্ চ কাক্ষসেনিম্ (কক্ষসেনের পুত্র অভিপ্রতারীকে) পরিবিষ্যমাণৌ (যে দুইজনকে অন্ন পরিবেশন করা হইতেছিল, সেই দুইজনকে) ব্রহ্মচারী বিভিক্ষে (ভিক্ষা চাহিল)। তস্মৈ (তাহাকে) উ হ ন দদতুঃ (ভিক্ষা দিল না)।
সরলার্থ : একদিন কপিপুত্র শৌনক এবং কক্ষসেনের পুত্র অভিপ্রতারী—এই দুইজনকে অন্ন পরিবেশন করা হইতেছিল। এমন সময় একজন ব্রহ্মচারী আসিয়া ভিক্ষা চাহিল। তাহারা তাহাকে ভিক্ষা দিল না।
মন্তব্য : পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ এবং জৈমিনীয় উপনিষদ ব্রাহ্মণে অভিপ্রতারী কাক্ষসেনির উল্লেখ আছে। ইনি একজন কুরুবংশোদ্ভব রাজন্য ছিলেন।
২৯৯. স হোবাচ—মহাত্মনশ্চতুরো দেব একঃ কঃ স জগার ভবনস্য গোপাস্ত কাপেয় নাভিপশ্যন্তি মর্ত্যা অভিপ্রতারিন্ বহুধা বসন্তম্। যস্মৈ বা এতদং তস্মা এতন্ন দত্তমিতি ॥ ৬
অন্বয় : সঃ হ উবাচ—মহাত্মনঃ চতুরঃ (চারিজন মহাত্মাকে) দেবঃ একঃ কঃ (কে) সঃ জগার (গ্রাস করিয়াছে)? ভুবনস্য (ভুবনের গোপাঃ (রক্ষক)? তম্ (তাহাকে কাপেয়! ন অভিপশ্যন্তি (দেখিতে পায় না) মর্ত্যাঃ (মরণশীল মানবগণ) অভিপ্রতারি! বহুধা (বহুরূপে)বসন্তম্ (বর্তমান)। যস্মৈ (যাহার জন্য) বৈ এতৎ অন্নম্ (এই অন্ন) তস্মৈ (তাহাকে) এতৎ ন দত্তম্ (ইহা দিলে না) ইতি।
সরলার্থ : সেই ব্রহ্মচারী বলিল, ‘এক দেবতা চারিজন মহাত্মাকে গ্রাস করিয়াছেন; তিনি কে? কে ভুবনের রক্ষক? হে কাপেয়, হে অভিপ্রতারী, বহুরূপে বর্তমান সেই দেবতাকে মানুষেরা দেখিতে পায় না। যাঁহার জন্য এই অন্ন তাঁহাকেই ইহা দিলে না।’
মন্তব্য : বায়ু এই চারিজনকে গ্রাস করেন—অগ্নি, সূর্য, চন্দ্র ও জল। প্ৰাণ গ্ৰাস করেন এই চারিজনকে—বাক্, চক্ষু, কর্ণ ও মন। বায়ু এবং প্রাণ একই দেবতা; এইজন্যই বলা হইয়াছে—একই দেবতা চারিজনকে গ্রাস করেন। শঙ্করের মতে ‘কঃ’ অর্থ ‘কে’ নহে। তিনি বলেন এখানে ‘ক’ নামক দেবতার অর্থাৎ প্রজাপতির কথা বলা হইয়াছে।
৩০০. তদু হ শৌনকঃ কাপেয়ঃ প্রতিমন্বানঃ প্রত্যেরায়াত্মা দেবানাং জনিতা প্রজানাং হিরণ্যদংস্ট্রো বভসোহনসূরিঃ মহান্তমস্য মহিমানমারনদ্যমানো যদনন্নমত্তীতি বৈ বয়ং ব্রহ্মচারিদেমুপাস্নহে দত্তাস্মৈ ভিক্ষামিতি ॥ ৭
অন্বয় : তৎ (সেই বাক্যকে) উ হ শৌনকঃ কাপেয়ঃ প্রতিমন্বানঃ (মনে মনে আলোচনা করিয়া) প্রত্যেয়ায় (প্রতি-আ-ইরায়; তাহার নিকট গমন করিল)। আত্মা দেবানম্ (দেবগণের) জনিতা (বৈদিক প্রয়োগ, জনয়িতা) প্রজানাম্ (স্থাবর ও জঙ্গমের; যাহা উৎপন্ন হয় তাহাই প্রজা) হিরণ্যদ্রংষ্ট্রঃ (সুবর্ণময় দন্তবিশিষ্ট) বভসঃ (ভক্ষক) অনসূরিঃ (সূরি মেধাবী; অসূরি—যে মেধাবী নয়; অনসূরি যে অসূরি নয় মেধাবী), মহান্তম্ (মহান এইরূপ) অস্য (ইহার) মহিমানম্ (মহিমাকে) আহ্ঃ (বলিয়া থাকে), অনদ্যমানঃ (ন অদ্যমানঃ—যাহা অপর কর্তৃক ভক্ষিত হয় না) যৎ (যাহা) অনন্নম্ (অন্ন নয় এমন বস্তুকেও) অত্তি (ভক্ষণ করেন) ইতি বৈ বয়ম্ (আমরা) ব্রহ্মচারিন্! ইদম্ (ইহাকে) আ উপামহে (উপাসনা করি)। দত্ত (দান করে) অস্মৈ (ইহাকে অর্থাৎ এই ব্রহ্মচারীকে ভিক্ষাম্ ইতি
সরলার্থ : শৌনক কাপেয় ইহা মনে মনে আলোচনা করিয়া সেই ব্রহ্মচারীর নিকট গেলেন এবং বলিলেন—যিনি সর্বদেবতার আত্মা, স্থাবর জঙ্গমের জনয়িতা, হিরণ্যদন্তী ভক্ষক এবং মেধাবী, অপরে যাঁহাকে ভক্ষণ করিতে পারে না কিন্তু অনন্নকেও (অর্থাৎ যাহা অন্ন নয় এমন বস্তুকেও) যিনি ভক্ষণ করেন, (জ্ঞানিগণ) তাঁহার মহিমাকে মহান বলিয়াছেন। হে ব্রহ্মচারী, আমরা তাঁহারই উপাসনা করি। (তাহার পর তিনি বলিলেন)— ইঁহাকে ভিক্ষা দাও।
৩০১. তস্ম উ হ দদুস্তে বা এতে পঞ্চান্যে পঞ্চান্যে দশ সন্তস্তৎ কৃতং তস্মাৎ সর্বাসু দিচ্ছ্বন্নমেব দশ কৃতং সৈষা বিবাড়ন্নাদী তয়েদং সর্বং দৃষ্টং সর্বমস্যেদং দৃষ্টং ভবত্যন্নাদো ভবতি য এবং বেদ য এবং বেদ ॥ ৮
অন্বয় : তস্মৈ (সেই ব্রহ্মচারীকে) উ হ দদুঃ (ভিক্ষা দিল)। তে বৈ এতে (সেই এই সমুদয়) পঞ্চ অন্যে (অন্য পাঁচজন; বায়ু এবং তাহার চারি অন্ন অর্থাৎ অগ্নি, আদিত্য, চন্দ্র ও জল), পঞ্চ অন্যে (অপর পাঁচজন; প্রাণ ও তাহার চারিটি খাদ্য অর্থাৎ বাক্, চক্ষু, শ্রোত্র ও মন) দশ সন্তঃ (দশ জন হইয়া) তৎ (তাহা) কৃতম্। তস্মাৎ (সেইজন্য) সর্বাসু দিক্ষু (সমুদয় দিকে) অন্নম্ এব দশ কৃতম্। সা এষা (সেই এই— দশ) বিরাট্ অন্নাদী (অন্নভোক্তা)। তয়া (সেই বিরাট্ দ্বারা) ইদম্ (এই সমুদয়) দৃষ্টম্। সর্বম্ অস্য (ইহার) ইদম্ (এই) দৃষ্টম্ ভবতি (হয়), অন্নাদঃ (অন্নভোক্তা) ভবতি, যঃ (যে) এবম্ (এই প্রকার) বেদ (জানেন), যঃ এবম্ বিদ (দ্বিরুক্তি সমাপ্তিসূচক)।
সরলার্থ : তখন তাঁহাকে ভিক্ষা দেওয়া হইল। সেই প্রথম পাঁচ (বায়ু ও তাহার চারিটি খাদ্য) এবং দ্বিতীয় পাঁচ (প্রাণ ও তাহার চারিটি খাদ্য) মিলিত হইয়া দশ হইলে ‘কৃত’ হয়। এই জন্য সর্বদিকে কৃত ও (তাহার) অন্নের সংখ্যা দশ। ইহাই বিরাট্ ও অন্নভোক্তা। তাহার দ্বারাই এই সব দৃষ্ট হয়। যিনি ইহা জানেন তিনি সর্বদিকে এই সমস্ত দেখিতে পান, তিনি অন্নাদ হন।
মন্তব্য : পাশার যে দিকে চারটি অঙ্ক আছে তাহার নাম কৃত (বা সত্য)। এই ভাবে ত্রেতায় তিনটি, দ্বাপরে দুইটি এবং কলিতে একটি মাত্র অঙ্ক বা সংখ্যা আছে। কৃত অপর তিনটিকে জয় এবং ভক্ষণ করিয়া থাকে অর্থাৎ অন্তর্ভূত করিয়া লয়। এখানে ভক্ষক ও ভুক্তের সংখ্যা দশ; ৪ + ৩ + ২ + ১ = ১০ সুতরাং কৃতই দশ। বায়ুর ও প্রাণের খাদ্যও চারিটি করিয়া। তাই এখানেও ভক্ষক ও ভুক্তের মোট সংখ্যা দশ।
সর্বাসু দিক্ষু অন্নম্ এব দশকৃতম্—এই অংশের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ হইতে পারে : (ক) কৃত ও অন্ন মোট দশ, (খ) অন্নই কৃত-সংজ্ঞক দশ, (গ) সর্বদিকে অন্নের সংখ্যা দশ, সুতরাং অন্নই কৃত।
চতুর্থ খণ্ড – সত্যকাম জাবালের আখ্যায়িকা
৩০২. সত্যকামো হ জাবালো জবালাং মাতরমামন্ত্রয়াঞ্চক্রে ব্রহ্মচর্যং ভবতি বিবৎস্যামি কিং গোত্রো ন্বহমস্মীতি ॥ ১
অন্বয় : সত্যকামঃ হ জাবালঃ জবালাম্ মাতরম্ (মাতা জবালাকে) আমন্ত্রয়াঞ্চক্রে (আহ্বান করিয়া বলিল) ব্রহ্মচর্যম্ ভবতি (হে পূজনীয়ে; ‘ভবৎ’ শব্দের স্ত্রীলিঙ্গে ‘ভবতী’, সম্বোধনে ‘ভবতি’) বিবৎস্যামি (বাস করিব)। কিং গোত্রঃ (কোন গোত্রের) নু অহম্ (আমি) অস্মি (হই)? ইতি।
সরলার্থ : সত্যকাম জাবাল মাতা জবালাকে বলিল—হে পূজনীয়া, আমি ব্ৰহ্মচর্য নিয়া গুরুগৃহে বাস করিব। আমার কি গোত্র?
৩০৩. সা হৈনমুবাচ নাহমেতদ্বেদ তাত যাগোত্রত্বমসি বহং চরন্তী পরিচারিণী যৌবনে ত্বামলভে সাহমেতন্ন বেদ যােত্রত্বমসি জবালা তু নামাহমস্মি সত্যকামো নাম ত্বমসি স সত্যকাম এব জাবালো রুবীথা ইতি ॥ ২
অন্বয় : সা (সে অর্থাৎ জবালা) হ এনম্ (ইহাকে) উবাচ (বলিল)—ন (না) অহম্ (আমি) এতৎ (ইহা) বেদ (জানি), তাত (হে পুত্র) যৎ-গোত্রঃ (যে গোত্রের অন্তর্গত) ত্বম্ (তুমি) অসি (হও)। বহু অহম্ চরন্তী (বহু বিচরণ করিয়া; কিংবা বহু লোকের সেবা করিয়া) পরিচাররিণী (অপরের পরিচর্যা করিবার অবস্থায়) যৌবনে ত্বাম্ (তোমাকে) অলভে (লাভ করিয়াছি)। সা অহম্ (সেই আমি) এতৎ ন বেদ যৎ গোত্রঃ ত্বম্ অসি, জবালা নাম তু অহম্ অস্মি; সত্যকমঃ নাম ত্বম্ অসি; সঃ (সেই তুমি) সত্যকামঃ জাবালঃ ব্রবীথাঃ (বলিও) ইতি।
সরলার্থ : জবালা তাহাকে বলিল— পুত্র, তোমার কোন্ গোত্র তাহা আমি জানি না। যৌবনে বহু বিচরণ করিয়া পরিচারিণী অবস্থায় (কিংবা যৌবনে পরিচারিণীরূপে বহুলোকের পরিচর্যা করিয়া) তোমাকে পাইয়াছি। আমি জানি না তোমার কোন্ গোত্র। আমি জবালা, তুমি সত্যকাম; তাই বলিও ‘আমি সত্যকাম জাবাল’।
৩০৪. স হ হারিদ্রুমতং গৌতমমেত্যোবাচ ব্রহ্মচর্যং ভগবতি বৎস্যাম্যুপেয়াং ভগবন্তমিতি ॥ ৩
অন্বয় : সঃ হ হারিদ্রুমতম্ (হরিদ্রুমানের পুত্র গৌতমের নিকটে) এত্য (গমন করিয়া) উবাচ (বলিল)—ব্রহ্মচর্যম্ ভগবতি (ভগবানের নিকটে অর্থাৎ আপনার নিকটে), বৎস্যামি (বাস করিব), উপেয়াম্ (শিষ্যরূপে আসিয়াছি) ভগবন্তম্ (আপনার নিকটে) ইতি।
সরলার্থ : সত্যকাম হারিদ্রুমত গৌতমের নিকট গিয়া বলিল—আমি আপনার নিকট ব্রহ্মচর্য বাস করিব; এই জন্য আসিয়াছি।
মন্তব্য : সত্যকামের জননী; অথচ তিনি জানেন না—তাঁহার জনকের নামগোত্রাদি কি। ইহার অর্থ কি? শঙ্কর প্রমুখ পণ্ডিতগণ বলেন—সময়াভাবে ও লজ্জাবশত জবালা স্বামীকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করিতে পারেন নাই; এবং স্বামীর মৃত্যুর পরে লজ্জা ও দুঃখবশত এ বিষয়ে অপর কাহাকেও জিজ্ঞাসা করেন নাই। কিন্তু এ প্রকার ব্যাখ্যা নিতান্তই অসঙ্গত। জবালার যৌবনাবস্থায় সত্যকামের জন্ম হয়। বর্তমান ঘটনার সময়ে জবালা এই যৌবনাবস্থাকে অতীত কাল বলিয়া বর্ণনা করিতেছেন। সুতরাং বলিতে হয় এই সময়ে জবালার প্রৌঢ়াবস্থা। প্রৌঢ় বয়সেও একজন নারী স্বামীর নাম গোত্রাদি জানে না ইহা অসম্ভব কল্পনা। বিবাহের পূর্ব হইতেই স্ত্রীলোক স্বামীর নামাদি শুনিতে আরম্ভ করে। তাহার পরে পিতৃকুল, শ্বশুরকুল, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, দাস-দাসী প্রবিবেশী, গ্রামবাসী, অতিথি অভ্যাগত সকলেই নানা ঘটনায় ইহার নাম উচ্চারণ করিয়া থাকে; বিনা চেষ্টায়ই স্বামীর নাম কানে আসে। তবে জবালা প্রৌঢ়বয়সেও সত্যকামের পিতার নাম জানিতেন না কেন? আলোচনা করিয়া দেখা যাউক ইহার কারণ কি।
পাণিনির মতে গোত্র অর্থ পৌত্র বা অন্য কোন অধস্তন অপত্য। উপনিষৎ পড়িলে জানা যায় যে, ঐ যুগে সাধারণত প্রত্যেক নামেরই দুইটি অঙ্গ ছিল। যেমন উদ্দালক আরুণি, প্রাচীনশাল ঔপমন্যব ইত্যাদি। আরুণি অর্থ অরুণের পুত্র; ঔপমন্যব অর্থ উপমন্যুর পুত্র। অনেক স্থলে পিতার নাম জানিলে প্রপিতামহ এবং তাহা অপেক্ষাও ঊর্ধ্বতন পুরুষের নাম জানা যাইত। যেমন শ্বেতকেতু আরুণেয় (আরুণেয়—অরুণের পৌত্র) ইত্যাদি। সুতরাং পিতার নাম জানিলেই অন্তত পিতামহের নামও জানা যায় অর্থাৎ পিতার নামের সঙ্গে সঙ্গেই গোত্রের পরিচয় হয়। জবালা সত্যকামের গোত্ৰাদি জানিতেন না—ইহার অর্থ তিনি সন্তানের জনকের নামও জানিতেন না। কেন জানিতেন না তাহার উত্তর ৪।৪।২ মন্ত্রে তিনি নিজেই দিয়াছেন।
উক্ত মন্ত্রের দুইটি অর্থ হইতে পারে—(১) যৌবনে বহুস্থলে বিচরণ করিয়া (বহু-চরন্তী) পরিচারিণী অবস্থায় তোমাকে লাভ করিয়াছিলাম। (সুতরাং) জানিনা তোমার কোন্ গোত্র। (২) যৌবনে পরিচারিণীরূপে বহুলোকের পরিচর্যা করিয়া (বহু-চরন্তী) তোমাকে লাভ করিয়াছিলাম। (সুতরাং) জানিনা তোমার কোন্ গোত্র। যে অর্থই গ্রহণ করা যাউক না কেন, সিদ্ধান্ত এই— এক স্থলে বাস করিয়াই হউক, বা বহুস্থলে বিচরণ করিয়াই হউক, জবালা যৌবনকালে বনিতারূপে বহু পুরুষের পরিচর্যা করিয়াছিলেন। ইহাদিগের মধ্যে কে সত্যকামের জনক ইহা নির্ণয় করা সম্ভব ছিল না। এই জন্যই জবালা সত্যকামের গোত্রাদি বলিতে পারেন নাই! হারিদ্রুমত গেতমও ইহাই বুঝিয়াছিলেন। তাহা না হইলে তিনি বলিবেন কেন— ‘অব্ৰাহ্মণ কখনও এ-প্রকার বলিতে পারে না। …তুমি সত্য হইতে বিচলিত হও নাই।’
সত্যকাম এমন কি বলিয়াছিলেন যাহা অব্রাহ্মণ বলিতে পারে না? তাহা নিশ্চয়ই কোন কলঙ্কের কথা এবং সেই কলঙ্ক মাতৃ-কলঙ্ক। গৌতম যখন দেখিলেন যে, সত্যকাম সত্যের অনুরোধে সরলভাবে মাতৃ-কলঙ্কের কথাও প্রকাশ করিলেন, তখন তিনি সিদ্ধান্ত করিলেন যে, ব্রাহ্মণ ভিন্ন কেহ এ প্রকার সরল ও সত্যবাদী হইতে পারে না। এইরূপে তিনি স্বীকার করিয়া লইলেন যে, সত্যকাম ব্রাহ্মণ। কিন্তু তাঁহার সিদ্ধান্ত সত্য কিনা তাহা নির্ণয় করা সম্ভব নয়।
৩০৫. তং হোবাচ কিংগোত্রো নু সোম্যাসীতি। স হোবাচ নাহমেতদ্বেদ ভো যদ্গোত্রোহহমস্ম্যপৃচ্ছং মাতরং সা মা প্রত্যব্রবীদ বহং চরন্তী পরিচারিণী যৌবনে ত্বামলভে সাহমেতন্ন বেদ যােত্রত্বমসি জবালা তু নামাহমস্মি সত্যকামো নাম ত্বমসীতি সোঽহং সত্যকামো জাবালোহস্মি ভো ইতি ॥ ৪
অন্বয় : তম্ হ উবাচ—কিং-গোত্রঃ নু সোম্য! অসি (হও)? ইতি। সঃ হ উবাচ—ন অহম্ এতৎ বেদ ভোঃ যৎ-গোত্রঃ অহম্ অমি। অপৃচ্ছম্ (জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম) মাতরম্ (মাতাকে)। সা (তিনি) মা (আমাকে) প্রতি + অব্রবীৎ (প্রত্যুত্তরে বলিয়াছেন বহু অহম্ চরন্তী পরিচারিণী যৌবনে ত্বাম্ অলভে, সা অহম্ এতদ্ ন বেদ যৎ-গোত্রঃ ত্বম্ অসি; জবালা তু নাম অহম্ অস্মি; সত্যকামঃ নাম ত্বম্ অসি ইতি। সঃ অহম্ সত্যকামঃ জাবালঃ অস্মি ভোঃ ইতি। (২য় মঃ দ্রঃ)।
সরলার্থ : গৌতম তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘হে সোম্য! তুমি কোন্ গোত্রীয়?” সত্যকাম বলিল, “ভগবান্, আমি কোন্ গোত্রীয় তাহা জানি না। আমি মাতাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। তিনি প্রত্যুত্তরে বলিয়াছেন—’আমি যৌবনে বহু বিচরণ করিয়া পরিচারিণী অবস্থায় (কিংবা আমি যৌবনে পরিচারিণীরূপে বহু পরিচর্যা করিয়া) তোমাকে পাইয়াছি। এই অবস্থায় আমি জানি না তুমি কোন্ গোত্রীয়। আমি জবালা, তুমি সত্যকাম; সুতরাং বলিও— ভগবান, আমি সত্যকাম জাবাল।”
৩০৬. তং হোবাচ নৈতদব্রাহ্মণো বিবক্কুমর্হতি সমিধং সোম্যাহরোপ ত্বা নেষ্যে ন সত্যাদগা ইতি তমুপনীয় কৃশানামবলানাং চতুঃশতা গা নিরাকৃত্যোবাচেমাঃ সোম্যানু সংব্রজেতি তা অভিপ্রস্থাপয়নু বাচ নাসহস্রেণাবর্তেয়েতি স হ বর্ষগণং প্রোবাস তা যদা সহস্ৰং সম্পেদুঃ ॥ ৫
অন্বয় : তম্ (তাহাকে) হ উবাচ (বলিলেন)—ন (না) এতৎ (ইহা) অব্রাহ্মণঃ বিবক্কুম্ (বিশেষরূপে বলিতে) অর্থতি (সমর্থ হয়)। সমিধম্, সোম্য! আহর (আহরণ করে)। উপ ত্বা নেষ্যে (ত্ত্বা উপনেষ্যে—তোমাকে উপনীত করাইব)। ন সত্যাৎ (সত্য হইতে) অগাঃ (বিচলিত হও নাই) ইতি। তম্ (তাহাকে উপনীয় (উপনীত করিয়া, উপনয়ন সম্পন্ন করিয়া) কৃশানাম্ অবলানাম্ (কৃশ ও দুর্বলদিগের) চতুঃশতাঃ (বৈদিক প্রয়োগ; চতুঃশতম্ = চারি শত) গাঃ (গো-সমূহকে) নিরাকৃত্য (পৃথক করিয়া) উবাচ—ইমাঃ (এই সমুদয়কে) সোম্য! অনু সং ব্রজ (অনুগমন কর) ইতি। তাঃ (সেই সমুদয়কে) অভিপ্রস্থাপয়ন্ (লইয়া যাইবার সময়) উবাচ— ন অসহস্রেণ (সহস্রসংখ্যা পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত) আবর্তেয় (ফিরিয়া আসিব) ইতি। সঃ হ বর্ষগণম্ (বহুবর্ষ) প্র + উবাস (প্রবাস করিয়াছিল)। তাঃ (তাহারা) যদা (যখন সহস্রম্ (সহস্ৰসংখ্যা) সংপেদুঃ (পূর্ণ হইয়াছিল)।
সরলার্থ : গৌতম সত্যকামকে বলিলেন, ‘অব্রাহ্মণ কখনও এরকম বলিতে পারে না। তুমি সমিধ কাষ্ঠ আন। আমি তোমাকে উপনীত করিব (অর্থাৎ তোমার উপনয়ন হইবে); তুমি সত্য হইতে বিচলিত হও নাই।’ তাহার উপনয়নের পর তিনি চারি শত দুর্বল ও কৃশ গরু পৃথক করিয়া নিয়া বলিলেন——হে সৌম্য, ইহাদের নিয়া যাও।’ গরু নিয়া যাইবার সময় সত্যকাম বলিল—’সহস্ৰ পূর্ণ না হইলে আমি ফিরিব না।’ এইরূপে সে বহু বৎসর অন্যত্র বাস করিল। গরুর সংখ্যা যখন এক সহস্র হইল—।
পঞ্চম খণ্ড – ব্রহ্মের চতুষ্কল প্রথমপাদ ‘প্রকাশবান্’
৩০৭. অথ হৈনমৃষভোহভ্যুবাদ সত্যকাম ৩ ইতি ভগব ইতি হ প্রতিশুশ্রাব প্রাপ্তাঃ সোম্য সহস্রং স্মঃ প্রাপয় ন আচার্য কুলম্ ॥ ১
অন্বয় : অথ হ এম (ইহাকে) ঋষভঃ (এক বৃষ) অভি + উবাদ (বলিল) — সত্যকাম ৩ (হে সত্যকাম! ৩ পুতস্বরের চিহ্ন) ইতি। ভগবঃ (ভগবন্) ইতি হ প্ৰতিশুশ্রাব (প্রত্যুত্তর করিল)। প্রাপ্তাঃ (প্রাপ্ত) (সাম্য, সহস্রম্ স্ম (হইয়াছি)। প্রাপয় (লইয়া যাও নঃ (আমাদিগকে) আচাৰ্যকুলম্ (আচার্য গৃহে)।
সরলার্থ : তখন একটি বৃষ তাহাকে ডাকিয়া বলিল—’সত্যকাম!” সত্যকাম উত্তর দিল—’ভগবান্!” (বৃষ বলিল)—’সৌম্য, আমরা এক সহস্র হইয়াছি; আমাদের আচার্যের গৃহে নিয়া চল।”
৩০৮. ব্রহ্মণশ্চ তে পাদং ব্রবাণীতি ব্রবীতু মে ভগবানিতি তস্মৈ হোবাচ প্রাচী দিক্কলা প্রতীচী দিক্কলা দক্ষিণা দিক্কলোদীচী দিক্কলৈষ বৈ সোম্য চতুষ্কলঃ পাদো ব্রহ্মণঃ প্রকাশবান্নাম ॥ ২
অন্বয় : ব্রহ্মণঃ (ব্রহ্মের) চ তে (তোমাকে) পাদম্ (এক পাদকে অর্থাৎ চতুর্থাংশকে ব্রবাণি (বলি) ইতি। ব্রবীতু (বলুন) মে (আমাকে) ভগবান্ ইতি। তস্মৈ (তাহাকে) হ উবাচ (বলিল) প্রাচী দিক্ (পূর্বদিক্) কলা (এক কলা অর্থাৎ ১/১৬); প্রতীচী (পশ্চিম) দিক্ কলা; দক্ষিণ দিক্ কলা; উদীচী (উত্তর) দিক্ কলা (কলা)। এষঃ বৈ (ইহাই) সোম্য! চতুষ্কলঃ পাদঃ (চারিকলা বিশিষ্ট একপাদ) ব্রহ্মণঃ প্রকাশাবান্ নাম।
সরলার্থ : (বৃষ বলিল)—’তোমাকে ব্রহ্মের এক পাদ বলিতেছি।’ (সত্যকাম বলিলেন), (‘ভগবান, বলুন।’ বৃষ বলিল—’পূর্বদিক ব্রহ্মের এক কলা, পশ্চিমদিক এক কলা, দক্ষিণদিক এক কলা এবং উত্তর দিক এক কলা। হে সৌম্য, ইহাই ব্রহ্মের চারি কলাবিশিষ্ট এক পাদ যার নাম প্রকাশবান্। ‘
৩০৯. স য এতমেবং বিদ্বাংশ্চতুষ্কলং পাদং ব্রহ্মণঃ প্রকাশবানিত্যুপাস্তে প্রকাশবানস্মিঁল্লোকে ভবতি প্রকাশবতো হ লোকাঞ্জয়তি য এতমেবং বিদ্বাংশ্চতুষ্কলং পাদং ব্রহ্মণঃ প্রকাশবানিত্যুপাস্তে ॥ ৩
অন্বয় : সঃ যঃ এতম্ (ইহাকে) এবম্ (এই প্রকার) বিদ্বান্ (জানিয়া) চতুষ্কলম্ পাদম্ ব্রহ্মণঃ (ব্রহ্মের) প্রকাশবান্ ইতি উপাস্তে (উপাসনা করে), প্রকাশবান্ (প্রখ্যাত, প্রতিষ্ঠাবান্) অস্মিন্ লোক (এই লোকে) ভবতি (হন), প্রকাশবতঃ হ লোকান্ (উজ্জ্বল লোকসমূহকে) জয়তি (জয় করেন) যঃ এতম্ এবম্ বিদ্বান্ চতুষ্কলম্ পাদম্ ব্রহ্মণঃ প্রকাশবান্ ইতি উপাস্তে (দ্বিরুক্তি)।
সরলার্থ : যিনি এইভাবে জানিয়া ব্রহ্মের চতুষ্কল পাদকে ‘প্রকাশবান্’ রূপে উপাসনা করেন, তিনি এই লোকে প্রতিষ্ঠাবান হন; এবং (মৃত্যুর পর) উজ্জ্বল লোকসমূহ জয় করেন।
ষষ্ঠ খণ্ড – ব্রহ্মের চতুষ্কল দ্বিতীয় পাদ—’অনন্তবান্’
৩১০. অগ্নিষ্টে পাদং বক্তেতি স হ শ্বোভূতে গা অভিপ্রস্থাপয়াঞ্চকার তা যত্রাভিসায়ং বভূবুস্তত্রাগ্নিমুপসমাধায় গা উপরুধ্য সমিধমাধায় পশ্চাদগ্নেঃ প্রাঙুপোপবিবেষ ॥১
অন্বয় : অগ্নিঃ তে (তোমাকে) পাদম্ বক্তা (বলিবে) ইতি। সঃ (সে) হ শ্বঃ ভূতে (পরদিনে) গাঃ (গো-সমূহকে) অভিপ্রস্থাপয়াঞ্চকার (প্রস্থান করাইল)। তাঃ (সেই গোসমূহ) যত্র (যেখানে) অভিসায়ম্ বভূবুঃ (সায়ংকাল প্রাপ্ত হইল; সায়ংকালে একত্র হইল) তত্র (সেই স্থানে) অগ্নিম্ উপসমাধায় (অগ্নি প্রজ্বলিত করিয়া) গাঃ উপরুধ্য (অবরোধ করিয়া) সমিধম্ আধায় (আহরণ করিয়া) পশ্চাৎ অগ্নেঃ (অগ্নির পশ্চাৎভাগে); প্রাঙ্ (পূর্বমুখ হইয়া) উপ+উপবিবেশ (‘গো ও অগ্নির’ সমীপে উপবেশন করিল)।
সরলার্থ : (বৃষ আরও বলিল)—’অগ্নি তোমাকে একপাদ বলিবে।’ পরদিন সত্যকাম গরুগুলিকে নিয়া (গুরুগৃহে) যাত্রা করিল। গরুগুলি সন্ধ্যাকালে যেখানে একত্র হইল সেখানে আগুন জ্বালিয়া তাহাদের আবদ্ধ করিল। তারপর কাঠ সংগ্রহ করিয়া অগ্নির পশ্চাদ্ভাগে পূর্বমুখ হইয়া বসিল।
মন্তব্য : অগ্নিঃ + তে = অগ্নিস্তে; ‘অগ্নিষ্টে’ বৈদিকপ্রয়োগ। ‘অভিসায়ম্ বভূবঃ’ অংশের দুই প্রকার অন্বয় হইতে পারে : (ক) অভিসায়ম্ বভূবুঃ—সায়ংকালের অভিমুখী হইয়াছিল; অভিসায়ম্—সায়ংকালের অভিমুখ। (খ) সায়ম্ অভিবভূবুঃ—সায়ংকালকে প্রাপ্ত হইয়াছিল বা সায়ংকালের অভিমুখ হইয়াছিল। আনন্দগিরি বলেন, ‘উপ উপবিবেশ’ অংশে ‘উপ’ দুইবার থাকায় বুঝিতে হইবে ‘গো ও অগ্নি উভয়েরই সমীপে উপবেশন করিবার কথা বলা হইয়াছে। ‘
৩১১. তমগ্নিরভ্যুবাদ সত্যকাম ৩ ইতি ভগব ইতি হ প্রতিশুশ্রাব ॥ ২
অন্বয় : তম্ (তাহাকে) অগ্নিঃ অভি + উবাদ (বলিল)—সত্যকাম ৩ ইতি। ভগবঃ ইতি হ প্রতিশুশ্রাবঃ (৪।৫।১ টীকা)।
সরলার্থ : অগ্নি তাহাকে ডাকিল’সত্যকাম!’ সত্যকাম উত্তর করিল—’ভগবান্’।
৩১২. ব্রহ্মণঃ সোম্য তে পাদং ব্রবাণীতি ব্রবীতু মে ভগবানিতি তস্মৈ হোবাচ পৃথিবী কলান্তরিক্ষং কলা দ্যৌঃ কলা সমুদ্ৰঃ কলৈষ বৈ সোম্য চতুষ্কলঃ পাদো ব্রহ্মণোহনন্তবান্নাম ॥৩
অন্বয় : ব্ৰহ্মণঃ সোম্য! তে পাদম্ ব্রবাণি ইতি। ব্রবীতু মে ভগবান্ ইতি। তস্মৈ হ উবাচ—পৃথিবী কলা; অন্তরিক্ষম্ কলা; দ্যৌঃ কলা; সমুদ্রঃ কলা; এষঃ বৈ সোম্য! চতুষ্কলঃ পাদঃ ব্রহ্মণঃ অনন্তবান্ নাম (৪।৫। ২)।
সরলার্থ : অগ্নি বলিল, ‘হে সৌম্য, তোমাকে ব্রহ্মের এক পাদ বলি।’ সত্যকাম বলিল, ‘ভগবান, বলুন।’ অগ্নি তাহাকে বলিল—’পৃথিবী এক কলা; অন্তরিক্ষ এক কলা; দ্যুলোক এক কলা; সমুদ্র এক কলা। হে সৌম্য, ইহাই ব্রহ্মের চারি কলা যুক্ত এক পাদ, ইহার নাম ‘অনন্তবান্’
৩১৩. স ষ এতমেবং বিদ্বাংশ্চতুষ্কলং পাদং ব্রহ্মণোহনন্তবানিত্যু-পাস্তেহনন্তবানস্মিঁল্লোকে ভবত্যনন্তবতো হল লোকাঞ্জয়তি য এতমেবং বিদ্বাংশ্চতুঙ্কলং পাদং ব্রহ্মণোহনন্তবানিত্যুপাস্তে ॥ ৪
অন্বয় : সঃ যঃ এতম্ এবম্ বিদ্বান্ চতুষ্কলম্ পাদম্ ব্রহ্মণঃ অনন্তবান্ ইতি উপাস্তে অনন্তবান্ অস্মিন্ লোকে ভবতি, অনন্তবতঃ হ লোকান্ (অনন্তবান্ অর্থাৎ অক্ষয় লোকসমূহকে) জয়তি, যঃ এতম্ এবম্ বিদ্বান্ চতুষ্কলম্ পাদম্ ব্রহ্মণঃ অনন্তবান্ ইতি উপাস্তে (৪।৫।৩)।
সরলার্থ : যিনি ইহাকে এই ভাবে জানিয়া ব্রহ্মের চতুষ্কল পাদকে ‘অনন্তবান্’ বলিয়া উপাসনা করেন, তিনি ইহলোকে অনন্তবান হন এবং (মৃত্যুর পর) অনন্তবান (অর্থাৎ অক্ষয়) লোকসমূহ জয় করেন।
সপ্তম খণ্ড – ব্রহ্মের চতুষ্কল তৃতীয় পাদ—’জ্যোতিষ্মান্’
৩১৪. হংসস্তে পাদং বক্তেতি স হ শ্বোভূতে গা অভিপ্রস্থাপয়াঞ্চকার তা যত্রাভিসায়ং বভূবুস্তত্রাগ্নিমুপসমাধায় গা উপরুধ্য সমিধমাধায় পশ্চাদগ্নেঃ প্রাঙুপোপবিবেশ ॥১
অন্বয় : হংসঃ তে পাদম্ বক্তা ইতি। সঃ হ শ্বঃ+ভূতে গাঃ অভিপ্রস্থাপয়াঞ্চকার তাঃ যত্র অভিসায়ম্ বভূবুঃ, তত্র অগ্নিম্ উপসমাধায়, গাঃ উপরুধ্য, সমিধম্ আধায়, পশ্চাৎ অগ্নেঃ প্রা উপ উপবিবেশ।
সরলার্থ : (বৃষ আরও বলিল)—’হংস তোমাকে ব্রহ্মের এক পাদ বলিবে।’ পরদিন সত্যকাম গরু লইয়া (আচার্যের গৃহাভিমুখে) যাত্রা করিল। সন্ধ্যায় তাহারা যেখানে এক হইল সেইখানে অগ্নি জ্বালিয়া গরুগুলিকে আবদ্ধ করিল। তারপর কাঠ সংগ্রহ করিয়া অগ্নির পশ্চাদ্ভাগে পূর্বমুখ হইয়া বসিল।
৩১৫. তং হংস উপনিপত্যাভ্যুবাদ সত্যকাম ৩ ইতি ভগব ইতি হ প্রতিশুশ্ৰাব ॥ ২ অন্বয় : তম্ হংসঃ উপনিপত্য (উড়িয়া আসিয়া) অভি+উবাদ সত্যকাম৩ ইতি। ভগবঃ ইতি হ প্রতিশুশ্ৰাব।
সরলার্থ : হংস তাহার নিকট উড়িয়া আসিয়া বলিল ‘সত্যকাম!” সত্যকাম প্রত্যুত্তরে বলিল ‘ভগবান্!
৩১৬. ব্রহ্মণঃ সোম্য তে পাদং ব্রবাণীতি ব্রবীতু মে ভগবানিতি তস্মৈ হোবাচাগ্নিঃ কলা সূর্যঃ কলা চন্দ্ৰঃ কলা বিদ্যুৎ কলৈষ বৈ সোম্য চতুষ্কলঃ পাদো ব্ৰহ্মণো জ্যোতিষ্মান্নাম ॥ ৩
অন্বয় : ব্রহ্মণঃ সোম্য, তে পাদম্ ব্রবাণি ইতি। ব্রবীতু মে ভগবান্ ইতি। তস্মৈ হ উবাচ—অগ্নিঃ কলা, সূর্যঃ কলা, চন্দ্রঃ কলা, বিদ্যুৎ কলা। এষঃ বৈ, সোম্য, চতুষ্কলঃ পাদঃ ব্রহ্মণঃ জ্যোতিষ্মান্ নাম (৪।৫।২ মন্ত্র দ্রষ্টব্য)।
সরলার্থ : হংস বলিল——সৌম্য, আমি তোমাকে ব্রহ্মের একপাদ বলিব। সত্যকাম বলিল—বলুন, ভগবান্। হংস বলিল—অগ্নি এক কলা, সূর্য এক কলা, চন্দ্র এক কলা, বিদ্যুৎ এক কলা। হে সৌম্য, ইহা ব্রহ্মের চারিকলা বিশিষ্ট এক পাদ; ইহার নাম জ্যোতিষ্মান্।।
৩১৭. স য এতমেবং বিদ্বাংশ্চতুষ্কলং পাদং ব্রহ্মণো জ্যোতিম্মানিত্যুপাস্তে জোতিষ্মানস্মিঁল্লোকে ভবতি জ্যোতিষ্মতো হ লোকাঞ্জয়তি য এতমেবং বিদ্বাংশ্চতুষ্কলং পাদং ব্রহ্মণো জ্যোতিম্মানিত্যুপাস্তে॥৪
অন্বয় : সঃ যঃ এতম্ এবম্ বিদ্বান্ চতুষ্কলম্ পাদম্ ব্রহ্মণঃ জ্যোতিষ্মান ইতি উপাস্তে, জ্যোতিষ্মান্ অস্মিন্ লোকে ভবতি, জ্যোতিষ্মতঃ হ লোকান্ (জ্যোতির্ময় (লাকসমূহকে) জয়তি—যঃ এতম্ এবম্ বিদ্বান্ চতুষ্কলম্ পাদম্ ব্রহ্মণঃ জ্যোতিষ্মান ইতি উপাস্তে (৪।৫।৩ মন্ত্র দ্রষ্টব্য)।
সরলার্থ : যিনি ইহাকে এইভাবে জানিয়া ব্রহ্মের এই চতুষ্কল পাদকে জ্যোতিষ্মান রূপে উপাসনা করেন, তিনি এই লোকে জ্যোতিষ্মান হন, এবং (মৃত্যুর পরে) জ্যোতির্ময় লোকসমূহ লাভ করেন।
অষ্টম খণ্ড – ব্রহ্মের চতুষ্কল চতুর্থ পাদ—‘আয়তনবান্’
৩১৮. মদ্ষ্টে পাদং বক্তেতি সহ শ্বোভূতে গা অভিপ্রস্থাপয়াঞ্চকার তা যত্রাভিসায়ং বভূবুস্তত্রাগ্নিমুপসমাধায় গা উপরুধ্য সমিধমাধায় পশ্চাদগ্নেঃ প্রাঙুপোপবিবেষ ॥১
অন্বয় : মদগুঃ তে পাদম্ বক্তা ইতি। সঃ হ শ্বঃভূতে গাঃ অভিপ্রস্থাপয়াঞ্চকার। তাঃ যত্র অভিসায়ম্ বভূবুঃ, অত্র অগ্নিম্ উপসমাধায়, গাঃ উপরুধ্য, সমিধম্ আধায়, পশ্চাৎ অগ্নেঃ প্রাত্ উপ উপবিবেশ (৪।৬।১ মন্ত্র দ্রষ্টব্য)।
সরলার্থ : (হংস আরও বলিল)—’মদ্ তোমাকে (ব্রহ্মের) একপাদ বলিবে’। পরদিন সত্যকাম গরু লইয়া (গুরু-গৃহাভিমুখে) যাত্রা করিল। যেখানে তাহারা সন্ধ্যাকালে একত্র হইল, সেখানে সত্যকাম অগ্নি জ্বালিয়া গরুগুলিকে আবদ্ধ করিয়া তারপর সমিধহস্তে অগ্নির পশ্চাতে পূর্বমুখ হইয়া বসিল।
মন্তব্য : মদ্ এক প্রকার জলচর পাখী।
৩১৯. তং মদ্রুপনিপত্যাভ্যুবাদ সত্যকাম৩ ইতি ভগব ইতি হ প্রতিশুশ্রাব ॥ ২
অন্বয় : তম্ মদ্গুঃ উপনিপত্য (৪।৫।৩ মন্ত্র দ্রষ্টব্য) অভি+উবাদ সত্যকাম ৩ ইতি। ভগবঃ ইতি হ প্রতি শুশ্রাব (৪।৫।২ মন্ত্র দ্রষ্টব্য)।
সরলার্থ : মগু তাঁহার নিকট উড়িয়া আসিয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিল—‘সত্যকাম!’ উত্তরে সত্যকাম বলিল, ‘ভগবান্!’
৩২০. ব্রহ্মণঃ সোম্য, তে পাদং ব্রবাণীতি ইতি ব্রবীতু মে ভগবানিতি তস্মৈ হোবাচ প্রাণঃ কলা, চক্ষুঃ কলা শ্রোত্রং কলা মনঃ কলৈষ বৈ সোম্য চতুষ্কলঃ পাদো ব্ৰহ্মণ আয়তনবান্নাম ॥ ৩
অন্বয় : ব্রাহ্মণঃ, সোম্য, তে পাদম্ ব্রবাণি ইতি ব্রবীতু ভগবান্ ইতি। তস্মৈ হ উবাচ প্রাণঃ কলা, চক্ষুঃ কলা, কর্ণ শ্রোত্রম্ কলা, মনঃ কলা। এষঃ বৈ সোম্য, চতুষ্কলঃ ব্রাহ্মণঃ আয়তনবান্ নাম (৩।৫।২ মন্ত্র দ্রষ্টব্য)
সরলার্থ : মদ্ বলিল ‘হে সৌম্য, তোমাকে ব্রহ্মের এক পাদ বলি।’ (সত্যকাম বলিল)—‘ভগবান, আমাকে বলুন’ মদ্ বলিল, ‘প্রাণ এক কলা, চক্ষু এক কলা, এক কলা, মন এক কলা। হে সৌম্য, ইহাই ব্রহ্মের চতুষ্কল এক পাদ—ইহার নাম আয়তনবান্ (অর্থাৎ আশ্ৰয়বান)।’
৩২১. স য এতমেবং বিদ্বাংশ্চতুষ্কলং পাদং ব্রহ্মণ আয়তনবানিত্যুপাস্ত আয়তনবানস্মিঁল্লোকে ভবত্যায়তনবতো হ লোকাঞ্জয়তি য এতমেবং বিদ্বাংশ্চতুষ্কলং পাদং ব্রহ্মণ আয়তনবানিত্যুপাস্তে ॥৪
অন্বয় : সঃ যঃ এতম্ এবম্ বিদ্বান্ চতুষ্কলম্ পাদম্ ব্রহ্মণঃ আয়তনবান্ ইতি উপাস্তে, আয়তনবান্ অস্মিন্ লোকে ভবতি, আয়তনবতঃ হ লোকান্ (আয়তনবান লোকসমূহকে) জয়তি— যঃ এতম্ এবম্ বিদ্বান্ চতুষ্কলম্ পাদম্ ব্রহ্মণঃ আয়তনবান্ ইতি উপাস্তে (৪।৫।৩ মন্ত্র দ্রষ্টব্য)।
সরলার্থ : যিনি ইহাকে এই রকম ভাবে জানিয়া ব্রহ্মের এই চতুষ্কল পাদকে আয়তনবান বলিয়া উপাসনা করেন, তিনি এই লোকে আয়তনবান (অর্থাৎ আশ্রয়বান, হন এবং (মৃত্যুর পরে) আয়তনযুক্ত লোকসমূহ লাভ করেন।
নবম খণ্ড – সত্যকাম জাবালের প্রকৃতি-লব্ধ ও মানব-লব্ধ শিক্ষা
৩২২. প্রাপ হাচাৰ্যকুলং তমাচার্যোহভ্যূবাদ সত্যকাম ৩ ইতি ভগব ইতি হ প্ৰতিশুশ্ৰাব ॥ ১
অন্বয় : প্রাপ (প্রাপ্ত হইল) হ আচাৰ্যকুলম্ (আচার্যগৃহকে) তম্ (তাহাকে আচার্যঃ অভ্যুবাদ (বলিলেন)—সত্যকাম ৩! ইতি। ভগবঃ ইতি হ প্রতিশুশ্রাব (৪।৫। ১ মন্ত্র দ্রষ্টব্য)
সরলার্থ : তারপর সত্যকাম আচার্যের গৃহে উপস্থিত হইল। আচার্য গৌতম তাহাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন—‘সত্যকাম!’ প্রত্যুত্তরে সত্যকাম বলিল, ‘ভগবান্!’
৩২৩. ব্ৰহ্মবিদিব বৈ সোম্য ভাসি কো নু ত্বানুশশাসেত্যন্যে মনুষ্যেভ্য ইতি হ প্রতিজজ্ঞে ভগবাংত্ত্বেব মে কামে ব্রুয়াৎ ॥ ২
অন্বয় : ব্রহ্মবিৎ ইব (ব্রহ্মবিদের ন্যায়) বৈ সোম্য ভাসি (দীপ্তি পাইতেছ)। কঃ (কে) নু ত্বা (তোমাকে) অনুশশাস (উপদেশ দিয়াছে)? ইতি। অন্যে মনুষ্যেভ্যঃ (মনুষ্য হইতে অন্য) ইতি হ প্রতিজজ্ঞে (বলিল)। ভগবান্ তু এব মে কামে (আমার ইচ্ছাতে; কিংবা, মে—আমাকে বা আমার; কামে—অভীষ্টবিষয়ে) ব্রুয়াৎ (বলুন)।
সরলার্থ : (আচার্য বলিলেন)—’সৌম্য, তুমি ব্রহ্মবিদের মত দীপ্তি পাইতেছ। কে তোমাকে উপদেশ দিয়াছে?’ সত্যকাম বলিল—’মানুষ ভিন্ন অন্যে। এইবার আপনি আমাকে অভীষ্ট বিষয়ে উপদেশ দিন। (কিংবা আমার ইচ্ছা আপনিই আমাকে উপদেশ দিন)।
৩২৪. শ্রুতং হ্যেব মে ভগবদ্দৃশেভ্য আচার্যাদ্ধৈব বিদ্যা বিদিতা সাধিষ্ঠং প্রাপয়তীতি তস্মৈ হৈতদেবোবাচাত্র হ ন কিংচন বীয়ায়েতি বীয়ায়েতি ॥ ৩
অন্বয় : শ্রুতম্ হি এব মে (আমি শুনিয়াছি; মে = ময়া—আমাকর্তৃক) ভগবদ্ দৃশেভ্যঃ (ভবাদৃশ লোকদিগের নিকট হইতে), আচার্যাৎ হ এব (আচার্য হইতে) বিদ্যা বিদিতা (বিদ্যা বিদিত হইলে) সাধিষ্ঠম্ (সাধু = ইষ্ঠ, সাধুতমত্ব) প্রাপয়তি (প্রাপ্ত করায়) ইতি। তস্মৈ (সত্যকামকে) হ এতং এব (এই বিদ্যাকেই) উবাচ (বলিলেন)। অত্র (এই বিষয়ে) হ ন (না) কিঞ্চন (কিছুই) বীয়ায় (পরিত্যক্ত হইয়াছে) ইতি; বীয়ায় ইতি (দ্বিরুক্তি সমাপ্তিসূচক)।
সরলার্থ : আপনার মত ব্যক্তিদিগের নিকট শুনিয়াছি যে, আচার্যের কাছে বিদ্যা লাভ করিলেই তাহা সর্বাপেক্ষা কল্যাণকর হয়। তখন আচার্য সত্যকামকে সেই সবই (অর্থাৎ বৃষ, অগ্নি, হংস এবং মদ্ যে সব উপদেশ দিয়াছিল তাহার সমস্তই) বলিলেন, কিছুই বাদ গেল না।
দশম খণ্ড – উপকোসল কামলায়ন-প্রাপ্ত অগ্নিবিদ্যা
৩২৫. উপকোসলো হ বৈ কামলায়নঃ সত্যকামে জাবালে ব্রহ্মচর্যমুবাস তস্য হ দ্বাদশবর্ষাণ্যগ্নীন্ পরিচচার স হ স্মান্যানন্তেবাসিনঃ সমাবর্তয়ংতং হ মৈব ন সমাবর্তয়তি ॥ ১
অন্বয় : উপকোসলঃ হ বৈ কামলায়নঃ (কমলের পুত্র) সত্যকামে জাবালে (সত্যকাম জাবালের নিকট) ব্রহ্মচর্যম্ উবাস (ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করিয়া বাস করিয়াছিল) তস্য হ (সত্যকামের) দ্বাদশবর্ষাণি (বার বৎসর) অগ্নীন্ পরিচচার—(পরিচর্যা করিয়াছিল)) সঃ (গুরু) হ স্ম (হ, বৈ ইত্যাদির অনুরূপ অব্যয়) অন্যান্ অন্তেবাসিনঃ (অন্য শিষ্যগণকে) সমাবর্তয়ন্ (সমাবর্তন করাইয়া; ব্রহ্মচর্য সমাপ্তির পর গৃহে প্রত্যাগমনের নাম ‘সমাবর্তন’) তম্ (তাহাকে) হ এব ন (না) সমাবর্তয়তি স্ম (সমাবর্তন করাইলেন)।
সরলার্থ : উপকোসল কামলায়ন সত্যকাম জাবালের নিকট ব্রহ্মচর্যবাস করিয়া বার বৎসর গুরুর অগ্নি—পরিচর্যা করিয়াছিল। সত্যকাম অন্য শিষ্যদিগকে সমাবর্তন করাইলেন, কিন্তু উপকোসলকে করাইলেন না।
৩২৬. তং জায়োবাচ তপ্তো ব্রহ্মচারী কুশলমগ্নীন্ পরিচচারীন্মা ত্বাগ্নয়ঃ পরিপ্রবোচন্ প্রব্রুহ্যমা ইতি তস্মৈ হাপ্রোচ্যেব প্ৰবাসাং চক্রে ॥ ২
অন্বয় : তম্ (সত্যকামকে) জয়া উবাচ (বলিলেন)—তপ্তঃ (তপস্যাযুক্ত বা ক্লিষ্ট ব্রহ্মচারী কুশলম্ (নৈপুণ্যসহকারে) অগ্নীন্ পরিচ্চারীৎ (বিদিকপ্রয়োগ—পরিচচার; পরিচর্যা করিয়াছিল)। মা (না) ত্বা (তোমাকে) অগ্নয়ঃ (অগ্নিরা) প্রাবোচন (নিন্দা করুক)। প্রহি (উপদেশ দাও) অস্মৈ (ইহাকে) ইতি। তস্মৈ (তাহাকে) হ অপ্ৰেচ্য (উপদেশ না দিয়াই) এর প্রবাসাঞ্চক্রে (প্রবাসে চলিয়া গেলেন)।
সরলার্থ : তাঁহার পত্নী তাঁহাকে বলিলেন—’ব্রহ্মচারী তপস্যানিষ্ঠ হইয়া (অথবা ক্লেশ করিয়া) নৈপুণ্যের সহিত অগ্নির পরিচর্যা করিয়াছে। অগ্নি যেন তোমাকে নিন্দা না করে—তুমি ইহাকে উপদেশ দাও।’ কিন্তু তিনি উপদেশ না দিয়াই প্রবাসে চলিয়া গেলেন।
মন্তব্য : ‘পরিপ্রবোচন’ ইত্যাদি। কেহ কেহ ইহার এইরূপ অর্থ করেন — ‘তোমার অগ্রে অগ্নিসমূহ যেন ইহাকে উপদেশ না দেয়; সুতরাং তুমিও ইহাকে উপদেশ দাও।’
৩২৭. স হ ব্যাধিনানশিতুং দধ্রে। তমাচার্যজায়োবাচ ব্রহ্মচারিন্নশান কিং নু নান্নাসীতি। স হোবাচ বহব ইমেহস্মিন্ পুরুষে কামা নানাত্যয়া ব্যাধিভিঃ প্রতিপূর্ণোহস্মি নাশিষ্যামীতি ॥ ৩
অন্বয় : সঃ (উপকোসল) হ ব্যাধিনা (ব্যাধিবশতঃ; মানসিক দুঃখবশত) অনশিতুম্ (অনাহারে থাকিতে) দধ্রে (ধারণ করিয়াছিল, মনন করিয়াছিল) তম্ (তাহাকে) আচার্য- জায়া উবাচ—ব্রহ্মচারিন্! অশান (অশ্; ভোজন কর) কিম্ নু (কেন) ন অশ্বাসি (ভোজন করিতেছ)? ইতি। সঃ (সে) হ উবাচ—বহবঃ (বহু) ইমে কামাঃ (এই সমুদয় কামনা) অস্মিন্ পুরুষে (এই পুরুষে অর্থাৎ আমাতে) নানাত্যয়াঃ (নানাদিকে যাহাদের গতি); ব্যাধিভিঃ (ব্যাধিসমূহ দ্বারা) প্রতিপূর্ণঃ (পরিপূর্ণ) অস্মি (হই) ন (না) অশিষ্যামি (ভক্ষণ করিব)।
সরলার্থ : উপকোসল মনোদুঃখে অনশন আরম্ভ করিল। তখন আচার্যজায়া তাঁহাকে বলিলেন—’হে ব্রহ্মচারী, আহার কর; কেন আহার করিতেছ না?’ উপকোসল বলিল— ‘এই পুরুষে (অর্থাৎ আমাতে) নানা পথগামী কামনাসকল রহিয়াছে। আমি নানা ব্যাধিতে (অর্থাৎ মানসিক দুঃখে) পরিপূর্ণ। আমি আহার করিব না।’
৩২৮. অথ হাগ্লয়ঃ সমুদিরে তপ্তো ব্রহ্মচারী কুশলং নঃ পর্যচারীদ্ধন্তাস্মৈ প্ৰব্ৰবামেতি তস্মৈ হোচুঃ প্রাণো ব্রহ্ম কং ব্রহ্ম খং ব্রহ্মেতি ॥ ৪
অন্বয় : অথ হ অগ্নয়ঃ সম্ + উদিরে (বলিতে লাগিল)—তপ্তঃ (তপস্যাশীল, ক্লিষ্ট) ব্রহ্মচারী কুশলম্ (নিপুণতার সহিত) নঃ (আমাদিগকে) পরি+অচারীৎ (পরিচর্যা করিয়াছে।) হন্ত (আদরসূচক অব্যয়) অস্মৈ (ইহাকে) প্রব্রবামঃ (উপদেশ দিই) ইতি। তস্মৈ (তাহাকে) হ উচুঃ (বলিয়াছিল) প্রাণঃ ব্রহ্ম, কম্ (ক—সুখ) ব্রহ্ম; খম্ (খ—আকাশ)) ব্ৰহ্ম ইতি।
সরলার্থ : তখন অগ্নিগণ (দক্ষিণাগ্নি, গার্হপত্য ও আহবনীয়—এই তিন অগ্নি) পরস্পর বলিতে লাগিল—’এই তপঃক্লিষ্ট ব্রহ্মচারী সহযত্নে আমাদের পরিচর্যা করিয়াছে। আমরা ইহাকে উপদেশ দিই।’ তারপর তাহারা বলিল ‘প্রাণই ব্রহ্ম; ‘ক’ অর্থাৎ সুখই ব্ৰহ্ম, ‘খ’ অর্থাৎ আকাশই ব্ৰহ্ম। ‘
৩২৯. স হোবাচ বিজানাম্যহং যৎ প্রাণো ব্রহ্ম কঞ্চ তু খঞ্চ ন বিজানামীতি। তে হোচুর্যদ্বাব কং তদেব খং যাদেব খং তদেব কমিতি প্রাণং চ হাস্মৈ তদাকাশং চোচুঃ ॥ ৫
অন্বয় : সঃ (সে) হ উবাচ (বলিল)—বিজানামি (জানি) অহম্ (আমি) যৎ (যে) প্ৰাণঃ ব্রহ্ম। কম্ চ (ক অর্থাৎ সুখকে) তু খম্ চ (খ অর্থাৎ আকাশকে) ন বিজানামি ইতি। তে (তাহারা) হ উঁচুঃ (বলিল)—যৎ (যাহা) বাব কম্ (সুখ), তৎ (তাহা) এব খম্ (আকাশ); যৎ এব খম্, তৎ এব কম্ ইতি। প্রাণম্ চ (প্রাণকে) হ অস্মৈ (ইহাকে, উপকোসলকে) তৎ আকাশম্ চ উচুঃ (বলিয়াছিল)।
সরলার্থ : উপকোসল বলিল—”প্রাণ যে ব্রহ্ম তাহা জানি; কিন্তু ‘ক’ এবং ‘খ’ যে ব্ৰহ্ম, তাহা জানি না।” তাহারা বলিল—”যাহা ‘ক’ তাহাই ‘খ’ এবং যাহা ‘খ’ তাহাই ‘ক’।” অগ্নিগণ উপকোশলকে ‘ব্রহ্মই প্রাণ এবং আকাশ’—এই উপদেশ দিয়াছিলেন।
মন্তব্য : এই মন্ত্রের শেষ অংশের নিম্নলিখিত অর্থ হইতে পারে—(১) তাহাকে প্রাণের বিষয় এবং সেই আকাশের বিষয় বলিয়াছিলেন। (২) তাহাকে প্রাণের বিষয় এবং ব্রহ্মস্বরূপ আকাশের বিষয় বলিয়াছিলেন। (৩) তাহাকে প্রাণের বিষয় এবং হৃদয় আকাশের বিষয় বলিয়াছিলেন। (৪) ‘ব্ৰহ্মই প্রাণ এবং আকাশ’—তাহার নিকট ইহাই বলিয়াছিলেন। (৫) (ব্ৰহ্মই) প্রাণ এবং হৃদয়াকাশ—তাহার নিকট ইহাই বলিয়াছিলেন।
একাদশ খণ্ড – গার্হপত্যাগ্লিবিদ্যা—ব্ৰহ্ম সর্বগত
৩৩০. অথ হৈনং গার্হপত্যোহনুশশাস পৃথিব্যগ্নিরন্নমাদিত্য ইতি য এষ আদিত্যে পুরুষো দৃশ্যতে সোহহমস্মি স এবাহমস্মীতি ॥ ১
অন্বয় : অথ হ এনম্ গার্হপত্যঃ (গার্হপত্য অগ্নি) অনুশশাস (উপদেশ দিয়াছিল)—পৃথিবী অগ্নিঃ অন্নম্ আদিত্যঃ ইতি। যঃ এষঃ (এই যে) আদিত্যে পুরুষঃ দৃশ্যতে (দৃষ্ট হন), সঃ (তিনি) অহম্ (আমি) অস্মি (হই); সঃ এব (তিনিই) অহম্ অস্মি ইতি।
সরলার্থ : তারপর গার্হপত্য অগ্নি উপকোসলকে বলিল—পৃথিবী, অগ্নি, অন্ন ও আদিত্য (ইহারাই আমার তনু বা ব্রহ্মের তনু)। আদিত্যমণ্ডলে ঐ যে পুরুষকে দেখা যায় তিনি আমি, তিনিই আমি।
৩৩১. স য এতমেবং বিদ্বানুপাতেহপহতে পাপকৃত্যাং লোকী ভবতি সর্বমায়ুরেতি জ্যোগ্জীবতি নাস্যাবরপুরুষাঃ ক্ষীয়ন্ত উপ বয়ং তং ভুঞ্জামোহিস্মংশ্চ লোকেহমুষ্মিংশ্চ য এতমেবং বিদ্বানুপাস্তে ॥ ২
অন্বয় : সঃ যঃ এতম্ (ইহাকে) এবম্ (এইরূপে) বিদ্বান্ (জানিয়া) উপাস্তে (উপাসনা করে), অপহতে (বৈদিক প্রয়োগ, অপহতে (বৈকি প্রয়োগ, অপহন্তি-বিনাশ করে) পাপকৃত্যাম্ (পাপকর্মকে) লোকী (লোকবান্) ভবতি (হয়), সর্বম্ আয়ুঃ এতি, জ্যোক্ জীবতি, ন (না) অস্য (ইহার) অবরপুরুষাঃ (অধস্তন পুরুষগণ অর্থাৎ পুত্র-পৌত্রদি) ক্ষীয়ন্তে (ক্ষয় হয়); উপ বয়ম্ (আমরা) তম্ (তাহাকে) [উপ] ভুঞ্জামঃ; (প্রাচীন প্ৰয়োগ, উপভুঞ্জঃ—উপভোগ করি, পালন করি) অস্মিন্ চ লোকে (এই লোকে) অমুষ্মিন্ চ (ঐ লোকেও, পরলোকেও)—যঃ এতম্ এবম্ বিদ্বান্ উপাস্তে (দ্বিরুক্তি)।
সরলার্থ : যিনি ইহাকে এইভাবে জানিয়া উপাসনা করেন তাঁহার পাপকর্ম নাশ হয়। তিনি (দক্ষিণাগ্নির) লোক, পূর্ণ আয়ু এবং দীর্ঘজীবন লাভ করেন। তাঁহার সন্তানেরা বিনষ্ট হয় না। ইহলোকে এবং পরলোকেও আমরা তাঁহাকে রক্ষা করিয়া থাকি।
দ্বাদশ খণ্ড – দহ্মিণাগ্নি-বিদ্যা—ব্রহ্ম সর্বগত
৩৩২. অথ হৈনমন্বাহাৰ্যপচনোহনুশশাসাপো দিশো নক্ষত্রাণি চন্দ্ৰমা ইতি য এষ চন্দ্রমসি পুরুষো দৃশ্যতে সোহহমস্মি স এবাহমস্মীতি ॥ ১
অন্বয় : অথ হ এনম্ অন্বাহাৰ্যপচনঃ (অন্বাহাৰ্যপচন নামক অগ্নি, দক্ষিণাগ্নি) অনুশশাস—আপঃ (জল), দিশঃ (দিকসমূহ), নক্ষত্রাণি (নক্ষত্রসমূহ) চন্দ্ৰমাঃ ইতি। যঃ এষঃ চন্দ্রমসি (চন্দ্রমাতে) পুরুষঃ দৃশ্যতে, সঃ অহম্ অস্মি, সঃ এব অহম্ অস্মি, ইতি।
সরলার্থ : তারপর দক্ষিণাগ্নি উপকোসলকে এই উপদেশ দিল—জল, দিকসমূহ, নক্ষত্রসমূহ ও চন্দ্র—(ইহারা আমার বা ব্রহ্মের তনু)। চন্দ্রে যে পুরুষকে দেখা যায় তিনি আমি, তিনিই আমি।
মন্তব্য : ইষ্টিযজ্ঞে ঋত্বিকদের যে অনুদক্ষিণা দেওয়া হয় তাহার নাম অন্বাহার্য। সেই অন্ন দক্ষিণাগ্নিতে পাক হয়। তাই দক্ষিণাগ্নির নাম অন্বাহার্যপচন।
৩৩৩. স ষ এতমেবং বিদ্বানুপাস্তেহপহতে পাপকৃত্যাং লোকী ভবতি সর্বমায়ুরেতি জ্যোগ্জীবতি নাস্যাবরপুরুষাঃ ক্ষীয়ন্ত উপ বয়ং তং ভুঞ্জামোহস্মিংশ্চ লোকেহমুষ্মিংশ্চ য এতমেবং বিদ্বানুপাস্তে ॥ ২
অন্বয় : সঃ যঃ (২।১১।২ টীকা) এতম্ এবম্ বিদ্বান্ উপাস্তে, অপহতে পাপকৃত্যাম্, লোকীভবতি, সর্বম্ আয়ুঃ এতি, জ্যোক্ জীবতি ন অস্য অবরপুরুষাঃ ক্ষীয়ন্তে; উপ বয়ম্ তম্ ভুঞ্জামঃ অস্মিন্ চ লোকে, অমুষ্মিন্ চ; যঃ এতম্ এবম্ বিদ্বান্ উপাস্তে (৪।১১।২ দ্রঃ)।
সরলার্থ : যিনি ইহাকে এইরকম জানিয়া উপাসনা করেন, তাঁহার পাপকর্ম নাশ হয় তিনি (গার্হপত্য অগ্নির) লোক পান, পূর্ণ আয়ু এবং উজ্জ্বল (বা দীর্ঘ) জীবন লাভ করেন। তাঁহার সন্তানগণ ক্ষয় পায়না (অর্থাৎ নষ্ট হয় না)। ইহলোকে এবং পরলোকে আমরা তাঁহাকে রক্ষা করিয়া থাকি।
ত্রয়োদশ খণ্ড – আহবনীয়াগ্নি-বিদ্যা— ব্ৰহ্ম সর্বগত
৩৩৪. অথ হৈনমাহবনীয়োহনুশশাস প্রাণ আকাশো দ্যৌর্বিদ্যুদিতি য এষ বিদ্যুতি পুরুষো দৃশ্যতে সোহহমস্মি স এবাহমস্মীতি ॥১
অন্বয় : অথ হ এনম্ আহবনীয়ঃ অনুশশাস—প্রাণঃ আকাশঃ, দ্যৌঃ বিদ্যুৎ ইতি। যঃ এষঃ বিদ্যুতি (বিদ্যুতে) পুরুষঃ দৃশ্যতে, সঃ অহম্ অস্মি, সঃ এব অহম্ অস্মি ইতি (৪। ১১।১ দ্রঃ)।
সরলার্থ : অনন্তর আহবনীয় অগ্নি তাহাকে এই উপদেশ দিল—প্রাণ, আকাশ, দ্যুলোক এবং বিদ্যুৎ—ইহারা (আমার বা ব্রহ্মের তনু)। ঐ বিদ্যুতে যে পুরুষকে দেখা যায় তিনি আমি, তিনিই আমি।
৩৩৫. স য এতমেবং বিদ্বানুপাস্তেহপহতে পাপকৃত্যাং লোকী ভবতি সর্বমায়ুরেতি জ্যোগ্জীবতি নাস্যাবরপুরুষাঃ ক্ষীয়ন্ত উপ বয়ং তং ভুজ্ঞামোহস্মিংশ্চ লোকেহমুষ্মিংশ্চ য এতমেবং বিদ্বানুপাস্তে ॥ ২
অন্বয় : সঃ যঃ এতম্ এবম্ বিদ্বান্ উপাস্তে, অপহতে পাপকৃত্যাম্, লোকীভবতি সর্বম্ আয়ুঃ এতি, জ্যোক্ জীবতি, ন অস্য অবরপুরুষাঃ ক্ষীয়ন্তে, উপ বয়ম্ তম্ ভুঞ্জামঃ, অস্মিন্ চ—যঃ এতম্ এবম্ বিদ্বান্ উপাস্তে।
সরলার্থ : যিনি ইহাকে এই ভাবে জানিয়া উপাসনা করেন, তাঁহার পাপকর্ম নাশ হয়, তিনি (আহবনীয় অগ্নির) লোক পান আর পূর্ণ আয়ু ও উজ্জ্বল (বা দীর্ঘ) জীবন লাভ করেন। তাঁহার অধস্তন পুরুষেরা অর্থাৎ সন্তানগণ বিনষ্ট হয় না। ইহলোকে এবং পরলোকে আমরা তাঁহাকে রক্ষা করিয়া থাকি।
চতুর্দশ খণ্ড – অগ্নিবিদ্যার ফল
৩৩৬. তে হোচুরুপকোসলৈষা সোম্য তেহমদ্বিদ্যাত্মবিদ্যা চাচার্যস্তু তে গতি বক্তেত্যাজগাম হাস্যাচার্যস্তমাচার্যোহভ্যুবাদোপকোসল ৩ ইতি ॥ ১
অন্বয় : তে (তাহারা) হ উচুঃ (বলিয়াছিল)—উপকোসল! এষ (এই বিদ্যা) সোম্য! তে (তোমাকে) অস্মৎবিদ্যা (আমাদিগের সংক্রান্ত বিদ্যা অর্থাৎ অগ্নিবিদ্যা) আত্মবিদ্যা চ। আচার্যঃ তু তে গতিম্ (গতি) বক্তা (বলিবেন) ইতি। আজগাম (প্রত্যাগত হইলেন) হ অস্য (ইহার) আচার্যঃ। তম্ (তাহাকে) আচার্যঃ অভি + উবাচ (বলিলেন)—উপকোসল ত ইতি।
সরলার্থ : অগ্নিগণ তাহাকে বলিল—উপকোসল, তোমাকে অগ্নিবিদ্যা ও আত্মবিদ্যা বলিলাম। আচার্য তোমাকে পরলোকে যাইবার পথের কথা বলিবেন। এই সময়ে আচাৰ্য প্রবাস হইতে ফিরিয়া আসিলেন। তিনি তাহাকে বলিলেন—’উপকোসল
মন্তব্য : ব্যাখ্যাকারগণ ‘গতি’ শব্দের অনেক অর্থ করিয়াছেনঃ (ক) গতি— ফল; অগ্নিগণ যে বিদ্যা শিক্ষা দিয়াছিল, তাহার ফল। (খ) গতি— ব্রহ্মজ্ঞান। অগ্নিগণ অগ্নিবিদ্যা শিক্ষা দিয়াছিল, এখানে ব্রহ্মজ্ঞান শিক্ষা দেওয়ার কথা বলা হইতেছে। (গ) গতিপথ, পরলোক গমন করিবার পথ, দেবপথ বা ব্রহ্মপথ। ইহার পরবর্তী খণ্ডে এই পথের কথাই বলা হইয়াছে (৪।১৫।৫ মন্ত্র দ্রষ্টব্য)।
৩৩৭. ভগব ইতি হ প্রতিশুশ্রাব ব্রহ্মবিদ ইব সোম্য তে মুখং ভাতি কো নু ত্বানুশশাসেতি কো নু মানুশিষ্যাডো ইতীহাপের নিত ইমে নূনম্ ঈদৃশা অন্যাদৃশা ইতীহাগ্নীনভ্যূদে কিং নু সোম্য কিল তেহবোচন্নিতি ॥ ২
অন্বয় : ভগবঃ ইতি হ প্রতি শুশ্রাব (প্রত্যুত্তর করিল)। ব্রহ্মবিদঃ ইব (ব্রহ্মবিদের ন্যায়) সোম্য, তে (তোমার) মুখম্ ভাতি (দীপ্তি পাইতেছে)। কঃ (কে) নু জ্বা (তোমাকে) অনুশশাস (অনুশাসন করিয়াছে)? কঃ নু মা (আমাকে) অনুশিষ্যাৎ (উপদেশ দিবে)? ভোঃ ইতি। ইহ (এই বিষয়ে) ইব (যেন) অপ নিহ্নুতে (গোপন করিল)। ইমে (এই সমুদয়, অঙ্গুলিদ্বারা নির্দেশ করিয়া বলিল— এই অগ্নিসমূহ) নূনম্ (নিশ্চয়ই ঈদৃশাঃ (এই প্রকার) অন্যাদৃশাঃ (অন্য প্রকার) ইতি ইহ (এইস্থলে) অগ্নীন্ (অগ্নিসমূহকে লক্ষ্য করিয়া) অভ্যুদে (বলিয়াছিল)—কিম্ (কি) নু সোম্য! কিল তে (তাহারা কিংবা তোমাকে) অবোচন্ (বলিয়াছে) ইতি?
সরলার্থ : উপকোসল উত্তর করিল—’ভগবান্!” আচার্য বলিলেন, “তোমার মুখ ব্রহ্মবিদের মত দীপ্তি পাইতেছে। তোমাকে কে উপদেশ দিয়াছে?’ উপকোসল বলিল— ‘ভগবান্, কে আমাকে উপদেশ দিবে?’ এই বলিয়া বিষয়টি যেন গোপন করিল। তারপর অগ্নিদের দেখাইয়া বলিল—এই যে অগ্নি, পূর্বে ইহা নিশ্চয়ই অন্য প্রকার ছিল। ‘অগ্নিগণ তোমাকে কি উপদেশ দিয়াছে?’
মন্তব্য : ‘ঈদৃশাঃ অন্যাদৃশাঃ’ অংশের অর্থ শঙ্কর এই প্রকার করিয়াছেন — এই অগ্নিগণ এখন এই প্রকার (ঈদৃশাঃ) কম্পমান বলিয়া দৃষ্ট হইতেছে, পূর্বে অন্যপ্রকার (অন্যাদৃশাঃ) ছিল।’ কেহ কেহ অর্থ করেন ‘ইহারা কি এই প্রকার না অন্য প্রকার?’
৩৩৮, ইদমিতি হ প্রতিজজ্ঞে লোকান্ বাব কিল সোম্য তেহবোচ‡হং তু তে তদ্বক্ষ্যামি যথা পুষ্করপলাশ আপো ন শ্লিষ্যন্ত এবমেবংবিদি পাপং কর্ম ন শ্লিষ্যত ইতি ব্রবীতু মে ভগবানিতি তস্মৈ হোবাচ ॥ ৩
অন্বয় : ইদম্ (এই উপদেশ; কি উপদেশ দিয়াছিল তাহা বর্ণনা করিয়া বলিল ‘ইদম্’—এই) ইতি হ প্রতিজজ্ঞে (প্রত্যুত্তর করিল)। লোকান্ (লোকসমূহকে, লোকসমূহের বিষয়কে) বাব কিল (নিশ্চয়ই) সোম্য! তে (তোমাকে; কিংবা তাহারা)) অবোচন্ (বলিয়াছে) অহম্ (আমি) তু তে তৎ (তাহা অর্থাৎ ব্রহ্মবিষয়ে) বক্ষ্যামি (বলিব)। যথা পুষ্করপলাশে (পদ্মপত্রে, পুষ্কর—পদ্ম; পলাশ—পত্র) আপঃ (জল) ন শিষ্যন্তে (সংশ্লিষ্ট হয়), এবম্ (এই প্রকার) এবংবিদি (এবংবিৎ—যিনি এই প্রকার জানেন তিনি) পাপম্ কর্ম ন শ্লিষ্যতে (লিপ্ত হয়) ইতি। ব্রবীতু (বলুন) মে (আমাকে) ভগবান্ ইতি। তস্মৈ (তাহাকে) হ উবাচ।
সরলার্থ : (অগ্নিগণ তাহাকে যে উপদেশ দিয়াছিল, তাহা উল্লেখ করিয়া উপকোসল) বলিল—’এই উপদেশ।’ আচার্য বলিলেন ‘ইহারা তোমাকে লোকসমূহের কথা বলিয়াছে, আমি তোমাকে তাঁহার (অর্থাৎ ব্রহ্মের) কথা বলিব। যেমন পদ্মপত্রে জল লাগিয়া থাকে না, তেমনি যিনি ব্রহ্মকে এই ভাবে জানেন তাঁহাকে পাপকর্ম স্পর্শ করে না।’ উপকোসল বলিল, ‘আপনি আমাকে তাহা বলুন।’ আচার্য বলিলেন—
পঞ্চদশ খণ্ড – অক্ষিপুরুষ ও দেবপথ
৩৩৯. য এষোহক্ষিণি পুরুষো দৃশ্যত এষ আত্মেতি হোবাচৈতদমৃতমভয়মেতদ্ ব্রহ্মেতি তদ্ যদ্যপ্যস্মিন্ সৰ্পিৰ্বোদকং বা সিঞ্চতি বর্জ্জনী এব গচ্ছতি ॥ ১
অন্বয় : যঃ এষঃ (এই যে) অক্ষিণি (বৈদিক প্রয়োগ, চক্ষুতে) পুরুষঃ দৃশ্যতে (দৃষ্ট হন) এষঃ আত্মা ইতি হ উবাচ (বলিলেন)—এবং (ইহা) অমৃতম্ অভয়ম্, এতৎ ব্ৰহ্ম ইতি। তৎ (সেই জন্য) যদ্যপি অস্মিন্ (এই চক্ষুতে) সর্পিঃ বা (ঘৃত) উদকম্ বা (জল)) সঞ্চতি (নিক্ষেপ করে) বর্তনী এব (চক্ষুর উভয় প্রান্তে, চক্ষুর পদ্মদ্বয়ে) গচ্ছিত (গমন করে)।
সরলার্থ : আচার্য বলিলেন—চক্ষুতে এই যে পুরুষকে দেখা যায় ইনিই আত্মা। ইনিই অমৃত ও অভয়, এবং ইনিই ব্রহ্ম। এইজন্য যদি কেহ ঘৃত বা জল চক্ষুতে নিক্ষেপ করে, তাহা চক্ষুর দুই প্রান্তে চলিয়া যায়।
৩৪০. এতং সংযদ্বাম ইত্যাচক্ষত এতং হি সর্বাণি বামান্যভিসংযন্তি সর্বাণ্যেনং বামান্যভিসংযন্তি য এবং বেদ ॥ ২
অন্বয় : এতম্ (ইঁহাকে) যংযদ্বাম ইতি আচক্ষতে (বলা হয়)। এতম্ হি (ইহাকে) সর্বাণি বামানি (সমুদয় কল্যাণকর বস্তু) অভিসংযন্তি (সর্বতোভাবে গমন করে)। সর্বাণি (সমুদয়) এনম্ (এই ব্যক্তিকে) বামানি অভিসংযন্তি, যঃ (যিনি) এবম্ (এই প্রকার) বেদ (জানেন)।
সরলার্থ : ইঁহাকে ‘সংযদ্বাম’ বলা হয়, কারণ ইনি সমুদয় ‘বাম’ অর্থাৎ শোভনীয়, ভজনীয় বস্তুর) আশ্রয়। যিনি এই প্রকার জানেন, সমুদয় কল্যাণ তাঁহাকে আশ্রয় করে। মন্তব্য : বামানি সংযন্তি অর্থাৎ কল্যাণকর বস্তুসমূহ ইহার নিকট গমন করে, এইজন্য ইহার নাম ‘সংযদ্বাম’। ‘সংযদ্বাম’ এবং ‘বামানি সংযন্তি’ এতদুভয়ের উচ্চারণের সাদৃশ্য দ্রষ্টব্য। ডয়সনের মতে ‘সংযদ্বাম’ শব্দের অর্থ ‘Love’s treasure’ অর্থাৎ প্রিয় বস্তুর আধার।
৩৪১. এষ উ এব বামনীরেষ হি সর্বাণি বামানি নয়তি সর্বাণি বামানি নয়তি য এবং বেদ। ৩
অন্বয় : এষঃ (এই পুরুষ) উ এব বামনীঃ (বাম + নী হইতে) এষঃ হি সর্বাণি বামানি নয়তি (প্রাপ্ত করান), সর্বাণি বামানি নয়তি, যঃ এবম্ বেদ (২য় মঃ দ্রঃ)।
সরলার্থ : ইনিই ‘বামনী’, কারণ তিনি নিখিল ‘বাম’ (অর্থাৎ কল্যাণ) সকলকে দান করেন। যিনি ইহা জানেন, তিনি সকল কল্যাণের বাহক হন।
৩৪২. এষ উ এব ভামনীরেষ হি সর্বেষু লোকেষু ভাতি সর্বেষু লোকেষু ভাতি য এবং বেদ ॥ ৪
অন্বয় : এষঃ উ এব ভামনীঃ (ভাম—দীপ্তি, নী—প্রাপ্ত করান) এষঃ হি সর্বেষু লোকেষু (সমুদয় লোকে) ভাতি (প্রতিভাত হয়)। সর্বেষু লোকেষু ভাতি, যঃ এবম্ বেদ (৩য় মঃ দ্রঃ)।
সরলার্থ : এই পুরুষই ‘ভামনী’, কারণ ইনিই সর্বলোকে প্রতিভাত হন। যিনি এই প্রকার জানেন, তিনি সর্বলোকে দীপ্তি পান
মন্তব্য : ডয়সন বলেন—ভামনী = The herald of love; The prince of love, ভামনী = The prince of radiance.
৩৪৩. অথ যদু চৈবাস্মিঞ্ছব্যং কুর্বন্তি যদি চ নার্চিষমেবাভিসম্ভবন্ত্যর্চিযোহহর আপূর্যমাণপক্ষমাপূর্যমাণপক্ষাদ্ যান্ ষডুদঙেতি মাসাংস্তান্মাসেভ্যঃ সংবৎসরং সংবৎসরাদাদিত্যমাদিত্যচন্দ্রমসং চন্দ্রমসো বিদ্যুতং তৎ পুরুষোহমান্বঃ। স এনান্ ব্রহ্ম গময়ত্যেষ দেবপথো ব্ৰহ্মপথ এতেন প্রতিপদ্যমানা ইমং মানবমাবর্তং নাবর্তন্তে নাবর্তন্তে ॥ ৫
অন্বয় : অথ (অনন্তর, মৃত্যুর পর) যৎ (যদি) উ চ এব অস্মিন্ (এই পুরুষে শব্যম্ (শবকর্ম, অন্ত্যেষ্টিকর্ম) কুর্বন্তি (করে), যদি চ ন (যদি না করে), অর্চিষম্ অর্চি—(জ্যোতি) এব অভি সম্ভবন্তি (প্রাপ্ত হয়), অর্চিষঃ (অচিং হইতে) অহঃ (দিনকে), অহ্নঃ (দিন হইতে) আপূর্যমাণপক্ষম্ (শূক্লপক্ষকে)। আপূর্যমাণপক্ষাৎ (শুক্লপক্ষ হইতে) যা ষট্ [মাসান্] (যে ছয়মাস কাল) উদঙ্ (উত্তর দিকে) এতি (সূর্য গমন করে) মাসান্ (সেই ছয় মাসকে) মাসেভ্যঃ (মাসসমূহ হইতে) সম্বৎসরম্ সম্বৎসরাৎ তান্ আদিত্যম্; আদিত্যাৎ চন্দ্ৰমসম্ (চন্দ্রকে); চন্দ্রমসঃ বিদ্যুতম্; তৎ (সেইস্থানে অর্থাৎ বিদ্যুৎলোকে অবস্থিত) পুরুষঃ (একজন পুরুষ) অমানবঃ (যে মানব নহে) সঃ (সেই) এনান্ (সেই সমুদয় মনুষ্যকে) গময়তি (ব্রহ্ম প্রাপ্ত করায়)। এষঃ (ইহাই) দেবপথঃ (ব্রহ্মপথ)। এতেন (এই পথ দ্বারা) প্রতিপদ্যমানাঃ (গমন করিয়া) ইমম্ মানবম্ আবর্তম্ (এই মানব-জন্মরূপ আবর্তকে) ন আবর্তন্তে (আবর্তিত হয় না, প্রাপ্ত হয় না); ন আবর্তন্তে (দ্বিরুক্তি নিশ্চয় বা সমাপ্তিসূচক)।
সরলার্থ : যিনি ইহা জানেন, মৃত্যুর পর তাঁহার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হউক বা না হউক, তিনি অর্চিতে (জোতিতে) গমন করেন। তারপর তিনি অর্চি হইতে দিবসে, দিবস হইতে শুক্লপক্ষে, শুক্লপক্ষ হইতে উত্তরায়ণের ছয় মাসে, সেই ছয় মাস হইতে সম্বৎসরে, সম্বৎসর হইতে আদিত্যে, আদিত্য হইতে চন্দ্রে, চন্দ্র হইতে বিদ্যুতে যান তখন সেই স্থানের এক অমানুষ পুরুষ তাঁহাদিগকে ব্রহ্মে লইয়া যান। ইহাই দেবযান ইহাই ব্রহ্মযান। ঐ পথে গেলে আর মানুষকে সংসাররূপ আবর্তে ফিরিয়া আসিতে হয় না।
ষোড়শ খণ্ড – যজ্ঞ সফলতার নিয়ম
৩৪৪. এষ হ বৈ যজ্ঞো যোহয়ং পবত এষ হ যন্নিন্দং সর্বং পুনাতি যদেষ যন্নিন্দং সর্বং পুনাতি তস্মাদেষ এব যজ্ঞস্তস্য মনশ্চ বাক্ চ বর্তনী ॥ ১
অন্বয় : এষঃ (ইনি) হ বৈ যজ্ঞঃ, যঃ অয়ম্ (এই যিনি) পবতে (পবিত্র করেন); এষঃ হ য (গমন করিয়া) ইদম্ সর্বম্ (এই সমুদয়কে) পুনাতি (পবিত্র করেন)। যৎ (যেহেতু) এষঃ যন্ সর্বম্ ইদম্ পুনাতি, তস্মাৎ (সেইজন্য) এষঃ এব যজ্ঞঃ। তস্য (তাহার) মনঃ চ বাক্ চ বর্তনী (উভয়পথ)।
সরলার্থ : যিনি পবিত্র করেন তিনিই অর্থাৎ বায়ুই যজ্ঞ। তিনি প্রবাহিত হইয়া পবিত্র করেন। যেহেতু তিনি প্রবাহিত হইয়া সমস্ত কিছু পবিত্র করেন, সেইজন্য তিনি যজ্ঞ। ন এবং বাক্য ঐ যজ্ঞের দুইটি পথ।
৩৪৫. তয়োরন্যতরাং মনসা সংকরোতি ব্রহ্মা বাচা হোতাধ্বরুদ্গাতান্যতরাং স যত্রোপাকৃতে প্রাতরনুবাকে পুরা পরিধানীয়ায়া ব্ৰহ্মা ব্যববদতি ॥ ২
অন্বয় : তয়োঃ (এই দুইটির) অন্যতরাম্ (একটিকে) মনসা (মনদ্বারা) সংকরোতি (সম্পন্ন করেন, শোধন করেন) ব্রহ্মা। বাচা (বাক্যদ্বারা) হোত অধ্বর্যুঃ, উদ্গাতা অন্যতরাম্। সঃ (ব্রহ্মা) যত্র (যখন) উপকৃতে (আরম্ভ হইলে) প্রাতঃ অনুবাকে (প্রাতঃকালে পঠনীয় অনুবাক) পুরা (পূর্বে) পরিধানীয়ায়াঃ (‘পরিধানীয়ায়া’ নামক ঋকের) ব্রহ্মা ব্যববদতি (মৌনভাব পরিত্যাগ করিয়া শব্দ করেন)।
সরলার্থ : ব্রহ্মা নামক ঋত্বিক ইহার একটি পথকে মন দ্বারা (অর্থাৎ চিন্তা দ্বারা, বা মৌনাবলম্বনপূর্বক) সম্পন্ন করেন (বা সংশোধন করেন); এইটি মনোরূপ পথ)। হোতা, অধ্বর্যু ও উদ্গাতা বাক্য দ্বারা অপরটিকে সম্পন্ন করেন; (এইটি বাক্যরূপ পথ)। প্রাতে যে অনুবাক পাঠ করা হয় তাহা আরম্ভ হইবার পর এবং ‘পরিধানীয়’ নামের ঋক্ পাঠ করিবার পূর্বে যদি ‘ব্রহ্মা’ মৌন ত্যাগ করিয়া বাক্য উচ্চারণ করেন—
মন্তব্য : ‘হু’ ধাতু অর্থ আহুতি দেওয়া। ইহাতে বুঝা যাইতেছে যে, অতি প্রাচীনকালে ‘হোতা’ হোম কর্মও সম্পন্ন করিতেন। সোমযজ্ঞে চারি প্রকার ঋত্বিক্ নিযুক্ত হইয়া থাকে—(১) ঋগ্বেদী ঋত্বিক—ইহার নাম হোতা। হোতার তিনজন সঙ্গী (ক) মৈত্রাবরুণ, (খ) আচ্ছাবাক, (গ) গ্রাবস্তুব; মোট চারি জন। (২) যজুর্বেদী অধ্ব—— ইহার তিনজন সঙ্গী (ক) প্রতিপ্রস্থাতা, (খ) নেষ্টা, (গ) উন্নেতা; মোট চারিজন। (৩) সামবেদী উদ্গাতা—ইহার তিনজন সঙ্গী (ক) প্রস্তোতা, (খ) প্রতিহর্তা, (গ) সুব্রহ্মণ্যা, মোট চারি জন। (৪) ব্রহ্মা নামক ঋত্বিক্—ইহার তিনজন সঙ্গী (ক) ব্রাহ্মণাচ্ছংসী, (খ) আগ্নীধ্র, (গ) পোতা; মোট চারি জন। হোতা নির্দিষ্ট মন্ত্র উচ্চারণ করেন; অধ্বর্যু হোমদ্রব্য প্রস্তুত ও আহুতি অর্পণ করেন এবং উদ্গাতা সামগান করেন। ব্রহ্মার তিন বেদের বিশেষ জ্ঞান থাকা আবশ্যক। তিনি অপরাপর ঋত্বিকের কার্যের তত্ত্বাবধান করেন এবং ভ্রম সংশোধন করিয়া থাকেন। পরবর্তীকালে ‘ব্রহ্মা’ অথর্ববেদী ঋত্বিক্ বলিয়া পরিচিত হইয়াছেন।
৩৪৬. অন্যতরামেব বর্তনীং সংস্করোতি হীয়তেহন্যতরা স যথৈকপাদ্ ব্ৰজ রথো বৈকেন চক্রেণ বর্তমানো রিষ্যত্যেবমস্য যজ্ঞো রিষ্যতি যজ্ঞং রিষ্যন্তং যজমানোহনুরিষ্যতি স ইষ্ট্বা পাপীয়ান্ ভবতি ॥ ৩
অন্বয় : অন্যতরাম্ এব বর্তনীম্ (দুইটির মধ্য একটি পথকে) সংকরোতি (সংস্কার করেন), হীয়তে (হীন হয়) অন্যতরা (মনোরূপ পথটি)। স যথা (যেমন, যে যেমন) একপাদ্ (একপদ বিশিষ্ট) ব্রজ (গমন করিয়া), রথঃ বা (অথবা যেমন রথ) একেন চক্রেণ (এক চক্রের সহিত) বর্তমানঃ রিষ্যতি (বিনাশ প্রাপ্ত হয়), এবম্ (এই প্রকার) অস্য (ইহার) যজ্ঞঃ রিষ্যতি। যজ্ঞম্ রিষ্যন্তম্ [অনু] (যজ্ঞ বিনষ্ট হইলে; যজ্ঞ বিনাশের অনুগমন করিয়া) যজমানঃ অনু রিষ্যতি। সঃ ইষ্ট্বা (যজ্ঞ করিয়া) পাপীয়ান্ (অধিকতর পাপী) ভবতি (হয়)।
সরলার্থ : তবে তিনি একটি পথকেই (অর্থাৎ বাক্যরূপ পথকেই) সংস্কৃত করেন; কিন্তু অন্য পথটি (অর্থাৎ মনোরূপ পথটি) বিনষ্ট হয়। যেমন একপদ বিশিষ্ট মানুষ কিংবা একচক্র বিশিষ্ট রথ চলতে গেলে বিনষ্ট হয়, তেমনি ইহার যজ্ঞ নষ্ট হয়। যজ্ঞ বিনষ্ট হইলে যজমানও বিনষ্ট হয়; সে যজ্ঞ করিয়া আরো অধিক পাপের ভাগী হয়।
মন্তব্য : ‘সঃ যথা’—অনেকস্থলে ‘য’ কিংবা ‘তৎ’ শব্দ ‘যথা’ ও ‘যদি’ শব্দের সহিত ব্যবহৃত হয়। ‘যথা’ এবং ‘যদি’ শব্দের অর্থ দৃঢ়ীকৃত করিবার জন্যই এই প্রকার প্রয়োগ। পালিতে ‘শেষ যথা’ প্রাকৃতে ‘সেজ্জহা’, ‘তজহা’ ইত্যাদির প্রয়োগ আছে। ইহার অর্থ ‘যেমন’, ‘সে যেমন’।
৩৪৭. অথ যন্ত্রোপাকৃতে প্রাতরনুবাকে ন পুরা পরিধানীয়ায়া ব্রহ্মা ব্যববদত্যুভে এব বর্তনী সংকুর্বন্তি ন হীয়তেহন্যতরা ॥ ৪
অন্বয় : অথ যত্র (যে যজ্ঞে) উপাকৃতে প্রাতঃ অনুবাকে, ন (না) পুরা পরিধানীয়ায়াঃ ব্রহ্মা ব্যববদতি উভে এব বর্তনী (উভয়পথই) সংস্কুর্বন্তি (সংস্কার করেন); ন (না) হীয়তে অন্যতরা (একটাও) (২য় মঃ দ্রঃ)।
সরলার্থ : আর যে যজ্ঞে প্রাতঃপঠনীয় অনুবাক্ আরম্ভ হইবার পর এবং পরিধানীয় ঋক্ পাঠ করিবার পূর্বে ব্রহ্মা বাক্য উচ্চারণ করেন না, সে যজ্ঞে উভয় পথই সংস্কৃত হয়, কোনটিই নষ্ট হয় না।
৩৪৮. স যথোভয়পাদ্ ব্রজন্ রথো বোভাভ্যাং চক্রাভ্যাং বর্তমানঃ প্রতিতিষ্ঠ— ত্যেবমস্য যজ্ঞঃ প্রতিতিষ্ঠতি যজ্ঞং প্রতিতিষ্ঠন্তং যজমানোহনু প্রতি— তিষ্ঠতি স ইষ্ট্বা শ্রোয়ানু ভবতি ॥ ৫
অন্বয় : সঃ যথা (৪।১৬।৩) উভয়পাৎ (উভয়পদযুক্ত) ব্রজন্ (গমন করিয়া) রথঃ বা উভাভ্যাম্ চক্রাভ্যাম্ (উভয় চক্রের সহিত) বর্তমানঃ প্রতিতিষ্ঠতি (প্রতিষ্ঠিত থাকে, পড়িয়া যায় না), এবম্ অস্য যজ্ঞঃ প্রতিতিষ্ঠতি। যজ্ঞম্ [অনু] প্রতিতিষ্ঠন্তম্ অনু (যজ্ঞ প্রতিষ্ঠিত থাকিলে) যজমানঃ প্রতিতিষ্ঠতি। সঃ ইষ্ট্বা শ্রেয়ান্ ভবতি (শ্রেয়োলাভ করে)।
সরলার্থ : যেমন দুই পা-যুক্ত লোক কিংবা দুই চাকাযুক্ত রথ চলিবার সময় প্রতিষ্ঠিত থাকে (অর্থাৎ পড়িয়া যায় না), তেমনি সেই যজমানের যজ্ঞ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যজ্ঞ সুপ্রতিষ্ঠিত হইলে যজমানের প্রতিষ্ঠা লাভ হয়। যজ্ঞ করিয়া সে শ্রেয়োলাভ করে।
সপ্তদশ খণ্ড – যজ্ঞশোধনে ব্যাহৃতির ব্যবহার
৩৪৯. প্রজাপতির্লোকানভ্যতপত্তেষাং তপ্যমানানাং রসান্ প্রাবৃহদগ্নিং পৃথিব্যা বায়ুমন্তরিক্ষাদাদিত্যং দিবঃ ॥ ১
অন্বয় : প্রজাপতিঃ লোকান্ (লোকসমূহকে উদ্দেশ্য করিয়া) অভি + অতপৎ (তপস্যা করিলেন)। তেষাম্ তপ্যমানানাম্ (সেই অভিতপ্ত লোকসমূহের) রসান্ (রসসমূহকে) প্রাবৃহৎ (উদ্ধৃত করিলেন)—অগ্নিম্ পৃথিব্যাঃ (পৃথিবী হইতে) বায়ুম্ অন্তরিক্ষাৎ (অন্তরিক্ষ হইতে), আদিত্যম্ দিবঃ (দ্যৌ হইতে)।
সরলার্থ : প্রজাপতি লোকসমূহকে উদ্দেশ করিয়া তপস্যা করিলেন। সেইসব লোক হইতে তিনি বিভিন্ন রস নিষ্কাশিত করিলেন—পৃথিবী হইতে অগ্নি, অন্তরিক্ষ হইতে বায়ু এবং দ্যুলোক হইতে আদিত্য।
মন্তব্য : ‘অভ্যতপৎ’—কেহ কেহ বলেন ‘লোকান্ অভ্যতপৎ’—লোকসমূহকে উত্তপ্ত করিয়াছিলেন। ‘তপ্’ ধাতুর মৌলিক অর্থ উত্তপ্ত করা।
৩৫০. স এতাস্তিস্ত্রো দেবতা অভ্যতপত্তাসাং তপ্যমানানাং রসান্ প্রাবৃহদগ্নেঝচো বায়োর্যভূষি সামান্যাদিত্যাৎ ॥ ২
অন্বয় : সঃ এতাঃ তিস্রঃ দেবতাঃ (এই তিন দেবতাকে লক্ষ্য করিয়া) অভ্যতপৎ। তাসাম্ তপ্যমানানম্ (তপ্যমান (দেবসমূহের) রসান্ প্রাবৃহৎঅগ্নেঃ (অগ্নি হইতে) ঋচঃ (ঋসমূহকে) বায়োঃ (বায়ু হইতে) যজুংসি (যজুঃসমূহকে), সামানি (সামসমূহকে আদিত্যাৎ (আদিত্য হইতে) [১মঃ দ্রঃ।]
সরলার্থ : তিনি এই তিন দেবতাকে উদ্দেশ করিয়া তপস্যা করিলেন। তপ্যমান দেবগণ হইতে তিনি এইসব রস উদ্ধৃত করিলেন—অগ্নি হইতে ঋক্, বায়ু হইতে যজুঃ এবং আদিত্য হইতে সাম।
৩৫১. স এতাং ত্রয়ীং বিদ্যামভ্যতপত্তস্যাস্তপ্যমানায়া রসান্ প্রাবৃহদ্ভূরিত্যভ্যো ভুবরিতি যজুর্ত্যঃ স্বরিতি সামভ্যঃ ॥ ৩
অন্বয় : সঃ এতাম, ত্রয়ীম্ বিদ্যাম্ (এই ত্রয়ীবিদ্যাকে লক্ষ্য করিয়া) অভ্যতপৎ। তস্যাঃ তপ্যমানায়ঃ (তপ্যমান ত্রয়ীবিদ্যার) রসান্ প্রাবৃহৎ—ভূঃ ইতি ঋভ্যঃ (ঋসমূহ হইতে) ভুবঃ ইতি যজুর্ত্যঃ (যজুঃসমূহ হইতে) স্বঃ ইতি সামভ্যঃ (সামসমূহ হইতে) [২য় মঃ দ্রঃ]।
সরলার্থ : প্রজাপতি এই ত্রয়ীবিদ্যাকে (লক্ষ্য করিয়া) তপস্যা করিলেন। তপ্যমান ত্রয়ীবিদ্যা হইতে রসসমূহ উদ্ধৃত করিলেন—ঋক্ হইতে ভূঃ, যজুঃ হইতে ভুবঃ এবং সাম হইতে স্বঃ।
৩৫২. তদ্যদ্যূক্তো রিষ্যেভূঃ স্বাহেতি গার্হপত্যে জুহুয়াদৃচামেব তদ্রসেনচাং বীর্যেণর্চাং যজ্ঞস্য বিরিষ্টং সন্দধাতি ॥ ৪
অন্বয় : তৎ (সেই জন্য) যদি ঋক্তঃ (ঋক হইতে, ঋক্ সংক্রান্ত দোষবশতঃ) রিষ্যেৎ (যজ্ঞের অনিষ্ট হয়)— ভূঃ স্বাহা ইতি গার্হপত্যে (গার্হপত্য অগ্নিতে) জুহুয়াৎ (হোম করিবে)। ঋচাম্ এব (ঋসমূহের) তৎ রসেন (সেই রসদ্বারা) ঋচাম্ বীর্যেণ (বীর্যদ্বারা) ঋচাম (ঋকের) যজ্ঞস্য (যজ্ঞের) বিরিষ্টম্ (অনিষ্টকে) সন্দধাতি (প্রতিবিধান করে)।
সরলার্থ : সেই জন্য যদি ঋক্ প্রয়োগের দোষে যজ্ঞের কোন অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা থাকে, তবে ‘ভূঃ স্বাহা” বলিয়া গার্হপত্য অগ্নিতে হোম করিবে। তাহা হইলে ঋক্ প্রয়োগের দোষবশত যজ্ঞের যে দোষ হইতে পারিত, ঋক্ সমূহের রসদ্বারা, ঋসমূহের বীর্যদ্বারা তাহার প্রতিবিধান হইবে।
৩৫৩. অথ যদি যজুষ্টো রিষ্যেদ্ভুবঃ স্বাহেতি দক্ষিণাগ্লৌ জুহুয়া যজুষামেব তদ্রসেন যজুষাং বীর্যেণ যজুষাং যজ্ঞস্য বিরিষ্ট সন্দধাতি ॥ ৫
অন্বয় : অথ যদি যজুষ্টঃ (যজুঃ প্রয়োগের দোষবশতঃ) রিষ্যেৎ, ভুবঃ স্বাহা ইতি দক্ষিণাগ্নৌ (দক্ষিণাগ্নিতে) জুহুয়াৎ; যজুষাম্ (যজুঃসমূহের) এব তৎ রসেন, যজুষাম্ বীর্যেণ, যজুষাম্ যজ্ঞস্য বিরিষ্টম্ সন্দধাতি (৪র্থ মঃ দ্রঃ)।
সরলার্থ : যদি যজুঃপ্রয়োগের দোষে কোন অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা থাকে, তবে ‘ভুবঃ স্বাহা’ এই মন্ত্রে দক্ষিণাগ্নিতে হোম করিবে। তাহা হইলে যজুঃসমূহের রসে ও বীর্যে সেই দোষের প্রতিবিধান হইবে।
৩৫৪. অথ যদি সামতো রিষ্যেৎ স্বঃ স্বাহেত্যাহবনীয়ে জুহুয়াৎ সাম্লামেব তদ্রসেন সাম্নাং বীর্যেন সাম্নাং যজ্ঞস্য বিরিষ্টং সন্দধাতি ॥ ৬
অন্বয় : অথ যদি সামতঃ (সামপ্রয়োগের দোষবশতঃ) রিষ্যেৎ, স্বঃ স্বাহা ইতি আহবনীয়ে (আহবনীয় অগ্নিতে) জুহুয়াৎ। সাম্লাম্ (সামসমূহের) এব তৎ রসেন, সাম্নাম্ বীর্যেণ সাম্লাম্ যজ্ঞস্য বিরিষ্টম্ সন্দধাতি (৪র্থ মঃ দ্রঃ)।
সরলার্থ : যদি সামপ্রয়োগের ত্রুটিবশত কোন অনিষ্ট হইবার সম্ভাবনা থাকে, তবে ‘স্বঃ স্বাহা” এই বলিয়া আহবনীয় অগ্নিতে হোম করিবে। তাহা হইলে সামসমূহের রসে ও বীর্যে সেই ক্ষতির প্রতিবিধান হইবে।
৩৫৫. তদ্ যথা (লবণেন সুবর্ণং সন্দধ্যাৎ সুবর্ণেন রজতং রজতেন ত্রপু ত্ৰপুণা সীসং সীসেন লোহং লোহেন দারু দারু চর্মণা ॥ ৭
৩৫৬. এবমেষাং লোকানামাসাং দেবতানামস্যাস্প্রয্যা বিদ্যায়া বীর্যেণ যজ্ঞস্য বিরিষ্টং সন্দধাতি ভেষজকৃতো হ বা এষ যত্রৈবংবিদ্ ব্রহ্মা ভবতি ॥৮
অন্বয় : তৎ যথা (যেমন) লবণেন (লবণ দ্বারা) সুবর্ণম্ সন্দধ্যাৎ (সংযোজিত করে), সুবর্ণেন রজতম্, রজতেন ত্রপু (রাংকে), ত্রপুণা (ত্রপুদ্বারা) সীসম্, সীসেন লোহম্ লোহেন দারু (কাষ্ঠকে), দারু (দারুকে) চর্মণা (চর্মদ্বারা)। এবম্ (এই প্রকার) এষাম্ লোকানাম্ (এই লোকসমূহের) আসাম্ দেবতানাম্ (এই দেবতাসমূহের) অস্যাঃ ত্রয্যাঃ বিদ্যায়াঃ (এই ত্রয়ী বিদ্যার) বীর্যেণ যজ্ঞস্য বিরিষ্টম্ সন্দধাতি। ভেষজকৃতঃ (সুচিকিৎসিত) হ বৈ এষঃ যজ্ঞঃ, যত্র (যে যজ্ঞে) এবংবিদ্ (এই প্রকার জ্ঞানসম্পন্ন) ব্রহ্মা ভবতি (হয়) (৪র্থ মন্ত্ৰ দ্ৰঃ)।
সরলার্থ : যেমন লবণদ্বারা সোনাকে, সোনাদ্বারা রূপাকে, রূপাদ্বারা রাংকে, রাংদ্বারা সীসাকে, সীসাদ্বারা লোহাকে এবং লোহা ও চর্মদ্বারা কাঠকে সংযোজিত করা হয়, তেমনি এই লোকসমূহের, এই দেবগণের এবং এই ত্রয়ীবিদ্যার বীর্য দ্বারা যজ্ঞের অনিষ্টের প্রতিবিধান করা হয়। এইরকম জ্ঞানসম্পন্ন ব্রহ্ম যে যজ্ঞে ঋত্বিক্ হন, সেই যজ্ঞ সুচিকিৎসিত (সংস্কৃত) হয়।
৩৫৭. এষ হ বা উদক্ প্রবণো যজ্ঞো যত্রৈবংবিদ্ ব্রহ্মা ভবত্যেবংবিদং হ বা এষা ব্ৰহ্মাণমনু গাথা—যতো যত আবর্ততে তত্তদ্গচ্ছতি ॥ ৯
অন্বয় : এষঃ (এই) হ বৈ উদক্ প্রবণঃ (উত্তরদিকে নিম্ন অর্থাৎ উত্তরায়ণ পথে যাইবার উপায়) যজ্ঞঃ, যত্র এবংবিদ্ ব্রহ্মা ভবতি। এবংবিদম্ হ বৈ এষা (এই) ব্ৰহ্মাণম্ অনু (ব্রহ্মাকে লক্ষ্য করিয়া) গাথা—যতঃ যতঃ (যেখানে, যেখানে) আবর্ততে (ক্ষতযুক্ত হয়—শঙ্কর; কিংবা মন্ত্রের আবৃত্তি হয়), তৎ তৎ (সেই সেই স্থানে) গচ্ছিত গমন করে)।
সরলার্থ : এই রকম জ্ঞানসম্পন্ন ব্রহ্মা যে যজ্ঞের ঋত্বিক্ সেই যজ্ঞ উত্তরায়ণ পথে যাইবার উপায়স্বরূপ। এই প্রকার জ্ঞানসম্পন্ন ব্রহ্মার বিষয়ে এইরকম একটি গাথা আছে—’যে যে স্থানে ক্ষত হয় ব্রহ্মা সেই সেই স্থানে যান (কিংবা যেখানে যেখানে মন্ত্রের আবৃত্তি হয় সেই সেই স্থানে ব্রহ্মা যান।’
মন্তব্য : গাথা—আনন্দগিরি বলেন, গায়ত্র্যাদি ছন্দ ছাড়া অপর ছন্দে যাহা রচিত তাহাই ‘গাথা’। পিঙ্গলসূত্রেও আছে—ছন্দঃশাস্ত্রে যাহার উল্লেখ নাই, অথচ প্ৰয়োগ আছে তাহাই গাথা (৮।১)। ঐতরেয় আরণ্যকে লিখিত আছে যে, ঋঙ্ মন্ত্রাদি অপৌরুষেয় এবং গাথা মানবরচিত (৭।১৮)। যে সকল কবিতা মন্ত্র নয়, সেই সকল কবিতাকে প্রাচীনকালে গাথা বলা হইত।
‘যতঃ যতঃ আবর্ততে’—কেহ কেহ ইহার অর্থ করেন, যে স্থলে ব্রহ্মা—পুরোহিত গমন করেন, সেই স্থলে সাধারণ মানুষও গমন করে।
৩৫৮. মানবো ব্রহ্মৈবৈক ঋত্বিক্কুরূনশ্বাভিরক্ষত্যেবংবিদ্ হ বৈ ব্ৰহ্মা যজ্ঞং যজমানং সর্বাশ্চত্বিজোহভিরক্ষতি তমাদেবংবিদমেব ব্ৰহ্মাণং কুর্বীত নানেবংবিদং নানেবংবিদম্ ॥ ১০
অন্বয় : মানবঃ (মননশীল বা মৌনাবলম্বী) ব্রহ্মা এব একঃ ঋত্বিক্। কুরূ (কুরুদিগকে; শঙ্করের মতে কুরুকর্তা বা যোদ্ধা। এখানে কুরুবংশীয় না বলিয়া শঙ্কর ‘সাধারণ যোদ্ধৃগণ’ বলিয়াছেন) অশ্বা (ঘোটকী) অভিরক্ষতি (রক্ষা করিয়া থাকে)। এবংবিৎ হ বৈ ব্রহ্মা যজ্ঞম্ যজমানম্ সর্বান্ চ ঋত্বিজঃ (এবং সমুদয় ঋত্বিককে অভিরক্ষতি। তস্মাৎ (সেই জন্য) এবংবিদম্ এব ব্রহ্মাণম্ (এইপ্রকার জ্ঞানী ব্রহ্মাকেই কুর্বীত (নিযুক্ত করিবে); ন (না) অনেবংবিদম্ (ন এবংবিদম্—এইপ্রকার জ্ঞান যাহার নাই তাহাকে); ন অনেবংবিদম্ (দ্বিরুক্তি সমাপ্তিসূচক কিংবা গুরুত্বসূচক)।
সরলার্থ : মননশীল (বা মৌনাবলম্বী) ব্রহ্মাই একমাত্র ঋত্বিক্। যেমন ঘোটকী কুরুগণকে (কিংবা যোদ্ধৃগণকে) রক্ষা করিয়া থাকে, তেমনি এইপ্রকার জ্ঞানসম্পন্ন ব্রহ্মা যজ্ঞ, যজমান ও সব ঋত্বিককে রক্ষা করেন। তাই যিনি এই প্রকার জানেন, তাঁহাকেই ব্রহ্মা-ঋত্বিরূপে নিযুক্ত করিবে। যে জানে না তাহাকে নিযুক্ত করিবে না।
মন্তব্য : ‘অশ্বা’— Deussen, Bohtlingk ও Roth ‘অশ্বা’ স্থলে ‘শ্বা’ গ্রহণ করিয়াছেন। শ্বা—কুকুর। কেহ কেহ বলেন কুরূন্—যজ্ঞকর্তৃগণ। তাহা হইলে এই অংশের অর্থ হইবে—কুকুর যেমন যজ্ঞকারিগণকে রক্ষা করে।