ছান্দোগ্য উপনিষদ – পঞ্চম অধ্যায়
পঞ্চম অধ্যায়
প্ৰথম খণ্ড – ইন্দ্রিয়গণের বিবাদ — প্রাণের শ্রেষ্ঠত্ব
৩৫৯. যো হ বৈ জ্যেষ্ঠং চ শ্রেষ্ঠং চ বেদ জ্যেষ্ঠশ্চ হ বৈ শ্রেষ্ঠশ্চ ভবতি প্ৰাণো বাব জ্যেষ্ঠশ্চ শ্রেষ্ঠশ্চ ॥ ১
অন্বয় : যঃ হ বৈ জেষ্ঠম্ চ (জ্যেষ্ঠকে) শ্রেষ্ঠম্ চ (এবং শ্রেষ্ঠকে) বেদ (জানেন) জ্যেষ্ঠঃ চ হ বৈ শ্রেষ্ঠঃ চ ভবতি (হন)। প্রাণঃ বাবা জ্যেষ্ঠঃ চ শ্রেষ্ঠঃ চ।
সরলার্থ : যিনি জ্যেষ্ঠ ও শ্রেষ্ঠকে জানেন তিনি জ্যেষ্ঠ ও শ্রেষ্ঠই হন। প্রাণই জ্যেষ্ঠ ও শ্রেষ্ঠ।
৩৬০. যো হ বৈ বসিষ্ঠং বেদ বসিষ্ঠো হ স্বানাং ভবতি বাগ্ বাব বসিষ্ঠঃ ॥ ২
অন্বয় : যঃ হ বৈ বসিষ্ঠম্ বেদ বসিষ্ঠঃ হ স্বানাম্ (স্বজনগণের) ভবতি। বাক্ বাব বসিষ্ঠঃ।
সরলার্থ : যিনি বসিষ্ঠকে জানেন, তিনি স্বজনের মধ্যে (কিংবা স্বজনের) বসিষ্ঠই হন। বাক্ই বসিষ্ঠ।
মন্তব্য : বসিষ্ঠ— অতিশয় বসুমান অর্থাৎ অতিশয় ধনশালী। শঙ্কর ও আনন্দগিরির মতে অন্য অর্থও হয়, যেমন—বাসয়িতা, যিনি অপরকে বাস করান; আচ্ছাদয়িতা, যিনি পরিচ্ছদাদি দ্বারা অপরকে আচ্ছাদন করেন।
৩৬১. যো হ বৈ প্রতিষ্ঠাং বেদ প্রতি হ তিষ্ঠত্যস্মিংশ্চ লোকেহ মুন্সিংশ্চ চক্ষুৰ্বাব প্রতিষ্ঠা ॥ ৩
অন্বয় : যঃ হ বৈ প্রতিষ্ঠাম্ (প্রকৃষ্টরূপে স্থিতি = প্রতিষ্ঠা) বেদ প্রতি হ তিষ্ঠতি [প্রতিতিষ্ঠতি হ] (প্রতিষ্ঠালাভ করেন) অস্মিন্ চ লোকে (এই লোকে) অমুষ্মিন্ চ (ঐ লোকে)। চক্ষুঃ বাব প্রতিষ্ঠা।
সরলার্থ : যিনি প্রতিষ্ঠাকে জানেন, তিনি ইহলোকে এবং পরলোকে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। চক্ষুই প্রতিষ্ঠা।
৩৬২. যো হ বৈ সম্পদং বেদ সং হাস্মৈ কামাঃ পদ্যন্তে দৈবাশ্চ মানুষা শ্রোত্রং বাব সৎ ॥ ৪
অন্বয় : যঃ হ বৈ সম্পদম্ বেদ, সম্ [পদ্যন্তে] হ অস্মৈ (ইহার জন্য) কামাঃ (কাম্যবস্তুসমূহ) [সম্] পদ্যন্তে (উপস্থিত হয়) দৈবাঃ চ (দেবসম্বন্ধী ভোগ্যবস্তুসমূহ) মানুষাঃ চ (মানবসংক্রান্ত ভোগ্যবস্তুসমূহ)। শ্রোত্রম্ বাব সম্পৎ।
সরলার্থ : যিনি সম্পদকে জানেন, দৈব এবং মানবীয় সমস্ত কাম্যবস্তুই তাঁহার জন্য উপস্থিত হয়। শ্রোত্রই সম্পদ।
৩৬৩. যো হ বা আয়তনং বেদায়তনং হ স্বানাং ভবতি মনো হ বা আয়তনম্ ॥৫ অন্বয় : যঃ হ বৈ আয়তনম্ (আশ্রয়কে) বেদ, আয়তনম্ হ স্বানাম্ ভবতি। মনঃ হ বৈ আয়তনম্।
সরলার্থ : যিনি আয়তনকে (অর্থাৎ আশ্রয়কে) জানেন, তিনি স্বজনবর্গের, আয়তনই হন। মনই আয়তন।
৩৬৪. অথ হ প্রাণাঃ অহংশ্রেয়সি ব্যূদিরেহহং শ্ৰেয়ানস্মীতি ॥ ৬
অন্বয় : অথ হ প্রাণাঃ অহম্ শ্রেয়সি (অহম্ শ্রেয়স্ অর্থাৎ আমি শ্রেষ্ঠ এই বিষয়ে; কে শ্রেষ্ঠ এই বিষয়ে) ব্যুদিরে (বিবাদ করিয়াছিল) অহম্ (আমি) শ্রেয়ান্ (শ্রেষ্ঠ) অস্মি (হই) অহম্ শ্রেয়ান্ অস্মি ইতি।
সরলার্থ : এক সময়ে ‘কে শ্রেষ্ঠ’ এই বিষয়ে প্রাণসমূহের মধ্যে কলহ হইয়াছিল। সকলেই বলিল—’আমি শ্রেষ্ঠ, আমি শ্রেষ্ঠ’।
মন্তব্য : জ্ঞানেন্দ্রিয়, কর্মেন্দ্রিয় এবং মন—ইঁহাদের প্রত্যেকেই এক একজন দেবতার অধিষ্ঠান এবং প্রাণদেবতার বিভিন্ন প্রকাশ
৩৬৫. তে হ প্ৰাণাঃ প্রজাপতিং পিতরমেত্যোচুর্ভগবন্ কো নঃ শ্রেষ্ঠ ইতি তান্ হোবাচ যস্মিন্ ব উৎক্রান্তে শরীরং পাপিষ্ঠতরমিব দৃশ্যেত স বঃ শ্ৰেষ্ঠ ইতি ॥ ৭
অন্বয় : তে হ প্ৰাণাঃ প্রজাপতিম্ পিতরম্ (পিতা প্রজাপতিকে) এত্য (গমন করিয়া উচুঃ (বলিল) ভগবান্ কঃ (কে) নঃ (আমাদিগের মধ্যে) শ্রেষ্ঠঃ? ইতি তান্ (তাহাদিগকে) হ উবাচ (বলিলেন)—যস্মিন্ বঃ উৎক্রান্তে (তোমাদিগের মধ্যে যে বহির্গত হইলে) শরীরম্ পাপিষ্ঠতরম্ ইব (সর্বাপেক্ষা পাপিষ্ঠের ন্যায়; হীন অপেক্ষাও হীনতরের ন্যায়) দৃশ্যেত (দৃষ্ট হয়), সঃ (সে) বঃ (তোমাদিগের মধ্যে) শ্রেষ্ঠঃ ইতি।
সরলার্থ : সেই প্রাণিগণ পিতা প্রজাপতির কাছে গিয়া বলিল—ভগবান্, আমাদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ? তিনি তাহাদিগকে বলিলেন—’তোমাদের মধ্যে যে বাহির হইয়া গেলে শরীর পাপিষ্ঠতর (অর্থাৎ হীন অপেক্ষাও হীনতর) হয়, সেই শ্রেষ্ঠ।’
৩৬৬. সা হ বাগুচ্চক্রাম সা সম্বৎসরং প্রোষ্য পর্যেত্যোবাচ কথমশকতর্তে মজ্জীবিতুমিতি কথা কলা অবদন্তঃ প্রাণন্তঃ প্রাণেন পশ্যন্তশ্চক্ষুষা শৃণ্বন্তঃ শ্রোত্রেণ ধ্যায়ন্তো মানসৈবমিতি প্রবিবেশ হ বাক্ ॥ ৮
অন্বয় : সা হ বাক্ (সেই বাক্) উৎচক্রাম (উৎক্রান্ত হইল)। সা সম্বৎসরম্ প্রোষ্য (প্রবাস করিয়া) পর্যেত্য (পুনরাগমন করিয়া) উবাচ (বলিল) — কথম্ (কি প্রকারে) অশকত (সমর্থ হইয়াছিলে) ঋতে মৎ (আমা বিনা) জীবিতুম (জীবনধারণ করিতে) ইতি। যথা কলাঃ (মূকগণ) অবদন্তঃ (কথা না বলিয়া) প্রাণন্তঃ (প্রাণ ধারণ করিয়া) প্রাণেন (প্রাণের সাহায্যে, নিশ্বাস—প্রশ্বাসাদি দ্বারা), পশ্যন্তঃ (দেখিয়া) চক্ষুষা (চক্ষুদ্বারা), শৃণ্বন্তঃ (শ্রবণ করিয়া) শ্রোত্রেণ (কর্ণদ্বারা), ধ্যায়ন্তঃ (চিন্তা করিয়া) মনসা (মনদ্বারা)—এবম্ (এই প্রকার) ইতি। প্রবিবেশ (প্রবেশ করিল) হ বাক্।
সরলার্থ : বাক্ দেহ হইতে বাহির হইয়া গেল। সে এক বৎসর বাহিরে থাকিবার পর ফিরিয়া আসিয়া বলিল—’আমার অভাবে তোমরা কিভাবে বাঁচিয়াছিলে? অন্য ইন্দ্রিয়েরা বলিল—’মূক যেমন কথা বলে না, অথচ নিশ্বাস দ্বারা জীবনধারণা করে, চক্ষু দ্বারা দেখে, কর্ণ দ্বারা শোনে, মন দ্বারা চিন্তা করে, তেমনি (আমরাও জীবিত ছিলাম)। তারপর বাক্ দেহে প্রবেশ করিল।
৩৬৭. চক্ষুর্বোচ্চক্ৰাম তৎ সংবৎসরং প্রোষ্য পর্যেত্যোবাচ কথমশকতর্তে মজ্জীবিতুমিতি যথান্ধা অপশ্যন্তঃ প্রাণন্তঃ প্রাণেন বদন্তো বাচা শৃণ্বন্তঃ শ্রোত্রেণ ধ্যায়ন্তো মনসৈবসিতি প্রবিবেশ হ চক্ষুঃ ॥ ৯
অন্বয় : চক্ষুঃ হ উচ্চচক্রাম। তৎ (সে) সম্বৎসরম্ প্রোষ্য পর্যেত্য উবাচ—কথম্ অশকত ঋতে মৎ জীবিতুম্? ইতি। যথা অন্ধাঃ (অন্ধগণ) অপশ্যন্তঃ (দর্শন না করিয়া) প্রাণন্তঃ প্রাণেন, বদন্তঃ (কথা বলিয়া) বাচা (বাগিন্দ্রিয় দ্বারা), শৃণ্বন্তঃ শ্রোত্রেণ, ধ্যায়ন্তঃ মনসা—এবম্ ইতি। প্রবিবেশ হ চক্ষুঃ (৫।১।৮ মন্ত্ৰ দ্ৰঃ)।
সরলার্থ : তখন চক্ষু দেহ হইতে চলিয়া গেল। সে এক বছর প্রবাসে কাটাইয়া ফিরিয়া আসিয়া বলিল, ‘আমার অভাবে তোমরা কি করিয়া বাঁচিয়াছিলে?” (অন্য ইন্দ্রিয়েরা বলিল)— ‘অন্ধ যেমন দেখিতে পায় না, অথচ নিশ্বাস-প্রশ্বাস নিয়া বাঁচিয়া থাকে, বাগিন্দ্রিয় দ্বারা কথা বলে, কর্ণ দ্বারা শোনে, মন দ্বারা চিন্তা করে, তেমনি (আমরা জীবিত ছিলাম)।’ তখন দর্শনেন্দ্রিয় দেহে প্রবেশ করিল।
৩৬৮. শ্রোত্রং হোচ্চক্রাম তৎ সংবৎসরং প্রোষ্য পর্যেত্যোবাচ কথমশকতর্তে মজ্জীবিতুমিতি যথা বধিরা অশৃণ্বন্তঃ প্রাণন্তঃ প্রাণেন বদন্তো বাচা পশ্যন্তশ্চক্ষুষা ধ্যায়ন্তো মনসৈবমিতি প্রবিবেশ হ শ্রোত্রম্ ॥ ১০
অন্বয় : শ্রোত্রম্ হ উৎচক্রাম্। তৎ সম্বৎসরম্ প্রোষ্য পর্যেত্য উবাচ—কথম্ অশকত ঋতে মৎ জীবিতুম্? ইতি যথা বধিরাঃ (বধিরগণ) অশৃণ্বন্তঃ (শ্রবণ না করিয়া) প্রাণন্তঃ প্রাণেন, বদন্তঃ বাচা, পশ্যন্তঃ চক্ষুষা, ধ্যায়ন্তঃ মনসা—এবম্ ইতি। প্রবিবেশ হ শ্রোত্রম্ (৮ম ও ৯ম মন্ত্ৰ দ্ৰঃ)।
সরলার্থ : তারপর কর্ণ দেহ ছাড়িয়া চলিয়া গেল। সে এক বছর প্রবাসে কাটাইয়া ফিরিয়া আসিয়া বলিল, ‘আমার অভাবে তোমরা কিভাবে বাঁচিয়াছিলে?’ (অন্য সব ইন্দ্রিয়েরা বলিল)——’যেমন বধিরেরা শুনিতে পায় না, অথচ নিশ্বাস-প্রশ্বাস নিয়া বাঁচিয়া থাকে, বাগিন্দ্রিয় দ্বারা কথা বলে, চক্ষু দ্বারা দেখে, মন দ্বারা চিন্তা করে, তেমনি (আমরাও জীবিত ছিলাম)।’ তখন কর্ণ দেহে প্রবেশ করিল।
৩৬৯. মনো হোচ্চক্ৰাম তৎ সংবৎসরং প্রোষ্য পর্যেত্যোবাচ কথমশকতর্তে মজ্জীবিতুমিতি যথা বালা অমনসঃ প্রাণন্তঃ প্রাণেন বদন্তো বাচা পশ্যন্তশ্চক্ষুষা শৃণ্বন্তঃ শ্রোত্রেণৈবমিতি প্রবিবেশ হ মনঃ ॥ ১১
অন্বয় : মনঃ হ উৎচক্রাম। তৎ সম্বৎসরম্ প্রোষ্য পর্বেত্য উবাচ—কথম্ অশকত ঋতে মৎ জীবিতুম্ ইতি। যথা বালাঃ (শিশুগণ) অমনসঃ (মনন অর্থাৎ চিন্তা না করিয়া) প্রাণন্তঃ প্রাণেন, বদন্তঃ বাচা, পশ্যন্তঃ চক্ষুষা, শৃণ্বন্তঃ শ্রোত্রেণ—এবম্ ইতি। প্ৰবিবেশ হ মনঃ (৮ম ও ৯ম মন্ত্রঃ দ্রঃ)।
সরলার্থ : তখন মন দেহ ছাড়িয়া গেল। সে এক বছর প্রবাসে কাটাইয়া ফিরিয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘আমার অভাবে তোমরা কিভাবে বাঁচিয়াছিলে?’ অন্য ইন্দ্রয়েরা বলিল, ‘শিশু যেমন চিন্তা করে না, কিন্তু নিশ্বাস-প্রশ্বাস নিয়া বাঁচে, বাক্ দ্বারা কথা বলে, চক্ষু দ্বারা দেখে, কর্ণ দ্বারা শোনে, তেমনি (আমরাও জীবিত ছিলাম)। ‘ তখন মন দেহে প্রবেশ করিল।
৩৭০. অথ হ প্রাণ উচ্চিক্রমিষন্ স যথা সুহয়ঃ পদ্বীশ— শঙ্কুন্ সংখিদেদেব- মিতরান্ প্রাণান্ সমখিদত্তং হাভিসমেত্যোচুর্ভগবন্নেধি ত্বং নঃ শ্রেষ্ঠোহসি মোক্রমীরিতি ॥ ১২
অন্বয় : অথ হ প্রাণঃ উৎচিক্রমিষন্ (উৎক্রমণ করিতে ইচ্ছা করিলে) সঃ যথা সু- হয়ঃ (উৎকৃষ্ট অশ্ব) পড্বীশ—শঙ্কূন্ (পাদবন্ধনের জন্য খুঁটাসমূহ, শঙ্কু—খুঁটা) = সংখিদে (বৈদিক প্রয়োগ = সংখিন্দেৎ–সমুৎপাটিত করে) এবম্ (এই প্রকার) ইতরান্ প্রাণান্ (অপরাপর প্রাণসমূহকে) সম্ অখিদৎ (বৈদিক প্রয়োগ = সমখিন্দৎ সমুৎপাটিত করিল। তম্ (তাহার নিকট) হ অভিসমেত্য (একত্র আগমন করিয়া) উচুঃ (বলিয়াছিল) — ভগবন্, এধি (হউন, অর্থাৎ ‘প্রভু’ হউন); ত্বম্ (আপনি) নঃ (আমাদিগের) শ্রেষ্ঠঃ অসি (হইতেছেন)। মা উৎক্রমীঃ (উৎক্রমণ করিবেন না)।
সরলার্থ : যখন প্রাণ দেহ ছাড়িবার ইচ্ছা প্রকাশ করিল, তখন উৎকৃষ্ট অশ্ব যেমন পা বাঁধিয়া রাখিবার খুঁটিসমূহ উৎপাটিত করে, তেমনি প্রাণও অন্য ইন্দ্রিয়গুলিকে উৎপাটিত করিবার উপক্রম করিল। তখন তাহারা প্রাণের নিকট যাইয়া বলিল— ‘ভগবান্, আপনিই আমাদের প্রভু হউন; আপনিই আমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ; আপনি ছাড়িয়া যাইবেন না’
মন্তব্য : পজ্বীশ—আনন্দগিরি বলেন ব্যাকরণের নিয়মানুসারে ‘পদ্বীশ’ হওয়া উচিত। ‘পদ্বীশ’ স্থলে ‘পড়ীশ’ বৈদিক। কিন্তু কি প্রকারে ইহার উৎপত্তি হইল তাহা বলা কঠিন। তবে ইহার অর্থ যে ‘পাদবন্ধন’ সে বিষয়ে প্রায় সকলেই একমত। Roth (রথ) বলেন—‘পদ্’ হইতে পড়; ইহার অর্থ পদ; বীশ—বন্ধন। কেহ কেহ বলেন পশ্ ধাতু হইতে ‘পদ্বীশ’ হইয়াছে। এই পশ্ ধাতুর অর্থ ‘বহন করা’ এবং ‘পশ্’ শব্দের অর্থ বন্ধন বা বন্ধনরজ্জু।
৩৭১. অথ হৈনং বাগুবাচ যদহং বসিষ্ঠোহস্মি ত্বং তদ্বসিষ্ঠোহসীত্যথ হৈন চক্ষুরুবাচ যদহং প্রতিষ্ঠাস্মি ত্বং তৎপ্রতিষ্ঠাসীতি ॥ ১৩
অন্বয় : অথ হ এনম্ (ইহাকে, মুখ্যপ্রাণকে) বাক্ উবাচ—যৎ (যে, যদি) অহম্ (আমি) বসিষ্ঠঃ অস্মি (হই), ত্বম্ (আপনি) তৎ বসিষ্ঠঃ (সেই প্রকার বসিষ্ঠ-গুণসম্পন্ন; কিংবা তৎ—তাহা হইলে) অসি (হইতেছেন) ইতি। অথ হ এনম্ চক্ষুঃ উবাচ—যৎ অহম্ প্রতিষ্ঠা অস্মি ত্বম্ তৎ প্রতিষ্ঠা (সেই প্রকার প্রতিষ্ঠা; কিংবা তৎ—তবে) অসি ইতি।
সরলার্থ : তখন বাক্ তাহাকে বলিল ‘আমি যদি বসিষ্ঠ হই, তাহা হইলে আপনিও বসিষ্ঠ (কিংবা আপনিও সেই প্রকার বসিষ্ঠ)।’ তাহার পর চক্ষু তাহাকে বলিল—‘আমি যদি প্রতিষ্ঠা হই, তাহা হইলে আপনিও প্রতিষ্ঠা (কিংবা আপনি সেই প্রকার প্রতিষ্ঠা)।’
৩৭২. অথ হৈনং শ্রোত্রমুবাচ যদহং সম্পদস্মি ত্বং তৎ সম্পদসীত্যথ হৈনং মন উবাচ যদহমায়তনমস্মি ত্বং তদায়তনমসীতি ॥ ১৪
অন্বয় : অথ হ এনম্ শ্রোত্রম্ উবাচ— যৎ অহম্ সম্পৎ অস্মি ত্বম্ তৎ সম্পৎ (সেই প্রকার সম্পদ; বা ‘তৎ’—তবে) ইতি অথ এনম্ মনঃ উবাচ—যৎ অহম্ আয়তনম্ (আশ্রয়) অমি, ত্বম্ তৎ আয়তনম্ (সেই প্রকার আয়তন; কিংবা তৎ—তাহা হইলে) অসি ইতি। [৫।১।১৩ মন্ত্ৰ দ্ৰঃ]
সরলার্থ : তারপর কর্ণ বলিল—’আমি যদি সম্পদ হই, তবে আপনিও সম্পদ (কিংবা সেই প্রকার সম্পদ)।’ মন বলিল, ‘আমি যদি আয়তন হই, আপনিও আয়তন (কিংবা সেই প্রকার আয়তন অর্থাৎ আশ্রয়)।’
৩৭৩. ন বৈ বাচো ন চক্ষুংষি ন শ্রোত্রাণি ন মনাংসীত্যাচক্ষতে প্ৰাণা ইত্যেবাচক্ষতে প্রাণো হ্যেবৈতানি সর্বাণি ভবতি ॥ ১৫
অন্বয় : ন (না) বৈ বাচঃ (বাসমূহ) ন চক্ষুংষি (চক্ষুসমূহ) নো শ্রোত্রাণি (শ্রোত্রসমূহ) ন মনাংসি (মনসমূহ) ইতি আচক্ষতে (বলিয়া থাকে)। প্রাণাঃ (প্রাণসমূহ) ইতি এব আচক্ষতে। প্রাণঃ হি এব এতানি সর্বাণি (এই সমুদয়) ভবতি (হয়)।
সরলার্থ : এইজন্য পণ্ডিতেরা ইন্দ্রিয়বর্গকে বাক বলেন না, চক্ষু বলেন না, কর্ণ বলেন না, মন বলেন না, ইহাদের প্রাণই বলিয়া থাকেন। প্রাণই এই সব হইয়াছেন।
মন্তব্য : ইন্দ্রিয়গণ অপেক্ষা প্ৰাণ শ্রেষ্ঠ—এই প্রতিপাদ্য বিষয় কৌষীতকি (২। ১৪), বৃহদারণ্যক (১।৩।২-৭) এবং প্রশ্ন (২।২-১৩) মন্ত্রসমূহে আলোচিত হয়েছে।
দ্বিতীয় খণ্ড – প্রণোপাসনা
৩৭৪. স হোবাচ কিং মেহন্নং ভবিষ্যতীত যৎকিঞ্চিদিদমাশ্বভ্য আশকুনিভ্য ইতি হোচুস্তদ্বা এতদনস্যান্নমনো হ বৈ নাম প্রত্যক্ষং ন হ বা এবংবিদি কিঞ্চনানন্নং ভবতীতি ॥ ১
অন্বয় : সঃ (সে) হ উবাচ (বলিল)——কিম্ (কি) মে (আমার) অন্যম্ ভবিষ্যতি (হইবে)? ইতি। যৎ (যাহা) কিম্ + চিৎ (কিছু) ইদম্ (এই) আশ্বভ্যঃ (‘শ্বন্’ হইতে; কুকুর হইতে আরম্ভ করিয়া) আশকুনিভ্যঃ (পক্ষী হইতে আরম্ভ করিয়া; শকুনি — পক্ষী ইতি হ উচুঃ (বলিয়াছিল)। তৎ বৈ এতৎ (সেই এই) অনস্য (প্রাণের; অন—প্ৰাণ) অন্নম্। অনঃ (‘অন’ এই শব্দ) হ বৈ নাম প্রত্যক্ষম্। ন হ বৈ এবংবিদি (এই প্রকার জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির নিকটে) কিম্ + চন (কিছুই) অনন্নম্ (ন + অন্নম্—অন্ন নয় এমন, অভক্ষ্য (হয়)।
সরলার্থ : মুখ্য প্রাণ জিজ্ঞাসা করিল, ‘আমার অন্য কি হইবে?” অন্ন ইন্দ্রিয়েরা বলিল, ‘কুকুর ও শকুনি হইতে আরম্ভ করিয়া যাহা কিছু আছে তাহার সমস্তই।’ এই সবই প্রাণের অন্ন। ‘অন’ এই নাম সাক্ষাৎ (প্ৰাণবাচক)। যিনি এই রকম জানেন তাঁহার নিকট কিছুই অভক্ষ্য নয়।
মন্তব্য : ‘অন শব্দের সহিত উপসর্গযোগে প্রাণ, উদান, সমান, ব্যান, ইত্যাদি নিষ্পন্ন হয়। প্র + অন—প্রাণ; অপ + অন—অপান; সম + আ + অন—সমান; উৎ + আ + অন—উদান; বি + আ + অন—ব্যান। ‘অন’ এবং ‘অন্ন’” বিভিন্ন অর্থ প্রকাশক; উচ্চারণের সাদৃশ্যে উভয়ের সংযোগ দেখান হইয়াছে।
৩৭৫. স হোবাচ কিং মে বাসো ভবিষ্যতীত্যাপ ইতি হোচুস্তস্মাদ্ধা এতদশিষ্যস্তঃ পুরস্তাচ্চোপরিষ্টাচ্চাট্টিঃ পরিদধতি লক্ষ্মকো হ বাসো ভবত্যনগ্লো হ ভবতি ॥ ২
অন্বয় : সঃ হ উবাচ—কিম্ মে বাসঃ (বস্ত্র) ভবিষ্যতি? ইতি। (১মঃ দ্রঃ) আপঃ (জল) ইতি হ উচুঃ। তস্মাৎ (সেই জন্য) বৈ এতৎ (ইহাকে) অশিষ্যন্তঃ (ভোজন করিবে এমন লোকসমূহ) পুরস্তাৎ (পূর্বে) চ উপরিষ্টাৎ (পরেও) চ অভিঃ (জলদ্বারা) পরিদধতি (পরিধান করে; বেষ্টন করে)। লম্বুকঃ (যে লাভ করে; লম্বা) হ বাসঃ (বাস অর্থাৎ আচ্ছাদনকে) ভবতি (হয়); অনগ্নঃ (নগ্ন নয়; পরিহিত বস্ত্র) হ ভবতি।
সরলার্থ : প্রাণ জিজ্ঞাসা করিল— ‘আমার বসন কি হইবে?” তাহারা বলিল ‘জল (আপনার বস্ত্র হইবে)।’ তাই লোকে ভোজনের পূর্বে ও পরে অন্নকে জল দিয়া বেষ্টন করে। (যিনি এইরকম জানেন তিনি) অন্ন-বস্ত্র লাভ করেন, কখনো নগ্ন থাকেন না।
মন্তব্য : ভোজনের পূর্বে ও পরে যে আচমনের বিধি আছে তাহাতে প্রাণের বাস বা আচ্ছাদনের দৃষ্টি আরোপিত হইয়াছে।
৩৭৬. তদ্বৈতং সত্যকামো জাবালো গোশ্রুতয়ে বৈয়াঘ্র পদ্যায়োক্ত্রোবাচ যদ্যপ্যেনচ্ছুষ্কায় স্থাণবে ব্রুয়াজ্জায়েরবোস্মিঞ্ছাখাঃ প্ররোহেয়ুঃ পলাশানীতি ॥ ৩
অন্বয় : তত্ হ এতং (সেই ইহাকে) সত্যকামঃ জাবালঃ গোশ্রুতয়ে বৈয়াঘ্রপদ্যায় (ব্যাঘ্রপদের অপত্য গোশ্রুতিকে) উত্তা (বলিয়া) উবাচ—যদ্যপি এনৎ (এই উপদেশকে) শুষ্কায় স্থাণবে (শুষ্ক স্থাণুতে; স্থাণু — শাখাপল্লবহীন বৃক্ষকাণ্ড) ব্রুয়াৎ (বলা হয়), জায়ের (উৎপন্ন হইতে পারে) এব অস্মিন্ (এই স্থাণুতে) শাখা প্ররোহেয়ুঃ (উদ্গাত হইবে) পলাশানি (পত্রসমূহ) ইতি।
সরলার্থ : সত্যকাম জাবাল ব্যাঘ্রপদের পুত্র গোশ্রুতিকে এই উপদেশ দিয়া বলিয়াছিলেন—যদি নীরস বৃক্ষকাণ্ডকেও এই উপদেশ দেওয়া হয়, তাহা হইলে তাহাতেও শাখা উদ্গত এবং পত্ররাশি আবির্ভূত হইতে পারে।
মন্তব্য : ইন্দ্রদ্যুম্ন এবং বুড়িলকেও ‘বৈয়াঘ্রপদ্য’ বলা হইয়াছে (৫। ১৪। ১; ৫।১৬।১)। শাঙ্খায়ন আরণ্যকে গোশ্রুতির নামোল্লেখ আছে (১১।৭)।
৩৭৭. অথ যদি মহজ্জিগমিষেদমাবাস্যায়াং দীক্ষিত্বা পৌর্ণমাস্যাং রাত্রৌ সর্বৌষধস্য মথং দধিমধুনোরুপমথ্য জ্যেষ্ঠায় শ্রেষ্ঠায় স্বাহেত্যগ্না-বাজ্যস্য হুত্বা মন্থে সম্পাতমবনয়েৎ ॥ 4
অন্বয় : অথ যদি মহৎ (মহত্ত্বকে) জিগমিষেৎ (প্রাপ্ত হইতে ইচ্ছা করে), অমাবাস্যায়াম্ (অমাবস্যাতে) দীক্ষিত্বা (দীক্ষা গ্রহণ করিয়া) পৌর্ণমাস্যাম্ রাত্রৌ (পূর্ণিমা রজনীতে) সর্বৌষধস্য (সমুদয় ওষীধর) মথম্ (বিভিন্ন ওষধি একত্র পেষণ করিলে যে পিষ্ট হয়, তাহার নাম মন্থ) দধিমধুনোঃ (দধি ও মধুতে) উপমথ্য (মন্থন বা মিশ্রিত করিয়া) জ্যেষ্ঠায় শ্রেষ্ঠায় স্বাহা (জ্যেষ্ঠ ও শ্রেষ্ঠের উদ্দেশ্যে স্বাহা) ইতি অগ্নৌ (অগ্নিতে) আজ্যস্য (আজ্যের, আজ্যকে; শঙ্করের মতে— আজ্যনিক্ষেপ স্থলে; আজ্য—ঘৃত) হুত্বা (আহুতি দিয়া) মন্থে (যে মথ পূর্বে প্রস্তুত করা হইয়াছিল সেই মন্থে; কিংবা মন্থপাত্রে) সম্পাতম্ (পাত্র সংলগ্ন হোমের অবশিষ্টাংশকে)। অবনয়েৎ (নিম্নে নিক্ষেপ করিবে)।
সরলার্থ : যদি কেহ মহত্ত্ব লাভ করিতে ইচ্ছা করে তবে সে অমাবস্যাতে দীক্ষা নিয়া পূর্ণিমা-রাত্রিতে নানা প্রকার ওষধি মিশাইয়া পেষণ করিবে। সেই মন্থকে দধি ও মধুর সহিত মিলাইয়া ‘জ্যেষ্ঠ ও শ্রেষ্ঠের উদ্দেশে স্বাহা’ বলিয়া অগ্নিতে ঘৃত এবং মন্থন—পাত্রে সম্পাৎ (হোমের অবশিষ্টাংশ) নিক্ষেপ করিবে।
৩৭৮. বসিষ্ঠায় স্বাহেত্যগ্লাবাজ্যস্য হুত্বা মন্থে সম্পাতমবনয়েৎ প্রতিষ্ঠায়ৈ স্বাহেত্যগ্লাবাজ্যস্য হুত্বা মন্থে সম্পাতমবনয়েৎ সম্পদে স্বাহেত্যগ্নাবাজ্যস্য হুত্বা মন্থে সম্পাতমবনয়েৎ। আয়তনায় স্বাহেত্যগ্লাবাজ্যস্য হুত্বা মন্থে সম্পাতমবনয়েৎ ॥ ৫
অন্বয় : বসিষ্ঠায় স্বাহা (বসিষ্ঠের উদ্দেশে স্বাহা) ইতি অগ্নৌ আজ্যস্য হুত্বা মন্থে সম্পাতম্ অবনয়েৎ। প্রতিষ্ঠায়ে স্বাহা (প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে সাহা) ইতি অগ্নৌ আজ্যস্য হুত্বা মন্ধে সম্পাতম্ অবনয়েৎ। সম্পদে স্বাহা (সম্পদের উদ্দেশে স্বাহা) ইতি অগ্নৌ আজ্যস্য হুত্বা মন্থে সম্পাতম্ অবনয়েৎ। আয়তনায় স্বাহা (আশ্রয়ের উদ্দেশে স্বাহা) ইতি অগ্নৌ আজ্যস্য হুত্বা মন্থে সম্পাতম্ অবনয়েৎ (৪র্থ মঃ দ্রঃ)।
সরলার্থ : বসিষ্ঠের উদ্দেশে স্বাহা—এই বলিয়া অগ্নিতে আহুতি দিয়া মন্থে সম্পাত নিক্ষেপ করিবে। প্রতিষ্ঠার উদ্দেশে স্বাহা— এই বলিয়া অগ্নিতে আহুতি দিয়া মন্থে সম্পাত নিক্ষেপ করিবে। সম্পদের উদ্দেশে স্বাহা— এই বলিয়া অগ্নিতে আহুতি দিয়া মন্ধে সম্পাত নিক্ষেপ করিবে। আয়তনের উদ্দেশে স্বাহা— এই বলিয়া অগ্নিতে আহুতি দিয়া মন্থে সম্পাত নিক্ষেপ করিবে 1
৩৭৯. অথ প্রতিস্প্যাঞ্জলৌ মন্থমাধায় জপত্যমো নামাস্যমা হি তে সর্বমিদং স হি জ্যেষ্ঠঃ শ্রেষ্ঠো রাজাধিপতিঃ স মা জ্যৈষ্ঠং শ্রৈষ্ঠং রাজ্যমাধিপত্য গময়ত্বহমেবেদং সর্বমসানীতি ॥ ৬
অন্বয় : অথ প্রতিসৃপ্য (অগ্নি হইতে দূরে যাইয়া) অঞ্জলৌ (অঞ্জলিতে) মথম্ আধায় (গ্রহণ করিয়া) জপতি (জপ করে) এ অমঃ নাম অসি (হও); অমা (সহিত) হি তে (তোমার; তে অমা— তোমার সহিত) সর্বম্ ইদম্ (এই সমুদয়)। সঃ (তিনি) হি জ্যেষ্ঠঃ শ্রেষ্ঠঃ, রাজা (রাজা বা দীপ্তিমান্) অধিপতিঃ। সঃ মা (আমাকে) জ্যৈষ্ঠম্ (জ্যেষ্ঠত্ব গুণকে) শ্রৈষ্ঠম্ (শ্রেষ্ঠত্বকে) রাজ্যম্ (দীপ্তিকে বা রাজ্যকে) আধিপত্যম্ গময়তু (প্ৰাপ্ত করান) অহম্ (আমি) এর ইদম্ সর্বম্ অসানি (হই) ইতি।
সরলার্থ : তারপর অগ্নি হইতে কিছু দূরে সরিয়া মন্থ হাতে নিয়া এই মন্ত্র জপ করিবে— হে মন্থ (অর্থাৎ হে প্ৰাণ), তোমার নাম অম; এই সবকিছু তোমাতে প্রতিষ্ঠিত। তিনি (অর্থাৎ মন্থরূপী প্রাণ) জ্যেষ্ঠ, শ্রেষ্ঠ, দীপ্তিমান এবং অধিপতি। তিনি আমাকে জ্যেষ্ঠত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব, দীপ্তি ও আধিপত্য দান করুন। আমি সর্বাত্মক হইতে চাই।
মন্তব্য : শঙ্কর বলেন, ‘অমা’ প্রাণের একটি নাম।
৩৮০. থ খল্বেতয়া পচ্ছ আচামতি তৎসবিতুবৃণীমহ ইত্যাচামতি বয়ং দেবস্য ভোজনমিত্যাচামতি শ্রেষ্ঠং সর্বধাতমমিত্যাচামতি তুরং ভগস্য ধীমহীতি সর্বং পিবতি। নির্ণিজ্য কংসং চমসং বা পশ্চাদগ্নেঃ সংবিশতি চর্মণি বা স্থণ্ডিলে বা বাচংযমোহপ্রসাহঃ স যদি স্ক্রিয়ং পশ্যেৎ সমৃদ্ধং কৰ্মেতি বিদ্যাৎ ॥ ৭
অন্বয় : অথ খলু এতয়া ঋচা (এই ঋক্ দ্বারা) পচ্ছঃ (এক এক পদে এক এক পাদ উচ্চারণ করিয়া) আচামতি (ভক্ষণ করে)— (১) তৎ (সেই খাদ্যকে) সবিতুঃ (সবিতার বৃণীমহে (প্রার্থনা করি) ইতি (এই বলিয়া) আচামতি। (২) বয়ম্ (আমরা) দেবসা (দৈবতার) ভোজনম্ (খাদ্যকে) ইতি আচামতি। (৩) শ্রেষ্ঠম্ সর্বধাতমম্ (শ্রেষ্ঠ ও সকলের ধারয়িতাকে) ইতি আচামতি। (৪) তুরম্ (শীঘ্র— শঙ্করের মতেঃ শত্রুবিনাশক – সায়ণের মতে) ভগস্য ধীমহি (শঙ্করের মতে, চিন্তা করি; সায়ণের মতে উপভোগ করি বা প্রার্থনা করি) ইতি সর্বম্ পিবতি (এই বলিয়া সমুদয় পান করিবে)। নির্ণিজ্য (প্রক্ষালন করিয়া) কংসম্ (কংস নামক পাত্রকে) চমসম্ বা (অথবা চমস নামক পাত্রকে পশ্চাৎ অগ্নেঃ (অগ্নির পশ্চাৎ ভাগে) সংবিশতি (শয়ন করে) চর্মণি বা (চর্মের উপরে) স্থণ্ডিলে বা (অথবা মৃত্তিকার উপরে) বাচম্ + যমঃ (বাক্যত হইয়া) অপ্রসাহঃ (সংযতচিত্ত হইয়া) সঃ যদি ত্ৰিয়ম্ (স্ত্রীলোককে) পশ্যেৎ (স্বপ্নে দর্শন করে) সমৃদ্ধ (সকল) কর্ম ইতি বিদ্যাৎ (ইহা জানিবে)।
সরলার্থ : তারপর এই ঋকের প্রত্যেক পদ উচ্চারণ করিয়া (মন্থ) ভোজন করিবে। ‘তৎ সবিতুর্বণীমহে’—এই পদ উচ্চারণ করিয়া এক গ্লাস ‘বয়ম্ দেবস্য ভোজনম্’— এই পদ উচ্চারণ করিয়া এক গ্রাস এবং ‘শ্রেষ্ঠম্ সর্বধাতমম্’—এই পদ উচ্চারণ করিয়া এক গ্রাস ভোজন করিবে। ‘তুরং ভগস্য ধীমহি’—এই পদ উচ্চারণ করিয়া কংস পাত্রই হউক বা চমস পাত্রই হউক, তাহা ধুইয়া সবটুকু পান করিবে। ইহার পর বাক্য ও চিত্তকে সংযত করিয়া অগ্নির পিছন দিকে কিংবা মাটিতে শয়ন করিবে। সে যদি স্বপ্নে স্ত্রীলোক দেখে তবে তাহার কর্ম সফল হইয়াছে মনে করিতে হইবে।
মন্তব্য : যে ঋক উচ্চারণ করিতে হইবে তাহা এই — তৎ সবিতুৰ্বণীমহে বয়ম্ দেবস্য ভোজনম্ শ্রেষ্ঠম্ সর্বধাতমম্ তুরম্ ভগস্য ধীমহি (ঋগ্বেদ ৫।৮২।১; অর্থ সবিতাদেবের নিকট আমরা সকলের ধারক সেই শ্রেষ্ঠ অন্ন প্রার্থনা করিতেছি। আমরা শীঘ্র ভগদেবতার ধ্যান করি। (কিংবা সবিতাদেবের নিকট অন্ন প্রার্থনা করি। আমরা শীঘ্র ভগদেবতার শ্রেষ্ঠ, সর্বধারক স্বরূপের ধ্যান করি।)
৩৮১. তদেষ শ্লোকঃ— যদা কর্মসু কাম্যেষু স্ক্রিয়ং স্বপ্নেষু পশ্যতি। সমৃদ্ধিং তত্র জানিয়াত্তস্মিন্ স্বপ্ননিদর্শনে, তস্মিন্ স্বপ্ননিদর্শনে ॥ ৮
অন্বয় : তৎ (সে বিষয়ে) এষঃ শ্লোকঃ (এই শ্লোক) — যদা (যখন) কর্মসু কাম্যে (কাম্য কর্মে) ত্রিয়ম্ (স্ত্রীলোককে) স্বপ্নেষু (স্বপ্নে) পশ্যতি (দেখে), সমৃদ্ধিম্ তত্র (সেখানে) জানীয়াৎ (জানিবে) তস্মিন্ স্বপ্ন-নিদর্শনে (স্বপ্নদর্শনে, স্বপ্নদর্শনের ফলে), তস্মিন্ স্বপ্ন-নিদর্শনে (দ্বিরুক্তি নিশ্চয়ার্থক বা সমাপ্তিসূচক)।
সরলার্থ : সে বিষয়ে শ্লোক আছে— ফলকামনায় কাজ করিতে গিয়া যদি স্বপ্নে স্ত্রীলোক দর্শন হয় তবে সেই স্বপ্ন-নিদর্শন হইতে জানিবে যে, কর্মে সিদ্ধিলাভ হইয়াছে।
তৃতীয় খণ্ড – শ্বেতকেতু-প্রবাহণ-সংবাদ
৩৮২. শ্বেতকেতুহারুণেয়ঃ পঞ্চালানাং সমিতিমেয়ায় তং হ প্ৰবাহণো জৈবলিরুবাচ কুমারানু ত্বাশিষৎ পিতেত্যনু হি ভগব ইতি ॥ ১
অন্বয় : শ্বেতকেতুঃ হ আরুণেয়ঃ (আরুণির পুত্র; আরুণি—অরুণের পুত্র) পঞ্চালানাম্ (পঞ্চালজাতির কিংবা পঞ্চাল দেশসমূহের) সমিতিম্ (সভাতে) এয়ায় (গমন করিয়াছিল)। তম্ (তাহাকে) হ প্রবাহণঃ জৈবলিঃ (জীবলের পুত্র প্রবাহণ) উবাচ (বলিয়াছিল) — কুমার! অনু [অশিষৎ] ত্বা (তোমাকে) অশিষৎ (শিক্ষা দিয়াছেন) পিতা ইতি। অনু [অশিষৎ] (অনুশাসন করিয়াছেন) হি (নিশ্চয়ই) ভগবঃ (প্রাচীন প্ৰয়োগ, ভগবন্)।
সরলার্থ : একদিন শ্বেতকেতু আরুণেয় পঞ্চালসভাতে গেল। (সেখানে) প্রবাহণ জৈবলি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল— ‘কুমার, (তোমার) পিতা কি তোমাকে উপদেশ দিয়েছেন?’ শ্বেতকেতু বলিল— ‘ভগবান, তিনি দিয়াছেন।’
মন্তব্য : (ক) কুমার—কম্ + আরণ; কম্ ইচ্ছা করা, প্রীতি করা, কমনীয় বলিয়া ইহার নাম কুমার। কেহ বলেন ইহার অর্থ ক্রীড়াশীল। Monier Williams-এর অভিধানে কুমার—কু + মার, যে সহজে মরে।
(খ) কৌষীতকি উপনিষদে শ্বেতকেতুকে আরুণিপুত্র এবং গৌতম বলা হইয়াছে। শ্বেতকেতু পিতা উদ্দালকের নিকট হইতে যে উপদেশ লাভ করিয়াছিলেন তাহা এই ছান্দোগ্য উপনিষদের ষষ্ঠ অধ্যায়ে বিবৃত হইয়াছে।
৩৮৩. বেথ যদিতোহধি প্রজাঃ প্রযন্তীতি? ন ভগব ইতি। বেথ যথা পুনরা- বর্তন্ত ৩ ইতি? ন ভগব ইতি। বেথ পথোর্দেবযানস্য পিতৃযাণস্য চ ব্যাবর্তনা ৩ ইতি? ন ভগব ইতি ॥ ২
অন্বয় : বেথ (জান?) যৎ (যেখানে) ইতঃ (এই স্থান হইতে) অধি (ঊর্ধ্বদেশে) প্রজাঃ (প্রাণিগণ) প্রযন্তি (গমন করে) ইতি। ন ভগবঃ ইতি। বেথ যথা (যে প্রকারে) পুনঃ আবর্তন্তে ৩ (প্রত্যাগমন করে)? ইতি। ন ভগবঃ ইতি। বেথ পথোঃ (পথদ্বয়ের) দেবযানস্য (দেবযানের) পিতৃযাণস্য চ (পিতৃযাণের) ব্যাবর্তনা ৩ (যেখানে পৃথক হইয়াছে)? ন ভগবঃ ইতি। [আবর্তন্তে ৩ এবং ব্যাবর্তনা ৩—এখানে ৩ পুত স্বরের চিহ্ন]।
সরলার্থ : প্রবাহণ জিজ্ঞাসা করিলেন—’প্রাণিগণ মৃত্যুর পর ঊর্ধ্বে কোন্ দেশে যায় তাহা কি জান?’ শ্বেতকেতু বলিল—’ভগবান্ জানি না।’ প্রবাহণ জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘যে ভাবে প্রাণিগণ ফিরিয়া আসে তাহা কি জান?’ শ্বেতকেতু বলিল— ‘ভগবন্, জানি না।’ প্রবাহণ আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘দেবযান ও পিতৃযাণ কোথায় পৃথক হইয়াছে, তাহা জান কি?” শ্বেতকেতু বলিল, ‘ভগবান্, জানি না।’
৩৮৪. বেথ যথাসৌ লোকো ন সম্পূর্যত ৩ ইতি? ন ভগব ইতি। বেথ যথা পঞ্চম্যামাহুতাবাপঃ পুরুষবচসো ভবন্তীতি? নৈব ভগব ইতি ॥ ৩
অন্বয় : বেথ যথা অসৌ লোকঃ (ঐ লোক; বা চন্দ্রলোক) ন সম্পূর্যতে ৩ (সম্পূর্ণরূপে পূর্ণ হয়, ‘৩’ পুত স্বরের চিহ্ন) ন ভগবঃ ইতি। বেথ যথা পঞ্চম্যাম্ আহুতৌ (পঞ্চমসংখ্যক আহুতিতে) আপঃ (জল) পুরুষবচসঃ (পুরুষ-শব্দ-বাচ্যঃ) ভবন্তি (হয়) ইতি ন এব ভগবঃ ইতি।
সরলার্থ : প্রবাহণ জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি কি জান ঐ লোক (অর্থাৎ পিতৃলোক) কেন (জীবদ্বারা) পূর্ণ হয় না?” শ্বেতকেতু বলিল, ‘ভগবান্ জানি না।’ প্রবাহণ জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি কি জান পঞ্চমী আহুতিতে জলকে কেন পুরুষ বলা হয়? ‘ভগবান্ জানি না।’
মন্তব্য : অসৌ লোকঃ—উপনিষদের ভাষ্যে শঙ্কর ইহার অর্থ পিতৃলোক করিয়াছেন। কিন্তু ব্রহ্মসূত্র ভাষ্যে অর্থ করিয়াছেন চন্দ্রলোক। রামানুজের অর্থ ‘দ্যুলোক’।
৩৮৫. অথানু কিমনুশিষ্টোহবোচথা যো হীমানি ন বিদ্যাৎ কথং সোহনুশিষ্টো রুবীতেতি স হায়স্তঃ পিতুরধমেয়ায় তং হোবাচাহননুশিষ্য বাব কিল মা ভগবানব্রবীদ ত্বাশিষমিতি ॥ ৪
অন্বয় : অথ নু কিম্। (কেন) অনুশিষ্টঃ (উপদিষ্ট হইয়াছি) অবোচথাঃ (বলিয়াছি)? যঃ (যে) হি ইমানি (এই সমুদয়কে) ন বিদ্যাৎ (জানেনা), কথম (কি প্রকারে) সঃ (সে) অনুশিষ্টঃ ব্রবীত (বলে)? ইতি। সঃ হ আয়স্ত (মনোবেদনা প্রাপ্ত হইয়া) পিতুঃ (পিতার) অর্ধম্ (স্থানকে) এয়ায় (প্রত্যাগমন করিল)। তম্ (তাহাকে) হ উবাচ (বলিল)— অননুশিষ্য (ন অনুশিষ্য—শিক্ষা না দিয়া) বাব কিল মা (আমাকে) ভগবান্ অব্রবীৎ (বলিয়াছিলেন) অনু ত্বা অশিষম্ (=ত্বা অনু + অশিষম্—তোমাকে শিক্ষা দিয়াছি) ইতি।
সরলার্থ : তখন প্রবাহণ বলিলেন, ‘তবে কেন বলিলে আমি উপদিষ্ট হইয়াছি? যে এসব বিষয় জানে না, সে কি করিয়া বলে ‘আমি উপদেশ পাইয়াছি?’ শ্বেতকেতু মনের দুঃখে পিতার নিকট ফিরিয়া আসিল এবং তাঁহাকে বলিল—’আপনি আমাকে উপদেশ না দিয়াই বলিয়াছিলেন— তোমাকে শিক্ষা দিয়াছি।’
৩৮৬. পঞ্চ মা রাজন্যবন্ধুঃ প্রশ্নানপ্রাক্ষীত্তেষাং নৈকঞ্চনাশকং বিবক্তমিতি। স হোবাচ যথা মা ত্বং তদৈতানবদো যথাহমেষাং নৈকঞ্চন বেদ যদ্যহমিমানবেদিষ্যং কথং তে নাবক্ষ্যমিতি ॥ ৫
অন্বয় : পঞ্চ (পাঁচটি) মা (আমাকে) রাজন্যবন্ধু প্রশান্ (প্রশ্নসমূহ) অপ্রাক্ষী (জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন)। তেষাম্ (সেই সমুদয় প্রশ্নের) ন একম্ + চন (একটিও) অশকম্ (সমর্থ হইয়াছি) বিবক্কুম্ (বলিতে) ইতি। সঃ (পিতা) হ উবাচ (বলিলেন) — যথা (যে, যে প্রকার) মা ত্বং তদা (তখন, রাজসভা হইতে প্রত্যাগমন করিয়া) এতান্ (এই সমুদয়কে; এই সমুদয় প্রশ্নকে) অবদঃ (বলিয়াছিলেন) যথা (যেহেতু) অহম্ (আমি) এষাম্ (এ সমুদয়ের) ন একচন (একটিও) বেদ (জানি)—যদি অহম্ ইমান্ (এ সমুদয়কে) অবেদিষ্যম্ (জানিতাম), কথম্ (কেন) তে (তোমাকে) ন অবক্ষ্যম্ (বলিতাম) ইতি?
সরলার্থ : (শ্বেতকেতু)——সেই রাজন্যবন্ধু আমাকে পাঁচটি প্রশ্ন করিয়াছিল। আমি তাহার একটিরও উত্তর দিতে পারি নাই। পিতা (এই সমুদয় প্রশ্নের বিষয় মনে মনে আলোচনা করিয়া সময়ান্তরে) বলিলেন—’তুমি তখন (অর্থাৎ রাজার নিকট হইতে ফিরিয়া) আমাকে যে সব প্রশ্নের কথা বলিয়াছিলে (সেই বিয়য়ে আমার বক্তব্য আমি বলি, শুন)। যেহেতু আমি ইহার একটিও জানি না (সেইজন্য তোমাকে এ বিষয়ে উপদেশ দিই নাই)। যদি আমি জানিবই তবে কেনই বা তোমাকে না বলিব?”
মন্তব্য : রাজন্যবন্ধুঃ—রাজার গুণ নাই, কেবল রাজগণের বন্ধু বলিয়া রাজা। ইহা একটি ঘৃণাসূচক বাক্য। ব্রহ্মবন্ধু, দ্বিজবন্ধু, ক্ষত্রবন্ধু প্রভৃতি কথারও অর্থ এইরূপ। এই স্থলে ‘রাজন্য’ শব্দ ‘রাজা’ অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে; কিন্তু প্রাচীনকালে ক্ষত্রিয় এবং রাজবংশের লোকদিগকেও ‘রাজন্য’ বলা হইত।
৩৮৭. স হ গৌতমো রাজ্ঞোহর্ধমৈয়ায় তস্মৈ হ প্রাপ্তায়াহাঞ্চকার, স হ প্রাতঃ সভাগ উদেয়ায়, তং হোবাচ মানুষস্য ভগবান্ গৌতম বিত্তস্য বরং বৃণীথা ইতি। স হোবাচ তবৈব রাজন্ মানুষং বিত্তং যামেব কুমারস্যান্তে বাচমভ্যষথাস্তামেব মে রুহীতি। স হ কৃচ্ছ্রীবভুব ॥ ৬
অন্বয় : সঃ হ গৌতমঃ রাজ্ঞঃ (রাজার) অধম (স্থান), এয়ায় (গমন করিলেন)। তস্মৈ হ প্রাপ্তায় (সেই অভ্যাগতকে) অর্হাম্ চকার (পূজা করিলেন)। সঃ হ প্ৰাতঃ সভাগে (রাজা সভাগত হইলে) উদেয়ায় (উপস্থিত হইল)। তম্ হ উবাচ (বলিলেন) মানুষস্য [বিত্তস্য] (মানবসম্বন্ধী বিত্তের) ভগবন্ গৌতম, বিত্তস্য (বিত্তের) বরম্ বৃণীথা (প্রার্থনা করুন) ইতি। সঃ হ উবাচ—তব এব (আপনারই থাকুক) রাজ, মানুষম্ বিত্তম্ (মনুষ্যসম্বন্ধী বিত্ত)। যাম্ এব [বাচন] (যে বাক্যকে) কুমারস্য (কুমারের) অন্তে (নিকটে) বাচম্ অভাষথাঃ (বলিয়াছিলেন), তাম্ এব (সেই বাক্যকেই) মে (আমাকে) ব্রুহি (বলুন) ইতি। সঃ (রাজা) কৃচ্ছ্রী বভূব (দুঃখিত হইলেন)।
সরলার্থ : (তারপর) গৌতম রাজভবনে উপস্থিত হইলেন। রাজা অভ্যাগতকে সমাদর করিলেন প্রাতঃকালে রাজা সভায় উপস্থিত হইলেন, গৌতমও সেখানে গেলেন। রাজা তাঁহাকে বলিলেন—’ভগবান্ গৌতম মনুষ্যসুলভ বিত্তের জন্য বর প্রার্থনা করুন। গৌতম বলিলেন, “হে রাজন, বিত্ত আপনারই থাকুক। আপনি আমার পুত্রকে যাহা বলিয়াছিলেন, আমাকে তাহাই বলুন।’ এই কথা শুনিয়া রাজা বিষণ্ন হইলেন।
মন্তব্য : ডয়সন্ শেষ অংশের এরূপ অর্থ করিয়াছেন—’হে গৌতম, তুমি যেমন বলিলে যে তোমার পূর্বে কোন ব্রাহ্মণ এই বিদ্যা লাভ করে নাই, এজন্যই রাজ্য শাসন করিবার ক্ষমতা ক্ষত্রিয়দিগের হস্তেই রহিয়াছে।’ ইঁহার মতে প্রশাসন অর্থ শাসন করিবার।
৩৮৮. তং হ চিরং বসেত্যাজ্ঞাপরাঞ্চকার তং হোবাচ যথা মা ত্বং গৌতমাবদো যথেয়ং ন প্রাক্ ত্বত্তঃ পুরা বিদ্যা ব্রাহ্মণান্ গচ্ছতি তস্মাদু সর্বেষু লোকেষু ক্ষত্রস্যৈব প্রশাসনমভুদিতি তস্মৈ হোবাচ ॥ ৭
অন্বয় : তম্ (গৌতমকে) হ চিরম্ (দীর্ঘকাল) বস (বাস কর) ইতি আজ্ঞাপয়াঞ্চকার (এই আজ্ঞা করিলেন)। তম্ হ উবাচ—যথা (যেমন, যে প্রকার) মা (আমাকে) ত্বম্ গৌতম, অবদঃ (বলিয়াছিলেন)। যথা (যেহেতু) ইয়ম্ [বিদ্যা] (এই বিদ্যা) ন প্রাক্ ত্বত্তঃ (ত্বৎ তস্; তোমার পূর্বে) পুরা (পুরাকালে) বিদ্যা ব্রাহ্মণান্ (ব্রাহ্মণদিগকে) গচ্ছতি (প্রাপ্ত হইয়াছে), তস্মাৎ (সেইজন্য) উ সর্বেষু লোকেষু (সর্বলোকে) ক্ষত্রস্য এব (ক্ষত্রিয়েরই) প্রশাসনম্ (শিক্ষা দিবার ক্ষমতা) অভূৎ (ছিল) ইতি। তস্মৈ (তাহাকে) হ উবাচ (বলিলেন)—
সরলার্থ : রাজা তাঁহাকে আদেশ করিলেন—’দীর্ঘকাল (আমার নিকট ব্রহ্মচারীরূপে) বাস কর।’ (এইরূপ দীর্ঘকাল বাস করিবার পর একদিন রাজা) তাঁহাকে বলিলেন— ‘তুমি যে আমাকে সেই বিষয় জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে—। তোমার পূর্বে পুরাকালে কোন ব্রাহ্মণই এই বিদ্যা লাভ করে নাই। (ইহা কেবল ক্ষত্রিয়গণই জানিত); এইজন্য সর্বলোকে ক্ষত্রিয়দিগেরই (এ বিষয়ে উপদেশ দিবার) ক্ষমতা ছিল।’ ইহার পর তিনি উপদেশ দিলেন—।
চতুর্থ খণ্ড – (পঞ্চ প্রশ্নের উত্তর) প্রবাহণ-কথিত পঞ্চাগ্লিবিদ্যা (১)
৩৮৯. অসৌ বাব লোকো গৌতমাগ্নিস্তস্যাদিত্য এব সমিদৃশ্ময়ো ধূমোহ- হরচিশ্চন্দ্রমা অঙ্গারা নক্ষত্রাণি বিস্ফুলিঙ্গাঃ ॥ ১
অন্বয় : অসৌ বাব লোকঃ (ঐ লোক, দ্যুলোক) গৌতম, অগ্নিঃ। তস্য (তাহার) আদিত্যঃ এব সমিৎ (কাষ্ঠ); রশ্ময়ঃ (রশ্মিসমূহ) ধূমঃ; অহঃ (দিন) অর্চিঃ (শিখা), চন্দ্রমাঃ অঙ্গারাঃ; নক্ষত্রাণি বিস্ফুলিঙ্গাঃ।
সরলার্থ : হে গৌতম, দ্যুলোকই (যজ্ঞের) অগ্নি, আদিত্য তাহার কাষ্ঠ, রশ্মিসমূহ ধূম, দিনই শিখা, চন্দ্ৰই অঙ্গার এবং নক্ষত্রগণই স্ফুলিঙ্গ।
৩৯০. তস্মিন্নেতস্মিন্নগ্লৌ দেবাঃ শ্রদ্ধাং জুহ্বতি তস্যা আহুতেঃ সোমো রাজা সম্ভবতি ॥ ২
অন্বয় : তস্মিন্ এতস্মিন্ অগ্নৌ (সেই এই অগ্নিতে) দেবাঃ শ্রদ্ধাম্ জুতি (আহুতি দেয়)। তস্যাঃ আহুতেঃ (সেই আহুতি হইতে) সোমঃ রাজা (চন্দ্র) সম্ভবতি (উৎপন্ন হয়)।
সরলার্থ : দেবগণ সেই অগ্নিতে শ্রদ্ধাকে আহুতি দেন। সেই আহুতি হইতে সোমরাজা চন্দ্র উৎপন্ন হয়
মন্তব্য : এখানে ‘অপ্’কেই শ্রদ্ধা বলা হইয়াছে। এই সংক্রান্ত প্রশ্ন অপ্ সম্বন্ধে (৫।৩।৩) এবং উপসংহারও অপ্ বিষয়ে (৫।৯।১)। সুতরাং অপ্ই শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধার সহিত জলকে আহুতি দেওয়া হয়, এই জন্যই সম্ভবত জলকে শ্রদ্ধা বলা হইয়াছে। শঙ্কর বেদান্তসূত্র ভাষ্যে (৩।১।৫) ইহার বিস্তৃত আলোচনা করিয়াছেন।
পঞ্চম খণ্ড – প্রবাহণ-কথিত পঞ্চাগ্নিবিদ্যা (২)
৩৮১. পর্জন্যো বাব গৌতমাগ্নিস্তস্য বায়ুরেব সমিদভ্রং ধূমো বিদ্যুদর্চির-শনিরঙ্গারা হ্রাদনয়ো বিস্ফুলিঙ্গাঃ ॥ ১
অন্বয় : পর্জন্যঃ (বৃষ্টির দেবতার নাম) বাব গৌতম অগ্নিঃ। তস্য বায়ুঃ এব সমিৎ, অভ্রম্ (মেঘ) ধূমঃ, বিদ্যুৎ অর্চিঃ; অশনিঃ অঙ্গারাঃ, হ্রাদনয়ঃ (মেঘগর্জন, হ্রাদনি—মেঘগর্জন) বিস্ফুলিঙ্গাঃ (৫।৪।১ মঃ দ্ৰঃ
সরলার্থ : হে গৌতম, পর্জন্যই অগ্নি, বায়ুই তাহার কাষ্ঠ, মেঘ ধূম, বিদ্যুৎ শিখা, বজ্রই অঙ্গার, মেঘগর্জনই স্ফুলিঙ্গ।
৩৯২. তস্মিন্নেতস্মিন্নগ্নৌ দেবাঃ সোমং রাজানং জুহ্বতি তস্যা আহুতেবর্ষং সম্ভবতি ॥ ২
অন্বয় : তস্মিন্ এতস্মিন্ অগ্নৌ দেবাঃ সোমম্ রাজানম্ (সোম রাজাকে) জুহ্বতি; তস্যাঃ আহুতেঃ বর্ষম্ (বৃষ্টি) সম্ভবতি (৫।৪।২ মঃ দ্ৰঃ)।
সরলার্থ : সেই অগ্নিতে দেবগণ সোমরাজকে আহুতি দেন। সেই আহুতি হইতে বৃষ্টি উৎপন্ন হয়।
ষষ্ঠ খণ্ড – প্রবাহণ-কথিত পঞ্চাগ্নিবিদ্যা (৩)
৩৯৩. পৃথিবী বাব গৌতমাগ্নিস্তস্যাঃ সংবৎসর এব সমিদাকাশো ধূমো রাত্রিরচির্দিশোহঙ্গারা অবান্তরদিশো বিস্ফুলিঙ্গা ॥ ১
অন্বয় : পৃথিবী বাবা গৌতম অগ্নিঃ তস্যাঃ (এই পৃথিবীর) সম্বৎসরঃ এব সমি, আকাশঃ ধূমঃ; রাত্রিঃ অর্টিঃ; দিশঃ (দিকসমূহ) অঙ্গারাঃ; অবান্তরদিশঃ (ঈশান, নৈৰ্ব্বতাদি কোণসমূহ, অবান্তর = অব + অন্তর, মধ্যবর্তী) বিস্ফুলিঙ্গাঃ (৫।৪।১ মঃ দ্রঃ)।
সরলার্থ : হে গৌতম, পৃথিবীই অগ্নি; সম্বৎসর ইহার সমিধ; আকাশই ধূম, রাত্রিই শিখা; (উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম) দিকসমূহ অঙ্গার; (ঈশান, নৈর্ঝত প্রভৃতি) অবান্তর কোণসমূহই স্ফুলিঙ্গ।
৩৯৪. তস্মিন্নেতস্মিন্নগ্লৌ দেবা বর্ষং জুহ্বতি তস্যা আহুতেরন্নং সম্ভবতি ॥ ২
অন্বয় : তস্মিন্ এতস্মিন্ অগ্নৌ দেবাঃ বর্ষম্ (বৃষ্টিকে) জুহ্বতি। তস্যাঃ আহুতেঃ অন্নম্ সম্ভবতি (৫।৪।২ মঃ দ্রঃ)।
সরলার্থ : সেই অগ্নিতে দেবগণ বৃষ্টিকে আহুতি দেন। সেই আহুতি হইতে অন্ন উৎপন্ন হয়।
সপ্তম খণ্ড – প্রবাহণ-কথিত পঞ্চাগ্নিবিদ্যা (8)
৩৯৫. পুরুষো বাব গেতমাগ্নিস্তস্য বাগেব সমিৎ প্রাণা ধূমো জিহ্বার্চিশ্চ- ক্ষুরঙ্গারাঃ শ্রোত্রং বিস্ফুলিঙ্গাঃ ॥ ১
অন্বয় : পুরুষঃ বাব গৌতম! অগ্নিঃ তস্য বাক্ এব সমিৎ; প্রাণঃ ধূমঃ জিহ্বা অর্চিঃ; চক্ষুঃ অঙ্গারাঃ, শ্রোত্রম্ বিস্ফুলিঙ্গাঃ (৬।৪।১ মঃ দ্রঃ)।
সরলার্থ : হে গৌতম, পুরুষ অগ্নি, বাক্ই তাহার সমিত্, প্রাণ ধূম, জিহ্বা শিখা, চক্ষু অঙ্গার, কর্ণ স্ফুলিঙ্গ।
৩৯৬. তস্মিন্নেতস্মিন্নগ্লৌ দেবাঃ অনুং জুহ্বতি তস্যা আহ্লতে রেতঃ সম্ভবতি ॥ ২
অন্বয় : তস্মিন্ এতস্মিন্ অগ্নৌ দেবাঃ অন্নম্ জুহ্বতি; তস্যাঃ আহুতেঃ রেতঃ সম্ভবতি (৫।৪।২ মঃ দ্ৰঃ)।
সরলার্থ : সেই অগ্নিতে দেবগণ অন্নকে আহুতি দেন, সেই আহুতি হইতে শুক্র উৎপন্ন হয়।
অষ্টম খণ্ড – প্রবাহণ-কথিত পঞ্চাগ্নিবিদ্যা (৫)
৩৯৭. যোষা বাব গৌতমাগ্নিস্তস্যা উপস্থ এব সমিদ্ যদুপমন্ত্রয়তে স ধূমো যোনিরচির্যদন্তঃ করোতি তেহঙ্গারা অভিনন্দা বিস্ফুলিঙ্গাঃ ॥ ১
অন্বয় : যোষা (স্ত্রীলোক) বাব গৌতম অগ্নিঃ; তস্যাঃ উপস্থঃ এব সমিৎ, যৎ উপমন্ত্রয়তে (আহ্বান করে) সঃ ধূমঃ; যোনিঃ অর্টিঃ; যৎ অন্তঃ করোতি, তে অঙ্গারাঃ, অভিনন্দাঃ বিস্ফুলিঙ্গাঃ (৫।৪।১ মঃ দ্রঃ)।
সরলার্থ : হে গৌতম, নারীই অগ্নি, উপস্থ তারার সমিধ (ইন্ধন), যে সম্ভাষণ করা হয় তাহাই ধূম, জননেন্দ্রিয় অর্চি (শিখা), মৌথুন অঙ্গার এবং স্বল্পসুখই স্ফুলিঙ্গ (অগ্নিকণা)।
৩৯৮. তস্মিন্নেতস্মিন্নগ্লৌ দেবা রেতো জুহ্বতি তস্যা আহুতের্গর্ভঃ সম্ভবতি ॥ ২ অন্বয় : তস্মিন্ এতস্মিন্ অগ্নেঃ দেবাঃ রেতঃ জুহ্বতি; তস্যাঃ আহুতেঃ গর্ভঃ সম্ভবতি (হয়)।
সরলার্থ : সেই শ্রীরূপ অগ্নিতে দেবগণ শুক্র আহুতি দেন। সেই আহুতি হইতে গর্ভসঞ্চার হয়।
মন্তব্য : প্রথম আহুতিতে শ্রদ্ধা অর্থাৎ জল অগ্নিতে হোম করা হয়; ইহা হইতে সোম উৎপন্ন হয়। দ্বিতীয় আহুতিতে সোমকে হোম করা হয়; ইহা হইতে বৃষ্টি উৎপন্ন হয়। তৃতীয় আহুতিতে বৃষ্টিকে হোম করা হয়; ইহা হইতে অন্ন উৎপন্ন হয়। চতুর্থ আহুতিতে অন্নকে হোম করা হয়; ইহা হইতে শুক্র উৎপন্ন হয়। পঞ্চম আহুতিতে শুক্রকে হোম করা হয়, ইহা হইতে মানব উৎপন্ন হয়। প্রথমে জলকে আহুতি দেওয়া হইয়াছিল। সেই জলই পঞ্চম আহুতিতে গর্ভরূপে পরিণত হইয়া মানবরূপে উৎপন্ন হয়। এইরূপে পঞ্চম প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হইল।
নবম খণ্ড – পঞ্চাগ্নিবিদ্যার উপসংহার (১)
৩৯৯. ইতি তু পঞ্চম্যামাহুতাবাপঃ পুরুষবচসো ভবন্তীতি স উল্কাবৃতো, গর্ভে দশ বা নব বা মাসানন্তঃ শয়িত্বা যাবদ্ বাথ জায়তে ॥ ১
অন্বয় : ইতি তু পঞ্চম্যাম্ অহুতৌ আপঃ পুরুষবচসঃ ভবন্তি (৫।৩।৩ মঃ দ্ৰঃ) ইতি। সঃ (সেই) উল্কাবৃতঃ (উল্ব অর্থাৎ জরায়ুদ্বারা আবৃত) গর্ভঃ দশ বা নব বা মাসান্ (দশ কিংবা নয় মাস) অন্তঃ (অভ্যন্তরে) শয়িত্বা (শয়ন করিয়া) যাবৎ বা (অথবা যতকাল আবশ্যক হয়), অথ (অনন্তর) জায়তে (উৎপন্ন হয়।
সরলার্থ : এইভাবেই পঞ্চম আহুতিতে জল পুরুষ আখ্যা পায়। জরায়ু দ্বারা আবৃত সেই গর্ভ নয় বা দশ মাস, বা যতদিন আবশ্যক হয়, জঠরে বাস করিবার পর জন্মলাভ করে।
৪০০. স জাতো যাবদায়ুষং জীবতি তং প্রেতং দিষ্টমিতোহয় এব হরন্তি যত এবেতো যতঃ সম্মুতো ভবতি ॥ ২
অন্বয় : সঃ (সে) জাতঃ (জন্মগ্রহণ করিয়া) যাবৎ আয়ুষম্ (যতদিন আয়ু, ততদিন) জীবতি (জীবন ধারণ করে)। তপ্রেতম্ (মৃত হইলে তাহাকে) দি (যেমন নির্দিষ্ট তেমনি; নির্দিষ্ট গতি প্রাপ্ত) ইতঃ (এইস্থান হইতে) এব অগ্নয়ে এব (অগ্নিতে দগ্ধ করিবার জন্য) হরন্তি (লইয়া যায়) যতঃ (যাহা হইতে) এব ইতঃ (আগত) যতঃ সম্ভুতঃ {উৎপন্ন) ভবতি (হয়)।
সরলার্থ : (সন্তান) জন্মগ্রহণ করিয়া যতদিন তাহার আয়ু ততদিন জীবিত থাকে। যথা নির্দিষ্ট রূপে দেহত্যাগ করিবার পর তাহাকে (অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য) সেই অগ্নিতে লইয়া যাওয়া হয়। ঐ অগ্নি হইতেই সে আসিয়াছে, তাহা হইতেই সে উৎপন্ন হইয়াছে।
মন্তব্য : শ্রদ্ধা, সোম, বৃষ্টি প্রভৃতি পাঁচটিকে আহুতিরূপে অগ্নিতে হোম করা করা হয়। সর্বশেষে মানুষের উৎপত্তি। এইজন্যই বলা হইয়াছে যে, পুরুষ অগ্নি হইতে আসিয়াছে এবং অগ্নি হইতে উৎপন্ন হইয়াছে।
দশম খণ্ড – পঞ্চাগ্নিবিদ্যার উপসংহার (২) দেবযান, পিতৃযাণ ও পুনরাবর্তন
৪০১. তদ্ য ইত্থং বিদুর্যে চেমেহরণ্যে শ্রদ্ধা তপ ইত্যুপাসতে তেহর্চিষমভিসম্ভবন্ত্যৰ্চিযোহহরহ্ন আপূর্যমাণপক্ষমাপূর্যমাণপক্ষাদ্ যান্ ষড়দঙঙেতি মাসাংস্তান্ ॥ ১
৪০২. মাসেভ্যঃ সংবৎসরং সংবৎসরাদাদিত্যমাদিত্যাচ্চন্দ্রমসং চন্দ্ৰমস্যে বিদ্যুতৎ তৎ পুরুষোহমানবঃ স এনান্ ব্রহ্ম গময়ত্যেষ দেবযানঃ পন্থা ইতি ॥ ২
অন্বয় : তৎ (পঞ্চাগ্নিবিদ্যাকে) যে (যাহারা) ইথম্ (অব্যয়, ইদম্ + অম্, এই প্রকারে) বিদুঃ (জানেন), যে চ ইমে (এই যাঁহারা) অরণ্যে শ্রদ্ধা তপঃ ইতি উপাসতে, তে (তাহারা) অর্চিষম্ (অর্চিকে) অভিসম্ভবন্তি (প্রায় হয়)। অর্চিষঃ অহঃ; আপূর্যমাণ- পক্ষম্; অহ্নঃ আপূর্যমাণ-পক্ষাৎ যান্ ষট্ উদঙ্ এতি মাসান্ তান্ (৪।১৫।৫ দ্রঃ)। মাসেভ্যঃ সংবৎসরম্; সংবৎসরাৎ আদিত্যম্, আদিত্যাৎ চন্দ্রমসম্ চন্দ্রমসঃ বিদ্যুতম্। তৎপুরুষঃ অমানবঃ সঃ এনান্ ব্রহ্ম গময়তি। এষঃ দেবযানঃ পন্থাঃ ইতি।
সরলার্থ : (১ম ও ২য় মন্ত্র) যাঁহারা পঞ্চাগ্নিবিদ্যা জানেন এবং যাঁহারা অরণ্যে শ্রদ্ধা ও তপস্যার উপাসনা করেন তাঁহারা (মৃত্যুর পর) অর্চিতে গমন করেন। অর্চি হইতে দিনে, দিন হইতে শুক্লপক্ষে, শুক্লপক্ষ হইতে উত্তরায়ণে ছয় মাসে গমন করেন। মাসসমূহ হইতে সংবৎসরে, সংবৎসর হইতে আদিত্যে, আদিত্য হইতে চন্দ্রে, চন্দ্র হইতে বিদ্যুতে গমন করেন। সেই স্থানে এক অমানব পুরুষ তাহাদিগকে ব্ৰহ্মলাভ করায়। ইহাই দেবযান পথ।
মন্তব্য : ৫।১০।৯ শ্রদ্ধা তপঃ ইতি— কেহ কেহ অর্থ করেন, ‘শ্রদ্ধাই তপস্যা’ এই ভাবে। ডয়সন্ বলেন, ‘অর্চি’ অর্থ চিন্তাগ্নির শিখা ি
বৃহদারণ্যক উপনিষদেও (৬।২।১৫-১৬) এই তত্ত্ব (দেবযান ও পিতৃযাণ) বিবৃত হইয়াছে। উভয় উপনিষদে যেমন সাদৃশ্য রহিয়াছে তেমনি পার্থক্যও আছে। এই প্রসঙ্গে এখানে উভয়ের তুলনামূলক বিচার দেওয়া হইল। ছান্দোগ্যে আছে “যে চ ইমে অরণ্যে ‘শ্রদ্ধা তপঃ’ ইতি উপাসতে তে অর্চিষম্ অভিসম্ভবন্তি” অর্থাৎ যাহারা অরণ্যে শ্রদ্ধা ও তপস্যার উপাসনা করে তাহারা অর্চিতে গমন করে। বৃহদারণ্যকে আছে ‘যে চ অমী অরণ্যে শ্রদ্ধাম্ সত্যম্ উপাসতে তে অর্চিঃ অভিসম্ভবন্তি’ অর্থাৎ যাহারা অরণ্যে শ্রদ্ধা ও সত্যের উপাসনা করে তাহারা অর্টিতে গমন করে। ছান্দোগ্যের মতে তপস্যা দ্বারা দেবযান পথে গমন করা যায়, কিন্তু বৃহদারণ্যকে ইহা স্বীকার করা হয় নাই। ছান্দোগ্যের মতে মাসসমূহে গমন করিবার পর এই সমুদয়ে যথাক্রমে উপস্থিত হইতে হয়— সংবৎসর, আদিত্য, চন্দ্রমা, বিদ্যুৎ। বৃহদারণ্যকের মতে এই ক্রম—দেবলোক, আদিত্য, বিদ্যুৎ। বিদ্যুতে গমন করিবার পর সেই আত্মার ব্রহ্মপ্রাপ্তি হয়—ইহা উভয় উপনিষদেই বলা হইয়াছে। বৃহদারণ্যক উপনিষদে এই অংশ অতিরিক্ত আছে—’তেষু ব্রহ্মলোকেষু পরাঃ পরাবতঃ বসন্তি; তেষাম্ ন পুনরাবৃত্তিঃ’ (৬।২।১৫)। অর্থাৎ সেই সমুদয় ব্ৰহ্মলোকে তাহারা শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করিয়া চিরকাল বাস করে; তাহাদিগের আর পুনরাবৃত্তি অর্থাৎ পৃথিবীতে আসিয়া জন্মগ্রহণ করিতে হয় না। ছান্দোগ্য উপনিষদের মতে যাহারা ইষ্টাপূর্ত ও দানের উপাসনা করে তাহারা ধূমের পথে গমন করে। বৃহদারণ্যকের মতে যাহারা যজ্ঞ, দান ও তপস্যা দ্বারা স্বর্গলোক জয় করে, তাহারাই ধূমের পথে গমন করে। ছন্দোগ্যের মতে মাসসমূহ হইতে পিতৃলোকে; পিতৃলোক হইতে আকাশে, আকাশ হইতে চন্দ্রমাতে গমন করে। কিন্তু বৃহদারণ্যকে লিখিত আছে-মাসসমূহ হইতে পিতৃলোকে এবং পিতৃলোক হইতে চন্দ্রমাতে গমন করে; আকাশের কোন উল্লেখ নাই। বৃহদারণ্যক বলেন—যখন চন্দ্রলোক হইতে প্রত্যাগমন করে, তখন সকলেই মানবরূপে জন্মগ্রহণ করে। ছান্দোগ্য বলেন— কেহ কেহ পশুরূপেও জন্মগ্রহণ করিয়া থাকে; যাহারা পূর্বজন্মে সাধু ছিল তাহারা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যরূপে জন্মগ্রহণ করে, আর যাহারা অসাধু ছিল তাহারা কুকুর, শূকর বা চণ্ডাল রূপে জন্মগ্রহণ করে।
৪০৩. অথ য ইমে গ্রাম ইষ্টাপূর্তে দত্তমিত্যুপাসতে তে ধূমমভিসম্ভবন্তি ধূমাদ্রাত্রিং রাত্রেরপরপক্ষম্ অপরপক্ষাদ্ যা ষডুদক্ষিণৈতি মাসাংস্তান্নৈতে সম্বৎসরমভিপ্রাপ্পুবন্তি ॥ ৩
অন্বয় : অথ যে ইমে (এই যাহারা) গ্রামে ইষ্টাপূর্তে (ইষ্ট ও পূর্ত, দ্বিবচন; ইষ্ট যজ্ঞ; কূপ তড়াগ, উদ্যানাদি প্রস্তুত করিবার নাম পূর্ত) দত্তম্ (দান) ইতি উপাসতে (উপাসনা করে), তে (তাহারা) ধূমম্ অভিসম্ভবন্তি (৫।১০।১ মঃ দ্রঃ); ধূমাৎ (ধূম হইতে) রাত্রিম্; রাত্রেঃ (রাত্রি হইতে) অপরপক্ষম্ (কৃষ্ণপক্ষকে); অপরপক্ষাৎ (কৃষ্ণপক্ষ হইতে) যান্ ষট্ দক্ষিণা এতি মাসান্ (যে ছয় মাস সূর্য দক্ষিণদিকে গমন করে; দক্ষিণা—দক্ষিণ দেশে, এতি—গমন করে) তান্ (সেই ছয় মাসকে)। ন এতে (ইহারা) সংবৎসরম্ অভি-প্রাপ্লুবন্তি (প্রাপ্ত হয়)।
সরলার্থ : আর যাহারা গ্রামে ইষ্টাপূর্ত, দান ইত্যাদির অনুষ্ঠান করে, তাহারা মৃত্যুর পর ধূমে গমন করে। ধূম হইতে রাত্রিতে, রাত্রি হইতে কৃষ্ণপক্ষে, কৃষ্ণপক্ষ হইতে দক্ষিণায়নের ছয়মাসে গমন করে। ইহারা সংবৎসরে গমন করে না।
মন্তব্য : ‘ইষ্টাপূর্তে’ ইত্যাদি—আমরা ‘ইষ্টাপূর্ত’ শব্দের প্রচলিত অর্থ গ্রহণ করিয়াছি। শঙ্করের এই মত। মহাভারতের টীকায় নীলকণ্ঠও এই অর্থ দিয়াছেন (২।৬৮।৮; ৩।৩২।৩০)। কেহ কেহ বলেন ইষ্টাপূর্ত—ইষ্ট + আপূর্ত। পূর্ত ও আপূর্ত একই অর্থে ব্যবহৃত হইতে পারে সায়ণ বলেন, ইহার অর্থ— শ্রৌত— স্মার্ত দান-ফলেন অর্থাৎ শ্রৌত ও স্মার্ত দান ফলের সহিত। Whitney, Lanman, Mecdonell প্রভৃতি অনেক পণ্ডিত বলেন, ইহার অর্থ ‘What is sacrificed and what is bestowed’—যাহা আহুতি দেওয়া হয় এবং যাহা দান করা হয়। Haug বলেন, ইষ্ট—যজ্ঞ, আপূর্ত—(স্বর্গে) সঞ্চিত। ঐতরেয় ব্রহ্মণে (৭।৩৪।৩) ‘ইষ্টম্ পূর্তম’-এর প্রয়োগ আছে। ইহা একখানি প্রাচীন গ্রন্থ। এই গ্রন্থে যখন ‘পূর্তম’ শব্দের ব্যবহার রহিয়াছে এবং প্রচলিত মতও যখন ইহাই, তখন ‘পূর্তম’ ত্যাগ করিয়া ‘আপূর্তম’ গ্রহণ করিবার কোন কারণ নাই।
৪০৪. মাসেভ্যঃ পিতৃলোকং পিতৃলোকাদাকাশমাকাশাচ্চন্দ্রমসমেঘ সোমো রাজা তদ্দেবানামনুং তং দেবা ভক্ষয়ন্তি ॥ ৪
অন্বয় : মাসেভ্যঃ (মাসসমূহ হইতে) পিতৃলোকম্ পিতৃলোকাৎ (পিতৃলোক হইতে) আকাশম্; আকাশাৎ (আকাশ হইতে) চন্দ্রমসম্ (চন্দ্রকে)। এষঃ (এই) সোমঃ রাজা। তৎ (সেই সোম) দেবানাম্ (দেবগণের) অন্নম্। তম্ (তাহাকে) দেবাঃ ভক্ষয়ন্তি (ভক্ষণ করেন, ভোগ করেন)।
সরলার্থ : মাসসমূহ হইতে পিতৃলোকে, পিতৃলোক হইতে আকাশে, আকাশ হইতে চন্দ্রলোকে গমন করে। এই চন্দ্রই সোমরাজা; ইহা দেবতাদিগের অন্ন; ইহাকেই দেবগণ ভক্ষণ করেন।
মন্তব্য : মন্ত্রে বলা হইয়াছে— ‘সোম অর্থাৎ চন্দ্র দেবতাদিগের অন্ন এবং দেবগণ এই অন্ন ভক্ষণ করেন’। এই অংশের অর্থ লইয়া অনেক বিচার হইয়াছে। কেহ কেহ বলেন— ইষ্টাপূর্ত ও দানকর্মাদির অনুষ্ঠান করিলে যদি সোমরূপে জন্মগ্রহণ করিয়া দেবতাদিগের অন্ন হইতে হয়, তবে এসমুদয় কর্ম করিয়া লাভ কি? ব্যাখ্যাকারগণ ইহার এই প্রকার উত্তর দিয়াছেন— (ক) অন্ন এবং অন্নভক্ষণ রূপক অর্থে গ্রহণ করিতে হইবে, কারণ দেবগণ ভক্ষণ করেন না, কেবল দর্শন করিয়াই তৃপ্ত হন (ছাঃ ৩।৫-১০)। যখন কোন আত্মা চন্দ্রলোকে উপস্থিত হয়, তখন দেবগণ তাহাকে দেখিয়াই তৃপ্ত হন; ইহাই দেবগণের অন্নভক্ষণ। (খ) দেবগণ যেমন এই আত্মাকে ভোগ করেন, সেই আত্মাও তেমনি দেবগণকে লাভ করিয়া আনন্দিত হন অর্থাৎ দেবগণকে সম্ভোগ করেন। পৃথিবীকেও অনুরূপ দৃষ্টান্ত দেখিতে পাই। স্বামীই যে কেবল স্ত্রীর সঙ্গলাভ করিয়া আনন্দিত হয় তাহা নহে, স্ত্রীও স্বামীর সঙ্গ লাভ করিয়া আনন্দ লাভ করে। সোমকে যদি দেবগণের অন্ন বলা হয়, সেই সঙ্গে সঙ্গে ইহাও বলিতে হইবে যে, দেবগণও সোমের অন্ন। (গ) মানুষ যখন এই পৃথিবীতে বাস করে, তখন যজ্ঞাদি সম্পন্ন করিয়া দেবগণের সন্তোষ বিধান করে। মৃত্যুর পর সে যখন চন্দ্রলোকে উপস্থিত হয় তখন দেবগণ তো আনন্দিত হইবেনই। বৃহদারণ্যক উপনিষদেও বলা হইয়াছে দেবোপাসকগণ দেবগণের পশু (১।৪।১০)। ইহলোকে তাহারা যেমন দেবগণের সেবা করে, পরলোকে যাইয়াও তেমনি তাহাদিগের সেবা করিয়া থাকে। অনুগত সেবক নিকটে অবস্থান করিলে কে না আনন্দিত হয়? এই অর্থেই পরলোকগামী আত্মা দেবগণের ভোগ্যবস্তু অর্থাৎ অন্ন। (ঘ) কেহ কেহ বলেন, আত্মাকে ভক্ষণ করার অর্থ আত্মার কর্ম সম্ভোগ করা। অথর্ববেদের মতে দেবগণ ইষ্টাপূর্তের ১/১৬ অংশ ফল গ্রহণ করেন।
বেদান্তদর্শনের ভাষ্যে শঙ্করাচার্য ও রামানুজ এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করিয়াছেন। (৩।১।৭ ভাঃ দ্রঃ)। জ্ঞানবাদিগণ এই অংশ হইতে প্রমাণ করিতে চাহেন যে কর্মপথ সর্বথাই পরিত্যাজ্য। চন্দ্রলোকে যাইয়া দেবগণের অন্ন হওয়া কোন ক্রমেই বাঞ্ছনীয় হইতে পারে না।
৪০৫. তস্মিন্ যাবৎ সম্পাতমুষিত্বাথৈতমেবাধ্বানং পুনর্নিবর্তন্তে যথেতামা-কাশমাকাশাদ্বায়ুং বায়ুর্ভূত্বা ধূমো ভবতি ধূমো ভূত্বাভ্রং ভবতি ॥ ৫
৪০৬. অভ্রং ভূত্বা মেঘো ভবতি মেঘো ভূত্বা প্ৰবৰ্ষতি ত ইহ ব্রীহিয়বা ওষধি-বনস্পতয়স্তিলমাষা ইতি জায়ন্তেহতো বৈ খলু দুর্নিষ্প্রপতরং যো যো হান্নমত্তি যো রেতঃ সিঞ্চতি তত্ত্বয় এব ভবতি ॥ ৬
অন্বয় : তস্মিন্ (সেই চন্দ্রমাতে) যাবৎস্পাতম্ (কর্মক্ষয় পর্যন্ত) উষিত্বা (বাস করিয়া) অথ (অনন্তর) এতম্ এব অধ্বানম্ (এইপথে) পুনঃ নিবর্তন্তে (প্রত্যাগমন করে) যথা ইতম্ (যেভাবে গমন করিয়াছিল) আকাশম্। আকাশাৎ (আকাশ হইতে) বায়ুম্। বায়ুঃ ভূত্বা (হইয়া) ধূমঃ ভবতি (হয়)। ধূমঃ ভূত্বা (হইয়া) অভ্রং (মেঘের প্রথমাবস্থা— যে অবস্থায় ইহা জল ধারণ করে; ২।১৫। ১ মঃ দ্রঃ) ভবতি। অভ্রম্ ভূত্বা মেঘঃ ভবতি, মেঘঃ ভূত্বা প্রবর্ষতি (বর্ষণ করে)। তে (তাহারা) ইহ (এই পৃথিবীতে) ব্রীহিয়বাঃ (ব্রীহি ও যবসমূহ) ওষধি-বনস্পতয়ঃ (ওষধি ও বনস্পতিসমূহ) তিলমাষাঃ (তিল ও মাষাসমূহ) ইতি (এইরূপে) জায়ন্তে (জন্মগ্রহণ করে)। অতঃ (এই অবস্থা হইতে) বৈ খলু (নিশ্চয়ই) দুর্নিষ্প্রপতরম্ (দূরতিক্রমণীয়, সহজে অতিক্রম করা যায় না)। যঃ যঃ (যে যে প্রাণী) হি অন্নম্ (অন্নকে) অত্তি (ভোজন করে) যঃ রেতঃ সিঞ্চতি (সন্তান উৎপন্ন করে) তৎ ভূয়ঃ এব ভবতি (সেই প্রকারই হয়, কিংবা তাহা পুনর্বার জন্মগ্রহণ করে)।
সরলার্থ : (৫ম ও ৬ষ্ঠ মঃ) যে পর্যন্ত কর্মক্ষয় না হয়, সে পর্যন্ত চন্দ্ৰমণ্ডলে বাস করিয়া যে পথে গিয়াছিল সেই পথেই ফিরিয়া আসে। (চন্দ্রমণ্ডল হইতে) আকাশে এবং আকাশ হইতে বায়ুতে যায়। বায়ু হইয়া ধূম হয় এবং ধূম হইতে অভ্র হয়। অভ্র হইয়া মেঘ হয়; মেঘ হইয়া বর্ষণ করে। তারপর তাহারা এই পৃথিবীতে ব্রীহি ও যব, ওষধি ও বনস্পতি, তিল ও মাষ— এই সব হইয়া জন্মায়। এই অবস্থা হইতে নিঃসরণ অত্যন্ত কঠিন। যে যে প্রাণী অন্ন ভোজন করে ও সন্তান উৎপন্ন করে ইহাই সেই সব প্রাণিরূপে আবার জন্মগ্রহণ করে। (অর্থাৎ ব্রীহি যবাদিরূপে অবস্থিত আত্মা অন্নরূপে সেই সেই প্রাণীর দেহে প্রবেশ করিয়া রেতোরূপ ধারণ করে)।
মন্তব্য : ৫।১০।৫, ‘যাবৎ সম্পাতম্’ কে ক্রিয়াবিশেষণরূপে গ্রহণ করা হইয়াছে। সম্পাত সম্ + পৎ + ঘ; ‘পৎ’ ধাতুর অর্থ গমন করা, উড়িয়া যাওয়া, পতিত হওয়া ইত্যাদি। শঙ্করাচার্যের মতে সম্পাতঃ— কর্মের ক্ষয়; কর্মক্ষয়ে মানুষের স্বর্গাদি লোক হইতে পতন হয়, এই জন্য কর্মক্ষয়ের নাম ‘সম্পাত’। রামানুজের মতে সম্পাত কর্ম; কর্মদ্বারা স্বর্গাদি লোকে যাওয়া যায়, এইজন্য কর্মের নাম ‘সম্পাত’। ‘যথেতম্’ ইত্যাদির অর্থ— যে ভাবে গমন করে, সেই ভাবেই প্রত্যাবর্তন করে। কিন্তু উভয় পথ যে ঠিক একই, তাহা নহে। চন্দ্রলোকে গমন করিবার ক্রম এই—ধূম, রাত্রি, কৃষ্ণপক্ষ, দক্ষিণায়নের ছয়মাস, পিতৃলোক, আকাশ এবং চন্দ্রলোক। প্রত্যাগমন করিবার পথ চন্দ্রলোক, আকাশ, বায়ু, ধূম, অভ্র, মেঘ, ব্রীহিয়বাদি। (গীতা, ৮।১৫-২৬)।
‘বায়ুঃ ভূত্বা’ ইত্যাদি (৫।১০।৫) মন্ত্রের ‘বায়ুঃ ভূত্বা’ হইতে আরম্ভ করিয়া (৫।১০।৭) মন্ত্রের শেষ পর্যন্ত অংশ বৃহদারণ্যকে নাই। ইহার পরিবর্তে (৬।২।১৬) মন্ত্রে যাহা আছে তাহার অর্থ হইল—বায়ু হইতে বৃষ্টিতে এবং বৃষ্টি হইতে পৃথিবীতে গমন করে। পৃথিবীতে গমন করিলে পুরুষরূপ অগ্নিতে আহুত হয় এবং তৎপরে যোষারূপ অগ্নিতে জন্মগ্রহণ করে। এইরূপে তাহারা লোকসমূহের অভিমুখে উত্থান করে এবং বিবর্তমান হয়। আর যাহারা এই দুই পথের বিষয় জানে না (কিংবা এই দুইটি পথের কোন পথেই গমন করে না) তাহারা কীট-পতঙ্গ এবং দন্দশূকরূপে জন্মগ্রহণ করে।
‘তে ইহ’ ইত্যাদি — ‘তে’ শব্দ বহুবচন। পূর্বে যাহাদের বিষয়ে এক এক করিয়া বলা হইয়াছিল, এ স্থলে তাহাদিগের বিষয়েই সমগ্রভাবে বলা হইল; এইজন্য এস্থলে বহুবচন প্রয়োগ।
৪০৭. তদ্ য ইহ রমণীয়চরণা অভ্যাশো হ যত্তে রমণীয়াং যোনিমাপদ্যের ব্রাহ্মণযোনিং বা ক্ষত্রিয়যোনিং বা বৈশ্যযোনিং বাথ য ইহ কপূয়চরণা অভ্যাশো হ যত্তে কপূয়াং যোনিমাপদ্যেরন্ শ্বযোনিং বা সূকরযোনিং বা চণ্ডালযোনিং বা ॥ ৭
অন্বয় : তৎ (তাহার পর, বা তাহাদিগের মধ্যে) যে (যাহারা) ইহ (এই পৃথিবীতে রমণীয়চরণাঃ (শোভনকর্মা) অভ্যাশঃ (শীঘ্র, কিংবা ‘ফল’ ১।৩।১২) হ যৎ (যে) তে (তাহারা) রমণীয়াম্ যোনিম্ (রমণীয় জন্মকে) আপদ্যেরন্ (প্রাপ্ত হয়)। ব্রাহ্মণযোনিম্ বা ক্ষত্রিয়যোনিম্ বা বৈশ্যযোনিম্ বা। অথ (আর) যে ইহ কপূয়চরণাঃ (কুকর্মা; কপূয় অর্থাৎ দুর্গন্ধযুক্ত আচরণ যাহাদিগের), অভ্যাশঃ হ যৎ তে কপূয়াম্ যোনিম্ (কুৎসিৎ জন্মকে) আপদ্যেরন্—শ্বযোনিম্ বা (কুকুর জন্মকে) সূকরযোনিম্ বা (বা শূকরজন্মকে চণ্ডালযোনিম্ বা (বা চণ্ডালজন্মকে)।
সরলার্থ : তাহাদের মধ্যে যাহারা (পূর্বজন্মে) এই পৃথিবীতে শোভন কর্ম করিয়াছিল, তাহারা শীঘ্রই ব্রাহ্মণযোনি, ক্ষত্রিয়যোনি বা বৈশ্যযোনিতে জন্মলাভ করে। আর যাহারা এই পৃথিবীতে কুৎসিত কর্ম করিয়াছিল, তাহাদের শীঘ্র জন্ম হয় কুকুরযোনি, শূকরযোনি বা চণ্ডালযোনিতে।
মন্তব্য : পাঠান্তর — দুইটি ‘অভ্যাশঃ’ স্থলেই ‘অভ্যাস’। ‘সূকর’ স্থলে ‘শূকর’। ‘চণ্ডাল’ স্থলে চাণ্ডাল’। ‘সূ কর’—’সূ’ ‘সূ’ শব্দ করে বলিয়া এই জন্তুকে সূকর বলে। (Monier Williams)
৪০৮. অথৈতয়োঃ পথোর্ন কতরেণ চ ন তানীমানি ক্ষুদ্রাণ্যসকৃদাবর্তীনি ভূতানি ভবন্তি জায়স্ব ম্রিয়ম্বেত্যেতস্তৃতীয়ং স্থানং তেনাসৌ লোকো ন সম্পূর্যতে তমাজ্জুগুপ্সেত। তদেষ শ্লোকঃ ॥ ৮
অন্বয় : অথ এতয়োঃ পথোঃ (এই দুই পথের; ১। অর্চির পথ অর্থাৎ দেবযান; ২। ধূমের পথ অর্থাৎ পিতৃযাণ) ন (না) কতরেণ চ ন (কোন পথ দ্বারাই) তানি ইমানি (সেই এই সমুদয়) ক্ষুদ্রাণি [ভূতানি] (ক্ষুদ্র জন্তুসমূহ) অসকৃৎ আবর্তিনী (পুনঃ পুনঃ আবর্তনশীল; সকৃৎ — একবার; অসকৃৎ—বহুবার; আবর্তিনী—যাহারা বারবার যাতায়াত করে) ভূতানি (ভূতসমূহ) ভবন্তি (হয়)। জায়স্ব (জন্মগ্রহণ কর) ম্রিয়স্ব (মরিয়া যাও) ইতি এতৎ (এই) তৃতীয়ম্ স্থানম্। তেন (সেইজন্য) অসৌ (ঐ) লোকঃ ন সম্পূর্যতে (পূর্ণ হয়)। তস্মাৎ (সেইজন্য) জুগুপ্সেত (সংসারগতিকে ঘৃণা করিবে)। তৎ (এ বিষয়ে) এষঃ (এই) শ্লোকঃ।
সরলার্থ : যাহারা এই দুইটির কোনটি দ্বারাই যায় না, তাহারা নিত্য আবর্তনশীল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণিরূপে জন্মায়। (ইহাদের বিষয়ে বলা যায়)— জন্মাও আর মর। অর্থাৎ ইহারা এতই ক্ষণস্থায়ী যে জন্মগ্রহণ করা মাত্রই মরিয়া যাইতেছে। সুতরাং জন্মমৃত্যু ছাড়া ইহাদের জীবনের অন্য কোন ঘটনা নাই—ইহাই তৃতীয় স্থান। এই জন্যই ঐ লোক (অর্থাৎ চন্দ্ৰলোক) পূর্ণ হইতেছে না। সুতরাং সংসার-গতিকে ঘৃণা করিবে। এবিষয়ে এই শ্লোক আছে—।
মন্তব্য : (ক) এই অষ্টম মন্ত্রের স্থলে বৃহদারণ্যক (৬।২।১৬) এইরূপ আছে— ‘অথ যে এতৌ পন্থানৌ ন বিদুঃ, তে কীটাঃ পতঙ্গাঃ যৎ ইদম্ দন্দশুকম্’ অর্থাৎ আর যাহারা এই দুইটি পথের বিষয় জানে না (কিংবা এই দুইটি পথের কোন পথেই গমন করে না) তাহারা কীট-পতঙ্গ এবং দন্দশূকরূপে জন্মগ্রহণ করে। ‘ন কতরেণ চন’ অংশের দুই প্রকার পাদপাঠ হইতে পারে। (১) ন, কতরেণ, চন; অনিশ্চয়ার্থে ‘চন’ প্রত্যয়। (২) ন, কতরেণ, চ, ন—না, কোন পথ দ্বারাই নয়। ‘ন’ পদের দ্বিরুক্তি। শঙ্কর অষ্টম মন্ত্রের প্রথমাংশের এইরূপ অন্বয় ও অর্থ করিয়াছেন— (১) অথ এতয়োঃ পথোঃ ন কতরেণ চ ন— (যাহারা বিদ্যা বা ইষ্টাপূর্তাদি কর্মের সেবা করে না, তাহারা দুই পথের কোন পথেই (গমন করে) না। (২) তানি ইমানি ক্ষুদ্রাণি অসকৃৎ আবর্তিনী ভূতানি ভবন্তি—(তাহারা) এই সমুদয় পুনঃ পুনঃ জন্মমরণশীল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীরূপে জন্মগ্রহণ করে। মোক্ষমূলার ও গঙ্গানাথ ঝা এই প্রকার অনুবাদ করিয়াছেন—’পুনঃ— পুনঃ জন্মমরণশীল এই সমুদয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণী এতদুভয়ের কোন পথ দ্বারাই গমন করে না।’ এ অর্থে সঙ্গত বলিয়া মনে হয় না। এই দুইটি পথ কেবল মানবাত্মার জন্যই; অন্য কোন প্রাণীই এই দুইটি পথে গমনাগমন করে না। সুতরাং পুনঃপুনঃ জন্ম- মরণশীল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণী এই দুই পথে গমনাগমন করে না—এরূপ বলিবার সার্থকতা কোথায়? আর মানবাত্মার পরলোকতত্ত্বই এস্থলের বক্তব্য বিষয়; অন্য প্রাণীর পরলোকতত্ত্ব আলোচনা করা ঋষির উদ্দেশ্য নহে। উক্ত অংশ হইতে বুঝা যাইতেছে যে,—(১) যাহারা পঞ্চাগ্নিবিদ্যার বিষয় অবগত আছে কিংবা যাহারা অরণ্যে শ্রদ্ধা ও তপস্যার সেবা করে, তাহারা দেবযান পথে গমন করিয়া ব্রহ্মলাভ করে। (২) যাহারা সংসারে থাকিয়া যাগাদি কর্মের অনুষ্ঠান করে, তাহারা ধূমের পথে গমন করে, তাহার পর নানাভাবে ভ্রমণ করিয়া পুনর্বার পৃথিবীতেই ফিরিয়া আসে। (৩) আর এক শ্রেণীর মানুষ আছে, যাহারা এতদুভয়ের কোন পথেই যাতায়াত করে না। ইহারা ক্ষণস্থায়ী কীটপতঙ্গাদিরূপে জন্মগ্রহণ করে। ইহাদিগের জন্য তৃতীয় স্থান। কাহারা এই সমুদয় ক্ষুদ্র প্রাণিরূপে জন্মগ্রহণ করে, তাহা এই মন্ত্রে বলা হয় নাই।
(খ) ‘তস্মাৎ জুগুপ্সতে’ হইতে এই খণ্ডের শেষ পর্যন্ত অংশ কেবল ছান্দোগ্য উপনিষদেই আছে। প্রবাহণ জৈবলি শ্বেতকেতুকে পাঁচটি প্রশ্ন (৫।৩।২ ও ৩ মন্ত্রে করিয়াছিলেন। উক্ত প্রশ্নগুলি ও তাহাদের উত্তর নিম্নে বর্ণিত হইল : (১) মৃত্যুর পর প্রাণিগণ কোথায় যায়? ইহার উত্তর এই খণ্ডের ১ম-৪র্থ মন্ত্রে দ্রষ্টব্য। (২) কি প্রকারে প্রাণিগণ পুনরাবর্তন করে? উত্তর— যাহারা ধূমাদির পথে গমন করে, তাহাদিগকে চন্দ্রলোক হইতে প্রত্যাবর্তন করিতে হয়। কি প্রণালীতে তাহারা প্রত্যাবর্তন করে, তাহা ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম মন্ত্রে বর্ণিত হইয়াছে। (৩) পিতৃযাণ ও দেবযান কোথায় পৃথক হইয়াছে? উত্তর মৃত্যুর পর সকলকেই অগ্নিতে নিক্ষেপ করা হয়। ইহার পর কেহ অর্চির পথে যায়, কেহ ধূমের পথে যায়। অর্চির পথই দেবযান এবং ধূমের পথই পিতৃযাণ। দেবযানের উত্তরায়ণের ছয় মাসের পর সংবৎসর, তাহার পর আদিত্য, তাহার পর চন্দ্রলোক প্রাপ্তি। পিতৃযাণে দক্ষিণায়ণের ছয়মাস পরই চন্দ্রলোক প্রাপ্তি। জ্ঞানিগণ অর্থাৎ দেবযানযাত্রিগণ চন্দ্ৰলোক হইতে ব্রহ্মে গমন করেন; কর্মিগণ আবার পৃথিবীতে আগমন করে (১ম-৭ম মন্ত্র দ্রঃ)। (৪) চন্দ্রলোক কেন পূর্ণ হয় না? উত্তর — চন্দ্রলোক হইতে কেহ ব্রহ্মে গমন করে, কেহ পৃথিবীতে পুনরাগমন করে। এই জন্য চন্দ্রলোক পূৰ্ণ হয় না (৮ম মন্ত্র দ্রঃ)। (৫) পঞ্চমী আহুতিতে জলকে কেন মানুষ বলা হয়? উত্তর ৫।৮।২ মন্ত্রের মন্তব্য দ্রষ্টব্য।
৪০৯. স্তেনো হিরণ্যস্য সুরাং পিবংশ্চ গুরোস্তন্নমাবসন্ ব্রহ্মহা বৈতে পতন্তি চত্বারঃ পঞ্চমশ্চাচরংস্তৈরিতি ॥ ৯
অন্বয় : স্তেনঃ (চোর) হিরণ্যস্য (সুবর্ণের) সুরাম্ পিবন্ চ (সুরা পান করে এমন লোক) গুরোঃ (গুরুর) তল্পন্ (শয্যায়) আবসন্ (যে গমন করে বা দূষিত করে ব্রহ্মহা চ (ব্রহ্মঘাতক)—এতে [চত্বারঃ] (এই চারিজন) পতন্তি (পতিত হয়) চত্বারঃ। পঞ্চমঃ চ (পঞ্চম ব্যক্তিও) আচরন্ তৈঃ (তাহাদিগের সহিত যে আচরণ করে) ইতি।
সরলার্থ : সুবর্ণচোর, সুরাপায়ী, গুরুপত্নীগামী এবং ব্রহ্মঘাতক—এই চারিজন পতিত হয় এবং ইহাদিগের সহিত যে সংসর্গ করে, সেই পঞ্চম ব্যক্তিও পতিত হয়।
৪১০. অথ হ য এতানেবং পঞ্চাগ্নীন্ বেদ ন সহ তৈরপ্যাঁচর পাপ্পনা লিপ্যতে শুদ্ধঃ পূতঃ পুণ্যলোকো ভবতি য এবং বেদ য এবং বেদ ॥ ১০
অন্বয় : অথ হ যঃ (যিনি) এতান্ (এই) এবম্ (এই প্রকারে) পঞ্চাগ্নীন্ (পঞ্চাগ্নিকে ন (না), সহ তৈঃ অপি (তাহাদিগের সহিতও) আচরন্ (আচরণ করিয়া) পাদ্মনা (পাপ দ্বারা) লিপ্যতে (লিপ্ত হয়); শুদ্ধঃ পূতঃ (পবিত্র) পুণ্যলোকঃ (পুণ্যলোকবাসী) ভবতি (হন) যঃ এবম্ (এই প্রকার) বেদ (জানেন) যঃ এবম্ বেদ (পুনরুক্তি সমাপ্তিসূচক)।
সরলার্থ : কিন্তু যিনি এই পঞ্চাগ্নিবিদ্যা জানেন, তিনি ইহাদিগের সংসর্গ করিয়াও পাপ দ্বারা লিপ্ত হন না। যিনি ইহা জানেন তিনি শুদ্ধ ও পূত; তিনি পুণ্যলোকে যান।
একাদশ খণ্ড – অশ্বপতি ও ষডুবাহ্মণ-সংবাদ — বৈশ্বানর (১)
৪১১. প্রাচীনশাল ঔপমন্যবঃ সত্যযজ্ঞঃ পৌলুষিরিন্দ্রদ্যুম্নো ভাল্লবেয়া জনঃ শার্করাক্ষ্যো বুড়িল আশ্বতরাশ্বিস্তে হৈতে মহাশালা মহা- শ্রোত্রিয়াঃ সমেত্য মীমাংসাঞ্চঙ্কুঃ কোন আত্মা কিং ব্রহ্মেতি ॥১
অন্বয় : প্রাচীনশালঃ ঔপমন্যবঃ (উপমন্যুর পুত্র প্রাচীনশাল) সত্যযজ্ঞঃ পৌলুষিঃ (পুলুষের পুত্র বা বংশোদ্ভব), ইন্দ্রদ্যুম্নঃ ভাল্লবেয়ঃ (ভাল্লুবিপুত্র; ভাল্লবি—ভল্লবির পুত্র), জনঃ শার্করাক্ষ্যঃ (শর্করাক্ষের পুত্র), বুড়িলঃ আশ্বতরাশ্বিঃ (অশ্বতরাশ্বপুত্র)—তে হ এতে (এই তাহারা) মহাশালাঃ (মহাগৃহস্থগণ; মহাশালা যাহাদিগের; শালা—গৃহ), মহাশ্রোত্রিয়াঃ (যাহারা ছন্দঃ অর্থাৎ বেদ অধ্যায়ন করে তাহারা, কিংবা শ্রোত্র— বেদজ্ঞান; শ্রোত্রিয়—বেদজ্ঞানসম্পন্ন) সমেত্য (একত্র হইয়া) মীমাংসাম্ চকুঃ (মীমাংসা করিয়াছিল) কঃ (কে), নঃ (আমাদিগের) আত্মা; কিম্ (কি) ব্রহ্ম ইতি।
সরলার্থ : উপমন্যুর পুত্র প্রাচীনশাল, পুলুষপুত্র সত্যযজ্ঞ, ভাল্লুবিপুত্ৰ ইন্দ্ৰদ্যুম্ন, শর্করাক্ষপুত্র জন এবং অশ্বতরাশ্ব পুত্র বুড়িল— এই কয় মহাগৃহস্থ এবং বেদজ্ঞানী মিলিত হইয়া এই বিচার করিয়াছিলেন—’কে আমাদিগের আত্মা? ব্ৰহ্ম কি?”
মন্তব্য : (ক) জৈমিনীয় উপনিষদ্ ব্রাহ্মণে প্রাচীনশালী নামক একজন উদ্গাতার উল্লেখ আছে (৩।৭।২; ৩।১০।২) এবং প্রাচীনশালদিগেরও নাম পাওয়া যায় (৩।১০।১)। (খ) এই উপনিষদের ৫।১০।১ অংশে সত্যযজ্ঞ পৌলুষিকে প্রাচীন-যোগ্য (অর্থাৎ প্রাচীনযোগের বংশোদ্ভব) বলা হইয়াছে। ব্রাহ্মণ (১০।৬।১।১) এবং জৈমিনীয় উপনিষদ ব্রাহ্মণে ইঁহার নাম পাওয়া যায়। সত্যযজ্ঞ, পুলুষ প্রাচীনযোগ্যের শিষ্য ছিলেন (জৈঃ উঃ ব্রাঃ ৩।৪০।২)। (গ) ইন্দ্রদ্যুম্ন ভাল্লবেয়কে বৈয়াঘ্রপদ্য (অর্থাৎ ব্যাঘ্রপদের অপত্য) বলা হইয়াছে (৫।১৪।১)। শতপথ ব্রাহ্মণেও ইহার নাম পাওয়া যায় (১০।৬।১।৮)। (ঘ) বুড়িল আশ্বতরাশ্বিকেও বৈয়াঘ্রপদ্য বলা হইয়াছে (৪।১৫।১)। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে (৬।৩০) এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদ (৫।১৪।৮) এবং শতপথ ব্রাহ্মণে (১০।৬।১।১) ইঁহার নাম পাওয়া যায়। (ঙ) জন শার্করাক্ষ্যের নাম শতপথ ব্রাহ্মণে পাওয়া যায় (১০।৬।১।১)।
৪১২. তে হ সম্পাদয়াঞ্চকুরুদ্দালকো বৈ ভগবন্তোহয়মারুণিঃ সম্প্রতীমমাত্মানং বৈশ্বানরমধ্যেতি তং হন্তাভ্যাগচ্ছামেতি তং হাভ্যাজঃ ॥ ২
অন্বয় : তে (তাহারা) হ সম্পাদয়াম্ চক্ষুঃ (নিরূপণ করিলেন)– উদ্দালকঃ বৈ, ভগবন্তঃ (হে ভগবদ্গণ) অয়ম্ আরুণিঃ (এই আরুণি) সম্প্রতি (বর্তমান সময়ে) ইমম্ আত্মানম্ বৈশ্বানরম্ (এই বৈশ্বানর আত্মাকে) অধ্যেতি (জানেন) তম্ (তাঁহার নিকট) হন্ত (ব্যাকুলতা বা আনন্দসূচক অব্যয়) অভি + আগচ্ছাম (আমরা যাই) ইতি। তম্ হ অভি + আজঃ (গমন করিয়াছিল)।
সরলার্থ : তাঁহারা (এ বিষয়ে যাহা) স্থির করিলেন (তাঁহাদিগের মধ্যে একজন অপর সরলকে তাহা বলিলেন) ‘ভগবানগণ, উদ্দালক আরুণি এই বৈশ্বানর আত্মার বিষয় জানেন। চলুন তাঁহার নিকট যাই।’ তারপর তাঁহারা তাঁহার নিকট গেলেন।
মন্তব্য : বৈশ্বানর— বিশ্ব এবং নর এই দুইটি শব্দ হইতে বৈশ্বানরের উৎপত্তি। বিশ্বসমুদয়; নর—মানব। নর শব্দ ‘নৃ’ ধাতু হইতেও হইতে পারে; তাহা হইলে নর— নেতা। ‘বৈশ্বানর’ শব্দের এই সকল অর্থ হইতে পারে— (ক) যিনি সমুদয় নরের মধ্যে বর্তমান। (খ) যিনি সকলের নেতা। (গ) যিনি সমস্ত নরের হিতকর। (ঘ) সমুদয় নর যাঁহাকে স্থাপন করে অর্থাৎ অগ্নি। (ঙ) সমুদয় মানব যাঁহার।
৪১৩. স হ সম্পাদয়াঞ্চকার প্রক্ষ্যন্তি মামিমে মহাশালা মহাশ্রোত্রিয়াস্তেভ্যো ন সর্বমিব প্রতিপৎস্যে হন্তাহমন্যমভ্যনুশাসানীতি ॥ ৩
৪১৪. তান্ হোবাচাশ্বপতির্বৈ ভগবন্তোহয়ং কৈকেয়ঃ সম্প্রতীমমাত্মানং বৈশ্বানর-মধ্যেতি তং হন্তাভ্যাগচ্ছামেতি তং হাভ্যাজঃ ॥ ৪
অন্বয় : সঃ (উদ্দালক) হ সম্পাদয়াম্ চকার (স্থির করিলেন) প্রক্ষ্যন্তি (প্রশ্ন করিবেন) মা (আমাকে) ইমে (এই সমুদয়) মহাশালাঃ মহাশ্রোত্রিয়াঃ (১ মঃ দ্রঃ) তেভ্যঃ (তাহাদিগকে) ন (না) সর্বম্ (সমুদয় বিষয়কে) ইব (হয়ত) প্রতিপৎস্যে (বলিতে সমর্থ হইব)। হন্ত, অহম্ (আমি) অন্যম্ (অন্য উপদেষ্টার নাম) অভি অনুশাসানি (বলিয়া দি) ইতি। তান (তাহাদিগকে হ উবাচ (বলিলেন)— অশ্বপতিঃ বৈ ভগবন্তঃ! অয়ম্ (এই) কৈকেয়ঃ সম্প্রতি (এখন) ইমম্ আত্মানম্ বৈশ্বানরম্ অধ্যেতি। তম্ হন্ত অভ্যাগচ্ছাম ইতি। তং হ অভ্যাজঃ (২ মঃ দ্রঃ)।
সরলার্থ : উদ্দালক (মনে মনে) এই স্থির করিলেন— এই সকল মহাগৃহস্থ মহাশ্রোত্রিয় আমাকে প্রশ্ন করিবেন। সম্ভবত আমি সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিব না। ইহাদিগকে অন্য উপদেষ্টার কথা বলিয়া দি। এই প্রকার স্থির করিয়া তখন তিনি তাহাদিগকে বলিলেন—’হে ভগবানৃগণ, সম্প্রতি কৈকয়পুত্র অশ্বপতি এই বৈশ্বানর আত্মার বিষয় জানেন। চলুন আমরা তাঁহার নিকট যাই।’ তখন তাঁহারা তাঁহার নিকট গেলেন।
মন্তব্য : ৫।১১।৪. কৈকয়ঃ—’কেকয়’ শব্দ একটি ক্ষত্রিয় জাতির নাম এবং ইহারা যে দেশে বাস করে তাহার নামও কেকয়। ইহাদিগের রাজ্যও কেকয় নামে পরিচিত। ‘কৈকেয়’ অর্থ, কেকয়ের অপত্য কিংবা কেকয় জাতির রাজা। শতপথ ব্রাহ্মণেও অশ্বপতি কৈকেয়ের উল্লেখ আছে (১০।৬।১।২)।
৪১৫. তেভ্যো হ প্রাপ্তেভ্যঃ পৃথগর্রাণি কারয়াঞ্চকার স হ প্রাতঃ সঞ্জিহান উবাচ ন মে স্তেনো জনপদে ন কদর্যো ন মদ্যপো নানাহিতাগ্নির্নাবিদ্বান্ন স্বৈরী স্বৈরিণী কুতঃ। যক্ষ্যমাণো বৈ ভগবন্তোহহমস্মি যাবদেকৈকমা ঋত্বিজে ধনং দাস্যামি তাবদ্ভগবভ্যো দাস্যামি বসন্তু ভগবন্ত ইতি ॥ ৫
অন্বয় : তেভ্যঃ হ প্রাপ্তেভ্যঃ (অভ্যাগত সেই সমুদয় লোকদিগকে; ৫।৩।৬ মঃ দ্রঃ) পৃথক্ (প্রত্যেককে পৃথক পৃথক) অর্থাণি (পূজা) কারয়াঞ্চকার (করাইলেন)। সঃ (অশ্বপতি) হ প্রাতঃ (প্রাতঃকালে) সম্জিহানঃ (বৈদিক প্রয়োগ ৪।১।৫ দ্রঃ; শয্যা বা নিদ্রা ত্যাগ করিয়া) উবাচ (বলিলেন)—ন (না) মে (আমার স্তেনঃ (চোর) জনপদে (রাজ্যে) ন কদর্যঃ (কুৎসিৎ ব্যক্তি) ন মদ্যপঃ (মদ্যপায়ী) ন অনাহিতাগ্নি (অগ্নিহোত্রী নয় এমন ব্রাহ্মণ; আহিতস্থাপিত) ন অবিদ্বান্ ন স্বৈরী (স্বেচ্ছাচারী, চরিত্রহীন); স্বৈরিণী (স্বেচ্ছাচারিণী) কুতঃ (কোথা হইতে)? যক্ষ্যমাণঃ (যজ্ঞে প্রবৃত্ত হইবে এমন লোক) বে ভগবন্তঃ (হে ভগবদ্গণ) অহম্ (আমি) অস্মি (হই) যাবৎ (যে পরিমাণ) এক + একস্মৈ ঋত্বিজে (এক একজন ঋত্বিককে) ধনম্ দাস্যামি (দিব) তাবৎ (সেই পরিমাণ) ভগবদ্ভ্যঃ (আপনাদিগকে) দাস্যামি (দিব)। বসন্তু (বাস করুন) মে আমার ‘গৃহে’, ভগবন্তঃ ইতি।
সরলার্থ : অশ্বপতি সেই অভ্যাগতদের প্রত্যেককে পৃথক পৃথক পূজা করাইলেন। (পরদিন) প্রাতে উঠিয়া তিনি তাঁহাদিগকে বলিলেন—’আমার রাজ্যে কোন চোর নাই অবিদ্বান নাই, কদর্য (কৃপণ) ব্যক্তি নাই, আহিতাগ্নি নয় এমন ব্রাহ্মণ নাই, কোন ব্যভিচারীও নাই—ব্যভিচারিণী কোথা হইতে আসিবে? ভগবাগণ, আমি যজ্ঞ করিতেছি; এক একজন ঋত্বিক্কে আমি যত ধন দিব, আপনাদেরও সেই পরিমাণই দিব। আপনারা এখানে বাস করুন। ‘
৪১৬. তে হোচুর্যেন হৈবার্থেন পুরুষশ্চরেত্তং হৈব বদেদাত্মানমেবেমং বৈশ্বানরং সম্প্রত্যধ্যেষি তমেব নো ৱুহীতি ॥ ৬
অন্বয় : তে (তাঁহারা) হ উচুঃ (বলিলেন) যেন হ এব অর্থেন (যে প্রয়োজনে; অর্থ -প্রয়োজন) পুরুষঃ চরেৎ (আগমন করেন) তম্ (সেই প্রয়োজনকে) হ এর বদেৎ (বলিয়া থাকে, বলা উচিত)। আত্মানম্ এব + ইমম্ বৈশ্বানরম্ (এই বৈশ্বানর আত্মাকে) সম্প্রতি (এখন) অধ্যেষি (জানেন)। তম্ এব (তাহাকেই) নঃ (আমাদিগকে) রুহি (বলুন) ইতি।
সরলার্থ : তাঁহারা তাঁহাকে বলিলেন— মানুষ যে উদ্দেশ্যে আগমন করে তাহাই প্রথমে বলিয়া থাকে। আপনি বৈশ্বানর আত্মার বিষয় জানেন, এখন তাহাই আমাদিগকে বলুন।
৪১৭. তান্ হোবাচ প্রাতর্বঃ প্রতিবক্তাস্মীতি তে হ সমিপাণয়ঃ পূর্বাহ্নে প্ৰতিচক্রমিরে তান্ হানুপনীয়ৈবৈতদুবাচ ॥ ৭
অন্বয় : তান্ (তাঁহাদিগকে) হ উবাচ (বলিলেন)—প্রাতঃ বঃ (আপনাকে) প্রতিবক্তা অস্মি (প্রত্যুত্তর দিব) তে (তাঁহারা) হ সমিৎপাণয়ঃ (সমিধ হস্তে লইয়া, ইহা শিষ্যত্বের লক্ষণ) পূর্বাহ্নে প্রতিচক্রমিরে (পুনর্বার আগমন করিলেন)। তান্ হ অনুপনীয় এব ন + উপনীয়—উপনীত না করিয়াই; উপনয়ন সংস্কার না করিয়াই) এতৎ (ইহা) উবাচ—।
সরলার্থ : তিনি তাহাদিগকে বলিলেন—’প্রাতে আপনাদিগকে উত্তর দিব।’ তাহারা সমিধ হাতে পরদিন পূর্বাহ্নে আবার তাঁহার নিকট গেলেন। তিনি তাঁহাদের ‘উপনীত’ না করিয়াই বলিলেন
দ্বাদশ খণ্ড – অশ্বপতি ও ষডুব্রাহ্মণ-সংবাদ—বৈশ্বানর (২)
৪১৮. ঔপমন্যব কং ত্বমাত্মানমুপাস ইতি দিবমেব ভগবো রাজনিতি হোবাচৈষ বৈ সুতেজা আত্মা বৈশ্বানরো যং ত্বমাত্মানমুপাসে তস্মাত্তব সুতং প্রসুতমাসুতং কুলে দৃশ্যতে ॥১
৪১৯. অৎস্যন্নং পশ্যসি প্রিয়মত্ত্যনুং পশ্যতি প্রিয়ং ভবত্যস্য ব্রহ্মবর্চসং কুলে য এতমেবামাত্মানং বৈশ্বানরমুপাস্তে মূর্ধা ত্বেষ আত্মন ইতি হোবাচ মূর্ধা তে ব্যপতিষ্যদ্ যন্মাং নাগমিষ্য ইতি ॥ ২
অন্বয় : ঔপমন্যব (হে উপমন্যুর পুত্র) কম্ (কাহাকেও) ত্বম্ (তুমি) আত্মানম্ (আত্মারূপে) উপাসে (উপাসনা কর)? ইতি। দিবম্ এব (দ্যুলোককেই) (প্রাচীন প্রয়োগ)) রাজন্! ইতি হ উবাচ। এষঃ (এই) দ্যৌ বৈ (নিশ্চয়ই) সুতেজাঃ (শোভন তেজোযুক্ত) আত্মা বৈশ্বানরঃ যম্ (যাহাকে) ত্বম্ আত্মানম্ উপাসে। তস্মাৎ (সেইজন্য) তব (তোমার) সুতম্, প্রসুতম্ আসুতম্ কুলে দৃশ্যতে (দৃষ্ট হয়)। অৎসি (ভোজন করিতেছ) অন্নম্, পশ্যসি (দর্শন করিতেছ) প্রিয়ম্ (প্রিয়বস্তুকে, প্রিয়জনকে)। অত্তি (ভোজন করে) অন্নম্ পশ্যতি (দর্শন করে) প্রিয়ম্ ভবতি (হয়) অস্য (ইহার) বহ্মবর্চসম্ (বেদজ্ঞানজনিত দীপ্তি) কুলে যঃ (যিনি) এতম্ (ইহাকে) এবম্ (এইরূপে) আত্মানম্ বৈশ্বানরম্ (বৈশ্বানর আত্মারূপে) উপাস্তে (উপাসনা করে)। মূর্ধা (মস্তক) তু এষ (এই) আত্মনঃ (আত্মার) ইতি হ উবাচ (বলিলেন)। মূর্ধা তে (তোমার) ব্যপতিষ্যৎ (পতিত হইত) যৎ (যদি) মাম্ (আমার নিকট) ন আগমিষ্যঃ (আসিতে) ইতি। [‘এতম্… বৈশ্বানরম্ আত্মানম্’ অংশের দুই অর্থ হইতে পারে— (১) এই বৈশ্বানর আত্মাকে, (২) ইহাকে বৈশ্বানর আত্মারূপে]।
সরলার্থ : (১ম ও ২য় মন্ত্ৰ)——হে ঔপমন্যব! তুমি কাহাকে আত্মারূপে উপাসনা কর?’ ঔপমন্যব বলিলেন ‘হে ভগবান রাজা; আমি দ্যুলোককেই আত্মা বলিয়া উপাসনা করি।’ অশ্বপতি বলিলেন—’তুমি যাঁহাকে আত্মা বলিয়া উপাসনা কর, ইনি নিশ্চয়ই অতি তেজোময় বৈশ্বানর আত্মা। এই জন্য তোমার কুলে সুত, প্রসুত ও আসুত দেখা যায়। এই জন্য অন্নভোজন করিতেছ, প্রিয়জন বা প্রিয়বস্তু দেখিতেছ (অর্থাৎ লাভ করিতেছ)। যিনি এইরূপে এই বৈশ্বানর আত্মাকে উপাসনা করেন, তিনি অন্ন ভোঁজন করেন, প্রিয়জনকে দেখেন এবং তাঁহার কুলে ব্রহ্মতেজ বর্তমান থাকে। কিন্তু এই দ্যুলোক আত্মার মস্তক মাত্র। তুমি যদি আত্মতত্ত্ব শিখিবার জন্য আমার নিকটে না আসিতে তোমার মস্তক খসিয়া পড়িত।
মন্তব্য : ৫।১২।১ সুত, প্রসুত এবং আসুত—এই তিনটি সোমরসের কিংবা সোমসবনের বিভিন্ন নাম। ‘একাহ’ যজ্ঞে ইহার নাম ‘সুত’, ‘অহীন’ যজ্ঞে ইহার নাম ‘প্রসুত’ এবং ‘সত্র’ যজ্ঞে ইহার নাম, ‘আসুত’ (আনন্দগিরি)। সুতেজা, সুত, প্রসুত ও আসুত-এই কয়েক শব্দেই ‘সুত’ রহিয়াছে। এইজন্যই সম্ভবত সুত, প্রসুত ও আসুতকে সুতেজার উপাসনার ফল বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। পরবর্তী কয়েকটি খণ্ডে বলা হইয়াছে যে, উপাস্য দেবতার যে নাম উপাসনার ফলেরও তাহাই নাম। শতপথ ব্রাহ্মণে (১০।৬।১) এইস্থলে ‘সুততেজা’ ব্যবহৃত হইয়াছে।
ত্রয়োদশ খণ্ড – অশ্বপতি ও ষডুব্রাহ্মণ-সংবাদ—বৈশ্বানর (৩)
৪২০. অথ হোবাচ সত্যযজ্ঞং পোলুষিং প্রাচীনযোগ্য কং ত্বমাত্মানমুপাস ইত্যাদিত্যমেব ভগবো রাজনিতি হোবাচৈষ বৈ বিশ্বরূপ আত্মা বৈশ্বানরো যং ত্বমাত্মানমুপাসে তস্মাত্তব বহু বিশ্বরূপং কুলে দৃশ্যতে ॥ ১
৪২১. প্রবৃত্তোহশ্বতরীরথো দাসীনিষ্ফোহৎস্যন্নং পশ্যসি প্রিয়মত্ত্যনুং পশ্যতি প্রিয়ং ভবত্যস্য ব্রহ্মবর্চর্সং কুলে য এতমেবমাত্মানং বৈশ্বানরমুপাস্তে চক্ষুষ্ট্ৰেতদাত্মন ইতি হোবাচান্ধোহভবিষ্যো যন্ মাং নাগমিষ্য ইতি ॥২
অন্বয় : অথ হ উবাচ (বলিল) সত্যযজ্ঞম্ পৌলুষিম্ প্রাচীনযোগ্য (প্রাচীনযোগের অপত্য) কম্ ত্বম্ আত্মানম্ উপাসে? ইতি। আদিত্যম্ এব ভগবঃ রাজন্ ইতি হ উবাচ। এষঃ বৈ (এই আদিত্যই) বিশ্বরূপঃ (নানা রূপ যাহার; বিশ্ব—বিবিধ) আত্মা বৈশ্বানরঃ যম্ ত্বম্ আত্মানম্ উপাসে। তস্মাৎ তব বহু বিশ্বরূপম্ (বিবিধ প্রকার ধন)) কুলে দৃশ্যতে (৫।১২।১ দ্রঃ)। প্রবৃত্তঃ (নিযুক্ত, প্রস্তুত; শঙ্করের মতে ইহার অর্থ, ত্বাম্ অনু প্রবৃত্ত—তোমার অনুগত) অশ্বতরীরথঃ (অশ্বতরযুক্ত রথ) দাসী-নিষ্কঃ (দাসী ও কণ্ঠহার) অৎসি অন্নম্ পশ্যসি প্রিয়ম্। অত্তি অন্নম্ পশ্যতি প্রিয়ম্ ভবতি অস্য ব্ৰহ্মবচসম্ কুলে যঃ এতম্ এবম্ আত্মানম্ বৈশ্বানরম্ উপাস্তে। চক্ষুঃ তু এতৎ (ইহা) আত্মনঃ ইতি হ উবাচ। অন্ধঃ অভবিষ্যঃ (হইতে) যৎ মাম্ না আগমিষ্যঃ ইতি (৫।১২।২ মঃ দ্রঃ)।
সরলার্থ : (১ম ও ২য় মন্ত্র) তারপর রাজা সত্যযজ্ঞ পৌলুষিকে বলিলেন— ‘প্রাচীনযোগ্য, তুমি কাহাকে আত্মারূপে উপাসনা কর?’ সত্যযজ্ঞ বলিলেন— ‘ভগবান্ রাজা, আদিত্যকেই।’ রাজা বলিলেন— ‘তুমি যাঁহার উপাসনা কর, তিনি বিশ্বরূপ নামে বৈশ্বানর আত্মা। সেই জন্য তোমার কুলে সকল সম্পদ দেখা যায়। অশ্বতরীতে টানা রথ, দাসী, কণ্ঠহার— এই সবই তোমার জন্য প্রস্তুত; তুমি অন্নভোজন করিতেছ ও প্রিয়বস্তু দেখিতেছ। যিনি এইরূপে বৈশ্বানর আত্মাকে উপাসনা করেন, তিনি অন্নভোজী হন, প্রিয়বস্তু দেখেন এবং তাঁহার কুলে ব্রহ্মতেজ বর্তমান থাকে। (কিন্তু) এই (আদিত্য) আত্মার চক্ষুমাত্র। তুমি যদি (আত্মতত্ত্ব শিখিবার জন্য) আমার নিকট না আসিতে, তবে তুমি অন্ধ হইয়া যাইতে।’
চতুর্দশ খণ্ড – অশ্বপতি ও ষডুব্রাহ্মণ-সংবাদ—বৈশ্বানর (৪)
৪২২. অথ হোবাচেন্দ্রদ্যুম্নং ভাল্লবেয়ং বৈয়াঘ্রপদ্য কং ত্বমাত্মানমুপাস ইতি বায়ুমেব ভগবো রাজনিতি চোবাচৈষ বৈ পৃথগ্বত্মাত্মা বৈশ্বানরো যং ত্বমত্মানমুপাসসে তস্মাত্ত্বাং পৃথগ্বলয় আয়ন্তি পৃথগ্রথশ্রেণয়ো- হনুযন্তি ॥ ১
৪২৩. অৎস্যন্নং পশ্যসি প্রিয়মত্ত্যনুং পশ্যতি প্রিয়ং ভবত্যস্য ব্রহ্মবচসং কুলে য এতমেবমাত্মানং বৈশ্বানরমুপাস্তে প্রাণশ্বেষ আত্মন ইতি হোবাচ প্রাণস্ত উদক্রমিষ্যদ্ যন্মাং নাগমিষ্য ইতি ॥২
অন্বয় : অথ হ উবাচ ইন্দ্রদ্যুম্নম্ ভাল্লবেয়ম্ বৈয়াঘ্রপদ্য, কম্ ত্বম্ আত্মানম্ উপাস্সে? ইতি। বায়ুম্ এব ভগবঃ রাজন্ ইতি চ উবাচ। এষঃ বৈ পৃথক্ বৰ্ম্মা (পৃথর্রা নামক, নানা গতি বিশিষ্ট) আত্মা বৈশ্বানরঃ যম্ ত্বম্ আত্মানম্ উপাসে। তস্মাৎ ত্বাম্ (তোমার নিকট) পৃথক্ (নানাবিধ; নানাদিক হইতে আগত) বলয়ঃ (বলিসমূহ) আয়ন্তি (আগমন করে) পৃথক্ রথশ্রেণয়ঃ (রথশ্রেণীসমূহ) অনুযন্তি (অনুগমন করে)। (৫।১২।১ দ্রঃ)। অৎসি অন্নম্, পশ্যসি প্রিয়ম্। অত্তি অন্নম্ পশ্যতি প্রিয়ম্ ভবতি অস্য ব্রহ্মবচসম্ কুলে যঃ এতম্ এবম্ আত্মানম্ বৈশ্বানরম্ উপাস্তে। প্ৰাণঃ তু এষঃ আত্মনঃ ইতি হ উবাচ। প্রাণঃ তে উদক্রমিষ্যৎ (উৎক্রমণ করিত) যৎ মাম্ ন আগমিষ্যঃ (৫।১২।২ দ্রঃ)।
সরলার্থ : (১ম ও ২য় মন্ত্র) অশ্বপতি ইন্দ্রদ্যুম্ন ভাল্লবেয়কে বলিলেন— ‘হে বৈয়াঘ্রপদ্য, তুমি কাহাকে আত্মারূপে উপাসনা কর?” ভাল্লবেয় বলিলেন, “ভগবান্ রাজন, বায়ুকেই।’ অশ্বপতি বলিলেন, ‘তুমি যাঁহার উপাসনা কর, তিনি পৃথক্ত্মা নামক বৈশ্বানর আত্মা। সেই জন্য পৃথক্ পৃথক্ অর্থাৎ নানারকম বলি উপহার তোমার নিকট আসে এবং নানা রথশ্রেণী তোমার অনুগমন করে। (সেই জন্য) তুমি অন্নভোজন করিতেছ। যিনি বৈশ্বানর আত্মাকে এইভাবে উপাসনা করেন তিনি অন্নভোজন করেন, প্রিয়বস্তু দেখেন এবং তাঁহার কুলে ব্রহ্মতেজ বর্তমান থাকে। কিন্তু এই বায়ু আত্মার প্রাণ (অর্থাৎ নিশ্বাস-প্রশ্বাস) মাত্র। যদি তুমি (আত্মতত্ত্ব শিখিবার জন্য) আমার নিকট না আসিতে তোমার প্রাণ বাহির হইয়া যাইত। ‘
পঞ্চদশ খণ্ড – অশ্বপতি ও ষড়ব্রাহ্মণ-সংবাদ—বৈশ্বানর (৫)
৪২৪. অথ হোবাচ জনং শার্করাক্ষ্য কং ত্বমাত্মানমুপাস ইত্যাকাশমে ভগবো রাজনিতি হোবাচৈষ বৈ বহুল আত্মা বৈশ্বানরো যং ত্বম আত্মানম্ উপাসে তস্মাত্ত্বং বহুলোঽসি প্রজসা চ ধনেন চ ॥ ১
৪২৫. অৎস্যন্নং পশ্যসি প্রিয়মত্ত্যন্নং পশ্যতি প্রিয়ং ভবত্যস্য ব্রহ্মবর্চসং কুলে য এতমেবমাত্মানং বৈশ্বানরমুপাস্তে সন্দেহত্ত্বেষ আত্মন ইতি হোবাচ সন্দেহস্তে ব্যশীর্যদ্ যন্মাং নাগমিষ্য ইতি ॥ ২
অন্বয় : অথ হ উবাচ জনম্—শার্করাক্ষ্য, কম্ ত্বম্ আত্মানম্ উপাসে? ইতি। আকাশম্ এব ভগবঃ রাজন্—ইতি হ উবাচ, এষঃ বৈ বহুলঃ (বহুল নামক; বহুল বিস্তৃত, প্রশস্ত; পূর্ণতাপ্রাপ্ত) আত্মা বৈশ্বানরঃ যম্ ত্বম্ আত্মানম্ উপাসে। তস্মাৎ ত্বম্ বহুলঃ (পূর্ণ) অসি প্রজয়া চ (সন্ততি দ্বারা) ধনেন চ (ধন দ্বারা) অৎসি অন্নম্, পশ্যসি প্রিয়ম্। অত্তি অন্নম্ পশ্যতি প্রিয়ম্ ভবতি অস্য ব্রহ্মবচসম্ কুলে, যঃ এতম্ এবম্ আত্মানম্ বৈশ্বানরম্ উপাস্তে। সংদেহঃ (দেহের মধ্যভাগ, মধ্যম শরীর) তু এষঃ আত্মনঃ ইতি হ উবাচ। সংদেহঃ তে (তোমায়) বি-অশীর্যৎ (বিশীর্ণ হইত) যৎ মাম্ ন আগমিষ্যঃ ইতি।
সরলার্থ : (১ম ও ২য় মন্ত্র)—ইহার পর অশ্বপতি জনকে বলিলেন, “হে শার্করাক্ষ্য, তুমি কাহাকে আত্মা বলিয়া উপাসনা কর?’ জন বলিল, ‘ভগবান্ রাজা, আকাশকেই (আমি আত্মা বলিয়া উপাসনা করি)।’ রাজা বলিলেন—’তুমি যাঁহাকে উপাসনা কর, তিনি বহুল নামে বৈশ্বানর আত্মা; সেইজন্য তুমি সন্ততি ও ধরে বহুল (সমৃদ্ধ) হইয়াছ। (সেইজন্য) অন্ন ভোজন করিতেছ, এবং প্রিয়বস্তু দেখিতেছ। যিনি এইরূপে এই বৈশ্বানর আত্মাকে উপাসনা করেন, তিনি অন্নভক্ষণ করেন, প্রিয়বস্তু দেখেন; তাঁহার কুলে ব্ৰহ্মতেজ বিদ্যমান থাকে। (কিন্তু) এই আকাশ আত্মার মধ্যদেহ। যদি তুমি (আত্মতত্ত্ব শিখিবার জন্য) আমার কিট না আসিতে, তবে তোমার শরীরের মধ্যভাগ বিশীর্ণ হইত।’
ষোড়শ খণ্ড – অশ্বপতি ও ষডুব্রাহ্মণ-সংবাদ—বৈশ্বানর (৬)
৪২৬. অথ হোবাচ বুড়িলমাশ্বতরাশ্বিং বৈয়াঘ্রপদ্য কং ত্বমাত্মানমুপাস ইত্যপ এব ভগবো রাজন্নিতি হোবাচৈষ বৈ রয়িরাত্মা বৈশ্বানরো যৎ ত্বমাত্মানম উপাসে তস্মাত্ত্বং রয়িমান্ পুষ্টিমানসি ॥ ১
৪২৭. অৎস্যন্নং পশ্যসি প্রিয়মত্যন্নং পশ্যতি প্রিয়ং ভবত্যস্য ব্রহ্মবর্চসং কুলে, য এতমেবমাত্মানং বৈশ্বানরমুপাস্তে বস্তিত্বেষ আত্মন ইতি হোবাচ, বস্তিস্তে ব্যভেৎস্যৎ যন্মাং ন্যগমিষ্য ইতি ॥ ২
অন্বয় : অথ হ উবাচ বুড়িলম্ আশ্বতরাশ্বিম্ বৈয়াঘ্রপদ্য, কম্ ত্বম্ আত্মানম্ উপাসে? ইতি। অপঃ এব (জলকেই) ভগবঃ রাজন্ ইতি হ উবাচ। এষঃ বৈ রয়ি আত্মা বৈশ্বানরঃ যম্ ত্বম্ আত্মানম্ উপাসে। তস্মাৎ ত্বম্ রয়িমান্ (ধনবান) পুষ্টিমান্ অসি (৫।১২।২ দ্রঃ)। অৎসি অন্নম্, পশ্যসি প্রিয়ম্। অত্তি অন্নম্, পশ্যতি প্রিয়ম্, ভবতি অস্য ব্রহ্মবর্চসম্ কুলে, যঃ এতম্ এবম্ আত্মানম্ বৈশ্বানরম্ উপাস্তে। বস্তিঃ (মূত্রাশয়) তু এষঃ আত্মনঃ ইতি হ উবাচ। বস্তি তে বি + অভেৎস্যৎ (বিদীর্ণ হইতে), যৎ মাম্ ন অগমিষ্যঃ ইতি।
সরলার্থ : (১ম ও ২য় মন্ত্র)—তারপর অশ্বপতি বুড়িল অশ্বতরাশ্বিকে বলিলেন— ‘হে বৈয়াঘ্রপদ্য, তুমি কাহাকে আত্মারূপে উপাসনা কর?” বুড়িল বলিলেন— ‘ভগবান্ রাজা, জলকেই (আমি আত্মারূপে উপাসনা করি)।’ রাজা বলিলেন— ‘তুমি যাহাকে উপাসনা কর, তিনি রয়ি নামক বৈশ্বানর আত্মা। সেইজন্য তুমি ধনবান এবং পুষ্টিমান। সেইজন্য অন্নভোজন করিতেছ, প্রিয়বস্তু দেখিতেছ। যিনি এইরূপে এই বৈশ্বানর আত্মাকে উপাসনা করেন, তিনি অন্ন ভোজন করেন, প্রিয়বস্তু দেখেন, তাঁহার কুলে ব্রহ্মতেজ বর্তমান থাকে। (কিন্তু) এই জল আত্মার বস্তিদেশ (মূত্রাশয়)। তুমি যদি (আত্মতত্ত্ব শিখিবার জন্য) আমার নিকট না আসিতে, তবে তোমার মূত্রাশয় বিদীর্ণ হইয়া যাইত। ‘
সপ্তদশ খণ্ড – অশ্বপতি ও ষডুব্রাহ্মণ-সংবাদ—বৈশ্বানর (৭)
৪২৮. অথ হোবাচোদ্দালকমারুণিং গৌতম কং ত্বমাত্মানমুপাস ইতি পৃথিবীমেব ভগবো রাজন্নিতি হোবাচৈষ বৈ প্রতিষ্ঠাত্মা বৈশ্বানরো যং ত্বমাত্মানমুপাসে তস্মাত্ত্বং প্রতিষ্ঠিতোঽসি প্রজয়া চ পশুভিশ্চ ॥ ১
৪২৯. অৎস্যন্নং পশ্যসি প্রিয়মত্ত্যন্নং পশ্যতি প্রিয়ং ভবত্যস্য বহ্মবর্চসং কুলে য এতমেবমাত্মানং বৈশ্বানরমুপাস্তে পাদৌ ত্বেতাবাত্মন ইতি হোবাচ পাদৌ তে ব্যম্পাস্যেতাং যন্মাং নাগমিষ্য ইতি ॥ ২
অন্বয় : অথ হ উবাচ উদ্দালকম্ আরুণিম্ — গৌতম, কম্ ত্বম্ আত্মানম্ উপাসে? ইতি। পৃথিবীম্ এব ভগবঃ রাজন্ ইতি। হ উবাচ এষঃ বৈ প্রতিষ্ঠা (প্রতিষ্ঠা নামধেয়; প্রতিষ্ঠা — প্রকৃষ্টরূপে স্থিতি) আত্মা বৈশ্বানরঃ, যম্ ত্বম্ আত্মানম্ উপাসে। তস্মাৎ ত্বম্ প্রতিষ্ঠিতঃ অসি (হও) প্রজয়া চ পশুভিঃ চ (৫।১২।১; ৫।১৫।১ দ্রঃ) অৎসি অন্নম্, পশ্যসি প্রিয়ম্। অত্তি অন্নম্, পশ্যতি প্রিয়ম্ ভবতি অস্য ব্রহ্মবচসম্ কুলে যঃ এতম্ এবম্ আত্মানম্ বৈশ্বানরম্ উপাস্তে। পাদৌ (পাদদ্বয়) তু এতৌ (এই দুই) আত্মনঃ ইতি হ উবাচ। পাদৌ তে ব্যশাস্যেতাম্ (বি-ম্লৈ + স্যেতাম্, ম্লান হইত) যৎ মাম্ ন আগমিষ্যঃ ইতি (৫।১২।২ মঃ দ্রঃ)।
সরলার্থ : (১ম ও ২য় মন্ত্র)—তখন অশ্বপতি উদ্দালক আরুণিকে জিজ্ঞাসা করিলেন—’গৌতম, তুমি কাহাকে আত্ম বলিয়া উপাসনা কর?’ উদ্দালক বলিলেন, ‘ভগবান্ রাজা, পৃথিবীকেই (আমি আত্মা বলিয়া উপাসনা করি)।’ রাজা বলিলেন– ‘তুমি যাহাকে উপাসনা কর, তিনি প্রতিষ্ঠা নামক বৈশ্বানর আত্মা। সেইজন্য তুমি সন্ততি ও পশুলাভ করিয়া প্রতিষ্ঠা পাইয়াছ। (সেই জন্য) তুমি অন্ন ভোজন করিতেছ, প্রিয়বস্তু দেখিতেছ। যিনি এইরূপে এই বৈশ্বানর আত্মাকে উপাসনা করেন,
তিনি অন্ন ভোজন করেন, প্রিয়বস্তু লাভ করেন, তাঁহার কুলে ব্রহ্মতেজ বিদ্যমান থাকে। (কিন্তু) ইহা আত্মার দুইটি পা মাত্র। যদি তুমি (আত্মতত্ত্ব শিখিবার জন্য) আমার নিকট না আসিতে, তবে তোমার পা দুটিও শিথিল হইয়া যাইত।’
অষ্টাদশ খণ্ড – অশ্বপতি ও ষড়ুব্রাহ্মণ-সংবাদ—বৈশ্বানর (৮)
৪৩০. তান্ হোবাচৈতে বৈ খলু যূয়ং পৃথগিবেমমাত্মানং বৈশ্বানরং বিদ্বাং- সোহনু মথ; যত্ত্বেতমেবং প্রাদেশমাত্রমভিবিমানমাত্মানং বৈশ্বানরমুপাস্তে স সর্বেষু লোকেষু সর্বেষু ভূতেষু সর্বেষ্বাত্মস্বন্নমত্তি ॥১
অন্বয় : তান্ (তাহাদিগকে) হ উবাচ— এতে [যূয়ম্] (এই তোমরা) বৈ খলু যূয়ম্ পৃথক্ ইব (যেন পৃথক্ এইরূপে) ইমম্ আত্মানম্ বৈশ্বানরম্ (এই বৈশ্বানর আত্মাকে বিদ্বাংসঃ (জানিয়া) অন্নম্ অথ (ভোজন করিতেছ)। যঃ (যিনি) তু (কিন্তু) এতম্ (ইহাকে) এবম্ (এই প্রকারে) প্রাদেশমাত্রম্ (দ্যুলোকাদি সমুদয় প্রদেশ যাহার পরিমাণ) অভিবিমানম্ (অভিব্যাপ্ত এবং অপরিমেয়) আত্মানম্ বৈশ্বানরম্ (বৈশ্বানর আত্মাকে উপাস্তে, সঃ সর্বেষু লোকেষু (সর্বেলোকে) সর্বেষু ভূতেষু (সর্বভূতে) সর্বেষু আত্মসু (সমুদয় আত্মাতে) অন্নম্ অত্তি (ভোজন করে)।
সরলার্থ : অশ্বপতি বলিলেন— (এই বৈশ্বানর আত্মা পৃথক পৃথক নন)। কিন্তু তোমরা ইঁহাকে পৃথক পৃথক কল্পনা করিয়া অন্নভোজন করিতেছ। যিনি এইরূপে এই বৈশ্বানর আত্মাকে প্রাদেশমাত্র ও অভিবিমান (সর্বত্র ব্যাপ্ত ও অপরিমেয়) রূপে উপাসনা করেন, তিনি সর্বলোকে, সর্বভূতে ও সর্ব আত্মাতে অন্নভোজন করেন।
মন্তব্য : অষ্টাদশ খণ্ডে সর্বলোকে, সর্বভূতে এবং সর্ব আত্মাকে প্রাদেশমাত্র এবং অভিবিমান বলা হইয়াছে। প্রাচীনশালাদি ছয় জন সর্বলোক ও সর্বভূতকেই বৈশ্বানররূপে উপাসনা করিতেন; মানবাত্মাও যে বৈশ্বানর ইহা কেহই জানিতেন না। অশ্বপতি উপদেশ দিলেন— কেবল দ্যুলোকাদিই যে বৈশ্বানরের অন্তর্ভূত তাহা নহে, সৰ্ব আত্মাও ইহারই অন্তর্গত; মানবদেহও বৈশ্বানর, অন্নভোজনও অগ্নিহোত্র যজ্ঞ। মানুষ যখন অন্নভোজন করে, তখন সেই অন্ন বৈশ্বানরকেই আহুতিরূপে অর্পণ করা হয়।
‘প্রাদেশমাত্রম্’ ও ‘অভিবিমানম্’ এই দুইটি শব্দের প্রকৃত অর্থ কি সে বিষয়ে অতি প্রাচীন কাল হইতেই মতভেদ চলিয়া আসিতেছে। বিভিন্ন ভাষ্যকার নিজ নিজ মত অনুযায়ী শব্দ দুইটির অর্থ করিতেছেন। আমাদের মনে হয়, যে অর্থ গ্রহণ করিলে পূর্বাপর সামঞ্জস্য থাকে, সেই অর্থ গ্রহণ করিতে হইবে। দেখা যাউক এই অংশের পূর্বে ও পরে এবিষয়ে কি বলা হইয়াছে। ইহার পূর্ববর্তী ছয় খণ্ডে বৈশ্বানর আত্মার বিষয়ে বলা হইয়াছে— যিনি দ্যৌ অর্থাৎ সুতেজা নামক বশ্বানর উপাসনা করেন, তাঁহার কুলে সুত, প্রসুত ও আসুত দৃষ্ট হয় (৫।১২।১)। সুতেজা শব্দেও ‘সুত’ এবং সুত, প্রসুত ও আসুত শব্দেও ‘সুত’, এইজন্যই বোধ হয় সুতেজার সহিত সুত প্রসুতাদির সম্বন্ধ দেখান হইয়াছে। শতপথ ব্রাহ্মণে অনুরূপ স্থলে ‘সুততেজা’ ব্যবহৃত হইয়াছে। ইহার পরে বলা হইয়াছে—যিনি আদিত্য অর্থাৎ বিশ্বরূপ বৈশ্বানরের উপাসনা করেন, তাহার কুলে ‘বহুবিশ্বরূপ’ বস্তু দৃষ্ট হয় (৫।১৩।১)। যিনি বায়ু অর্থাৎ পুথগত্মাত্মা বৈশ্বানরের উপাসনা করেন, তাঁহার কুলে ‘পৃথক’ বলি আগমন করে (৫।১৪।১)। যিনি আকাশ অর্থাৎ বহুল নামক বৈশ্বানরের উপাসনা করেন, তিনি প্রজা ও ধনে ‘বহুল’ হন (৫।১৫।১)। যিনি আপ্ অর্থাৎ রয়ি নামক বৈশ্বানরের উপাসনা করেন, তিনি ‘রয়িমান’ হন (৫।১৬।১)। যিনি পৃথিবী অর্থাৎ প্রতিষ্ঠা নামক বৈশ্বানরের উপাসনা করেন, তিনি প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। (৫।১৭।১)। ইহা হইতে বুঝা যাইতেছে যে, প্রতিষ্ঠার উপাসনার ফল প্রতিষ্ঠা, রয়ির উপাসনার ফল রয়ি, বহুলের উপাসনার ফল বহুল ইত্যাদি।
উপাস্য বস্তু যাহা, উপাসনার ফলও তদনুরূপ। পূর্বোক্ত ছয় বৈশ্বানরের উপাসনার কথা বলিয়া অশ্বপতি বলিতেছেন— যে বৈশ্বানর প্রাদেশমাত্র এবং অভিবিমান; তাঁহার উপাসনার ফল সর্বলোকে, সর্বভূতে এবং সর্ব আত্মার অন্নভোজন। উপাস্য যাহা, উপাসনার ফলও যখন তাহাই তখন ইহাই সিদ্ধান্ত করিতে হয় যে, প্রাদেশমাত্র এবং অভিবিমান যাহা, সর্বলোক, সর্বভূত এবং সর্ব আত্মা তাহাই। এস্থলে যদি কেবল ‘প্রাদেশমাত্র’ শব্দটি থাকিত তাহা হইলে অতি সহজেই ইহার অর্থ নির্ণয় করা যাইত। ‘প্রাদেশমাত্র’ এবং ‘অভিবিমান’ এই দুইটি শব্দ থাকাতে অর্থ কিঞ্চিৎ জটিল হইয়াছে। এস্থলে দুই প্রকার অর্থ হইতে পারে— (ক) সর্বলোক ও সর্বভূতের সহিত প্রাদেশমাত্রের সম্বন্ধ এবং সর্ব আত্মার সহিত অভিবিমানের সম্বন্ধ। সর্বলোক ও সর্বভূত অর্থাৎ দ্যুলোক হইতে ভূলোক পর্যন্ত সমুদয় প্রদেশ ইঁহার মাত্রা এই জন্য ইঁহার নাম প্রাদেশমাত্র (শঙ্কর)। সর্ব আত্মারূপে ইনি অভিবিমিত হন অর্থাৎ জ্ঞাত হন, এইজন্য ইঁহার নাম অভিবিমান। প্রাদেশমাত্র নাম দ্বারা সমুদয় অনাত্মবস্তুকে বৈশ্বানরের অন্তর্ভূত করা হইল। ‘অভিবিমান’ নাম দ্বারা বলা হইল সমুদয় আত্মবস্তুও তিনি। (খ) দ্বিতীয় অর্থ এই— প্রাদেশমাত্র বলিলে সর্বলোক, সর্বভূত ও সর্ব আত্মা এই তিনটিকেই বুঝিতে হইবে। ‘সর্ব আত্মা’ প্রদেশের বাহিরে, এপ্রকার আশঙ্কা করিবার কোন কারণ নাই। এস্থলে ‘আত্মা’ অর্থ অবশ্যই অশরীর ‘আত্মা’ নহে—যখন অন্নভোজনের কথা বলা হইয়াছে তখন বুঝিতে হইবে এই আত্মা সশরীর ‘আত্মা’। আর উপনিষদের বহুস্থলে ‘দেহ’ অর্থে ‘আত্মা’ ব্যবহৃত হইয়াছে। সুতরাং সর্বলোক, সর্বভূত এবং সর্বআত্মা—এই তিনটি দ্বারাই প্রাদেশমাত্র বুঝাইতে পারে।
অভিবিমান—অভিবি-মা + অনট্, ‘মা’ ধাতুর অর্থ ‘পরিমাণ করা’। যাহার পরিমাণ নাই তাহার নাম ‘বিমান’ বা অতিবিমান বা অভিবিমান (শঙ্কর)। রামানুজ ‘অবিব্যাপ্ত’ অর্থে ‘অভি’ এবং ‘অপরিমেয়’ অর্থে ‘বিমান’ গ্রহণ করিয়াছেন। ‘প্রাদেশমাত্র’ বলিলে বৈশ্বানরকে দেশ-পরিচ্ছিন্ন করা হয়; এইজন্য প্রাদেশমাত্র বলিয়াই সেই সঙ্গে সঙ্গে বলা হইল ইনি ‘অভিবিমান’ অর্থাৎ অপরিমেয় (কিংবা সর্বব্যাপী ও অপরীমেয়)। ‘প্রদেশমাত্র’ দ্বারা বলা হইল বৈশ্বানর আত্মা জগদুপে প্রকাশিত; অভিবিমান দ্বারা বলা হইল জগৎ দ্বারা তাঁহার পরিমাণ করা যায় না। তিনি জগতের অতীত।
সঃ সর্বেষু লোকেষু সর্বেষু ভূতেষু সর্বেষু আত্মসু আন্নম্ অত্তি— তিনি সর্বলোকে সর্বভূতে এবং সমুদয় আত্মাতে অন্নভোজন করেন অর্থাৎ তিনি সকলের সহিত একত্ব অনুভব করেন; সুতরাং তাঁহার ভোগে সকলের ভোগ এবং সকলের ভোগে তাঁহার ভোগ হইয়া থাকে। যতদিন মানুষ এই একত্ব অনুভব করিতে না পারে, ততদিন কেবল ক্ষুদ্র আমিত্বেই আবদ্ধ হইয়া থাকে।
দ্যৌ, আদিত্য, বায়ু, আকাশ, জল ও পৃথিবী—এই ছয়টির কোনটিই পূর্ণ বৈশ্বানর আত্মা নহে; ইহারা বৈশ্বানর আত্মার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মাত্র। ইহাই আরও স্পষ্ট করিয়া বুঝাইবার জন্য ইহার পরে বলা হইয়াছে দ্যৌ ইহার মস্তক, আদিত্য চক্ষু, বায়ু প্ৰাণ, আকাশ মধ্যদেহ, জল এবং পৃথিবী ইহার পাদ। এইভাবে মাথা হইতে পা পর্যন্ত সবকিছুই বর্ণনা করা হইল। এই স্থলে মন্ত্র শেষ হইলে উপমার কোন হানি হইত না। শতপথ ব্রাহ্মণেও আর নূতন কোন উপমা দেওয়া হয় নাই। ছান্দোগ্য উপনিষদে অতিরিক্ত যাহা কিছু বলা হইয়াছে, তাহার সহিত উপরের অংশের বিশেষ কোন সঙ্গতি দেখা যায় না। দ্যৌ যাহার মস্তক, আদিত্য চক্ষু, বায়ু প্রাণ, আকাশ মধ্যদেহ, জল বস্তি, এবং পৃথিবী পদ—তাহার উরু, লোম, হৃদয়, মন ও মুখের সহিত বেদি, কুশ, গার্হপত্য অগ্নি, অন্বাহাৰ্যপচন অগ্নি এবং আহবনীয় অগ্নির তুলনা দেওয়া সুসঙ্গত বলিয়া মনে হয় না।
শঙ্কর এই শেষ অংশকে পরবর্তী খণ্ডের সহিত সংযুক্ত করিয়া ব্যাখ্যা করিয়াছেন। ঊনবিংশ খণ্ড হইতে ত্রয়োবিংশ খণ্ড পর্যন্ত অংশে প্রাণাগ্নিহোত্রের বিষয় বলা হইয়াছে। অগ্নিহোত্র যজ্ঞে বেদি কুশ প্রভৃতির আবশ্যক হয়। মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গকে এই সমুদয় বস্তুরূপে কল্পনা করিয়া লওয়া হইয়াছে, যেমন ভোক্তার বক্ষঃস্থলই যজ্ঞের বেদি, বক্ষঃস্থলের লোমসমূহই কুশ, হৃদয়ই গার্হপত্য অগ্নি, মনই অন্বাহার্যপচন এবং মুখই আহবনীয় অগ্নি। প্রতিদিন যে ভোজন করা হয় তাহাই অগ্নিহোত্র যজ্ঞ মুখে যে অন্ন নিক্ষেপ করা হয় তাহাই এই যজ্ঞের আহুতি।
৪৩১. তস্য হ বা এতস্যাত্মনো বৈশ্বানরস্য মূর্ধেব সুতেজাশ্চক্ষুর্বিশ্বরূপঃ প্রাণঃ পৃথগ্ধত্মাত্মা সন্দেহো বহুলো বস্তিরেব রয়িঃ পৃথিব্যেব পাদাবুর এব বেদির্লোমানি বর্হিহৃদয়ং গার্হপত্যো মনোহন্বাহাৰ্য পচন আস্যমাহ- বনীয়ঃ ॥ ২
অন্বয় : অস্য হ বৈ এতস্য আত্মনঃ বৈশ্বানরস্য (সেই বৈশ্বানর আত্মার) মূর্ধা এব সুতেজাঃ (৫।১২।১); চক্ষুঃ বিশ্বরূপ (৫।১৩।১); প্রাণঃ পৃথক্ বৰ্ম্মাত্মা (৫। ১৪। ১); সন্দহঃ বহুলঃ (৫। ১৫। ১); বস্তিঃ এব রয়িঃ (৫।১৬।১); পৃথিবী এব পাদৌ (৫।১৭), উরঃ (উরস্ শব্দ; বক্ষস্থল) এব বেদিঃ; লোমানি (লোমসমূহ) বর্হিঃ (কুশ); হৃদয়ম্ গার্হপত্যঃ (৪।১১) মনঃ অশ্বাহার্যপচনঃ (৪।১২); আস্যম্ (মুখ) আহ আহবনীয়ঃ (৪। ১৩)।
সরলার্থ : ‘সুতেজা’ এই বৈশ্বানর আত্মার মস্তক; ‘বিশ্বরূপ’ ইহার চক্ষু; ‘পৃথগ্ বর্থাত্মা” প্রাণ; ‘বহুল’ শরীরের মধ্যভাগ; ‘রয়ি’ বস্তি এবং পৃথিবী ইহার দুই পা; ‘বেদি’ ইহার বক্ষ; কুশ লোম; গার্হপত্য অগ্নি হৃদয়; দক্ষিণাগ্নি মন এবং আহ আহবনীয় অগ্নি ইহার মুখ।
ঊনবিংশ খণ্ড – প্রাণাগ্নিহোত্ৰ (১)
৪৩২. তদ্ যজ্ঞক্তং প্রথমমাগচ্ছেত্তদ্বোমীয়ং স যাং প্রথমামাহুতিং জুহুয়াত্তাং জুহুয়াৎ প্রাণায় স্বাহেতি প্ৰাণস্তূপ্যতি ॥ ১
অন্বয় : তৎ (সেই জন্য) যৎ ভক্তম্ (যে অন্ন; কিংবা তৎ যৎ-সেই যে; ২।১১। ২ মন্তব্য) প্রথমম্ (প্রথমে) আগচ্ছেৎ (উপস্থিত হয়) তৎ (তাহা) হোমীয়ম্ (হোমস্থানীয়)। সঃ (সেই অনুভোক্তা) যাম্ প্রথমাম্ আহুতিম্ (যে প্রথম আহুতিকে) জুহুয়াৎ (হু; হোম করিবে) তাম্ (তাহাকে) জুহুয়াৎ প্রাণায় স্বাহা ইতি (প্রাণের উদ্দেশ্যে স্বাহা এই বলিয়া)। প্ৰাণ তৃপ্যতি (তৃপ্ত হয়)।
সরলার্থ : সেই জন্য যে অন্ন প্রথম উপস্থিত হয় তাহা (অর্থাৎ অন্নের প্রথম অংশ) হোমের জন্য। অন্নভোক্তা প্রথমে যে আহুতি অর্পণ করেন তাহা ‘প্রাণায় স্বাহা” বলিয়া অর্পণ করিবে। ইহাতে প্রাণ তৃপ্ত হয়। [এখনও অনেকে অন্নভোজন করিবার সময় কল্পনা করেন যে, প্রথম গ্রাসকে প্রাণের উদ্দেশে, দ্বিতীয় গ্রাসকে ব্যানের উদ্দেশে, তৃতীয় গ্রাসকে অপানের উদ্দেশে, চতুর্থ গ্রাসকে সমানের উদ্দেশে এবং পঞ্চম গ্ৰাসকে উদানের উদ্দেশে আহুতি দেওয়া হইল।]
৪৩৩. প্রাণে তৃপ্যতি চক্ষুতৃপ্যতি চক্ষুষি তৃপ্যত্যাদিত্যস্তূপ্যত্যাদিত্যে তৃপ্যতি দ্যৌতৃপ্যতি দিবি তৃপ্যন্ত্যাং যৎ কিঞ্চি দ্যৌশ্চাদিত্যশ্চাধি- তিষ্ঠতস্তত্ত্বপ্যতি তস্যানুতৃপ্তিং তৃপ্যতি প্রজয়া পশুভিরন্নাদ্যেন তেজসা ব্ৰহ্মবর্চসেনেতি ॥ ২
অন্বয় : প্রাণে তৃপ্যতি (প্রাণ তৃপ্ত হইলে) চক্ষুঃ তৃপ্যতি (তৃপ্ত হয়); চক্ষুষি তৃপ্যতি (চক্ষু তৃপ্ত হইলে) আদিত্যঃ তৃপ্যতি (তৃপ্ত হয়), আদিত্যে তৃপ্যতি (আদিত্য তৃপ্ত হইলে) দ্যৌঃ তৃপ্যতি (তৃপ্ত হয়), দিবি তৃপ্যন্ত্যাম্ (দ্যৌ তৃপ্ত হইলে) যৎ কিম্ চ (যাহা কিছু) দ্যৌঃ চ আদিত্যঃ চ অধিতিষ্ঠতঃ (অধিষ্ঠান করে; পরিচালনা করে) তৎ তৃপ্যতি (তাহা তৃপ্ত হয়); তস্য (তাহার) অনুতৃপ্তিম্ (তৃপ্তিম্ অনু, তৃপ্তিকে অনুসরণ করিয়া) তৃপ্যতি (তৃপ্ত হয়) প্রজয়া (সন্ততি দ্বারা) পশুভিঃ (পশুগণ দ্বারা) অন্নাদ্যেন (খাদ্যাদি দ্বারা) তেজসা (তেজ দ্বারা) ব্রহ্মবর্চসেন (১।১৬।২ দ্রঃ, ব্রহ্মবর্চস দ্বারা) ইতি।
সরলার্থ : প্রাণ তৃপ্ত হইলে চক্ষু, চক্ষু তৃপ্ত হইলে আদিত্য, আদিত্য তৃপ্ত হইলে স্বর্গলোক তৃপ্ত হয়। স্বর্গলোক তৃপ্ত হইলে, দ্যুলোক আদিত্যে যাহা কিছু আছে, সে সবই তৃপ্ত হয়। এই তৃপ্তির ফলস্বরূপ ভোক্তাও সন্ততি, পশুসমূহ, অনাদি, দেহকান্তি ও ব্রহ্মতেজ লাভ করিয়া তৃপ্ত হন।
বিংশ খণ্ড – প্রাণাগ্নিহোত্র (২)
৪৩৪. অথ যাং দ্বিতীয়াং জুহুয়াত্তাং জুহুয়াদ্ব্যানায় স্বাহেতি ব্যানস্তূপ্যতি ॥ ১
৪৩৫. ব্যানে তৃপ্যতি শ্রোত্রং তৃপ্যতি শ্রোত্রে তৃপ্যতি চন্দ্রমাতৃপ্যতি চন্দ্রমসি তৃপ্যতি দিশস্তূপ্যন্তি দিক্ষু তৃপ্যন্তীষু যৎ কিংচ দিশশ্চ চন্দ্ৰমাশ্চাধিতিষ্ঠন্তি তত্ত্বপ্যতি তস্যানুতৃপ্তিং তৃপ্যতি প্রজয়া পশুভিরন্নাদ্যেন তেজসা ব্ৰহ্মবর্চসেনেতি ॥ ২
অন্বয় : অথ যাম্ দ্বিতীয়াম্ (যে দ্বিতীয়া আহুতিকে) জুহুয়াৎ তাম্ জুহুয়া ব্যানায় স্বাহা (ব্যানের উদ্দেশ্যে ‘স্বাহা”) ইতি (এই বলিয়া)। ব্যানঃ তৃপ্যতি (৫।১৯।১)। ব্যানে তৃপ্যতি (ব্যান তৃপ্ত হইলে) শ্রোত্রম্ তৃপ্যতি; শ্রোত্রে তৃপ্যতি (শ্রোত্র তৃপ্ত হইলে) চন্দ্ৰমাঃ তৃপ্যতি; চন্দ্রমসি তৃপ্যতি (চন্দ্ৰমা তৃপ্ত হইলে) দিশঃ (দিকসমূহ) তৃপ্যন্তি (তৃপ্ত হয়); দিক্ষু তৃপ্যন্তীষু (দিকসমূহ তৃপ্ত হইলে) যৎ কিম্ চ (যেকোন বস্তুতে) দিশঃ চ চন্দ্ৰমাঃ চ অধিতিষ্ঠন্তি (অধিষ্ঠান করে) তৎ তৃপ্যতি। তস্য অনুতৃপ্তিম্ তৃপ্যতি প্ৰজয়া পশুভিঃ অনাদ্যেন তেজসা ব্রহ্মবর্চসেন। ইতি (৫। ১৯।২)।
সরলার্থ : (১ম ও ২য় মন্ত্র) তাহার পর যাহাকে দ্বিতীয় আহুতিরূপে অৰ্পণ করিবে, তাহাকে ‘ব্যানায় স্বাহা” (ব্যানের উদ্দেশে স্বাহা) এই বলিয়া হোম করিবে। ইহাতে ব্যান তৃপ্ত হয়। ব্যান তৃপ্ত হইলে কর্ণ, কর্ণ তৃপ্ত হইলে চন্দ্র, চন্দ্র তৃপ্ত হইলে দিকসমূহ তৃপ্ত হয়; দিকসমূহ তৃপ্ত হইলে, যাহা কিছু দিক ও চন্দ্র কর্তৃক পরিচালিত, সে সবই তৃপ্ত হয়। ভোক্তা এই তৃপ্তির ফলে সন্ততি, পশু, ভোগ্য অন্ন, দেহকান্তি ও ব্রহ্মতেজজনিত তৃপ্তি লাভ করেন।
একবিংশ খণ্ড – প্রাণাগ্নিহোত্র (৩)
৪৩৬. অথ যাং তৃতীয়াং জুহুয়াত্তাং জুহুয়াদপানায় স্বাহেত্যপানস্তূপতি ॥ ১ ৪৩৭. অপানে তৃপ্যতি বাক্ তৃপ্যতি, বাচি তৃপ্যন্ত্যামগ্নিস্তূপ্যত্যগ্নৌ তৃপ্যতি, পৃথিবী তৃপ্যতি, পৃথিব্যাং তৃপ্যন্ত্যাং যৎ কিংচ পৃথিবী চাগ্নিশ্চাধি – তিষ্ঠতস্তত্ত্বপ্যতি, তস্যানু তৃপ্তিং তৃপ্যতি প্রজয়া পশুভিরনাদ্যেন তেজসা ব্রহ্মবর্চসেনেতি ॥ ২
অন্বয় : অথ যাম্ তৃতীয়াম্ (যে তৃতীয়া আহুতিকে) জুহুয়াৎ, তাম্ জুহুয়াৎ অপানায় (অপানের উদ্দেশে) স্বাহা ইতি। অপানঃ তৃপ্যতি (৫।১৯।১)। অপানে তৃপ্যতি (অপান তৃপ্ত হইলে), বাক্ তৃপ্যতি; বাচি তৃপ্যন্ত্যাম্ (বাক্ তৃপ্ত হইলে) অগ্নিঃ তৃপ্যতি; অগ্নৌ তৃপ্যতি (অগ্নি তৃপ্ত হইলে) পৃথিবী তৃপ্যতি। পৃথিব্যাম্ তৃপ্যন্ত্যাম্ (পৃথিবী তৃপ্ত হইলে) যৎ কিম্ চ পৃথিবী চ অগ্নিঃ চ অধিতিষ্ঠতঃ, তৎ তৃপ্যতি। তস্য অনুতৃপ্তিম্ তৃপ্যতি প্রজয়া পশুভিঃ অন্নাদ্যেন তেজসা ব্রহ্মবর্চসেন।
সরলার্থ : (১ম ও ২য় মন্ত্র) তাহার পর যাহাকে তৃতীয় আহুতিরূপে দিবে তাহাকে ‘অপানায় স্বাহা’ (অপানের উদ্দেশ্যে স্বাহা) এই বলিয়া দিবে। ইহাতে অপান তৃপ্ত হয়। অপান তৃপ্ত হইলে বাগিন্দ্রিয়, বাক্ তৃপ্ত হইলে অগ্নি, অগ্নি তৃপ্ত হইলে পৃথিবী তৃপ্ত হয়; পৃথিবী তৃপ্ত হইলে যাহা কিছু পৃথিবী ও অগ্নি দ্বারা পরিচালিত সে সমস্তই তৃপ্ত হয়। ভোক্তা এই তৃপ্তির ফলে প্রজা, পশু, ভোগ্য অন্ন, দেহলাবণ্য ও ব্রহ্মতেজ লাভ করিয়া তৃপ্ত হন।
দ্বাবিংশ খণ্ড – প্রাণাগ্নিহোত্র (৪)
৪৩৮. অথ যাং চতুর্থীং জুহুয়াত্তাং জুহুয়াৎ সমানায় স্বাহেতি সমানস্তূপ্যতি ॥ ১
৪৩৯. সমানে তৃপ্যতি মনস্তূপ্যতি, মনসি তৃপ্যতি পর্জন্যস্তূপাতি, পর্জন্যে তৃপ্যতি বিদ্যুতৃপ্যতি, বিদ্যুতি তৃপ্যন্ত্যাং যৎ কিংচ বিদ্যুচ্চ পর্জন্যশ্চাধি- তিষ্ঠতস্তত্ত্বপ্যতি তস্যানু তৃপ্তিং তৃপ্যতি, প্রজয়া পশুভিরন্নাদ্যেন তেজসা ব্ৰহ্মবর্চসেনেতি ॥ ৩
অন্বয় : অথ যাম্ চতুর্থীম্ (যে চতুর্থী আহুতিকে) জুহুয়াৎ, তাম্ জুহুয়াৎ সমানায় (সমানের উদ্দেশে) স্বাহা ইতি। সমানঃ তৃপ্যতি (৫।১৯।১)। সমানে তৃপ্যতি (সমান তৃপ্ত হইলে) মনঃ তৃপ্যতি; মনসি তৃপ্যতি (মন তৃপ্ত হইলে) পর্জন্যঃ তৃপ্যতি; পর্জন্যে তৃপ্যতি (পর্জন্য তৃপ্ত হইলে) বিদ্যুৎ তৃপ্যতি; বিদ্যুতি তৃপ্যন্ত্যাম্ (বিদ্যুৎ তৃপ্ত হইলে) যৎ কিম্ চ বিদ্যুৎ চ পর্জন্যঃ চ অধিতিষ্ঠতঃ, তৎ তৃপ্যতি। তস্য অনুতৃপ্তিম্ তৃপ্যতি প্রজয়া পশুভিঃ অনাদ্যেন তেজসা ব্রহ্মবর্চসেন ইতি (৫।১৯।২ মন্ত্র দ্রষ্টব্য)।
সরলার্থ : (১ম ও ২য় মন্ত্র)— অনন্তর যাহাকে চতুর্থী আহুতিরূপে অর্পণ করিবে তাহাকে ‘সমানায় স্বাহা’ (সমানের উদ্দেশ্যে স্বাহা)— এই বলিয়া হোম করিবে। ইহাতে ‘সমান’ তৃপ্ত হয়। ‘সমান’ তৃপ্ত হইলে মন, মন তৃপ্ত হইলে পর্জন্য, পর্জন্য তৃপ্ত হইলে বিদ্যুৎ তৃপ্ত হয়; বিদ্যুৎ তৃপ্ত হইলে, যাহা কিছু বিদ্যুৎ ও পর্জন্য দ্বারা পরিচালিত, সে সবই তৃপ্ত হয়। অন্নভোক্তা এই তৃপ্তির ফলে প্রজা, পশু, ভোগ্য অন্ন, দেহকান্তি ও ব্রহ্মতেজ লাভ করিয়া তৃপ্ত হন।
ত্রয়োবিংশ খণ্ড – প্ৰাণাগ্নিহোত্ৰ (৫)
৪৪০. অথ যাং পঞ্চমীং জুহুয়াত্তাং জুহুয়াদুদানায় স্বাহেত্যুদানস্তূপ্যতি ॥ ১
৪৪১. উদানে তৃপ্যতি ত্বক্ তৃপ্যতি, ত্বচি তৃপ্যন্ত্যাং বায়ুস্তূপ্যতি বায়ৌ তৃপত্যাকাশস্তূপ্যত্যাকাশে তৃপ্যতি যৎ কিংচ বায়ুশ্চাকাশশ্চাধিতিষ্ঠত- স্তত্ত্বপ্যতি, তস্যানু তৃপ্তিং তৃপ্যতি প্রজয়া পশুভিরন্নাদ্যেন তেজসা ব্ৰহ্মবর্চসেনেতি ॥২
অন্বয় : অথ যাম্ পঞ্চমীম্, (যে পঞ্চমী আহুতিকে) জুহুয়াৎ তাম্ জুহুয়াৎ উদানায় (উদানের উদ্দেশ্যে) স্বাহা ইতি। উদানঃ তৃপ্যতি (৫।১৯।২) উদানে তৃপ্যতি (উদান তৃপ্ত হইলে) ত্বক্ তৃপ্যতি; ত্বচি তৃপ্যন্ত্যাম্ (ত্বক্ তৃপ্ত হইলে) বায়ুঃ তৃপ্যতি; বায়ৌ তৃপ্যতি (বায়ু তৃপ্ত হইলে) আকাশঃ তৃপ্যতি; আকাশে তৃপ্যতি (আকাশ তৃপ্ত হইলে) যৎ কিষ্ণ বায়ুঃ চ আকাশঃ চ অধিতিষ্ঠতঃ তৎ তৃপ্যতি। তস্য অনুতৃপ্তিম্ তৃপ্যতি প্রজয়া পশুভিঃ অনাদ্যেন তেজসা ব্রহ্মবর্চসেন ইতি (৫।১৯। ২)।
সরলার্থ : (১ম ও ২য় মন্ত্ৰ অনন্তর যাহাকে পঞ্চমী আহুতিরূপে অর্পণ করিবে, তাহাকে ‘উদানায় স্বাহা’ (উদানের উদ্দেশে স্বাহা) এই বলিয়া অর্পণ করিবে। ইহাতে উদান তৃপ্ত হয়। উদান তৃপ্ত হইলে ত্বক্, ত্বক্ তৃপ্ত হইলে বায়ু, বায়ু তৃপ্ত হইলে আকাশ তৃপ্ত হয়। আকাশ তৃপ্ত হইলে যাহা কিছু বায়ু ও আকাশ কর্তৃক পরিচালিত সে সবই তৃপ্ত হয়। ভোক্তা এই তৃপ্ত হেতু প্রজা, পশু, ভোগ্য অন্ন, দেহকান্তি ও ব্রহ্মতেজ লাভ করিয়া তৃপ্ত হন।
চতুর্বিংশ খণ্ড – প্রাণাগ্নিহোত্র (৬)
৪৪২. স য ইদমবিদ্বানগ্নিহোত্রং জুহোতি যথাঙ্গারানপোহ্য ভস্মনি জুহুয়াত্তাদৃক্ তৎ স্যাৎ ॥ ১
৪৪৩. অথ য এতদেবং বিদ্বানগ্নিহোত্রং জুহোতি তস্য সর্বেষু লোকেষু সর্বেষু ভূতেষু সর্বেষ্বাত্মসু হুতং ভবতি ॥ ২
অন্বয় : সঃ যঃ (সেই যে কোন লোক) ইদম্ (ইহাকে) অবিদ্বান্ (না জানিয়া) অগ্নিহোত্রম্ জুহোতি (অগ্নিহোত্র হোম করে) যথা (যেমন) অঙ্গারান্ (জ্বলদঙ্গারকে) অপোহ্য (পরিত্যাগ করিয়া) ভস্মনি (ভস্মে) জুহুয়াৎ (হোম করে) তাদৃক্ (সেই প্রকার) তৎ স্যাৎ (হয়)। অথ যঃ এতৎ (ইহাকে) এবম্ (এইরূপ) বিদ্বান্ (জানিয়া) অগ্নিহোত্রম্ জুহোতি (১মঃ) তস্য (তাহার) সর্বেষু লোকেষু (সর্বলোকে) সর্বেষু ভূতেষু (সর্বভূতে সর্বেষু আত্মষু (সমুদয় আত্মাতে) হুতম্ ভবতি (হোম করা হয়)।
সরলার্থ : (১ম ও ২য় মন্ত্ৰ)— যে লোক ইহা অর্থাৎ এই বৈশ্বানর বিদ্যা না জানিয়া অগ্নিহোত্র হোম করে— জ্বলন্ত অঙ্গার ছাড়িয়া ভস্মে আহুতি দিলে যাহা হয়— ইহারও তাহাই হয়। আর যিনি ইঁহাকে এইরূপ জানিয়া অগ্নিহোত্র হোম করেন, তাঁহার সর্বলোকে, সর্বভূতে ও সকল আত্মাতে হোম করা হয়।
মন্তব্য : অগ্নিতে আহুতি দেওয়ার নাম ‘অগ্নিহোত্র’। প্রাতঃকালে এবং সায়ংকালে নির্দিষ্ট অগ্নিতে আহুতি দেওয়া গৃহস্থের পক্ষে একটি নিত্য কর্ম।
৪৪৪. তদ্ যথেষীকাতূলমগ্নৌ প্রোতং প্রদূয়েতৈবং হাস্য সর্বে পাপ্মানঃ প্রদূয়ন্তে য এতদেবং বিদ্বানগ্নিহোত্রং জুহোতি ॥ ৩
৪৪৫. তস্মাদু হৈবংবিদ্ যদ্যপি চণ্ডালায়োচ্ছিষ্টং প্রযচ্ছেদাত্মনি হৈবাস্য তদ্বৈশ্বানরে হুতং স্যাদিতি তদেষ শ্লোকঃ ॥ ৪
৪৪৬. যথেহ ক্ষুধিতা বালা মাতরং পর্যুপাসতে। এবং সর্বাণি ভূতান্যগ্নিহোত্ৰমুপাসত ইত্যগ্নিহোত্ৰমুপাসত ইতি ॥ ৫
অন্বয় : তৎ যথা (যেমন) ইষীকাতূলম্ (মুঞ্জা ঘাসের তুলা) অগ্নৌ (অগ্নিতে) প্ৰোতম্ (নিক্ষিপ্ত হইলে) প্রদূয়েত (সম্যক্ দগ্ধ হইয়া যায়), এবম্ (এই প্রকার) হ অস্য (ইহার) সর্বে পাপ্পানঃ (সমুদয় পাপ) প্রদূয়ন্তে (সম্যক দগ্ধ হইয়া যায়)। যঃ (যিনি) এতৎ (ইহাকে) এবম্ (এই প্রকার) বিদ্বান্ (জানিয়া) অগ্নিহোত্রম্ জুহোতি (১মঃ)। তৎ যথা— (৪।১৬।৩ মন্তব্য) তস্মাৎ (সেই জন্য) উ হ এবংবিৎ (এই প্রকার জ্ঞানসম্পন্ন) যদ্যপি চণ্ডালায় (চণ্ডালকে) উচ্ছিষ্টম্ প্রযচ্ছেৎ (প্রদান করে); আত্মনি (আত্মাতে) হ এব অস্য (ইহার) তৎ (সেই উচ্ছিষ্টকে) বৈশ্বানরে [আত্মনি] (বৈশ্বানর আত্মাতে) হুতম্ স্যাৎ (আহুত হইয়া থাকে) ইতি। তৎ (এ বিষয়ে) এষঃ (এই) শ্লোকঃ যথা (যেমন) হই (এই পৃথিবীতে) ক্ষুধিতাঃ বালাঃ (ক্ষুধিত শিশুগণ) মাতরম্ (মাতাকে) পরি + উপাসতে (উপাসনা করে), এবম্ (এই প্রকার) সর্বাণি ভূতানি (সমুদয় ভূত) অগ্নিহোত্রম্ উপাসতে ইতি; অগ্নিহোত্রম্ উপাসতে ইতি (দ্বিরুক্তি সমাপ্তিসূচক)।
সরলার্থ : (৩য়— ৫ম মন্ত্র) যেমন ইষীকার তুলাকে আগুনে দিলে তাহা সম্পূর্ণ দগ্ধ হইয়া যায়, তেমনি যিনি ইহাকে এইরূপ জানিয়া অগ্নিহোত্র হোম করেন, তাঁহার সমস্ত পাপ নিঃশেষে দগ্ধ হইয়া যায়। সেই জন্য এই রকম জ্ঞানবান ব্যক্তি যদি চণ্ডালকেও উচ্ছিষ্ট প্রদান করেন, তাহা হইলে বৈশ্বানর আত্মাতেই তাঁহার হোম করা হয়। এ বিষয়ে এই শ্লোক আছে— যেমন এই পৃথিবীতে ক্ষুধার্ত শিশুগণ মাতার উপাসনা করে (অর্থাৎ সাগ্রহে তাঁহার কাছে গিয়া জড় হয়) তেমনি সকল চরাচর প্রাণী অগ্নিহোত্রের উপাসনা করিয়া থাকে।
মন্তব্য : ৫। ২৪।৪ ‘যদ্যপি চণ্ডালায় উচ্ছিষ্টম্’ ইত্যাদি— এখানে বলিবার উদ্দেশ্য, এই পবিত্র অগ্নিতেই পবিত্র বস্তুকে হোম করিতে হয়; কিন্তু চণ্ডাল অস্পৃশ্য জাতি এবং উচ্ছিষ্টও অপবিত্র বস্তু। চণ্ডালস্থ বৈশ্বানর অগ্নিতে উচ্ছিষ্ট অর্পণ করিলে আহুতি প্রদানের কোন ফল লাভ হইবার কথা নয়। কিন্তু যিনি প্রাণাহুতি-তত্ত্ব জানেন, তিনি এ প্রকার করিলেও ফল লাভ করিয়া থাকেন।