ছান্দোগ্য উপনিষদ – ষষ্ঠ অধ্যায়
ষষ্ঠ অধ্যায়
প্ৰথম খণ্ড – আরুণি-শ্বেতকেতু-সংবাদ (১) – একবিজ্ঞানে সর্ববিজ্ঞান
৪৪৭. ওঁ শ্বেতকেতুহারুণেয় আস তং হ পিতোবাচ শ্বেতকেতো বস ব্রহ্মচর্যং ন বৈ সোম্যাস্মকুলীনোহননূচ্য ব্রহ্মবন্ধুরিব ভবতীতি ॥ ১
অন্বয় : শ্বেতকেতুঃ হ আরুণেয় (৫।৩।১ দ্রঃ) আস (ছিল; বৈদিক প্রয়োগ)। তম্ (তাহাকে) হ পিতা উবাচ (বলিলেন) — শ্বেতকেতো, বস (বাস কর
শ্বেতকেতো, বস (বাস কর— ব্রহ্মচারীরূপে) ব্রহ্মচর্যম্। ন (না) বৈ (যেহেতু নিশ্চয়ই) সোম্য অস্মকুলীনঃ (‘অস্মাৎ + কুল’ হইতে নিষ্পন্ন; কুলীনঃ— কুলে উৎপন্ন; আমাদিগের বংশোদ্ভব কেহ) অননূচ্য (বেদ অধ্যয়ন না করিয়া) ব্রহ্মবন্ধুঃ ইব (ব্রহ্মবন্ধুর ন্যায়) ভবতি (হয়)। [ব্রহ্মবন্ধুঃ— ব্রাহ্মণের গুণ নাই, কিন্তু ব্রাহ্মণবংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছে বলিয়া ব্রাহ্মণ— এই অর্থে ব্ৰহ্মবন্ধু, ৫।৩।৫ মন্তব্যঃ দ্রষ্টব্য]।
সরলার্থ : আরুণির শ্বেতকেতু নামে এক পুত্র ছিল। পিতা তাহাকে বলিলেন— ‘শ্বেতকেতু, তুমি ব্রহ্মচর্য নাও। আমাদিগের বংশে কেহই বেদাধ্যয়ন না করিয়া ব্রহ্মবন্ধুর মত হন নাই।’
৪৪৮. স হ দ্বাদশবর্ষ উপেত্য চতুর্বিংশতিবর্ষঃ সর্বান্ বেদানধীত্য মহামনা অনূচানমানী স্তব্ধ এয়ায় তং হ পিতোবাচ শ্বেতকেতো যন্নু সোম্যেদং মহামনা অনূচানমানী স্তব্ধোহস্যুত তমাদেশমপ্রাক্ষ্যঃ ॥২
৪৪৯. যেনাশ্রুতং শ্রুতং ভবত্যমতং মতমবিজ্ঞাতং বিজ্ঞাতমিতি কথং নু ভগবঃ স আদেশো ভবতীতি ॥ ৩
অন্বয় : সঃ (শ্বেতকেতু) হ দ্বাদশবর্ষঃ (বার বছর বয়স্ক) উপেত্য (‘গুরুগৃহে গমন করিয়া) চতুর্বিংশতিবর্ষঃ (চব্বিশ বৎসর বয়সে) সর্বান্ বেদান্ (সমুদয় বেদকে) অধীত্য (অধ্যয়ন করিয়া) মহামনাঃ (গম্ভীর যাহার মন; যে মনে করে আমার মন উন্নত)) অনুচানমানী (পাণ্ডিত্যাভিমানী; যে মনে করে আমি বেদজ্ঞ) স্তব্ধঃ (অবিনীত) এয়ায় (ফিরিয়া আসিল)। তম্ (তাহাকে) হ পিতা উবাচ (বলিলেন) শ্বেতকেতো যৎ নু সোম্য ইদম্ (যৎ ইদম্ = এই যে,) মহামনাঃ অনূচানমানী, স্তব্ধঃ অসি (হইয়াছ)। উত (কি) তম্ আদেশম্ (সেই আদেশকে, উপদেশকে) অপ্রাক্ষ্যঃ (জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে যেন (যে উপদেশ দ্বারা) অশ্রুতম্ (অশ্রুতবিষয়) শ্রুতম্ ভবতি (শ্রুত হয়), অমতম্ (যাহা মনন করা হয় নাই সেই বিষয়) মতম্ (বোধগম্য), অভিজ্ঞাতম্ (অবিজ্ঞাত বিষয়) বিজ্ঞাতম্ (বিজ্ঞাত)? ইতি কথম্ নু (কি প্রকার) ভগবঃ (ভগবন্) সঃ আদেশঃ ভবতি ইতি।
সরলার্থ : (২য় ও ৩য় মন্ত্র)— শ্বেতকেতু বার বছর বয়সে গুরুগৃহে গিয়া চব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত সমস্ত বেদ অধ্যয়ন করিল। বেদ অধ্যয়নের পর সে গম্ভীরচিত্ত, পাণ্ডিত্যাভিমানী ও অবিনীত হইয়া গৃহে ফিরিল। পিতা তাহাকে বলিলেন— ‘শ্বেতকেতু, তুমি ত মহামনা, পাণ্ডিত্যাভিমানী, অবিনীত হইয়া ফিরিয়া আসিয়াছ। কিন্তু তুমি কি সেই আদেশের কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে, যাহাতে অশ্রুতবিষয় শোনা যায়, অচিন্তিত বিষয় চিন্তা করা যায় এবং অজ্ঞাত বিষয় জানা যায়?’ শ্বেতকেতু জিজ্ঞাসা করিলেন—’ভগবান কি সেই উপদেশ?”
৪৫০. যথা সোম্যৈকেন মৃৎপিণ্ডেন সর্বং মৃন্ময়ং বিজ্ঞাতং স্যাদ্বাচারম্ভণং বিকারো নামধেয়ং মৃত্তিকেত্যেব সত্যম্ ॥ ৪
অন্বয় : যথা (যেমন) সোম্য! একেন মৃৎপিণ্ডেন (একটি মৃৎপিণ্ড দ্বারা) সর্বশ্ মৃন্ময়ম্ (সমুদয় মৃন্ময় বস্তু) বিজ্ঞাতম্ স্যাৎ (বিজ্ঞাত হয়); বাচা + আরম্ভণম্ (বাক্যসমূহের অবলম্বন) বিকারঃ (মৃন্ময় বস্তুরূপ বিকার) নামধেয়ম্ (নামমাত্র); মৃত্তিকা ইতি এব সত্যম্
সরলার্থ : পিতা বলিলেন, ‘হে সৌম্য, একটি মৃৎপিণ্ড জানিলেই সমস্ত মৃন্ময় বস্তু জানা যায়; বিকার বাক্যের অবলম্বন মাত্র, কেবল একটি নাম। মৃত্তিকাই সত্য (অর্থাৎ মৃন্ময় বস্তু মৃত্তিকারই বিকার; কিন্তু এই বিকার আর কিছুই নহে, ইহা কেবল শব্দাত্মক)। [ভাষায় বলিতে হয়, এইটা ঘট, এইটা সরা, কিন্তু ভাষা দ্বারা পার্থক্য না করিলে সবই মৃত্তিকা হইয়া যায়; সুতরাং মৃত্তিকাই সত্য।
৪৫১. যথা সোম্যৈকেন লোহমণিনা সর্বং লোহাময়ং বিজ্ঞাতং স্যাদ্বাচারম্ভণং বিকারো নামধেয়ং লোহমিত্যেব সত্যম্ ॥ ৫
৪৫২. যথা সোম্যৈকেন নখনিকৃন্তনেন সর্বং কাায়সং বিজ্ঞাতং স্যাদ্বাচারম্ভণং বিকারো নামধেয়ং কৃষ্ণায়মিত্যেব সত্যমেবং সোম্য স আদেশো ভবতীতি ॥ ৬
অন্বয় : যথা সৌম্য! একেন লোহমণিনা (একটি সুবর্ণপিণ্ড দ্বারা) সর্বম্ লোহময়ম্ (সমুদয় স্বর্ণময় বস্তু) বিজ্ঞাতম্ স্যাৎ; বাচা আরম্ভণম্ বিকারঃ (লোহময় বস্তুরূপ বিকার) নামধেয়ম্; লোহম্ ইতি এব সত্যম্ (৪র্থ মঃ দ্রঃ)। যথা সৌম্য একেন নখনিকৃন্তনেন (একটি নরুণ দ্বারা অর্থাৎ একখণ্ড লৌহদ্বারা; নিকৃন্তন—যাহা দ্বারা ছেদন করা যায়, নখনিকৃন্তন—যাহা দ্বারা নখ ছেদন করা যায়) সর্বম্ কাষ্ণায়সম্ (লৌহময় বস্তু) বিজ্ঞাতম্ স্যাৎ, বাচারম্ভণম্ বিকারঃ নামধেয়ম্, কৃষ্ণায়সম্ ইতি এব সত্যম্। এবম্ সোম্য সঃ (সেই) আদেশঃ (উপদেশ) ভবতি (হয়) ইতি (৪র্থ মঃ দ্রঃ)।
সরলার্থ : (৫ম ও ষষ্ঠ মন্ত্ৰ)— হে সৌম্য, যেমন একটি সুবর্ণপিণ্ড জানিলেই সব সুবর্ণময় বস্তু জানা যায়; বিকার শব্দমূলক, নামমাত্র, এবং সুবর্ণই সত্য (অর্থাৎ সুবর্ণময় বস্তু সুবর্ণেরই বিকার, এই বিকার কেবল শব্দমূলক, কেবল একটি নামমাত্র; ভাষায় বলিতে হয় এইটি কুণ্ডল, এইটি বলয়; কিন্তু ভাষা দ্বারা পার্থক্য না করিলে সমস্ত সুবর্ণময় বস্তু এক সুবর্ণই হইয়া যায়; সুতরাং সুবর্ণই সত্য পদার্থ)। হে সৌম্য, যেমন একটা নরুণকে জানিলে সব লৌহময় বস্তু জানা যায়, বিকার শব্দাত্মক, নামমাত্র, লৌহই সত্য, তেমনি হে সৌম্য, সেই উপদেশ (অর্থাৎ সেই উপদেশ শ্রবণ করিলে অশ্রুত বস্তু শ্রুত হয়, অচিন্তিত বিষয় চিন্তা করা যায় এবং অজ্ঞাত বিষয় জ্ঞাত হয়)।
মন্তব্য : ৬।১।৫ লোহমণি — সুবর্ণপিণ্ড (শঙ্কর)। ‘লোহ’ শব্দ হইতেই ‘লোহিত’ শব্দ। এইজন্য কেহ কেহ বলেন ‘লৌহ’ নামক ধাতু লোহিত বর্ণই হইবে, সুতরাং লোহ = তাম্র এবং লোহমণি = তাম্রময় অলঙ্কার। ডয়সন্ ইহার অনুবাদে ‘copper but- ton or ornament’ ব্যবহার করিয়াছেন। (৬ষ্ঠ মন্তব্য দ্রষ্টব্য)।
=
৬।১।৬ (ক) নিকৃন্তন, ব্যাকরণের নিয়মানুসারে ‘নিকৃন্তন’ না হইয়া ‘নিবর্তন’ হওয়া উচিত। কিন্তু প্রচলিত সংস্কৃত সাহিত্যেও এই প্রকার ব্যবহার রহিয়াছে (ভাগবত ৩।৩০।২৭, ৬।২।৪৬)। (খ) ‘কার্ফায়স’ শব্দ ‘কৃষ্ণায়স্ শব্দ হইতে উৎপন্ন। কৃষ্ণায়স্ কৃষ্ণ + অয়স্ —কৃষ্ণবর্ণ, অয়স—লৌহ। ‘অয়স’ একটি ধাতু, কিন্তু ইহা কোন ধাতু তাহা বলা কঠিন। বাজসনেয়ি সংহিতাতে (১৮।১৩) এই ছয়টি ধাতুর নাম করা হইয়াছে— (১) হিরণ্য, (২) অয়স্, (৩) শ্যাম, (৪) লোহ, (৫) সীস, (৬) ত্রপু। ‘হিরণ্য’ অর্থ সুবর্ণ; আমরা বর্তমান সময়ে যাহাকে লৌহ বলি, তাহারই প্রাচীন নাম ‘শ্যাম’। অথর্ববেদে এই অর্থেই ‘শ্যাম’ শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে (৯।৫।৪, ১১।৩।৭)। পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণ অনেকে মনে করেন লোহ তাম্র (৬।১।৫ মন্তব্য দ্রষ্টব্য) এবং ‘অয়স্’ bronze নামক রক্তাভ মিশ্র ধাতু। সাধারণত লোকে মনে করে অয়স্ = লৌহ। ঋগ্বেদে (১০।৮৭।২) অগ্নিকে ‘অয়োদ্রংষ্ট’ বলা হইয়াছে। অন্য এক স্থলে (১।৮৮।৫) ‘অয়োদংষ্টান্’ শব্দের ব্যবহার আছে, Macdonell-এর মতে এই শব্দ অগ্নিরই বিশেষণ। অগ্নির জিহ্বাকে লক্ষ্য করিয়াই এই সমুদয় কথা ব্যবহৃত হইয়া থাকে। অগ্নির জিহ্বা বা শিখা অবশ্যই লৌহের মত নহে। একটি মন্ত্রে (৬।৭১।৪) সূর্যকে হিরণ্যপাণি ও অয়োহনু বলা হইয়াছে। ‘অয়স্’ এখানে অবশ্যই লৌহ নহে। ইহা এমন এক ধাতু যাহার বর্ণ সূর্যের মত। সায়ণের মতে আয়োহনুঃ = হিরণ্যহনুঃ। এক স্থলে ‘বান’কে অয়োমুখম্ বলা হইয়াছে (৬।৭৫।১৫), অপর এক স্থলে ব্যবহার করা হইয়াছে (১০।৯৯।৬) ‘অয়ো অগ্রয়া’। এই দুই স্থলে ‘অয়স্’ অর্থ যে ‘লৌহ’ই করিতে হইবে তাহা নহে, ইহার অর্থ তাম্র বা bronze-ও হইতে পারে। শতপথ ব্রাহ্মণে (৫।৪।১২) ‘অয়স্ ও লোহায়স্ এই দুয়ের মধ্যে পার্থক্য করা হইয়াছে। জৈমিনীয় উপনিষদ্ (৩।১৭।৩) ব্রাহ্মণের মতে লোহায়স্ এবং কার্যায়স্ বিভিন্ন ধাতু। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণেও (৩।৬২।৬।৫) কৃষ্ণায়াস্ ও লোহায়কে দুই ধাতু বলা হইয়াছে। এই সমুদয় অংশ হইতে অনুমান করা যাইতে পারে যে, এক সময়ে ‘অয়স্’ শব্দ ‘লৌহ’ অর্থে ব্যবহৃত হইত না।
৪৫৩. ন বৈ নূনং ভগবন্তস্ত এতদবেদিষুর্যদ্ধ্যেতদবেদিষ্যন্ কথং মে নাবক্ষ্যন্নিতি ভগবাংত্ত্বেব মে তদ্ব্রীত্বিতি তথা সোম্যেতি হোবাচ ॥ ৭
অন্বয় : ন (না) বৈ নূনম্ ভগবন্তঃ (পূজনীয়) তে (তাঁহারা, উপাধ্যায়গণ) এতৎ (ইহা) অবেদিষুঃ (জানিতেন)। যৎ (যদি) হি এতং অবেদিষ্যন্ (জানিতেন), কথম্ (কেন্) মে (আমাকে) ন (না) অবক্ষ্যন্ (বলিবেন) ইতি। ভগবান্ তু এব মে তৎ ব্রবীতু (বলুন) ইতি। তথা (তাহাই) সোম্য! ইতি হ উবাচ।
সরলার্থ : পুত্র বলিল ‘পূজনীয় উপাধ্যায়গণ নিশ্চয়ই ইহা জানিতেন না। যদি জানিতেনই তবে বলিলেন না কে? সুতরাং আপনিই আমাকে তাহা বলুন।’ পিতা বলিলেন, ‘সৌম্য, তাহাই হউক’।
দ্বিতীয় খণ্ড – সৎস্বরূপ হইতে তেজ, জল ও অন্নের সৃষ্টি
৪৫৪. সদেব সোম্যেদমগ্র আসীদেকমেবাদ্বীকিয়ম্। তদ্ধৈক আহুরসদেবেদমগ্র আসীদেকমেবাদ্বিতীয়ং তস্মাদসতঃ সজ্জায়ত ॥ ১
অন্বয় : সৎ এব (সৎস্বরূপই, যাহা আছে তাহাই সৎ) সোম্য! ইদম্ (এই জগৎ) অগ্রে আসীৎ (ছিল) একম্ এব অদ্বিতীয়ম্। তৎ (ইহাকে, এ বিষয়ে) হ একে (কেহ কেহ) আহুঃ (বলেন) অসৎ এব (অসৎই, যাহা নাই তাহার নাম ‘অসৎ’) ইদম্ অগ্রে আসীৎ একম্ এব অদ্বিতীয়ম্। তস্মাৎ অসতঃ (সেই অসৎ হইতে) সৎ (সত্তা) জায়ত (বৈদিক প্রয়োগ অজায়ত—উৎপন্ন হইয়াছে)।
সরলার্থ : সৌম্য, প্রথমে এই জগৎ এক অদ্বিতীয় সরূপে বর্তমান ছিল। কেহ কেহ বলেন, প্রথমে এই জগৎ এক অদ্বিতীয় ‘অসৎ’ রূপে বর্তমান ছিল এবং সেই অসৎ হইতে সৎ উৎপন্ন হইয়াছে।
৪৫৫. কৃতস্তু খলু সোম্যৈবং স্যাদিতি হোবাচ কথমসতঃ সজ্জায়েতেতি সত্ত্বেব সোম্যেদমগ্র আসীদেকমেবাদ্বিতীয়ম্ ॥ ২
অন্বয় : কুতঃ তু খলু (কি প্রকারে)? সোম্য, এবম্ (এই প্রকারে) স্যাৎ (হইতে পারে)? ইতি। হ উবাচ (বলিলেন)। কথম্ (কি প্রকারে) অসতঃ সৎ জায়েত (উৎপন্ন হইতে পারে) ইতি। সৎ তু এব সোম্য, ইদম্ অগ্রে আসীৎ একম্ এব অদ্বিতীয়ম্ (১মঃ)।
সরলার্থ : কিন্তু সৌম্য, ইহা কি করিয়া হইতে পারে? কি করিয়া অসৎ হইতে সৎ উৎপন্ন হইতে পারে? এই জগৎ পূর্বে এক অদ্বিতীয় সরূপেই বর্তমান ছিল।
৪৫৬. তদৈক্ষত বহু, স্যাং প্রজায়েয়েতি তত্তেজোহসৃজত। তত্তেজ ঐক্ষত বহু স্যাং প্রজায়েয়েতি। তদপোহসৃজত। তস্মাদ্ যত্র ক্ব চ শোচতি স্বেদতে বা পুরুষস্তেজস এব তদধ্যাপো জায়ন্তে ॥ ৩
অন্বয় : তৎ (সেই সৎ) ঐক্ষত (সঙ্কল্প করিয়াছিল)— বহু স্যাম্ (বহু হই) প্ৰজায়েয় (উৎপন্ন হই) ইতি। তৎ (সেই সৎ) তেজঃ অসৃজত (সৃষ্টি করিল)। তৎ (সেই) তেজঃ ঐক্ষত বহু স্যাম্ প্রজায়েয় ইতি তৎ অপঃ (জলকে) অসৃজত। তস্মাৎ (সেই জন্য) যত্র ক্ব চ (যে কোন স্থানে) শোচতি (শোক করে স্বেদতে বা (ঘর্মাক্ত হয়) পুরুষঃ তেজসঃ এব (তেজ হইতেই) তৎ (সেই স্থলে) অধি আপঃ (জল) জায়ন্তে (উৎপন্ন হয়)।
সরলার্থ : সেই সৎ— স্বরূপ আলোচনা করিলেন (বা সঙ্কল্প করিলেন)— “আমি বহু হই, আমি জন্মগ্রহণ করি।’ তারপর তিনি তেজ সৃষ্টি করিলেন। সেই তেজও সঙ্কল্প করিল, ‘আমি বহু হই, আমি জন্মগ্রহণ করি।’ সেই তেজ জল সৃষ্টি করিল। তাই পুরুষ যখন যেখানে শোকার্ত বা ঘর্মাক্ত হয়, সেখানেই তেজ হইতে জল উৎপন্ন হয়।
৪৫৭. তা আপ ঐক্ষন্ত বহ্ব্যঃ স্যাম প্রজায়েমহীতি তা অন্নমসৃজন্ত তস্মাদ যত্র কৃ চ বৰ্ষতি তদেব ভূয়িষ্ঠমন্নং ভবত্যদ্ভ্য এব তদধ্যনাদ্যং জায়তে ॥ ৪
অন্বয় : তাঃ আপঃ (সেই জল) ঐক্ষন্ত (সঙ্কল্প করিল)— বহ্ব্যঃ (বহু) স্যাম (হই) প্রজায়েমহি (উৎপন্ন হই) ইতি। তাঃ (সেই জল) অন্নম্ অসৃজন্ত (সৃষ্টি করিল)। তস্মাৎ যত্র ক্ব চ বৰ্ষতি (বৃষ্টিপাত হয়), তৎ (তখনই) ভূয়িষ্ঠম্ (বহু পরিমাণে) অন্নম্ ভবতি (হয়)। অদ্ভ্যঃ এব (জল হইতেই) তৎ (তখন) অধি [জায়তে] (উৎপন্ন হয়) অন্নাদ্যম্ (অন্নাদি) জায়তে।
সরলার্থ : সেই জল সঙ্কল্প করিল, ‘বহু হই, জাত হই।’ সেই জল অন্ন সৃষ্টি করিল। এই জন্য যেখানে যখন বৃষ্টিপাত হয়, সেখানে বহু অন্ন উৎপন্ন হয়।
মন্তব্য : ঐক্ষত—ঈক্ষ্ ধাতু হইতে। দর্শন করা, চিন্তা করা, সঙ্কল্প করা ইত্যাদি বহু অর্থে এই ধাতু ব্যবহৃত হয়। যত্র ক্ব চ শঙ্করের মতে ইহার অর্থ, দেশ এবং কাল উভয় হইতে পারে, ‘দেশে কালে বা’।
তৃতীয় খণ্ড – আদি দেবত্রয়ের মিশ্রণে জগতের উৎপত্তি
৪৫৮. তেষাং খল্বেষাং ভূতানাং ত্রীণ্যের বীজানি ভবন্ত্যাণ্ডজং জীবজমুদ্ভিজ্জমিতি ॥১
অন্বয় : তেষাম্ খলু এষাম্ ভূতানাম্ (সেই এই ভূতসমূহের) ত্রীণি এব (তিন প্রকারই) বীজানি (কারণ) ভবন্তি (হয়)— আণ্ডজম্ (অণ্ডজম্—অণ্ড হইতে উৎপন্ন; আণ্ড, বৈদিক প্রয়োগ = অণ্ড), জীবজম্ (জীব হইতে উৎপন্ন) উদ্ভিজ্জম্ (উদ্ভিদ্ হইতে উৎপন্ন) ইতি। [অর্থাৎ তাহারা তিনরকম ভাবে জন্মায়।]
সরলার্থ : সেই ভূতগণের উৎপত্তির তিনিটি কারণ ইহারা অণ্ডজ, জীবজ ও উদ্ভিজ্জ।
মন্তব্য : ‘উদ্ভিজ্জম্’ শব্দের অনেক অর্থ করা হইয়াছে— (ক) উদ্ভিদ্ অর্থাৎ বৃক্ষাদি হইতে জাত, (খ) উদ্ভিদ্ অর্থ বীজ বা অঙ্কুর; বীজ বা অঙ্কুর হইতে যাহা জাত তাহাই উদ্ভিজ্জ।
৪৫৯. সেয় দেবতৈক্ষত হন্তাহমিমাস্তিস্ত্রো দেবতা অনেন জীবেনাত্মনানুপ্রবিশ্য নামরূপে ব্যাকরবাণীতি ॥ ২
৪৬০. তাসাং ত্রিবৃতং ত্রিবৃতমেকৈকাং করবাণীতি সেয়ং দেবতেমাস্তিস্রো দেবতা অনেনেব জীবেনাত্মনানুপ্রবিশ্য নামরূপে ব্যাকরোৎ ॥ ৩
অন্বয় : সা ইয়ম্ দেবতা (সেই এই দেবতা) ঐক্ষত (আলোচনা বা সঙ্কল্প করিলেন, ৬।২।৩ মন্তব্য) হন্ত (আচ্ছা, বেশ) অহম্ (আমি) ইমাঃ তিস্রঃ দেবতাঃ (এই তিন দেবতাতে অর্থাৎ তেজ, জল অন্ন— এই তিন দেবতাতে) অনেন জীবেন আত্মনা (এই জীবাত্মারূপে) অনুপ্রবিশ্য (অনুপ্রবেশ করিয়া) নামরূপে (নাম ও রূপকে) ব্যাকরবাণি ব্যাকৃত করি, ব্যক্ত করি) ইতি। তাসাম্ (সেই তিন দেবতার ত্রিবৃতম্ ত্রিবৃতম্ (ত্রিবৃৎ ত্রিবৃৎ) একৈকাম্ (প্রত্যেককে) করবাণি (করি)। ইতি। সা ইয়ম্ দেবতা (সেই এই দেবতা) ইমাঃ তিসঃ দেবতাঃ (এই তিন দেবতাতে) অনেন এব জীবনে আত্মনা অনু প্রবিশ্য নামরূপে ব্যাকরোৎ (ব্যক্ত করিলেন)।
সরলার্থ : (২য় ও ৩য় মন্ত্ৰ সেই সৎস্বরূপ দেবতা সঙ্কল্প করিলেন— ‘আচ্ছা, আমি এই জীবাত্মারূপে এই তিন দেবতাতে (তেজ, জল ও অন্ন নামক দেবতাতে) অনুপ্রবিষ্ট হইয়া নাম ও রূপ ব্যক্ত করি। আমি এই তিন দেবতাকে ত্রিবৃৎ ত্রিবৃৎ করি।’ তারপর তিনি জীবাত্মারূপে এই সব দেবতার অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া নাম ও রূপ ব্যক্ত করিলেন।
মন্তব্য : ৬।৩।৩ ত্রিবৃৎকরণের অর্থ এই— তেজ, জল ও পৃথিবী এই তিনটি ভূত। তেজ যে কেবল বিশুদ্ধ তেজ, তাহা নহে, ইহাতে জল ও পৃথিবী এই দুই-এর অংশও আছে। তবে তেজে তেজের অংশই বেশি। এইরূপ জলে তেজ ও পৃথিবীর অংশও আছে। আমাদের দেশের দার্শনিকগণ বলেন— তেজ = ১/২ ভাগ তেজ + ১/৪ ভাগ জল + ভাগ পৃথিবী। জল = ১/২ ভাগ জল + ১/৪ ভাগ তেজ + ১/৪ ভাগ পৃথিবী। পৃথিবী = ১/২ ভাগ পৃথিবী + ১/৪ ভাগ তেজ + ১/৪ ভাগ জল।
৪৬১. তাসাং ত্রিবৃতং ত্রিবৃতমেকৈকামকরোদ্ যথা তু খলু সোম্যেমাস্তিস্রো দেবতাত্রিবিৎ ত্রিবৃদেকৈকা ভবতি তন্মে বিজানীহীতি ॥ ৪
অন্বয় : তাসাম্ ত্রিবৃতম্ ত্রিবৃতম্ একৈকাম্ আকরোৎ। যথা (যে প্রকারে) তু খলু সোম্য, ইমাঃ তিস্রঃ দেবতাঃ ত্রিবৃৎ ত্রিবৃৎ এক + একা ভবতি, তৎ (তাহা) মে (আমার নিকটে) বিজানীহি (অবগত হও) ইতি। (৩য় মন্ত্ৰ)।
সরলার্থ : সেই সৎস্বরূপ দেবতা তাহাদিগের প্রত্যেককে ত্রিবৃৎ ত্রিবৃৎ করিয়াছিলেন। হে সৌম্য, এই তিন দেবতা প্রত্যেকে কি প্রকারে ত্রিবৃৎ হইয়াছিলেন, তাহা আমার নিকট জানিয়া লও।
চতুর্থ খণ্ড – অগ্নি-সূর্যাদি সমুদয় বস্তুতে আদি দেবত্রয়ের অবস্থিতি
৪৬২. যদগ্নে রোহিতং রূপং তেজসস্তদ্রূপং যচ্ছুক্লং তদপাং যৎ কৃষ্ণ তদন্নস্যাপাগাদগ্নেরগ্নিত্বং বাচারম্ভণং বিকারো নামধেয়ং ত্রীণি রূপাণীত্যেব সত্যম্ ॥১
অন্বয় : যৎ (যে) অগ্নেঃ (অগ্নির) রোহিতম্ (লোহিত) রূপম্ তেজসঃ (তেজের) তৎ রূপম্ (সেইরূপ)। যৎ শুক্লম্, তৎ অপাম্ (জলের)। যৎ কৃষ্ণম্, তৎ অন্নস্য (অন্নের)। অপ-অগ্যৎ (চলিয়া গেল) অগ্নেঃ (অগ্নি হইতে) অগ্নিত্বম্। বাচারম্ভণম্ বিকারঃ নামধেয়ম্ (৬।১।৪ টীকা)। ত্রীণি রূপাণি (তিনটি রূপ) ইতি এব সত্যম্।
সরলার্থ : অগ্নির যে রক্তবর্ণ তাহা তেজের রূপ; শুক্লবর্ণ জলের রূপ এবং কৃষ্ণবর্ণ অন্নের রূপ। সুতরাং অগ্নি হইতে অগ্নিত্ব চলিয়া গেল। সমস্ত বিকারই শব্দাত্মক নামমাত্র। এই তিনটি রূপই কেবল সত্য।
৪৬৩. যদাদিত্যস্য রোহিতং রূপং তেজসস্তদ্রূপং যচ্ছুক্লং তদপাং যৎ কৃষ্ণং তদন্নস্যাপাগাদাদিত্যাদিত্যত্বং বাচারম্ভণং বিকারো নামধেয়ং ত্রীণি রূপাণীত্যেব সত্যম্ ॥ ২
অন্বয় : যৎ আদিত্যস্য (আদিত্যের) রোহিতম্ রূপম্, তেজসঃ তৎ রূপম্; যৎ শুক্লম্, তৎ অপাম্ যৎ কৃষ্ণম্, তৎ অনুস্য। অপাগাৎ আদিত্যাৎ (আদিত্য হইতে) আদিত্যত্বম্। বাচারম্ভণম্ বিকারঃ নামধেয়ম্ (৬।১।৪)। ত্রীণি রূপাণি ইতি এব সত্যম্ (১মঃ দ্রঃ)।
সরলার্থ : সূর্যের যে লোহিতবর্ণ তাহা তেজের রূপ, তাহার শুক্লবর্ণ জলের রূপ এবং কৃষ্ণবর্ণ অন্নের রূপ। এইভাবে সূর্য হইতে সূর্যত্ব চলিয়া গেল। সব বিকারই শব্দত্মক, নামমাত্র। এই রূপ তিনটিই সত্য।
৪৬৪. যচ্চন্দ্রমসো রোহিতং রূপং তেজসস্তদ্রূপং যচ্ছুক্লং তদপাং যৎ কৃষ্ণং তদন্নস্যাপাগাচ্চন্দ্রাচ্চন্দ্রত্বং বাচারম্ভণং বিকারো নামধেয়ং ত্রীণি রূপাণী—ত্যেব সত্যম্ ॥ ৩
৪৬৫. যদ্বিদ্যুতো রোহিতং রূপং তেজসস্তদ্রূপং যচ্ছুক্লং তদপাং যৎ কৃষ্ণং তদন্নস্যাপাগাদ্ বিদ্যুতো বিদ্যুত্ত্বং বাচারম্ভণং বিকারো নামধেয়ং ত্রীণি রূপাণীত্যেব সত্যম্ ॥ ৪
অন্বয় : যৎ চন্দ্রমসঃ (চন্দ্রের) রোহিতম্ রূপম্ তেজসঃ তৎ রূপম্; যৎ শুক্লম্, তৎ অপাম্; যৎ কৃষ্ণম্ তৎ অনুস্য। অপাগাৎ চন্দ্রাৎ (চন্দ্র হইতে) চন্দ্রত্বম্। বাচারম্ভণম্ বিকারঃ নামধেয়ম্, ত্রীণি রূপাণি ইতি এব সত্যম্ (১ম মন্ত্র দ্রঃ)। যৎ বিদ্যুতঃ (বিদ্যুতের) রোহিতম্ রূপম্, তেজসঃ তৎ রূপম্; যৎ শুক্লম্ তৎ অপাম্; যৎ কৃষ্ণম্ তৎ অন্নস্য। অপাগাৎ বিদ্যুতঃ (বিদ্যুৎ হইতে) বিদ্যুত্ত্বম্ (বিদ্যুত্ত্ব —বিদ্যুতের ভাব)। বাচারম্ভণম্ বিকারঃ নামধেয়ম্; ত্রীণি রূপাণি ইতি এব সত্যম্ (১ম মন্ত্র দ্রঃ)
সরলার্থ : (৩য় ও ৪র্থ মন্ত্র)— চন্দ্রের যে লোহিতরূপ তাহা তেজের রূপ, তাহার যে শুক্লরূপ তাহা জলের রূপ এবং কৃষ্ণরূপ অন্নের রূপ। সুতরাং চন্দ্র হইতে চন্দ্রত্ব চলিয়া গেল। সব বিকারই শব্দাত্মক, নামমাত্র; এই রূপ তিনটিই সত্য। বিদ্যুতের যে লোহিতরূপ তাহা তেজের, শুক্লরূপ জলের এবং ইহার কৃষ্ণরূপ অন্নের। সুতরাং বিদ্যুৎ হইতে বিদ্যুত্ত্ব চলিয়া গেল। বিকার বাক্যমূলক, কেবল একটি নাম। এই যে তিনটি রূপ ইহাই সত্য।
৪৬৬. এতদ্ধ স্ম বৈ তদ্বিদ্বাংস আহুঃ পূর্বে মহাশালা মহাশ্রোত্রিয়া ন নোহদ্য কশ্চনাশ্রুতমমতমবিজ্ঞাতমুদাহরিষ্যতীতি হ্যেভ্যো বিদাঞ্চকুঃ ॥ ৫
অন্বয় : এতত্ হ (এই) স্ম বৈ তৎ বিদ্বাংসঃ (তাহার জ্ঞাতাসকল) আহুঃ (বলিয়াছিলেন) পূর্বে (পূর্বকালের) মহাশালাঃ মহাশ্রোত্রিয়াঃ (৫।১১।১ টীঃ) ন (না) নঃ (আমাদের) অদ্য কঃ চন (কোন ব্যক্তি) অশ্রুতম্ অমতম্ অবিজ্ঞাতম্ (৬।১।২,৩ মন্ত্ৰ উদাহরিষ্যতি (বলিবেন) ইতি। হি এভ্যঃ (এই সমুদয় অর্থাৎ লোহিতাদি রূপ হইতে বিদাঞ্চঙ্কুঃ (অবগত হইয়াছিলেন)
সরলার্থ : ইহা জানিয়াই পূর্বে মহাগৃহস্থ ও মহাশ্রোত্রিয়গণ বলিয়াছিলেন— আজ হইতে কোন ব্যক্তি আমাদের এমন কিছু বলিতে পারিবে না যাহা আমরা শুনি নাই, চিন্তা করি করি নাই বা আমাদের জানা নাই।’ তাঁহাদের এই রকম বলার কারণ— এই সব অর্থাৎ লোহিতাদি প্রভা তো জ্ঞান হইতেই তাঁহারা জানিয়াছিলেন [অর্থাৎ লোহিতাদিই সত্য আর সমস্ত লোহিতাদির বিকার; সুতরাং লোহিতাদি জানিলেই আর সব জানা যায়]।
৪৬৭. যদু রোহিতমিবাভূদিতি তেজসস্তদ্রুপমিতি তদ্বিদাঞ্চকর্ষদু শুরুমিবাভূদিত্যপাং রূপমিতি তদ্বিদাঞ্চকুর্যদু কৃষ্ণমিবাভূদিত্যনুস্য রূপমিতি তদ্বিদাঞ্চকুঃ ॥ ৬
অন্বয় : যৎ (যাহা) উ রোহিতম্ ইব (লোহিতের ন্যায়) অভূৎ (ছিল) ইতি, তেজসঃ (তেজের) তৎ রূপম্ (সেইরূপ) ইতি, তৎ বিদাঞ্চঙ্কুঃ (জানিয়াছিলেন) যৎ উ শুক্লম্ ইব (শুক্লের ন্যায়) অভূৎ ইতি, অপাম্ রূপম্ (জলের রূপ) ইতি, তৎ বিদঞ্চঙ্কুঃ; যৎ উ কৃষ্ণম্ ইব (কৃষ্ণের ন্যায়) অভূৎ ইতি, অন্নস্য (অন্নের) রূপম্ ইতি তৎ বিদাঞ্চঙ্কুঃ।
সরলার্থ : যাহা লোহিতের মত মনে হইত অর্থাৎ লোকে যাহাকে লোহিত বলিয়া মনে করিত তাহা তাঁহারা তেজের রূপ বলিয়া বুঝিয়াছিলেন; যাহা শুক্লের মত মনে হইত, তাহা জলের রূপ ও যাহা কৃষ্ণের মত মনে হইত, তাহাকে অন্নের রূপ বলিয়া বুঝিয়াছিলেন।
৪৬৮. যদ্ববিজ্ঞাতমিবাভূদিত্যেতাসামেব দেবতানাং সমাস ইতি তদ্বিদাঞ্চকুৰ্যথা নু খলু সোম্যেমাস্তিস্রো দেবতাঃ পুরুষং প্রাপ্য ত্রিবৃৎ ত্রিবৃদেকৈকা ভবতি তন্মে বিজানীহীতি ॥ ৭
অন্বয় : যৎ উ (যাহা) অবিজ্ঞাতম্ ইব (অবিজ্ঞাতের ন্যায়) অভূৎ (ছিল), ইতি এতাসাম্ এব দেবতানাম্ (এই দেবতাদিগেরই) সমাসঃ (সংযোগ, সমষ্টি) ইতি, তৎ বিদাঞ্চঙ্কুঃ। যথা খলু তু সোম্য! ইমাঃ তিস্রঃ দেবতাঃ পুরুষম্ প্রাপ (পুরুষকে প্রাপ্ত হইয়া) ত্রিবৃৎ ত্রিবৃৎ একৈকা ভবতি (হয়), তৎ মে বিজানীহি ইতি (৬।৩।৪ মন্ত্ৰ দ্ৰঃ)।
সরলার্থ : যাহা কিছু অজ্ঞাত মনে হইত, তাহাও যে এই দেবতাদেরই (অর্থাৎ তেজ, জল ও অন্নেরই) সমষ্টি— তাহারা সে কথা বুঝিয়াছিলেন। সৌম্য, এই তিন দেবতা পুরুষকে পাইয়া প্রত্যেকে যেরূপ ত্রিবৃৎ ত্রিবৃৎ হইয়া থাকে, তাহা আমার নিকট জানিয়া লও।
পঞ্চম খণ্ড – আদি দেবত্রয় হইতে শরীর, মন, প্রাণ ও বাক্যের উৎপত্তি
৪৬৯. অনুমশিতং ত্রেধা বিধীয়তে তস্য যঃ স্থবিষ্ঠো ধাতুস্তৎপুরীষং ভবতি যো মধ্যমস্তন্মাংসং যোহণিষ্ঠস্তন্মনঃ ॥ ১
অন্বয় : অন্নম্ অশিতম্ (ভুক্ত হইলে) ত্রেধা (তিন প্রকার) বিধীয়তে (বিভক্ত হয়); তস্য (তাহার) যঃ (যাহা) স্থবিষ্ঠঃ (স্থূলতম) ধাতুঃ (অংশ), তৎ (তাহা) পুরীষম্ ভবতি; যঃ মধ্যমঃ, তৎ মাংসম, যঃ অণিষ্ঠঃ (সুক্ষ্মতম) তৎ মনঃ
সরলার্থ : অন্ন ভুক্ত হইয়া তিনভাগে বিভক্ত হয়। অন্নের স্থূলতম অংশ হয় পুরীষ, মধ্যম ভাগ মাংস এবং সূক্ষ্মতম অংশ হয় মন।
৪৭০. আপঃ পীতাত্রেধা বিধীয়ন্তে তাসাং যঃ স্থবিষ্ঠো ধাতুস্তমূত্রং ভবতি যো মধ্যমস্তল্লোহিতং যোহণিষ্ঠঃ স প্ৰাণঃ ॥ ২
৪৭১. তেজোহশিতং ত্ৰেধা বিধীয়তে তস্য যঃ স্থবিষ্ঠো ধাতুস্তদস্থি ভবতি যো মধ্যমঃ স মজ্জা যোহণিষ্ঠঃ সা বাক্ ॥ ৩
,
অন্বয় : আপঃ (জল) পীতাঃ (পীত হইয়া) ত্রেধা বিধীয়ন্তে (বিভক্ত হয়); তাসাম্ (সেই জলের) যঃ স্থবিষ্ঠঃ ধাতুঃ, তৎ মূত্রম্ ভবতি; যঃ মধ্যমঃ, তৎ লোহিতম্ (রক্ত); যঃ অণিষ্ঠঃ, সঃ প্রাণঃ (১মঃ দ্রঃ)। তেজঃ (ঘৃতাদি তেজস্কর পদার্থ) অশিতম্ (ভুক্ত হইয়া) ত্রেধা বিধীয়তে। তস্য যঃ স্থবিষ্ঠঃ ধাতুঃ, তৎ অস্থি ভবতি; যঃ মধ্যমঃ, সঃ মজ্জা; যঃ অণিষ্ঠঃ, সা বাক্ (১ মঃ দ্রঃ)।
সরলার্থ : (২য় ও ৩য় মন্ত্র)— জল পীত হইয়া তিনভাগে বিভক্ত হয়। জলের স্থূলতম অংশ হয় মূত্র। ঘৃত প্রভৃতি মধ্যম অংশ রক্ত এবং সূক্ষ্মতম অংশ হয় প্ৰাণ। ঘৃত প্রভৃতি তেজস্কর পদার্থ ভুক্ত হইয়া তিনভাগে বিভক্ত হয়। তাহার স্থূলতম অংশ অস্থি হয়, মধ্যম অংশ মজ্জা এবং সূক্ষ্মতম অংশ বাক্-এ পরিণত হয়।
৪৭২. অন্নময়ং হি সোম্য মন আপোময়ঃ প্রাণস্তেজোময়ী বাগিতি ভূয় এব মা ভগবান্ বিজ্ঞাপয়ত্বিতি তথা সোম্যেতি হোবাচ।। ৪
অন্বয় : অন্নময়ম্ হি সোম্য মনঃ; আপোময়ঃ (প্রাচীন প্রয়োগ অম্ময় = জলময়) প্রাণঃ তেজোময়ী বাক্ ইতি। ভূয়ঃ এব মা (আমাকে) ভগবান্ বিজ্ঞাপয়তু (বিজ্ঞাপন করুন) ইতি। তথা (সেই প্রকার হউক) সোম্য! ইতি হ উবাচ।
সরলার্থ : ‘সৌম্য, মন অন্নময়, প্রাণ জলময় এবং বাক্ তেজোময়।’ শ্বেতকেতু বলিলেন— ‘আপনি পুনরায় আমাকে বুঝাইয়া দিন।’ পিতা বলিলেন— ‘সৌম্য, তাহাই হউক।’
ষষ্ঠ খণ্ড – আদি দেবত্রয় হইতে মন, প্রাণ ও বাক্যের উৎপত্তি (পুনরুক্তি)
৪৭৩. দধ্নঃ সোম্য মধ্যমানস্য যোহণিমা স ঊর্ধ্বঃ সমুদীষতি তৎ সর্পিভবতি ॥১ 898. এবমেব খলু সোম্যান্নস্যাশ্যমানস্য যোহণিমা স ঊর্ধ্বঃ সমুদীষতি তন্মনো ভবতি ॥ ২
অন্বয় : দধ্নঃ (দধির) সোম্য! মধ্যমানস্য (যাহা মন্থন করা হইতেছে তাহার) যঃ (যাহা) অণিমা (সূক্ষ্মতম অংশ) সঃ ঊর্ধ্বঃ (ঊর্ধ্বদিকে) সমুদীষতি (উত্থিত হয়); তৎ (তাহা) সর্পিঃ (নবনীত) ভবতি (হয়)। এবম্ এব (এইরূপই) খলু সোম্য! অন্নস্য অশ্যমানস্য (ভুক্ত অন্নের) যঃ অণিমা, সঃ ঊর্ধ্বঃ সমুদীষতি; তৎ মনঃ ভবতি (১মঃ দ্রঃ)। [‘অণিমা’ শব্দের প্রচলিত অর্থ অণুর ভাব বা অণুত্ব। প্রাচীনকালে ‘অণুতম অংশ’ অর্থেও ইহা ব্যবহৃত হইত।
সরলার্থ : (১ম ও ২য় মন্ত্র)—দধি মন্থন করার সময় তাহর সূক্ষ্মতম অংশ উপরে উঠিয়া আসে; তাহা ঘৃত হয়। সৌম্য, এইভাবে ভুক্ত অন্নের সূক্ষ্মতম অংশ উপরদিকে উঠিয়া মনরূপে পরিণত হয়।
৪৭৫. অপাম্ সোম্য পীয়মানানাং যোহণিমা স ঊর্ধ্বঃ সমুদীষতি সা প্রাণো ভবতি ॥ ৩
৪৭৬. তেজসঃ সোম্যাশ্যমানস্য যোহণিমা স ঊর্ধ্বঃ সমুদীষতি সা বাগ্ ভবতি ॥ ৪
অন্বয় : অপাম্ (জলের) সোম্য, পীয়মানানাম্ (যাহা পান করা হয়, তাহার), যঃ অণিমা, সঃ ঊর্ধ্বঃ সমুদীষতি; সঃ প্রাণঃ ভবতি (১ম মঃ)। তেজসঃ (তেজের) সোম্য, অশ্যমানস্য [তেজসঃ] (ভুক্ত তেজের) যঃ অণিমা, সঃ ঊর্ধ্বঃ সমুদীষতি সা (তাহা) বাক্ ভবতি (১ম মন্ত্র দ্রঃ)।
সরলার্থ : (৩য় ও ৪র্থ মন্ত্র) — সৌম্য, যে জল পান করা হয়, তাহার সূক্ষ্মতম অংশ উপরদিকে উঠিয়া প্রাণরূপে পরিণত হয়। তেজস্কর বস্তু ভুক্ত হইলে তাহার যে সূক্ষ্মতম অংশ, তাহা উপরে উঠে এবং বাপে পরিণত হয়।
৪৭৭. অন্নময়ং হি সোম্য মন আপোময়ঃ প্রাণস্তেজোময়ী বাগিতি ভুয় এব মা ভগবান্ বিজ্ঞাপয়ত্বিতি তথা সোম্যেতি হোবাচ ॥ ৫
অন্বয় : অন্নময়ম্ হি সোম্য, মনঃ আপোময়ঃ প্রাণঃ, তেজোময়ী বাক্ ইতি। ভূয়ঃ এব মা ভগবান্ বিজ্ঞাপয়তু ইতি। তথা সোম্য! ইতি হ উবাচ (৬।৫।৪ দ্রঃ)
সরলার্থ : ‘সৌম্য, মন অন্নময়, প্রাণ জলময় এবং বাক্ তেজোময়।’ শ্বেতকেতু বলিলেন, ‘আপনি আবার আমাকে বুঝাইয়া দিন।’ পিতা বলিলেন, ‘তাহাই হউক।
সপ্তম খণ্ড – শ্বেতকেতুর অনশন ও পুনর্ভোজন দ্বারা উক্ত তত্ত্বের প্রমাণ
৪৭৮. ষোড়শকলঃ সোম্য পুরুষঃ পঞ্চদশাহানি মাশীঃ কামমপঃ পিবাপোময় প্রাণো ন পিবতো বিচ্ছেৎস্যত ইতি ॥ ১
অন্বয় : ষোড়শকলঃ (ষোল কলা যাহার) সোম্য, পুরুষঃ। পঞ্চদশ অহানি (পনের দিন) মা (না) অশীঃ (ভোজন করিও)। কামম্ (যথেচ্ছ) অপঃ (জল) পিব (পান কর)। আপোময়ঃ (জলময়) প্রাণঃ। ন (না) পিবতঃ (পানকারীর) বিচ্ছেৎস্যতে (বিচ্ছেদ হয় না) ইতি।
সরলার্থ : সৌম্য, পুরুষ ষোলকলাযুক্ত। পনের দিন ভোজন করিও না, কিন্তু যতটা ইচ্ছা জল পান করিও; কারণ প্রাণ জলময়। যে জল পান করে তাহার প্রাণ বিয়োগ হয় না।
৪৭৯. স হ পঞ্চদশাহানি নাশাথ হৈনমুপসসাদ কিং ব্রবীমি ভো ইত্যূচঃ সোম্য যজুংষি সামানীতি স হোবাচ ন বৈ মা প্রতিভান্তি ভো ইতি ॥ ২
অন্বয় : সঃ (সে) হ পঞ্চদশ + অহানি ন আশ (ভোজন করিল)। অথ হ এনম্ (ইহার নিকট) উপসসাদ (গমন করিল)। কিম্ (কি) ব্রবীমি (বলিব) ভোঃ ইতি। ঋচঃ (ঋমন্ত্রসমূহকে) সোম্য, যংষি (যজুর্মন্ত্রসমূহকে) সামানি (সামমন্ত্রসমূহকে) ইতি। সঃ হ উবাচ (বলিল)—ন (না) বৈ মা (আমার নিকট) প্রতিভান্তি (প্রতিভাত হইতেছে) ভোঃ ইতি।
সরলার্থ : শ্বেতকেতু পনের দিন ভোজন করিলেন না। তারপর পিতার নিকট যাইয়া বলিলেন—’পিতা, আমি কি বলিব?’ পিতা বলিলেন, ‘ঋক্, যজু ও সাম মন্ত্ৰ উচ্চারণ কর।’ শ্বেতকেতু বলিলেন—’ঐ সব আমার মনে হইতেছে না। ত
৪৮০. তং হোবাচ যথা সোম্য মহতোহভ্যাহিতস্যৈকোহঙ্গারঃ খদ্যোতমাত্রঃ পরিশিষ্টঃ স্যাত্তেন ততোহপি ন বহু দহেদেবং সোম্য তে ষোড়শানা কলানামেকা কলাতিশিষ্টা স্যাত্তয়ৈতর্দি বেদান্নানুভবস্যশানাথ মে বিজ্ঞাস্যসীতি ॥ ৩
অন্বয় : তম্ (তাহাকে) হ উবাচ (বলিলেন) যথা (যেমন); সোম্য, মহতঃ অভ্যাহিতস্য (মহান প্রজ্বলিত অগ্নির; অভ্যাহিত— ইন্ধনাদি দ্বারা পরিবর্ধিত) একঃ অঙ্গারঃ খদ্যোতমাত্রঃ (খদ্যোতপরিমিত আকাশে দ্যুতি প্রদান করে, এই জন্য জোনাকি পোকার নাম খদ্যোত) পরিশিষ্টঃ (অবশিষ্ট) স্যাৎ (থাকে); তেন (তাহা দ্বারা) ততঃ অপি (তাহা অপেক্ষাও) ন (না) বহু দহেৎ (দগ্ধ করে), এবম্ (এইপ্রকার) সৌম্য, তে (তোমার) ষোড়শানাম্ কলানাম্ (ষোল কলার) একা কলা (এক কলা) অতিশিষ্টা (অবিশষ্ট) স্যাৎ (ছিল); তয়া (তাহা দ্বারা) এতর্হি (এখন) বেদান্ (বেদসমূহ) ন অনুভবসি (বুঝিতে পারিতেছ)। অশান (ভোজন কর)। অথ মে (আমার কথা) বিজ্ঞাস্যসি (বিশেষভাবে বুঝিতে পারিবে) ইতি।
সরলার্থ : পিতা তাহাকে বলিলেন— ‘সৌম্য, যদি বিরাট ভাবে প্রজ্বলিত অগ্নির ছোট একখণ্ড অঙ্গার মাত্র অবশিষ্ট থাকে, তবে তাহা দ্বারা তাহার অপেক্ষা বড় কোন বস্তু দগ্ধ করা যায় না। তেমনি তোমার ষোলটি কলার একটি মাত্র অবশিষ্ট আছে। তাহাদ্বারা বেদসমূহ বুঝিতে পারিতেছ না। তুমি আহার কর, পরে আমার কথা বুঝিতে পারিবে।’
৪৮১. স হাশাথ হৈনমুপসসাদ তং হ যৎ কিংচ পপ্ৰচ্ছ সর্বং হ প্রতিপেদে ॥ ৪
৪৮২. তং হোবাচ যথা সোম্য মহতোহভ্যাহিতস্যৈকমঙ্গারং খদ্যোতমাত্রং পরিশিষ্টং তং তৃণৈরুপসমাধায় প্রাজ্বলয়েত্তেন ততোহপি বহু দহেৎ ॥ ৫
৪৮৩. এবং সোম্য তে ষোড়শানাং কলানামেকা কলাতিশিষ্টাভূৎ সাহন্নেনোপ- সমাহিতা প্রাজ্বালী তয়ৈতর্হি বেদাননুভবস্যন্নময়ং হি সোম্য মন আপোময়ঃ প্রাণস্তেজোময়ী বাগিতি তদ্ধাস্য বিজ্ঞজ্ঞাবিতি বিজ্ঞজ্ঞাবিতি॥৬
অন্বয় : সঃ হ আশ (ভোজন করিল)। অথ হ এনম্ উপসসাদ (২য় মঃ)। তম্ হ (তাহাকে) যৎ কিম্ চ (যাহা কিছু) পপ্রচ্ছ (জিজ্ঞাসা করিলেন) সর্বম্ হ (সমুদয়ই) প্রতিপেদে (বুঝিলেন)। তম্ হ (তাহাকে) উবাচ—যথা সোম্য, মহতঃ অভ্যাহিতস্য একম্ অঙ্গারম্ খদ্যোতমাত্রম্ পরিশিষ্টম্ (অবশিষ্ট) তম্ (সেই অঙ্গারকে) তৃণৈঃ (তৃণদ্বারা) উপসমাধায় (উপচিত করিল) প্রাজ্বলায়েত (প্ৰজ্বলিত হয়), তেন ততঃ অপি বহু দহেৎ এবম্ সোম্য, তে ষোড়শানাম্ কলানাম্ একা কলা অতিশিষ্টা অভূৎ (ছিল) (৩য় মঃ), সা (সেই কলা) অন্নেন (অন্নদ্বারা) উপসমাহিতা (বর্ধিত হইয়া) প্রাজ্বালী (বৈদিক প্রয়োগ; প্রাজ্বালী—প্রাজ্জ্বলিত হইয়াছে), তয়া এতর্হি বেদান্ অনুভবসি— (৩য় মঃ)। অন্নময়ম্ হি সোম্য; মনঃ আপোময়ঃ প্রাণঃ তেজোময়ী বাক্ ইতি (৬।৫।৪ দ্রঃ)। তৎ (এই বাক্যকে) হ অস্য (পিতার নিকট) বিজজ্ঞৌ (বুঝিয়াছিল)) ইতি, বিজজ্ঞৌ ইতি (দ্বিরুক্তি)।
সরলার্থ : (৪র্থ-৬ষ্ঠ মন্ত্ৰ) শ্বেতকেতু ভোজন করিয়া পিতার নিকট গেলেন। পিতা তাঁহাকে যাহা কিছু বলিলেন সেই সবই তিনি অনায়াসে বুঝিলেন। পিতা বলিলেন— ‘বিশাল প্রজ্বলিত অগ্নির অবশিষ্ট সেই অঙ্গারকে যদি তৃণদ্বারা বাড়ান যায় তবে তাহাদ্বারা তাহার অপেক্ষাও বেশি পরিমাণ বস্তু দগ্ধ করা যায়। তেমনি হে সৌম্য, তোমার ষোড়শ কলার এক কলা মাত্র অবশিষ্ট ছিল; তাহা অনুদ্বারা বর্ধিত হইয়া প্রজ্বলিত হইয়াছে। তাহার সাহায্যেই তুমি বেদ বুঝিতেছ। হে সৌম্য, মন অন্নময়, প্ৰাণ জলময় এবং বাক্ তেজোময়। (তখন শ্বেতকতু) পিতার উপদেশ বুঝিতে পারিলেন।
অষ্টম খণ্ড – সুষুপ্তি ও পান-ভোজনের দৃষ্টান্ত দ্বারা তত্ত্বমসি বাক্যের ব্যাখ্যা
৪৮৪. উদ্দালকো হারুণিঃ শ্বেতকেতুং পুত্রমুবাচ স্বপ্নান্তং মে সোম্য বিজানীহীতি যত্রৈতৎ পুরুষঃ স্বপিতি নাম সতা সোম্য তদা সম্পন্নো ভবতি স্বমপীতো ভবতি তস্মাদেনং স্বপিতীত্যাচক্ষতে স্বং হ্যপীতো ভবতি ॥ ১
অন্বয় : উদ্দালকঃ হ আরুণিঃ (অরুণের পুত্র উদ্দালক) শ্বেতকেতুম্ পুত্রম্ উবাচ— স্বপ্নান্তম্ (সুষুপ্তি-তত্ত্বকে) মে (আমার নিকট) সোম্য, বিজানীহি (অবগত হও) ইতি— যত্র (যে সময়ে) এতৎ পুরুষঃ (এই পুরুষ) স্বপিতি (সুষুপ্ত হয়) নাম (বাক্যালঙ্কারে) সতা (সৎস্বরূপ দ্বারা) সোম্য, তদা (সেই সময়ে) সম্পন্নঃ (সম্মিলিত) ভবতি (হয়), স্বম্ (আপনাকে; আত্মস্বরূপকে) অপীতঃ (প্রাপ্ত) ভবতি। তস্মাৎ (সেইজন্য) এনম্ (ইহাকে স্বপিতি ইতি আচক্ষতে (ইহা বলা হয়); স্বম্ হি অপীতঃ ভবতি।
সরলার্থ : উদ্দালক আরুণি পুত্র শ্বেতকেতুকে বলিলেন— সৌম্য, আমার নিকট সুষুপ্তিতত্ত্ব শোন। যখন পুরুষ নিদ্রিত হয়, তখন সে সৎস্বরূপের সহিত মিলিত হয়। সেই সময়ে সে স্বীয় রূপ (স্বম্ রূপম্) পায় (অপীতঃ)। এই জন্য লোকে ইঁহাকে বলে ‘সুষুপ্তি’ (স্বপতি—নিদ্রা যাইতেছে) — কারণ তখন সে স্ব-রূপ পায়।
মন্তব্য : (ক) ‘যত্র এতৎ পুরুষঃ’ ইত্যাদি— এই অংশের দুই প্রকার অন্বয় হইতে পারে। (১) যত্র এতৎ পুরুষঃ স্বপিতি নাম— যখন এই পুরুষ সুষুপ্ত হয়। নাম—বাক্যালঙ্কারে। (২) যত্র পুরুষঃ স্বপিতি এতৎ নাম— যখন পুরুষ ‘স্বপিতি’ এই নাম যুক্ত হয়।
(খ) ‘স্বপিত্তি’ এবং ‘স্বম্ অপীতঃ’ এই দুইটিকে একার্থসূচক বলা হইয়াছে। কিন্তু ইহাদিগের ধাত্বর্থ এক নহে। উচ্চারণে কিছু সাদৃশ্য আছে বলিয়া ঋষি বলিতেছেন — যে ব্যক্তির বিষয়ে বলা যায় ‘স্বপিতি” (নিদ্রা যাইতেছে) তাহার বিষয়েই বলা যাইতে পারে ‘স্বম্ অপীত’ (অর্থাৎ সে স্বরূপ প্রাপ্ত হইয়াছে)।
৪৮৫. স যথা শকুনিঃ সূত্রেণ প্রবদ্ধো দিশং দিশং পতিত্বান্যত্রায়তনমলা বন্ধনমেবোপশ্ৰয়ত এবমেব খলু সোম্য তন্মনো দিশং দিশ পতিত্বান্যত্রায়তনমলা প্রাণমেবোপশ্রয়তে প্রাণবন্ধনং হি সোম্য মন ইতি ॥ ২
অন্বয় : সঃ যথা (যেমন) শকুনিঃ (পক্ষী) সূত্রেণ (সূত্রদ্বারা) প্রবদ্ধঃ (আবদ্ধ হইয়া) দিশম্ দিশম্ (সর্বদিকে) পতিত্বা (উড়িয়া) অন্যত্র আয়তনম্ (আশ্রয়কে) অলম্বা (প্রাপ্ত না হইয়া) বন্ধনম্ এব (বন্ধনকেই) উপশ্রয়তে (আশ্রয় করে); এবম্ এব (এই প্রকারই) খলু সোম্য, তৎ মনঃ (এই মন, জীবাত্মা) দিশম্ দিশম্ পতিত্বা অন্যত্র আয়তনম্ অলব্ধা প্রাণম্ এব উপশ্রয়তে। প্রাণবন্ধনম্ (প্রাণের সহিত বন্ধন যাহার) হি সোম্য, মনঃ ইতি।
সরলার্থ : সূতায় বাঁধা পাখি যেমন এদিক ওদিক উড়ে, কিন্তু অন্য কোথাও আশ্রয় না পাইয়া শেষে সেই বন্ধন স্থানেই আশ্রয় নেয়, তেমনি এই মন চারিদিকে ঘুরিয়া যখন কোথাও আশ্রয় না পায়, তখন প্রাণকেই অবলম্বন করে। হে সৌম্য, মন প্রাণেই আবদ্ধ হইয়া রহিয়াছে।
৪৮৬. অশনাপিপাসে মে সোম্য বিজানীহীতি যত্রৈত পুরুষোঽশিশিষতি নামাপ এব তদশিতং নয়ন্তে তদ্্যথা গোনায়োহশ্বনায়ঃ পুরুষনায় ইত্যেবং তদপ আচক্ষতেহশনায়েতি তত্রৈতচ্ছৃঙ্গমুৎপতিতং সোম্য বিজানীহি নেদমমূল ভবিষ্যতীতি ॥ ৩
অন্বয় : অশনা—পিপাসে (ক্ষুধা ও পিপাসাকে; এস্থলে ‘আশনা’ বৈদিক প্ৰয়োগ; অশনায়া—ভোজন করিবার ইচ্ছা) মে (আমার নিকট) সোম্য; বিজানীহি (অবগত হও) ইতি। যত্র (যখন) এতৎ পুরুষঃ (এই পুরুষ) অশিশিষতি (ক্ষুধার্ত হয়) নাম, আপঃ (জল) এব তৎ অশিতম্ (সেই ভুক্ত খাদ্যকে) নয়ন্তে (যথাস্থানে লইয়া যায়)। তৎ যথা (যেমন ৪।১৬।৩ মন্তব্য) গোনায়ঃ অশ্বনায়ঃ, পুরুষনায়ঃ ইতি (এই সমুদয় বলা হয়), এবম্ (এই প্রকার) তং (সেইজন্য) অপঃ (জলকে) আচক্ষতে (বলা হয়) অশনায় ইতি। তত্র (সেই বিষয়ে) এবং শুঙ্গম্ (এই অঙ্কুর শরীর) উৎপতিতম্ (উৎপন্ন হইয়াছে) সোম্য, বিজানীহি (জানিও)। ন (না) ইদম্ (ইহা) অমূলম (মূলবিহীন) ভবিষ্যতি (হইবে) ইতি।
সরলার্থ : সৌম্য, ক্ষুধা ও তৃষ্ণার কথা আমার নিকট শোন। যখন পুরুষ ক্ষুধার্ত হয় তখনই জলই অনুকে (যথাস্থানে বা যথাকার্যে) চালাইয়া নিয়া যায় (অর্থাৎ ঐ অন্নের নেতা হয়)। যেমন (গো-নেতাকে) ‘গোনায়’, (অশ্ব-নেতাকে) ‘অশ্বনায়’, (পুরুষের নেতাকে) ‘পুরুষনায়” (বলা হয়), তেমনি জলকে ‘অশনায়’ অর্থাৎ অশনের (অন্ন বা খাদ্যের) নেতা বলা হয়। এই ভাবে এই অঙ্কুর (রূপ-শরীর) উৎপন্ন হয়। (এই শরীর) কারণবিহীন নহে।
মন্তব্য : যত্র এতৎ পুরুষঃ ইত্যাদি— এই অংশের দুই প্রকার অন্বয় হইতে পারে— (ক) যত্র এতৎ পুরুষঃ অশিশিষতি নাম— যখন এই পুরুষ ক্ষুধার্ত হয়; ‘নাম’ বাক্যালঙ্কারে। (খ) যত্র পুরুষঃ অশিশিষ্যতি এতৎ নাম— যখন পুরুষ ‘অশিশিষতি ‘ (ক্ষুধার্ত হয়) এই নামযুক্ত হয়। (৬।৮।১ মন্তব্য দ্রষ্টব্য)।
৪৮৭. তস্য ক্ব মূলং স্যাদন্যত্রান্নাদেবমেব খলু সোম্যান্নেন শৃঙ্গেনাপো মূলমন্বিচ্ছাড়িঃ সোম্য শুঙ্গেন তেজো মূলমন্বিচ্ছ তেজসা সোম্য শুঙ্গেন সন্মুলমন্বিচ্ছ সন্মূলাঃ সোম্যেমাঃ সর্বাঃ প্রজা সদায়তনাঃ সৎপ্রতিষ্ঠাঃ ॥ ৪
অন্বয় : তস্য (সেই দেহের) ক্ব (কোথায়) মূলম্ (কারণ) স্যাৎ (হইবে) অন্যত্র অন্নাৎ (অন্ন হইতে) এবম্ এব খলু (এই প্রকারেই) সোম্য, অন্নেন শুঙ্গেন (অনুরূপ অঙ্কুর দ্বারা) অপঃ মূলম (মূলস্বরূপ জলকে) অন্বিচ্ছ (অনুসন্ধান কর)। অদ্ভিঃ সোম্য, শুঙ্গেন [অদ্ভিঃ] (জলরূপ অঙ্কুর দ্বারা) তেজঃ মূলম্ (তেজোরূপ মূলকে) অন্বিচ্ছ। তেজসা সোম্য, শুঙ্গেন (হে সোম্য, তেজোরূপ অঙ্কুর দ্বারা) সৎমূলম্ (কারণরূপী সৎস্বরূপকে) অন্বিচ্ছ। সন্মূলাঃ (সৎমূলক) সোম্য, ইমাঃ সর্বাঃ (এই সমুদয়) প্রজাঃ (জন্মবান্ পদার্থ) সৎ আয়তনাঃ (সৎ যাহাদিগের আয়তন অর্থাৎ আশ্রয়) সৎ-প্রতিষ্ঠাঃ (সৎ-ই যাহাদিগের প্রতিষ্ঠা। প্রতিষ্ঠা— সম্যক্, স্থিতি; শঙ্করের মতে—লয়)।
সরলার্থ : অন্ন ছাড়া এই দেহের মূল কোথায়? হে সৌম্য অনুরূপ অঙ্কুর দ্বারা ইহার কারণস্বরূপ জলকে জান। এই জলরূপ অঙ্কুর দ্বারা মূলস্বরূপ তেজকে জান। এই অঙ্কুররূপ তেজ দ্বারা সৎস্বরূপ মূলকে জান। সৎস্বরূপই এই চরাচরের মূল, আশ্রয় এবং প্রতিষ্ঠা।
৪৮৮. অথ যত্রৈতৎ পুরুষঃ পিপাসতি নাম তেজ এব তৎ পীতং নয়তে তদ্যথা গোনায়োহশ্বনায়ঃ পুরুষনায় ইত্যেবং তত্তেজ আচষ্ট উদন্যেতি তত্রৈতদেব শুঙ্গমুৎপতিতং সোম্য বিজানীহি নেদমমূলং ভবিষ্যতীতি ॥ ৫
অন্বয় : অথ (তাহার পর) যত্র (যখন) এতৎ পুরুষঃ পিপাসতি (তৃষ্ণার্ত হয়) নাম তেজঃ এব (তেজই) তৎপীতম্ (সেই পীত জলকে) নয়তে (লইয়া যায়, নেতা হয়) তৎ যথা (যেমন) গোনায়ঃ (গো-নেতা) অশ্বনায়ঃ (অশ্ব-নেতা) পুরুষনায়ঃ (পুরুষনেতা) ইতি — এবম্ (এই প্রকার) তৎ তেজঃ (সেই তেজকে) আচষ্টে (বলা হয়) উদন্যা (উদক-নেতা) ইতি। তত্র (সেই বিষয়ে, সেইরূপে) এতৎ এব শুঙ্গম্ উৎপতিতম্ সোম্য, বিজানীহি ন ইদম্ অমূলম্ ভবিষ্যতি ইতি।
সরলার্থ : যখন পুরুষ তৃষ্ণার্ত হয়, তখন তেজই পীত জলের নেতা হয় অর্থাৎ জলকে লইয়া যায়। যেমন (গো-নেতাকে) ‘গো-নায়’, (অশ্ব-নেতাকে) ‘অশ্ব-নায়’, (পুরুষনেতাকে) ‘পুরুষনায়’ বলা হয়; তেমনি জলের নেতারূপী সেই তেজকে ‘উদন্যা’ বলা হয়। এইভাবে এই দেহরূপ অঙ্কুর উৎপন্ন হয়। হে সৌম্য, জানিও, ইহা মূলবিহীন নহে।
মন্তব্য : ‘যত্র এতৎ পুরুষঃ পিপাসতি নাম’— এই অংশের দুই প্রকার অন্বয় হইতে পারে—(ক) যত্র এতৎ পুরুষঃ পিপাসতি নাম—যখন এই পুরুষ পিপাসিত হয়, ‘নাম’ বাক্যালঙ্কারে। (খ) পুরুষঃ পিপাসতি এতৎ নাম—যখন পুরুষ ‘পিপাসতি’ (পিপাসিত হয়) এই নামযুক্ত হয়।
৪৮৯. তস্য ক্ব মূলং স্যাদন্যত্রাদ্ভোঽদ্ভিঃ সোম্য শুঙ্গেন তেজো মূলমন্বিচ্ছ তেজস্যা সোম্য শুঙ্গেন সন্মূলমন্বিচ্ছ সন্মুলাঃ সোম্যেমাঃ সর্বাঃ প্রজাঃ সদায়তনাঃ সৎপ্রতিষ্ঠা যথা তু খলু সোম্যেমাস্তিস্রো দেবতাঃ পুরুষং প্রাপ্য ত্রিবৃৎ ত্রিবৃদেকৈকা ভবতি তদুক্তং পুরস্তাদেব ভবত্যস্য সোম্য পুরুষস্য প্রয়তো বাঘনসি সম্পদ্যতে মনঃ প্রাণে প্রাণস্তেজসি তেজঃ পরস্যাং দেবতায়াম্ ॥ ৬
অন্বয় : তস্য (সেই দেহের) ক্ব (কোথায়) মূলম্ স্যাৎ অন্যত্র অভ্যঃ (জল ভিন্ন অন্যত্র)? অদ্ভিঃ সোম্য? শুঙ্গেন (হে সোম্য, জলরূপ শুঙ্গ দ্বারা) তেজঃ মূলম্ (কারণরূপ তেজকে) অন্বিচ্ছ (অন্বেষণ কর)। তেজস্য সোম্য শুঙ্গেন (হে সোম্য, তেজোরূপ শুঙ্গ দ্বারা) সৎ মূলম্ (কারণরূপ সৎস্বরূপকে) অন্বিচ্ছ। সৎ-মূলাঃ সোম্য! ইমাঃ সর্বাঃ প্রজাঃ (এই সমুদয় প্রজা; প্রজা— উৎপন্ন বস্তু) সৎ-আয়তনাঃ সৎ-প্রতিষ্ঠাঃ। যথা (যে প্রকার) তু খলু সোম্য ইমাঃ তিস্রঃ দেবতাঃ (এই তিন দেবতা) পুরুষম্ প্রাপ্য (প্রাপ্ত হইয়া) ত্রিবৃৎ ত্রিবৃৎ একা-একা (প্রত্যেক) ভবতি, তৎ (তাহা) উক্তম্ (উক্ত) পুরস্তাৎ এব (পূর্বেই) ভবতি। অস্য সোম্য পুরুষস্য প্রযতঃ (হে সৌম্য, এই মুমূর্ষু পুরুষের) বাক্ মনসি (মনে সম্পদ্যতে (সম্মিলিত হয়), মনঃ প্রাণে, প্রাণঃ তেজসি (তেজে) তেজঃ পরস্যাম্ দেবতায়াম্ (পরম দেবতাতে)।
সরলার্থ : জল ভিন্ন এই দেহের মূল আর কোথায়? হে সৌম্য, জলরূপ অঙ্কুর দ্বারা কারণরূপ তেজকে অন্বেষণ কর; তেজরূপ অঙ্কুর দ্বারা কারণরূপ সৎ-স্বরূপকে অন্বেষণ কর। চরাচর এই সমস্তই সৎ হইতে উৎপন্ন, সতে আশ্রিত ও সতে বিলীন হয়। এই তিন দেবতা পুরুষকে পাইয়া প্রত্যেকে যে ভাবে ‘ত্রিবৃৎ ত্রিবৃৎ’ হয় তাহা পূৰ্বেই বলা হইয়াছে। মুমূর্ষু পুরুষের বাক্ মনের সহিত মিলিত হয়, মন প্রাণের সহিত, প্ৰাণ তেজের সহিত এবং তেজ পরম দেবতায় মিলিত হয়।
৪৯০. সঃ যঃ এষোহণিমৈতদাত্ম্যমিদং সর্বং তৎ সত্যং স আত্মা তত্ত্বমসি শ্বেতকেতো ইতি ভূয় এব মা ভগবান্ বিজ্ঞাপয়ত্বিতি তথা সোম্যেতি হোবাচ। ৭
—
অন্বয় : সঃ যঃ (২।১১।২ মন্তব্য) এষঃ (এই) অণিমা (সূক্ষ্মতম বস্তু), এতৎ + আত্ম্যম্ (এতদ্ ইহা, এই ব্ৰহ্ম; ‘এতদ্’ যাহার আত্মা, তাহাই ‘এতদাত্ম’; ঐতদাত্ম্যম্— এতদাত্মার ভাব) ইদম্ সর্বম্ (এই সমুদয়); তৎ (তাহা) সত্যম্ সঃ আত্মা তত্ত্বমসি (তৎ + ত্বম্ + অসি; তৎ—তাহা; ত্বম্— তুমি; অসি—হও) শ্বেতকেতো, ইতি। ভূয় এব মা ভগবান্ বিজ্ঞাপয়তু ইতি। তথা সোম্য ইতি হ উবাচ। [‘অণিমা’ বিষয়ে ৬।৬।১-এর অন্বয় দ্রষ্টব্য]।
সরলার্থ : এই যে সূক্ষ্মতম বস্তু ইহাই সমস্ত জগতের আত্মা। তিনিই সত্য, তিনিই আত্মা। হে শ্বেতকেতু, তুমিই তিনি। শ্বেতকেতু বলিল— “ভগবান, আপনি আবার আমাকে উপদেশ দিন।’ পিতা বলিলেন ‘সোম্য, তাহাই হউক’।
নবম খণ্ড – মধুচক্র ও জীব-বৈচিত্র্যের দৃষ্টান্ত দ্বারা ‘তত্ত্বমসি’ বাক্যের ব্যাখ্যা
৪৯১. যথা সোম্য মধু মধুকৃতো নিস্তিষ্ঠন্তি নানাত্যয়ানাং বৃক্ষাণাং রসান্ সমবহারমেকতাং রসং গময়ন্তি ॥ ১
৪৯২. তে যথা তত্র ন বিবেকং লভন্তেহমুষ্যাহং বৃক্ষস্য রসোঽস্ম্যমৃষ্যাহং বৃক্ষস্য রসোহমীত্যেবমেব খলু সোম্যেমাঃ সর্বাঃ প্রজাঃ সতি সম্পদ্য ন বিদুঃ সতি সম্পদ্যামহ ইতি ॥ ২
অন্বয় : যথা (যে প্রকার) সোম্য, মধু মধুকৃতঃ (মধু মক্ষিকাগণ) নিস্তিষ্ঠন্তি (প্রস্তুত করে) নানা অত্যয়ানাম্ (নানাগতি সম্পন্ন, নানাবিধ) বৃক্ষাণাম্ (বৃক্ষসমূহের রসান্ (রসসমূহকে) সম্ অবহারম্ (সংগ্রহ করিয়া) একতাম্ (একভাব রসম্ (রসকে গময়ন্তি (প্রাপ্ত করায়)। তে (তাহারা) যথা (যেমন) তত্র (সেইস্থলে) ন (না) বিবেকম্ (জ্ঞান, পার্থক্যবোধ) লভন্তে (লাভ করে) অমুষ্য (অমুক) অহম্ (আমি) বৃক্ষস্য (বৃক্ষের রসঃ অস্মি (হই) ইতি এবম্ এব খলু (এই প্রকারই) সোম্য! ইমাঃ সর্বাঃ প্রজাঃ (এই সমুদয় প্রাণীঃ) সতি (সৎস্বরূপে) সম্পদ্য (মিলিত হইয়া) ন বিদুঃ (জানে না) সতি সম্পদ্যামহে (মিলিত হইয়াছি)।
সরলার্থ : (১ম ও ২য় মন্ত্র)— সৌম্য, মৌমাছিরা নানা বৃক্ষের রস আহরণ করিয়া একত্র করিলে যেমন রসসমূহের ‘আমি অমুক বৃক্ষের রস’—এইরকম কোন পৃথক পরিচয় থাকে না, তেমনি প্রাণিগণ (সুষুপ্তি সময়ে) সৎ-স্বরূপকে পাইয়াও ‘আমরা সৎস্বরূপকে পাইয়াছি’ ইহা জানিতে পারে না।
৪৯৩. ত ইহ ব্যাঘ্ৰো বা সিংহো বা বৃকো বা বরাহো বা কীটো বা পতঙ্গো বা দংশো বা মশকো বা যদ্ যদ্ভবন্তি তদাভবন্তি ॥ ৩
অন্বয় : তে (তাহারা) ইহ (ইহলোকে) ব্যাঘ্রঃ বা, সিংহঃ বা, বৃকঃ বা, বরাহঃ বা, কীটঃ বা, পতঙ্গঃ বা, দংশঃ বা (ডাঁশ), মশকঃ বা—যৎ যৎ (যাহা যাহা) ভবন্তি (হয়, ছিল), তৎ (তাহা) আভবন্তি (পুনর্বার হয়)।
সরলার্থ : বাঘ, সিংহ, বৃক, বরাহ, কীট, পতঙ্গ, ডাঁস বচা মশক—ইহলোকে (সুষুপ্তির পূর্বে) যে যেভাবে ছিল, সুষুপ্তির পর জাগ্রত হইয়াও সেই সেই ভাবই পায়।
৪৯৪. স য এষোহণিমৈতদাত্ম্যমিদং সর্বং তৎ সত্যং স আত্মা তত্ত্বমসি শ্বেতকেতো ইতি ভূয় এব মা ভগবান্ বিজ্ঞাপয়ত্বিতি তথা সোম্যেতি হোবাচ ॥ ৪
অন্বয় : সঃ যঃ এষঃ ইত্যাদি ৬।৮।৭ মন্ত্র দ্রষ্টব্য।
সরলার্থ : এই যে সূক্ষ্মতম সৎবস্তু, ইহাই সমস্ত জগতের আত্মা; তিনিই সত্য, তিনিই আত্মা। হে শ্বেতকেতু, তুমিই তিনি। শ্বেতকেতু বলিল—’আপনি আবার আমাকে উপদেশ দিন।’ পিতা বলিলেন-’তাহাই হউক।”
দশম খণ্ড – নদীর উৎপত্তি-বিলয় ও জীব-বৈচিত্র্যের দৃষ্টান্ত দ্বারা ‘তত্ত্বমসি’ বাক্যের ব্যাখ্যা
৪৯৫. ইমাঃ সোম্য নদ্যঃ পুরস্তাৎ প্রাচ্যঃ স্যন্দন্তে পশ্চাৎ প্রতীচ্যস্তাঃ সমুদ্রাৎ সমুদ্রমেবাপিযন্তি স সমুদ্র এব ভবতি তা যথা তত্র ন বিদুরিয়মহম্
অস্মীতি। এবমেব খলু সোম্যেমাঃ সর্বাঃ প্রজাঃ সত আগম্য ন বিদুঃ সত আগচ্ছামহ ইতি ॥ ১
অন্বয় : ইমাঃ (এই) সোম্য, নদ্যঃ (নদীসমূহ) পুরস্তাৎ (পূর্বদিকে) প্রাচ্যঃ (প্রাচ্য দেশস্থ) স্যন্দন্তে (প্রবাহিত হয়); পশ্চাৎ (পশ্চিমদিক) প্রতীচ্যঃ (পশ্চিম দেশস্থ) তাঃ (তাহারা) সমুদ্রাৎ (সমুদ্র হইতে ‘উৎপন্ন হইয়া’) সমুদ্রম্ এব (সমুদ্রেই) অপিযন্তি (গমন করে) সঃ (সে) সমুদ্রঃ এব (সমুদ্রই) ভবতি (হয়); তাঃ (তাহারা) যথা তত্ৰ ন বিদুঃ (জানে), ইয়ম্ (এই) অ (আমি) অস্মি (হই) ইতি এবম্ এব খলু সোম্য ইমাঃ সর্বাঃ প্রজাঃ সতঃ (সৎ হইতে) আগম্য (আসিয়া) ন বিদুঃ সতঃ আগচ্ছামহে (আসিয়াছি) ইতি।
সরলার্থ : হে সৌম্য, পূর্বদেশের সব নদী পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়, পশ্চিমদেশের নদী পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়। তাহারা সমুদ্র হইতে উৎপন্ন হইয়া আবার সমুদ্রেই যায় এবং সমুদ্রই হইয়া যায়। তখন তাহারা যেমন জানিতে পারে না যে, ‘আমি এই নদী’, ‘আমি এই নদী’— তেমনি হে সৌম্য, জীবগণ সৎস্বরূপ হইতে আসিয়া জানিতে পারে না যে,— ‘আমরা সৎস্বরূপ হইতে আসিয়াছি’।
৪৭৬. ত ইহ ব্যাঘ্ৰো বা সিংহো বা বৃকো বা বরাহো বা কীটো বা পতঙ্গো বা দংশো বা মশকো বা যদ্ যদ্ভবন্তি তদাভবন্তি ॥ ২
অন্বয় : ‘ত হই” ইত্যাদি— ৬।৯।৩ অন্বয় দ্রষ্টব্য।
সরলার্থ : বাঘ, সিংহ, বৃক, কীট, পতঙ্গ, ডাঁশ বা মশক— ইহারা ইহলোকে সুষুপ্তির পূর্বে যে যে ভাবে ছিল সুষুপ্তির পর জাগ্রত হইলেও সে সেই ভাবই পায়।
৪৯৭. স য এষোহণিমৈতদাত্ম্যমিদং সর্বং তৎ সত্যং স আত্মা তত্ত্বমসি শ্বেতকেতো ইতি ভূয় এব মা ভগবান্ বিজ্ঞাপয়ত্বিতি তথা সোম্যেতি হোবাচ ॥ ৩
অন্বয় : ‘সঃ যঃ অণিমা’ ইত্যাদি— ৬।৮।৭ অন্বয় দ্রষ্টব্য।
সরলার্থ : এই যে সূক্ষ্মতম সৎবস্তু, ইহাই নিখিল জগতের আত্মা, তিনিই সত্য, তিনিই আত্মা। হে শ্বেতকেতু, তুমিই তিনি। শ্বেতকেতু বলিল— ‘ভগবান্, আপনি আবার আমাকে উপদেশ দিন।’ পিতা বলিলেন— ‘তাহাই হউক
একাদশ খণ্ড – বৃক্ষের জীবন-মৃত্যুর দৃষ্টান্ত দ্বারা ‘তত্ত্বমসি’ বাক্যের ব্যাখ্যা
৪৯৮. অস্য সোম্য মহতো বৃক্ষস্য যো মূলেহত্যাঽন্যাজ্জীবন্ সুবেদ্ যো মধ্যেহভ্যাহন্যাজ্জীবন্ সুবেদ্ যোহগ্রেহভ্যাহন্যাজ্জীবন্ সুবেৎ স এষ জীবেনাত্মনানু প্রভূতঃ পেপীয়মানো মোদমানস্তিষ্ঠিতি ॥১
অন্বয় : অস্য সোম্য, মহতঃ বৃক্ষস্য (এই মহান বৃক্ষের) যঃ (যে কেহ) মূলে অভ্যাহন্যাৎ (আঘাত করে), জীবন্ (জীবনধারণ করিয়া) স্রবেৎ (রস ক্ষরণ করে)। যঃ মধ্যে অভ্যাহন্যাৎ জীবন্ স্রবেৎ। যঃ অগ্রে অভ্যাহন্যাৎ জীবন্ স্রবেৎ সঃ এষঃ (সেই বৃক্ষ) জীবনের আত্মনা (জীবিত আত্মা দ্বারা, জীবাত্মা দ্বারা) অনুপ্রভূতঃ (অনুব্যাপ্ত হইয়া) পেপীয়মানঃ (ক্রমাগত রস পান করিয়া) মোদমানঃ (হর্ষযুক্ত হইয়া) তিষ্ঠতি (অবস্থান করে)।
সরলার্থ : হে সোম্য, এই বিশাল বৃক্ষের মূলে যদি কেহ আঘাত করে, তবে সে বাঁচিয়া থাকিয়াই রস ক্ষরণ করে; যদি কেহ তাহার মাঝখানে আঘাত করে, তখনও সে বাঁচিয়া থাকিয়াই রস ক্ষরণ করে; যদি কেহ তাহার মাথার দিকে আঘাত করে, তবেও সে বাঁচিয়া থাকিয়াই রস ক্ষরণ করে। এই বৃক্ষ জীবাত্মা কর্তৃক অনুব্যাপ্ত হইয়া অবিরাম রসপান করিয়া সানন্দে অবস্থান করে।
৪৯৯. অস্য যদেকাং শাখাং জীবো জহাত্যথ সা শষ্যতি দ্বিতীয়াং জহাত্যথ সা শষ্যতি তৃতীয়াং জহাত্যথ সা শুষ্যতি সর্বং জহাতি সর্বঃ শুষ্যতি ॥ ২
অন্বয় : অস্য (এই বৃক্ষের) যৎ (যখন) একাম্ শাখাম্ (এক শাখাকে) জীবঃ জহাতি (ত্যাগ করে), অথ সা (সেই শাখা) শুষ্যতি (শুষ্ক হয়); দ্বিতীয়াম্ (দ্বিতীয় শাখাকে জহাতি অথ সা শুষ্যতি; তৃতীয়াম্ (তৃতীয় শাখাকে) জহাতি, অথ সা শষ্যতি; সর্বম্ (সমুদয়কে) জহাতি, সর্বঃ (সমুদয় বৃক্ষ) শষ্যতি।
সরলার্থ : যদি জীব এই বৃক্ষের এক শাখা পরিত্যাগ করে, তবে সেই শাখা শুকাইয়া যায়; যদি দ্বিতীয় শাখা পরিত্যাগ করে, তবে দ্বিতীয় শাখাও শুকাইয়া যায়, তৃতীয় শাখা পরিত্যাগ করিলে তাহাও শুকায় এবং যদি সমস্ত বৃক্ষকে পরিত্যাগ করে, তবে সমস্তটিই শুকাইয়া যায়।
৫০০. এবমেব খলু সোম্য বিদ্ধীতি হোবাচ জীবাপেতং বাব কিলেদং ম্রিয়তে ন জীবো ম্রিয়ত ইতি স য এষোহণিমৈতদাত্ম্যমিদং সর্বং তৎ সত্যং স আত্মা তত্ত্বমসি শ্বেতকেতো ইতি ভূয় এব মা ভগবান্ বিজ্ঞাপয়ত্বিতি তথা সোম্যেতি হোবাচ ॥ ৩
অন্বয় : এবম্ এব (এই প্রকারই) খলু সোম্য, বিদ্ধি (জানিও) ইতি উবাচ (বলিয়াছিলেন)— জীব অপেতম্ (জীব কর্তৃক পরিত্যক্ত হইয়া; অপেত— চলিয়া যাওয়া) বাব কিল ইদম্ (এই দেহ) ম্রিয়তে (মৃত হয়); ন (না) জীবঃ ম্রিয়তে ইতি। সঃ যঃ এষঃ — ইত্যাদি পূর্ববৎ (৬।৮। ৭ মঃ দ্রঃ)।
সরলার্থ : পিতা বলিলেন, “হে সৌম্য, এইকথা জানিও — জীব কর্তৃক পরিত্যক্ত হইলে এই দেহ মরিয়া যায়, কিন্তু জীব মরে না। এই যে সূক্ষ্মতম বস্তু ইহাই সমস্ত জগতের আত্মা। তিনিই সত্য তিনিই আত্মা। হে শ্বেতকেতু, তুমিই তিনি।’ শ্বেতকেতু বলিল— ‘আবার আমাকে উপদেশ দিন।’ পিতা বলিলেন, ‘তাহাই হউক।’
দ্বাদশ খণ্ড – ন্যগ্রোধ বৃক্ষবীজের দৃষ্টান্ত দ্বারা ‘তত্ত্বমসি’ বাক্যের ব্যাখ্যা
৫০১. ন্যগ্রোধফলমত আহরেতীদং ভগব ইতি ভিন্ধীতি ভিন্নং ভগব ইতি কিমত্র পশ্যসীত্যন্য ইবেমা ধানা ভগব ইত্যাসামঙ্গৈকাং ভিন্ধীতি ভিন্না ভগব ইতি কিমত্র পশ্যসীতি ন কিঞ্চন ভগব ইতি ॥ ১
অন্বয় : ন্যগ্রোধফলম্ অতঃ (এই বৃক্ষ হইতে) আহর (আহরণ কর) ইতি। ইদম্ (এই) ভগবঃ! ইতি। ভিন্ধি (ভাঙ) ইতি। ভিন্নম্ (ভাঙা হইয়াছে) ভগবঃ ইতি। কিম্ (কি) অত্র (এখানে) পশ্যসি (দেখিতেছ) ইতি। অন্যঃ ইব (অণুর ন্যায়; অতি সূক্ষ্ম) ইমাঃ ধানাঃ (এই বীজসমূহ) ভগবঃ ইতি। আসাম্ (এই ‘ধানা’ অর্থাৎ বীজসমূহের) অঙ্গ (অব্যয়, সাম্বোধনে) একাম্ (একটি বীজকে) ভিন্ধি ইতি। ভিন্না (ভাঙা হইয়াছে ভগবঃ ইতি। কিম্ অস্য পশ্যসি? ইতি ন কিম্ চন (কিছুই না) ভগবঃ ইতি।
সরলার্থ : উদ্দালক বলিলেন— ‘এই বটবৃক্ষ হইতে একটি ফল নিয়া আস।’ শ্বেতকেতু বলিল, ‘ভগবান্, আনিয়াছি।’ উ। ‘ইহা ভাঙিয়া ফেল।’ শ্বে। ‘ভাঙিয়াছি। উ। ‘এখানে কি দেখিতেছ?’ শ্বে। ‘অণুর মত সব বীজ’। উ। ‘ইহাদিগের একটি ভাঙ।’ শ্বে। ‘ভগবান্, ভাঙা হইয়াছে।’ উ। ‘কি দেখিতেছ?’ শ্বে। ‘কিছুই না।’
৫০২. তং হোবাচ যং বৈ সোম্যৈতমণিমানং ন নিভালয়স এতস্য বৈ সোম্যৈষোহণিম্ন এবং মহান্যগ্রোধস্তিষ্ঠতি শ্রদ্ধস্ব সোম্যেতি ॥ ২
অন্বয় : তম্ (তাহাকে, পুত্রকে) হ উবাচ (বলিলেন) — যম্ (যাহাকে) বৈ সোম্য! এতম্ অণিমানম্ (এই অণু পরিমাণকে) ন (না) নিভালয়সে (দেখিতেছ), এতস্য [অণিম্নঃ] (এই অণুপরিমাণের) এবম্ (এই প্রকার) মহান্যগ্রোধঃ তিষ্ঠতি (বর্তমান আছে) শ্রদ্ধস্থ (শ্রদ্ধাযুক্ত হও) সোম্য, ইতি।
সরলার্থ : উদ্দালক বলিলেন— হে সৌম্য, বীজের মধ্যে যে সূক্ষ্মতম অংশ আছে, তাহা তুমি দেখিতেছ না। এই সূক্ষ্মতম অংশেই বিরাট বটবৃক্ষ রহিয়াছে। সৌম্য, শ্রদ্ধাযুক্ত হও।
৫০৩. স য এষোহণিমৈতদাত্ম্যমিদং সর্বং তৎ সত্যং স আত্মা তত্ত্বমসি শ্বেতকেতো ইতি ভূয়ো এব মা ভগবান্ বিজ্ঞাপয়ত্বিতি তথা সোম্যেতি হোবাচ ॥ ৩
অন্বয় : ‘সঃ যঃ এষঃ’ ইত্যাদি (৬।৮।৭ দ্রঃ)
সরলার্থ : এই যে অণিমা, ইহাই অখিল জগতের আত্মা। তিনিই সত্য, তিনিই আত্মা। হে শ্বেতকেতু, ‘তুমিই তিনি।’ শ্বেতকেতু বলিল, ‘ভগবান্, আবার আমাকে উপদেশ দিন।’ পিতা বলিলেন, ‘তাহাই হউক।’
ত্রয়োদশ খণ্ড – লবণাক্ত জলের দৃষ্টান্ত দ্বারা ‘তত্ত্বমসি’ বাক্যের ব্যাখ্যা
৫০৪. লবণমেতদুদকেহবধায়াথ মা প্রাতরুপসীদথা ইতি স হ তথা চকার তং হোবাচ যদ্ধোষা লবণমুদকেহবাধা অঙ্গ তদাহরেতি তদ্ধাবমৃশ্য ন বিবেদ যথা বিলীনমেব ॥ ১
অন্বয় : লবণম্ এতৎ (এই লবণকে) উদকে (জলে) অবধায় (নিক্ষেপ করিয়া) অথ মা (আমার নিকট) প্রাতঃ উপসীদথাঃ (বৈদিক প্রয়োগ; উপসীদ কিংবা উপসীদেঃ আসিও) ইতি। সঃ (শ্বেতকেতু) হ তথা (সেই প্রকার) চকার (করিল)। তম্ (তাহাকে) হ উবাচ (বলিলেন)—যৎ [লবণম্] (যে লবণকে) দোষা (রাত্রিতে) লবনম্ উদকে অবাধাঃ (নিক্ষেপ করিয়াছিলে) অঙ্গ (হে পুত্র) তৎ (তাহা) আহর (আনয়ন কর) ইতি। তৎ (তাহাকে) হ অবমৃশ্য (অনুসন্ধান করিয়া) ন (না) বিবেদ (প্রাপ্ত হইল; ‘অবগত হইল’) যথা (যেহেতু) বিলীনম্ এব (বিলীনই হইয়াছিল)।
সরলার্থ : উদ্দালক বলিলেন—’এই লবণখণ্ড জলে রাখিয়া পরদিন সকালে আমার নিকট আসিবে।’ শ্বেতকেতু তাহাই করিল। উদ্দালক তাহাকে বলিলেন, ‘রাত্রিতে জলে যে লবণ রাখিয়াছিলে, তাহা আন।’ শ্বেতকেতু লবণ খুঁজিয়া পাইল না, কারণ তাহা জলে বিলীন হইয়া গিয়াছিল।
৫০৫. অঙ্গাস্যান্তাদাচামেতি কথমিতি লবণমিতি মধ্যাদাচামেতি কথমিতি লবণমিত্যন্তাদাচামেতি কথমিতি লবণমিত্যভিপ্রাস্যৈতদথ মোপসীদথা ইতি তদ্ধ তথা চকার তচ্ছশ্বৎ সংবর্ততে তং হোবাচাত্র বাব কিল সৎ সোম্য ন নিভালয়সেহত্রৈব কিলেতি ॥ ২
অন্বয় : অঙ্গ (হে বৎস) অস্য (ইহার) অন্তাৎ (অন্তভাগ হইতে; উপরিভাগ হইতে) আচাম (পান কর) ইতি। কথম্ (কি প্রকার)? ইতি। লবণম্ ইতি। মধ্যাৎ (মধ্যভাগ হইতে) আচাম ইতি। কথম্? ইতি। লবণম্ ইতি। অন্তাৎ (নিম্নভাগ হইতে) আচাম ইতি কথম্? ইতি। লবণম্ ইতি অভিপ্রাস্য (নিক্ষেপ করিয়া) এতৎ (ইহাকে) অথ মা (আমার নিকট) উপসীদথাঃ (বৈদিক প্রয়োগ; আসিও) ইতি। তত্ হ (তাহা কিংবা তদনন্তর) তথা (সেই প্রকার) চকার (করিল)। তৎ (তাহা, সেই লবণ) শশ্বৎ (নিত্যই) সংবর্ততে (বিদ্যমান রহিয়াছে), তম্ (তাহাকে) হ উবাচ (বলিলেন) অত্র (এখানে, এই দেহে) বাব কিল সৎ (বিদ্যমান থাকিলেও; কিংবা সৎস্বরূপকে) সোম্য, ন নিভালয়সে (দেখিতেছ) অত্র এব কিল ইতি।
সরলার্থ : উদ্দালক বলিলেন—’ইহার উপরের দিক হইতে জলপান কর। ‘ (শ্বেতকেতু জলপান করিলে পর পিতা (জিজ্ঞাসা করিলেন)—’কি রকম?” শ্বেতকেতু বলিল, ‘লবণাক্ত।’ উদ্দালক বলিলেন, ‘ইহার মাঝখান হইতে পান কর। ‘কি রকম?’ ‘লবণাক্ত’। ‘ইহার নীচের দিক হইতে পান কর।” ‘কি রকম?’ ‘লবণাক্ত’। ‘এই জল ফেলিয়া আমার কাছে এস।’ শ্বেতকেতু তাহাই করিল। উদ্দালক বলিলেন, ‘লবণ জলের সর্বত্রই রহিয়াছে। হে সৌম্য, (জলে সর্বদা বিদ্যমান লবণকে যেমন তুমি দেখিতে পাও নাই, তেমনি) এই দেহে সৎস্বরূপ আত্মা নিত্য বর্তমান আছেন, কিন্তু তুমি দেখিতে পাইতেছ না।’
৫০৬. স য এষোহণিমৈতদাত্ম্যমিদং সর্ব তৎ সত্যং স আত্মা তত্ত্বমসি শ্বেতকেতো ইতি ভূয় এব মা ভগবান্ বিজ্ঞাপয়ত্বিতি তথা সোম্যেতি হোবাচ ॥ ৩
অন্বয় : সঃ যঃ—পূর্ববৎ (৬।৮।৭ মন্ত্র দ্রঃ)।
সরলার্থ : এই যে অণিমা, ইহাই জগতের আত্মা; তিনিই সত্য, তিনিই আত্মা। হে শ্বেতকেতু, তুমিই তিনি। শ্বেতকেতু বলিল—’ভগবান্, আবার আমাকে উপদেশ দিন’ পিতা বলিলেন—’তাহাই হউক।”
চতুর্দশ খণ্ড – দস্যু কর্তৃক বদ্ধচক্ষু গন্থারদেশীয় পথিকের দৃষ্টান্ত দ্বারা ত্বত্ত্বমসি বাক্যের ব্যাখ্যা
৫০৭. যথা সোম্য পুরুষং গন্ধারেভ্যোঽভিনদ্ধাক্ষমানীয় তং ততোহতিজনে বিসৃজেৎ স যথা তত্র প্রাবোদ বাধরাঙ্ বা প্রত্য বা প্রঋায়ী- তাভিনদ্ধাক্ষ আনীতোঽভিনদ্ধাক্ষো বিসৃষ্টঃ ॥ ১
অন্বয় : যথা (যেমন) সোম্য, পুরুষম্ (কোন পুরুষকে) গন্ধারেভ্যঃ (গন্ধার হইতে অভিনদ্ধ + অক্ষম্— (যাহার চক্ষু বাঁধা হইয়াছে) আনীয় (আনিয়া) তম্ (তাহাকে) ততঃ (অনন্তর; কিংবা তাহা অপেক্ষাও) অতিজনে (বিসৃজেৎ পরিত্যাগ করে), সঃ যথা (যেমন) তত্র (সেইস্থানে) প্রাঙ্ বা (পূর্বাভিমুখ ‘হইয়া’) উদঙ্ বা (উত্তরাভিমুখ ‘হইয়া’) অধরাঙ্ বা (দক্ষিণাভিমুখ ‘হইয়া’) প্রত্যঙ্ বা (পশ্চিমাভিমুখ ‘হইয়া’) প্রঋায়ীত; (বর্তমান প্রয়োগ, প্রধমেৎ—চীৎকার করে), অভিনদ্ধাক্ষঃ আনীতঃ (চক্ষু বাঁধিয়া আমাকে আনা হইয়াছে) অভিনদ্ধাক্ষঃ বিসৃষ্টঃ (পরিত্যক্ত ‘হইয়াছি’)।
সরলার্থ : হে সৌম্য, যেমন কোন পুরুষের চোখ বাঁধিয়া তাহাকে গন্ধার দেশ হইতে কোন নির্জন স্থানে আনিয়া ছাড়িয়া দিলে সে যেরূপ (দিগ্ভ্রান্ত হইয়া) কখনও পূর্ব, কখনও দক্ষিণ, কখনও পশ্চিমমুখী হইয়া চীৎকার করিয়া বলিতে থাকে’চোখ বাঁধিয়া আমাকে এখানে আনিয়াছে, চোখ বাঁধিয়া আমাকে এখানে ফেলিয়া দিয়াছে।’ ৫০৮. তস্য যথাভিনহনং প্রমুচ্য প্রব্রুয়াদেতাং দিশং গন্ধারা এতাং দিশং ব্রজেতি স গ্রামাস্ গ্রামং পৃচ্ছন্ পণ্ডিতো মেধাবী গন্ধারানেবোপ- সম্পদ্যেতৈবমেবেহাচার্যবান্ পুরুষো বেদ তস্য তাবদেব চিরং যাব বিমোক্ষ্যেহথ সম্পৎস্য ইতি ॥ ২
অন্বয় : তস্য (তাহার) যথা (যেমন) অভিনহনম্ (চক্ষুর বন্ধন) প্রমুচ্য (মোচন করিয়া) প্রব্রুয়াৎ (কেহ বলে), এতাম্ দিশম্ (এইদিকে) গন্ধারা: (গন্ধার দেশ); এতাম্ দিশম্ ব্রজ (গমন কর) ইতি–সঃ গ্রামাৎ (এক গ্রাম হইতে) গ্রামম্ পৃচ্ছন (জিজ্ঞাসা করিয়া) পণ্ডিতঃ (উপদেশবান ‘হইয়া’) (মেধাবী অর্থাৎ বিচারসমর্থ ‘হইয়া’) গন্ধারান্ এব (গন্ধার প্রদেশেই) উপসম্পদ্যেত (উপস্থিত হয়)—এবম্ এব (এই প্রকারই) ইহ (এই পৃথিবীতে) আচার্যবান্ পুরুষঃ বেদ (জানেন)—তস্য [মম] (সেই আমার) তাবৎ এব (তত দিনই) চিরম্ (বিলম্ব) যাবৎ (যতদিন) ন (না) বিমোক্ষ্যে (দেহ হইতে বিমুক্ত হইবে)। অথ (অনন্তর) সম্পৎস (সৎস্বরূপকে প্রাপ্ত হইবে) ইতি।
সরলার্থ : তখন যেমন কেহ তাহার চোখের বন্ধন খুলিয়া দিয়া বলে— এইদিকে গন্ধার, এইদিকে যাও’ সে যেমন তখন গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে জিজ্ঞাসা করিতে করিতে (এবং লোকের উপদেশে পথ বিষয়ে) অভিজ্ঞ ও বিচারসমর্থ হইয়া গন্ধার প্রদেশেই গিয়া পৌঁছায়; সেইরকম যিনি গুরুর উপদেশ পাইয়াছেন তিনি জানেন—’যতদিন দেহ হইতে মুক্ত না হইব তত দিনই দেরী, তাহার পর আমি সৎস্বরূপকে (ব্রহ্মকে) লাভ করিব।’
মন্তব্য : (ক) পণ্ডিতো মেধাবী’—কেহ কেহ অর্থ করেন—(যদি) সে পণ্ডিত (হয়) অর্থাৎ যদি সে বুদ্ধিমান হয়। (খ) এবম্ এর আচার্যবান্ পুরুষঃ ইত্যাদি। শঙ্কর এই অংশের এই রকম অর্থ করিয়াছেন—সেইরকম আচার্যবান পুরুষ (সৎস্বরূপ আত্মাকে) জানেন। যতদিন দেহ হইতে মুক্ত না হয় ততদিন তাঁহার বিলম্ব, তারপর তিনি সৎপুরুষকে পাইবেন।
৫০৯. স য এষোহণিমৈতদাত্ম্যমিদং সর্বং তৎ সত্যং স আত্মা তত্ত্বমসি শ্বেতকেতো ইতি ভূয় এব মা ভগবান্ বিজ্ঞাপয়ত্বিতি তথা সোম্যেতি হোবাচ ॥ ৩
অন্বয় : সঃ যঃ এষঃ—ইত্যাদি পূর্ববৎ (৬।৮।৭ দ্রষ্টব্য)।
সরলার্থ : ‘এই যে অণিমা, ইহাই সমগ্র জগতের আত্মা। তিনিই সত্য, তিনিই আত্মা। হে শ্বেতকেতু, তুমিই তিনি।’ শ্বেতকেতু বলিল—’ভগবান্, আবার আমাকে উপদেশ দিন দিন।’ পিতা বলিলেন—”হে সৌম্য, তাহাই হউক।
পঞ্চদশ খণ্ড – মুমূর্ষু ও মৃত ব্যক্তির দৃষ্টান্ত দ্বারা ‘তত্ত্বমসি’ বাক্যের ব্যাখ্যা
৫১০. পুরুষং সোম্যোতোপতাপিনং জ্ঞাতয়ঃ পর্যুপাসতে জানাসি মাং জানাসি মামিতি তস্য যাবন্ন বাঘনসি সম্পদ্যতে মনঃ প্রাণে প্রাণস্তেজসি তেজঃ পরস্যাং দেবতায়াং তাবজ্জানাতি ॥ ১
অন্বয় : পুরুষম্ (কোন পুরুষকে) সোম্য, উত উপতাপিনম্ [পুরুষম্] (রোগসন্তপ্ত পুরুষকে) জ্ঞাতয়ঃ (জ্ঞাতিগণ) পরি + উপাসতে (পরিবেষ্টন করিয়া উপবেশন করে জানাসি (চিনিতেছ, চেন) মাম্ (আমাকে) জানাসি মাম্ ইতি; তস্য (তাহার) যাবৎ (যে পর্যন্ত) ন (না) বাক্ মনসি (মনে) সম্পদ্যতে (মিলিত হয়, বিলীন হয়), মনঃ প্ৰাণে, তেজসি (তেজে) তেজঃ পরস্যাম্ দেবতায়াম্ (পরম দেবতাতে), তাবৎ (সেই পর্যন্ত) জানাতি (চিনিতে পারে)।
সরলার্থ : সৌম্য, জ্ঞাতিগণ রোগসন্তপ্ত ব্যক্তিকে ঘিরিয়া জিজ্ঞাসা করে—’আমাকে চিনিতে পার কি? আমাকে চিনিতে পার কি?’ যতক্ষণ তাহার বাক্ মনে, মন প্ৰাণে, প্রাণ তেজে এবং তেজ পরম দেবতাতে বিলীন না হয়, ততক্ষণ সে তাহাদিগকে চিনিতে পারে।
৫১১. অর্থ যদাস্য বাঘনসি সম্পাদ্যতে মনঃ প্রাণে প্রাণস্তেজসি তেজঃ পরস্যাংদেবতায়ামথ ন জানাতি ॥ ২
৫১২. স য এষোহণিমৈতদাত্ম্যমিদং সর্বং তৎ সত্যং স আত্মা তত্ত্বমসি শ্বেতকেতো ইতি ভূয় এব মা ভগবান্ বিজ্ঞাপয়ত্বিতি তথা সোম্যেতি হোবাচ ॥ ৩
অন্বয় : অথ (অনন্তর) যদা (যখন) অস্য (এই ব্যক্তির) বাক্ মনসি সম্পদ্যতে, মনঃ প্রাণে, প্রাণঃ তেজসি, তেজঃ পরস্যাম্ দেবতায়াম্, অথ ন জানাতি (১ম মন্ত্র দ্রঃ)। সঃ যঃ এষঃ—ইত্যাদি ৬।৮।৭ মন্ত্ৰ দ্ৰঃ।
সরলার্থ : (২য় ও ৩য় মন্ত্র)—পরে যখন বাক্ মনে, মন প্রাণে, প্রাণ তেজে এবং তেজ পরম দেবতাতে লীন হয়, তখন আর সে ব্যক্তি তাহাদিগকে চিনিতে পারে না। এই যে অণিমা ইহাই সমস্ত জগতের আত্মা। তিনিই সত্য, তিনিই আত্মা। হে শ্বেতকেতু, তুমিই তিনি। শ্বেতকেতু বলিল—’আপনি আবার আমাকে উপদেশ দিন।’ পিতা বলিলেন—’হে সৌম্য, তাহাই হউক।
ষোড়শ খণ্ড – তপ্ত পরশুস্পর্শের দৃষ্টান্ত দ্বারা ‘তত্ত্বমসি’ বাক্যের ব্যাখ্যা
৫১৩. পুরুষং সোম্যেত হস্তগৃহীতমানয়ন্ত্যপহার্ষীৎ স্তেয়মকার্ষীৎ পরশুমমৈ তপতেতি। স যদি তস্য কর্তা ভবতি তত এবানৃতমাত্মানং কুরুতে, সোইনৃতাভিসন্ধোহনৃতেনাত্মানমন্তর্ধায় পরশুং তপ্তং প্রতিগৃহ্নাতি স দহ্যতেহথ হন্যতে ॥ ১
অন্বয় : পুরুষম্ (কোন পুরুষকে) সোম্য, উত হস্তগৃহীতম্ [পুরুষম্] (যাহার হাত ধরা হইয়াছে বা বাঁধা হইয়াছে, তাহাকে) আনয়ন্তি (আনয়ন করে), অপহার্ষীৎ (বৈদিক প্রয়োগ; অপহরণ করিয়াছে) স্তেয়ম্ (চৌর্য) অকার্ষীৎ (করিয়াছে); পরশুম্ অস্মৈ (ইহার জন্য) তপত (উত্তপ্ত কর) ইতি। সঃ (সে) যদি তস্য (ইহার, চৌর্যের) কর্তা ভবতি (হয়), ততঃ (তাহা হইলে) এব (নিশ্চয়ই) অনৃতম্ (অসত্য) আত্মানম্ (আপনাকে) কুরুতে (করে); নঃ অনৃতাভিসন্ধঃ (অসত্যমনা; অভিসন্ধা—বাক্য, প্রতিজ্ঞা,অভিসন্ধি) অনৃতেন (অসত্য দ্বারা) আত্মানম্ (আপনাকে) অন্তর্ধায় (আচ্ছাদন করিয়া) পরশুম্ তপ্তম্ (উত্তপ্ত কুঠারকে) প্রতিগৃহাতি (গ্রহণ করে), সঃ দহ্যতে (দগ্ধ হয়), অথ (অনন্তর হন্যতে (হত হয়)।
সরলার্থ : হে সোম্য, যদি কোন ব্যক্তির হাত বাধিয়া আনা হয় এবং বলা হয় ‘এ ব্যক্তি অপহরণ করিয়াছে চুরি করিয়াছে ইহার জন্য কুঠার উত্তপ্ত কর’— সে যদি চুরি করিয়া থাকে তাহা হইলে সে নিজের বিষয়ে সত্য গোপন করিবে। তারপর সেই অসত্যমনা ব্যক্তি নিজেকে মিথ্যায় আবৃত করিয়া তপ্ত কুঠার গ্রহণ করিবে এবং দগ্ধ হইয়া শেষে নিহত হইবে।
৫১৪. অথ যদি তস্যাকর্তা ভবতি তত এব সত্যমাত্মানং কুরুতে স সত্যাভিসন্ধঃসত্যেনাত্মানমন্তর্ধায় পরশুং তপ্তং প্রতিগৃহাতি স ন দহতেহথ মুচ্যতে ॥ ২
৫১৫. স যথা তত্র নাদাহ্যেতৈতদাত্ম্যমিদং সর্বং তৎ সত্যং স আত্মা তত্ত্বমসি শ্বেতকেতো ইতি তদ্ধাস্য বিজজ্ঞাবিতি বিজ্ঞজ্ঞাবিতি ॥ ৩
অন্বয় : অথ যদি তস্য অকর্তা ভবতি, ততঃ এব সত্যম্ আত্মানম্ কুরুতে। স সত্যাভিসন্ধঃ (সত্যমনা) সত্যেন আত্মানম্ অন্তর্ধায় পরশুম্ তপ্তম্ প্রতিগৃহাতি; সঃ ন দহ্যতে অথ মুচ্যতে (মুক্ত হয়)। (১মঃ দ্রঃ)। সঃ (সে) যথা (যেমন) তত্র (সেই স্থলে) ন অদাহ্যেত (দগ্ধ হয় না) ‘ঐতদাত্ম্যম্’ ইত্যাদি পূর্ববৎ (৬।৮।৭ দ্রঃ)। অস্য (আরুণির নিকট হইতে) তত্ হ (সেই সৎস্বরূপকে) বিজজ্ঞৌ (জানিয়াছিলেন) ইতি (দ্বিরুক্তি সমাপ্তিসূচক)।
সরলার্থ : (২য় ও ৩য় মন্ত্র)—যদি সে ব্যক্তি ঐ কাজ না করিয়া থাকে, তবে সে নিজেকে সত্য বলিয়া প্রতিপন্ন করিবে; সেই সত্যাভিসন্ধ পুরুষ নিজেকে সত্যে আবৃত করিবে, দগ্ধ হইবে না এবং অবশেষে মুক্তিলাভ করিবে। সেই ব্যক্তি যেমন দগ্ধ হয় না এবং মুক্ত হয়, তেমনি সত্যপরায়ণ ব্যক্তি পরলোকে পাপদগ্ধ হয় না। সে মুক্তি লাভ করে ও সত্যস্বরূপকে লাভ করে। এই যে অণিমা, ইহাই সমস্ত জগতের আত্মা। তিনিই সত্য, তিনিই আত্মা। হে শ্বেতকেতু, তুমিই তিনি। পিতা আরুণির নিকটে শ্বেতকেতু সেই সন্বরূপকে জানিয়াছিলেন।