ছান্দোগ্য উপনিষদ – সপ্তম অধ্যায়
সপ্তম অধ্যায়
প্ৰথম খণ্ড – নারদ-সনৎকুমার-সংবাদ—ভূমাতত্ত্ব : ঋগ্বেদাদি সকল বিদ্যাই ‘নাম’ মাত্ৰ
৫১৬. অধীহি ভগব ইতি হোপসসাদ সনৎকুমারং নারদস্তং হোবাচ যদ্বেথ তেন মোপসীদ ততস্ত ঊর্ধ্বং বক্ষ্যামীতি স হোবাচ ॥ ১
অন্বয় : অধীহি (বৈদিক প্রয়োগ; অধ্যাপয়—অধ্যয়ন করান) ভগবঃ (ভগবন্ ইতি হ উপসসাদ (উপস্থিত হইল) সনৎকুমারম্ (সনৎকুমারের কাছে) নারদঃ। তম্ (তাহাকে) হ উবাচ (বলিলেন)—যৎ (যাহা) বেথ (জান) তেন (তাহার সহিত, তাহা বলিয়া) মা (আমার নিকট) উপসীদ (উপস্থিত হও) ততঃ (তাহা অপেক্ষা) তে (তোমাকে) ঊর্ধ্বম্ (অধিক, অতিরিক্ত) বক্ষ্যামি (বলিব) ইতি। সঃ (তিনি অর্থাৎ সনৎকুমার) হ উবাচ (বলিলেন)।
সরলার্থ : নারদ সনৎকুমারের নিকট গিয়া বলিলেন—’ভগবান্, আমাকে শিক্ষা দিন।’ সনৎকুমার বলিলেন, “তুমি যাহা জান, তাহা প্রথমে বল; তার পরে তাহার অতিরিক্ত আমি বলিব।’
মন্তব্য : অধীহি অর্থ ‘অধ্যয়ন করুন’। কিন্তু এই মন্ত্রে ইহা ‘অধ্যয়ন করান’ ‘শিক্ষা দিন’ অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। স্মরণ করা অর্থে ‘অধীহি’ বলিলে ‘স্মরণ করান’ বোঝায়। কিন্তু এখানে স্মরণ করা অর্থ সঙ্গত হয় না। নারদ যাহা শিখিতে গিয়াছিলেন সে বিষয় তিনি কিছুই জানিতেন না। কাজেই গুরু তাঁহাকে কি স্মরণ করাইবেন?
৫১৭. ঋগ্বেদং ভগবোহধ্যেমি যজুর্বেদং সামবেদমাথবণং চতুর্থমিতিহাসপুরাণং পঞ্চমং বেদানাং বেদং পিত্র্যং রাশিং দৈবং নিধিং বাকোবাক্যমেকায়নং দেববিদ্যাং ব্ৰহ্মবিদ্যাং ভূতবিদ্যাং ক্ষত্রবিদ্যাং সর্পদেবজনবিদ্যামেতদ্ভগবোহধ্যেমি ॥ ২
অন্বয় : ঋগ্বেদম্ ভগবঃ (ভগবন্) অধ্যেমি [জানি] যজুর্বেদম্ সামবেদম্ আথর্বণম্ চতুর্থম্ (চতুর্থস্থানীয় অথর্ববেদ), ইতিহাসপুরাণম্ পঞ্চমম্ (ইতিহাস-পুরাণ নামক পঞ্চম বেদকে) বেদানাম্ বেদম্ (বেদসমূহের বেদকে, ব্যাকরণকে) পিত্র্যম্ (পিতৃপুরুষদিগের শ্রাদ্ধ-বিষয়ক তত্ত্বকে), রাশিম্ (গণিতশাস্ত্রকে) দৈবম্ (দৈব উৎপাতসমূহের বিদ্যাকে), নিধিম্ (কালতত্ত্বকে বা ধনতত্ত্বকে) বাকোবাক্যম্, একায়নম্, দেববিদ্যাম্, ব্রহ্মবিদ্যাম্, ভূতবিদ্যাম্ (ভূতযোনি-সংক্রান্ত বিদ্যা) ক্ষত্রবিদ্যাম্ (ধনুর্বেদকে), নক্ষত্রবিদ্যাম্ (জ্যোতির্বিদ্যাকে) সর্প-দেবজন-বিদ্যাম্ (সর্পবিদ্যা ও দেবজনবিদ্যাকে)–এতৎ (এই সমুদয়কে) ভগবঃ অধ্যেমি।
সরলার্থ : নারদ বলিলেন—ভগবান্, ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, চতুর্থস্থানীয় অথর্ববেদ, ইতিহাস-পুরাণ নামক পঞ্চম বেদ, সমস্ত বেদেরও যে বেদ (অর্থাৎ ব্যাকরণ), শ্রাদ্ধতত্ত্ব, গণিতশাস্ত্র, দেব-উৎপাত বিষয়ক বিদ্যা, কালতত্ত্ব, নীতিশাস্ত্র, দেববিদ্যা, ব্রহ্মাবিদ্যা, ভূতবিদ্যা, ধনুর্বেদ, নক্ষত্রবিদ্যা, সর্প ও দেবজনবিদ্যা—আমি এই সবই জানি।
মন্তব্য : পাণিনির মতে ‘অথবর্ণম্’ শব্দ হইতে আথর্বণিক হইয়াছে। অথবা একজন ঋষি; অথর্বদৃষ্ট মন্ত্রে যাঁহারা পারদর্শী, তাঁহাদিগের নাম আথর্বণিক। যাহা আথর্বণিকদিগের তাহাই আথর্বণ। ইহা অথর্ববেদেরই একটি প্রাচীন নাম ‘অথর্বাঙ্গিরস’ নামেও ইহা অভিহিত হইত। (৩।৪।১ মন্ত্রের মন্তব্য দ্রষ্টব্য)।
‘ইতিহাস-পুরাণম্’—ইতিহাস = ইতি + হ আস। ইতি—এই প্রকার; ‘হ’ নিশ্চয়াৰ্থক অব্যয়। ‘ইতিহ’ = এই প্রকারই। আস—প্রাচীন প্রয়োগ; ছিল। ইতি + হ + আস = এই প্রকার ছিল, এই প্রকার ঘটিয়াছিল। এই প্রকার অর্থ হইতেই বর্তমান ইতিহাস অর্থ হইয়াছে। ইতিহাস একটি বাক্য, কিন্তু কালক্রমে ‘ইতি’ বিশেষ্যপদ রূপে ব্যবহৃত হইয়াছে। ভাষায় ‘ইতিহ’ শব্দেরও প্রয়োগ আছে। ‘ঐতিহ্য’ শব্দ ‘ইতিহ’ শব্দ হইতেই উৎপন্ন। ‘পুরা’ শব্দ হইতে ‘পুরাণ’ শব্দের উৎপত্তি। পুরাণ—পুরাকালের কথা। ছান্দোগ্য উপনিষদে (৩।৪।১, ২; ৭।১।২; ৪; ৭।২।১; ৭।৭।১) এবং শতপথ ব্রাহ্মণে (১১।৫।৬।৮) ‘ইতিহাস পুরাণ’ শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে। ইতিহাস এবং পুরাণ এতদুভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য থাকিলেও ইহারা যে এক বিষয় নহে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। সর্গ, প্রতিসর্গ, বংশ, মন্বন্তর ও বংশানুচরিত—এই পঞ্চ লক্ষণ-যুক্ত গ্রন্থকে যে পুরাণ বলা হয়, ইহা আধুনিক মত। দৈবম্—দৈব উৎপাতসমূহের জ্ঞান (শঙ্কর ও মোক্ষমুলার)। কেহ কেহ ‘দৈবম্’ পদকে নিধিম্’ পদের বিশেষণ বলিয়া মনে করেন।
নিধিম্—মহাকালাদি নিধিশাস্ত্র (শঙ্কর); the science of time (মোক্ষমূলার)। ‘নিধি’ শব্দের মৌলিক অর্থ ‘সম্পত্তির আধার’; পরে ইহা ‘সম্পত্তি’ অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। এইস্থলে ‘নিধি’ ধন অর্থেও ব্যবহৃত হইতে পারে।
বাকোবাক্য—তর্কশাস্ত্র (শঙ্কর ও মোক্ষলার); Macdonell এবং Keith বলেন এ অর্থ নিতান্তই অসঙ্গত। ইঁহাদিগের মতে, বেদের যে অংশ কথোপকথনচ্ছলে লিখিত তাহাই ‘বাকোবাক্য’। Monier Williams-এর অভিধানে ইহার দুইটি অর্থ দেওয়া হইয়াছে—(১) কথোপকথন, (২) বেদের নির্দিষ্ট কোন অংশ।
একায়নম্—এক+অয়ন; অয়ন—পথ, গতি। ভিন্ন ভিন্ন লোক ইহার এই প্রকার অর্থ করিয়াছেন : (ক) নীতিশাস্ত্র (শঙ্কর), Ethics (মোক্ষঃ), (খ) The only way or. manner of conduct অর্থাৎ আচরণের একমাত্র পথ; worldly wisdom, সাংসারিক জ্ঞান (Mon, Will. অভিধান)। (গ) The doctrine (অয়ন) of unity (এক) অর্থাৎ একত্ববাদ; monotheism অর্থাৎ একেশ্বরবাদ।
দেববিদ্যা—নিরুক্ত (শঙ্কর), Etymology (Maxmuller); কেহ কেহ অর্থ করেন ‘দেবতা-সংক্রান্ত-বিদ্যা’। ব্রহ্মবিদ্যা—শিক্ষা কল্পাদি বিদ্যা (শঙ্কর ও মোক্ষমূলার); Knowledge of the Absolute অর্থাৎ পরব্রহ্মের জ্ঞান (Vedic Index) সর্প-দেবজন-বিদ্যা=সর্পবিদ্যা ও দেবজন-বিদ্যা। সর্পবিদ্যা—সৰ্প ও সর্পবিষ-সংক্রান্ত বিদ্যা। দেবজন—গন্ধর্ব; দেবজনবিদ্যা=গন্ধর্বদিগের বিদ্যা অর্থাৎ গন্ধদ্রব্য প্রস্তুত প্রণালী ও নৃত্য-গীতাদি বিদ্যা (শঙ্কর)। কেহ কেহ বলেন ইহার অর্থ ‘দেব-পুরুষগণের বিদ্যা’।
৫১৮. সোহহং ভগবো মন্ত্রবিদেবাস্মি নাত্মবিৎ শুতং হ্যেব মে ভগবদ্দৃশে— ভ্যস্তরতি শোকমাত্মবিদিতি সোহহং ভগবঃ শোচামি তং মা ভগবাঞ্ছোকস্য পারং তারয়াত্বিতি তং হোবাচ যদ্বৈ কিংচৈতদধ্যগীষ্ঠা নামৈবৈতৎ ॥ ৩
অন্বয় : সঃ অহম্ (এমন যে আমি, এত বিদ্যা লাভ করিয়াও আমি) ভগবঃ! মন্ত্রবিৎ এব (কেবল মন্ত্ৰবিই) অস্মি (হই); ন আত্মবিৎ (আত্মবিৎ নই; আত্মা কি জানি না) শ্রুতম্ হি এব মে (আমি শুনিয়াছি) ভগবৎ+দৃশেভ্যঃ (ভগবৎ সদৃশ লোকের নিকট) তরতি (উত্তীর্ণ হয়) শোকম্ আত্মবিৎ ইতি। সঃ অহম্ ভগবঃ! শোচামি (শোক অনুভব করিতেছি)। তম্ মা (সেই আমাকে) ভগবান্ শোকস্য পারম্ (শোকের পরপারে) তারয়তু (উত্তীর্ণ করুন) ইতি। তম্ হ উবাচ—যৎ বৈ কিম্চ এতৎ (যাহা কিছু) অধ্যগীষ্ঠা (অধ্যয়ন করিয়াছ) নাম এব (নামমাত্র) এতৎ (ইহা)।
সরলার্থ : ‘এত জানিয়াও আমি কেবল মন্ত্রবিৎ আত্মবিৎ নই। আপনার মত ব্যক্তিদের মুখে শুনিয়াছি যে, আত্মবিৎ শোক অতিক্রম করেন। আমি শোকমগ্ন; আপনি আমাকে শোকের পরপারে লইয়া যান।’ সনৎকুমার তাঁহাকে বলিলেন—”তুমি যাহা কিছু অধ্যয়ন করিয়াছ তাহা নাম (বাক্য) মাত্ৰ।’
৫১৯. নাম বা ঋগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদ আথবর্ণশ্চতুর্থ ইতিহাসপুরাণঃ পঞ্চমো বেদানাং বেদঃ পিত্রো রাশির্দৈবো নিধিবাকোবাক্যমেকায়ন দেববিদ্যা ব্রহ্মবিদ্যা ভূতবিদ্যা ক্ষত্রবিদ্যা নক্ষত্রবিদ্যা সর্পদেবজনবিদ্যা নামৈবৈতন্নামোপাস্থেতি ॥ ৪
অন্বয় : নাম বৈ ঋগ্বেদঃ যজুর্বেদঃ সামবেদ আথর্বণঃ চতুর্থঃ ইতিহাসপুরাণঃ পঞ্চমঃ, বেদানাম্ বেদঃ, পিত্র্যঃ রাশি, দৈবঃ, নিধিঃ বাকোবাক্যম্ একায়নম্ দেববিদ্যা, ব্রহ্মবিদ্যা, ভূতবিদ্যা, ক্ষত্রবিদ্যা, নক্ষত্রবিদ্যা, সর্প-দেবজন-বিদ্যা-নাম এব এতৎ (এ সমুদয় নামই)। নাম (নামকে) উপাস্থ (উপাসনা কর) ইতি (২য় মন্ত্র দ্রঃ)।
সরলার্থ : ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, চতুর্থত অথর্ববেদ, পঞ্চমত ইতিহাস ও পুরাণ, ব্যাকরণ, শ্রাদ্ধতত্ত্ব, গণিতবিদ্যা, দৈব-উৎপাত বিষয়ক বিদ্যা, কালবিদ্যা, বাকোবাক্য, নীতিশাস্ত্র, নিরুক্ত, ব্রহ্মবিদ্যা, ভূতবিদ্যা, ক্ষত্রবিদ্যা, নক্ষত্রবিদ্যা, সর্প ও দেবজন বিদ্যা—এই সবই নাম। নামের উপাসনা কর।
৫২০. স যো নাম ব্রহ্মেত্যুপাস্তে যাবন্নাম্নো গতং তত্রাস্য যথাকামচারো ভবতি য়ো নাম ব্রহ্মেত্যুপাস্তেঽস্তি ভগবো নাম্নো ভুয় ইতি নামো বাব ভূয়োহস্তীতি তন্মে ভগবান্ ব্রবীত্বিতি ॥ ৫
অন্বয় : সঃ যঃ (সেই যে কোন ব্যক্তি) নাম (নামকে) ব্রহ্ম ইতি উপাস্তে (উপাসনা করে) যাবৎ (যে পর্যন্ত) নাম্নঃ (নামের) গতম্ (গতি), তত্র (সেই নাম বিষয়ে) অস্য (ইহার) যথাকামচারঃ (স্বেচ্ছাচরণ) ভবতি (হয়) যঃ (যিনি) নাম ব্রহ্ম ইতি উপাস্তে (দ্বিরুক্তি)। অস্তি (আছে) ভগবঃ নাম্নঃ (নাম অপেক্ষা) ভূয়ঃ (অধিক, শ্রেষ্ঠ)? ইতি। নাম্নঃ বাব ভূয়ঃ অস্তি ইতি। তৎ (তাহা) মে (আমাকে) ভগবান্ ব্রবীতু (বলুন) ইতি।
সরলার্থ : যিনি নামকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন—নামের গতি যতদূর, ততদূর তিনি ইচ্ছানুযায়ী যাইতে পারেন। নারদ জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভগবান্, নাম অপেক্ষা কি শ্রেষ্ঠ কিছু আছে?’ সনৎকুমার বলিলেন—’নাম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বস্তু নিশ্চয়ই আছে।’ নারদ বলিলেন, “আপনি তাহা আমাকে বলুন।’
মন্তব্য : যথাকামচারঃশঙ্কর বলেন : ‘নিজ রাজ্যে রাজার যেমন কামচরণ অর্থাৎ স্বাধীনতা, সেই প্রকার।’ Monier Williams-এর মতে ‘Actions according to pleasure or without control.’
দ্বিতীয় খণ্ড – নাম অপেক্ষা বাক্ শ্রেষ্ঠ
৫২১. বাগ্বাব নাম্নো ভূয়সী বাগ্বা ঋগ্বেদং বিজ্ঞাপয়তি ঋজর্বেদং সামবেদ- মাথবর্ণং চতুর্থমিতিহাসপুরাণং পঞ্চমং বেদানাং বেদং পিত্র্যং রাশিং দৈবং নিধিং বাকোবাক্যমেকায়নং দেববিদ্যাং ব্রহ্মবিদ্যাং ভূতবিদ্যাং ক্ষত্রবিদ্যাং নক্ষত্রবিদ্যাং সর্পদেবজনবিদ্যাং দিবং চ পৃথিবীং চ বায়ুং চাকাশং চাপশ্চ তেজশ্চ দেবাংশ্চ মনুষ্যাংশ্চ পশূংশ্চ বয়াংসি চ তৃণ- বনস্পতীঞ্চ শ্বাপদান্যাকীটপতঙ্গপিপীলকং ধর্মং চাধর্মং চ সত্যং চানৃতং চ সাধু চাসাধু চ হৃদয়জ্ঞং চাহৃদয়জ্ঞং চ যদ্বৈ বাঙ্গাভবিষ্য ধর্মো নাধর্মো ব্যজ্ঞাপয়িষান্ন সত্যং নানৃতং ন সাধু নাসাধু ন হৃদয়জ্ঞো নায়য়জ্ঞো বাগেবৈতৎ সর্বং বিজ্ঞাপয়তি বাচমুপাস্ৱেতি ॥ ১
অন্বয় : বাক্ বাব নাম্নঃ (নাম অপেক্ষা) ভূয়সী (শ্রেষ্ঠ)। বাক্ বে ঋগ্বেদম্ বিজ্ঞাপয়তি (জানায়); যজুর্বেদম্ সামবেদম্, আথর্বর্ণম্ চতুর্থম, ইতিহাসপুরাণম্ পঞ্চমম্, বেদানাম্ বেদম্, পিত্র্যম্, রাশিম্, দৈবম্ নিধিম্ বাকোবাক্যম্ একায়নম্, দেববিদ্যাম্, ব্রহ্মবিদ্যাম্, ভূতবিদ্যাম্ ক্ষত্রবিদ্যাম্ নক্ষত্রবিদ্যাম্, সর্পদেবজনবিদ্যাম্ (৭।১।২ দ্রঃ), দিবম্ চ (দ্যুলোককে), পৃথিবীম্ চ বায়ূম্ চ, আকাশম চ, অপঃ চ, তেজঃ চ, দেবান্ চ (দেবগণকে) মনুষ্যান্ চ (মনুষ্যগণকে) পশূন্ চ্ (পশুগণকে), বয়াংসি চ (পক্ষিগণকে, বয়স্—পক্ষী) তৃণবনস্পতীন্ (তৃণ ও বনস্পতি সমূহকে) শ্বাপদানি (হিংস্ৰজস্তুদিগকে) আকীট-পতঙ্গ-পিপীলকম্ (কীট, পতঙ্গ, পিপীলিকা পর্যন্ত সমুদয় প্রাণীকে) ধর্মম্ চ, অধর্মম্ চ, সত্যম্ চ, অনৃতম্ চ, সাধু চ (শুভ বিষয়কে), অসাধু চ (অসাধু বিষয়কে), হৃদয়জ্ঞম্ চ (মনোরম) অহূদয়জ্ঞং চ (অপ্রীতিকর বিষয়কে)। যৎ (যদি) বৈ বাক্ ন অভবিষ্যৎ (থাকিত), ন ধর্মঃ, ন অধর্মঃ, ব্যজ্ঞাপয়িষ্যৎ (আপনাকে জানাইত) ন সত্যম্ ন অনৃতম্, ন সাধু ন অসাধু; ন হৃদয়জ্ঞঃ, ন অহৃদয়জ্ঞঃ। বাক্ এব এতৎ সর্বম্ (এই সমুদয়কে) বিজ্ঞাপয়তি। বাচম্ (বাক্কে) উপাস্থ (উপাসনা কর)।
সরলার্থ : বাক্ অবশ্যই নাম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। ঋগ্বেদ, ঋজুর্বেদ, সামবেদ, চতুর্থ অথর্ববেদ, পঞ্চম ইতিহাস-পুরাণ, ব্যাকরণ, শ্রাদ্ধতত্ত্ব, গণিতশাস্ত্র, দৈববিদ্যা, নিধিবিদ্যা, বাকোবাক্য, একায়ন, দেববিদ্যা, ব্রহ্মবিদ্যা, ভূতবিদ্যা, ক্ষত্রবিদ্যা, নক্ষত্রবিদ্যা, সর্প ও দেবজনবিদ্যা, স্বর্গলোক, পৃথিবী, বায়ু, আকাশ, জল, তেজ, দেবগণ, মনুষ্যগণ, পশুসমূহ, পক্ষিগণ, তৃণ ও বনস্পতিসমূহ, শ্বাপদগণ, কীটপতঙ্গ ও পিপীলিকা পর্যন্ত যাবতীয় প্রাণী, ধর্ম ও অধর্ম, সত্য ও অসত্য, সাধু ও অসাধু, প্রীতিকর ও অপ্রীতিকর বিষয়—এই সমস্তকেই বাক্ বিজ্ঞাপিত করে। যদি বাক্ না থাকিত, ধর্ম ও অধর্ম, সত্য ও অসত্য, সাধু ও অসাধু, প্রীতিকর ও অপ্রীতিকর—কিছুই বিজ্ঞাপিত হইত না। বাক্ই এই সবকে বিজ্ঞাপিত করে। বাক্কেই উপাসনা কর।
৫২২. স যো বাচং ব্রহ্মেত্যুপাস্তে যাবদ্বাচো গতং তত্রাস্য যথা কামচারো ভবতি যো বাচং ব্রহ্মেতে্যুপাস্তেঽস্তি ভগবো বাচো ভূয় ইতি বাচো বাব ভয়োহস্তীতি তন্মে ভগবান্ ব্রবীত্বিতি ॥ ২
অন্বয় : সঃ যঃ বাচম্ ‘ব্রহ্ম’ ইতি উপাস্তে, যাবৎ বাচঃ (বাক্যের) গতম্, তত্র অস্য যথাকামচারঃ ভবতি—যঃ বাচম্ ব্রহ্ম ইতি উপাস্তে। অস্তি ভগবঃ বাচঃ ভূয়? ইতি। বাচঃ বাব ভয়ঃ অস্তি ইতি। তৎ মে ভগবান্ ব্রবীতু ইতি (৭।১।৫)।
সরলার্থ : যিনি বাক্কে ব্রহ্ম বলিয়া উপাসনা করেন, বাক্যের যতদূর গতি ততদূর পর্যন্ত তিনি যথেচ্ছ যাইতে পারেন। নারদ বলিলেন—’ভগবান্, বাক্ অপেক্ষা কি কিছু শ্রেষ্ঠ আছে?’ সনৎকুমার বলিলেন—’বাক্ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ এমন বস্তু নিশ্চয়ই আছে।’ নারদ বলিলেন—’আপনি তাহা আমাকে বলুন।’
তৃতীয় খণ্ড – বাক্ অপেক্ষা মন শ্ৰেষ্ঠ
৫২৩. মনো বাব বাচো ভূয়ো যথা বৈ দ্বে বামলকে দ্বে বা কোলে দ্বৌ বাক্ষৌ মুষ্টিরনুভবত্যেবং বাচং চ নাম চ মনোহনুভবতি, স যদা মনসা মনস্যতি মন্ত্রানধীয়ীয়েত্যথাধীতে কর্মাণি কুর্বীয়েত্যথ কুরুতে পুত্রাংশ্চ পশৃংশ্চেচ্ছেয়েত্যথেচ্ছত ইমং চ লোকমমুং চেচ্ছেয়েত্যথেচ্ছতে, মনো হ্যাত্মা মনো হি লোকো মনো হি ব্ৰহ্ম মন উপাস্থেতি ॥ ১
অন্বয় : মনঃ বাব বাচঃ (বাক অপেক্ষা) ভূয়ঃ (শ্রেষ্ঠ)। যথা বৈ দ্বে বৈ আমলকে (দুইটি আমলক ফলকে) দ্বে বা কোলে (দুইটি বদরী ফলকে), দ্বৌ বা অক্ষৌ (দুইটি অক্ষ ফলকে; অক্ষবিভীতক, বহেড়া) মুষ্টিঃ (হস্তের মুষ্টি), অনুভবতি (ধারণ করে, অন্তর্ভূত করে, অনুভব করে), এবম্ (এই প্রকার) বাচম্ চ নাম চ (নামকে) মনঃ অনুভবতি সঃ (মানুষ) যদা (যখন) মনসা (মনদ্বারা) মনস্যতি (মনন করে), মন্ত্রান্ (মন্ত্রসমূহকে) অধীয়ীয় (অধ্যয়ন করি) ইতি, অথ অধীতে (অধ্যয়ন করে)। কর্মাণি (কর্মসমূহকে) কুর্বীয় (করি) ইতি অথ কুরুতে (করে)। পুত্রান্ চ (পুত্রসমূহকে), পশূন্ চ (পশুসমূহকে) ইচ্ছেয় (বৈদিক, ইচ্ছেয়ম্—ইচ্ছা করি। ইতি, অথ ইচ্ছতে (বৈদিক, ইচ্ছা করে, লাভ করে); ইমম্ চ লোকম্ (এই লোককে) অমুম্ চ (ঐ লোককে, পরলোককে) ইচ্ছেয় ইতি অথ ইচ্ছতে। মনঃ হি আত্মা, মনঃ লোকঃ; মনঃ হি ব্ৰহ্ম। মনঃ উপাসাস্থ (উপাসনা কর) ইতি।
সরলার্থ : মন বাক্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। হাতের মুঠি যেমন দুইটি আমলকী, বদরী (কুল) বা বিভীতক (বহেড়া) ফলকে ধরিয়া রাখে, মন তেমনি বাক্ ও নামকে ধারণ করিয়া থাকে। কারণ মন যখন স্থির করে যে ‘আমি পড়ি’, তখন সে পড়ে; যখন স্থির করে যে ‘আমি কাজ করি,’ তখন সে কাজ করে; যখন স্থির করে যে, ‘আমি পুত্র চাই পশু চাই” তখন সে সেই সবই পায়; যখন স্থির করে যে, ‘আমি ইহলোক ও পরলোক লাভ করিতে চাই’ তখন তাহাই পায় (অর্থাৎ মানুষ প্রথমে ‘মন দ্বারা একটি বিষয় ঠিক করে তাহার পর সেই অনুযায়ী কাজ করে)। মনই আত্মা, মনই লোক, মনই ব্ৰহ্ম। মনকেই উপাসনা কর।
৫২৪. স যো মনো ব্রহ্মেত্যুপাস্তে যাবন্মনসো গতং তত্রাস্য যথাকামচারো ভবতি যো মনো ব্রহ্মেত্যুপাস্তেঽস্তি ভগবো মনসো ভূয় ইতি মনসো বাব ভূয়োহস্তীতি তন্মে ভগবান্ ব্রবীত্বিতি ॥ ২
অন্বয় : সঃ যঃ মনঃ ব্রহ্ম ইতি উপাস্তে, যাবৎ মনসঃ (মনের) গতম্ তত্র অস্য যথা কামচারঃ ভবতি, যঃ মনঃ ব্রহ্ম ইতি উপাস্তে। অস্তি ভগবঃ মনসঃ ভুয়ঃ? ইতি। মনসঃ বাব ভুয়ঃ অস্তি ইতি। তৎ মে ভগবান্ ব্রবীতু ইতি (৭।১।৫)।
সরলার্থ : যিনি মনকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, মনের গতি যত দূর, তত দূর পর্যন্ত তিনি স্বচ্ছন্দে যাইতে পারেন। নারদ জিজ্ঞাসা করিলেন—’ভগবান, মন অপেক্ষা কি কিছু শ্রেষ্ঠ আছে?’ সনৎকুমার বলিলেন—’মন অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ কিছু আছে।’ নারদ বলিলেন—’আপনি আমাকে তাহা বলুন।’
চতুর্থ খণ্ড – মন অপেক্ষা সংকল্প শ্ৰেষ্ঠ
৫২৫. সংকল্পো বাব মনসো ভূয়ান্ যদা বৈ সঙ্কল্পয়তেহথ মনস্যত্যথ বাচমীরয়তি তামু নাম্নীরয়তি নাম্নি মন্ত্রা এবং ভবন্তি মন্ত্রেষু কর্মাণি ॥ ১
অন্বয় : সংকল্পঃ বাব মনসঃ (মন অপেক্ষা) ভূয়ান্ (শ্রেষ্ঠ)। যদা (যখন) বৈ সঙ্কল্পয়তে (সংকল্প করে), অথ মনস্যতি (চিন্তা করে), অথ বাচম্ ঈরয়তি (প্রেরণ করে), তাম্ (সেই বাক্কে) উ নাম্নি (নামে) ঈরয়তি, নাম্নি মন্ত্রাঃ (মন্ত্রসমূহ) একম্ ভবন্তি (হয়), মন্ত্রেষু (মন্ত্ৰসমূহ) কর্মাণি (কর্মসমূহ।
সরলার্থ : সংকল্প মন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। প্রথমে মন সংকল্প করে, পরে চিন্তা করে, পরে বাগিন্দ্রিয়কে পরিচালিত করে, তাহার পর ইহাকে নাম উচ্চারণে প্রবৃত্ত করে। সমস্ত মন্ত্র নামে এবং সমস্ত কর্ম মন্ত্রে একীভূত হয়।
৫২৬. তানি হ বা এতানি সংকল্পৈকায়নানি সংকল্পাত্মকানি সংকল্পে প্রতিষ্ঠিতানি সমরূপতাং দ্যাবাপৃথিবী সমকল্পেতাং বায়ুশ্চাকাশং চ সমকল্পন্তাপশ্চ তেজশ্চ তেষাং সংস্কৃপ্ত্যৈ বর্ষং সংকল্পতে বর্ষস্য সংস্কৃত্যা অন্নং সংকল্প— তেহনস্য সংস্কৃপ্ত্যৈ প্রাণাঃ সংকল্পন্তে প্রাণানাং সংকূপ্ত্যৈ মন্ত্রাঃ সংকল্পন্তে মন্ত্রাণাং সংকূপ্ত্যৈ কর্মাণি সংকল্পন্তে কর্মাণাং সংস্কৃপ্ত্যৈ লোকঃ সংকল্পতে লোকস্য সংকূপ্ত্যৈ সর্বং সংকল্পতে স এষ সংকল্পঃ সংকল্পমুপাস্থেতি ॥২
অন্বয় : তানি হ বা এতানি (সেই সমুদয় অর্থাৎ মন, বাক্, নাম, মন্ত্র ও কর্ম) সংকল্প + একায়নানি (সংকল্পে যাহাদিগের লয়) সংকল্পাত্মকানি (সংকল্পে যাহাদিগের উৎপত্তি) সংকল্পে প্রতিষ্ঠিতানি (প্রতিষ্ঠিত)। সমরূপতাম্ (সংকল্প করিয়াছিল)) দ্যাবাপৃথিবী (বৈদিক শব্দ দ্যৌ এবং পৃথিবী); সমকল্পেতাম্ (সংকল্প করিয়াছিল) বায়ুঃ চ আকাশম্ চ (আকাশ) সমকল্পন্ত আপঃ চ (জল) তেজঃ চ। তেষাম্ (তাহাদিগের সকূপ্ত্যৈ (সংকল্পের নিমিত্ত) বর্ষম্ (বৃষ্টি) সংকল্পতে (সংকল্প করে), বর্ষস্য (বৃষ্টির সংস্কৃপ্ত্যৈ (সংকল্পবশতঃ) অন্নম্ সংকল্পতে; অন্নস্য সংস্কৃপ্ত্যৈ প্রাণাঃ সংকল্পন্তে (সংকল্প করে); প্রাণানাম্ (প্রাণসমূহের) সংকূপ্ত্যৈ মন্ত্রাঃ সংকল্পন্তে; মন্ত্রাণাম্ সংস্কৃপ্ত্যৈ কর্মাণি সংকল্পন্তে; কর্মণাম্ সংকূপ্ত্যৈ লোকঃ (স্বর্গাদিলোকে) সংকল্পতে; লোকস্য (স্বর্গাদি লোকের) সংকূপ্ত্যৈ সর্বম্ (সমুদয়ই) সংকল্পতে; সঃ (সেই) এষঃ (এই প্রকার) সংকল্পঃ। সংকল্পম্ উপাস্থ (উপাসনা করে) ইতি।
সরলার্থ : সংকল্পই এই সবকিছুর গতি, সংকল্পই এই সকলের আত্মা, সংকল্পেই এইসব প্রতিষ্ঠিত। দ্যুলোক ও পৃথিবী সংকল্প করিয়াছিল; বায়ু ও আকাশ সংকল্প করিয়াছিল; জল ও তেজ সংকল্প করিয়াছিল। ইহাদের সংকল্পেই বৃষ্টি সংকল্প করে (অর্থাৎ নিজের কাজ করে); বৃষ্টির সংকল্পেই অন্ন সংকল্প করে; অন্নের সংকল্পেই সমস্ত প্রাণ সংকল্প করে। প্রাণের সংকল্পেই মন্ত্র সংকল্প করে; মন্ত্রের সংকল্পেই কর্ম সংকল্প করে; কর্মের সংকল্পেই (স্বর্গাদি) লোক সংকল্প করে; এবং (স্বর্গাদি) লোকের সংকল্পে সমস্ত জগৎ সংকল্প করে। সেই সংকল্প এই রকম। (এই) সংকল্পের উপাসনা কর।
মন্তব্য : (ক) সংকল্পৈকায়নানি—সংকল্প+একায়নানি, সংকল্পে যাহাদিগের লয়; (খ) সংকল্পাত্মকানি—সংকল্পে যাহাদিগের উৎপত্তি; (গ) সংকল্পে প্রতিষ্ঠিতানি—সংকল্পে ইহাদিগের প্রতিষ্ঠা (শঙ্কর)। এই সমুদয়ের অন্য অর্থও হইতে পারে। সকলের পথ, গতি, আশ্রয় বা মিলনের স্থল যাহা তাহাই ‘একায়ন’। সংকল্প যাহাদিগের একায়ন সেই সমুদয় ‘সংকল্পৈকায়নানি’। সংকল্প যাহাদিগের আত্মা বা স্বরূপ সেই সমুদয় সংকল্পাত্মকানি।
৫২৭. স যঃ সংকল্পং ব্রহ্মেত্যুপাস্তে সংকৄপ্তান্ বৈ স লোকান্ ধুবান্ ধ্রুবঃ প্রতিষ্ঠিতান্ প্রতিষ্ঠিতোহ ব্যথমানানব্যথমানোহভিসিধ্যতি। যাবৎ সংকল্পস্য গতং তত্রাস্য যথাকামচারো ভবতি যঃ সংকল্পং ব্রহ্মেত্যু- পাস্তেঽস্তি ভগবঃ সংকল্পাদ্ভূয় ইতি সংকল্পাদ্বাব ভূয়োহস্তীতি তন্মে ভগবান্ ব্রবীত্বিতি ॥ ৩
অন্বয় : সঃ যঃ (২।১১।২ মন্তব্য) সংকল্পম্ ব্রহ্ম ইতি উপাস্তে সংকৄপ্তান্ লোকান্ বৈ সঃ লোকান্ ধুবান্ (ধ্রুবলোক সমূহকে) ধ্রুবঃ (স্বয়ং ধ্রুব হইয়া) প্রতিষ্ঠিতান্ (প্রতিষ্ঠিত লোকসমূহকে) প্রতিষ্ঠিতঃ (স্বয়ং প্রতিষ্ঠিত ‘হইয়া’) অব্যথমানান্ [লোকান্] (ব্যথারহিত লোকসমূহকে) অব্যথমানঃ (স্বয়ং ব্যথা রহিত ‘হইয়া’) অভিসিধ্যতি (প্রাপ্ত হন)। যাবৎ সংকল্পস্য গতম্, তত্র অস্য যথাকামচারঃ ভবতি, যঃ সংকল্পং ব্রহ্ম ইতি উপাস্তে। অস্তি ভগবঃ সংকল্পাৎ ভূয়ঃ ইতি। সংকল্পাৎ বাব ভূয়ঃ অস্তি ইতি। তৎ মে ভগবান্ ব্রবীতু ইতি (৭।১।৫)।
সরলার্থ : যিনি সংকল্পকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, তিনি যে সকল লোক সংকল্প করেন, সেই সকল লোক পান। নিজে ধ্রুব হইয়া ধ্রুবলোক লাভ করেন; নিজে সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়া সুপ্রতিষ্ঠিত লোক পান এবং নিজে ব্যথাশূন্য হইয়া ব্যথারহিত লোক লাভ করেন। যিনি সংকল্পকে ব্ৰহ্ম বলিয়া উপাসনা করেন, সংকল্পের যত দূর গতি তত দূর তিনি ইচ্ছানুযায়ী যাইতে পারেন। (নারদ)——হে ভগবান, সংকল্প অপেক্ষা কি কিছু শ্রেষ্ঠ আছে?’ (সনৎকুমার)—’সংকল্প অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ বস্তু অবশ্যই আছে।’ (নারদ)— ‘আপনি তাহা আমাকে বলুন।’
পঞ্চম খণ্ড – সঙ্কল্প অপেক্ষা চিত্ত শ্ৰেষ্ঠ
৫২৮. চিত্তং বাব সংকল্পাদ্ভূয়ো যদা বৈ চেতয়তেহথ সংকল্পয়তেহথ মনস্যত্যথ বাচমীরয়তি তামু নাম্নীরয়তি নাম্নি মন্ত্রা এবং ভবন্তি মন্ত্রেষু কর্মাণি ॥ ১
অন্বয় : চিত্তম্ বাব সংকল্পাৎ ভূয়ঃ। যদা (যখন) বৈ চেতয়তে (অনুভব করে, বুঝিতে পারে) অথ সংকল্পয়তে (সংকল্প করে), অথ মনস্যতি অথ বাচম্ ঈরয়তি, তাম্ উ নাম্নি ঈরয়তি, নাম্নি মন্ত্রাঃ একম্ ভবন্তি মন্ত্রেষু কর্মাণি (৭।৪।১ টীঃ)।
সরলার্থ : সংকল্প অপেক্ষা চিত্ত শ্রেষ্ঠ। মানুষ প্রথমে অনুভব করে, তারপর ক্রমে সংকল্প করে,মনন করে, এবং বাগিন্দ্রিয়কে নিযুক্ত করে; তারপর তাহাকে নাম উচ্চারণ করিতে প্রবৃত্ত করে। মন্ত্রসমূহ নামে এবং কর্মসমূহ মন্ত্রে একীভূত হয়।
৫২৯. তানি হ বা এতানি চিত্তৈকায়নানি চিত্তাত্মানি চিত্তে প্রতিষ্ঠিতানি তস্মাদ্ যদ্যপি বহুবিদচিত্তো ভবতি নায়মস্তীত্যেবৈনমাতুর্যদয়ং বেদ যদ্বা অয়ং বিদ্বান্নেখমচিত্তঃ স্যাদিতি। অথ যদ্যল্পবিচ্চিত্তবান্ ভবতি তস্মা এবোত শুশ্ৰুষন্তে চিত্তং হ্যেবৈষামেকায়নং চিত্তমাত্মা চিত্তং প্ৰতিষ্ঠা চিত্তমুপাস্ৱেতি ॥ ২
অন্বয় : তানি হ বৈ এতানি (এই সমুদয়; সঙ্কল্প, মন, বাক্, নাম, মন্ত্র ও কর্ম) চিত্ত+একায়নানি (চিত্ত যাহাদিগের একায়ন, ৭।৪।২ দ্রঃ) চিত্তাত্মানি (চিত্তই যাহাদিগের আত্মা) চিত্তে প্রতিষ্ঠিতানি (চিত্তেই প্রতিষ্ঠিত)। তস্মাৎ (সেইজন্য) যদ্যপি বহুবিৎ (বহুজ্ঞ) অচিত্তঃ (বিবেচনারহিত) ভবতি (হয়)—ন (না) অয়ম্ (এই ব্যক্তি) অস্তি (আছে) ইতি এব এবম্ আহুঃ (বলিয়া থাকে)—যৎ অয়ম্ বেদ (এ ব্যক্তি যতই জানুক না কেন) যৎ (যদি) বৈ অয়ম্ বিদ্বান্ (জানিত) ন (না) ইথম্ (এই প্রকার) অচিত্তঃ (চিত্তবিহীন) স্যাৎ (হইত) ইতি। অথ (আর) যদি অল্পবিৎ (অল্পজ্ঞ) চিত্তবান্ (বিবেচনাশীল) ভবতি (হয়), তস্মৈ (তাহাকে) এর উত শুশ্রুষন্তে (শ্রবণ করিতে ইচ্ছা করে)। চিত্তম্ হি এব এষাম্ (ইহাদিগের) একায়নম্ (একমাত্র গতি) চিত্তম্ আত্মা চিত্তম্ প্রতিষ্ঠা। চিত্তম্ উপাস্ত্ৰ ইতি (৭।৪।২ টীকা)।
সরলার্থ : চিত্তই সঙ্কল্প প্রভৃতির গতি, চিত্তই ইহাদের আত্মা এবং চিত্তেই ইহাদের প্রতিষ্ঠা। কোন মানুষ যতই জানুক না কেন তাহার বিবেচনাশক্তি না থাকিলে লোকে বলে, ‘এ ব্যক্তি (থাকিয়াও) নাই; সে যদি সত্যই বিদ্বান হইত, তবে এমন চিত্তহীন (বুদ্ধিহীন) হইত না।’ আর অল্প জানিয়াও কেহ যদি বুদ্ধিমান হয়, তবে সকলেই তাহার কথা শুনিতে ইচ্ছা করে। চিত্তই ইহাদের একমাত্র গতি, চিত্তই আত্মা এবং চিত্তেই ইহাদের প্রতিষ্ঠা। চিত্তেরই উপাসনা কর।
মন্তব্য : ‘যৎ অয়ম্ বেদ’ এই অংশ পূর্ববাক্যের সহিতও যুক্ত হইতে পারে, পরবাক্যের সহিতও যুক্ত হইতে পারে। পূর্ববর্তী বাক্যের সহিত যুক্ত হইলে ইহার অর্থ হইবে ‘এই ব্যক্তি যতই জানুক না কেন’ আর পরবর্তী বাক্যের সহিত যুক্ত হইলে ইহার অর্থ হইবে—’এই ব্যক্তি যদি জানিত’।
৫৩০. স যশ্চিত্তং ব্রহ্মেত্যুপাস্তে চিত্তান্ বৈ স লোকান্ ধুবান্ ধ্রুবঃ প্রতিষ্ঠিতা প্রতিষ্ঠিতোহব্যথমানানব্যথমানোহভিসিধ্যতি যাবচ্চিত্তস্য গতং তত্রাস্য যথাকামচারো ভবতি যশ্চিত্তং ব্রহ্মেত্যুপাস্তেঽস্তি ভগবশ্চিত্তাদ্ভূয় ইতি চিত্তাদ্ বাব ভূয়োহস্তীতি তন্মে ভগবান্ ব্রবীত্বিতি ॥ ৩
অন্বয় : সঃ যঃ (২।১১।২ মন্তব্য) চিত্তম্ ব্রহ্ম ইতি উপাস্তে, চিত্তান্ [লোকান্] (যে সমুদয় লোকের বিষয় বিবেচনা করা হইয়াছে, সেই সমুদয় লোককে) বৈ সঃ লোকান্ ধুবান্ ধ্রুবঃ, প্রতিষ্ঠিতান্ প্রতিষ্ঠিতঃ, অব্যথমানান্ অব্যথমানঃ অভিসিধ্যতি। যাবৎ চিত্তস্য গতম্, তত্র অস্য যথাকামচারঃ ভবতি—যঃ চিত্তম্ ব্রহ্ম ইতি উপস্তে’ অস্তি ভগবঃ চিত্তাৎ (চিত্ত অপেক্ষা) ভূয়ঃ ইতি। চিত্তাৎ বাব ভূয়ঃ অস্তি ইতি। তৎ মে ভগবান্ ব্রবীতু ইতি (৭।১।৫ দ্রঃ)।
সরলার্থ : যিনি চিত্তকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, তিনি যে সব লোকের বিষয় অন্তরে বিবেচনা করেন, সেই সব লোক লাভ করেন। তিনি ধ্রুব হইয়া ধ্রুবলোক সুপ্ৰতিষ্ঠ হইয়া সুপ্রতিষ্ঠ লোক, ব্যথারহিত হইয়া ব্যথারহিত লোক লাভ করেন। যিনি চিত্তকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন—চিত্তের যত দূর গতি, তত দূর তাঁহার ইচ্ছানুরূপ গতি হয়। (নারদ)— ‘ভগবান, চিত্ত অপেক্ষা কি কিছু শ্রেষ্ঠ আছে?’ (সনৎকুমার)’চিত্ত অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ বস্তু আছে। (নারদ)— ‘আপনি তাহা আমাকে বলুন।
মন্তব্য : শঙ্কর বলেন—চিত্তান্ (উপচিতান্) = যাহা সঞ্চয় করা হইয়াছে, তাহাকে। চতুর্থ খণ্ডে সঙ্কল্পের গুণকীর্তন করা হইয়াছে এবং ইহার তৃতীয় মন্ত্রে কৃন্তান্ লোকান’ লাভের বিষয় উল্লিখিত হইয়াছে। এই খণ্ডে (৭।৫) চিত্তের মহিমা বর্ণনা করা হইয়াছে এবং এখানে ‘চিত্তান্ লোকান্’ লাভের বিষয় বলা হইতেছে। উভয় অংশ তুলনা করিলেই বুঝা যাইবে যে, ‘কৃন্তান্’-এর সহিত সঙ্কল্পের যে সম্বন্ধ, ‘চিত্তান্’-এর সহিতও চিত্তের সেই সম্পর্ক। কৃপ্ত, কল্প, সঙ্কল্প একই ধাতু হইতে নিষ্পন্ন; ‘চিত্তান্’, ‘চিত্ত’ও সেইরূপ এক ধাতু হইতে নিষ্পন্ন। সুতরাং চিত্তান্ লোকান্=যে সমুদয় লোকের বিষয় বিবেচনা (চিত্ত) করা হইয়াছে, সেই সমুদয় লোককে।
ষষ্ঠ খণ্ড – চিত্ত অপেক্ষা ধ্যান শ্ৰেষ্ঠ
৫৩১. ধ্যানং বাব চিত্তাদ্ভূয়ো ধ্যায়তীব পৃথিবী ধ্যায়তীবান্তরিক্ষং ধ্যায়তীব দ্যৌধায়ন্তীবাপো ধ্যায়ন্তীব পর্বতা ধ্যায়ন্তীব দেবমনুষ্যাস্তস্মাদ্য ইহ মনুষ্যাণাং মহত্তাং প্রাপ্পুবন্তি ধ্যানাপাদাংশা ইবৈব তে ভবন্ত্যথ যে অল্পাঃ কলহিনঃ পিশুনা উপবাদিনস্তেহথ যে প্রভবো ধ্যানাপাদাংশা ইবৈব তে ভবন্তি ধ্যানমুপাস্স্বেতি ॥ ১
অন্বয় : ধ্যানম্ বাব চিত্তাৎ (চিত্ত অপেক্ষা) ভূয়ঃ (শ্রেষ্ঠ)। ধ্যায়তি (ধ্যান করিতেছে) ইব (যেন) পৃথিবী, ধ্যায়তি ইব অন্তরিক্ষম্; ধ্যায়তি ইব দ্যৌঃ; ধ্যায়ন্তি (ধ্যান করিতেছে) ইব আপঃ (জল); ধ্যায়ন্তি ইব পর্বতাঃ, ধ্যায়ন্তি ইব দেবমনুষ্যাঃ। তস্মাৎ (সেইজন্য) যে (যাহারা) ইহ (এই পৃথিবীতে) মনুষ্যাণাম্ (মনুষ্যগণের মধ্যে মহত্তাম্ (মহত্তকে) প্রাবন্তি (লাভ করে) ধ্যানাপাদাংশাঃ (ধ্যান+আপাদ+ অংশা ধ্যানফলের অংশী, আপাদ ফল লাভ) ইব এব তে ভবন্তি (হয়)। অথ যে অল্পাঃ (ক্ষুদ্রচেতা) কলহিনঃ (কলহপ্রিয়) পিশুনাঃ (ক্রূর, খল) উপবাদিনঃ (কুৎসাপ্রিয় বা চাটুকার) তে (তাহারা; ইহার ক্রিয়া ‘ধ্যান ফলের অংশী হয়’ উহ্য)। অথ যে প্রভবঃ (প্রভু, শ্রেষ্ঠ) ধ্যানাপাদাংশাঃ ইব তে ভবন্তি। ধ্যানম্ উপাস্ত্ৰ ইতি।
সরলার্থ : ধ্যান চিত্ত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। পৃথিবী যেন ধ্যান করিতেছে; অন্তরিক্ষ, স্বর্গলোক, জল ও পর্বত যেন ধ্যান করিতেছে; দেবতা এবং মনুষ্যগণ যেন ধ্যান নিরত। মানুষের মধ্যে যিনি মহত্ত্ব লাভ করেন, তিনি যেন ধ্যানফলের অংশ লাভ করেন। আর যাহারা ক্ষুদ্র, তাহারা কলহপ্রিয়, ক্রুর এবং কুৎসাপ্রিয়। যাঁহারা শ্রেষ্ঠ, তাঁহারা ধ্যানফলের অংশী হন। এই ধ্যানের উপাসনা কর।
মন্তব্য : ঋগ্বেদে (৭।১০৪।২০) এবং অথর্ববেদে ‘পিশুন’ শব্দের ব্যবহার আছে। সায়ণের অর্থ ‘কপট’; Whitmey and Lanman ইহার ‘treacherous ones’ অর্থ করিয়াছেন। এই উপনিষদের অনুবাদে মোক্ষমূলার ‘abusive’ শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন। Vedic Index-এ এই শব্দের অর্থ traitor করা হইয়াছে। শঙ্করের মতে যাহারা পরের দোষ কীর্তন করে’।
৫৩২. স যো ধ্যানং ব্রহ্মেত্যুপাস্তে যাবদ্ধ্যানস্য গতং তত্রাস্য যথাকামচারো ভবতি যো ধ্যানং ব্রহ্মেত্যুপাস্তেঽস্তি ভগবো ধ্যানাড়ূয় ইতি ধ্যানা বাব ভূয়োহস্তীতি তন্মে ভগবান্ ব্রবীত্বিতি ॥ ২
অন্বয় : সঃ যঃ (২।১১।৩ মন্তব্য) ধ্যানম্ ব্রহ্ম ইতি উপাস্তে, যাবৎ ধ্যানস্য (ধ্যানের) গতম্, তত্র অস্য যথাকামচারঃ ভবতি—যঃ ধ্যানম্ ব্রহ্ম ইতি উপাস্তে। অস্তি ভগবঃ ধ্যানাৎ (ধ্যান অপেক্ষা) ভূয়ঃ? ইতি ধ্যানাৎ বাব ভূয়ঃ অস্তি ইতি। তৎ মে ভগবান্ ব্রবীতু ইতি।
সরলার্থ : যিনি ধ্যানকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, ধ্যানের যতদূর গতি, ততদূর তিনি যেমন ইচ্ছা যাইতে পারেন। (নারদ)— ‘ভগবান্, ধ্যান অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কি কিছু আছে?’ (সনৎকুমার)—’ধ্যান অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ বস্তু আছে।’ (নারদ)— ‘আপনি তাহা আমাকে বলুন।’
সপ্তম খণ্ড – ধ্যান অপেক্ষা বিজ্ঞান শ্ৰেষ্ঠ
৫৩৩. বিজ্ঞানং বাব ধ্যানাদ্ভূয়ো বিজ্ঞানেন বা ঋগ্বেদং বিজানাতি যজুর্বেদং সামনে বৈদমাথবণং চতুর্থমিতিহাসপুরাণং পঞ্চমং বেদানাং বেদং পিত্র্যংরাশিম্ দৈবং নিধিং বাকোবাক্যমেকায়নং দেববিদ্যাং ব্রহ্মবিদ্যাং ভুতবিদ্যাং ক্ষত্রবিদ্যাং নক্ষত্রবিদ্যাং সর্প-দেবজনবিদ্যাং দিবং চ পৃথিবী চ বায়ুং চাকাশং চাপশ্চ তেজশ্চ দেবাংশ্চ মনুষ্যাংশ্চ পশূংশ্চ বয়াংসি চ তৃণবনস্পতীঞ্ঝাপদান্যাকীটপতঙ্গপিপীলকং ধর্মং চাধর্মং চ সত্যং চানৃতং চ সাধু চাসাধু চ হৃদয়জ্ঞং চাহৃদয়জ্ঞং চান্নং চ রসং চেমং চ লোকমমুং চ বিজ্ঞানেনৈব বিজানাতি বিজ্ঞানমুপাস্ৱেতি ॥ ১
অন্বয় : বিজ্ঞানম্ বাব ধ্যানাৎ (ধ্যান অপেক্ষা) ভূয়ঃ। বিজ্ঞানেন (বিজ্ঞান দ্বারা) বৈ ঋগ্বেদম্ বিজানাতি (জানে, ‘মানব’ ইহার কর্তা, উহ্য), যজুর্বেদম্, সামবেদম্, আথবর্ণম্ চতুর্থম্ ইতিহাস-পুরাণম্ পঞ্চমম্ বেদানাম্ বেদম্, পিত্র্যম্, বাশিম্, দৈবম্, নিধিম্, বাকোবাক্যম্, একায়নম্, দেববিদ্যাম্, ব্রহ্মবিদ্যাম্, ভূতবিদ্যাম্, ক্ষত্রবিদ্যাম্, নক্ষত্রবিদ্যাম্, সর্প-দেবজন-বিদ্যাম্, দিবম্ চ, পৃথিবীম্ চ, বায়ুম্ চ, আকাশম্ চ; আপঃ চ, তেজঃ চ, দেবান্ চ, মনুষ্যান্ চ, পশূন্ চ, বয়াংসি চ, তৃণ্ বনস্পতী, শ্বাপদানিঃ আকীট-পতঙ্গ-পিপীলকম্ ধৰ্মম্ চ, সত্যম্ চ, অনৃতম্ চ, সাধু চ, অসাধু চ, হৃদয়জ্ঞম্ চ, অহৃদয়জ্ঞম্ চ, অন্নম্ চ, রসম্ চ, ইমম্ চ লোকম্, অমুম্ চ, বিজ্ঞানেন এব বিজানাতি। বিজ্ঞানম্ উপাস্ত্ৰ ইতি। (৭।১।২; ৭।২।১ দ্রঃ)।
সরলার্থ : ধ্যান অপেক্ষা বিজ্ঞান শ্রেষ্ঠ। বিজ্ঞান দ্বারা ঋগ্বেদ জানা যায় এবং যজুর্বেদ, সামবেদ, চতুর্থ অথর্ববেদ, পঞ্চম ইতিহাস-পুরাণ, ব্যাকরণ, পিত্র্য, রাশি, দৈব, নিধি, বাকোবাক্য, নীতিশাস্ত্র, দেববিদ্যা, ব্রহ্মবিদ্যা, ভূতবিদ্যা, ক্ষত্রবিদ্যা, নক্ষত্রবিদ্যা, সর্প ও দেবজনবিদ্যা, দ্যৌ, পৃথিবী, বায়ু, আকাশ, জলসমূহ, তেজ, দেবগণ, মনুষ্যগণ, পক্ষিগণ, তৃণ ও বনপতিসমূহ, শ্বাপদ, কীট-পতঙ্গ-পিপীলিকা পর্যন্ত (সমস্ত প্রাণী), ধর্ম ও অধর্ম, সত্য ও অসত্য, শুভ ও অশুভ, প্রীতিকর ও অপ্রীতিকর, অন্ন ও রস, ইহলোক ও পরলোক—(এই সবই) বিজ্ঞান দ্বারা জানা যায়। এই বিজ্ঞানের উপাসনা কর।
৫৩৮. স যো বিজ্ঞানং ব্রহ্মেত্যুপাস্তে বিজ্ঞানবতো বৈ স লোকাঞ্ জ্ঞানবতোহভিসিধ্যতি যাবদ্বিজ্ঞানস্য গতং তত্রাস্য যথাকামচারো ভবতি যে বিজ্ঞানং ব্রহ্মেত্যুপাস্তেঽস্তি ভগবো বিজ্ঞানাদ্ভূয় ইতি বিজ্ঞানাদ্বাব ভূয়োহস্তীতি তন্মে ভগবান্ ব্ৰবীত্বিতি ॥ ২
অন্বয় : সঃ যঃ বিজ্ঞানম্ ব্রহ্ম ইতি উপাস্তে, বিজ্ঞানবতঃ [লোকান্] (বিজ্ঞানসম্পন্ন লোকসমূহকে) বৈ সঃ লোকান্, জ্ঞানবতঃ [লোকান্] (জ্ঞানসম্পন্ন লোকসমূহকে অভিসিধ্যতি (প্রাপ্ত হয়)। যাবৎ বিজ্ঞানস্য (বিজ্ঞানের) গতম্, তত্র অস্য যথাকামচার: ভবতি, যঃ বিজ্ঞানম্ ব্রহ্ম ইতি উপাস্তে। অস্তি ভগবঃ বিজ্ঞানাৎ (বিজ্ঞান অপেক্ষা ভূয়? ইতি। বিজ্ঞানাৎ বাব ভূয়ঃ অস্তি ইতি। তৎ মে ভগবান্ ব্রবীতু ইতি। (৭।১।৫ দ্রঃ) [বিজ্ঞান—শাস্ত্রোক্ত বিষয়ের জ্ঞান। জ্ঞান—সাধারণ বিষয়ের জ্ঞান (শঙ্কর)।]
সরলার্থ : যিনি বিজ্ঞানকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, তিনি জ্ঞানময় ও বিজ্ঞানময় জগৎ লাভ করেন। যিনি বিজ্ঞানকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, বিজ্ঞানের যত দূর গতি, তত দূর তাঁহার ইচ্ছানুযায়ী গতি হইয়া থাকে। (নারদ)— ‘ভগবান্, বিজ্ঞান অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কি কিছু আছে?’ (সনৎকুমার)—’বিজ্ঞান অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ বস্তু আছে।’ (নারদ)— ‘আপনি আমাকে তাহা বলুন।’
অষ্টম খণ্ড – বিজ্ঞান অপেক্ষা বল শ্ৰেষ্ঠ
৫৩৫. বলং বাব বিজ্ঞানাদ্ভুয়োহপি হ শতং বিজ্ঞানবতামেকো বলবানাকম্পয়তে স যদা বলী ভবত্যথোথাতা ভবত্যুত্তিষ্ঠন্ পরিচরিতা ভবতি পরিচরনুপসত্তা ভবত্যুপসীদন্দ্রষ্টা ভবতি শ্রোতা ভবতি মন্তা ভবতি বোদ্ধা ভবতি কর্তা ভবতি বিজ্ঞাতা ভবতি বলেন বৈ পৃথিবী তিষ্ঠতি বলেনান্তরিক্ষং বলেন দ্যৌবলেন পর্বতা বলেন দেবমনুষ্যা বলেন পশবশ্চ বয়াংসি চ তৃণবনস্পতয়ঃ শ্বাপদান্যাকীটপতঙ্গপিপীলক বলেন লোকস্তিষ্ঠতি বলমুপাস্ৱেতি ॥ ১
অন্বয় : বলম্ বাব বিজ্ঞানাৎ (বিজ্ঞান অপেক্ষা) ভূয়ঃ। অপি হ শতম্ বিজ্ঞানবতাম্ (বিজ্ঞানবাদিগের) একঃ বলবান্ আকম্পয়তে (কম্পিত করে)। সঃ যদা বলী ভবতি (হয়), অথ উথাতা (যে উত্থিত হইতে পারে; মতান্তরে—উদ্যমশীল) ভবতি; উত্তিষ্ঠন্ (উথিত হইয়া বা উদ্যমশীল হইয়া) পরিচরিতা (পরিচর্যাপরায়ণ) ভবতি; পরিচর (পরিচর্যা করিয়া) উপসত্তা (যে নিকটে উপবেশন করে; সমীপস্থ); উপসীদন্ (সমীপে উপবেশন করিয়া) দ্রষ্টা ভবতি, শ্রোতা ভবতি, মস্তা (মননকর্তা) ভবতি, বোদ্ধা (যে বুঝিতে পারে, সেই বোদ্ধা) ভবতি। কর্তা (যে করে সেই ব্যক্তি, অনুষ্ঠাতা) ভবতি, বিজ্ঞাতা ভবতি। বলেন (বল দ্বারা) বৈ পৃথিবী তিষ্ঠতি (অবস্থান করে), বলেন অন্তরিক্ষম্, বলেন দ্যৌঃ, বলেন পর্বতাঃ, বলেন দেবমনুষ্যাঃ, বলেন পশবঃ চ (পশুগণও), বয়াংসি চ (পক্ষিগণও) তৃণবনস্পতয়ঃ (তৃণ ও বনস্পতিসমূহ) শ্বাপদানি (হিংস্রজন্তুসমূহ) আকীটপতঙ্গপিপীলিকম্ (কীট, পতঙ্গ ও পিপীলিকা পর্যন্ত), বলেন লোকঃ (স্বর্গাদি লোক) তিষ্ঠতি বলম্ উপাস্ত্ৰ ইতি
সরলার্থ : বল বিজ্ঞান অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। একজন বলবান ব্যক্তি শত বিজ্ঞানবান ব্যক্তিকেও কম্পিত করিতে পারে। মানুষ যদি বলী হয়,তবে সে উদ্যমশীল হইতে পারে, উদ্যমশীল হইয়া (গুরু প্রভৃতির) পরিচর্যা করিতে পারে, পরিচর্যা করিয়া (তাঁহাদিগের) নিকট উপবেশন করিতে পারে, নিকটে উপবেশন করিয়া দেখিতে পারে, শুনিতে পারে, চিন্তা করিতে পারে, বুঝিতে পারে, কাজ করিতে পারে ও বিশিষ্ট জ্ঞানলাভ করিতে পারে। বলের দ্বারাই পৃথিবী প্রতিষ্ঠিত আছে। বল দ্বারাই অন্তরিক্ষ, দ্যুলোক, পর্বতসমূহ, দেবমানব, পশুপক্ষী, তৃণ-বনস্পতি, শ্বাপদ, কীটপতঙ্গ, পিপীলিকা পর্যন্ত সমস্তকিছু এবং স্বর্গাদি লোক অবস্থান করে। বলেরই উপাসনা কর।
৫৩৬. স যো বলং ব্রহ্মেত্যুপাস্তে যাবদ্বলস্য গতং তত্রাস্য যথাকামচারো ভবতি যো বলং ব্রহ্মেত্যুপাস্তেঽস্তি ভগবো বলাভূয় ইতি বালদ্বাব ভুয়োহস্তীতি তন্মে ভগবান্ ব্ৰবীত্বিতি ॥ ২
অন্বয় : সঃ যঃ বলম্ ব্রহ্ম ইতি উপাস্তে, যাবৎ বলস্য গতম্ তত্র তস্য যথাকামচারঃ ভবতি—যঃ বলম্ ব্রহ্ম ইতি উপাস্তে। অস্তি ভগবঃ বলাৎ (বল অপেক্ষা) ভূয়ঃ? ইতি। বলাৎ বাব ভূয়ঃ অস্তি ইতি। তৎ মে ভগবান্ ব্রবীতু ইতি (৭।১।৫ দ্রঃ)।
সরলার্থ : যিনি বলকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, বলের গতি যত দূর, তত দূর পর্যন্ত তাঁহার যথেচ্ছগিত। (নারদ)— ‘ভগবান, বল অপেক্ষা কি কিছু শ্রেষ্ঠ আছে?’ (সনৎকুমার)—’বল অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ বস্তু আছে। (নারদ)— ‘আপনি তাহা আমাকে বলুন।’
নবম খণ্ড – বল অপেক্ষা অনু শ্রেষ্ঠ
৫৩৭. অনুং বাব বলায়স্তস্মাদ্ যদ্যপি দশরাত্রীনাম্নীয়াদ্যদ্যু হজীবেদথ বাহদ্রষ্টাহশ্রোতাহ মন্তাহবোদ্ধাহ কর্তাঽবিজ্ঞাতা ভবত্যথাহনুস্যায়ৈ দ্রষ্টা ভবতি শ্রোতা ভবতি মন্তা ভবতি বোদ্ধা ভবতি কর্তা ভবতি বিজ্ঞাতা ভবত্যন্নমুপাস্ৱেতি ॥ ১
অন্বয় : অন্নম্ বাব বলাৎ (বল অপেক্ষা) ভূয়ঃ। তস্মাৎ (সেই জন্য) যদ্যপি দশরাত্রীঃ (অর্থাৎ দশ রাত্রি ও দশ দিন) ন আশীয়াৎ (আহার করে না) যদি ঊ হ (যদিও জীবেৎ (জীবিত থাকে), অথ (তখন) বা (নিশ্চয়ই) অদ্রষ্টা, অশ্রোতা, অমন্তা (সে মনন করিতে পারে না), অকর্তা, অবিজ্ঞাতা ভবতি। অথ অনুস্য (অন্নের) আয়ৈ (লাভে), দ্রষ্টা ভবতি, শ্রোতা ভবতি, মন্তা ভবতি, বোদ্ধা ভবতি, বিজ্ঞাতা ভবতি ইতি। অন্নম্ উপাস্থ (৭।৮।১ মঃ দ্ৰঃ)ব।
সরলার্থ : অন্ন বল অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। সেইজন্য যদি কেহ দশ দিন ও দশ রাত্রি আহার না করে, তবে সে জীবিত থাকিলেও দেখিতে পারে না, শুনিতে পারে না, চিন্তা করিতে পারে না, বুঝিতে পারে না, কাজ করিতে পারে না, জানিতে পারে না। কিন্তু আহার করিলে সে দেখিতে, শুনিতে, চিন্তা করিতে, বুঝিতে পারে, কাজ করিতে পারে, জ্ঞানলাভ করিতে পারে। এই অন্নের উপাসনা কর।
৫৩৮. স যোহনং ব্রহ্মেত্যুপাস্তেহনুবতো বৈ স লোকান্ পানবতোঽভিসিধ্যতি যাবদস্য গতং তত্রাস্য যথাকামচারো ভবতি যোহন ব্রহ্মেত্যুপাস্তেঽস্তি ভগবোহন্নায় ইত্যন্নাদ্বাব ভূয়োহস্তীতি তন্মে ভগবান্ ব্রবীত্বিতি ॥ ২
অন্বয় : সঃ যঃ অনুম্ ব্রহ্ম ইতি উপাস্টে,অন্নবতঃ [লোকান্] (অন্নবান লোকসমূহকে) বৈ সঃ লোকান্ পানবতঃ [লোকান্] (পানযুক্ত লোকসমূহকে) অভিসিধ্যতি (লাভ করে)। যাবৎ অন্নস্য (অন্নের) গতম্ তত্র অস্য যথাকামচারঃ ভবতিযঃ অনুম্ ব্ৰহ্ম ইতি উপাস্তে। অস্তি ভগবঃ অন্নাৎ (অন্ন অপেক্ষা) ভূয়ঃ ইতি। অন্নাৎ বাব ভূয়ঃ অস্তি ইতি। তৎ মে ভগবান্ ব্রবীতু ইতি (৭।১।৫ মঃ দ্ৰঃ)।
সরলার্থ : যিনি অন্নকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, তিনি অন্ন ও পানযুক্ত লোকসমূহ লাভ করেন। যিনি অন্নকে ব্রহ্ম বলিয়া উপাসনা করেন, অন্নের গতি যত দূর, তত দূর তাঁহার যথেচ্ছগতি হয়। (নারদ)—‘ভগবান্ অন্ন হইতে শ্রেষ্ঠ কি কিছু আছে?’ (সনৎকুমার)—‘অন্ন হইতেও শ্রেষ্ঠ বস্তু আছে।’ (নারদ)—‘আপনি তাহা আমাকে বলুন।’
দশম খণ্ড – অন্ন অপেক্ষা জল শ্রেষ্ঠ
৫৩৯. আপো বাবান্নাদ্ভূয়স্তস্মাদ্যদা সুবৃষ্টির্ন ভবতি ব্যাধীয়ন্তে প্রাণা অন্ন কনীয়ো ভবিষ্যতীত্যথ যদা সুবৃষ্টির্ভবত্যানন্দিনঃ প্রাণা ভবন্ত্যন্নং বহু ভবিষ্যতীত্যাপ এবেমা মূর্তা যেয়ং পৃথিবী যদন্তরিক্ষং যদ্ দ্যৌর্যৎ পর্বতা যদ্দেবমনুষ্যা যৎ পশবশ্চ বয়াংসি চ তৃণবনস্পতয়ঃ শ্বাপদান্যাকীটপতঙ্গপিপীলকমাপ এবেমা মূর্তা অপ উপাস্থেতি ॥ ১
অন্বয় : আপঃ (জল) বাব অন্নাৎ (অন্ন অপেক্ষা) ভূয়ঃ (শ্রেষ্ঠ)। তস্মাৎ (সেই জন্য) যদা (যখন) সুবৃষ্টিঃ ন ভবতি (হয়), ব্যাধীয়ন্তে (দুঃখিত হয়) প্রাণাঃ ‘অনুম্ কনীয়ঃ ভবিষ্যতি’ (অন্ন অল্প হইবে এই ভাবিয়া)। অথ যদা সুবৃষ্টিঃ ভবতি, আনন্দিনঃ (তুষ্ট) প্রাণাঃ ভবন্তি অন্নম্ বহু ভবিষ্যতি ইতি (বহু অন্ন হইবে এই ভাবিয়া)। আপঃ এব ইমাঃ (এই সমুদয়) মূর্তাঃ (বিবিধ মূর্তিরূপে পরিণত)—যা ইয়ম্ (এই) পৃথিবী যৎ (এই যে অন্তরিক্ষম্, যৎ দ্যৌঃ, যৎ পর্বতাঃ, যৎ দেবমনুষ্যাঃ যৎ পশবঃ চ, বয়াংসি চ তৃণবনস্পতয়ঃ, শ্বাপদানি আকীট-পতঙ্গ-পিপীলকম্—আপঃ এব ইমাঃ মূর্তাঃ। অপঃ (জলকে) উপাস্থ ইতি (৭।৮।১ দ্রঃ)।
সরলার্থ : জল অন্ন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। সেইজন্য যখন সুবৃষ্টি না হয় তখন অন্ন কম উৎপন্ন হইবে ভাবিয়া প্রাণ দুঃখিত হয়; আর যখন সুবৃষ্টি হয়, তখন বহু অন্ন হইবে ভাবিয়া প্রাণ আনন্দিত হয়। এই যে পৃথিবী, এই যে অন্তরিক্ষ, দ্যুলোক, পর্বতসমূহ, দেব ও মনুষ্য, পশু-পক্ষী, তৃণ-বনস্পতি, শ্বাপদ এবং কীট-পতঙ্গ—পিপীলিকা পর্যন্ত সমস্ত প্রাণী—এই সব জলেরই রূপ। জলেরই উপাসনা কর।
৫৪০. স যোহপো ব্রহ্মেত্যুপাস্ত আপ্নোতি সর্বান্ কামাংতৃপ্তিমান্ ভবতি যাবদপাং গতং তত্রাস্য যথাকামচারো ভবতি যোহপো ব্রহ্মেত্যুপাস্তেহস্তি ভগবোহভ্যো ভূয় ইত্যঙ্যো বাব ভূয়োহস্তীতি তন্মে ভগবান্ ব্রবীত্বিতি ॥ ২
অন্বয় : সঃ যঃ অপঃ (জলকে ‘ব্রহ্ম’ ইতি উপাস্তে, আপ্নোতি (প্রাপ্ত হয়) সর্বান্ কামান্ (সমুদয় কল্পনাকে) তৃপ্তিমান্ ভবতি (হয়)। যাবৎ অপাম্ (জলের) গতম্, তত্র অস্য যথাকামচারঃ ভবতিযঃ অপঃ ব্রহ্ম ইতি উপাস্তে। অস্তি ভগবঃ অভ্যঃ (জল অপেক্ষা) ভুয়ঃ? ইতি। অভ্যঃ বাব ভূয়ঃ অস্তি ইতি। তৎ মে ভগবান্ ব্রবীতু ইতি (৭।১।৫ টীকা)।
সরলার্থ : যিনি জলকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, তিনি যাবতীয় কাম্যবস্তু লাভ করিয়া পরিতৃপ্ত হন। যিনি জলকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, জলের গতি যত দূর, তত দূর পর্যন্ত তাঁহার স্বাধীন বিচরণ। (নারদ)— ‘ভগবান্, জল হইতে কি শ্রেষ্ঠ কিছু আছে?” (সনৎকুমার)—’জল হইতে শ্রেষ্ঠ বস্তু নিশ্চয়ই আছে।’ (নারদ)— ‘আপনি তাহা আমাকে বলুন। ত
একাদশ খণ্ড – জল অপেক্ষা তেজ শ্ৰেষ্ঠ
৫৪১. তেজো বাবাঙো ভূয়োস্তদ্বা এতদ্বায়ুমাগৃহ্যাকাশমভিতপতি তদাহুর্নি- শোচতি নিতপতি বর্ধিষ্যতি বা ইতি তেজ এব তৎ পূর্বং দর্শয়িত্বা- হথাপঃ সৃজতে তদেতদূর্ধ্বাভিশ্চ তিরশ্চীভিশ্চ বিদ্যুত্তিরাহ্রাদাশ্চরন্তি তস্মাদাহুর্বিদ্যোততে স্তনয়তি বর্ধিষ্যতি বা ইতি তেজ এব তৎ পূর্বং দর্শয়িত্বাহথাপঃ সৃজতে তেজ উপাস্থেতি ॥ ১
অন্বয় : তেজঃ বাব অভ্যঃ (জল অপেক্ষা) ভূয়ঃ (শ্রেষ্ঠ)। তৎ (সেইজন্য) বৈ এতৎ বায়ুম্ আগৃহ্য (অবলম্বন করিয়া) আকাশম্ অভিতপতি (উত্তপ্ত করে)। তদা (তখন) আহুঃ (লোকে বলে) নিশোচতি (উত্তাপ দিতেছে, দগ্ধ করিতেছে) নিতপতি (সন্তপ্ত করিতেছে) বর্ধিষ্যতি (বর্ষণ করিবে) বৈ ইতি। তেজঃ এব তৎ (এই সমুদয় অবস্থাকে) পূর্বম (প্রথমে) দর্শয়িত্বা (দেখাইয়া) অথ (পরে) অপঃ (জলকে সৃজতে (সৃষ্টি করে)। তৎ এতৎ [আহ্লাদাঃ]——(মেঘধ্বনি সমুদয়; মন্তব্য দ্রষ্টব্য) ঊর্ধ্বাভিঃ চ তিরশ্চীভিঃ চ বিদ্যুৎভিঃ (ঊর্ধ্বগতিবিশিষ্ট এবং তির্যক গতি বিশিষ্ট বিদ্যুৎগণের সহিত) আহ্রাদাঃ চরন্তি (বিচরণ করে)। তস্মাৎ (সেই-জন্য) আহুঃ বিদ্যোততে (বিদ্যুৎ প্ৰকাশ পাইতেছে) স্তনয়তি (গর্জন করিতেছে) বর্ধিষ্যতি বৈ ইতি। তেজঃ এব তৎ পূর্বম্ দর্শয়িত্বা অথ অপঃ সৃজতে। তেজঃ উপাস্ত্র (উপাসনা কর) ইতি।
সরলার্থ : তেজ জল অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। যখন এই তেজ বায়ুকে আশ্রয় করিয়া আকাশকে উত্তপ্ত করে, তখন লোকে বলে, ‘বড় গরম, গা পোড়াইতেছে, বৃষ্টি হইবে।’ তেজ প্রথমে এই অবস্থা দেখাইয়া পরে জল সৃষ্টি করে। সেইজন্য ঊর্ধ্বগামী ও আঁকাবাঁকা বিদ্যুৎফুরণের সঙ্গে সঙ্গে চলে মেঘের গর্জন। তখন লোকে বলে ‘বিদ্যুৎ চমকাইতেছে, মেঘ ডাকিতেছে, বৃষ্টি হইবে।’ তেজ পূর্বে এইরূপ দেখাইয়া পরে জল সৃষ্টি করে। (এই) তেজেরই উপাসনা কর।
৫৪২. স যস্তেজো ব্রহ্মেত্যুপাস্তে তেজস্বী বৈ স তেজস্বতো লোকান্ ভাস্বতোহপহততমস্কানভিসিধ্যতি যাবত্তেজসো গতং তত্ৰাস্য যথাকামচারো ভবতি যস্তেজো ব্রহ্মেত্যুপাস্তেহস্তি ভগবস্তেজসো ভূয় ইতি তেজসো বাব ভূয়োহস্তীতি তন্মে ভগবান্ ব্ৰবীত্বিতি ॥ ২
অন্বয় : সঃ যঃ তেজঃ ব্রহ্ম ইতি উপাস্তে তেজস্বী বৈ সঃ তেজস্বতঃ লোকান্ (তেজোময় লোকসমূহকে) ভাস্বতঃ [লোকান্] (প্রকাশবান্ বা দীপ্তিমান্ লোকসমূহকে অপহততমস্কান্ [লোকান্] (যে সমুদয় লোকের অন্ধকার বিদূরিত হইয়াছে, সেই সমুদয় লোককে) অভিসিধ্যতি (লাভ করে)। যাবৎ তেজসঃ গতম্; তত্র অস্য যথাকামচারঃ ভবতি—যঃ তেজঃ ব্ৰহ্ম ইতি উপাস্তে। অস্তি ভগবঃ তেজসঃ (তেজ অপেক্ষা) ভূয়ঃ? ইতি। তেজসঃ বাব ভূয়ঃ অস্তি ইতি। তৎ মে ভগবান্ ব্রবীতু ইতি।
সরলার্থ : যিনি তেজকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন তিনি তেজস্বী হন। তিনি তেজোময়, দীপ্তিমান এবং তমোহীন লোক লাভ করেন। যিনি তেজকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, তেজের গতি যতদূর ততদূর পর্যন্ত তাঁহার যথেচ্ছগতি। (নারদ) ‘তেজ হইতে কি শ্রেষ্ঠ কিছু আছে?’ (সনৎকুমার)—’তেজ হইতে শ্রেষ্ঠ বস্তু অবশ্যই আছে।’ (নারদ)—‘আপনি তাহা আমাকে বলুন।’
দ্বাদশ খণ্ড – তেজ অপেক্ষা আকাশ শ্ৰেষ্ঠ
৫৪৩. আকাশো বাব তেজসো ভূয়ানাকাশে বৈ সূর্যাচন্দ্রমসাবুভৌ বিদ্যুম্ন – ক্ষত্রাণ্যগ্নিরাকাশেনাহ্বয়ত্যাকাশেন শূণোত্যাকাশেন প্রতিশৃণোত্যাকাশে রমত আকাশে ন রমত আকাশে জায়ত আকাশমভিজায়ত আকাশমুপাস্থেতি ॥ ১
অন্বয় : আকাশঃ বাব তেজসঃ (তেজ অপেক্ষা) ভূয়ান্ (শ্রেষ্ঠ)। আকাশে বৈ সূর্যাচন্দ্রমসৌ (সূর্য ও চন্দ্রমা) উভৌ (এই উভয়) বিদ্যুৎ নক্ষত্রাণি (নক্ষত্রসমূহ) অগ্নিঃ। আকাশেন (আকাশ দ্বারা) আহ্বয়তি (আহ্বান করে); আকাশেন শৃণোতি (শ্রবণ করে আকাশেন প্রতিশৃণোতি (প্রত্যুত্তর দেয়), আকাশে রমতে (রমণ করে),আকাশে ন রমতে; আকাশে জায়তে (উৎপন্ন হয়), আকাশম্ অভিজায়তে (আকাশের অভিমুখে উত্থিত হয়; বৃক্ষাদি উৎপন্ন হইয়া আকাশের অভিমুখে উত্থিত হয়)। আকাশম্ (আকাশকে) উপাস্ত্ৰ ইতি।
সরলার্থ : আকাশ তেজ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। আকাশেই চন্দ্র ও সূর্য উভয়ে, বিদ্যুৎ, নক্ষত্রসমূহ এবং অগ্নি রহিয়াছে। আকাশের সাহায্যে মানুষ পরস্পরকে আহ্বান করে, শ্রবণ করে, উত্তর প্রত্যুত্তর দেয়। মানুষ আকাশেই আনন্দ লাভ করে, আকাশেই দুঃখ ভোগ করে। আকাশেরই উপাসনা কর।
৫৪৪. স য আকাশং ব্রহ্মেত্যুপাস্ত আকাশবতো বৈ স লোকান্ প্রকাশবতোহ- সংবাধানুরুগায়বতোহভিসিধ্যতি যাবদাকাশস্য গতং তত্রাস্য যথাকামচারো ভবতি য আকাশং ব্রহ্মেত্যুপাস্তেঽস্তি ভগব আকাশায় ইত্যাকাশাদ্বাব ভূয়োহস্তীতি তন্মে ভগবান্ ব্রবীত্বিতি ॥ ২
অন্বয় : সঃ যঃ আকাশম্ ব্রহ্ম ইতি উপাস্তে, আকাশবতঃ [লোকান্] (আকাশবান্ অর্থাৎ বিস্তারযুক্ত লোকসমূহকে) সঃ লোকান্ প্রকাশবতঃ (প্রকাশবান অর্থাৎ উজ্জ্বল লোকসমূহকে) অসংবাধা [লোকান্] (বাধারহিত লোকসমূহকে) উরুগায়বতঃ [লোকান্] (বিস্তীর্ণ) অভিসিধ্যতি (প্রাপ্ত হয়)। যাবৎ আকাশস্য (আকাশের) গতম্, তত্র অস্য যথাকামচারঃ ভবতি—যঃ আকাশম্ ব্রহ্ম ইতি উপাস্তে। অস্তি ভগবঃ আকাশাৎ (আকাশ অপেক্ষা) ভূয়ঃ? ইতি। আকাশাৎ বাব ভূয়ঃ অস্তি ইতি। তৎ মে ভগবান্ ব্রবীতু ইতি। (৭।১।৫ মন্ত্র দ্রঃ)।
সরলার্থ : যিনি আকাশকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, তিনি জ্যোতির্ময়, বাধাহীন এবং সুবিস্তীর্ণ লোকসমূহ লাভ করেন। যিনি আকাশকে ব্রহ্মরূপে উপাসনা করেন, আকাশের গতি যত দূর তত দূর তাঁহার স্বাধীন বিচরণ হইয়া থাকে। (নারদ)— ‘আকাশ অপেক্ষা কি শ্রেষ্ঠ কিছু আছে?’ (সনৎকুমার)—‘আকাশ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ বস্তু আছে।’ (নারদ)—‘আপনি তাহা আমাকে বলুন’।
মন্তব্য : ‘অসংবাধান্,—‘সম্বাধ’ শব্দের দুই অর্থ : (ক) পরস্পরের পীড়া উৎপাদন, (খ) সংকীর্ণ স্থান। স্থান সংকীর্ণ হইলেই পরস্পর পরস্পরকে বাধা দিতে পারে এবং পরস্পরের পীড়া উৎপাদন করিতে পারে। সুতরাং অর্থ বিভিন্ন হইলেও উভয়ের ভাবার্থ একই। উরুগায়বতঃ ইত্যাদি—যাস্ক ঋগ্বেদের ব্যাখ্যায় বলিয়াছেন, উরু অর্থ বিস্তীর্ণ; উরুগায়—বিস্তীর্ণ পাদবিক্ষেপ। ‘গায়’—’গা’ ধাতু হইতে, এই ধাতুর অর্থ ‘গতি’। উরুগায়বৎ—যে স্থলে বিস্তীর্ণ পাদবিক্ষেপ করা যায়।
ত্রয়োদশ খণ্ড – আকাশ অপেক্ষা স্মৃতি শ্ৰেষ্ঠ
৫৪৫. স্মরো বাবাকাশাদ্ভূয়স্তস্মাদ্যদ্যপি বহব আসীর স্মরন্তো নৈব তে কঞ্চনশৃণুয়ুর্ন মন্ত্রীরন্ন বীজানীরন্ যদা বাব তে স্মরেয়ুরথ শৃণুয়ুরথ মন্ত্রীরথ বিজানীর স্মরেণ বৈ পুত্রান্ বিজানাতি স্মরেণ পশূন্ স্মরমুপাস্বেতি ॥ ১
অন্বয় : স্বরঃ (স্মৃতি) বাব আকাশাৎ (আকাশ অপেক্ষা) ভূয়ঃ (শ্রেষ্ঠ)। তস্মাৎ (সেই জন্য) যদ্যপি বহবঃ (বহুলোক) অসীর (উপবেশন করে, একত্র হয়) ন (না) স্মরন্তঃ (স্মরণ করিয়া) ন এব তে (তাহারা) কম্+চন (কোন বিষয়কে বা ব্যক্তিকে) শৃণুয়ুঃ (শুনিতে পারে), ন মন্ত্রীর (মনন করিতে পারে) ন বিজানীর (জানিতে পারে) যদা (যখন) বাব তে (তাহারা) স্মরেয়ুঃ (স্মরণ করিতে পারে), অথ মন্বীর, অথ বিজানীর; স্মরেণ বৈ (স্মৃতি দ্বারাই) পুত্রান্ (পুত্রগণকে) বিজানাতি (জানে), স্মরেণ পশূন্ (পশুসমূহকে)। স্মরম্ (স্মৃতিকে) উপাস্ত্র (উপাসনা কর) ইতি।
সরলার্থ : স্মৃতি আকাশ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। তাই, যদি স্মৃতি না থাকে, তবে বহুলোক একত্র হইলেও তাহারা কোন বিষয় শুনিতে, চিন্তা করিতে বা জানিতে পারে না। আর যদি তাহারা স্মরণ করিতে পারে, তবে তাহারা শুনিতে, চিন্তা করিতে এবং জানিতে পারে। স্মৃতির সাহায্যে পুত্র ও পশুগণকে জানা যায়। স্মৃতিকে উপাসনা কর।
৫৪৬. স যঃ স্মরং ব্রহ্মেত্যুপাস্তে যাবৎ স্মরস্য গতং তত্রাস্য যথাকামচারো ভবতি যঃ স্মরং ব্রহ্মেত্যুপাস্তেঽস্তি ভগবঃ স্মরাদ্ভূয় ইতি; স্মরাদ্বাব ভূয়োহস্তীতি তন্মে ভগবান্ ব্ৰবীত্বিতি ॥ ২
অন্বয় : সঃ যঃ স্মরম্ (স্মরণকে) ব্রহ্ম ইতি উপাস্তে, যাবৎ স্মরস্য (স্মৃতির গতম্, তত্র অস্য যথাকামচারঃ ভবতি — যঃ স্মরম্ ব্রহ্ম ইতি উপাস্তে। অস্তি ভগবঃ স্মরাৎ (স্মৃতি অপেক্ষা) ভূয়ঃ? ইতি। স্মরাৎ বাব ভূয়ঃ অস্তি ইতি তৎ মে ভগবান্ ব্রবীতু ইতি (৭।১।৫ দ্রঃ)
সরলার্থ : যে ব্যক্তি স্মরণকে ব্রহ্ম বলিয়া উপাসনা করেন, স্মরণের গতি যত দূর তত দূর তাহার স্বাধীন গতি। (নারদ)— ‘ভগবান্, স্মৃতি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কি কিছু আছে?’ (সনৎকুমার)—‘স্মরণ অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ বস্তু আছে।’ (নারদ)— ‘আপনি তাহা আমাকে বলুন।’
চতুর্দশ খণ্ড – স্মৃতি অপেক্ষা আশা শ্রেষ্ঠ
৫৪৭. আশা বাব স্মরাভূয়স্যাশেদ্ধো বৈ স্মরো মন্ত্রানধীতে কর্মাণি কুরুতে পুত্ৰাংশ্চ পশৃংশ্চেচ্ছত ইমং চ লোকমমুং চেচ্ছত অশামুপাস্থেতি ॥ ১
অন্বয় : আশা (অপ্রাপ্ত বস্তু পাইবার আকাঙ্ক্ষা) বাব স্মরাৎ (স্মৃতি অপেক্ষা ভূয়সী (শ্রেষ্ঠ)। আশা+ইদ্ধঃ (আশা দ্বারা উদ্দীপিত হইয়া; ইদ্ধ—প্রজ্বলিত) বৈ স্মরঃ (স্মৃতি) মন্ত্রান্ (মন্ত্রসমূহকে) অধীতে (অধ্যয়ন করে), কর্মাণি (কর্মসমূহকে) কুরুতে (করে), পুত্রান্ চ (পুত্রগণকে), পশূন্ চ (পশুসমূহকে) ইচ্ছতে (ইচ্ছা করে) ইমম্ চ লোকম্ (এই লোককে) অমুম্ চ (ঐ লোককে, পরলোককে) ইচ্ছতে। আশাং উপাস্থ ইতি (আশারই উপাসনা কর)।
সরলার্থ : স্মৃতি অপেক্ষা আশা শ্রেষ্ঠ। আশা দ্বারা উদ্দীপিত হইয়া স্মৃতি (অর্থাৎ স্মৃতিমান পুরুষ) মন্ত্র পাঠ করে, কর্মের অনুষ্ঠান করে, পুত্র ও পশু কামনা করে, ইহলোক ও পরলোক লাভ করিবার ইচ্ছা করে। (এই) আশারই উপাসনা কর।
৫৪৮. স য আশাং ব্রহ্মেত্যুপাস্ত আশয়াস্য সর্বে কামাঃ সমৃধ্যন্ত্যমোঘা হাস্যাশিষো ভবন্তি যাবদাশায়া গতং তত্রাস্য যথাকামচারো ভবতি য আশাং ব্রহ্মেত্যুপাস্তেঽস্তি ভগব আশায়া ভূয় ইত্যাশায়া বাব ভূয়োহস্তীতি তন্মে ভগবান্ বব্ৰীত্বিতি ॥ ২
অন্বয় : সঃ যঃ আশাম্ ব্রহ্ম ইতি উপাস্তে, আশয়া (আশাদ্বারা) অস্য (ইহার) সর্বে কামাঃ (সমুদয় কামনা) সমৃধ্যন্তি (বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়), অমোঘাঃ (অব্যর্থ; মোঘ নিষ্ফল) হ অস্য আশিষঃ (প্রার্থনা, ইচ্ছা), ভবন্তি (হয়)। যাবৎ আশায়াঃ (আশার) গতম্, তত্র অস্য যথাকামচারঃ ভবতি যঃ আশাম্ ব্রহ্ম ইতি উপাস্তে। অস্তি ভগবঃ আশায়াঃ (আশা অপেক্ষা) ভূয়ঃ? ইতি আশায়াঃ বাব ভূয়ঃ অস্তি ইতি। তৎ মে ভগবান্ ব্রবীতু ইতি (৭।১।৫ টীকা)।
সরলার্থ : যিনি আশাকে ব্রহ্ম বলিয়া উপাসনা করেন, আশা দ্বারাই তাঁহার সব কামনা পূর্ণ এবং প্রার্থনা সফল হয়। যিনি আশাকে ব্রহ্ম বলিয়া উপাসনা করেন, আশার গতি যতদূর, ততদূর তাঁহার যথেচ্ছ গতি হয়। (নারদ)— ‘আশা অপেক্ষা শ্ৰেষ্ঠ কি কিছু আছে?’ (সনৎকুমার)—’আশা অপেক্ষা নিশ্চয়ই শ্রেষ্ঠ বস্তু আছে।’ (নারদ)’আপনি তাহা আমাকে বলুন।
পঞ্চদশ খণ্ড – আশা অপেক্ষা প্ৰাণ শ্ৰেষ্ঠ
৫৪৯. প্রাণো বা আশায়া ভূয়ান্ যথা বা অরা নাভৌ সমর্পিতা এবমস্মিন্ প্রাণে সর্বং সমর্পিতং প্রাণঃ প্রাণেন যাতি প্ৰাণঃ প্রাণং দদাতি প্ৰাণায় দদাতি প্ৰাণো হ পিতা প্রাণো মাতা প্রাণো ভ্রাতা প্রাণঃ স্বসা প্রাণ আচার্যঃ প্রাণো ব্রাহ্মণঃ ॥ ১
অন্বয় : প্ৰাণঃ বৈ আশায়াঃ (আশা অপেক্ষা) ভূয়ান্ (শ্রেষ্ঠ)। যথা (যেমন) বৈ অরাঃ (অরসমূহ; অর—চাকার কেন্দ্র হইতে পরিধি পর্যন্ত বিস্তৃত শলাকা) নাভৌ (চাকার নাভিতে; নাভি—কেন্দ্রস্থিত কাষ্ঠ, এই কাষ্ঠে করসমূহের এক দিক্ প্ৰবিষ্ট হইয়া থাকে); সমর্পিতাঃ (নিহিত হইয়া থাকে)—এবম্ (এই প্রকার) অস্মিন্ প্রাণে (এই প্রাণে)) সর্বম্ (সমুদয়) সমর্পিতম্ (নিহিত)। প্রাণঃ প্রাণেণ (প্রাণদ্বারা; স্বশক্তি দ্বারা) যাতি (যায়, স্বীয় কার্য করে), প্রাণঃ প্রাণম্ দদাতি (দান করে), প্রাণায় (প্রাণকে, প্রাণের উদ্দেশ্যে) দদাতি। প্রাণঃ হ পিতা, প্রাণঃ মাতা, প্রাণঃ ভ্রাতা, প্রাণঃ স্বসা (ভগিনী) প্রাণঃ আচার্যঃ, প্ৰাণঃ ব্রাহ্মণঃ।
সরলার্থ : প্রাণ আশা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। (রথের চাকার) অরসমূহ যেমন (রথের) নাভিতে প্রবিষ্ট থাকে, তেমনি সমস্তই এই প্রাণে প্রতিষ্ঠিত আছে। প্রাণদ্বারাই প্রাণ কাজ করে, প্রাণই প্রাণকে এবং প্রাণের উদ্দেশ্যে দান করে। প্রাণই পিতা, প্রাণই মাতা, প্রাণই ভ্রাতা, প্রাণই ভগ্নী, প্রাণই আচার্য এবং প্রাণই ব্ৰাহ্মণ।
৫৫০. স যদি পিতরং বা মাতরং বা ভ্রাতরং বা স্বসারং বাচার্যং বা ব্ৰাহ্মণং বা কিঞ্চিদ্ ভূশমিব প্রত্যাহ ধিক্ ত্বাত্ত্বিত্যেবৈনমাহুঃ পিতৃহা বৈ ত্বমসি মাতৃহা বৈ ত্বমসি ভ্রাতৃহা বৈ ত্বমসি স্বস্হা বৈ ত্বমস্যাচার্যহা বৈ ত্বমসি ব্রাহ্মণহা বৈ ত্বমসীতি ॥ ২
অন্বয় : সঃ (কেহ) যদি পিতরম্ বা (পিতাকে), মাতরম্ বা (বা মাতাকে), ভ্রাতরম্ বা (বা ভ্রাতাকে), স্বসারম্ বা (বা স্বসাকে), আচার্যম্ বা (বা আচার্যকে) ব্রাহ্মণম্ (বা ব্রাহ্মণকে) কিম + চিৎ (কিছু) ভূশম্ ইব (যেন রুক্ষভাবে; শঙ্কর বলেন—এখানে ‘তুমি’ কিংবা এই প্রকার কোন অনুচিত বাক্যপ্রয়োগের কথা বলা হইয়াছে) প্ৰতি-আহ (প্রত্যুত্তর করে), ধিক্ ত্বা (তোমাকে ধিক) অস্তু (হউক) ইতি বা এনম্ (ইহাকে) আহুঃ (বলিয়া থাকে) পিতৃহা (পিতৃহন্তা) বৈ ত্বম্ (তুমি) অসি (হও), মাতৃহা (মাতৃহন্তা) বৈ ত্বম্ অসি, ভ্রাত্হা (ভ্রাতৃহন্তা) বৈ ত্বম্ অসি, স্বস্হা (ভগিনীহন্তা) বৈ ত্বম্ অসি, আচার্যহা (আচার্যহন্তা) বৈ ত্বম্ অসি, ব্রাহ্মণহা (ব্রাহ্মণহন্তা) বৈ ত্বম্ অসি ইতি।
সরলার্থ : যদি কেহ পিতা, মাতা, ভ্রাতা, ভগ্নী, আচার্য বা ব্রাহ্মণকে সম্মান না দেখাইয়া রুক্ষভাবে উত্তর দেয়, তবে লোকে তাহাকে বলে— ‘তোমাকে ধিক্, তুমি পিতৃহন্তা, তুমি মাতৃহন্তা, তুমি ভ্রাতৃহন্তা, তুমি ভগিনীহন্তা, তুমি আচার্যহন্তা, তুমি ব্ৰাহ্মণহন্তা।’
৫৫১. অথ যদ্যপ্যেনানুৎক্রান্তপ্রাণাঞ্ছলেন সমাসং ব্যতিষন্দহেন্নৈবৈনং ব্রুয়ুঃ পিতৃহাসীতি ন মাতৃহাসীতি ন ভ্রাতৃহাসীতি ন স্বগৃহাসীতি নাচার্যহাসীতি ন ব্রাহ্মণহাসীতি ॥ ৩
অন্বয় : অথ+অপি এনান্ (ইহাদিগকে) উৎক্রান্তপ্রাণান্ (মৃতদেহকে; যাহাদিগের প্রাণ উৎক্রমণ করিয়াছে তাহাদিগকে) শূলেন (শূল দ্বারা) সমাসম্ (একত্র করিয়া) ব্যতিষম্ (বৈদিক প্রয়োগ, খণ্ড খণ্ড করিয়া) দহেৎ (দগ্ধ করে), ন এব এনম্ (ইহাকে) ব্রুয়ুঃ (বলিয়া থাকে)—পিতৃহা অসি ইতি ন (না, ইহা বলিবে না) মাতৃহা অসি ইতি ন; ভ্রাতৃহা অসি ইতি ন; স্বস্হা অসি ইতি ন; আচার্যহা অসি ইতি ন, ন ব্রাহ্মণহা অসি ইতি।
সরলার্থ : কিন্তু ইহারা বিগতপ্রাণ হইলে যদি কেহ শূলদ্বারা (দেহের অবয়ব- সমূহকে) একত্র করিয়া, বা খণ্ড খণ্ড করিয়া দগ্ধ করে, তাহা হইলেও কেহ বলে না— ‘তুমি পিতৃহন্তা, তুমি মাতৃহন্তা, তুমি ভ্রাতৃহন্তা, তুমি ভগিনীহন্তা, তুমি আচার্যহন্তা, তুমি ব্রাহ্মণহন্তা।’
মন্তব্য : শব দাহ করিবার সময় বর্তমান সময়েও অনেক স্থানে কাঁচা বাঁশ দ্বারা বা কাঁচা কাঠ দ্বারা দেহকে উলট পালট করিয়া দেওয়া হয়, অনেক সময়ে ইহার দ্বারা দেহকে বিদ্ধ করিয়া ছিন্ন ভিন্ন করা হয়। এই কার্যের জন্য এখানে শূলের ব্যবহারের কথা বলা হইয়াছে।
৫৫২. প্ৰাণো হোবৈতানি সর্বাণি ভবতি স বা এষ এবং পশ্যন্নেবং মন্বান এবং বিজানন্নতিবাদী ভবতি তং চেদ্ ব্রুয়ুরতিবাদ্যসীত্যতিবাদ্যস্মীতি ব্রুয়ান্নাপহ্নুবীত ॥ ৪
অন্বয় : প্রাণঃ হি এব এতানি সর্বাণি ভবতি (এই সমুদয় হয়)। সঃ বৈ এষঃ (সেই প্রাণবিৎ ব্যক্তি) এবম্ (এই প্রকার) পশ্যন্ (দেখিয়া) এবম্ মন্থানঃ (মনন করিয়া) এবম্ বিজানন্ (জানিয়া) অতিবাদী ভবতি (হন)। তম্ (তাহাকে) চেৎ (যদি) ব্রুয়ুঃ (কেহ বলে) অতিবাদী অসি (হও) অতিবাদী অমি (হই) ইতি ব্লুয়াৎ (বলিবে)। ন অপহ্নুবীত (অস্বীকার করিবে না; গোপন করিবে না)।
সরলার্থ : প্রাণই এই সব কিছু হইয়াছে। যিনি এই ভাবে দেখেন, মনন করেন এবং এই রকমই জ্ঞান লাভ করেন, তিনি ‘অতিবাদী’ হন। যদি কেহ তাঁহাকে বলে ‘তুমি অতিবাদী’, তিনি অস্বীকার না করিয়া বলিবেন, ‘হাঁ, আমি অতিবাদী’।
মন্তব্য : ‘নামই ব্ৰহ্ম’ হইতে আরম্ভ করিয়া ‘আশাই ব্রহ্ম’ এই পর্যন্ত যে তত্ত্ব বলা হইয়াছে, তাহা অনেকে জানেন। কিন্তু ‘প্রাণই ব্রহ্ম’ এই জ্ঞান পূর্বোক্ত সত্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। যিনি ইহা জানেন, তিনি পূর্ব পূর্ব সত্যকে অতিক্রম করিয়া নূতন তত্ত্ব লাভ করিয়াছেন। তিনি কিছু অতিরিক্ত জানেন এবং অতিরিক্ত বলেন তাঁহার নাম ‘অতিবাদী’। অতি—অধিক; বাদী—বক্তা। অতিবাদী—অধিক তত্ত্বের বক্তা। ‘মৈত্রায়ণ’ উপনিষদে (৪।৫) ‘অতিবাদী’ শব্দের উল্লেখ আছে (সম্ভবত অর্থ একই)। ‘অতিবাদী ‘ শব্দের একটা অর্থ ‘যে বেশী কথা বলে’। নিন্দাচ্ছলে অনেক জায়গায় এই শব্দ ব্যবহৃত হইত। মুণ্ডকোপনিষদে (৩।১।৪) এই শব্দের ব্যবহার আছে।
ষোড়শ খণ্ড – প্রাণবিৎ ও সত্যবিদের প্রভেদ
এষ তূ বা অতিবদতি যঃ সত্যেনাতিবদতি সোহহং ভগবঃ সত্যেনাতিবদানীতি। সত্যং ত্বেব বিজিজ্ঞাসিতব্যমিতি সত্যং ভগবো বিজিজ্ঞাস ইতি ॥ ১
অন্বয় : এষঃ (এই ব্যক্তি) তু বৈ অতিবদতি (অতিবাদী হন) যঃ (যিনি) সত্যেন (সত্যদ্বারা, সত্যস্বরূপের জ্ঞান লাভ করিয়া) অতিবদতি। সঃ অহম্ (এমন যে আমি) ভগবঃ! সত্যেন অতিবদানি (অতিবাদী হইতে ইচ্ছা করি) ইতি। সত্যম্ তু এব বিজিজ্ঞাসিতবাম্ (বিশেষরূপে জানিবার ইচ্ছা করিতে হইবে) ইতি। সত্যম্ (সত্যকে ভগবঃ! বিজিজ্ঞাসে (জিজ্ঞাসা করি) ইতি।
সরলার্থ : কিন্তু যিনি সত্যস্বরূপকে জানিয়া অতিবাদী হন, তিনিই (প্রকৃতপক্ষে) অতিবাদী। (নারদ)—ভগবান, আমি সত্যস্বরূপকে জানিয়া অতিবাদী হইতে চাই। (সনৎকুমার)—তবে সত্যস্বরূপকে বিশেষরূপে জানিবার জন্য উৎসুক হইতে হইবে। (নারদ)—ভগবান্, আমি সত্য সত্যস্বরূপকেই বিশেষরূপে জানিতে চাই।
মন্তব্য : ‘প্রাণই ব্ৰহ্ম’ এই পর্যন্ত শুনিয়াই নারদ পরিতৃপ্ত হইলেন। তিনি ভাবিলেন আমি অতিবাদী হইয়াছি আমি শ্ৰেষ্ঠ সত্য লাভ করিয়াছি। এইজন্য তিনি আর এই প্রশ্ন করিলেন না—’ভগবান প্রাণ অপেক্ষা কি শ্রেষ্ঠ কিছু আছে?’ নারদের এই ভুল বিশ্বাস দূর করিবার জন্য সনৎকুমার নিজেই উপদেশ দিতে লাগিলেন, আর কোন প্রশ্নের অপেক্ষা করিলেন না। তাঁহার উপদেশ ৭।১৬ হইতে অধ্যয়ের শেষ পর্যন্ত।— (শঙ্কর)।
সপ্তদশ খণ্ড – সত্যস্বরূপের বিজ্ঞান
৫৫৪. যদা বৈ বিজানাত্যথ সত্যং বদতি নাবিজানন্ সত্যং বদতি বিজানন্নেব সত্যং বদতি বিজ্ঞানং ত্বেব বিজিজ্ঞাসিতব্যমিতি বিজ্ঞানং ভগবো বিজিজ্ঞাস ইতি ॥ ১
অন্বয় : যদা (যখন) বৈ বিজানাতি (বিশেষরূপে জানে) অথ (তখন) সত্যম্ বদতি (বলে); ন অবিজানন্ (বিশেষরূপে না জানিয়া) সত্যম্ বদতি। বিজানন্ এব (বিশেষরূপে জানিয়াই) সত্যম্ বদতি। বিজ্ঞানম্ তু এব বিজিজ্ঞাসিতব্যম্। বিজ্ঞানম্ ভগবঃ বিজিজ্ঞাসে ইতি (৭।১৬ মন্ত্র দ্রঃ)।
সরলার্থ : সনৎকুমার বলিলেন—’যখন মানুষ বিশেষরূপে জানে, তখন সত্য বলে, না জানিয়া বলে না। বিশেষ জানিলেই সত্য বলা চলে। এই বিজ্ঞানকেই জানিবার ইচ্ছা করা উচিত।’ নারদ বলিলেন—’আমি বিজ্ঞানকেই জানিতে ইচ্ছা করি।’
অষ্টাদশ খণ্ড – বিজ্ঞান মননসাপেক্ষ
৫৫৫. যদ বৈ মনুতেহথ বিজানাতি নামত্বা বিজানাতি মত্বৈব বিজানাতি মতিত্বেব বিজিজ্ঞাসিতব্যেতি। মতিং ভগবো বিজিজ্ঞাস ইতি ॥ ১
অন্বয় : যদা বৈ মনুতে (মনন করে) অথ বিজানাতি; ন অমত্বা (মনন না করিয়া) বিজানাতি। মত্বা এব (মনন করিয়াই) বিজানাতি। মতিঃ (মনন, তর্কশঙ্কর) তু এব বিজিজ্ঞাসিতব্যা ইতি। মতিম্ ভগবঃ বিজিজ্ঞাসে ইতি (৭।১৭)।
সরলার্থ : সনৎকুমার বলিলেন—’যখন মানুষ মনন করে, তখনই বিশেষরূপে জানে, মনন না করিলে জানিতে পারে না। এই মননকেই বিশেষরূপে জানিবার ইচ্ছা করিতে হইবে।’ নারদ বলিলেন—’আমি মননকেই বিশেষরূপে জানিতে চাই।’
ঊনবিংশ খণ্ড – মনন শ্রদ্ধাসাপেক্ষ
৫৫৬. যদা বৈ শ্রদ্ধধাত্যথ মনুতে নাশদ্দধন্মনুতে শ্রদ্দধদেব মনুতে শ্রদ্ধা ত্বেব বিজিজ্ঞাসিতব্যেতি। শ্রদ্ধাং ভগবো বিজিজ্ঞাস ইতি ॥ ১
অন্বয় : যদা বৈ শ্রদধাতি (মন্তব্য বিষয়ে শ্রদ্ধাযুক্ত হয়), অথ মনুতে। ন অশ্রদধৎ (শ্রদ্ধাযুক্ত না হইলে) মনুতে। শ্রদধৎ এব (শ্রদ্ধাযুক্ত হইয়াই) মনুতে শ্রদ্ধা তু এব বিজিজ্ঞাসিতব্যা ইতি শ্রদ্ধাং ভগবো বিজিজ্ঞাসে ইতি। (৭।১৭)।
সরলার্থ : সনৎকুমার বলিলেন—’যখন মানুষ শ্রদ্ধাবান হয় তখনই মনন করে, শ্রদ্ধাবান না হইলে মনন করিতে পারে না, শ্রদ্ধাবান হইলেই পারে। এই শ্রদ্ধাকেই বিশেষরূপে জানিবার ইচ্ছা করিতে হইবে।’ নারদ বলিলেন—’ভগবান্, আমি শ্রদ্ধাকেই বিশেষরূপে জানিতে চাই।’
বিংশ খণ্ড – শ্রদ্ধা নিষ্ঠাসাপেক্ষ
৫৫৭. যদা বৈ নিস্তিষ্ঠত্যথ শ্রদ্দধাতি নানিস্তিষ্ঠ�দ্দধাতি নিস্তিষ্ঠনের শ্রদধাতি নিষ্ঠা ত্বেব বিজিজ্ঞাসিতব্যেতি নিষ্ঠাং ভগবো বিজিজ্ঞাস ইতি।।১
অন্বয় : যদা বৈ নিস্তিষ্ঠতি (গুরুতে নিষ্ঠাবান হয়) অথ শ্রদধাতি। ন অনিস্তিষ্ঠন্ (নিষ্ঠা না থাকিলে) শ্রদ্দাধাতি নিষ্ঠাবান এব (নিষ্ঠা থাকিলেই শ্রদধাতি। নিষ্ঠা (নিশ্চিতরূপে স্থিতি) তু এব বিজিজ্ঞাসিতব্যা ইতি। নিষ্ঠাম্ ভগবঃ বিজিজ্ঞাসে ইতি (৭।১৭-১৯ মঃ দ্রঃ)।
সরলার্থ : মানুষ যখন নিষ্ঠাবান হয়, তখনই শ্রদ্ধাবান হইয়া থাকে। নিষ্ঠাবান না হইলে শ্রদ্ধাবান হইতে পারে না, নিষ্ঠাবান হইলেই পারে। এই নিষ্ঠাকেই বিশেষরূপে জানিবার ইচ্ছা করিতে হইবে। নারদ বলিলেন—’আমি নিষ্ঠাকেই বিশেষরূপে জানিতে চাই।’
একবিংশ খণ্ড – নিষ্ঠা কর্মসাপেক্ষ
৫৫৮. যদা বৈ করোত্যথ নিস্তিষ্ঠতি নাকৃত্বা নিস্তিষ্ঠতি কৃত্বৈব নিস্তিষ্ঠতি কৃতিত্বেব বিজিজ্ঞাসিতব্যেতি কৃতিং ভগবো বিজিজ্ঞাস ইতি ॥ ১
অন্বয় : যদা বৈ করোতি (কর্তব্যকর্ম করে), অথ নিস্তিষ্ঠতি, ন অকৃত্বা (কর্তব্য কর্ম না করিয়া) নিস্তিষ্ঠতি। কৃত্বা এব (করিয়াই) নিস্তিষ্ঠতি। কৃতিঃ (কর্তব্যকর্ম) তু এব বিজিজ্ঞাসিতব্যা ইতি। কৃতিম্ (কর্মকে) ভগবঃ বিজিজ্ঞাসে ইতি।
সরলার্থ : সনৎকুমার বলিলেন—’যখন লোকে কর্তব্য কর্ম করে, তখনই নিষ্ঠাবান হয়। কর্ম না করিলে নিষ্ঠাবান হয় না, করিলেই হয়। এই কৃতিকেই (কর্মে একাগ্রতা) বিশেষরূপে জানিবার ইচ্ছা করা উচিত।’ নারদ বলিলেন—’ভগবান্, আমি এই কৃতিকে বিশেষরূপে জানিতে চাই।
মন্তব্য : কৃতিঃ—ইন্দ্রিয়সংযম ও চিত্তের একাগ্রতা সম্পাদন (শঙ্কর)। এখানে ব্রহ্মচারীর কর্তব্য সম্পাদনের কথা বলা হইয়াছে।
দ্বাবিংশ খণ্ড – কর্ম সুখসাপেক্ষ
৫৫৯. যদা বৈ সুখং লভতেহথ করোতি নাসুখং লম্বা করোতি সুখমেব লম্বা করোতি সুখং ত্বেব বিজিজ্ঞাসিতব্যমিতি সুখং ভগবো বিজিজ্ঞাস ইতি ॥১
অন্বয় : যদা বৈ সুখম্ লভতে (লাভ করে), অথ করোতি (কর্ম করে)। ন অসুখম লম্বা (সুখ লাভ না করিয়া) করোতি। সুখম্ এব লম্বা করোতি। সুখম্ তু এব বিজিজ্ঞাসিতব্যম্ ইতি। সুখম্ ভগবঃ বিজিজ্ঞাসে ইতি। (৭।১৭)।
সরলার্থ : সনৎকুমার বলিলেন—’যদি মানুষ সুখ পায় তবেই কর্ম করে। সুখ না পাইলে কর্ম করে না; সুখ পাইলেই করে। এই সুখকেই বিশেষরূপে জানিতে উৎসুখ হওয়া দরকার।’ নারদ বলিলেন—’ভগবান্, এই সুখকেই বিশেষরূপে জানিতে চাই।’
ত্রয়োবিংশ খণ্ড – ভূমাই সুখস্বরূপ
৫৬০. যো বৈ ভূমা তৎ সুখং নাল্পে সুখমস্তি ভূমৈব সুখং ভূমা ত্বেব বিজিজ্ঞাসিতব্য ইতি ভূমানং ভগবো বিজিজ্ঞাস ইতি ॥ ১
অন্বয় : যঃ বৈ ভূমা (মহান) তৎ (তাহা) সুখম্। ন অল্পে (সীমাবিশিষ্ট বস্তুতে) সুখম্ অস্তি (আছে)। ভূমা এব সুখম্। ভূমা তু এব বিজিজ্ঞাসিতব্যঃ ইতি। ভূমানম্ (ভূমাকে) ভগবঃ বিজিজ্ঞাসে ইতি (৭।১৭ মঃ দ্রঃ)।
সরলার্থ : সনৎকুমার বলিলেন—’যাহা ভূমা, তাহাই সুখ; অল্পে সুখ নাই, ভূমাই সুখ। এই ভূমাকেই বিশেষরূপে জানিতে ইচ্ছা করিবে।’ নারদ বলিলেন—এই ভূমাকেই বিশেষরূপে জানিতে ইচ্ছা করি।’
চতুর্বিংশ খণ্ড – ভূমার লক্ষণ
৫৬১. যত্র নান্যৎ পশ্যতি নান্যস্থূণোতি নান্যদ্ বিজানাতি স ভূমাহথ যত্রান্যৎ পশ্যত্যন্যস্থূণোত্যন্যদ্বিজানাতি তদন্সং যো বৈ ভূমা তদমৃতমথ যদল্পং তন্মর্ত্যং স ভগবঃ কম্ িপ্রতিষ্ঠিত ইতি স্বে মহিমি যদি বা ন মহিম্নীতি ॥ ১
অন্বয় : যত্র (যে স্থলে) ন (না) অন্যৎ (অন্যবস্তুকে) পশ্যতি (দেখে), ন অন্যৎ শৃণোতি (শ্রবণ করে), ন অন্যৎ বিজানাতি (বিশেষরূপে জানে) সঃ ভূমা (মহান)। অথ (আর) যত্র অন্যত্র পশ্যতি, অন্যৎ শৃণোতি, অন্যৎ বিজানাতি, তৎ অল্পম্। যঃ (যাহা) বৈ ভূমা, তৎ (তাহা) অমৃতম্; অথ যৎ অল্পম্, তৎ মর্ত্যম্ (মরণশীল)। সঃ (সেই ভূমা) ভগবঃ! কস্মিন্ প্রতিষ্ঠিতঃ? ইতি। স্বে মহিমি (নিজের মহিমাতে) যদি বা (অথবা) ন মহিম্নি ইতি।
সরলার্থ : যাহাতে অন্য কিছু দেখা যায় না, অন্য কিছু শোনা যায় না, অন্য কিছু জানা যায় না, তাহাই ভূমা। আর যাহাতে অন্য কিছু দেখা যায়, শোনা যায়, জানা যায়—তাহাই অল্প। যাহা ভূমা তাহাই অমৃত, আর যাহা অল্প তাহাই মরণশীল। নারদ জিজ্ঞাসা করিলেন—’ভগবান, সেই ভূমা কিসে প্রতিষ্ঠিত?’ সনৎকুমার বলিলেন— ‘(তিনি) স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত, অথবা কোনরূপ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত নন।’
মন্তব্য : ভূমা নিজেই নিজেতে প্রতিষ্ঠিত, এই অর্থে বলা হইয়াছে তিনি স্বীয় মহিমাতে প্রতিষ্ঠিত। ইহা শুনিয়া হয়ত নারদ মনে করিতে পারিতেন ‘ভূমারও আশ্রয় আবশ্যক’ এবং ইহাও হয়ত মনে হইত যে, ‘ভূমা ও ভূমার মহিমা আলাদা এবং ইহাদিগের মধ্যে এক অপরে প্রতিষ্ঠিত’। এই প্রকার সন্দেহ দূর করিবার জন্য সনৎকুমার বলিলেন—‘ভূমা নিজ মহিমাতেও প্রতিষ্ঠিত নহেন’ অর্থাৎ তাঁহার আশ্রয় আবশ্যক হয় না, তিনি প্রতিষ্ঠাবিহীন, তিনি নিরালম্ব।
৫৬২. গোঅশ্বমিহ মহিমেত্যাচক্ষতে হস্তিহিরণ্যং দাসভার্যং ক্ষেত্ৰাণ্যায়তননীতি নাহমেবং ব্রবীমি ব্রবীমীতি হোবাচান্যো হ্যন্যস্ প্রতিষ্ঠিত ইতি॥২
অন্বয় : গো-অশ্বম্ (গো ও অশ্বকে) ইহ (এই পৃথিবীতে) মহিমা ইতি আচক্ষতে (বলে), হস্তিহিরণ্যম্ (হস্তী ও সুবর্ণকে) দাসভার্যম্ (দাস ও ভার্যাকে) ক্ষেত্রাণি (ক্ষেত্রসমূহকে) আয়তনানি (বাসস্থানসমূহকে) ইতি। ন (না) অহম্ (আমি) এবম্ (এই প্রকার) ব্রবীমি (বলি) ব্রবীমি ইতি হ উবাচ। অন্যঃ (অন্যবস্তু) হি অন্যস্মিন্ (অন্যবস্তুতে) প্রতিষ্ঠিতঃ ইতি।
সরলার্থ : লোকে এই জগতে গরু, ঘোড়া, হাতী, সোনা, ভৃত্য, স্ত্রী, ভূসম্পদ, বাসগৃহ—এই সবকে ‘মহিমা’ বলে। কিন্তু আমি এই জাতীয় মহিমার কথা বলিতেছি না; কারণ ইহারা একে অপর বস্তুতে প্রতিষ্ঠিত।
পঞ্চবিংশ খণ্ড – ভূমা সর্বময়—ভূমাবিদের স্বারাজ্য
৫৬৩. স এবাধস্তাৎ স উপরিষ্টাৎ স পশ্চাৎ স পুরস্তাৎ স দক্ষিণতঃ স উত্তরতঃ স এবেদং সর্বমিতি। অথাতোহহঙ্কারাদেশ এবাহমেবাধস্তাদহমু পরিষ্টাদহং পশ্চাদহং পুরস্তাদহং দক্ষিণতোহহমুত্তর- তোহহমেবেদং সর্বমিতি ॥ ১
অন্বয় : সঃ (সেই ভূমা) এর অধস্তাৎ (আধোদেশে) সঃ উপরিষ্টাৎ (ঊর্ধ্বদেশে সঃ পশ্চাৎ (পশ্চাৎভাগে) সঃ পুরস্তাৎ (পুরোভাগে), সঃ দক্ষিণতঃ (দক্ষিণদিকে), সঃ উত্তরতঃ (বামদিকে)—স এব ইদম্ সর্বম্ (এই সমুদয়) ইতি। অথ+অতঃ (এখন, তাহার পর) অহম্+কার+আদেশঃ (‘অহম্’ এই দৃষ্টিতে উপদেশ; অহম্=আমি, অহঙ্কার=‘আমি’ এই ভাব) এব—অহম্ এব অধস্তাৎ, অহম্ উপরিষ্টাৎ, অহম্ পশ্চাৎ, অহম্ পুরস্তাৎ, অহম্ দক্ষিণতঃ অহম্ উত্তরতঃ—অহম্ এব ইদং সর্বম্ ইতি।
সরলার্থ : সেই ভূমাই নিম্নে, তিনিই ঊর্ধ্বে, তিনিই পশ্চাতে, তিনিই সম্মুখে, তিনিই দক্ষিণে, তিনিই বামে—তিনিই এই সমস্ত কিছু। এখন ‘অহম্’ দৃষ্টিতে উপদেশ—আমিই অধোভাগে, আমিই ঊর্ধ্বে, আমিই পশ্চাতে, আমিই সম্মুখে, আমিই দক্ষিণে, আমিই বামে—আমিই এই সমস্ত।
মন্তব্য : পশ্চাৎ=দেহের পশ্চাৎভাগে; পৃথিবীর পশ্চিমদিকে। পুরস্তাৎ=দেে পুরোভাগে; পৃথিবীর পূর্বদিকে। দক্ষিণতঃ=দেহের দক্ষিণভাগে; পৃথিবীর দক্ষিণদিকে। উত্তরতঃ=দেহের বামভাগে; পৃথিবীর উত্তরদিকে। সম্ভবতঃ প্রথম অর্থই মৌলিক। সূর্যোদয়ের সময়ে সূর্যকে পুরোভাগে করিয়া দাঁড়াইলে যাহা সম্মুখ, পশ্চাৎ, দক্ষিণ ও বাম হয়, তাহাই যথাক্রমে পূর্ব, পশ্চিম, দক্ষিণ ও উত্তর দিক্ বলিয়া পরিচিত হইয়াছে। ব্যাখ্যাকারগণ কেহ প্রথম অর্থ কেহ বা দ্বিতীয় অর্থ গ্রহণ করিয়াছেন।
৫৬৪. অথাত আত্মাদেশ এবাত্মৈবাধস্তাদাত্মোপরিষ্টাদাত্মা পশ্চাদাত্মা পুরস্তাদাত্মা দক্ষিণত আত্মোত্তরত আত্মৈবেদং সর্বমিতি। স বা এষ এবং পশ্যন্নেবং মন্বান এবং বিজানন্নাত্মরতিরাত্মক্রীড় আত্মমিথুন আত্মানন্দঃ স স্বরাড়ু ভবতি, তস্য সর্বেষু লোকেষু কামচারো ভবতি। অথ যেহন্যাথাহতো বিদুরন্যরাজানস্তে ক্ষয্যলোকা ভবন্তি। তেষাং সর্বেষু লোকেম্বকামচারো ভবতি ॥ ২
অন্বয় : অথ অতঃ (ইহার পর) আত্মাদেশঃ (আত্মদৃষ্টিতে উপদেশ) এর আত্মা এবং অধস্তাৎ, আত্মা উপরিষ্টাৎ, আত্মা পশ্চাৎ, আত্মা পুরস্তাৎ, আত্মা দক্ষিণতঃ, আত্মা উত্তরতঃ—আত্মা এব ইদম্ সর্বম্ ইতি (১ম মন্ত্রের মন্তব্য দ্রঃ)। সঃ বৈ এষঃ (সেই সাধক) এবম্ (এই প্রকারে) পশ্যন্ (দেখিয়া) এবম্ মন্বানঃ (মনন করিয়া) এবম্ বিজানন্ (জানিয়া) আত্মরতিঃ (আত্মাতে যাঁহার রতি তিনি), আত্মক্রীড়ঃ (আত্মাতে যিনি ক্রীড়া করেন), আত্মমিথুনঃ (আত্মাতে যাঁহার মিথুনভাব), আত্মানন্দঃ (আত্মাতে যাঁহার আনন্দ); সঃ স্বরাট্ (স্ব+রাজ্=আত্মেম্বর; স্বাধীন) ভবতি। তস্য সর্বেষু লোকেষু (সমুদয় লোকে) কামচারঃ (স্বাধীন আচরণ) ভবতি। অথ যে (যাহারা) অন্যথা (অন্যপ্রকার) অতঃ (ইহা অপেক্ষা) বিদুঃ (জানে) অন্যরাজানঃ (পরাধীন; অন্য ব্যক্তি যাহাদের রাজা) তে (তাহারা) ক্ষয্যলোকাঃ (যাহাদিগের স্বর্গাদি লোক ক্ষয়শীল) ভবন্তি (হয়) তেষাম্ (তাহাদিগের) সর্বেষু লোকেষু অকামচারঃ (পরাধীনতা) ভবতি।
সরলার্থ : এইবারে আত্মদৃষ্টিতে উপদেশ—আত্মাই নিম্নে, আত্মাই ঊর্ধ্বে, আত্মাই পশ্চাতে, আত্মাই সম্মুখে, আত্মাই দক্ষিণে, আত্মাই বামে—আত্মাই এই সমস্ত। যিনি এইভাবে দেখেন, মনন করেন, এই রকম বিজ্ঞান লাভ করেন, তিনি আত্মরতি, আত্মক্রীড়, আত্মমিথুন এবং আত্মানন্দ হন এবং তিনিই স্বরাট্ হন। আর যে ইহা ছাড়া অন্যরকম জানে, সে অন্যের অধীন হয়, এবং ক্ষয়শীল লোক লাভ করে। সমস্ত লোকে তাহার গতি সীমিত হয়।
মন্তব্য : স্বরা—যিনি স্বাধীন, কিংবা যিনি আপনাতে আপনি বিরাজমান।
ষড়বিংশ খণ্ড – ভূমাতত্ত্ববিদ সমুদয় জগৎ ব্রহ্মময় দেখেন
৫৬৫ . তস্য হ বা এতস্যৈবং পশ্যত এবং মন্বানস্যৈবং বিজানত আত্মতঃ প্ৰাণ আত্মত আশাত্মতঃ স্মর আত্মত আকাশ আত্মতস্তেজ আত্মত আবির্ভাবতিরোভাবাবাত্মতোহন্নমাত্মতো বলমাত্মতো বিজ্ঞানমাত্মতো ধ্যানমাত্মতশ্চিত্তমাত্মতঃ সংকল্প আত্মতো মন আত্মতো বাগাত্মতো নামাত্মতো মন্ত্রা আত্মতঃ কৰ্মাণ্যাত্মত এবেদং সর্বমিতি ॥ ১
অন্বয় : তস্য হ বৈ এতস্য (এই প্রকার ব্যক্তির) এবম্ পশ্যতঃ (এই প্রকার দ্রষ্টার) এবম্ মন্বানস্য (এই প্রকার মননকারীর) এবম্ বিজানতঃ (এই প্রকার বিজ্ঞাতার) আত্মতঃ (আত্মা হইতে) প্রাণঃ আত্মতঃ আশা, আত্মতঃ স্মরঃ (স্মৃতি), আত্মতঃ আকাশঃ, আত্মতঃ তেজঃ, আত্মতঃ পাপঃ, আত্মতঃ আবির্ভাব-তিরোভাবৌ (আবির্ভাব ও তিরোভাব), আত্মতঃ অন্নম্, আত্মতঃ বলম্, আত্মতঃ বিজ্ঞানম্, আত্মতঃ ধ্যানম্, আত্মতঃ চিত্তম্, আত্মতঃ সঙ্কল্পঃ, আত্মতঃ মনঃ, আত্মতঃ বাক্, আত্মতঃ নাম, আত্মতঃ মন্ত্রাঃ, আত্মতঃ কর্মাণি, আত্মতঃ এব ইদম্ সর্বম্ ইতি।
সরলার্থ : এইপ্রকার দ্রষ্টা, মননকারী ও বিজ্ঞাতার নিকটে আত্মা হইতেই প্রাণ, আত্মা হইতেই আশা, আত্মা হইতেই স্মৃতি, আত্মা হইতেই আকাশ, আত্মা হইতেই তেজ, আত্মা হইতেই জল, আত্মা হইতেই আবির্ভাব ও তিরোভাব। আত্মা হইতেই অন্ন, আত্মা হইতেই বল, আত্মা হইতেই বিজ্ঞান, আত্মা হইতে ধ্যান, আত্মা হইতে চিত্ত, আত্মা হইতে সঙ্কল্প, আত্মা হইতে মন, আত্মা হইতে বাক্, আত্মা হইতে নাম, আত্মা হইতে মন্ত্র, আত্মা হইতে কর্ম, আত্মা হইতে এই সবই উৎপন্ন হয়।
৫৬৬. তদেষ শ্লোকো—ন পশ্যো মৃত্যুং পশ্যতি ন রোগং নোত দুঃখতাং সর্বং হ পশ্যঃ পশ্যতি সর্বমাপ্নোতি সর্বশ ইতি। স একধা ভবতি ত্রিধা ভবতি পঞ্চধা সপ্তধা নবধা চৈব পুনশ্চৈকাদশঃ স্মৃতঃ শতং চ দশ চৈকশ্চ সহস্রাণি চ বিংশতিঃ। আহারশুদ্ধৌ সত্ত্বশুদ্ধিঃ সত্ত্বশুদ্ধৌ ধ্রুবা স্মৃতিঃ স্মৃতিলম্ভে সর্বগ্রন্থীনাং বিপ্রমোক্ষস্তস্মৈমৃদিতষায়ায় তমসম্পারং দর্শয়তি ভগবান্ সনৎকুমারস্তং স্কন্দ ইত্যাচক্ষতে তং স্কন্দ ইত্যাচক্ষতে ॥ ২
অন্বয় : তৎ (সে বিষয়ে) এষঃ (এই) শ্লোকঃ—ন পশ্যঃ (দর্শনকারী) মৃত্যু পশ্যতি (দেখে), ন রোগম্ ন উত দুঃখতাম্ (দুঃখকে)। সর্বম্ হ পশ্যঃ পশ্যতি, সৰ্বম্ আপ্নোতি (প্রাপ্ত হয়), সর্বশঃ (সর্বদা, সর্বত্র, সম্পূর্ণরূপে বা সর্বপ্রকারে) ইতি। সঃ একধা (‘সৃষ্টির পূর্বে’ এক) ভবতি; ত্রিধা (তিন প্রকার; তেজ, অপ্ ও অন্ন) ভবতি, পঞ্চধা (পাঁচ প্রকার), সপ্তধা (সাত প্রকার), নবধা (নয় প্রকার) চ এব; পুনঃ চ একাদশঃ স্মৃতঃ (একাদশ বলিয়া কথিত হন) শতম্ চ দশ চ ১১০), একঃ চ সহস্রাণি চ বিংশতি (=১০২০)। আহারশুদ্ধৌ (আহারশুদ্ধি হইলে) সত্ত্বশুদ্ধিঃ (সত্ত্বের বিশুদ্ধত্ব সত্ত্বশদ্ধৌ (সত্ত্বের শুদ্ধি হইলে) ধ্রুবা (নিশ্চল) স্মৃতিঃ স্মৃতিলম্ভে (স্মৃতিলাভ হইলে) সর্বগ্রন্থীনাম্ (সমুদয় বন্ধনের; প্রন্থি—বন্ধন) বিপ্রমোক্ষঃ (বিশেষরূপে মুক্তি)। তস্মৈ (সেই) মৃদিতষায়ায় (যাহার মলিনতা দূর হইয়াছে, তাহাকে; মৃদিত—বিনষ্ট, বিদূরীত; কষায়—মলিনতা) তমসঃ (অন্ধকারের) পারম্ (অপর পার) দর্শয়তি (দেখাইলেন) ভগবান্ সনৎকুমারঃ। তম্ (সনৎকুমারকে) স্কন্দঃ ইতি (‘স্কন্দ’ এই নাম, স্কন্দ=জ্ঞানী) আচক্ষতে (বলিয়া থাকে), তম্ স্কন্দ ইতি আচক্ষতে (দ্বিরুক্তি সমাপ্তিসূচক)।
সরলার্থ : এ বিষয়ে এই শ্লোক আছে—তত্ত্বদর্শী মৃত্যুদর্শন করেন না, রোগ দুঃখ দর্শন করেন না। তত্ত্বদর্শী সবই দর্শন করেন, এবং সর্বদা সবই লাভ করেন। তিনি সৃষ্টির পূর্বে এক, তারপরে তিন, পাঁচ, সাত, নয় প্রকার হন; আবার তাঁহাকে একাদশ, একশত দশ এবং একহাজার বিশ বলা হয়। আহারশুদ্ধি হইলে সত্ত্বশুদ্ধি হয়; সত্ত্বশুদ্ধি হইলে স্মৃতি নিশ্চল হয়; স্মৃতি লাভ হইলে সমস্ত গ্রন্থির মোচন হয়। ভগবান্ সনৎকুমার নারদের সকল মলিনতা দূর করিয়া তাঁহাকে অন্ধকারের পার দেখাইয়াছিলেন। পণ্ডিতগণ সনৎকুমারকে পরম জ্ঞানী বলিয়া থাকেন।
অন্বয় : ‘আহারশুদ্ধি’ বিষয়ে শঙ্কর বলেন—যাহা আহরণ করা যায়, তাহাই আহার। মানুষ শব্দাদি বিষয়ের জ্ঞান আহারণ করে, সুতরাং বিষয়োপলব্ধিরূপ বিজ্ঞান ও রাগদ্বেষাদি এই বিজ্ঞানের মলা। সুতরাং জ্ঞান যদি রাগদ্বেষাদি বিরহিত হয়, তাহা হইলে তাহাকে আহারশুদ্ধি বলা যাইতে পারে। সত্ত্বশুদ্ধিসত্ত্বের বিশুদ্ধতা; সত্ত্ব বা সত্তা শব্দের মৌলিক অর্থ অস্তিত্ব বা আত্মার স্বভাব। শঙ্করের মতে সত্ত্ব—অন্তঃকরণ। মুণ্ডকোপষিদে (৩।১।৮) ‘জ্ঞানপ্রসাদেন বিশুদ্ধসত্ত্ব’ আছে। এস্থলে সত্ত্ব—অন্তঃকরণ। কঠোপনিষদে আছে ‘মনসঃ সত্ত্বম্ উত্তমম্ (২।৩।৭); এস্থলে সত্ত্ব—বুদ্ধি।