Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    উপমহাদেশ – আল মাহমুদ

    লেখক এক পাতা গল্প320 Mins Read0
    ⤶

    ১১. রাতে খাওয়ার টেবিলে

    রাতে খাওয়ার টেবিলে নন্দিনী ইমামকে হঠাৎ এক আচমকা প্রশ্ন করে বসল, আমাদের সমর্থনের অছিলায় ভারতীয় বাহিনী কী বাংলাদেশ দখল করবে?

    ইমাম অনেকক্ষণ এ কথার জবাব না দিয়ে চুপ করে বসে থাকল। তারপর খুব শান্ত গলায় বলল, আক্রমণ বা দখল নয়। সাহায্যের জন্য এগিয়ে যেতে পারে। তাদের সাহায্যেই যখন আমরা পাক হানাদারদের সাথে লড়ছি।

    দেশের ভেতরে এখন প্রতিটি গ্রামে গ্রামে লড়াই চলছে। খান সেনারা মার খেয়ে ক্যান্টনমেন্টগুলোর দিকে সরে যাচ্ছে। বলতে গেলে সারা গ্রামবাংলা এখন ফ্রি জোন। এ অবস্থায় ভারতীয় বাহিনীকে আপনারা আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন?

    আমরা আমন্ত্রণ জানাচ্ছি এটা ঠিক নয়। ভারত ভাবছে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে এভাবে প্রতিরোধ চালিয়ে গেলে তাদের আসামে মেঘালয়-এমন কী পশ্চিমবঙ্গেও এ যুদ্ধ ছড়িয়ে যাবে। পরিণামে ভারতের সমগ্র পূর্বাঞ্চলে নকশালপন্থীরা প্রভাব বিস্তার করবে। আর পরাজিত পাকিস্তানীরা তাদের সমস্ত আর্মস এমনেশন তুলে দেবে নকশালদের হাতে। তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ পরিণত হবে পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নবাদীদের লড়াইয়ে। ভারত এটা হতে দেবে কেন?

    ইমামের কথার জবাবে আমি বললাম, কিন্তু ভারত যদি বাংলাদেশে ঢুকে বেরুতে না চায়?

    আমরা মনে করি ভারতের এখন সে পরিস্থিতি নেই। তারা তাড়াতাড়ি যুদ্ধটার একটা সমাপ্তি চায়। মুক্তিযোদ্ধাদের দেশের ভেতরকার নিয়ন্ত্রণ এখন কারো হাতে নেই। তাদের হাতে অস্ত্র থাকতে ভারত তেমন ভুল করতে পারে না। ভারত চায় না বাংলাদেশের মাটিকে চীনপন্থীদের গেরিলা তৎপরতার উর্বর ক্ষেত্র বানাতে। শেখ সাহেব যদি পাকিস্তানের কারাগার থেকে জ্যান্ত ফিরতে না পারেন তবে এ যুদ্ধ, এ আন্দোলনের নেতৃত্ব চলে যাবে মাওলানা ভাসানীর হাতে। তখন ভারত যা আশংকা করছে তাই ঘটবে।

    এবার নন্দিনীর দিকে হেসে মুখ তুলল ইমাম।

    আমি বললাম, এ জন্যই কী মাওলানাকে নজরবন্দি রাখা হয়েছে?

    এ বিসয়ে মন্তব্য করা আমার পক্ষে অনুচিত হবে।

    বলেই ইমাম তার প্লেটের ভেতর পানি ঢেলে উঠে গেলেন।

    খাওয়ার পর নন্দিনী মিতুর সাথে থাকবে বলে চলে গেলে আমি ডাইনিং টেবিল থেকে সোজা আমার কামরায় এসে শুয়ে পড়লাম। দরজা ভেজিয়ে দিলেও ছিটকিনি তুললাম না। কারণ আমি জানতাম নন্দিনী মিতুকে ঘুম পাড়িয়ে আমার সাথে কথা বলতে আসবে। শুধু পারুলের সামনে চক্ষু লজ্জার খাতিরে সে মিতুর কামরায় গিয়ে শুয়েছে।

    আমার একদম ঘুম পাচ্ছিল না। অনেক চেষ্টা করেও চোখের পাতা এক করতে পারছিলাম না। চোখ বুজলেই হামিদার যন্ত্রণাকাতর মুখ ভেসে উঠছিল। অনেকক্ষণ নন্দিনীর জন্য অপেক্ষা করে আমি দুয়ার খুলে বাইরে এলাম। সারাটা ফ্ল্যাটে বাতি নিভানো। শুধু একটা টয়লেটের ভেতরে বাতি জ্বলছে। টয়লেটের ভেতর থেকে কে বেরুবে কিছুই আন্দাজ করতে না পেরে আমি একটা থামের আড়ালে অপেক্ষা করতে লাগলাম। একটু পরেই মুখে পানি ছিটিয়ে নন্দিনীকে বেরুতে দেখে আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম নন্দিনী নিজের ইচ্ছেয় আমার কামরায় ঢুকে কিনা। কিন্তু আমার ধারণা সঠিক হয় না। নন্দিনী বারান্দার বাতি জ্বালিয়ে বেসিনের ওপরের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার শাড়ি ঠিক করে টাওয়েলে হাতমুখ মুছে মিতুর ঘরের দিকে হেঁটে যেতে লাগল। একেবারে মিতুর দরজার কাছে চলে গেলে আমি খুব আস্তে তার নাম ধরে ডাকলাম। নন্দিনী আমার দিকে না ফিরেই চুপচাপ দরজার কড়া ধরে দাঁড়িয়ে রইল।

    ঘুম আসছে না। এসে একটু কথা বল নন্দিনী।

    আমার কথায় নন্দিনী একটু নড়ছে না দেখে নিজেই এক পা এক পা করে কাছে এসে তার হাত ধরলাম।

    তোমার কী হয়েছে নন্দিনী?

    কই কিছু হয় নি তো।

    হঠাৎ আমাকে এড়িয়ে চলছ বলে মনে হচ্ছে। আমার কোনো কথায় বা আচরণে কী তুমি দুঃখ পেয়েছে?

    না কবি। তোমাকে এড়িয়ে চলার শক্তি আমার নেই। আমি চেষ্টা করছি সমাজের চোখে যা অপরাধ, পাপ সেটার হাত থেকে তোমার মতো সরল মানুষকে বাঁচাতে। তুমি আমার সহায় না হলে মনে হচ্ছে পারব না।

    বলেই নন্দিনী দুহাতে আমার গলা জড়িয়ে ধরে একটা বাচ্চা মেয়ের মতো ফুঁপিয়ে উঠল।

    আমি নন্দিনীর ফুঁপিয়ে ওঠা কান্নাকে নিজের হৃদয়ের ভেতর উথলে ওঠার সংক্রাম অনুভব করে তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম, কেঁদো না নন্দিনী। আমি কথা দিচ্ছি, তোমার সহায়তা করব। লোকেরা তোমাকে আমাকে জড়িয়ে নানা কথা রটনা করার সুযোগ পাবে আমি সেটা কেন হতে দেব? আমার ঘরে যখন তখন আমি আর তোমাকে ডেকে নেব না। তুমি এখন মিতুর সাথে গিয়ে শুয়ে পড়। আমি তোমাকে ডেকে সত্যি ভুল করেছি। আমাকে ছাড়, আমিও গিয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করি।

    আমার কথায় নন্দিনী আরও জোরে আমাকে জড়িয়ে ধরে বেশ বিলাপ করে কাঁদতে লাগল, আমি তোমাকে ভালবাসি কবি। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। এ জগতে তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই।

    আমি দিশেহারার মতো নন্দিনীর রোদনরত কম্পিত দেহকে বুকের ওপর রেখে একবার পারুলের ঘরের দিকে তাকালাম। না, সেখানে কোনো আলো নেই। মিতুর ঘুমের মৃদু আওয়াজ পাচ্ছি ঘরের ভেতর থেকে। এ ঘরের ভিতরে বোধ হয় একটা ঢাকা দেয়া টেবিল ল্যাম্প জ্বলছে।

    আমি বললাম, আমাদের এভাবে কেউ দেখতে পাবে নন্দিনী।

    আমার কথায় নন্দিনী কান্না থামাল। কিন্তু আমার গলা জড়িয়ে ধরে রাখা হাত দুটি সরাল না। আমিও তা জোর করে এখন সরিয়ে দিতে পারছি না। এক অদ্ভুত অনুভূতি এবং বিহ্বলতা নিয়ে আমরা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যায় এই বিব্রতকর চিন্তা আসতেই নন্দিনী আমার গলা থেকে হাত নামিয়ে নিয়ে বলল, চল তোমার ঘরে গিয়ে একটুখন বসব।

    আমি কোনো জবাব না দিয়ে নন্দিনীর পেছন পেছন আমার ঘরে এসে ঢুকলাম। আমরা উভয়ে ঘরে ঢোকা মাত্রই নন্দিনী ফিরে দাঁড়িয়ে ঘরের দুয়ার বন্ধ করে ছিটকিনি এঁটে দিয়ে বাতি নিভিয়ে দিল। কামরায় ভেতরকার নিকষ অন্ধকারে আমরা পরস্পরকে দেখতে পাচ্ছি না। আমি অন্ধের মতো আন্দাজে আমার বিছানাটা স্পর্শ করতে এগোলে নন্দিনীর গায়ে হাত ঠেকল। নন্দিনী আমার হাতটা ধরে টানল, আমার পাশে বস কবি।

    আমি বললাম, বাতি নেভালে কেন?

    আলোকে ভয় লাগে।

    অথচ একটু আগেই তুমি পাপ পুণ্যের কথা, লোক নিন্দার কথা বলছিলে। সমাজের চোখে যেটা মন্দ সেটার হাত থেকে আত্মরক্ষার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে মিনতি করেছিলে। এখন হঠাৎ কী হল নন্দিনী?

    কিছুই হয় নি। আমি সমাজকে লোকনিন্দাকে মিথ্যে ভয় পেয়েছিলাম।

    না নন্দিনী। তুমি ঠিক কথাই বলেছিলে। বরং আমিই ছিলাম লোভী। একটু আগে আমিই ভুলে গিয়েছিলাম আমি নিজের দেশ ছেড়ে কেন এখানে এসেছি। ভুলে গিয়েছিলাম আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। মাত্র কয়েকদিন আগে শত্রুদের সাথে সামনাসামনি একটা মারাত্মক যুদ্ধ থেকে ফিরে এসেছি। যেখানে কমরেড রেজার প্রাণপ্রিয় সহকর্মীরা ফ্রন্টাল ফাঁইটে বীরের মতো প্রাণ দিয়েছে। নাসরিনের মতো একটা কিশোরী মেয়ের ওপর এক রকম আমাদের নাকের ডগায় বলাৎকার হয়েছে। মেয়েটির মানসিক ভারসম্য নষ্ট হওয়ার উপক্রম হওয়ার তার চিকিৎসার জন্য আমি দ্বিতীয়বার কলকাতায় এসেছি। এসেই শুনেছি আমার মুক্তিযোদ্ধা স্ত্রী একটা অপারেশনে গিয়ে পঙ্গু হয়ে বিনা চিকিৎসায় বিপদের মধ্যে পড়ে তড়পাচ্ছে। আমি তার সাহায্যের জন্য ঢাকায় যাচ্ছি। মুহূর্তের লোভে আমি সব ভুলে যাই নন্দিনী। বরং আজ একটু আগে তোমার সামান্য প্রত্যাখ্যানে আমি আমার আসল চেহারাটা উপলদ্ধি করে খুব ভয় পেয়েছি। মনে হয়েছে তোমার অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়েছি আমি। যারা তোমাকে ট্রেনিং ক্যাম্পে অপমানের চেষ্টা করেছিল আমি তাদের চেয়ে কোনো অংশেই ভালো নই। আমাকে তুমি ক্ষমা কর নন্দিনী। এখন থেকে তোমার মর্যাদার কথা আমি মুহূর্তের জন্যও ভুলব না। মুক্তিযুদ্ধে তুমি যেভাবে ফতুর হলে তা আমার চেয়ে কে বেশি জানে?

    আমি অন্ধকারে নন্দিনীর হাত ধরে তার পাশে বসলাম।

    ফতুর? বল ধর্ষিতা হয়েছি। বল নষ্ট হয়েছি। বল নষ্টা নারীকে শেষ পর্যন্ত সকলেই ভোগ করতে চায়; কেউ ভালবাসতে পারে না। সে কারো দয়িতা প্রেমিকা হয় না। তাকে নিয়ে কোনো কবিতা লেখা যায় না।

    নন্দিনী…

    আমাকে বলতে দাও। তুমি এখনও দ্বিধা ত্যাগ করতে পার নি। আমি জানি তোমার স্ত্রী আছে। আমি না দেখলেও জানি হামিদা বানু সুন্দরী এবং তোমার কাম্য নারী। তাছাড়া তিনি বীরনারী। স্বামী সংসারের চেয়ে দেশকে তিনি সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন। একজন বিবাহিত ব্যক্তিকে অন্য নারীর ভালবাসাটা যে নীতিজ্ঞানহীন অপরাধ এটাও আমার অজানা নয় কিন্তু পরিস্থিতি এবং যুদ্ধ আমাদের জন্য কোন্ কোন্ নীতিজ্ঞান এবং মূল্যবোধ অবশিষ্ট রেখেছে তা কী আমাকে বলে দিতে পার? এই কয়দিন আগেও তুমি আমাকে বলেছ তুমি আমাকে ভালবাস। বল, বল নি?

    কিন্তু আমাদের পরস্পরের ভালবাসা সামাজিক আপত্তিকে প্রতিরোধ করতে পারে না, নন্দিনী এখনও তোমাকে অকপটে বলছি তোমাকে ভালবাসি। আমার অন্তর থেকে ভালবাসি। আমার এটুকুই অপরাধ, সমাজের কাছে, আত্মীয়স্বজনদের কাছে। আমার স্ত্রী আছে। তাকেও আমি ভালবাসি। গভীরভাবে ভালবাসি। অথচ এই দুটি ভালবাসাকে একসাথে মেলাবার আমাদের আধুনিক জীবনে কোনো যুক্তি নেই। আমি যত সমকালীন সাহিত্য কাব্য উপন্যাস পড়ি সেখানে দুটি নারীকে একসাথে ভালবেসে একসাথে ঘর করার কোনো দৃষ্টান্ত পাই না। যেটুকু আছে তা ধর্মীয় দৃষ্টান্ত। সম্ভবত এ দৃষ্টান্ত তোমার তেমন ভালো লাগবে না নন্দিনী। কারণ তুমি মুসলমান নও। আমি তোমাকে তা হতেও বলতে পারি না। আর তুমি মুসলমান হলেই যে সমস্যার সমাধান হয়ে গেল এটাও ভাবা যায় না। হামিদাই বা তা মানবে কেন? আমার মনে হয় হামিদা নিজেকে বিনাশ করে ফেলতেও দ্বিধা করবে না। তবুও এ পরিস্থিতি মেনে নিতে রাজি হবে না।

    কেন হবেন না, বৌদি কী মুসলমান নন?

    মুসলমান। তবে আমরা সবাই কী পাশ্চাত্য মূল্যবোধের বাইরে যেতে পারি?

    তোমাদের ধর্ম যদি আমার জন্যে একটু আশ্রয় রেখে থাকে তাহলে আমার মতো ভিখিরির প্রতি তার মমতা হতেও পারে? আগে থেকেই তুমি তো বলতে পার না কবি?

    এমনভাবে নন্দিনী কথা বলল আমি বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গেলাম। আমি বললাম, নন্দিনী বাতিটা জ্বালিয়ে দিই?

    থাক না। বললাম তো এখন আলোতে আমরা আমাদের দুজনকে খোলামেলা দেখতে পেলে কথা এগোবে না। আমি কিছু বিষয় নিয়ে তোমার সাথে একটু একান্তে আলাপ করতে চাই। কবি সত্যি কী তুমি আমাকে ভালবাস? না আমি নিরুপায় বলে আমার প্রতি করুণা করছ?

    নন্দিনী!

    থাক, বলতে হবে না। আমিই বলছি শোন। আমি জানি তুমি আমাকে ভালবাস। এই ভালবাসা সৃষ্টি হয়েছে আমার সামান্য রূপ, আমার নিরুপায় অবস্থা এবং একটা দীর্ঘ সময়ের মেলামেশা ও একই সাথে দুঃখ বরণের মধ্য দিয়ে। রূপকে সামান্য বললেও আমার রূপ অর্থাৎ দেহের মোহও প্রকৃতপক্ষে তোমার কবি মনে নেশা ধরিয়ে দিয়েছে। তুমি আমার দেহটাকে পেতে চাও। এর ফলে তোমার সংসার এবং আত্মীয়স্বজনের সাথে সম্পর্ক ভেঙে যেতে পারে বলে মনে কর। প্রথম ভেবেছিলে যাই ঘটুক, আমাকে তোমার চাই। কিন্তু এখন, আমার সাময়িক অনুপস্থিতি, হামিদা বৌদির বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগের সংকল্প সব ঘটনা তালগোল পাকিয়ে গেছে। এখন তুমি ভাবছ, হামিদাকে তুমি ত্যাগ করে আমাকে স্ত্রী রুপে গ্রহণ করতে পার না। কারণ তোমার বিবেক বলছে এ এক গুরুতর অন্যায়। ঠিক কিনা?

    আমি কোনো জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকলাম।

    আমার কথার জবাব দিতে চাও না?

    তুমি তো বললে আমার কিছু বলতে হবে না। যা বলার তুমিই বলবে।

    হাঁ। আমিই বলব।

    বলে যাও আমি শুনছি।

    শোনো। প্রেম বা পুরুষ সম্বন্ধে তোমার সাথে সাক্ষাতের আগে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। তাছাড়া ধর্মের ব্যাপারে আমার পরিবার পরিজন এবং আমি নিজে ছিলাম অত্যন্ত গোঁড়া। আমাদের গাঁয়ের মুসলমান প্রতিবেশীদের সাথে আমরা প্রকাশ্যে সম্প্রীতির ভাব দেখালেও মনে প্রাণে ঘৃণা করতাম। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের সম্প্রদায়ের সামান্যতম কোনো আনুগত্য বা ভালবাসা ছিল না। আমাদের আনুগত্য ছিল ভারতের প্রতি। সবদেশে সব সংখ্যালঘুদের মনোভাব একই রকম। আমরা সব সময় ভাবতাম একদিন না একদিন ভারত এসে পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নেবে। আমার নিজের দেশটা একদিন ভারতের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাবে। আমার সম্প্রদায়ের অর্থাৎ হিন্দুদের সেই সময় পর্যন্ত শুধু ধৈর্য ধরে থাকতে হবে। এই প্রতীক্ষার মধ্যেই আওয়ামী লীগ ছ’দফার দাবি তুললে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি হিন্দুর হৃদয়ে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়। হিন্দু মাত্রই ছ’দফার সমর্থক ছিল। কিন্তু এ ধারণা কারুরই ছিল না পূর্ব বাংলার মুসলমানরা বৃটিশ আমলের হিন্দু জমিদার শ্রেণীর দ্বারা নিষ্পেষিত হলেও শিক্ষাদীক্ষা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যবসা বাণিজ্যে অনেকদূর পর্যন্ত এগিয়ে এসেছে আর সংস্কৃতি ক্ষেত্রে এমন এক অদ্ভুত জাতীয়তাবাদের উন্মাদনা সৃষ্টি করতে যাচ্ছে যা পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু এবং পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি বা আকাঙ্ক্ষার সাথে মেলে না। উনসত্তরের গণ আন্দোলনের সময়ই পূর্ব বাংলার ভারতমুখী সাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল হিন্দুরা বুঝতে পারে ছ’দফার আন্দোলনকারী জাতীয়তাবাদী মুসলমানরা এমন এক আন্দোলনের সূচনা করতে যাচ্ছে যা পাঞ্জাবি ঔপনিবেশিক ধ্যানধারণা শোষণতন্ত্র এবং উর্দুভাষীদের প্রাধান্যকে খর্ব করবেই। আবার অন্যদিকে ভারতেও মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এ সময় আমি পত্রপত্রিকায় তোমার রচনার সাথে পরিচিত হই। তোমার কবিতা আমার হৃদয়মনকে এমনভাবে নাড়া দেয় যে আমার মধ্যে মুসলমানদের প্রতি যে গোপন ঘৃণার ভাব ছিল তা দূর হতে থাকে। আমি সীমাদির স্বামীকে ঢাকা থেকে তোমার কবিতার বই কিনে আনতে পীড়াপীড়ি করতাম এবং নিজেও একটু আধটু লিখতে চেষ্টা করতাম। তুমিই ছিলে আমার প্রিয় কবি। বিশ্বাস কর, তোমাকে এক নজর না দেখেই আমি তোমার ভক্ত ও আবেগের বশীভূত হয়ে যাই। ভেব না দেশ থেকে পালিয়ে আসার সময় এবং বিপদমুহূর্তে তোমার পরিচয় পেয়েই আমি তোমার প্রেমে পড়েছি। তবে তোমার তখনকার সাহস এবং দুটি অসহায় নারীর প্রতি দয়া ও কর্তব্যবোধ দেখে তোমার কবিতার চেয়েও তোমাকে ভালবেসেছি বেশি।

    কথাগুলো বলে নন্দিনী একটা বড় নিশ্বাস ফেলে অন্ধকারে চুপ করে গেল।

    আর কিছু বলবে?

    তোমাকে বিবাহিত জেনেও তোমাকে কামনা করতে বাঁধেনি। আমার সমস্ত দেহমন তখন তোমাকে সঁপে দিতে আমি প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তোমার স্ত্রীর ছবি আমি এ জনমের মতো তোমায় হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে পারব। কিন্তু আমি জানতাম না হামিদা এমন শক্তিশালী মেয়ে যে স্বদেশের জন্য নিজের স্বামীকেও তুচ্ছজ্ঞান করে এত অসুবিধার মধ্যে যুদ্ধের শপথ নিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হবে। বৌদি আমার সমস্ত অহংকারকে তছনছ করে দেয় যেদিন আমি পারুল ও মিতুর কাছে হামিদার শারীরিক বর্ণনা শুনি এবং তার তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার মুহূর্তের কান্নার কথা শুনি তখনই বুঝতে পারি আমার সাধ্য নয় এই নারীর কাম্য পুরুষকে শুধু ভালবাসার জোরে দখল করে নিতে পারব। যে মেয়ে কর্তব্য পালনের জন্য নিজের পুরুষকে হেলায় অন্য নারীর দ্বারা বেদখলের বিপদ জেনেও ফেলে চলে যেতে পারে তার মনে প্রেমের ওপর ভরসা আমার চেয়ে অনেক বেশি। আমি সাময়িকভাবে আমার দেহের মোহে তোমাকে ভোলাতে পারলেও, এ মোহ ভেঙে যেতে বেশি দেরি হবে না। হামিদার মতো সাহসী মেয়েকে যে একদা ভালবেসেছে সে আজ না হোক কাল তার জন্য অনুতাপে এবং অনুশোচনায় দগ্ধ হবেই এবং আমাকে ভাববে সমস্ত অনিষ্টের মূল।

    অর্থাৎ আমি তোমাকে ঘৃণা করতে শুরু করব। এই তো?

    ঠিক তাই। তুমি স্বীকার কর বা না কর ঠিক তাই।

    এই জন্যই বোধহয় ইসলামের একাধিক বিবাহের সুযোগটা খুঁজছ এবং ধর্ম পরিবর্তন করতেও চাও?

    হ্যাঁ, তোমার অনুমান মিথ্যে নয়। তোমার ধর্মের একাধিক বিবাহের ব্যাকগ্রাউন্ড এখন আমি বুঝতে পারি। খুবই বাস্তবসম্মত এই উদার অনুমতি। এই সুযোগ নিতে পারলে আমি তোমার সাথে ব্যাভিচারের পাপ থেকে বেঁচে যাই। আর তোমার রক্ষিতা হয়েও থাকতে হয় না। আমাকে বাঁচাও কবি। আমাকে বাঁচাও কবি। যদি আমাকে মুহূর্তের জন্য একবার একটুও ভালোলেগে থাকে তবে তোমার ভালবাসার দোহাই, আমাকে বাঁচাও।

    বলেই নন্দিনী আমাকে অন্ধকারে দুহাতে জড়িয়ে ধরে আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম, ভবিষ্যতে কী ঘটবে তা আমি জানি না নন্দিনী। তবে আমার প্রতিশ্রুতি আমি ভঙ্গ করব না। তোমাকে কোনো অবস্থাতেই পরিত্যাগ করব না আমি। আমি আমার স্ত্রীকেও জানি। সেও তোমার মর্যাদা রক্ষা করতে কোনো কসুর করবে না। এর জন্য অনিচ্ছায় কেন তোমাকে ধর্ম পরিবর্তন করতে হবে?

    আমার কথায় হঠাৎ নন্দিনীর কান্না থেমে গেল। সে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে সুইচ হাতড়ে বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে বলল, অনিচ্ছায় তোমাকে কে বলল? স্বেচ্ছায় আমি ইসলাম গ্রহণ করতে চাই।

    স্বেচ্ছায় নয়, বল আমি মুসলমান বলেই তুমি মুসলমান হতে চাও। তুমি তো ইসলাম সম্বন্ধে কিছুই জান না। এ যুদ্ধের পর একথা যখন জানাজানি হবে তখন এর পরিণাম চিন্তা করেছ?

    পরিণাম?

    সকলেই বলবে কবি হাদী মীর মুক্তিযুদ্ধের সময় একটা অসহায় হিন্দু মেয়েকে জোর করে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করেছে। আমার প্রতিদ্বন্দ্বিরা আমার কবিখ্যাতিতে কালিমা লেপনের চেষ্টা করবে। সকলে মিলে আমার জীবন অসহনীয় করে তুলবে।

    আমার কথায় নন্দিনী খানিকক্ষণ নিষ্পলক চোখে আমাকে দেখল। তারপর মুখটা ঘুরিয়ে নিল দেয়ালের দিকে। সেখানে একটা পটচিত্রে কালিঘাটের আঁকা স্বাস্থ্যবতী কোনো দেবী বা বাংলার চিরন্তন বঁধুর মুখ।

    এতদিন কিন্তু এসব খ্যাতি অখ্যাতি বা পরিণাম চিন্তা তোমার মনে ঠাঁই পায় নি।

    ঠাঁই পায় নি কারণ কোনো পুরুষই তোমার মতো রূপসী নারীকে হাতের কাছে পেলে পরিণাম ভেবে দেখবে না। আমিও তো পুরুষ নন্দিনী। আমারও তো বন্য কামনা বাসনা আছে?

    আমি কী খুবই সুন্দরী কবি?

    জানি না, আয়নার নিজেকে দেখ গিয়ে।

    আমার কথায় আমরা উভয়েই হেসে ফেললাম।

    অবস্থাটা একটু হালকা হলে বললাম, চল তোমাকে মিতুর ঘরে দিয়ে আসি। রাত তো অনেক হয়েছে। একটু না ঘুমালে তোমার শরীর খারাপ হবে।

    যাবার আগে আর একটা কথা বলতে চাই।

    কি কথা?

    ট্রেনিং ক্যাম্পে না ফেরার প্রকৃত কারণটা তোমাকে খোলাখুলি বলা হয় নি।

    তুমি বলতে চেয়েছিলে কিন্তু আমিই শুনতে চাই নি। শুনে কী হবে, সব জায়গাতেই কিছু নোংরা লোকজন থাকে যারা মানুষ নামের কলঙ্ক। তাবলে মুক্তিযুদ্ধটাই খারাপ একথা তোমার মুখে শুনতে আমার ভাল লাগবে না বলে শুনতে ইচ্ছে করে নি।

    আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম।

    নন্দিনী বলল, আমি শুধু মানুষের লোভের কথা তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম তুমি সেটুকু শোনারও আগ্রহ দেখাও নি। আমি সেসব অসুবিধেকে পরোয়া করি না। কিন্তু যেজন্য ট্রেনিং ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আমার মন বিষিয়ে গেছে সেটা কোনো লোভী মানুষের নোংরামো নয়। সেটা একজন নির্দোষ নিরপরাধ মানুষের হত্যাকান্ড। যা আমার চোখের সামনে ঘটেছে। যে অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেও প্রতিরোধ করতে পারি নি। আমার দিনের আহার ও রাতের ঘুম যে দৃশ্যটি কেড়ে নিয়েছে কবি। যে অসহায় মুখখানির নিরুপায় দৃষ্টি ও ঈশ্বরের কাছে কাতর প্রার্থনার দৃশ্য আমাকে তাড়া করে ফিরছে। যার ফলে আমার মনে হাজার হাজার বাঙালি বীরের আত্মত্যাগের মহিমা, আমার বোনের মৃত্যু, আমার ভগ্নিপতির নিখোঁজ হওয়া, আমার সম্ভ্রম লুণ্ঠন ইত্যাদি যা কিছু আমরা বাংলাদেশের মুক্তির জন্য উৎসর্গ করেছি, সবকিছুর ওপরই কালি ঢেলে দিয়েছে। মনে হচ্ছে আমি কোথায়, কাদের সঙ্গে আছি? কেন আছি? প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধ কোথায় চলছে? কারা সেই মুক্তিযোদ্ধা? আর সেই মুহূর্তে ভেসে উঠেছে কমরেড রেজার মুখ, তোমার আর নাসরিনের মুখ। সুযোগ পেয়েই সেই নরক ছেড়ে আমি ছুটে এসেছি তোমার কাছে এখানে, যেখানে ইমাম সাহেবের মতো উদারচেতা দাদা, পারুলের মতো বোন আর মিতুর মতো সুন্দর শিশুরা স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের জন্য কাল গুনছে। কবি, এই যুদ্ধের খারাপ দিকগুলো তুমিও কম দেখ নি কিন্তু আমি যা দেখেছি তা যেন কোনো বাঙালি নারীর দেখার দুর্ভাগ্য না হয়। আমিও যোদ্ধা, হত্যার মন্ত্র আমিও নিয়েছি। হানাদার পশুদের বিরুদ্ধে আমার যুদ্ধ। কিন্তু যে আমাদের প্রতিজ্ঞার সাথে শত্রুতা সাধন করে নি কিংবা এই লড়াইয়ের তাৎপর্য সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ এবং নিরপরাধ, যে একটা মসজিদে ঈশ্বরের গুণগান করছে, এমন অবস্থায় তাকে ধরে এনে বিনা প্রমাণে যারা তাকে গুলী করে মারল, আমি তাদের কাছে ফিরে যেতে চাই না কবি। আমি তাদের ঘৃণা করি, ঘৃণা করি, ঘৃণা করি…

    উত্তেজনায় ও গভীর ঘৃণায় নন্দিনী আবার আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। আমি তার এ কান্নায় বাধা না দিয়ে তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে থাকলাম। নন্দিনী এমনভাবে কাঁদছে আমার মনে হল তার ভিতরের কোনো রুদ্ধ কপাটের খিল যেন কে ভেঙে দিয়েছে। আমি তার প্রতি আর কোনো সান্ত্বনার শব্দ উচ্চারণ করতে পারলাম না। বলতে পারলাম না, নন্দিনী শান্ত হও, তোমার সব দুর্ভাগ্যের কথা আমাকে খুলে বল। আমি শুধু নিবিড়ভাবে তাকে বুকের মধ্যে নিয়ে তার অন্তরের কাতরতার ঢেউগুলো অনুভব করতে লাগলাম। কাঁদতে কাঁদতে নন্দিনী এক সময় স্তব্ধ হয়ে এল। আমি একবার তার আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখা হাতের বাঁধন আলগা করে দিয়ে বললাম, এস তোমাকে মিতুর খাটে রেখে আসি। তোমার একটু ঘুমের প্রয়োজন।

    নন্দিনী যেন হঠাৎ সম্বিৎ পেয়ে, নিজেকে আমার কাছ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, সেই নির্মমতার ঘটনা তুমি শুনতে চাও না?

    চাই। এখন একাকী এই ঘরে যে বিষয় বা ঘটনা তোমাকে এমন কাতর করেছে তা যদি বলতে থাক নন্দিনী তবে তুমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। তোমার শরীর কতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে তা আমি বুঝতে পেরেছি। এ অবস্থায় আমি তোমার বিবরণ শোনার কৌতূহল দেখাতে পারি না। কাল সকালে তুমি তোমার চাক্ষুস দেখার বিবরণ দিও পরিবারের সকলের সামনে। আমার বোন, ভাগ্নি ও ভগ্নিপতিকে। রেজাভাইও শুনবে। এরা সবই মুক্তিযোদ্ধা। সবাই শুনুক সে কাহিনী। তখন বলতে গিয়ে তুমি আর কাঁদবে না। তোমার মধ্যে তখন ক্রোধ জেগে উঠবে। পশুত্বের বিরুদ্ধে মনুষ্যত্বের ক্রোধ। কান্না নয় ঐ ক্রোধ আমি আগামীকাল তোমার মধ্যে দেখতে চাই। নন্দিনী আমি তোমাকে আরও নিবিড়ভাবে ভালবাসতে চাই।

    আমার কথায় নন্দিনী আশ্বস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল।

    আমি তাহলে মিতুর কাছে গিয়ে শুয়ে পড়ি।

    বলল নন্দিনী। আমিও দরজার ছিটকিনি খুলে দিয়ে বললাম, এস নন্দিনী।

    .

    আমার দুচোখে আর ঘুম নেই। নন্দিনী কী দেখে এমন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে তা ভাবতে লাগলাম। আমি চিন্তা করে পাচ্ছি না প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে? যদিও নন্দিনী তার বলার সময় ঘটনার একটা আতংকজনক ইঙ্গিত দিয়েছে। তবুও ঘটনার বৃত্তান্ত সে বলে নি। কে জানে আগামীকাল কী বর্ণনা তার মুখ থেকে শুনতে হবে? নিশ্চয়ই এমন কোনো ঘটনা যা নন্দিনীর মতো এক লাঞ্চিত নারীকেও মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং ক্যাম্পের শপথ বাণীতে সন্দেহ জাগিয়ে তুলেছে। সে বিবরণ আমাকেও কী নন্দিনীর মতো দ্বিধান্বিত করে তুলবে? তাহলে সে বর্ণনা আমার না শোনাইতে উত্তম। অথচ আমি নন্দিনীকে একটু আগে কথা দিয়েছি আমরা একটি পরিবারের সবাই মিলে এবং কমরেড রেজাসহ এ কাহিনী শুনব। আমি বিছানায় এপাশ ওপাশ করেও চোখে ঘুম আনতে পারছি না। এর মধ্যে দুটি সিগ্রেট ফোকা হয়ে গেছে। ঘুম না পেলে সাধারণত আমি বিছানায় গড়াগড়ি যেতে পারি না। বাতি জ্বালিয়ে বই পড়ি কিংবা রাস্তায় বেরিয়ে গিয়ে পায়চারী করি। কিছুই ভালো লাগছিল না। একবার ভাবলাম, নিচে নেমে গিয়ে দারোয়ানকে বলি গেট খুলে দিতে। একটু ঘুরে আসি কিংবা একটু এগিয়ে গিয়ে পার্কসার্কাসের কোনো রাতজাগা দোকান থেকে সরভাসানো গাঢ় চা খেয়ে আসি। আমি জানি কলকাতার এদিককার মুসলমান পাড়াগুলোতে এমন অনেক চায়ের দোকান আছে যা সারারাত খোলা থাকে। হয়ত চা খেয়ে একটু পায়চারী করে এলে মনের ভার নেমে যাবে। হয়তো ঘুমিয়ে পড়তেও পারি।

    আমি বিছানা থেকে নেমে শার্ট প্যান্ট পরে নিয়ে ঘরের বাইরে এলাম। বারান্দায় এসেই মনে হল একটু শীত লাগছে। আমার ঘড়িতে এখন রাত দেড়টা। রাত বারটার পর থেকে শুরু হয়েছে ডিসেম্বরের এক তারিখ। শীতের আমেজটা বুঝলাম। শীত আসছে অথচ আমার বা নন্দিনীর শীতের কোনো কাপড় কেনা হয় নি। সিঁড়ির কাছে এগিয়ে যেতেই কে যেন পেছন থেকে ডাকল।

    কবি ভাই কী নিচে যাচ্ছেন?

    আমি ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম ইমাম তার ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দার পেসে এসে দাঁড়িয়েছে।

    আপনি এখনও জেগে আছেন?

    ঘুম পাচ্ছিল না। দেখলাম আপনি ঘর থেকে বেরুলেন।

    আমারও ঘুম পাচ্ছে না। নিচে রাস্তায় পায়চারী করতে যাচ্ছি।

    আপনার আপত্তি না থাকলে আমাকেও নিন না।

    চলুন।

    দাঁড়ান, আপনার জন্য একটা কোট এনে দিই।

    বলে ইমাম ঘরের ভেতর চলে গেল। আমি সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। একটু পরেই সোনালি বোতামঅলা একটা নীল ব্লেজার এনে আমার হাতে দিল।

    নিন আপনার শীতকালটা এটা দিয়ে পার করে দিতে পারবেন। আমি মাত্র একটা শীতে পরেছিলাম। নতুনই আছে।

    আমি ব্লেজারটা গায়ে দিয়ে বললাম, একেই বলে রাজার কপাল।

    ইমাম বলল। সেও একটা কাশ্মীরি শাল গায়ে চাপিয়েছে। আমরা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম।

    .

    আমরা রাস্তায় খানিকক্ষণ পায়চারী করে একটা গলির ভেতরকার চায়ের দোকানে এসে ঢুকলাম। কাউন্টার পার হয়ে টেবিলে বসা মাত্রই তিনজন সঙ্গীসহ রেজাভাই এসে দোকানে ঢুকলেন। কাকতালীয় যোগাযোগ। আমি হাত তুলে রেজাভাইয়ের দিকে ইঙ্গিত করতেই তার সাথের তিন সঙ্গী হকচকিয়ে আমার দিকে মুহূর্তের মধ্যে ফিরে দেখেই রেজাভাইকে আড়াল করে দাঁড়াল। তাদের প্রত্যেকের ডান হাত পকেটে ঢোকান। এ অবস্থায় আমিও হতভম্ব হয়ে গেলাম। ততক্ষণে রেজাভাই ব্যাপারটা আন্দাজ করে সঙ্গের লোকদের হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে এলেন, আরে এতরাতে আপনারা এখানে কী করছেন?

    ইমাম হেসে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ঘুম আসছিল না বলে রাস্তায় আমরা একটু পায়চারী করব বলে বেরিয়েছি। আর কবি ভাইয়ের সরে ভাসা চা পছন্দ।

    ইমামের কথায় দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো পকেট থেকে হাত বের করে একটু শিথিল ভঙ্গিতে একটা টেবিল দখল করে বসে পড়ল। কমরেড রেজাও ইমামের সাথে হ্যান্ডসেক করে আমাদের টেবিলে এসে বসলেন।

    এরা তিনজন আমার লোক। মুক্তিযোদ্ধা।

    খুব অনুচ্চকণ্ঠে রেজাভাই কথা বলছেন।

    আপনার কলকাতার কাজ সম্ভবত শেষ। এবার ভেতরে যাওয়ার ব্যাপারে কী ভাবছেন?

    আগামীকাল সন্ধ্যায় কলকাতা ছেড়ে যাব। আমি জানি এখানে ভারত সরকারের কাছে আপনি আমার জিম্মাদার। আপনার আর তাজউদ্দিন সাহেবের জন্যই এখানে আমার ওপর কেউ আপাতত নজর রাখছে না। আমিও এখানকার বন্ধুদেরকে আপনার সহযোগিতার কথা জানিয়েছি। তাদেরও ধারণা আগামী দুসপ্তাহের মধ্যেই ভারত আমাদের দেশের ভেতর হস্তক্ষেপ করবে।

    ফিস ফিস করে, ইমামের কানের কাছে মুখ নামিয়ে রেজাভাই কথাগুলো শেষ করলেন। ইমাম আর কিছু বলল না। চায়ের দোকানের বয়টা আমাদের সামনে সরেভাসা চায়ের কাপগুলো নামিয়ে রাখল। এখন একজন শিখ ভদ্রলোক ছাড়া দোকানে অন্য কোনো খদ্দের নেই। লোকটা সম্ভবত ট্যাক্সি ড্রাইভার। গলিতে ঢোকার সময় আমরা গলির মুখে একটি ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এসেছি।

    চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ইমাম বলল, কাল সন্ধ্যায় রওনা দেবেন তো এখন এত রাতে সশস্ত্র সঙ্গীদের নিয়ে পথে পথে ঘোরা কী নিরাপদ?

    আমি জরুরি কাজে অর্থাৎ আমার এই কমরেডের বিভিন্ন এলাকা থেকে তুলে আনতে কলকাতার বাইরে গিয়েছিলাম। ফিরতে রাত হয়ে গেল। ভেবেছিলাম সামান্য কিছু খেয়ে আপনার বাসায় গিয়ে আপনাকে জাগাব। আমরা চারজনই অভুক্ত।

    আমি বললাম, তাহলে চলুন রেজাভাই বাসায় গিয়ে আমার বোনকে জাগিয়ে কিছু একটু মুখে দেবেন। এখানে তাহলে আর কিছু খাওয়ার দরকার নেই।

    এতরাতে তাকে জাগালেই যে খাবার পাওয়া যাবে সেটা কী করে বলা যায়? তিনি তো আর আমাদের জন্য রেঁধে রেখে ঘুমান নি? তারচেয়ে বরং এখানেই চা-বিস্কুট একটু বেশি করে খেয়ে যাই।

    দরকার নেই, চলুন বাসায় গিয়ে সবাই মিলে একটা ব্যবস্থা করা যাবে। আপনারা রাতে কিছু খান নি, তাহলে তো এতক্ষণ খুবই কষ্ট পেয়েছেন। চলুন।

    বলে ইমাম কাউন্টারের দিকে চায়ের দাম মিটাতে গেলে আমি রেজাভাইকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম এবং পাশের টেবিলে চা পানরত রেজাভাইয়ের সঙ্গীদেরও ইঙ্গিত করলাম। আমার ইঙ্গিতে সঙ্গী তিনজন চা শেষ না করেই কাপ টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়াল। তিনজনই যুবক এবং দেখতে ফর্সা এবং সুদর্শন। তারা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে আমাদের টেবিলের পাশ কাটিয়ে কাউন্টার পার হয়ে বেরিয়ে গেলে আমি ও রেজাভাই তাদের অনুসরণ করলাম। ইমামও চায়ের দাম মিটিয়ে আমাদের পেছনে আসতে লাগল।

    আমরা রাস্তায় নেমে দেখলাম রেজাভাইয়ের লোকেরা আমাদের থেকে পঁচিশ গজের ব্যবধান রেখে সামনে এগোচ্ছে। রেজাভাই হঠাৎ হাঁটতে হাঁটতে আমার হাতটা, ধরলেন, আমার সঙ্গীদের একজনকে তো আপনার চেনার কথা? এদের তিনজনই আসাম থেকে এখানে এসেছে। এরা তোরা বর্ডার দিয়ে আসামে প্রবেশ করেছিল। একজন টাকার স্যুটকেসটা আপনার সঙ্গিনীকে দিয়েছিল। এখন চিনতে পারছেন? ওই যে মাঝের জন। নাম ক্যাপটেন গজনফর। ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে ছিল।

    আমি পেছন থেকে মাঝের ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। এখন ঠিক চেনা যাচ্ছে না। তিনজনই সাফারীর মতো সাদা প্যান্টশার্ট পরা। তিনজনই বেশ লম্বাচওড়া। হাঁটছেনও সামরিক কেতায়। আমি বললাম, বাসায় গিয়ে পরিচয় হবে।

    গজনফর আপনাকে দেখেই সম্ভবত চিনেছে। একটু আগে তার হাসি থেকে কিছু বুঝতে পারেন নি? স্যুটকেস এবং টাকা যে আপনারা পৌঁছে দিয়েছেন আমাদের ঠিকানায় জীবন বাজি রেখে একথা আমি গজনফরকে জানিয়েছি। সে আপনার এবং আপনার বান্ধবীর সততায় অতিশয় মুগ্ধ।

    তাকে তো আটক করা হয়েছিল ছাড়া পেলেন কী করে?

    তাজউদ্দিন সাহেবকে তার আটকের কথা আমি বলেছিলাম। অনুরোধ করেছিলাম এ ব্যাপারে সাহায্য করতে। তিনি আমার অনুরোধের খুবই মূল্য দিয়েছেন।

    জানালেন রেজাভাই। আমরা হাঁটতে হাঁটতে পার্ক সার্কাসের মাঝামাঝি আমাদের বাসার গেটে এসে দাঁড়াতেই দারোয়ান গেট খুলে দিল। ওপরে এসে দেখি পারুলের ঘরে বাতি জ্বলছে। বারান্দায় আমাদের পায়ের শব্দ পেয়েই পারুল দরজায় এসে মুখ বাড়াল, কী ব্যাপার তোমরা এত রাতে কোথায় গিয়েছিলে?

    ইমাম বলল, একটু পায়চারী করছিলাম রাস্তায়। বাইরে রেজা সাহেবের সাথে দেখা। এরা রেজা সাহেবের সঙ্গী। আমাদের বাসার উদ্দেশ্যেই আসছিলেন। এদের রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। আছে কিছু?

    পারুল একটু বিব্রত হয়ে আমার দিকে ফিরে বলল, সামান্য কিছু ভাত আর মুরগীর সুরুয়া গরম করে দিতে পারি।

    চমৎকার, তাই দিন।

    হেসে বললেন রেজাভাই।

    ইমাম জিজ্ঞেস করল, ভাত কম থাকলে তোমার ভাঁড়ারে পাউরুটি পাওয়া যাবে না?

    সকালের নাস্তার জন্য রাখা আস্ত দুটি পাউরুটি বের করে দিতে পারি।

    তাই দাও। জলদি।

    ইমামের কথায় পারুল রান্নাঘরের দিকে যেতে উদ্যত হলে আমি বললাম, আমি নন্দিনীকে জাগিয়ে দেব?

    এত রাতে তাকে জাগিয়ে কষ্ট দেয়ার কী দরকার? আমিই খাবার এনে দিচ্ছি। আপনারা বরং খাবার টেবিলে একটু অপেক্ষা করুন।

    .

    আমরা সবাই টেবিলে গিয়ে বসলাম। একটু পরেই মুরগীর গরম ঝোল, দুটি আস্ত পাউরুটি এবং একপ্লেট ভাত এনে পারুল রেজাভাইয়ের সামনে রাখল। আমি ও ইমাম ছাড়া বাকি চারজনই গোগ্রাসে খেতে লাগল। ইমাম বলল, খাওয়ার পর আপনাদের দুজনকে ড্রয়িংরুমে সোফায় চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমোতে হবে। আর বাকি দুজন শোবেন কবি ভাইয়ের খাটে। একটু কষ্ট হবে।

    রেজাভাই খেতে খেতে বললেন, কষ্টের কথা কেন বলছেন? আজরাতে দারুণ ঘুম হবে। এটাই সম্ভবত কলকাতায় আমাদের সবচেয়ে নিরাপদ শেষরাত। আপনি নিশ্চিন্তে গিয়ে শুয়ে পড়ুন।

    .

    স্বভাবতই পরদিন দেরি করে ঘুম ভাঙল আমার। পারুলের ডাকে চোখ মেলে সোজা বিছানায় উঠে বসে গেলাম, এখন কটা বাজে?

    নটা। আপনার বন্ধুরা সবাই নাস্তা সেরে ড্রয়িংরুমে জমায়েত হয়েছে। দিদিও আছেন। ক্যাপ্টেন গজনফরের সাথে কথা বলছেন। সেই যে যার টাকার ব্যাগ দিদি নিয়ে এসেছিলেন?

    হেসে বলল পারুল।

    আমি বললাম, আমাকে জাগাস নি কেন?

    ইমাম বলল আপনি ক্লান্ত, আজই বিকেলে ঢাকার দিকে রওনা হবেন। একটু বেশি ঘুমিয়ে নিলে শরীর ঠিক থাকবে তাই ডাকি নি।

    আমি বললাম, ঠিকই আছে। আমি হাতমুখ ধুয়ে আসি, তুই টেবিলে নাস্তা লাগা।

    ডাইনিং টেবিলে বসে খাওয়ার সময় নন্দিনী ক্যাপ্টেন গজনফরকে নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল, চিনতে পারছ?

    আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললাম, হ্যাঁ, রেজাভাইয়ের কাছে পরিচয় জেনেছি।

    ক্যাপ্টেন গজনফর আমার পাশে এসে বসতে বসতে বললেন, আপনাদের কাছে কী বলে কৃতজ্ঞতা জানাব? যে অবস্থায় আপনারা স্যুটকেসটা আমাদের লোকদের কাছে এনে পৌঁছে দিয়েছেন তা অবিশ্বাস্য। শুধু এটুকু বলতে পারি আপনাদের মতো লোক থাকলে দেশ দুর্ভোগ কাটিয়ে উঠবে। আপনাদের সাথে আমিও ঢাকায় যাচ্ছি। এখন থেকে সব সময় যোগাযোগ থাকবে।

    .

    খাওয়ার পর আমরা সবাই পারুলদের ড্রইংরুমে এসে বসলাম। রেজাভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আজ সন্ধ্যায় আমরা বর্ডার ক্রশ করব। কলকাতা ছাড়তে হবে বেলা দুটোয়। নষ্ট করার মতো সময় আমাদের হাতে নেই। কেউ কোনো ভারি জিনিসপত্র এমন কী একাধিক কাপড়চোপড়ও সঙ্গে নেবেন না। যতটা দ্রুত সম্ভব আমরা ঢাকায় গিয়ে পৌঁছতে চাই। যদিও জানি আমাদের ঢাকার ঢুকবার আগেই ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের বর্ডার ক্রশ করবে।

    .

    ১২.

    আঠারোই ডিসেম্বর মধ্যরাতে রেজাভাই আমাদের নিয়ে সদরঘাটে নৌকা থেকে নামলেন। যেভাবে আমাদের আসার কথা ছিল বলাবাহুল্য আমরা সেভাবে আসতে পারি নি। সেভাবে এলে আমরা ঢাকা এসে পৌঁছুতাম ষোল ডিসেম্বর নিয়াজির সারেন্ডারের এক সপ্তাহ আগে। নানা প্রতিকূল অবস্থায় এক গ্রাম থেকে অন্যগ্রামে রেজাভাইয়ের নিজস্ব রাজনৈতিক যোগাযোগের সূত্র ধরে আমরা এগিয়ে এসেছি। আমাদের পাশ কাটিয়ে উল্লসিত মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় বাহিনীকে পথ দেখিয়ে ঢাকার পথে নিয়ে গেছে। গুলীর শব্দে সারা বাংলাদেশের পল্লী এলাকাকে প্রকম্পিত করে যাওয়ার বিজয়োল্লাস আমরা চোখে না দেখলেও কানে শুনতে পেয়েছি। এই উল্লাস ধ্বনিতে নন্দিনী একবার লাফিয়ে উঠে রেজা ভাইয়ের হাত চেপে ধরেছিল, আমরা কি, রেজাভাই, এদের সাথে হেঁটে হেঁটেই ঢাকায় চলে যেতে পারি না?

    রেজাভাই গম্ভীর মুখে হেসেছেন, পারতাম যদি আপনি আমাদের সাথে না থাকতেন। এখনকার সময়টার কথা বিবেচনা করতে হবে। এখনকার এই গ্রুপগুলো যারা ঢাকার দিকে এগোচ্ছে তারা একদিকে যেমন প্রতিহিংসা পরায়ণ তেমনি অনেক প্রিয়জনকে হারিয়ে ক্ষিপ্ত। যদিও হানাদাররা ষোল ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করেছে এবং ইন্ডিয়ান আর্মি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে রক্তপাত বন্ধের। তবুও যুদ্ধ পরবর্তী বিশৃঙ্খলা ও হিংস্রতা দমনের ক্ষমতা তাদের হাতে থাকবে বলে মনে হয় না। সামাজিক অরাজক অবস্থা কতদিন চলবে তা এখনই আন্দাজ করা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় একটু ঘুরপথে পাড়াগাঁর নদীনালা ধরে আমরা এগোব। সদর রাস্তা ধরে যেতে চাইলে আমরা আরিচা দিয়েই যেতে পারতাম। কিন্তু আমি মনে মনে স্থির করেছি আমরা নদীপথ ধরে একটু সময়ক্ষেপণ করে সদরঘাট গিয়ে নামব। এ ব্যাপারে আপনার কী কিছু বলার আছে কবি ভাই!

    না রেজা ভাই। আমি আপনার ধীরে এগোনোর কারণটা মোটামুটি আন্দাজ করতে পারছি। নন্দিনী একটু অস্থির হয়ে পড়েছে বটে। তবে বিলম্বে ঢাকার প্রবেশের ফল আখেরে আমাদের জন্য ভালোই হবে।

    বলেছিলাম আমি। আমার কথার ওপর নন্দিনী হঠাৎ কথা চালিয়ে বলে উঠেছিল, আমি জানি না লাখ লাখ দেশত্যাগী নরনারী আর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এমন কেউ আছে কিনা যে এই মুহূর্তে নিজেদের বাড়িঘর এবং আত্মীয়দের মধ্যে পৌঁছুতে চায় না। আমার অবশ্যি আত্মীয় বলতে পৃথিবীতে কেউ নেই। ঢাকা আমার দৈনন্দিন থাকারও জায়গা নয়। আমি এই মুহূর্তে ঢাকায় থাকতে চেয়েছিলাম কেবল একজনের জন্য। তিনি হামিদা বৌদি। জানি না বেচারা এখন কোথায় কী অবস্থায় আছেন।

    নন্দিনীর মুখে হামিদার নাম শুনে সহসা আমার বুকটা কেমন যেন ধক করে উঠেছিল। সত্যি তো হামিদা এখন কোথায়? ষোল ডিসেম্বরের পর নিশ্চয়ই সে এখন আর আত্মগোপন করে নেই। হামিদা আহত মুক্তিযোদ্ধা, নিশ্চয়ই কেউ তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। হয়তো এখন সে হাসপাতালের সীটে শুয়ে আমার কথাই ভাবছে। আমার কথাই ভাবছে কি? হামিদা তার সাথে শেষ সাক্ষাতের সময় বলেছিল তাকে পরিত্যাগের আগে আমি ও নন্দিনী যেন অন্তত কয়েকটা দিন অপেক্ষা করি। কারণ তারও আত্মীয়স্বজন বলতে কেউ নেই। হঠাৎ সে কোথায় গিয়ে উঠবে?

    হামিদার এই সোজা সরল অভিব্যক্তিতে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। হামিদা কত সহজেই আমার আর নন্দিনীর সম্পর্কটিকে মেনে নিয়েছিল। আমি হামিদাকে বহুদিন থেকে জানি। আমার স্ত্রী বলেই যে তাকে জানতাম এমন নয়। বিয়ের আগে থেকেই জানতাম। আবেগ ও বাস্তববুদ্ধির এমন একটি মেয়েমহিমা আমার পরিচিত বৃত্তের মধ্যে ছিল না বলেই হামিদাকে আমার চোখে পড়েছিল। আর হামিদা আমার দৃষ্টিতে চিরকালই ছিল এক আকর্ষণীয় সুশ্রী মেয়ে। হামিদাকে যে আমি কতটা ভালবাসি তা আর তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার কোনো উপায় না থাকলেও আমার বর্তমানকালের বিপর্যয়কর সম্পর্ককেও আমি অস্বীকার করতে পারি না এবং পারছি না। আমার অপরাধ কী এই, আমি দুটি মেয়েকেই ভালবাসি?

    নন্দিনীর কথায় রেজাভাইও কেমন যেন একটু বিহ্বল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রেজাভাই আমার দিকে সান্ত্বনার ভঙ্গিতে বললেন, আমার ধারণা আপনার স্ত্রী ষোল ডিসেম্বরের পর আপনাদের সাবেক বাসাতেই ফিরে এসেছেন। এখন তো আর লুকিয়ে থাকার প্রয়োজন দেখি না। যদি তার শারীরিক অবস্থা একেবারেই সটান শুয়ে থাকার মতো না হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে তাকে বাসায় গিয়েই পাবেন। আর যদি শরীরের নিম্নাংশ পঙ্গু হয়ে গিয়ে থাকে তবে তাকে সম্ভবত হাসপাতালগুলোর কোনো একটায় পাওয়া যাবে। আমি শুধু এটুকুই আন্দাজ করতে পারি তিনি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর বিপদমুক্ত পরিবেশেই কোথাও অবস্থান করছেন। এ নিয়ে আপনি আর টেনশনে থাকবেন না। আর আমি তো কলকাতা ছাড়ার আগেই আমার পার্টির প্রতি সহানুভূতিশীল মেডিক্যাল প্রফেসনের লোকদের এবং ছাত্রদের ইন্সট্রাকশন পাঠিয়েছিলাম আপনার স্ত্রীকে খুঁজে বের করে চিকিৎসা করতে। আপনার দেয়া ঠিকানাও তাদের পাঠানো হয়েছিল। যদি সত্যি তারা তাকে পেয়ে থাকেন তবে জানবেন আপনার স্ত্রী যেখানেই থাকুন অযত্নে নেই।

    আমি ও নন্দিনী পরস্পরের দিকে তাকালাম। কারো মুখ থেকে কোনো কথা বেরুল না।

    .

    সদরঘাটে নেমে রেজাভাই বিশাল গয়না নৌকার মতো ডিঙ্গিনাওয়ের মাঝিদের ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ডাঙায় উঠলেন। তার অন্যান্য কমরেডের সাথে আমি আর নন্দিনীও বাকল্যান্ড রোডের ওপর উঠে এলাম। আমি বহুক্ষণ ধরে সিগ্রেটের অভাবে কষ্ট পাচ্ছিলাম। সদরঘাট এসেই মনে হল এক প্যাকেট সিগ্রেট কিনি। কিন্তু সমস্ত এলাকাটাই কেমন যেন অন্ধকার। এর মধ্যে ইসলামপুর কিংবা ওয়াইজঘাট রোড থেকে ক্রমাগত আকাশের দিকে গুলী ছুঁড়ে আনন্দ করার মতো শব্দ এবং হইহল্লা ভেসে আসছিল।

    আমি বললাম, রেজাভাই একটা সিগ্রেট খেতে ইচ্ছে করছে। গত চব্বিশ ঘণ্টা ধরে ধূমপান করি নি। আপনার কাছেও সিগ্রেট ছিল না। আমার কাছেও। এক প্যাকেট সিগ্রেট কিনব তেমন দোকান দূরে থাক সারা সদরঘাটে রাত সাড়ে বারোটায় একটা বাতিও জ্বলছে না এটা কেমন কথা?

    এই অবস্থা থেকেই ঢাকার পরিবেশটা আন্দাজ করে নিতে হবে। সতর্কতার সাথে এগোতে হবে। এখন সিগ্রেটের চেয়ে যে জিনিসটা আমাদের বেশি দরকার তা হল কিছু খাবারের। আজ দুপুর থেকে নদীতে উপোষ দিয়ে চলতে হয়েছে। ভেবেছিলাম সদরঘাট নেমে হোটেল থেকে কিছু খেয়ে নিয়ে শহরের দিকে যাব। কিন্তু দেখতেই পাচ্ছেন শহরের অবস্থা স্বাভাবিক নয়। মনে হচ্ছে হেঁটেই যার যার গন্তব্যে পৌঁছুতে হবে। এখন বলুন আপনি কী এ রাতেই আপনার বাসায় যেতে চান?

    প্রশ্ন করলেন রেজাভাই।

    আমি বললাম, শহরের এ অবস্থায় নন্দিনীসহ হেঁটে হেঁটে শাজাহানপুর যাওয়ার ভরসা পাচ্ছি না রেজাভাই। যেরকম বেপরোয়া গুলীর শব্দ হচ্ছে তাতে নিরাপদে পথচলা বোধহয় সম্ভব হবে না। তার চেয়ে আজ রাতটা আপনারা যেখানে যাবেন কিংবা থাকবেন আমাদেরও সেখানেই নিয়ে চলুন।

    আমরা আপনার বাড়ির কাছেই আমাদের এক শেল্টারে যাব। খিলগাঁও বাগিচায়। চলুন আপনাদের রাসায় পৌঁছে দিয়েও যেতে পারব। তবে সারাটা পথ কিন্তু হেঁটেই যেতে হবে।

    বলেই আমাদের তার সাথে চলার ইঙ্গিত করে রেজাভাই হাঁটা শুরু করলেন। আমিও নন্দিনীর হাত ধরে জমাট বাঁধা কালিমার মতো ঢাকা শহরের অন্ধকার উদরের দিকে হাঁটা শুরু করলাম।

    .

    আমরা রাত আড়াইটার দিকে শাজাহানপুর আমার বাসার সামনে এসে দাঁড়ালাম। একতলা বাড়ি। রাস্তা থেকে ঝিল পর্যন্ত লম্বা দালান। দালানটার শেষ দিকের তিনটে কামরা নিয়ে আমি ও হামিদা থাকতাম। আমাদের বাঁদিকে খাদেম সাহেব বলে একজন শ্রমিক নেতা সপরিবারে দুটি কামরা নিয়ে থাকতেন। প্রায় ন’দশমাস পর নিজের বাসার সামনে এসে মনটা কেমন যেন করতে লাগল। মনে হল একটা অজানা ভয়ে হৃদয় কাঁপছে। হৃদপিন্ডের দুলুনিতে শরীরটাও কাঁপছে। নন্দিনী বোধহয় আমার অবস্থাটা উপলদ্ধি করে আস্তে ফিসফিস করে বলল, এ বাসায় তো কেউ আছেন বলে মনে হচ্ছে না কবি। আমি কড়া নাড়ব?

    রেজাভাই বললেন, আপনারা দাঁড়ান। আমিই ডাকছি।

    আমার নড়ার সাহস হল না। রেজাভাই বারান্দায় উঠলেন।

    অন্ধকারে দরজার কড়ায় হাত দিয়েই বললেন, ভেতরে লোকজন আছে মনে হচ্ছে।

    রেজাভাই কড়া নাড়লেন।

    কেউ আছেন বাড়িতে?

    ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

    রেজাভাই আবার কড়া নেড়ে বললেন, দরজা খুলুন হামিদা বোন। আপনার কবি এসেছেন।

    রেজা ভাইয়ের আপনার কবি এসেছেন শব্দটি শুনেই নন্দিনী এতক্ষণ ধরে থাকা আমার হাতটি তার মুঠো থেকে অন্ধকারে নিঃশব্দে ছেড়ে দিল। কিন্তু এবারও ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

    রেজাভাই বারান্দা থেকে মুখ বাড়িয়ে আমাকে বললেন, ভেতরে কেউ নিশ্চয়ই আছে। মনে হয় ভয়ে সাড়া দিচ্ছে না। আমার মনে হয় কবি ভাইয়ের গলা শুনলে পরিচিত কেউ বাসায় থাকলে উঠে আসবেন। আপনি এসে ভাবিকে ডাকুন না।

    এ কথায় আমি যেই সিঁড়িতে পা দিয়েছি অমনি পাশের বাসার বাতি জ্বলে উঠল এবং দুয়ার খুলে আমার প্রতিবেশী খাদেম সাহেব বেরিয়ে এলেন। দরজায় এসে তার স্ত্রী ও কন্যা কৌতূহল ভরে দাঁড়িয়েছে। খাদেম সাহেবের মেয়েটি হঠাৎ আনন্দে চিৎকার করে উঠল, ওমা কবি চাচা এসেছেন। আমি গিয়ে পাঁচিলের ওপাশ দিয়ে দরজা খুলে দিচ্ছি। চাচি তো বিছানা ছেড়ে নামতে পারবে না।

    খাদেম সাহেব এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, আল্লাহ আপনাকে সুস্থদেহে ফিরিয়ে এনেছেন এজন্য হাজার শোকরগোজার করছি। যান, ভিতরে গিয়ে দেখুন কী অবস্থা। আপনার স্ত্রী তো দুদিন আগে গুরুতর অবস্থায় বাসায় ফিরেছেন। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা স্ট্রেচারে করে তাকে এখানে আমাদের তত্ত্বাবধানে রেখে গেছে। কোমর থেকে নিচের দিকটা একদম নাড়াতে পারছেন না। দু’রাত আমার স্ত্রীই তার সাথে থেকে তার দেখাশোনা করছেন। আজ তিনি নিজেই বললেন তিনি রাতটা একাই থাকতে পারবেন। আমার মেয়েটা থাকতে চেয়েছিল তাকেও থাকতে বারণ করলেন।

    ভদ্রলোকের কথা শেষ হওয়ার আগেই আমার বাসার ভেতরে আলো জ্বলে উঠল এবং কপাট খুলে দিল খাদেম সাহেবের মেয়েটি।

    আসুন, কবি চাচা, চাচিকে জাগিয়ে দিয়েছি।

    আমি ভেতরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেলাম। আমার ছোট তিন কামরার এই বাসায় যত আসবাব ও বইপত্র ছিল এর কিছুই নেই। বসার ঘরটা একেবারেই ফাঁকা।

    খাদেম সাহেব বললেন, এ পাড়ায় বেপরোয়া লুটতরাজ হয়েছে। আমরা গাঁয়ের বাড়িতে পালিয়ে গিয়েছিলাম। ষোল তারিখ ফিরে এসে দেখি আপনার, আমার আর পাড়ার পলাতক গৃহস্থদের কিছুই অবশিষ্ট নেই। এমনকি চৌকি, খাট, লেপতোষক, বালিশ, বাসন কোসন সবই লুট হয়ে গেছে কবি সাহেব। আপনার স্ত্রীকে যারা এখানে আমাদের জিম্মায় রেখে গেছে তারা কোত্থেকে যেন একটা জাজিম এনে ফ্লোরে পেতে তাকে শুইয়ে দিয়ে গেছে।

    একথা শুনে আমি দ্রুত গিয়ে শোয়ার ঘরে ঢুকলাম। আমার পেছনে রেজাভাই, নন্দিনী ও রেজাভাইয়ের তিনজন রাজনৈতিক সঙ্গী।

    ভেতরে ঢুকেই দেখলাম ফ্লোরে একটা খোলা জাজিমে বিছানো শাড়ির ওপর সটান শুয়ে আছে হামিদা। অসুস্থতার ধকলে শরীর খানিকটা শীর্ণ মনে হলেও বাহু উন্মুক্ত থাকায় স্বাস্থ্যের দীপ্তি একেবারে ম্লান হয় নি। তার বিশাল দুটিচোখ আমাকে দেখা মাত্রই পানিতে ভিজে গেল। মুখে ম্লান হাসিটি বজায় রেখেই বলল, কখন ঢাকায় এসে পৌঁছুলে?

    এই তো দুঘণ্টা আগে।

    আমার খোঁজ পেয়েছিল? এই আমার আহত হওয়ার খবর?

    হ্যাঁ, জেনেছিলাম।

    সে আসে নি?

    কার কথা বলছ, নন্দিনীর?

    আমি কিছু বলার আগেই পেছন থেকে নন্দিনী বলল, আমিও এসেছি বৌদি, তোমাকে একনজর দেখে জীবন ধন্য করতে এসেছি। আমাকে ক্ষমা করে দাও বৌদি। … বলেই নন্দিনী হুমড়ি খেয়ে জাজিমের পৈথানে হামিদার অনড় পা দুটিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল।

    হামিদা হাত বাড়িয়ে নন্দিনীর বেণীটা স্পর্শ করতে পারল মাত্র। নন্দিনীর কান্না এই স্নেহপর্শে দ্বিগুণতর বেগে ফুলে উঠছে দেখে হামিদা বলল, বিশ্বাস কর বোন আমি তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম।

    এ কথায় নন্দিনীর কান্না সহসা থেমে গেল। সে উত্তেজিত কণ্ঠে বলতে লাগল, আমার অপেক্ষা? জানি কিসের অপেক্ষা। কবি আমাকে বলেছে তুমি নাকি বলেছ আমি এলে তুমি কবিকে ছেড়ে চলে যাবে। আমার মতো একজন পাপী মেয়ের লোভের কাছে পরাজিত হয়ে তুমি তোমার সংসার ছেড়ে চলে যাবে বৌদি? তুমি না একজন বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধা? আমার মতো পাপীকে, লোভীকে এক্ষুণি গুলী করে মেরে ফেলতে পার না বৌদি? তোমার পকেটে তো শুনেছি সব সময় একটা পিস্তল থাকতো। আমাকে মেরে ফেল বৌদি, আমাকে শেষ করে দাও।

    নন্দিনী শিশুর মতো বিলাপ করতে করতে হামিদার পায়ের তালুতে মুখ ঘষতে লাগল। এ অবস্থায় আমি দেখলাম হামিদা যেন উঠে বসতে চাইছে কিন্তু পেরে উঠছে না। আমি দ্রুত এগিয়ে গিয়ে তার পিঠের নিচে আস্তে চাপ দিলাম। আমার দেখাদেখি রেজাভাইও হামিদার সাহায্যে এগিয়ে এসে তাকে আস্তে করে পিঠে হাতের ঠেলা রেখে বসতে সাহায্য করলেন। হামিদা বসেই নন্দিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরল।

    আমি তোমাকে এবং কবিকে রেখে চলে যাওয়ার কথা যুদ্ধের দিনগুলোতে একবার ভেবেছিলাম নন্দিনী। তখন আমি সুস্থ ও সক্ষম ছিলাম। আমার একজন সতীন থাকবে। এটা ছিল আমার কাছে একদম অসম্ভব ব্যাপার। আমি এখন আর একজন নারী হিসেব সক্ষম নই। আমার স্বামীর যোগ্যও নই। যে কারণে একজন নারী অন্য নারীর আওতায় তার পুরুষকে এক মুহূর্তের জন্য ছাড়তে চায় না, আমার সেই সম্পদ, নন্দিনী, বোন আমার, আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তা খুইয়ে ফেলেছি। আর তা কোনো দিন ফিরে পাব না। আমাকে আর কবিকে ফেলে তুই কোথাও যাস না নন্দিনী। আজ থেকে এ সংসার তোর। আমি পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা, নিরাশ্রয় মানুষ। তোর কবির কোনো কাজে লাগব না। তবে কবিকে ছেড়ে কোথাও যেতেও পারব না কারণ তোর মতো আমারও এ সংসারে আপন বলতে কেউ নেই। কোথায় যাব? রাষ্ট্র হয়তো পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার দায়িত্ব নিতে রাজি হবে। কেন হবে না? কিন্তু আমি তোদের সাথেই থাকতে চাই নন্দিনী। তোদের প্রেম ভালবাসা সন্তান সন্ততি দেখে সুখ পেতে চাই।

    নন্দিনী আর থাকতে পারল না হাত দিয়ে হামিদার মুখ বন্ধ করতে গিয়ে বলল, আর বলো না দিদি, তোমার দুঃখ আমি আর সইতে পারছি না। তোমার তো যাওয়ার প্রশ্নই আসে না বরং তুমি দয়া করে তোমার সেবার সুযোগ দিলে আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সেবা করে জীবন কাটিয়ে দেব। ভাবব, আমার সীমাদি শত্রুর গুলীতে পঙ্গু হয়ে আমার ঘরে আছে। কবির কাছে নিশ্চয়ই শুনেছ আমার হতভাগিনী দিদির কথা? আজ থেকে তুমিই আমার সেই দিদি। বলেই নন্দিনী হামিদাকে আকড়ে ধরে কাঁদতে লাগল। এ অবস্থায় হামিদার পিঠের নিচে থেকে হাতের ঠেকনা ছেড়ে দিয়ে আমি রেজা ভাইয়ের দিকে তাকালে রেজা ভাই হাসলেন, আমরা তা হলে আসি কবি সাহেব। পরে কোথাও না কোথাও আপনার সাথে দেখা হয়ে যাবে। ঠিকানা রেখে যেতে পারব না। জানেনই তো আসলে আমাদের কোনো ঠিকানা নেই। আমরা এই বিশাল উপমহাদেশের সর্বত্রই আছি। আপনি তো আমাদের দেখেছেন। বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে যেমন দেখেছেন, তেমনি দেখেছেন আসামে, মেঘালয়ে, আগরতলায় আর পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র। আমাদের যুদ্ধটা কার সাথে তা আপনার জানা। আমি ভাবতাম দ্বান্দ্বিক নিয়মেই সবকিছুর সমাধান সম্ভব। কিন্তু আজ এ মুহূর্তে সামাজিক একটি সমস্যার সমাধান দেখলাম। এটা যে কোনো বস্তুতান্ত্রিক দ্বান্দ্বিক সমাধান নয় তা মানতে আমি বাধ্য। আমি তাহলে আসি কবি ভাই।

    ⤶
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআলীবর্দী ও তার সময় – কালিকিঙ্কর দত্ত
    Next Article উড়ালকাব্য – আল মাহমুদ

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }