Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    উপমহাদেশ – আল মাহমুদ

    লেখক এক পাতা গল্প320 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৫. মার্কেট থেকে ফিরে এসে

    মার্কেট থেকে ফিরে এসে দেখি সিঁড়িতে ভিড়। ওপর তলার বাসিন্দারা ঠিক সাড়ে আটটায় ডাইনিং হলের দিকে যাচ্ছে। সকলেই বিদেশী এবং সাদা চামড়া। নেটিভ যে দুএকজন নামছেন তারাও অবাঙালি। কেউ কেউ আমাদের নতুন আগন্তুক ভেবে গুড নাইট বলে সৌজন্যও দেখাচ্ছেন। ইমামও সৌজন্য বিনিময় করে আমাদের নিয়ে তাড়াতাড়ি ওপরে ওঠে এল। তেতলায় আমাদের ঘরগুলো। বারান্দায় পৌঁছে দেখি আমাদের ঘরগুলো যথারীতি বন্ধ। বাজার থেকে সদ্য আনা প্যাকেটগুলো সবই পারুল বগলদাবা করে গাড়ি থেকে নামিয়েছে। আমি সাহায্য করতে চাইলে ও না করল। বলল, পারব। আপনি ওপরে যান আমি আপনাদের পেছনেই থাকছি। ইমাম তালা খুলে দিলে পারুল ও মিতুসহ ইমাম তাদের ঘরে ঢুকল। আমি আমার কামরায় ঢুকে দেখি ঘরে বাতি জ্বলছে। আলোর মধ্যে স্যুটকেস ও মালামালগুলোর ওপর চোখ পড়ল। সবি আছে, নেই শুধু সেই হ্যান্ডব্যাগটা। আমি দ্রুত দরজা খোলা রেখেই এলাম। মিতু ও নন্দিনীর ঘরটা ভেতর থেকে বন্ধ। নন্দিনী হয়তো এঘরে ব্যাগটা এনে খোলার জন্য ধস্তাধস্তি করছে। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো শব্দ নেই দেখে আমি কলিং বেলটা টিপলাম। দেরি করেই নন্দিনী খুলে দিল, তোমরা এসেছ?

    এইমাত্র এলাম। এরা সব এদের ঘরে গেছে। ভেতরে যাবো?

    আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে নন্দিনী দুয়ার থেকে পিছিয়ে গিয়ে আমাকে তাদের কামরায় ঢুকবার পথ ছেড়ে দিল। আমি ভেতরে ঢুকেই জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের ব্যাগটা?

    আছে। এঘরের খাটের নিচে।

    খুলতে পেরেছিলে?

    কেন পারব না? তোমার বোনের একটা ঝোলা থেকে বিশাল কাঁচি পেয়ে তালাগুলো খুলেছি।

    কি পেলে?

    আমি অতি উৎসাহে উৎসুক হয়ে নন্দিনীর মুখের কাছে নুয়ে পড়লাম।

    ভয়াবহ কিছু নয়। বই আর কিছু মূল্যবান কাগজপত্র।

    হেসে বলল নন্দিনী।

    আমি বললাম, আমি তো আগেই বলেছিলাম লোকটা মিথ্যে বলে নি। আসলে কেন যে ওকে গোহাটিতে প্লেনে উঠতে দিল না সিকিউরিটি গার্ডরা আল্লাহ মালুম। চলো পারুলদের নিয়ে ডাইনিং হলে যাই। মার্কেট ঘুরে খিদে পেয়েছে।

    নন্দিনী বলল, তুমি যাও, আমি এক্ষুণি আসছি। হাতমুখ একটু পানি ছিটা দিয়ে আসি। তার কথা শেষ হবার আগেই মিতুর আব্বা-আম্মা ও মিতু এসে এ কামরায় ঢুকল। পারুল বলল, আপা একা একা ভয় পান নি তো?

    ভয়ের তো কিছু দেখি নি, শুধু শুধু ভয় পাব কেন? আমি বিছানায় শুয়ে আজকের ইংরেজি খবরের কাগজ দেখছিলাম। আপনারা বোধহয় আমার জন্যই একটু তাড়াতাড়ি বাজার শেষ করলেন। আসুন।

    নন্দিনীর কথায় পারুল বলল, হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। আপনাকে একা ফেলে গিয়ে একটু চিন্তিতই ছিলাম। অচেনা হোটেল। আবার না কেউ এসে আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করে। আপনিও তো একেবারেই এ শহরে নতুন। নাকি আগেও এসেছেন?

    এক্কেবারেই নতুন না এলেও, কলকাতা শহরের সাহেবপাড়ায় একবারও আসি নি। যদিও ছোটোবেলায় এশহরেই দিদির সাথে দুবার এসেছি। ভবানীপুরে আমার পিসিদের বাসা ছিল। এখন এরা কোথায় থাকেন জানি না। ভবানীপুরের স্মৃতি এখনও খানিকটা মনে আছে। ফ্রক ছেড়ে তখনও শাড়ি ধরি নি।

    বলল নন্দিনী।

    শাড়ির কথায় পারুল হাতের প্যাকেট দুটো এগিয়ে দিয়ে বলল, এই নিন আপনার শাড়িজোড়া। দুটোই কিন্তু অল্পদামে কেনা।

    খুব ভালো হয়েছে।

    প্যাকেট না খুলেই ভালো বলছেন? খুলেই দেখুন না।

    দেখতে হবে না। আপনার শাড়ি পরাইতো আছে। আপনার রুচি কেমন বুঝতে পারি। দিন রেখে দিচ্ছি, পরে পরব।

    পারুলের হাত থেকে শাড়ির প্যাকেট নিয়ে নন্দিনী তার বিছানায় রাখল।

    পারুল আমার দিকে ফিরে বলল, কবি ভাই চলুন রাতের খাওয়া নিচে থেকে সেরে আসি। আপনার কাপড় জামার প্যাকেটগুলো আমাদের কামরা থেকে নিয়ে নেবেন।

    আমি বললাম, চল খেয়ে আসি।

    .

    খাওয়ার পর আমি সোজা ওপরে এসে আমার কামরায় বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। উডস্ট্রীটে গাড়ি চলাচলের আওয়াজ তেমন না থাকলেও অদূরে পার্কস্ট্রীট এলাকা, চৌরঙ্গীর আশপাশ এলাকা এবং রাস্তা থেকে গাড়ির শব্দ পাচ্ছি। বহুদিন পর কলকাতায় এসেছি। আজ নিউ মার্কেটে গিয়ে এল. রহমানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কত কথা মনে পড়ল। মুরুব্বীদের কাছে শুনেছি এ দোকান থেকেই দেশ বিভাগের আগে আমাদের বাড়ির সকলের ঈদের জামা-কাপড় কেনা হত। দোকানটা নাকি ছিল আমার এক দাদার। দেশ বিভাগের পর হাতবদল হয়ে যায়।

    যখনই কলকাতায় আসি নিউ মার্কেটে কেনাকাটার দরকার হলে আমি এল. রহমানে আসি। একবার নিজের পরিচয় দেওয়াতে এক মাড়ওয়াড়ি ভদ্রলোক খুব খাতির যত্ন করেছিলেন। বলেছিলেন, হামার ক্যায়সা খুব নসীব, আপ আব্দুল ওহাব মীরকা ওয়ালিদ, চায়ে পিজিয়ে।

    সেবার কাপড়ের দাম অর্ধেক কমিয়ে রেখেছিল। আজ অবশ্য ঐসব লোককে দেখি নি। তবে আজও কাপড়চোপড় কেনার ব্যাপারে আমরা খাতির পেলাম। খাতিরটা জয়বাংলার লোক বলে।

    ঘুম পাচ্ছিল না। বিছানা থেকে উঠে একটা সিগ্রেট ধরিয়ে পশ্চিম দিকের জানালার পর্দা সরিয়ে দিলাম। বাইরে দেখা যায় উডস্ট্রীটের সাথে অন্য একটা ছোটো রাস্তার সংযোগস্থল। কারো বাড়ির বাঁধানো চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা ঝাউগাছের ওপর ভাঙা চাঁদ। আমি জানালার কাঁচের পাল্লা দুটো না খুলেই রাতের কলকাতার একটা দৃশ্য দেখছি। আর মনে মনে ভাবছি হ্যান্ডব্যাগটা নিয়ে নন্দিনীর মানসিক উদ্বেগটা এখন নিশ্চয়ই হালকা হয়েছে। নন্দিনী কী এখন ঘুমিয়ে পড়েছে? কলকাতায় আসার পর নন্দিনীর মানসিক বল অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে তা আমি উপলদ্ধি করছিলাম। আজি অবশ্য তার মুখে একটা নতুন কথাও শুনলাম! কথাটা, এর আগেও নন্দিনীরা তাদের কৈশোরে আমার মতই কলকাতায় এসেছে। এ শহর তার কাছেও একেবারেই অপরিচিত শহর নয়। তাছাড়া এ শহরে নন্দিনীর পিসি বা ফুপুর মতো নিকটাত্মীয়রাও বাস করেন। নন্দিনী কী তার আত্মীয়স্বজনদের খোঁজ করবে না? কেন করবে না? নিশ্চয়ই করবে। শুধু আমি ও আমি যাদের সঙ্গে এসেছি অর্থাৎ আমার বোনের পরিবারই এখানে শিকড়হীন। আপন বলতে এখানে আমাদের কেউ নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমার কর্তব্য হল পাকিস্তানী ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে আপ্রাণ লড়াই করা। আর লেখক হিসেবে আমার যুদ্ধের ধরনটা একটু আলাদা হবেই। এখন আমিও সর্বাত্মক হিংস্রতাকেই জীবনের মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করতে দ্বিধান্বিত নই। কিন্তু দেশত্যাগ করে এ আমি কোথায় এসেছি? আমার মনে কেন কবিতার একটি স্ফুলিঙ্গও জ্বলছে না? ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা কী শেষ পর্যন্ত অর্জিত হবে? নাকি আমরা তপ্ত কড়াই থেকে প্রজ্বলিত অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছি?

    আবার মনে হল আমরা একটা সশস্ত্র লড়াইয়ে লিপ্ত। এ অবস্থায় ভবিষ্যৎ চিন্তা প্রকৃত মুক্তিযোদ্বার কোনো কাজে লাগে না। প্রবলের সংহার-যজ্ঞে নিরুপায়ের সহায় হল অন্য শত্রুর সহানুভূতি জাগিযে তুলতে পারা। আগামীকাল সকালেই আমাকে যেতে হবে। সেইসব সংবাদপত্রের অফিসে যেখানে আমার পরিচিত লেখক ও কবিরা আছেন। যেখানে আমার পরিচয় দিলে একেবারে অবহেলায় উড়িয়ে দেওয়া হয়ত সম্ভব হবে না। অন্তত লিখেটিখে সামান্য রোজগারের একটা ব্যবস্থা করে নিতে হবে। আনন্দ বাজারে শক্তি ও সুনীল আছেন। মধ্য পাশে আমি যখন এদের সম্পাদিত কৃত্তিবাস বা অন্যান্য লিটল ম্যাগাজিনে লেখা শুরু করি, এদের সাথে নিয়মিত চিঠিপত্র আদানপ্রদান হত। এরা নিশ্চয়ই হাদী মীরকে ভুলে যায় নি। আর আমি তো একেবারে নিঃসহায় হয়ে এখানে আসিনি। আমার বোন ও ভগ্নিপতির আশ্রয়ে আমি মোটামুটি ভালই থাকব। কিন্তু এরা কেন নন্দিনীসহ আমাকে আশ্রয় দেবে? আর দিলেই আমি কোনমুখে একটি বাড়তি মানুষকে এদের ওপর চাপিয়ে নিশ্চিন্তে কাল কাটাতে পারি?

    চাঁদটা এখন তার আধখানা শরীর নিয়ে ঝাউবীথির ওপর স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ঘোলাটে জ্যোছনায় এখান থেকেই রাস্তাটা বেশ পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি। লোক চলাচল না থাকলেও দুএকটা প্রাইভেট গাড়ি নিঃশব্দে চলাফেরা করছে। আমি বাতি নিভিয়ে বিছানায় এসে বসলাম। বেশ কিছুনি পরে একটা কামরায় একা ঘুমোবার সুযোগ পেয়েছি। আমি প্যান্টশার্ট খুলে ইমামের দেওয়া একটা লুঙ্গি পরে শুয়ে পড়লাম। যদিও আজই বাজার থেকে আমার জন্য কাপড়-জামা এবং লুঙ্গি ইত্যাদি কেনা হয়েছে, সেসব রয়েছে ইমামের ঘরে। অন্যান্য কাপড়ের সাথে প্যাকেট করা। কাল একটা নতুন জামা পরে রাস্তায় বেরুনো যাবে।

    নন্দিনী নিশ্চয়ই এখন মিতুর সাথে ঘুমোচ্ছে। দুশ্চিন্তায় ও ক্লান্তিতে এমনিতেই বেচারীর যা অবস্থা তার ওপর অন্যের বোঝা হয়ে থাকার সংকোচও সে ছাড়াতে পারছে না। নন্দিনী নিশ্চয়ই তার পিসিকে খুঁজে বের করবে। আমিও তাকে সাহায্য করব। নন্দিনী কী তার স্বজনদের পেলে এই কদিনের দুঃখের কথা মনে রাখবে? মনে রাখবে আমি তার সাথে ছিলাম?

    এসময় দরজার ওপর কলিং বেলের একটা ছোট্ট আওয়াজ হল। উঠে কপাট একটু ফাঁক করতেই দেখি নন্দিনী।

    ঘুমাও নি?

    এখনও শুই নি।

    ভেতরে এসো। আমি দরজার একপাশে সরে গেলাম।

    মিতু জেগে নেই?

    মিতু আমার ঘরে আসেই নি। তার মা তাকে তাদের সাথেই থাকবে বলে খাওয়ার টেবিলেই আমাকে বলে ছিল।

    তাহলে এরা আমাদের দুজনের জন্য দুটো ঘরই ছেড়ে দিয়েছে।

    একটু বিব্রত গলায় বললাম আমি।

    আমার কিন্তু লজ্জা করছে। এ অবস্থায় আমাদের অন্যত্র ব্যবস্থা করা উচিত। বলল নন্দিনী।

    আমি বললাম, তুমি কী তোমার পিসির কথা ভাবছ?

    না। পিসির বাড়ি খুঁজে বের করতে পারলেও পিসি আমার আসার সব কথা জানলে আমাকে আশ্রয় দেবে না। সমাজ, বিশেষ করে আমাদের সমাজে আমার কোনো ঠাঁই হবে না। এটা আমি ভালো করেই জানি। আমি অন্য আশ্রয়ের কথা বলছি।

    অন্য আশ্রয়?

    হ্যাঁ, আমাদের দুজনের জন্য একটা বাসা।

    খুব স্পষ্ট গলায় কথা বলছে নন্দিনী।

    আমি হেসে বললাম, তুমি পাগল হয়েছ।

    পাগলের কী দেখলে?

    পাগল না তো কি? কলকাতায় কে আমাদের জন্য বাসা দেবে? আবার আমরা টাকাই বা পাব কোথায়?

    টাকা কোনো সমস্যা হবে না। আমরা এখন কয়েক লক্ষ টাকার মালিক। আসল সমস্যা হল কলকাতায় একটা বাসাবাড়ি খুঁজে পাওয়া। তোমার সাথে কাল সকালে আমিও বেরুব।

    নন্দিনীর কথায় হতভম্ভ হয়ে আমি অন্ধকারে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকলাম।

    আমার অবস্থা বুঝে নন্দিনী পেছনের দুয়ারটা ভেজিয়ে দিয়ে বলল, চল বিছানায় বসে তোমাকে সবকথা খুলে বলি। তোমার আপত্তি না থাকলে আমরা বিছানায় শুয়েও আলাপ করতে পারি।

    আমি বললাম, তুমি বরং শোও। আমি পাশের চেয়ারটায় বসে শুনছি। আমরা লাখ টাকার মালিক এ কথার মানে কি? তুমি কী ব্যাগটায় কোনো টাকাকড়ি পেয়েছো?

    আমার কথার জবাব না দিয়ে নন্দিনী সহসা গিয়ে আমার বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। জানালার ঘোলাটে চাঁদের আলোয়ই তার রহস্যময় মৃদু হাসি আমি খানিকটা দেখতে পেলাম।

    ব্যাগটায় কত টাকা আছে নন্দিনী?

    তিন লাখ।

    নন্দিনীর কথার চমকে গিয়ে বললাম, বল কী নন্দিনী এত টাকা? সব কী পাকিস্তানী নোট?

    সবই ভারতীয় পাঁচশত টাকার নোট। তোমাকে কারেন্সি চেঞ্জ করার কষ্টও পোহাতে হবে না। বাসা চাই। হাদী, আমরা সংসার পাতব। আমরা এদেশেই থাকব। তুমি আমাকে নিয়ে কবিতা লিখবে। আমার দুঃখ ভুলিয়ে দেবে। আমাকে ফেলে কোথাও যাবে না।

    এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে আমার হাত টেনে দরে নন্দিনী চকিতে বিছানায় উঠে বসল। অপ্রকৃতিস্থ গলায় অত্যন্ত মিনতি মিশিয়ে বলল, বল, আমাকে ফেলে কোথাও যাবে না?

    আমিতো বলেছি নন্দিনী এ লড়াইয়ের সময়, তোমাকে নিঃসঙ্গ ফেলে আমি কোথাও যাবো না।

    আমি গভীর আশ্বাস বাণী উচ্চারণের মতো কথাগুলো বললাম। পর মুহূর্তেই জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাগটায় কী শুধু তিন লাখ টাকার কারেন্সি নোটই পেলে? ব্যাগটাতো খুব ভারী আর টানটান ছিল?

    রাজনৈতিক লিফলেট আর বইয়ে ভর্তি ছিল। নকশালদের লিটারেচার। বলল নন্দিনী। আমি বললাম, টাকাগুলো কী গুণে দেখেছ?

    দেখার দরকার হয় নি। টাকার বান্ডিলগুলোর মধ্যে একটা চিঠি আছে। চিঠিতে এটাকা ও বইগুলো বাংলাদেশের দর্শনায় একটা কাস্টম কলোনীর ঠিকানায় এক ছাত্রীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার ইঙ্গিত আছে। গোহাটিতে লোকটা সেই কাজ করতে গিয়েই ধরা পড়ে গেছে। কিন্তু ব্যাগটা আমরা নিয়ে এসেছি। চিঠিতে কে এক আলীকে বলা হয়েছে। এ টাকায় অস্ত্র সংগ্রহ করে অপারেশন চালিয়ে যেতে। বান্ডিলে সর্বমোট তিন লক্ষ টাকা আছে-একথা চিঠিতেই আছে। চিঠিতে স্বাক্ষরকারী কে এক দাশগুপ্ত। স্বাক্ষরটা অবশ্য ইংরেজিতে।

    আমার হাত ধরে নন্দিনী যেন রূপকথা বলে যাচ্ছে। আমি বললাম, ব্যাগ ও ঘরে নিয়ে রেখেছ কেন এক্ষুণি এখানে নিয়ে এস।

    নন্দিনী এবার মুচকি হেসে বলল, ভেবো না। টাকা কেউ নিতে পারবে না। দুয়ারে চাবি দিয়ে এসেছি। এত টাকা নিয়ে ঘুমোতে আমার ভয় করে বলেই আমি দুয়ার লক করে এখানে চলে এসেছি। এখন তুমি চেয়ারে বসে রাত কাটালেও আমি এ ঘর ছেড়ে যাব না।

    আমি বললাম, ঠিক আছে। তুমি দুটো বালিশের একটি আমাকে দাও। আর পায়ের নিচের বেডকভারটাও আমাকে দাও। আমি নিচে পেতে শুয়ে পড়ি। এখন আর কিছু ভাবতে পারছি না। কাল সকালে যাহোক ভেবে চিন্তে একটা কিছু করা যাবে। সকালে পারুলরা জাগবার আগেই তোমাকে এ ঘর ছাড়তে হবে। এখন শুয়ে পড়, আর কথা নয়।

    আমার কথা শুনে নন্দিনী বালিশে মাথা রেখেই স্তদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। আমি বিব্রত হয়ে বললাম, তুমি রাগ করলে?

    নন্দিনী কোনো জবাব না দিয়ে হঠাৎ বিছানায় উঠে বসল। কতক্ষণ মাথা নিচু করে নখ খুটতে লাগল। তারপর হঠাৎ বিছানা ছেড়ে নামতে গিয়ে আমাকে একটু ঠেলে সরিয়ে খাটের নিচে রাখা স্যান্ডেল পরতে পরতে বলল, তুমি শোও। আমি বরং ও ঘরেই গিয়েই শোব।

    নন্দিনী যেতে উদ্যত হলে আমি তার শাড়ির আঁচল ধরে ফেললাম, কথা শোনো নন্দিনী।

    আমাকে যেতে দাও।

    তুমি রাগ করে যাচ্ছ।

    তুমি যদি এখন অসভ্যের মতো টানাটানি কর আমি চেঁচিয়ে লোক জড়ো করব।

    নন্দিনীর হঠাৎ এমন ক্ষেপে যাওয়াতে আমি ভয় পেয়ে তার আঁচলটা ছেড়ে দিয়ে মিনতি মেশানো গলায় বললাম, ঠিক আছে আমি ছেড়ে দিলাম। অন্তত আমার একটা কথা তো শুনে যাবে?

    বল।

    নন্দিনী আঁচল তুলে তার একটা বাহু ঢাকল।

    আমি তোমাকে সম্মান করি নন্দিনী। তোমার সম্ভ্রম রক্ষা করা কী আমার কর্তব্য নয়?

    এ কর্তব্য তো বেশ কিছুদিন পালন করে এসেছ। সম্মান সম্ভ্রম আমার কতটুকু অবশিষ্ট আছে তা তুমি ভাল করেই জান। আমি চাই নিশ্চয়তা। তোমার ভালবাসা, নির্ভরতা। এ নির্ভরতা না পেলে আমি তোমার আর তোমার বোনের বোঝা হয়ে থাকব না। কেন থাকব?

    তার জবাবে একটা অবজ্ঞার সুর বেজে ওঠায় আমি কতক্ষণ চুপ করে নন্দিনীর দিকে চেয়ে রইলাম। এ এক সম্পূর্ণ অচেনা নারী। যেন এ কয়দিনের আমাদের রক্তাক্ত পথের অভিযাত্রী সেই অসহায় মেয়েটি নয়।

    আমি বললাম, হঠাৎ তুমি অনেক টাকার মালিক হয়ে গেছ নন্দিনী। আমার বোনের বোঝা হয়ে থাকার তোমার আর বোধহয় দরকারই হবে না। আর আমি নিজেই অন্যের বোঝা। তোমার বোঝা বইবার শক্তি কোথায়? তবুও তোমার বোঝা বইবার একটা প্রতিশ্রুতি তুমি কী আমার কাছ থেকে আদায় কর নি?

    হ্যাঁ করেছি। তুমি আমাকে ভালবাসার কথা বলেছিলে বলেই আমি তোমাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছি। আর টাকার কথা তুলছ কেন? টাকাটা তো একটা দৈব ব্যাপার। যদি তুমি আমাকে কোনো ভালবাসার নির্ভরতা না দাও তবে টাকার স্যুটকেসটা তোমার কাছেই রেখে যাব। মালিককে পেলে তাকে ফেরত দিও। না পেলে আমাকে বিপদে রক্ষা করার প্রতিদান ভেবে খরচ করে ফেলো।

    বলেই নন্দিনী এগিয়ে গিয়ে দরজার ছিটকিনিটা শব্দ করে খুলে ফেলল। আমি লাফ দিয়ে নন্দিনীর হাত ধরে ফেললাম, আমার কথা শেষ হয় নি নন্দিনী।

    ফাঁক হয়ে যাওয়া ছিটকিনিটা তুলে দিয়ে নন্দিনী ফিরে দাঁড়াল, বল, কী বলবে?

    আমি তোমাকে ভালবাসি নন্দিনী। তবুও আমি বিবাহিত। আমার স্ত্রী আছে। সে কোথায় কীভাবে আছে তা জানি না এবং খোঁজও নিচ্ছি না। প্রেম, ভালবাসা, কর্তব্যবোধ, অপরাধবোধ এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা আমার বুকের পাঁজর ধরে টানাটানি করছে। এ অবস্থায় আমার মানসিক টেনশনের কথা কী তুমি একটুও বিবেচনা করতে পারো না?

    আমার কথার কোনো জবাব না দিয়ে নন্দিনী হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আবার আমার বিছানার কাছে এগিয়ে গেল। সেখান থেকে একটা বালিশ ও বেড কভার তুলে নিয়ে। মেঝের ওপর ছড়িয়ে বিছানা পাততে লাগল। আমিও তাড়াতাড়ি গিয়ে হাত ধরে ফেললাম, আমরা দুজন এস একসাথেই থাকব নন্দিনী। আমার দ্বিধাকে মাফ করে দাও।

    আমার কথায় একটু নির্ভরতার আশ্বাস পেয়ে নন্দিনী ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আমি তাকে বুকের কাছে টেনে এনে কপালে চুম্বন করলাম। এবার নন্দিনী বেশ শব্দ করে কাঁদতে শুরু করায় আমি তাকে থামাবার জন্য বললাম, বাইরে দারোয়ানেরা শুনতে পাবে। চলো উপরে গিয়ে শুই।

    আমি নন্দিনীকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিলে সে সহসা গিয়ে আমার বিছানায় শুয়ে ফোঁপাতে লাগল। আমি দ্রুত হাতে মেঝে থেকে বালিশ ও চাদরটা তুলে নিয়ে বাতি নিভিয়ে দিলাম।

    .

    সকালে দরজায় করা নাড়ার শব্দে জেগে দেখি বেলা অনেক। নন্দিনী নেই। কব্জি উল্টে ঘড়িতে দেখি বেলা সাড়ে আটটা। দরজার ছিটকিনি খোলা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কে?

    দরজা ঠেলে ইমাম এসে ঘরে ঢুকল।

    কী ব্যাপার দরজা খোলা রেখেই ঘুমোচ্ছেন?

    আমি বললাম, কী জানি ভুলে হয়ত দুয়ারটায় ছিটকিনি না লাগিয়েই শুয়ে পড়েছিলাম।

    আমার কথায় ইমাম হেসে বলল, একেই বলে কবি।

    আমি হেসে দ্রুত বিছানা ছেড়ে নামলাম।

    হাত মুখ ধুয়ে নাস্তার জন্যে তৈরি হয়ে আসুন।

    আপনার সঙ্গিনী তো অনেক আগেই জেগেছেন। আমাদেরও জাগিয়েছেন।

    আমি বললাম, নন্দিনী?

    হ্যাঁ। আমাদের ঘরে খবরের কাগজ দেখছেন। আপনাকে এই মুহূর্তে একটা আগাম দুঃসংবাদ দিয়ে রাখি।

    আমি বললাম, সে আবার কি?

    লেখক তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় মারা গেছেন।

    ইমাম গম্ভীর গলায় দুঃসংবাদটি শোনাল।

    আমি কতক্ষণ হতবাক হয়ে থেকে বললাম, বাংলা ভাষার সত্যই মস্তবড় অনিষ্ট হল।

    ইমাম বলল, আপনি টয়লেট থেকে এসে কাগজ দেখুন। আজকের কাগজেই বিস্তারিত বর্ণনা ছাপা হয়েছে। ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা একটা পাওয়ার হাউজ উড়িয়ে দিয়েছে। আর আখাউড়ায় চলছে মুখোমুখি লড়াই। মনে হচ্ছে, একটা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে।

    আমি খুশি হয়ে বললাম, আল্লার শোকর আদায় করুন।

    আলহামদুলিল্লাহ।

    তারাশঙ্করের মৃত্যু সংবাদ সত্ত্বেও ইমামের আনন্দ প্রকাশের কারণ যে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্য তা বুঝতে পারলাম।

    আপনি ঘরে যান। আমি এক্ষুণি তৈরি হয়ে আসছি।

    আসুন। একবারে নিচে চলে আসবেন। আমরা ডাইনিং হলে আপনার জন্য অপেক্ষা করব।

    বলে ইমাম দরজার ভেজিয়ে দিয়ে চলে গেল।

    .

    আমি নাস্তার টেবিলে কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে হাজির হলাম। নন্দিনী পট থেকে ছুরির আগায় মাখন তুলে রুটিতে মাখাতে মাখাতে একবার আমার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল। তার মুখ লাজরক্তে রক্তিম। যদিও নন্দিনী স্নান সেরে স্নিগ্ধ হয়ে নতুন শাড়ি পরে এসেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে বহুদিন পরে একটু পরিপাটি হওয়ার চেষ্টা করছে। আমি টেবিলে যোগ দেওয়া মাত্র সে মাখন মাখানো রটির। স্নাইসগুলো আমার প্লেটে তুলে দিতে লাগল। নন্দিনীর এই পরিবেশনটা পারুল আড়চোখে লক্ষ্য করছে আমি বুঝতে পারলাম। আমি আমার বোনের দিকে মুখ তুলতেই সে একট কায়দা করে হাসল, ভাইয়ের বোধহয় ভাবির চিন্তায় রাতে ভালো ঘুম হয় নি।

    আমি পারুলের কথায় হাসলাম, শুধু ভাবি না, নানা দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম আসতে চায় না।

    দিদি গতরাতে ভালোই ঘুমিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে।

    পারুলের কথায় যে একটা শ্লেষের আভাস থাকতে পারে তা ছিল আমার ধারণার বাইরে।

    নন্দিনীর হাত সহসা থেমে গেল। ছুরির ডগা থেকে অবশিষ্ট মাখনটুকু আমার প্লেটে রাখা একটা স্লাইসে মুছে নন্দিনী আস্তে করে ছুরিটা তার সামনের প্লেটে রাখল।

    পারুল অদ্ভুত এক ধরনের মেয়েলী হাসি হেসে নন্দিনীকে উদ্দেশ্য করে বলল, যাই ভাবেন, দিদিকে কিন্তু কমদামের শাড়িতেও দারুণ লাগে। ঠিক বলি নি দিদি?

    নন্দিনী সম্ভবত আর ধৈর্য রাখতে পারল না, ঠিকই বলেছেন। যেটুকু সামনা সামনি দেখছেন তাতে এর চেয়ে ঠিক আর কী বলবেন? তবে যেটুকু আন্দাজ করে কষ্ট পাচ্ছেন সে সন্দেহ আমি এক্ষুণি দূর করে দিচ্ছি। কাল রাত একাকী ঘরে ভয়ে ঘুম হবেনা ভেবে আপনার ভাইকে কাকুতি-মিনতি করে রাজি করিয়ে তার ঘরে তার খাটে গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছি। বেশ ভালো ঘুম হয়েছে। কোনো দুঃস্বপ্ন দেখি নি। ঘুমে কী আর দুঃস্বপ্ন দেখব? আপনাকে বলা হয় নি, আমি হানাদারদের দ্বারা লাঞ্জিতাদেরই একজন। আপনার ভাই কবি, একজন যুক্তিসংগ্রামীও। এমন মানুষের বিছানার বা পাশটায় ক্ষণকালের জন্যে আশ্রয় পেলেও জীবন সার্থক হয়। আমি এ লোভ ছাড়তে পারছি না। ছেড়ে কোথায় যাব? প্রকৃতপক্ষে আমার যাবার কোনো জায়গা নেই দিদি। একটা যুদ্ধের সময় যে যেখানে পারে আশ্রয় নিয়ে মাটি কামড়ে ধরছে। কোনটা ভারত কোনটা পাকিস্তান এখন আর সেটা ভেবে দেখার সময় পাচ্ছে না। আমি এই মুহূর্তে বেঁচে থাকতে পারছি এটাই আমার যুক্তি। আমি যদি উটকো দখলদার হয়ে থাকি তবে প্রকৃত মালিক এলে আমাকে উচ্ছেদের নোটিশ দিয়ে দেবেন। আমি আপত্তি করব না। এখন থেকে আশা করি সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখবেন না। সবই খুলে বললাম। ভেবে দেখুন, আমি ওপরে যাই।

    মুহূর্তের মধ্যে কথাগুলো বলে নন্দিনী চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল। আমি কী করব বুঝতে পারছিলাম না। পারুলও নন্দিনীর এ ধরনের কথাবার্তায় অপ্রস্তুত হয়ে একেবারে কাঠ হয়ে ইমামের দিকে তাকিয়ে রইল। ইমাম সহসা দাঁড়িয়ে নন্দিনীকে বলল, আমার স্ত্রীর আচরণে আমি অত্যন্ত লজ্জিত। আপনি দয়া করে একটু বসে আমার কথাগুলো শুনবেন।

    নন্দিনী বসল।

    আমি আমার চাবিটা মিতুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, যাও তো মা তুমি ওপরে চলে যাও।

    মিতু চাবিটা হাতে নিয়ে এক রকম দৌড়েই ওপরে চলে গেল। মিতু ওপরের সিঁড়ির শেষ ধাপে না পৌঁছা পর্যন্ত ইমাম সেদিকে চেয়ে রইল। পরে সহসা নন্দিনীর দিকে ফিরে বলল, আপনার সাহস ও সরলতার আমি তারিফ করি মিস নন্দিনী। আমার স্ত্রী এতক্ষণ আপনাকে যেভাবে ইঙ্গিতপূর্ণ কথাবার্তা বলেছে এর যোগ্য জবাব তার পাওনা ছিল, সে তা পেয়েছে। আর সে এ পর্যন্ত আপনার সাথে যে ব্যবহার আগাগোড়া করে এসেছে তা ভালো হোক মন্দ হোক কবি সাহেবের বোন হিসেবেই করেছে। আমার স্ত্রী হিসেবে নয়। আমি আগরতলাতেই ব্যাপারটা লক্ষ্য করে আসছি। আজ আপনি খোলামেলা কথা বলে আমার ও আমার স্ত্রীর উপকারই করলেন। আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আমিও প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধাদেরই সরকারের কর্মচারী এবং সে অর্থে মুক্তিযোদ্ধা। আপনাকে সমর্থন ও আশ্রয় দেয়াই আমার মূল কর্তব্য। আমার স্ত্রীর নির্বুদ্ধিতার জন্য আমি অতিশয় লজ্জিত ও দুঃখিত।

    ইমামের কথা শেষ হওয়া মাত্রই পারুল উঠে গিয়ে নন্দিনীর হাত ধরে বলল, আমিও খুব লজ্জিত। আমাকে ক্ষমা করে দিন বোন। আমি ঠিক বুঝতে পারি নি কী অবস্থা থেকে কবি ভাই ও আপনি এসেছেন। আমি শুধু অবস্থার একটা দিকই বিবেচনা করেছি। অন্য দিকটা দেখতে পাই নি। আপনারা আমার ওপর রাগ করে আমায় ছেড়ে যাবেন না।

    পারুলের কথায় নন্দিনী গলে গেল। বলল, না, আর যাব না।

    পারুল খুশি হয়ে আমাদের পেয়ালায় চা ঢেলে দিতে এগিয়ে এল।

    চা খাওয়ার পর আমি ওপরে এসে দেখি মিতু মুখ ভার করে আমার কামরায় বসে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কিরে মন খারাপ করে আছিস কেন?

    মামা নন্দিনী ফুপু কী সব বলল, আম্মা কী ফুপুকে চলে যেতে বলেছে?

    মহা উৎকণ্ঠা নিয়ে মিতু আমাকে প্রশ্ন করল। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, না না ওসব কিছু নয়। জানিস তো তোর নন্দিনী ফুপুর এক বোন আসার সময় পথে পাক বাহিনীর গুলীতে শহীদ হয়েছে। ওর কী মাথার ঠিক আছে? তার ওপর গত রাত তুইও তোর মার সাথে শুতে গেলি। বেচারা একা একা দুঃস্বপ্নেরও ভয়ে ঘুমোতে না পেরে কাঠ হয়ে আমার ঘরে এসে মাটিতে বিছানা পেতে শুয়েছে।

    নিজের অজান্তেই কিশোরী মেয়েটিকে আমি যেন কৈফিয়ত দিলাম। যদিও জানি এই মিথ্যা মেশানো সত্যে মিতুর কিছুই আসে যায় না এবং এ কৈফিয়ত না দিলেও চলত।

    কেন আমাকে ডাকলেই হত।

    এত রাতে তোদের জাগাতে গেলে সারা হোটেলের মানুষজন জেগে উঠত।

    নন্দিনী ফুপুর আপনজন আর কেউ নেই?

    হয়ত আছে। কিন্তু একটু থিতু হওয়া না গেলে তো ও আর ওর আপনজনদের তালাশ করতে পারবে না।

    থাকুন না আমাদের সাথে। মামা আপনি কী আমাদের রেখে অন্য বাসায় চলে যাবেন?

    আমি মিতুর কথার কোনো জবাব খুঁজে না পেলে হাসলাম, আমি আর কোথাও যাব না। এখানে কী আমার কেউ আছে?

    মামিকে খুঁজে পেতে নিয়ে আসুন না মামা। মামি এলে কী নন্দিনী ফুপু রাগ করবেন?

    তা কেন করবেন? তোর মামির তো সন্ধানই পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি নিশ্চয়ই বাংলাদেশে কোথাও নিরাপদেই আছেন। তোর মামি তো আর অশিক্ষিত গাঁয়ের মেয়ে নয়, ঢাকার মেয়ে। নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে পারবে।

    আমি মিতুর সব কৌতূহল এক সাথে মেটানোর একটা দায়িত্ববোধ থেকে জবাব দিলাম।

    মিতু হঠাৎ বলে বসল, আচ্ছা মামা, মুক্তি বাহিনীকে সাহায্য করতে আপনি আব্বা আপনারা যুদ্ধে যাবেন না?

    এবার মিতু কিশোরী সুলভ ঔৎসুক্যে এমন এক প্রশ্ন করল যা সহজেই আঁতে ঘা লাগার মত। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, আমরা তো যুদ্ধ করব বলেই এসেছি। যারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নানা জায়গায় হানাদার বাহিনীকে ঠেকাচ্ছে আমরা তো তাদের সাহায্য করতেই দেশ ছেড়ে ভারতে চলে এসেছি। আমরা এখানে থেকে লিখে সারা বিশ্বের মানুষের মনযোগ আকর্ষণ করে এই যুদ্ধের রসদ ও অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করব।

    আমার কথা শেষ হবার মুহূর্তেই নন্দিনী এসে ঘরে ঢুকল। পেছন থেকে পারুল বলল, মামা-ভাগ্নি কাদের জন্য অস্ত্র আর রসদের যোগান দিচ্ছেন?

    আমি হাসলাম। মিতু বলল, আমরাও যুদ্ধ করব। মামা লিখবে আর আমি গেয়ে মানুষকে জাগাব, একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি।

    ঠিক আছে, এখন আমাদের ঘরে চল। এরা চা-নাস্তা করে এসেছেন, একটু বিশ্রাম নিতে দাও।

    বলল পারুল। আমি জানতে চাইলাম, ইমাম কী এখন থিয়েটার রোডে যাবে?

    তাই তো বলল।

    আমি কী তার সাথে যাব?

    আপনি বরং আপনার লেখক বন্ধুদের সাথে ঘুরে ফিরে দেখা সাক্ষাৎ করে আসুন। বেরুবার আগে একটু আমার ঘরে আসবেন তো ভাই। চল মিতু।

    পারুল মিতুকে নিয়ে চলে গেলে নন্দিনী বলল, কোথায় যাবে, আনন্দ বাজার?

    কবি বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করতে হলে তা সেখানেই আগে যেতে হবে। কিন্তু তারাশঙ্করের মৃত্যুর সংবাদ দেখে মনে হচ্ছে সেখানে আজ কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে না।

    সুতারকিন স্ট্রীটে আনন্দবাজার অফিসে যাওয়ার পর খুব ইচ্ছে থাকলেও আমার মন বলছিল আজ সেখানে পরিচিত কাউকে পাওয়া মুস্কিল হবে। তারাশঙ্করের মৃত্যু সংবাদে কলকাতার লেখকগণ স্বস্থানে থাকবে বলে আমার মনে হল না।

    নন্দিনী বলল, যদি সেখানে না যাও তবে আমাকেও নিয়ে চল না। একটু ঘুরে ফিরে বেড়িয়ে আসব।

    তোমার প্রস্তাবটা মন্দ নয়। বাংলাদেশের কে কোথায় কীভাবে আছেন জানা থাকলে ভাল হত। আমি তো কোনো কিছুই জানি না। বলতে গেলে এ শহরটা আমার কাছে অচেনাই। তবে তুমি যদি চাও ভবানীপুর তোমার পিসির কাছে একবার যেতে পারি। অন্তত সীমাদির মৃত্যুর খবরটা তাদের জানানো উচিত।

    তারা আমাকে গ্রহণ করবে না হাদী। সেখানে গেলে তারা যদি তোমাকে যথার্থ আতিথ্য না দেয় তখন আমার খুব খারাপ লাগবে। আমার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম।

    নন্দিনী মাথা নিচু করে ধীরে সুস্থে কথাগুলো বলল।

    আমি বললাম, এর উল্টোওতো ঘটতে পারে। সেখানে না গিয়ে তুমি সব জানলে কী করে? হাজার হলেও তোমার বাপের বোন তোমাকে দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেবে এটা আমি ভাবতে পারি না নন্দিনী।

    অর্থাৎ তারা গ্রহণ করলে তুমি আমাকে সেখানেই রেখে আসতে চাও?

    না, তা চাই না। বরং তারা তোমাকে আত্মীয়ের দাবিতে জোর করে রাখতে চাইলেও আমি তোমাকে ফেলে আসব না।

    তাদের না হয় আত্মীয়তার এবং রক্ত সম্পর্কের দাবি আছে। তুমি তাদের কোনো দাবির কথা তুলে আমাকে আনবে?

    কেন, গত রাতে যে দাবিতে তুমি আমার বিছানায়, আমার পাশে শুয়ে সারা রাত কেঁদে কাটালে এটা কী কোনো দাবি নয়?

    বললাম আমি।

    তাহলে চল আমি যাব।

    আমি বললাম, একটু দাঁড়াও আমি গোসল সেরে কাপড় পরে নিই। তুমি বরং এই ফাঁকে পারুলের কাছ থেকে আমার জন্য এক জোড়া বেরুবার মতো পোশাক নিয়ে এস।

    নন্দিনী আমার কথায় নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে আমি গোসলের জন্য বাথরুমে গিয়ে ঢুকলাম।

    গোসল করে ফিরে এসে দেখি আমার বিছানার ওপর একজোড়া ইস্ত্রি করা সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। নন্দিনী পোশাক রেখে সম্ভবত নিজের কামরায় তৈরি হতে গেছে। আমি কাপড়গুলো পরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে পারুলদের ঘরের দিকে রওনা হলাম। যাবার সময় নন্দিনীর দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ দেখে কলিং বেল টিপলাম। নন্দিনী দুয়ার খুলে একটু কপাট ফাঁক করে মুখ বাড়াল। আমি বললাম, আমি পারুলের সাথে কথা বলে আসছি।

    নন্দিনী বলল, আমাদের বেরুতে টাকা লাগবে না? হাজার খানেক সঙ্গে নেব? আমি বললাম, দাঁড়াও, আমি পারুলের সাথে আগে কথা বলে নিই। সম্ভবত পারুল আমাকে হাত খরচের কিছু টাকা দিতেই ডেকেছে। যদি সেখান থেকেই পাই তবে গচ্ছিত টাকায় এখনই হাত দেয়ার ইচ্ছে নেই। তুমি কী বল?

    কী বলব, তোমার মতই আমার মত।

    বলে দরজা এঁটে দিল নন্দিনী।

    আমি ঘরে ঢোকা মাত্রই পারুল বলল, আসুন ভাই। আপনাদের জামাই তার অফিসের পৌঁছেই এই মাত্র টেলিফোন করেছিল। আমাদের বাসা ঠিক হয়ে গেছে। আমরা কাল পার্ক সার্কাসের একটা বাসায় উঠব। আমাদের জন্য সেখানে তিন তলায় একটা আস্ত ফ্লাট পাওয়া গেছে। ওপরে নিচে যারা আছেন তারা সবাই বাংলাদেশী। সবাই আমাদের অফিসার ও কর্মচারী। পাঁচ কামরার ফ্লাট। আমাদের কোনো অসুবিধাই নাকি হবে না।

    আমি বললাম, এখন কী আমরা বেরুব?

    পারুল বলল, যান না, একটু ঘুরে আসুন। আর এই খামটা রাখুন। এতে হাজার দুয়েক টাকা আছে।

    আমি হাত বাড়িয়ে খামটা নিতে গেলে পারুলের বিছানার শিথানে রাখা একটা মান্ধাতার আমলের কালো টেলিফোন সেট বেজে উঠল। পারুল টেলিফোন তুলে সাড়া দিয়েই বলল, আপনার সাথে কথা বলবে।

    আমি টেলিফোনটা ধরেই বললাম, হ্যালো।

    কবি ভাই, বাংলাদেশ থেকে আসা সব কবি-সাহিত্যিককে আমি আপনার আগমন বার্তা জানিয়ে দিয়েছি। এরা সবাই পার্ক সার্কাস এলাকার বালু হাক্কাক লেনে আমাদের স্বাধীন বাংলা বেতারের যোগাযোগ কেন্দ্রের সাথে জড়িত। তারা সবাই আপনার জন্য অপেক্ষায় আছে। আপনি এখনই সেখানে চলে যান।

    আমি বললাম, সেখানে গেলে এখন কাদের পাবো?

    শুনেছি গাফফার চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরী আরও অনেকে সেখানে আসা-যাওয়া করেন। আপনি গেলে কাউকে না কাউকে তো সেখানে পেয়ে যাবেন। আমি আমাদের দফতরে আপনার জন্য একটা চাকুরির চেষ্টা করছি। আশা করছি নন্দিনীদিরও একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

    খুব আত্মবিশ্বাস আর আনন্দের সাথে ইমামের কথা উপচে পড়ছে। আমি কী বলে যে ইমামকে ধন্যবাদ দেব বুঝতে পারছিলাম না। শুধু কাঁপা গলায় বললাম, আমি আর নন্দিনী এখুনি পার্ক সার্কাস রওনা হচ্ছি। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

    আমি টেলিফোন রেখে পারুলকে বললাম, আমরা এখুনি বেরুচ্ছি। আমাদের ঘরের দিকে একটু লক্ষ্য রাখিস।

    আমরা রাস্তায় বেরিয়েই একটা পানের দোকানের সামনে দাঁড়ালাম। আমি কালেভদ্রে পান খাই। দাঁড়ালাম, কারণ বালু হাক্কাক লেনটা কোথায় তা খুঁজে বের করা দরকার। পান কেনার অছিলায় গলিটির দিশা পাওয়া যাবে ভেবে আমি দোকানিকে দুটো পান দিতে বললাম।

    দোকানি মুখ তুলে আমাকে এক নজর দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, জর্দা?

    আমি বললাম, একটায় একছিটে জর্দা আর খয়ের।

    নন্দিনীর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলাম, তোমারও জর্দা লাগবে?

    দিক না একটু জর্দা।

    রাস্তায় বেরুতে পেরে নন্দিনীও মনে হচ্ছে খানিকটা বেপরোয়া, একটু হেসে জবাব দিল নন্দিনী। আমি পানঅলার দিকে তাকালাম। ষাট-পঁয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধ। কাঁচাপাকা চাপ দাঁড়ি। মাথায় টুপী। নিবিষ্ট দক্ষতায় কাটা পানপাতার ওপর খয়ের ঘষছে। এই সুযোগে আমি জিজ্ঞেস করলাম, বালু হাক্কাক লেনটা কোন্ দিকে?

    সেখানে কার বাড়ি যাবেন?

    চমকে প্রশ্ন করল লোকটা।

    আপনারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছেন?

    আমি ও নন্দিনী একসাথে জবাব দিলাম, হ্যাঁ।

    আমাদের জবাব শুনে লোকটা এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল। সে হাতের পান পাতা দুটো ছুঁড়ে সামনের বালতিতে ফেলে দিল।

    আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, কী ব্যাপার?

    সামনের দোকান থেকে পান নিন। আমি আপনাদের কাছে পান বেচব না। আপনারা পাকিস্তান ভেঙে দেয়ার জন্য হিন্দুস্তানে গাদ্দারি করতে এসেছেন। আমরা হিন্দুস্তানি মুসলমানরা আপনাদের ঘৃণা করি। যান আগে বাড়েন।

    মুখে চরম বিরক্তি ফুটিয়ে বৃদ্ধটি আমাদের পথ দেখিয়ে দিল। আমি হতবাক হয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। নন্দিনী কিন্তু সহজে দমল না। বলল, তুমিই গাদ্দার। পাকিস্তানের দালাল। জানো এই ব্যবহারের জন্য আমরা তোমাকে পুলিশে ধরিয়ে দিতে পারি?

    লোকটা ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত আপত্তিকর ভাষায় বলে উঠল, খুব দেখেছি। রোজ দেখি। কথা বাড়াবেন না মেম সাব। এখান থেকে এক্ষুনি চলে যান। জানেন না এটা পার্ক সার্কাস। যান আগে বাড়েন।

    নন্দিনী পানওয়ালাটার মুখের ওপর কী একটা জবাব দিতে যাচ্ছিল। আমি তাকে ঠেলে সামনের দিকে চালিয়ে সরে এলাম, কি দরকার কথা বাড়িয়ে? এরা এখানকার বঞ্চিত মুসলিম। পাকিস্তান ছিল এদের স্বপ্ন। যারা এই স্বপ্ন ভাঙতে উদ্যত তাদের এরা মানবে কেন?

    এজন্য কী এক খিলি পানও বিক্রি করবে না?

    না করবে না। এদের ক্ষোভ কতটা গভীর তা তোমাকে সহানুভূতির সাথে বুঝতে হবে নন্দিনী। এদেরকেও পাকিস্তানে আমরা বাঙালি হিন্দু-মুসলমান কী অবস্থায় আছি তা বুঝিয়ে দিতে হবে। এরা ভাবতেই পারছে না ভারতীয় কূটনীতি ও সামরিক সহায়তায় পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম জনগণ স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে।

    এ অবস্থায় আমরা কী সফল হব?

    আমি নির্দ্বিধায় জবাব দিলাম, নিশ্চয়ই হব। দশ কোটি মানুষ যদি পাকিস্তান বা হিন্দুস্তানের পতাকার নিচে থাকতে না চায়, সামরিক দমন পীড়ন, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালানো, অসহায় নারীর ওপর অকথ্য লাঞ্ছনা চালিয়ে কী কেউ তাদের মুক্তি সংগ্রামকে পরাজিত করতে পারে?

    লোকটার ব্যবহারে আমার বুকে ভয় ধরে গেছে কবি। আমার গা কাঁপছে। বাপরে আমাদের প্রতি এখানকার মুসলিমদের এত্তো ঘৃণা? এমন ঘৃণা আর অপছন্দ নিয়ে ইন্ডিয়ার সংখ্যালঘু বিশ পঁচিশ কোটি মুসলমান বাস করে এদেশে? তাহলে তো ভারতও একদিন ভেঙে টুকরো হয়ে যাবে।

    নন্দিনীর এই সহসা সরল উপলদ্ধিতে আমি কোনো বাধা না দিয়ে চুপ করে তার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলাম।

    বেশ খানিকটা এগিয়ে আমরা পার্ক সার্কাসের শেষ প্রান্তে ট্রাম লাইনের একটু আগে ঝাউবীথির নিচের ফুটপাতে এসে পড়লাম। এসময় আমাদের পাশ দিয়ে একটা খালি ট্যাকসি চলে যেতে দেখে আমি হাত তুললাম। শিখ ট্যাকসি ড্রাইভার খানিকটা পথ এগিয়ে গিয়ে গাড়ি থামিয়ে মুখ বাড়াল, কীধার যানা?

    বালু হাক্কাক লেন। জয়বাংলা অফিস।

    নন্দিনী বলল।

    ট্যাকসিওয়ালা হাতের ইশারায় গাড়িতে উঠতে বলল। আমরা উঠলাম। গাড়িতে ওঠার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়িটা বাঁক ঘুরে একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। ট্যাকসি ড্রাইভার স্টার্ট রেখে আমাদের দিকে না ফিরেই গাড়ির মিটার উল্টে দিয়ে বলল, দশ রুপেয়া।

    আমি খাম থেকে একটা একশো টাকা এগিয়ে দিয়ে বললাম, চেঞ্জ দিজিয়ে সর্দারজি। ঔর মেহেরবানী করকে জয় বাংলা অফিস কোন মকানমে জরাসা সমঝা দিজিয়ে।

    লোকটা আমার কথায় বেশ খুশি হয়েছে মনে হল। দ্রুত হাতে ভাংতি টাকা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ওতারকে ইসতরা সামনেঅলা মকানমে যাকর পুছিয়ে। এহি আপকা ঠিকানা।

    আমরা নেমে সামনের একতলা একটা বাড়ির বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। ভেতরে লোকজনের ভিড়ের মধ্যে চেনা মানুষকে খুঁজতে লাগলাম। নন্দিনী আমার হাত ধরে থাকল। আমাদের দিকে এখানে কেউ এক নজর ফিরেও দেখছে না। আমি সাহস করে একটা টেবিলের চারদিকে ভিড় করে থাকা কয়েকজন মেয়ে পুরুষের গা ঘেঁষে ভেতরে প্রবেশ করেই চট্টগ্রাম রেডিওর এককালের নিয়মিত স্ক্রীপ্ট লেখক, আমার বন্ধু বেলাল মোহাম্মদকে চেয়ারে উপবিষ্ট দেখে সালাম বললাম। বেলাল টেবিলে উবু হয়ে ক্রমাগত কী যেন লিখে যাচ্ছে। আমার আসোলামু আলাইকুম শুনে মুখ তুলেই হেসে শ্লোগান দিল, জয় বাংলা। কী আশ্চর্য আরও একজন কবি এসে গেছে। কবি হাদী মীর।

    আমি হেসে বললাম, আরও এক কবি-সাহিত্যিক এখানে আছেন জেনেই এসেছি। আপনি কেমন আছেন বেলাল?

    বেলাল আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হেসে বলল, এ যুদ্ধে আমরা জিতবই। আপনার মতো নিরীহ কবিও যখন চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন তখন বুঝতে হবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীরাও সামিল হতে আর দ্বিধা করছে না। জয় বাংলা।

    আমি বললাম, আসাদ, নির্মলেন্দু এদের সাথে দেখা হলে ভালো হত। কই, এদের তো দেখছি না।

    একটু পরেই সবাইকে পাবেন। একটু ধৈর্য ধরুন। বলে বেলাল একটু দূরে সংকুচিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নন্দিনীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, আপনি সপরিবারেই চলে এসেছেন মনে হচ্ছে? ওকে এখানে এসে বসতে বলুন। ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? আপনিও বসুন। এই আপনারা কবি দম্পতিকে একটু বসতে দিন তো।

    সামনের কয়েকজন যুবক বেলালের কথায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আমি হাতের ইশারায় নন্দিনীকে ডাকলে সে সসংকোচে পাশে এসে বসল এবং অনভ্যস্ত হাত তুলে বেলাল মোহাম্মদকে সালাম জানাল।

    বেলাল বলল, আপনারা কোথায় উঠেছেন?

    আমরা উডস্ট্রীটের একটা হোটেলে আছি। সাথে আমার বোন ভগ্নিপতি ও ভাগ্নি আছে। আমার বোন জামাই প্রবাসী সরকারের উচ্চপদের কর্মচারী। তার সাথে আছি বলেই ভালো আছি। আগামীকাল হয়ত হোটেল ছেড়ে অন্যত্র যাব।

    যাক, আপনি ভালোই আছেন। তবে এটা জানবেন দেশ ছেড়ে আসা অধিকাংশ শিল্পী সাহিত্যিক সাংবাদিক আপনাদের মতো ভাল আশ্রয়ে নেই। সবাই আমরা সব অবস্থা মেনে নিয়েছি। ঐ যে আপনার বন্ধু আসাদ চৌধুরী এসে গেছেন।

    বেলালের কথায় আমি মুখ ফিরিয়ে দেখলাম আসাদ সিঁড়ি বেয়ে এদিকেই আসছে। আমাকে দেখেই দুহাত বাড়িয়ে এগিয়ে এসে কোলাকুলি করল, জয় বাংলা।

    আমিও বললাম, জয় বাংলা।

    ভাবির সাথে দেখা হয়েছে?

    আমি অবাক হয়ে বললাম, ভাবি? হামিদা কী কলকাতায় এসেছে?

    আশ্চর্য আপনি এখনও তার খোঁজ পান নি? তিনি তো অনেক আগেই কলকাতা পৌঁছেছেন। শুধু তাই নয়, এর মধ্যে যেসব মুক্তিযোদ্ধারা প্রাথমিক ট্রেনিং শেষ করেছে। তিনিও তাদের একজন। সম্ভবত এখন তার অপারেশনে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। কাল আট নম্বর থিয়েটার রোডে গিয়ে ভাবির বর্তমান অবস্থানের খোঁজ নিন। মনে রাখবেন এখন আপনার বৌ আর নিরস্ত্র গৃহিণী মাত্র নন। গুলী আর হ্যান্ড গ্রেনেড মারতে জানেন।

    বলেই আসাদ তার স্বভাব সুলভ কলরবময় হাসিতে ফেটে পড়লেন। আমার মুখে আর কথা সরছে না। হামিদা কলকাতায়? হামিদা সামরিক ট্রেনিং প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা? হানাদার বাহিনীকে আঘাত হানতে দেশের ভেতর যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে?

    কিছুই যেন আমার মাথায় ঢুকছে না। আমি একবার মাত্র আড় চোখে নন্দিনীকে দেখলাম। সে মাথা নত করে নখ খুঁটছে।

    এবার নন্দিনীর দিকে চোখ পড়তেই আসাদ প্রশ্ন করলেন, ইনি আপনার বোন মিসেস ইমাম?

    আমার জবাব দেবার আগেই নন্দিনী বলল, না, আমি কবির বান্ধবী। আমার নাম নন্দিনী ভট্টাচার্য। ভৈরববাজার থেকে এসেছি। আমি ইমাম পরিবারের আশ্রয়ে। আপনি তো কবির ভগ্নিপতিকে ভালো করেই চেনেন মনে হচ্ছে?

    আসাদ বলল, হাঁ, এদের সবাইকে চিনি। আমার দিকে ফিরে বললেন, একটা দেশাত্ববোধক কবিতা স্টকে আছে নাকি? দিন, কালই প্রচার করব।

    আমি বললাম, না এখনও কবিতার মতো কোনোকিছু বানিয়ে ফেলার ফুরসৎ পাই নি। একটু সময় দিতে হবে।

    অফুরন্ত সময়। মনস্থির করে একটা বুক কাঁপানো কবিতা লিখে ফেলুন।

    আসাদের কথায় আমি হাসলাম, দেখা যাক।

    বেলাল আমার স্ত্রীকে চিনতেন না। সম্ভবত তিনি ধরে নিয়েছিলেন আমার সঙ্গিনী আমার স্ত্রীই হবেন। এখন আমার স্ত্রী ট্রেনিং প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্বা জানতে পেরে এবং আমার সাথে এখনও তার যোগাযোগ ঘটে নি বুঝতে পেরে বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলেন।

    আমি বললাম, আজ তাহলে উঠি বেলাল।

    একটু বসলে গাফফার ভাই আর গুণের সাথে দেখা হয়ে যেত।

    এদের সাথে আগামীকাল দেখা করব। বলবেন আমি এদের খুঁজে গেলাম।

    বলে নন্দিনীকে উঠবার ইঙ্গিত করে আমি বেলাল ও আসাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম।

    .

    গলিটা পার হয়ে আমরা বড় রাস্তায় পা দেয়া মাত্র নন্দিনী মুখ খুলল, কবি আমার মনে হয় বৌদির খোঁজ নেওয়ার আগেই আমার একটা ব্যবস্থা হওয়া উচিত।

    আমি বললাম, আমি এখনও ঠিক ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না। আমাকে একটু চিন্তা করতে দাও নন্দিনী। যা শুনলাম তাতে মনে হচ্ছে তোমার বৌদি ঠিক পানিতে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন না। তার ব্যবস্থা তিনি করে নিয়েছেন।

    নন্দিনী বলল, তিনি বীর নারী। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। এটাই স্বাভাবিক। আমরাই বরং হাবুডুবু খাচ্ছি। আর আমি তো আগেই বলেছি, তোমার বৌ ফিরে এলে আমি আমার পথ দেখব। এখন চল ভবানীপুরের দিকে একটু ঘুরে আসি। যদিও জানি সেখানে গিয়ে তেমন কোনো ফল হবে না।

    সেখানে যাওয়ার আগে একবার হোটেলে গিয়ে একটু চিন্তাভাবনা করে দেখলে ভাল হয় না? এতক্ষণে ইমাম নিশ্চয়ই বাসায় ফিরেছে। বিকেলে না হয় ভবানীপুর যাওয়া যাবে।

    না। তার আগেই আমরা একবার ভবানীপুর যাব। তুমি যে বলেছিলে দিদির মৃত্যুর খবরটা একবার অন্তত আমার পিসীমাকে দেয়া উচিত। এখন মনে হচ্ছে সেটাই ঠিক।

    দৃঢ়তার সাথেই নন্দিনী আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ট্যাক্সির জন্য এদিক সেদিক তাকাতে লাগল। আমি বললাম, আরেকটু এগিয়ে গেলে ট্রাম স্ট্যান্ডের মোড়ে ট্যাক্সি পাওয়া যাবে।

    নন্দিনী আমার কথামত হাঁটতে লাগল। আমার কেন যেন মনে হল নন্দিনী যন্ত্রের মতো শুধু পা ফেলে যাচ্ছে। তার মধ্যে কোনো অনুভূতি নেই। আমি হাত বাড়িয়ে নন্দিনীর একটা হাত ধরলাম, নন্দিনী?

    হঠাৎ নন্দিনী ফুটপাতে দাঁড়িয়ে পড়ল, ছেলেমানুষি করার জায়গা বুঝি এটা? দেখছ না পথচলা মানুষ আমাদের দেখছে।

    আমি তার হাত ছেড়ে দিয়ে পথের দুপাশে তাকালাম। পথযাত্রীরা সংখ্যা কম হলেও, চলতে চলতে এরি মধ্যে দুচারজন আমাদের দেখছে।

    আমি বললাম, নন্দিনী আমি তোমাকে ভালবাসি।

    মাঝপথে আমি বুঝি তোমার ভালবাসার প্রমাণ চাইছি?

    তা কেন।

    এখন চল ভবানীপুর যাই।

    ভবানীপুর গেলেই কী তুমি বাড়ি খুঁজে বের করতে পারবে?

    মনে হয় পারব। একটা স্কুলের পাশ দিয়ে গলিটা ঢুকছে। গলির ভেতরে ১১৭ নম্বর বাড়ি। বাড়ির ভেতর অনেক ভাড়াটের সাথে আমার বিধবা পিসিমা তার এক বেকার ছেলে ও দুটি স্কুলে পড়ুয়া মেয়ে নিয়ে থাকতেন। বহু বছর আগের কথা। আমার বোন দুটি ছিল আমারই বয়েসী, নাম অঞ্জলি আর দীপালি। আমার দাদা যাকে আমি বহুদিন আগে একজন গ্রাজুয়েট বেকার দেখে গিয়েছিলাম তার নাম অনুপ মুখোপাধ্যায়। আর পিসিমার নাম রাধারাণী দেবী। আশা করি এখনও সেখানেই থাকলে এরা আমাকে চিনতে পারবেন। তবে এমন আশা করি না, এরা আমাকে আত্মীয় হিসেবে আশ্রয় দিতে চাইবেন।

    বলল নন্দিনী।

    আমি আর কথা না বাড়িয়ে নন্দিনীর পাশাপাশি ট্যাক্সির উদ্দেশ্যে চলতে লাগলাম। ট্রাম স্ট্যান্ডের মোড়ে এসে সহজেই ট্যাক্সি পাওয়া গেল। আমরা গাড়িতে উঠে ভবানীপুর যেতে বললাম।

    ট্যাক্সি ভবানীপুর ঢুকতেই নন্দিনী বলল, ঐতো স্কুলটা, এর পাশের গলিতে ঢুকতে হবে।

    আমি ট্যাক্সি ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বললাম, হিয়াই রোক যাইয়ে।

    ড্রাইভার গাড়ি রাখলে আমরা ভাড়া মিটিয়ে নেমে গেলাম। গলিতে ঢুকে কেন জানি একটা অযথা ভয় ও বুকের ভেতর ধুকধুকানি অনুভব করছিলাম।

    নন্দিনী বলল, চিনতে পারছি, এটাই সেই গলি। একটু সামনে গিয়ে ডানদিকের বাড়িটা।

    আমি বললাম, আমার বুক কাঁপছে নন্দিনী। আমি বাড়ির বাইরে থাকব। তুমি ভেতরে যেও। তোমার আত্মীয়রা এখনও এখানে থাকলে পরিস্থিতি বুঝে আমাকে ডেকে নিও।

    নন্দিনী হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, এখানে দাঁড়িয়ে বরং একটা সিগ্রেট খাও। তারপর না হয় ধীরে সুস্থে বাড়ির ভেতর ঢুকবে। এমন কাঁপতে কাঁপতে ঢুকলে এরা কী ভাববে?

    আমার ভয় লাগছে।

    কিসের ভয়? আমাকে হারাবার?

    বুঝতে পারছি না।

    আমার কথায় নন্দিনী ঠোঁট টিপে হাসল, আমি যদি তোমার মুক্তিযোদ্ধা বৌয়ের সাথে লড়াই করে জিততে চাই, বুঝতে পারছি জিতে যাব। তবে আমি এমন কাপুরুষের মতো জিততে চাই না। নাও সিগ্রেট ধরাও।

    আমি পকেট থেকে প্যাকেট বের করে একটা সিগ্রেট ধরিয়েই বললাম, এখানে আর দাঁড়াতে হবে না, চল বাড়িটার ভেতরে গিয়ে ঢুকি।

    নন্দিনীও আর কোনো কথা না বলে আমার আগে আগে চলতে লাগল। আমরা গলির মাথায় এসে ডানদিকে একটা অতিকায় শেওলা পড়া বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। নন্দিনী বলল, এটাই।

    বাড়ির সামনে একটা ভাঙা দেয়াল। দেয়ালের শেষপ্রান্তে একটা গেট। একতলা এই পুরানো বাড়িটাকে ঘিরে আছে স্থানে স্থানে ক্ষয়ে সুরকি ঝরে যাওয়া প্রাচীন দেয়াল।

    গেটের কপাট খোলাই। আমি ও নন্দিনী ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরের সরু গলিটা পার হতেই বাড়ির সান বাঁধানো উঠানে একজন খালি গা হাড্ডিসার লোককে বালতি থেকে মগ ভর্তি পানি নিয়ে মাথায় ঢালতে দেখলাম। পরনে একটা ধুতি লুঙ্গির মতো পেঁচিয়ে পরা। ভদ্রলোক আমার ও নন্দিনীর দিকে একবার একটু মুখ ফিরিয়ে দেখেও তেমন গা করলেন না। আবার মগভর্তি পানি মাথায় ঢালতে লাগল।

    আমি নন্দিনীকে বললাম, এই ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলে হয়।

    জিজ্ঞেস করতে হবে না। ইনি অনুপদা। আমার পিসতুতু ভাই। চিনতে ভুল হচ্ছে না। স্বাস্থ্যটা মনে হয় একদম খুইয়ে বসেছেন।

    নন্দিনীর অনুচ্চ কথাগুলোও সম্ভবত ভদ্রলোকের কানে গেছে। মগটা বালতির ভেতর রেখে তিনি নন্দিনীর দিকে ফিরলেন, কে আপনারা? কোত্থেকে এসেছেন?

    আমাকে চিনতে পারছ না অনুপদা, আমি নন্দিনী। পাকিস্তান থেকে এসেছি। পিসিমা কোথায়? অঞ্জু, দীপু এদের দেখছি না যে?

    ভদ্রলোক নন্দিনীর কথায় কিছুক্ষণ অত্যন্ত হতভম্ব হয়ে আমার ও নন্দিনীর দিকে তাকাতে লাগলেন। চমক ভাঙলে অকস্মাৎ বলে উঠলেন, তুই নন্দিনী, হাবুল মামার মেয়ে নন্দিনী? সীমার বোন?

    তার কথায় নন্দিনীর বাঁধ ভেঙে গেল। সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে তার স্নানরত গুরুজনের পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে গেলে অনুপ বাবু ভেজা শরীরেই নন্দিনীকে জড়িয়ে ধরলেন, তোরা বেঁচে আছিস বোন? সীমা কোথায়? তার জামাই?

    সীমাদি নেই অনুপদা। আগরতলা ঢোকার পথে পাক হানাদারদের গুলীতে মারা গেছে। আর জামাইবাবু ২৫শে মার্চের আগেই ঢাকায় গিয়েছিলেন। ফেরেন নি। তার খোঁজখবর জানি না। বোধহয় বেঁচে নেই।

    ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল নন্দিনী। এদিকে এদের কান্না ও কথোপকথন শুনে আশপাশের বিভিন্ন কামরা থেকে বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ বেরিয়ে এসেছে। আমি হাতের সিগ্রেট ফেলে দিয়ে কী করব ভেবে না পেয়ে এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে রইলাম। জীবনে এমন মিলন দৃশ্য আমি আর দেখি নি। অনুপ বাবু নন্দিনীকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে মেয়েদের মত বিলাপ করছেন, মা নেই, অঞ্জি পালিয়ে বেঁচেছে, তুই এই শ্মশানের আগুনে আরও সর্বনাশের খবর নিয়ে কেন এলি হতভাগী?

    এসময় আমার পেছনের একটি ঘর থেকে নন্দিনীর বয়েসী একটি মেয়ে এলোচুলে ছুটে বেরিয়ে এদের মধ্যে পড়ল, কে এসেছে দাদা?

    মেয়েটির ব্যাকুল প্রশ্নে নন্দিনী ও অনুপবাবু যেন সম্বিৎ ফিরে পেলেন। তিনি নন্দিনীকে বুক থেকে আলগা করে মেয়েটিকে বললেন, চিনতে পারছিস না দীপু, এ আমাদের হাবুল মামার মেয়ে নন্দিনী। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছে। আগে এদের ঘরে নিয়ে যা। আমি একটু জল ঢেলে এক্ষুণি আসছি।

    মেয়েটি এগিয়ে এসে নন্দিনীর হাত ধরে বলল, এসো। আমি দীপালি। খুব ছোটো বেলায় তুমি একবার এ বাড়িতে হাবুল মামার সাথে এসেছিলে। আমি আর অঞ্জ তোমাকে নিয়ে সারা কলকাতায় কত ঘুরে বেড়িয়েছিলাম। মনে নেই?

    খুব মনে আছে দীপুদি। পিসিমা কবে মারা গেলেন?

    গত ফেব্রুয়ারিতে। ক্যানসার হয়েছিল।

    জবাব দিল দীপালি। আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ইনি বুঝি তোমাকে নিয়ে এসেছেন?

    হ্যাঁ দীপুদি। ইনি আমার বন্ধু। বিখ্যাত কবি, হাদী মীর। এর সাথেই আমরা ভৈরবের কাছে নারায়ণপুর বাজার থেকে রওনা দিই। পথে সীমাদির গায়ে গুলী লেগে মারা গেলে আমি এর বোনের আশ্রয়ে আগরতলায় এসে উঠি। এর ভগ্নিপতি বাংলাদেশ সরকারের বড় কর্মকর্তা। এখন পর্যন্ত এদের সাথে পার্ক স্ট্রীটের একটা হোটেলে এসে উঠেছি। বলল নন্দিনী।

    দীপালি আমার দিকে ফিরে বলল, আসুন ভেতরে।

    আমি ও নন্দিনী দীপালির পেছন পেছন এদের ঘরে এসে ঢুকলাম। দু কামরার একটা পুরানো বাসা। সামনের ঘরে একটা খাটের পাশে ছোট্ট টেবিল পাতা। একটিমাত্র চেয়ার পাশে। নোংরা দেয়াল। নোনাধরা সুরকির প্লাস্টার খসে পড়ছে। খাটের মাথার দিকে দেয়ালে রাধাকৃষ্ণের যুগল বাঁধানো ছবি। ছবির গায়ে শুকনো মালা। ধুলোবালি মাখা ধূসর কড়িবর্গাঅলা ছাদ। ছাদ থেকে নেমে আসা একটা লোহার রডে নিস্তব্ধ আদিম বৈদ্যুতিক পাখা ঝুলছে। খাটের ওপর ময়লা রং ওঠা বেড কভারে ঢাকা বিছানা। বোঝা যায় একটা দীনহীন পরিবেশে প্রবেশ করেছি।

    আমি চেয়ারটায় এসে বসলাম। দীপালি এখনও নন্দিনীর হাত ধরে আছে। আমি আগ বাড়িয়ে বললাম, আপনি একে ভেতরে নিয়ে গিয়ে কথা বলুন। আমরা অত্যন্ত দুর্দশার মধ্য থেকে দেশ ছেড়ে এসেছি। ওর হয়ত আপনাদের মতো আপনজনদের কাছে অনেক কিছু বলার আছে।

    ওর কথা পরে শুনব। আগে আপনাকে এককাপ চা দিই।

    আমি বললাম, দিন।

    দীপালি নন্দিনীকে নিয়ে পাশের কামরায় চলে গেলে স্নান সেরে অনুপ বাবু মাথা মুছতে মুছতে ঘরে এসে ঢুকলেন।

    আপনাকে কী বলে ধন্যবাদ জানাব। আমার বোনটিকে আপনি এতদূর পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন।

    আমি হাসলাম, নিয়ে আসার জন্য ধন্যবাদ দিন। কিন্তু তাকে এখানে আপনার বোঝা হিসেবে রেখে যেতে চাই না। নন্দিনী এখন আমাদের পরিবারেরই একজন। সে শুধু তার একমাত্র পিসিমাকে সীমাদির মৃত্যুর খবরটা পৌঁছে দেবে বলে এসেছে।

    আমার কথার মধ্যেই নন্দিনী এসে ঘরে ঢুকল, আমি এখানে কয়েকটা দিন থেকে যাই কবি। বহুকাল পরে এসেছি। এদের ওপর দিয়েও কম ঝড় বয়ে যায় নি। এইমাত্র দীপুদি বলল অঞ্জুদি কিছুদিন আগে একটি মুসলমান হকার ছেলেকে বিয়ে করে বাড়ি ছেড়ে হাওড়া চলে গেছে। এরা অঞ্জুদির সাথে, তার বরের সাথে সম্পর্ক রাখতে চায়। কিন্তু অঞ্জুদি লজ্জায় আসতে চায় না। আমার বিশ্বাস, আমি এদের লজ্জা ভাঙিয়ে ফিরিয়ে আনতে পারব।

    আমি বললাম, নন্দিনী তুমি থাকতে চাইলে আমি কী আর বলতে পারি?

    রাগ করলে?

    না।

    আমি কাল সকালে দীপুদিকে নিয়ে উডস্ট্রীটে যাব। ইমাম সাহেব আর পারুলকে আমি বুঝিয়ে বলব।

    কাল ইমামরা হোটের ছেড়ে পার্ক সার্কাস এলাকায় চলে আসবে।

    জানি। সে জন্যই খুব সকালে গিয়ে হাজির হব।

    নন্দিনী এমনভাবে বলছে, মনে হল, তার মনের মধ্যে একটা স্বনির্ভর সিদ্ধান্ত আছে। দীপালি ততক্ষণে চা আর একটা প্লেটে সন্দেশ এনে টেবিলে রাখল। আমি বললাম, আপনার বোনকে আমি এখানে রেখে যাব ভাবি নি।

    হয়ত ও নিজেই ভাবে নি এ বাড়িতে আমরা এখনও আছি। তাছাড়া আমার মা ছিলেন খুব রক্ষণশীল। একটি মুসলমান ছেলের সাথে সে দেশ ছেড়ে চলে এসেছে দেখলে মা হয়ত ওকে ঘরে ঢুকতেই দিত না। মা নেই ভালোই হয়েছে। তা না হলে তার নিজের মেয়েই মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করে সুখে আছে শুনলে মরমে মরে যেত।

    আপনাদের বুঝি এখন আর সে সংস্কার নেই?

    আমাদের কেন, এ শহরে কেইবা এখন জাতপাত মানে? ঐ দেখুন আমার দাদা, অঞ্জুদির ভালবেসে গৃহত্যাগের কথা শুনে কেঁদেকেটে দুচোখ ভাসিয়ে দিলেন। এখন প্রতিদিন শিয়ালদা স্টেশনে গিয়ে অঞ্জুদির বরের সাথে চা-বিস্কুট খেয়ে আসেন। বলেন, ছেলেটি নাকি খুব ভদ্র আর শিক্ষিত। বোনের পছন্দের তারিফ করেন। বলেন, এমন একজন ধার্মিক ভগ্নিপতি পেয়ে তিনি ধন্য। সময়ই সব বদলে দিচ্ছে।

    বলল দীপালি।

    আমি সন্দেশ ও চা শেষ করে উঠে দাঁড়ালাম, আজ তাহলে উঠি। কাল দেখা হবে।

    অনুপবাবু বললেন, দাঁড়ান আপনাকে গলির মাথায় রেখে আসি।

    আমি পকেট থেকে পারুলের দেওয়া খামটা বের করে নন্দিনীকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, খামটা রাখো। আমার কাছে হোটেলে যাওয়ার মতো ট্যাকসি ভাড়া আছে। নন্দিনী আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কী ভেবে যেন খামটা নিল। আমি অনুপ বাবুর সাথে বাইরে বেরিয়ে এলাম।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleআলীবর্দী ও তার সময় – কালিকিঙ্কর দত্ত
    Next Article উড়ালকাব্য – আল মাহমুদ

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }