Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আবার যদি ইচ্ছা কর – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    আম্রপালী – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    বিশ্বাসঘাতক – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    উলের কাঁটা – নারায়ণ সান্যাল

    নারায়ণ সান্যাল এক পাতা গল্প181 Mins Read0

    উলের কাঁটা – ১

    এক

    “কৃপা কর সুনিয়ে…অব হামারা হাওয়াই জাহাজ…”

    বাকিটা শুনবার প্রয়োজন হল না। কৌশিক স্ত্রীকে বললে, মাজার পেটিটা বেঁধে নাও আমরা শ্রীনগরে পৌঁছে গেছি। এখনই ল্যান্ড করবে।

    সুজাতা জানলা দিয়ে তুষারমৌলী পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। ওর কথায় কোমরের বেল্টটা কষতে কষতে বললে, শেষ পর্যন্ত কী সাব্যস্ত হল? হোটেল না হাউসবোট?

    কৌশিক ততক্ষণে নিজের বেল্টটা বেঁধে ফেলেছে। জবাবে বললে, দুটোর একটাও নয়। গাধাবোট!

    —গাধাবোট? তার মানে?

    —কর্তায় ইচ্ছায় কর্ম। বড়-কর্তা কী রায় দেন দেখ।

    সুজাতা আড়চোখে সামনের সীটে-বসা ব্যারিস্টার সাহেবকে এক নজর দেখে নেয়। ঘুমাচ্ছেন কি না বোঝার উপায় নেই। কোলের উপর বিছানো আছে একখণ্ড দৈনিক পত্রিকা। চোখ দুটি বোজা। বাঁ-হাতে ধরা আছে চশমাটা।

    কৌশিক সামনের দিকে একটু ঝুঁকে পড়ে বললে, ঘুমোচ্ছেন নাকি বাসু মামু? প্লেন শ্রীনগরে ল্যান্ড করছে কিন্তু।

    বাসু-সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। বলেন, না জেগেই আছি। থিংক করছিলাম।

    রানী দেবী বসেছেন ওঁর পাশের সীটে। ‘আইল্’-এর দিকে। একটু ধমকের সুরে বলেন, সারাটা পথই তো তুমি কাগজ পড়লে আর ‘থিংক’ করলে! তাহলে জানলার ধারে বসা কেন বাপু?

    —আয়াম সরি। তা বলেই পারতে। জানলার ধারের সীটটা তোমাকেই ছেড়ে দিতাম।

    —কিন্তু কী এত ভাবছ তখন থেকে?

    অমায়িক হাসলেন বাসু-সাহেব। বলেন, তুমি শুনলে রাগ করবে রানু। আমি ভূস্বর্গে এসেও ধান ভান্‌ছি।

    —ধান ভান্‌ছ? মানে?

    —কালপেবল হোমিসাইড’ না ‘ডেলিবারেট মার্ডার’?

    খবরের কাগজটা বাড়িয়ে ধরেন উনি। রানী দেবী হাসবেন না কাঁদবেন ভেবে পেলেন না। সে যাই হোক কাগজটা দেখবার সময় হল না। ইতিমধ্যে আকাশযান ভূমিস্পর্শ করেছে।

    এয়ার হস্টেকে বলাই ছিল। ওঁরা অপেক্ষা করলেন। শেষ যাত্রীটি নেমে যাবার পর এয়ার হস্টেস্ এসে জানালো, ব্যবস্থা হয়ে গেছে। বাসু-সাহেব আর কৌশিক ধরাধরি করে রানী দেবীকে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে আনলেন। ততক্ষণে হুইল-চেয়ারটা সিঁড়ির নিচে লাগানো হয়েছে। রানী দেবীকে তাতে বসিয়ে ওঁরা চারজন টারমিনাল বিল্ডিং-এর দিকে চলতে থাকেন। কৌশিক বলে, মামু, আপনি লাগেজগুলো সংগ্রহ করুন। আমি ততক্ষণে বরং খোঁজ নিয়ে দেখি কোথায় থাকার ব্যবস্থা করা যায়।

    রানী বলেন, এখানে কী খোঁজ নেবে? তুমি বরং একটা ট্যাক্সি ধর। চল সবাই মিলে টুরিস্ট রিসেপশন সেন্টারে যাই। আমি আর সুজাতা সেখানে মালপত্র পাহারা দেব। আর তোমরা দুজনে হোটেল কিম্বা হাউসবোট ঠিক করে আসবে।

    সুজাতা আসছিল পিছন পিছন। বলে, হোটেল নয়, রানুমামী। হাউসবোট। মামু কী বলেন? শ্রীনগরে এসেও হোটেল?

    বাসু-সাহেব বলেন, আমার মতামত যদি জানতে চাও সুজাতা, তাহলে আমি বল্‌ হাউসবোটও নয়, হোটেলও নয়। এখান থেকে ট্যাক্সি নিয়ে সো-জা চলে যাব কোনও নির্জন জায়গায়। যাকে বলে, ‘ফার ফ্রম দ্য ম্যাডিং ক্রাউড’।

    —পহলগাঁও কিম্বা গুলমার্গ?—কৌশিক তার ভূগোলের জ্ঞানের পরিচয় দেয়।

    বাসু মাথা নাড়েন, উঁহু। ওসব জায়গাতেও ট্যুরিস্টদের গাদাগাদি। আমি চাইছিলাম—নিতান্ত নির্জন একটা পরিবেশ। পাইন-বার্চ-ওকের মাঝখানে, কাছেই নদী, সলিটারী লগ্‌-কেবিন বলতে যা বোঝায়। যেমন ধর, ‘ট্রাউট-প্যারাডাইস্’!

    কৌশিক অবাক হয়ে বলে, ট্রাউট-প্যারাডাইস’! সেটা আবার কোথায়? নামও তো শুনিনি কখনও।

    —কাল রাত পর্যন্ত নামটা আমিও জানতাম না। আজ সকালে জেনেছি। ‘ট্রাউট-প্যারাডাইস্’ হচ্ছে লীডার নদীর ধারে একটা গ্রাম। রিটুইন অৰ্চ্চাবল অ্যান্ড কোকরনাগ। সেখানে ছোট ছোট লগ্‌-কেবিন ভাড়া পাওয়া যায়। ফার্নিশড কেবিন। ইলেক্‌ট্রসিটি আছে, টেলিফোন আছে। ‘অ্যাংলার’রা এই সিজনে সেখানে যায় ট্রাউট মাছ ধরতে। গ্র্যান্ড আইডিয়া, ‘মাছ মারব খাব ভাত!” ব্যস্!

    —কিন্তু এত সব তথ্য কোথায় সংগ্রহ করলেন রাতারাতি?

    বাসু-সাহেব জবাব দেবার সুযোগ পেলেন না। ইতিমধ্যে ওঁরা পায়ে পায়ে টার্মিনাল বিল্ডিংস-এ এসে পৌঁছেছেন। মালপত্র এখনও প্লেনের গর্ভ থেকে খালাস হয়ে আসেনি। যাত্রীরা ‘বেল্ট-কেরিয়ার’ ঘিরে একসার জিরাফে পরিণত। কৌশিক হঠাৎ বললে, এ কী! আপনার নাম অ্যানাউন্স করছে না?

    তিনজনেই উৎকর্ণ হয়ে ওঠেন। না, ভুল শোনেনি কৌশিক। লাউড-স্পিকারে ঘোষিত হচ্ছে, ইংরাজীতে : অ্যাটেনশান্ প্লিজ! মিস্টার পি. কে. বাসু বার-অ্যাট-ল। আপনাকে অনুরোধ করা হচ্ছে আপনি যেখানেই থাকুন ইন্ডিয়ান এয়ার-লাইন্স কাউন্টারে চলে আসুন। সেখানে মিস্টার এস. পি. খান্না আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। থ্যাঙ্কু!

    কৌশিক একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, এস. পি. খান্না? চেনেন?

    বাসু বলছেন, চাক্ষুষ পরিচয় নেই। তবে নামটা জানি। আর লং-লেগ বাউন্ডারীতে লোকটা কেন দাঁড়িয়ে আছে তা-ও আন্দাজ করতে পারছি…

    —লং-বাউন্ডারী মানে?

    —রানু একটা ওভার বাউন্ডারী হাঁড়েছে—পুজোর ছুটিতে আমার গোয়েন্দাগিরি বন্ধ! আর ঐ বাইশ বছরের ছোকরা বাউন্ডারী ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আমাকে কপাৎ করে লুফে নেবে বলে!

    কৌশিক না বুঝলেও রানু দেবী ধরতাইটা ঠিকই ধরেছেন। বলেন, তার মানে তোমার ক্লায়েন্ট? তাই এক কথাতেই শ্রীনগরে আসতে রাজি হয়ে গেলে! নয়?

    বাসু পাইপ ধরাবার উপক্রম করছিলেন। হঠাৎ ঝুঁকে পড়ে বলেন, বিশ্বাস কর রানু, এই পাইপ ছুঁয়ে বলছি—লোকটা আমার ক্লায়েন্ট নয়। তাকে আমি জীবনে কখনও দেখিনি, কথাবার্তাও হয়নি কখনও। বস্তুত কাল রাত পর্যন্ত তার নামই জানতাম না।

    রানু দেবী ঝাঁঝিয়ে ওঠেন, মায়ের কাছে মাসির গপ্পো! তোমাকে চিনতে বাকি আছে নাকি আমার? যাকে দেখনি, যার সঙ্গে জীবনে কথা বলনি, যার নামটা পর্যন্ত জানো না, তার বয়স ‘বাইশ’ তুমি কেমন করে জানলে?

    —পিওর ডিডাক্‌শান! বুঝিয়ে বললে সহজেই বুঝবে। তবে একটু অপেক্ষা কর। লোকটাকে বিদায় করে আসি। ভয় নেই রানু, কথা যখন দিয়েছি তখন এ ছুটির মধ্যে ওসব ঝামেলায় নিজেকে জড়াব না।

    অন্যমনস্কের মতো পাউচ থেকে টোব্যাকো নিয়ে পাইপে ভরতে ভরতে বাসু-সাহেব ইন্ডিয়ান এয়ার-লাইন্স-এর কাউন্টারের দিকে এগিয়ে এলেন।

    দূর থেকেই নজর হল কাউন্টার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে একজন অল্পবয়সী ভদ্রলোক। বয়স সম্বন্ধে বাসু-সাহেব যা আন্দাজ করেছিলেন, দেখা গেল তা নির্ভুল। বছর বাইশ-তেইশ বলেই মনে হয়। থ্রি-পিস্ ডার্ক-গ্রে স্যুট। গলায় একটা কালো টাই। মাঝারি গড়ন, স্বাস্থ্যবান। গোঁফ-দাড়ি কামানো। বাঁ-হাতের অনামিকায় ওটা বোধ হয় পোখরাজ নয়, হীরে। নিখুঁত সাজ-পোশাক সত্ত্বেও সে কেমন যেন নিষ্প্রভ। একটা আন্তর-বিষণ্ণতা যেন ঢেকে রেখেছে তার আপাত চাকচিক্য।

    বাসু-সাহেব আর একটু অগ্রসর হতেই ছেলেটি এগিয়ে আসে। ডান হাতখানা বাড়িয়ে দিয়ে সপ্রতিভ ভাবে বলে, মিস্টার. পি. কে. বাসু?

    বাসু ওর করগ্রহণ করে বলেন, ইয়েস, মিস্টার খান্না। বাট হাউ অন আর্থ কুড য়ু নো দ্যাট আয়াম কামিং বাই দিস্ ফ্লাইট?

    ছেলেটি ইংরেজীতে বললে, একটা অত্যন্ত জরুরী প্রয়োজনে কাল রাত্রে ক’লকাতায় আপনার চেম্বারে ট্রাঙ্ক–কল করেছিলাম। সেই সূত্রেই জেনেছি, আপনি এই ফ্লাইটে দিল্লি থেকে আসছেন। এয়ারপোর্টে আপনাকে ধরতে না পারলে খুব মুশকিল হত। কারণ যিনি টেলিফোন ধরেছিলেন তিনি বলতে পারলেন না-আপনি এখানে কোথায় উঠছেন। তা আগে বরং সেই কথাটাই জেনে নিই। কোথায় উঠছেন আপনারা? হোটেলে না হাউসবোটে?

    বাসু-সাহেবের জবাব দিতে একটু দেরি হল। পাইপটা ধরিয়ে নিতে যেটুকু সময় লাগে আর কি। তারপর বললেন, আপনি আমাকে মাপ করবেন মিস্টার খান্না। আমি এখানে সপরিবারে বেড়াতে এসেছি। আপনার কেসটা আমি নিতে পারছি না।

    খান্না ম্লান হাসল। বল্ল, চাক্ষুষ আপনাকে কখনও না দেখলেও আপনার অনেক কীর্তি-কাহিনী আমার জানা। সুতরাং আমি অবাক হইনি। আপনি ঠিকই ধরেছেন। একটা জটিল কেস্-এ আপনার সাহায্যপ্রার্থী হতে চাই বলেই আমি ট্রাঙ্ক-কলে আপনাকে ধরতে চেয়েছিলাম। আর আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কেসটা কী জাতের শোনার পর আপনি আপত্তি করতে পারবেন না।

    বাসু মাথা নেড়ে বললেন, ওটাও আপনার ভুল ধারণা। কেসটা আমার অজানা নয়। ‘ট্রাউট-প্যারাডাইস’-এর রহস্য তো?

    এবার বিস্মিত হবার পালা ও-পক্ষের। বাসু-সাহেবের প্রথম প্রশ্নটি এতক্ষণে সে এ-কোর্টে ফিরিয়ে দিল : হাউ অন আর্থ কুড য়ু নো দ্যাট, স্যার?

    —খুব সহজে। আজ সকালের ‘কাশ্মীর টাইম্‌স্‌’-এ আপনার পিতৃদেবের হত্যার খবরটা ছাপা হয়েছে। আপনার নামটাও কাগজে আছে। প্লেনে সেই বিবরণটা পড়তে পড়তে এসেছি। ইয়েস, আই অ্যাডমিট—ইটস্ অ্যান ইন্টারেস্টিং—এক্সীডিংলি ইন্টারেস্টিং কেস! কিন্তু—আমাকে মাপ করতে হবে, এই মুহূর্ত আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত নই।

    খান্না সবিনয়ে বললে, স্যার, কাগজে যেটুকু বার হয়েছে তাতেই যদি আপনার মনে হয়ে থাকে কেসটা অত্যন্ত আকর্ষণীয়, তাহলে আমি সুনিশ্চিত যে, কেসটা আপনাকে নিতে হবে। কারণ দু-দুটি অবিশ্বাস্য রকমের ‘ব্লু’-র সন্ধান আমি রাখি, যা কাগজে ছাপা হয়নি। সে দুটি শোনার পর…অল রাইট, স্যার। ওসব কথা পরে হবে। আপাতত বলুন, কোথায় উঠবেন?

    বাসু বলেন, ঠিক করা নেই কিছু। হঠাৎ পূজার ছুটিতে সকলে মিলে চলে এসেছি। এবং মিসেস্ বাসুকে কথা দিয়েছি—ছুটির এই কটা দিন আমি কোনও কেস নেব না।

    —আই সি! আপনারা কজন আছেন?

    —আমাকে নিয়ে চারজন। কেন?

    খান্না একটু ভেবে নিয়ে বললে, অলরাইট স্যার। আমি একটা প্রস্তাব দিচ্ছি। দেখুন, আপনি তাতে রাজি হতে পারেন কি না।

    কী প্রস্তাব?

    আমাদের একটা হাউসবোট আছে। ‘ঝিলাম কুইন’। ডিলাক্স ক্লাস। দুটো ডল্‌-বেড রুম, ড্রইং অ্যান্ড ডাইনিং। আপনাদের অসুবিধা হবে না। ঠাণ্ডা-গরম জল পাবেন, অ্যাটাচড বাথ্, ইলেকট্রিসিটি আছে, টেলিফোন আছে। কুক আছে, বেয়ারা আছে।

    —দৈনিক ভাড়া কত?

    ম্লান হাসল ছেলেটি। বললে, স্যার, ওটা আমরা কখনও ভাড়া দিইনি। বস্তুত ওটা আমাদের বাড়ির গেস্ট রুম। আমাদের পরিবারের বন্ধুরা এলে ওখানেই ওঠেন। আপনার সঙ্কোচ করার কিছুই নেই

    মাথা নাড়েন বাসু-সাহেব। বলেন, তা হয় না। আমি আপনার হাউসবোটটা নিতে চাই, এবং কেসটা নেব না। এ-ক্ষেত্রে আপনি যদি ন্যায্য ভাড়া না নেন, তাহলে আমি কেমন করে রাজী হই?

    এক কথায় ফয়সালা করে দিল ছেলেটা–বেশ তো, ভাড়া দেবেন। বাজার দর অনুযায়ী যা ন্যায্য ভাড়া হওয়া উচিত তাই দেবেন আমাকে। আমি মাথা পেতে নিয়ে

    নেব।

    —আপনি তাতে ক্ষুব্ধ হবেন না?

    —বিন্দুমাত্র না। কারণ আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর কেসটা আপনি নিতে বাধ্য হবেন…আপনি ওখানে উঠুন। গুছিয়ে নিয়ে বসুন। ঘণ্টাদুয়েক পরে আমি আসব। আমার কেসটা শোনাব—হ্যাঁ, মিসেস বাসুকেও। তারপর যদি কেসটা না নিতে চান, নেবেন না। ন্যায্য ভাড়া দিয়ে ছুটির শেষে কলকাতায় ফিরে যাবেন। এগ্রীড?

    — এগ্রীড!

    —থ্যাঙ্কু স্যার। মালপত্র নিয়ে বাইরে আসুন। আমার গাড়িতে পৌঁছে দেব।

    বাসু-সাহেব ফিরে এসে দেখলেন ইতিমধ্যে কৌশিক মালপত্র সনাক্ত করে ছাড়িয়েছে। ওঁর জন্যে অপেক্ষা করছি সকলে। কৌশিক বলে, তাহলে কী স্থির হল? এখান থেকে সোজা টুরিস্ট রিসেপশান সেন্টারে যাবো তো?

    —না। আমি ইতিমধ্যে হাউসবোট বুক করে ফেলেছি। ‘ঝিলাম কুইন’। দুটো ডবল্-বেডের রুম আছে। অসুবিধা হবে না কিছু

    কৌশিক বলে, একবার না দেখেই অ্যাডভান্স করে দিলেন? শুনেছি, এখানে দরদাম করলে ভাড়া অনেক কমে যায়।

    —তা হয়তো যায়। কিন্তু এটা একটা শৌখিন হাউসবোট। ভাড়া দেওয়া হয় না। আমরা হয়তো গেস্ট হিসাবে—

    রানী দেবী ওঁকে মাঝপথে থামিয়ে দেন, থাক, আর কৈফিয়ত দিতে হবে না। আমরা বুঝেছি। হাউসবোটের মালিক ঐ মিস্টার খান্না তো?

    বাসু-সাহেব হেসে ওঠেন, সবাই গোয়েন্দা হলে আমরা যাই কোথায়? একটা সুটকেস উঠিয়ে নিয়ে বললেন, চল যাওয়া যাক। বাইরে গাড়ি অপেক্ষা করছে।

    বেরিয়ে আসতেই খান্না এগিয়ে এসে নমস্কার করল। বাসু-সাহেব তার সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দিলেন। মালপত্র উঠিয়ে দেওয়া হল গাড়িতে। প্রকাণ্ড স্টেশন-ওয়াগন পিছনের ডালাটা খুলে দেবার পর রানী দেবীর হুইল চেয়ারটা অনায়াসে স্থান পেল কেরিয়ারে।

    হাউসবোটটা চমৎকার। অপছন্দ হবার কথা নয়। আসবাব-পত্র অবশ্য একটু সেকেলে ধরনের—মিড-ভিক্টোরিয়া যুগের। তা হ’ক, আধুনিক জীবনযাত্রার যাবতীয় উপকরণই উপস্থিত। ড্রইংরুমে প্রকাণ্ড একটা আয়না। সোফা-সেট, সেন্টার-টেব্‌ল্। তারপর ডাইনিং রুম। সেটা পার হলে একটা চওড়া গলিপথ। রানী দেবীর হুইল চেয়ারটা সে গলিপথে অনায়াসে চলবে। তার দুদিকে দুটি বেড-রুম। সংলগ্ন স্নানাগার। হাউসবোটের পিছনে বাঁধা আছে আর একটি ছোট নৌকা। সেটা রান্নাঘর ও ঠাকুর চাকরদের বাসস্থান। ঝিলাম- নদী যেখানে ডাল লেক-এ গিয়ে মিশেছে প্রায় তার কাছাকাছি হাউসবোটটা নোঙর করা

    আভূমি নত হয়ে আদাব জানালো ‘কেয়ার-টেকার কাম-কুক’ খোদাবক্স। ধবধবে সাদা দাড়ি। মাথায় কাজকরা সাদা গোল টুপি। পরনে একটা জোব্বা মতো পোশাক। মনে হল, যেন মোঘল-পেন্টিং-এর কোন মূর‍্যাল থেকে হাউসবোটে নেমে এসেছে। ওর পিছনেই দাঁড়িয়েছিল একটি অল্পবয়সী ছোকরা—ওরই নাতি। সেও সেলাম করল আগন্তুকদের দেখে।

    খান্না ওদের জিম্মাদারী বুঝিয়ে দিল কেয়ারটেকারকে। বললে, খোদাবক্স, এঁরা কলকাতা থেকে আসছেন। আমার মেহমান। ঠিকমত দেখভাল কর। যেন তোমার হাউসবোটের বদনাম না হয়ে যায়।

    খোদাবক্স পুনরায় মোঘলাই কায়দায় আদাব জানিয়ে বললে, বে-ফিকর রহিয়ে সাব! তারপর একটু ইতস্তত করে উর্দুতে জিজ্ঞাসা করল, কাল সব মিটতে কত রাত হল হুজুর?

    —রাত প্রায় কাবার হয়ে গিয়েছিল।

    খোদাবক্স পুনরায় মাথা নেড়ে সখেদে বললে, আজব এ দুনিয়া! কোথা থেকে কী যে হয়ে গেল!

    খান্না আর কথা না বাড়িয়ে বাসু-সাহেবের দিকে ফিরে বললে, আপনারা বিশ্রাম করুন। আমি ঘণ্টাদুয়েক পরে আবার আসব।

    ফিরতে গিয়েও আবার থেমে পড়ে বলে, মিস্টার বাসু, মানসিক প্রস্তুতি আমারও এখন নেই। কিন্তু ভেঙে পড়লে তো চলবে না। যা করার তাড়াতাড়িই তো করতে হবে? বাসু-সাহেব ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, তা তো বটেই। কিন্তু খোদাবক্স আপনাকে কী জিজ্ঞাসা করল বলুন তো? কাল রাত্রে কোথা থেকে ফিরতে অত রাত হল আপনার?

    ম্লান হাসল খান্না। অস্ফুটে বললে, শ্মশান থেকে। এমনিতেই এক সপ্তাহ পার হয়ে গিয়েছিল। পচন শুরু হয়ে গিয়েছিল আর কি—

    বাসু ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, থাক ওসব কথা। আপনি ঘণ্টাদুয়েক পরেই আসবেন। কেসটা নিই বা না নিই, কিছু পরামর্শ আপনাকে দিতে পারব নিশ্চয়ই।

    খান্না চলে যেতেই সকলে ওঁকে ঘিরে ধরে : ব্যাপারটা কী?

    বাসু বললেন, তোমরা বিশ্রাম করবে না? কাহিনীটা বলতে অনেক সময় লাগবে। সুজাতা বলল, বিশ্রাম করার আবার কী আছে? এলাম তো প্লেনে। ঢুলতে ঢুলতে। আপনি এখনই শুরু করুন। আমি বরং খোদাবক্সকে বলি চার কাপ কফি বানাতে।

    বাসু বলেন, বল। তবে আমারটা ব্ল্যাক-কফি। ওকে বলে দিও। আর জিজ্ঞাসা করে দেখ তো, হাউসবোটে খবরের কাগজ রাখা হয় কিনা? আজকের ‘কাশ্মীর টাইম্‌স্‌’ পাওয়া যাবে?

    তেরই সেপ্টেম্বর, অর্থাৎ সেদিনের সংবাদপত্র সহজেই সংগ্রহ করা গেল। তার প্রথম পৃষ্ঠাতে খবরটা ফলাও করে ছাপা হয়েছে—কারণ সূরযপ্রসাদ খান্নার স্বর্গগত পিতৃদেব এ শহরের একজন বিশিষ্ট নাগরিক ছিলেন। ওঁর কোনও ছবি ছাপা হয়নি বটে তবে যে লগ-কেবিনে ওঁর মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে তার একটি আলোকচিত্র আছে। প্রথম পৃষ্ঠা থেকে সংবাদটা পঞ্চম পৃষ্ঠায় উপচিয়ে পড়েছে। তাছাড়া পঞ্চম পৃষ্ঠায় সূরপ্রসাদের একটা ইন্টারভিয়ুও ছাপা হয়েছে। পত্রিকার নিজস্ব সংবাদদাতা দুঃসংবাদটা এমনভাবে সাজিয়েছেন যাতে একটা মানবিকতার আবেদন ফুটে উঠেছে। সংবাদের চুম্বকসার এই রকম :

    নিহত মহাদেও প্রসাদ খান্না এ অঞ্চলের একজন প্রখ্যাত ব্যক্তি। জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত। ‘কাশ্মীর-ভ্যালী ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড অটোমোবাইল্স্’-এর স্বত্বাধিকারী। তিনি প্ৰাক্তন এম. পি. ও বটে। ইদানীং তিনি রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। পর পর দুটি ইলেক্‌শনে নির্বাচনপ্রার্থী হননি। অথচ সাধারণ লোকের ধারণা তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হলে অনায়াসেই নির্বাচিত হতে পারতেন। বস্তুত বছর দুই হল তাঁর চরিত্রে একটা বিচিত্র পরিবর্তন লক্ষিত হয়েছে। ব্যবসায় সংক্রান্ত কাজকর্ম তিনি ইদানীং বড় একটা দেখতেন না। পুত্র সূরযপ্রসাদ বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পর সব দায়ঝক্কি তার স্কন্ধেই অর্পণ করেছিলেন! অথচ অবসর নেবার মত এমন কিছু বয়সও তাঁর হয়নি। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ছেচল্লিশ, যে বয়সে অনেকেই নতুন উদ্যমে নতুন ব্যবসায় নামে।

    বছর দুই হল খেয়ালী প্রৌঢ় মানুষটি শুধু হিমালয়ের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন। দাক্ষিণাত্যে যাননি, ভারতের বাইরেও নয়। শুধু মাত্র হিমালয়ের দক্ষিণ সীমান্ত বরাবর পূর্ব-পশ্চিমে পরিক্রমা করেছেন। তাঁর চিঠিপত্র মাঝে মাঝে আসত—কখনও কুলু-মানালী থেকে, কখনও কেদারবদ্রীর বিভিন্ন চটি থেকে, কখনও বা সাণ্ডাকপু-ফালুট অঞ্চল থেকে। তিব্বত এবং নেপালের বহু অঞ্চলে তিনি এই দু’বছরে ঘুরেছেন। যখন যে অঞ্চলে যেতেন তখন সেখানকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশবার চেষ্টা করতেন! সাধারণ পোশাকে; যাতে কেউ না বুঝতে পারে তিনি লক্ষপতি! ওদের সব-দুঃখের গল্প শুনতেন—ছবি আঁকতেন, ওদের লোক-সঙ্গীত সংগ্রহ করতেন। কখনও বা নির্জন পাইন বনে বসে থাকতেন বাইনোকুলার হাতে। ছড়িয়ে দিতেন পাঁউরুটি অথবা বিস্কুটের টুকরো। দেখতেন আরণ্যক প্রাণীদের—কাঠবড়ালী, খরগোশ আর বিচিত্র পাখিদের সন্ত্রস্ত আহার সংগ্রহের প্রচেষ্টা।

    পুত্র শ্রীসূরযপ্রসাদ খান্না পত্রিকার নিজস্ব সংবাদদাতাকে বলেছিলেন, মহাদেবের এই চারিত্রিক বিবর্তনের মূলে আছে নাকি তাঁর ছোট ভাই প্রীতমপ্রসাদ খান্না। তিনি যৌবনের প্রারম্ভেই সংসার ত্যাগ করেন। সন্ন্যাস নেননি—কিন্তু ভবঘুরের জীবন যাপন করে এসেছেন এতদিন। প্রীতিমপ্রসাদ যখন সংসার ত্যাগ করেন, তখনও ওঁদের পিতৃদেব জীবিত। তিনি তাঁর দুটি সন্তানকেই সমানভাবে সম্পত্তির অধিকার দিয়ে যান; কিন্তু প্রীতম বন্ধনমুক্ত থাকার প্রেরণায় সব কিছু পুনরায় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকেই লিখে দেন, সামান্য মাসোহারার বিনিময়ে। প্রথম দিকে মাঝে মাঝে তিনি এঁদের সংসারে আসতেন, দু-চারদিন থেকে আবার ফিরে যেতেন তাঁর অজ্ঞাত আবাসে। হয়তো মহাদেওয়ের সংগে তাঁর একটা যোগাযোগ ছিল, পত্র বিনিময়ে, সুরষ সে খবর জানত না।

    সংবাদে প্রকাশ, এ বছর ‘ট্রাউট-প্যারাডাইস্’-এর সিজন শুরু হয়েছে মঙ্গলবার ছয়ই সেপ্টেম্বর। ‘মৎস্য ও বন্যপ্রাণী মন্ত্রক’ প্রতি বছরই ঘোষণা করেন কবে থেকে ট্রাউট মাছ ধরা যাবে। জুলাই অগস্টে মাছেরা ডিম পাড়ে—তাই সে সময় মাছ ধরা বে-আইনি। প্রতি বছরের মতো এ বছরও মহাদেও প্রসাদ পনেরই অগস্ট থেকে একটি লগ্‌-কেবিন বুক করেন; যাতে সিজনের উদ্বোধন দিবস থেকেই তিনি ঐ নির্জনাবাসে থাকতে পারেন। মৃতদেহ আবিষ্কারের পরে পুলিস ‘সারকাস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স’ থেকে সিদ্ধান্তে এসেছেন, মহাদেওপ্রসাদ সোমবার পাঁচই সেপ্টেম্বর বিকালে ঐ লগ-কেবিনে আসেন। সকাল-সকাল স্বপাক আহার সেরে শয্যাগ্রহণ করেন। পরদিন অর্থাৎ উদ্বোধনের দিন যাতে সূর্যোদয় মুহূর্ত থেকেই মাছ ধরা শুরু করা যায়, তাই তিনি ‘অ্যালার্ম ক্লকে’ সাড়ে পাঁচটায় দম দিয়ে শুয়ে পড়েন। পরদিন তিনি শয্যাত্যাগ করেন, প্রাতঃকৃত্য সেরে প্রাতরাশ তৈরি করেন এবং আহার করেন। তারপর মাছ ধরার সরঞ্জাম নিয়ে নদীর ধারে চলে যান। দৈনিক যতটা মাছ ধরার অনুমতি আছে দুপুরের আগেই সেই পরিমাণ মাছ ধরে তিনি কেবিনে ফিরে আসেন। তার কিছু পরেই—ঠিক কতটা পরে সেটাও পুলিস বিভিন্ন যুক্তির মাধ্যমে আন্দাজ করতে পারছে—আততায়ীর গুলিতে মহাদেও নিহত হন! অর্থলোভ হত্যার কারণ হতে পারে না—কারণ মহাদেও-এর মানিব্যাগে প্রায় শ-তিনেক টাকা ছিল এবং সুটকেসে ছিল সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। অনুমান করা যায়, মাত্র তিন-চার ফুট দূরত্ব থেকে আততায়ী একসঙ্গে দুটি গুলি করে—কারণ মৃতদেহে পাশাপাশি দুটি ক্ষতচিহ্ন প্রমাণ দিচ্ছে কী ভাবে হৃৎপিণ্ড বিদীর্ণ হয়েছিল। পিস্তলটা মৃতদেহের অদূরে আবিষ্কৃত হয়েছে।

    রুদ্ধদ্বার কক্ষে মহাদেও প্রসাদের আদরের পাহাড়ী ময়নাটিকে অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে। মহাদেও যখনই যেখানে যেতেন এই পোষা ময়নাটিকে নিয়ে যেতেন।

    লগ্‌-কেবিনটা বেশ নির্জনে। যে পাহাড়ী পাকদণ্ডী পথটা পাহাড়কে বেষ্টন করে চলে গেছে, তার থেকে অন্তত তিনশ’ মিটার দূরে। ঐ রাস্তায় মোটর গাড়ি যেতে পারে, তবে সারাদিনে খুব বেশি গাড়িঘোড়া ও-পথে যায় না। নিকটতম লগ্-কেবিনটিও এতদূরে যে পিস্তলের শব্দ সেখানে পৌঁছাবে না।

    দিনের পর দিন ঐ পাকদণ্ডী পথ বেয়ে মানুষজন চলাফেরা করেছে, অন্যান্য লগ্-কেবিনের বাসিন্দাও হয় তো ঐ রুদ্ধদ্বার কামরার সামনে দিয়ে চলাফেরা করেছে। তারা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি, অর্গলবদ্ধ গৃহের ভিতর পড়ে আছে একটি মৃতদেহ।

    প্রায় পাঁচদিন পরে—এতদিনে প্রায় প্রত্যেকটি কেবিনই ভর্তি হয়ে গেছে—একজনের খেয়াল হল, ঐ ঘরটা থেকে একটা পাহাড়ী ময়না ক্রমাগত কর্কশ স্বরে ডাকছে। কৌতূহলী হয়ে তিনি সদর দরজায় ‘নক’ করলেন, দেখলেন সেটা তালাবন্ধ। ভিতর থেকে কেউ সাড়া দিল না। দরজায় গা-তালা আছে, ইয়েল-লক। দুদিক থেকেই বন্ধ করা যায়। ওঁর মনে হল, এই কেবিনের গৃহস্বামী হয়তো শহরে গিয়ে কোনও কারণে আটকা পড়েছেন—তাই অভুক্ত ময়নাটা অমন তারস্বরে প্রতিবাদ করছে। কৌতূহলী হয়ে উনি জানলা দিয়ে ভিতরে উঁকি দিলেন। শুধু ময়নাটিকেই নয়, তিনি ঐ কেবিনের মেঝেতে এমন কিছু দেখলেন যাতে তৎক্ষণাৎ ছুটতে ছুটতে ফিরে গেলেন পুলিসে খবরটা জানাতে।

    হত্যাকারী যতই নিষ্ঠুর হ’ক তার অন্তরের একটি প্রান্তে ছিল কিছু শুভবুদ্ধি। নিজস্ব সংবাদদাতা এখানে একটু কাব্য করে লিখেছেন : ‘লেডি ম্যাকবেথের মত পিশাচীর অন্তরে যদি একটি কন্যা-হৃদয় লুকিয়ে থাকতে পারে, তাহলে হত্যাকারীর অন্তরেও একটি প্রাণী-দরদী থাকতে পারবে না কেন?’ সে যাই হোক, দেখা গেল—যাবার আগে লোকটা ঐ ময়নার খাঁচার দরজাটা খুলে রেখে গেছে। একটি পাত্রে কিছু জল এবং যথেষ্ট পরিমাণ থিন এ্যারারুট বিস্কুট মেঝেতে ফেলে রেখে গেছে।

    দীর্ঘ বিবৃতিটা পাঠ করে বাসু-সাহেব বলেন, এই সংবাদটাই প্লেনে পড়তে পড়তে এসেছি। তাই লাউড-স্পিকারে যেইমাত্র শুনলাম আমার সঙ্গে জনৈক এস. পি. খান্না দেখা করতে চান, তখনই বুঝলাম তার উদ্দেশ্যটা কী। এখন তোমরা বল, কেসটা আমি নেব, না নেব না?

    তিনজনের কেউই জবাব দিচ্ছেন না দেখে বাসু-সাহেব বলেন, তাহলে আর একটু বিশ্লেষণ করে বলি—কেসটা নিলে আমি ওতঃপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ব গুলমার্গ-পহেলগাঁও-উলার লেক বাদ যাবে। অবশ্য তোমরা তিনজনে ঘুরে আসতে পার। রানী দেবী বললেন, বেশ তো, আগে শুনেই দেখ না সূরযপ্রসাদ কী বলে। সবটা শুনে তারপর আমরা রায় দেব, কী বল সুজাতা?

    —আমি একমত।—সুজাতা বললে।

    অনতিবিলম্বেই ফিরে এল সূরযপ্রসাদ। গুছিয়ে নিয়ে বসল একটা সোফায়। রানী দেবী বললেন, তোমরা কথা বল, আমরা ভিতরে গিয়ে বসছি।

    সূরয চট করে দাঁড়িয়ে উঠল। হাত দুটি জোড় করে বলল, তার কোনও প্রয়োজন নেই। মিস্টার বাসু যদি কেসটা নেন তাহলে হয়তো ‘সুকৌশলী’কেও কাজে নেমে পড়তে হবে। তাছাড়া আমি এমন কিছু গোপন কথা বলছি না যাতে আপনাদের উঠে যেতে হয়। বাসু-সাহেব পকেট থেকে পাইপ আর পাউচ বার করে বলেন, ঠিক আছে, শুরু করুন।

    —’করুন’ নয়, ‘কর’। আপনি আমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়।

    —ঠিক আছে। শুরু কর।

    —ঠিক কোথা থেকে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। আপনি খবরের কাগজে প্রকাশিত সংবাদটা তো পড়েছেন। সুতরাং আপনি প্রশ্ন করুন, আমি একে একে জবাব দিয়ে যাই।

    বাসু-সাহেব পাইপটা ধরিয়ে নিয়ে বললেন, আমার প্রথম প্রশ্ন, তুমি আমার কাছে কী জাতের সাহায্য চাইছ?

    —অনেক কিছুই। প্রথম কথা, আমার বাবার হত্যাকারীকে খুঁজে বার করতে হবে। কে—কেন কী-ভাবে এটা করল আমাকে জানতে হবে। দ্বিতীয় কথা, হত্যাকারী আমার স্বর্গত পিতৃদেবের চরিত্রহনন কেন করতে চাইল সেটা আমাকে বুঝে নিতে হবে! তৃতীয় কথা, আমি চাই—আপনি আমার বিমাতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করুন। এমন ব্যবস্থা করুন যাতে তিনি আমাদের ‘কাশ্মীর ভ্যালী ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড অটোমোবাইল’-টাকে ডকে তুলে দিতে না পারেন। আমার দৃঢ় ধারণা, পিতৃদেব সম্প্রতি একটি উইল করেছিলেন—আমাকে তিনি স্বমুখেই সে কথা বলেছিলেন, যদিও আমি জানি না, উইলে তিনি কাকে কী দিয়ে গেছেন; তবু আমার দৃঢ় ধারণা কোম্পানীর যাবতীয় দায়-দায়িত্ব, দেনা-পাওনা আমাকেই দিয়ে গেছেন। এই উইলটি আমি এখনও খুঁজে পাইনি। আমাদের যিনি সলিসিটার তাঁর কাছে নেই। বাড়িতেও খুঁজে পাইনি। অবশ্য দুটি জায়গা এখনও খুঁজে দেখতে পারিনি-বাড়িতে একটা সিন্দুকে উনি দরকারী কাগজপত্র রাখতেন, তার একটি চাবি তাঁর কাছে ছিল, ডুপ্লিকেট থাকে ওঁর প্রাইভেট সেক্রেটারীর কাছে। সেটি দেখা হয়নি। দ্বিতীয়ত ব্যাঙ্ক অব্ ইন্ডিয়াতে বাবার ও আমার অ্যাকাউন্ট আছে, ঐ ব্যাঙ্কের ভল্টে তিনি স্বনামে একটি লকারও রেখেছেন। সেটাও দেখা হয়নি। এ দু-জায়গায় যদি না থাকে, তবে আমার আশঙ্কা—আমার বিমাতা সেটা হস্তগত করেছেন এবং নষ্ট করে ফেলেছেন।

    বাসু বললেন, তুমি তোমার বিমাতাকে পছন্দ কর না, নয়?

    —‘পছন্দ করি না’ বলে সত্যের অপলাপ হয়। ঘৃণা করি। —কী নাম তোমার বিমাতার, কোথায় আছেন তিনি?

    —ওঁর নাম ‘সুরমা দেবী’। শ্রীনগরেই আছেন। একটি হোটেলে। বস্তুত ছয় অথবা সাত তারিখে তিনি এবং জগদীশ দিল্লি থেকে এখানে এসেছেন, কিন্তু ইদানীং ওঁরা এ বাড়িতে ওঠেন না; শ্রীনগরে যে কদিন থাকেন হোটেলেই থাকেন। শ্রীনগরে পৌঁছেই তিনি আমাকে ফোন করেন, পিতাজী এবং চাচাজীর খোঁজ করেন, প্র্যাকটিক্যালি প্রতিদিনই খোঁজ করে চলেছেন। তাঁকে দুর্ঘটনার কথা বলেছি, আজকালের মধ্যেই তিনি আমাদের বাড়িতে আসবেন।

    —কী আশ্চর্য! এখনও তাঁর সঙ্গে তোমার দেখা হয়নি?

    —না। এই খবরও পেয়েও তিনি আসেননি। আমারও রুচি হয়নি হোটেলে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করার।

    —কতদিন হল তিনি মহাদেও প্রসাদকে বিবাহ করেন?

    —বছর তিনেক। আমার মা ছিলেন চিররুগ্না। দীর্ঘদিন ভুগে তিনি মারা যান। সুরমা দেবী পাশ করা নার্স। বিধবা। আমার মায়ের শুশ্রূষা করার জন্যই তিনি এ বাড়িতে আসেন। তাঁর একটি সন্তানও আছে। আমার চেয়ে বছর তিনেকের বড়—তারই নাম জগদীশ মাথুর।

    —তোমার বিমাতার এইবারের বিবাহ সুখের হয়নি, নয়?

    সূরয মাথা নিচু করে বলল, তাঁর পক্ষে নিশ্চয় সুখের হয়েছে। ইতিপূর্বে নার্সগিরি করে অন্নসংস্থান করতেন; এখন দু-হাতে টাকা ওড়াচ্ছেন। বাবার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শুধু টাকার। বিবাহের পর থেকেই বাবা বস্তুত গৃহত্যাগী— বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন।

    বাসু একটু ইতস্তত করে বলেন, বিষয়টা অপ্রিয়, বিশেষ তোমার পক্ষে, তবু প্রশ্নটা করতে বাধ্য হচ্ছি : তোমার কি ধারণা মহাদেও প্রসাদ কোনও কারণে এই বিবাহ করতে বাধ্য হয়েছিলেন?

    সূরয কোনও সঙ্কোচ করল না। বললে, হ্যাঁ। আমার ধারণা তিনি ফাঁদে পড়ে এ কাজ করতে বাধ্য হন। আর তারপর থেকেই পিতাজী সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হয়ে যান—ঠিক চাচাজীর মতো।

    বাসু-সাহেব ওকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ঠিক আছে, ও অপ্রিয় প্রসঙ্গ থাক। তুমি বরং খোলাখুলি বল—তুমি আমার কাছে ঠিক কী চাইছ?

    —আমি খোলাখুলিই বলছি। আমার বিজনের সলিসিটার হচ্ছেন ‘মেসার্স সাক্‌সেনা অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’। আমি চাই আপনি ওঁদের সঙ্গে সহযোগিতা করুন—

    —মানে সম্পত্তিতে তোমার ‘প্রোবেট’ পাওয়ার বিষয়ে?

    —আজ্ঞে হ্যাঁ। দ্বিতীয়ত আমার বাবা স্বাভাবিকভাবে দেহ রাখেননি। আমি চাই, আপনি পুলিসের সঙ্গেও সহযোগিতা করে আসল হত্যাকারীকে খুঁজে বার করুন। কে জানে, দুটো ব্যাপার অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত কিনা—

    —অর্থাৎ তোমার বাবার মৃত্যু এবং তোমার বিমাতার সম্পত্তি লাভ?

    —হ্যাঁ। সেটাও আমি জানতে চাই।

    বাসু-সাহেব এবার অন্য দিক থেকে প্রশ্ন করেন—তুমি একটু আগে তোমার পিতৃদেবের চরিত্রহননের কথা বলছিলে–সেটা কী? তাছাড়া এয়ারোড্রামে তুমি বলেছিলে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি এমন দুটি খবর…

    —আজ্ঞে হ্যাঁ। দুটি কথা সংবাদপত্রে ছাপা হয়নি আমারই অনুরোধে। তার একটা পুলিস জানে, দ্বিতীয়টা জানে না। শুধুমাত্র আমিই জানি।

    —সে দুটি কী?

    —প্রথম খবরটা হচ্ছে এই : পুলিস গিয়ে যখন ঘরটা সার্চ করে তখন অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে তারা দুটি জিনিস উদ্ধার করে যা ওখানে খুঁজে পাওয়ার কথা নয়। একটা মেয়েদের ব্র্যাসিয়ের এবং একজোড়া উলের কাঁটা, আধবোনা একটা সোয়েটার ও কিছু উল। আমার বিশ্বাস, হত্যাকারী উদ্দেশ্য-প্রণোদিত ভাবে ওগুলি রেখে গেছে।

    —দ্বিতীয়টা? যেটা পুলিসও জানে না?

    —আপনি নিশ্চয়ই কাগজে পড়েছেন, আমার বাবার একটা পোষা ময়না ছিল। সেটা আমার চাচাজী বাবাকে উপহার দিয়েছিলেন। চাচাজী বস্তুত এক জাতের পক্ষী-বিশারদ। সালেম আলীর বই এবং বাইনোকুলার তাঁর নিত্য সাথী। তিনি একজন ‘বার্ড-ওয়াচার’। পাখিও ছবিও এঁকেছেন অসংখ্য। মোট কথা এই পাখিটা বাবার খুব প্রিয়। তার নাম ‘মুন্না’। বাবা যখন দুর্গম কোনও অঞ্চলে যান তখন মুন্না আমাদের এই শ্রীনগরের বাড়িতেই থাকে। আর যখন সহজগম্য কোনও জায়গায় যান, তখন ওকে নিয়ে যান। এবার ঐ লগ্‌-কেবিনে ওটাকে নিয়ে গিয়েছিলেন।…আশ্চর্যের কথা, পুলিস ওঁর কেবিন থেকে যে পাহাড়ী ময়নাটাকে উদ্ধার করেছে, সেটা মুন্না নয়! ঠিক একই রকম দেখতে আর একটা ময়না!

    কৌশিক এতক্ষণ নীরবে শুনে যাচ্ছিল। আর যেন ধৈর্য করতে পারল না। বলে বসল, আপনি নিঃসন্দেহ?

    —সন্দেহাতীতভাবে!

    —কেমন করে জানলেন?

    —প্রথম কথা, মুন্না যে বোলগুলো পড়ত—’হ্যালো’, ‘রাম-রাম’, ‘আইয়ে বৈঠিয়ে—চায়ে পিজিয়ে’, ‘সীতারাম’–তার একটাও এ ময়নাটা বলতে পারে না। পুলিসের অনুমতি নিয়ে ওটাকে আমি বাড়ি নিয়ে এসেছি। এ দুদিনে সে তার অভ্যস্ত ‘বোল’-এর একটাও বলতে পারেনি।

    বাসু-সাহেব বলেন, পোষা জন্তু-জানোয়ার তার মালিকের অভাবটা অদ্ভুতভাবে বুঝতে পারে। আমরা সেটা বুঝতে পারি না, কিন্তু সব রকম পোষমানা জন্তুর মধ্যেই দেখা গেছে—তার সত্যিকারের ‘মাস্টার’-এর অনুপস্থিতিটা…

    ওঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে সূরযপ্রসাদ বলে ওঠে, পার্ডন মি ফর ইন্টারাপশান, স্যার—আমার দ্বিতীয় যুক্তিটাও শুনুন—মুন্নার ডান পায়ের মাঝের আঙুলটা অনেকদিন আগে কাটা গিয়েছিল—কেবিন থেকে যে ময়নাটাকে আমরা এনেছি তার দুটি পায়ের সব কটা আঙুলই আছে!

    বাসু-সাহেবের ভ্রুকুঞ্চনটা দৃষ্টি এড়ালো না কারও। উনি বলে ওঠেন, কিন্তু কেন? হত্যাকারীই হোক বা যেই হোক, ময়নাটাকে বদলে দিয়ে যাবে কেন?

    সূরযপ্রসাদ বলল, আমি স্যার এ জিনিসটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। আমার মনে একটা সম্ভাবনার কথা জেগেছে। হয়তো শুনতে উদ্ভট লাগবে তবু আমার যুক্তিটাও শুনুন। ‘মুন্না’ ক্ষেত্রবিশেষে অত্যন্ত তাড়াতাড়ি কোনও ‘বোল’ শিখে ফেলত। আমার মনে আছে, একবার রাস্তা দিয়ে একদল শববাহী যাচ্ছিল। আমাদের বাড়ির সামনে তারা একবার মাত্র হুংকার দিয়েছিল ‘রাম নাম সৎ হ্যায়’। মুন্নার খাঁচাটা ছিল বারান্দায়। একবার মাত্র শুনেই সে বলে উঠল ‘রাম নাম সৎ হ্যায়’।

    —তাতে কী হল?

    —আমার বিশ্বাস-মৃত্যু-সময়ে বাবা হয়তো চীৎকার করে উঠেছিলেন আততায়ীর নাম ধরে। এবং হত্যাকাণ্ডের পরেই হয়তো মুন্না ঠিক একই স্বরে হত্যাকারীর নামটা বলে ওঠে। এজন্যই…

    এবার বাধা দিয়ে বাসু-সাহেব বলে ওঠেন—উঁহু! মিলছে না! সেক্ষেত্রে হত্যাকারী মুন্নাকেও শেষ করে দিয়ে যেত! ঠিক একই রকম দেখতে আর একটা ময়না যোগাড় করে ঐ ঘরে দ্বিতীয়বার পদার্পণ সে কখনই করত না।

    সূরযপ্রসাদ হার স্বীকার করল। বলল, তা ঠিক।

    মিনিটখানেক চোখ বুজে কী ভেবে নিয়ে বাসু বলেন, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে—ঐ পাহাড়ী ময়নাটার পথ ধরেই আসল হত্যাকারীকে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। দাঁড়াও, মুন্নার ব্যাপারটা ভালোভাবে বুঝে নিই। তুমি নিশ্চিতভাবে জান যে, মুন্নাই ছিল ওঁর কেবিনে?

    সেটাই একমাত্র সম্ভাবনা। এ বছর অগস্ট মাসে পিতাজী অমরনাথ তীর্থে যান। সেখানে যাবার আগেই উনি চিঠি লিখে আমাদের জানিয়েছিলেন যে, সোমবার পাঁচই সেপ্টেম্বর উনি শ্রীনগরে আসবেন। এবং ঐদিনই বিকালে ট্রাউট-প্যারাডাইসে চলে যাবেন। লিখেছিলেন, ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়াতে ওঁর কী একটা জরুরী কাজ আছে। আর ওঁর সেক্রেটারী গঙ্গারামজীকেও জানিয়েছিলেন—তিনি যেন অতি অবশ্যই পাঁচ তারিখ শ্রীনগরে থাকেন। কিন্তু যে-কোনও কারণেই হোক, উনি দিনতিনেক আগেই এসে উপস্থিত হন—অর্থাৎ তার আগের শুক্রবার, দোসরা সেপ্টেম্বর, সকালে। পিতাজী বাড়িতে এসেই গঙ্গারামজীকে নিয়ে ব্যাঙ্কে চলে যান। বারোটা নাগাদ দুজনেই একসঙ্গে ফিরে আসেন; এবং তারপরই একটা সুটকেস আর মুন্নাকে নিয়ে তিনি চলে যান! যাওয়ার সময় তিনি আমাদের বলেন, দিন দুই পহেলগাঁওয়ে থেকে মৎস্য মরশুমের আগেই পাঁচ তারিখ বিকালের মধ্যে তিনি ট্রাউট-প্যারাডাইসে চলে যাবেন। বস্তুত অগস্ট মাসের মাঝামাঝি থেকে একটা লগ্-কেবিন ওঁর নামে বুক করা ছিল। ঠিক কোনটা আমি অবশ্য জানতাম না।

    বাসু প্রশ্ন করেন, কী কারণে পাঁচ তারিখ সকালে আসবেন জানিয়েও তিনি দিনতিনেক আগে চলে এসেছিলেন আন্দাজ করতে পার?

    —তা বোধ হয় পারি। অগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে, তারিখটা আমার মনে নেই, দিল্লি থেকে জগদীশ আমাকে টেলিফোন করে জানায়, সেপ্টেম্বরের ছয় তারিখে মর্নিং ফ্লাইটে সে তার মাকে নিয়ে এখানে আসছে। আমাকে সে অনুরোধ করে, আট তারিখ সকালের ফ্লাইটে ওদের দুজনের জন্য দিল্লির দুখানি টিকিট কেটে রাখতে। সম্ভবত পিতাজী তাঁর সেক্রেটারীর কাছ থেকে এ খবরটা জানতে পেরেছিলেন। তাই তিনি তাঁর প্রোগ্রামটা বদলে ফেলেন। মানে, তিনি আমার বিমাতার সম্মুখীন হতে চাইছিলেন না।

    —কিন্তু মুন্না যে বদল হয়ে গেছে এ খবরটা তুমি পুলিসকে জানাওনি কেন? সূরযপ্রসাদ একটু অশান্তভাবে মাথা নাড়ল। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল তার। বেশ বোঝা যায় লোকটা নিতান্ত ক্লান্ত। দেহে ও মনে। আবার সোজা হয়ে বলল, আপনি যাই বলুন বাসু সাহেব আমার ধারণা পুলিস এ রহস্যের কিনারা কিছুতেই করতে পারবে না। পুলিসের কতকগুলো বাঁধাধরা ছক আছে। ঘটনা যদি সেই খাতে না চলে ওরা নিতান্ত নাচার। এজন্যই আমি আপনাকে কলকাতায় ট্রাঙ্ককল করেছিলাম। আমার ধারণা, এই হত্যা রহস্যের উদ্ঘাটন আপনার মতো লোকের পক্ষেই করা সম্ভব। আপনি নেবেন সে দায়িত্ব?

    বাসু-সাহেব আড়চোখে উপস্থিত তিনজনের উপর দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে বলেন, ঘণ্টাখানেক সময় নিচ্ছি। তুমি বাড়িতে ফিরে যাচ্ছ তো? আমি টেলিফোন করে জানাব। রানী দেবী বাধা দিয়ে বলে ওঠেন, মিছিমিছি সময় নষ্ট করে কী লাভ? আমরা সবাই সূরযপ্রসাদের হয়ে সুপারিশ করছি।

    বাসু আবার একবার সকলের উপর নজরটা চালিয়ে নিয়ে বললেন, অলরাইট, আই অ্যাক্সেপ্ট!

    তৎক্ষণাৎ সূরযপ্রসাদ তার পকেট থেকে একটা বন্ধ খাম বার করে টেবিলের উপর রাখল। বললে, থ্যাঙ্কু স্যার।

    —ওটা কী?—

    আপনার ‘রিটেইনার’ এবং আমার তরফে আপনার নিয়োগপত্র, যাতে পুলিস আপনাকে সাহায্য করে।

    বাসু হেসে বলেন, তুমি তো খুব সিস্টেম্যাটিক?

    —তা বলতে পারেন। আচ্ছা চলি নমস্কার।

    দ্বার পর্যন্ত গিয়ে আবার ফিরে দাঁড়ায়। বলে, ও! দুটো কথা বলার আছে আরও। প্রথম কথা, আমার বিমাতা ও জগদীশ প্রসাদ আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে আপনাকে টেলিফোন করব এবং গাড়ি পাঠিয়ে দেব। আমার ইচ্ছা, তাঁর সঙ্গে আমার যা কথাবার্তা হবে তা আপনার উপস্থিতিতে হওয়া চাই। দ্বিতীয় কথা, পহেলগাঁওয়ের ও. সি. যোগীন্দর সিংজী একটু আগে আমাকে ফোন করে জানিয়েছেন–দিল্লি থেকে কেন্দ্রীয় পুলিস সংস্থার অর্থাৎ সি. বি. আই.-এর একজন সিনিয়ার অফিসার সরেজমিনে তদন্ত করতে আসছেন। আজ বিকালেই যোগীন্দর সিংজী তাঁকে নিয়ে লগ্‌-কেবিনটা দেখতে যাবেন। আপনি কি যাবেন?

    বাসু বলেন, দাঁড়াও, দাঁড়াও! এর মধ্যে সি. বি. আই. ঢুকল কেমন করে?

    —আগেই বলেছি, পিতাজী একজন প্রাক্তন এম. পি.। তাঁর একটা পোলিটিকাল কেরিয়ার আছে। যদিও তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন, তবু রাজনৈতিক-কারণে হত্যা হওয়াও অসম্ভব নয়। তাই—

    বাসু বলেন, বুঝলাম। ওঁরা কখন যাচ্ছেন?

    —যোগীন্দর তো বললেন পহেলগাঁও থেকে বেলা চারটে নাগাদ রওনা হবেন। তাহলে সাড়ে চারটে নাগাদ ঐ লগ্‌ কেবিনে পৌঁছে যাবেন।

    —ঠিক আছে। তুমি বেলা একটা নাগাদ আমাকে একটা গাড়ি পাঠিয়ে দিও।

    সূরয বলে, আমি সঙ্গে যেতে পারলে ভাল হত; কিন্তু এদিকে আমার অনেক কাজ জমে গেছে। সন্ধ্যার পর জগদীশরা আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে বলে জানিয়েছে। চাচাজীও যে-কোনও মুহূর্তে এসে পৌঁছাতে পারেন।

    —চাচাজী; মানে প্রীতমপ্রসাদ? তিনি কোথায় আছেন?

    —না, না। প্রীতমপ্রসাদজী কোথায় আছেন আমরা কেউ খবরই রাখি না। খবরের কাগজে সংবাদটা দেখে তিনি যদি নিজে থেকে যোগাযোগ করেন তবেই হয়তো শ্রাদ্ধবাসরে তাঁকে পাব। কিন্তু তিনি বোধহয় ইদানীং খবরের কাগজও পড়েন না। ‘চাচাজী’ বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছি শ্রীগঙ্গারাম যাদবকে। তিনি আমার বাবার প্রাইভেট সেক্রেটারী। পুরানো আমলের লোক, বাবারই বয়সী। তাঁকেই আমি ‘চাচাজী’ ডাকি। কী একটা জরুরী কাজে তিনি ঐ ছয় তারিখের মর্নিং ফ্লাইটে দিল্লি গেছেন। ট্রাঙ্ক-লাইনে খবরটা তাঁকে জানিয়েছি। আশা করছি, আজই তিনি এসে পড়বেন।

    —দোসরা তারিখে তোমার বাবা ব্যাঙ্কে এসে কী-জাতের ট্র্যানজ্যাকশান করেন তা জানো না? গঙ্গারাম কিছু বলতে পারেননি?

    —ট্রাঙ্ক-টেলিফোনে অত কথা কিছু হয়নি। তাছাড়া হঠাৎ খবরটা শুনে উনি খুবই বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। পিতাজীর অধীনস্থ কর্মচারী হলেও তাঁর সঙ্গে ওঁর একটা হৃদয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, প্রায় বন্ধুস্থানীয়। বয়সটা সমান হওয়াতেই বোধ হয়। উনি শুধু বললেন, এখনই আমি যাচ্ছি! অ্যাভেইলেব্‌ল্‌ নেক্সট ফ্লাইটে।

    —এখানকার ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়াতে তোমার বাবার এ্যাকাউন্ট আছে, ভল্টে লকারও আছে। সেখানকার ম্যানেজার কিছু বলতে পারছেন না?

    —আমি খোঁজ নিইনি।

    —তাহলে এখনই চল। পোলিটিক্যাল মার্ডার যদি না হয়, তাহলে দোসরা তারিখের ঐ ব্যাঙ্কের জরুরী কাজ এবং ছয়ই তাঁর জীবনাবসানের মধ্যে যোগসূত্র থাকার সম্ভাবনা যথেষ্ট। দশটা বেজে গেছে। চল, প্রথমেই ব্যাঙ্ক দিয়ে, শুরু করি।

    .

    ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার ম্যানেজার মিস্টার অশোক সোন্ধী তাঁর ক্লায়েন্ট সূরযপ্রসাদকে ঘনিষ্ঠভাবেই জানেন। ওঁদের আপ্যায়ন করে বসিয়ে প্রথমেই সূরযের পিতৃবিয়োগের জন্য অনুশোচনা ও সান্ত্বনা-বাক্য শোনালেন। বললেন, শহরে একটা ইন্দ্রপাত হয়ে গেল!

    সূরয তাঁর সঙ্গে ব্যারিস্টার সাহেবের পরিচয় করিয়ে দিল এবং জানালো, তার পিতৃদেবের রহস্যজনক মৃত্যুর বিষয়ে উনি তদন্ত করছেন।

    সোন্ধী সবিনয়ে জানায়, বলুন স্যার? আমি সর্বান্তঃকরণে আপনাকে সাহায্য করব। মানে, যেটুকু আমার সাধ্য।

    বাসু বললেন, মিস্টার সোন্ধী, আমি ঐ দোসরা তারিখের ট্র্যানজ্যাকশানের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাই। ঠিক কী ঘটেছিল, যতটা আপনার মনে আছে আনুপূর্বিক বলে যান।

    —আমি খুব ডিটেলস্-এ আপনাকে বলতে পারব। কারণ সেটাই তাঁর সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাৎ। সংবাদপত্রে খবরটা পড়ে আমি সেদিনের ঘটনাটা আনুপূর্বিক মনে মনে আলোচনা করেছিলাম। শুনুন : দোসরা শুক্রবার ঠিক ব্যাঙ্ক খোলার সঙ্গে সঙ্গেই উনি আর মিস্টার যাদব আমার ঘরে আসেন। উনি বলেন—

    —জাস্ট এ মিনিট। আমি আরও ডিটেইল্‌-এ শুনতে চাই। তখন ওঁর পরনে কী পোশাক ছিল, হাতে কী ছিল, ওঁকে উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছিল কি না-

    —ওঁর পরিধানে কী ছিল, আমার ঠিক মনে নেই। হাতে ছিল একটা ফোলিও ব্যাগ। না, ওঁকে প্রথমবার মোটেই উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছিল না—

    —প্রথমবার মানে?

    —আমাকে বলতে দিন, স্যার। পর পর ঘটনাগুলো বলে যাই। তারপর আপনি প্ৰশ্ন করবেন।

    —অলরাইট!—বাসু পাইপ ধরালেন।

    —ওঁরাই সেদিন আমার প্রথম ক্লায়েন্ট। সকাল দশটা পাঁচ, কি দশটা দশ হবে। ওঁরা দুজনে একসঙ্গেই এলেন। দু’একটা মামুলী সৌজন্য বিনিময়ের পরেই মিস্টার খান্না তাঁর ফোলিও-ব্যাগ খুলে এক বাণ্ডিল ফিক্সড ডিপসিট্-এর সার্টিফিকেট বার করলেন। কতগুলো তা আমার মনে নেই, কিন্তু সব কটা সার্টিফিকেট মিলিয়ে ফিক্সড-ডিপসিটের অঙ্কটা পঞ্চান্ন হাজার টাকার, সুদ বাদে। সবগুলিই ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার, কনোট সার্কাস, দিল্লি ব্রাঞ্চের। উনি সেগুলি আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বললেন, এগুলি আমানত হিসাবে জমা দিয়ে উনি পঞ্চাশ হাজার টাকা কর্জ করতে চান। আমি জবাবে বললাম, যেহেতু এগুলি অন্য ব্রাঞ্চের ফিক্সড ডিপসিট তাই আমার পক্ষে সেগুলি সিকিউরিটি হিসাবে গ্রহণ করা সম্ভবপর হচ্ছে না। উনি বললেন, ‘কেন, এ তো আপনাদেরই ব্যাঙ্কের, এগুলি তো আমি গচ্ছিত রাখছি।’ আমি জবাবে বললাম, ‘স্যার, এটাই সব ব্যাঙ্কের নিয়ম। ধরুন আপনি তো দিল্লি ব্রাঞ্চে জানাতে পারেন যে, এই সার্টিফিকেটগুলি নষ্ট হয়ে গেছে। তখন ইন্ডেম্‌নিটি-বন্ড দিয়ে আপনি সেখান থেকে টাকা তুলে নিতে পারেন।’ তখন উনি বললেন, ‘এই সার্টিফিকেটগুলি যদি আপনি দিল্লি ব্রাঞ্চে পাঠিয়ে দেন? তারা কনফার্ম করলে নিশ্চয়ই আপনি লোনটা দিতে পারেন?’ তার জবাবে আমি বললাম, ‘তাতে স্যার দিন দশ-পনের দেরি হয়ে যাবে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি আপনি মিস্টার যাদবকে এগুলি দিয়ে দিল্লি পাঠিয়ে দেন, মিস্টার যাদব তো আপনার জেনারেল পাওয়ার-অব-অ্যাটর্নি হোল্ডার। এগুলি জমা দিয়ে তিনি আপনার তরফে পঞ্চাশ হাজার টাকার ঋণ নিতে পারেন। দিল্লি ব্রাঞ্চ এই ব্রাঞ্চের উপর আপনার নামে একটা ব্যাঙ্ক ড্রাফ্‌টে পেমেন্ট করবে, এবং আমি নগদে টাকাটা আপনাকে দিয়ে দেব। তাহলে আপনি তিন চার-দিনের মধ্যেই টাকাটা নগদে এখানে বসেই পেয়ে যাবেন। উনি শুনে কিছু বললেন না, মনে হল উনি তাতেই রাজি হলেন। ফিক্সড-ডিপসিট সার্টিফিকেটগুলি ওঁর ফোলিও ব্যাগে ভরে এরপর ওঁর ভল্টে গেলেন। মিস্টার যাদব এ ঘরেই বসে রইলেন। আমি আর মিস্টার খান্না আন্ডার-গ্রাউন্ড ভল্টে গেলাম। ওঁর হাতে তখনও সেই ফোলিও ব্যাগটা ছিল। আমি আমার চাবি দিয়ে ওঁর লকার খুলে দিয়ে চলে এলাম। প্রায় দশ মিনিট পরে উনি ফিরে এলেন। এবং দুজনে চলে গেলেন। তখন বেলা দশটা পঁচিশ-ত্রিশ হবে।

    —তারপর?

    —তারপর উনি দ্বিতীয়বার আসেন, এবার একা—ঐ দিনই বেলা ঠিক দুটোর সময়। সময়টা আমার মনে আছে, কারণ ওঁকে দেখেই আমি একটু অপ্রস্তুত বোধ করি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি যে, ব্যাঙ্কের আওয়ার্স শেষ হয়ে গেছে। এখন উনি কোনও চেক ভাঙাতে চাইলে আমি বিব্রত হয়ে পড়ব। সেবার ওঁর হাতে ছিল একটা মাঝারি-সাইজ সুটকেস আর একটা খাঁচায় একটা ময়না। এইবার ওঁকে উদ্ভ্রান্ত মনে হল। এসেই বললেন, ‘মিস্টার সোন্ধী, আমার লকারটা জয়েন্ট-নামে করতে চাই। আমার ছেলের সঙ্গে।’ আমি বললাম, ‘সেটা কিছু শক্ত নয়, মিস্টার সূরযপ্রসাদকে নিয়ে আসুন। আমার খাতায় একটা এন্ট্রি করতে হবে, তাঁর স্পেসিমেন সিগনেচারটাও লাগবে।’ তাতে উনি বললেন, ‘আমার একটু তাড়াতাড়ি আছে। আমি যদি একটা চিঠি দিই আপনাকে—আমার পুত্রকে জয়েন্ট হোল্ডার হিসাবে, তাহলে হয় না? ওর নিজস্ব অ্যাকাউন্ট তো আছে আপনার এই ব্রাঞ্চে। সেই স্বাক্ষরই ভ্যালিড হবে। হয় না?’ আমি তাঁকে বললাম, ‘সাধারণ ক্ষেত্রে তা হয় না। তবে আপনাকে এবং আপনার পুত্রকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। এক্ষেত্রে আপনার চিঠি আমি সাময়িকভাবে মেনে নেব। তবে, যত শীঘ্র সম্ভব আপনি একদিন মিস্টার সূরযপ্রসাদকে নিয়ে এসে ফর্মালিটিগুলি সেরে যাবেন।’ উনি রাজি হলেন। সুটকেস খুলে একটি লেটার হেড প্যাড বার করে ঐ মর্মে আমাকে একটি চিঠি লিখে দিলেন।

    মিস্টার সোন্ধী সেই চিঠিখানি বার করে দেখালেন। বাসু সেটি পরীক্ষা করে ফেরত দেবার সময় বললেন, তাহলে আমার ক্লায়েন্ট এখনই ঐ ভল্টটা খুলে দেখতে পারেন?

    –পারেন, যদি চাবিটা তাঁর কাছে থাকে। আছে কি?

    সূরয মাথা নেড়ে জানালো, সে জানে না, চাবিটা কোথায়।

    বাসু বললেন, আপনি দয়া করে দেখবেন, ওঁর আকাউন্ট থেকে সম্প্রতি কোনও বড় রকমের উইথড্রয়াল হয়েছে কিনা?

    সোন্ধী তৎক্ষণাৎ লেজারটা চেয়ে পাঠালেন। দেখে বললেন, শেষ উইথড্রয়াল হয়েছে অগস্ট মাসের পাঁচ তারিখে, হাজার টাকা। ঐ অ্যাকাউন্টে ব্যালেন্স আছে 8,735.15 টাকা!

    বাসু ওঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিলেন।

    সূরয ওঁকে হাউসবোটে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নিল। বাসু বললেন, তাহলে ঠিক দেড়টার সময় একটা গাড়ি পাঠিয়ে দাও। আমি পহেলগাঁও যাব। আর ঐ সঙ্গে তোমার বাড়িতে যে বোবা ময়নাটা আছে সেটাকেও আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।

    সূরয প্রস্থান করলে বাসু-সাহেব বললেন, আমার দোষ নেই রানু, কাজটা তুমিই আমার ঘাড়ে চাপালে। সে যা হোক, তোমরা দুজনে তৈরি হয়ে নাও। আমার সঙ্গে আজ পহেলগাঁও অঞ্চলটা বেড়িয়ে আসবে। দেড়টার সময় গাড়ি আসবে।

    রানু বললেন, দুজন মানে? বাদ যাচ্ছে কে?

    —কৌশিক। তাকে শ্রীনগরেই থাকতে হবে। কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছি। শোন কৌশিক, আগেই বলেছি—আমার ইন্টুইশান বলছে, ঐ পাহাড়ী ময়নাটাকে ঘিরেই রহস্য-সমাধানের মূল চাবিটা রয়েছে। যে কোনও কারণেই হোক আততায়ী ময়নাটাকে বদলে দিয়েছে। সময় সে খুব বেশি পায়নি। সুতরাং হয় পহেলগাঁও অথবা শ্রীনগরের বাজার থেকে সে ঐ দ্বিতীয় ময়নাটাকে কিনেছে। তুমি ওবেলা শ্রীনগরের বাজারটাকে চষে ফেল। দেখ, এখানে অমন কোনও দোকান আছে কিনা—যারা টিয়া, ময়না, বদরিকা ইত্যাদি বেচে।

    কৌশিক কাঁধ ঝাঁকানি দিয়ে বললে, ভাল কাজ দিলেন যা হোক—

    —আর শোন ঐ সঙ্গে বাজারে গিয়ে খোঁজ নিও উলের দোকান কটা আছে।

    —উল?

    —হ্যাঁ, উল। লগ্‌-কেবিনে যে আধবোনা সোয়েটারটা পাওয়া গেছে তার রঙ ঘটনাচক্রে যদি একটু বেপট ধরনের হয় তাহলে আমরা ঐ নমুনা দেখিয়ে খোঁজ নিতে পারব এমন উল সম্প্রতি কে কিনেছে। ঐ উলের কাঁটাটাও আমাকে খোঁচাচ্ছে।

    কৌশিক বলে, কিন্তু শ্রীনগরের বাজারেই কেনা হয়েছে কেমন করে জানলেন? —জানি না। পহেলগাঁয়েও হয়ে থাকতে পারে; কিন্তু সেখানে তো আমরাই যাচ্ছি। খোঁজ নেব। তুমি শ্রীনগরটা দেখ।

    —এটা রীতিমত ‘ওয়াইল্ড-গুজ-চেজ্‌’ হয়ে যাচ্ছে না বাসু মামা?

    বাসু বললেন, যাচ্ছে। কোনও একটা দিক থেকে শুরু তো করতে হবে। তাছাড়া যাকে আমরা খুঁজছি সে ঠিক ‘ডোমেটিক গুজ’ নয়। এটাই আমার বিশ্বাস।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঅ-আ-ক-খুনের কাঁটা – নারায়ণ সান্যাল
    Next Article কুলের কাঁটা – নারায়ণ সান্যাল

    Related Articles

    নারায়ণ সান্যাল

    আবার যদি ইচ্ছা কর – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    নারায়ণ সান্যাল

    আম্রপালী – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    নারায়ণ সান্যাল

    বিশ্বাসঘাতক – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    নারায়ণ সান্যাল

    সোনার কাঁটা – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    নারায়ণ সান্যাল

    মাছের কাঁটা – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    নারায়ণ সান্যাল

    পথের কাঁটা – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    আবার যদি ইচ্ছা কর – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    আবার যদি ইচ্ছা কর – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    আবার যদি ইচ্ছা কর – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    আম্রপালী – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    বিশ্বাসঘাতক – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.