উষার দুয়ারে – ১
১.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের আমগাছের ডালে ডালে ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি হুটোপুটি করছে। পাতায় পাতায় আলোর নাচন, তার সঙ্গে পুচ্ছ তুলে নাচে এই ত্রিকালদর্শী পাখি দুটো। ব্যাঙ্গমা বলল, ‘কত কিছু ঘইটা গেল এই কয় দিনে, তাই না?’
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘হ, হইছে।’
ব্যাঙ্গমা বলল, ‘কও তো, কী কী হইছে?’
ব্যাঙ্গমি গ্রীবা বাঁকাল, ঠোঁট দিয়ে পিঠ চুলকে বলল :
রক্ত ঝরেছে যে মেডিকেল চত্বরে।
শহীদ মিনার সেথা উঠেছিল গড়ে ॥
গোলাম মাওলা আর সাঈদ হায়দার।
বদরুলের ওপরে দেয় নকশার ভার ॥
এরা পড়ে ডাক্তারি, লাগল নির্মাণে।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই ধ্বনি আসে কানে ॥
শহীদ স্মৃতিরে চির অমর করিতে।
ঠিকাদারে বলে তারা সিমেন্ট-ইট দিতে ॥
শরফ উদ্দিন ছিল মেডিকেল ছাত্র।
ইঞ্জিনিয়ার বলে তাকে সকলে ডাকত ॥
কারফিউ চারদিকে ভয়ার্ত চৌদিক।
ছেলেরা মিনার গড়ে, এমনি নিৰ্ভীক ॥
সারা রাত কাজ হলো, ভোর হলো রাত।
শহীদ মিনার গড়ে সম্মিলিত হাত ॥
শহীদ শফির বাবা উদ্বোধন করে।
কালাম শামসুদ্দিনও করেছেন পরে ॥
দলে দলে চলে আসে ফলক চত্বরে।
ফুলেল শ্রদ্ধা তারা নিবেদন করে ॥
কাগজে খবর হলো শহীদ মিনার।
শাসকে প্রমাদ গোনে, কী আছে করার ॥
পুলিশ লেলিয়ে দিয়ে ভাঙো ও মিনারে।
বুকের পাঁজর যেন ভাঙল আহা রে ॥
ইটের মিনার ভাঙে পুলিশেরা যত।
বুকে বুকে গড়ে ওঠে স্মৃতিস্তম্ভ তত ॥
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি দেখেছে সেই স্মৃতিস্তম্ভটির গড়ে ওঠা। দেখেছে পুলিশের নিষ্ঠুর আক্রমণে কীভাবে খসে পড়ল একেকটা ইট। কীভাবে ছাত্ররা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠল তাদের নিজ হাতে গড়ে তোলা শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটার ধ্বংসদৃশ্য দেখে।
তারা দুজনে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইল আমগাছের ডালে।
২.
‘স্মৃতিস্তম্ভটা ভেঙে ফেলেছে, মা।’
ঠান্ডা ভাত মুখে তুলে আনিসুজ্জামান বললেন। মা তাঁর পাতে তরকারি তুলে দিলেন চামচে, বললেন, ‘তরকারিটা গরম। তরকারি মেখে ভাত খাও।’
১৭ বছরের আনিসুজ্জামান। জগন্নাথ কলেজে পড়েন। যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত। কতই-না কাজ তাঁর। সারা দিন তাঁর কাটে বাইরে বাইরে। বাড়ি ফিরেছেন মধ্যরাতে। ঠাঁটারীবাজারে ৮৭ বামাচরণ চক্রবর্তী রোডের দোতলায় এই বাড়ি। খাবার টেবিলে বসে রাস্তা দেখা যায়। একটা মাধবীলতার ঝাড় আছে দোতলার বারান্দায়, সেখান দিয়ে চোখ গেলে রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট, চলন্ত রিকশার নিচে কেরোসিনের লন্ঠনের আলো দেখা যায়। চলন্ত ঘোড়ার গাড়ির চলাচলের আওয়াজ, অশ্বখুরধ্বনি, মাঝেমধ্যে ঘোড়ার ডাকও শোনা যায়। আজ অবশ্য খুব নীরব চারদিক। কেবল পেছনের আমগাছটায় ঝিঁঝি ডাকছে, দূরে কুকুরের বিলাপ–কান পাতলে শোনা যাবে।
আনিসুজ্জামান মায়ের মুখের দিকে তাকালেন। তিনি নীরব।
‘আমাদের চোখের সামনেই ভাঙল,’ আনিসুজ্জামান বললেন।
ভাত মেখে নিচ্ছেন তিনি তরকারিতে। মা সব সময়ই চান, ভাতটা তরকারির সঙ্গে ভালো করে মেখে নিয়ে ছেলে মুখে তুলুক। আনিসুজ্জামানরা পাঁচ ভাইবোন। তাঁর বড় তিন বোন, ছোট একটা ভাই আখতারুজ্জামান—স্কুলে পড়ে। দোতলা বাড়ির নিচতলায় তাঁদের একটা বোন থাকেন, সংসার পেতে। ছোট ভাইটা নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছে। আব্বাও শুয়ে পড়েছেন। বাসাটা নীরব 1 শুধু একা জননী জেগে ছিলেন ছেলের আসার প্রতীক্ষায়।
খুব ভয়ার্ত এখন ঢাকার পরিবেশ। দুই দিন আগেও গুলি হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি, বাইশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই স্লোগান দিতে দিতে কতজন মারা গেল। কতজন আহত হলো। এখন চলছে সাধারণ ধর্মঘট। আবার কারফিউ। রাস্তা পাহারা দিচ্ছে পুলিশ আর মিলিটারি। মিলিটারিবাহী শকট রাস্তায় চলে ভীতি ছড়াতে ছড়াতে। তারা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র তাক করে রাখে ট্রাকের সামনের মাথাটার ওপরে।
মাধবীলতার ঝাড় থেকে সুগন্ধ আসছে।
আনিসুজ্জামান পানির গেলাস তুলে নিলেন। মা বললেন, ‘ভাত খাওয়ার সময় পানি খেতে হয় না, বাবা।
আনিসুজ্জামান বললেন, ‘পুলিশ আসছে, এই খবর শুনে আমরা জড়ো হওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। তুমি তো স্মৃতিস্তম্ভটা দেখে এসেছ, মা। আমরা সবাই যতটা পারি, স্তম্ভটার কাছেই ভিড়েছিলাম। লোহার রেলিংটা ধরে। ইমাদুল্লাহ আছে না, ওই যে লম্বা ছেলেটা, শেরওয়ানি-পাজামা পরে থাকে, ও তো কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করছিল, ক্যামেরা, ক্যামেরা। কেউ একজন ক্যামেরা নিয়ে এসো। ওরা শহীদ মিনার ভেঙে ফেলছে। একটা একটা করে ইট খুলে ফেলল। আমাদের মনে হচ্ছিল যেন আমাদের পাঁজরের হাড় ভেঙে ফেলছে।
মা টেবিল ছেড়ে উঠে অন্য ঘরে চলে গেলেন।
মা কি খুব দুঃখ পেলেন?
আনিসুজ্জামানেরও আর খেতে ইচ্ছে করছে না। তিনিও উঠে পড়লেন।
মা গতকাল স্মৃতিস্তম্ভে গিয়েছিলেন, আব্বাকে সঙ্গে নিয়ে। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক আব্বাও হয়তো গিয়েছিলেন নিজের গরজেই। বাংলা ভাষার প্রতি টান তো সবারই আছে। তবে মা-ই তাঁকে বলেছিলেন, ‘চলো, শুনলাম শহীদ
স্মৃতি মিনার হয়েছে। ওখানে যাই। দেখে আসি।’
ধর্মঘট চলছিল। কাজেই গাড়ি আর নেওয়া হলো না। রিকশা ভাড়া করে গিয়েছিলেন আনিসুজ্জামানের পিতা ডাক্তার এ টি এম মোয়াজ্জেম আর মা সৈয়দা খাতুন।
তোয়ালেতে হাত মুছছেন আনিসুজ্জামান। বারান্দায় তাঁর ছায়া পড়ে। নাতিদীর্ঘ তরুণ, নাকের নিচে প্রজাপতির মতো গোঁফ, হালকা-পাতলা অবয়ব, চোখে চশমাটা স্থায়ী হয়ে আছে। ছায়ায় চশমাটার এক কোনা দেখা যায়। এ সময় আব্বার চপ্পলের আওয়াজ। আব্বা কি ঘুম থেকে উঠে এলেন! তিনি বারান্দায় দাঁড়ালেন। বললেন, ‘তোমার মা বলছিলেন, স্মৃতি মিনারটা ভেঙে ফেলেছে পুলিশ!’
‘জি আব্বা।’
‘তোমার মা কথাটা শুনে একটু আঘাত পেয়েছেন।’
শুনে আনিসুজ্জামান ঘরের খোলা দরজাপথে মায়ের মুখের দিকে তাকালেন। চশমাটা একটু ঠিক করে নিলেন। মা কি কাঁদছেন?
‘তোমার মা একটু বেশি ইমোশনাল হয়ে পড়েছেন। তুমি কি জানো, কালকে যখন আমরা বিকেলবেলা শহীদ মিনারে যাই, তখন খুব একটা আবেগঘন দৃশ্য তৈরি হয়েছিল। সবাই সাধ্যমতো সাহায্য করছিল। টাকাপয়সা, ফুল। ওরা বলাবলি করছিলেন, এই সাহায্য আন্দোলনের তহবিলে জমা করা হবে। যেখানে যা খরচ লাগছে, দেওয়া হবে। তোমার মা সোনার হার দিয়ে দিলেন। আমি তো অবাক। এই হারটা তিনি আমাকে না বলেই সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। জিগ্যেস করলাম, ‘কোন হার।’ তোমার মা বললেন, নাজমুনের।
আনিসুজ্জামানেরও চোখটা ছলছল করে উঠল। নাজমুন তাঁর ছোট বোন। মাত্র ১১ মাস বয়সে তাদের এই ছোট বোনটি বছর দুয়েক আগে মারা যায়।
মা তাকে ভোলেননি।
মা ভাষা আন্দোলনে শহীদদের জন্যও কিছু একটা করার কথা ভেবেছেন। অকালে প্রাণ হারানো ১১ মাস বয়সী কন্যার সোনার হার সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে। স্তম্ভের বেদিতে সেটা নিবেদন করে এসেছেন চুপি চুপি। মায়ের সঙ্গে এই কয়েক দিন বেশি কথা বলার সময় হচ্ছে না বটে, কিন্তু মা এই কথাটাও তাঁকে বলেননি
ইলেকট্রিক বাতির আলোয় মায়ের চোখের নিচের জলবিন্দু আনিসুজ্জামান দেখতে পান।
মা তাড়াতাড়ি করে আঁচল দিয়ে মুখটা ঢেকে ফেলেন।
কোথাও একটা শকুনি কি কেঁদে উঠল। ঠিক মানবশিশুর কণ্ঠে। নাকি পাশের বাড়ির বাচ্চাটা!
আনিসুজ্জামান বারান্দা ছেড়ে নিজের ঘরের দিকে হাঁটতে থাকলেন।
৩.
কত দিন পর এই বাড়ি ফেরা! কত দিন পর সেই পরিচিত নদী মধুমতী, বাইগার, বাড়ির পাশের গভীর অথচ কররেখার মতো চিকন আর পরিচিত খালটি পেরিয়ে ফিরে আসা! সেই পরিচিত হিজলের ডাল ঝুঁকে আছে খালের পাড়ে, কোথাও বা জলের গায়ে নুয়ে আছে তার সবুজ পাতা! সেই পরিচিত ঘাট, দূরে বাজে পোড়া জামের ডাল। কত দিন পর ফিরছেন শেখ মুজিব! কত মাস! ২৭-২৮ মাস। প্রায় ৮০০টা দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী শেখ মুজিবুর রহমানকে পার করতে হয়েছে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। সন্ধ্যা হলেই তাঁকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে তালাবদ্ধ কুঠুরিতে। একা সেলে কত রাত কাটাতে হয়েছে তাঁকে। একটুখানি আকাশ দেখার জন্য কী রকম আকুলিবিকুলিই-না করত তাঁর পুরো অন্তর। চাঁদের আলো কেমন, মনে করার চেষ্টা করতেন জেলখানার দেয়ালঘেরা কক্ষে শুয়ে। মনে হতো, একটা জোনাকিও কি পথ ভুলে আসতে পারে না কারাগারের ভেতরে। মনে হতো, রাতের আকাশ কেমন, একটিবার কি দেখা যাবে না। মনে হতো, যদি কোনো দিন মুক্তি পান এই কারাগার থেকে, রাতে শুয়ে থাকবেন খোলা কোনো মাঠে, ঘাসের ওপরে, চিত হয়ে, শুধু আকাশ দেখার জন্য। দেখবেন রাতের আকাশ, আকাশের গায়ে অনন্ত নক্ষত্রবীথি, দেখবেন চাঁদের নিচে মেঘের ছুটে চলা! দেখবেন আকাশের ওপারে আকাশ।
শেখ মুজিব দূর থেকে দেখতে পেলেন নিজেদের বাড়ির ঘাট। নৌকার পাটাতনে ছইয়ের নিচে বসে থেকে তিনি শুনতে পাচ্ছেন একটানা দাঁড় টানার শব্দ, পানির ছলাচ্ছল। শ্যাওলার গন্ধ নাকে এসে লাগছে, কচুরিপানার দাম কেটে পথ করে নৌকা এগিয়ে চলেছে, হোগলার বনে একটা বেজি মুখ তুলে তাকাল। একটু পরই তাদের নৌকা ভিড়বে ঘাটে, লুৎফর রহমান সাহেব তাঁর লাল রঙের গামছাখানা নৌকার পাটাতন থেকে তুলে ঘাড়ে রাখলেন। ওই তো ঘাট। এবার নামতে হবে। বাড়ি ফিরছেন মুজিব, ২৮ মাস পর।
ছলাৎ করে একপশলা পানি নৌকার বৈঠার বাড়ি খেয়ে ছিটকে এসে পড়ল মুজিবের হাতে। সেই পানিতে আঙুল বোলাতে বোলাতে মুজিবের মনে পড়ল, বছর দুয়েক আগে বন্দী অবস্থায়ই গোপালগঞ্জে নিয়ে আসা হয়েছিল তাঁকে। ওখানে একটা মামলা ছিল। গোপালগঞ্জ উপকারাগারে ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দী আর নিরাপত্তা বন্দী রাখার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ম্যাজিস্ট্রেট আদেশ দিলেন, মুজিবকে রাখতে হবে থানা চত্বরে। থানায় তাঁর থাকার জায়গা হলো ‘নজরবন্দী’ ঘরে। শেখ মুজিব সেই ঘরে ঢুকেই মৃদু হেসেছিলেন। সেটা তো সেই ঘর, যেখানে ব্রিটিশ আমলে স্বদেশি আন্দোলনের কর্মীদের নজরবন্দী করে রাখা হতো। সে ঘর যেখানে, সেই মহল্লাতেই বালক মুজিব থাকতেন। গোপালগঞ্জে সেই ছোটবেলা থেকেই বসবাস করেছেন মুজিব, সেখানেই তাঁর স্কুলজীবন, সেখানকার মাঠেই তাঁর ফুটবল খেলা, সেখানকার নদীতে সাঁতার কেটে তাঁর বেলা পার করা, সেখানকার আলো-বাতাসেই তাঁর জীবনীশক্তি সঞ্চয়, তার প্রতিটা ধূলিকণা, প্রতিটা গাছপালা, প্রতিটা রাস্তা, দোকান, ঘরবাড়ি, িিহন্দু-মুসলমান প্রত্যেকের বাড়ির সদর-অন্দর তাঁর কত চেনা! আর ওই থানা চত্বর তো ছোটবেলায় হাফপ্যান্ট পরা মুজিব রীতিমতো চষে বেড়িয়েছেন। ছোট্ট বালক ওই ঘরের নজরবন্দীদের সঙ্গে মিশতেন, গল্প করতেন, কেউ বাধা দিত না। তাদের কাছে শুনতেন দেশপ্রেমের কথা, দেশের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার ব্রতের কথা। সেদিন দেশ ছিল পরাধীন। সেদিন শাসক ছিল ব্রিটিশরা। ওইখানে যাঁরা বন্দী থাকতেন, তাঁরা ছিলেন স্বাধীনতার কর্মী I ব্রিটিশরা বিদায় নিয়েছে। কায়েম হয়েছে পাকিস্তান। যে পাকিস্তানের জন্য মুজিব আন্দোলন করেছেন দিনের পর দিন। ওই গোপালগঞ্জবাসীকেই কত আশার কথা শুনিয়েছেন। তাঁদের সংগঠিত করেছেন মুসলিম লীগের পতাকাতলে সমবেত হওয়ার জন্য। ব্রিটিশদের বানানো সেই নজরবন্দী ঘরে এখন ঠাঁই মিলেছে মুজিবের। একটা রাতের জন্য।
২৮ মাস পর টুঙ্গিপাড়ার নিজের বাড়ির ঘাটে নৌকা ভিড়ছে, আর মুজিবের মনে পড়ছে সেই থানা চত্বরের নজরবন্দী ঘরে আশ্রয় পাওয়া রাতটার কথা। তিনি ঘরের বাইরে বসে আছেন। জেলের মধ্যে প্রত্যেক সন্ধ্যায় সেলে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। জানালা দিয়ে একটুখানি জ্যোৎস্না একটুখানি তারা দেখার জন্য কী ব্যাকুল হয়েই-না তিনি উঁকিঝুঁকি মারতেন! তাই থানা চত্বরে নজরবন্দী ঘরে আশ্রয় পেয়ে মুজিব গভীর রাত পর্যন্ত বাইরে বসে থেকেছিলেন। অন্ধকার দেখলেন। আকাশের তারা দেখলেন। দূরে নদী বয়ে যাচ্ছে, কল্লোল শোনা যায় কান পেতে থাকলে। তিনি নদীর স্রোতধ্বনি শুনলেন। পুলিশ কর্মচারী তাঁর পাশে বসে রইলেন। তাঁরা গল্প জুড়ে দিলেন। দু-একজন বন্ধুবান্ধবও এসে জুটল। আহ্! কত দিন পর মুক্ত আকাশের নিচে রাতযাপন। পুলিশের দিক থেকে কোনো ভয় ছিল না, তারা জানে, এই বন্দী পালিয়ে যাবে না। তিনি দেখলেন, দূরে শটিবনে জোনাকির ঝাঁক। তাঁর মনে হলো, জোনাকির জীবনও কত মুক্ত। তারা ইচ্ছামতো ঘুরছে, চলছে, ফিরছে। আর আলো জ্বালাচ্ছে। মুজিবের মনে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথের গান :
ও জোনাকি, কী সুখে আজ ডানা দুটি মেলেছ।
এই আঁধার সাঁঝে বনের মাঝে উল্লাসে প্রাণ ঢেলেছ ॥
তুমি নও তো সূর্য, নও তো চন্দ্র, তাই বলে কি কম আনন্দ।
তুমি আপন জীবন পূর্ণ করে আপন আলো জ্বেলেছ।।
রাত বেড়ে গেল। বন্ধুরা বিদায় নিল। একটা নীরবতা নেমে এল যেন চরাচরে। মুজিব খোলা আকাশের নিচে বসে সেই নীরবতাই উপভোগ করতে লাগলেন। আকাশে তারা জ্বলে উঠল। কত তারা। কত দূর, আকাশের ওপারে কোন আকাশে এই তারাগুলো জ্বলছে। মুজিব অন্ধকারে অসীম আকাশের নিচে বসে তারা দেখছেন। পুলিশ কর্মচারী নিজেও ঘুমোতে যাবেন। তিনি বুঝছেন না, এই অসীম অন্ধকারে, এই নির্জন থানা চত্বরে বসে মুজিব পাচ্ছেনটা কী! তাঁকে কে বোঝাবে, কারাগারে কোনো দিন সন্ধ্যার পর খোলা আকাশের নিচে থাকার সুযোগ হয় না মুজিবের। তিনি আর কিছু না হোক, পাচ্ছেন ছাদহীন, সীমাহীন আকাশের নিচে থাকার আস্বাদ। তিনি হয়তো তাঁর সীমানার বাইরে আনুভূমিকভাবে কোথাও যেতে পারবেন না, কিন্তু তাঁর দৃষ্টি তো মুক্তি পেয়েছে এখানে। সামনে কোথাও দেয়াল নেই। মাথার ওপরে জেলখানার ছাদটা নেই। এখানে বসে থাকাতেই তাঁর একধরনের আরাম, একধরনের প্রশান্তি। পুলিশ কর্মচারী হাই তুললেন, বললেন, ‘বড্ড ঘুম পাচ্ছে। এবার যে শুতে যেতে হয়।’ মুজিব বাধ্য হয়েই ঢুকে পড়লেন সেই ঘরে। কিন্তু তাঁর ঘরের পাশেই একটা ওয়্যারলেস মেশিন। সারাক্ষণ তাতে খটখট শব্দ হচ্ছে। মুজিব ঘুমোতে না পেরে আবার বেরোলেন। বাইরেই ঘুমোবেন, একবার ভাবলেন। কিন্তু গোপালগঞ্জের বিখ্যাত মশার যন্ত্রণায় তা-ও সম্ভব হলো না। আবার ঘরের ভেতরেই গিয়েই তাঁকে শুয়ে পড়তে হলো।
.
এখন টুঙ্গিপাড়ায় শেখবাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে তিনি। সঙ্গে আব্বা। পাঁচ দিন আগে তিনি মুক্তি পেয়েছেন ফরিদপুর কারাগার থেকে। নৌকা থেকে ঘাটে উঠতে কষ্ট হচ্ছে মুজিবের। রোগা শরীর, প্রায় ১০ দিনের অনশন ধর্মঘটের ধকল গেছে তার ওপর দিয়ে। ঘাটের সিঁড়িগুলো বেয়ে উঠছেন তিনি। একটা একটা করে ধাপে পা রাখছেন। আব্বা এসে তাঁর হাত ধরলেন। মুজিব বললেন, ‘আব্বা, আমাকে ধরতে হবে না। আপনি সাবধানে ওঠেন।’
ফরিদপুর থেকে টুঙ্গিপাড়ায় আসতে পাঁচ দিন লেগে গেল শেখ মুজিবুর রহমানের।
শেখ লুৎফর রহমান ছুটে গিয়েছিলেন ফরিদপুরে। আব্বার সঙ্গেই নৌকায় ফিরছেন শেখ মুজিব। সেই পরিচিত মধুমতী নদী, বাইগার খাল হয়ে টুঙ্গিপাড়া ঘাট। ঘাটের ধাপগুলো বেয়ে খালপাড়ে উঠলেন তিনি। আব্বা তাঁর হাত ধরে রেখেছেন। বাড়ির দাওয়া। ফাল্গুনের হাওয়ায় গাছগাছালির পাতা দুলছে। আমের মুকুলের মাদকতাভরা গন্ধ চারদিকে। খোলা জায়গাজুড়ে খড়বিচালি ইতস্তত ছড়ানো। লাল গরু গা চেটে দিচ্ছে তার বাছুরের। লোকজন এসে ভিড় করে ধরতে লাগল তাঁকে। তিনি উঠোনের দিকে তাকালেন। মাকে দেখা যাচ্ছে, দূরে, সাদা শাড়ি পরে মা এদিকেই এগিয়ে আসছেন। মুজিবকে দেখে তাঁর মায়ের মুখটা প্রসন্ন হাসিতে ভরে উঠল
তাঁরা বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলেন।
শেখ মুজিবের চোখে চশমা। গায়ে হাওয়াই শার্ট। পরনে পায়জামা। ৩২ বছরের এই যুবক শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছেন। নাকের ভেতরে ক্ষত। তিনি নিজেদের বাড়ির প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে জোরে শ্বাস নিলেন। ধানের খড়ের গন্ধ, আমগাছ থেকে ভেসে আসা মুকুলের গন্ধ নাকে এসে লাগল। তিনি যেন ঠিক তাঁর শৈশবের গন্ধ পাচ্ছেন। একদল হাঁসের বাচ্চা তাঁকে পাশ কাটিয়ে প্যাক প্যাক করতে করতে খালের দিকে চলে যাচ্ছে।
মুজিব তাঁর নিজ ভিটেয় হাঁটছেন। ঘাট থেকে হেঁটে হেঁটে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। যেখানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করে আছে রেনু আর তাঁর দুই সন্তান, হাসু আর কামাল। মুজিবের মনে হলো, আহা, মহিউদ্দিনের না জানি কী অবস্থা? ও কি এখনো অনশন করছে ফরিদপুর কারাগারে? নাকি তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে? মুজিব ঢাকা জেলে ৫ নম্বর খাতা বা ওয়ার্ডে নির্জন প্রকোষ্ঠে থাকতেন। কাউকেই নির্জন প্রকোষ্ঠে তিন মাসের বেশি রাখার নিয়ম নেই, মুজিবের বেলায় নিয়ম ভঙ্গ করা হয়েছিল। মুজিব যখন চিকিৎসার জন্য জেল- হাসপাতালে, তখন মহিউদ্দিনকেও এই সেলে আনা হয়। একদিন দুপুরবেলা মহিউদ্দিন বিছানায় শুয়ে আছেন, তখন হঠাৎ মুজিব এলেন সেখানে। মহিউদ্দিনকে দেখেই তিনি ভীষণ জোরে হাসতে লাগলেন। তাঁর হাসিতে সমস্ত জেলখানা যেন কেঁপে উঠছে। মহিউদ্দিনও মুজিবকে দেখে আনন্দে আপ্লুত হয়ে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন।
মুজিব মহিউদ্দিনের পাশে শুয়েই কেঁদে ফেললেন, যেন কত দিন পর নিকটজনের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে।
এরপর মুজিব গল্প আরম্ভ করলেন। কীভাবে তিনি গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়েছেন, সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করেছেন, পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে মিশেছেন, পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে আবার দেশে ফিরেও এসেছেন, সেসব গল্প।
তারপর তিনি বললেন, ‘মহিউদ্দিন, ঢাকায় একটা খুব ভালো ছেলে পাওয়া গেছে, জানো, দারুণ! খুব গোছানো। খুবই নিষ্ঠাবান। রাজনৈতিক সাংগঠনিক ক্ষমতাও খুব ভালো।’
মহিউদ্দিন বিছানা থেকে উঠে বসে বললেন, ‘কে?’
মুজিব বললেন, ‘তাজউদ্দীন আহমদ। খুব ভালো ড্রাফট করতে পারে, খুব মেধাবী। পড়াশোনা করে, ভাবনাচিন্তাও খুব পরিষ্কার।’
কথায় কথায় বেলা হয়ে গেল। মুজিব বললেন, ‘উঠি রে। আমাকে আবার হাসপাতালে যেতে হবে। শরীরটা ভালো না।’
মুজিব দরজার দিকে পা বাড়ালেন। মহিউদ্দিন আহমদ বলে উঠলেন, ‘মুজিব, আমার তো এখনই একা একা লাগছে। এই নিঃসঙ্গ প্রকোষ্ঠে তুমি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস একা থাকলে কী করে?’
ঢাকা জেল-হাসপাতাল থেকে শিগগিরই মুজিবকে আবার কারাগারের ওই সেলে ফিরে আসতে হলো। তার পর থেকে তারা দুজন থাকেন একই সেলে। কিন্তু এইভাবে আর কত দিন!
.
টুঙ্গিপাড়ার শেখবাড়িতে নিজের ভিটেয় দাঁড়িয়ে আমগাছের মুকুলগুলোর দিকে তাকালেন মুজিব। কাঁঠালগাছে এঁচোড় ধরেছে, মাটিতে ছোট ছোট এঁচোড় পড়ে আছে। মুজিবের মনে পড়ল কারাগারের দিনগুলোয় তাঁদের অনশনের প্রস্তুতির দিনগুলোর স্মৃতি। তিনি উপুড় হয়ে একটা এঁচোড় হাতে তুলে নিলেন, অলক্ষ্যে আঙুল দিয়ে খোঁচাতে লাগলেন এঁচোড়ের গায়। একটা বিড়াল তার পায়ের কাছে এসে মিউ মিউ করছে। মুজিবের মনে পড়ে গেল ঢাকা কারাগারে তাঁর পোষা বিড়ালটার কথা।
৪.
ঢাকা কারাগারে মুজিবের একটা পোষা বিড়াল ছিল।
আজ থেকে প্রায় এক মাস আগের কথা। ফেব্রুয়ারির শুরু। ১৯৫২ সাল। সামনে একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হবে। খাজা নাজিম উদ্দিন উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিয়ে আবারও ঘুমন্ত অগ্নিগিরির জ্বালামুখ খুলে দিয়েছেন। সারা দেশ, বিশেষ করে ঢাকায় ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারিতে বিক্ষোভ মিছিল-প্রতিবাদ আয়োজন করার। শেখ মুজিব কিছুদিন আগেও ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন ছাত্রলীগের নেতারা। মোহাম্মদ তোয়াহা আর অলি আহাদ এসেছেন। শওকত মিয়া এসেছেন। ছাত্রলীগের কর্মীরা এসেছেন। সবাই মিলে সেখানেই ঠিক করা হয়েছে, একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হবে এবং এ জন্য সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হবে। মুজিবও জানিয়ে দিয়েছেন, ‘আমার মুক্তি দাবি করে আমি ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট করব।’
জেলখানায় এসে মুজিব আর মহিউদ্দিন আল্টিমেটাম পাঠিয়ে দিলেন সরকারের কাছে। তাঁদের স্পষ্ট ঘোষণা, ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে মুক্তি না দিলে তাঁরা অনশন ধর্মঘট করবেন। দুই বছরের বেশি মুজিবকে আটক রাখা হয়েছে বিনা বিচারে। আর কত অন্যায় জুলুম সহ্য করা যায়!
তাঁদের অনশনের নোটিশ পেয়ে ঢাকা জেলের জেলার ছুটে এসেছিলেন মুজিবের কাছে।
‘অনশন করতে চাচ্ছেন কেন? আপনার শরীর খারাপ। মাত্র হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন। এখন অনশন করলে নির্ঘাত মারা যাবেন।’ তিনি মুজিবের উদ্দেশে বললেন হাত নেড়ে নেড়ে।
‘শরীর খারাপ? আপনাদের মেডিকেল বোর্ডই তো একজামিন করে রিপোর্ট দিয়েছে আমি সুস্থ। এখন আর হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন নাই। বাকি চিকিৎসা জেলখানাতেই চলতে পারে।’
‘হাসপাতালে থাকার প্রয়োজন নাই, সেটা বলেছে। কিন্তু আপনার চিকিৎসার প্রয়োজন নাই, সেটা তো বলে নাই।’
‘ছাব্বিশ-সাতাশ মাস বিনা বিচারে বন্দী রেখেছেন। কোনো অন্যায় তো করি নাই। আমি ঠিক করেছি জেলের বাইরে যাব। হয় জ্যান্ত অবস্থায়, না হয় মৃত অবস্থায়। ইদার আই উইল গো আউট অব দি জেইল অর মাই ডেডবডি উইল গো আউট।’
.
তাঁরা অনশন করবেন। সব ঠিকঠাক। বাইরে নেতা-কর্মীদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মুজিব আর মহিউদ্দিন মানসিকভাবে প্রস্তুত।
আগামী একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস। তার আগেই মুক্তি পেতে হবে মুজিবকে।
সকালবেলা। কেন্দ্রীয় কারাগারের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে মুজিব আর মহিউদ্দিন এসব নিয়েই কথা বলছিলেন। রাজপথে রোজ মিছিল হচ্ছে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দীদের মুক্তি চাই। শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিন কারাভবনের তিনতলার সিঁড়িতে এসে দাঁড়ান। এখান থেকে মিছিলকারীদের দেখা যায়। মিছিলকারীরাও বোধ করি শেখ মুজিবকে দেখে চিনতে পারেন। তাঁরা স্লোগান ধরেন, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’। নাজিম উদ্দিন রোডে এই কারাগার। মাঝামাঝি জায়গায় দেয়াল ঘেঁষে একটা মাজার। মিছিলগুলো সেই মাজারের কাছে এসে সমাবেশ করে। বক্তৃতা হয়।
মুজিব আর মহিউদ্দিন তিনতলার সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে হাততালি দিতে লাগলেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন জঙ্গি রূপ নিচ্ছে, মুজিব ছাত্রনেতাদের হাসপাতালে থাকতেই একুশে ফেব্রুয়ারি সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার পরামর্শ দিয়ে রেখেছেন। তাঁর সমস্ত অন্তর ছুটে যাচ্ছে বাইরের মিছিলে। কিন্তু তিনি নিজে যেতে পারছেন না। অনশন ধর্মঘট করে হয় একুশের আগেই মুক্তি আদায় করে নিতে হবে, না হলে ভেতরে থেকেই অনশনের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানানো যাবে।
মুজিব একটা জগে করে পানি নিয়ে বের হলেন বাইরে। ফেব্রুয়ারির নরম রোদে তাঁর লাগানো ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলার গাছগুলোর পাতা তীব্র সবুজ দেখাচ্ছে। গাছের পাতায় এখনো শিশিরবিন্দু জমে আছে। মুজিব জগ থেকে পানি ঢাললেন গাছের গোড়ায়।
তাঁদের পোষা বিড়ালটা এসে শুয়ে আছে বারান্দায়, কারাগারের পাঁচিল টপকে বারান্দায় এসে পড়া এক টুকরো রোদে। ভীষণ মোটা এই বিড়ালটা। মুজিব আর মহিউদ্দিন পাশাপাশি বিছানায় থাকেন। আর তাঁদের সঙ্গে থাকে এই বিড়ালটা। রাজবন্দী হিসেবে তাঁরা পর্যাপ্ত খাবার পান, মুরগির মাংস থেকে শুরু করে পাউরুটি, মাখন, দুধ পর্যন্ত। তাঁরা বিড়ালটাকে সেই খাবারের ভাগ দেন। বিড়ালটা ভীষণ মোটা হয়ে গেছে। কারাবন্দীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য নিয়মিত ওজন নেওয়া হয়, সেই ওজন মাপা মেশিনে বিড়ালটাকে তুলে মহিউদ্দিন একদিন মেপে দেখলেন, এর ওজন হয়েছে ১৩ পাউন্ড। সে এতই আরামপ্রিয় যে মুরগির মাংস নিজে চিবিয়ে খেতে পারে না। মুজিব মাংস চিবিয়ে বিড়ালটার সামনে ধরেন। ছোটবেলা থেকেই শেখ মুজিব বাড়িতে নানা ধরনের পশুপাখি পুষে আসছেন। বিড়ালটার জন্য আলাদা করে বিছানা-বালিশ-তোশকেরও ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁরা। বিড়ালটা এমন অলস আর মোটাগাটা হয়েছে যে ছোট্ট বিড়ালের বাচ্চা দেখলেও ভয়ে সে দৌড়ে মুজিব বা মহিউদ্দিনের বিছানার কোণে এসে আশ্রয় নেয়।
একজন ফালতুর পায়ে লেগে মুজিব-মহিউদ্দিনের ফুটবলটা গড়িয়ে গিয়ে বিড়ালটাকে আঘাত হানল। বিড়ালটা এমন অলস আর ধীরগতির যে সময়মতো নড়ে নিজেকে আঘাত থেকে বাঁচাতেও পারল না। ফুটবলের আঘাত পেয়ে সে মিউ মিউ করতে করতে মুজিবের পাশে চলে এল। মুজিব হাত বুলিয়ে তাকে আদর করলেন।
এই ফুটবলটাও এই নিঃসঙ্গ কারাগারে এ দুজন বন্দীর জন্য অনেক বড় সঙ্গ, গুরুত্বপূর্ণ এক বিনোদনের মাধ্যম। মুজিব আর মহিউদ্দিন রোজ ফুটবল খেলেন বিকেলবেলা। খেলা শেষে গোসল সারেন। তারপর কারাপ্রকোষ্ঠে ঢোকেন, যেমন করে রোজ সন্ধ্যায় পোষা মুরগি ঢুকে পড়ে খাঁচায়। ওয়ার্ডেন এসে প্রকোষ্ঠের লোহার দরজায় তালা না লাগানো পর্যন্ত তাঁদের কেমন যেন অস্বস্তি হয়। মুজিবকে সে কথা বলেছেন মহিউদ্দিন, ‘যেদিন ওরা তালা লাগাতে দেরি করে, সেদিন আমার কেমন যেন লাগে, মনে হয়, তালা দিতে আসে না কেন?’
খবরের কাগজ এসেছে। দুজনে একই সঙ্গে মনোযোগ দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন। এই সময় একজন কারাকর্তা এসে বললেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব, আপনাকে একটু জেলগেটে যেতে হবে।’
মুজিব মাথা না তুলেই বললেন, ‘কেন?’
‘আলোচনা আছে।
‘কী আলোচনা?’
‘অনশন বিষয়ে।’
মুজিব জেলগেটে গেলেন। একটু পর মহিউদ্দিনকেও আনা হলো সেখানে। তারও একটু পর মুজিবের মালপত্র, কাপড়চোপড়, বইপত্র সব আনা হলো। মহিউদ্দিনের জিনিসপত্রও এসে গেল।
মুজিব বললেন, ‘ব্যাপার কী?’
কারাকর্তারা বললেন, ‘আপনাদের বদলি করা হচ্ছে। অন্য জেলে নেওয়া হবে।’
‘কোন জেলে?’
কেউ কিছু বলতে চায় না। একটু পর একজন বলেই দিল, ফরিদপুর জেলে।
আর্মড পুলিশ, গোয়েন্দা অফিসার প্রস্তুত হয়ে আছেন।
মুজিব তাঁর জিনিসপত্র গোছাচ্ছেন খুব ধীরে ধীরে। তাঁর উদ্দেশ্য হলো, দেরি করিয়ে দেওয়া। ফরিদপুর যেতে হলে তাঁদের প্রথমে যেতে হবে নারায়ণগঞ্জে। সেখান থেকে স্টিমারে গোয়ালন্দ। নারায়ণগঞ্জে স্টিমার ফেল করলে তারা কিছুটা সময় বেশি নারায়ণগঞ্জে থাকার সুযোগ পাবেন। এখন তাঁদের ঢাকা কারাগার থেকে ফরিদপুর কারাগারে সরানো হচ্ছে কঠোর গোপনীয়তায়। কিন্তু মুজিবের প্রথম কর্তব্য হলো মানুষকে জানিয়ে দেওয়া যে তিনি কোথায় আছেন। নারায়ণগঞ্জে তাঁর পার্টির অবস্থা ভালো। কর্মীরা সংগঠিত ও সক্রিয়। তাঁদের কারও না কারও সঙ্গে দেখা হয়ে গেলেই তিনি জানিয়ে দিতে পারবেন তাঁর অবস্থান আর কর্মসূচির কথা। এই কারণে মুজিব তাঁর বইগুলো একটা একটা করে মেলে ধরলেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতার বই, নয়া চীনের ওপরে বই। তিনি পাতা উল্টে কবিতা পড়ছেন। যেন তাঁর কোনো তাড়া নেই।
তাঁর পাশে দাঁড়ানো গোয়েন্দা কর্মচারীরা অধৈর্য হয়ে উঠছেন। সুবেদার তাগিদ দিতে লাগলেন, ‘তাড়াতাড়ি করো, তাড়াতাড়ি করো।’ এই সুবেদার অবশ্য মুজিবকে প্রথম দিন জেলখানায় দেখে চমকে উঠে বলেছিলেন, ‘ইয়ে কিয়া বাত হায়, আপ জেলখানা মে।’ (‘এ কী কথা, আপনি জেলখানায়?’) মুজিব তাকিয়ে দেখলেন, এ যে সেই বেলুচ ভদ্রলোক, যিনি কিনা বহু দিন গোপালগঞ্জে নিয়োজিত ছিলেন। মুজিবকে দেখেছেন মুসলিম লীগের হয়ে পাকিস্তান আন্দোলন করতে। এখন পাকিস্তান আন্দোলনের এত বড় নেতাকে পাকিস্তানের কারাগারে দেখে তিনি বিস্ময় গোপন করতে পারলেন না। মুজিব হেসে বললেন, ‘কিসমত। আমার ভাগ্য।
ঘোড়ার গাড়ি এল কেন্দ্রীয় কারাগারের ফটকে। তাতে উঠতে বলা হলো মুজিব-মহিউদ্দিনকে।
মুজিব বললেন, ‘আমাদের পোষা বিড়ালটাকেও ফরিদপুর নিয়ে যাব। ওকে আমাদের সঙ্গে দেন।’
জেলার বললেন, ‘ওকে তো দেওয়া যাবে না। ওর তো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে।’
ওরা দুজনে ধীরে ধীরে ঘোড়ার গাড়িতে উঠলেন। তারপর গাড়ির দরজা- জানালা সব বন্ধ করে দেওয়া হলো। দুজন প্রহরী রইল গাড়ির ভেতরে এই দুই রাজবন্দীর সঙ্গে। বাকিরা আরেকটা গাড়িতে তাঁদের অনুসরণ করছে। গাড়ি চলছে ভিক্টোরিয়া পার্কের দিকে। সকাল ১০টার মতো বাজে। বাইরে বোধ হয় বেশ রোদ। আবহাওয়াটা সুন্দর। ফাল্গুনের শুরু। এখনো তেমন গরম পড়েনি। দুজন একসঙ্গে যাচ্ছেন। একজন গোপালগঞ্জের। আরেকজন বরিশালের। দুজনেই মুসলিম লীগ করতেন। দুজনেই পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন করেছেন। তবে শেখ মুজিব চিরকালই সোহরাওয়ার্দীপন্থী, আবুল হাশিমকেও তিনি তাত্ত্বিক গুরু মানেন, আর মহিউদ্দিন ছিলেন হাশিমবিরোধী। এখন তাঁরা একসঙ্গে একই সেলে থাকেন। একই সঙ্গে মৃত্যু না আসা পর্যন্ত কিংবা লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত অনশন করবেন। ‘তুমি থাকো খালে-বিলে আমি থাকি ডালে, দেখা হবে একসাথে মরণের কালে।’ মুজিব বিড়বিড় করলেন। ছোটবেলায় এই ধাঁধাটা শুনেছেন। এর উত্তর হলো : মাছ ও মরিচ। মাছ পানিতে থাকে, মরিচ থাকে ডালে, তাদের দেখা হয় রান্নার পাতিলে। মহিউদ্দিনের সঙ্গেও তাঁর এমনি করে দেখা হলো। তাঁরা দুজনে ছিলেন দুই মেরুতে। আজ মৃত্যু কি তাঁদের একসঙ্গে করল? ঘোড়ার খুরের শব্দ উঠছে রাস্তায়। তাঁদের গাড়ি চলছে।
ভিক্টোরিয়া পার্কের পাশের রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ি থামল। তাঁরা নেমে দেখেন, বাইরের পৃথিবীটা সত্যি রোদে-বাতাসে অপরূপ হয়ে আছে। একটা ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখেছে মর্ড পুলিশ। মুজিব ও মহিউদ্দিন আস্তে আস্তে নামলেন ঘোড়ার গাড়ি থেকে। ট্যাক্সিতে উঠলেনও আস্তে আস্তে। এদিক- ওদিক তাকালেন। পরিচিত কাউকে দেখা যায় কি না। না, পরিচিত কাউকে পাওয়া গেল না। ট্যাক্সি স্টার্ট নিল। আস্তে আস্তে চলতে শুরু করল নারায়ণগঞ্জ অভিমুখে। রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি, মোটরগাড়ি। দু-একটা পেটমোটা বাস। ট্যাক্সির জানালা দিয়ে বাইরের আলোকিত পৃথিবীটা দেখে নিচ্ছেন মুজিব। আদমজী কারখানা দেখা যাচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জ এল ট্যাক্সি। তাঁরা ট্যাক্সি থেকে নামলেন। ছায়া পড়ল তাঁদের পায়ের নিচে। দুপুর হয়ে গেছে। তাঁদের ইচ্ছাকৃত বিলম্ব কাজে লেগেছে। নারায়ণগঞ্জ স্টিমার ঘাটে এসে দেখা গেল স্টিমার চলে গেছে। এই বিলম্বের কারণ হলো, নারায়ণগঞ্জ শহরের ছাত্রকর্মীদের সঙ্গে তাঁর দেখা হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ানো। তাঁদের থানায় নিয়ে যাওয়া হলো। পরের জাহাজ রাত একটায়। থানায় পরিচিত লোক পেয়ে গেলেন মুজিব। মুহূর্তে খবর ছড়িয়ে পড়ল নারায়ণগঞ্জের নেতা-কর্মীদের মধ্যে, মুজিব এখন থানায়। থানায় চলে আসতে লাগলেন নেতা-কর্মীরা। তাঁদের কারও কারও হাতে খাবার। পুলিশ তাঁদের বেশিক্ষণ থানায় থাকতে দিতে চায় না। মুজিব বললেন, “রাতে কোন হোটেলে খেতে যাব বলেন।
একজন নেতা বললেন, ‘ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রোডে নতুন দোতলা হোটেল হয়েছে। ওখানে আসেন।’
মুজিব বললেন, ‘আমি রাত আটটা-সাড়ে আটটার দিকে ওই হোটেলে আসব। সবাইকে খবর দেন। জরুরি কথা আছে।’
রাত আটটায় সেই হোটেলে খেতে গিয়ে সব নেতা-কর্মীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল মুজিবের। তাঁরা বসেছেন দোতলায়।
মুজিব বললেন, ‘ভাসানী সাহেব, হক সাহেব, অন্য নেতাদের খবর দিন। খবরের কাগজগুলোকে জানান। আর সাপ্তাহিক ইত্তেফাক তো আছেই। আমরা আগামীকাল থেকেই আমরণ অনশন করব।’
নারায়ণগঞ্জের নেতারা বললেন, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি আমরা নারায়ণগঞ্জে পূর্ণ হরতাল করব। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি তো আছেই, আমরা আপনার মুক্তির দাবিও করব।’
‘আমার মুক্তির দাবির সঙ্গে মহিউদ্দিনের মুক্তির দাবিও লাগায়ে দেন।’
‘মহিউদ্দিনকে কি বিশ্বাস করা যায়? সে তো মুসলিম লীগার। আবার কারাগারে এসেছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার কারণে। কী রকম অত্যাচারী হলে মুসলিম লীগ সরকার একজন মুসলিম লীগারকে জেলে পোরে, বোঝেন। উনি বেরিয়ে গিয়ে আবার মুসলিম লীগই করবেন।’
মুজিব মুখের খাবারটা গিলে নিয়ে বললেন, ‘আমাদের কাজ আমরা করি। তার কর্তব্য সে করবে। তবে মুসলিম লীগ করবে না! সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নাই। সে বন্দী, তার মুক্তি চাইতে আপত্তি কী? মানুষকে ভালোবাসা, ভালো ব্যবহার ও প্রীতি দিয়েই জয় করা যায়, অত্যাচার, জুলুম, ঘৃণা দিয়ে জয় করা যায় না।
রাত ১১টায় মুজিব ও মহিউদ্দিনকে স্টিমার ঘাটে আনা হলো। জাহাজ ঘাটেই নোঙর করা ছিল, তাঁরা তাতে উঠে পড়লেন। জাহাজ না ছাড়া পর্যন্ত সব নেতা-কর্মী জাহাজঘাটে দাঁড়িয়ে রইল। রাত একটায় জাহাজ ছাড়বে। জোরে জোরে হর্ন বেজে উঠল। মুজিব নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। বললেন, ‘জীবনে আর কোনো দিন দেখা হবে কি না জানি না, আপনারা আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। দুঃখ নেই। মরতে তো একদিন হবেই। অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যদি মরতে পারি, সেই মরণেও শান্তি আছে।’ কর্মীরা কেউ জাহাজ থেকে নামছে না। জাহাজ ছাড়তে পারছে না। মুজিব কর্মীদের বললেন, ‘আপনারা জাহাজ থেকে নামেন। আমাদের যেতে দেন। আমরা থাকব ফরিদপুর জেলে। আপনারা নারায়ণগঞ্জের রাজপথে। আমরা আপনাদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম। আমরা সবাই এক থাকব, একাত্মা হয়েই থাকব। আমাদের দয়া করে যেতে দেন। স্টিমারটা ছাড়তে দেন।’ নেতা-কর্মীরা স্টিমার থেকে নেমে গিয়ে স্টিমারটা ছাড়ার সুযোগ করে দিলেন। নোঙর উঠল। কাঠের সিঁড়ি সরিয়ে নেওয়া হলো। নদীতে কল্লোল তুলে জাহাজ জেটি থেকে দূরে সরে যেতে লাগল। ঘাটে সব নেতা-কর্মীর মুখ দেখা যাচ্ছে ইলেকট্রিকের আলোয়। তাঁদের অনেকের চোখেই টলমল করছে অশ্রু।
মুজিব আর মহিউদ্দিনকে দেওয়া হয়েছে ইন্টারক্লাস। কাঠের বেঞ্চ। মহিউদ্দিন ঘুমোতে পারলেন না। মুজিব একটু পরই ঘুমিয়ে পড়লেন। গভীর রাতে জাহাজ পৌঁছাল গোয়ালন্দ ঘাটে। সেখান থেকে ট্রেনে ফরিদপুর।
.
ফরিদপুর কারাগারে মহিউদ্দিন আহমদ ও শেখ মুজিবুর রহমানকে নেওয়া হলো জেল হাসপাতালে।
ফরিদপুর কারাগারটা বেশ ছিমছাম। জেলখানার ভেতরের সরু পথগুলোর দুই পাশে সারি সারি পেঁপেগাছ। তাতে পেঁপে ধরে আছে। সেই পথ বেয়ে তাঁরা এলেন হাসপাতালে। দোতলা হাসপাতাল ভবন। তাঁদের রাখা হলো নিচতলার একটা কক্ষে। সেখানে ঢুকে তাঁরা দেখতে পেলেন দুটো পালঙ্ক, জাজিমের ওপর ধোপদুরস্ত চাদর। দেখে যেন চোখ জুড়িয়ে যায়। মহিউদ্দিন বললেন, ‘এই আমাদের মৃত্যুশয্যা পাতা হয়েছে, আমাদের দুজনকেই এখানে শেষশয্যা গ্রহণ করতে হবে।’
মুজিব নীরব-নিথর হয়ে গেলেন। মৃত্যুকে তিনি ভয় পান না। আমরণ অনশন মানে যে মরণ না হওয়া পর্যন্ত না খেয়ে থাকা, এটা জেনে-বুঝেই তিনি অনশনে যাচ্ছেন।
মহিউদ্দিন কারাকর্মীদের বললেন, ‘আমাদের জন্য ক্যাস্টর অয়েল আর ঘোলের শরবত আনেন। এটা খেয়ে আগে পেট পরিষ্কার করে নিতে হবে
কারা কর্তৃপক্ষ ক্যাস্টর অয়েল ও ঘোলের শরবতের ব্যবস্থা করলেন। তাঁরা দুজনেই ক্যাস্টর অয়েল মুখে ঢেলে খেয়ে নিলেন। রাতের মধ্যেই তাঁদের পেট পরিষ্কার হয়ে গেল।
সকালে উঠে তাঁরা প্রথমে দুই গেলাস ঘোলের শরবত খেয়ে নিলেন। এরপর তাঁরা আর কিছুই খাবেন না। তবে কাগজি লেবু আর লবণ দিতে বলেছেন।
শেখ মুজিবের স্বাস্থ্য এমনিতেই খুব খারাপ। চোখে অসুখ, হার্টের অসুখ। মহিউদ্দিনেরও প্লুরিসিস রোগ। তাঁরা মুখে কোনো কিছুই খাচ্ছেন না। শুধু লেবু আর লবণ মেশানো পানি পান করছেন। কারণ তাঁরা জানেন, এর কোনো ফুড ভ্যালু নেই। শিগগিরই তাঁদের ওজন কমে যেতে লাগল। জেলার, ডেপুটি জেলার, জেলের ডাক্তাররা প্রমাদ গুনলেন। প্রতিদিন পাঁচ পাউন্ড করে ওজন কমছে দুজনের। দুই অনশনকারীর নাকের ভেতরেই জোর করে নল ঢুকিয়ে পাকস্থলী পর্যন্ত নেওয়া হলো। সেই নলের এক মাথায় একটা কাপের মতো, যার ভেতরে নল ঢোকানোর ছিদ্র আছে, সেই কাপের মধ্যে দুধের মতো তরল খাবার রাখা হয়। পেটের ভেতর সেটা আস্তে আস্তে ঢুকে পড়ে। মহাবিপদ! শেখ মুজিবের নাকে আগে থেকেই একটা অসুখ ছিল। দু-তিনবার খাবারের নল ঢোকাতেই নাকে ঘা হয়ে গেল। এখন নল ঢোকাতে গেলেই রক্ত উঠে আসে। প্রচণ্ড কষ্ট হয়। তিনি বাধা দিতে লাগলেন, কিছুতেই নাকে নল ঢোকাতে দেবেন না। তখন জেল কর্তৃপক্ষ হ্যান্ডকাফ নিয়ে এল। যদি নাকে নল ঢোকাতে বাধা দেওয়া হয়, তাহলে মুজিবের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেওয়া হবে।
নল ঢোকানোর সময় ভীষণ কষ্ট হচ্ছে মুজিবের। তিনি বুঝতে পারছেন, নলটা একটু এদিক-ওদিক হলেই তিনি মারা যাবেন। তাঁর হার্টের অসুখও বেড়ে গেছে। ভীষণ প্যালপিটিশন হচ্ছে। বিছানার সঙ্গে শরীর একেবারেই সেঁটে গেছে। তিনি নিঃশ্বাসও নিতে পারছেন না ঠিকমতো।
মুজিবের মনে হলো, মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু তিনি অনশন ভাঙবেন না। তিনি তো এককথার মানুষ। তিনি মুক্তি আদায় করেই ছাড়বেন। হয় তিনি বাইরের আলো-বাতাসে শ্বাস নেবেন, নয়তো তাঁর লাশ কারাগার থেকে বাইরে আসবে। সিভিল সার্জন, জেলার সাহেব, জেলের ডাক্তার সবাই বারবার বলছেন, ‘সাহেব, অনশন ভাঙুন।’ কিন্তু দাবি আদায় না করে রণে ভঙ্গ দেওয়ার পাত্র তো মুজিব নন।
তিনি একজন কয়েদিকে দিয়ে কয়েক টুকরো কাগজ আনালেন। তিনি চিঠি লিখবেন। বিছানায় জেলখানার লাইব্রেরি থেকে আনা বইয়ের ওপরে কাগজ রেখে কলম দিয়ে লিখবেন। উঠে বসতেও কষ্ট হচ্ছে। হাত কাঁপছে। জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে। বুক কাঁপছে হাপরের মতো। কাঁপা কাঁপা অক্ষরে তিনি চিঠি লিখলেন। প্রথমে লিখলেন আব্বাকে। তারপর রেনুকে। আর দুটো চিঠি লিখলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানী সাহেবের নামে। তিনি সবার কাছে বিদায় নিলেন। লিখলেন, ‘আমার ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিও/দিবেন।’
নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। রক্তে তাঁর গায়ের জামা লাল হয়ে গেছে। মুজিব সেই রক্তের দিকে একবার তাকালেন। কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। চার দিন খাওয়া নাই। বুক ঢিপঢিপ করছে। যেন প্রাণপ্রদীপ নিভে আসছে। কেরোসিনের ল্যাম্পোর তেল শেষ হয়ে গেলে পটপট শব্দ হয়, আর শিখাটা দপদপিয়ে একটুখানি উজ্জ্বলতর হয়ে জ্বলে ওঠে। তারপর নিভে যায়। শেখ মুজিবের হৃৎপিণ্ডটা কি নিভন্ত সলতের মতো শেষ আওয়াজটুকু করে নিচ্ছে। শরীর অসাড় হয়ে পড়ছে।
ঠিক এই সময় যেন স্লোগানের আওয়াজ কানে আসতে লাগল : ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বাঙালিদের শোষণ করা চলবে না’, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’। শেখ মুজিবের মনে হলো, আজ একুশে ফেব্রুয়ারি, রাষ্ট্রভাষা দিবস, সারা দেশে হরতাল পালিত হচ্ছে। ঢাকায় আজকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বড় ধরনের আন্দোলনের কর্মসূচি পালিত হওয়ার কথা। ঢাকায় কী হচ্ছে কে জানে?
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান শেখ মুজিবের নিস্তেজ শরীরে যেন খানিকটা তেজের সঞ্চার করল। ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’ স্লোগান শুনে মুজিব একটু মন খারাপ করলেন মহিউদ্দিনের জন্য। বেচারা মহিউদ্দিন! রোগে-শোকে মহিউদ্দিনের অবস্থা কাহিল। কিন্তু তাঁর মুক্তির দাবিতে কেউ স্লোগান দিচ্ছে না। আসলে মহিউদ্দিন আহমদ মুজিবের সঙ্গে একত্রে অনশন করবেন, এই কথা ছাত্রলীগের বা আওয়ামী মুসলিম লীগের কেউই মানতে পারছে না। যেমন মানতে পারেননি নারায়ণগঞ্জের নেতা-কর্মীরা।
আজকেও ফরিদপুরের মানুষ মুজিবের মুক্তির দাবিতে জেলখানার বাইরে স্লোগান দিচ্ছে, কিন্তু মহিউদ্দিনের মুক্তি চাইছে না। আচ্ছা, তাহলে শুধু রাজবন্দীদের মুক্তি চাই স্লোগান দিলেই তো হয়, মুজিব বিড়বিড় করেন।
রাতের বেলা মুজিব আর মহিউদ্দিন ফরিদপুর কারাগার হাসপাতালে পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে আছেন। সেপাইরা ডিউটি করতে এসে খবর দিল, ঢাকায় ভীষণ গোলমাল হয়েছে। কত লোক মারা গেছে বলা মুশকিল। গুলি হয়েছে।
শরীরে এক কণা শক্তিও অবশিষ্ট নাই, তবু মুজিব উত্তেজনায় উঠে বসলেন। তাঁকে দেখে উঠে বসলেন মহিউদ্দিনও। ডিউটিরত প্রহরীদ্বয় আবার ধরে তাঁদের দুজনকেই শুইয়ে দিলেন। মুজিবের খুবই খারাপ লাগছে। তাঁর মনে হচ্ছে, তিনি চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলছেন। গুলি কেন করবে? তিনি বিড়বিড় করতে লাগলেন। মানুষ হরতাল করবে, শোভাযাত্রা করবে, সভা করবে, কেউ তো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায় না। তিনি নিজের মনে কথা কইতে থাকেন। কোনো গোলমাল করার কথা কখনো কোনো আন্দোলনকারীর চিন্তায়ও থাকে না। ১৪৪ ধারা জারি করলেই গন্ডগোল লাগে। ১৪৪ ধারা জারি না করলে কোনো সমস্যাই হয় না।
রাত বাড়ছে। মুজিবের চোখে ঘুম নাই। মাথার ওপর একটা ইলেকট্রিক বাল্ব জ্বলছে। ওই বিছানায় মহিউদ্দিন শুয়ে আছেন। দুজন সেপাই পাহারা দিচ্ছেন। আরেকজন সেপাই এলেন। মুজিব বললেন, ‘ঢাকার আর কোনো খবর পাওয়া গেল?’
অনেক ছাত্র মারা গেছে। বহু লোক গ্রেপ্তার হয়েছে। সেপাই ভদ্রলোক জানালেন।
মুজিবের চোখের ঘুম একেবারেই হারাম হয়ে গেল।
পরের দিন সকাল থেকেই স্লোগানের শব্দ আসছে। শোনা গেল, ফরিদপুর শহর পরিণত হয়েছে মিছিলের শহরে। কয়েকজন ছাত্রছাত্রী এক জায়গায় একত্র হলেই স্লোগান ধরে। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে পর্যন্ত রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে আর স্লোগান দিচ্ছে। এই হাসপাতালটা বড় রাস্তার মোড়েই। রাস্তায় যে অনেক লোক জমে গেছে, বিক্ষোভ করছে, সব শোনা যাচ্ছে। হর্ন লাগিয়ে বক্তৃতা করছে কেউ একজন। মুজিব বিছানায় শুয়ে সব শুনতে পেলেন। দোতলায় গেলে দেখাও যাবে। কিন্তু শরীরে একটু বল নাই। দোতলায় উঠতে পারবেন না।
মুজিব বিড়বিড় করতে লাগলেন, ‘রক্ত যখন আমাদের ছেলেরা দিয়েছে, তখন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে হবেই।’ তবে তাঁর শরীরের যে অবস্থা, তাতে তিনি দেখে যেতে পারবেন কি না, ঘোরতর সন্দেহ।
এক দিন পরের খবরের কাগজে জানা যেতে লাগল ঘটনার কিছু কিছু। দুদিন পর জানা গেল আরেকটু বিস্তৃত। আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতা- কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
.
শেখ মুজিবের নাড়ি ধরে আছেন সিভিল সার্জন সাহেব। তিনি দিনের মনে পাঁচ-ছয়বার করে আসছেন। তাঁর চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ! কারণ মুজিবের নাড়ির গতি ধীর হয়ে আসছে। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। মুজিব দেখলেন, তাঁর হাত ধরা অবস্থাতেই সিভিল সার্জ সাহেবের মুখটা অন্ধকারে ছেয়ে গেল। তিনি হাত ছেড়ে দিলেন। তারপ গম্ভীর মুখে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। মুজিব বুঝতে পারলেন, তার সম ঘনিয়ে আসছে। পৃথিবীকে বিদায় বলতে হবে। মরতে তিনি ভয় পান না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে মরার মধ্যে একটা সার্থকতা আছে।
আবার জুতার শব্দ। সিভিল সার্জন সাহেব ফিরে আসছেন। তিনি আবারও মুজিবের পাশে বসলেন। মুজিবের হাত ধরে বললেন, ‘এভাবে মৃত্যুবরণ করে কোনো লাভ হবে? বাংলাদেশ আপনার কাছে অনেক কিছু আশা করে।
মুজিবের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। তিনি অনেক কষ্টে মুখ খুলে আস্তে আস্তে বললেন, ‘অনেক লোক আছে, কাজ পড়ে থাকবে না। দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালোবাসি, তাদের জন্য জীবন দিতে পারলাম, এটাই শান্তি।’
একসময় ডেপুটি জেলার সাহেবও পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বললেন, ‘কাউকে খবর দিতে হবে? আপনার ছেলেমেয়ে, স্ত্রী কোথায়? আপনার আব্বার কাছে টেলিফোন করবেন কি?’
মুজিব অনুচ্চ কণ্ঠে বললেন, ‘দরকার নাই। জীবনে অনেক কষ্ট তাঁদের দিয়েছি। আর কষ্ট দিতে চাই না।’
আর কোনো আশা নাই। মুজিবের হাত-পা সব ঠান্ডা আর অবশ হয়ে আসছে। একজন কয়েদি সরষের তেল গরম করে শেখ মুজিবের হাত-পায়ে মালিশ করে দিতে লাগলেন।
মুজিব তাকালেন মহিউদ্দিন আহমদের বিছানার দিকে। তাঁর অবস্থাও ভালো নয়। প্লুরিসিস রোগ তাঁকে আক্রমণ করেছে। বুকে প্রচণ্ড ব্যথার কথা তিনি বলেন। তাঁর শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। বারবার কাশি দেন। ভয়ংকর কষ্ট পাচ্ছেন তিনি।
একজন কর্মচারী এসে দাঁড়িয়েছেন মুজিবের বিছানার পাশে। মুজিব তাঁকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। তারপর চারটা কাগজের টুকরায় লেখা চিঠি চারটা বালিশের নিচ থেকে বের করার চেষ্টা করলেন। কর্মচারী তাঁকে সাহায্য করলেন। তিনি চিঠিগুলো লোকটির হাতে দিয়ে বললেন, ‘আমি তো আর বাঁচব না। ফরিদপুরেই আমার বোনের বাসা আছে। আমার মৃত্যুর পর চিঠি চারটা সেখানে পৌঁছে দিলেই চলবে। পারবা না?’
‘জি, পারব।’ কর্মচারীটি বললেন।
‘দেখো, তুমি কিন্তু কথা দিতেছ। মৃত্যুপথযাত্রীকে দেওয়া কথা কিন্তু রাখতে হয়। ওয়াদা করে বলো, কথা রাখবে।’
কর্মচারীটি ওয়াদা করলেন।
শেখ মুজিবের চোখের সামনে তাঁর আব্বার মুখ। তাঁর মায়ের মুখ। ভাইবোনের মুখ। তারপর তাঁর মনের পর্দায় স্থির হয় রেনুর মুখ। রেনুর তো বয়স বেশি নয়। পুরো জীবনটাই তাঁর পড়ে আছে সামনে। দুটো ছোট্ট বাচ্চা তাঁর কোলে। বাচ্চা দুটোকে নিয়ে সে কোথায় দাঁড়াবে? খাওয়া-পরার চিন্তা হয়তো করতে হবে না। আব্বা আছেন। মা আছেন। ভাইবোনেরা আছে। নাসের হয়তো তাঁর ভাবিকে, ভাস্তে-ভাস্তিকে ঠিকমতোই দেখাশোনা করবে। হাসিনাকে, কামালকে দেখতে বড় ইচ্ছা করছে। হাসিনা কত বড় হয়েছে? সাড়ে চার? কামাল? হাসিনা তো অনেক কথা বলে। কামালও আধো আধো কথা বলতে পারে…এদের সবাইকে ছেড়ে অসময়ে চলে যেতে হচ্ছে। যুগে যুগে মানুষ মানুষের মুক্তির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছে। এভাবেই অন্যায়ের প্রতিবাদ সংঘটিত হতে পেরেছে। মৃত্যুভয়ের ঊর্ধ্বে না উঠতে পারলে কিসের দেশপ্রেম! আত্মদান করতে প্রস্তুত থাকতে না পারলে কিসের রাজনীতি! মানুষ যখন মরতে শেখে, তখনই তাকে আর দাবায়া রাখা যায় না!
মহিউদ্দিনের হাত ধরে শুয়ে আছেন মুজিব। পাশাপাশি খাট। হাত বাড়ালে হাত ধরা যায়। মুজিবের বুকে খুব ব্যথা। মহিউদ্দিনেরও নিশ্চয়ই। মাগরেবের আজান হয়ে গেছে অনেক আগে। একটা ছোট্ট টেবিলে রাখা হারিকেন জ্বলছে। টেবিলে লেবুর কাটা টুকরো, গেলাস, লবণ। এই কেবল তাদের খাদ্য। এখন জোর করে নাকের নল দিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টাও কমে এসেছে। কারণ নাকের ভেতরে ঘা। নল ঢোকাতে গেলেই রক্ত উঠে আসে।
মৃত্যু যখন আসন্ন, তখন তাকে সুন্দরভাবে বরণ করে নেওয়াই সংগত। দুজন কয়েদি বসে আছে এই ঘরের দরজায়। মুজিব তাঁদের ইঙ্গিতে কাছে ডাকলেন। ওরা মুজিবের খুবই অনুগত। ছুটে এল। মুজিবের মুখের কাছে কান আনল। বলেন।
মুজিব বললেন, ‘পানি আনো। অজু করিয়ে দাও।’
দুজন কয়েদি মিলে প্রথমে মুজিবকে আর পরে মহিউদ্দিনকে অজু করালেন। ওরা দুজন শুয়েই শুয়েই অজু করলেন। ওঠার শক্তি দুজনের কারোরই নেই।
অজু করার পর তিনি দোয়াদরুদ পড়তে লাগলেন। সুরা ফাতিহা, সুরা এখলাস তিনবার, দরুদ শরিফ। মুজিব চিত হয়ে শুয়েই দুই হাত একত্র করে মুখের সামনে মোনাজাতের ভঙ্গিতে ধরলেন। তারপর প্রার্থনা করতে লাগলেন, ‘হে আল্লাহ, গাফুরুর রাহিম। তুমি মাফ করে দাও। পৃথিবীর সব মানুষকে ভালো রাখো। আমার বাংলার প্রতিটি মানুষকে ভালো রাখো। তাদের মঙ্গল করো। আব্বাকে ভালো রাখো, মাকে ভালো রাখো। ভাইবোনদের ভালো রাখো। রেনুকে ভালো রাখো। আমার ছোট্ট সোনামণি হাসিনাকে ভালো রাখো। কামালকে ভালো রাখো। আমার না থাকার বিনিময়ে আমার দেশের সব মানুষকে ভালো রাখো।’
তিনি চোখ বন্ধ করে আপনমনে দোয়া করে চলেছেন। কখন যে ডেপুটি জেলার তাঁর পাশে এসে বসেছেন, তিনি টেরও পাননি। তিনি তাঁর কপালে হাত রেখে বললেন, ‘আপনাকে যদি মুক্তি দেওয়া হয়, খাবেন তো!’
মুজিব চোখ মেললেন। দেখলেন, তাঁর পাশে ডেপুটি জেলার, ভদ্রলোক আবারও বললেন, ‘আপনাকে যদি মুক্তি দেওয়া হয়, আপনি খাবেন তো!’
শেখ মুজিব অনুচ্চ স্বরে বললেন, ‘মুক্তি দিলে খাব। না দিলে খাব না। তবে মুক্তি নিয়ে আমি আর চিন্তিত না। আমার লাশ ঠিকই মুক্তি পেয়ে যাবে।’
ডাক্তার সাহেব এসে গেছেন, সঙ্গে আরও কয়েকজন কর্মচারী, মুজিব একটু চোখ সরিয়ে দেখতে পেলেন।
ডেপুটি জেলার বললেন, ‘আপনার মুক্তির অর্ডার এসে গেছে। ঢাকা থেকে এসেছে রেডিওগ্রামে। আবার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবও একটা অর্ডার পাঠিয়েছেন। দুটো অর্ডারই পেয়ে গেছি।’
ডেপুটি জেলার অর্ডার পড়ে শোনালেন।
মুজিব বললেন, ‘আমি বিশ্বাস করি না। আপনারা আমাকে খাওয়ানোর জন্য এসব বানিয়ে বলছেন।’
মহিউদ্দিন বললেন, ‘আমাকে দেন তো অর্ডারগুলা। আমি পড়ে দেখি।’
শয্যাশায়ী মহিউদ্দিনের কাছে কাগজগুলো নেওয়া হলো। তিনি পড়লেন। দেখলেন, ঠিকই অর্ডার এসেছে। বললেন, ‘তোমার অর্ডার সত্যি এসেছে, মুজিব।’
তিনি হাত বাড়িয়ে মুজিবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
ডেপুটি জেলার বললেন, ‘আমাকে অবিশ্বাস করার কিছু নাই। কারণ, আমার কোনো স্বার্থ নাই। আপনার মুক্তির অর্ডার সত্যি এসেছে।’
কাটা ডাব চলে এল। গেলাসে ডাবের পানি ঢালা হলো।
মহিউদ্দিন বললেন, ‘মুজিব, আমি তোমার মুখে পানি দেব। আমিই তোমার অনশন ভঙ্গ করাব।’
মহিউদ্দিনকে ধরে বিছানায় বসানো হলো। চামচে ডাবের পানি ঢেলে তাঁর হাতে দেওয়া হলে তিনি তা মুজিবের মুখে ধরলেন। মুজিবের অনশন ভঙ্গ হলো।
মুজিবের মুক্তির আদেশ এসে গেছে। কিন্তু জেলে যাওয়ার শক্তি তে মুজিবের নেই। সিভিল সার্জন সাহেবও বললেন, ‘এইভাবে আপনাকে ছাড়া যাবে না। রাতটা থাকুন। আপনার শরীরটা একটু ভালো হোক। তারপর কালকে দেখা যাবে।
মুজিবকে ডাবের পানিই খাওয়ানো হতে লাগল। অন্য কিছু মুখে নেওয়ার মতো শক্তি তাঁর নেই।
মুজিব চিন্তিত হয়ে পড়লেন মহিউদ্দিনের জন্য। তাঁর মুক্তির আদেশ এসে গেছে, কিন্তু মহিউদ্দিনেরটা যে এল না? মহিউদ্দিনের অবস্থাও তো খুবই খারাপ। তাঁকে কেন ছাড়বে না? মুজিব না হয় মুসলিম লীগ সরকারের দুশমন হয়ে পড়েছেন, মহিউদ্দিন তো কারাগারে আসার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত মুসলিম লীগারই ছিলেন। দুশ্চিন্তার কথা হলো, রাজনীতিতে নিজের দলের লোক যখন পর হয়ে যায়, তখন অন্য দলের লোকের চেয়েও সে-ই হয়ে ওঠে বড় শত্রু।
এসব নানা ভাবনায় রাত কেটে গেল।
পরের দিন মুজিবকে নরম ভাত খেতে দেওয়া হলো। খুব একটা যে খেতে পারলেন, তা নয়। তবু শরীরে খানিকটা বল ফিরে আসছে। সকাল ১০টার দিকে খবর পেলেন, তাঁর আব্বা এসেছেন জেলগেটে। মুজিবের তখন বাইরে যাওয়ার মতো শারীরিক অবস্থা নয়। কাজেই লুৎফর রহমান সাহেব নিজেই এলেন জেলখানার এই হাসপাতালে।
মাথায় টুপি, শ্মশ্রুমণ্ডিত লুৎফর রহমান ছেলের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলেন। কী চেহারা হয়েছে ছেলের! এমন শুকিয়ে গেছে, মনে হচ্ছে, দু- টুকরা কাপড় পরে আছে বিছানায়। তাঁর চোখে জল এসে যাচ্ছে। তাঁর সহ্যশক্তি অসাধারণ বলেই সবাই জানে। তিনি নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু চোখের পানি বাঁধ মানছে না। তিনি চোখ মুছে নিলেন। ছেলের পাশে বসে তাঁর কপালে হাত রাখলেন।
মুজিব বললেন, ‘আব্বা।’
লুৎফর রহমান সাহেব বললেন, “বাবা, তোমার মুক্তির আদেশ হয়েছে। তোমাকে আমি বাড়ি নিয়ে যাব। তুমি অনশন ধর্মঘট করবে, এই খবর পাওয়ার পর আমরা ঢাকা গিয়েছিলাম। তোমার মা, রেনু, হাসিনা, কামাল…ওদের সঙ্গে করে নিয়ে গেলাম। জেলে গিয়ে শুনলাম, তুমি ঢাকায় নাই। কোথায় আছ, কেউ বলে না। দুই দিন বসে রইলাম। তারপর জানতে পারলাম, তুমি ফরিদপুর। তখন আর ফরিদপুর আসার উপায় নেই। হরতালের কারণে রাস্তাঘাট সব বন্ধ। নারায়ণগঞ্জ এসে জাহাজ ধরব, তা-ও পারছিলাম না। তোমার মা, রেনু ও বাচ্চাদের সবাইকে ঢাকায় রেখে আমি চলে এসেছি। কারণ আমার সন্দেহ হচ্ছিল, তোমাকে আদৌ ফরিদপুর নিয়েছে নাকি অন্য কোথাও নিয়েছে। আজই ঢাকায় টেলিগ্রাম করে দেব, ওরা টুঙ্গিপাড়া চলে আসুক। আমি তোমাকে নিয়ে আগামীকাল বা পরশু রওনা করব ইনশাল্লাহ। সিভিল সার্জন সাহেব তোমাকে ছাড়তে চান না। আমি জোর করায় বললেন, তাহলে লিখে দিতে হবে আমি নিজ দায়িত্বে তোমাকে নিচ্ছি।’ মুজিব বললেন, ‘আব্বা, আমি তো মুক্তি পেলাম। কিন্তু মহিউদ্দিনের কী হবে? ওকে না ছাড়লে তো ও অনশন ভঙ্গ করবে না। ও তো এখানেই মারা যাবে।
লুৎফর রহমান বললেন, ‘খবর পেয়েছি মহিউদ্দিনকেও মুক্তি দেওয়া হবে। তবে তোমার সঙ্গে ছাড়বে না। এক দিন পর ছাড়বে।’
মুজিব হাত বাড়িয়ে তাঁর আব্বার হাতটা ধরলেন। লুৎফর রহমান সাহেব বললেন, ‘আর দুশ্চিন্তা কোরো না। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। তুমিও সুস্থ হয়ে উঠবে। মহিউদ্দিনও ছাড়া পাবে। মানুষের দোয়া তোমার জন্য আছে। ইনশাল্লাহ কোনো ক্ষতি হবে না তোমার।’
মুজিবকে স্ট্রেচারে তোলা হবে। কারাগারের বাইরে নেওয়া হবে। মুজিব মহিউদ্দিনের খাটের কাছে চলে এলেন। তাঁকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। বললেন, ‘মহিউদ্দিন, আজকে তোকে একলা ফেলে রেখে চলে যেতে হচ্ছে এ জন্য তুই আমার কোনো অপরাধ নিস না। আমি সব সময়ই তোর পাশে আছি। বাইরে গিয়ে তোকে ভুলে যাব না। তোর মুক্তির জন্য অবশ্যই আমি সংগ্রাম করব।’
মুজিব বেরিয়ে এলেন।
কারাগারের বাইরে তখন জনতার ভিড়। সেখান থেকে ফরিদপুরের বোনের বাড়ি। পরদিন ট্যাক্সিতে ভাঙ্গা। ভাঙ্গা থেকে মুজিবের বড় বোনের বাড়ি দত্তপাড়া। সেখানে এক দিন এক রাত থেকে নৌকায় গোপালগঞ্জ। মুজিব এখনো শয্যাশায়ী। কিন্তু যেখানে যে ঘাটে যাচ্ছেন, জনতা ভিড় করে ঘিরে ধরছে তাঁকে। সিন্ধিয়াঘাটে কর্মীরা যখনই শুনল, নৌকা যাচ্ছে গোপালগঞ্জ, তারা জাহাজে উঠে পড়ল গোপালগঞ্জ যাবে বলে। গোপালগঞ্জ যখন পৌঁছালেন তখন নদীর পাড়ে মানুষ আর মানুষ। তাঁকে তারা নামাবেই। লুৎফর রহমান প্রমাদ গুনলেন, ‘তোমরা ওকে মেরে ফেলতে চাও নাকি?’
জনতা কিছুই শুনল না। তারা মুজিবকে কোলে করে রাস্তায় নিয়ে গিয়ে মিছিল করতে লাগল।