উষার দুয়ারে – ৪৫
৪৫.
মওলানা ভাসানী আর শেখ মুজিব টাঙ্গাইলে কর্মী সম্মেলনে হাজির হয়েছেন। কর্মীরা বক্তৃতা করছেন। এরপর নেতাদের পালা। ভাসানী ও মুজিব দুজনেই মঞ্চে বসা। ভিড়ে গিজগিজ করছে চারপাশ। চৈত্র মাস। কাল রাতে বৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়া সহনীয়।
গরম যা পড়েছে, তা মানুষের ভিড়ের গরম।
এই সময় টাঙ্গাইলের এসডিও এসে হাজির। শেখ মুজিবের কাছে এসে বললেন, ‘আমার কাছে রেডিওগ্রাম এসেছে, প্রধানমন্ত্রী আপনাকে ঢাকা যেতে বলেছেন।’
মুজিব ভাসানীর সঙ্গে পরামর্শ করলেন। এখন কেন ঢাকা যেতে বলবে?
ভাসানী বললেন, ‘তোমারে মন্ত্রী হইতে কইব নিশ্চয়ই।’
মুজিব বললেন, ‘কেন? এখন কেন আমাকে মন্ত্রী হতে বলে? বিপদ দেখেছে?’
মুজিবের এই কথা বলার একটা মানে আছে। ঢাকায় মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেই ফজলুল হক সপারিষদ চললেন করাচি। মুসলিম লীগ নেতারা তাঁর সঙ্গে দেখা করে বললেন, ‘আপনাকে তো আমরা পছন্দ করি। আপনি যাতে ক্ষমতায় থাকতে পারেন আমরা দেখব। কিন্তু আমাদের বড় অপছন্দ ওই আওয়ামী লীগ। আপনি আওয়ামী লীগকে দূরে সরিয়ে রাখেন।’
এরপর ফেরার পথে ফজলুল হক গেলেন কলকাতা। সেখানে সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বললেন আবেগপূর্ণ কথা। বললেন, ‘এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, দুই বাংলার জনগণকে একটা মৌলিক সত্য উপলব্ধি করতে হবে, সুখে বসবাস করতে চাইলে তাদের অবশ্যই পরস্পরকে সহযোগিতা করতে হবে। রাজনীতিবিদেরা ভূখণ্ডকে ভাগ করেছেন বটে, কিন্তু সাধারণ জনতাকে এটা নিশ্চিত করতে হবে, যেন প্রতিটা মানুষ শান্তিতে থাকে। ইতিহাসে প্রমাণিত হয়েছে, ভাষা হলো ঐক্যের সবচেয়ে বড় নিয়ামক। দুই বাংলার জনগণের ভাষা এক, তাদের রাজনৈতিক বিভাজন ভুলে যেতে হবে, মনে করতে হবে যে তারা এক।
এমন কোনো কথা ফজলুল হক বলেননি যেটা খুব নতুন কিছু, যেটা পাকিস্তানের অখণ্ডতার প্রতি হুমকি।
কিন্তু মোহাম্মদ আলী বগুড়া, গভর্নর গোলাম মোহাম্মদ এটাকেই একটা সুযোগ হিসাবে নিতে চেষ্টা করছেন।
পশ্চিম পাকিস্তানে প্রচণ্ড সমালোচনা শুরু হয়েছে ফজলুল হকের বিরুদ্ধে। তিনি আসলে ষড়যন্ত্র করছেন পূর্ব বাংলাকে আলাদা করে নিয়ে পশ্চিম বাংলার সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার, এই সব কথাও বলাবলি হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ অবশ্য পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছে, তারা হক মন্ত্রিসভাকে পূর্ণ সমর্থন দেবে।
হক সাহেবও বিপদ বুঝে এবার মন্ত্রিসভা বাড়ানোর প্রস্তাব করলেন। আওয়ামী লীগকে ডাকলেন আলোচনা করে সবকিছু ঠিকঠাক করতে।
ভাসানী বললেন মুজিবকে, ‘তুমি ঢাকা যাও। দরকার হইলে মন্ত্রিসভায় যোগ দেও। তবে সবকিছুর আগে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের লগে একটু পরামর্শ কইরা লইয়ো।’
মুজিব ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলেন।
সন্ধ্যার দিকে পৌঁছালেন রজনী বোস লেনের বাসায়।
দেখলেন, বাসায় রেনু এসেছে। সঙ্গে হাসু, কামাল তো আছেই, আর তাঁর কোলে আছে একটা ফুটফুটে ছোট্ট বাচ্চা।
মুজিবের একটা ছেলে হয়েছে।
রেনু বললেন, ‘আমি কালকে এসেছি। হাসু বড় হচ্ছে, ওরে একটা স্কুলে ভর্তি করে দিতে হবে না নে!’
মুজিব বললেন, ‘এসেছ। খুব ভালো করেছ। আমার তো কোনো কিছুরই ঠিক নাই। মোসাফিরের মতো থাকি। তুমি সবকিছু গোছগাছ করে নাও। তবে হক সাহেব আমাকে ডেকে পাঠায়েছেন। মনে হয়, মন্ত্রী হতে বলবেন।’
মুজিব গেলেন ফজলুল হকের সঙ্গে দেখা করতে। ফজলুল হক বললেন, ‘নাতি, শোন। তোকে মন্ত্রী হতে হবে। তুই না করিস না। রাগ করিস না। তোরা সবাই মিলে ঠিক কর, আর কাকে কাকে নেওয়া যেতে পারে।’
মুজিব বললেন, ‘আমাদের তো আপত্তি নাই। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সাথে পরামর্শ করা দরকার। তিনি তো অসুস্থ। আর মওলানা ভাসানীও তো ঢাকায় নাই। পরামর্শ করে আপনাকে মত জানাচ্ছি।’
ফজলুল হক বললেন, ‘দেখ নাতি। নানার উপরে রাগ রাখবি না। অবশ্যই যেন হ্যাঁ হয়। কোনো ‘না’ চলবে না।’
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কারা মন্ত্রী হবেন, সোহরাওয়ার্দী আর ভাসানী তা তো আগেই ঠিক করে রেখেছেন।
মুজিব ফোন করলেন সোহরাওয়ার্দীকে। ‘স্যার, মুজিব বলছি স্যার। হ্যালো, লিডার, শুনতে পাচ্ছেন?’
না, সোহরাওয়ার্দী এতই অসুস্থ যে তিনি ফোনেও কথা বলতে পারবেন না। তাঁর জামাতা আহমেদ সোলায়মান কথা বললেন। মুজিব তাঁকে বললেন, ‘বলেন, লিডার আর মওলানা সাহেব মিলে যে তালিকা তৈরি করেছিল, সবাইকে নিতে হক সাহেব রাজি। উনি কী বলেন?’
জামাইয়ের মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী জানিয়ে দিলেন, তাঁর আপত্তি নাই। আতাউর রহমান খান, কফিলউদ্দিন চৌধুরী, আবদুল কাদের সর্দার ও মুজিব চলেছেন দুটো জিপ নিয়ে। টাঙ্গাইলের পথে।
নির্বাচনের আগে ও পরে কফিলউদ্দিন চৌধুরী আওয়ামী লীগের যোগ্য প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়ার পক্ষে কথা বলেছেন, তুলে ধরেছেন আওয়ামী লীগ থেকে মন্ত্রী করার প্রয়োজনীয়তার কথা, তাই তাঁকে ফজলুল হক মন্ত্ৰী করতে চান না, যদিও তিনি করেন ফজলুল হকের দল। আওয়ামী লীগ চায়, তিনি মন্ত্রী হোন। দরকার হলে তিনি আওয়ামী লীগের কোটায় মন্ত্রী হবেন।
রাত ১১টা পর্যন্ত ফজলুল হক সাহেবের সঙ্গে দেনদরবার করে নেতৃবর্গ ছুটে চলেছেন টাঙ্গাইল অভিমুখে। রাস্তা খুব খারাপ। তার ওপর চারটা খেয়া পার হতে হয়। ছয় ঘণ্টা লাগে।
ভোরবেলা টাঙাইল পৌঁছুলেন তাঁরা। ভাসানী আছেন আওয়ামী লীগ অফিসের দোতলায়। ভাসানী প্রথমে খুব খেপে গেলেন। তারপর ঠান্ডা হলেন। আতাউর রহমান খান পকেট থেকে কাগজ বের করে ভাসানীকে দিলেন। আওয়ামী লীগের মনোনীত মন্ত্রীদের নাম। আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, আবদুস সালাম খান, হাশিমউদ্দিন আহমদ এবং শেখ মুজিবুর রহমান।
ভাসানী অনুমোদন করলেন।
১৯৫৪ সালের ১৫ মে।
সকাল নয়টা। গুলিস্তান আর ওয়ারীর মধ্যবর্তী লাট ভবনে মন্ত্রী হিসাবে শপথ নিলেন মুজিবসহ নেতৃবর্গ। কফিলউদ্দিন চৌধুরীকেও মন্ত্রিত্ব দেওয়া হলো।
শপথ নেওয়ার অনুষ্ঠানেই এল দুঃসংবাদটি। আদমজী জুট মিলে বাঙালি ও অবাঙালি শ্রমিকদের মধ্যে ভীষণ দাঙ্গা বেঁধে গেছে। ভোররাত থেকেই সৈয়দ আজিজুল হক সেখানে আছেন। রাতেই ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর ফোর্স সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে। তাহলে আওয়ামী লীগের লোকেরা যখন শপথ নিচ্ছেন, তখন কেন দাঙ্গা বাধতে গেল? এর মানে কী?
প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক মন্ত্রীদের নিয়ে সোজা চললেন আদমজী অভিমুখে।
আদমজী যাওয়ার জন্য প্রথমে যেতে হবে নারায়ণগঞ্জ। রাস্তার অবস্থা ভালো নয়, তবে জিপ যেতে পারে। তারপর সেখান থেকে উঠতে হবে লঞ্চে।
মুজিব বেরিয়েই লাট ভবনের সামনে পড়লেন অপেক্ষমাণ জনতার ভিড়ের মধ্যে। তারা ধরে বসেছে, মিছিল করতে হবে।
মুজিব তাদের বোঝালেন, অবস্থা গুরুতর। আদমজীতে তাঁকে এখন যেতেই হবে।
ফজলুল হক আগেই রওনা হয়ে গেলেন। জনতার ভিড় ঠেলে বেরোতে বেরোতে মুজিবের আধ ঘণ্টা দেরি হয়ে গেল।
মুজিব জিপে করে নারায়ণগঞ্জ পৌঁছালেন। তাঁর জন্য একটা লঞ্চ অপেক্ষা করছে। তিনি তাতে করে আদমজী পৌঁছালেন। পুলিশের একটা জিপ তাঁকে নিয়ে চলল দাঙ্গা-উপদ্রুত এলাকায়।
বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সেখানে ছিলেন তিনি। একটু পরে মোহন মিয়া এলে তাঁর মনে জোর বাড়ল। অবস্থা খুব সঙিন। প্রায় ৫০০ লাশ মুজিব নিজে গুনলেন। আহতদের তিনি পাঠালেন হাসপাতালে।
মেলা রাত করে বাড়ি ফিরলেন। গিয়ে দেখলেন, রেনু তাঁর অপেক্ষায় না খেয়ে বসে আছেন।
মুজিব বললেন, ‘আমি খেয়ে এসেছি রেনু। তুমি খেয়ে নাও।’
মিথ্যা কথা। সকাল থেকে মুজিব একটু পানিও পান করার সুযোগ পান নাই। কিন্তু এতগুলো লাশ দেখে, হাত-পা কাটা, মাথা ফাটা, পেট বেরিয়ে যাওয়া মানুষকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেওয়ার অভিজ্ঞতার পরে তাঁর খিদে চলে গেছে।
মুজিব বললেন, ‘তুমি এতক্ষণ না খেয়ে থেকে ঠিক করো নাই, রেনু। তোমার কোলে দুধের শিশু। তার জন্যও তো তোমার নিয়মিত ভালো খাবার খেতে হবে।’
রেনু ভাত নিতে বাধ্য হলেন।
মুজিব খেতে খেতে বললেন, ‘এইটা নির্ঘাত একটা চক্রান্ত। আমরা যখন শপথ নিচ্ছি, ঠিক সেই সময়েই দাঙ্গা শুরু করার মানে কী? পশ্চিমারা খুব ভয় পেয়ে গেছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। কারণ, তারা তো সব ব্যবসা-বাণিজ্য করে মুনাফা নিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানে। ব্যবসায়ী, ধনিকশ্রেণীর ভয়টা বেশি।’
‘রেনু বললেন, বেশি দুশ্চিন্তা কোরো না। তোমাকে খুব রোগা দেখা যাচ্ছে।’
.
শেখ মুজিব গেলেন সচিবালয়ে। প্রথম দিন। মুজিবকে দেওয়া হয়েছে সমবায় ও কৃষি উন্নয়ন দপ্তর। কিন্তু গিয়ে দেখেন ওখানে মোহন মিয়া তৎপর, তিনিও মন্ত্রী, আগে মুসলিম লীগে ছিলেন, মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কৃত হয়ে এখন কৃষক শ্রমিক পার্টিতে গেছেন। তিনি সিএসপি সোবহান সাহেবকে পরামর্শ দিচ্ছেন, কাকে কোন দপ্তর দিতে হবে। মুজিবের কাছ থেকে কৃষি উন্নয়ন দপ্তরটা সরিয়ে আবার আরেকজনকে দেওয়া হলো।
তিনি সোবহান সাহেবকে ডাকলেন। বললেন, ‘শোনেন, আমার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। কথাটা মনে রাখবেন। বেশি ষড়যন্ত্র করবেন না। ‘
মুজিব গেলেন ফজলুল হকের কাছে। ‘নানা, ব্যাপার কী? এসব কী হচ্ছে? আমরা তো মন্ত্রী হতে চাই নাই। আপনি তো ডেকে আমাদের মন্ত্রী হতে অনুরোধ করলেন। এখন ভেতরে ডেকে এনে আবার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে কেন? আমার দপ্তর আরেকজনকে দেওয়ার মানে কী?’
ফজলুল হক বললেন, ‘করবার দে। আমার পোর্টফলিও তোরে দিয়া দিব। তুই রাগ করিস না। পরে তোকে সব দিয়ে দেব।’
মুজিব কিছুই বলতে পারলেন না। এই বয়সী একজন মুরুব্বির মুখের ওপরে কথা বলা যায়?
মুজিবের সঙ্গে ফজলুল হকের খাতির হয়ে গেল। তিনি প্রায়ই ডেকে নেন মুজিবকে। তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করেন। সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি বুড়া, মুজিব গুঁড়া, আমি নানা ও নাতি।
মুজিবও উৎসাহভরে কাজ করতে লাগলেন।
মুজিবকে দেওয়া হয়েছে একটা ছোট্ট চেম্বার। তাঁর গাড়িটিও ছোট, অস্টিন টেন। মুজিবের বয়স কম, ৩৪ বছর। সরকারি কর্মকর্তারা তাঁর প্রতি সন্দিগ্ধ। কিন্তু তাঁরা তাঁকে সেটা বুঝতে দেন না।
.
আওয়ামী লীগ নেতাদের মন্ত্রিপরিষদে যোগ দেবার দুদিন পরেই করাচি থেকে তলব এল।
ফজলুল হক মুজিবকে ডেকে বললেন, ‘করাচি থেকে খবর এসেছে। আমাকে যেতে হবে। নান্না, মোহন মিয়া আর আশরাফউদ্দিন যাবে। তুই চল। আতাউর রহমান খান সাহেবকেও নেই। ব্যাটাদের হাবসাব ভালো মনে হচ্ছে না।’
মুজিব ভাবলেন, ভালোই হলো। সোহরাওয়ার্দী সাহেব অসুস্থ, তাঁকে দেখতে এমনিতেই তাঁর করাচি যেতে হতো।
৪৬.
আমগাছ। বিখ্যাত আমগাছ। আজ থেকে দুই বছর দুই মাস আগে যে গাছের নিচে সমবেত হয়েছিল ঢাকার ছাত্রছাত্রীরা। তারা চেয়েছিল তাদের মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে। সেই গাছের ডালে বাস করে যে দুই পক্ষী, যারা কথা বলে মানুষের মুখের ভাষায়, যারা ত্রিকালের সবকিছু জানে, তারা আবার কথা কয়ে উঠল
ব্যাঙ্গমা বলল, ‘শেখ মুজিব আর আওয়ামী লীগের নেতারা মন্ত্রী হওয়ার ১৫ দিনের মাথায় সেই মন্ত্রিসভা ভাইঙ্গা দিব পাকিস্তানের লাটসাবে। এইটারে কয় ৯২-ক ধারা। মন্ত্রিসভা খারিজ। প্রাদেশিক সরকার স্থগিত। রাজনীতি নিষিদ্ধ।
‘অজুহাত হইল ফজলুল হকের কলকাতা বিবৃতি। যাতে তিনি কইছেন, দুই বাংলার ভাষা এক, তাই জনগণের মধ্যে সহযোগিতা দরকার। সেইটারে তারা বানাইল, ফজলুল হক কইছেন, ভারত পাকিস্তান সবটা মিইলাই ভারত। পাকিস্তান আবার কী? কইছেন দুই বাংলারে আবার এক করতে হইব।’
ব্যাঙ্গমি কইল, ‘আরও অজুহাত আছে। সেইটা হইল, যুক্তফ্রন্ট সরকার পূর্ব পাকিস্তানে অবাঙালিদের ধইরা ধইরা গলা কাইটা দিতাছে। তারা দাঙ্গা বাধাইছে। কিন্তু আসল কারণ এইসবের একটাও না।’
ব্যাঙ্গমা কইল, ‘কইছিলাম কি না, এই নয়া জমানায় গরিব দেশগুলানের ভাগ্য আর দেবতারা নির্ধারণ করে না। এইটা নির্ধারিত হয় ওয়াশিংটন থাইকা।’
তখন দুই পাখি মিলে তাদের পুরোনো গানটা গাইতে লাগল :
কোন দেশে কী ঘটবে, কে বা করে ঠিক ।
নেতা নাকি সৈন্যদল কিংবা পাবলিক ॥
শ্যামচাচা কলকাঠি নাড়ে তলে তলে।
গরিবের ভাগ্যচাবি তাদের দখলে ॥
তলে তলে নয় কাঠি প্রকাশ্যেই নাড়ে।
পাকিস্তানে নেবে তারা উন্নতির দ্বারে?
ছয় দশক পরে পাকিস্তান কবে—
আমারে ছাড়িলে তুমি মোর ভালো হবে ॥
তোমার ভাতিজা আমি তুমি মোর চাচা।
আমারে ছাড়িয়া চাচা মোর প্রাণ বাঁচা ॥
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘আমেরিকার ভয় হইল কমিউনিস্টগো।’
ব্যাঙ্গমা বলল, ‘১৯৫০ সালের আগস্ট মাসেই আমেরিকানরা একটা কর্মসূচি হাতে লয়। খুবই গোপন সেই কর্মসূচি। এইটার নাম তারা দেয়, “পূর্ব বাংলায় কমিউনিস্ট প্রভাব রোখার সমন্বিত প্রোগ্রাম”।’
‘এই কর্মসূচির উদ্দেশ্য তারা পরিষ্কার ভাষায় লেখে, কমিউনিস্ট-প্রভাব দূর করা এবং পাকিস্তানের নতুন ভাবাদর্শের সমর্থনে কর্মসূচি প্রণয়ন করা। তাদের টার্গেট আছিল ঢাকা ইউনিভার্সিটি আর তার অধীনে ৬৭ কলেজ, শ্রমিক, সেনাবাহিনী, সাধারণ নাগরিক।’
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘সেই প্রোগ্রাম তারা পালন করতেছে পাকিস্তানের আমেরিকান তথ্যকেন্দ্র ইউসিস আর পাকিস্তান সরকারের মধ্যে গোপন সহযোগিতার মাধ্যমে।
‘তারা বুঝাইব, কমিউনিজম কত খারাপ। মুসলমানরা কেন কমিউনিস্ট হইব?’ ব্যাঙ্গমি বলল, ‘আমেরিকার খুব দুশ্চিন্তা, যেন পূর্ব বাংলা বিচ্ছিন্ন না হইয়া যায়।’
ব্যাঙ্গমা বলল, ‘আর চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লব হইয়া গেছে। ভারতেও কমিউনিস্ট পার্টি সক্রিয়। কাজেই পূর্ব বাংলায় কমিউনিস্টরা জনপ্রিয় হইতেছে, পায়ের নিচে মাটি পাইয়া শিকড় ছড়াইতেছে, এইটা তাদের ভাবাইয়া তুলছে।’ ব্যাঙ্গমি বলল, ‘ইন্ডিয়ার সাথে ভালো সম্পর্ক করতে চাইছিল কিছুদিন। তারপর তারা কইল, পাকিস্তানের সাথে ভালো সম্পর্কই বেশি লাভজনক।
ব্যাঙ্গমা বলল, ‘আমেরিকানরা এইটাও কইল, ইসলামি দলগুলার সাথে সম্পর্ক বাড়াইতে হইব। তাগো হেল্প করতে হইব। সিআইএ বিশেষ প্রোগ্রাম নিয়া মাঠে নামল।
ব্যাঙ্গমি কইল, ‘১৯৪৮ সালেই তো আমেরিকার প্রতিরক্ষা দপ্তর কইল, পাকিস্তানের লগে বন্ধন গইড়া তুলতে পারলে এইখানে বিমানঘাঁটি গইড়া তোলা যাইব। আর সেই ঘাঁটি থাইকা সহজে সোভিয়েত ইউনিয়নে বিমান হামলা করা যাইব। তারা সুপারিশ করল, ইন্ডিয়ার চাইতে পাকিস্তানের সাথে পিরিতি আমেরিকার লাইগা বেশি লাভজনক।
‘পাকিস্তানের নেতারাও আমেরিকাকে চিঠি লেইখা, লিয়াকত আলী খান আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যানের লগে দেখা কইরা কইল, আরে আহেন মিয়া, একলগে কাজ করি। কমিউনিস্টগো ধ্বংস করন লাগব না?
‘আমেরিকা কইল, লাগব তো। কমিউনিস্টগো জাঁতা দেও।
‘পশ্চিম পাকিস্তানে আর পূর্ব বাংলায় কমিউনিস্টগো ধইরা ধইরা জেলে পোরা হইল। কমিউনিস্ট পার্টি ব্যান্ড করা হইল।’
ব্যাঙ্গমা বলল, ‘জেলখানায় কমিউনিস্টগো খুব অত্যাচার করে।’
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘ইলা মিত্ররে ধইরা অত্যাচার করছে। রাজশাহীর জেলে গুলি কইরা কমিউনিস্টগো মারছে।’
ব্যাঙ্গমা বলল, ‘এত অত্যাচার-নিপীড়ন কইরাও কমিউনিজম দমানো গেল না। হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী যুক্তফ্রন্ট হইয়া যাওয়ার লগে লগে কমিউনিস্টরা তাগো সাপোর্ট দিয়া বসল।’
ব্যাঙ্গমি পাখা ঝাপটে বলল, ‘শেখ সাহেব শপথ লইলেন ১৫ মে ১৯৫৪। ১৯ মে সই হইল পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি। পাক-ইউএস আর্মস প্যাক্ট। শেখ সাহেব যুক্ত বিবৃতি দিলেন, খন্দকার ইলিয়াস, আলী আকসাদ, আনিসুজ্জামান সেই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করানোর লাইগা এমএলএদের কাছে ছুটাছুটি করলেন। ১৬৫ জন এমএলএ বিবৃতি দিল পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির তীব্র নিন্দা কইরা। এই বিবৃতি দেইখা আমেরিকানরা চইটা ফায়ার হইয়া গেল।
‘আর আমেরিকা থাইকা আইছেন কালাহান সাহেব। তিনি নিউ ইয়র্ক টাইমসে লেখছেন, এ কে ফজলুল হক পূর্ব বাংলাকে আলাদা করতে চান। দুই বাংলা এক করতে চান।
ব্যাঙ্গমা কইল, ‘ফজলুল হক মন্ত্রীগো লইয়া করাচি গেলে কালাহান সাহেবরে ডাইকা আনায়া সাক্ষী দেওয়া হইল যে ফজলুল হক দেশদ্রোহী কথা কইছেন।’
ব্যাঙ্গমি কইল, ‘মোহাম্মদ আলী বগুড়া আছিল ওয়াশিংটনে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত। মুসলিম লীগের পলিটিক্সের লগে তাঁর কোনো সম্পর্ক আছিল না। ‘৪৭-এর আগে আছিল সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভার সদস্য। তারে হঠাৎ কইরা কেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা হইল? ওয়াশিংটন থাইকা কেন তারে ধইরা আনা হইল?’
ব্যাঙ্গমা কইল, ‘কারণ একটাই। আমেরিকার স্বার্থ। পাকিস্তানের জন্মের আগেই তার ভাগ্য নির্ধারিত হইয়া গেছে। আমেরিকা বলছে, এই দেশটা সামরিক দিক থাইকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ওটা দিতে হবে।
‘একদিকে আফগানিস্তান, তার পাশে রাশিয়া, পাশেই চীন, তার পাশে ইন্ডিয়া, ওই পাশে ইরান, তুরস্ক—এই রকম একটা ভূগুরুত্বপূর্ণ দ্যাশরে তারা ভালুকের থাবা দিয়া জড়ায়া ধরল, কইল, আইসো ভালোবাসা দেই। হায়! আমেরিকা যারে ভালোবাসার আলিঙ্গন কয়, তার চাপে গরিবের যে শ্বাস বন্ধ হইয়া যায়। এই যে আমেরিকা পাকিস্তানের ঘাড়ে সওয়ার হইল, আরও ৬০ বছর পরেও সেই ভূত নামব না। পাকিস্তানের গলায় যে মালা আমেরিকা পরাইল, সেইটা তার গলার ফাঁস হইয়া থাকব বহু বছর। বহু বছর।’
ব্যাঙ্গমি কইল, ‘করাচিতে ডাইকা নিয়া মুজিবররে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ কয়, শুনেছি, লোকে বলে, আপনি নাকি কমিউনিস্ট।
‘পূর্ব বাংলায় নির্বাচনে কয়জন কমিউনিস্ট নির্বাচিত হইছে, এই খবর সবার আগে গেল ওয়াশিংটনে। প্রকাশ্যে একজনও নয়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সেই সংখ্যা অনেক। সরকার মনে করে, গণতন্ত্রী দল হইল গিয়া কমিউনিস্ট পার্টির পার্লামেন্টারি দল, ছাত্র ইউনিয়ন হইল রিক্রুটিং দুয়ার আর যুবলীগ হইল প্রশিক্ষণকেন্দ্র। গণতন্ত্রী দলের ১৩ জন তো নির্বাচিতই হইছে।
‘তার উপরে ১৪ এপ্রিল যুক্তফ্রন্টের কর্মী সম্মেলনে সভাপতির ভাষণ দিতে গিয়া মওলানা ভাসানী পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির তীব্র নিন্দা করলেন। তাঁর চীন-কানেকশনের কথা সক্কলেই জানে। আর শেখ মুজিব তো চীন সফরই কইরা আইছেন। তার মানে ওয়াশিংটনের হিসাব হইল, পূর্ব বাংলারে কমিউনিস্টরা খাইয়া ফেলতাছে। আর এইটা হইতেছে গিয়া যুক্তফ্রন্ট সরকারের ব্যানারে।’
ব্যাঙ্গমা কইল, ‘৯২/ক ধারা মানে গভর্নরের শাসন চলাকালে আমেরিকার সাথে আরও দুইটা চুক্তি হইব। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থা আর বাগদাদ চুক্তি—সিয়াটো আর সেনটো।
ব্যাঙ্গমি কইল, ‘তয় আমেরিকা যা চায়, সকল সময় যে তাই হয়, তাও তো না। মানষের ইচ্ছার কাছে আমেরিকার ইচ্ছাও হাইরা যায়। দেখা যাউক, পাকিস্তানে অহন কী কী হয়?’
৪৭.
পাকিস্তানের রাজধানী করাচি। মোহাম্মদ আলী বগুড়া পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী। তাঁর চেম্বারে বসে আছেন এ কে ফজলুল হক, শেখ মুজিব আর সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া। ফজলুল হক বয়স্ক, অখণ্ড বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তাঁকে সবাই শ্রদ্ধা করে, অন্তত তাঁর সামনে বেয়াদবি কেউ তো করে না। আর এই মোহাম্মদ আলী বগুড়া শেরেবাংলার সঙ্গে কথা বলছে বেয়াদবের মতো। মুজিবের সহ্য হতে চায় না।
বগুড়া বললেন, ‘হক সাব, আপনি স্বাধীন বাংলা করতে চেয়েছেন?’
ফজলুল হক বলল, ‘না, আমি সেই রকম কিছু বলিনি। আমি স্বায়ত্তশাসনের কথা বলেছি।’
বগুড়া বললেন, ‘আমার কাছে রিপোর্ট আছে। আপনি বলছেন, কলকাতায় আপনি কী বলেছেন—পাকিস্তান আবার কী? পুরোটাই ইন্ডিয়া।
ফজলুল হক বললেন, ‘না, তা কেন আমি বলব।’
বগুড়া বললেন, ‘আমার কাছে রিপোর্ট আছে। আপনি নিউ ইয়র্ক টাইমস- এর রিপোর্টার কালাহানের সাথে সাক্ষাৎকার দিয়ে কী বলেছেন? বলেছেন, পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করতে চান।’
‘না, বলি নাই তো!’
‘বলেছেন, বলেছেন। আমার কাছে প্রমাণ আছে। সাক্ষী আছে।’
শেখ মুজিব খেপে গেলেন। বললেন, ‘আপনি একজন সিনিয়র নেতার সাথে এইভাবে কথা বলতে পারেন না। হক সাহেব খুবই সম্মানিত ব্যক্তি।’
বগুড়া বললেন, ‘মুজিবুর রহমান। তোমার বিরুদ্ধে বিরাট ফাইল আমার কাছে আছে।’
মুজিব হেসে বললেন, ‘ফাইল তো থাকবেই। আপনাদের বদৌলতে আমাকে কম দিন তো জেল খাটতে হয় নাই!’
বগুড়া আমেরিকান কাউবয় মার্কা সিনেমার ভিলেনের মতো করে টেবিল থেকে উঠে একটা মোটাসোটা ফাইল এনে শেখ মুজিবের সামনে রাখলেন।
মুজিব বললেন, ‘আপনার বিরুদ্ধেও একটা ফাইল আমাদের প্রাদেশিক সরকারের আছে?’
বগুড়া ভ্রু কুচকে বললেন, ‘মানে?’
‘মনে নাই? ১৯৪৭ সালে যখন খাজা নাজিম উদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেন, তখন আপনাকে মন্ত্রী করে নাই। তখন ১৯৪৮ সালে আমরা যখন প্রথম রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করি, তখন আপনি আমাকে দুই শত টাকা চাঁদা দিয়েছিলেন। মনে নাই? পুরোনো কথা ভুলে গেছেন। ১৯৪৯ সালে যখন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন আপনি রোজ গার্ডেনে গেছলেন। সেইসব ফাইল আমাদের হাতে আছে।’
ফজলুল হক ও তার ভাগনে নান্না মিয়া দেখলেন আবহাওয়া গরম হয়ে উঠছে। নান্না মিয়া বললেন, ‘আজকে আমরা উঠি। পরে আবার আলোচনা হবে।’
পরের দিন নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত হলো সাংবাদিক কালাহানের নেওয়া এ কে ফজলুল হকের সাক্ষাৎকার।
সেটার কপিই দ্রুতই চলে এল করাচিতে।
ফজলুল হককে আবার ডেকেছেন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়া। সঙ্গে শেখ মুজিব আর নান্না মিয়াকে নিতে ভুললেন না ফজলুল হক।
বগুড়া নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর একটা কপি ফজলুল হকের সামনে রেখে বললেন, ‘আপনি বলেছিলেন, কলকাতায় আপনি স্বাধীন বাংলার কথা বলেননি। এখন আমি তো দেখছি, আপনি করাচিতে বসে কালাহানকে ইন্টারভিউ দিয়েছেন। তাতে আপনি আপনার পুরা পরিকল্পনার কথাই খুলে বলেছেন।’
শেখ মুজিব পত্রিকার কপিটি হাতে তুলে নিয়ে পড়তে লাগলেন :
পূর্ব পাকিস্তান মুক্তি চায়
প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী স্বাধীন দেশ গঠনে আগ্রহী
নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর বিশেষ সংবাদদাতা জন পি কালাহানের প্রতিবেদন :
করাচি, পাকিস্তান ২২ মে (১৯৫৪)। পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তানের নেতা আজ বলেছেন, তিনি স্বাধীনতার পক্ষপাতী এই প্রদেশের প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক দেশের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকের মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর এই মন্তব্য করেন। অশীতিপর রাজনীতিক হক ৫০ বছরের অধিক সময় ধরে রাজনীতি করে আসছেন। একদা তিনি অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভেতর যে এক হাজার মাইলের বেশি ব্যবধান, চার কোটি বিশ লাখ বাঙালির স্বাধীনতা দাবির এটা অন্যতম কারণ। দুই ঘণ্টা ধরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি দুই প্রদেশের ভেতর সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পার্থক্যের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে ভাষাগত ব্যবধান (পূর্ব পাকিস্তানে বাংলায় ও পশ্চিম পাকিস্তানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উর্দুতে কথা বলা হয়), ভারতের ভেতর দিয়ে দুই পাকিস্তানের মধ্যে যাতায়াতের সংযোগের অভাব এবং রাজস্ব আয়ের অসমতা।
…
তিনি বলেন, কত দ্রুত স্বায়ত্তশাসন অর্জিত হবে, সে বিষয়ে তাঁর কোনো নির্দিষ্ট ধারণা নাই। ‘তবে আমার মন্ত্রিসভার অন্যতম প্রধান কাজই হবে স্বাধীনতার বিষয়টি বিবেচনা করা।’ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্নতার চেষ্টা করলে কেন্দ্রীয় সরকারে তার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, এ প্রশ্নের জবাবে হক বলেন, ‘সন্দেহ নাই, তারা সে চেষ্টায় বাধা দেবে। কিন্তু কোনো জাতি যখন স্বাধীনতা চায়, তাকে দমিয়ে রাখা অসম্ভব।’
নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর ২৩ মে ১৯৫৪ সালের সংখ্যা এটা
মুজিব দ্রুত পড়ে নিলেন পত্রিকাটা। তিনি মনে মনে বললেন, নানা আমার ঠিক সময়ে ঠিক কথা বলেননি বটে, কিন্তু যা বলেছেন, সব আমার মনের কথা।
বগুড়া বললেন, ‘আপনি আর আপনার মন্ত্রিসভা পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করতে চান। আপনার মন্ত্রিসভাকে কি এর পরেও চলতে দেওয়া যায়?’
ফজলুল হক বললেন, ‘আমি এই কথা বলি নাই। আমি বলেছি অটোনমির কথা। স্বায়ত্তশাসনের কথা। আমি ইন্ডিপেনডেন্স ওয়ার্ডটাই ইউজ করি নাই।
‘ওকে ওকে মিস্টার হক। মি. কালাহান ইজ প্রেজেন্ট হিয়ার।’ বগুড়া হলিউডি সিনেমার কায়দায় পিএবিএক্স ফোন তুললেন। বললেন, ‘আনো।’
দরজা খুলে গেল। ঢুকলেন আমেরিকান সাংবাদিক জন পি কালাহান।
বগুড়া বললেন, ‘মিস্টার কালাহান, আপনার প্রতিবেদন নাকি মিথ্যা? উনি বলছেন।’
কালাহান বলল, ‘একটা ওয়ার্ডও মিথ্যা নয়। আমার কাছে নোট আছে।’
ফজলুল হক বললেন, ‘আমি আপনাকে বলেছি অটোনমির কথা। এটা আমাদের যুক্তফ্রন্টের ঘোষিত ও মুদ্রিত কর্মসূচি। আমি আপনাকে কখন বললাম স্বাধীনতার কথা। আপনি অবশ্যই ভুল স্বীকার করে আজকেই কাগজে নোট পাঠাবেন। আগামীকালের কাগজেই ভুল সংশোধন করে দেবেন।’
‘না আপনি স্বাধীনতার কথা বলেছেন।’
‘সে তো তোমাকে একটা কবিতার লাইন শুনিয়েছি। স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়,/ কে পরিতে চায় হে, কে পরিতে চায়?’
কালাহান বললেন, ‘আমি আমার রিপোর্টের একটা অক্ষরও পাল্টাব না। আমি আমার প্রতিবেদনের প্রতিটা শব্দ সঠিক বলে স্থির থাকব।’
বগুড়া বলেন, ‘এখন হক সাহেব, আপনিই বলেন, আমার জায়গায় আপনি থাকলে আপনি কী করতেন?’
ফজলুল হক বললেন, ‘আপনি, মিস্টার কালাহান, সব সময়েই আমাদের বিষয়ে মিথ্যা খবর প্রকাশ করেছেন। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপরে নুরুল আমিনের পুলিশ গুলি চালানোর পরে আপনি নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ লিখেছেন, ইন্ডিয়ান পুলিশ ঢাকায় গুলি চালিয়েছে। ৪ জন নিহত, কয়েকজন আহত। ঢাকায় এসে ইন্ডিয়ান পুলিশ গুলি চালাবে? আর ছাত্ররা কেন বিক্ষোভ করছিল। আপনি লিখেছেন, দৈনিক অবজারভার পত্রিকা নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে ছাত্ররা মিছিল করছিল। তার ওপরে ইন্ডিয়ান পুলিশ গুলি করে। এই হলো আপনার সততার নমুনা
কালাহান বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়ার আহ্বানে এখানে এসেছি। আপনার সাথে সাংবাদিকতা নিয়ে কথা বলতে আসিনি। আমি আপনার কাছে সাংবাদিকতা শিখতে চাই না।’
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি আমগাছ থেকে নেমে আরেকটা কৃষ্ণচূড়া গাছে বসে। মে মাস। জ্যৈষ্ঠ। কৃষ্ণচূড়াগাছে ফুল আসছে।
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি নিউ ইয়র্ক টাইমস পূর্ব বাংলা সম্পর্কে কী রকম সব প্রতিবেদন প্রকাশ করছে, তাই নিয়ে আলোচনা করল, আর ঠোঁটে পায়ের আঙুল রেখে ভাবতে লাগল।
২১ ফেব্রুয়ারির পরে নিউ ইয়র্ক টাইমস লেখে : ফেব্রুয়ারি ২১ থেকে ২৩ পর্যন্ত সংঘটিত সহিংস ঘটনায় কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে সরকার তার প্রথম বিজয় অর্জন করেছে।…এ ব্যাপারে সবাই মোটামুটি একমত যে, ছাত্ররা মূলত অরাজনৈতিক ছিল, কিন্তু একটা অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য এটাই উপযুক্ত সময়—এই বিবেচনা থেকে কমিউনিস্টরা তাদের সব মেশিনারি কাজে লাগায়।’
ব্যাঙ্গমা বলে, ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস পাকিস্তান আর আমেরিকার সরকারের মতো কমিউনিস্টভীতিতে ভুগতাছে।’
ব্যাঙ্গমি বলে, ‘তারা ভাষা আন্দোলনরে কমিউনিস্টদের কাজ বইলা প্রচার করতেছে। আর প্রতিবেদন প্রকাশ করতেছে। স্টেট ডিপার্টমেন্ট চিঠি চালাচালি কইরা যাইতাছে।
‘নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর মালিকদের একজনও চলে আসেন পাকিস্তানে ও ভারতে। তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য, এই অঞ্চলে কমিউনিস্টদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সোভিয়েত প্রোপাগান্ডার বিস্তার সরেজমিনে দেখা।
তিনি তাঁর পত্রিকায় লেখেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নজর যখন ইউরোপের ওপরে নিবদ্ধ, সোভিয়েত ইউনিয়ন ঠিক সেই সুযোগে প্রাচ্যের দেশগুলোর ওপরে লোলুপ দৃষ্টি বিস্তৃত করেছে।
‘খাজা নাজিম উদ্দিন তাঁকে বলেন, ভারত ও বার্মার ভেতর দিয়ে কমিউনিজম পাকিস্তানে প্রবেশের চেষ্টা করছে। রাশিয়া এই কাজে হাত লাগাচ্ছিল। আমাদের তরুণ মুসলমানরাও তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। আমি অনুপ্রবেশ ঠেকিয়েছি। যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। এই উদ্ধৃতি নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত হয়।’
ব্যাঙ্গমা ও ব্যাঙ্গমির বিশ্লেষণ দাঁড়াল, আমেরিকা চায় না, পূর্ব বাংলা বিচ্ছিন্ন হোক। আমেরিকা চায় না, কমিউনিস্টরা পূর্ব বাংলায় মাথাচাড়া দিক। আর পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার দোস্তি তাদের নিজেদের স্বার্থেই দরকার। আমেরিকা মনে করে, যুক্তফ্রন্টে কমিউনিস্টরা আছে। কাজেই আদমজীর দাঙ্গা, কালাহানের তৎপরতা, আর মোহাম্মদ আলী বগুড়ার ওয়াশিংটন থেকে উড়াল দিয়ে এসে পাকিস্তানের মন্ত্রিত্ব নেওয়া—সবটার পরিণতি একটাই হতে যাচ্ছে, তা হলো, যুক্তফ্রন্টের সরকার বাতিল। পূর্ব বাংলায় গভর্নরের শাসন।
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি উড়াল দিল, কৃষ্ণচূড়া গাছের ডাল থেকে উড়ে গিয়ে আবার আশ্রয় নিল আমগাছের ডালে।
৪৮.
করাচিতে ফজলুল হক, আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবসহ কয়েকজন মন্ত্রী। তারা টের পেলেন তাঁদের মন্ত্রিত্ব আর নাই। যুক্তফ্রন্টের এই বিজয় পাকিস্তানিরা মেনে নিতে পারছে না।
কিন্তু মুজিব টের পেলেন আরেকটা ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। তাঁরা যাতে পূর্ব বাংলায় ফিরতে না পারেন, সেই চেষ্টা করা হচ্ছে।
পূর্ব বাংলার চিফ সেক্রেটারিকে বলা হয়েছে, ‘শোনেন, ওঁদের প্লেনের টিকিট করবেন না।’
চিফ সেক্রেটারি ইসহাক সাহেব জবাব দিলেন, ‘আইনত আমি তা পারি না। কারণ ওঁরা এখনো মন্ত্রী। ওঁরা যা বলবেন, আমি তা শুনতে বাধ্য।’
শেখ মুজিব আর আতাউর রহমান খান সেই খবর জেনে গেলেন।
শেখ মুজিব এ কে ফজলুল হককে বললেন, ‘নানা, ষড়যন্ত্র চলছে। আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পূর্ব বাংলায় ঢুকে পড়তে হবে। পারলে আজকেই আমাদের করাচি ছাড়তে হবে।’
ফজলুল হক বললেন, ‘আমিও যাব।’
তাঁরা টিকিটের জন্য ইসহাক সাহেবকে অর্ডার দিয়ে চললেন সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে দেখতে। তাঁর অপারেশন হয়েছে। তিনি খুবই কাতর। কথা বলতে পারেন না। তাঁর সঙ্গে রাজনৈতিক আলাপ করতেও পরিবারের লোকেরা নিষেধ করে দিয়েছেন। তিনি আস্তে আস্তে বললেন, ‘আমাকে চিকিৎসার জন্য জুরিখ যেতে হবে। টাকার অভাব। টাকা নাই।
শেখ মুজিব তাঁর হাত ধরে বসে আছেন। তাঁর মনটা আর্দ্র হয়ে উঠল I এই হাত দিয়ে লিডার কতজনকে কত টাকাপয়সা দান করেছেন, আর আজ তাঁর নিজের চিকিৎসার টাকা নাই! কী রকম পরিহাসের মতো শোনাচ্ছে কথাগুলো।
৪৯.
পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক ও তাঁর মন্ত্রীরা এখন আকাশে। করাচি থেকে প্লেন ছেড়ে দিয়েছে। প্লেন দিল্লি ও কলকাতা হয়ে যাবে ঢাকা।
তাঁদের সঙ্গে চিফ সেক্রেটারি ইসহাক সাহেব আছেন, আর আছেন পুলিশের আইজি শামসুদ্দোহা।
মুজিব তাঁর আসন থেকে উঠে ফজলুল হক সাহেবের কাছে গিয়ে বললেন, ‘পুলিশের এই লোকটা কেন আমাদের সাথে এসেছে? তাকে কে পারমিশন দিয়েছে?’
ফজলুল হক বললেন, ‘আমিই দিছি।’
দিল্লি থেকে প্লেন কলকাতার উদ্দেশে উড়াল দিল। কিছুক্ষণ পরে পুলিশের আইজি দোহা গেলেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। বললেন, ‘স্যার, আপনার উচিত হবে, আজকের দিনটা কলকাতায় থেকে যাওয়া। রাতেই ইস্কান্দার মির্জা এবং এম এন হুদা মিলিটারি প্লেনে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়ে গেছেন। ঢাকা এয়ারপোর্টেই কোনো ঘটনা ঘটে যেতে পারে। যদি কোনো কিছু না হয়, আগামীকাল প্লেন পাঠিয়ে আপনাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে।’
ফজলুল হক চোখ বন্ধ করে তর্জনী উঠিয়ে নান্না মিয়া আর মুজিবকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ‘ওদের সাথে কথা কন।’
মুজিবের কাছে এসে দোহা সাহেব বললেন সেই একই কথা। মুজিব বললেন, ‘শোনেন, ভালোমন্দ যা হওয়ার দেশের মাটিতেই হোক। মারলে মারবে। ধরলে ধরবে। কলকাতায় কেন নামব। যান। নিজের সিটে গিয়ে বসেন। প্লেন এখন নামবে। সিটবেল্ট বেঁধে রাখেন শক্ত করে।’ বিড়বিড় করলেন তিনি, ‘পুলিশের চাকরি করে বলে নিজেকে চালাক ভেবেছে। ফজলুল হক কলকাতায় রয়ে যাবেন। আর পাকিস্তানি শাসকেরা দুনিয়াকে দেখাবে, দেখো, লোকটা দুই বাংলাকে এক করতে চায় আবার কলকাতায় রয়ে গেল। আর আমরা তার কাজের সাথি
কলকাতায় নামল প্লেন। কলকাতায় এক ঘণ্টা বিরতি। তাঁরাও এয়ারপোর্টে পা রাখলেন। খবরের কাগজের সাংবাদিকেরা তাঁদের ঘিরে ধরল। ফজলুল হক কিছুই বললেন না। ইশারা করে দেখালেন, যা বলার মুজিব বলবেন।
মুজিবও বললেন, ‘এখানে আমাদের কিছু বলার নাই। যদি কিছু বলতে হয়, ঢাকায় গিয়ে বলব।’
আবার দোহা সাহেব এলেন। বললেন, ‘ঢাকায় ফোন করেছিলাম স্যার। সমস্ত এয়ারপোর্ট মিলিটারি ঘিরে ফেলেছে। চিন্তা করে দেখেন কী করবেন?’ মুজিব বললেন, ‘ঘিরে রেখেছে ভালো কথা। যা হবার দেশের মাটিতেই হোক। বিদেশের মাটিতে এক মুহূর্ত না।
ঢাকায় এসে বিমান নামল দুপুরবেলা। বিমানবন্দরে হাজারো মানুষ। তারা এসেছে নেতাদের বরণ করে নেওয়ার জন্য। জ্যৈষ্ঠের দিনটায় প্রচণ্ড গরম। আজকে বাতাসে আর্দ্রতাও বেশি। তবু মানুষ ভিড় করে আছে নেতাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। তারা নানান গুজব শুনছে, এ কে ফজলুল হক বিপদে পড়েছেন, তাদের নবনির্বাচিত সরকার বেকায়দায় পড়েছে, এখনই তো তাদের পাশে এসে দাঁড়ানোর সময়।
সাংবাদিকেরা ঘিরে ধরল নেতৃবৃন্দকে। ফজলুল হক কিছু বললেন না, শুধু দেখিয়ে দিলেন তাঁর নাতি শেখ মুজিবকে।
মুজিব সরাসরি চলে গেলেন মিন্টো রোডে, তাঁর সরকারি বাসভবনে। আগের রাতে বিমানে ভালো ঘুম হয় নাই। তার ওপর এত দীর্ঘ ভ্রমণ। তিনি ক্লান্ত বোধ করছেন। তবু বিমানবন্দরে সমবেত নেতা-কর্মীদের প্রত্যেকের সঙ্গে তিনি হাত মিলিয়েছেন, জনতার উদ্দেশে হাত নেড়েছেন।
এই বাসায় এখনো আসবাবপত্র আনা হয়নি বংশালের বাসা থেকে। হঠাৎ বন্যা আসায় তারা রজনী বোস লেনের বাসা ছেড়ে বংশালে একটা বাসায় উঠেছিলেন। তবে মন্ত্রী হওয়ার পর জিনিসপত্র নিয়ে এই বাসভবনে ওঠার পরপরই তাঁকে পাকিস্তানে চলে যেতে হয়।
ফেরার পরে দেখলেন, রেনু বাড়িটা বেশ গুছিয়ে নিয়েছে। যদিও সব ফাঁকা ফাঁকা। বিছানা সব মেঝেতে করা।
রেনু বললেন, ‘সব খবর ভালো।’
মুজিব বললেন, ‘হ্যাঁ, ভালো। তোমাদের খবর কী?’ হাসু এসে আব্বাকে জড়িয়ে ধরল। কামাল কাছে এলে মুজিব তাঁকে কোলে তুলে নিলেন। এই বাচ্চাগুলোর সাথে তার দেখা হয় কত কম!
এক মাসের শিশুটির যত্ন নিচ্ছে টুঙ্গিপাড়া থেকে আসা একজন পরিচারিকা।
মুজিব বললেন, ‘গোসল সেরে নিই।’
.
গোসল সেরে খেতে বসলেন। মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে খাবার ব্যবস্থা।
এরই মধ্যে দু-তিনজন বন্ধু সহকর্মী এসে হাজির। রেনু জানেন, কেউ না কেউ আসবে, তিনি ভাত-তরকারি বেশি করেই রাঁধতে বলে দিয়েছিলেন।
সবাইকে নিয়ে মুজিব খেতে বসলেন। ডাল-ভাত, ছোট মাছ, সবজি—এই হলো খাবার।
মুজিব বললেন, ‘রেনু, আজকেই মন্ত্রিপরিষদ ভেঙে দিবে মনে হচ্ছে। তার মানে আজকে রাতেই আমাকে অ্যারেস্ট করবে।’
রেনু বললেন, ‘ভাগ্যিস, বংশালের বাড়ি থেকে জিনিসপত্র আনি নাই। আনলে বিপদই হতো।
মুজিব বললেন, ‘হাতের টাকা যা আনছিলা, সব নিশ্চয় শেষ। এখন কোথায় থাকবা, ঢাকায়? না হয় বাড়ি চলে যেয়ো।’
রেনু বললেন, ‘তোমার কাছে থাকব বলে এসেছিলাম। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া কোথায় করাব, সেইটাও একটা চিন্তা। যাক, আল্লাহ ভরসা।’
ভাত খাওয়া শেষে মুজিব গেলেন একটুখানি জিরিয়ে নিতে। এই সময় ফোন এল, কেন্দ্রীয় সরকার ৯২/ক ধারা জারি করেছে। তার মানে পূর্ব বাংলায় এখন গভর্নরের শাসন চলবে। মন্ত্রিপরিষদ বিলুপ্ত।
রেনু বললেন, ‘কী?’
মুজিব বললেন, ‘হ্যাঁ, ৯২/ক জারি করেছে। আমাদের মন্ত্রিপরিষদ বিলুপ্ত। পশ্চিমাগুলান এত ষড়যন্ত্র জানে!’
মুজিব এখন বেরিয়ে পড়বেন। রেনুকে বললেন, ‘রেনু, আমার জন্য একটা জেলখানার ব্যাগ রেডি করে রেখো। দরকারি যা যা লাগে। করাচির সুটকেসেও অনেক কিছু পাবা।’
মুজিব কখনো একা বের হন না। কেউ না কেউ তাঁর সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু আজ মুজিব বললেন, ‘শোনো। আমাকে সন্ধ্যায় বা রাতের মধ্যে অ্যারেস্ট করবে। আজকে আর আমার সাথে কারও বাহির হওয়ার দরকার নাই।’
তিনি একাই বের হলেন সরকারি গাড়ি নিয়ে।
প্রথমে গেলেন আতাউর রহমান খানের বাড়িতে। তাঁকে তুলে নিলেন। তারপর ফজলুল হকের বাড়ি। ফজলুল হক দোতলার বারান্দায় বসে আছেন। চোখ অর্ধনিমীলিত। নান্না মিয়াকেও পাওয়া গেল।
মুজিব বললেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকারের এই অন্যায় মেনে নেওয়া যায় না। এটা অগ্রাহ্য করা উচিত।’
নান্না মিয়ার উদ্দেশে মুজিব বললেন, ‘কী করবেন, ভেবেছেন কিছু?’
নান্না মিয়া কিছুই বললেন না। মনে হচ্ছে তিনি ভয় পাচ্ছেন।
আতাউর রহমান খান রাজি। তিনি প্রতিবাদ করতে চান। মুজিব তাঁকে বললেন, ‘আপনি দেখেন তো, সবাইকে ডেকে আনতে পারেন কি না। আমি একটু আওয়ামী লীগ অফিসে যাই, অফিস থেকে কাগজপত্রগুলো সরায়া ফেলি।’
মুজিব চললেন সরকারি অস্টিন গাড়িতেই। নবাবপুর আওয়ামী লীগ অফিসে ঢুকে দ্রুত তিনি কাগজপত্র কোলে তোলেন। অফিস থেকে বেরিয়ে তিনি গাড়িতে উঠলেন। ড্রাইভার বলল, ‘স্যার পেছনে দেখেন পুলিশ আইসা ঘেরাও দিতেছে।’
মুজিব আবার গেলেন ফজলুল হকের বাড়ি। অনেকেই ভিড় করেছেন। কিন্তু মন্ত্রীরা তেমন আসেননি। নান্না মিয়া বললেন, ‘পুলিশ এসেছিল, আপনাকে খুঁজতে।’
মুজিব ফোন করলেন বাসায়। রেনু বললেন, ‘বাড়িতে পুলিশ এসেছিল, তোমারে খুঁজে গেছে।
মুজিব বললেন, ‘এবার আসলে বলিও অপেক্ষা করতে। আমি শিগগিরই আসতেছি।’
এখানে উপস্থিত লোকজনের উদ্দেশে মুজিব বললেন, ‘আমি চললাম। আপনারা তৈরি হোন। অনেককেই জেলে যেতে হবে। তবে এই অন্যায় আপনারা বিনা প্রতিবাদে মেনে নেবেন না। প্রতিবাদ করবেন। জনগণ প্রস্তুত আছে। আপনারা ডাক দিলেই তারা রাস্তায় নেমে আসবে। জেলে তো যেতেই হবে, প্রতিবাদ করে তারপর জেলে যাওয়া উচিত।’
মুজিব বের হলেন। সরকারি গাড়ি ছেড়ে দিলেন। ড্রাইভারকে বললেন, ‘তোমার গাড়ি, তুমি সরকারি গ্যারাজে নিয়ে যাও।’
ড্রাইভারের নাম মতিন মিয়া, তিনি কেঁদে ফেললেন। ‘স্যার, আপনারে এত তাড়াতাড়ি ছাড়তে হইব, ভাবি নাই।’
মুজিব একটা রিকশা ভাড়া করলেন। কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করলেন। কাউকেই পেলেন না।
রিকশাওয়ালাকে বললেন, ‘মিন্টো রোডে যাও।’
বাড়ির সামনে এসে দেখলেন পুলিশ পাহারা। তিনি রিকশায় করে ঢুকলেন। পুলিশ টের পেল না।
রেনু রাতের খাবার রেডি করে রেখেছেন। বললেন, ‘খেয়ে নাও।’ রেনুর চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। বাচ্চা দুটোও তাঁর সঙ্গে খেতে বসল।
এর আগে মুজিব অনেকবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। কিন্তু রেনুর সামনে থেকে কোনো দিনও তাঁকে পুলিশের সঙ্গে যেতে হয় নাই। তবু রেনুর চেহারা স্বাভাবিকই মনে হলো।
রেনু বললেন, ‘আমি বাড়ি যেতে চাই না। হাসুর একটা স্কুলের ব্যবস্থা হয়েছে।
মুজিব বললেন, ‘আচ্ছা, আমি ইয়ার মোহাম্মদ খানকে বলে যাচ্ছি, উনি তোমার জন্য বাড়ি ভাড়া করে দিবেন।’
খাওয়ার পরে মুজিব বিছানা গোছালেন একটা। জেলে নিয়ে যাবেন। রেনু তাঁর ব্যাগ এগিয়ে দিলেন। কোনটা কোথায় রেখেছেন, বুঝিয়ে দিতে লাগলেন।
মুজিব ফোন করলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে। ‘হ্যালো, শেখ মুজিবুর রহমান বলতেছি, আমার কাছে মনে হয় পুলিশ এসেছিল, আমাকে গ্রেপ্তার করার জন্য। এখন আমি বাসায় আছি, পুলিশ পাঠায়া দেন।’
পুলিশের গাড়ি এল। অনেক লোকই বাড়িতে ছিল, গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়ে পুরুষ মানুষ বেশির ভাগই পালিয়ে গেছে। এখন বাড়িটা অকারণে বেশি সুমসাম। গাড়ি থামার আওয়াজ পাওয়া গেল। গাড়ি থেকে পুলিশের নামার বুটের শব্দও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়েছে। রেনু কাঁদতে আরম্ভ করলেন।
মুজিব বললেন, ‘বাচ্চাদের আর উঠায়ো না। আর তোমাকে কী বলে যাব? ঢাকায় থাকলে কষ্ট হবে। তার চেয়ে বাড়ি চলে যেয়ো।
মুজিব বিছানায় শায়িত সন্তানদের দিকে তাকালেন। হাসু এত বড় হয়ে গেছে। ওর দিকে তাকানোই হয়নি। ইলেকশনের সময়ও তো টুঙ্গিপাড়া গিয়েছিলেন। ওরাও তো এসেছিল গোপালগঞ্জের বাসায়। কী নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তিনি!
কামালটাকে একটু রোগা দেখা যাচ্ছে। তিনি নিজেও ছোটবেলায় খুব হালকা-পটকা ছিলেন, মা বলেন।
ও একটু লম্বা হয়েছে হয়তো।
এবার তাঁর চোখ পড়ল দেড় মাসের শিশুটির দিকে। তিনি কি একে একবারও কোলে নিয়েছেন?
রেনুকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা উচিত হবে না। ও কাঁদছে। আরও আবেগপ্রবণ হয়ে যাবে।
তিনি বললেন, ‘রেনু, ছোটটাকে একটু আমার কোলে দাও তো।
মেঝেতেই বিছানা। বড় করে বিছানো। এরই এক পাশে রেনুও ঘুমায়।
রেনু হাঁটুর ওপরে বসে শিশুটিকে কোলে তুলে নিলেন। মুজিবের দিকে বাড়ালেন বাচ্চাটাকে। এত ছোট বাচ্চাকে মুজিব ধরতেও জানেন না। রেনু বললেন, মাথার নিচে হাত দাও, মাথার নিচে হাত দাও।
মুজিব বললেন, ‘এর নাম কী রাখবা ঠিক করছ?’
রেনু বলল, ‘তুমিই বলো।’
মুজিব বললেন, ‘কামালের ভাইয়ের নাম তো জামালই রাখতে হবে। শেখ জামাল। কী বলো?’
রেনু বললেন, ‘খুব সুন্দর নাম।’
মুজিব বেরিয়ে এলেন বাড়ি থেকে। রেনু এল তাঁকে গাড়িতে তুলে দিতে।
পুলিশ অফিসার সালাম দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিল।
মুজিব উঠলেন। মুখে হাসি এনে বললেন, ‘আসি, রেনু।’
গোপালগঞ্জের এক কর্মী চিৎকার করে কেঁদে উঠল। তার নাম শহীদুল ইসলাম। সে চলে এল গাড়ির কাছে। এমন হাউমাউ করে কাঁদছে! মুজিব তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘কেন কান্দিস? এ-ই তো আমার পথ। তবে আমি ঠিকই বাহির হব। তোর ভাবিকে দেখে রাখিস।’
মুজিবকে পুলিশ প্রথমে নিয়ে গেল জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে। তিনি বসেই ছিলেন, কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বললেন, ‘কী করব বলুন। করাচি আপনাকে গ্রেপ্তার করার জন্য পাগল হয়ে গেছে। আমরা জানি, আপনি জেলের ভয় করেন না। আপনাকে খবর দিলে আপনি নিজেই চলে আসবেন।’
ডিআইজি সাহেব এলেন। তিনিও খুব মোলায়েম ব্যবহার করলেন। বললেন, আপনার কি সিগারেট লাগবে?’
‘জি না।’
‘কী লাগবে, বলেন।’
‘কিছু লাগবে না।’
‘না, মানে আমি আপনার জন্য কী করতে পারি?’
মুজিব বললেন, ‘খুব বড় একটা উপকার হয়, যদি তাড়াতাড়ি আমাকে জেলে পাঠায়ে দিতে পারেন। আমি কাল রাতেও প্লেনে ঘুমাতে পারি নাই। আজকে রাতে একটু শান্তিমতো ঘুমাতে চাই।’