উষার দুয়ারে – ৫০
৫০.
গণপূর্ত বিভাগের একজন লোক, তার মাথায় বড় টাক, টাকের নিচে একটা কালো দাগ, এসে বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ছে।
রেনু বললেন, ‘দেখ তো? কে ডাকে?’
গৃহপরিচারিকা মোমেনা, বয়স ১০, খুবই চঞ্চল, বাতাসের আগে ছোটে, দৌড়ে গেল দরজায়। এসে বলল, ‘আপনেরে বুলায়।’
রেনু তাঁর শিশুপুত্র জামালকে কোলে নিয়ে গেলেন দরজায়। জামাল কাল সারা রাত ঘুমোতে দেয়নি।
দুপুরবেলা।
রেনু এগিয়ে গেলেন, ‘কে?’
লোকটি বলল, ‘আমি গণপূর্ত বিভাগ থেকে এসেছি, আপনারা কবে বাসা ছাড়বেন?’
রেনু শক্ত করে ফেললেন মুখ। ‘কবে ছাড়ব? দুই সপ্তাহের মধ্যে ছাড়লেই তো হলো, নাকি?’
‘জি। সেই কথাটাই বলতে এসেছিলাম। আপনারা ১৪ জুনের মধ্যে বাসা ছেড়ে দেবেন। ভাবি, আমার উপরে রাগ কইরেন না, আমি সরকারি কর্মচারী, আমি হুকুমের চাকর, আমার ডিউটি আমি করে গেলাম।’
‘আচ্ছা যান। বলতে হবি না নে।
‘এই চিঠিটা একটু যদি সাইন করে নিতেন। সরকারি নোটিশ। এই জায়গায় একটু সাইন করে দেন।’
রেনু স্বাক্ষর করলেন। ফজিলাতুন্নেসা।
ইয়ার মোহাম্মদ খান আসেন। আল হেলাল হোটেলের মালিক হাজি হেলাল উদ্দিন আসেন।
রেনু বললেন, ‘বাড়ি ছাড়ার তাগাদা দিয়ে গেছে। ভাড়া বাড়ি যে খুঁজে দিতে হয় ভাইসাব।’
ইয়ার মোহাম্মদ খান বললেন, ‘আপনি একদম চিন্তা করবেন না, ভাবি। আমরা সব দেখছি।’
বললেই হলো চিন্তা করবেন না! টাকাপয়সা হাতে নাই। এত বড় বাড়িতে একা একা বাচ্চাকাচ্চাগুলোকে নিয়ে থাকা। মুজিব কেমন আছেন-না-আছেন, জেলখানায় কী খাচ্ছেন-না-খাচ্ছেন, চিন্তা বুঝি হয় না! টুঙ্গিপাড়াতে আব্বা কেমন আছেন, মা-ই বা কেমন আছেন?
ইয়ার মোহাম্মদের পক্ষেও বাসা খুঁজে পাওয়া সহজ হলো না। কে নিবে বাসাভাড়া? শেখ মুজিব। শুনেই লোকে ভয় পায়। উনি তো জেলে। পুলিশ ওনাকে শুধু ধরে নিয়ে যায়। এখন তো আবার গভর্নরের শাসন। পরে কোনো
ঝামেলা হবে না তো!
‘বাড়ি পাওয়া গেছে।’ ইয়ার মোহাম্মদ খান এসে বললেন।
‘কোথায় পাওয়া গেল?’
‘নাজিরাবাজারের গলিতে। ষাট টাকা ভাড়া।’
‘পাওয়া যখন গেছে, চলেন। কালকেই উঠে পড়ি,’ রেনু বললেন।
‘মুজিব ভাইয়ের সাথে দেখা করে আসি, তারপর দুদিন পরে ওঠা যাবে। আপনি গুছায়া নেন।’
‘আমার তো বেশি কিছু জিনিসপাতি নাই। আমি সব সময়ই জানতাম, এই বাড়ি আমার না। আপনার ভাইও এই লালবাড়িতে থাকতি পারবে না। তাকে জেলখানাতেই থাকতি হবে।’
‘সে তো আমি জানিই ভাবি।’
৫১.
আজ রেনু যাচ্ছেন মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে জেলখানা গেটে।
ইয়ার মোহাম্মদ খান এসেছেন মিন্টো রোডের সরকারি বাসায়। ফজিলাতুন্নেসা ওরফে রেনুকে বললেন, ‘ভাবি, চলেন।’
রেনু মাথায় শাড়ির আঁচল তুলে দিতে দিতে এগিয়ে এলেন, দেখলেন, ইয়ার মোহাম্মদের সঙ্গে একজন তরুণ এসেছেন।
তরুণটি তাঁকে সালাম দিলেন।
ইয়ার মোহাম্মদ পরিচয় করিয়ে দিলেন, ‘ওর নাম তাজউদ্দীন। আওয়ামী লীগ করে। এবার এমএলএ হয়েছে।
রেনু বললেন, ‘নতুন মেহমান নিয়ে এসেছেন ভাইজান, একটু বসেন, আমি একটু দেখি নাশতা-পানির কী ব্যবস্থা করতে পারি।’
ইয়ার মোহাম্মদ বললেন, ‘না না, ভাবি। আগে চলেন, মুজিব ভাইয়ের সাথে দেখা করে আসি। এখন আর ঝামেলা করবেন না।
ইয়ার মোহাম্মদ জানেন, শেখ মুজিবের সহধর্মিণী স্বামীর মতো, অতিথিবৎসল। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে রেনু এসেছেন ঢাকায়, এরই মধ্যে বংশালের বাসায়, মন্ত্রীর এই বাসভবনে মুজিবের সঙ্গে সকালে দুপরে রাতে তাঁকে খেতে হয়েছে কয়েকবার।
রেনু বললেন, “তাইলে পান দিই, ছোড ভাইডি।’ তাজউদ্দীন নাম বললেন না। ‘ভাইডি আপনি পান খান তো!’
‘জি, তাই দিন,’ তাজউদ্দীন বিনীত ভঙ্গিতে বললেন।
হাসু, কামাল আর জামালকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন রেনু। হাসু হাত ধরল ইয়ার মোহাম্মদের, কামাল ধরল তাজউদ্দীনের আঙুল আর রেনুর কোলে জামাল। তারা রিকশায় উঠলেন। হাসুকে নিয়ে সন্তান কোলে রেনু উঠলেন এক রিকশায়, আর কামালকে কোলে বসিয়ে তাজউদ্দীন আর ইয়ার মোহাম্মদ উঠলেন আরেক রিকশায়।
‘এই রিকশা, চলো জেলগেট।’
হাসু চোখ বড় বড় করে চেয়ে দেখছে ঢাকা শহর। এই শহরে তারা নতুন, আর বাড়ি থেকে তার বেরোনোও হয় খুব কম। বিকালবেলা। গির্জার ঘড়িতে সাড়ে তিনটা বাজে। আকাশ মেঘলা। ভীষণ গরম। ভাপসা চারদিক। রিকশা চলতে শুরু করলে বাতাস এসে শিস দেয় দুই কানে। বাতাসটা হাসুর ভালো লাগে।
টুঙ্গিপাড়ার বাড়িটা কত বড় ছিল। চারদিক খোলা। কত বড় উঠোন। ঘরের চালে, আঙিনায় সারাক্ষণ পায়রা ডাকে বাকুম বাকুম। বাড়ির সামনে খুলি। সেখানে ধান শুকোনো হচ্ছে, খড়ের নাড়া নেড়ে দিচ্ছে কিষান। ওই দূরে বরইয়ের গাছ, দল বেঁধে ছেলেমেয়ের ছুটছে বরইগাছের দিকে, মাটির ঢেলা কি বাঁশের টুকরো ছুড়ে মেরে চলেছে বরই পাড়ার চেষ্টা। ওই যে ওইটা পাকা, ওই যে ঝাঁকড়া ডালটার ওপরে, দেখ দেখ, ওইটাতে ঢিল লাগানো চাই। কুল যখন পেকে গেল সত্যি সত্যি, পাকার অবশ্য জো থাকে না, পাকার আগেই ঢিল মেরে সব সাফ, তবু দক্ষিণপাড়ার ঘন জঙ্গলের মধ্যে যে বরইগাছটা, যেখানে গেলে দিনের বেলায়ও গা ছমছম করে, একটা পুরোনো মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে যেখানে, বেজি মাথা তুলে তাকিয়ে যেখান থেকে পর্যবেক্ষণ করে ছেলেমেয়েদের, সেখানে গেলে দেখা যায় পাকা কুল লাল হয়ে আছে। এত কুল যে গাছের পাতা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। ধান শুকোনোর সময় পাখি আর মুরগি তাড়ানোর জন্য যে বড় চিকন বাঁশটা ব্যবহার করা হয়, সেটা নিয়ে গেলে আর ঢিল দেবার দরকার পড়ে না। বাঁশের মাথায় একটা বাঁকা কঞ্চি থাকায় মূর্ধন্য ণ-য়ের মতো মনে হয় জিনিসটাকে, সেটা দিয়ে বরই পাড়া যায় কোছা ভরে।
তারপর বরইগুলো ছেনে কাঁচা মরিচ নুন, যদি জোগাড় করা যায়, একটুখানি সরষের তেল আর সামান্য হলুদ দিয়ে মাখতে হয়। উফ, কী যে তার স্বাদ!
কিন্তু দখিনপাড়ার জঙ্গলে যেতে ছেলেমেয়েরা ভয় পায়। ওখানে নাকি….
আরেকটা বরইয়ের গাছ আছে পুকুরের পাড়ে। সেই গাছে উঠে পড়ে পাড়ার ছেলেমেয়েদের কেউ কেউ। ডালটা ধরে দেয় ঝাঁকুনি। লাল টুকটুকে বরইটাই গিয়ে পড়ে পানিতে। যাহ্, এখন রিকশায় মার পাশে বসে, মার কোলে বসা জামালকে একটুখানি আদর দিতে দিতে, হাসু ওই লাল বরইটার পানিতে ডুবে যাওয়ার স্মৃতি মনে করে, আর কী যে তার দুঃখ হয়! এই বৈশাখ মাসেও তারা আম পেড়ে খেয়েছে। ছোট ছোট আম। একটা গাছ ছিল কাঁচামিঠা আমের। সেই আম পেড়ে কুচি কুচি করে কেটে সরষে বাটা, লবণ আর কাঁচামরিচ মেখে কলাপাতা দিয়ে তিন কোনা পানের খিলির মতো বানিয়ে যে-ই না তুমি মুখে দিয়েছ, আহ্, স্বর্গ!
টুঙ্গিপাড়াই তো ভালো ছিল। রিকশার পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া একটা ঘোড়ার গাড়ির ঘোড়ার কান নাড়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হাসু ভাবল, আহা রে, আমাদের টুঙ্গিপাড়ার বড় নৌকাটা এখন ঘাটে বাঁধা আছে। কত বড় নৌকা, তাতে দুটো ঘর, জানালাও বড় বড়। নৌকার হালটা পেছনে, দাঁড় দুটো সামনে। আর ছোট্ট ডিঙি নৌকাটা! ওটা তো দুজনে মিলে বাওয়া যায়। কত চড়েছে হাসু ওটায়।
পাটখেতের ভেতর দিয়ে ওই নৌকা চড়ে ঘুরে বেড়ানোর দিন কি তবে শেষ হয়ে এল?
প্রথম স্কুলে যাওয়ার দিনটাও মনে পড়ে। খাল পেরোতে হবে, খালের ওপরে একটা বাঁশের চিকন সাঁকো, পায়ের নিচে একটা বাঁশ, মাথার কাছে ধরার জন্য একটা বাঁশ, এক হাতে বই-খাতা, যাও, এখন সাঁকো পার হও। সঙ্গে ছিল তিন বছরের বড় ফুপু, তিনি বললেন, বই-খাতা আমাকে দাও, তুমি আমার এই হাতটা ধরো, ওই হাত দিয়ে বাঁশ ধরো। ভয়ে ধুকপুক করছিল জানটা। এরপর ভয় গেল ভেঙে, সবার আগে তো ছুটে যেতে পারে হাসুই।
শীতের ভোরে ঘুম থেকে জেগে লাল আলোয়ান গায়ে জড়িয়ে ছুটে যাওয়া ঘুমন্ত নদীর ধারে। কুয়াশায় ঢেকে আছে চরাচর, ঘাসের ডগায় শিশির, পা ভিজে যাচ্ছে। নদীর পানিতে পা ডোবাও, ও মা, কী উষ্ণ পানি! দুপুরবেলা ছুটে যাও নদীতে, গোসল করতে, কলার গাছ কিংবা জোড়া নারকেল ধরে সাঁতরে চলো ওই কচুরিপানাটা পর্যন্ত। গোসল করতে করতেই দুজনে গামছা ধরে পানি ছাঁকলেই উঠে আসছে টেংরা কিংবা পুঁটি কিংবা বেলে মাছ। আর ওই ওখানে, ডোবানো নৌকাটার পাশে, যেখানে কচুরিপানা ঘন হয়ে আছে, পানি কালো, দুটো কাটা গাছ পড়ে আছে কালো কালো পাতাবিহীন ডালপালাগুলো আকাশের দিকে তুলে ধরে, ওইখানে চলো, একটা কচুরিপানার ঝাঁক তুলে তীরে আনো, পানার নিচের কালো চুলের মতো ঝোলানো শিকড় থেকে পানি টপটপ করে ঝরে পড়ছে, ওই দেখো, একটা বাইন মাছ। কিংবা কই মাছ পড়ল একটা, লাফাচ্ছে কী রকম তড়বড়িয়ে।
একদিন বাইনের বদলে উঠে এল একটা সাপ।
উরে বাবা!
রিকশা এসে পৌঁছাল জেলখানার প্রধান গেটে।
রেনু বললেন, হাসু, নামো। হাসু টুঙ্গিপাড়ার মধুর স্মৃতির ঘোর থেকে ফিরে এল বর্তমানে
রেনু নামলেন।
ইয়ার মোহাম্মদ এগিয়ে এসে রিকশাভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ভেতরে চললেন। দেখা করার পারমিশন আছে ইয়ার মোহাম্মদের, রেনু আর বাচ্চাদের; তাজউদ্দীনের নাই।
তাজউদ্দীন বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন।
১৯৫৪ সাল, ৫ জুন।
মুজিবের সঙ্গে দেখা হলো রেনুর, ইয়ার মোহাম্মদের, বাচ্চাদের। ইয়ার মোহাম্মদ দ্রুত কুশলাদি সারলেন।
মুজিব বললেন, ‘রেনু, কী ঠিক করেছ? টুঙ্গিপাড়া যাবা?’
রেনু বললেন, ‘বাবা-মাই তো আসতিছে। কী করে যাব।’
মুজিব বললেন, “ইয়ার মোহাম্মদ ভাই, তাহলে রেনুর জন্য একটা বাসা ভাড়া করে দেন।’
ইয়ার মোহাম্মদ বললেন, ‘আমি লোক লাগায়া রাখছি। পাওয়া যায় না। দেখা যাক। হবে।
‘আর কী অবস্থা? নেতা-কর্মীরা কোথায়?’
‘আগামীকাল মিটিং আছে। যুক্তফ্রন্ট পার্লামেন্টারি কমিটির। আবু হোসেন সরকারের বাড়িতে জড়ো হব। সেখান থেকে যাব সিমসন স্ট্রিটের পার্টি অফিসে। দেখা যাক কী হয়, আমরা ৯২/ক মানব না। আমি বাইরে যাই। আপনি ভাবি আর বাচ্চাদের সাথে কথা বলেন।’
ইয়ার মোহাম্মদ বেরিয়ে এলেন ভিজিটরস রুম থেকে।
মুজিব বললেন, ‘হাসু, কামাল, কেমন আছো?’
হাসু বলল, ‘ভালো আছি।’
কামাল বলল, ‘আব্বা, আপনি বাড়ি আসেন না কেন?’ রেনু বলল, ‘তুমি বড় রোগা হয়ে গেছ।’
মুজিব বললেন, ‘ঠিক মোটা হয়ে যাব। জেলখানার খাওয়া ভালো। কাজকর্ম নাই। তবে মনে হয় ডাকাতি ও খুন করার চেষ্টা, লুটতরাজ, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করা—এই অভিযোগ দিয়েছে। আবার এই মামলায় যদি জামিন পাই, সেই ভয়ে নিরাপত্তা মামলাও দিয়েছে। তো ক্রিমিনাল চার্জ যখন দিয়েছে, কিছু কাজ করতে হতে পারে। আগের বার তো বাগান করেছিলাম, ফুলগাছ লাগিয়ে ছিলাম। এবার দেখি, কী কাজ করা যায়
হাসু বলল, ‘আব্বা, কী ফুলগাছ লাগাবেন?’
মুজিব বলল, ‘কী ফুলগাছ! দেখি মা। রেনু, টাকাপয়সা সব শেষ?’
রেনু বললেন, ‘না, ইয়ার ভাই, হাজি সাব এনারা কিছু দিয়েছেন। আমিও ব্যবস্থা করেছি।’
‘কী ব্যবস্থা?’
‘তোমাকে আমাদের নিয়ে দুর্ভাবনা করতে হবে না নে। তুমি ভালো থেকো, তাহলেই হবে।’
হাসু বলল, ‘মা, একজোড়া চুড়ি বিক্রি করে দিয়েছে। খোকা কাকু নিয়ে গেছে।
রেনু বলল, ‘ওগুলোর ডিজাইন পছন্দ না। আমি আরেক জোড়া পছন্দমতো গড়তে দিব।’
মুজিব ম্লান হাসলেন। বললেন, ‘আমি তো কোনো দিনও তোমাদের খোঁজখবর করতে পারি নাই। চিরকাল তুমিই আমাকে টাকা দিয়েছ। কোনো দিন আমি তোমাকে কিছু দিতে পারি নাই। এখন ঢাকায় এসেছ। কষ্ট হবে। আমি জানি, তুমি সামলায়া নিতে পারবা।’
বরাদ্দকৃত সময় শেষ হয়ে এল।
ছলছল চোখে সন্তান কোলে বেরিয়ে এলেন রেনু, বেরিয়ে এল হাসু, জামাল।
বেরিয়ে এসে দেখলেন, তাজউদ্দীনও নাই, ইয়ার মোহাম্মদ খানও নাই।
রেনু বিহ্বল দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকালেন।
গেল কই?
হঠাৎ কোথা থেকে একটা ছাতা দিয়ে মাথা ঢেকে তাজউদ্দীন এসে উপস্থিত হলেন। বললেন, ‘সরি ভাবি। ইয়ার মোহাম্মদ খানকে অ্যারেস্ট করল এখনই। আমি তাই সটকে পড়েছিলাম। তাড়াতাড়ি চলেন। সরকার পাগল হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের, গণতন্ত্রী দলের, যুবলীগের লোক দেখলেই অ্যারেস্ট করছে।’
তাঁরা দ্রুত হেঁটে খানিকটা দূরে এসে রিকশা পেয়ে গেলেন।
.
আতাউর রহমান খানও দেখা করলেন শেখ মুজিবের সঙ্গে, জেলগেটে। একই দিনে।
মুজিব বললেন, ‘রহমান সাহেব, আমাদের উচিত প্রতিবাদ করা। সবাই মিলে আইন অমান্য করেন। অ্যারেস্ট হন। এতগুলান এমএলএ একযোগে অ্যারেস্ট হলে বড়লাট এমনিতেই বাপ বাপ করে ৯২/ক প্রত্যাহার করে নিবে।’
আতাউর রহমান বললেন, ‘দেখা যাক। আগামীকাল তো এমএলএ সবাইকে ডাকা হয়েছে। যুক্তফ্রন্টের সবাইকে। আমরা দেখি, এই ডিসিশন নিতে পারি কি না। আমি নেওয়ার পক্ষে। কিন্তু হক সাহেবের মতিগতি তো ভালো ঠেকছে না। উনি তো খুব ভয় পেয়ে গেছেন।’
মুজিব বললেন, ‘তাহলে আমরা নতুন লিডার নির্বাচন করব।’
আতাউর রহমান বললেন, ‘হ্যাঁ, তা করা যায়। আবু হোসেন সরকার, আশরাফুদ্দীন, সালাম খান আর আমি—চারজন হয়তো লিডার হওয়ার জন্য কনটেস্ট করতে পারি।’
মুজিব বললেন, ‘খান সাহেব, কী বলব, যে কয়দিন মন্ত্রী ছিলাম, বেতন তো কিছু পাওনা হয়েছে। টিএ-ও পাওনা হওয়ার কথা। রেনুর হাত তে পুরাটাই খালি। টাকাপয়সা কিছু নাই। আপনি কি আমার বেতন-টিএ তোলার ব্যবস্থা করে রেনুর হাতে টাকাটা পৌঁছে দিতে পারেন?’
আতাউর রহমান বললেন, ‘আমি অবশ্যই এই কাজটা করে দেব।’
মুজিব বললেন, ‘আমার বিরুদ্ধে কীসব ডাকাতি, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট—এইসব অভিযোগ দিয়েছে। আপনি জামিনের আবেদন করুন।
আতাউর রহমান খান ওকালতনামা বের করে দিয়ে বললেন, ‘আমি কেস ফাইল করছি। আপনি এখানে একটু স্বাক্ষর করে দিন।’
মুজিব স্বাক্ষর করলেন। আতাউর রহমান সাহেব বিদায় নিলেন।
.
পুরো আলাপটা শুনে নোট নিলেন একজন গোয়েন্দা কর্মচারী। কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁর রিপোর্ট জমা পড়ল গোয়েন্দা কার্যালয়ে
৫২.
নাজিরাবাজারের গলিতে এবারের বাড়ি। ষাট টাকা ভাড়া।
হাসু খালি বাসার এদিক-ওদিক ঘুরেফিরে দেখতে লাগল। কামালও রইল সঙ্গে সঙ্গে। কামাল হঠাৎ জানালা দিয়ে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘হাসু আপা, হাসু আপা, দেখো দেখো ওইটা কী?’
একটা বাঁদর বসে আছে পাশের বাড়ির ছাদে। তার কোলে একটা বাচ্চা বাঁদর।
‘মা মা, দেখে যাও,’ হাসু চিৎকার করে উঠল।
রেনুও এলেন। জানালা দিয়ে তাকালেন।
‘ওই দেখো মা, একটা মা-বাঁদর আর তার বাচ্চা।’
বাঁদরটা চার পায়ে হাঁটতে লাগল আর বাচ্চাটা তার বুকের কাছটা ধরে ঝুলেই রইল। রেনু বললেন, ‘মা রে, আমার কি আর এইসব দেখার সময় আছে। আমারে পুরা বাড়িঘর গোছাতি হবে। চুলা ধরাতে হবে।’
অন্ধকার নেমে আসছে। গলির ভেতরে হয়তো একটু তাড়াতাড়ি নামে।
মোমেনার কোলে জামালকে দিয়ে রেনু লেগে পড়লেন ঘরদোর গোছাতে।
৫৩.
রাতের বেলা ঢাকার বাসা থেকে সরে থাকলেন তাজউদ্দীন। আশ্রয় নিলেন তাঁর এক অরাজনৈতিক বন্ধুর বাড়িতে। আজ রাতে পুলিশ তাঁর বাড়িতে হানা দিতে পারে।
রাতের বেলা রেডিওর খবর শুনলেন।
জানতে পারলেন সব। আগে থেকেই অবশ্য অনুমান করা যাচ্ছিল, ঢাকা শহরে নানা গুজবও ভেসে বেড়াচ্ছিল। হক মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে, জারি করা হয়েছে ৯২-ক ধারা। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা সচিব মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জাকে করা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর। নিয়াজ মোহাম্মদ খানকে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের চিফ সেক্রেটারি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
রাত ১১টার খবরে জানতে পারলেন, ফজলুল হক সাহেবকে করা হয়েছে গৃহবন্দী আর গ্রেপ্তার করা হয়েছে শেখ মুজিবকে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়া রেডিওতে ভাষণ দিয়েছেন। তাজউদ্দীন সেটা সরাসরি শোনেন নাই। রেডিওর খবরে বারবার সেটার কথা বলা হচ্ছে।
মোহাম্মদ আলী বগুড়া তাঁর ভাষণে বলেছেন, ফজলুল হক মন্ত্রিসভা সম্পূর্ণ অযোগ্য। দেশের প্রশাসন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল। নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনায় দাঙ্গায় বহু মানুষ মারা গেছে, তা প্রতিরোধ করতে তো পারে নাই, আবার বলে যে, এটা কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্টকে ব্যর্থ প্রমাণ করার জন্য নিজেরা ঘটিয়েছে। আমি অনেকবার বলেছি, পূর্ব বাংলায় কমিউনিস্টরা সক্রিয়, আর এই সব দাঙ্গাহাঙ্গামা তারা ঘটিয়েছে, ফজলুল হক ততই বলে, পূর্ব বাংলায় কোনো কমিউনিস্ট নাই। ফজলুল হকের মানসিক ভারসাম্যও নষ্ট। তিনি কলকাতায় গিয়ে পাকিস্তানের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, নিউ ইয়র্ক টাইমস আর রয়টারর্সকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বলেছেন, পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করতে হবে, তারপর সেই সাক্ষাৎকারকে মিথ্যা বলে অভিহিত করেছেন এবং এর তিন দিনের মধ্যেই আমার সঙ্গে বৈঠককালে তিনি আবার বলেছেন, তাঁর লক্ষ্য হচ্ছে একটা স্বাধীন পূর্ব বাংলা। এ কে ফজলুল হক পাকিস্তানের জন্য একটা অভিশাপ আর বিরাট বিশ্বাসঘাতক।
জ্যৈষ্ঠের কাঁঠালপাকা গরমে একটা হাতপাখা নাড়তে নাড়তে তাজউদ্দীন বিড়বিড় করেন, কে কাকে বিশ্বাসঘাতক বলছে?
এই লোক না কলকাতা রাইটার্স বিল্ডিংয়ে সোহরাওয়ার্দীর অফিস সেক্রেটারি ছিল। সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভাতেও অবশ্য ঠাঁই পেয়েছিল সে।
তাজউদ্দীন বিছানায় বসে রেডিওর খবর শুনছিলেন। এবার তিনি উঠে দাঁড়ালেন। এইসব সমস্যার একটাই সমাধান, পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা, পায়চারি করতে করতে তিনি বললেন। সেটাই আমাদের অর্জন করতে হবে। প্রস্তুতি নিয়ে, সময়-সুযোগমতো।
৫৪.
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি কথা বলছে। ব্যাঙ্গমা বলল,
পাকিস্তানি শাসক ও সঙ্গী আমেরিকা।
অ্যাকশন যা নিল তা ইতিহাসে লিখা ॥
কমুনিস্ট ধরো মারো এই লক্ষ্য নিয়া।
হক-সরকার উৎখাতিল নাইনটু দিয়া ॥
মেজর জেনারেলে লাটসাহেব বানায়।
দশ হাজার সৈন্য তারা পাঠায় বাংলায় ॥
পাইকারি গ্রেপ্তার চলে কমুনিস্ট ভেবে।
আওয়ামী লীগেও তারা একহাত নেবে ॥
আমেরিকা সব জানে, চুক্তি হবে আরো।
দুই দিকের বন্ধুত্ব হবে আরো গাঢ় ॥
সিয়োটা ও সেন্টো চুক্তি পাক ও মার্কিনে।
স্বাক্ষরিত হলো, তারা নিল ঘাড় কিনে ॥
কমুনিস্ট পার্টি ব্যান্ড হলো দুই পাকিস্তানে।
মার্কিনি তারার সাথে হাসে পাকি চানে ॥
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘শুনো, মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা পূর্ব বাংলার লাটসাহেব হইয়া যে ভাষায় কথা কইলেন, আর যেভাবে ফজলুল হক সরকার উৎখাতের আগে পশ্চিম পাকিস্তান থাইকা পূর্ব বাংলায় ১০ হাজার সৈন্য পাঠাইলেন, সেইটা কিন্তু আমারে ভবিষ্যতের কথা মনে করায় দিতেছে।’
ব্যাঙ্গমা বলল, ‘কী রকম, কী রকম?’
ব্যাঙ্গমি হেসে বলল, ‘সবই জানো। কেন রঙ্গ করো। আজ থাইকা ১৭ বছর পরে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে এইভাবেই সৈন্য পাঠানো হইব, পূর্ব বাংলার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা না দেওনের লাইগা আর আমেরিকা তাগো সাপোর্ট দিব। আজকা মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা বইলা বেড়াইতেছেন, দরকার হইলে পূর্ব বাংলার প্রতিটা গ্রামে সৈন্য পাঠানো হইব, ৯২-ক ধারার বিরুদ্ধে কেউ কিছু কইলে সেইটা সহ্য করা হইব না। পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার লাইগা আমি যে কুনু কিছু করতে রাজি আছি, দরকার হইলে আমি ১০ হাজার বাঙালি হত্যা করুম, এই ঘোষণা সে দিছে না? আর ১৭ বছর পর তার ফলোয়াররা ৩০ লাখ বাঙালি হত্যা করব।
‘আর সে কী কয়? ইস্কান্দার মির্জা কয়, ভাসানী দেশে ফেরামাত্র তারে এয়ারপোর্টেই গুলি করা হইব। সে নাকি তার সবচেয়ে ভালো হাবিলদার শ্যুটাররে পাঠাইব বিমানবন্দরে। ভাসানী গেছেন বিলাতে। বিশ্বশান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে। অহন ফিরবেন কেমনে?