উষার দুয়ারে – ৫৫
৫৫.
তাজউদ্দীনকে গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে হচ্ছে। সরকার উন্মাদ হয়ে গেছে। নির্বিচারে কমিউনিস্ট ধরার নাম করে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, গণতন্ত্রী দল—শিক্ষক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে জেলে পুরছে। আর জেলখানায় করছে অকথ্য নির্যাতন। সবাইকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে নিরাপত্তা আইনে, বিনা বিচারে আটক রাখার কুখ্যাত আইন। তিন মাসের বেশি বিনা বিচারে আটক রাখা যায় না, তাই তিন মাস পরে নামমাত্র ছেড়ে দিয়ে জেলগেট থেকে আবার গ্রেপ্তার। এই চলছে ১৯৪৮ সাল থেকেই, কমিউনিস্টদের বেলায়। মুজিব ভাই, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহার মতো রাজনৈতিক নেতা, কিংবা মুনীর চৌধুরীর মতো বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকেরা জেলে আছেন এইভাবেই।
তাজউদ্দীন এখনো পর্যন্ত সব সময়েই গ্রেপ্তার এড়িয়ে থাকতে পেরেছেন। এরপর থাকতে পারবেন কি না, তা-ই ভাবছেন। তাঁর এই গোপন আস্তানা, তাঁর এক আত্মীয়র বাড়ির ঘরে বসে তিনি এইসব ভাবেন।
বাড়িটা ঢাকাতেই, এই বাড়িতে তিনি এর আগে কখনো রাত কাটাননি। ঢাকার বিখ্যাত গোলাপবাগানের পাশে তাঁর এই গোপন আশ্রয়। তিনি জানালা দিয়ে বাগান দেখতে পাচ্ছেন, দেখতে পাচ্ছেন ফুল আর নানা লতাগুল্মের বাহার।
সারাক্ষণ অবশ্য বাসায় বসে থাকেন না তাজউদ্দীন। মাঝেমধ্যে বেরিয়ে পড়েন সাইকেলটা নিয়ে, তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র-ভ্রাতুষ্পুত্রী আর ভাবির খোঁজ তাঁকে নিতে হয়। এটা তাঁর দায়িত্ব। বড় ভাই মারা যাওয়ার পর থেকে তিনি এই দায়িত্ব পালন করছেন। বন্দী নেতাদের খোঁজখবরও নেন তিনি। তাঁদের পরিবারের খোঁজ। মুজিব ভাবির কাছে যেতে হয়। তিনটা ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে তিনি থাকেন ঢাকায়। ঢাকায় তাঁরা নবাগত। তাঁদের কুশলাদি জানাও তো তাজউদ্দীনের কর্তব্য।
শেখ মুজিবকে এখন মুজিব ভাই বলেই সব সময় ডাকেন তিনি। এমনকি তিনি যে রোজ ডায়েরি লেখেন, সেখানে আগে শেখ মুজিব বলে অভিহিত করতেন এই নেতাটিকে, ইদানীং লিখছেন মুজিব ভাই। শেখ মুজিবের বিষয়ে ক্রমাগত তাঁর দ্বিধা কেটে যাচ্ছে, তাঁর ওপরে আস্থা বাড়ছে। বিশেষ করে, যুক্তফ্রন্টের মনোনয়ন দানের সময় শেখ মুজিবের ভূমিকা তিনি দেখেছেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব পশ্চিমা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, নৈশক্লাবে যাতায়াত করা মানুষ। তিনি কমিউনিস্টদের নমিনেশন দিতে চান না।
তাজউদ্দীন ইত্তেফাক-এর সাংবাদিকের কাছে শুনেছেন সোহরাওয়ার্দীর মনোনয়ন দেওয়ার সময়কার ঘটনা। দিনাজপুরের মনোনয়ন প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে সেদিন। সোহরাওয়ার্দীর হাতে জেলা আওয়ামী লীগের পাঠানো মনোনয়নপ্রার্থীদের তালিকা। তিনি নামগুলো মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলেন। একটা নামের দিকে তার চোখ পড়ল। এই লোক তো আওয়ামী লীগের না। এ কোত্থেকে এসেছে!
তিনি ডাকলেন আওয়ামী লীগের দিনাজপুর জেলা শাখার সভাপতি রহিমউদ্দীন উকিলকে। তাঁকে ওই নামটা দেখিয়ে বললেন, ‘মে আই আস্ক ইউ হু ইজ দিস জেন্টলম্যান?’
রহিমউদ্দিন উকিল কোনো জবাব দিলেন না।
এবার তিনি ডাকলেন সেই সন্দেহভাজন ভদ্রলোককে।
তাঁকে বললেন, ‘আপনি কি দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি?’
‘জি হ্যাঁ।’
‘তাহলে তো আপনাকে নমিনেশন দিতেই হবে। তবে হামাকে একটা সত্য কথা বলুন।’
‘কী বিষয়ে?’
‘হামি বলতে চাই, আপনের মতো হামার পার্টিতে আর কতজন ঢুকেছেন?’
‘জি মানে। প্রশ্নটা ঠিক বুঝলাম না।’
‘আপনে ঠিকই বুঝেছেন। হামি কমিউনিস্টদের কথা বলছি।’
সেই কমরেডকে নমিনেশন দেওয়া হয়নি। তবে শেখ মুজিব বাম বলে কথিত, কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন বলে পরিচিত অনেককেই নমিনেশন পাইয়ে দিয়েছেন। মুজিব ভাই বলেন, ‘আমি কমিউনিস্ট নই। কিন্তু সমাজতন্ত্র যে বৈষম্যমুক্তির পথ, সেটা আমিও বিশ্বাস করি। আর আমি বিশ্বাস করি অসাম্প্রদায়িকতায়। যদিও আমি মুসলমান।’
শেখ মুজিব আর মওলানা ভাসানীই যুক্তফ্রন্টের মনোনয়ন তালিকায় বেশ কয়েকজন বামপন্থীকে ইচ্ছাকৃতভাবেই ঢুকিয়েছেন।
মুজিব ভাই চেয়েছিলেন নির্বাচিত সরকার উৎখাতের অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নির্বাচিত এমএলএরা প্রতিবাদ করুন। ৬ জুন যুক্তফ্রন্টের অফিসে সব এমএলএর দুপুর দুইটায় সমবেত হওয়ার কথা। জানা গেল, পুলিশ ফ্রন্ট অফিসের পুরোটাই ঘিরে রেখেছে। তখন সবাই সমবেত হলেন আবু হোসেন সরকারের বাড়িতে।
যুক্তফ্রন্টের যে এমএলএরা জেলখানার বাইরে ছিলেন, তাঁদের প্রায় সবাই সমবেত এই বাড়িতে।
আবুল মনসুর আহমদ আর আবদুস সালাম খান বেরিয়ে পড়লেন একটা জিপ নিয়ে। প্রথমে গেলেন সিমসন রোডের ফ্রন্ট অফিসে। গিয়ে দেখলেন, অফিসে পুলিশ তালা ঝুলিয়েছে। তারা এগিয়ে গেলে পুলিশ বাধা দিল। একজন অফিসার একটা সরকারি নোটিশ দেখিয়ে, বললেন, ‘এখানে কোনো সভা করতে দেওয়া হবে না।’
ফজলুল হক সাহেব পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে বাড়ির বাইরে এলেন। পুলিশ বলল, ‘আপনি গৃহবন্দী, আপনার বাইরে যাওয়ার অনুমতি নাই।’ তিনি রাগে গজরাতে গজরাতে ঘরে ফিরে গেলেন।
আবু হোসেন সরকারের সরকারি বাড়িতেই সভা শুরু হলো।
সভাপতিত্ব করলেন চৌধুরী আশরাফউদ্দিন আহমদ।
কেন্দ্রীয় সরকারের ৯২-ক ধারা জারির অনিয়মতান্ত্রিক, অগণতান্ত্রিক, অন্যায় কাজের নিন্দা করা হলো। ফজলুল হককে অন্তরীণ করা আর শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করে গৃহীত হলো প্রস্তাব।
আতাউর রহমানের নেতৃত্বে একটা আহ্বায়ক পরিষদ গঠিত হলো সংগ্রামে নেতৃত্ব দেবার জন্য।
এই সময় পুলিশ এসে এই বাড়িতেও হানা দিল। সভা ভেঙে গেল অবিলম্বে।
আবুল মনসুর আহমদসহ কয়েকজন এমএলএ দেখা করতে গেলেন ফজলুল হকের সঙ্গে।
আবুল মনসুর পরে বলেছেন তাজউদ্দীনকে, ‘হক সাহেবকে তো কিছুই বোঝা যায় না। তাঁকে মনে হয় বার্ধক্যে পেয়ে বসেছে। আমরা বললাম, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সরকারের এই অন্যায় সিদ্ধান্ত আমরা মানব না। সকল এমএলএ গ্রেপ্তার বরণ করব। তাহলে কেন্দ্রীয় সরকার সাত দিনের মধ্যে আবার আপনাকে প্রধানমনন্ত্রী পদ ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হবে। আমরা ডাক দিলে দেশের সব মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে। হক সাহেব বললেন, এইভাবে বিপ্লব হয় না। জেলে গিয়ে কী লাভ। গ্রামে যাও, থানাপুলিশ আক্রমণ করো, সশস্ত্র বিপ্লব করো। আমার পক্ষে গ্রেপ্তার হওয়া সম্ভব না। আমরা বুঝলাম, তিনি খুব ভয় পেয়ে গেছেন। বোধ হয়, মাথাও একটু খারাপ হয়ে গেছে।’
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি বলাবলি করল, প্রায় একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে ১৭ বছর পর, যখন শেখ মুজিব এই নির্দেশই দেবেন বাংলার মানুষকে, বলবেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব, মরতে যখন শিখেছি কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, বাংলার মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ।’
.
তাজউদ্দীনের কাছে একটা চিঠি এসেছে। আজ সকালে একজন কর্মী চিঠিটা তাঁকে দিয়ে গেছে। চিঠিতে অবশ্য প্রাপকের নাম তারেক, প্রেরকের নাম রহমত। দেখেই তাজউদ্দীন বুঝলেন জেলখানা থেকে কৌশলে চিঠি পাঠিয়েছেন অলি আহাদ। অলি আহাদ নিজের নাম নিয়েছেন রহমত। তাজউদ্দীনের ছদ্মনাম তারেক।
অলি আহাদ আর কারাগারে থাকতে নারাজ। বহুদিন হলো তিনি কারাগারে। দাসখত দিয়ে মুক্তি তিনি পেতে পারতেন। কিন্তু তিনি দাসখত দিতে নারাজ। তাই তাঁর মুক্তির আশাও সুদূরপরাহত। তবু তিনি চান, তাঁকে যেন মুক্তি দেওয়া হয়। সে ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্যই তিনি তাজউদ্দীনকে চিঠি লিখেছেন। এর আগেও একটা চিঠি অলি আহাদ লিখেছিলেন। তাজউদ্দীন তার উত্তর দিতে পারেননি। জেলখানায় চিঠি পাঠানো সহজ নয়। তার চেয়ে বড় কথা, তাজউদ্দীন গ্রেপ্তারবরণ করতে চান না। এমন নয় যে, গ্রেপ্তার হওয়াটাকে তিনি ভয় পান। দেশের সেবা করতে চাইলে কিছু মূল্য তো দিতে হতেই পারে। ভাষাশহীদেরা মাতৃভাষাকে ভালোবেসে চরম মূল্য দিয়ে গেছেন। মুজিব ভাইয়ের নিষেধ আছে গ্রেপ্তার হওয়ার ব্যাপারে। এর আগে অন্তত দুইবার মুজিব ভাই তাঁকে বলেছেন, গ্রেপ্তার হোয়ো না। কাজেই অলি আহাদের চিঠির জবাব লিখতে হবে, এটা যেমন কর্তব্য, তেমনি তাজউদ্দীনের কর্তব্য বোকার মতো ধরা না পড়া।
তিনি অবশ্য অলি আহাদের মুক্তির ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য আতাউর রহমান খানের সঙ্গে কয়েকবার কথা বলেছেন।
.
তাজউদ্দীন এখন বসে বসে সেই চিঠির উত্তর লিখছেন। বৃষ্টি হতে শুরু করল। জানালা দিয়ে তিনি দেখতে পাচ্ছেন বাগানের পত্রপুষ্পের গায়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরছে। বুলবুল পাখিগুলো সব উড়ে কোথায় চলে গেল।
তিনি লিখলেন :
প্রিয় রহমত,
সকালে আপনার পত্র পেলাম। আমি খুবই দুঃখিত। আপনার এর আগের চিরকুটটির উত্তর দিতে পারিনি বলে অপরাধ মানছি। কিন্তু আপনি নিশ্চিত জানবেন, আপনার মতামতের প্রতি আমরা খুবই আগ্রহী। আমার অনুরোধে আর নিজের আগ্রহে আতাউর রহমান খান সাহেব চিফ সেক্রেটারির সঙ্গে আপনার মামলার বিষয়ে কথা বলেছেন। মি. খান প্রায়ই যান চিফ সেক্রেটারির কাছে, রাজবন্দীদের মুক্তির বিষয়ে কথা বলেন, বিশেষ করে কথা বলেন আওয়ামী লীগের রাজবন্দীদের ব্যাপারে। আপনার আর মি. তোয়াহার মুক্তির ব্যাপারে তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ আছে। নেজামে ইসলামী আর কৃষক শ্রমিক পার্টির ব্যাপারে আওয়ামী লীগের দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে আপনার চিঠি কামরুদ্দীন সাহেব আমাকে দেখিয়েছেন। আমি আতাউর রহমান খান সাহেবকে আপনার মত জানিয়েছি। তিনি আপনার মতের প্রশংসা করেছেন। আপনি হয়তো লক্ষ করে থাকবেন, বন্যা ত্রাণ কমিটিতে অবাঞ্ছিত লোকদের প্রাধান্য কমিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু এমনভাবে চলতে হবে, যাতে যুক্তফ্রন্টের সংহতি বিনষ্ট না হয়। অন্তত বাইরের কেউ যেন না বোঝে, যুক্তফ্রন্টে কোনো বিভেদ আছে। আমাদের নির্দোষ শুভাকাঙ্ক্ষী কিংবা ঈর্ষাপরায়ণ শত্রুদের কাউকেই তা জানতে দেওয়া উচিত নয়। আজ এই দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে আপনার উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা আপনার খারাপ বন্ধুরাও (বললাম না শত্রুরা) অনুভব করবে।
পূর্ব বাংলা সরকার আর আতাউর রহমান খান সাহেবের মধ্যেকার আলোচনা থেকে মনে হচ্ছে, সরকার আওয়ামী লীগের ব্যাপারে সদয় হবে। কিন্তু পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন, যুবলীগ আর গণতন্ত্রী দলের লোকদের ব্যাপারে তারা কঠোর হবে। ভুল হোক, আর ঠিক হোক, এই তিনটা দলকে তারা মনে করে কমিউনিস্ট পার্টির অনুসারী। আপনি শুনলে আশ্চর্য হবেন যে, সরকার মনে করে, ছাত্র ইউনিয়ন হলো কমিউনিস্ট পার্টির রিক্রুটিং সংগঠন, যুবলীগ তাদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র আর গণতন্ত্রী দল হলো তাদের পার্লামেন্টারি শাখা। এ হলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশ্লেষণ।
তোয়াহা সাহেব আওয়ামী লীগার, আবার যুবলীগেরও লোক। ইয়ার মোহাম্মদ খানও তাই। সুতরাং আমরা সবাই মনে করি, আপনার আরও কিছুদিন অপেক্ষা করা উচিত। তত দিন পর্যন্ত, যত দিনে সরকারি কর্মকর্তারা বুঝতে পারে যে তাদের ঈর্ষান্বিত ও পদোন্নতিকামী আইবি-কর্তারা যা রিপোর্ট করেন, স্বর্গ ও মর্ত্যে তার বাইরেও আরও কিছু থাকতে পারে। আমরা মনে করি, শিগগিরই সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। আমি আপনার অসুবিধা বুঝতে পারছি, কিন্তু এই তো আমাদের নিয়তি বা আমরা তো এই পথই বেছে নিয়েছি, যে পথে শুধুই কাঁটা। দেশপ্রেমিকের আত্মত্যাগ বৃথা যেতে পারে না। তাদের অকৃত্রিম দেশপ্রেম মানবতাবাদীদের চিরকাল লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে। কোনো নির্যাতনই তাদের সত্যের পথ থেকে তাদের সরাতে পারে না।
মওলানা (ভাসানী) সব সময়েই চান দ্রুত আত্মপ্রকাশ করতে, ঠিক আপনারই মতো। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী মওলানাকে বলেছেন তিনি পাকিস্তানে না আসা পর্যন্ত যেন মওলানা দেশে না আসেন। আমরা আপনার ব্যাপারে আলোচনা করেছি। আমাদের মত হলো, আপনি সোহরাওয়ার্দীর আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। দু সপ্তাহ আগে তাঁর অপারেশন হয়েছে। তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছেন। তাঁর লেখা চিঠি আমি আতাউর রহমান খান আর কামরুদ্দীন সাহেবের কাছে দেখেছি। দয়া করে বিশ্রাম নিন আর অপেক্ষা করুন। আপনি তো সব সময়ই পিলারের মতো শক্ত। আমাদের বিশ্বাস, আপনি সব কষ্ট সহ্য করবেন এবং হতাশায় নিমজ্জিত হবেন না।
তারেক
এ পর্যন্ত লিখে ফের লিখলেন—পুনশ্চ : এই মুহূর্তে আত্মসমর্পণের প্রশ্নই ওঠে না।
.
চিঠিটা এখন জেলখানায় পৌঁছাতে হবে।
একটা কৌশল অবলম্বন করতে হবে তাজউদ্দীনকে। জেলখানার প্রহরীরাই চিঠি আদান-প্রদান করে থাকে। তাজউদ্দীনের সূত্র জানা আছে। যেভাবে এসেছিল অলি আহাদের চিরকুটগুলো, সেভাবেই চিঠিটা পৌঁছাতে হবে তাঁর হাতে।
৫৬.
শেখ লুৎফর রহমান, সায়রা বেগম, তাঁদের ছেলে শেখ আবু নাসের আর ভাতিজা আবুল হোসেন এসেছেন ঢাকায়। নাজিরাবাদের বাড়িতে এসে পৌছুলেন তাঁরা। সারা রাত কষ্টকর জার্নি। পাটগাতী পর্যন্ত নৌকায়। তারপর স্টিমার। স্টিমার সদরঘাটে থামল। সেখান থেকে ঠিকানা হাতে করে এই ৭৯ নাজিরাবাজার লেন। ভোরবেলা এসে পৌঁছালেন তারা।
তখন রেনু উঠে নামাজ সেরেছেন। কাল সারা রাত ঝিরঝির করে বৃষ্টি হয়েছে। ভোরের দিকে বৃষ্টি থেমে গেছে।
এই সময় দরজায় করাঘাত।
রেনু জানতেন, তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ি আসবেন। তিনি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললেন।
হাসু কামালও জানত, ভোরবেলা দাদা-দাদি আসবেন। দরজায় একটু শব্দ হতেই তারা ঘুম থেকে উঠে খালি পায়ে দরজার কাছে চলে এল।
দাদা-দাদিকে কাছে পেয়ে হাসু আর কামাল যেন আকাশের চাঁদ পেয়ে গেল।
দাদি বললে, ‘কেমন আছো, বুবু?’
হাসু বলল, ‘এখানে ভালো লাগে না দাদি। আমাদের টুঙ্গিপাড়া অনেক ভালো।’
দাদি হাসুর জন্য আম এনেছেন। গাছের পাকা আম।
আমের ঝুড়িটা খুললেন তিনি। ধানের বিচালির মধ্যে রাখা আম।
হাসু বলল, ‘দাদি, তুমি পাকা আম এনেছ? কাঁচা আম আনতে পারলা না। ছোট ছোট কাঁচা আম?’
দাদি বললেন, ‘এখন জ্যৈষ্ঠ শেষ হয়ে আষাঢ় মাস, এখন ছোট কাঁচা আম পাওয়া যায় না, বুবু।
রেনু তাঁর শাশুড়ির হাত ধরে বললেন, ‘হাসুবুড়ির পটর-পটর কথা শুনেছেন। ওরা যে সারা দিনে কত কী বলে?’
শেখ লুৎফর রহমান সাহেব বললেন, ‘আমাদের খোকার সাথে দেখা করার টাইম কখন? তোমরা রেডি হয়ে নাও। খোকা কই? মমিনুল হক খোকা?’
রেনু বললেন, ‘ও তো ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের হোস্টেলে কার সাথে জানি থাকে। ও আসবে। ওর সাথেই আমরা যাব জেলখানায়। বেশি দূর তো নয়।
‘ও আচ্ছা।’
রেনু বললেন, ‘আপনারা গোসল করে নেন। আমি নাশতা তৈয়ার করে ফেলি।’
একটাই গোসলখানা। লুৎফর রহমান সাহেব ঢুকলেন। সায়রা খাতুন রান্নাঘরে এসে বললেন, ‘পিঠা এনেছি। যা গরম, নষ্ট না হয়। চিড়ামুড়ি গুড় এনেছি। তোমারে আর কষ্ট করে এখন নাশতা বানাতে হবে না। আমরা ওগুলোই খেয়ে নেব। বাচ্চাদের দাও।’
‘তাহলে আমি ভাত চড়ায়ে দেই। খেয়ে একেবারে বের হয়ে জেলখানায় যাব। নাকি খিচুড়ি চড়াব?’
‘খিচুড়িই চড়াও। ঝামেলা কম হবে।’ সায়রা খাতুন বললেন।
রেনু খিচুড়িই চড়ালেন। সবার সঙ্গে মেঝেতে মাদুর পেতে বসে খিচুড়ি খেতে খেতে হাসু বলল, ‘মা, ভাত রাঁধা ভুলেই গেছে। আমরা রোজ খিচুড়ি খাই।’
রেনু বললেন, ‘কী বলো। পরশুই না ভাত রাঁধলাম।’
সায়রা খাতুনের চোখে জল চলে এল। সেটা গোপন করার জন্য তিনি বললেন, ‘একটা কাঁচা মরিচ মুখের নিচে পড়েছে।’
তিনি জানেন, বউমা কেন প্রতিবেলা খিচুড়ি রেঁধে বাচ্চাদের খাইয়েছে। শুধু ডাল দিয়ে ভাত খাওয়া যায় না, কিন্তু খিচুড়ি কোনো তরকারি ছাড়াই খাওয়া যায়। বউমার হাতে টাকা নাই।
কয়েকটা রিকশা নিয়ে তারা চললেন জেলখানা অভিমুখে। মমিনুল হক খোকাও তাঁদের সঙ্গে ছিলেন।
মুজিব যখন মন্ত্রী হলেন, তারপর ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দিয়ে যখন চলে গেলেন মিন্টো রোডে, তখন মমিনুল হক খোকা ঢাকার বাইরে ছিলেন। ফিরে এসে দেখলেন, তাঁর ঘরের জিনিসপত্র কিছু নাই।
কে নিয়ে গেছে?
মুজিব ভাই লোক পাঠিয়ে সব নিজের মন্ত্রিভবনে নিয়ে গেছেন।
মমিনুল হক খোকা গেলেন মিন্টো রোডে। গিয়ে দেখলেন, বাড়ি ভর্তি লোক গমগম করছে। তাঁর জিনিসপত্র বিছানা সব এক কোণে সবার অলক্ষ্যে পড়ে আছে।
তিনি রেনুকে বললেন, ‘কী করেছেন, ভাবি। আমাকে না জানিয়ে আমার বিছানাবালিশ সব নিয়ে এসেছেন।’
মুজিব বললেন, ‘আমার যখন থাকার জায়গা ছিল না, তোর কাছে আমি ছিলাম না! এখন এত বাড়ি নিয়ে আমি একলা থাকব? তোর আবার আলাদা বাসা কিসের? তুই এখন থেকে আমাদের সাথেই থাকবি।’
রেনু বলেছিলেন, ‘ভাইডি, ভাই যা বলে শোনো। আমাদের সাথেই থাকো। আমরা যদি দুডো ডালভাত জোগাড় করতি পারি, তুমিও তা-ই খাবে।
তাই ছিলেন মমিনুল হক খোকা। কয়েক দিনের মধ্যেই তো মন্ত্রিত্বই চলে গেল।
বাড়ি ছেড়ে দিতে হলো। মুজিব ভাই নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘সরে থাক। আমাকে অ্যারেস্ট করতে এসে না হলে তোরেও অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে। এর আগে তো ভোটের সময় জেল খেটেছিস।’
মুজিব প্রায় জোর করেই তাঁকে ওই দিন বাড়ি থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। তখনই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে বন্ধুর হোস্টেলে তাঁকে উঠতে হয়।
লুৎফর রহমান সাহেবকে জেলগেটের সবাই চেনে। তিনি অনেকবার এসেছেন এই গেটে। তাঁরও জায়গাটা, নিয়মকানুন সব মুখস্থ হয়ে গেছে।
.
সকাল থেকেই মুজিবের মনে ফূর্তি। আজ তাঁর ‘দেখা’ আসবে। আব্বা, মা, রেনু, বাচ্চারা। তিনি জেলখানার বাগান থেকে ফুল তুললেন। ফুলের একটা তোড়া বানালেন। বানানোর পরে মনে হলো, একটা তোড়া কাকে দেবেন? তিনি আরেকটা তোড়া বানাতে লাগলেন।
দুটো তোড়া নিয়ে তিনি গেলেন তাঁর ভিজিটরদের সঙ্গে দেখা করতে।
আব্বার হাতে একটা ফুলের তোড়া দেবেন কি! কেমন বেখাপ্পা লাগবে। দুটো তোড়ার একটা তিনি হাসুকে, একটা কামালকে দিলেন।
কামাল তার প্যান্টের পকেট থেকে বের করল একটা মুড়ির মোয়া। বলল, ‘আব্বা, নেন, দাদি আজকে এনেছে।’
হাসু বলল, ‘আব্বা, আপনার বাগান থেকে আমাকে একটা গোলাপ ফুলের চারা দেবেন তো। আমি আমাদের বাসায় মাটির হাঁড়িতে লাগাব।’
লুৎফর রহমান বললেন, ‘খোকা, তোমারে কত দিন রাখবে মনে হয়?’
মুজিব বললেন, ‘মনে হয় না ছাড়বে। ডাকাতি মামলা দিয়েছে, আবার নিরাপত্তা আইনেও গ্রেপ্তার দেখায়েছে। ছাড়ার ইচ্ছা থাকলে এত কিছু করত না। বাইরে আন্দোলন না হলে ছাড়ার কোনো কারণ দেখি না।’
লুৎফর রহমান বললেন, ‘এরা দেখি গণতন্ত্র মানে না। জনগণের ভোটের যদি কোনো দাম না-ই থাকে, ভোট করার কী দরকার ছিল?’
বিদায়ের সময় হলো। উপস্থিত কারারক্ষী বলল, ‘সময় শেষ। আপনাদের যেতে হবে। স্যার, আপনিও ওঠেন।’
শেখ লুৎফর রহমান বললেন, ‘চলো, আমরা একটু বাইরে যাই। রেনু যদি একলা কোনো কথা বলতে চায়, বলুক।
শেখ লুৎফর রহমান ছেলের হাত ধরে বললেন, ‘আসি খোকা। নীতি নিয়া থাকো, আমাদের জন্য কোনো চিন্তা করিও না। ইনশাল্লাহ জয়যুক্ত হবা।’
সায়রা খাতুন মুজিবকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘আল্লাহ তোমাকে ভালো রাখুক।’
মমিনুল হক খোকা বললেন, ‘মিয়াভাই, আসি। আমি আছি। ভাবিদের নিয়া চিন্তা করবেন না।’
হাসু বলল, ‘আসি আব্বা, আমি আছি, মাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না।’
কামাল বলল, ‘হাসু আপু। তুমি যাও। আমি যাব না। আমি জেলখানায় থাকব।’
রেনু বললেন, ‘আমার আলাদা কোনো কথা নাই। আমি আপনাদের সাথেই বারাই। কামাল চলো।’
কামাল মুজিবের কোলে উঠে পড়ল। বলল, ‘আমি যাব না। আমি আব্বার সঙ্গে জেলখানাতেই থাকব।’
রক্ষী আবার তাগাদা দিল। ‘স্যার, আপনার সময় অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। আপনি তো বোঝেনই স্যার। আমরা হুকুমের চাকর।’
মুজিব সব সময় পুলিশ বা ডিবি সদস্যদের ব্যক্তিগত কোনো অসুবিধা যাতে না হয়, তা দেখে এসেছেন। এরা তো আসলেই চাকুরে মাত্র, এদেরকে বিপদে ফেলার কোনো মানে হয় না। তিনি বললেন, “ঠিক আছে তোমরা যাও। আমিও যাই। কামাল বাবা, আমি তাড়াতাড়ি বাড়ি যাব। তোমার সাথে থাকব। এখন মার সাথে তুমি বাড়ি যাও।’
কামাল বলল, ‘না, তোমার বাড়ি যাওয়ার দরকার নাই। তুমি জেলখানায় থাকো। আমিও তোমার সঙ্গে জেলখানায় থাকব। তোমার সাথে ফুলের বাগান করব।’
কামাল কিছুতেই তার আব্বার কোল ছাড়বে না। কিছুতেই না। তাকে নামাতে গেলেই সে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করতে লাগল
৫৭.
আতাউর রহমান খান লম্বা-চওড়া মানুষ। শেরওয়ানি পরছেন হোটেল কক্ষে। বোতাম লাগাচ্ছেন। তিনি এসেছেন করাচি। দেখা করবেন গভর্নর জেনারেল বা বড় লাটসাহেবের সঙ্গে। লাটসাহেব গোলাম মোহাম্মদ অসুস্থ। শুয়ে শুয়ে দেশ পরিচালনা করেন। তার শরীরের অর্ধেকাংশ অবশ। কথা জড়িয়ে যায়।
বড়লাট খবর পেয়েছেন আতাউর রহমান করাচিতে। তিনি নিজেই ডেকে পাঠিয়েছেন। বড়লাট ডেকে পাঠালে না গিয়ে উপায় কী? ৪৭ বছর বয়সী এই রাজনীতিক কাম উকিল চললেন লাটসাহেবের প্রাসাদে।
আতাউর রহমান খান বললেন, ‘স্যার, ডেকেছিলেন কেন?’
তখন তাঁর দীনহীন বেশ। মুখখানা করুণ।
বললেন, ‘ওরা আমার সব ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে আমাকে পঙ্গু করে দিয়েছে।’
আতাউর রহমান তাঁকে কয় মাস আগেও দেখে গেছেন। তখনই তিনি এই রকম অর্ধ-অবশই ছিলেন। ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে পঙ্গু করে দেওয়ার কথাটা একটা রূপক মাত্ৰ।
আতাউর রহমান মুখখানা কাতর করলেন। কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়ার নেতৃত্বে মুসলিম লীগের গণপরিষদ সদস্যরা বিল উত্থাপন করে পাস করে নিয়েছে। গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা হ্রাস। গভর্নর জেনারেল তখন করাচি ছিলেন না, হাওয়া বদল করতে গেছেন অ্যাবোটাবাদ।
গোলাম মোহাম্মদ ঘটনা বলতে লাগলেন তো তো করে। আর গালি দিতে লাগলেন মন্ত্রী আর গণপরিষদ সদস্যদের, ও একটা চোর, ওটা বদমাশ, ও তো একটা হারামজাদা।
আতাউর রহমান বললেন, ‘এই সমস্যার একটা সমাধান আছে। আপনি গণপরিষদ ভেঙে দেন। আট বছর আগে ওরা নির্বাচিত হয়েছে। কাজের কাজ কিছু করতে পারে নাই। তাদের আসল কাজ হলো শাসনতন্ত্র রচনা করা। সেটাই তো তারা করেনি। তা না করে আইনপ্রণেতার ভূমিকা নেওয়ার মানে কী?
গোলাম মোহাম্মদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘দেখা যাক কী করতে পারি! আর শোনো। এসব কথা কাউকে কিছু বোলো না। তোমার আর আমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকুক।’
‘আমি তো লন্ডন আর জুরিখ যাচ্ছি। লন্ডনে মওলানা ভাসানী আছেন। একটু দেখা করব। আর সোহরাওয়ার্দী সাহেব আছেন জুরিখে। তাঁর অপারেশন হয়েছে। তাঁকেও একটিবার দেখা আমার কর্তব্য।’
‘শহীদকে তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো। তাকে আমার খুব দরকার। সন্ধ্যার সময়ে আতাউর রহমান খান আয়োজন করলেন এক সাংবাদ সম্মেলন। জানালেন, পূর্ব বাংলায় বন্যা হচ্ছে। বন্যা-পরিস্থিতি খুব ভয়ংকর। সাংবাদিকেরা বন্যা নিয়ে জানতে আগ্রহী নয়। একজন প্রশ্ন করলেন, ‘এ কে ফজলুল হককে বাদ দিয়ে আপনারা সরকার গঠন করতে পারেন না?’
‘সংখ্যাগরিষ্ঠতার কথা বিবেচনা করলে অবশ্যই পারি।’
.
পরের দিন ভোরবেলা তিনি রওনা হলেন লন্ডনের উদ্দেশে।
সেখানে তিনি দেখা করলেন মওলানা ভাসানীর সঙ্গে। সেই একই রূপ ভাসানীর। লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি। মাথায় সেই তালের আঁশের টুপি।
ভাসানী দেশ ছেড়েছিলেন বার্লিনে বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে অংশ নেবেন বলে। বিশ্বশান্তি পরিষদের সভাপতি জুলিও কুরি তাঁদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সফরসঙ্গী ছিলেন খন্দকার ইলিয়াস, জমিরুদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ আর ফয়েজ আহমদ।
করাচি গিয়েছিলেন তাঁরা প্রথমে। জার্মানির ভিসা তাঁরা জোগাড় করতে পারেননি। তাই তাঁরা ইউরোপে চলে আসেন। প্রথমে যান রোমে। সেখানেও জার্মানির ভিসা না পেয়ে চলে আসেন লন্ডনে।
তত দিনে বার্লিনের শান্তি সম্মেলন সমাপ্ত হয়ে যায়। ভাসানী অবশ্য একটা বাণী পাঠিয়েছিলেন বার্লিন সম্মেলনে। সভাপতি জুলিও কুরি তা পাঠ করে শোনান।
.
ভাসানী বললেন, ‘আতাউর, এইখানে তো ভালো লাইগতেছে না, আমারে দেশে ফেরার ব্যবস্থা কইরে তারপর তুমি যাও। পরের ঘরে পরেরটা খাইয়া কি ভালো লাগে! দেশের মানুষ কেমন আছে, না আছে, জানতে ইচ্ছে করে।’
আতাউর রহমান খান বললেন, ‘আপনাকে তো সোহরাওয়ার্দী সাহেব আর কয়েক দিন অপেক্ষা করতে বলেছেন। করেন অপেক্ষা। আমি যাচ্ছি জুরিখে। দেখা করে তাঁকে করাচিতে ফিরে যেতে বলি। গোলাম মোহাম্মদও তাঁকে খুঁজছেন।
ভাসানী লন্ডনে আছেন ২৯ সেন্ট ম্যারি অ্যাবোট টেরাসে। তাঁর আগমনের খবরে বাঙালিরা ভিড় জমিয়ে ফেলে। তাঁরাই চাঁদা তুলে তাঁর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করছে।
ভাসানী বললেন, ‘শোনো, তুমি শহীদ সাহেবরে বইলবা, পাকিস্তানে কমিউনিস্টদের উপরে অত্যাচার বন্ধ না হইলে আমি দেশে ফিইরব না।’
আতাউর রহমান খান বুঝতে পারলেন না, ভাসানী আসলে কী চান? তিনি কি দেশে ফিরতে চান, নাকি দেশের বাইরে থাকতে চান!
.
আমগাছের ডাল থেকে পাখি দুটো উড়ে যায় মেডিকেল কলেজের জরুরি বিভাগের ছাদে। সেখানে দুজনে গল্প করে।
ব্যাঙ্গমা বলল, ‘এরপরে শান্তি সম্মেলন হইব স্টকহোমে। সেখানে ভাসানী হাজির হইব। তাঁর সঙ্গে চিলির কবি পাবলো নেরুদা, তুরস্কের নির্বাসিত কবি নাজিম হিকমত হোটেল রুমে আইসা দেখা করব।
‘আর ইংল্যান্ডের লেবার পার্টি নেতা তারে আমন্ত্রণ জানাইব তাগো সম্মেলনে ভাষণ দিতে। ভাষণ শুইনা তারে খেতাব দেওয়া হইব “ফায়ার ইটার মওলানা”।
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘আচ্ছা, সে তো আরও কিছুদিন পরের কথা। অহন আতাউর রহমান খান কই যাইব?’
‘জুরিখ। সুইজারল্যান্ড।’
.
আতাউর রহমান গেলেন জুরিখে। সোহরাওয়ার্দীর হাসপাতালে যখন পৌঁছালেন, তখন সন্ধ্যা। খবর এল, বড়লাট গোলাম মোহাম্মদ গণপরিষদ ভেঙে দিয়েছেন। মোহাম্মদ আলী বগুড়া তখন যুক্তরাষ্ট্রে। আর ইস্কান্দার মির্জাকে পূর্ব বাংলা থেকে সরিয়ে করা হয়েছে কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে কথা হলো আতাউর রহমান খানের। আতাউর রহমান খান বললেন, ‘এখন শরীরটা ভালো?”
‘হ্যাঁ এখন ভালো। তবে ডক্টর বলছে, হামাকে আরও রেস্ট করতে হোবে।’
‘আপনি করাচি ফিরে যান। বড়লাট আপনাকে খোঁজে। আপনাকে খুব দরকার। শুনেছেন তো, আজ গণপরিষদ বাতিল করে দিয়েছে।’
‘শুনেছি। কেন খোঁজে?’
‘মনে হয়, আপনাকে ক্ষমতা দিতে চায়।’
‘শরীরটা ঠিক হোক। তারপর হামি ফিরব।’
.
আতাউর রহমান খান ফিরলেন করাচিতে। বড়লাট গোলাম মোহাম্মদ তখন করাচি থেকে ২০ মাইল দূরে আরব সাগরতীরে। আরাম করছেন।
আতাউর রহমান টেলিফোন করলেন বড়লাট ভবনে। ‘আমি কি একটু দেখা করতে পারি বড়লাট সাহেবের সঙ্গে?’
‘বিলকুল নেহি।’
‘আমার নাম আতাউর রহমান খান। নামটা একটু বলবেন তাঁকে।’
ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই এক সামরিক কর্মচারী হোটেলে এসে হাজির। লাটসাহেব সালাম দিয়েছেন।
আতাউর রহমান গেলেন লাটসাহেবের কাছে, গাড়িতে করে, ২০ মাইল দূরে, মরুভূমির লু হাওয়া খেতে খেতে।
আতাউর রহমানের জন্য বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। গোলাম মোহাম্মদ অনেকটাই সুস্থ। তিনি এখন হেসে হেসে কথা বলছেন। জিগ্যেস করলেন, ‘সোহরাওয়ার্দী সাহেব তো এখন সুস্থ, তাহলে তিনি এলেন না কেন?
‘তিনি বিশ্রাম করছেন। আপনি ডাকলেই এসে পড়বেন।’
‘তাঁকে আমার বহুত দরকার। গণপরিষদ ভেঙে দিয়েছি। এ অবস্থা তো চলতে পারে না। শাসনতন্ত্র তো রচনা করতে হবে। একটা ছোটখাটো পরিষদ গঠন করে দেওয়া যায়। যারা শাসনতন্ত্র রচনা করতে পারবেন। তুমি সোহরাওয়ার্দীকে চিঠি লিখে বলো, তাড়াতাড়ি যেন চলে আসে।’
‘আমি লিখব। আপনিও লিখুন। তবে, একটা কথা। সোহরাওয়ার্দী কিন্তু ষড়যন্ত্র জিনিসটা পছন্দও করেন না, নিজেও ঘোঁট পাকাতে জানেন না। আপনার এখানে এসে এইসব প্যাঁচঘোচের মধ্যে পড়ে না আবার নাজেহাল হন।’
‘তওবা তওবা। আমার এখানে কোনো ষড়যন্ত্র নাই।’
৫৮.
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অজিত গুহর পাঠশালায় এক নতুন ছাত্র এসেছেন। তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ভালোবাসেন কবিতা। রবীন্দ্রনাথের কবিতা, কাজী নজরুলের কবিতা তাঁর কণ্ঠস্থ। অজিত গুহ তাঁকে কালিদাস পড়ে শোনাচ্ছেন।
অজিত গুহ এই ছাত্রকে শুধু যে পাঠদান করেন, তা নয়, খাদ্যও সরবরাহ করেন।
অজিত গুহ আগের মতোই রান্নাবান্না করছেন জেলখানার ভেতরে। বন্দী যাঁরা আছেন এখানে, ইয়ার মোহাম্মদ খান, দেওয়ান মাহবুব আলী, বিজয় চ্যাটার্জি, মোহাম্মদ তোয়াহা—সবাই এক ওয়ার্ডেই থাকেন। অজিত গুহর রান্না করা খাবার খান। মুনীর চৌধুরী এপ্রিলেই মুক্তি পেয়ে গেছেন, যুক্তফ্রন্টের স্বল্পায়ু শাসনকালে।
অজিত গুহও মুক্তি পেলেন।
ফজলুল করিমও।
এবার রান্নার ভার নিলেন মোহাম্মদ তোয়াহা।
তাঁর রান্না আগের মতো ভালো হয় না। মুজিব বলেন, ‘আমাদের আগের বাবুর্চিই ভালো ছিল।’
মোহাম্মদ তোয়াহা রাগ করেন।
আবার তাঁকে অনুরোধ করতে হয়, ‘আরে, তোয়াহার রান্নার মতো এত ভালো কেউ রাঁধতে পারে নাকি?”
তিনি আবার রাঁধতে বসেন। মুজিব আর কোরবান আলী তাঁর রান্নার আশপাশে ঘুরঘুর করেন। যা পাওয়া যায়, তাই তো লাভ! কিন্তু কোরবান আলীর শরীরের ধারণক্ষমতা বেশি। এতটুকুন খাবারে তাঁর পোষায় না। তিনি একটু কষ্টই পান। কোরবান আলীর মুক্তির আদেশ এল। কোরবান সবার কাছ থেকে বিদায়-আদায় নিয়ে মালপত্র কাঁধে তুলে চললেন জেলগেটে।
একটু পরে কোরবান ফিরে এলেন। ভীষণ রেগে আছেন তিনি। বললেন, ‘আরে আমারে গেটে নিয়া যায়া আবার গ্রেপ্তার করল। তারপর বলে ছেড়ে দিব, যদি বন্ড সই করেন। আমি কি সেই রকম, যে বন্ড সই করে মুক্তি নেব?’ সবার কাছ থেকে বিদায়-আদায় নিয়ে গেছেন, বেচারা! আবার তাঁকে ফিরে আসতে হলো। তিনি খুব কষ্ট পেয়েছেন।
মুজিব ডাকলেন এক জেলকর্তাকে। ‘শোনেন, এর পরে যদি কাউকে বন্ড সই দিয়ে মুক্তি নিতে হয়, এটা আগেই বলে দিবেন। অন্য মামলা থাকলেও আগেই বলে দেবেন। মালপত্র নিয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসা বড় অবমাননাকর। রাজনৈতিক বন্দীদের মধ্যে তো কেউ দরখাস্ত করে নাই যে আমি বন্ড সই করব, আমাকে মুক্তি দেন। আরেকবার যদি এই কাণ্ড ঘটতে দেখি, জেলে ভীষণ গন্ডগোল হবে, বলে দিলাম।’
ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের কর্মচারী এসেছেন। তিনি কিছু বলেন না। মুজিবের সামনে শুধু হাত কচলান। মুজিব খেপে গেলেন। ‘শোনেন, বন্ড নিতে এসেছেন তো। যান। অযথা ঘোরাঘুরি করার দরকার নাই। আপনার সরকারকে বলে দেন, শেখ মুজিবর বলে দিছে, সরকারকে বন্ড দিতে হবে। ভবিষ্যতে এই রকম অন্যায় যেন আর না করে আর বিনা বিচারে যেন কাউকে আটক করে না রাখে।’ কর্মচারীটি হেসে ফেললেন। বললেন, ‘স্যার, আমি কি আপনাকে বন্ড দিতে বলেছি?’
.
শেখ মুজিবুর রহমান চিঠি লিখলেন স্বরাষ্ট্র বিভাগকে :
‘আমাকে কেন ডিটেনশন দেওয়া হয়েছে, তার ব্যাখ্যা আমি পেয়েছি। আপনারা যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং এর মধ্যে এক ফোঁটা সত্যতা নাই। আমি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য। এইটা একটা সাংবিধানিকভাবে গঠিত বিরোধী দল।’
জেলপুলিশের কর্মকর্তা দেখা করলেন মুজিবের সঙ্গে। মুজিবকে বললেন, ‘শেখ সাহেব, আপনার বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ আছে। তা হলো, আপনার সঙ্গে কমিউনিস্টদের যোগাযোগ আছে। এই কারণে আপনাকে ছাড়া হচ্ছে না।’
মুজিব বললেন, ‘শোনেন। আপনাদের পাকিস্তানের বড়লাটসাহেবও আমাকে এই কথা বলেছিলেন। মুজিব, তুমি নাকি কমিউনিস্ট। আমি তাঁকে যা বলেছিলাম, আপনাকেও তা-ই বলি। আমার নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। উনি একজন সত্যিকারের গণতন্ত্রী। আমিও তাঁর মতো শুধু গণতন্ত্রেই বিশ্বাস করি। আওয়ামী মুসলিম লীগ ছাড়া আর কোনো পার্টির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নাই। ছিল না।’
‘আচ্ছা বলেন তো, পূর্ব পাকিস্তানে যে ৯২/ক জারি করা হলো। এটা নিয়ে আপনার অভিমত কী?’
‘এই প্রশ্ন করবেন না। এটা আমার জন্য খুব একটা বেদনার বিষয়। এটা আমাকে রাতারাতি মন্ত্রী থেকে নিরাপত্তাবন্দীতে পরিণত করেছে।’
‘আপনি যদি বন্ড সই দেন, তাহলে আপনাকে মুক্তি দেওয়ার কথা ভাবা যায়।’
‘শেখ মুজিবর রহমান জীবন থাকতেও বন্ড সই দিয়ে মুক্তি নিবে না। আপনার সরকারকে বলে দেন, অন্যায় করা থেকে বিরত থাকতে যেন বন্ড দেয়।’
.
জেলপুলিশের কর্তা তাঁর রিপোর্টে লিখলেন, ‘তাঁর মনোভাব দৃঢ় এবং অপরিবর্তিত। তিনি শর্তসাপেক্ষ মুক্তির বিরোধী।’
৫৯.
ব্যাঙ্গমা বলল, ‘বড়লাট গোলাম মোহাম্মদের শরীরটা ভালা না, তার কথা যায় জড়ায়া, কিন্তু দাবার চাল তিনি কম চালতে পারেন না
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘ঠিকই কইছ। তিনি তো সবাইরে ঘোল খাওয়ায়া ছাড়তেছেন। আতাউর রহমানরে পাঠাইলেন সোহরাওয়ার্দীর কাছে।। সোহরাওয়ার্দীরে ডাইকা আনতে চান। তিনি সোহরাওয়ার্দীরে কইবেন, আপনেরে প্রধানমন্ত্রী করুম। আহেন।’
ব্যাঙ্গমা বলল, ‘আর আতাউর রহমান খানরে কইবেন, আপনেরে পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী বানামু, আহেন মিয়া, ফজলুল হকের উপরে আমার রাগ। আপনের উপরে তো না। আপনি যুক্তফ্রন্টের পার্লামেন্টারি বোর্ডের সভাপতি হন।’
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘আর ফজলুল হকরে খবর দিবেন, আপনেই তো পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী হইবেন। আপনেরেই তো আমি শ্রদ্ধা করি। আওয়ামী লীগরে বাদ দেন।’
ব্যাঙ্গমা বললেন, ‘গোলাম মোহাম্মদ বললেন, আমি ঢাকা আসতাছি। ৯২/ক তুইলা দিব। পূর্ব পাকিস্তানে নতুন মন্ত্রিসভা হইব। কারে যে প্রধানমন্ত্রী হইতে কই। আতাউর রহমান সাব, মনে হয়, আপনেরেই ডাকুম। আবার ফজলুল হকরে কন, হক সাব, আপনে ছাড়া আর কে হবেন প্রধানমন্ত্রী। খেলা জইমা উঠল।’