উষার দুয়ারে – ৬০
৬০.
কার্জন হল প্রাঙ্গণকে সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে। পাশেই বোটানিক্যাল গার্ডেন, সেখানে গোলাপ ফুটে আছে সারি সারি। বড়লাট গোলাম মোহাম্মদ এখানেই চায়ের নেমন্তন্ন জানিয়েছেন সমস্ত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি আর পার্লামেন্ট মেম্বারদের। আর সবার জন্য চার-পায়া টিংটিঙে চেয়ার। শুধু একটা তিন আসনবিশিষ্ট শুভ্র সোফা ঈষৎ উঁচুতে রাখা। তার মধ্যখানে বসলেন বড়লাট। এক পাশে এ কে ফজলুল হক। আরেক পাশে আতাউর রহমান খান।
এঁরা দুজন এয়ারপোর্টে ছুটে গিয়েছিলেন বড় বড় ফুলের মালা নিয়ে। কে বড়লাটের গলায় আগে মালা পরাবেন, এই নিয়ে দৌড় প্রতিযোগিতা। আতাউর রহমান খানের বয়স ৪৭, আর এ কে ফজলুল হকের ৮১। দৌড় প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করলেন আতাউর রহমান। তবে মালার ওজন, দৈর্ঘ্য ও সৌন্দর্যে জয়লাভ করলেন ফজলুল হক।
গোলাম মোহাম্মদ তাঁর বাঁকা ঠোঁটে মৃদু মৃদু হাসলেন।
.
এখন কার্জন হলের এই চা-চক্রে এই সাদা সোফায় উপবিষ্ট বড়লাট গোলাম মোহাম্মদের ওপরে শ দুয়েক মানুষের শ চারেক চোখ নিবিষ্ট। গোলাম মোহাম্মদ কোন দিকে ঝোঁকেন! তিনি ডান দিকে ঝুঁকলেন। মৃদু হাসলেন। ফজলুল হক তাকে কী যেন বলছেন। গোলামের ঠোঁটও নড়ে উঠল। তিনিও কী যেন বলছেন।
কৃষক শ্রমিক পার্টির সবার মনে আশা, মুখে হাসি ফুটে উঠল, যাক, শেরেবাংলাই হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী।
খানিক পরে গোলাম ঝুঁকে পড়লেন বাঁ দিকে। আতাউর রহমান খানের কানে কানে কী যেন বললেন। আতাউর রহমান খানও জবাব দিলেন তাঁর কথার।
আওয়ামী মুসলিম লীগারদের মনে আশার সঞ্চার হলো। খেলা ১-১ ড্র। আরেকটা গোল করতে পারলেই…
চা-চক্র শেষ হয়ে গেল। কে হবেন পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী, তা অনিষ্পন্ন রেখে বড়লাট সহকারীদের ঘাড়ে হাত রেখে গাড়িতে উঠলেন। মোটামুটি তাঁকে কোলে করেই তাঁরা গাড়িতে তুলে দিল।
ফজলুল হকও একজনের কাঁধে হাত রেখে উঠে পড়লেন তাঁর কালো গাড়িতে।
.
ওই রাতে ফজলুল হক গেলেন প্রবীণ কংগ্রেস নেতা, কেন্দ্রীয় গণপরিষদ সদস্য শ্রীশ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে, কারণ র্যাংকিন স্ট্রিটের এই বাড়িতেই ফজলুল হকের চিকিৎসক ডা. এম এন নন্দীও থাকেন। ডাক্তারের কাছেই এসেছেন ফজলুল হক। শুনে শ্রীশ তাঁকে ডেকে নিলেন নিজের ঘরে। বললেন, ‘হক রে, গোলাম তোকে কানে কানে কী বলল রে?’
ফজলুল হক গোলাম মোহাম্মদের বাচনভঙ্গি নকল করে বললেন, ‘ও তো একতা অথব্বো, ওর কথা কি বোথা দায়?’ (ও তো একটা অথর্ব ওর কথা কি বোঝা যায়)
শ্রীশ বললেন, ‘না বুঝলে কাত হয়ে উত্তর দিলি যে!’
‘ও যেমন করেছে। আমিও তেমন করেছি। ও আমার কথা বুঝে নাই। আমিও ওর কথা বুঝি নাই।’
উপস্থিত সবাই দুই বৃদ্ধের কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন।
৬১.
হাসিনা আর কামাল ঘুমিয়ে আছে জাহাজের কেবিনে। জাহাজ ছেড়েছে রাতে, বাদামতলী ঘাট থেকে। রেনুর কোলে ঘুমুচ্ছে কয়েক মাস বয়েসী জামাল।
রেনুরও তন্দ্রামতো এসেছে। তবু কোথায় এলাম, কী বৃত্তান্ত, বোঝার জন্য কেবিনের জানালা খুলে তিনি একবার উঁকি দিলেন। বাইরে অন্ধকার নদী। জেলে নৌকার আলো জোনাকির মতো জ্বলছে। লঞ্চ, জাহাজ চলাচল করছে। হইচইও হচ্ছে। বোধ করি, জাহাজ এসে নারায়ণগঞ্জ ঘাটে থামল।
জাহাজের বারান্দার আলো কিছু পড়েছে নদীর জলে। কালো কালো ঢেউয়ের অবিরাম ওঠানামা দেখা যাচ্ছে। খুব ঠান্ডা। রেনু জানালাটা বন্ধ করে দিলেন।
রেনু যাচ্ছেন টুঙ্গিপাড়া। তাঁর কাছে টেলিগ্রাম এসেছে। শেখ লুৎফর রহমান সাহেব গুরুতর অসুস্থ।
তিনি তখনই মনস্থির করে ফেললেন, টুঙ্গিপাড়া যাবেন।
তবে যাবার আগে সরকারের কাছে একটা আবেদন করলেন। তাঁর কারাবন্দী স্বামীকে কি সরকার মুক্তি দিতে পারে না? মুজিব কি তাঁর অসুস্থ পিতাকে দেখতে পারবেন না?
এরই মধ্যে সোহরাওয়ার্দী সাহেব করাচি ফিরে এসেছেন। আর তিনি এখন কেন্দ্রে আইনমন্ত্রী। রেনু কারাবন্দী মুজিবকে বলেছিলেন, সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে অভিনন্দন জানিয়ে একটা টেলিগ্রাম পাঠাতে। মুজিব বলেছেন, ‘না, টেলিগ্রাম করব না। আমার দরকার নাই। ‘
রেনু খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আব্বার শরীরটা না জানি এখন কেমন? মুজিব তো মুক্তি পেল না। এখন আব্বার যদি কিছু হয়ে যায়!
হঠাৎই কেবিনের দরজায় ঠকঠক আওয়াজ। কে এত রাতে তাঁর কেবিনের দরজায় আঘাত করছে? বাচ্চারা ঘুমিয়ে আছে। রাত বাজে ১১টারও বেশি। খাওয়াদাওয়া হয়ে গেছে, লঞ্চের পরিচারককে খাবারের দাম তিনি দিয়েও দিয়েছেন।
রেনুর বুকটা একটু কেঁপে উঠল। তিনি এক হাতে জামালকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে আরেক হাতে কেবিনের ছিটকিনি খুললেন।
খুলে যা দেখলেন, তাতে নিজের চোখকে বিশ্বাস করা কঠিন
তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন মুজিব। সঙ্গে পার্টির কর্মী নুরুদ্দীন।
রেনুর মুখে হাসি ফুটে উঠল। তিনি সহাস্য মুখে বললেন, ‘আসো।’
মুজিব নুরুদ্দীনকে অনেক ধন্যবাদ দিলেন।
নুরুদ্দীন না থাকলে তো আজকে তিনি নিজের বাসাও খুঁজে পেতেন না। আর রেনুর সঙ্গে একই জাহাজে বাড়ি ফিরতে পারতেন না।
রাত সাড়ে সাতটার সময় জেলখানায় সংবাদ এল, শেখ মুজিবের মুক্তির আদেশ এসে গেছে। নয়টার সময় মুজিবকে ছেড়ে দেওয়া হলো। তিনি সহবন্দীদের ফেলে রেখে স্বার্থপরের মতো কারাগারের বাইরে থাকবেন, এটা ভাবতেই তার মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল। তিনি বিদায়ের সময় ইয়ার মোহাম্মদ খানকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘হয় তোমরা মুক্তি পাবা, নাহলে আমি আবার
জেলে এসে তোমাদের সঙ্গে থাকব।
জেলগেটে এরই মধ্যে ভিড় জমে গেছে। কোত্থেকে খবর পেয়ে তাঁর বন্ধুবান্ধব ভক্তরা ফুলের মালা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁকে দেখেই তারা স্লোগান দিয়ে উঠল, “শেখ মুজিব শেখ মুজিব/ জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ। রাজবন্দীদের মুক্তি চাই, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’
মুজিব মিছিল করে বংশাল রোড ধরে এগিয়ে যাচ্ছেন।
এই সময় রায়সাহেব বাজারের আওয়ামী লীগ কর্মী নুরুদ্দীন তাঁর কাছে ছুটে এল। বলল, ‘মুজিব ভাই, আমি ভাবিকে জাহাজে তুলে দিয়ে আসতেছি। ভাবি বাদামতলী ঘাট থেকে জাহাজে উঠে গোপালগঞ্জ রওনা হইছেন। আপনি যদি এখনই রওনা হন, তাইলে নারায়ণগঞ্জ গিয়া জাহাজ ধরতে পারবেন। আপনার আব্বার শরীরটা মনে হয় বেশ খারাপ।’
বন্ধুদের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে মুজিব ছুটলেন। নাজিরাবাজারের বাসা মুজিব চেনেন না। নুরুদ্দীনই তাঁকে নিয়ে গেল পথ দেখিয়ে। বাসায় ঢুকে কিছু জিনিসপত্র রেখে, কিছু নিয়ে তাঁরা ছুটলেন নারায়ণগঞ্জ ঘাটের উদ্দেশে। ট্যাক্সি খুঁজছিলেন। একটা পাওয়া গেল।
মুজিবকে জাহাজে তুলে দিয়ে কেবিনে রেনুর হাতে তাঁকে বুঝিয়ে দিয়ে নুরুদ্দীন বিদায় নিল।
মুজিব কেবিনে ঢুকেই হাসিনা আর কামালকে ঘুম থেকে তুললেন।
হাসিনা উঠতে চায় না। চোখ রগড়ে দেখল, আব্বা। সে আব্বার কোলে উঠে গলা জড়িয়ে ধরল।
কামালেরও ঘুম ছুটে গেল কিছুক্ষণের মধ্যেই। সে বলল, ‘আব্বা, আমি কি জেলখানায়?’
.
খানিক পরে বাচ্চারা আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
মুজিব বললেন, ‘রেনু, চলো, বাইরে বসি। কত দিন বাইরের আকাশ দেখি না, খোলা প্রান্তর দেখি না। নদী দেখি না। জেলখানায় তো সন্ধ্যার পরেই তালা লাগিয়ে দেয়।’
তাঁরা দুজন বারান্দায় বসে রইলেন দুটো চেয়ারে। জাহাজ চলছে একটানা শব্দ তুলে। ওই দূরে নদীতীরে কোথাও কোথাও আলো দেখা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে মানুষের বসতির আভাস। মাঝেমধ্যে অন্য জাহাজ বা লঞ্চ চলে যাচ্ছে পাশ দিয়ে।
শীতকাল। কুয়াশা আছে। কুয়াশার ফাঁকে ফাঁকে কখনোও উঁকি দিচ্ছে তারা।
রেনু আর মুজিব পাশাপাশি বসে আছেন।
মুজিব রেনুর হাত ধরলেন। সারা রাত তারা গল্প করলেন।
এই রকম নিরিবিলি সময় কাটানো তো এই জীবনে কখনো হয়ে ওঠে নাই।
কত কথা জমে আছে দুজনের।
ভোর হচ্ছে। নদীর বুকে ভোর। দুজনেই ক্লান্ত। তারা ঘুমুতে গেলেন। সারা দিন ধরে জাহাজ চলল।
রাতের বেলা তারা নামলেন জাহাজ থেকে। এখান থেকে আরও দুই মাইল পথ নৌকায় যেতে হবে। তাঁদের নিজেদের নৌকাকে ঘাটে আসতে বলা হয় নাই। তবে শেখ মুজিব নৌকা পেয়ে গেলেন সহজেই।
টুঙ্গিপাড়া গিয়ে দেখলেন, আব্বা এখানে নাই। তাঁকে গোপালগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হয়েছে চিকিৎসার জন্য। গ্রামে ভালো ডাক্তার নাই।
রাতেই তাঁরা রওনা হলেন গোপালগঞ্জের দিকে।
গোপালগঞ্জের বাসায় তারা পৌঁছুলেন সকাল ১০টায়।
আব্বা বাসায়। তিনি আরোগ্যের দিকে। আম্মা বললেন, ‘খোকা, এখন আর কোনো দুশ্চিন্তা নাই। যে অবস্থা হয়েছিল তোমার আব্বার!’
মুজিব দেখা করলেন ডাক্তার ফরিদ আর বিজিতেন বাবুর সঙ্গে। তাঁরা বললেন, ‘আর ভয় নাই।’
বাসায় ফিরে এসে দেখলেন, রেনুর মুখটা একটু ছায়াচ্ছন্ন।
‘কী হয়েছে, রেনু?’
রেনু একটা টেলিগ্রাম এগিয়ে দিলেন। আতাউর রহমান সাহেব টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের আদেশ। মুজিবকে যেতে হবে করাচি এখনই।
মুজিব বললেন, ‘চিন্তা কোরো না। আজ রাতে যাব না। কাল রাতে রওনা হব।’
রেনু বললেন, ‘এর আগের বার জেল থেকে বের হয়ে তুমি কিছু দিন বাড়ি ছিলা। আমি ভাবলাম, আমরা কিছুদিন একসাথে থাকতে পারব। তা হলো না। অসুবিধা নাই। তুমি যাও।’
মুজিব বললেন, ‘রেনু। তোমার মতো স্ত্রী পাওয়া সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার। শামসুল হক সাহেবকে দেখো। তাঁর স্ত্রী কোথায় বিদেশে চলে গেছেন। আর ভদ্রলোক আধাপাগল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর তুমি আমার সংসার কত কষ্ট করে আগলে আছ। কোনো দিন তুমি আমাকে বাধা দাও নাই। আমি যদি দেশের জন্য সামান্য কিছু করে থাকতে পারি, তবে তা তোমার কারণেই সম্ভব হয়েছে। লোকে তো এই কথা জানবেও না।’
‘লোকের জানার দরকার কী!’ রেনু হাসলেন।
পরের দিন বিকালে গোপালগঞ্জে শেখ মুজিবের সংবর্ধনা। হঠাৎ করেই আয়োজন করা হয়েছে এই সভা। হাজার চারেক মানুষ উপস্থিত সেখানে। সভাপতিত্ব করলেন রহমত সরকার।
মুজিবের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা করার জন্য বক্তারা সরকারের সমালোচনা করলেন। আর প্রশংসা করলেন মুজিবের আত্মত্যাগের
মুজিব দাঁড়ালেন ভাষণ দিতে। তিনি বললেন, ২১ দফা বাস্তবায়নের কথা, বললেন, সংখ্যালঘুদের সমস্যার কথা।
সভা শেষে বণিক সমিতি মুজিবের যাতায়াতের খরচ বাবদ ৫০১ টাকা চাঁদা তুলল আর তা অর্পণ করল মুজিবের হাতে।
টাকা পেয়ে ভালোই হলো মুজিবের। তিনি বিমানে ঢাকা যাবেন। তাতে সময় বেঁচে যাবে। গোপালগঞ্জ থেকে খুলনা। খুলনা থেকে যশোর। যশোর থেকে বিমানে ঢাকা। ঢাকা থেকে বিমানে করাচি যাবেন। প্লেনে উঠে বসে আছেন। সঙ্গে আরও কয়েকজন নেতা। কিন্তু তিনি নিজেকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছেন না। সোহরাওয়ার্দী সাহেব মোহাম্মদ আলী বগুড়ার অধীনে আইনমন্ত্রী! এটা কোনো কথা হলো! গোলাম মোহাম্মদ যে তাঁকে ফাঁদে ফেলেছেন, এটা কি তিনি বুঝবেন না?
সোহরাওয়ার্দী সাহেব ষড়যন্ত্র বোঝেন না। ষড়যন্ত্রের রাজনীতি হলেই তিনি হেরে যান। এবারও যাবেন। মুজিব করাচিগামী বিমানে বসে সিদ্ধান্ত টেনে ফেললেন।
করাচি পৌঁছালেন রাতে। রাতের বেলায়ই যেতে পারতেন সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করতে, কিন্তু গেলেন না। কারণ খুব রাগ হচ্ছে। লিডারের সঙ্গে তিনি বেয়াদবি করে ফেলতে পারেন। রাতে ঘুমিয়ে নিতে হবে আগে হোটেলে। রাগটা যদি কিছু কমে।
পরের দিন সকালে গেলেন হোটেল মেট্রোপলে, সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করতে।
সোহরাওয়ার্দী বাইরে যাবেন। কাপড়চোপড় পরছেন। বললেন, “শুনলাম রাতে এসেছ। রাতে দেখা করতে এলে না যে?’
‘ক্লান্ত ছিলাম। আর দেখা করেই বা কী হবে? আপনি তো এখন মোহাম্মদ আলী বগুড়ার মন্ত্রী।’
‘রাগ করেছ বোধ হয়?’
‘রাগ করব কেন, স্যার? ভাবছি সারা জীবন আপনাকে নেতা মেনে ভুল করেছি কি না!’
‘বুঝেছি। অনেক কথা আছে। বিকাল তিনটায় এসো। বিস্তারিত কথা বলব।’
৬২.
ওয়াশিংটনের স্টেট ডিপার্টমেন্টের মাথা খারাপ হয়ে গেছে : ওয়ান কমিউনিস্ট ফ্রম জেইল ইলেক্টেড টু কনস্টিটুয়েন্ট অ্যাসেমব্লি। একজন কমিউনিস্ট জেলে বসে গণপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে গেছে।
এটা কী করে সম্ভব? পাকিস্তানকে প্রথম দিন থেকে বলা হচ্ছে, তুমি আমার দোস্ত, কিন্তু একটা কাজ তোমাকে করতে হবে, কমিউনিস্টদের নির্মূল করতে হবে, এ জন্য বিশেষ ধরনের কর্মসূচি নেওয়া হলো। পাকিস্তান বলে আসছে, কমিউনিস্টদের ব্যাপারে তারা ক্ষমাহীন এবং নিষ্ঠুর। আমেরিকার উদ্বেগ তো পূর্ব বাংলা নিয়ে। ওটা কমিউনিস্টদের লীলাক্ষেত্র। এটা তারা মোহাম্মদ আলীকে বুঝিয়েছে, মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জাকে বুঝিয়েছে পইপই করে। তাঁরা বলেছেন, কমিউনিস্টদেরকে কোনো দিনও তাঁরা বাড়তে দেবেন না। আমেরিকা নাম ধরে ধরে বলে দিয়েছে, ও কমিউনিস্ট, ওকে ধরো, ও কমিউনিস্ট, ওকে ক্ষমতাচ্যুত করো। এত সাবধানতা, এত সতর্কতা, এত কর্মসূচি, এত পয়সা খরচ—তার পরও জেলে বসে একটা কমিউনিস্ট গণপরিষদ সদস্য হয়ে গেল!
ওয়াশিংটন জরুরি তারবার্তা পাঠাল করাচির আমেরিকান দূতকে। কীভাবে এটা সম্ভব হলো, ব্যাখ্যা দাও। তার মানে পূর্ব বাংলার আইনসভায় অনেকেই কমিউনিস্ট। তোমরা খোঁজ রাখো না!
করাচি থেকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত কৈফিয়ত তলব করল করাচির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে। কী করো তোমরা? একটা কমিউনিস্ট ইলেক্টেড হয়ে যায়, আর তোমরা ঘোড়ার ঘাস কাটো? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখন আবার শোকজ করে ঢাকার আবু হোসেন সরকারকে। বাতাও। সরদার ফজলুল করিম তো ঢাকা জেলে ছিল। ও ছাড়া পেল কী করে?
.
সরদার ফজলুল করিম একজন ছোটখাটো মানুষ। বরিশালের কৃষকের ছেলে। লেখাপড়ায় ভালো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে অনার্স আর এমএ দুটোতেই প্রথম শ্রেণী পেয়ে শিক্ষক হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে। তখন পাকিস্তান একেবারেই শিশু, আর সরদারের বয়স ২২। দাঁত ওঠার বয়স হবার আগেই শিশু পাকিস্তান কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ঘোষণা করল সর্বাত্মক যুদ্ধ। যেখানে পারে, কমিউনিস্ট ধরে আর জেলে পোরে। ধরবে না-ই বা কেন? মহান আমেরিকার নির্দেশ এবং কর্মসূচি। কিছুদিন চাকরি করার পরেই কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশ পেলেন সর্দার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি ছাড়ো, পুলিশ তোমাকে ধরবে, জেলে পুরবে, তার আগেই চলে যাও অন্তরালে। আন্ডারগ্রাউন্ডে। মজিদ কিংবা অশোক নামের আড়ালে নিজেকে গোপনে রেখে বিভিন্ন কৃষকের বাড়িতে ভালোই তো কাটছিল সময় সরদারের। ১৯৪৯ সালে ধরা পড়লেন। ঢাকার সন্তোষ গুপ্তর বাড়িতে গোপন বৈঠক করার সময়। ঘুরলেন এ জেল ও জেল, একবার জেলে অনশন করলেন ৫৮ দিন। তারপর একসময় দেখলেন, দেশে নির্বাচন হচ্ছে। যুক্তফ্রন্ট জিতে গেল। মুসলিম লীগ ধরাশায়ী। এ কে ফজলুল হক মন্ত্রী হলেন বাংলায়, আবার ক্ষমতাচ্যুতও হলেন। কেন্দ্রে চলছে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রী হলেন মোহাম্মদ আলী বগুড়ার অধীনে। শেখ মুজিবের মুক্তির ব্যবস্থা করলেন সোহরাওয়ার্দী। মওলানা ভাসানী দেশে ফিরে এলেন।
তারপর পূর্ব বাংলায় কৃষক শ্রমিক পার্টির আবু হোসেন সরকারের প্রধানমন্ত্রিত্বে প্রাদেশিক সরকারও গঠিত হলো। তাঁরা ক্ষমতায় এসে রাজবন্দীদের মুক্তির প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে লাগলেন। শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হলো। কিস্তিতে রাজবন্দীরা মুক্তি পেতে লাগলেন।
ঢাকা জেল থেকে ফজলুল করিম মুক্তি পেলেন। সরদার প্রথম দফায় পেলেন না। এরই মধ্যে একদিন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ জেলে এসে সরদার ফজলুল করিমের কাছ থেকে নমিনেশন ফরমে সাইন নিয়ে গেলেন। গণপরিষদ সদস্য নির্বাচন হবে। সরদার ফজলুল করিমকে প্রার্থী হতে হবে। ভোটার হলেন প্রাদেশিক পরিষদের এমএলএরা।
ঢাকা জেল থেকে সরদার করিমেরও মুক্তির আদেশ এল। তিনি কারামুক্ত হলেন।
তারপর ভোট। এমএলএরা সমবেত হচ্ছেন অ্যাসেমব্লি ভবনে। প্রত্যেক সদস্যের একটা করে ভোট। সবচেয়ে বেশি ভোট পেলেন এ কে ফজলুল হক। মোট ৫০ জন সদস্য নির্বাচিত হবেন। আওয়ামী লীগ আর কৃষক শ্রমিক পার্টি এর মধ্যে আলাদা হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ পেল ১৩টা আসন, যুক্তফ্রন্ট ১৬টা। আওয়ামী লীগের এই ১৩টা আসনের মধ্যে একটা হলো সরদার ফজলুল করিমের।
প্রাদেশিক পরিষদে বেশ কয়েকজন কমিউনিস্ট সদস্য ছিলেন। হিন্দু আসনের নেতাদের মধ্যেও তাঁরা ছিলেন, যুক্তফ্রন্টের মধ্যেও ছিলেন। তাঁরা শেখ মুজিবকে ধরলেন, ‘আমরা আপনাদেরকে ভোট দেব, কিন্তু একটা আসন আমাদেরকে ছেড়ে দেন। আমরা ওই আসনে আমাদের একজন প্রার্থী দেব।’ মুজিব বললেন, ‘কে?’ তাঁরা বললেন, ‘এটা আমাদের ব্যাপার।’ শেখ মুজিব রাজি হলেন।
আর সেই আসনে জিতে গেলেন একজন সাচ্চা কমিউনিস্ট, সরদার ফজলুল করিম, যিনি কিনা দুই সপ্তাহ আগেও জেলে ছিলেন।
ওয়াশিংটনের মাথা তখন এলোমেলো হয়ে গেছে। তার মানে, প্রাদেশিক পরিষদে অনেকেই আছে কমিউনিস্ট, তা না হলে কীভাবে একজন কমিউনিস্ট জয়লাভ করে! আর জয়লাভ করল করল, সে জেলের বাইরে কেন? করাচির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পূর্ব বাংলার প্রধান মন্ত্ৰী আবু হোসেন সরকারকে কারণ দর্শাতে বলা হলো। তারা বলল, আমরা সরদার ফজলুল করিমকে মুক্তি দিইনি। আরেকজন ছিলেন, ফজলুল করিম। তাকে মুক্তি দিয়েছি। সরদার নিজের নাম গোপন করে মুক্তি নিয়েছে। দাঁড়াও তাকে গ্রেপ্তার করছি।
সরদার ফজলুল করিম পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়েছিলেন গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে অংশ নিতে। সভা হয়েছিল মারিতে। পরের বার যাওয়ার জন্য প্লেনে উঠলেন, প্লেন আর ছাড়ে না, সবাই বসে আছে প্লেনে, শেষে পুলিশ উঠল প্লেনে, বলল, ‘হু ইজ সরদার ফজলুল করিম। ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট।’ সরদার বলে উঠলেন, ‘মুজিব ভাই, আমাকে নিয়ে যাচ্ছে।’
সরদারকে আবার জেলে পোরা হলো, যেহেতু ওয়াশিংটন তা-ই চেয়েছে। শেখ মুজিব দেখলেন, সরদারকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। তিনি সিটবেল্ট খুলে উঠে পড়লেন।
সরদারকে এইভাবে ধরে নিয়ে যাওয়ার মানে কী? বিমানের আসনে বসে মুজির ভাবলেন। তেজগাঁও বিমানবন্দর স্টেশনের ওসিকে মুজিব বললেন, ‘গ্রেপ্তার করতে হলে আগে করতে পারলেন না। সরদার ভাই, আমরা অবশ্যই আপনার মুক্তির জন্য লড়াই করব। আমরা সব রাজবন্দীর মুক্তি চাই। আর নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হোক, তাই চাই।’
.
করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন বসেছে। মুজিব উঠলেন বক্তৃতা দিতে। লম্বা শেরওয়ানি পরা মুজিবকে দেখাচ্ছে অপূর্ব। তাঁর কণ্ঠে স্পষ্টতা। তবে তিনি কথা বলছেন ধীরে ধীরে। এর আগে যখন তিনি প্রথমবার পার্লামেন্টে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তখন তাতে ছিল জনসভার সুর। সোহরাওয়ার্দী তাঁকে ডেকে বললেন, ‘মুজিব তোমার বক্তৃতায় এখনো পল্টনের ধ্বনি। এখানে কথা বলবে আস্তে, অনুচ্চ স্বরে, ধীরে ধীরে, নিজের বক্তব্য স্পষ্ট করে।’
আজ তাই করবেন মুজিব।
তিনি স্পষ্ট উচ্চারণে বললেন, ‘স্যার, আপনি দেখবেন ওরা “পূর্ব বাংলা” নামের পরিবর্তে “পূর্ব পাকিস্তান” নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার দাবি জানিয়েছি, আপনারা এটাকে “বাংলা” নামে ডাকেন। “বাংলা” শব্দটার মধ্যে একটা ইতিহাস আছে, আছে এর একটা ঐতিহ্য।’
পূর্ব বাংলার বদলে তাঁর স্বদেশের নাম পাকিস্তান রাখা হোক, এট কখনোই চাননি শেখ মুজিব। কিন্তু তা-ই পাস হয়ে গেল গণপরিষদে।
কিন্তু শেখ মুজিব কোনো দিনও পূর্ব পাকিস্তান কথাটা উচ্চারণ করতে চাইতেন না। তিনি এই বদ্বীপটাকে অভিহিত করতে লাগলেন ‘বাংলা’ বলে।
৬৩.
শেখ মুজিব বাড়ি ফিরলেন ভোরের বেলা। চারদিক ফরসা হতে শুরু করেছে। দোকানপাট সব বন্ধ। আরমানিটোলার অবনীর দোকানের সামনে সিঁড়িতে শুয়ে আছে কোনো বাস্তুহারা, নাকি নৈশপ্রহরী! বটগাছের নিচে ঝরা পাতার স্তূপ। ফেলে দেওয়া খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে কুকুরের দল। হাওয়া উঠল, হেমন্তের বাতাসে রিকশারোহী শেখ মুজিবের একটুখানি আরামই বোধ হলো, শিরশিরিয়ে উঠল বটগাছের পাতা, সরসরিয়ে উঠল রাস্তায় পড়ে থাকা ঝরাপাতার দল। কাক কা-কা করতে লাগল ভোরের আগমনীর সংবাদ পেয়ে। রূপমহল সিনেমা হল থেকে তিনি ফিরছেন। ওখানে পার্টির কাউন্সিল ছিল। রিকশা এসে থামল তাঁর বাসার সামনে। বাচ্চারা সব ঘুমোচ্ছে নিশ্চয়, তিনি আস্তে আস্তে দরজায় টোকা দিলেন।
রেনু জেগেই ছিলেন। দরজা খুলে দিলেন। বললেন, ‘সারা রাত ধরে মিটিং হলো?’
মুজিব বললেন, ‘হ্যাঁ, আর বোলো না। কথা তো শেষই হয় না।
‘গরম পানি করে দিই। একেবারে গোসল করে তারপর ঘুম দাও।’ ‘সেই ভালো।’
মুজিব ঘরে গেলেন। পাশাপাশি দুটো বিছানা। একটায় শুয়ে আছে আট বছরের হাসিনা আর ছয় বছরের কামাল। পাশের বিছানাটা বড়। সেখানে শুয়ে আছে দেড় বছরের জামাল, আর ৪০ দিনের শিশু রেহানা।
জানালা দিয়ে আসছে ভোরের আলো। খুব স্নিগ্ধ আর নরম সেই আলো। শিশু চারজনকে মনে হচ্ছে স্বর্গের পারিজাত।
মুজিব গোসল সেরে এলেন। নাশতা করার জন্য বসলেন টেবিলে।
রেনু রুটি করেছেন। গৃহপরিচারিকা তাঁকে সাহায্য করছে।
এই সময় রেহানা কেঁদে উঠল। দৌড়ে গেলেন রেনু। বাচ্চাকে কোলে করে আনলেন। পিঠে চাপড় দিতেই রেহানা ফের ঘুমিয়ে পড়ল।
সায়রা খাতুন উঠে এলেন। বললেন, ‘তুমি রেহানাকে আমার কোলে দিয়ে দাও।’
রেনু বললেন, ‘লাগবে না, মা। আপনি ওজু করে নামাজ পড়ে নেন।’
সায়রা খাতুন এই বাসাতেই আছেন মাস দুয়েক। বউমার বাচ্চা হবে শুনে তিনি একা একা জাহাজে চড়ে চলে এসেছেন টুঙ্গিপাড়া থেকে। যাত্রাপথে কষ্ট হয়েছে। জাহাজের কেবিনের টিকিট ছিল, কিন্তু এক সরকারি কর্মকর্তা কেবিন দখল করে দরজা বন্ধ করে ঘুম দিয়েছিল। তিনি কী করবেন, বুঝছিলেন না। পরে নীলিমা ইব্রাহিম নামের এক শিক্ষিকা তাঁকে তাঁর কেবিনে ডেকে নেন। এইসব গল্প মুজিবকে শোনাতে পারেননি সায়রা খাতুন। ছেলে যে তাঁর বড় ব্যস্ত। তিনি বলেন, আমার পাগল ছেলে। রেনু শাশুড়ির একা একা ঢাকা আসার রোমাঞ্চকর কাহিনি সবিস্তারে শুনেছেন।
এই শাশুড়ি-বউয়ের সম্পর্কটা অন্য রকম। পিতৃমাতৃহীন রেনু যে ছোটবেলায় শাশুড়িকে বাবা ডাকতেন।
রেনু শেখ মুজিবের পাতে একটুখানি খেজুরের গুড় ভেঙে দিলেন। মুজিব রুটির সঙ্গে গুড় খেতে পছন্দ করেন।
রেনু বললেন, ‘এত কী নিয়ে আলোচনা হলো যে সারা রাত কাবার হয়ে গেল?’
মুজিব নাশতা খেতে খেতে বললেন, ‘আমাদের পার্টির একটা বড় সিদ্ধান্ত আজকে নেওয়া হয়ে গেল। আমাদের দলের নাম আর আওয়ামী মুসলিম লীগ না।’
একটু বিরতি দিয়ে মুজিব বললেন, ‘আজ থেকে আমাদের দলের নাম পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ।
‘তাই তো ছিল।’
‘না’। মুসলিম শব্দটা আমরা বাদ দিলাম।’
‘ও তাই তো!’
‘এইটা নিয়া সারা রাত তর্ক। মওলানা সাহেব চান, মুসলিম শব্দ বাদ দিতে। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের দুশ্চিন্তা, মানুষের রি-অ্যাকশন কী হবে! সালাম খানেরা বলল, মুসলিম শব্দ বাদ দিলে তোমাদেরকে আমরা বহিষ্কার করব। আমরা আওয়ামী মুসলিম লীগেই থেকে যাব। আমি এই দলকে একবার বোঝাই ওই দলকে একবার বোঝাই। দল তো সবার। দেশ তো সবার। হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সবাই এই দলে আসতে পারবে। ভোর চারটায় আলোচনা শেষ হলো। আমরা এখন থেকে আওয়ামী লীগ।’
‘কমিটি কী হলো?’
‘আগের মতোই। মওলানা সাহেব সভাপতি। খান সাহেব, মনসুর সাহেব, খয়রাত সাহেব সহসভাপতি। আমি সাধারণ সম্পাদক।’
‘তাজউদ্দীন?’
‘তাকে এবার সংস্কৃতি ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক করলাম।’
‘অলি আহাদ?’
‘যুগ্ম সম্পাদক।’
.
রেহানা ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রেনু চা করে আনলেন। মুজিব চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘গোসলটা করে আরাম লাগল। একটু ঘুমায়া নেই। কাল তো আবার কাউন্সিল শুরু হবে ১২টায়।’
‘তুমি এই ঘরে শোও। না হলে বাচ্চারা ঘুম থেকে জেগে তোমাকে জ্বালাবে। কামাল এসে তোমার ঘাড়ে চড়ে বসলে আর ঘুমাতে পারবা না।’
মুজিব শুয়ে পড়লেন। আলো আসছে জানালা গলিয়ে। রেনু জানালার পর্দা টেনে দিলেন। রাস্তায় লোকজনের চলাচলের শব্দও আসছে।
‘তুমি ঘুমাও।’ পান চিবুতে চিবুতে বললেন রেনু।
মুজিবের মনে আজ প্রশান্তি। ৩৫ বছরের জীবনে তাঁর রাজনীতির অভিজ্ঞতা কম হলো না। কিশোরবেলা থেকে শুরু। সুভাষচন্দ্র বসুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ ছিলেন। সেখান থেকে মুসলিম লীগ। তখন হিন্দু জমিদারেরা মুসলমান কৃষকদের কীভাবে শোষণ করেছে, সেসব কথা শুনতেন, পড়তেন, বলতেন। আস্তে আস্তে আবুল হাশিম সাহেবদের সংস্পর্শে এসে ইসলামের উদারতার কথা শুনলেন। অসাম্প্রদায়িকতার পথ হয়ে উঠল তাঁর পথ। সাম্প্রদায়িকতার
ভয়াবহ রূপ দেখেছেন কলকাতায়।
কমিনিস্টদের সঙ্গেও মুজিবের খাতিরের সম্পর্ক। তিনি বারবার করে বলেন, তিনি কমিউনিস্ট না। কিন্তু সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক কর্মসূচি তাঁর পছন্দ। তিনি একটা শোষণহীন সমাজের স্বপ্ন দেখেন। আর হিন্দু-মুসলিম- বৌদ্ধ-খ্রিষ্টানে পার্থক্য না করার আদর্শটা তাঁর পছন্দ।
আল্লাহ এক। সবাই তাঁরই সৃষ্টি। আল্লাহ যদি সব মানুষের জন্য চাঁদের আলো, মেঘের ছায়া, সূর্যকিরণ, বৃষ্টি সমান করে দেন, রাষ্ট্র কেন তাহলে মানুষে মানুষে পার্থক্য করবে? তা হয় না। গণতন্ত্রে সব মানুষ সমান। প্রতিটা মানুষ এক ইউনিট। প্রত্যেকের এক ভোট। রাজার ছেলের এক ভোট, নুলো ভিখিরির এক ভোট। এটাই গণতন্ত্রের মূল কথা। এখানেই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য I
মুজিবের আজ মনে পড়ছে চন্দ্র ঘোষের কথা।
ফরিদপুর জেলে গিয়ে দেখলেন, চন্দ্রবাবু ওখানে। মুজিব, চন্দ্রবাবু আর ফণীভূষণ মজুমদার একই কক্ষে থাকতেন। ফণীভূষণ মজুমদার ইংরেজ আমলে করতেন ফরোয়ার্ড ব্লক, তখন অনেক দিন জেল খেটেছেন, বিয়ে করেন নাই, পাকিস্তান আমলেও জেলখানাই তাঁর ঠিকানা।
আর বৃদ্ধ চন্দ্রবাবু। গোপালগঞ্জের দানশীল নিঃস্বার্থ সমাজসেবক। রাজনীতির সাতে-পাঁচে তিনি নাই। সাত্ত্বিক মানুষ, মহাত্মা গান্ধীর মতো বেশবাস, একটা সেলাইহীন কাপড় পরনে, আরেকটা গায়ে। জুতা-স্যান্ডেল পরবেন না, সব সময় খড়ম পায়ে দেবেন। কি শীতে, কি গ্রীষ্মে—এই তাঁর এক বেশ। গোপালগঞ্জ মহকুমায় স্কুল গড়ে দিয়েছেন অনেকগুলো। কাশিয়ানি থানার রামদিয়া গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছেন ডিগ্রি কলেজ। যেখানে খালকাটা দরকার পড়েছে, মানুষ গিয়ে তাঁকে ধরেছে, তিনি দান করেছেন, খালকাটা হয়েছে। যেখানে রাস্তা বানানো দরকার, সেখানে তিনি রাস্তা বানিয়ে দিয়েছেন। একটা মেয়েদের স্কুল তিনি করে দিয়েছেন গোপালগঞ্জে। এমন মানবদরদি দেশদরদি মানুষ কমই হয়। দেশকে ভালোবেসে পাকিস্তানে রয়ে গেছেন, ভারতে যাননি। হিন্দু-মুসলমান সবাই তাঁর ভক্ত। হিন্দুদের মধ্যে আবার তাঁর বিশেষ ভক্ত তফসিলি সম্প্রদায়ের মানুষেরা।
তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে শুধু হিন্দু হওয়ার অপরাধে। একজন সরকারি কর্তা নিজের কাজ দেখানোর জন্য তাঁর বিরুদ্ধে বানিয়ে বানিয়ে যা নয় তা বলে সরকারকে রিপোর্ট দিয়েছে। অভিযোগ হলো, চন্দ্রবাবু পাকিস্তান মানেন না, তিনি ভারতের পতাকা উড়িয়েছেন। এর চেয়ে বড় মিথ্যা কথা আর কিছুই হয় না। এই অভিযোগে চন্দ্রবাবুর সাজা হয়। কিন্তু সাজার মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও তাঁর মুক্তি আসে না। তাঁকে নিরাপত্তা আইনে আটক দেখানো হয়। শুধু হিন্দু হওয়ার অপরাধে চলছে তাঁর বিনা বিচার কারাবাস।
বছর চারেক আগের কথা। ফরিদপুর জেলে মুজিবের খুব জ্বর এল একদিন। মাথাব্যথা ভীষণ, বুকেও চাপ। দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা চন্দ্রবাবু রইলেন মুজিবের শিয়রের কাছে বসে। তাঁর মাথা টিপে দেন, তাঁকে ওষুধ খাওয়ান, পথ্য খাওয়ান, না খেতে চাইলে ধমক দেন। তিন দিন চন্দ্রবাবু একবারও বিছানায় শোন নাই, এক ফোঁটাও ঘুমান নাই। ফণীভূষণ মজুমদারও অনেক সেবাযত্ন করেছেন মুজিবের। অন্য বন্দীরাও তাঁর জন্য খেটেছেন। মুজিবের মাথায় পানি ঢেলে দিয়েছেন চন্দ্রবাবু।
মুজিব তাঁকে বলেছিলেন, ‘এত কষ্ট করবেন না। আপনারও তো বয়স হয়েছে, এই বয়সে এত কষ্ট আপনার সহ্য হবে না। একটু শোন। একটু বিশ্রাম করেন।’
চন্দ্রবাবু জবাব দিয়েছিলেন, ‘সারাটা জীবন এই কাজ করেছি। মানুষের সেবা। এখন এটা অভ্যাস হয়ে গেছে। বুড়া বয়সে আর কোনো কষ্ট পাই না।’
ডাক্তার এসে বললেন, ‘শেখ সাহেব, আপনাকে হাসপাতালে নিতে হবে।’
চন্দ্রবাবু বললেন, ‘ওষুধপথ্য লিখে দেন। ওষুধ এখানে দিয়ে যান। হাসপাতালে নিতে হবে না। ওখানে ওকে কে দেখবে?’
মুজিব এই বৃদ্ধের সেবা আর যত্নের গুণেই সুস্থ হয়ে উঠলেন।
তারপর চন্দ্রবাবু নিজেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেন। মুজিবকে নেওয়া হয়েছিল গোপালগঞ্জ, ওখানকার আদালতে তাঁর মামলার হাজিরার তারিখ ছিল। ফিরে এসে দেখেন এই অবস্থা—চন্দ্রবাবু ঘোরতর অসুস্থ। হার্নিয়া ছিল, পেটে চাপ পড়ে নাড়ি উল্টে গেছে, মুখ দিয়ে মল বেরোচ্ছে, অপারেশন করতে হবে, মারা যেতে পারেন যেকোনো মুহূর্তে।
তাঁর আত্মীয়স্বজন কেউ নাই। অপারেশনের অনুমতি কে দেবে?
চন্দ্র ঘোষ নিজেই তাঁর অনুমতিপত্রে স্বাক্ষর করে দিলেন।
চন্দ্র ঘোষকে জেল হাসপাতাল থেকে বাইরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে স্ট্রেচারে করে। সেখানে তাঁর অপারেশন হবে। জেলগেটে চন্দ্রবাবু বললেন, ‘আমার তো কেউ নাই। কেবল আছে শেখ মুজিব। সে আমার ছোট ভাইয়ের তুল্য। তাঁকে আমি একবার দেখতে চাই। জীবনে তো আর দেখা হবে না
তখন মুজিবকে নেওয়া হলো জেলের গেটে।
চন্দ্র ঘোষকে দেখে বড় মায়া হলো মুজিবের, এত শুকিয়ে গেছেন, চোখ বসে গেছে, মুখমণ্ডলে ক্লেশের চিহ্ন। চন্দ্রবাবু মুজিবকে দেখেই কেঁদে ফেললেন, বললেন, ‘আমার কোনো দুঃখ নাই। কিন্তু মরার আগে আমার একটাই দুঃখ। ওরা আমাকে সাম্প্রদায়িক বলে বদনাম দিল। কোনো দিন হিন্দু-মুসলমানকে আলাদা করে দেখি নাই, সব সময় সমান দৃষ্টিতে দেখেছি। সবাইকে বোলো আমাকে যেন ক্ষমা করে দেন। আর তোমার কাছে আমার অনুরোধ, মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখবা। মানুষে মানুষে কোনো পার্থক্য তো ভগবানও করেন নাই। আমার তো কেউ নাই। আপন ভেবে তোমাকে কথাগুলো বললাম। ভগবান তোমার মঙ্গল করুন।
তাঁর কথা শুনে উপস্থিত ডাক্তার, জেলার, ডেপুটি জেলার, সুপারিনটেনডেন্ট, গোয়েন্দা কর্মচারী সবার চোখে জল চলে এল। জেলগেটে নেমে এল বিষাদের ছায়া। মুজিবের চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে। তিনি চোখ মুছে ধরা গলায় কোনোমতে বললেন, ‘আপনি ভালো হয়ে যাবেন চন্দ্রবাবু। এত বড় ডাক্তার আপনার অপারেশন করবে। আর চিন্তা করবেন না। আমি মানুষকে মানুষ হিসাবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ। ‘
বলতে বলতে কান্নায় মুজিব নিজেই ভেঙে পড়লেন।
আজ আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক সংগঠন করা গেল। চন্দ্রবাবুর কথা আজ তাই তাঁর খুব মনে পড়ছে।
চন্দ্রবাবু সেরে উঠেছিলেন। হাসপাতালে অনেকদিন থাকতে হয়েছিল। তারপর তাঁকে এক হাতে মুক্তির আদেশ ধরিয়ে দিয়ে আরেক হাতে দেওয়া হয় আরেক হুকুম, তিনি গৃহবন্দী। তাঁর গ্রাম রামদিয়ায় তাঁকে থাকতে হবে। ম্যাজিস্ট্রেট এই আদেশ দিয়ে বললেন, ‘তবে চিকিৎসার জন্য চাইলে আপনি কলকাতা যেতে পারেন। তাতে আমাদের সরকারের কোনো আপত্তি নাই।’
চন্দ্রবাবু জেলখানায় এলেন তাঁর জিনিসপত্র নিতে। তিনি চিকিৎসার জন্য কলকাতা যাচ্ছেন। তাঁর জ্ঞাতিগোষ্ঠী সবাই ভারতে চলে গেছে। বিশেষ করে, তাঁকে গ্রেপ্তারের পরে ভয়েই দেশ ছেড়েছে অনেকে।
চন্দ্রবাবুর সঙ্গে দেখা করতে জেলগেটে গেলেন মুজিব।
চন্দ্রবাবু বললেন, ‘মুজিবর, দেশ তো ছাড়তে ইচ্ছা করে না। এখানে যে আমার নাড়িপোঁতা।
মুজিবর চোখ আবার জলে ভরে যায়।
.
আরমানিটোলার বাড়িতে তখন অনেক আলো, সেই আলোর মধ্যেই মুজিব ঘুমিয়ে পড়লেন। এক টুকরা রোদ তাঁর মুখে এসে পড়েছে, আর তাঁর চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু চিকচিক করছে।
.
দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত