উষার দুয়ারে – ৫
৫.
এইভাবে পাঁচ দিন পর তারা এসে পৌঁছেছেন টুঙ্গিপাড়ার ঘাটে।
এখন তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন তাঁর ঘরের দিকে। আঙিনার কাছাকাছি হতেই লোকজন এসে তাঁকে ঘিরে ধরল।
তাঁকে ধরে বাড়ির ভেতরে নেওয়া হলো। সাড়ে চার বছরের হাসিনা তাঁর গলা ধরে ঝুলে পড়ল। প্রথম যে কথাটা সে বলল, তা হলো, ‘আব্বা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দীদের মুক্তি চাই।’
মুজিব একটুও বিস্মিত হলেন না। কারণ একুশে ফেব্রুয়ারিতে হাসুরা ঢাকায় ছিল। ফরিদপুরের রাস্তায় একুশে ফেব্রুয়ারিতে যত মিছিল-শোভাযাত্রা হয়েছে, কারাগারের ভেতরে শুয়েই তিনি এই স্লোগান বহুবার শুনেছেন। ঢাকায় হাসিনার কানে সে এই স্লোগান যে বারবার প্রবেশ করেছে, তাতে আর সন্দেহ কী! বাচ্চারা যা শোনে, তা শিখে ফেলে দ্রুত। কামাল কিন্তু শেখ মুজিবের কাছে গেল না। দূর থেকে পিতার দিকে চেয়ে রইল। ওরা মাত্র আগের দিনই ঢাকা থেকে এসেছে। মুজিবের মা এলেন মুজিবের কাছে, তাঁকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন। তারপর একে একে সবাই চলে গেল ঘর থেকে।
ঘরে শুধু রেনু। তিনি কাঁদতে লাগলেন। ‘তোমার চিঠি এল। তুমি লিখেছ, অনশন করবা। বিদায়-আদায় নিয়েছ। তাতেই আমার মনে হলো, তুমি একটা কিছু করে ফেলবা। আমি তোমাকে দেখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কাকে বলব নিয়ে যেতে। আব্বাকে বলতে পারি না লজ্জায়। নাসের ভাই বাড়ি নাই। যখন খবর পেলাম, খবরের কাগজে লিখল তুমি অনশন শুরু করে দিয়েছ, তখন লজ্জাশরম ভুলে গিয়ে আব্বাকে বললাম। আব্বা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সোজা রওনা হয়ে গেলাম ঢাকার উদ্দেশে। আমাদের বড় নৌকায় তিনজন মাল্লা নিয়ে। কেন তুমি অনশন করতে গেছলা? এদের কি দয়ামায়া কিছু আছে? আমাদের কারও কথাও তোমাদের মনে ছিল না? কিছু একটা হলে কী হতো? আমি এই দুইটা দুধের বাচ্চা নিয়ে কীভাবে বাঁচতাম? হাসিনা-কামালের কী অবস্থা হতো? তুমি বলবা, খাওয়া-পরার তো কোনো অসুবিধা হতো না। মানুষ কি শুধু খাওয়া-পরা নিয়েই বেঁচে থাকতে চায়? আর মরে গেলে দেশের কাজই বা কী করে করতা?’
বাইরে ঝিঁঝির ডাক। দূরে হোগলা বনে শেয়াল ডাকছে। তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ডাকছে কুকুর। লন্ঠনের আলো পড়েছে বিছানায় শায়িত ও ঘুমন্ত দুই শিশু হাসিনা আর কামালের মুখে। হারিকেনের আলোয় রেনুর চোখের অশ্রু দুটো আলোর ফোঁটার মতো লাগছে।
শেখ মুজিব কিছুই বললেন না। শুধু বললেন, ‘উপায় ছিল না, রেনু।’
রেনু এমনিতে খুব চাপা স্বভাবের। আজকে তিনি কথা বলছেন। যেন তার মনের রুদ্ধ কবাট আজ খুলে গেছে। বলছে, বলুক। মনের ভার তাতে কিছুটা কমবে।
আজ সাতাশ-আটাশ মাস পর এই ঘরে তিনি শুয়েছেন। সেই পরিচিত বাড়ি, পুরোনো কামরা, পুরোনো বিছানা। কারাগারের কথা মনে পড়ছে। মুজিব বাইরে এলেন, আর তাঁর সহকর্মীরা প্রায় সবাই এখন জেলে। শুধু তাজউদ্দীন বোধ হয় গ্রেপ্তার এড়াতে পেরেছে।
কুহু কুহু একটা কোকিল ডেকে উঠল। রাতের বেলা কোকিলের ডাক।
মুজিব ধীরে ধীরে ঘুমের কোলে ঢলে পড়লেন।
৬.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমের ডালে বসে ব্যাঙ্গমা মুখ খুলল, ‘ওদিকে শেখ মুজিব কী কী করলেন, খেয়াল করলা?’
‘কী কী?’ ব্যাঙ্গমি মাথা উঁচু করে শুধায়।
‘তিনটা জিনিস তিনি করলেন। খেয়াল করো’—ব্যাঙ্গমা বলল।
‘তিনটা জিনিস, কী কী?’ ব্যাঙ্গমি জানতে চায়।
ব্যাঙ্গমা পায়ের আঙুলে গুনতে গুনতে বলল, ‘এক : শেখ মুজিব ফরিদপুর জেলে অনশন করার সময় কইলেন, মানুষ যখন মরতে শেখে, তখনই তাকে আর দাবায়া রাখা যায় না! এই কথাটা তিনি আরেকবার বলবেন আজ থাইকা ১৯ বছর পর… দুই : আর এই যে মরণরে ভয় না পাওয়া, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়া নিজের মরণরে তুচ্ছ ভাবা, এইটাই কিন্তু ওনারে শেখ মুজিব থাইকা বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু থাইকা জাতির জনক কইরা তুলব। মুজিব বারবার মৃত্যুর মুখে পড়বেন, কিন্তু মরণের ভয়ডরের ঊর্ধ্বে উঠবেন, এইটাই তাঁরে আগায়া নিতে থাকব…’
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘দুইটা হইল। আর তিন নম্বরটা?’
‘আর তিনটা নম্বরটা হইল’—ব্যাঙ্গমা বলল, ‘তুমি খেয়াল করো, মুজিবররে যখন ঢাকা জেলখানা থাইকা হঠাৎ কইরা ফরিদপুরে নিতাছে, তখন কিন্তু সরকার খুব গোপনে কাজটা করছে। তাঁর আব্বা শেখ লুৎফর রহমান সাহেব ঢাকা জেলখানার গেটে গিয়া দুই দিন বইসা থাইকাও খবর পাইতেছিলেন না, মুজিবররে কই নিছে। কিন্তু মুজিব ঠিকই তাঁর লোকজনরে খবরটা পৌঁছাইতে পারলেন যে, তাঁরে ফরিদপুরে লওয়া হইতেছে আর উনি অনশন করতে যাইতেছেন।
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘হ, খেয়াল করলাম। উনি ইচ্ছা কইরা ঢাকা জেলে বই মেইলা, কাপড় মেইলা দেরি কইরা নারায়ণগঞ্জের স্টিমার ফেইল করাইলেন, থানায় গিয়া একজন পরিচিত লোক পাইয়া পার্টির লোকদের খবর দিলেন…সকলে জাইনা গেল তিনি ফরিদপুর যাইতেছেন আর অনশন করতেছেন…কিন্তু এই ঘটনার গুরুত্ব কী?’
‘এই ঘটনার গুরুত্ব হইল, তিনি এইভাবে পার্টির কর্মীর কাছে কৌশলে খবর পাঠানোর কায়দাটাই আজ থাইকা ১৯ বছর পর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাইতে প্রয়োগ করবেন।’
‘মানে?’
‘ওই রাইতে যখন পাকিস্তানি মিলিটারি ট্যাংক কামান নিয়া আক্রমণ করল, তখন তিনি তাঁর অর্ডারটা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামে পৌঁছাইতে পারছিলেন।’
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘হ হ, তা-ই হইব। ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের ভাষণে মুজিব সেই কথাটা আবার স্মরণ করবেন।’ ‘তারা অতর্কিতে ২৫ মার্চ তারিখে আক্রমণ করল। তখন বুঝতে পারলাম যে, আমাদের সংগ্রাম শুরু হয়েছে। আমি ওয়্যারলেসে চট্টগ্রাম জানালাম বাংলাদেশ আজ থেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। এই খবর প্রত্যেককে পৌঁছিয়ে দেওয়া হোক, যাতে প্রতিটি থানায়, মহকুমায়, জেলায় প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে উঠতে পারে।’
৭.
হঠাৎ তাজউদ্দীন তাকিয়ে দেখলেন, ট্রেনের কামরায় কয়েকজন পুলিশ।
ফুলবাড়িয়া স্টেশনে ট্রেনে উঠেছেন তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি যাবেন শ্রীপুর। কয়লার ইঞ্জিন ধুকধুক করে ধোঁয়া ছাড়ছে। স্টেশনের আকাশ সেই ধোঁয়ায় ছেয়ে আছে। পুঁ করে ট্রেনের বাঁশি বেজে উঠল।
তাজউদ্দীন আহমদ একটা কাঠের বেঞ্চে বসে আছেন। ফাল্গুন মাস। মনোরম আবহাওয়া। শীত কমে এসেছে। দখিনা বাতাসও বইতে শুরু করেছে। আকাশ পরিষ্কার। মাজা কাঁসার বাসনের মতো ঝকঝক করছে রোদ। ট্রেনের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, দুপুরবেলার উজ্জ্বল রোদ পড়ে আছে পাশের রেললাইনের ওপর।
তাজউদ্দীন আহমদের মনটা নানা কারণে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে আছে। নানা ধরনের চিন্তা, গত কয়েক দিনে দ্রুত ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার স্মৃতি তাঁর মনটা আচ্ছন্ন করে রেখেছে। একুশে ফেব্রুয়ারি, বাইশে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্র-জনতার মিছিল, গুলি, লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস, শহীদ হলো কতজন, আহত হয়ে কাতরাচ্ছে কতজন, কতজনকে যে গ্রেপ্তার করা হলো, তবু রাজপথ দখল করে রাখল মানুষেরা। ধর্মঘট হলো সারা দেশে। ট্রেন বন্ধ, গাড়িঘোড়া সব বন্ধ। সেন্ট্রাল কমিটি অব অ্যাকশন আর সিভিল লিবার্টিজ কো-অর্ডিনেটিং কমিটির সভা হলো মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে। তিনি যোগ দিলেন সেসব সভায়। এক সভায় সারা দেশে দুই দিন হরতাল আহ্বান করার সিদ্ধান্ত হলো। হরতাল পালিত হয়েছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। বাস চলাচল পুরোপুরি বন্ধ ছিল নবাবপুর ও ইসলামপুরের অবাঙালিরা ছাড়া বাকি সবাই দোকানপাট বন্ধ রেখেছিল। মিছিল করার কোনো কর্মসূচি ছিল না। তাজউদ্দীন আহমদ আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করেছিলেন, ১৪৪ ধারা ভেঙে পড়ল, যেন তাসের ঘর। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় মিছিল করছে। প্রায় ১০ হাজার লোকের মিছিল রাস্তা প্রদক্ষিণ করছে। রাস্তায় মিলিটারি নামানো হয়েছিল। তারা অসহায়ভাবে তাকিয়ে আছে। জনতাও শান্তিপূর্ণ। তারা ভাঙচুর-জ্বালাও-পোড়াও করছে না। শুধু গভর্নর নুরুল আমিনের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছে। পুরো রাজপথ এখন সম্পূর্ণ জনতার নিয়ন্ত্রণে। রাতে ছিল কারফিউ। চলছে গ্রেপ্তার অভিযান। আবুল হাশিম, একুশে ফেব্রুয়ারিতে যিনি তাঁর এমএলএ পদ ত্যাগ করেছেন, সেই আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ আর মনোরঞ্জন ধর প্রমুখকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারপর পুলিশ হামলা করল ফজলুল হক হলে। ভোরবেলা। মাইক কেড়ে নিল। জগন্নাথ কলেজ ছাত্রাবাসেও ঢুকে পড়ল পুলিশ। তারা এসএম হলে ঢুকে পড়ল মাইক কেড়ে নিতে। প্রভোস্ট বাধা দিলেন। বিকেলে এই হল থেকে হাউসটিউটর-সমেত ২৩ জন ছাত্রকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হলো, শহীদ শফিউরের পিতা এবং আবুল কালাম শামসুদ্দীন সেটার উদ্বোধনও করলেন। রাতে পুলিশ এসে সেই স্তম্ভে হামলা চালাল। তারা একটা একটা করে ইট খুলে ফেলল। শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ দিল ধুলার সঙ্গে মিশিয়ে।
সরকার এই আন্দোলনকে হিন্দুস্তানের চক্রান্ত বলছে, এটাকে ধ্বংসাত্মক আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে। সরকারের মতে, এটা ভারতের অনুচর আর কমিউনিস্টদের কাজ। তার বিরুদ্ধে একটা বিবৃতি লিখেছেন তাজউদ্দীন। আতাউর রহমান খান বলেছেন আর তিনি লিখে নিয়েছেন। সেই বিবৃতি সংবাদপত্রে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন তিনি। এসএম হলে সভা হলো। সেখানেও হাজির তিনি। প্রস্তাব তুললেন, সরকারের অপপ্রচারের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। তাজউদ্দীনের সেই প্রস্তাব সভায় গৃহীত পর্যন্ত হলো। এদিকে মন্ত্রী আফজাল সাহেব একটা আপস ফর্মুলা পাঠিয়েছেন। তাজউদ্দীন কামরুদ্দীন আহমদসহ নেতাদের সঙ্গে সেই ফর্মুলা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এক দুপুরে মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে পুলিশ তল্লাশি চালাল। তন্ন তন্ন করে প্রত্যেকটা কক্ষ সার্চ করা হলো।
এখন আপাতত হরতাল কর্মসূচি নেই। যে শ্রমজীবী মানুষ হরতালে অংশ নিয়েছেন, তাঁরা বলাবলি করছেন, হরতাল স্থগিত করায় তাঁদের একটু সুবিধাই হয়েছে। তাঁদের খুব কষ্ট হচ্ছিল।
ট্রেনের কামরায় জানালার ধারে বসে আছেন তাজউদ্দীন। দ্রুত ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি তাঁর মনের মধ্যে চলচ্চিত্রের মতো একটার পর একটা ছবি হয়ে দেখা দিচ্ছে, আবার মিলিয়েও যাচ্ছে। ফেরিওয়ালার ‘ডিম ডিম’ ‘রুটি রুটি’ ‘কলা কলা’ চিৎকার তাঁর কানেই যাচ্ছে না।
হঠাৎ তাজউদ্দীন তাকিয়ে দেখলেন, ট্রেনের কামরায় কয়েকজন পুলিশ। তাদের পরনে খাকি হাফপ্যান্ট, গায়ে খাকি শার্ট। তাদের মধ্যে একজন হাবিলদার। খুব ধরপাকড় হচ্ছে চারদিকে। ছাত্রদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, শিক্ষকদেরও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আওয়ামী মুসলিম লীগের তো প্রায় সবাই হয় কারাগারে, নয়তো মাথায় হুলিয়া নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। একুশে ফেব্রুয়ারি-বাইশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনকে দমন করার জন্য সরকার মরিয়া। তারা নানা রকমের দমন-পীড়ন অভিযান চালাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি চালাচ্ছে অবশ্য মুখ। বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন পূর্ব বাংলার মানুষ করেনি, করেছে হিন্দুস্তান থেকে আসা হিন্দুরা, কলকাতা থেকে হিন্দু ছাত্ররা দলে দলে এসেছে, ধুতি খুলে তারা লুঙ্গি পরেছে, তারপর তারা যোগ দিয়েছে ভাষাসংগ্রামে, আর পুরো ব্যাপারটার পেছনে ইন্ধন জুগিয়েছে কমিউনিস্টরা—এই হলো মুসলিম লীগ সরকারের নেতাদের কথা। এসব কথা শুনলে কার না মাথা গরম হয়ে যায়!
এখন চলন্ত ট্রেনের কামরায় পুলিশ দেখে তাজউদ্দীন প্রথমে কিছুটা শঙ্কিত বোধ করলেন। কাকে গ্রেপ্তার করার জন্য বেরিয়েছে এই পুলিশের দল?
তাজউদ্দীন ভাবতে লাগলেন, পুলিশ যদি তাঁকে গ্রেপ্তার করতেই রওনা হয়ে থাকে, তাহলে তো গ্রেপ্তার এড়ানোর আর কোনোই উপায় নাই। কিন্তু তাদের মধ্যে সে রকম কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বাঙালি পুলিশ এরা। বাংলা ভাষার প্রতি তাদের মমত্ববোধ কারও চেয়ে কম হওয়ার কোনোই কারণ নাই। কাজেই এই পুলিশদের উদ্দেশেই তিনি কথা বলবেন বলে ঠিক করলেন। কথা বলবেন, রাষ্ট্রভাষা কেন বাংলা হওয়া উচিত, সেই বিষয়ে।
ঝিকির ঝিক ঝিকির ঝিক করে ট্রেন চলছে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে দুই পাশের ভবন, নোংরা বস্তি, গাছপালা, খালবিল। সব পিছিয়ে পড়ছে। আজকের দিনটায় এত আলো যে শত্রুকেও বন্ধু বলে আলিঙ্গন করা যায়।
তাজউদ্দীনের সঙ্গে উঠেছেন তাঁর এক পরিচিত যুবক, পাবুরের নেওয়াজ আলী। তিনি যাবেন রাজেন্দ্রপুর পর্যন্ত। ট্রেনেই সাধারণত তাঁর সঙ্গে দেখা হয়।
যেন তিনি নেওয়াজ আলীকে বোঝাচ্ছেন, এইভাবে কথা বলা শুরু করলেন। বললেন, ‘বলেন তো নেওয়াজ আলী, পাকিস্তানের কতজন লোক উর্দু বলে, কতজন লোক বাংলা বলে?’
‘বেশির ভাগ লোকই বাংলা বলে।’
‘তাহলে আমরা তো দাবি করতে পারতাম, বাংলাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা হোক। আর পশ্চিম পাকিস্তানের স্কুলগুলোতে বাংলা শেখানোর ক্লাস শুরু করা হোক। আমরা কি সেই দাবি করেছি?’
‘না, আমরা করিনি।’
‘আচ্ছা, তিন দিন আগে ঢাকার রাস্তায় হাজার হাজার লোক মিছিল করেছে না? ১৪৪ ধারা ভঙ্গ হয়েছে না?’
‘জি, হয়েছে।’
‘রাস্তায় মিলিটারিও তো ছিল। ছিল না?’
‘ছিল।’
‘গুলি হয়েছে?’
‘না, হয়নি।’
‘রাস্তায় কেউ কোনো গাড়ি ভেঙেছে, কেউ পুলিশ বা আর্মির ওপরে ঢিল ছুড়েছে?’
‘না, ছোড়েনি।’
‘তাহলে একুশে ফেব্রুয়ারি ছেলেরা মিছিল করবে, এটাতে বাধা দেওয়া হলো কেন? গুলি করা হলো কেন?’
‘বুঝতেছি না তাজউদ্দীন ভাই।’
‘আর সরকার যে বলছে, সব হিন্দু পায়জামা পরে কলকাতা থেকে এসে আন্দোলন করছে, সেটা কি সত্য? আপনি কি কলকাতার? আমি কি কলকাতার? যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁরা সবাই মুসলমান কি না!’
‘জি, মুসলমান।’
‘তাহলে?’
তাজউদ্দীন আহমদের কথায় যেন পুলিশের হাবিলদারের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। তিনি উঠে এই দিকেই আসছেন। সবাই স্তব্ধ। কী হয় না হয়।
ট্রেন টঙ্গী স্টেশনে থেমেছে।
হাবিলদার জানালা দিয়ে খেজুরের রস কিনলেন এক হাঁড়ি। গেলাসে ঢেলে প্রথমেই এলেন তাজউদ্দীনের কাছে। বললেন, ‘ভাই, এক গেলাস খেজুরের রস খান। আপনি খেলে খুব খুশি হব।’
তাজউদ্দীন খেজুরের রসের গেলাস হাতে নিলেন। বললেন, ‘আচ্ছা, আমরা দুজনে মিলে খাচ্ছি।’
হাবিলদার বললেন, ‘আপনি খান। ওনাকেও দেব।’
তাজউদ্দীন বুঝলেন, পুলিশের হাবিলদারও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে। এতক্ষণ তিনি যে যুক্তি দিয়েছেন, সেসব এই হাবিলদারের মনে ধরেছে। তারই পুরস্কার এই খেজুরের রস।
তাজউদ্দীন খেজুরের রসে চুমুক দিতে লাগলেন। দুপুরবেলার রস গেঁজে যাওয়ার কথা। কিন্তু মাটির কলসিতে থাকায় রসটা ভালোই আছে বলতে হবে। ট্রেন চলতে শুরু করলে একটুখানি রস ছলকে পড়ল তাজউদ্দীনের হাঁটুতে।
ট্রেন রাজেন্দ্রপুর পৌঁছালে হাবিলদার ও তার পুলিশ দল নেমে গেল। যাওয়ার আগে হাবিলদার তাজউদ্দীনের সঙ্গে করমর্দন করে বিদায় নিলেন।
তাজউদ্দীন বললেন, ‘বুঝলেন নেওয়াজ, নুরুল আমিন সরকার কত বড় ভুল করছে। তাঁর কর্মচারীরাই তো বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতে চায়। আর উনি কোন বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন!’
৮.
মমতাজ তাকিয়ে রইলেন ভিজিটরস রুমের দেয়ালের দিকে। দেয়ালে শ্যাওলা পড়ে অদ্ভুত সব দাগ পড়েছে। সেই দাগের মধ্যে তিনি কল্পনা করতে পারলেন একটা নারীমুখ। সেই নারীমুখের আরেকটু ওপরে একটা মাকড়সা নিজের বানানো সরু সুতা বেয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছে।
মন্নাফ সাহেব বললেন, ‘এটাই কি তোমার শেষ কথা?”
মমতাজ বললেন, ‘শেষ কথা কেন হবে, আমরা অন্য বিষয়ে কথা বলি। খুকু কেমন আছে। ও কি তিনের ঘরের নামতা শিখেছে?’
মন্নাফ বললেন, ‘কথা ঘুরিয়ো না। তুমি বন্ড সই দেবে না?’
মমতাজ বললেন, ‘বন্ড সই দিয়ে কেন আমাকে মুক্তি পেতে হবে? রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, এই কথা কি ভুল? যদি ভুল না হয়, তাহলে আমি বারবার বলব। এখন ওরা যদি আমাকে বলে, বন্ড দাও, লেখো, তুমি আর কোনো দিন রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই বলবে না, এটা আমি কী করে দেব। সেটা তো মিথ্যা বলা হবে।’
মন্নাফ বললেন, ‘তুমি একটা বেয়াদব মহিলা। আমি তোমার স্বামী। তুমি আমার কথা শুনছ না। তোমার একটা পাঁচ বছরের মেয়ে আছে। তার জন্যও তোমার কোনো মায়া হচ্ছে না। আমি তো সমাজে মুখ দেখাতে পারছি না। তার ওপরে আমি সরকারি চাকরি করি। তোমার জন্য আমার চাকরিটাও চলে যাচ্ছে। এখন তুমি বন্ড সই দিলে আমি বলতে পারি, ও বন্ড দিয়েছে, আর কোনো দিন অ্যান্টি স্টেট অ্যাকটিভিটিজ করবে না। তাহলে তোমারও চাকরি থাকে, আমারও চাকরি থাকে। তা না হলে তোমারও চাকরি যায়, আমারও চাকরি যায়।
মমতাজ বললেন, ‘তুমি শুধু চাকরি-চাকরি করছ কেন?’
মন্নাফের কপালে ভাঁজ। চোখে-মুখে রাগ-দুঃখ-হতাশা। ভদ্রলোক দেখতে ছোটখাটো। সাদা রঙের একটা শার্ট পরে এসেছেন, যেমন তিনি সচরাচর পরে থাকেন। তিনি হাতের আঙুল ফোটাতে ফোটাতে বললেন, ‘দেখো, তোমাকে আমি লাস্ট কথা বলছি। আর কথাটা খুবই সিরিয়াস। তুমি যদি বন্ড সই না দাও, আমি তোমাকে তালাক দেব।’
মমতাজ দেয়ালের দিকে তাকালেন আবার। মাকড়সাটা অনেক ওপরে উঠে গেছে। আর একটু আগে শ্যাওলার যে দাগটাকে তার নারীমুখ বলে মনে হচ্ছিল, সেটা আসলে একটা বিড়াল। নিচের দিকে লেজা ঝুলে আছে।
তিনি দেয়াল থেকে মুখ সরিয়ে তাঁর স্বামীর মুখের দিকে তাকালেন। তাঁর স্বামীর চোখ দুটো টিকটিকির চোখের মতো লাগছে।
এই লোকটাকে ভালোবেসে তিনি তাঁর পূর্বজনম ছেড়ে নতুন জনমে চলে এসেছেন। এখন এই লোকটাই তাঁকে ছেড়ে দিতে চাইছে।
রাগ তো তাঁরও হতে পারে। তারও তো অভিমান হতে পারে। যে লোকটা তাঁকে এত সহজেই তালাক দেওয়ার কথা বলতে পারে, মমতাজেরও তো মনে হতে পারে, তাঁকে ছেড়ে দেওয়াই উচিত।
একটা মুহূর্ত শুধু তিনি দম নিলেন, তারপর বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি যদি আমাকে তালাক দিতে চাও, দাও, তবু আমি বন্ড সই দিয়ে মুক্তি চাই না
হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন মন্নাফ, ‘তুমি তো তা-ই বলবে, আমি জানতাম, বাজে মহিলা কোথাকার। আমি জানতাম। ঠিক আছে, তালাকই দেব।’
আশপাশের ভিজিটর, প্রহরী, কারাকর্মী, পুলিশ—সবাই তটস্থ হয়ে উঠল। আরও অনেক ভিজিটরই এসেছে তাঁদের কারাবন্দী আত্মীয়স্বজনকে দেখতে। তাঁদের সবার কথা এক মুহূর্ত থেমে গেল মন্নাফের চিৎকারে।
মমতাজ চাপা গলায় বললেন, ‘গলা নামিয়ে কথা বলো।’
মন্নাফও নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। বললেন, ‘তুমি রেগে আছ। আমিও রেগে গেছি। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ডোন্ট গিভ আ প্রমিজ হোয়েন ইউ আর ইন লাভ, অ্যান্ড ডোন্ট টেক আ ডিসিশন হোয়েন ইউ আর অ্যাংরি। আমি সোমবারে আবার আসব। ওই দিন আমি তোমার কাছে ফাইনাল কথা শুনতে চাই। মনে রেখো, তুমি যদি বন্ড সই দিয়ে মুক্তি না নাও, আমি তোমাকে তালাক দেব। আমার বাড়ির সবারই সেই মত। পাড়াপড়শির গঞ্জনা আর সইতে পারছি না।’
ততক্ষণে তাঁর ‘দেখা’ বা ভিজিটরস আওয়ারও শেষ হয়ে গেছে। মেট্রন তাঁর হাত ধরে বললেন, ‘চলেন। টাইম শেষ।
মমতাজ শক্ত মুখ করে ফিরে চললেন কারাগারে।
কেন্দ্রীয় কারাগার, ঢাকা। মহিলা ওয়ার্ড। পুরোনো ভবন। সূর্যের আলো কোনো দিনও এই মহিলা ওয়ার্ডে এসে ঢোকে না। অসূর্যম্পশ্যা। মেঝে স্যাঁতসেঁতে। দেয়াল নোনা ধরা। ছাদের গা থেকে চুনবালু খসে পড়ছে, যেকোনো সময় ছাদ ভেঙে নিচের বন্দী কয়েদিদের ওপরে পড়তে পারে।
দুটো কক্ষ। তারই মধ্যে গাদাগাদি করে ৪০-৫০ জন মহিলা আসামি আর মহিলাকে থাকতে হয়। জায়গা এত কম যে কেউ ঠিকমতো শুতে পায় না। রাতে এ নিয়ে ঝগড়া-কাজিয়া লেগে যায়। তখন জমাদারনি উঠে এসে কয়েক ঘা লাগিয়ে দেয় যাঁকে খুশি তাঁকে। নানা ধরনের নারী আছেন এই ওয়ার্ডে। কেউ বা বিষ দিয়ে খুন করেছেন নিকটজনকে, কেউ বা ঘোরতর মানসিক রোগী। কেউ বা ধরা পড়েছেন অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে। কেউ বা দেহপসারিণী। একজন আছেন যক্ষ্মা রোগিণী। কেউ তাঁর সঙ্গে শুতে চায় না। পালিয়ে বিয়ে করতে গিয়ে ধরা পড়া তরুণী আছেন। লকআপের সময় এই ফিমেইল ওয়ার্ডের অবস্থা হয় নারকীয়।
এরই মধ্যে এসে পড়েন মমতাজ।
তাঁকে দেখামাত্রই কি কয়েদি, কি আসামি, কি জমাদারনি, কি মেট্রন—সবাই সমীহই করে। তাঁর কাজকর্ম করে দেওয়ার জন্য ফালতুদের কোনো আপত্তি নাই, বরং আগ্রহ আছে।
একে তো তিনি দেখতে অপরূপা। সুন্দরী বললে তাঁকে কম বলা হয়। ২৯ বছর বয়সের এই ভদ্রমহিলা কথায়-বার্তায়, চালচলনে যারপরনাই আকর্ষণীয়। তাঁর ওপর সবার শ্রদ্ধা, সমীহ ও ভালোবাসা তিনি একবারেই আকর্ষণ করেন, যখন সবাই শুনতে পায়, তিনি ভাষাসংগ্রামী। তাঁকে ধরা হয়েছে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনে নারায়ণগঞ্জ এলাকায় নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য।
দুপুরবেলা মহিলা ওয়ার্ডের আঙিনায় বসে আছেন মমতাজ। একজন সহবন্দিনী—তাঁর নাম আসফিয়া, যিনি কিনা বন্দী হয়েছেন তাঁর সতিনকে বিষ প্রয়োগে খুন করার দায়ে—মমতাজের মাথায় তেল বসিয়ে দিয়ে চিরুনি চালাচ্ছিলেন। মমতাজকে তিনি নিজের জীবনের গল্প বলছিলেন। ‘আপা, আপনে যদি দেখতেন, আমার জামাইটা কিন্তু ছয় ফুটের মতো লম্বা। আপা, আমি তো খাটো। আমারে তাঁর পাশে মানাইত না, কী কন…
মমতাজের কানে আসফিয়ার কোনো কথাই ঢুকছে না।
মন্নাফ—তাঁর স্বামী, যাঁকে ভালোবেসে তিনি কলকাতা শহর, তাঁর এত দিনের পালিত ধর্ম, সংস্কৃতি, পশ্চিম বাংলা, আত্মীয়স্বজন, বাবা-মা, ভাইবোন, সবকিছু ছেড়ে চলে এসেছেন পূর্ব বাংলায়—সেই মন্নাফ বলতে পারল তাঁকে তালাকের কথা?
কে যেন তাঁকে ডাকছে, ‘মিনু মিনু…মা।’ সকালবেলা পুজো সেরে গরদের শাড়ি পরে দোতলা থেকে মা নামছেন। তাঁর ভেজা চুল থেকে জল ঝরছে টুপটাপ। মুখে প্রসন্ন হাসি, তিনি বলছেন, ‘মিনু, প্রসাদ নিয়ে যা।’
মিনু—যার ভালো নাম কল্যাণী রায় চৌধুরী, ছিপছিপে এক কিশোরী, যে এক লাফে সিঁড়ির তিনটা ধাপ পেরুতে থাকে—দৌড়েই চলে যায় মায়ের কাছে।
কত দিন মাকে দেখি না। মমতাজ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
মন্নাফের সঙ্গে প্রথম দেখার দিনটাও কি কোনো দিন ভুলতে পারবেন মিনু ওরফে কল্যাণী ওরফে মমতাজ বেগম।
তখন মিনুর বয়স ২০ বছরের মতো। তিনি চাকরি করেন কলকাতা স্টেট অব ব্যাংক ইন্ডিয়ায়। খুব বড় ঘরের মেয়ে। জমিদার বংশ। রায় চৌধুরী পদবি। তাঁর মা শিক্ষকতা করেন। তাঁর মামা প্রমথনাথ বিশী বিখ্যাত সাহিত্যিক-নাট্যকার। বাবা জেলা জজ। বাবা রক্ষণশীল ছিলেন। মেয়েকে স্কুলে না দিয়ে প্রাইভেটে পড়ান। সেভাবেই মমতাজ ম্যাট্রিক পাস করেন। কিন্তু এর পরই তিনি বিদ্রোহ করে বসেন। কলেজে পড়বেনই। মামা প্রমথনাথ বিশী এগিয়ে আসেন ভাগনি উদ্ধারে। মিনু কলেজে ভর্তি হন। সেকালের কলেজ। যাতায়াত করা হতো কাপড় দিয়ে আবৃত গাড়িতে। বেথুন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন মিনু। তারপর যোগ দেন ব্যাংকের চাকরিতে।
একদিন তাঁর টেবিলের সামনে এসে বসেন এক ভদ্রলোক। ছোটখাটো মানুষ, সাদামাটা চেহারা। আলাদা কিছু বলে মনেই হয়নি মিনুর।
মিনু বললেন, ‘আপনাকে কীভাবে হেল্প করতে পারি।’
তিনি বললেন, ‘আমার একটা চেক বই দরকার।’ লোকটা সরাসরি তাকিয়ে আছে তাঁর চোখের দিকে। এই ব্যাপারটা বিশেষভাবে পছন্দ হয় মিনুর। ব্যাংকে একজন নারীকে কাজ করতে দেখে পুরুষগুলো সব আড়চোখে তাকায়। প্রথমে তো এমন ভঙ্গি করে যেন ভূত দেখছে। সেই তুলনায় এই ভদ্রলোক তাকাচ্ছেন সরাসরি। দেখার ইচ্ছা থাকলে পূর্ণ চোখেই দেখো।
মিনু বললেন, ‘আপনার আগের চেক বইটা এনেছেন।’
তিনি বললেন, ‘জি, এনেছি।’ তিনি একটা চেক বই বের করলেন।
মিনু সেটা হাতে নিয়ে মলাট উল্টে বললেন, সেকি, আপনার চেক বইয়ে তো এখনো অনেক পাতা আছে।
মিনু চেক বইয়ে এই অ্যাকাউন্ট হোল্ডারের নামটা দেখে নিলেন, আবদুল মন্নাফ। মুসলিম নাম, বুঝতে পারলেন মিনু ওরফে কল্যাণী
‘তাহলে টাকা তুলি।’
‘তাহলে টাকা তুলি মানে? টাকা লাগলে তুলবেন।’
‘আচ্ছা, তুলি কিছু টাকা।’ চেক বইয়ের পাতায় এক হাজার টাকা লিখে তিনি সই করলেন।
৯.
পরে মন্নাফের সঙ্গে এই নিয়ে কথা হয়েছে মিনুর। মন্নাফ আসলে কল্যাণী রায় চৌধুরী নামের এই অত্যন্ত সুন্দরী ব্যাংকারের সামনে খানিকক্ষণ বসতে চেয়েছিলেন।
আর সেটা বুঝতে পেরেছিলেন মিনু। সামনে সুন্দরী নারী থাকায় সবকিছু উল্টাপাল্টা হয়ে যাচ্ছে মন্নাফের।
মন্নাফের অ্যাকাউন্টে তখন টাকাও ছিল অনেক। কারণ তিনি চাকরি করতেন কলকাতার সিভিল সাপ্লাই অফিসে।
ব্যাংকে তাঁর কাজ থাকত প্রায়ই, কিন্তু এখন মিনুকে দেখে মন্নাফ আসা- যাওয়ার হারটা দিলেন বাড়িয়ে।
মিনুর (ওরফে কল্যাণীর ওরফে মমতাজের) সেসব দিনের কথা মনে পড়ছে। মন্নাফের জন্য তিনি স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার টেবিলে বসে কী অধীর আগ্রহেই না অপেক্ষা করতেন! তখন এই লোকটাকে দেখতে তাঁর কাছে মনে হতো দেবদূতের মতো।
তিনি এসেই তাঁর সামনে হাতের মুঠো মেলে ধরতেন, সেখানে থাকত ছোট্ট একটা চকলেট। বলতেন, ‘এটা নিন। আমার কাছে থাকলে গলে যাবে। যা গরম কলকাতায়।’
একদিন মিনু অফিস থেকে বেরোচ্ছেন। ছুটির পর। সে ছিল এক শীতের সন্ধ্যা। সেদিন কুয়াশাও পড়েছিল খুব। মিনু অফিস থেকে বেরিয়ে ট্রাম ধরবেন বলে হাঁটছিলেন। ঠিক তখনই একটা অ্যামব্যাসেডর গাড়ি এসে থামল তাঁর পাশে। মন্নাফ মাথা বাড়িয়ে বললেন, ‘মিস কল্যাণী, আপনি হাঁটছেন কেন? উঠুন। আমি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।’ এভাবে চলল কিছুদিন। তারপর রোববারে সিনেমা দেখতে যাওয়া। মিলনায়তন অন্ধকার হয়ে গেলে হাত ধরা, একটু আসনের পেছনে হাত রাখার ছলে কাঁধ স্পর্শ করা। তখন তাঁরা বুঝে ফেললেন, দুজন দুজনকে ভীষণভাবে ভালোবেসে ফেলেছেন।
অফিসে কথা হতে লাগল। ব্যাংকের ক্লায়েন্টের সঙ্গে এসব কী করছে এক লেডি অফিসার। বাড়িতে উড়ো চিঠি গেল। মন্নাফের নৈহাটির অফিসেও চিঠি আসতে ভুল করল না। মিনুর বাবা ভীষণ কড়া। একেবারে গোঁড়া বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন তা-ই। তিনি বললেন মিনুকে, ‘তোমার আর চাকরি করার দরকার নেই। তুমি আজ থেকে আর বাইরে যেতে পারবে না। কত টাকা মায়না পাও। আমার কাছ থেকে প্রতি মাসের ১ তারিখে নিয়ে নিয়ো।’
মিনু বুঝলেন, এখন রাস্তা খোলা আছে একটাই।
মন্নাফকে বিয়ে করে ফেলা। অন্য ধর্মের কেউ ধর্মান্তরিত হয়ে হিন্দু হতে পারে না। কাজেই তাকেই স্বধর্ম ত্যাগ করতে হবে। আর ধর্ম ত্যাগ করা মানে নিজের বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন—সবাইকে চিরকালের জন্য পরিত্যাগ করা। তাঁর এক দিকে মন্নাফ, আরেক দিকে পুরো পৃথিবী। তবু তিনি মন্নাফকেই বেছে নিলেন। কলকাতা শহরের নাখুদা মসজিদের ইমামের কাছে কলেমা পড়লেন তিনি। কল্যাণী রায় চৌধুরীর নতুন নাম হলো মমতাজ বেগম।
দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। দুপুরের খাবার খাওয়া শেষ। এখন সবাইকে লকআপে ঢোকানো হবে। ৪০-৫০ জনকে ঢোকানো হবে একটা ছোট্ট ঘরে। গায়ে গা লাগিয়ে শুতে হবে সবাইকে। পা মেলে শোয়াও মুশকিল। কারণ এর পা লাগবে ওর মাথায়। মহা হইচই শুরু হয়ে গেল।
মমতাজ ঢুকলেন লকআপে। তিনি দেয়ালে পিঠ দিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে রইলেন। রাজবন্দীর মর্যাদাও তাঁকে দেওয়া হয়নি। কারণ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে মরগান কলেজের তহবিল তছরুপের। একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস উপলক্ষে তিনি যে আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন, সেই অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে আনা হয়নি। কিন্তু নারায়ণগঞ্জবাসী ঠিকই বুঝে নিয়েছে সব। তারা মমতাজ বেগমকে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য সর্বশক্তি দিয়ে আন্দোলন করেছে।
নারায়ণগঞ্জের সবাই তাঁর পাশে আছে, শুধু একজন ছাড়া। তিনি হলেন তাঁর স্বামী মন্নাফ। তাঁর জন্য তিনি কী ত্যাগ করেননি! ১৯৪৭ সালে যখন দেশ ভাগ হলো, তখন প্রশ্ন দেখা দিল, মন্নাফ কী করবেন! কলকাতা থাকবেন, নাকি চলে আসবেন পূর্ব বাংলায়?
মন্নাফ বললেন, ‘কলকাতায় আমার কে আছে? আমি তো পূর্ব বাংলাতেই যাব।’
আবদুল মন্নাফের বাবা চাকরি করতেন ময়মনসিংহে, রেল বিভাগে। রেল কলোনিতে থাকতেন তাঁরা। মন্নাফ মমতাজকে নিয়ে চলে এলেন ময়মনসিংহে। মমতাজ জানেন, এই যাওয়া মানে তাঁর শৈশবের, তাঁর কৈশোরের, তাঁর যৌবনের কলকাতা ছেড়ে চিরদিনের জন্য যাওয়া। কিন্তু তিনি একবাক্যে রাজি। তাঁর কেউ না থাকুক, মন্নাফ আছে। আর তত দিনে তাঁদের সন্তান খুকু জন্ম নিয়েছে। কয়েক মাস বয়সী খুকুকে নিয়ে তাঁরা চলে আসেন পূর্ব বাংলায়। প্রথমে ওঠেন ময়মনসিংহ রেল কলোনিতে, শ্বশুরবাড়িতে। তখন ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী কলেজে তিনি শিক্ষকতার চাকরি নেন। তারপর আসেন ঢাকায়। এ সময় মন্নাফ ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রুফ রিডারের কাজ করতেন। পত্রিকা চলে না। কাগজ কেনার টাকা নেই। মানিক মিয়া অতি কষ্টে পত্রিকা চালান। শেখ মুজিব নানা কায়দায় টাকাপয়সা জোগাড় করে দেন জেলে বসেই। ফলে আবদুল মন্নাফের আয়-রোজগার কিছু ছিল না বললেই চলে। পরে ভারত থেকে কাগজপত্র আসে, তিনি আবার সিভিল সাপ্লাই বিভাগে কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত হন। নারিন্দায় তার পোস্টিং হয়।
গত বছর মমতাজের চাকরি হয় নারায়ণগঞ্জ মর্গান হাইস্কুলে, প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে।
‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে আমি যোগ দিয়েছি প্রাণের তাগিদে।’ মমতাজ বেগম কারাগারের দেয়ালে পিঠ রেখে বিড়বিড় করেন। ‘কেউ তো আমাকে বলেনি এতে যোগ দিতে। আমার স্বামী চায়নি। কিন্তু আমার তো বিবেক আছে।’ তিনি ২১ ফেব্রুয়ারিতে মিছিলে নেতৃত্ব দেন নারায়ণগঞ্জে। তারপর খবর এল, ঢাকায় গুলি হয়েছে। পরের দিন চাষাঢ়া মাঠে বিশাল প্রতিবাদ সভায় তাঁর পা আপন-আপনি তাঁকে টেনে নিয়ে যায়। সঙ্গে যোগ দেয় স্কুলের মেয়েরা। যে শহরে প্রতিটি রিকশা, প্রতিটি ঘোড়ার গাড়ি কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়ে তাঁর ভেতরে মেয়েরা বসে থাকে, সেই শহরে মেয়েরা মিছিলে যোগ দিয়েছে। পুরুষেরাও তখন যোগ দেয় মিছিলে, জনসভায়।
‘আমি আরেকটা কাজ করেছি’, মমতাজ বিড়বিড় করেন। — আমি আদমজীর শ্রমিকদের বুঝিয়েছি, বাংলা ভাষা না থাকলে তুমি-আমি কেউ থাকব না।’ মমতাজের কথা শুনে শ্রমিকেরা বুঝ মানে। আদমজীর শ্রমিকেরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যোগ দিলে আন্দোলন এক নতুন মাত্রা লাভ করে।
মিছিলে যখন যোগ দিতেন, মমতাজের মনে হতো, তাঁর হাতটা আকাশ স্পর্শ করবে। মনে হতো, মানুষের সম্মিলিত শক্তির কাছে সবই তুচ্ছ।
নারায়ণগঞ্জের আপামর সাধারণ মানুষ তাঁর জন্য যা করেছে, সে কথা ভাবতেই গর্বে বুকটা ভরে ওঠে মমতাজের
দৈনিক আজাদ পত্রিকার কাটিংটা তিনি রেখেছেন তাঁর কাছে। সেটা মেলে ধরেন মমতাজ। এটা তিনি সৌভাগ্যক্রমে পেয়ে যান জেলখানার লাইব্রেরিতে। সেখান থেকে পাতাটা ছিঁড়ে নিয়ে আসেন তিনি
আজাদ লিখেছে :
সকালবেলা স্থানীয় পুলিশ নারায়ণগঞ্জ মর্গান বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষয়িত্রী মিসেস মমতাজ বেগমকে গ্রেফতার করিয়া মহকুমা হাকিমের আদালতে হাজির করে। সংবাদ পাইয়া একদল ছাত্র ও নাগরিক আদালতের সামনে হাজির হয়, বিনা শর্তে তাঁহার মুক্তি দাবি করিয়া ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ইত্যাদি ধ্বনি দিতে থাকে। মহকুমা হাকিম ইমতিয়াজী তখন বাহিরে আসিয়া বলেন, মমতাজ বেগমকে স্কুলের তহবিল তছরুপের দায়ে গ্রেফতার করা হইয়াছে, রাষ্ট্রভাষা- আন্দোলনের সঙ্গে তাঁহার গ্রেফতারের সম্পর্ক নাই। কিন্তু জনতা তাহা বিশ্বাস করে না, বলিতে থাকে, মমতাজ বেগম রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রধান কর্মী বলিয়াই পুলিশ তাঁহাকে গ্রেফতার করিয়াছে। সুতরাং তাঁহাকে বিনা শর্তে মুক্তি না দিলে তাহারা আদালত প্রাঙ্গণ ছাড়িয়া যাইবে না। পুলিশ মৃদু লাঠিচার্জ করিয়া জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে।
বৈকালে পুলিশ মোটরযোগে মমতাজ বেগমকে লইয়া ঢাকা রওনা হইলে চাষাঢ়া স্টেশনের কাছে জনতা বাধা দেয়। তাহাতে পুলিশ ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষ হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ করে। ফলে উভয় পক্ষে ৪৫ জন আহত হয়।
জনতা সেদিন বটগাছ কেটে কেটে এনে রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়েছিল, যাতে মমতাজ বেগমকে ঢাকায় নিতে না পারে। জনতার আক্রমণে নাকাল পুলিশ তাঁকে নিয়ে পুলিশ ফাঁড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানে বসেই তিনি এসব তথ্য জানছিলেন। দীর্ঘ ছয় মাইল রাস্তায় নাকি শত শত গাছ কেটে ফেলে রাখা হয়েছিল। মানুষ তাঁর মুক্তির জন্য যে আন্দোলন করেছে, তাঁর জন্য আহত হয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছে, তাদের অসম্মান করে তিনি কি বন্ডসই দিয়ে মুক্তি লাভ করতে পারেন?
পুলিশ শুধু তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে তা নয়, তার কয়েকজন ছাত্রীকেও গ্রেপ্তার করেছে।
মমতাজের মামলা জামিনযোগ্য।
মমতাজকে তো ছাড়া হবে না। কারণ, তাঁর জন্ম হাওড়ায়, তাঁর আদি নাম কল্যাণী রায় চৌধুরী। মুসলিম লীগ তো এটাই প্রমাণ করতে চায় যে ভাষা আন্দোলন করেছে হিন্দুরা, কলকাতা থেকে এসে।