উষার দুয়ারে – ১০
১০.
খুকুর কথা মনে পড়ছে মমতাজের। নিজের গর্ভে যাকে তিনি ধারণ করেছেন। বাচ্চাটার পাঁচ বছর হলো এই ২১ ফেব্রুয়ারিতেই। একুশে ফেব্রুয়ারিতে তার জন্মদিনে কেক কাটার জন্য তিনি বিশেষ কেকের অর্ডার দিয়ে রেখেছিলেন। মেয়েটার জন্য নতুন জামা কিনে এনে রেখেছিলেন। বেলুন কেনা হয়েছিল। পাঁচটা মোমবাতিও কেনা ছিল। বিকেলে ওর দু-চারজন বন্ধুও এসেছিল। কিন্তু মমতাজ বেগম বাড়ি ফিরেছিলেন গভীর রাতে। সারা দিন তাঁরা মিছিল করেছেন। সভা করেছেন। রাতেও তাঁর বৈঠক ছিল নারায়ণগঞ্জের শ্রমিকদের সঙ্গে। কাজেই মেয়েটা অনেক রাত পর্যন্ত মায়ের জন্য জেগে থেকে ঘুমিয়ে পড়েছিল সেদিন। গভীর রাতে বাড়ি ফিরে মন্নাফের কথার খোঁটা উপেক্ষা করে মমতাজ মেয়ের কাছে গিয়েছিলেন। তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করেছিলেন। ঢাকায় গুলি হয়েছে, ছাত্ররা শহীদ হয়েছে, এ খবর পেয়ে তিনি কিছুতেই ঘুমোতে পারছিলেন না।
এখন তাঁর খুকুর কাছে যেতে ইচ্ছা করছে। খুকুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে। খুকুকে ভাত মেখে খাওয়াতে ইচ্ছা করছে।
খুকু এসেছিল জেলখানায়। দেখা করেছে তাঁর সঙ্গে। আবার কবে আসবে খুকু?
খুকু আসে সোমবার। তার বাবার সঙ্গে। খুকুকে দেখে বুকটা যেন মোচড় দিয়ে ওঠে মমতাজের। বেচারি! মুখটা কী রকম শুকিয়ে আছে। মন্নাফ বলেন, ‘এই যে তোমার মেয়ে।’ ‘খুকু, মাকে বলো আমাদের সাথে বাড়ি ফিরতে।’
খুকু বলে, ‘মা, আমাদের সাথে বাড়ি চলো।’
মমতাজ বলেন, ‘যাব মা। যাব। তোর মা মাথা উঁচু করে বের হয়ে আসবে জেল থেকে। তোর বাবার মতো কাপুরুষের মতো চাকরি বাঁচানোর চেষ্টা করবে না।
মন্নাফ বলেন, ‘এই কি তোমার শেষ কথা?
মমতাজ বলেন, ‘আমি তো বলেছি, আমি বন্ডে সাইন করব না।’
মন্নাফ বলেন, ‘তাহলে মনে রেখো, তালাকই তুমি বেছে নিচ্ছ।’
মমতাজ বলে, ‘দুটোকে এক কোরো না।’
মন্নাফ বলে, ‘তালাক না দিলে তো আমার চাকরি থাকবে না। কাগজে- কলমে হলেও তোমাকে তালাক আমাকে দিতেই হবে।’
মমতাজ বলে, ‘তুমি যাও। কোনো কাপুরুষের সঙ্গে আমার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না
মমতাজ রাগে মেঝেতে জোরে জোরে পা ফেলে ওয়ার্ডে ফিরে এলেন। যেন সব রাগ তার এই কারাগারের মেঝের ওপর।
মন্নাফ তাঁর মেয়েকে নিয়ে চলে গেলেন।
রাতের বেলা। নারকীয় লকআপে গাদাগাদি শুয়ে আছেন মমতাজ। একজনের মাথা আরেকজনের পায়ের গুঁতোয় কাহিল। এ-কাত থেকে ও-কাত হলেই একজনের হাত-পা পড়ছে অন্যের গায়ে। মধ্যরাতে এই নিয়ে চিৎকার- চেঁচামেচি লেগেই থাকে। ঘুমভাঙা চোখ রগড়াতে রগড়াতে জমাদারনি এসে দু-চার ঘা লাগিয়ে দিয়ে সব ঠান্ডা করতে প্রয়াসী হয়। সেখানে এক ভোরে মমতাজ বেগম স্বপ্ন দেখলেন, তাঁর ছোট্ট মেয়েটি, খুকু, একটা সাদা রঙের ফ্রক পরেছে। মাথায় দুই বেণি। আর একটা সাদা ফিতা। মমতাজ বেগম কেবল মর্গান স্কুল থেকে বাসায় ফিরেছেন। মেয়েটি এসে তাঁর হাত ধরে বলল, ‘মা, আমি সাদা পরি। আমি আর এই দেশে থাকব না। পরিদের দেশে মেঘের ওপরে চলে যাব।’
‘কেন মা? তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছ কেন?’ মমতাজ বেগম হাতের ব্যাগটা টেবিলের এক কোণে রেখে মেয়েকে কোলে তুলে নেওয়ার জন্য হাত বাড়ালেন।
পাঁচ বছরের খুকু বলল, ‘তুমি ভালো না। আমি এই বাড়িতে তোমাকে ছাড়া থাকি। বাবা সারা দিন বাইরে বাইরে থাকে। আমাকে কেউ ভালোবাসে না। সারা রাত আমি ঘুমাই না। মা মা বলে কাঁদি। কিন্তু তবু তুমি আমার কাছে আসো না।’
ঠিক তখনই মমতাজের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি বিড়বিড় করতে লাগলেন, ‘মা মা, তুমি কোথায়?’ তাঁর মনে হলো, তিনি কলকাতার হাওড়ার বাড়িতে, মা শাঁখ বাজাচ্ছেন। তারপর চোখ মেলে দেখলেন, তিনি ঢাকায় কেন্দ্রীয় কারাগারের ফিমেইল ওয়ার্ডের লকআপের ভেতরে দুজন বন্দিনীর শরীরের চাপে পিষ্ট হয়ে শুয়ে আছেন।
১১.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমগাছে বসে ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি এই মমতাজ বেগমকে নিয়ে কথা বলছে।
ব্যাঙ্গমা বলল, ‘ও ব্যাঙ্গমি, হুনছ। মমতাজ বেগম তাঁর স্বামীরে কইলেনটা কী?’
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘তুমিও যদি কাপুরুষের মতন আচরণ করো, তোমারও লগে আমার একই কথা। আমি কোনো কাপুরুষের লগে কথা কমু না।’
ব্যাঙ্গমা বলল, ‘ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়া একজন নারী দুই রকম জুলুম ভোগ করতে বাধ্য হইলেন। একটা হইল সরকারের জুলুম। আরেকটা হইল পুরুষগো জুলুম। মমতাজ বেগম বন্ড দিবেন না। মুক্তি ভিক্ষা কইরা লইবেন না। অনশন করবেন। আর অনশন করলে একই অত্যাচার করব হ্যার উপরেও, যেমন করছিল মুজিবের উপরে। নল দিয়া ফোর্স ফিডিং। অনেক কষ্ট পাইবেন মহিলা। কিন্তু মাথা নত করবেন না। বছর দেড়েক পরে মুক্তি পাইবেন। তত দিনে তাঁর স্বামীর মন উইঠা গেছে। শ্বশুরবাড়িও তাঁর ওপরে নাখোশ। শাশুড়ি গঞ্জনা দেন। ননদেরা নানা কথা কয়। শেষতক মহিলা আলাদা হইয়া যাইবেন। আর স্বামীও আরেকটা বিয়া কইরা সুখে সংসার করবেন। ভাষা আন্দোলন করতে গিয়া অনেকে অনেক কিছু ত্যাগ করছেন। কিন্তু নিজের সংসারজীবন তছনছ হইয়া গেছে, এই খবর তুমি আর পাইছ?’
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘খুব খারাপ লাগে, যখন মহিলার কথা ভাবি। তিনি তো তাঁর বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, ধর্ম-দেশ সব ছাইড়া আইছিলেন তাঁর প্রেমিকের কাছে। সেই প্রেমিক তাঁরে ছাইড়া ভবিষ্যতে আরেকটা বিয়া করবেন। মহিলা থাকবেন কী নিয়া?’
‘কী নিয়া থাকবেন, কও তো?’
ব্যাঙ্গমি বলল :
সব কিছু হারাইলেও হারান নাই মান।
রাষ্ট্রভাষা তরে নারী করে আত্মদান ॥
একূল-ওকূল তার সব কূল যায়।
সব হারিয়েও নারী মাথা তুলে চায়।।
কারণ মায়ের ভাষা হারান না তিনি।
বাংলাদেশ বাংলা ভাষা তার কাছে ঋণী।।
১২.
বাহাদুর শাহ পার্কের কাছেই নাসিরউদ্দিন লেন। ১০১ নম্বর বাড়ির দোতলায় মহিউদ্দিন আহমদ শুয়ে আছেন পালঙ্কে। অনশন ধর্মঘট তাঁর শরীরে ধ্বংসচিহ্ন রেখে গেছে। তাঁর ওজন গেছে কমে। চোখ ঢুকে গেছে কোটরে। চোয়াল বসা। এটা তাঁর ভাইয়ের বাসা। ভাবি তাঁকে নানা কিছু খাইয়ে তাঁর হৃত স্বাস্থ্য ও ওজন ফেরানোর চেষ্টা করছেন। প্রথম দিন অবশ্য মহিউদ্দিন ঘোল ছাড়া কিছুই খাননি। তারপর গলা ভাত, নরম সবজি। ভাবি এখন তাঁর সামনে ধরেছেন মুরগির স্যুপের বাটি। এটা তাঁকে খেতে হবে।
কোত্থেকে কোথায় এলেন। মহিউদ্দিনের মনে পড়ে গেল ফরিদপুর কারাগারে অনশনের দিনগুলো। মুজিব আর তিনি, দুজনেই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন। আহা, কারাগার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে মুজিব তাঁকে ধরে কী কান্নাটাই না কেঁদেছিলেন! মুজিব এখন টুঙ্গিপাড়ায়, তাঁর গ্রামের বাড়িতে।
সামনে একটা বড় বাড়ি। সেখানে লোকজন আসা-যাওয়া করছে। পালঙ্কে আধা শয়ান মহিউদ্দিন সব দেখতে পাচ্ছেন। একটুখানি স্যুপ মুখে তুলে নিয়ে গামছায় মুখ মুছে মহিউদ্দিন বললেন, ‘ভাবি, ওই বাড়িটা কার। সারাক্ষণ দেখি লোকজন আসা-যাওয়া করছেই।’
ভাবি বললেন, ‘ওটা ইয়ার মোহাম্মদ খানের বাড়ি।
ইয়ার মোহাম্মদ খান আওয়ামী লীগের নেতা। মুজিবের বড় পৃষ্ঠপোষক। কারাগারে এসে মুজিবের সঙ্গে দেখা করতেন। ভাইয়ের কাছ থেকে মহিউদ্দিন জানতে পারলেন, বাড়িতে মওলানা ভাসানী এসে উঠেছেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্যই মানুষ ভিড় করে আসছে এই বাড়িতে।
মহিউদ্দিন বললেন, ‘মওলানা ভাসানী না আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি, আর ভাষাসংগ্রাম কমিটিরও সভাপতি। তাঁকে তো পুলিশ খুঁজছে। যেখানে পারছে বিরোধী নেতা-কর্মীদের পুলিশ গ্রেপ্তার করে জেলে ভরে ফেলছে। আর মওলানা আন্ডারগ্রাউন্ডে না গিয়ে এই বাড়িতে বসে লোকজনকে দেখা দিচ্ছেন। আজব তো!’
মহিউদ্দিন আহমদ আস্তে আস্তে দোতলা থেকে নামলেন। রাস্তায় রিকশা, ঘোড়াগাড়ি, মানুষের ভিড়। ভিস্তিওয়ালা পানি নিয়ে যাচ্ছে। বসন্তের সকাল। রৌদ্রোজ্জ্বল পথঘাট। আকাশ নীল। কুলফিওয়ালা ‘কুলফি চাই, কুলফি’ বলে চিৎকার করছে। মহিউদ্দিন ধীর পায়ে হেঁটে মওলানা ভাসানীর ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলেন।
মওলানা ভাসানী বসে আছেন দোতলার ঘরে। যথারীতি তাঁর মাথায় তালের আঁশ দিয়ে বানানো টুপি, তিনি বসে আছেন একটা সাদা হাফ হাতা ঢোলা গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে। মহিউদ্দিন বললেন, ‘হুজুর, আমি মহিউদ্দিন। শেখ মুজিবরের সাথে এক সেলে ছিলাম ঢাকায়। ফরিদপুরে একসাথে অনশন করেছি।’
ভাসানী বললেন, ‘তুমি ঢাকায় আইছ? মজিবর তো গোপালগঞ্জেই! নাকি?’
‘জি, হুজুর।’
‘শরীলটা এখন কেমুন?’
‘আমার শরীর! আছে আর কি। অনশনে ছিলাম বোঝেনই তো। আপনার শরীরটা কেমন?’
‘আল্লায় রাখছে। খাজা নাজিম উদ্দিন আর নুরুল আমিনের পাকিস্তানে কেমন থাকন যায়, বুঝোই তো! ৬৭ বছর বয়স! আল্লায় রাখছে আর কি! দ্যাহো না, এই যে পলায়া আছি।’
‘পলায়ে আছেন কেন?’
ভাসানী কাশি দিলেন, তারপর একটু দম নিয়ে বললেন, ‘এই মুহূর্তে গ্রেপ্তার হওন ঠিক হইব না। আন্দোলন করব কেডা? সব তো জেলে। তাই পলায়া আছি।’
মহিউদ্দিন বললেন, ‘হুজুর, এটা আপনার কেমন পালানো! আওয়ামী মুসলিম লীগের সব নেতাকে ধরেছে, ঢাকা ইউনিভার্সিটির শিক্ষক, ছাত্র, মেডিকেলের ছাত্র—যাকে পাচ্ছে তাকেই অ্যারেস্ট করছে, আপনাকেও তো ধরবে। আপনি তো প্রকাশ্যেই আছেন। আপনার সাথে দেখা করার জন্য লোকে লাইন দিচ্ছে। এইটা হুজুর আপনার কেমন আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা?”
মওলানা ভাসানীর পালানোর ব্যবস্থা হলো। পাশেই বুড়িগঙ্গা নদী। তিনি সেই নদীতে একটা নৌকা ভাড়া করে উঠে পড়লেন। সেই নৌকায় থাকা- খাওয়া, বাথরুম করারও ব্যবস্থা আছে। মাঝেমধ্যে নৌকা ঘাটে ভেড়ে। চাল- ডাল-নুন-তেল যা লাগে মাঝি কিনে আনে। রাজনৈতিক কর্মীরাও ওই নৌকাতেই তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। তারপর আবার নৌকা ভাসানো হয়।
পুলিশ তাঁর সন্ধান পাচ্ছে না। হয়রান হয়ে যাচ্ছে।
তাঁর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতারা সিদ্ধান্ত নিলেন, আওয়ামী লীগ একটা নিয়মতান্ত্রিক দল। তার নেতারা পালিয়ে থেকে আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতি করবে না। মওলানা ভাসানীকে আদালতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করতে হবে।
মওলানা ভাসানী পার্টির আদেশ মেনে নিলেন। তিনি জেলা প্রশাসক অফিসে গিয়ে দস্তুরমাফিক আত্মসমর্পণ করলেন। অতঃপর তাঁর জায়গা হলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ৫ নম্বর ওয়ার্ডে।
১৩.
শেখ মুজিবকে সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকতে হচ্ছে। ডাক্তার বলে দিয়েছেন, মুজিবকে যেন বিছানা ছেড়ে উঠতে দেওয়া না হয়। আব্বাই ডাক্তার ডেকে এনেছিলেন। তারপর সিভিল সার্জনের দেওয়া প্রেসক্রিপশন তো আছেই।
টুঙ্গিপাড়ায় পৈতৃক বাড়ির নিজের ঘরে মুজিব শুয়েই থাকেন সারাক্ষণ। রেনু পাশে বসেন একটা হাতপাখা নিয়ে। দক্ষিণের জানালাটা খোলা। সেটা দিয়ে আমের মুকুলের গন্ধ আর কোকিলের কুহুতান আসে। টুপটাপ মুকুল ঝরে পড়লে টিনের চালে তার শব্দও হয়।
সকালের নাশতা বিছানায় বসেই সেরে নিয়েছেন মুজিব। রেনু এখন তাঁর পানের কৌটা নিয়ে বসেছেন। পান সাজাবেন। হাসু আর কামালও বিছানায় আব্বার শরীর ধরে পড়ে আছে।
কামালটা হয়েছে শুকনো-পটকা। সবাই বলে মুজিবের মুখটাই নাকি তার মুখে বসানো। সে প্রথম প্রথম তার আব্বার কাছে আসতে সংকোচ বোধ করত। সে তো বলেই ফেলেছিল হাসিনাকে, ‘হাসু আপা, হাসু আপা, তোমার আব্বাকে আব্বা বলে ডাকি।’ মুজিব ছেলেটাকে কাছে টেনে নেন। কামাল আব্বার গলা জড়িয়ে ধরে বুকের সঙ্গে বুক লাগিয়ে পড়ে রইল। আড়াই বছরের কামালের চুলে মুজিব হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। সাড়ে চার বছরের হাসিনা মাথার লাল ফিতা খুলে আঙুলে পেঁচাচ্ছে। এবার সে তার আব্বার হাতের আঙুল নিয়ে ফিতায় পেঁচাতে শুরু করল।
রেনু বললেন, ‘খবরের কাগজে নাকি লিখেছে, সোহরাওয়ার্দী সাহেব বাংলা চান না। উনি নাকি বাঙালিদের উর্দু শিখতে বইলে দিয়েছেন?’
মুজিব বললেন, ‘আমিও শুনছি। আমার মনে হয় না লিডারের মতো যুক্তিবাদী লোক এই রকম কথা বলতে পারেন। পশ্চিম পাকিস্তানে বসে কী বলেছেন, না বলেছেন, আর কাগজে কী রিপোর্ট ছাপা হয়েছে, কে জানে! আমার সঙ্গে তাঁর দেখা হওয়া দরকার। এসব কথা তাঁর ক্ষতি করবে। আর তাতে আমাদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনেরও বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। ঢাকায় ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার জন্য শহীদ হয়েছে। সেই খবর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ফরিদপুরে কত বড় বড় মিছিল হয়েছে আমি জেলে বসেই শুনেছি। মেয়েরা পর্যন্ত মিছিল করেছে। মানুষ জেগে উঠেছে। আর পারবে না। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে। আর প্রতিক্রিয়াশীল চক্রও সুবিধা করতে পারবে না।
মুজিব বলছেন আর ভাবছেন সোহরাওয়ার্দীর কথা। এই মানুষটাকে তিনি খুবই ভালোবাসেন, খুবই মান্য করেন। জীবনে তিনি একবারই সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে কথা-কাটাকাটি করেছেন। কিন্তু এবার মনে হয়, একটা প্রশ্নে লিডারের অবাধ্য তাঁকে হতেই হচ্ছে। তা হলো রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে। বাঙালিরা উর্দু শিখবে, এই কথাটা তিনি বলতে পারলেন?
শেখ মুজিবের মনে পড়ল আট বছর আগের একটা দিনের কথা। কলকাতায় থিয়েটার রোডের ৪০ নম্বর বাড়ি। সোহরাওয়ার্দী সাহেব তাঁদের ডেকেছেন তাঁদের বাড়িতে। মুসলিম ছাত্রলীগের কলকাতার কর্মীদের কয়েকজন সমবেত হয়েছেন সেখানে। সামনে কুষ্টিয়ায় ছাত্রলীগের সম্মেলন। কুষ্টিয়ায় ডাকা হয়েছে, কারণ শাহ আজিজের বাড়ি কুষ্টিয়া। শেখ মুজিব ও তাঁর সহকর্মীরা সবাই আবুল হাশিমপন্থী। সোহরাওয়ার্দীকেও তাঁরা খুব পছন্দ করেন। আরেকটা দল আছে, শাহ আজিজের, যাদের নেতা আনোয়ার, যিনি কিনা হাশিম সাহেবকে দেখতেই পারেন না। যদিও আনোয়ারও সোহরাওয়ার্দীর অনুগত। তাঁরা বসে আছেন নিচতলার বৈঠকখানায়। লাল রঙের মেঝে। ছাদ অনেক উঁচুতে। বড় বড় সোফা সব এই ঘরে। সোহরাওয়ার্দী এই দুই দলের মধ্যে একটা সমঝোতার চেষ্টা করছেন। তিনি বললেন, ‘আনোয়ারকে তোমরা একটা পদ দাও।
মুজিব বললেন, ‘কখনোই হতে পারে না। সে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোটারি করেছে, ভালো কর্মীদের সে জায়গা দেয় না। কোনো হিসাবনিকাশও সে কোনো দিন দাখিল করেনি। তাকে কেন আমরা পদ দেব?’
সোহরাওয়ার্দীর পরনে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি, তিনি মুজিবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হু আর ইউ। ইউ আর নোবডি।’
মুজিব পরে আছেন একটা হাফ হাতা শার্ট, চোখে যথারীতি মোটা কালো ফ্রেমের পুরু লেন্সের চশমা, হঠাৎই রেগে গেলেন, চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘ইফ আই এম নোবডি, দেন হোয়াই হ্যাভ ইউ ইনভাইটেড মি? ইউ হ্যাভ নো রাইট টু ইনসাল্ট মি। আই উইল প্রুভ দ্যাট আই এম সামবডি। থ্যাংক ইউ স্যার। আই উইল নেভার কাম টু ইউ অ্যাগেইন।’ মুজিব উঠে পড়লেন চেয়ার ছেড়ে। হনহন করে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। বারান্দা পেরিয়ে নেমে পড়লেন লনে। তাঁর সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন তাঁর বন্ধু-সহকর্মীরা।
সোহরাওয়ার্দী তখন তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী কর্মী মাহমুদ নুরুল হুদাকে বললেন, ওকে ধরে আনো। মুজিব হাঁটছেন হনহন করে। রাগে তাঁর দুই চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসছে। হুদা ভাই দৌড়ে এসে মুজিবকে ধরে ফেললেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেবও দোতলার বারান্দা থেকে ডাকছেন, মুজিব, মুজিব, শোনো, শুনে যাও।’
বন্ধুবান্ধবেরা মুজিবকে বলতে লাগলেন, ‘শহীদ সাহেব ডাকছেন, বেয়াদবি করাটা উচিত হবে না। চলো ফিরে যাই।
মুজিব এবং বন্ধুবান্ধবেরা দোতলায় উঠলেন। সোহরাওয়ার্দী বললেন, “ঠিক আছে, তোমরা ইলেকশন করো, যে জিতবে, সেই কমিটিতে আসবে, আমার কোনো আপত্তি নেই। শুধু গোলমাল কোরো না। মুজিব, তুমি আমার সঙ্গে আসো।
শেখ মুজিবকে তিনি ডেকে নিয়ে গেলেন তাঁর ভেতরের ঘরে। মুজিবের মাথায় হাত রাখলেন। বললেন, ‘তোমাকে আমি বেশি স্নেহ করি। তুমি তো বোকা। তোমাকে আদর করি বলেই তোমাকে আমি এই কথা বলেছিলাম। অন্য কাউকে তো বলি নাই।’ মুজিবের রাগ পড়ে এল। তার পর থেকে এত দিন, প্রায় আট বছর, মুজিব সব সময়ই সোহরাওয়ার্দী সাহেবের স্নেহ পেয়ে আসছেন।
মুজিব সব সময়ই সোহরাওয়ার্দীর আদেশ-নিষেধ শুনে আসছেন। বিপদে- আপদে তাঁকেই চিঠি লেখেন, তাঁরই শরণাপন্ন হন। কিন্তু এই একটা ব্যাপারে গুরু-শিষ্যের মতদ্বৈধতা দেখা দিল। রাষ্ট্রভাষা বাংলা করা হবে কি হবে না। মুজিব ভাবেন, বাঙালিদের দাবি তো অত্যন্ত যৌক্তিক। পাকিস্তানে বাঙালিরাই সংখ্যাগুরু। তবু তারা দাবি করেছে, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হোক। উর্দুও রাষ্ট্রভাষা হবে, বাংলাও হবে। এই সোজা কথাটা খাজা নাজিম উদ্দিন আর নুরুল আমিন বুঝল না। এরা দেশ চালাবে কী করে? আজ বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জেও ছড়িয়ে পড়েছে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান। মানুষ বুঝতে পেরেছে, মুসলিম লীগ সরকার একটা জালিম সরকার। পশ্চিমারা পূর্ব বাংলার মানুষকে শাসনের নামে শোষণ করতে চায়। আজকে তাই মুজিবকে তাঁর নেতার মতের বাইরেই যেতে হবে।
কামাল মুজিবের পেটের ওপরে উঠে পড়ল। রেনু বললেন, ‘কামাল, নামো। আব্বার শরীরটা ভালো না
মুজিব বললেন, ‘থাকুক। ওর তো কোনো ওজনই নেই।
হাসিনা কামালকে দুই হাতে ধরে নামিয়ে নিল তাঁর পায়ের ওপর থেকে। বলল, ‘আসো ঘুঘু ঘুঘু খেলি।’ কামালকে পায়ের ওপরে বসিয়ে সে একবার তোলে, আরেকবার নামায় ঢেঁকির মতো। ‘ঘুঘু ঘুঘু, ছেলের ফুপু, ছেলে কই, মাছে গেছে, মাছ কই, চিলে নিয়ে গেছে, চিল কই, আড়াত বসেছে, আড়া কই, পুড়ে গেছে, ছাই কই, উড়ে গেছে…’
রেনু পান চিবোচ্ছেন। পানের গন্ধে ঘরটা ম-ম করছে।
মুজিব বললেন, ‘রেনু, শোনো ফরিদপুর জেলখানায় কার সাথে দেখা হয়েছিল!’
‘কার সাথে?’ রেনু পানের পিক পিকদানিতে ফেলে বললেন।
‘রহিম চোরের সাথে। সে কী বলে, জানো? সেই যে অনেক আগে আমাদের বাড়িতে চুরি হয়েছিল, তখন তো তুমি ছোট? তোমার মনে আছে?
‘আছে।’ হাতের চুন দেয়ালে মুছতে মুছতে রেনু বললেন।
‘কে চুরি করেছিল মনে আছে?’
‘রহিম চোরা! বাড়ি খালি কইরে নিয়ে গিয়েছিল। মনে হয়, এক শ দেড় শ ভরি শুধু সোনাই নিয়েছিল!’
‘হ্যাঁ। সেই রহিম চোরের সাথে দেখা ফরিদপুর জেলে। হাসপাতালে থাকি। হাসপাতালটা দোতলা। আমি সকালবেলা উঠে প্রথমে খানিক হাঁটাহাঁটি করলাম। তারপর বারান্দায় বসে চা খাচ্ছি। এমন সময় একজন আধা বুড়া কয়েদি আসলেন। তিনিও হাসপাতালে আছেন। এসেই মেঝেতে বসে পড়লেন আমার পাশেই। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনার বাড়ি কোথায়?” “বাড়ি গোপালগঞ্জ থানায়, ভেন্নাবাড়ি গ্রামে। নাম রহিম।” আমি বললাম, “আপনার নামই রহিম মিয়া?” সে মাথা নাড়ে। আমি বললাম, “রহিম মিয়া, আপনিই না আমাদের বাড়ি চুরি করেছিলেন?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ করছিলাম।” “আপনি সাহস করলেন কী করে? আমাদের বাড়িতে বন্দুক আছে। অনেক শরিকদের বাড়িতে বন্দুক আছে। এত বড় বাড়ি। কত লোক।” তিনি কী বললেন জানো, বললেন, “গ্রামের লোক সাথে ছিল। আপনার বাড়ির লোকও সাথে ছিল।”
রেনু বললেন, ‘কে একজন দুদিন পরে আইসে স্বীকার করেছিল না সে নৌকোয় করে চোর নিয়ে এসেছিল?’
মুজিব বললেন, ‘আমাদেরই তো এক প্রজা। কেরায়া নৌকা চালাত। দুদিন পরে এসে নিজেই বলল, সে নৌকায় করে রহিম আর তার দলকে নিয়ে আসে। আব্বা থানাপুলিশ করলেন। চুরির মাল কিছুই ধরা পড়ল না। কেস দুর্বল হয়ে গেল। সে-ও এক দারোগার জন্য। রহিম মিয়াকে না ধরলে কি আর সোনা-দানা পাওয়া যায়? আব্বা অবশ্য ওই দারোগার বিরুদ্ধে কমপ্লেইন করেছিলেন। রহিমের ইতিহাস শোনো। তিনি বললেন, “আপনাদের বাড়িতে চুরি করে যখন আমার কোনো ক্ষতি হলো না, তখন ঘোষণা দিয়ে দিলাম, লোকে বলে চোরের বাড়িতে দালান উঠে না। আমি আমার বাড়িতে দালান দিয়ে দেব। কিছুদিন পরে আরেকটা ডাকাতি করতে গেলাম বাগেরহাট। সেইখেনে গিয়ে ধরা পইড়ে গেলাম। অনেক টাকাপয়সা খরচ করে জামিন নিয়ে এলাম। তারপর উলপুর গ্রামের রায় চৌধুরীদের বাড়িতে ডাকাতি করে ফেরার পথে পুলিশ ধরে ফেলল। পুলিশ জানত, আমি ওই পথে ফিরব। তাই ওত পেতে ছিল। ফির জামিন নিলাম। তারপর আবার ডাকাতি কইরে ধরা পড়লাম। আর জামিন দিল না। সব মিইলে ১৫/১৬ বছর জেল হয়েছে। আগে আমি কোনো দিনও ধরা পড়ি নাই। আপনেদের বাড়িতে চুরি করার পর থেকেই সব জায়গায় ধরা পইড়ে গেলাম। আপনাদের বাড়ি তো আমাদের জইন্যে পুণ্যস্থান ছিল। সেইখানে হাত দিয়ে হাত জ্বইলে গেছে। আপনার মার কাছে মাফ চাইতে পারলে বোধ হয় খানিকটা প্রায়শ্চিত্ত হতো!’ আমি বললাম, “রহিম মিয়া, আমার মা আর আব্বা দুঃখ পেয়েছিলেন বেশি। কারণ আমার বিধবা বোনের গহনাই ছিল বেশি। একটা ছোট ছেলে আর একটা ছোট মেয়ে নিয়ে বোনটা আমার ১৯ বছর বয়সে বিধবা হয়েছিল।” রহিম বললেন, “আর জীবনে চুরি করব না। আপনার কিছু দরকাল হলে বলবেন। আমার গলার মাঝে খোকর আছে। তাতে সোনার গিনি রাখা আছে।” আমি বললাম, “আমার কোনো কিছুর প্রয়োজন নাই।” মনে মনে বললাম, সোনার গিনি থাকবে না। আমাদের বাড়ি থেকেই তো নিয়েছ সোয়া শত ভরি।’
বাইরে লোকজন এসে গেছে। মা এসে বললেন, ‘খোকা, তোমার সাথে দেখা করার লাইগে লোকজন এসে ভরে গেছে।
মুজিব বললেন, ‘মা, তোমার কথাই হচ্ছিল। রহিম মিয়া, ওই যে আমাদের বাড়িতে চুরি করেছিল, তার সাথে দেখা জেলখানায়। তোমার কাছে মাফ চাইতে নাকি আসবে।’
মা বললেন, ‘আমার সর্বস্ব নিয়ে গেছে। বিধবা মেয়েটার গয়না। তারে আমি মাফ করব কী করে?’
রেনু তাড়াতাড়ি উঠে মাথায় কাপড় দিয়ে বাইরে গেলেন। হাসু আর কামালও ছুটে গেল বাইরে।
সাবের মাতবর এসেছেন। তাঁর সঙ্গে আরও কয়েকজন যুবক। তাঁরা ঘরে ঢুকলেন। সাবের মাতবরকে মুজিব বললেন, ‘চাচা, উঠতে তো পারব না। শুয়ে শুয়ে সালাম দিই। বেয়াদবি নিয়েন না।’
ঘরে চেয়ার কতগুলো দেওয়াই ছিল। সাবের মাতবর বসলেন। বললেন, ‘না বাবা, তোমাকে একনজর দেখতে এসেছি। বাপ রে, তুমি তো বাপ শুকোয়ে কাঠি হয়ে গেছ। আমি তো রাতের বেলা তোমারে দেখলে ভূত ভেবে জ্ঞান হারাতাম। এত শুকোলে কেমন করে?’
‘বোঝেনই তো, খাজা নাজিম উদ্দিনের মেহমান হয়ে ছিলাম আড়াই বছর। কেমন থাকতে পারি!’ মুজিব বললেন।
সাবের মাতবর তাঁর গালের দাড়ি নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘কত কথা বইলেছিলে দেশ ভাগের আগে। বললে, পাকিস্তান হলে কত উন্নতি হবে। জনগণ সুখে থাকবে। অত্যাচার-জুলুম থাকবে না। কয়েক বছর হইয়ে গেল, দুঃখ তো জনগণের আরও বাড়ল। চালের দাম বেশি। কমার তো কোনো লক্ষণ নেই। তুমি করলে পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন, এখন তোমাকে জেলে নেয় কেন?’
মুজিব কী করে বোঝাবেন এঁদের?
তিনি নীরব হয়ে রইলেন। কথা বলতে তাঁর ইচ্ছা করছে না। সাবের মাতব্বর বললেন, ‘এখন নাকি আবার সবাইরে উর্দু শিখতি হবে। বাপ-দাদার ভাষা ছাইড়ে আবার উর্দু কই কেমনে? এইটা কেমন দেশ তোমরা আনলা?’
আস্তে আস্তে দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়তে লাগল। টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল থেকে লোকজন আসছে শেখ মুজিবকে দেখবে বলে। রেনু ব্যস্ত হয়ে পড়েন দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষগুলোকে আপ্যায়ন করানোর আয়োজন নিয়ে। পানের পসরা চলে আসে ঘরে। তাঁর রান্নাঘরের চুলায় ভাত ওঠে। ধামায় খই-মুড়ি-গুড়।
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে মুজিব জানালার পর্দা সরিয়ে দিলেন। আলো আসুক। মুজিব মানিক ভাইকে একটা চিঠি লিখলেন। এরপর তিনি একটা চিঠি লিখবেন সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে। সারা দিন এত দর্শনার্থী আসে যে চিঠিপত্র লেখার বা পড়াশোনা করার সময় পাওয়া যায় না।
টুঙ্গিপাড়া
পাটগাতী, ফরিদপুর।
২৮-০৩-৫২
আমার প্রিয় মানিক ভাই,
আপনাকে আমার আন্তরিক সালাম। আমি এইমাত্র আপনার পোস্টকার্ড পেলাম। আমি সত্যি আপনার অসুবিধা অনুধাবন করতে পারছি। আমি যখন ঢাকা রওনা হওয়ার কথা ভাবছিলাম, ঠিক তখনই আমাকে আমাশয় আক্রমণ করে বসল। আমি এখন আল্লাহর রহমতে অনেকটাই ভালো। আমার শরীরটা একটা রোগগৃহ। যা-ই হোক না কেন, আমি ১৬ তারিখে বা তার আগে অবশ্য অবশ্যই ঢাকা পৌঁছাব আমার একটা সার্বিক চিকিৎসা দরকার। আমার জন্য একটা থাকার ব্যবস্থা করবেন। যেভাবেই হোক না কেন, দয়া করে আমি না এসে পৌঁছানো পর্যন্ত কাগজটা চালিয়ে যাবেন। আমাকে অনুগ্রহ করে চিঠি লিখবেন। আতাউর রহমান সাহেবকে আমার সালাম পৌঁছে দেবেন।
আমি ওয়াদুদের অবস্থা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন, যে কিনা গ্রেপ্তারের সময় অসুস্থ ছিল। আপনি কেমন আছেন?
আপনার স্নেহের
মুজিব
চোখে চশমাটা পরে নিয়ে এরপর তিনি ইংরেজিতে লিখলেন :
টুঙ্গিপাড়া,
ডাকঘর : পাটগাতী
জেলা : ফরিদপুর
তারিখ : ২৮/৩/৫২
জনাব সোহরাওয়ার্দী সাহেব,
কারাগার থেকে মুক্তির পর আমি আপনাকে একটা চিঠি লিখেছিলাম, কিন্তু আমি এখন পর্যন্ত ‘আপনার কাছ থেকে কোনো প্রত্যুত্তর পাই নাই। আমার শরীর এখনও দুর্বল। আমি রক্ত আমাশায় ভুগছি। আমার একটা সার্বিক চিকিৎসা প্রয়োজন। এ জন্য আমি ১৬ এপ্রিল বা তার আগে ঢাকা রওনা হব। আপনি পূর্ব বাংলার অবস্থা জানেন। ক্ষমতাসীন লোকেরা জনগণকে সাংবিধানিকভাবে কাজ করতে দেবে না। তারা দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করছে। আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য আমি অধীর হয়ে আছি। আড়াই বছরের কারাবাস আমার স্বাস্থ্য ধ্বংস করে দিয়েছে। দয়া করে আমাকে মানিক ভাইয়ের ঠিকানা ৯ হাটখোলা রোড ঢাকা বরাবর চিঠি লিখবেন। অনুগ্রহ করে বন্ধু ও সহকর্মীদের আমার সালাম পৌঁছে দেবেন।
আপনার অনুরক্ত মুজিবুর
ডাকপিয়ন এল বাড়িতে। তার গায়ে খাকি রঙের শার্ট, পরনে লুঙ্গি, পিঠে ঝোলা। ‘খোকা ভাইয়ের চিঠি এয়েছে, চিঠি’ বলে দীর্ঘ লয়ে হাঁক পাড়ছেন। হাসু দৌড়ে গেল, চিঠি এসেছে, চিঠি। পেছনে পেছনে ছুটতে লাগল কামাল, হাতে একটা গাছের ডাল, এটা তার গাড়ি, সে ছুটছে ভোঁ শব্দ করে। আপার সঙ্গে দৌড়ে পেরে উঠল না, গাড়িসমেত ড্রাইভার নরম মাটিতে একটা ডিগবাজি খেল। পাশে একটা মুরগি, তার হলুদ ছানা কয়েকটা নিয়ে কককক করে ডেকে উঠল। মুরগির ছানাগুলোর সঙ্গেই কয়েকটা হাঁসের ছানা। মুরগি-মা হাঁস ও মুরগির ডিমে তা দিয়ে মুরগির ছানা আর হাঁসের ছানা উভয় সন্তানদের মা হয়ে সব কটাকেই সামলাচ্ছে।
হাসু চিঠি নিল পিয়নের হাত থেকে। ডাকপিয়ন বললেন, ‘ভাইজান এয়েছে শুনছি, তাঁর সাথে একটু দেখা না কইরে যাই কেমনে!’ তিনি মুজিবের শোবার ঘরের দিকে রওনা হলেন। সেখানে গিয়ে ভিড়ের পাশে দাঁড়ালেন, শেখ মুজিব তাকে দেখেই ‘আতর আলী নাকি কেমন আছ, তোমার বাবার শরীলটা কেমন আছে’ বলে হাঁক পাড়লেন। চৈত্র মাস, রোদে আতর আলী পিয়নের সমস্ত গা ঘর্মাক্ত, খাকি শার্ট ভিজে উঠেছে।
আতর আলী পিয়ন পানির গেলাসের দিকে হাত বাড়ালে মুজিব বললেন, ‘খালি পেটে পানি খাইয়ো না, একটু গুড়-মুড়ি মুখে দিয়া তার পরে খাও।’
ততক্ষণে হাসু চিঠি নিয়ে চলে এসেছে আব্বার কাছে। ‘আব্বা, আব্বা, চিঠি এয়েছে, চিঠি’–পিয়নের সুর নকল করে সে বলল।
ইংরেজিতে নাম-ঠিকানা লেখা।
টু
মি. শেখ মুজিবুর রহমান, বি.এ.
ভিল. টুঙ্গিপাড়া,
পো. অ. পাটগাতী,
ডিট. ফরিদপুর।
ফ্রম
টি. হোসেন
৯, হাটখোলা রোড
পো.অ. ওয়ারী, ডেকা।
হলুদ খাম। তাতে উর্দুতে লেখা সরকারি খামের নকশা। মানিক ভাইয়ের চিঠি। মুজিব খাম ছিঁড়ে চিঠি বের করলেন। চশমাটা চোখে দিলেন। ইংরেজিতে লেখা চিঠি। মানিক ভাই লিখেছেন :
৯, হাটখোলা রোড
পো.অ. ওয়ারী, ডেকা।
২৯.৩.৫২
ডিয়ার ব্রাদার,
তোমার চিঠির জন্য অনেক ধন্যবাদ। ঢাকার পরিস্থিতি এখনো অনিশ্চিত। গ্রেপ্তার চলছেই। শামসুল হক ১৯ তারিখে আত্মসমৰ্পণ করেছেন। খালেক নেওয়াজ আর আজিজ আহমেদ ২৭ ও ২৮ তারিখে আত্মসমর্পণ করেছেন।
মওলানা সাহেবের কোনো খবর নেই। বহু আগে তাঁর কাছ থেকে আমরা খবর পেয়েছিলাম যে তিনি উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন।
আমরা সবাই তোমার স্বাস্থ্যের ব্যাপারে খুবই উদ্বিগ্ন। প্রত্যেকে তোমাকে চিকিৎসা ও বিশ্রাম নিতে পরামর্শ দিচ্ছে। কেবল চিকিৎসা নেওয়ার জন্যই তোমার ঢাকা আসা উচিত। আমরা এই ব্যাপারে সব ব্যবস্থা নিয়ে রাখব।
আমি গভর্নর ভবনের ঠিক পূর্ব পাশে কমলাপুর বাজারে বাস করছি। এখানে তুমি সব সময়ই স্বাগত।
আমরা কোনোরকমে চালিয়ে যাচ্ছি। সাক্ষাতে কথা হবে। তোমার আব্বা-আম্মাকে আমার সালাম।
প্ৰীতিসহ
টি. হোসেন
২৯.৩.৫২
মুজিব চিঠিটা পড়লেন।
তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এর আগেও তাঁকে চিঠি লিখেছিলেন। তাঁকে ঢাকা আসতে বলেছেন। বলেছেন, চিকিৎসার জন্যই ঢাকা আসতে হবে। ঢাকায় শেখ মুজিব যদি বসেও থাকেন, তাতেও কাজ হবে।
আজও একই কথা। চিঠিটা আব্বাকে দেখানো দরকার। এটা দেখালে কাজ হতে পারে। লুৎফর রহমান চান না, অসুস্থ ছেলে ঢাকায় যাক। ছেলের হৃৎপিণ্ডে সমস্যা, নাকের ভেতরে ক্ষত। তার ওপর হলো আমাশা। ছেলের শরীরে কখানা হাড় ছাড়া কিছুই ছিল না। তালপাতার সেপাইয়ের মতো দেখাত তাকে। কয়েক দিন বাড়িতে থেকে শরীর কিছুটা ফিরেছে। এখনই তার ঢাকা যাওয়ার দরকার নাই, লুৎফর রহমান সাহেবের অভিমত।
এখন এ চিঠিটা দেখালে যদি আব্বার সদয় হন।
.
মুজিব ঘর থেকে বের হলেন। হাসিনা তার এক হাতের আঙুল ধরে আছে, কামাল এসে ধরল হাসিনার আঙুল। তিনজন ঘর ছেড়ে এসে উঠোনে দাঁড়ালেন। শেখ লুৎফর রহমান সাহেব কাঁঠালগাছের নিচে টঙের ওপরে বসে আছেন।
বসন্তের বাতাস বইছে। আজকের দিনটা মনোরম।
একটা সুপারিগাছ থেকে একটা পাতা খসে পড়ল সশব্দে। হাসিনা আর কামাল সেই পাতাটা কুড়ানোর জন্য ছুটে চলে গেল। মুজিব গিয়ে তাঁর পিতার পাশে দাঁড়ালেন।
কাঁঠালপাতার ফাঁকে ফাঁকে রোদ এসে লুৎফর রহমানের মুখে পড়ে আলো-ছায়ার এক অপূর্ব আলপনা এঁকেছে। পিতার মুখের দিকে তাকিয়ে মুজিব যেন অভয় পেলেন। আব্বার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা মায়া, শাসন, প্রশ্রয় আর পৃষ্ঠপোষকতার রসায়ন দিয়ে গড়া। পরস্পর পরস্পরকে খুব ভালোবাসেন। আবার মুজিব একটু সমীহও করেন আব্বাকে। তাঁর কাছ থেকে এখনো নিয়মিত টাকা নেন তিনি। কখনো তাঁর কথার অবাধ্য হন না।
লুৎফর রহমানও তাঁর এই ছেলেটিকে গভীরভাবে ভালোবাসেন।
বছর চার-পাঁচ আগের একটা ঘটনা জীবনেও ভুলবেন না মুজিব। পাকিস্তান হওয়ার পর একবার কলকাতা গিয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে এলেন ঢাকায়। সোহরাওয়ার্দী সাহেব বরিশালে জনসভা করবেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে। হিন্দুরা যাতে পূর্ব বাংলা ছেড়ে না যান, সেই আবেদন জানানোর জন্য। মুজিব তাঁর সঙ্গে স্টিমারে চললেন বরিশাল। বরিশালে জনসভা আরম্ভ হয়েছে। মুজিব বসে আছেন বক্তৃতার মঞ্চে, ঠিক সোহরাওয়ার্দীর পাশেই। তাঁকেও বক্তৃতা করতে হবে। রাত আটটার মতো বাজে। এই সময়ে একটা চিরকুট তাঁর হাতে এল। মুজিব চিরকুটটা খুললেন। মুজিবের ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাতের হাতের লেখা। তিনি লিখেছেন, ‘মিয়াভাই, আব্বার অবস্থা খুবই খারাপ। তিনি ভীষণ অসুস্থ। তোমার জন্য নানা জায়গায় টেলিফোন করা হয়েছে। যদি দেখতে হয়, রাতেই রওনা করতে হবে। হেলেন তোমাদের বাড়িতে চলে গিয়েছে।’ মুজিব চিঠিটা পড়ে খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন। তারপর চিঠিটা পড়ে শোনালেন সোহরাওয়ার্দীকে। তিনি বললেন, ‘তুমি রওনা হয়ে যাও।’
সোহরাওয়ার্দী ভালোভাবেই চিনতেন লুৎফর রহমান সাহেবকে। গোপালগঞ্জে গিয়ে তিনি মুজিবদের বাড়িতে অবশ্যই ঢুঁ মারতেন। লুৎফর রহমান সাহেবের সঙ্গে দেখা করতেন। একবার নির্বাচনের আগে গোপালগঞ্জ থেকে কাকে মনোনয়ন দেওয়া যায়, সে ব্যাপারে লুৎফর রহমান সাহেবের পরামর্শও নিয়েছিলেন। পিতার অসুখের খবর শুনে মুজিব যে এই মুহূর্ত থেকেই বিচলিত বোধ করতে শুরু করেছেন, সেটা বুঝতে সোহরাওয়ার্দীরও বিন্দুমাত্র দেরি হলো না। তিনি বললেন, ‘মুজিব, তুমি এক্ষুনি রওনা হয়ে যাও।’ মুজিব মঞ্চ থেকে নামলেন। দেখা হয়ে গেল আবদুর রব সেরনিয়াবাতের সঙ্গে। মুজিব তাঁকে বললেন, ‘কখন খবর পেয়েছ?’
রব সাহেব বললেন, ‘গতকাল খবর পেয়েছি। খবর শোনামাত্রই হেলেন রওনা হয়েছে। আমি ভেবে দেখলাম, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের জনসভা যেহেতু, কাজেই তুমি আসবেই। তাই তোমার জন্য এইখানে খোঁজ করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে বলে মনে হলো।’
মুজিব বললেন, ‘চলো চলো। আর দেরি করা যাবে না। স্টিমার ছাড়ার সময় হয়ে এসেছে। এই রাতের স্টিমার ধরতে না পারলে পুরা একদিন পিছায়ে যাব।’ মালপত্র নিয়ে তাঁরা চড়ে বসলেন বরিশাল-ঢাকার স্টিমারে। সারা রাত ঘুম এল না মুজিবের দুই চোখে। তিনি বসে রইলেন। আবদুর রব এলেন। বললেন, ‘এত কী ভাবো, মুজিবর?’
মুজিব বললেন, ‘আব্বার কথা ভাবি। কত স্নেহ পেয়েছি আব্বার কাছ থেকে। দুই বাপ-বেটা একসঙ্গে থেকেছি গোপালগঞ্জে, মাদারীপুরে। এখনো আব্বার কাছ থেকে নিয়মিত টাকা নেই, আমার কোনো সংকোচ লাগে না। আর আমি তো সংসারের কোনো খোঁজখবরই রাখি না। কত আঘাত এই জীবনে দিয়েছি আব্বাকে।’
স্টিমার চলছে। বিকট শব্দ হচ্ছে ইঞ্জিনের। স্টিমারের সার্চলাইট দূরের গ্রামগুলোর ওপর, নদীর অগাধ জলের ওপর পড়ছে, আবার সরে যাচ্ছে। অন্ধকার চিরে কোথায় চলেছে এই জাহাজ। দূর আকাশে ওই একটা তারা দেখা যাচ্ছে, ধ্রুবতারা। মুজিব মনে মনে বললেন, ‘আব্বা, আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি। খুব।
ভোরবেলা পাটগাতী ঘাটে এসে জাহাজ থামল। আবদুর রব আর মুজিব নামলেন স্টিমার থেকে। ঘুমন্ত ঘাট জেগে উঠল। কয়েকজন যাত্রী উঠল জাহাজে, কয়েকজন নামল। দু-চারজন কুলি-জাতীয় লোক তৎপরতা শুরু করেছে। স্টেশনমাস্টার দাঁড়িয়ে আছেন ঘাটে।
মুজিব তাঁর কাছে গেলেন। বললেন, ‘আমাদের বাড়ির কোনো খবর জানেন? আব্বা কেমন আছে, জানেন কিছু?’ লোকেরাও ভিড় করে ঘিরে ধরল মুজিবকে। তারা সবাই বলল, ‘আপনার আব্বার খুব অসুখ শুনেছি। তবে তিনি কেমন আছেন, সেটা জানি না।
পাটগাতী থেকে টুঙ্গিপাড়ার আড়াই মাইল পথ। নদীপথে যেতে অনেক সময় লাগবে। সবচেয়ে তাড়াতাড়ি হবে যদি হেঁটে যাওয়া যায়। মালপত্র সব রাখা হলো স্টেশনমাস্টারের কাছেই। ঝাড়া হাত-পা নিয়ে মুজিব রওনা হলেন বাড়ির দিকে। চষা জমি মাড়িয়ে, মাঠ পেরিয়ে ছুটে চলেছেন তাঁরা। মধুমতী নদী পার হলেন নৌকায়। তারপর আবার হাঁটা। খেতখামার ডিঙিয়ে তাঁরা পৌঁছালেন বাড়ির উঠানে।
তখন সকাল হচ্ছে। সূর্য কেবল উঠি উঠি। মুজিব ও আবদুর রবের ছায়া লম্বা হয়ে পড়েছে উঠানে। তাঁরা বারান্দায় উঠলেন। আব্বার শয়নঘরে উঁকি দিলেন। এরই মধ্যে রেনু, মা ঘুম থেকে উঠেছেন। রেনু বললেন, ‘এসেছ। যাও। ভেতরে যাও। আব্বাকে দেখো।’
‘কী হয়েছে আব্বার?’
‘কলেরা,’ রেনু বললেন। শুনেই মুজিবের বুকটা ধক করে উঠল।
ডাক্তার বাবু লুৎফর রহমানের কবজি ধরে বসে আছেন। দেখা হওয়ামাত্র বললেন, ‘নাড়ির অবস্থা ভালো না। বারবার পায়খানা হয়ে পেশাব বন্ধ হয়ে গেছে। আমি সারা রাত এখানেই বসে আছি। বাকিটা ভগবানের কৃপা। আমি তো কোনো আশা দেখি না।’
মুজিব আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। পিতার বুকে মাথা রেখে বললেন, ‘আব্বা।’ লুৎফর রহমান চোখ মেলে তাকালেন। আবার চোখ বন্ধ করলেন। মুজিব কাঁদতে লাগলেন। তাঁর অশ্রুতে আব্বার জামা ভিজে যেতে লাগল।
ডাক্তার বললেন, ‘আশ্চর্য তো, নাড়ি ঠিক হয়ে যাচ্ছে।’
লুৎফর রহমান সাহেবের পেশাব হলো।
ডাক্তার বললেন, ‘আর ভয় নাই। পেশাব হয়েছে।’
দু-এক ঘণ্টার মধ্যেই লুৎফর রহমান সাহেবের চেহারার মধ্যেও একটা সজীবতা ফিরে এল। ডাক্তার বাবু বললেন, ‘এবার আমি যেতে পারি। সারা রাত ছিলাম।’
.
মুজিবের সঙ্গে তার আব্বার এমনি একটা অনির্বচনীয় যোগাযোগ আছে।
এখন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার চিঠি হাতে মুজিব দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর পিতার পাশে।
‘আব্বা?’ মুজিব বিনম্র স্বরে ডাকলেন।
‘কী?’ লুৎফর রহমান মুখ তুললেন।
‘মানিক ভাইয়ের চিঠি। পড়েন।’ মুজিব হাত বাড়িয়ে চিঠিটা দিলেন। লুৎফর রহমান সাহেব চিঠিটা পড়লেন। তিনি চুপ করে রইলেন। কাঁঠালগাছ থেকে পাতা ঝরছে। মুজিব সেই শব্দও শুনতে পাচ্ছেন। অবশেষে লুৎফর রহমান সাহেব মুখ খুললেন, ‘যেতে চাও, যেতে পারো।’
মুজিবের বুকের ওপর থেকে যেন একটা পাথর নেমে গেল। তিনি কাঁঠালছায়া থেকে সরে এলেন। রোদ এসে লাগল গায়ে।
মুজিব কাঁঠালতলা থেকে এগিয়ে এলেন উঠোনের দিকে, ‘হাসুর মা, এদিকে আসো, মানিক ভাই চিঠি দিয়েছেন, চিকিৎসার জন্য ঢাকা যেতে বলেছেন, তুমি কী বলো?’
রেনু বললেন, ‘ঢাকা গেলে তো তোমার শরীর আবার খারাপ করবে। তুমি খাবা না, বিশ্রাম নিবা না, খালি কাজ করবা, আর তোমার শরীর খারাপ করবে। হার্টের ব্যারাম, তার ওপর আবার আমাশা। আরও কয়েক দিন থেকে তার পরে যাও।’
‘তা কয়েক দিন থাকি। এপ্রিলের মাঝামাঝি যাব। দুই সপ্তাহ থাকি।’
‘আচ্ছা, তাহলে আপত্তি নাই।’ রেনু বললেন।
.
মুজিব ঢাকা যাবেন। এবার আর ১৫০ মোগলটুলিতে ওয়ার্কার্স ক্যাম্পে উঠতে চান না তিনি। ওখানে এত লোক আসা-যাওয়া করে যে প্রাইভেসি বলতে কিছুই থাকে না। সবাই মিলে ওইভাবে বসবাস করারও একটা আলাদা আকর্ষণ আছে, কিন্তু একটু বসে বই পড়ার, চিঠি লেখার, একটু জিরোনোর জন্যও তো খানিকটা পরিসর দরকার হয়।
আবদুল হামিদ চৌধুরী আর মোল্লা জালাল উদ্দিন মিলে তাঁতীবাজারে একটা বাসা ভাড়া নিয়েছেন। তাঁরা মুজিবকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন সেই নতুন বাসায় এসে উঠতে। মুজিব ঠিক করেছেন ওখানেই উঠবেন। যদিও মানিক ভাইও তাঁর ওখানে ওঠার জন্য চিঠিতে আহ্বান জানিয়ে রেখেছেন।
কারাগারে যাওয়ার আগে, আড়াই বছর আগে, মুজিবের বিছানা-বালিশ সব ছিল মোগলটুলির বাসায়। সেসব এখন কোথায় আছে, কে ব্যবহার করছে, কে জানে। আর বাসায় উঠতে গেলে খাট, বিছানা-বালিশ, টেবিল-চেয়ার কত কী লাগবে! কয়েক মাসের খরচও সঙ্গে রাখা দরকার। আর দরকার চিকিৎসা। সে জন্যও তো টাকা লাগবে। একটাই উপায়। আব্বার কাছে চাওয়া।
মুজিব আবার দাঁড়ালেন তাঁর আব্বার সামনে। বললেন, ‘আব্বা, টাকা দরকার। সবকিছু নতুন করে কিনতে হবে, বিছানা-বালিশ-খাট। চিকিৎসার জন্যেও তো টাকা দরকার।’
আব্বা বললেন, ‘আচ্ছা, নিয়ো।’
.
রেনু বলল, ‘হাসুর আব্বা, নাও।’
তিনি আঁচলের গিঁট খুলছেন।
মুজিব জানেন রেনু কী দেবেন। তবু বললেন, ‘কী?’
রেনু হাসিমুখে ভাঁজ করা কতগুলো টাকা মুঠো করে তুলে দিলেন মুজিবের হাতে। মুজিব হেসে বললেন, ‘রেনু, আমার উচিত তোমাকে টাকা দেওয়া। উল্টা আমি তোমার কাছ থেকে নেই।
রেনু বললেন, ‘ও মা, আমি বুঝি তোমার পর। আমি তো চাকরি করি না। বাড়ির এখান থেকে ওখান থেকে টাকাটা জোগাড় করি। ধান বিক্রি করি। পাট বিক্রি করি। সরিষা বিক্রি করলাম। এসব তো তোমারই টাকা। তুমি চিকিৎসা করাও। সুস্থ হও। ভালো থাকো। এইটুকুই আমার চাওয়া। এর বেশি কিছু আমার চাওয়া নাই।’
.
হাসু জোরে জোরে কাঁদছে। বলছে, ‘আব্বা, তুমি যাবা না।’ তাই শুনে কামালও কান্না জুড়ে দিল, ‘আব্বা, যাবা না। আব্বা, যাবা না।’
মুজিব হাসুকে কোলে নিয়েছেন। কামালও তার হাঁটু ধরে টানছে। মুজিব আরেক কোলে কামালকেও উঠিয়ে নিলেন। রেনু বললেন, ‘হাসুকে আমার কোলে দাও। তোমার রোগা শরীরে তুমি দুজনকে একসাথে নিতে পারো নাকি?’ তিনি হাত বাড়িয়ে হাসুকে নিতে গেলেন, সে হাত সরিয়ে নিল আব্বার কোল থেকে সে কিছুতেই নামবে না। রেনু অগত্যা একরকম জোর করেই কামালকে নিজের কোলে টেনে নিলেন।
বাড়ির সামনে খালপাড়। খালে নিজস্ব নৌকা বাঁধা। মুজিব সেই নৌকায় গিয়ে উঠলেন। তাঁর আব্বা ও আম্মা খালপাড়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। রেনু কামালকে কোলে করে ঘাটে নামলেন মাটির সিঁড়ি বেয়ে। হাসিনা এখনো মুজিবের কোলে। সে কিছুতেই নামবে না। তার এক কথা, ‘আব্বা, যাবা না।’ এবার হেলেন, মুজিবের বোন, নেমে এলেন ঘাটে। হাসিনাকে বললেন, ‘মা, নাম তো। দেখ, তোর জন্য কী এনেছি। একটা লাল রঙের পাখি। চল তো, চল তো।’
হাসিনা একটু বিভ্রান্ত হলো। হেলেন তাকে কোলে করে নিয়ে খালপাড়ের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে লাগলেন।
এই সুযোগে নৌকা ছেড়ে দিল।
জোয়ার এসেছে। নৌকা ছাড়ার এখনই উপযুক্ত সময়। পানি চিরে নৌকা চলল। লগি ঠেলতে লাগল মাঝি। ঘাট পেছনে ফেলে নৌকা এগিয়ে যাচ্ছে।
মুজিব আপন মনেই আবৃত্তি করতে থাকলেন, ‘যেতে নাহি দেব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, হায় তবু চলে যায়…’
রেনু খালের পাড়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। নৌকা চলে গেছে। পানিতে ঢেউ উঠেছিল। সেই দাগও মিলিয়ে গেল। এখন ওই জায়গাটা ফাঁকা।
রেনুর বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠছে। তিনি চোখ মুছে বাড়ির দিকে গেলেন। কেউ তাঁর চোখের জল দেখে ফেললে সে ভারি লজ্জার ব্যাপার হবে।
.
মুজিব বসে আছেন আওয়ামী লীগের নতুন অফিসে। নবাবপুরে এই অফিস। এই বাড়ির দুটো কামরায় তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া থেকেছেন কিছুদিন ছেলেমেয়েদের নিয়ে। আওয়ামী লীগ অফিসে একটা টেবিল, গোটা তিনেক চেয়ার, একটা লম্বা টুল। সেইসব চেয়ারের একটায় বসে আছেন মুজিব। আর আছেন কামরুজ্জামান সাহেব। বিকেলবেলা। অফিস তবু ফাঁকা। পিয়ন আক্কাস আলী দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। এই অফিসে ইদানীং কেউ আসতে চায় না। নেতারা বেশির ভাগই কারাগারে। ধরপাকড় এখনো চলছে।
মুজিবের মাথা থেকে কিছুতেই এই দুশ্চিন্তা যায় না যে, তাঁর লিডার উর্দুর পক্ষে সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়েছেন। ঢাকায় এসে সরকার-সমর্থক কাগজগুলোয় প্রকাশিত লিডারের সেই বিবৃতি তিনি নিজের চোখেই দেখতে পেলেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কোনো পরামর্শই মুজিব অমান্য করেন না। মুজিবের কাছে পিতার মতোই প্রিয় হলেন সোহরাওয়ার্দী। কিন্তু এবার আর উপায় নাই। শেখ মুজিবকে সোহরাওয়ার্দীর মতের বিরুদ্ধেই দাঁড়াতে হবে। লিডার আসলেই বাংলার মানুষের মন-মানসিকতা ধরতে পারছেন না। তিনি কী বলছেন? বাঙালিকে উর্দু শিখতে হবে। কোন দুনিয়ায় যে আছেন তিনি!
কামরুজ্জামান সাহেব বলেন, ‘কী হয়েছে, মুজিব ভাই? কোনো খারাপ খবর?’
মুজিব বলেন, ‘না, খবর খারাপ না। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে। কী বলেন?’
কামরুজ্জামান বলেন, ‘না করলে শাসকেরা নিজেরাই ঠকবে।’
‘হ্যাঁ, আমিও তা-ই বলি। সারা দেশে, গ্রামে-গঞ্জে সর্বত্র মানুষের মধ্যে একটা উন্মাদনা জেগেছে। আর বাঙালিকে দাবায়া রাখতে পারবে না।’
.
খুব বৃষ্টি হচ্ছে। বৈশাখের এই দিনে এত বৃষ্টি! বৃষ্টি উপেক্ষা করেই ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে সমবেত হয়েছেন চার-পাঁচ শ মানুষ। কামরুদ্দীন আহমদ, আতাউর রহমান খানসহ অনেকেই উপস্থিত আছেন। রাষ্ট্রভাষা পরিষদের উদ্যোগে সর্বদলীয় কর্মী পরিষদের একটা সভা হচ্ছে। সভায় কে কী বলেন, তারই নোট নিতে এসেছেন একজন গোয়েন্দা। তিনিও কর্মী সেজে স্লোগান ধরছেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। আর কাগজ বের করে মাঝেমধ্যে নোট নিচ্ছেন কে কী বলছেন। তাঁর একটা সমস্যা হচ্ছে। পথে তাঁর নোট বই ভিজে গেছে। ভেজা কাগজে পেনসিল দিয়ে নোট নিতে হচ্ছে। কলম চালানো যাচ্ছে না।
আতাউর রহমান খান সভাপতিত্ব করছিলেন। তিনি বললেন, ‘এবার ভাষণ দেবেন সদ্য কারামুক্ত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।’ সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতারা চঞ্চল হয়ে উঠল। তারা শেখ মুজিবের নামে জয়ধ্বনি দিতে লাগল। আতাউর রহমান খান বললেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব সবার শেষে ভাষণ দেবেন। তা না হলে আপনারা আর কারও বক্তৃতা শুনবেন বলে মনে হচ্ছে না
আতাউর রহমান খান তার লিখিত ভাষণ পাঠ শুরু করলেন। অর্ধেকটা পড়া হয়েছে এই সময় প্রচণ্ড গরমে তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন। ধপাস শব্দ করে তিনি পড়ে গেলেন চেয়ার থেকে। সবাই তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো পাশের আরেকটা ঘরে। সেখানে তাঁর মাথায় আর চোখেমুখে পানি দেওয়া হতে লাগল। মাথার ওপর বৈদ্যুতিক পাখা ঘুরছে। তা সত্ত্বেও দুজন দুটো ফাইল দিয়ে বাতাস করতে লাগল।
কামরুদ্দীন সাহেব ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। তিনি সভাপতির লিখিত ভাষণের বাকিটা পাঠ করে শোনালেন।
.
সভাপতির ভাষণের পরে এল শেখ মুজিবের বক্তব্য দেওয়ার পালা।
তিনি বললেন, ‘দীর্ঘ আড়াই বছর কারাবাসের পর আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। আপনারা যখন ভাষাসংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন, আমি তখন কারাগারে অনশনরত। আমি যখন জেলে অনশন করছিলাম, তখন আমার ছাত্রবন্ধুদের ওপরে গুলি চালানোর খবর পাই। ছাত্রদের এ ত্যাগ বৃথা যাবে না। আপনারা সংঘবদ্ধ হোন। মুসলিম লীগের মুখোশ খুলে ফেলুন। এই মুসলিম লীগের অনুগ্রহে মওলানা ভাসানী, অন্ধ আবুল হাশিম ও অন্য কর্মীরা আজ কারাগারে। আমরা বিশৃঙ্খলা চাই না। বাঁচতে চাই, লেখাপড়া করতে চাই। ভাষা চাই। মুসলিম লীগ সরকার আর মর্নিং নিউজ গোষ্ঠী ছাড়া সবাই বাংলা ভাষা চাই।
.
গুড়ুম করে আওয়াজ হলো। বজ্রপাত হলো কোথাও। সবাই স্লোগান ধরল, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’।
গোয়েন্দা ভদ্রলোক তাঁর রিপোর্টে লিখলেন :
‘শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাকে আঞ্চলিক ভাষার মর্যাদা দেওয়ার সোহরাওয়ার্দীর প্রস্তাব বাতিল করে দেন, তাদের প্রধান দাবি হলো, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।’
ইংরেজিতে লেখা এই প্রতিবেদন গোয়েন্দা ভদ্রলোক তাঁর অফিসে পেশ করেন।
শেখ মুজিবের বক্তৃতা শেষ। তাঁর বক্তৃতা শেষ হলে সভাও সমাপ্ত হয়ে গেল। সারা দেশ থেকে আসা কর্মীরা ছেঁকে ধরল তাঁকে। তিনি সবার সঙ্গে কথা বলছেন। অনেকেরই নাম তিনি জানেন, কে কোত্থেকে এসেছে, তাঁর মুখস্থ, তিনি তাদের ব্যক্তিগত কুশল জিগ্যেস করলেন। অন্য বক্তারা চলে গেলেও বেশ খানিকক্ষণ কর্মী-পরিবেষ্টিত অবস্থায় রইলেন তিনি। তারপর বেরিয়ে এলেন হল থেকে। তিনি আতাউর রহমান সাহেবের খোঁজ করলেন। জানা গেল, তিনি সুস্থ বোধ করায় তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।
কর্মীরাই একটা ঘোড়ার গাড়ি ধরে আনল। ‘মুজিব ভাই, ওঠেন।’ তিনি উঠলেন। যাবেন তাঁতীবাজার। তাঁর সঙ্গে আছেন মোল্লা জালালউদ্দিন। বৃষ্টি হচ্ছে প্রচণ্ড। টমটমের ছাদ বৃষ্টির ছাট আটকাতে পারছে না। বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে টমটমে উঠে বসা মুজিবের স্যান্ডেল। বৃষ্টির ছাট এসে লাগছে তাঁর চোখেমুখে। তিনি হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির জল ছুঁতে লাগলেন। ভেজা হাত মুখে বোলালেন। ঘোড়া ছুটে চলেছে ঠকঠক শব্দ তুলে। বাতাস এসে লাগছে মুজিবের চোখেমুখে।
তাঁর খুব আরাম বোধ হচ্ছে।
সোহরাওয়ার্দীর বাংলা ভাষাবিরোধী অবস্থানের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দেওয়ার পর মুজিবের নিজেকে খানিকটা হালকা বলে মনে হয়। আহ্, কী একটা পাষাণভারই না তাঁর মনের ওপর এই কটা দিন চেপে বসেছিল।
.
পরের দিন, ২৮ এপ্রিল ১৯৫২, আওয়ামী মুসলিম লীগের এক সভায় শেখ মুজিবকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের ভার দেওয়া হলো। কারণ, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক কারাগারে। এই সভায়ও আতাউর রহমান খান সভাপতিত্ব করলেন।
সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়ার পর শেখ মুজিব একটা সাংবাদ সম্মেলন ডাকলেন।
তাতে তিনি বললেন, “বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে। সব রাজবন্দীকে মুক্তি দিতে হবে। ২১ ফেব্রুয়ারির শহীদ পরিবারদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এবং যারা অন্যায়ভাবে বাংলার মানুষের ওপরে জুলুম করেছে, তাদের শাস্তি দিতে হবে। সরকার বলছে, বিদেশি রাষ্ট্রের উসকানিতে আন্দোলন হয়েছে। সরকারকে এই কথা প্রমাণ করতে হবে। হিন্দু ছাত্ররা কলকাতা থেকে পায়জামা পরে এসেছে, এসে আন্দোলন করেছে, এই কথা বলতেও আপনাদের বাধে নাই। আমি সরকারকে জিগ্যেস করি, যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের সবাই মুসলমান কি না! যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁদের ৯৯ শতাংশই মুসলমান কি না! এত ছাত্র কলকাতা থেকে এল, হাজার হাজার ছাত্র, তাদের একজনকেও যে সরকার ধরতে পারে নাই, তাদের ক্ষমতায় থাকার কোনোই অধিকার নাই।’
.
এর কয়েক দিনের মধ্যেই শেখ মুজিবের হাতে এসে পৌঁছাল একটা চিঠি চিঠিটা লিখেছেন সোহরাওয়ার্দী সাহেব। ইংরেজিতে লেখা চিঠি।
৫৬, ক্লিফটন
করাচি
২২.৪.৫২
আমার প্রিয় মুজিবুর,
ওপরওয়ালাকে ধন্যবাদ যে তোমাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তুমি অসুস্থ জেনে আমি দুঃখিত। তুমি যদি করাচি আসতে চাও, যে উপায়েই হোক না কেন, চলে এসো। এতে তোমার স্বাস্থ্যের উপকার হতে পারে। খুবই ভয়ংকর কথা যে তারা সব জায়গার আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতাদের গ্রেপ্তার করেছে অথচ আমরা কিছু করতে পারছি না। আর কতকাল আমাদের জনগণকে এই দুঃখকষ্ট সইতে হবে? আল্লাহ সবই দেখছেন নিশ্চয়ই। তিনি আমাদের উদ্ধারে এগিয়ে আসবেন। আমি মনে করি, রাষ্ট্রভাষা-বিতর্ক অর্থহীন এবং বাস্তবে পাকিস্তানকে ধ্বংস করে দেবে, যদি না তারা ব্যাপারটাকে বাদ দিতে পারে। খুব খারাপ হলেও আমরা যেটা করতে পারি, আমরা আঞ্চলিক রাষ্ট্রভাষা পেতে পারি, বাংলার জন্য বাংলা আর পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য উর্দু, আর ইংরেজিকে কিছু দিন চালিয়ে নিতে পারি আন্তপ্রাদেশিক ভাষা হিসেবে এবং আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে। কিন্তু আমি পরামর্শ দেব, বাংলার মুসলিমদের বাধ্যতামূলকভাবে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে উর্দু শিখতে হবে। আমি যদি ভুল বলে না থাকি, তাদের ঠিকভাবে বোঝানো গেলে তারা আপত্তি করবে না।
তোমারই শহীদ সোহরাওয়ার্দী
চিঠি পেয়ে মুজিব বুঝলেন, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের বিবৃতি বিকৃত করে পত্রিকায় ছাপানো হয় নাই। পূর্ব বাংলার মানুষকে উর্দু শিখতে হবে, এটাই ।তাঁর মনের কথা। তাঁর মতো একজন বিবেকবান মানুষ এই রকম কথা বলতে পারলেন! তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়া দরকার। কত বড় ভুল তিনি ভাবছেন, ব্যাপারটা তাঁকে বোঝানো দরকার।
১৪.
মওলানা ভাসানীর কাছে আজকে একটা বিচার এসেছে।
বিচারপ্রার্থী স্বয়ং জেলার মাখলুকুর রহমান।
মওলানা ভাসানী থাকেন কারাগারের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের শেষ প্রান্তে। তাঁর এলাকাটা পর্দাঘেরা। বর্ষীয়ান এই নেতা আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি, বুজুর্গ ব্যক্তি, যার কিনা অনেক মুরিদ আছে, যারা তাঁর কাছ থেকে পানি-পড়া নেয়, এই রকম একজন মানুষকে আলাদা সম্মান দেওয়াটাকে জেল কর্তৃপক্ষ কর্তব্য বলেই মনে করেছে।
মওলানা ভাসানী কারাগারের সবার ভালো-মন্দের খোঁজখবর নিয়ে থাকেন। কারাগার এখন ভর্তি ভাষাসংগ্রামীদের দিয়ে। মওলানা ভাসানী তো আছেনই, আছেন মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, আবুল হাশিম, শহীদুল্লা কায়সার, মুনীর চৌধুরী, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, খালেক নেওয়াজ খান। নারায়ণগঞ্জের বিখ্যাত পরিবারের প্রধান কর্তা খান সাহেব ওসমান। তাঁকে সবাই ডাকে চাচা বলে। কারণ, তাঁর ছেলে শামসুজ্জোহা যুবলীগের সহসভাপতি। যুবলীগের আরেকজন ভাইস প্রেসিডেন্ট তোয়াহা আর সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদও কারাগারে। তাঁরা সারাক্ষণ ওসমান সাহেবকে চাচা বলে ডাকেন, কাজেই তিনি এখন কারাগারের সবার চাচা। খয়রাত হোসেন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য। তিনি থাকেন চাচার পাশের খাটে।
খয়রাত হোসেন এক কাণ্ড করেছেন।
নারায়ণগঞ্জ মর্গান স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মমতাজ বেগম থাকেন মহিলা ওয়ার্ডে। এরই মধ্যে তিনি রাজবন্দী ও ভাষাসংগ্রামী হিসেবে ডিভিশন পেয়েছেন। তবে, তিনি একাই রাজবন্দী বলে ওই ওয়ার্ডে কোনো সংবাদপত্র যায় না। আইন হলো, তিনজন রাজবন্দীর জন্য একটা করে কাগজ। ৫ নম্বর ওয়ার্ডে আজাদ, সংবাদ ও স্টেটসম্যান—তিনটা দৈনিক পত্রিকা আসে। কারণ, এই ওয়ার্ডে রাজবন্দী অনেক। কারা কর্তৃপক্ষের কাছে মমতাজ বেগম পত্রিকা দাবি করলেন। তখন ঠিক করা হলো, ৫ নম্বর ওয়ার্ড থেকে স্টেটসম্যান পত্রিকাটি এক দিন পর মহিলা ওয়ার্ডে মমতাজ বেগমের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তিনি আবার সেটা পড়া হয়ে গেলে তার পরের দিন ফেরত দেবেন। উত্তম ব্যবস্থা।
চাচা একদিন লক্ষ করলেন, খয়রাত সাহেবের স্টেটসম্যান পত্রিকাটা মমতাজ বেগমকে পাঠানোর ব্যাপারে খুবই উৎসাহ। ব্যাপার কী?
জমাদার পত্রিকাটা নিয়ে যাচ্ছে মহিলা ওয়ার্ডে পাঠাবে বলে। চাচা বললেন, ‘এই, আনো তো দেখি পত্রিকাটা।’ তিনি দেখলেন, পত্রিকার পাতায় খয়রাত সাহেব লিখে রেখেছেন, ‘সুইট হার্ট’
চাচা কিছু বললেন না।
কিন্তু পরের দিন যখন এই পত্রিকা ফেরত এল, তিনি দেখলেন, ওপাশ থেকে উত্তর এসেছে, ‘সুইট লাভ’।
চাচা দেখছেন, খয়রাত সাহেবের উৎসাহ আরও বেড়ে যাচ্ছে। কাগজ পড়া হওয়ার আগেই মহিলা ওয়ার্ডে পাঠানোর জন্য তিনি উশখুশ করছেন।
ব্যাপারটা লক্ষ করে তিনি একটা কৌতুক করার আয়োজন করলেন। খয়রাতের সঙ্গে তাঁর রসিকতার সম্পর্ক। পরস্পরকে তাঁরা ডাকেন বিয়াই বলে। এইটাই সুযোগ। চাচা একটা চিঠি লিখলেন খয়রাত সাহেবের স্ত্রীর উদ্দেশে। তাঁকে বেয়াইন বলে সম্বোধন করে লিখলেন :
বেয়াইন সাহেব,
সালাম নিবেন। আশা করি ভালো আছেন। আমরাও এখানে জেলখানায় খুব ভালো আছি। আপনার স্বামী খয়রাত হোসেন জেলখানায় দ্বিতীয় বিবাহের আয়োজন করিয়াছেন। পাত্রী খুবই সুন্দরী ও শিক্ষিত। তিনিও জেলখানার রাজবন্দী। জেলখানায় এইরূপ আইন আছে যে এক রাজবন্দী আরেক রাজবন্দীকে বিবাহ করিতে পারে। যাই হোক, এই বিবাহে আপনিও আমন্ত্রণ পাইতে পারেন। তবে, আপনার বেয়াই হিসাবে আমার দুশ্চিন্তা, বিবাহের পরে পুত্রকন্যা লইয়া আপনার কী অবস্থা হইবে। তবে, জেলার সাহেব ইচ্ছা করিলে এই বিবাহ বন্ধ করিতে পারেন।
ইতি, খান সাহেব ওসমান আলী
এই চিঠি চলে গেল খয়রাত সাহেবের রংপুরের বাড়িতে।
এই চিঠি পেয়ে মিসেস খয়রাতের তো মাথাখারাপ অবস্থা। তিনি কান্নাকাটি করতে লাগলেন। তাঁর দুলাভাই বিশিষ্ট আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতা দবির উদ্দিন। দবির উদ্দিন শ্যালিকার কান্নাকাটি দেখে চিঠি লিখলেন জেলার সাহেবকে। বললেন, এই বিয়ে যেমন করে হোক বন্ধ করতে হবে। আর যদি জেলার সাহেব বিয়ে বন্ধ করতে না পারেন, তবে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের কাছে বিচার দেওয়া হবে।
জেলার মাখলুকুর রহমান ছোটখাটো মানুষ। ভাসানীর সামনে দাঁড়িয়ে তিনি ঘামছেন। তিনি বললেন, ‘হুজুর, নুরুল আমিন সাহেবের কাছে বিচার গেলে আমার চাকরি আপনা-আপনি চলে যাবে। কারণ, জেলের চিঠি বাইরে যাচ্ছে, এই কথা জানাজানি হওয়ার পরে আর আমার চাকরি থাকে না।’
তিনি করুণ মুখে এই কথা বললেন।
ভাসানী ডাকলেন চাচাকে। ডাকলেন খয়রাত ভাইকে। আরও কয়েকজন বন্দীও একটা উত্তেজনাকর কিছু ঘটছে আঁচ করে ভিড় করেছে।
প্রথমে তো সবাই হাসাহাসি করতে লাগল।
কারণ, খয়রাতও কোনো দিন মমতাজকে দেখেননি।
মমতাজও কোনো দিন খয়রাতকে দেখেননি। তা ছাড়া মহিলা ওয়ার্ডে মমতাজের কয়েকজন ছাত্রীও বন্দী হয়ে আছে। তারাও শিক্ষিত। স্টেটসম্যান পড়তে পারে। তাদের যে কেউই এইসব ‘সুইট হার্ট’-জাতীয় কথা লিখতে পারে।
কিন্তু যেই না জেলার সাব কাঁদো কাঁদো হয়ে বলতে লাগলেন ‘হুজুর, আমার চাকরি বাঁচান’, তখন সবাই এ ব্যাপারটা যে গুরুতর, সেটা বুঝতে পেরে চুপ মেরে গেল।
খয়রাত সাহেব তো একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেছেন। একটা কথাও বলছেন না।
ভাসানী মুখ খুললেন, ‘এই মিয়া ওসমান, ইয়ারকি-ফাজলামো তো ভালোই করছ। অহন ঠেলা সামলাও। লও, আর একখান চিঠি লিখো তোমার বেয়াইনরে। সব খুইলা কও। কও যে বেয়াইনের লগে একটু ইয়ারকি- ফাইজলামো করছ। এই রকম কিছুই ঘটে নাই। আর জানায়া দেও, জেলখানায় বন্দী-বন্দিনীর মইধ্যে শাদি হওনের নিয়ম নাই।
ওসমান চাচা বললেন, ‘আচ্ছা, এখনই চিঠি লিখতাছি।’
ভাসানী বললেন, ‘খালি চিঠি লিখলেই হইব না। তোমার জরিমানা হইল ২৫ টাকা।’
ওসমান সাহেব বড়লোক মানুষ। সঙ্গে সঙ্গে ২৫ টাকা হস্তান্তর করলেন।
সেটা জেলারের হাতে তুলে দিয়ে ভাসানী বললেন, ‘মিঠাই লইয়া আহেন মিয়া, যান। শুনেন, সীতারাম ভান্ডার থাইকা মিষ্টি আনবেন।’
মিষ্টি এল। ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সবাই মিলে সেই মিষ্টি খেলেন।
জেলার সাহেব খয়রাত সাহেবকে দেওয়ানি ওয়ার্ডে বদলি করলেন। ওইটা রীতিমতো যেন বেহেশতখানা। ওটা আসলে বন্দী রাখার জন্য তৈরি হয়নি। কিন্তু ভাষা আন্দোলনে বন্দীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় কিছুসংখ্যক ভাষাসংগ্রামীকে ওখানে রাখা হয়েছে। ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় যেন এটা। সামনের বাগানে থরে থরে গোলাপ, লিলি, বেলি ফুল ফুটে আছে। আমগাছের নিচে সিমেন্টের প্রশস্ত বেঞ্চ।
ভাষাসংগ্রামীদের জেলের সবাই শ্রদ্ধা করে। ভালো রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু খুবই করুণ হালে রাখা হয়েছে কমিউনিস্টদের। তাদের রাখা হয় গাদাগাদি-ঠাসাঠাসি করে। তাদের না দেওয়া হয় সংবাদপত্র, না দেওয়া হয় নিজস্ব কাপড়চোপড় পরার সুযোগ। তারা জেলে বানানো মোটা কাপড় পরে। না খেয়ে না দেয়ে শুকিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
পাকিস্তান সরকার কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে যেন।
এবার ওসমান সাহেবের পাশে ঠাঁই হলো আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকের। তিনি নানা ধরনের কাণ্ড করছেন। সারা রাত জিকির করেন।
একদিনের ঘটনা। অধ্যাপক অজিত গুহ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী সবাই যে যাঁর বিছানায় শুয়ে গল্প করছেন।
হঠাৎ চিৎকার। আওয়ামী মুসলিম লীগেরই শওকত একটা বিশাল ডাব মাথার ওপরে দুই হাতে ধরে আছেন, ছুড়ে মারবেন শামসুল হকের মাথায়। শামসুল হকের কোনো ভাবান্তর নেই। দুজনের মধ্যিখানে অলি আহাদ। শওকত বলে চলেছেন, ‘তরে আইজ মাইরাই ফালামু। তর জন্য কী না করছি। পাইছস কী?’
এই শওকত আলী ৫০ মোগলটুলীর ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের রক্ষক। এখানেই কামরুদ্দীন, তাজউদ্দীনরা বামপন্থী মুসলিম লীগ সংগঠিত করেছিলেন। শামসুল হক এই বাড়িতেই থাকতেন বিয়ের আগে পর্যন্ত। শেখ মুজিবও কলকাতা থেকে এসে এই বাড়িতেই উঠতেন। শওকত মুজিবকে খাতিরও করেছেন খুব। তাঁর জন্য আলাদা রুমের ব্যবস্থা করেছেন সেই ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরেই। মুসলিম লীগের গুন্ডারা ও সরকার এই বাড়িটা দখল করার চেষ্টা করেছে অনেকবার, শওকতের জন্যই পারেনি।
ঘটনা কী?
ঘটনা হলো, শামসুল হক সাহেবের মাথায় গন্ডগোল দেখা দিয়েছে। এর আগে শেখ মুজিবও জেলখানায় তাঁর পাশে থাকতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, সারা রাত তিনি বিকট শব্দে জিকির করেন বলে। তাঁর স্ত্রী আফিয়া খাতুন যখন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন, শেখ মুজিব তাঁর জন্য জেলের বাগানের ফুল তুলে মালা গেঁথে দিতেন শামসুল হকের হাতে। কিন্তু শামসুল হক ব্যবহার করতেন অস্বাভাবিক। তিনি দেখা করতে যেতে চাইতেন না। গেলেও কোনো কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতেন। ইদানীং তাঁর মাথায় এসেছে যে তাঁর কাছে ফেরেশতা আসে। তারা তাঁকে নানা বাণী দিয়ে যায়। একদিনের ঘটনা। ওসমান চাচা ও শামসুল হক পাশাপাশি বিছানায় থাকেন। ওসমান চাচার একটা পোষা বিড়াল ছিল। কয়েক দিন ধরে সেটা আসছিল না। হঠাৎই বিড়ালটা তাঁর বিছানার ওপর একদিন লাফিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে শামসুল হক চিৎকার করে উঠলেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু…’
ওসমান সাহেব জিগ্যেস করলেন, ‘কী হয়েছে?’
শামসুল হক বললেন, ‘আল্লাহর ফেরেশতা এসেছে, দেখতে পাচ্ছেন না?’
ওসমান চাচা হো হো করে হেসে ফেললেন।
শামসুল হক ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। ছয় ঘণ্টা সাত ঘণ্টা চলে যায়, তিনি বিরামহীনভাবে দণ্ডায়মান। সমস্ত গা বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে, তার খেয়াল নেই। গেঞ্জি-পায়জামা ভিজে জবজবে হয়ে যায়। কেউ কিছু বললে তিনি জবাব দেন না। তাঁর কাছে নাকি ফেরেশতারা আসে। তিনি আল্লাহর দিদার লাভ করেন। এই রকমই একটা সময় শওকত গেছেন তাঁর কাছে, ‘আপনি কি ডাব খাবেন?’
শামসুল হক সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হাত এক ঝটকা মেরে সরিয়ে দিয়েছেন। শওকত সাহেব তাই রেগে গেছেন। ওই ডাব তিনি শামসুল হকের মাথায় ভাঙবেন। অলি আহাদ অনেক কষ্টে শওকতকে নিবৃত্ত করলেন।
আফিয়া খাতুন আবার এসেছেন। শামসুল হককে ডাকতে জেলগেট থেকে এসেছে একজন সেপাই। শামসুল হক পাঞ্জাবি টেনে নিলেন। একটা হাত পাঞ্জাবিতে ঢুকিয়ে মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে থাকলেন। সেপাই তাঁকে তাড়া দিল। তখন তিনি আরেকটা হাত ঢোকালেন এবং আরও ১০ মিনিট পার করলেন। ৪০ মিনিট পরে প্রায় জোর করেই তাঁকে জেলগেটে নেওয়া হলো। তিনি আফিয়া খাতুনের হাত ধরলেন এবং নীরব হয়ে গেলেন। একটা কথাও বললেন না।
এর পর থেকে আফিয়া খাতুন আর আসেননি জেলগেটে।
আফিয়া খাতুন ধরলেন আতাউর রহমান খান ও কামরুদ্দীন আহমদকে। ‘আপনারা আমার সঙ্গে চলুন, মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন সাহেবের কাছে যাই। শামসুল হককে মুক্তি দিক। ও তো অসুস্থ। ওর চিকিৎসা দরকার।’ আতাউর রহমান খান লম্বা শেরওয়ানি আর কামরুদ্দীন সাহেব কোর্ট-প্যান্ট পরে চললেন নুরুল আমিনের কাছে। মুখ্যমন্ত্রী ফাইল দেখছিলেন। ৪৫ মিনিট ধরে দুজনে বোঝালেন যে শামসুল হকের মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটছে। তাঁকে মুক্তি না দিলে তিনি মারা যাবেন।
নুরুল আমিন মাথা না তুলে বললেন, ‘আপনাদের কথায় তার মুক্তি হবে না। আইজি প্রিজন্স তো আমাকে কিছু জানায়নি।’
কামরুদ্দীন আহমদ বললেন, ‘ওনার পক্ষে তো মুখ্যমন্ত্রীকে সরাসরি রিপোর্ট করা সম্ভব না। আপনি আমাদের কথার পরিপ্রেক্ষিতে তার কাছ থেকে রিপোর্ট চান।’
নুরুল আমিন বললেন, ‘আপনাদের কথামতো চললে সরকার চালানো যাবে না।’
.
নুরুল আমিন সরকার আওয়ামী মুসলিম লীগকে ভীষণ ভয় পায়। তারা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুজনকেই অন্তরীণ রাখতে চায়। এবং সাধারণ সম্পাদক অসুস্থ হয়ে পড়েছে, এটা মুসলিম লীগ সরকারের জন্য একটা বিরাট উপশম বলে প্রতিভাত হয়।