উষার দুয়ারে – ১৫
১৫.
আনিসুজ্জামানের হাতে একটা মর্নিং নিউজ। একটা এক কলাম খবর, বক্স করে ছাপানো। শিরোনাম—’শেলীজ ওন শপ’। খবরে বলা হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ওরফে শেলী, যিনি ১৯৫১ সালে ইতিহাসে এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছিলেন, তিনি যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসাবে। পুলিশ রিপোর্ট খারাপ হওয়ায় তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চাকরিচ্যুত করেছে। প্রতিবাদে তিনি গলায় ট্রে ঝুলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সিগারেট বিক্রি করছেন। তার সেই ভ্রাম্যমাণ দোকানের নাম দিয়েছেন ‘শেলীজ ওন শপ’।
.
আনিসুজ্জামান বেরিয়ে পড়লেন শেলীজ ওন শপের সন্ধানে। ভ্ৰাম্যমাণ দোকান। কখন কোথায় যায়, কে জানে। আনিসুজ্জামান একে-ওকে জিগ্যেস করলেন, কেউ শেলী সাহেবের দোকান দেখেছে কি না!
সন্ধ্যার সময় কলাভবনের গেটের বাইরে দেখা মিলল দোকানের, এবং ঝুলন্ত দোকানের মালিক মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের। ‘আমার নাম আনিসুজ্জামান, জেলখানায় আপনার রুমমেট ছিল যে নেয়ামাল বাসির, সে আমার বিশেষ বন্ধু, ছাড়া পেয়ে সে প্রথম আমাদের বাসায় এসেই উঠেছে।’
মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান সঙ্গে সঙ্গেই আনিসুজ্জামানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। বললেন, ‘আসুন আসুন, নেয়ামাল বাসির খুব ভালো মানুষ। ‘
আনিসুজ্জামান বললেন, ‘পুলিশ রিপোর্ট খারাপ দেওয়ায় আপনাকে চাকরিচ্যুত করল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অবস্থা নাকি?”
‘আপনিও মর্নিং নিউজ পড়েছেন নাকি? না না। ওরা ঠিক লেখেনি। আমি যখন জেলখানায়, তখন ডিপার্টমেন্টে বেশ একটা অস্বস্তি তৈরি হয়। সেটা জানার পর আমিই চাকরি ছেড়েছি। আমাকে কেউ চাকরিচ্যুত করেনি। সিগারেট নেবেন?’
‘না। আমি তো স্মোক করি না।’ আনিসুজ্জামান বললেন।
.
কলাভবনের সামনের আমগাছের ডালে ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি বলাবলি করতে লাগল, ‘এই হাবিবুর রহমান একদিন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হইবেন, তারপর সরকারের প্রধানও হইবেন কিছুদিনের লাইগা, কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে
১৬.
তাঁতীবাজারে ভাড়া বাসায় থাকেন শেখ মুজিব। তাঁরা থাকেন নিচতলায়। এই বাসায় আরও থাকেন আবদুল হামিদ চৌধুরী, মোল্লা জালালউদ্দিন আর আবুল হুসেন। তাঁরা সবাই আইনের ছাত্র। কেউ পাস করেছেন, কেউ পড়ছেন। রান্নার জন্য লোক রাখা আছে। নিয়মিত রান্না হয়, বন্ধু বা অতিথি কেউ এই বাড়িতে এলে এদের চমৎকার ব্যবহার আর গরম মাছ-ভাতের আপ্যায়নে পরিতৃপ্ত হয়েই তবে ফিরতে পারে।
শেখ মুজিবুর রহমানের নিয়মিত রুটিন হলো সকালবেলা নবাবপুরে পার্টি অফিসে যাওয়া। সেখানে অফিসের কাজকর্ম সেরে চিঠিপত্র মুসাবিদা করা হলে স্বাক্ষর করে জেলায় জেলায় পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করা। কর্মী-সমর্থক কেউ এলে তাদের সময় দেওয়া। এই বাড়িতেই ইত্তেফাক-এর কর্ণধার তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াও সপরিবারে থাকেন। ইত্তেফাক এখন খুবই জনপ্রিয়। কাগজের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। সেটাও একটা দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে মানিক মিয়ার এবং শেখ মুজিবের। কারণ যত বিক্রি বাড়ছে, তত লোকসান। বিজ্ঞাপন তো পাওয়া যায় না। অতএব শেখ মুজিবকে বেরিয়ে পড়তে হয়। তিনি সমর্থকদের বাড়ি বা অফিসে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে দেখা করেন। ইত্তেফাক-এর জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। দুপুর দুটোর দিকে ফিরে আসেন তাঁতীবাজারের বাড়িতে। পুরোনো আদালতের পেছনে এই বাড়ি। মধ্যাহ্নভোজ সেরে ছোটখাটো একটা ঘুম দেন। বিকালবেলা পার্টির কর্মী আর বন্ধুবান্ধব এসে ভিড় করে। এই বাড়ির অন্য বাসিন্দারাও সবাই পার্টির জন্য যথাসাধ্য পরিশ্রম করেন। ফলে তাঁদের আড্ডা জমে ভালো। চারটা-পাঁচটার মধ্যেই সবাই মিলে বেরিয়ে পড়েন পার্টির কার্যালয়ের উদ্দেশে। আটটা-নটা পর্যন্ত পার্টি অফিস জমজমাট থাকে।
পার্টি অফিসে বসে মুজিব চিঠিপত্র লেখেন পার্টির বিভিন্ন জেলা শাখার নেতাদের। তাতে থাকে সাংগঠনিক পরামর্শ।
তিনি একটা চিঠি লিখলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজের মাকে। খালেক নেওয়াজ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী।
খালেক নেওয়াজের মাকে আম্মা সম্বোধন করে তিনি লিখলেন :
আম্মা,
আমার ভক্তিপূর্ণ সালাম নিবেন। আপনি আমাকে জানেন না—তবু লিখতে বাধ্য হচ্ছি। আপনার ছেলে খালেক নেওয়াজ আজ জেলখানায়। এতে দুঃখ করার কারণ নাই। আমিও দীর্ঘ আড়াই বৎসর কারাগারে কাটাতে বাধ্য হয়েছি। দেশের ও জনগণের দুঃখ- দুর্দশা দূর করার জন্যই আজ সে জেলখানায়। দুঃখ না করে গৌরব করাই আজ আপনার কর্তব্য। যদি কোনো কিছুর দরকার হয়, তবে আমাকে জানাতে ভুলবেন না। আমি আপনার ছেলের মতো। খালেক নেওয়াজ ভালো আছে। জেলখানা থেকেই পরীক্ষা দিচ্ছে। সে মওলানা ভাসানী সাহেবের সাথে আছে।
আপনার স্নেহের
শেখ মুজিবুর রহমান।
.
আজ দুপুরে একটা দাওয়াত আছে শেখ মুজিবের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকর্মী মোশারফ হোসেন চৌধুরী এমএ পাস করেছে। তাই সে নেমন্তন্ন করেছে মুজিবসহ তাঁর প্রিয় ও ঘনিষ্ঠ কিছু মানুষকে। গেন্ডারিয়ায় তাঁর বাড়ি। বাবা-মার সঙ্গে থাকে সে। বেলা একটার দিকে মুজিব মোশারফের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলেন।
শেখ মুজিবের গায়ে পপলিনের সাদা শার্ট, পরনে সাদা পায়জামা, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। অতিথিদের একজন আরেকজনকে ফিসফিস করে বলল, ‘মুজিব ভাই তো অসুখের পরে বেশ ভারিক্কি হয়েছেন।’
এই অতিথিদের মুজিব আগে থেকেই চেনেন। তিনি পুরোনো মানুষদের সঙ্গে এই পুনর্মিলনীতে খুব খুশি। খাওয়াদাওয়া হলো, গল্পগুজব হলো তারও চেয়ে বেশি।
কথায় কথায় মুজিব বলতে লাগলেন বিনা টিকিটে রেলগাড়িতে দিল্লি থেকে কলকাতা ফেরার গল্প, ‘আমি তখন ইসলামিয়া কলেজে আইএ পড়ি। বেকার হোস্টেলে থাকি। আমাদের মধ্যে তখন দুটো গ্রুপ। আমার একটা গ্রুপ। আর আনোয়ারের একটা গ্রুপ। দিল্লিতে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সম্মেলন হবে। আমাকে ডেলিগেট করা হয়েছে আগেই। আর আমার গ্রুপে ডেলিগেট হলো আমার খালাতো বোনের ছেলে মাখন। মাখন ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সেক্রেটারি। আমার সমর্থনে সে জয়লাভ করেছে। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল বরিশালের নুরুদ্দিন। সে আনোয়ারের দলের। সেই কারণেই হেরেছে। আমার দলে থাকলে হারত না। যা-ই হোক, আনোয়াররাও যাবে দিল্লি। আমার তো টাকার সোর্স আব্বা, রেনু। মাঝেমধ্যে মা। মাখনের অবশ্য টাকার অভাব নাই। ওর বাবা-মা দুজনেই যদিও ওর ছোটবেলায় মারা গেছেন, কিন্তু টাকাপয়সা-ধনসম্পত্তি রেখে গেছেন প্রচুর।
‘দুই মামা-ভাগনে আমরা উঠে বসলাম ট্রেনে। দুজনের দিল্লিতে কী পরিমাণ টাকা লাগতে পারে, সেই আন্দাজে আমরা টাকা নিয়েছি। আনোয়ারের দলও উঠল একই ট্রেনে। কিন্তু ওরা উঠল আলাদা কামরায়।
দিল্লি পৌছুলাম। মুসলিম লীগ স্বেচ্ছাসেবক দল আমাদের পৌঁছে দিল অ্যাংলো অ্যারাবিয়ান কলেজে। সেখানে কলেজ মাঠে তাঁবুতে থাকতে হবে।
‘শরীর আমার খারাপ হয়ে গেল। দিনের বেলা বেজায় গরম, রাতের বেলা ভীষণ ঠান্ডা। সকালে আর বিছানা থেকে উঠতে পারছি না। বুকে, পেটে, সারা শরীরে ভীষণ বেদনা। পায়খানা হয় না। যন্ত্রণায় কাতর হয়ে পড়লাম। মাখন আমার পাশে বসে আছে। মামা, কী করব? ডাক্তার ডাকতে হবে, মাখন তো কাউকে চেনে না, আমিও চিনি না। একজন ভলান্টিয়ারকে বলা হলো, সে জবাব দিল, আভি নেহি, থোড়া বাদ। তাকে আর দেখা গেল না। থোড়া বাদ থোড়া বাদই রয়ে গেল। মাখন বলল, মামা, আমি যাই, দেখি, যেখান থেকে পারি, একজন ডাক্তার ধরে আনি। সে যখন বের হতে যাবে, তখনই এসে হাজির হলেন খলিল ভাই। খলিল ভাই আলিয়া মাদ্রাসার আমাদের বড় ভাই। এক বছর আগে আলিয়া মাদ্রাসা থেকে পাস করে দিল্লি এসেছেন, হেকিমি পড়ছেন। তিনি থাকতেন ইলিয়ট হোস্টেলে। আমরা ঠাট্টা করে বলতাম, ইডিয়ট হোস্টেল। তিনি মাখনকে বললেন, ডাক্তার ডাকতে হবে না। আমি ডাক্তার নিয়ে আসছি। তিনি বেরিয়ে গেলেন। আধঘণ্টা পরে একজন হেকিম নিয়ে এলেন। হেকিম আমাকে পরীক্ষা করে ওষুধ দিলেন। তিনি আমাকে বললেন, ভয় নাই, ওষুধ খাওয়ার পরে তিনবার পায়খানা হবে। রাতে আর কিছু খাবেন না। ভোরে এই ওষুধটা খাবেন। বিকালে আপনি ভালো হয়ে যাবেন। আমি ওষুধ খেলাম। তিনি যা হবে বলেছিলেন, একেবারে তা অক্ষরে অক্ষরে ফলল।
‘আমি পরের দিন সুস্থ হয়ে গেলাম।
‘খলিল ভাই আমাদের সঙ্গে থেকে আমাদের দিল্লি ঘুরে ঘুরে দেখাবেন।
‘এই সময় আনোয়ারের দলের নুরুদ্দিন আমাদের তাঁবুতে এসে হাজির। সে বলল, আনোয়ারের সাথে আমার ঝগড়া হয়েছে। আমি এখানে যদি মরেও যাই, এখানেই থাকব, কিন্তু আনোয়ারের কাছে আর ফিরে যাব না। আমি বললাম, ঠিক আছে, তুমি থাকো আমাদের সাথে।
‘নূরুদ্দিন বলল, আমার কাছে কিন্তু কোনো টাকাপয়সা নাই। আনোয়ার সব রেখে দিয়েছে।
‘আচ্ছা সে দেখা যাবে পরে। থাকো তো।
‘আমরা আরও তিন দিন থাকলাম। খলিল ভাইয়ের সঙ্গে বেরিয়ে লালকেল্লা, জামে মসজিদ, কুতুবমিনার, নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগা সব দেখে ফেললাম। টাকাপয়সা আরও খরচ হয়ে গেল।
‘দিল্লি রেলস্টেশনে এসে টাকা গুনে দেখলাম, টাকা যা আছে, তাতে তিনজনের টিকেটের দাম হয় না।
‘তিনজনে মিলে পরামর্শ করে ঠিক করা হলো, একটা টিকেট কাটা হবে। আর সার্ভেন্ট ক্লাসে উঠে পড়ব। ফার্স্ট ক্লাস প্যাসেঞ্জারদের চাকরবাকরদের জন্য তাঁদের কামরার পাশে একটা ছোট্ট কামরা থাকে। সাহেবদের ফুট-ফরমাশ খাটা হয়ে গেলে এই ছোট কামরায় বসে থাকে চাকরেরা। আমরা একটা থার্ড ক্লাস টিকেট কাটলাম হাওড়া পর্যন্ত। আর দুটা কিনলাম প্ল্যাটফর্ম টিকেট। এইভাবে তিনজনে স্টেশনের ভেতরে ঢুকলাম। মাখনের চেহারা খুব সুন্দর। কেউ দেখলে কোনো দিনও বিশ্বাস করবে না সে চাকর হতে পারে। নুরুদ্দিন খবর আনল, খান বাহাদুর আবদুল মোমেন সাহেব একটা ফার্স্ট ক্লাস বগিতে যাচ্ছেন। নুরুদ্দিন তাঁকে চিনত। আমরা তাঁর সার্ভেন্টস ক্লাসে উঠে পড়লাম। মাখনকে উপরে বার্থে শুয়ে পড়তে বললাম। কেউ এলে আমরা নুরুদ্দিনকে ঠেলে দেব সামনে, এই হলো প্ল্যান। খান বাহাদুর মোমেন সাহেব রেলওয়ে বোর্ডের মেম্বার ছিলেন। কাজেই আশা, কেউ তাঁর সার্ভেন্টস রুমে আসবে না। একবার এক চেকার এল। জিজ্ঞাসা করল, তোমরা কোন সাহেবের লোক। নুরুদ্দিন জবাব দিল,
মোমেন সাব কা। চেকার চলে গেল।
‘ভাত খাওয়ার পয়সা নাই। মাঝেমধ্যে ফলফলাদি কিনে এনে খাওয়া হলো। কোনোরকমে হাওড়া পৌঁছা গেল।
‘গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গে মাখন নেমে গেল। আমরা দুইজন ময়লা জামাকাপড় পরে আছি। আমার চোখের চশমা লুকিয়ে রেখেছি। কেউ দেখলে বিশ্বাস করবে না চশমা পরা লোক চাকর হতে পারে। মাখন মালপত্র নিয়ে সম্বলমাত্র টিকেট খানি নিয়ে বেরিয়ে গেল। যা-ই হোক, মালপত্র কোনো এক জায়গায় রেখে তিনটা প্ল্যাটফর্ম টিকেট কিনে ফিরে এল। আমরা সেই তিনখানা টিকেট তিনজনের হাতে রেখে বেরিয়ে আসলাম। হাঁটতে পারছি না। ক্ষুধায় কাহিল। হিসাব করে দেখা গেল, আর এক টাকা আছে অবশিষ্ট বাসে চড়ে চলে আসলাম বেকার হোস্টেলে।’
সেই গল্প শুনে সবার কী হাসি!
.
দাওয়াত খেয়ে গল্পগুজব করে মোশারফের বাসা থেকে মুজিব বেরিয়ে এলেন যখন, তখন রোদ বেশ মরে এসেছে। বেরিয়েই বারান্দায় তাঁর চোখ পড়ল স্পেশাল ব্রাঞ্চের দুই সদস্যের ওপর। এরা তাঁকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে। যখন তিনি রিকশায় বা টমটমে ওঠেন, তখন এরা সাইকেল চালিয়ে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে চলে। যখন তিনি হাঁটেন, তখন সাইকেল ঠেলে নিয়ে এরাও হাঁটে।
মুজিব বললেন, ‘এই, তোমরা কখন থেকে এখানে এসেছ?’
ওরা কাঁচুমাচু ভঙ্গি করে।
মুজিব জিগ্যেস করলেন, ‘এই, তোমরা দুপুরে খেয়েছ?’
‘জি না।’
‘খাও নাই কেন?’
‘আপনি যে এখানে অনেকক্ষণ থাকবেন, সেটা বুঝতে পারি নাই।’
‘একজন একজন করে খেয়ে আসলেও তো পারতা? মিয়ারা, কতক্ষণ না খেয়ে থাকবা? যাও, খেয়ে আসো।’
‘আপনি তো এখন চলে যাবেন। আমরা পরে খাব। এখন আপনাকে ফলো করব।’
‘মুশকিল হলো তো! মোশারফ। ভাই, আমার যে আরও দুজন অতিথি আছে সঙ্গে। তাদেরকেও যে তোমার খাওয়াতে হয়।
মোশারফ বলল, ‘মুজিব ভাই, এইটা কোনো ব্যাপার নাকি। ভাই, আপনারা আসেন, ভেতরে আসেন। ‘
মুজিব হেসে বললেন, ‘যাও, বাড়ির ভিতরে যাও। আমি আরও খানিকক্ষণ বসতেছি। তোমরা ততক্ষণে খেয়ে নাও। নুরুল আমিন সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের কপালে এই কষ্টই লেখা। শেখ মুজিবররে ফলো করলে কখনো খাওয়া পাবা, কখনো পাবা না। আসো আসো, ভিতরে আসো।’
১৭.
কারাগারে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে দেখা করে এসেছেন মুজিব। আতাউর রহমান খানসহ পার্টির নেতাদের সঙ্গে আলাপ করেছেন। শেখ মুজিব করাচি যাবেন, এই হলো পার্টির সিদ্ধান্ত। করাচিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন তিনি। পার্টির নেতাদের প্রায় সবাই কারান্তরালে। শুধু কি পার্টির নেতারা? ছাত্র-শিক্ষকসহ সমাজের নানা ধরনের মানুষ বিনা বিচারে কারাগারে আটক হয়ে আছেন। শহীদুল্লা কায়সার, মুনীর চৌধুরী, অজিত গুহ, মোজাফফর আহমদ চৌধুরী মতো অধ্যাপকেরা জেলে। তাঁকে অবশ্যই রাজবন্দীদের মুক্তি দাবি করতে হবে। কিন্তু আরেকটা কাজ করার জন্য তাঁর হৃদয় চঞ্চল হয়ে আছে। তিনি একটুও শান্তি পাচ্ছেন না। তাঁর নেতা সোহরাওয়ার্দী কী করে বলেন উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নিতে? তিনি সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে সেই কথাটা জিগ্যেস করতে চান।
পাকিস্তানের রাজধানী করাচি। করাচির ভূপ্রকৃতি শেখ মুজিবের একদমই পছন্দ হলো না। এ যে মরুভূমি। চারদিকে পাষাণবালু। তিনি বিড়বিড় করতে লাগলেন, ‘আমরা জন্মগ্রহণ করেছি সবুজের দেশে। মরুভূমির এই বালুরাশি আমাদের পছন্দ হবে কেন? প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের মনেরও একটা সম্বন্ধ আছে। বালুর দেশের মানুষের মন বালুর মতোই উড়ে বেড়ায়। আর পলিমাটির দেশ বাংলার মানুষের মন ওই রকমই নরম, ওই রকমই সবুজ। প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্যের মধ্যে আমাদের জন্ম, সেই সৌন্দর্যই আমরা ভালোবাসি।’
প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনকে চিঠি দিয়েছেন মুজিব সাক্ষাতের অভিপ্রায় জানিয়ে। সেই চিঠির উত্তর এসেছে। খাজা নাজিম উদ্দিন মুজিবকে সময় দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গেলেন মুজিব। তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন খাজা সাহেবের ব্যক্তিগত সহকারী সাজেদ আলী। মুজিব তাঁকে চেনেন কলকাতার দিনগুলো থেকে। এই ভদ্রলোক এর আগে ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তানের চিফ মিনিস্টারেরও পিএ ছিলেন। পিএর রুমেই প্রথমে বসলেন মুজিব।
খাজা নিজে এলেন পিএর রুমে। মুজিবকে স্বাগত জানিয়ে নিজের কক্ষে নিয়ে গেলেন। খাতির করে বসালেন।
জিগ্যেস করলেন, ‘তোমার শরীরটা এখন কেমন?’
‘শরীর তো খুবই খারাপ হয়ে পড়েছিল। ব্লাড ডিসেন্ট্রিতে ভুগেছি। এখন যথেষ্ট ভালো আগের চেয়ে।
‘কত দিন থাকবে করাচিতে?’
‘করাচিতে হয়তো বেশি দিন থাকা হবে না। তবে এসেছি যখন, পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু জায়গা দেখে যেতে চাই।’
মুজিবের মনে পড়ে যেতে লাগল কলকাতার দিনগুলো। একই দল ছিল তাঁদের। লক্ষ্যও এক ছিল। মুজিব যে মুসলিম লীগের কত বড় নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ছিলেন, এটা খাজারও জানা।
মুজিব বললেন, ‘মওলানা ভাসানী, শামসুল হক, আবুল হাশিম, মাওলানা তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন, খান সাহেব ওসমান আলী—সবাই এখন জেলখানায়। আরও আটক আছেন অনেক অধ্যাপক, কবি-সাহিত্যিক, ছাত্রকর্মী। ভাষা আন্দোলনের সমস্ত রাজবন্দীকে মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা আপনি করেন। আর একটা জুডিশিয়াল এনকোয়ারি কমিটি করেন, কেন ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করা হলো?’
খাজা বললেন, ‘এটা তো আমার হাতে না। এটা প্রাদেশিক সরকারের হাতে। আমি কী করতে পারি?’
‘আপনি মুসলিম সরকারের প্রধানমন্ত্রী। আর পূর্ব বাংলায়ও মুসলিম লীগ সরকার। আপনি তাদের নিশ্চয়ই বলতে পারেন। আপনি কি চান যে দেশে বিশৃঙ্খলা হোক। নিশ্চয়ই চান না। আমরাও চাই না। আমি করাচি পর্যন্ত এসেছি আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে; কারণ, আমি জানি, প্রাদেশিক সরকারের কাছে দাবিদাওয়া পেশ করে কোনো লাভ হবে না। তারা অন্যায় করেছে। সেই অন্যায় ঢাকার জন্য তাঁরা একের পর এক অন্যায় করেই চলেছে।’
মাথার ওপরে ফ্যান ঘুরছে। একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্রও চলছে। মরুভূমির এই দেশ খুবই গরম।
মুজিব বসে আছেন একটা সোফায়। তার পাশে এসে বসেছেন প্রধানমন্ত্রী। সেক্রেটারিয়েট টেবিলটা কক্ষের অপর পাশে।
চা এসেছে। সেই চা ঠান্ডা হয়েও গেছে। মুজিবের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতের সময় বরাদ্দ ছিল ২০ মিনিট। কখন যে এক ঘণ্টা অতিবাহিত হয়ে গেছে, দুজনের কেউই টের পাননি।
মুজিব বললেন, ‘আপনি স্বীকার করেন কি না যে আওয়ামী লীগ বিরোধী পার্টি? আপনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তা আমি জানি। বিরোধী দল না থাকলে তো গণতন্ত্র চলতে পারে না। আপনি বলেন, আপনি স্বীকার করেন কি না আওয়ামী লীগ বিরোধী দল?’
খাজা বললেন, ‘হ্যাঁ। নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ বিরোধী দল।’
‘আপনি যে স্বীকার করে নিলেন আওয়ামী লীগ বিরোধী দল, এই কথাটা
আমি খবরের কাগজে দিতে পারি কি না?’
‘নিশ্চয়ই দিতে পারো।’
‘তাহলে বিরোধী দলকে আপনার কাজ করতে দিতে হবে। তা না হলে গণতন্ত্র থাকে না।’
‘আমি প্রদেশের কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করি না। তার পরও আমি চেষ্টা করে দেখব, কত দূর কী করতে পারি।’
শেখ মুজিব উঠে পড়লেন। নাহ্, অনেক বেশি সময় নিয়ে নেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর। তিনি তাঁকে সম্মান দেখিয়ে আদাব জানিয়ে বিদায় নিলেন।
দুদিন পর করলেন সাংবাদ সম্মেলন। পাকিস্তানি সাংবাদিকেরা তাঁকে ছেঁকে ধরল মৌমাছির ঝাঁকের মতো।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবি নিয়ে তাদের অনেক প্রশ্ন। মুজিব বুঝিয়ে বললেন, জানালেন, বাঙালির দাবি ন্যায্য, কারণ বাঙালিরাই পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু আর তা সত্ত্বেও বাঙালিদের দাবি বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা। ওই আন্দোলন হিন্দুদের নয়, ভারত থেকে আসা এজেন্টদের নয়, কমিউনিস্টদের নয়। জানালেন, আন্দোলনে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, সবাই মুসলমান। বললেন, ‘কত নেতা গ্রেপ্তার হয়ে আছেন কারাগারে, তাঁদের সবাই তো পূর্ব বাংলার লোক, অনেকেই আওয়ামী লীগের নেতা, মওলানা ভাসানী সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক, সবাই তো কারাগারে
তিনি আরও বললেন, ‘পূর্ব বাংলায় প্রায় ৩০টা উপনির্বাচন স্থগিত করে রাখা হয়েছে। কারণ আগের উপনির্বাচনে শামসুল হকের কাছে মুসলিম লীগ প্রার্থী হেরে গেছে। পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগ এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় দল, মুসলিম লীগ জনগণের সমর্থন হারিয়েছে। যেকোনো একটা উপনির্বাচন দিক, মুসলিম লীগ প্রার্থীকে আমরা অবশ্যই শোচনীয়ভাবে পরাজিত করতে সমর্থ হব।’
করাচির রাজনৈতিক কর্মীরা আড্ডা দেয় সেখানকার কফি হাউসে। মুজিব গেলেন সেখানে। তাঁর সঙ্গী আমানুল্লাহ। আমানুল্লাহ বাঙালি ছাত্র। করাচিতে থেকে পড়াশোনা করে। শেখ মুজিবের সচিবের ভূমিকা পালন করছে সে। স্বেচ্ছায়, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে—সবকিছুতেই তার প্রবল উৎসাহ। করাচির কফি হাউস এক বাঙালি আমানুল্লাহ একাই গরম করে রাখে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে সে একাই লড়ে, তার যুক্তির কাছে অবাঙালিরা সব কুপোকাত হয়ে যায়।
আর শেখ মুজিবকে সঙ্গ দিচ্ছেন ও নানা কাজে সহায়তা করছেন করাচি আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মঞ্জুরুল হক।
এঁরা দুজনে মিলেই সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন।
মঞ্জুরুল জিপ চালাচ্ছেন। তার পাশে সামনের আসনে বসে আছেন মুজিব। জিপ চলছে মরুভূমির বালুময় পথে। লু হাওয়া বইছে যেন। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে মুজিবের। মুজিবেরা চলেছেন হায়দরাবাদ। মুজিব খানিকটা উত্তেজিত। কারণ, তিনি চলেছেন লিডার সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করতে। সোহরাওয়ার্দীর মতো ঝানু নেতা কী করে হিসাবে ভুল করেন? কী করে বলতে পারেন বাঙালিদের উচিত উর্দু মেনে নেওয়া। একটা বোঝাপড়া করবেন তিনি লিডারের সঙ্গে।
করাচির বাইরে চলে এল জিপ। এত ঘোরতর মরুভূমি। কোনো বাড়িঘর নাই। মাঝেমধ্যে দু-একটা ছোট বাজারের মতো চোখে পড়ে।
মুজিব বললেন মঞ্জুরুলকে, ‘তোমরা এই মরুভূমিতে থাকো কী করে?’ মঞ্জুরুলের এক হাত স্টিয়ারিঙে, এক হাত গিয়ারের হ্যান্ডেলে, দৃষ্টি সম্মুখপানে, তিনি বললেন, ‘বাধ্য হয়ে। মোহাজের হয়ে এসেছি। এখন এটাই তো আমাদের বাড়িঘর। এখানেই মরতে হবে আমাদের। দিল্লি তো তুমি দেখেছ। এই রকম মরুভূমি আগে দেখো নাই? প্রথম প্রথম খারাপ লেগেছিল। এখন তো সহ্য হয়ে গেছে। তবে আমরা মোহাজেররা যখন এসেছি, এই মরুভূমিকেই আমরা ফুলে-ফলে ভরে তুলব, একদিন দেখো।’
লিডার সোহরাওয়ার্দী থাকেন ডাকবাংলোয়। সোজা সেখানেই চলে গেলেন। লিডার বাইরে, রাতের আগে ফিরবেন না। তাঁরা একটা হোটেলে গিয়ে উঠলেন। হাতমুখ ধুলেন। খাওয়াদাওয়া করলেন। গড়িয়ে নিলেন। রাত নয়টায় এলেন সোহরাওয়ার্দীর ডাকবাংলোয়।
তিনি তখনো ফেরেননি।
তাঁরা অপেক্ষা করতে লাগলেন।
সোহরাওয়ার্দী ফিরলেন রাত ১০টায়। মুজিবকে দেখেই বললেন, ‘কী, খুব প্রেস কনফারেন্স করা হচ্ছে?’
মুজিব হেসে বললেন, ‘কী আর করব?’
.
কুশল বিনিময়ের পর মুজিব এলেন আসল কথায়?
‘এটা আপনি কী করেছেন?’
সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘কী করেছি!’
‘রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে আপনার মত খবরের কাগজে বের হয়েছে।’ ‘কী বের হয়েছে?’
‘কাগজগুলোয় বের হয়েছে, আপনি বলেছেন, বাঙালিদের উচিত উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেওয়া।’
সোহরাওয়ার্দীর চোখমুখ লাল হয়ে গেল। তিনি হাত দুটো একত্র করে আঙুলের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে বুকের কাছে নিয়ে নাড়তে নাড়তে রাগী গলায় বললেন, ‘এ কথা তো আমি কোনো কাগজে বলি নাই। উর্দু ও বাংলা—দুইটা হলে আপত্তি কী! তাই বলেছিলাম। ছাত্রদের ওপরে গুলিবর্ষণের প্রতিবাদ করেছি, পূর্ব বাংলার মানুষদের ওপরে যে অত্যাচার করা করা হচ্ছে, তার নিন্দা জানিয়েছি।’
সেসব কথা কোনো কাগজে পরিষ্কার করে ছাপা হয় নাই। পূর্ব বাংলার জনগণ আপনার কথা কাগজে যা পড়েছে, তাতে খুবই মর্মাহত হয়েছে।’
অনেক রাত হয়ে গেছে। কথা শেষ হলো না। সেদিন মঞ্জুরুল ও মুজিব ফিরে গেলেন হোটেলে। পরের দিন মঞ্জুরুল করাচি চলে যাবেন। যাওয়ার আগে মুজিবের কাছে রেখে গেলেন মাসুদকে। মাসুদ আগে নিখিল ভারত স্টেট মুসলিম লীগের সেক্রেটারি ছিলেন। এখন হায়দরাবাদবাসী। সোহরাওয়ার্দীর ভক্ত। সোহরাওয়ার্দী করাচিতে জিন্নাহ আওয়ামী লীগ গঠন করেছেন। মাসুদ সেই পার্টি গঠনে সহায়তা করেছেন।
আওয়ামী লীগের আগে জিন্নাহ শব্দটা বসানোটা আবার মুজিবের পছন্দ নয়। পূর্ব বাংলার আওয়ামী মুসলিম লীগ সভায় এই ব্যাপারটা নিয়ে কথা হয়েছে। তাঁদের স্পষ্ট সিদ্ধান্ত, কোনো ব্যক্তির নামে পার্টির নামকরণ করা যায় না। তাঁরা কিছুতেই নাম পরিবর্তন করবেন না।
মঞ্জুরুল বিদায় নিলেন। মাসুদকে নিয়ে দুপুরবেলা মালপত্রসমেত হোটেল ছেড়ে দিয়ে চলে এলেন সোহরাওয়ার্দীর ডাকবাংলোয়।
লিডারের সঙ্গে দেখা হলো। মুজিব খেয়াল করে দেখলেন, সোহরাওয়ার্দী কয়েকটা বিস্কুট আর হরলিক্স্ খেলেন। এটাই কি তার দুপুরের খাবার?
মাসুদ চলে গেলেন। মুজিব রয়ে গেলেন সোহরাওয়ার্দীর বাংলোয়। অতিথি আরেকজন আছেন। পেশোয়ার থেকে আসা এক অ্যাডভোকেট। রাতের খাওয়ায় মুজিব আর সেই অ্যাডভোকেট সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে শামিল হলেন। বিস্কুট, মাখন আর রুটি। শেখ মুজিব বললেন, ‘এভাবে চলে কেমন করে? বাড়িতে তো আর কাউকে দেখিও না। সবকিছু একা একা করেন। এইভাবে চলতে পারে?’
সোহরাওয়ার্দী হেসে বললেন, ‘চলে তো যাচ্ছে।’
খাওয়ার পর আবার রাজনীতির কথা শুরু হয়। ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ তো আমাদের পার্টির সঙ্গে অ্যাফিলিয়েশন নেয় নাই। আমি তো তোমাদের কেউ না।’
মুজিব তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে বললেন, ‘প্রতিষ্ঠান না গড়লে কার কাছ থেকে অ্যাফিলিয়েশন নেব। আপনি তো আমাদের নেতা আছেনই। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ তো আপনাকে নেতা মানে, এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণও আপনাকে নেতা মানে। আপনাকে সমর্থন করে। কিন্তু আপনি জিন্নাহ আওয়ামী লীগ করেছেন। আমরা আমাদের পার্টির নাম বদলাতে পারব না। কোনো ব্যক্তির নাম রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত করতে চাই না। দ্বিতীয়ত, আমাদের ম্যানিফেস্টো আছে, গঠনতন্ত্র আছে, সেসবের পরিবর্তন সম্ভব নয়। মওলানা ভাসানী ১৯৪৯ সালেই আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছিলেন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠনের জন্য। তাঁরও কোনো আপত্তি থাকবে না, যদি আপনি আমাদের ম্যানিফেস্টো আর গঠনতন্ত্র মেনে নেন।’
রাত বাড়ছে। অ্যাডভোকেট সাহেব হাই তুলে ঘুমোতে চলে গেলেন। মুজিব আর সোহরাওয়ার্দী কথা বলেই চলেছেন। মুজিবের আজ ভাত খাওয়া হয় নাই। রুটি খেলে কি বাঙালির রাতের খাওয়া হয়। যা-ই হোক, তিনি পার্টির আলাপ নিয়ে এতই মগ্ন যে ভাত না খাওয়ার দুঃখ তিনি ভুলে রইলেন।
সোহরাওয়ার্দী শেষ পর্যন্ত মুজিবের প্রস্তাব মেনে নিলেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র, ম্যানিফেস্টো মেনে নিতে রাজি। মুজিব বললেন, ‘আপনি নিজের হাতে এই কথা লিখে দেন। আর আপনার নিজের হাতে এ কথাও লিখে দেন যে, আপনি বাংলা ও উর্দু—দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে। আর ফেব্রুয়ারিতে গুলিবর্ষণের ও বাংলা ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর সরকারি জুলুম-নির্যাতনের প্রতিবাদ করছেন।
সোহরাওয়ার্দী কী বলেন, তা শোনার জন্য মুজিব তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।
একটুখানি থেমে সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘দাও লিখে দিচ্ছি। এটা তো আমার নীতি ও বিশ্বাস।’
সোহরাওয়ার্দী স্বহস্তে লিখে দিলেন মুজিবের প্রস্তাবমতো। বিবৃতি দুটোর নিচে স্বাক্ষর করলেন। তারিখ দিলেন।
মুজিব কাগজ দুটো নিজের সুটকেসের পকেটে রাখলেন।
তিনি এখন অনেকটাই স্বস্তি বোধ করছেন।
মুজিব সোহরাওয়ার্দীকে জিগ্যেস করলেন, ‘লিডার, পিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলা সত্য কি না। আসামিদের কি রক্ষা করতে পারবেন? আর ষড়যন্ত্র করে থাকলে তাঁদের শাস্তি হওয়া উচিত কি না?’
সোহরাওয়ার্দী খেপে গেলেন। তাঁর চোখেমুখে যেন রক্ত উঠে এসেছে। বললেন, ‘এই প্রশ্ন কোরো না। কারণ, অ্যাডভোকেট হিসাবে আমাকে শপথ নিতে হয় মামলার সম্বন্ধে তৃতীয় পক্ষকে কিছু না বলতে। এই শপথ আমি ভঙ্গ করতে পারব না।
পিন্ডি চক্রান্ত মামলায় সোহরাওয়ার্দী আসামিপক্ষের উকিল। রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা। পাঞ্জাবের কেউ আসামিপক্ষের উকিল হতে রাজি নয়। জেনারেল আকবর খানের স্ত্রী নাসিমা খান খুব করে ধরলেন সোহরাওয়ার্দীকে। সোহরাওয়ার্দী রাজি হলেন মামলায় আসামিপক্ষের হয়ে লড়তে।
জেনারেল আকবর খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি কমিউনিস্টদের সঙ্গে পিন্ডিতে মিলিত হয়ে সরকার উৎখাতের ও দেশে রুশ কমিউনিস্ট শক্তিকে ক্ষমতায় বসানোর চক্রান্ত করছেন। আকবর খান তখন ছুটিতে। তিনি পিন্ডিতে সফররত কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ ও সাজ্জাদ জহির বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেন নৈশভোজে। ওই সময় ছুটিতে থাকা আরও কিছু সামরিক অফিসার তার বাড়িতে অংশগ্রহণ করে।
আইয়ুব খান সেনাবাহিনীপ্রধান।
তিনি খবর পান, বা এই সুযোগটি কাজে লাগান যে, জেনারেল আকবর দেশের বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
আইয়ুব খানকে সেনাপ্রধান করায় সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ ছিল। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান সেনাবাহিনীর ব্যাপারটা কিছু বুঝতেন না। দেশরক্ষা সচিব ইস্কান্দার মির্জার পরামর্শে তিনি চলতেন। আইয়ুব খান আর ইস্কান্দার মির্জা মিলে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত খানকে বোঝালেন, এরা সরকার উৎখাত করার চক্রান্ত করছে। এদের গ্রেপ্তার করা হোক। এদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হোক।
লিয়াকত আলী খান কথাটা বিশ্বাস করলেন। কারণ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরুকে আমেরিকা আমন্ত্রণ করেছিল, আর লিয়াকত আলী খানকে উপেক্ষা দেখাচ্ছে, এরই প্রেক্ষাপটে সাজ্জাদ জহির এগিয়ে এসেছিলেন লিয়াকত আলীর উদ্ধারে। তিনি তাঁর পুরোনো সহযোগী, যখন লিয়াকত ভারতের অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থমন্ত্রী ছিলেন, তখন তার বাজেট-বক্তৃতা সাজ্জাদ জহির লিখে দিয়েছিলেন। সাজ্জাদ এসে বললেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমেরিকা নিমন্ত্রণ করেনি তো কী হয়েছে! আমি আপনাকে রাশিয়া থেকে আমন্ত্রণ এনে দিচ্ছি।’ সত্যি সত্যি রাশিয়ার আমন্ত্রণপত্র নিয়ে জহির হাজির হলেন। লিয়াকত বুঝলেন, কবি ফয়েজ আহমদ ফয়েজ আর সাজ্জাদ জহির আসলেই রাশিয়ার লোক। কাজেই আইয়ুব খান ও ইস্কান্দার মির্জার পরামর্শে জেনারেল আকবর আলী খানসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হলো। এটাই পিন্ডি বা রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলা বলে এখন বিখ্যাত হয়েছে।
সোহরাওয়ার্দী সেই মামলায় আসামিপক্ষের উকিল। জেরার জন্য আইয়ুব খান আদালতে হাজির।
আসামিপক্ষের উকিল সোহরাওয়ার্দী তাঁকে জেরা করছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে এই চক্রান্ত সম্পর্কে প্রথম কে খবর দেন?’
আইয়ুব খান বললেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহাবুদ্দিন।’
সোহরাওয়ার্দী : ‘সরকারের ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ বেশি দক্ষ, নাকি আমি ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ বেশি দক্ষ?’
আইয়ুব খান : ‘আর্মি ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ বেশি দক্ষ।’
সোহরাওয়ার্দী : ‘আর্মি ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ বেশি দক্ষ। তাহলে তো সর্বাগ্রে সেনাবাহিনীপ্রধানের কাছেই খবর আসা উচিত।’
আইয়ুব খান : ‘আমার কাছেই সবার আগে খবর এসেছিল। আমি চেক করছিলাম। এমন সময় উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের গভর্নর চুন্দ্রিগড় খবর পেয়ে প্রধানমন্ত্রীকে খবর দেন।’
সোহরাওয়ার্দী : ‘আপনি একটু আগে বললেন শাহাবুদ্দিন প্রধানমন্ত্রীকে খবর দিয়েছেন।’
আইয়ুব : ‘তারা দুইজনেই খবর দিয়েছেন। তবে কে আগে দিয়েছেন, আমি বলতে পারব না। আমার ঠিক স্মরণে আসছে না।’
সোহরাওয়ার্দী : ‘যারা আর্মিতে দ্রুত প্রমোশন পেয়েছেন, তাঁরা মামলাটি সাজিয়েছেন, তাঁদের অবস্থান ও ভবিষ্যৎকে নিষ্কণ্টক করার জন্য।’
আইয়ুব : ‘আমি এই ধরনের বাজে প্রশ্নের জবাব দিব না
জজ সাহেব বললেন, ‘আসামিপক্ষের অ্যাডভোকেটের প্রশ্নের জবাবে আপনি বলতে পারেন—হ্যাঁ; আপনি বলতে পারেন—না; আপনি বলতে পারেন—এটা সত্য নয়; কিন্তু হ্যাঁ বা না আপনাকে একটা কিছু বলতে হবে।’
আইয়ুব তখন তেলে-বেগুনে জ্বলছেন। তিনি বললেন, ‘আমি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীপ্রধান। আমাকে এই ধরনের প্রশ্ন করা ধৃষ্টতা ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল।’
জজ সাহেব বললেন, ‘এটা উকিলের এখতিয়ার। তিনি এ ধরনের প্রশ্ন করতে পারেন।
আইয়ুব খান বললেন, ‘আমি কিছু বলব না।’ তিনি কাঠগড়া থেকে নেমে গেলেন।
সোহরাওয়ার্দী মুজিবকে এসবের কিছুই বললেন না। শুধু বললেন, ‘অনেক রাত হয়েছে। ঘুমাতে যাও। কাল সকাল সকাল উঠতে হবে।’
.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ব্যাঙ্গমা দুই পাখা মেলে শূন্যে ভাসছে। কিন্তু এগোচ্ছে না, একটা জায়গায় স্থির হয়ে আছে। ব্যাঙ্গমি বলল, ‘ওই রকম আমিও পারি।’ সে-ও পাখা মেলে ব্যাঙ্গমার পাশে স্থির হয়ে ভাসতে লাগল। একটু একটু করে পাখা তাদের নাড়তে হচ্ছে।
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘আইয়ুব খান আর সোহরাওয়ার্দীর এই দড়ি-টানাটানির ঘটনা কিন্তু দুইজনের কেউই ভুলবেন না। ‘
ব্যাঙ্গমা বলল,
ঠিক কইছ বুড়ি তুমি কথা কইছ খাঁটি।
দুইজনেই মনে রাখব এই ঘটনাটি ॥
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘এর আগেও দুইজনের বাহাস হইছে। ১৯৪৮ সালে আইয়ুব খানের পোস্টিং হইছিল ঢাকায়। তখন রণদাপ্রসাদ সাহা, ওই যে ভারতেশ্বরী হোমস যিনি প্রতিষ্ঠা করছিলেন, তখন বিশাল বড়লোক, আইয়ুব খানরে নেমন্তন্ন করছিলেন ঢাকা ক্লাবে। সেদিন সোহরাওয়ার্দীও ঢাকায়। রণদাপ্রসাদ তাঁরেও নেমন্তন্ন করলেন। সোহরাওয়ার্দী সাদা প্যান্ট আর বুশ শার্ট পইরা হাজির হইলেন পার্টিতে। রণদাপ্রসাদ তাঁরে লইয়া গেলেন মেইন টেবিলে, আইয়ুব খানের লগে পরিচয় করায়া দিতে। সোহরাওয়ার্দী কইলেন, নাইস টু মিট ইউ, জেনারেল।
‘আইয়ুব খান তাঁরে বেশি পাত্তা দিলেন না। সোহরাওয়ার্দী গান্ধীজির লগে শান্তি মিশন কইরা বেড়াইছেন, এইটা তাঁর পছন্দ না। মন্ত্রীরা সেই আসরে উপস্থিত। হাবিবুল্লাহ বাহার কইলেন, পাকিস্তানের পশ্চিম অংশ ধরব অসি, আর পূর্ব বাংলার লোকেরা ধরব মসি। পূর্ব বাংলার লোকেরা শান্তিপ্রিয়, তারা যুদ্ধ করন জানে না। কিন্তু বীরের প্রশংসা কইরা গল্প কবিতা লেখবার পারে। আপনেরা আমগো বাঁচায়া রাখবেন আর আমরা আপনাগো সাহিত্যে ইতিহাসে অমর কইরা রাখুম।
‘সোহরাওয়ার্দী মুখ খুললেন। কইলেন, মাননীয় মন্ত্রী, আপনের কথা সংশোধন করতে হইব। বাঙালিরা নিজেরা যথেষ্ট সাহসী আর শক্ত। তারা নিজেরাই নিজেদের রক্ষা করতে পারে, পশ্চিমাগো লাগে না। আমি যহন প্রাইম মিনিস্টার আছিলাম, তখন শুনি, ঢাকার একটা বাচ্চা ছেলে আর একটা শিখের লগে মারামারি লাগছে। তখন ওই অসিওয়ালা অসি বাইর করছে। আর মসিওয়ালা তার অসি কাইড়া নিয়া তারই পেটে ঢুকায়া দিছে। নিরীহ শান্তিবাদী হইতে পারে। বিপদে পড়লে বাঘ হইয়া যায়।
‘হাবিবুল্লাহ বাহার চুপসায়া গেলেন। মন্ত্রীরা সবাই চুপ। জেনারেল আইয়ুব খান মহা বিরক্ত।
ব্যাঙ্গমা পাখা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘পরে আইয়ুব খানের বই বারাইব ১৯৬৭ সালে। হে কিন্তু সোহরাওয়ার্দীর এই দিনের আদালতের জেরায় নাজেহাল হওনের কথাটা ভুলেন নাই। আইয়ুব খান লেখবেন, সোহরাওয়ার্দী আছিলেন একটা জটিল চরিত্র। নাইট ক্লাবে যান। খুবই প্রাণশক্তি আর উদ্যম। উনি সাক্ষীদের জেরা করার সময় আর্মি অফিসারগো আক্রমণ কইরা খুব মজা পাইছেন। উনি অনেক বেশি বাড়াবাড়ি করছেন, আর আদালত তাঁরে বাধা দেন নাই। তখন আমার কিছু করনের আছিল না। আদালত অভিযুক্তদের অপরাধী বইলা রায় দিছে আর সাজা দিছে।’
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘সোহরাওয়ার্দীও পাকিস্তানের মন্ত্রী হইয়া সেই বন্দীদের ছাইড়া দেওনের ব্যবস্থা করছেন।
‘আর আইয়ুব খানরে ক্ষমতা থাইকা করুণভাবে বিদায় নিতে হইছে সোহরাওয়ার্দীর চ্যালা মুজিবের নেতৃত্বে গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়া।’
.
গাড়ি চলছে। বিকালবেলা। হায়দরাবাদ থেকে গাড়ি ছুটছে করাচির দিকে I গাড়ি চালাচ্ছেন সোহরাওয়ার্দী। পাশের আসনে বসে আছেন মুজিব। হায়দরাবাদের প্রকৃতি, ঘরবাড়ি, পরিবেশ দেখে নিচ্ছেন মুজিব!
গাড়ির পেছনের আসনে বসে আছেন কয়েকজন অ্যাডভোকেট। তাঁরা শেখ মুজিবকে জিগ্যেস করলেন, ‘আচ্ছা, বাংলা ভাষা আন্দোলন তো ভারতের ষড়যন্ত্র, তাই না? এটা তো হিন্দুরা চাইছে। মুসলমানরা তো সব উর্দুর পক্ষে? তাই না?’
মুজিব বললেন, ‘জি না। এটা হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধ—সব বাঙালিরই আন্দোলন। সবাই রাষ্ট্রভাষা বাংলা চায়। তবে মুসলমানরা যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ, কাজেই আন্দোলন করেছে মূলত পূর্ব বাংলার মুসলমানরাই। এর প্রমাণ হলো, যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের সবাই মুসলমান। যাঁরা ধরা পড়েছেন, তাঁদেরও প্রায় সবাই মুসলমান।’
সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘পূর্ব বাংলার মানুষ প্রায় সবাই বাঙালি। বাংলা ছাড়া তারা আর কোনো ভাষা জানে না। উর্দু তো একেবারেই জানে না। বাংলা খুব উন্নত ভাষা। কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও সাহিত্য খুবই উন্নত।’
একজন অ্যাডভোকেট পেছন থেকে বললেন, ‘শেখ সাহেব, তাহলে আপনি কাজী নজরুল ইসলামের একটা কবিতা শোনান না?’
মুজিব গড়গড় করে আবৃত্তি করতে লাগলেন,
গাহি সাম্যের গান—
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান।
গাহি সাম্যের গান!
সোহরাওয়ার্দী এই কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিতে লাগলেন।
সাম্যবাদী কবিতার পর মুজিব আবৃত্তি করলেন ‘নারী’ কবিতাটি—
সাম্যের গান গাই—
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।
বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
.
সোহরাওয়ার্দী সাহেবের গাড়ি মরুভূমি চিরে এগিয়ে চলেছে করাচির দিকে। মাঝেমধ্যে গিয়ার বদলের ফলে গাড়ির শব্দও বদলে যাচ্ছে।
সেই শব্দ ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে মুজিবের দরাজ কণ্ঠের কবিতা। মুজিব চার লাইন পর পর বিরতি দিচ্ছেন, আর সোহরাওয়ার্দী সেই পঙ্ক্তিগুলো ইংরেজিতে তরজমা করে শোনাচ্ছেন।
এবার পেছন থেকে এক অ্যাডভোকেটের অনুরোধ এল, ‘আপনি কি আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা শোনাতে পারেন?’
মুজিব বললেন, ‘নিশ্চয়ই।’ তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা অবলীলায় মুখস্থ বলে যেতে লাগলেন-
ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে
দয়াহীন সংসারে—
তারা বলে গেল ‘ক্ষমা করো সবে’, বলে গেল ‘ভালোবাসো—
অন্তর হতে বিদ্বেষবিষ নাশো’।
পেছন থেকে একজন অ্যাডভোকেট বললেন, ‘রবীন্দ্রনাথের কবিতার ইংরেজি অনুবাদ আমি পড়েছি।’
আরেকজন বললেন, ‘আমিও পড়েছি।’
আস্তে আস্তে সূর্য ডুবে গেল মরুভূমির বুকে। তাঁরাও শহরের কাছাকাছি এসে পড়েছেন। দূর থেকে আলো দেখা যাচ্ছে শহরের। কিছুক্ষণের মধ্যেই আলোকশোভিত রাজপথে উঠে পড়লেন তাঁরা।
সোহরাওয়ার্দী প্রথমে গাড়ি থামালেন মুজিবের আশ্রয়স্থল ওসমানি সাহেবের বাড়িতে। বললেন, ‘সকাল সকাল চলে এসো ১৩ নম্বর কাচারি রোডে।’
মুজিব তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে সালাম দিলেন।
সোহরাওয়ার্দীর জিপ শব্দ তুলে ধোঁয়া ছেড়ে চলে গেল।
.
সোহরাওয়ার্দী মুজিবকে বললেন, ‘তুমি লাহোর যাও, ওখানেও সাংবাদিক সম্মেলন করো। আমি ওখানকার কন্টাক্টদের টেলিগ্রাম করে দিচ্ছি।’
মুজিব এখন লাহোরে। উঠেছেন জাভেদ মনজিলে। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের টেলিগ্রাম পেয়ে প্রাক্তন আইসিএস খাজা আবদুর রহিম নিজের আবাসস্থলেই তাঁকে তুললেন। মুজিবের সমস্ত শরীরে আবেগের তরঙ্গ খেলে যাচ্ছে। কারণ, জাভেদ মনজিল কবি আল্লামা ইকবালের বাড়ি। কবি এখানে বসেই পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আল্লামা ইকবালকে কবি হিসেবে শেখ মুজিবের পছন্দ, তারও চেয়ে পছন্দ দার্শনিক হিসেবে। এই বাড়িতে উঠে হাতমুখ ধুয়ে মুজিব বললেন, ‘খাজা সাহেব, আমি কবির মাজারে যাব। মাজার জিয়ারত করব।’
‘নিশ্চয়ই।’ খাজা আবদুর রহিম সঙ্গে গেলেন। কবির মাজারের পাশে দাঁড়িয়ে মুজিব খুবই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। তিনি মোনাজাত করলেন দুহাত তুলে।
অকারণেই তার মনে পড়ে গেল ইকবালের লেখা গীতিকবিতা—
সারা জাহাঁ সে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা
হাম বুলবুলে হ্যায় ইস কি ইয়ে গুলিস্তাঁ হামারা…
.
জাভেদ মনজিলে বসেই শেখ মুজিব চিঠি লিখতে বসলেন তফাজ্জল হোসেন মানিক ভাইকে।
জাভেদ মনজিল
মিও রোড, লাহোর।
১৩. ৬. ১৯৫২
মানিক ভাই,
আমার ভক্তিপূর্ণ সালাম গ্রহণ করিবেন। করাচি হতে আসার সময় আপনার ২ খানা চিঠি জনাব সুরাওয়ার্দি সাহেব আমাকে দেন। চিঠি পেতে দেরি হওয়ার কারণ শহিদ সাহেব ক্লিপটনের বাসা ছেড়ে ১৩ নম্বর কাচারু রোডে আসিয়াছেন। আপনার বিপদের কথা আমি অনুভব করতে পারি। কিন্তু কী করব? আর এক বিপদে পড়িয়াছি। লাহোর এসেই টিকেট করিতে যাই কিন্তু ২৪ তারিখের আগে কোন টিকেট পাওয়া গেল না। সপ্তাহে মাত্র ২ বার এরোপ্লেন ঢাকা যায়। এত ভিড় যাহা কল্পনাও করা যায় না। ২৪ তারিখ ঈদ আর আমাকে সেদিনই রওনা হতে হবে। কী করব, ভেবেছিলাম বাড়িতে ঈদ করব। তাহা আর হল না। যাহা হউক, গরিবের আবার ঈদ কী? জেলখানায় মওলানা ভাসানী ও বন্ধুবান্ধবদের কী অবস্থায় দিন কাটছে বুঝতে পারছি না। দয়া করে আমাকে এই ঠিকানায় চিঠি দিবেন। নুরুল হুদা করাচি কিংবা লাহোর নাই। ফজলুল হক ও রউফের কোনো খবর পেয়েছেন কি? প্রফেসর সাহেবকে আর রফিককে অফিসে বসে কিছু কাজ করতে বলবেন। আমি জানি আপনার পক্ষে সম্ভব নহে। আতাউর রহমান সাহেব ও অন্যান্য সকলকে সালাম দিবেন। কাজ কিছু করতে পেরেছি। পশ্চিম পাকিস্তানের লোকের ভুল অনেকটা ভাঙাতে পেরেছি বলে মনে হয়। দোয়া করবেন, টাকা-পয়সা নাই যে আবার করাচি যেয়ে তাড়াতাড়ি পৌঁছাব। অ্যাডভার্টাইজমেন্ট কিছু পাব। তবে কয়েক দিন দেরি করতে হবে। আমি চেষ্টার ত্রুটি করি নাই। আপনার শরীরের যত্ন নিবেন। মোটেই চিন্তা করবেন না। খোদা হাফেজ।
আপনার ছোট ভাই
মুজিব
মাই অ্যাড্রেস
সি/ও আলহাজ আবদুর রহিম, বার এট ল
জাভেদ মনজিল
মিও রোড, লাহোর
১৮.
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ৫ নম্বর ওয়ার্ডে থাকেন ভাষা আন্দোলনের বন্দী ফজলুল করিম। চৌমুহনী কলেজের আইএ ক্লাসের ছাত্র তিনি। তরুণ বয়স। সারা দিন তাস, ক্যারম, দাবা ইত্যাদি নিয়ে হইচই করছেন। ভাগ্যিস, মওলানা ভাসানীকে ৫ নম্বর ওয়ার্ডের একেবারে শেষ প্রান্তে রাখা হয়েছে। কারা কর্তৃপক্ষ একটা পর্দা দিয়ে ঘিরে দিয়েছেন তাঁর বিছানা। ফলে অপর প্রান্তে ফজলুল করিমদের মতো তরুণদের সুবিধাই হয়েছে হইচই করার, বিড়ি- সিগারেট খাওয়ার।
মওলানা ভাসানীকে বন্দীরা যেমন সবাই শ্রদ্ধা করে, তেমনি কারা কর্তৃপক্ষও সব সময় খেয়াল রাখে তাঁর যেন কোনো অসুবিধা না হয়। ভাষা আন্দোলনের কর্মীদেরও বাঙালি কারা-কর্মচারীরা সমীহের চোখেই দেখত।
মওলানা ভাসানীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন অ্যাডিশনাল জেলার। তাঁর পেছন পেছন এসেছেন ডেপুটি জেলার, একজন জমাদার, জনা কয়েক সেপাই।
মওলানা ভাসানী তাঁদের পেয়ে একটা ছোটখাটো ভাষণ দিয়ে দিলেন—
‘শোনেন। আমি তখন আসামের বড়দলুই জেলে। আমারে দেখতে আইছেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ। তিনি আমারে পুছ করলেন, হুজুর, আপনের কুনো অসুবিধা হইতাছে না তো জেলখানায়? আমি কইলাম, আর কুনো অসুবিধা নাই, খালি একটাই অসুবিধা। গরুর কলিজা খাইতে বড় হাউশ হয়। কিন্তু খাইতে তো পারি না। গোপীনাথ কইলেন, হুজুর, ইন্ডিয়ায় তো জেলখানায় গরুর গোশত নিষিদ্ধ আইটেম। এইটা তো ব্রিটিশ গো বানাইনা আইন। আচ্ছা, আপনে এক কাজ করেন। আমি বইলা দিতেছি, আপনেরে কেউ বাইরে থাইকা রান্না কইরা কলিজা পাঠাইলে গার্ডরা জিগাইব না হেইডা গরু না পাঁঠা। এই ব্যবস্থা আমি কইরা দিতেছি। গোপীনাথ কথা রাখছিলেন। আমার কাছে রান্না করা গরুর কলিজা আইছিল।
মওলানা ভাসানী যখন শৌচাগারে যেতেন, তখন মুশকিলে পড়ত ফজলুল করিম। তাড়াতাড়ি করে বিড়ি-সিগারেট লুকোতে হতো। ক্যারম খেলার সময় পাশ দিয়ে হুজুর যাচ্ছেন, হঠাৎ খেলা ছেড়ে তো সরে যাওয়াও যায় না। একদিন দাঁড়িয়ে ফজলুল করিমকে মওলানা ভাসানী বললেন, ‘কি মিয়া, সারা দিন খালি খেলাধুলা করলে চইলব? লেখাপড়া কিছু করন লাগব না? পরে যখন পরীক্ষা আইব, আর ফেইল মারবা, তখন তোমার গার্জিয়ানরা কইব, ভাসানীর চ্যালা সাইজা একেরে গোল্লায় গেছে।’
ফজলুল করিম কোথায় মুখ লুকাবেন বুঝতেই পারছিলেন না।
শৌচাগার বলতে টানা খাটা পায়খানা। মাথার ওপরে টিনের চাল আছে। তবে ব্যবস্থা এমন, বসলে যেন ঘাড় থেকে মাথা পর্যন্ত দেখা যায়। প্রহরীরা যেন নজর রাখতে পারে।
এই পায়খানা ব্যবহার করা মুশকিল। ফজলুল করিমের কোষ্ঠকাঠিন্য রোগ হয়ে গেল। তিনি বেশ কষ্ট পাচ্ছেন।
মাঝেমধ্যে ডাক্তাররা আসেন বন্দীদের খোঁজখবর করতে। একজন তরুণ ডাক্তার এলেন ফজলুল করিমের কাছে। জিগ্যেস করলেন, ‘তোমার কি কোনো অসুবিধা হচ্ছে?’
ফজলুল করিম বললেন, ‘খুব কোষ্ঠকাঠিন্য।’
‘হাসপাতালের ডাক্তার কী ওষুধ দিয়েছেন?
ফজলুল করিম ওষুধের নাম বললেন।
‘না না, ওই ওষুধে তো হবে না। তোমার লাগবে মিল্ক অব ম্যাগনেশিয়া।’
‘উনি তো এই ওষুধই দেন। মিল্ক অব ম্যাগনেশিয়া দেন না।’
‘আচ্ছা, তুমি এক কাজ করো। নেক্সট উইকে আমার নাইট ডিউটি। তুমি অসুস্থ হওয়ার ভান করে আমাকে কল দেবে রাত্রিবেলা। আমি এসে তোমাকে মিল্ক অব ম্যাগনেশিয়া দিয়ে যাব।’
পরের সপ্তাহ আসতে আরও তিন দিন বাকি। তিন দিন কোনোরকমে কষ্টেসৃষ্টে কাটিয়ে রাতের বেলা ফজলুল করিম অসুস্থতার অভিনয়পর্ব শুরু করলেন। রাতের খাবারের পর ফজলুল পেটে ব্যথার ভান করে চিৎকার- চেঁচামেচি-গড়াগড়ি করতে লাগলেন পেট ধরে। ডাক্তারকে কল দেওয়া হলো। সেই তরুণ চিকিৎসক এলেন। চারপাশে অন্য বন্দীরা ঘিরে ধরে আছেন। তরুণ চিকিৎসক তিন দিনে সব ভুলে বসে আছেন। তিনি গুরুত্বের সঙ্গে ফজলুল করিমকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে আরম্ভ করলেন।
চারদিকের বন্দীরা সবাই উৎসুক ও সহানুভূতিময়।
এর মধ্যে ফজলুল করিম কী করে বলেন যে এসবই তো অভিনয়, ডাক্তারের পরামর্শক্রমেই করা।
ডাক্তার পেটে টোকা দিচ্ছেন। বুকে স্টেথোস্কোপ ধরছেন। শেষে বুকের কাছে কান আনতেই ফজলুল করিম বলে বসলেন, ‘মিল্ক অব ম্যাগনেশিয়া।’ ডাক্তার এই প্রয়োজনীয় কথাটা শুনলেন না। তিনি এক গাদা ওষুধ প্রেসক্রিপশনে লিখে ফেললেন।
তাঁর বিদায়ের পর শুরু হলো সহবন্দীদের সহানুভূতি দেখানোর পালা। ‘শোনো, আমারও একবার এই রকম হইছিল খাওয়ার পর। নাভির গোড়ায় না ব্যথাটা? এটা হলো ডিসেন্ট্রির লক্ষণ।’
‘আরে না। এইটা হইল গ্যাস্ট্রিক আলসার। শোনো, তুমি চুনের পানি খাও। ভালো হইয়া যাবে।’
ফজলুল করিম বলতেই পারলেন না, এসবই ছিল তাঁর অভিনয়। তারপর একজন কম্পাউন্ডারকে ইনজেকশন হাতে আসতে দেখা গেল। পেটের ব্যথার রোগী ফজলুল করিমকে এখন ইনজেকশন দেওয়া হবে।
ফজলুল করিমেরটা ছিল অভিনয়। কিন্তু মওলানা ভাসানীরটা অভিনয় ছিল না।
এক রাতের কথা।
হঠাৎ চিৎকার আর গোঙানি। শব্দটা আসছে ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ওই পর্দাঘেরা কক্ষ থেকেই। ফজুলল করিম ছুটে গেলেন। মওলানা ভাসানী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পেটের ব্যথায় তিনি গলাকাটা মুরগির মতো ছটফট করছেন। সব বন্দী ঘিরে আছে তাঁর বিছানা। ফজলুল করিম কেঁদে ফেললেন। মওলানা ভাসানীকে তিনি নিজের বাবার মতোই শ্রদ্ধা করেন ও ভালোবাসেন।
পরের দিন মওলানা ভাসানীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হবে। অলি আহাদ বললেন, ‘হুজুর, আপনি কিন্তু কেবিন ছাড়া ওয়ার্ডে উঠবেন না। আপনি যদি কেবিন পান, তাহলে ভবিষ্যতে অন্য রাজবন্দীরাও কেবিন পাবে। আর শোনেন, শেখ মুজিব আপনাকে কেবিন খরচ দিয়ে কেবিনে রাখতে চাইবে। আপনি তাতেও রাজি হবেন না। সরকারি হাসপাতাল, সরকার আপনার কেবিন খরচ দিবে।’
বিকালবেলা ভাসানী ফিরে এলেন কারাগারে। তাঁর শরীরে যেসব পরীক্ষা করা দরকার ছিল, তার কিছু কিছু করা হয়েছে। কিন্তু তাঁকে কেবিনে না রেখে ওয়ার্ডে রাখা হয়। তিনি এতে রাজি হননি। তাই অগত্যা তাঁকে কারাগারেই ফেরত আনা হয়েছে। খবর পেয়ে মুজিব ছুটে এসেছিলেন। অলি আহাদের ধারণাই সঠিক, মুজিব তাঁকে বলেছেন, ‘আপনি কেবিনে থাকেন, কেবিনের ভাড়া আমি জোগাড় করে দেব।’ ভাসানী তাতেও রাজি হননি।
.
পরের দিন তাঁকে আবার নেওয়া হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। শেখ মুজিব খবর পেয়ে আবারও হাজির সেখানে। বললেন, ‘আপনি কেবিনে ওঠেন, বাকিটা আমি দেখতেছি। আপনাকে আমাদের লাগবে। আপনি জেলে যেতে পারবেন না। হাসপাতালে থাকলে আমরা এসে আপনার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতে পারব। জেলখানায় তো যখন ইচ্ছা তখন আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারি না।’
.
শেখ মুজিবের কথার ওপরে কথা চলে না।
মওলানা ভাসানী রয়ে গেলেন কেবিনে।
শেখ মুজিব বললেন বটে, ‘আপনি কেবিনে থাকেন, বাকিটা আমি দেখব’, কিন্তু কেবিন ভাড়ার পরিমাণ দেখে তিনি একটু ঘাবড়েই গেলেন। প্রতিদিন ১৫০ টাকা ভাড়া। ১০ দিন পর পর টাকা দিতে হবে।
আতাউর রহমান খান সাহেব কিছু সাহায্য করলেন।
আনোয়ারা খাতুন মাঝেমধ্যে টাকাপয়সা দিতে লাগলেন।
শেখ মুজিবের এক বন্ধু আছেন, সরকারি কর্মকর্তা, তিনি কিছু কিছু দিলেন। আর হাজি গিয়াসউদ্দিন নামে শেখ মুজিবের এক ব্যবসায়ী বন্ধু, কুমিল্লা বাড়ি, মুজিবের সাহায্যে সদা উদারহস্ত ছিলেন।
টাকাপয়সা জোগাড় করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হলো, তবে শেষ পর্যন্ত টাকা জোগাড়ও হয়ে গেল। তবে প্রতি ১০ দিন পর ১৫০ টাকা দেওয়া সত্যি একটা কঠিন কাজই ছিল মুজিবের পক্ষে।
মুজিব লাহোর থেকে প্লেনে সম্প্রতি ঢাকা এসেছেন। তাঁর কাছে আছে মহামূল্যবান সম্পদ, সোহরাওয়ার্দীর দুটো বিবৃতি। তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা ডাকলেন। মওলানা ভাসানীর সঙ্গেও কথা বললেন। সবাই সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে অ্যাফিলিয়েশনে রাজি।
সর্বসম্মতিক্রমে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে অ্যাফিলিয়েশনের প্রস্তাব গৃহীত হলো।
মুজিব স্বস্তি পেলেন। রাতের বেলা তাঁতীবাজারের বাসায় আবদুল হামিদ চৌধুরী আর মোল্লা জালাল উদ্দীনের সঙ্গে কথা বললেন এই নিয়ে। মেঝেতে মাদুর পেতে টিনের থালায় ভাত খাচ্ছেন তাঁরা।
মুজিব বললেন, ‘আজকা আমি শান্তি নিয়া ঘুমাতে যাব, বুঝলা। লিডারের অ্যাফিলিয়েশনটা হয়ে গেল। আর লিডার যে বাংলা আর উর্দু—দুই ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষা চান, সরকারের জুলুম-নির্যাতন-গুলির প্রতিবাদ করেন, এইটাও আজকে পার্টির লোকেরা জানল। মানিক ভাইকে বিবৃতি দিয়া আসলাম। ইত্তেফাক-এ বার হলে দেশের মানুষও জানবে।’
মোল্লা জালাল বললেন, ‘ইত্তেফাক এখন খুব চলে। যেইখানে যাই সেইখানেই দেখি লোকে ইত্তেফাক পড়ে। আরেকটা মাছ লও, মুজিবর।’
মুজিবের পাতে মাছ তুলে দিলেন মোল্লা জালাল।
শেখ মুজিব বললেন, ‘দাও আরেকটা। আজকা আমার ক্ষুধাও বেশি। আজকা আমি দুইটা মাছ খেতে পারব।’
১৯.
তাজউদ্দীন ঘুম থেকে উঠেছেন ভোর সাড়ে চারটায়। রোজই তিনি খুব ভোরে ওঠেন। তাতে দিনটা বড় হয়। অনেক কাজ করা যায়। বর্ষাকাল। পুরান ঢাকার ভাড়াবাড়ির জানালা দিয়ে তিনি দেখে নিলেন বৃষ্টিস্নাত ভোরে আলোর ফুটে ওঠা। তাজউদ্দীনের শরীর-মন চাঙা হয়ে উঠল। সারাটা দিন খুব গরম থাকে আজকাল। ভোরবেলা বৃষ্টি হলে খানিকটা ঠান্ডা পড়ে। আরাম বোধ হয়।
তাজউদ্দীন তাঁর টাইপ মেশিনটা নিয়ে টাইপ করে চলেছেন। একটা দরখাস্ত তিনি মুসাবিদা করছেন। যুবলীগের নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা আর অলি আহাদ ঢাকা কারাগারে বন্দী। তিনি তাঁদের মুক্তির ব্যাপারে তৎপর হয়েছেন। ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের ডিজি আর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর দরখাস্ত লেখাটা সেই তৎপরতার অংশ।
গতকাল তোয়াহা সাহেবের স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন জেলগেটে। ভাবি দেখা করলেন তোয়াহা সাহেবের সঙ্গে। তাজউদ্দীন দূরে দাঁড়িয়ে রইলেন। কারাবাসের প্রধান শাস্তি এটিই যে, তোমার চলাচলের স্বাধীনতা হরণ হয়ে গেল। তুমি চাইলেও আর যেখানে খুশি যেতে পারবে না, নিজের পরিজনের সঙ্গে একত্র হতে পারবে না। দরখাস্ত করে, তারিখ নিয়ে এসে দেখা করতে হয়। তখনো প্রহরী দাঁড়িয়ে থাকে, কোনো গোপন কথা, পারিবারিক কথা কে কাকে বলবে?
তোয়াহা সাহেব স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে ভেতরে চলে যাচ্ছিলেন, তাজউদ্দীন এগিয়ে গেলেন তোয়াহা ভাই বলে। কয়েক মিনিট কথা হলো। তোয়াহা সাহেব বললেন, ‘তোমার ভাবির দিকে খেয়াল রেখো। টাকাপয়সা কিছু হাতে নাই বলল।’
শুনে তাজউদ্দীনের বুকটা যেন একটু কেঁপে উঠল।
মোহাম্মদ তোয়াহা জোতদারের ছেলে। তাঁদের জমিজমার পরিমাণ অনেক। কোনোই অভাব তাদের পিতৃপরিবারের নেই। কিন্তু মোহাম্মদ তোয়াহা ছাত্রজীবন থেকেই সাম্যবাদের আদর্শে দীক্ষিত। ফলে তিনি বাড়ি থেকে কোনো টাকাপয়সা নেন না। ভাষা আন্দোলনের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। কাজেই আজ তাঁর এই কারাবাস। তাঁর স্ত্রী আজ অভাবের মুখে দিশাহারা। সে কথা তিনি বলতেও পারছেন না মুখ খুলে।
কত গুণ মোহাম্মদ তোয়াহার! তিনি খুব ভালো ছবি আঁকেন। শিশুর মতো সরল তাঁর আচার-ব্যবহার। হাসিটি যেন ফুলের মতো। সুদর্শন মানুষ। যুবলীগের কাউন্সিলের দিন তিনি পরেছিলেন ঘিয়ে রঙের গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট, সাদা শার্ট, কালো কার্ডিগান আর টাই। সবার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছিলেন। যুবলীগের অন্যতম সহসভাপতি তিনি।
আবার তাঁর সারল্যের গল্পও ঢাকার রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে বেশ প্রচলিত। একুশে ফেব্রুয়ারির পর সংগ্রাম কমিটির গোপন সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে শান্তিনগরের এক বাসায়। পুলিশ এসে পড়লে একসঙ্গে সব নেতাকে পেয়ে যাবে, এই ভয় ছিল। তাড়াতাড়ি আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি ও পরবর্তী কর্তব্য নিয়ে আলোচনা সারা হলো। সভা সমাপ্ত। সবাই সটকে পড়বে পুলিশ আসার আগেই।
ঠিক এই সময় নাকি তোয়াহা সাহেব পকেট থেকে ইয়া বড় এক তোড়া কাগজ বের করে তা পড়তে আরম্ভ করে দিলেন। ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য আর মূল্যায়ন নিয়ে রচিত থিসিস। সময় পেরিয়ে যেতে লাগল। তোয়াহা সাহেবের থিসিস পাঠ আর শেষ হয় না। পুলিশ বাড়ি ঘিরে ফেলল। তাঁদের সভা থেকেই একজন কর্মী আগেভাগে বেরিয়ে গিয়েছিল। সম্ভবত সেই খবর দিয়েছে পুলিশে। পুলিশ তারপর এসেছে। তবু তোয়াহা সাহেবের থিসিস পাঠ শেষ হয়নি। একসঙ্গে অনেকজনকে পেয়ে গেল পুলিশ। যেন একবার জাল ফেলে পেয়ে গেল রাঘববোয়ালদের।
এই রকম সহজ-সরল একটা মানুষকে এইভাবে কারাবরণ করতে হচ্ছে! তাঁর স্ত্রী টাকাপয়সার কষ্টে ভুগছেন!
ফেরার পথে ভাবির সঙ্গে এইসব নিয়েই কথা বলতে লাগলেন তাজউদ্দীন। তাঁরা একটা টমটমে উঠেছেন। মুখোমুখি বসেছেন। ঘোড়ার গাড়ি ছুটছে, ভিড়ভাট্টা এড়িয়ে। সন্ধ্যা নামছে। বাতি জ্বলে উঠছে দোকানে দোকানে। লন্ঠন জ্বালানো হচ্ছে রিকশার পেছনে। সারা দিন গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে। এখন বৃষ্টি নাই।
ভাবি বললেন, ‘আপনার ভাই তো সরলসোজা মানুষ। বিয়ের পর তাঁর সঙ্গে ট্রেনে ঢাকা ফিরছি। তিনি আমাকে রেখে নেমে পড়লেন ভৈরব জংশনে। বললেন, দাঁড়াও, নাশতা কিনে আনি। সেই যে নামলেন, ট্রেন ছেড়ে দিল, তিনি আর ফিরলেন না। আমি গ্রামের মেয়ে। জীবনে ঢাকা শহর দেখিনি। কী হবে আমার? আমি কাঁদতে আরম্ভ করে দিলাম। পরে শুনলাম, ট্রেনের হুইসেল শুনে আপনার ভাই দৌড়ে এসেছেন, কিন্তু ট্রেন ধরতে পারেননি। তারপর ভৈরব স্টেশন মাস্টারের কাছে গেছেন। তাঁকে দিয়ে ফোন করিয়েছেন ঢাকার স্টেশন মাস্টারকে। ঢাকার স্টেশন মাস্টারকে বলা হলো, আমাকে যেন ওয়েটিং রুমে বসিয়ে রাখে। আর এখনই যেন খবর পাঠানো হয় ফজলুল হক হলে। তিনি তো ফজলুল হক হলের ভিপি।
‘আমি স্টেশনে নেমে কাঁদছি। সবাই যার যার গন্তব্যে চলে গেল। আমি কই যাব? এই সময় স্টেশন মাস্টার নিজে এসে পরিচয় দিলেন। ছাত্রকর্মীরা এল। তারা বলল, চলেন। আমি বললাম, আমি ওয়েটিং রুমেই বসি। উনি কি পরের ট্রেনে আসবেন না?’
.
তাজউদ্দীন অলি আহাদের মুক্তির জন্যও চেষ্টা করছেন। তিনি অলি আহাদের রাজনৈতিক জীবনের একটা প্রত্যয়নপত্রও টাইপ করলেন। সারা দিন বাসায়ই রইলেন। বৃষ্টি হলো দুপুরের দিকে। বিকালে বেরোলেন। যুবলীগ অফিসে গেলেন। সেখানে শুনতে পেলেন জামালপুরে গ্রেপ্তার অভিযান চলেছে, সেই খবর।
পরের দিন সকাল ১০টার দিকে ছাতা মাথায় তাজউদ্দীন হাজির হলেন ওয়ারী ডাকঘরে। ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের ডিআইজি আর স্বরাষ্ট্রসচিবের বরাবরে লেখা দরখাস্তগুলো রেজিস্ট্রি করে ডাকে ধরিয়ে দিলেন। ডা. করিমের চেম্বারে গেলেন। তাজউদ্দীন দুপুরের ট্রেনে শ্রীপুর যাবেন। শ্রীপুরের স্কুলে তিনি প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন। এদিকে অর্থনীতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনাও করছেন। রাজনীতি করেন। আওয়ামী মুসলিম লীগের চেয়েও প্রগতিশীল কোনো রাজনৈতিক দল করা যায় কি না, ইদানীং কামরুদ্দীন আহমদের সঙ্গে তা-ই নিয়ে প্রায়ই কথা বলেন। গণতন্ত্রী দল নামে নতুন একটা সংগঠনের কথা বলাবলি হচ্ছে। কামরুদ্দীন আহমদ বলছেন, আমাদের ওয়েট অ্যান্ড সি নীতিতে চলতে হবে। দেখা যাক, আওয়ামী লীগ আরও অসাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতে পারে কি না।
ডা. করিম তাজউদ্দীনের সঙ্গে চললেন ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন পর্যন্ত। তাজউদ্দীন বললেন, ‘তোয়াহা ভাবিকে কিছু টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করব ভাবছি।’
ডা. করিম বললেন, ‘তাহলে আমিও পঞ্চাশ টাকা দেব। আমারটাও কাল সংগ্রহ করে নেবেন।
ট্রেন ছাড়ল দুপুর ১২টার পর। শ্রীপুর পৌঁছাল তিনটায়।
তাজউদ্দীন ট্রেন থেকে নামলেন।
আজ আর দুপুরে খাওয়া হলো না। গোসলও হয়নি।