উষার দুয়ারে – ২৫
২৫.
এ কে ফজলুল হক আর ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের অবস্থান ভিন্ন হয়ে গেল।
তাঁরা দুজনেই এসেছেন পূর্ব বাংলা থেকে। করাচিতে। গণপরিষদের অধিবেশনে অংশ নেবার জন্য। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সবার আগে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব এই পরিষদেই চার বছর আগে উত্থাপন করেছিলেন। তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়ে গেলে সে খবর পৌঁছে যায় বাংলায়, আর জেগে ওঠে বাংলার ছাত্রসমাজ। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে দুবার তিনি গিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুপুর একটার দিকে একবার। রিকশায় করে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত যাচ্ছিলেন আইন পরিষদ ভবনের দিকে। সঙ্গে ছিলেন প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী। হোস্টেলের ছাত্ররা তাঁদের দেখতে পেয়ে আহ্বান জানায়, আহত ছাত্রদের দেখতে হোস্টেলে চলুন।
ধীরেন্দ্রনাথ হোস্টেলে গিয়েছিলেন। মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে পুলিশের পিটুনি খাওয়া ছেলেরা। তাদের চোখ লাল হয়ে আছে কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়ায়।
তিনি সজল চোখে বলেছিলেন, ‘আমি অবশ্যই পরিষদে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনের কাছে এই অত্যাচার-নির্যাতনের কৈফিয়ত চাইব।
দুপুরে শুরু হয়েছিল প্রাদেশিক আইন পরিষদের অধিবেশন। ততক্ষণে গুলিবর্ষণের খবর পৌঁছে গেছে তাদের কাছে।
তিনি বললেন, ‘একটু আগে পুলিশের নির্যাতনে আহত ছাত্রদের আমি দেখে এসেছি। সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্যের বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এখন আমরা জানতে পেরেছি পুলিশ ছাত্রদের ওপর গুলি চালিয়েছে। আমরা কি এখন এইখানে বসে আলোচনা করব, যখন আমার ছাত্র ভাইদের ওপরে গুলি চলছে। না। যতক্ষণ না আমি স্বচক্ষে দেখে আসছি পরিস্থিতি কী, যতক্ষণ না গুলিবর্ষণের ঘটনার তদন্ত চলছে, ততক্ষণ এই পরিষদের কার্যক্রমে অংশ নেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।’
এই প্রতিবাদের মুখেও নুরুল আমিন অধিবেশন চালিয়ে যেতে চাইলেন।
হট্টগোলের মধ্যে স্পিকার অধিবেশন মুলতবি করে দিলে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও কয়েকজন পরিষদ সদস্য চলে গেলেন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
হাসপাতালের মেঝেয় শুয়ে কাতরাচ্ছে আহত ছাত্ররা।
তাঁর চোখ ভিজে উঠল। তিনি ধুতির খুঁটে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘এটা নারকীয় হত্যাকাণ্ড। আর একটি জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাযজ্ঞ।’ মাটিতে শায়িত কয়েকজন আহত ছাত্রের পাশে দাঁড়িয়ে দুহাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে তিনি বললেন, ‘তোমরা সবাই আমার প্রণাম গ্রহণ করো।’
.
এ কে ফজলুল হক ২২ ফেব্রুয়ারির শহীদদের জানাজায় আরও হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। সেই জানাজা থেকে মিছিল নবাবপুর রোডের দিকে এগিয়েছিল। রক্তাক্ত জামা হয়ে উঠেছিল পতাকা।
.
আজ, ১৯৫২ সালের ১০ এপ্রিল, করাচির গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা হোক, এই প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে পূর্ব বাংলা থেকে নির্বাচিত সদস্য নূর আহমদ। তিনি কিন্তু বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিলেন না, বাংলাকে সরাসরি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিলেন।
অ্যাসেম্বলির কার্যক্রম চলছিল এভাবে :
মি. নূর আহমেদ (পূর্ব বাংলা, মুসলিম লীগ) : ‘স্যার, আমার প্রস্তাব, বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হোক, এই হলো এই অ্যাসেম্বলির মত। ‘স্যার, আমার বক্তব্য এই অ্যাসেম্বলির প্রত্যেক সম্মানিত সদস্যর কাছে স্বতঃপ্রমাণিত ও পরিষ্কার। কাজেই আমি এর সমর্থনে কোনো বক্তব্য পেশ করব না।
সভাপতি : ‘আপনি কী বক্তব্য রাখতে চান?’
নুরুল আমিন (পূর্ব বাংলা, মুসলিম লীগ) : ‘উনি এরই মধ্যে ওনার বক্তব্য বলে ফেলেছেন। ‘
সরদার শওকত হায়াত খান (পাঞ্জাব, মুসলিম লীগ) : ‘একজন সরকারি নেতা তার কথা বলায় বাধা দিচ্ছেন।’
সভাপতি : ‘প্রস্তাব উত্থাপিত হলো : বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হোক, এই হলো এই অ্যাসেম্বলির মত।’
পীরজাদা আবদুস সাত্তার খান (সিন্ধু, মুসলিম লীগ) : ‘রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এটা এখনই করার কোনো প্রয়োজনীয়তাও নাই। সময়ের ধারায় যখন প্রয়োজনীয়তা আসবে, তখন এই অ্যাসেম্বলি এটা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
‘আমার এই সংশোধনী পরিষ্কার এবং এটা আর কোনো ব্যাখ্যা দাবি করে না।’
সভাপতি : ‘এই সংশোধনী উপস্থাপিত হলো : রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এটা এখনই করার কোনো প্রয়োজনীয়তাও নাই। সময়ের ধারায় যখন প্রয়োজনীয়তা আসবে, তখন এই অ্যাসেম্বলি এটা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।’
সরদার শওকত হায়াত খান : ‘স্যার, আমি খুবই দুঃখিত ও বিস্মিত যে, সরকারদলীয় একজন সদস্য একটা প্রস্তাব আনলেন। আরেকজন সদস্য সেটা স্থগিত করার চেষ্টা করছেন।’
এরপর পাঞ্জাবের সরদার শওকত হায়াত খান অনেকক্ষণ ধরে তাঁর বক্তব্য দিলেন। তিনি বললেন, বাংলা পাকিস্তানের ৪ কোটি ৯ লাখ লোকের ভাষা। অবশ্যই তাদের দাবি মানতে হবে। তিনি মনে করেন, উর্দু ও বাংলা দুটোই যদি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হয়, তাহলে তা দুই অঞ্চলের মধ্যে যোগাযোগ ও বন্ধন আরও দৃঢ় করবে। তিনি বলেন, সাহসী হতে হবে, সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করতে বর্তমানের চাহিদা, এটাকে স্থগিত করা উচিত হবে না, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার করার প্রস্তাব গ্রহণ করতে হবে।
এরপর উঠলেন এ কে ফজলুল হক। ৮০ বছর তাঁর বয়স। ঢাকা হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট জেনারেল। তিনি বলেন, ‘পূর্ব বাংলার প্রতিটি মানুষ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে। তবু আমি বলব, আপাতত এই প্রস্তাব ভোটে দেওয়ার কোনো দরকার নাই। এটা স্থগিত থাকুক।’
সরদার শওকত হায়াত খান বললেন, ‘আপনি কেন স্থগিত করতে চাচ্ছেন প্রস্তাবটা।’
ফজলুল হক বললেন, ‘আমি খোলাখুলিভাবে বলি। আজ ভোট হলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব ভোটে হেরে যাবে।’
ফজলুল হকের এই ধারণার পেছনে বাস্তব কারণ আছে। তিনি দেখলেন, সরকারি দলের নূর আহমেদ প্রস্তাব উত্থাপন করলেন, কিন্তু তাঁর পক্ষে কোনো বক্তব্য দিলেন না। সরকারদলীয় সব সদস্যই মুখে কুলুপ এঁটে আছেন। তিনি তাই আজ এটা স্থগিত রাখার পক্ষে। সুসময় আসুক। আবার এই প্রস্তাব অ্যাসেম্বলিতে তোলা হবে। তখন ভোট হবে।
এই সময় উঠে দাঁড়ালেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি এ কে ফজলুল হকের মতের বিরোধিতা করলেন। তিনি বললেন, ‘বাংলার প্রতিটা মানুষ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চায়। যে শিশু কথা বলে ভাঙা ভাঙা, সে-ও স্লোগান দিচ্ছে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”।
পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন ঢাকায় প্রাদেশিক পরিষদে ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ এই প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন এবং পাস করিয়ে নিয়েছিলেন যে, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হোক। সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি মনে করেন, এই প্রস্তাবের সুরাহা এখনই করতে হবে, আর তা করতে হবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে সকলে মিলে ভোট দিয়ে।
তাঁকে সমর্থন জানালেন পূর্ব বাংলা থেকে নির্বাচিত আরেক গণপরিষদ সদস্য শ্রীশ চট্টোপাধ্যায়। তিনি বললেন, ‘নূর আহমেদ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবটা এমনভাবে উত্থাপন করলেন, যেন তিনি মৃতের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে মন্ত্র পড়ছেন। তিনি প্রস্তাবের সমর্থনে একটা বাক্যও ব্যয় করলেন না। অথচ অন্য সময় তিনি কত কথা বলেন। পরিষদে যখন তিনি বক্তৃতা করতে ওঠেন, স্পিকার বারবার বলেও তাঁকে থামাতে পারেন না। যা-ই হোক, ছাত্ররা যখন ভাষা আন্দোলন করছিল পূর্ব বাংলায়, প্রধানমন্ত্রী তখন তড়িঘড়ি করে প্রাদেশিক আইন পরিষদে দৌড়ে গিয়ে প্রস্তাব পাস করেছেন যে, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হবে।’
নুরুল আমিনের সঙ্গে শ্রীশ চট্টোপাধ্যায়ের তর্ক লেগে গেল।
নুরুল আমিন দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনি কোথায় পেলেন এসব কথা?’
শ্রীশ বললেন, ‘আপনি কি রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে সমর্থন করেন নাই?’
‘আপনি কেন আমার মুখে এমন উক্তি বসাচ্ছেন যা আমার মুখ থেকে বের হয় নাই?’
‘আপনি কি প্রস্তাবটা উত্থাপন করেছিলেন, নাকি করেন নাই?’
‘আমি অন্য কিছু বলেছিলাম।’
‘আচ্ছা, প্রস্তাবটা কী ছিল, যেটা আপনি উত্থাপন করেছিলেন?’
‘আপনি নিজেই পড়ে শোনান।’
‘আমি তো সেখানে ছিলাম না। প্রাদেশিক পরিষদের আমি মেম্বার নই। আমি তো কোনো কপিও পাই নাই। আমি সংবাদপত্রে দেখেছি।’
তাহলে আপনি আমাকে উদ্ধৃত করছেন কেন? আপনি কেন একটা বিষয়ে নাক গলাচ্ছেন যার কপি আপনি পড়েনই নাই?’
‘খবরের কাগজে রিপোর্ট বেরিয়েছে, আপনি প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন এবং বলেছেন আপনি এখানে আসবেন, এই হাউসকে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার প্রস্তাব পাস করিয়ে নেবেন।
.
শেষে দুটো প্রস্তাব ভোটে দেওয়া হলো। ‘বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হোক’ আর ‘রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি আপাতত স্থগিত থাকুক’।
৪১-১২ ভোটে স্থগিত রাখার প্রস্তাব পাস হলো।
এ কে ফজলুল হক ভোট দানে বিরত রইলেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত রাষ্ট্রভাষা বাংলা করা হোক—প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলেন। বলা দরকার, নূর আহমেদ নিজেই তাঁর প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিলেন।
ব্যাপারটা যে ষড়যন্ত্র ছিল, তা বুঝতে এ কে ফজলুল হকের বিন্দুমাত্র অসুবিধা হলো না।
তবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত মন খারাপ করলেন। এ কে ফজলুল হক কেন স্থগিতের পক্ষে বললেন। এই প্রস্তাব আজ যদি ভোটে বাতিল হয়ে যায়, পূর্ব বাংলার মানুষ আবার ঝাঁপিয়ে পড়ত সংগ্রামে।
খাজা নাজিম উদ্দিন, নুরুল আমিনদের আসল চেহারা মানুষের সামনে উন্মোচিত করে দেওয়াই তো ভালো ছিল।
২৬.
বিমান ছাড়বে ২৪ তারিখে। টিকিট বুকিং দেওয়া আছে। কিন্তু টিকিট কিনে ফেলা যাচ্ছে না, কারণ পাসপোর্ট হয়নি। ২৩ তারিখ পেরিয়ে গেল। পাসপোর্ট আসে না।
১৬ তারিখের দিকে খবর এল, পিকিং থেকে দাওয়াত এসেছে। শান্তি সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ। পুরো পাকিস্তান থেকে ৩০ জন আমন্ত্ৰণ পেয়েছেন, পূর্ব বাংলা থেকে মাত্র পাঁচজন আছেন সে কাফেলায়। আতাউর রহমান খান, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, যুগের দাবী পত্রিকার সম্পাদক খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, উর্দু লেখক ইউসুফ হাসান এবং শেখ মুজিবুর রহমান।
যুগের দাবী ছিল যৌনপত্রিকা। ভাষা আন্দোলনের পর অনেক কিছুই বদলে যাচ্ছে, যুগের দাবীও যৌনতা বিসর্জন দিয়ে সমাজ ও রাজনীতি-বিষয়ক পত্রিকা হয়ে উঠেছে।
আমন্ত্রণ পেয়েই পূর্ব বাংলার ডেলিগেটরা পাসপোর্টের জন্য আবেদন করলেন। কিন্তু পাসপোর্ট আর আসে না। পাসপোর্ট আসবে করাচি থেকে। সেখানেও পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে লোক গিয়ে ছোটাছুটি করছেন। ঢাকাতেও আতাউর রহমান খান সচিব-উপসচিবের সঙ্গে দেখা করে জরুরতটা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।
সরকার আসলে নাখোশ। কমিউনিস্ট দেশে যাচ্ছে, কিসের শান্তি সম্মেলন, আসলে তো কমিউনিস্টদের সম্মেলন। এরা নিজেরাও কমিউনিস্ট না হলে কি আর আমন্ত্রণ পায়?
পাসপোর্ট এল ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৫২, যাতে তখন আর প্লেনের টিকিট কেনা ও প্লেন ধরার সময় না থাকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বিমান আসেনি, লেট আছে, ২৪ ঘণ্টা লেট।
এই পাঁচজনের চারজন দৌড়াদৌড়ি করে সব গুছিয়ে নিলেন।
শুধু তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া আরাম করে ঘুমোচ্ছেন।
সকাল সকাল তাঁর বাড়িতে হাজির হলেন শেখ মুজিব।
মানিক মিয়াকে ঘুম থেকে তোলাই যায় না। তাঁর এক কথা, ‘আপনারা যান। বেড়িয়ে আসেন। আমি যাব না। ইত্তেফাক কে দেখবে? বিজ্ঞাপন কে জোগাড় করবে? লিখবে কে?’
মুজিব ধরলেন মানিক মিয়ার স্ত্রীকে, ‘ভাবি, আপনি কেন যেতে বলছেন না মানিক ভাইকে, ১০-১৫ দিনের ব্যাপার, তিনি চীন গেলে নতুন চীনের কথা লিখতে পারবেন, দেশের মানুষ জানতে পারবে। কাপড় কোথায়? সুটকেস কোথায়? আনেন। গোছান। মানিক ভাই, ওঠেন। আপনি না গেলে আমি যাবই না।’
মানিক মিয়া জানেন মুজিব নাছোড়বান্দা। অগত্যা উঠলেন।
‘তাড়াতাড়ি করেন। ১০টার মধ্যে আমরা আতাউর রহমান সাহেবের বাড়ি যাব। সেখান থেকে ১১টার মধ্যে এয়ারপোর্ট পৌঁছাতে হবে।’
তেজগাঁও বিমানবন্দরে তাঁরা পৌঁছে গেলেন ১১টার মধ্যেই।
তখনো তাদের বিমান আসেনি। তাঁরা চেক-ইন করে নিলেন।
ফ্লাইট এসে অবতরণ করল।
সরকারের কারসাজি বৃথা গেল।
প্লেন ২৪ ঘণ্টা লেট হওয়ার সুবাদে তাঁরা চীনের পথে আকাশে উড়াল দিতে সক্ষম হলেন।
প্রথমে তাঁরা নামলেন রেঙ্গুন। তারপর ব্যাংকক। সেখান থেকে হংকং। তারপর ট্রেনে করে ক্যান্টন।
ক্যান্টন থেকে বিমানে করে দেড় হাজার মাইল চীনের ভেতরে উড়ে যেতে হবে পিকিং।
সুন্দর ট্রেন। প্রতি তিনজনের জন্য একজন করে দোভাষী। মালপত্রের দায়িত্ব সব স্বেচ্ছাসেবকেরা নিয়ে নিয়েছে। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা এইসব দায়িত্ব পালন করছে। ট্রেনের মধ্যে আছে খাওয়া আর ঘুমোনোর সুব্যবস্থা। ট্রেনের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত হেঁটেই চলাচল করা যায়। মুজিব হেঁটে হেঁটে এমাথা-ওমাথা করলেন।
মানিক মিয়া ঝিমোচ্ছেন। মুজিব ফিরে এলে বললেন, ‘ভাই মুজিবর, কই গেছলেন?’
‘এই তো মানিক ভাই, ট্রেনের এমাথা-ওমাথা ঘুরে দেখলাম।’
‘কী দেখলেন?’
‘প্রত্যেকটা মুখ উজ্জ্বল। মনে হচ্ছে, নতুন দেশ, নতুন মানুষ। মাত্র তিন বছর হলো স্বাধীনতা পেয়েছে, এর মধ্যে এত জাগরণ এরা সৃষ্টি করল কীভাবে। মনে হচ্ছে, আফিম খাওয়া জাত জেগে উঠেছে। আর আফিম খায় না। আর আমরা স্বাধীন হলাম পাঁচ বছর। আমরা তো ঘুমিয়ে পড়লাম। শাসকদের অযোগ্যতা আমাদের সমস্ত সম্ভাবনা বিনষ্ট করে দিল।’
ক্যান্টনে ওরা পৌঁছালেন সন্ধ্যার পর। শত শত ছেলেমেয়ে ফুলের তোড়া নিয়ে এসে হাজির।
স্থানীয় শান্তি কমিটির লোকেরা তাদের অভ্যর্থনা করে নিয়ে গেল পার্ল নদীর ধারে বিরাট হোটেলে।
রাতেই শান্তি কমিটির পক্ষ থেকে ভোজ, ভোজের পর বক্তৃতা। মুজিব খন্দকার ইলিয়াসকে বললেন, ‘এরা দেখি বাঙালিদের মতোই বক্তৃতা করতে আর বক্তৃতা শুনতে ভীষণ ভালোবাসে। আর ভালোবাসে হাততালি দিতে কথায় কথায় তালি দেয়। অগত্যা অতিথিদেরও হাত নড়াতে হয়।’
সকালবেলা তাঁরা বেরিয়ে পড়লেন এয়ারপোর্টের উদ্দেশে।
এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথে ক্যান্টন শহরটাকে দুচোখ ভরে দেখে নিচ্ছেন মুজিব। তাঁর মনে হলো, এই প্রদেশটা বাংলার মতোই সুজলা-সুফলা। পিকিংয়ের উদ্দেশে প্লেন ছাড়ল। প্লেনের জানালা দিয়েও তিনি নিচের ভূদৃশ্য অবলোকন করতে লাগলেন। বাহ্, কত সুন্দর!
বিকালবেলা তাঁরা পৌঁছালেন পিকিং এয়ারপোর্টে। শিশুরা তাঁদের হাতে তুলে দিল ফুলের তোড়া। পিকিং শান্তি কমিটির সদস্যরা তাঁদের অভ্যর্থনা জানালেন। তাঁদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ভারতবর্ষের কয়েকজন প্রতিনিধির।
তারপর তাঁদের নিয়ে যাওয়া হলো পিকিং হোটেলে। বিশাল হোটেল। বড় বড় রুম।
.
শান্তি সম্মেলন শুরু হয়েছে। ৩৭টা দেশের ৩৭৮ জন সদস্য যোগ দিয়েছেন এই সম্মেলনে। ৩৭টা দেশের পতাকা উড়ছে। শান্তির প্রতীক পায়রার প্রতিকৃতি দিয়ে পুরো মিলনায়তন সাজানো হয়েছে সুন্দরভাবে। প্রত্যেক টেবিলে হেডফোন আছে। পাকিস্তানের ৩০ জন প্রতিনিধি একসঙ্গে বসেছেন। বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা বক্তৃতা শুরু করলেন। ৩৭টা দেশের প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে প্রত্যেক দেশের একজন বা দুজন করে নিয়ে সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হলো।
হেডফোনে অনুবাদ শোনা যাচ্ছে। ইংরেজি, চীনা, স্প্যানিশ ও রুশ ভাষায় বক্তব্য অনূদিত হয়ে যাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে।
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অনেকেই বক্তৃতা দিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কথা বলবেন দুজন, আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিবুর রহমান।
আতাউর রহমান ভাষণ দিলেন ইংরেজিতে। শেখ মুজিব ভাবছেন তিনি কী করবেন। ইংরেজি বক্তৃতা তিনি দিতে পারেন, অনেক জায়গায় দিতেও হয়েছে। পাকিস্তানেই তিনি সব বক্তৃতা সব সময় ইংরেজিতে দিয়েছেন। কারণ তিনি উর্দু একদমই পারেন না। এখানে তিনি ইংরেজিতে অবশ্যই বলতে পারেন। কিন্তু এর আগে ভারত থেকে লেখক মনোজ বসু বক্তৃতা করেছেন বাংলায়। এই তো সুযোগ বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে পূর্ব বাংলার পক্ষ থেকে বাংলায় ভাষণ দেওয়ার। পূর্ব বাংলার ছাত্ররা বুকের রক্ত দিয়েছে এই ভাষার জন্য। এই ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব জয় করেছেন, কে না তাঁকে চেনে? কাজেই মাতৃভাষায় ভাষণ দেওয়াই তিনি কর্তব্য বলে মনে করলেন।
তিনি দাঁড়ালেন এবং শুরু করলেন বাংলায়।
দোভাষীরা সেটা ইংরেজি, চীনা, স্প্যানিশ ও রুশ ভাষায় অনুবাদ করে যেতে লাগল।
তাঁর ভাষণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলেন মনোজ বসু, জড়িয়ে ধরলেন মুজিবকে, বললেন, ‘আজ আমরা দুটো আলাদা দেশের নাগরিক বটে, কিন্তু আমাদের ভাষা কেউ ভাগ করতে পারেনি। আর পারবেও না। তোমরা বাংলা ভাষাকে জাতীয় মর্যাদা দেওয়ার জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছ, তার জন্য আমরা ভারতবর্ষের বাংলাভাষী মানুষেরা খুবই গর্ব অনুভব করি।
খন্দকার ইলিয়াস শেখ মুজিবের গলা জড়িয়ে ধরে আছেন, আর ছাড়তেই চান না। ক্ষিতীশ বাবু এসেছেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে, কিন্তু আসলে তিনি পিরোজপুরের লোক, তিনি বাংলা গানে মাতিয়ে তুললেন আসর। মাইক্রোফোনে তিনি বললেন, ‘বাংলা ভাষা আমাদের গর্ব।’
খন্দকার ইলিয়াসকে মুজিব বললেন, ‘আজকে ক্ষিতীশ বাবুর গান শুনে আমার আব্বাসউদ্দীনের কথা খুব মনে পড়ছে।
‘আমরা গেছি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। কৃষ্ণনগর হাইস্কুলের উদ্বোধন করতে। সেখানে বিখ্যাত গায়ক আব্বাসউদ্দীন আহ্মদ, সোহরাব হোসেন আর বেদারউদ্দীন আহম্মদ খান গান গাইবেন। আব্বাসউদ্দীনের গান শোনার জন্য হাজার হাজার লোক উপস্থিত হলো। বোঝোই তো, আব্বাসউদ্দীনের গান মানে জনসাধারণের প্রাণের গান। তাঁর গানে মাটির গন্ধ। বাংলার মাটির সঙ্গে তাঁর নাড়ির সম্পর্ক
‘ওই সভায় গান হলো। সব গায়ক গান করলেন। আমি আর আব্বাসউদ্দীন রাতে একই বাড়িতে থাকলাম।
‘পরের দিন আমরা রওনা হলাম নৌকায়। আশুগঞ্জ স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরব। পথে গান আরম্ভ হলো। নদীর স্রোত বয়ে যাচ্ছে কুলুকুলু রবে। এই সময় আব্বাসউদ্দীন ধরলেন ভাটিয়ালি গান। আমরা সবাই তন্ময় হয়ে শুনছি। তিনি আস্তে আস্তে গান করছেন। আমার মনে হলো, নদীর ঢেউগুলোও যেন তাঁর গান মন দিয়ে শুনছে। গান শেষ হলে আমি আমার মুগ্ধতার কথা জানালাম। বললাম, আপনি এত ভালো গান করেন কী করে?
‘তিনি বললেন, মুজিব। আমার গান ভালো লেগেছে, কারণ এ হলো আমার বাংলার মাটির গান, বাংলার জলের গান। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। এই যে ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, বাউল–কত প্রকারের গান, এ আর থাকবে না। আমাদের কৃষ্টি-সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গান তুমি ভালোবাসো, এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা-কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।
‘আমি তাঁকে কথা দিলাম। আমার জীবন দিয়ে হলেও বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার চেষ্টা আমি করব।
.
শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে আসা পুরো সমাবেশকে কতগুলো ছোট ছোট দলে ভাগ করা হলো। আলাদা আলাদা করে বসলেন তাঁরা। মুজিবও যোগ দিলেন একটা গ্রুপে। আলোচনায় অংশ নিলেন। কতগুলো প্রস্তাব এই ছোট গ্রুপে নেওয়া হলো। যেগুলো আবার বড় অধিবেশনে পেশ করে পাস করে নেওয়া হবে।
মানিক মিয়া এসব আলোচনার কোনোটিতেই অংশ নিলেন না। তিনি বললেন, ‘আরে, এদের প্রস্তাব, সিদ্ধান্ত সব আগে থেকে ঠিক করে রাখা হয়েছে। এইসব আলোচনার কোনো মানেই হয় না।’
এই সম্মেলনে মুজিবের দেখা হয়েছিল দুজন জগদ্বিখ্যাত সাহিত্যিকের সঙ্গে। একজন রাশিয়া থেকে আসা আইজাক আসিমভ। সায়েন্স ফিকশনের সবচেয়ে বড় লেখক। আরেকজন নাজিম হিকমত। তুরস্কের বিখ্যাত কবি, কিন্তু দেশত্যাগী, তাঁর একমাত্র দোষ তিনি কমিউনিস্ট। এখন আশ্রয় নিয়েছেন রাশিয়ায়।
ব্যাঙ্গমা বলল, ‘শেখ মুজিব কী রকম গুণীর কদর বুঝতেন, এইবার বুইঝা লও।
‘এই দুজনের কথা তিনি কখনো ভোলেন নাই। ১৯৬৭ সালে কারাবন্দী থাইকা যখন তিনি কোনো কাগজপত্র নোট ডায়েরি ছাড়াই গড়গড় কইরা নিজের জীবনের স্মৃতিকথা লিখতে বসলেন, তখন তিনি আলাদা কইরা আসিমভ আর নাজিম হিকমতের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা বিশেষ গুরুত্বের সাথেই লিখবেন।’
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘হ। মুজিবরের স্মরণশক্তি যেমন ভালা আছিল, তেমনি ভালা আছিল তাঁর গুণের কদর করার ক্ষমতা। তাই তো তিনি এদের কথা, ১৫ বছর পরেও লেখতে ভোলেন নাই।’
শেখ মুজিব নতুন চীন দেখে মুগ্ধ। শান্তি সম্মেলনের আগে ১ অক্টোবরে হয়েছিল স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান। মুজিবদের পেছনেই উঁচু বেদিতে ছিলেন মাও সে-তুং, মাদাম সান ইয়েৎ সেন, চৌ এন-লাই, লিও শাও চি প্রমুখ। কুচকাওয়াজ হলো। ৫ লাখ মানুষের শোভাযাত্রা ছিল কাল, সংবাদপত্র পড়ে পরের দিন বিড়বিড় করছেন মুজিব, কিন্তু কোনো বিশৃঙ্খলা নাই। বিপ্লবী সরকার সমস্ত জাতটার মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছে।
প্রথম রাতে মুজিবরা খেতে গিয়েছিলেন গাড়িতে করে, পাকিস্তানের পুরো প্রতিনিধিদল, তাদের দলনেতা পীর সাহেবের নেতৃত্বে, একটা মুসলমান হোটেলে। সেখানে সবকিছুই অসম্ভব ঝাল। মুজিব একটুখানি খাবার মুখে দিয়েই খাওয়া বন্ধ করে দিলেন, পেটে ব্যথা অনুভূত হলো। ফিরে এসে হোটেল রুমে রাখা আঙুর, আপেল খেয়ে কোনোরকমে শুয়ে পড়ে রাত কাটিয়ে দিলেন। মানিক মিয়া পরের দিন দুপুরবেলা ঘোষণা করলেন, ‘আমি আর ওই ঝালওয়ালা মুসলিম খাবার খেতে পারব না, এই পিকিং হোটেলের খাবার অর্ডার দিয়ে খাব।’ তিনি পিকিং হোটেলে খেয়ে সেখানেই দিবানিদ্রা দিলেন আরামে। মুজিব দুপুরবেলাও গেলেন পীর সাহেবের পিছু পিছু মুসলিম হোটেলে। উফ্। এত ঝাল! রাতের বেলা দেখা গেল পীর সাহেবের পেছনে দু-তিনজন ছাড়া আর কেউ নাই। তাঁরা মুসলিম হোটেলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়ে পিকিং হোটেলেই অর্ডার দিয়ে ভাত, ডিম, চিংড়ি, মুরগি, গরুর মাংস ইত্যাদি খেয়ে নিতে লাগলেন আরাম করে।
তবু হাত দিয়ে ভাত-তরকারি মেখে খেতে না পারলে কি আর ভালো লাগে। বাঙালির খাওয়া হলো ডাল, ভাত, মাছের ঝোল। মুজিব খুবই বাঙালি খানার অভাব অনুভব করছেন। সেই সমস্যারও অলৌকিক সমাধান হয়ে গেল। মুজিব পেয়ে গেলেন তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহপাঠী মাহাবুবকে, যে কিনা পিকিংয়ের পাকিস্তান দূতাবাসে তৃতীয় সেক্রেটারির পদে নিয়োজিত। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে মাহাবুব চলেছেন সস্ত্রীক, হঠাৎ তাঁকে দেখতে পেয়ে মুজিব চিৎকার করে উঠলেন, ‘মাহাবুব, মাহাবুব’; বাঙালি-বিরল চীনা রাস্তায় তাঁর নাম ধরে কে ডাকছে—মাহাবুব চমকে উঠে তাকিয়ে দেখতে পেলেন মুজিবকে, এসে জড়িয়ে ধরলেন। এর পর থেকে মাহাবুবের বাড়িতেই খাওয়াদাওয়া করতেন।
১৫ বছর পর মুজিব সেই স্মৃতি উল্লেখ করে লিখবেন, ‘যে কয়দিন পিকিংয়ে ছিলাম, রাতে ওদের বাড়িতেই খেতাম। বাংলাদেশের খাবার না খেলে আমার তৃপ্তি কোনো দিনও হয় নাই।’
ব্যাঙ্গমা বলল, ‘দেখলা, মুজিব তাঁর স্মৃতিকথায় দেশটার নাম কী বলল?
‘বাংলাদেশ। মুজিব তো কখনো পূর্ব পাকিস্তান কথাটা মুখে আনতে চাইতেন না। তিনি কইতেন, পূর্ব বাংলা। তারপর আস্তে আস্তে বাংলাদেশ কথাটা তাঁর মনে ধরে। ১৯৫২ সালেও তিনি চীনে গিয়া যেইটা মিস করলেন, সেইটা বাংলাদেশের খাবার। পাকিস্তানের খাবার না।’
চীনে আরেক অসুবিধা হতে লাগল মুজিবের। তিনি দাড়ি কাটার ব্লেড খুঁজে পাচ্ছেন না। এখন এই দেশে দাড়ি কামানোর একমাত্র উপায় হলো সেলুনে বসে নাপিতের হাতে ক্ষৌরকর্ম করা। কিন্তু পুরো চীন ছুঁড়েও কোথাও ব্লেড পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ চীন তখনো ব্লেড উৎপাদন শুরু করে নাই। আমদানি করে ব্লেড এনে দাড়ি কামানোর কোনো মানে হয় না। ক্ষুর দিয়ে দাড়ি কামাও। এই হলো চীনের নীতি। চীনে বিদেশি সিগারেট পাওয়া যায় না। মুজিবের মনে ভাবনা, কোরিয়ার যুদ্ধের সময় দেশে কিছু বিদেশি মুদ্রা এসেছিল, সেই টাকা আমরা ব্যয় করেছি জাপানি পুতুল আমদানি করে, আর চীনে বিদেশি মুদ্রা একমাত্র ব্যয় করা হয় শিল্প-কলকারখানা স্থাপনে
সম্মেলন শেষ হয়ে গেছে। আতাউর রহমান খান আর মানিক মিয়া দেশে ফিরে গেছেন। মুজিব আর ইলিয়াস রয়ে গেলেন। চীনটা ভালো করে দেখে নেওয়া যাক। খরচ তো সব শান্তি কমিটি’ দেবে। তারা সঙ্গে দোভাষী দেবে, চলাফেরা থাকা-খাওয়ার দায়দায়িত্ব তাদের, আর সেই দায়িত্ব তারা সুচারুভাবে পালন করে চলেছে।
মুজিব ও ইলিয়াস গেছেন সাংহাই। দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহর বলে মনে হলো সাংহাইকে। সেখানে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হলো সবচেয়ে বড় টেক্সটাইল মিলে। এসবই জাতীয়করণ করা হয়েছে। শ্রমিকেরা এর মালিক। শ্রমিকদের থাকার জন্য সুন্দর ও বিশাল কলোনি বানানো হয়েছে। সেসব দেখানো হলো মুজিবদের।
মুজিব বললেন, ‘আমি কলোনির ভেতরে কোনো একটা শ্রমিকের বাড়িতে যেতে চাই। তারা কেমন আছে, সেটা স্বচক্ষে দেখতে চাই।’
ইলিয়াস বললেন, ‘গাইডকে বলো। সেই নিয়ে যাবে।’
মুজিব বললেন, ‘এখন বলব না। হঠাৎ একটা বাড়ির সামনে গিয়ে বলব, এই বাড়িটা দেখতে চাই। তা না হলে ওদের কোনো সাজানো বাড়িতে নিয়ে যাবে, যেটা হয়তো দর্শনার্থীদের জন্য বিশেষভাবে গুছিয়ে রাখা হয়েছে।’
মুজিব তা-ই করলেন। একটা বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে দোভাষীকে বললেন, ‘এই কলোনির যেকোনো একটা বাড়ির ভেতরটা দেখতে চাই। এদের ঘরের ভেতরের অবস্থাটা আমি দেখব। ব্যবস্থা করা যাবে?’
দোভাষী ভেতরে গেল, ফিরে এসে বলল, ‘চলো।’
তাঁরা ভেতরে গেলেন। একজন মহিলা দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁদের তিনি স্বাগত জানালেন। ফ্ল্যাটের ভেতরে পা রাখলেন মুজিব আর ইলিয়াস। ভেতরে গিয়ে বসলেন তাঁরা। দু-তিনটা চেয়ার, একটা খাট, ভালো বিছানা। পুরো বাড়িতে একটা পরিচ্ছন্নতা ও সম্পন্নতার চিহ্ন ছড়িয়ে আছে যেন। গৃহকর্ত্রীও শ্রমিক, এক মাস আগে তাঁদের বিয়ে হয়েছে, স্বামী গেছেন কাজে।
দোভাষী বললেন, ‘আপনারা বাড়ির ভেতরটা দেখুন।’
মুজিব ও ইলিয়াস অন্দরে গেলেন। আরও একটা শোবার ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম। সবটা মিলিয়ে একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য যথেষ্টরও বেশি ব্যবস্থা।
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আপনারা খবর না দিয়ে এসেছেন। আপনাদের এখন আপ্যায়ন করি কীভাবে! একটু চা খান।’
তিনি ভেতরে গিয়ে চা বানিয়ে আনলেন, দুধ-চিনি ছাড়া চীনা চা। তারা চা খেলেন।
মুজিব বললেন ইলিয়াসের কানে কানে, ‘এর নতুন বিয়ে হয়েছে, একে কোনো উপহার না দিয়ে যাই কী করে? কী দেওয়া যায়?’
হঠাৎ মুজিবের নজর পড়ল তার নিজের হাতের আঙুলের দিকে, বেশ তো একটা আংটি সেখানে শোভা পাচ্ছে।
মুজিব আংটি খুলে ফেললেন। দোভাষীকে বললেন, ‘এই সামান্য উপহার আমরা ভদ্রমহিলাকে দিতে চাই। কারণ, আমাদের দেশের নিয়ম হলো, কোনো নতুন বিয়েবাড়িতে গেলে বর-কনের জন্য কিছু নিয়ে যেতে হয়, তাদের উপহার দিতে হয়
ভদ্রমহিলা কিছুতেই সেই আংটি নেবেন না।
মুজিব বললেন, ‘না নিলে আমরা দুঃখিত হব। বিদেশি অতিথি আমরা, অতিথিকে দুঃখ দিতে নাই। চীনের লোক অতিথিপরায়ণ হয়, এটা শুনেছি, দেখছি।’
ভদ্রমহিলা আংটি নিলেন।
পরের দিন সেই দম্পতি সাংহাইয়ের কিংকং হোটেলে শেখ মুজিবের কাছে এসে হাজির। তাঁরাও একটা উপহার এনেছে। এবার মুজিব বললেন, ‘না না, বিয়ের উপহারের বদলে কোনো উপহার নেওয়ার নিয়ম বাংলাদেশে নাই।
কিন্তু নাছোড় দম্পতি উপহার দেবেনই। মুজিবকে নিতে হলো। চীনের স্বাধীনতার প্রতীকচিহ্নিত কলম।
প্লেনে উঠে পড়েছেন মুজিব, ইলিয়াস। তাঁরা ফিরে আসছেন স্বদেশে। মুজিবের মনে নানা ভাবনা। পাকিস্তান স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৭ সালে, চীন স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৯ সালে। স্বাধীন হয়ে পাকিস্তান সরকার এমন সব কাজ করছে, দেশ ঝিমিয়ে পড়েছে। আর চীনা সরকার সমস্ত জাতিকে জাগিয়ে তুলেছে। ওদের দেশের সরকার মানুষকে বোঝাতে পেরেছে, দেশটাও জনগণের, দেশের সম্পদও জনগণের। আর পাকিস্তানের সরকার বোঝাতে পেরেছে, দেশটাও জনগণের নয়, সম্পদ কতিপয় একটা বিশেষ গোষ্ঠীর।
ব্যাঙ্গমা ঠোঁট বাঁকাল। ব্যাঙ্গমি পাখা ঝাপটাল।
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘মুজিব ১৫ বছর পরে কী লিখবেন স্মৃতিকথায়?’
ব্যাঙ্গমা বলল, ‘খুব একটা জরুরি কথা লিখবেন তিনি। বলবেন, চীনে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করছে কমিউনিস্টরাই। আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসাবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির যন্ত্র যত দিন দুনিয়ায় থাকবে, তত দিন দুনিয়ার মানুষের উপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধপরিকর। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের জনগণের কর্তব্য বিশ্ব শান্তির জন্য সংঘবদ্ধভাবে কাজ করা।’
মুজিব চীনে বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে বাংলায় বক্তৃতা করেছেন। সেই খবর ছড়িয়ে পড়ল শরতের বাতাসে, সেই খবর ছড়িয়ে পড়ল বাঙালির কানে কানে। সবাই খুব খুশি। তারা ফিরে আসার পর পূর্ব পাকিস্তান শান্তি কমিটির উদ্যোগে চীন-ফেরত প্রতিনিধিদলের সংবর্ধনার আয়োজন করা হলো।
তাতে খন্দকার ইলিয়াস উপস্থিত হলেন চীনের জাতীয় পোশাক, গলাবন্ধ কোট আর ট্রাউজার্স পরে।
প্রতিনিধিরা সবাই চীনের সমাজব্যবস্থা, জনগণ ও নেতাদের প্রশংসা করে বক্তব্য রাখলেন।
তারপর ঘোষণা এল, এবার বক্তৃতা দেবেন শেখ মুজিবুর রহমান।
পুরো হল সোল্লাসে করতালি দিয়ে উঠল।
গুঞ্জন উঠল, তিনি চীনে বক্তৃতা দিয়েছেন বাংলায়। আরও জোরে তালি হবে। তালি…
২৭.
তাজউদ্দীন আহমদের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসতে চাইছে। তিনি বসে আছেন শ্রীপুর রেলওয়ে স্টেশন ছেড়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেওয়া ট্রেনে। তাকিয়ে আছেন প্ল্যাটফরমে দাঁড়ানো স্কুলের ছাত্র-আর শিক্ষকদের দিকে। সবাই আজ এসেছে তাঁকে বিদায় জানাতে। এই স্কুলে তিনি ছিলেন এক বছর তিন মাস তিন দিন। যোগ দিয়েছিলেন সহকারী শিক্ষক হিসেবে, আজ অবশ্য বিদায় নিলেন প্রধান শিক্ষক হিসাবে।
গত সোয়া এক বছরে তাঁর সময় চার ভাগে ভাগ করে নিতে হয়েছিল। একটা ভাগে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে স্নাতক শ্রেণীতে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া। এখন তিনি তৃতীয় বর্ষে। এক ভাগে আছে তাঁর গ্রামের বাড়ি। বনের সঙ্গে বাড়ি, বন বিভাগের দুর্নীতি ইত্যাদি নিয়ে মামলা- মোকদ্দমা লেগেই আছে। তিনি নিপীড়িতের পক্ষে, পীড়কের বিরুদ্ধে সোচ্চার, ঢাকায় কামরুদ্দীন সাহেব ওকালতি করেন, তাঁদের কাছে তিনি নিয়ে যান এই এলাকার লোকজনদের, যারা ঠিক জানে না ন্যায়বিচারের জন্য কোথায় কার কাছে যেতে হবে। আর এক ভাগে আছে এই শ্রীপুর স্কুলের শিক্ষকতা। পরীক্ষার খাতা দেখা থেকে শুরু করে ক্লাসে পড়ানো, সরকারের নানা বিভাগে দৌড়াদৌড়ি করা স্কুলের উন্নয়নের জন্য, আন্তস্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় স্কুল যোগ দিলে তার পাশে দাঁড়ানো, স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলা হলে রেফারির দায়িত্ব পালন করা—এসবই তাঁকে করতে হয়েছে, কোনো রকমের গাফিলতি ছাড়াই। তারপর আছে রাজনীতি।
যুবলীগের নেতা তিনি। ভাষা আন্দোলনের কর্মী। আবার একই সঙ্গে তিনি চেষ্টা করছেন কামরুদ্দীন আহমদকে সঙ্গে নিয়ে একটা বিকল্প রাজনৈতিক দল গঠনের। আওয়ামী মুসলিম লীগ মুসলিম লীগের লেবাস ছাড়তে পারছে না। সাম্প্রদায়িকতার সম্পূর্ণ ঊর্ধ্বে উঠে পরিচালিত হবে, এমন একটা রাজনৈতিক দলের প্রয়োজনীয়তা তাঁরা অনুভব করেন।
ট্রেন নড়ে উঠে ধীরে ধীরে ঢাকার দিকে চলতে শুরু করেছে। কয়লার ইঞ্জিনের ঝিকঝিক শব্দ কানে আসছে। তাজউদ্দীন তাঁকে বিদায় দিতে আসা ছাত্রদের ওপর থেকে চোখ সরাতেই পারছেন না। পুরো স্কুলের ছাত্র- শিক্ষকেরা চলে এসেছে স্টেশনে, তাঁকে বিদায় জানানোর জন্য। এরা এত ভালোবাসে তাঁকে! তিনিও এদের এত ভালোবেসে ফেলেছেন!
দুপুরে ছাত্ররা আয়োজন করল তাঁর বিদায়ের অনুষ্ঠান। অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র আবদুল বাতেন তাঁকে ফুলের মালা পরিয়ে দিল। সেই মালা গলায় পরে তাজউদ্দীনের মনে হলো, এই ফুল কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো নির্জীব হয়ে পড়বে, কিন্তু ছেলেদের ভালোবাসার স্মৃতি তাঁর মন থেকে কোনো দিনও মুছে যাবে না। এই ভালোবাসার স্মৃতি চিরদিন সজীব থাকবে, তাজা থাকবে।
বক্তৃতা দেবার পালা এল তাজউদ্দীনের। ঘোষণা হলো, এবার ভাষণ দেবেন আজকের অনুষ্ঠান যাঁকে ঘিরে, আমাদের প্রাণপ্রিয় প্রধান শিক্ষক, এই এলাকার গর্ব জনাব তাজউদ্দীন আহমদ।
তিনি উঠলেন। দাঁড়িয়ে থাকলেন। তাঁর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছে বাষ্পে। তাঁর গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না। ছেলেরা সবাই কাঁদতে আরম্ভ করল, কাঁদতে লাগলেন শিক্ষকেরাও। এই রকম একটা আবেগঘন পরিস্থিতি তৈরি হবে, তাজউদ্দীন ভাবতেও পারেননি। তিনি কখনো লোকসমক্ষে এইভাবে কান্নাকাটি করেননি।
অনুষ্ঠানের পর যখন তিনি রেলস্টেশনের দিকে রওনা দিলেন, ছেলেরা আর শিক্ষকেরা চলল তাঁর পিছু পিছু। যতক্ষণ না ট্রেন আসে, তারা দাঁড়িয়েই রইল।
তাজউদ্দীনের সঙ্গে তাঁর ভাইঝি শাহিদা, ও ঢাকায় প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা দিচ্ছে। তাকে তিনি সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন। ১৭ কারকুন বাড়ি লেনের ভাড়া বাসায় শাহিদা রাতে থাকবে। কালকে তার পরীক্ষা।
এই মেয়েটি অতি অল্প বয়সে পিতৃহারা হয়। এরা তিন ভাইবোন। তিনজনকেই লেখাপড়ার দিকে ঝুঁকিয়েছেন তাজউদ্দীন। তিনিই এখন তাদের অভিভাবক। বাড়ি থেকে দুই ভৃত্য সোবহান আর আকবর শাহিদাকে এনেছে শ্রীপুর স্টেশন পর্যন্ত।
শাহিদা বলল, ‘চাচা, আপনার চোখে পানি?’
তাজউদ্দীন রুমাল বের করে চোখ মুছলেন। ট্রেন চলছে। ঠান্ডা বাতাস আসছে জানালা দিয়ে।
ছেলেরা চোখের আড়াল হয়ে গেল। কিন্তু মনের আড়াল তারা হবে কি কোনো দিনও? তাজউদ্দীন ভাবতে লাগলেন।
হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছিটা আসছে। নভেম্বর মাসে বৃষ্টি! তিনি শাহিদাকে বললেন, ‘গায়ের চাদরটা ভালোমতো জড়িয়ে নাও। ঠান্ডা লেগে যাবে হঠাৎ করে।’
শাহিদা তার গায়ের চাদর টানাটানি করতে লাগল।
তাজউদ্দীন চাকরিটা ছাড়লেন কিশোর মেডিকেল হলে একটা চাকরি পেয়েছেন বলে। বাড়ি-শ্রীপুর-ঢাকা করতে গিয়ে তাঁর অনেক সময় ও উদ্যম অপচয় হয়ে যায়। এবার হয়তো একটু বেশি সময় পাওয়া যাবে।
কিশোর মেডিকেল হলটা তাঁর বন্ধু ডা. এম এ করিম সাহেবের। মিটফোর্ড থেকে এলএমএফ পাস করে তিনি জগন্নাথ কলেজে আইএসসি পড়েন, ওই সময় তিনি ছাত্র সংসদের সহসভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর কিশোর মেডিকেল হল ছিল রাজনৈতিক কর্মীদের আড্ডাখানা। তিনি যুবলীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, আবার কমিউনিস্টদের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগটা বেশ অন্তরঙ্গ। তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করেন, অনেক রাত তিনি ডা. করিমের সঙ্গে তাঁর বাসাতেও কাটিয়ে দেন।
হোসেন মাস্টারও তাঁর সঙ্গে ট্রেনে সহযাত্রী হয়েছেন। তিনি বললেন, আজকা আকাশটা কাঁদতেছে।
হোসেন মাস্টার ইংরেজি ও বাংলা পড়ান। এঁরা সহজ কাব্য করতে পছন্দ করেন।
তাজউদ্দীন মৃদু হাসলেন। কিন্তু তাঁরও মনে হতে লাগল, আজ আকাশের ও মন খারাপ!
শাহিদা বলল, ‘চাচাজান, সিনেমা দেখব।
ওর পরীক্ষা শেষ হয়েছে। পরীক্ষা সে ভালোই দিয়েছে। এখন তো সে একটা সিনেমা দেখার আবদার করতেই পারে। তাজউদ্দীন আহমদ ভাইঝিকে নিয়ে চললেন রূপমহল হলে। ওখানে প্রদর্শিত হচ্ছে রানী ভবানী সিনেমা শেষ।
তাজউদ্দীন বললেন, ‘কেমন লাগল?’
শাহিদা বলল, ‘ভালো। তবে শেষটা আরও ভালো হতে পারত!’ বলে কী এই মেয়ে! তাজউদ্দীন চমকে উঠলেন।
ভাইঝিকে বাসায় রেখে তাজউদ্দীন ছুটলেন যোগীনগর। যুবলীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা হচ্ছে। তিনি ধরতে পারেন কি পারেন না!
শেষ ১০ মিনিট পাওয়া গেল সভার।
গলার ভেতরটা খুসখুস করছে। গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে ঠান্ডা লেগে গেছে তাজউদ্দীনের। তিনি অস্বস্তি বোধ করছেন।
সভার ভেতরেই কাশি দিতে থাকলেন তিনি। কী বিপদ!
ভাগ্যিস, সভা তাড়াতাড়ি শেষ হলো! সভাপতি মাহবুব আলী তাড়াতাড়িই সভা শেষ করে দিলেন। তাজউদ্দীন উঠলেন।
শীতের আমেজ বাইরে। তিনি গলার মাফলারটা ভালোমতো জড়িয়ে নিয়ে সাইকেলে উঠলেন। কানের কাছে শীতের বাতাস শিস বাজাতে লাগল।
সাইকেল চালাতে চালাতেই তাজউদ্দীনের মনে পড়ল শ্রীপুর স্কুলের কথা, ছাত্রদের কথা, সহকর্মীদের কথা।
এই ছেলেগুলো এইভাবে তাঁর হৃদয় দখল করে বসে আছে! তাঁর সেই হৃদয় আবার দ্রবীভূত হতে লাগল!
২৮.
সওগাত পত্রিকা অফিসে গেছেন আনিসুজ্জামান। হাসান হাফিজুর রহমান ছিলেন সেখানে। তাঁর হাতে এক তোড়া কাগজ। সেটা তিনি ধরিয়ে দিলেন আনিসুজ্জামানের হাতে। শিরোনামহীন এক দীর্ঘ কবিতা :
আম্মা তাঁর নামটি ধরে একবারও ডাকবে না তবে আর?
ঘূর্ণিঝড়ের মতো সেই নাম উন্মথিত মনের প্রান্তরে
ঘুরে ঘুরে ডাকবে, জাগবে
দুটি ঠোঁটের ভেতর থেকে মুক্তোর মতো গড়িয়ে এসে
একবারও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে না, সারাটি জীবনেও না?
কি করে এই গুরুভার সইবে তুমি? কতোদিন?
আবুল বরকত নেই; সেই অস্বাভাবিক বেড়েওঠা
বিশাল শরীর বালক, মধুর স্টলের ছাদ ছুঁয়ে হাঁটতো যে তাঁকে
ডেকো না,
আর একবারও ডাকলে ঘৃণায় কুঁচকে উঠবে-
সালাম, রফিকউদ্দিন, জব্বার— কি বিষণ্ন থোকা থোকা নাম;
এই এক সারি নাম বর্শার তীক্ষ্ণ ফলার মতো এখন হৃদয়কে হানে;…
আনিসুজ্জামান দীর্ঘ সেই কবিতাটি পাতার পর পাতা উল্টে পড়ে গেলেন। সবটা যে বুঝলেন তা নয়, কিন্তু আবেগে তার শরীর রোমাঞ্চিত হলো।
জিগ্যেস করলেন, ‘কোথায় ছাপবেন?’
হাসান বললেন, ‘দেখি।’
সওগাত প্রেসে হাসান তখন ছাপছিলেন ফজুলল হক হল বার্ষিকী, তাঁরই সম্পাদনায়। বার্ষিকীটা যখন বেরোল, তখন সবাই বিস্মিত, অনেকেই মুগ্ধ; কারণ এটা দেখতে একেবারে হল ম্যাগাজিনের মতো নয়, প্রভোস্টের ছবি নাই, সম্পাদনা পরিষদ বা খেলোয়াড়দের গ্রুপ ছবি ঠাঁই পায়নি, কার্টিজ কাগজে একেবারে সাহিত্যপত্রিকার মতো করে ছাপা। তাতেই কবিতাটা ছাপা হলো ‘অমর একুশে’ নাম দিয়ে।
এই কবিতা লেখার পর হাসানের মনে হলো, একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম বার্ষিকীর আগেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়ে একটা পত্রিকা বের করতে হবে। এটি হবে সাহিত্য পত্রিকা
খুব সুন্দর একটা একুশে সংকলন বের করলেন হাসান। কিন্তু সেটা একুশে ফেব্রুয়ারির আগে বের করতে পারলেন না। ছাপাখানায় কখনো কোনো জিনিস সময়মতো পাওয়া যায় না।
লেখা পেতে দেরি হয়েছিল। হাসান চেষ্টা করছিলেন সবার লেখা ঠিকমতো সময়মতো জোগাড় করতে, লেখকেরা আবার কুড়ে প্রকৃতির হয়ে থাকেন কিনা। শামসুর রাহমান লেখা দিলেনই না, কলকাতার পরিচয় পত্রিকায় সদ্য প্রকাশিত তাঁর একটা কবিতা পুনর্মুদ্রণ করে দিলেন হাসান।
কিন্তু আসল সমস্যা কাগজ কেনার টাকা জোগাড় করা। সেটাই করে উঠতে পারছিলেন না হাসান।
সেই টাকা জোগাড় করে ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ নাম নিয়ে সংকলনটা বেরোল মার্চে।
কাগজের টাকা জোগাড় হলো বটে, ছাপাখানার বাকির টাকা আর শোধ হয় না। ছাপাখানার মালিক মোহাইমেন সাহেবের ভাই মুকিত সাহেব হাসানকে খুব বকাবকি করলেন। আনিসুজ্জামানও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি খুব মন খারাপ করলেন। একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনটিতে আনিসুজ্জামানের গল্প ছাপা হয়েছে। ব্লকে ছাপা উৎসর্গপত্রের লেখাটাও আনিসুজ্জামানের নিজের হাতের।
কাজেই ছাপাখানার টাকা পরিশোধ করতে না পারার কারণে হাসান যে বকুনি খেলেন, তার অংশ যেন আনিসুজ্জামানকেও বিদ্ধ করছে।
হাসান সেদিনই বাড়ি চলে গেলেন।
গুড় বিক্রি করে টাকা নিয়ে ফিরে এলেন ঢাকায়।
শোধ করলেন প্রেসের দেনা।
২৯.
আবার এল ফেব্রুয়ারি। আবার এল একুশে ফেব্রুয়ারি। ১৯৫৩ সাল। একটা বছর ধরে কারাগারে আটক কতজন! ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভাষা আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা। উদ্দীপনা। তাঁরা কারাগারের ভেতরে বসেই শুনতে পান কোকিলের ডাক। ফাল্গুনের দখিনা বাতাস তাদের মনকে উদাস করে, একটা বছর আগের ফাল্গুনের স্মৃতি তাঁদের মনে উঁকি দেয়।
তরুণ ফজলুল করিমের উত্তেজনা বেশি। আইএ ক্লাসের ছাত্র, বয়স কম, কিন্তু সান্নিধ্য পেয়েছে মহাজনদের, মওলানা ভাসানী ছিলেন এই পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডে, এখনো আছেন অধ্যাপক অজিত গুহ, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা এবং শামসুল হক।
তিন নামকরা অধ্যাপক পড়ান ফজলুল করিমকে, মুনীর চৌধুরী পড়ান ইংরেজি। তিনি ইংরেজি সাহিত্যে এমএ, কারাগারে বসবাসের সময়টাকে ফলপ্রসূ করতে এখন পড়ছেন বাংলা সাহিত্যে এমএ, তাঁকে বাংলা পড়ান অধ্যাপক অজিত গুহ। মুনীর চৌধুরী তরুণ ছাত্রকে প্রবল উৎসাহে নাটক পড়ান, পড়াতে গিয়ে বসা থেকে তিনি দাঁড়িয়ে যান, এবং নিজেই সেই নাটকে অভিনয় করতে শুরু করে দেন। তিনি নিজেই আবার গল্প করেন, ছাত্রদের সঙ্গে কীভাবে মিশে যেতে পারেন তিনি, একবার নাকি তাঁর ছাত্র সিগারেট হাতে করে তাঁর সামনে এসে বলে, দিয়াশলাই হবে, মুনীর চৌধুরী বলেন, হবে; তিনি দিয়াশলাই এগিয়ে দিলে ছেলেটি সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে, পরে ক্লাসে গিয়ে দেখতে পায়, সে তার শিক্ষকের কাছ থেকে দিয়াশলাই নিয়েছে। নিজেই গল্প করেন, ক্লাসে তিনি এত উচ্চ স্বরে পড়ান যে অন্য ক্লাস থেকে শিক্ষকেরা তাঁকে চিরকুট পাঠান, আস্তে কথা বলুন।
মুনীর চৌধুরী ফজলুল করিমকে পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে এইসব গল্প করেন।
অজিত কুমার গুহ জগন্নাথ কলেজের বাংলার অধ্যাপক। রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে তাঁর অবস্থান প্রকাশ্য। তাই পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে। তিন অধ্যাপকই দিনাজপুর জেল থেকে এসেছেন। আগমনের প্রথম দিন অজিত গুহ নাম-পরিচয় জানতে চাইলেন ফজলুল করিমের। পরের দিন ভোরে চা- নাশতার পর্ব শেষ হলে তিনি এলেন এই তরুণের বিছানার কাছে। জানতে চাইলেন, ‘তোমার পড়াশোনার কী অবস্থা?’
ফজলুল করিম বললেন, ‘মার্চ মাসে আইএ পরীক্ষা, আমি প্রস্তুতি নিতে চাই।’
‘সাবজেক্ট কী কী নিয়েছ?’
‘বাংলা বিশেষ পত্র নিয়েছি।’
‘খুব ভালো। আমি তোমাকে বাংলা ও লজিক পড়াব। মুনীর চৌধুরী ইংরেজি পড়াতে পারবেন। মোজাফফর আহমদ পড়াবেন লজিক।’
শুনে ফজলুল করিম খুশিতে আটখানা। দেশের শ্রেষ্ঠ তিন শিক্ষককে তিনি পেয়ে গেলেন কারাগারে এসে। তাঁকে অর্থনীতি পড়ানোর দায়িত্ব নিলেন মোহাম্মদ তোয়াহা আর অলি আহাদ।
অজিত গুহ এই শিক্ষার্থীর দায়িত্ব যেন নিজে নিয়েছেন। জেলে বসে পরীক্ষা দেব, অনুমতি দিন—এই মর্মে দরখাস্ত লিখতে হলো ফজলুল করিমকে, ডিকটেশন দিয়ে লিখিয়ে নিলেন অজিত গুহ। নিজেই বাইরে থাকা শিক্ষকদের কাছ থেকে জেনে নিলেন পাঠ্যতালিকা, বইপুস্তকও তিনিই তাঁর সহকর্মীদের দিয়ে কিনিয়ে তাঁর নামে জেলগেটে আনানোর ব্যবস্থা করলেন। একটা জানালার ধারে ফজলুল করিমের বিছানা পাতা হলো। আশপাশে কেউ থাকবে না। তাতে ছেলের পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটবে। নিজের বিছানা পাতলেন ছাত্রের বিছানা থেকে পাঁচ-ছয় হাত দূরে। নিজের টাকায় অনেকগুলো এক্সারসাইজ খাতা কিনে আনালেন। পড়ার জন্য রুটিন তৈরি হলো।
শুধু পড়া নয়, ভালো খাদ্যের ব্যবস্থাও করলেন অজিত গুহ। একটা স্টোভ আনালেন। নুন-মসলাপাতি, ডিম, মাংস ইত্যাদি কিনে এনে নিজেই রাঁধেন। পরোটা, মাংস, শিঙাড়া ইত্যাদি বানিয়ে ওয়ার্ডের সব বন্দীকে খাওয়ান।
মুনীর চৌধুরী নিজেও বাংলায় এমএ পরীক্ষা দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাকেও বাংলা পড়ান অজিত গুহ।
কালিদাস তাঁর প্রিয় কবি।
মেঘদূত থেকে তিনি পড়ান, ‘কশ্চিৎ কান্তাবিরহ গুরুণা স্বাধিকার প্রমত্ত।’ বোঝাতেন মন্দ্রাক্রান্তা ছন্দ, আর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত অনূদিত মেঘদূত থেকে আবৃত্তি করেন :
‘পিঙ্গল বিহ্বল ব্যথিত নভোতল, কই গো কই মেঘ, উদয় হও,
সন্ধ্যার তন্দ্রার মূরতি ধরি আজ মন্দ্র-মন্থর বচন কও।’
.
আজ রাতে ফজলুল করিমের ঘুম আসতে চায় না। জানালার ধারে বিছানায় শুয়ে তিনি ছটফট করেন। অজিতদা রীতিমতো ১০টাতেই ঘুমিয়ে পড়েছেন।
কাল একুশে ফেব্রুয়ারি।
কারাগারের ভেতরেও পালন করা হবে।
আজ দুপুরবেলা মাক্কুশা মাজারের কাছ থেকে পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এসেছিল। তেজোদীপ্ত কণ্ঠে বক্তৃতা শোনা যাচ্ছিল, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দীদের মুক্তি চাই। ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বন্দীরা দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেলেন। দেখতে পেলেন মাজারসংলগ্ন মসজিদের দেয়ালে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছেন কিছু দিন আগে জেল থেকে ছাড়া পাওয়া আবদুল ওয়াদুদ পাটোয়ারী। তিনি ভাষণ দেওয়া শেষ করে বন্দীদের উদ্দেশে স্যালুট দিলেন। ফজলুল করিমের হাত আপনা-আপনি কপাল পর্যন্ত উঠে এল। তারপর ওয়াদুদ তাঁর দল নিয়ে চলে গেলেন। বন্দীরা নিচে নেমে এল। আবার মিছিল আসছে। আবারও সবাই দোতলা অভিমুখে রওনা দিলেন। দোতলার সিঁড়িটার মুখ একটা নড়বড়ে বাঁশের বেড়া দিয়ে আটকানো। তাঁরা সেই বেড়া ভেঙে ওপরে উঠে গেলেন।
একুশে ফেব্রুয়ারি কীভাবে পালন করা হবে, ঠিক করা হয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি কেউ খাদ্য গ্রহণ করবেন না। জেল কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানিয়ে দেওয়া হবে, সকালের নাশতা ও দুপুরের খাবারের টাকা যেন রাজবন্দী সাহায্য তহবিলে নগদ জমা দেওয়া হয়। কালো ব্যাজ ধারণ করা হবে।
জেলখানায় কালো কাপড় নাই। এ সমস্যার সমাধান কী হবে, কে জানে?
ফজলুল করিম ভাবলেন, তাঁর কালো ব্যাজটা জেলগেটে জমা আছে। নোয়াখালীতে যখন তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়, তখন তো তাঁর বুকে একটা কালো ব্যাজ ছিল। সেটা মাইজদী জেল কর্তৃপক্ষ জেলগেটে জব্দ করে। নোয়াখালী থেকে ঢাকায় আসার পরে ফজলুল করিম চিঠি লিখে ওই মূল্যবান ব্যাজটি ঢাকায় আনিয়ে নেন। কালকে সকালে উঠে গেট থেকে কি ওই ব্যাজটা নেওয়া যাবে না? দেবে ওরা? আর একটা ব্যাজ দিয়ে এতজন করবেটা কী?
এইসব নানা ছেঁড়াখোঁড়া ভাবনা তার রাতের ঘুম কেড়ে নেয়।
ভোরবেলা, চারটার সময় অজিত গুহ অভ্যাসমাফিক উঠে পড়েছেন। কিন্তু বাকি বন্দীরাও উঠে পড়লেন। বাইরে স্লোগানের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
এর মধ্যে দেখা গেল অজিত গুহ কালো ব্যাজের ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। তাঁর এক জোড়া সিল্কের মোজা ছিল। সেই মোজা কেটে তিনি কালো ব্যাজ বানিয়েছেন।
বেলা বাড়ছে। নাজিম উদ্দিন রোড ধরে ছোট ছোট মিছিল কালো পতাকা নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে চলে যাচ্ছে। রাস্তায় স্লোগান দিচ্ছে প্রভাতফেরির মানুষেরা, আর কারাগারের ভেতরে স্লোগান ধরল বন্দীরা : রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।
তখন বাইরের মিছিলকারীরা স্লোগান ধরল, রাজবন্দীদের মুক্তি চাই।
বেলা বাড়ছে, মিছিলের সংখ্যাও বাড়ছে।
মিছিলের আওয়াজ শুনলেই বন্দীরা দৌড়ে যাচ্ছেন দোতলায়। মিছিলে অনেক কালো পতাকা। এদেরও তো কালো পতাকা দরকার। মোহাম্মদ তোয়াহার কালো কার্ডিগানটাকে পতাকা বানিয়ে তারা দোলাতে লাগলেন।
আবার তাঁরা ছুটে নামেন নিচতলায়। যান পাঁচিলের কাছে। মুনীর চৌধুরী দরাজ গলায় স্লোগান ধরেন, বাকি ছয়-সাতজন তার জবাব দেন।
অনেক মিছিল গেল বংশাল রোড আর নাজিম উদ্দিন রোড ধরে।
.
বাইরে একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম বার্ষিকী পালিত হলো বিপুলভাবে। হাজার হাজার মানুষ, আবালবৃদ্ধবনিতা, খালি পায়ে চলল আজিমপুর কবরস্থানে। ফুলে ফুলে ছেয়ে গেল শহীদ বরকত আর শফিউরের সমাধি। মেডিকেল কলেজের সামনে যেখানে প্রথম গুলি হয়েছিল, সেখানেও ফুল দিল শোকার্ত প্ৰতিবাদী মানুষ।
কবরস্থানে নারীর প্রবেশ নিয়ে খাদেমদের সঙ্গে একটু বচসা হলো। তাঁরা বললেন, মেয়েরা কবরস্থানের ভেতরে ঢুকতে পারবে না। নিয়ম নাই। কিন্তু ভিড় গেল বেড়ে, শত শত মেয়ে আসতে লাগল, হাজার হাজার মানুষ, কে কাকে বাধা দেয় আর কেই-বা কার কথা শোনে। প্রথমে বলা হয়েছিল, কবরে ফুল দেওয়া যাবে না, কিন্তু ফুলে ফুলে ভরে গেল কবর।
তবে প্রভাতফেরির গান কেউ কবরস্থানের দেয়ালঘেরা চত্বরে গাইবে না, এই নিষেধটা মানা হলো।
প্রভাতফেরির মানুষের মুখে মুখে ধ্বনিত হলো তিনটা গান :
মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে,
আজিকে স্মরিও তারে।
ভুলব না এই একুশে ফেব্রুয়ারি
ভুলব না।
আর আবদুল লতিফ সুরারোপিত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর গান :
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি?
সন্ধ্যায় কার্জন হলে অনুষ্ঠান হলো। তাতেও এই তিনটা গান গাওয়া হলো।
লুৎফর রহমান যখন দরদ দিয়ে গাইতে লাগলেন, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’, তখন শ্রোতাদের চোখ ছলছল করে উঠল আপনা- আপনিই।