উষার দুয়ারে – ৩০
৩০.
পুরোপুরি পাগল না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত নুরুল আমিন সরকার শামসুল হককে জেলখানা থেকে ছাড়ল না।
তাঁর স্ত্রী আফিয়া খাতুনও বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ চলে গেলেন।
শামসুল হক রাস্তায় রাস্তায় ঘোরেন। তাঁর পরনে ছেঁড়া ময়লা কাপড়। একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা তরুণ লেখক ও সাংবাদিক আবু জাফর শামসুদ্দীনের। আবু জাফর শামসুদ্দীন বসে আছেন তাঁর বইয়ের দোকানে। হঠাৎই শামসুল হক সেখানে হাজির হন। তাঁর গায়ে একটা পুরোনো ছেঁড়া কালো আচকান। পরনে ময়লা পায়জামা। পায়ে শতচ্ছিন্ন ইংলিশ জুতা। আচকানের পকেট থেকে শামসুল হক এক তোড়া কাগজ বের করলেন। বললেন, পড়ে দেখেন। আবু জাফর শামসুদ্দীন পড়লেন। হিজ ইমপেরিয়াল ম্যাজেস্টি দি অলমাইটি আল্লাহ। একটা দরখাস্ত বা স্মারকলিপি। পূর্ব বাংলার অবস্থা বেশ খারাপ। আল্লাহ তাআলার সরাসরি হস্তক্ষেপ দরকার। আল্লাহ যেন তাড়াতাড়ি হস্তক্ষেপ করেন।
শামসুল হক বললেন, ‘এটা আল্লাহর কাছে পাঠাব। ডাকখরচ দরকার। ৫০টা টাকা হবে?’
আবু জাফর শামসুদ্দীন ১০টা টাকার একটা নোট বের করে বললেন, ‘আমার তো আর্থিক অবস্থা এত ভালো না, আপনি এইটাই রাখুন। তবে আপনি যাবেন না। বসুন। খেয়েছেন কিছু?’
তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সঙ্গে দিদার হচ্ছে। খাওয়াদাওয়া লাগে না।’
জাফর চা-বিস্কুট আনালেন। তিনি খেলেন। তারপর ১০ টাকা নিয়ে মুখ নিচু করে কাছারির দিকে চলে গেলেন। ডানে-বাঁয়ে কোনো দিকেও তিনি তাকাচ্ছেন না। জাফর বিস্মিত হয়ে তাঁর গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল জাফরের বুক থেকে।
.
আওয়ামী মুসলিম লীগের সভা হচ্ছে। শামসুল হক সাহেবকে বক্তৃতা করতে বলা হলো। তিনি বললেন, ‘আমি সারা পৃথিবীর খলিফা। এই নির্দেশ ওপর থেকে আমার ওপরে এসেছে।’
সবাই বিস্মিত। যাঁরা জানত, তারা উদ্বিগ্ন। কেউ কেউ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, কেউ বা মুখ টিপে টিপে হাসছেন।
৩১.
ঢাকার পল্টন ময়দান। আওয়ামী মুসলিম লীগের জনসভা। লোকে- লোকারণ্য। বক্তা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। বৈশাখ মাস। ভীষণ গরম। সোহরাওয়ার্দী সবে বক্তৃতা করতে দাঁড়িয়েছেন। একজন এসে তাঁর কানে কানে একটা খবর দিলেন।
সোহরাওয়ার্দী তাঁর ভাষণে বললেন, আজ পাকিস্তানের একটা বিরাট খবর আছে।
সভা শেষ হলো। মুজিব ফিরছেন সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে, জিপগাড়িতে। মুজিব তাঁর পাশে বসা। ‘লিডার, পাকিস্তানের খবর আছে বললেন। খবরটা কী?’
সোহরাওয়ার্দী বললেন, ‘খাজা নাজিম উদ্দিন সাহেবকে গভর্নর জেনারেল বরখাস্ত করেছে।’
‘এ তো খুশির খবর।’
‘এতে খুশি হওয়ার কিছু নাই।’
‘এটা তো খাজা সাহেবের প্রাপ্য।’
‘হ্যাঁ, শাসনতন্ত্র না দিয়ে আর সাধারণ নির্বাচন না করে এরা পাকিস্তানকে ষড়যন্ত্রের রাজনীতির লীলাক্ষেত্র বানিয়ে তুলেছে।
প্রধানমন্ত্রী বানানো হলো মোহাম্মদ আলী বগুড়াকে। তিনি মুসলিম লীগের সদস্যও না। আমেরিকায় রাষ্ট্রদূত ছিলেন পাকিস্তানের। তাঁকে দেশে ডেকে পাঠানো হলো। এবং তাঁকেই মুসলিম লীগেরও সভাপতি বানিয়ে দেওয়া হলো। মুজিব বললেন, ‘মোহাম্মাদ আলী বগুড়ার তো কোনো রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নাই, সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানও কম, এ তো আমেরিকা থেকে কোট- প্যান্ট টাই পরা ছাড়া আর কিছু শিখেও আসতে পারে নাই। এই প্রধানমন্ত্রী দিয়া পাকিস্তান চলবে?’
মুসলিম লীগের কেউ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করল না।
একমাত্র প্রতিবাদ করল পূর্ব বাংলার আওয়ামী মুসলিম লীগ।
বগুড়ার মোহাম্মদ আলী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে সত্যি সত্যি নানা হাস্যকর কাণ্ড করতে লাগলেন। একদিন বললেন, ভারতের সঙ্গে দেশরক্ষা চুক্তি করতে হবে। নেহরু আমার বড়দা হয়।
পাকিস্তানে ব্যাপক নিন্দা হলো সে কথা নিয়ে।
তারপর বললেন, ‘বাংলা জবান হামি ভুলিয়া গেছে।’
খুশি হলেন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল। আর খুশি হলো আমেরিকা। তারা ঠিক লোককেই বেছে নিয়েছে।
৩২.
শেখ মুজিব বললেন আতাউর রহমান সাহেবকে, ‘আপনি পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি হন। আমার পদের দরকার নাই। আমি কাজ করছি। কাজ করতেই থাকব।’
দিন পনেরো পরে আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন। নতুন কমিটি হবে।
মুজিব সারা দেশ ঘুরে ঘুরে পার্টি গড়েছেন। ৭০টা ইউনিয়নে পর্যন্ত লীগের কমিটি হয়েছে। প্রত্যেকটা জেলায় গেছেন। এর মধ্যে করাচি থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এসেছিলেন মুজিবের উদ্যোগে। তিনিও মুজিবের সঙ্গে ঘুরেছেন দেশের বিভিন্ন জেলায়। তাঁকে দেখে পার্টিতে উৎসাহের সৃষ্টি হয়েছে, জনসভাগুলোয় ভিড় হয়েছে।
এমনিতেই মুজিবের জনপ্রিয়তা সর্বমহলে। তার ওপর পার্টির শাখাগুলো গঠিত হয়েছে তাঁরই উদ্যোগে। কাজেই শেখ মুজিব যদি জেনারেল সেক্রেটারি হতে চান, সব কাউন্সিলরের ভোট তিনিই পাবেন, এতে কোনো সন্দেহ নাই। ৩৩ বছরের যুবক মুজিবকে এই পদে কেন্দ্রীয় নেতাদের সবাই যে চান, তা কিন্তু নয়। আবদুস সালাম খান মনে করেন, মুজিব তাঁকে গুরুত্ব কম দেন। আতাউর রহমান খানকে গুরুত্ব বেশি দেন। কাজেই তিনি চান না, মুজিব সাধারণ সম্পাদক হোক। তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন রংপুরের খয়রাত হোসেন, ময়মনসিংহের হাশিমউদ্দিন আহমদ প্রমুখ। মুজিব শুনতে পেয়েছেন, তিনি যাতে সাধারণ সম্পাদক হতে না পারেন, সে জন্যে তাঁরা টাকাপয়সা খরচ করতে শুরু করেছেন।
মুজিব একা একা বিড়বিড় করেন, পার্টির দরকারের সময় কেউ একটা পয়সা দিয়ে সাহায্য করল না, আর এখন আমাকে ঠেকানোর জন্য টাকাপয়সা খরচ করতে কোনো বেগ পেতে হচ্ছে না। হবই না সাধারণ সম্পাদক।’
তিনি সোজা চলে গেলেন আতাউর রহমান খান সাহেবের বাড়িতে। বৈঠকখানায় ঢুকেই হাঁক পাড়লেন, ‘খান সাহেব, কই?’
আতাউর রহমান খান পাঞ্জাবির বোতাম লাগাতে লাগাতে এলেন। বললেন, ‘কী ব্যাপার।’
মুজিব বললেন তিনি সাধারণ সম্পাদক হতে চান না। আতাউর রহমানই যেন এই পদে অধিষ্ঠিত হন।
আতাউর রহমান খান বললেন, ‘মাথা খারাপ! আমার কত কাজ। আমাকে ওকালতি করতে হয়। এখন যিনি সেক্রেটারি জেনারেল হবেন, তাঁকে অবশ্যই পূর্ণকালীন এই কাজই করতে হবে। আপনি ছাড়া কে এই কাজ পারবে! সারা দিনরাত পার্টির কাজ কে করতে পারবে। এই পদে আপনি ছাড়া আর কাউকে আমি কল্পনাও করতে পারি না।
মুজিব চেয়ারের হাতল শক্ত করে ধরে বললেন, ‘আপনি জানেন, কয়েকজন নেতা তলে তলে ষড়যন্ত্র করছে, আমার নাকি বয়স কম। একজন বয়স্ক লোকের সেক্রেটারি জেনারেল হওয়া দরকার। এই লোকগুলোর একটুও কৃতজ্ঞতা নাই। আমি রাতদিন পরিশ্রম করে সারা বাংলাদেশে ঘুরে ঘুরে পকেটের টাকা খরচ করে প্রতিষ্ঠান দাঁড় করায়েছি।’
আতাউর রহমান তাঁর হাতে হাত রেখে বললেন, ‘বাদ দেন ওদের কথা। কাজ করবে না। শুধু বড় বড় কথা।’
মুজিব বললেন, ‘আপনি ভালোভাবে চিন্তা করে বলেন। একবার আমি যদি বলি, আমি প্রার্থী, তাহলে কিন্তু আর কারও কথা আমি শুনব না।’
‘না না। আপনিই তো সেক্রেটারি হবেন। এইটাই ফাইনাল কথা।’
আতাউর রহমান খান জানেন, সালাম খান মুজিবের ওপরে রাগ করেছে আতাউর রহমান খানকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার জন্য।
মুজিব বেরিয়ে এলেন আতাউর রহমান খানের বাসা থেকে।
তিনি গেলেন কারকুন বাড়ি লেনে, মওলানা ভাসানীর সঙ্গে দেখা করতে।
ভাসানী বললেন, ‘এইটা আবার কওন লাগব নাকি!’ মাথায় তালপাতার আঁশের টুপি, গায়ে পাঞ্জাবি, পরনে লুঙ্গি—এই তো ভাসানীর চিরদিনের পোশাক। একটা তসবিহ তাঁর আসনের পাশে। ‘তুমিই হইবা সেক্রেটারি।’
মুজিব বললেন, ‘হুজুর, আমি তো সেক্রেটারি হইতে চাই না। আপনি আর কাউরে করেন। আমি জয়েন সেক্রেটারি থাকলাম। না-হয় মেম্বার থাকলাম। আমি তো কাজ করবই আপনি আমারে যা করতে বলেন।’
‘না না। এইটা নিয়া দ্বিতীয় কোনো কথা নাই। যাও গা। সামনে কাউন্সিল। কাম কি কম! হল ভাড়া করন লাগব, স্টেজ, মাইক, দাওয়াতের কার্ড, ম্যানিফেস্টো, গঠনতন্ত্র। টাকাও তো জোগাড় করন লাগব। আমি বেবাক বুঝি। তুমি আর এইটা নিয়া কথা বাড়াইয়ো না। তুমিই হইবা সেক্রেটারি।’
ভাসানী মুক্তি পেয়েছেন ১৯৫৩ সালের ১৯ এপ্রিল।
কাউন্সিলের তারিখ এগিয়ে আসছে। মুকুল সিনেমা হলে কাউন্সিল হবে। ইয়ার মোহাম্মদ খান মুকুল সিনেমা হল বুকিংয়ে সহায়তা করলেন। কাউন্সিলে যোগ দিতে সারা পূর্ব বাংলা থেকে নেতা-কর্মীরা আসতে লাগলেন। তাঁরা থাকবেন কোথায়? এত হোটেল তো ঢাকা শহরে নাই।
মুজিব নদীপারের ছেলে। জীবনের অনেকটা সময় কেটেছে নৌকায়। তিনি বুড়িগঙ্গায় বড় বড় নৌকা ভাড়া করলেন। সদরঘাটে সব নৌকা বাঁধা রইল। সোহরাওয়ার্দী সাহেব কাউন্সিলে যোগ দেবেন প্রধান অতিথি হিসাবে, সেটাও সবাই মিলে সাব্যস্ত করলেন।
মুজিবের বিরোধী গ্রুপ গিয়ে ধরল আবুল হাশিমকে, যিনি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, এবং সদ্য কারামুক্ত, প্রবীণ। ‘হাশিম সাহেব, আপনি আমাদের জেনারেল সেক্রেটারি হন।’
আবুল হাশিম নিমরাজি। বললেন, ‘আমার কোনো আপত্তি নাই। তবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হতে হবে।’
আবুল হাশিম তাঁর বাড়িতে দাওয়াত করলেন মওলানা ভাসানীকে। ভালোমন্দ খাওয়াদাওয়ার পর তিনি বললেন, ‘আমি তো একটা মুশকিলে পড়েছি। আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা আমাকে খুব করে ধরেছেন, আমি যেন সেক্রেটারি জেনারেল পদে কনটেস্ট করি। আমি বলেছি, আমি করতে পারি, কিন্তু আমাকে নির্বাচিত করতে হবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।’
ভাসানী বললেন, ‘সাধারণ সম্পাদক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হইতে পারবেন কি না জানি না। কারণ, মুজিব ঘোষণা কইরা দিছে, সে একজন প্রার্থী। তয় আপনি যদি সভাপতি হইতে চান, আমি ছাইড়া দিতে রাজি আছি।’
কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হলো। মওলানা ভাসানী সভাপতিত্ব করছেন। সোহরাওয়ার্দী প্রধান অতিথি। শত শত কাউন্সিলর যোগ দিয়েছে সম্মেলনে। প্রথম অধিবেশনের পর ভাসানী ঘোষণা করলেন, আতাউর রহমান খান, আবদুস সালাম খান, আবুল মনসুর আহমদ আর শেখ মুজিবুর রহমান বসবেন একত্রে। তাঁরা মিলে সর্বসম্মতিক্রমে তালিকা করে আনবেন নতুন কমিটির।
আতাউর রহমান খান মুজিবকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বললেন, “ওরা তো খুব ধরেছে আমি যেন সেক্রেটারি পদে প্রার্থী হই। কী করি বলেন তো?’
মুজিব বললেন, ‘আপনাকে তো আমিই প্রার্থী হতে বলছিলাম। আপনি শোনেন নাই। এখন আমি দাঁড়ায়া গেছি। এখন আপনি দাঁড়ালে নির্বাচন হবে। যে বেশি ভোট পাবে, সে সাধারণ সম্পাদক হবে।’
আতাউর রহমান খান বললেন, ‘ঠিক আছে ঠিক আছে, আমি প্রার্থী হচ্ছি না।’
.
চার নেতা বসলেন। কিন্তু একমত হতে পারলেন না।
মুজিব এসে কাউন্সিলে বললেন, ‘ভোট হবে।’
কাউন্সিল সভায় মওলানা ভাসানী সভাপতি, আতাউর রহমান খান, সালাম খান, খয়রাত হোসেন সহসভাপতি আর শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচিত হয়ে গেলেন।
সাবজেক্ট কমিটিতে দলের ইশতেহার ও গঠনতন্ত্র নিয়ে সারা রাত আলোচনা হলো। সেটাও পাস হয়ে গেলে মুজিব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, এত দিনে আওয়ামী লীগ একটা সত্যিকারের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে দাঁড়াল। ম্যানিফেস্টো ও গঠনতন্ত্র না থাকলে কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না।
তাজউদ্দীন আহমদকে করা হলো ঢাকা উত্তর আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক।
.
আমগাছে তখন ছোট ছোট আম ধরেছে। বড় বড় বোঁটায় সবুজ ছোট ছোট আম ঝুলে আছে।
সেগুলোর দিকে তাকিয়ে ব্যাঙ্গমা বলল, ‘ঘটনা তো ঘইটা গেল।
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘কী ঘটনা?’
ব্যাঙ্গমা ঠোঁট নেড়ে নেড়ে বলল, ‘তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝাইড়া ফেলতে সক্ষম হইলেন। তিনি কি যুবলীগ করবেন, নাকি ছাত্রলীগ, নাকি গণতান্ত্রিক পার্টি, নাকি মিইশা যাইবেন কমিউনিস্টগো লগে, এই দ্বন্দ্ব থাইকা তিনি একেবারে সাফসুতরা হইয়া বাইরাইয়া আইলেন।’
ব্যাঙ্গমা বলল, ‘শেখ মুজিব তাঁরে দায়িত্ব দিছেন ঢাকা উত্তরের সাধারণ সম্পাদক পদে।’
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের সিরাজউদ্দৌলা হলে ছাত্রদের ডাইকা মুজিব কইছিলেন, এই স্বাধীনতা স্বাধীনতা না। আমগো আসল স্বাধীনতার লাইগা লড়াই করতে পূর্ব বাংলায় যাওন লাগব।’
ব্যাঙ্গমা বলল, ‘হ। কইছিলেন তো।’
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘তাজউদ্দীনও একই মতের মানুষ। বিশেষ কইরা, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন সব পাল্টায়া দিছে। আতাউর রহমান খানের ছোট ভাই শামসুর রহমান খান আছেন না! ওই যে তাজউদ্দীনের লগে অল্পস্বল্প আলাপ- পরিচয় আছিল। ১৯৫০ সালে তিনি তো ঢুইকা গেলেন সরকারি চাকরিতে। পোস্টিং হইল করাচিতে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর তাজউদ্দীনের সঙ্গে তাঁর দেখা হইল একটা অনুষ্ঠানে। দুজনে পাশাপাশি বইসা আছেন। অনুষ্ঠান শুরু হইতে দেরি হইব। লোকজন তহনও তেমন আসে নাই।
‘শামসুর রহমান খান কইলেন, আমি তো পাকিস্তান সরকারের চাকরি নিছি। তোমরা যারা জনতার রাজনীতি করো, তারা নিশ্চয়ই আমগো পছন্দ করো না।’
‘তাজউদ্দীন তাঁরে কইলেন, না না, ঠিক আছে। অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। দরকার আছে।
‘কী ব্যাপারে দরকার? জিগাইলেন শামসুর রহমান খান।
‘তাজউদ্দীন তখন তাঁরে কইলেন, দ্যাশ স্বাধীন হইলে আপনারা দ্যাশের কামে লাগবেন।
‘দেশ তো স্বাধীন হইছেই।
‘পাকিস্তান না। এই দেশ না।
‘পূর্ব পাকিস্তান আবার আলাদা কইরা স্বাধীন হওনের কাম আছে নাকি?’
‘হ। আছে। পশ্চিমা গো লগে থাকতে আমরা পারুম না। আমগো আলাদা দ্যাশ লাগবই।’ তাজউদ্দীন কইলেন।
.
ব্যাঙ্গমা বলল, ‘শেখ মুজিব আর তাজউদ্দীন দুইজন আলাদা আলাদা কইরা একই ভাবনা ভাবতাছেন। আজকা তাঁরা একটা লাইনে মিলিত হইলেন। এরপরেই না ইতিহাস তাগো দুইজনারে আরও কাছে লইয়া যাইব। দ্যাশটা স্বাধীন হইব।’
ব্যাঙ্গমি বলল, ‘১৯৪৯ সালে মুজিব যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের দাবিদাওয়া নিয়া আন্দোলন করতেছেন, করতে গিয়া ছাত্রদের ওপরে শাস্তির খড়্গ নাইমা আইছে, তখন মুজিব দাবি আদায়ে চাপ সৃষ্টি আর শাস্তির আদেশ প্রত্যাহারের লাইগা ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়ি ঘেরাও করল। তাঁর বাড়ির নিচের ঘরগুলাও দখল করল ছাত্ররা।
‘সেই সময় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপার বিশাল এক পুলিশ বহর নিয়া উপস্থিত। মুজিব ছাত্রদের সাথে পরামর্শ করলেন। ঠিক হইল, আর হগ্গলের গ্রেপ্তার হওনের দরকার নাই। আটজন থাকব, যারা গ্রেপ্তার বরণ করব। মুজিব অবশ্যই থাকবেন। কারণ হেয় গ্রেপ্তার হইলে আন্দোলন চাঙ্গা হইব।
‘তাজউদ্দীন সেইখানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁরে বলা হইছে, তিনি যেন গ্রেপ্তার না হন। ম্যাজিস্ট্রেট পাঁচ মিনিট সময় দিল ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়ি ছাড়নের। আটজন বাদে সবাই বাইরে গেল। কিন্তু ভিড়ের চাপে তাজউদ্দীন বাইরাইতে পারেন নাই। মুজিব তাঁরে চোখ টিপি মারলেন। তিনি তাড়াতাড়ি একটা কাগজ বাইর কইরা কইলেন, আমি প্রেস রিপোর্টার। একটা কাগজে তিনি কে কে গ্রেপ্তার হইছে, তাগো নাম লেখতে লাগলেন। পুলিশ তাঁরে ছাইড়া দিল।’
ব্যাঙ্গমা কইল, ‘মুজিব এই ছোট চোখ টিপার ঘটনা আর তাজউদ্দীনের ছাড়া পাওনের কথা ভুলতে পারেন নাই। ১৮ বছর পর নিজের স্মৃতিকথা জেলে বইসা লেখনের সময় এই কথা উল্লেখ করতে তিনি ভোলেন নাই। কাজেই আরও পরে যখন ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের রাইতে শেখ মুজিবরে পাকিস্তান আর্মি ধইরা নিয়া যাইব, তাজউদ্দীন যে গ্রেপ্তার এড়ায়া যাইতে পারব, আর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হইব, এইটা তো আমরা অহনই কইয়া দিতে পারি।’
৩৩.
হেমন্তকাল। হাটখোলার সরুপথে রিকশায় চলেছেন মুজিব। সকালবেলা। রোদ উঠেছে মিষ্টি। রাস্তায় শিউলি ফুল ঝরে পড়ে আছে, পাঁচিল ডিঙিয়ে মাথা বের করা শিউলিঝাড়ে পড়েছে সকালবেলার রোদ।
শেখ মুজিব যাচ্ছেন এ কে ফজলুল হকের কাছে। কে এম দাস লেনের বাড়িটির গেট খোলাই ছিল। তিনি ভেতরে ঢুকে বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করলেন, ‘নানা, আছেন নাকি।’
বিশালদেহী ৮১ বছরের ফজলুল হক বেরিয়ে এলেন। পরনে পায়জামা, পাঞ্জাবির ওপরে একটা কার্ডিগান। মুজিবের পরনে ট্রাউজার, গায়ে শার্ট, শার্টের ওপরে একটা হালকা কোট।
‘নাতি, কী খবর? আসো, বসো।’
মুজিব বৈঠকখানায় বসলেন।
এ কে ফজলুল হককে বাংলার লোকেরা জানে শেরেবাংলা বা বাংলার বাঘ বলে। তাঁকে বাংলার মানুষ মোটের ওপরে খুব শ্রদ্ধা করে। তিনি অখণ্ড বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। কৃষক প্রজা পার্টির নেতা। মুসলিম লীগ করেননি বলে শেখ মুজিবের দল তাঁর বিরোধিতা করত।
আজ বৈঠকখানায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মুজিবের মনে পড়ে গেল, বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা। মুজিব তখন কলকাতায় ছাত্র, গোপালগঞ্জ আসেন মাঝেমধ্যে, বক্তৃতা দেন পাকিস্তানের পক্ষে। এই সময় শহরের কয়েকজন মুরুব্বি মুজিবের পিতা শেখ লুৎফর রহমান সাহেবকে বললেন, ‘আপনার ছেলে যা আরম্ভ করেছে, ওকে তো জেল খাটতে হবে। তার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে। ওকে এখনই মানা করেন।’
আব্বা তখন যে উত্তরটা করেছিলেন, তা মুজিবের আজও মনে আছে। তিনি বললেন, ‘দেশের কাজ করছে। অন্যায় তো কিছু করছে না। যদি জেল খাটতে হয়, খাটবে। দেশের জন্য জেল খাটবে। পাকিস্তান না করলে আমরা মুসলমানরা কি টিকতে পারব?’
একদিন মেলা রাত পর্যন্ত বাপ-বেটায় শুয়ে শুয়ে রাজনীতি নিয়ে আলাপ করছেন। হাবিবুল্লাহ বাহারের লেখা পাকিস্তান গ্রন্থ মুজিবের মুখস্থ। মুজিবুর রহমান খাঁর পাকিস্তান বইও তিনি হেফজ করেছেন। শেরেবাংলা লাহোরে যে পাকিস্তান প্রস্তাব করেছিলেন, আর সেদিন যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছিল, পাকিস্তান হবে দুইটা, আলাদা আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র, পশ্চিম অংশ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান, আর সমস্ত বাংলা ও আসাম নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান। কলকাতাও সেই স্বাধীন দেশে থাকবে, দার্জিলিং থাকবে, আসাম থাকবে। পিতা খুশি হলেন পুত্রের আলোচনা শুনে।
শুধু বললেন, ‘শোনো, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের বিরুদ্ধে কোনো রকমের ব্যক্তিগত আক্রমণ করবা না।’
একদিন মা-ও বললেন, ‘বাবা, আর যা-ই করতি চাও, করবা, কিন্তু হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলিও না। শেরেবাংলা এমনি এমনি শেরেবাংলা হন নাই।’
শেরেবাংলার সামনে বসে আছেন মুজিব। দুজনের হাতেই চায়ের কাপ। কী চা? দার্জিলিং চা নাকি? দার্জিলিংও বাংলার অংশ হওয়ার কথা ছিল, খাজা নাজিম উদ্দিন সে দাবি ছেড়ে চলে এসেছেন ঢাকায়। মুজিব মনে মনে ভাবলেন।
মায়ের কথাটাও আজ মুজিবের মনে পড়ছে। শেরেবাংলা এমনি এমনি শেরেবাংলা হন নাই। বাংলার মাটিও তাঁকে ভালোবেসে ফেলেছিল। আরেক দিনের কথা। শেখ মুজিব বক্তৃতা করছেন তাঁর নিজের ইউনিয়নে, বলছিলেন, ফজলুল হক সাহেব কেন মুসলিম লীগ ত্যাগ করলেন, কেন তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সঙ্গে হাত মিলিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করলেন, কেন তিনি পাকিস্তান চান না?
এই সময় একজন বৃদ্ধ উঠে দাঁড়ালেন। মুজিব তাঁকে চেনেন। মুজিবের দাদার বন্ধু। তাঁদের বাড়ি প্রায়ই আসতেন। তাঁদের সবাইকে তিনি ভালোবাসেন ও শ্রদ্ধাভক্তি করেন। সেই বৃদ্ধ বললেন, ‘খোকা মিয়া, যা বলার বলেন, কিন্তু হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বইলেন না। তিনি যদি পাকিস্তান না চান, আমরাও চাই না। জিন্নাহ কে? আমরা তো তাঁকে চিনি না। নামও শুনি নাই। হক সাহেব গরিবের বন্ধু।’
এর পর থেকে মুজিব কোনো দিনও ফজলুল হকের বিরুদ্ধে কিছু বলেন নাই।
ফজলুল হক সাহেবের আরেকটা গুণ আছে। তিনি সবার নাম ও চোহারা মনে রাখতে পারেন। বহুদিন পরে কাউকে দেখলে তার নাম ধরে ডেকে বসেন তিনি। এইভাবে নাম ধরে ডাকলে কে না মুগ্ধ হবে! মুজিব ফজলুল হকের এই গুণটা রপ্ত করার চেষ্টা করেন। তিনিও সবার নাম ও চেহারা মনে রাখার অনুশীলন করেন। আর ফজলুল হক স্বচ্ছন্দ বোধ করেন দেশি পরিবেশ। ইংলিশ কেতা, উর্দু কেতা তার পছন্দ নয়। মুজিবের সঙ্গে এদিক দিয়ে মিলে যায় ফজলুল হকের।
শেখ মুজিব চায়ের কাপ নামিয়ে বললেন, ‘নানা, আপনি অ্যাডভোকেট জেনারেল পদ ছেড়ে দিয়েছেন। আপনি মুসলিম লীগে যোগ দিয়েছেন কেন? মুসলিম লীগ তো খুবই আনপপুলার। দেশের মানুষ তো দুই চোখে এই অযোগ্য, জালিম, অসৎ, দুর্নীতিবাজদের পছন্দ করে না।’
‘কী করতে বলো?” সুরুৎ করে এক কাপ চায়ের অর্ধেকটা গিলে ফেলে ফজলুল হক বললেন।
‘আপনি আওয়ামী লীগে জয়েন করেন। ‘
‘করতে বলো।’
‘হ্যাঁ। আপনি শেরেবাংলা। আপনার কি শেয়ালদের সঙ্গে চলা মানায়? আমি যাচ্ছি চাঁদপুরে। আওয়ামী লীগের জনসভা করতে। আপনিও যাবেন আমার সাথে।’
‘আচ্ছা তুমি যখন বলছ।’
মুজিব জানেন, ফজলুল হক রাজি হবেন। মোহন মিয়া চেষ্টা করেছিলেন ফজলুল হককে দিয়ে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে সরিয়ে নিজেরা ক্ষমতা নিতে। পারেন নাই। কার্জন হলে বেদম মারপিট হয়েছে দুই গ্রুপে। মার খেয়ে কেটে পড়েছে মোহন মিয়ার দল।
চাঁদপুরের জনসভায় ফজলুল হক বললেন, ‘যাঁরা চুরি করবেন, তাঁরা মুসলিম লীগে থাকেন। আর যাঁরা ভালো কাজ করতে চান, তাঁরা আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।
মুজিব জানেন, ফজলুল হক ভালো বক্তৃতা করেন। বক্তৃতা করেন গল্পের ছলে। এই কারণেই মুসলিম লীগের সঙ্গে কৃষক প্রজা পার্টির যখন কোনো নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো, নির্বাচনী এলাকায় ফজলুল হকের জনসভা থাকলে তিনি যেন ভাষণ দিতে না পারেন, তা নিশ্চিত করতে কৌশল প্রয়োগ করত মুসলিম ছাত্রলীগের কর্মীরা। তারা রটিয়ে দিত, শেরেবাংলা ওখানে আসছেন কেরোসিন তেল দিতে। তখন কেরোসিন তেলের খুব আক্রা। লোকজন কেরোসিনের খালি টিন হাতে আসত, আর দেখত, কেরোসিন দেওয়া হবে না, দেওয়া হবে ভাষণ। তারা বিরক্ত হতো। আর মুসলিম ছাত্রলীগের ছেলেরা ফজলুল হককে নানা প্রশ্ন করতে শুরু করত। তাদের ভয়, শেরেবাংলা যদি একবার তার গল্পের ঝাঁপি খুলতে পারেন, জনতা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়বে।
তাঁর গল্পের কৌশলও ছিল ভিন্ন ভিন্ন। তিনি একবার ঢাকায় লেখাপড়া না- জানা প্রার্থী কালু মিয়ার পক্ষে নির্বাচনী সভায় ভাষণ দিতে এসেছেন। লোকে তাঁকে ধরল, ‘এই রকম মূর্খ প্রার্থীর পক্ষে আপনি কেন কথা বলছেন?’
তিনি বললেন, ‘দেশ হলো একটা নৌকা। আমি হলাম তার মাঝি। আমি তো হাল ধরেই আছি। আমার এখন দরকার মাল্লা। এখন শিক্ষিত লোককে আমি মাল্লা বানাব কেন। মাল্লা হিসাবে আমার দরকার কালু মিয়াকে। আমি মাঝি, দেশের হাল ধরি, এই যদি চান, মাল্লা হিসাবে কালু মিয়াকে ভোট দেন। আর যদি মাঝি বদলাতে চান, চান যে আমিই না থাকি, তাইলে কালু মিয়ার শিক্ষিত প্রতিদ্বন্দ্বীকে ভোট দেন।’
এই গল্প শেখ মুজিবের অনেকবার শোনা।
আরেকবারের ঘটনা। মুর্শিদাবাদে গেছেন তিনি। উপনির্বাচন উপলক্ষে। তিনি সমর্থন জানাতে এসেছেন সৈয়দ বদরুদ্দোজাকে। বদরুদ্দোজা শিক্ষিত লোক। তিন ভাষায় সুন্দর কথা বলতে জানেন। ফজলুল হক ভাষণ দিতে শুরু করলেন, ‘ভাইসব, আপনারা যখন হাটে হাঁড়ি কিনতে চান, তখন হাঁড়ি বাজিয়ে দেখে নেন কি না?’
সবাই বলল, ‘হ্যাঁ। তাই নেই।’
‘তাহলে এবার আমরা একটু বদরুদ্দোজাকে বাজিয়ে দেখব। বদরুদ্দোজা তুমি পাঁচ মিনিট বাংলায় বক্তৃতা করো তো।’
বদরুদ্দোজা পাঁচ মিনিটে কর্ডোভা, গ্রানাডা থেকে শুরু করে বাংলার নির্যাতিত মুসলমানদের ইতিহাস তেজোদীপ্ত ভঙ্গিতে বর্ণনা করতে লাগলেন।
ফজলুল হক বললেন, ‘এবার একটু উর্দুতে পাঁচ মিনিট ভাষণ দাও তো।’
বদরুদ্দোজা উর্দুতে বলতে লাগলেন।
এবার একটু ইংরেজিতে বলো দেখি।
অমনি বদরুদ্দোজা ইংরেজিতে বলতে লাগলেন।
ফজলুল হক বললেন, ‘আপনারা নিজেরা বাজিয়ে দেখলেন। বদরুদ্দোজা বাজে কি না?’
একই মানুষ, একবার শিক্ষিতের পক্ষে, একবার অশিক্ষিতের পক্ষে চমৎকার করে বলে গেলেন। মানুষ তাঁর কথাতেই উদ্দীপিত হলো।
এখন তিনি মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে, আর আওয়ামী লীগের পক্ষে বলছেন।
কিছুদিন আগে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দিয়েছেন।
মুজিব ফজলুল হকের ভাষণ শোনেন আর হাসেন।
৩৪.
কোর্টের পেছনে তাঁতীবাজারের ছোট্ট বাসা। সকালবেলা। মুজিব নাশতা করতে বসেছেন। সঙ্গে অপর দুই গৃহবাসী খোন্দকার আবদুল হামিদ আর মোল্লা জালাল। বাখরখানি এসেছে গরম গরম, আর জিলাপি। নাশতা ভালো হচ্ছে। জিলাপি খাওয়ার একটা অসুবিধা হলো, কামড় দেওয়ার পর রস গায়ে পড়ে। মুজিব খুবই সাবধান। রস তিনি কিছুতেই গায়ে পড়তে দেবেন না। তিনি নিচে বাখরখানি রেখে ওপরে জিলাপি রেখে মুখে পুরছেন।
একটু পরে দেখলেন, শার্টে জিলাপির রস লেগে গেছে। কোন পথে যে রস পড়ে!
এমন সময় ঘরে এসে ঢুকলেন খোকা। পুরো নাম মমিনুল হক খোকা। শেখ মুজিবের ফুফাতো ভাই। তাঁকে দেখে মুজিব উচ্চ স্বরে বললেন, ‘এই তুই কোথায় থাকিস। আমি নূরপুর গেছলাম। ফুপুআম্মা বললেন, তোর কোনো খবরাখবর পান না। ব্যবসার জন্য নাকি বাড়ি থেকে টাকাপয়সা আনছিস। তারপর আর কোনো খবর নাই। নে, নাশতা কর। বস।
‘আমি নাশতা কইরে এসেছি মিয়াভাই।’
‘থো। কী নাশতা করছিস। নে বস। জিলাপি আর বাকরখানি দুইটাই গরম আছে।’
নাশতা খাওয়া হয়ে গেলে মুজিব বললেন, ‘খোকা। তুই কোথায় থাকিস? বাসা নিছিস কোথায়?’
‘আরমানিটোলা। রজনী বোস লেন।’
‘চল তো, দেখে আসি তোর বাসা।’
মুজিব আর খোকা রিকশায় চললেন আরমানিটোলা। বাইরে আকাশে মেঘ। রোদ ওঠেনি। দিনটা মৃত মাছের চোখের মতো। রাস্তার ধারে একদল কাক পাতার ঠোঙা নিয়ে টানাটানি করছে।
তাঁরা রজনী বোস লেনে এসে পড়েছেন। বটতলার নিচে অবনীর মিষ্টির দোকান। এই দোকানে পাওয়া যায় দারুণ স্বাদের পুরী আর ঘিয়ে ভাজা হালুয়া। এইখানে আড্ডা বসে মমিনুল হক খোকাদের, বন্ধুবান্ধব রোজ ভিড় করেন এখানে। ওই যে ওখানে আগাখান সম্প্রদায়ের মোহাম্মদ ভাইয়ের বাড়ি। আরেকটু দূরে দেখা যাচ্ছে বোম্বে রেস্টুরেন্ট।
মুজিব নামলেন রিকশা থেকে। রিকশাওয়ালাকে বললেন, “ভাই, আপনি একটুখানি ওয়েট করেন। আমি এখনই আবার ফিরব।’
৮/৩ রজনী বোস লেনের বাড়িতে ঢুকে পড়লেন মুজিব। চারদিক তাকিয়ে দেখলেন। রান্নাঘর, শৌচাগার সব। তারপর বললেন, ‘চল, আমার সাথে চল।’
মমিনুল হক খোকা বাধ্য ছেলের মতো তাঁর মিয়াভাইয়ের রিকশায় উঠে পড়লেন।
তাঁতীবাজারের বাড়িতে গিয়ে তিনি মোল্লা জালাল আর খোন্দকার আবদুল হামিদকে বললেন নির্দেশের স্বরে, ‘এই, তোমরা সব বিছানাপত্র গুছায়া লও। আমরা আজ থেকে খোকার বাসাতেই থাকব।’
মুজিবের কথার ওপরে কোনো কথা চলে না।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনজনের বিছানাপত্র, সুটকেস, ব্যাগ এসে পৌঁছে গেল রজনী বোস লেনের বাড়িতে।
মুজিবের কপালে জুটল একটা ছোট্ট কামরা।
সেই ছোট কামরাতেই আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদের মতো বড় বড় নেতারা প্রায়ই আসতে লাগলেন।