উষার দুয়ারে – ৩৫
৩৫.
বগুড়ার পাঁচবিবি গ্রামে মওলানা ভাসানী অবস্থান করছেন। তাঁকে ধরে আনতে হবে। মুজিব আর খন্দকার ইলিয়াস তাই চলেছেন ট্রেনে।
ভাসানী পাঁচবিবি থেকে চিঠি পাঠিয়েছেন মুজিবের কাছে। সাধারণ সম্পাদকের কাছে সভাপতির চিঠি। ময়মনসিংহে পার্টির সম্মেলন ডাকো।
সভাপতির নির্দেশ। মুজিব অমান্য করতে পারেন না। তিনি ময়মনসিংহেই সম্মেলন ডাকলেন।
কিন্তু তিনি এর মধ্যে ষড়যন্ত্রের গন্ধ পেলেন।
সরকার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে। সামনে পূর্ব বাংলায় নির্বাচন হবে। মুজিবের হিসাব হলো, বাংলায় এখন আওয়ামী মুসলিম লীগ ছাড়া আর কোনো দল নাই। আর কোনো পার্টির কোনো জনপ্রিয়তা নাই। ‘গণতন্ত্রী দল’ নামে একটা দল খোলা হয়েছিল, কাগজ-কলমের বাইরে তার কোনো অস্তিত্ব নাই। মুসলিম লীগ ঘোরতর অজনপ্রিয়। এ অবস্থায় নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগ এককভাবে জয়লাভ করবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের ভেতরেই অনেকেই চাইছেন যুক্তফ্রন্ট। কেউ কেউ গিয়ে ফজলুল হককে বুঝিয়েছেন, আপনি কেন আওয়ামী লীগে যোগ দেবেন। তাহলে তো আপনার লোকজন নমিনেশন পাবে না। এমএলএ, মিনিস্টার হতে পারবে না। আপনি কৃষক প্রজা পার্টিকে পুনরুজ্জীবিত করুন। আপনি আওয়ামী লীগের সাথে দর-কষাকষি করতে পারবেন। আর তা ছাড়া যদি মুসলিম লীগ কিছু আসন পায়, নির্বাচনের পরে তাদের সাথেও দর-কষাকষি করা যাবে।
ফজলুল হক দেখলেন, কথা ঠিক।
তাঁর পেছনে গিয়ে জুটল মুসলিম লীগের বিদ্রোহী, পদত্যাগী, বহিষ্কৃত সুবিধাবাদীরা।
শেখ মুজিব যুক্তফ্রন্ট চান না। বিশেষ করে, ফরিদপুরের মুসলিম লীগারদের তিনি সব সময়ই অপছন্দ করে এসেছেন, তারা এসে জুটেছে ফজলুল হকের সঙ্গে।
ভাসানী কাউন্সিল ডেকে নিজে আশ্রয় নিয়েছেন বগুড়ার পাঁচবিবিতে।
ট্রেনে বসে খন্দকার ইলিয়াসকে মুজিব বললেন, ‘মওলানা সাহেবের এই এক অভ্যাস। যখনই কোনো জটিল সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হয়, উনি সটকে পড়েন।’ এর আগে মুজিব ভাসানীর সঙ্গে দেখা করেছেন। ভাসানী তাঁকে বলেছেন, ‘যদি হক সাহেব আওয়ামী লীগে আইসেন, তাইলে তাঁরে গ্রহণ করা যায়। আর যদি অন্য দল করেন, তাইলে তাগো আমরা যুক্তফ্রন্টে লইমু না। যে লোকগুলান মুসলিম লীগ থাইকা বিতাড়িত হইছে, হেরা অহন হক সাহেবের কান্ধে ভর করনের চেষ্টা করতাছে। মুসলিম লীগের যত আকাম-কুকাম, তার সাথে হেরা এই সেদিন পর্যন্ত জড়িত আছিল, হেরা রাষ্ট্রভাষা বাংলারও বিরোধিতা করছে, হেগো আমরা ক্যান লমু? আর শুনো, আওয়ামী লীগের মইধ্যে জানি যুক্তফ্রন্টঅলারা মাথাচাড়া দিয়া উঠতে না পারে, এইটাই দেইখো।’
মুজিব জানেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রশ্নে মওলানা ভাসানীর অবস্থান পরিষ্কার। বাংলার জন্য তাঁর যে ভালোবাসা, তাতে কোনো খাদ নাই। তিনি প্রাদেশিক আইন পরিষদে প্রথম বাংলায় ভাষণ দেন।
ট্রেন চলছে। প্রথমে যেতে হবে বাহাদুরাবাদ ঘাট। তারপর নদী পার হতে হবে স্টিমারে। ওপারে ফুলছড়ি ঘাট।
মওলানা ভাসানীকে নিয়ে সত্যিই মুশকিল। তাঁর জনপ্রিয়তা দারুণ, তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা তুলনাহীন, লোক ভালো কিন্তু যখন কোনো একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া সময় আসে, যাতে দুটো বিবদমান পক্ষ থাকে, ভাসানী আড়ালে চলে যান। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তানের ‘কায়েদ-এ আজম’ জিন্নাহ এসেছিলেন আসামে। মওলানা ভাসানী তখন আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি। আসামের মুসলমানেরা পাকিস্তান আন্দোলনে পুরা সমর্থন দেবে, জিন্নাহকে আশ্বস্ত করলেন ভাসানী। সেই সঙ্গে তিনি আসামের মুসলমানদের ওপরে কী রকম অত্যাচার হচ্ছে, তার বিবরণ পেশ করতে লাগলেন। বর্ণনার এক পর্যায়ে আবেগে তিনি কেঁদে ফেললেন। তাঁর বর্ণনা শুনে উপস্থিত নেতা-কর্মীরা সবাই কাঁদতে লাগল। পরে, জিন্নাহকে আলাদা পেয়ে, ডিনারের আগে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ইস্পাহানি জিন্নাহর সামনে মওলানা ভাসানীর প্রশংসা করতে লাগলেন। জিন্নাহ বিরক্তিভরে বললেন, ‘মওলানার মতো লোক মোটেও রাজনীতির উপযুক্ত নন। রাজনীতিতে বাজে ভাবালুতার কোনো স্থান নাই। আবেগের কোনো জায়গা নাই। রাজনীতি কঠিন দাবা খেলা। এখানে চোখ থাকবে অশ্রুহীন, যাতে বহুদূর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। এ জন্য প্রয়োজন কঠিন পরিশ্রম, সাহস আর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।’
মুজিবকে এই গল্প নিজের মুখে করেছেন ইস্পাহানি।
.
ব্যাঙ্গমা বলে, ‘ইস্পাহানি কিন্তু বাঙালি নন। পাকিস্তানি।।’
ব্যাঙ্গমি বলে, ‘তাতে কী হইল। তাগো আদি নিবাস ইরান। তয় মুজিবের তিনি ভক্ত আছিলেন। আরও কয়েক বছর পর আইয়ুব খান যহন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হইব, আর বেসিক ডেমোক্রেসি চালু করতে চাইব, তহন একদিন ইস্পাহানি প্লেনে বসবেন বিশিষ্ট লেখক কলকাতাবাসী অন্নদাশঙ্কর রায়ের পাশের আসনে। অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁরে জিগাইবেন, পাকিস্তানের পলিটিকসের খবর কী?
‘ইস্পাহানি জবাব দিবেন, আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেসি কোনো ডেমোক্রেসিই না। একে তো মাত্র আশি হাজার ভোটার। এর মধ্যে একচল্লিশ হাজার ভোটার কিইনা ফেলতে কয় টাকা আর লাগে? আইয়ুব খান ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে চান।
‘তাইলে কী করা উচিত? অন্নদাশঙ্কর রায় পুছ করবেন। ইস্পাহানি জবাব দিবেন, গণতন্ত্র দিয়া ইলেকশন কইরা ইলেকটেড পলিটিশিয়ানদের হাতে ক্ষমতা ছাইড়া দিয়া চইলা যাওন উচিত আইয়ুব খানের।
‘পূর্ব বাংলায় কে আছে যে প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হইতে পারে?’
‘কেন, শেখ মুজিব। ইস্পাহানি জবাব দিব।’
.
বাহাদুরাবাদ ঘাট এসে গেল।
শেখ মুজিব আর খন্দকার ইলিয়াস নামলেন ট্রেন থেকে। এখন এই বালিভরা পথে ছুটে যেতে হবে স্টিমার ধরতে। মুজিবকে অনেকেই চেনে, তারা তাঁকে সালাম দিয়ে পথ করে দিতে লাগল।
শেখ মুজিবের মনে নানা দুশ্চিন্তা। সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে খবর দেওয়া হয়েছে। তিনি আসবেন। তিনি পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি। কিন্তু পূর্ব বাংলার লীগের সিদ্ধান্ত নেবে কাউন্সিলররা। যুক্তফ্রন্টের পক্ষে অনেকেই ঘোঁট পাকিয়েছে। ময়মনসিংহ জেলা কমিটির সভাপতি আবুল মনসুর আহমদ। তিনি বুঝদার লোক। কিন্তু তিনি পরিচালিত হচ্ছেন তাঁর সাধারণ সম্পাদক হাশিমউদ্দিন সাহেবের দ্বারা। মুজিব সমস্ত জেলায় জেলায় চিঠি পাঠিয়েছেন, সব জেলার প্রতিনিধি যেন উপস্থিত থাকে। তাদের থাকার জন্য ছোটবড় সব হোটেল বুকিং দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।
মুজিব জানেন, সব জেলা থেকে প্রতিনিধিরা এলে মুজিব যা বলবেন, সেটাই ভোটে গৃহীত হবে। কিন্তু মওলানা ভাসানী হঠাৎ করে চিঠি পাঠিয়েছেন, ‘আমি সভায় উপস্থিত হইতে পারিব না।’
মুজিবের মাথায় হাত। সভাপতি ছাড়া সভা হবে, এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে! তিনি তাই ছুটেছেন মওলানা ভাসানীকে পাঁচবিবি থেকে ধরে আনতে। খন্দকার মোশতাকও যুক্তফ্রন্ট-সমর্থক। কমিউনিস্ট ভাবাপন্নরা আওয়াজ তুলেছে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে।
স্টিমার ফুলছড়ি ঘাটে পৌঁছাল।
মুজিব আর ইলিয়াস নামলেন স্টিমার থেকে। আবার দৌড়ে গিয়ে বগুড়াগামী ট্রেনে উঠতে হবে।
তাঁরা তাঁদের নির্ধারিত ট্রেনে উঠেছেন। আরেকটা ট্রেন এল বগুড়া থেকে। মুজিব যেন দেখতে পেলেন, ওই ট্রেনে দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরায় ভাসানীর মতো দেখতে কাকে যেন দেখা যায়।
ইলিয়াসকে বললেন, ‘দেখ তো কে?’
ইলিয়াস ট্রেন থেকে নেমে ওই ট্রেনের জানালায় উঁকি দিয়ে বললেন, ‘ওই তো মওলানা সাহেব।’
তখন মুজিবের ট্রেন ছেড়ে দেয় দেয়। হুইসেল বেজে উঠেছে। তাড়াতাড়ি তিনি মালপত্রসমেত নেমে পড়লেন।
মওলানা ভাসানীও ট্রেন থেকে নেমেছেন। মুজিব আর ইলিয়াস তাঁর কাছে গেলেন। তিনি কোনো কথা না বলে হনহন করে হাঁটতে লাগলেন। মুজিবেরাও তাঁর পেছনে পেছনে হাঁটতে লাগল।
মুজিব জিগ্যেস করলেন, ‘ব্যাপার কী? আপনি সভা ডাকতে বললেন। আমি সভা ডাকলাম। এখন আবার আপনি উপস্থিত হবেন না কেন?
মওলানা ভাসানী হাঁটতে হাঁটতে বললেন, ‘তোমরা জানো না, ঐক্যফ্রন্ট করার লাইগা তোমাগো নেতারা পাগল হইয়া গেছে। আমি তো নীতি ছাড়া নেতাগো লগে এক হইতে পারি না। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে লোক বেশি। ভোট হইলে হাইরা যাইবা। আমি আর রাজনীতিই করুম না। আমার তো কিছুই নাই। আমি তো ভোটে খাড়ামু না। কারও ক্যানভাসও করতে পারুম না। তাই আর রাজনীতি করুম না। কাউন্সিল সভায় যোগ দেওনের কোনো ইচ্ছা তাই আমার নাই।’
মুজিব হাঁটতে হাঁটতে বললেন, ‘আপনি তো আমার সাথে পরামর্শ না করেই কাউন্সিল ডাকতে বলে দিলেন। কাউন্সিল তো আর কিছু দিন পরে ঢাকায় হওয়ার কথা ছিল। ময়মনসিংহের বুদ্ধি আপনারে কে দিল! তবে আপনি তো কাউন্সিলের মত জানেন না। আপনিও ইচ্ছা করলে যুক্তফ্রন্ট পাস করাইতে পারবেন না। আওয়ামী লীগের সদস্যরা এই বিতাড়িত মুসলিম লীগ নেতাদের হাতে অনেক মাইর খেয়েছে। অনেক অত্যাচার সহ্য করেছে। তারা জানে, মুসলিম লীগের এই ননি খাওয়া নেতারা বিরোধী দল করার জন্য আসে নাই। আওয়ামী লীগের কান্ধে পাড়া দিয়া ইলেকশন পার হইতে আসছে। আপনি যদি উপস্থিত না হন, তাইলে আমি এখনই টেলিগ্রাম করে দিলাম। সভা স্থগিত। আমিও বাড়ি চলে যাব।’
মওলানার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে তাঁরা সর্দারের চর নামে একটা জায়গায় পৌঁছে গেলেন। ছোট্ট দুটি কুঁড়েঘর, একটা সামান্য আঙিনায় গিয়ে থামলেন ভাসানী। হাঁক পাড়লেন, ‘মুসা মিয়া।’
মুসা মিয়া দৌড়ে এসে কদমবুসি করলেন তাঁর পীর সাহেবকে। ‘হুজুর, আসসালামু আলাইকুম। আস্যা পড়ছেন, খুবই ভালো করিছেন, একনা খবর দিয়া আসা লাগে না, হুজুর
তিনি এখন মওলানা আর তাঁর সঙ্গীদের কোথায় বসতে দেন?
রাতে কোনো ট্রেন নাই ঢাকা ফেরার, মুজিব-ইলিয়াসকে এখানেই রাত কাটাতে হবে।
গাছের নিচে মাদুর বিছিয়ে বসে পড়লেন মওলানা ভাসানী, মুজিব, খন্দকার ইলিয়াস। সেখানেই মুজিব-ইলিয়াসের সুটকেসও রাখা হলো। তখন সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। ডুবন্ত সূর্যের ম্লান আলো এসে পড়েছে গাছের নিচে এই আগন্তুকদের চোখে-মুখে। আস্তে আস্তে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। গরুর পাল নিয়ে ফিরে আসছে রাখাল। হাঁসের দল কাতারবন্দী হয়ে জলাশয় থেকে ফিরে আসছে গৃহস্থবাড়ির আঙিনায়।
রান্নাঘর থেকে ধোঁয়া উঠে কুয়াশার সঙ্গে মিশে থমকে আছে কলাগাছের মাথায়।
মুসা মিয়া বলতে লাগলেন, ‘হুজুরদের কষ্ট হতিছে। চা খাবেন? হামি চা আনবার পাঠ্যা দিছু ফুলছড়ি ঘাটত। চা আসিচ্চে।’
সন্ধ্যার সময় যে মোরগ ঘরে ফিরে এল, সে কি জানত, কী অপেক্ষা করছিল তার অদৃষ্টে। একটু পরে মোরগের পাখা ঝাপটানোর শব্দ এল। বোঝা গেল, মোরগ জবাই হচ্ছে।
মুসা মিয়ার তো কোনো সংস্থান নাই যে এই অতিথিদের রাতে থাকতে দেন। একজন প্রতিবেশীর একটা ঘর আছে। সেখানেই তিনজনের বিছানার ব্যবস্থা হলো। রাতের বেলা তিনজনে একবার গরম স্বরে, একবার নরম স্বরে আলোচনা চালিয়ে গেলেন। ভাসানী বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমরা যাও গা, আমি কথা দিতাছি আমিও যামু। জয়েন করুম মিটিঙে।’
ভাসানীর প্রতিশ্রুতি পেয়ে মুজিব আর খন্দকার ইলিয়াস ফিরলেন ময়মনসিংহ। কিন্তু আসার আগে মুসা মিয়া নামের ওই প্রায় চালচুলাহীন সহায়-সম্বলহীন কৃষকটিকে তিনি জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘মুসা মিয়া, আপনার মতো বড় হৃদয়ের মানুষ আমি জীবনেও দেখি নাই। আজকে আপনি আমাদের মতো উড়ে এসে জুড়ে বসা মেহমানদের জন্য যা করলেন, তার কোনো তুলনা নাই। আমি আপনার কথা চিরদিন মনে রাখব।
ব্যাঙ্গমা বলল,
মুসা মিয়া গরিব না, অন্তরেতে ধনী।
তার কথা মুজিবর ভোলেনি কখনই ॥
ব্যাঙ্গমি বলল,
১৩ বৎসর পরে কারাগারে বসে।
মুজিবর স্মৃতি লেখে বিষাদে হরষে ॥
কত মহারথী নাম এসে ভিড় করে।
এক নাম লেখা হয় স্বর্ণাক্ষরে ॥
মুসা মিয়া নাম, বাড়ি চর সরদার।
এত বড় প্রাণ আমি দেখি নাই আর ॥
মুজিব লেখেন তাহা, কৃতজ্ঞতাভরে।
ইতিহাসে মুসা মিয়া জ্বল জ্বল করে ॥
ময়মনসিংহের সম্মেলনে মুজিব জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিলেন যুক্তফ্রন্ট গঠনের ধারণার বিরুদ্ধে। ১৯৪৮ সালের, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের যাঁরা বিরোধিতা করেছে, তাদের সঙ্গে ঐক্য হতে পারে না। তবে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক যদি আওয়ামী লীগে যোগ দিতে চান, তাকে স্বাগত জানানো হবে।
ভোট হলে এই মর্মে সিদ্ধান্ত পাস হয়ে যেত যে, আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল ঐক্যফ্রন্ট চায় না।
কিন্তু আতাউর রহমান সাহেব বললেন, ‘মুজিব, এই প্রস্তাব কিন্তু প্রকাশ্যে আমাদের পাস করিয়ে নেওয়া উচিত নয়। কারণ, তাতে লোকের মনে ভুল ধারণা হবে, আওয়ামী লীগ ঐক্য চায় না।’
মুজিব বললেন, ‘আমি আপনার কথার সঙ্গে সম্পূৰ্ণ একমত।’
কারণ, মানুষ মুসলিম লীগের দুঃশাসনে অতিষ্ঠ। তারা যেমন করেই হোক, এই অত্যাচার থেকে মুক্তি চায়। কাজেই তারা বিরোধী দলগুলো মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ঐক্য করুক, এটা আশা করে। বিশেষ করে, শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী এক হোন, এটা জনতার প্রত্যাশা।
সোহরাওয়ার্দী এসেছেন কাউন্সিলের প্রধান অতিথি হয়ে। তিনিও একবার বললেন, ‘বৃদ্ধ নেতা ফজলুল হক সাহেবকে একবার দেশের মানুষের সেবা করার সুযোগ দেওয়া উচিত।’
শেখ মুজিব বললেন, ‘ইলেকশন এলায়েন্স করা যেতে পারে। যেখানে হক সাহেবের দলের ভালো লোক থাকবে, সেখানে আওয়ামী লীগ প্রার্থী দেবে না, আর যেখানে আওয়ামী লীগের ভালো প্রার্থী থাকবে, সেখানে হক সাহেবের দল প্রার্থী দেবে না।
মওলানা ভাসানী খেপে গেলেন, বললেন, ‘না, কোনো রকমের এলায়েন্স হইব না। আওয়ামী লীগ একলাই ইলেকশন করব।’
এই পর্যন্ত কথা হয়ে রইল।
.
মওলানা ভাসানী আর মুজিব বেরিয়ে পড়লেন সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় জনসভা করতে। সোহরাওয়ার্দীও করাচি ঘুরে ঢাকায় আসছেন।
ভাসানী-মুজিব প্রথমে সফর করলেন উত্তরবঙ্গ। জনসভা উপচে পড়ছে লোকে। আর মুজিব দলের লোকদের বললেন, ‘কাকে প্রার্থী করা যায়, ঠিক করে নাম পাঠিয়ে দেবেন।
উত্তরবঙ্গ থেকে তাঁরা গেলেন কুষ্টিয়া। এই সময় ঢাকা থেকে এল টেলিগ্রাম। প্রেরক : আতাউর রহমান খান এবং তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবকে অতিসত্বর ঢাকা যেতে হবে।
মুজিব বললেন, ‘কাল জনসভা। সেটা ক্যানসেল করে যাওয়া যায় নাকি? লোকজন খেপে গিয়ে কর্মীদের ধরে ধরে মার দিবে। হুজুর আপনি যান, আমি কালকের জনসভা শেষ করে আসব।’
কুষ্টিয়ার জনসভা শেষ করার পর মুজিব খবর পেলেন, ঢাকায় মওলানা ভাসানী ও ফজলুল হক যুক্তফ্রন্টের অঙ্গীকারনামায় সই করেছেন।
মুজিব তাড়াতাড়ি ফিরলেন ঢাকায়। মওলানা ভাসানীকে গিয়ে ধরলেন, ‘এইটা আপনি কী করলেন! আমার জন্য দুইটা দিন অপেক্ষা করতে পারলেন না? আর আমার জন্য না পারেন, সোহরাওয়ার্দী সাহেবের জন্য তো অপেক্ষা করতে পারতেন?’
ভাসানী বললেন, ‘আমি কিছু জানি না। আমি কইছিলাম, মুজিব না আইলে আমি কোনো দস্তখত করতে পারুম না। আতাউর রহমান খান আর মানিক মিয়া কইল, মুজিবরে আমরা বুঝামু। ওই দায়িত্ব আমাগো। আপনে সাইন করেন। আমি করলাম।’
মুজিব বললেন, ‘আতাউর রহমান খান সাহেব আর মানিক ভাই যদি বলে থাকেন, আমার দায়িত্ব তাঁরা নিছেন, আমি তো আপত্তি করতে পারব না। মানিক ভাইয়ের কোনো কথা আমি ফেলি না। তবে খান সাহেব নিজেই তো যুক্তফ্রন্টের বিরুদ্ধে ছিলেন। তবে উনি তো আবার না করতে পারেন না। কেউ এসে হাত ধরলেই উনি তাঁর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। যা-ই হোক, দেশের যদি এতে ভালো হয়, আমি যুক্তফ্রন্ট মেনে নিলাম।’
মুজিবের রাগ কমে গিয়েছিল। কিন্তু আবার তিনি খেপে গেলেন, যখন শুনলেন নিজামে ইসলামী নামের একটা দলকেও যুক্তফ্রন্টে নিতে হবে। ফজলুল হক সাহেব নাকি তাদের সঙ্গে আগেই ঐক্যবদ্ধ নির্বাচন করার জন্য চুক্তি করে রেখেছেন। গণতন্ত্রী দলকেও নিতে হবে। বুঝলাম, তাদের কর্মীরা প্রগতিশীল। কিন্তু আমার পার্টির লোকদের বঞ্চিত করে তো আমি বাইরের লোকদের জায়গা করে দিতে পারি না। তিনি মওলানা সাহেবকে গিয়ে ধরলেন। এসব কী হচ্ছে?
যুক্তফ্রন্টের একটা ২১ দফা কর্মসূচি প্রস্তুত করলেন আবুল মনসুর আহমদ। তাঁকে একটা ঘরে বন্দী করে রাখা হয়েছে এই নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করার জন্য। মওলানা ভাসানী বললেন, ‘শুনো মনসুর, আওয়ামী লীগের ৪২ দফা মেনিফেস্টো তৈরি করাই তো আছে। কাউন্সিলে পাস করানো আছে। সেইটারেই তুমি যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহার বানায়া ফেলো।’
আবুল মনসুর আহমদ ভাবলেন, একুশে ফেব্রুয়ারির একুশ শব্দটাকে মূল অনুপ্রেরণা হিসাবে গ্রহণ করা যায়। তিনি ওই ৪২ দফাকেই বানিয়ে ফেললেন ২১ দফা। আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতেই এটা ছিল যে, ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করতে হবে, একটা স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করতে হবে, এবং মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি বর্ধমান হাউসকে বাংলা ভাষার সেবাকেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এগুলো যুক্তফ্রন্টের ম্যানিফেস্টোতেও রাখতে হবে।
একুশের চেতনায় উজ্জীবিত ২১ দফা কর্মসূচি বানিয়ে সেটাতেই ভাসানী ও ফজলুল হকের স্বাক্ষর নেওয়া হলো।
যুক্তফ্রন্টের সভাপতি হলেন সোহরাওয়ার্দী। যুগ্ম সম্পাদক আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান খান ও কৃষক প্রজা পার্টির কফিলউদ্দিন চৌধুরী। দপ্তর সম্পাদক হলেন কামরুদ্দীন।
রজনী বোস লেনের বাড়িতে ফিরে মুজিবের রাতের বেলা ভালো ঘুম হলো না।
.
তিনি বিড়বিড় করতে লাগলেন, আতাউর রহমান খান, মানিক ভাই, আবুল মনসুর আহমদ—সবাই তাঁর চেয়ে বয়সে আর অভিজ্ঞতায় বড়। তাঁরা যখন বলছেন, যুক্তফ্রন্ট হলে দেশের ভালো হবে, নিশ্চয়ই হবে। তবে তিনি ভবিষ্যৎ ভালো দেখেন না। সালাম খান সেদিন এসে বলছিলেন, ‘আর কত দিন বিরোধী দলে থাকা যায়, ক্ষমতায় না গেলে জনসাধারণের আস্থা আর আমাদের উপরে থাকবে না। যেভাবে হোক, ক্ষমতায় যেতে হবে। যুক্তফ্রন্ট করলে ক্ষমতায় যাওয়া হান্ড্রেড পারসেন্ট নিশ্চিত হয়।
মুজিব জবাব দিয়েছিলেন, ‘নির্বাচনে হয়তো জেতা যাবে, ক্ষমতায় যাওয়াও যাবে। তবে এই ক্ষমতা বেশি দিন থাকবেও না। আর যেখানে আদর্শের মিল নাই, সেখানে ঐক্যও বেশি দিন থাকে না।’
টিক টিক টিক টিক। একটা টিকটিকি ডেকে উঠল সেই সময়।
মুজিবের তন্দ্রামতো এল। বাইরে মোরগ ডাকছে। তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।
৩৬.
সোহরাওয়ার্দী যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান। যুক্তফ্রন্ট পরিচিত হতে লাগল হক- ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর দল হিসাবে। তাদের দলীয় প্রতীক নৌকা। সোহরাওয়ার্দী করাচি থেকে আসার সময়েই পকেট ভরে টাকা নিয়ে এসেছেন। তিনি একটা পুরোনো জিপ কিনলেন। যুক্তফ্রন্টের অফিস হলো ৫৬ সিমসন রোড। সদরঘাটের কাছে। পাশে রিভারভিউ রেস্তোরাঁ। একটু দূরে রূপমহল সিনেমা হল। যুক্তফ্রন্টের অফিস ভবন পুরোনো, জরাজীর্ণ। দপ্তর সম্পাদক কামরুদ্দীন আহমদ। সোহরাওয়ার্দী ওই অফিসের একটা ছোট্ট কামরাকে নিজের আবাস করে তুললেন। দিন নাই, রাত্রি নাই, তিনি ওই অফিসেই সময় কাটান। মুড়ি, টোস্ট বিস্কুট তার খাদ্য, দোকানের ভাঙা কাপের নোংরা চা তার পানীয়। তাঁর গ্যাসট্রিক-আলসারের সমস্যা আছে। তা উপেক্ষা করে তিনি অহোরাত্র কঠোর পরিশ্রম করছেন।
শারীরিক পরিশ্রম যত, তারও চেয়ে বেশি তাঁকে করতে হচ্ছে মাথা ঘামানো। একে তো তিনি আছেন প্রার্থী মনোনয়নের প্রক্রিয়ায়। তার ওপর পুরো প্রচারণার কেন্দ্রবিন্দু তিনি।
যুক্তফ্রন্ট কোনো আদর্শের ঐক্য নয়। আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলামী, গণতন্ত্রী দল—একেকজনের আদর্শ আর উদ্দেশ্য একেক রকম। কৃষক শ্রমিক পার্টি নতুন দল, তাতে সব মনোনয়নপ্রত্যাশীর ভিড়। মুসলিম লীগে মনোনয়ন না পেয়ে তারা আসতে লাগল ফজলুল হকের কাছে। নমিনেশন ফরম ছাপিয়ে বিক্রি করা হলো। এক লাখ টাকার বেশি এল ফরম বিক্রির টাকা থেকে।
সোহরাওয়ার্দী নিজের টাকায় কতগুলো মাইক্রোফোন কিনে আনলেন।
মনোনয়ন নিয়ে যুক্তফ্রন্টের দলগুলোর মধ্য বিরোধ তুঙ্গে। আওয়ামী লীগ আর কৃষক শ্রমিক পার্টির কর্মীরা বিক্ষোভ-পাল্টাবিক্ষোভ প্রদর্শন করে চলেছে। সেই ক্ষোভ ফজলুল হক আর ভাসানীর মধ্যেও সংক্রমিত হলো। ভাসানী রাগ করে ঢাকার বাইরে চলে গেলেন। মুজিব একা কত সামলাবেন!
নেজামে ইসলামী একটা তালিকা দিয়ে বলল, এদের নমিনেশন দেওয়া যাবে না, এরা কমিউনিস্ট
মাঝেমধ্যে ফজলুল হকের কাছ থেকে ছোট ছোট চিঠি আসে, তাঁকে অসম্মান করতেও পারা যায় না।
তবে কৃষক শ্রমিক পার্টির কফিলউদ্দিন চৌধুরী, যিনি কিনা যুক্তফ্রন্টের জয়েন্ট সেক্রেটারি, তিনি আবার ভালো প্রার্থী আওয়ামী লীগের হলেও তাঁকেই সমর্থন করছেন। আতাউর রহমান খানও জয়েন্ট সেক্রেটারি। মুজিব তৎপর। বোঝা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ থেকে বেশি মনোনয়ন দেওয়া হবে, তাতে হক সাহেবের দলের মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
এই অবস্থায় সোহরাওয়ার্দী না থাকলে যুক্তফ্রন্ট ভেঙেই যেত। সোহরাওয়ার্দী ঘোষণা করলেন, আমি নিজে হলাম একজন গ্লোরিফায়েড ক্লার্ক। আমি কোনো মত দিব না।
শেষ মত দিবেন ফজলুল হক আর মওলানা ভাসানী। এর মধ্যে ভাসানী ঢাকার বাইরে। তাঁকে ধরে আনা হলো।
মুজিব তাঁকে বললেন, ‘হুজুর, আপনি সরে থাকবেন না। কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতারা কিছু হলেই উঠে যায়; বলে, ফজলুল হক সাহেবের সাথে পরামর্শ করে আসি, আমি কার সাথে পরামর্শ করব? আপনাকে থাকতেই হবে।’
মুজিব নিজে থেকে অনেকগুলো জেলার মনোনয়ন চূড়ান্ত করলেন। কিন্তু তার নিজের মনোনয়নপত্র জমা দিতে যেতে হবে গোপালগঞ্জ নির্বাচনী অফিসে।
তিনি ঢাকা ত্যাগ করলেন। এর ফলে তিন-চারটা জেলার মনোনয়ন তাঁর মনের মতো হলো না। আজিজ আহমেদকে চট্টগ্রামে মনোনয়ন না দিয়ে একজন ব্যবসায়ীকে দেওয়া হলো। খন্দকার মুশতাককে মনোনয়ন দেওয়া হলো না, এটাও মুজিব পছন্দ করলেন না।
.
আতাউর রহমান খান ও ফজলুল হকও চলে গেলেন নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায়।
এবার ঢাকার অফিস সামলানোর দায়িত্ব একা সোহরাওয়ার্দীর। তিনি আহার-নিদ্রা ত্যাগ করলেন। চব্বিশ ঘণ্টা তিনি মনোনয়নপ্রার্থীদের সাক্ষাৎকার নিতে থাকলেন। ২৩৭ আসনের জন্য মনোনয়নপ্রার্থী ১১০০-এর বেশি। তিনি সবার সঙ্গে দেখা করলেন। সবার কথা শুনলেন। এদের প্রত্যেকের কথা শোনা আর তাঁদের সমর্থকদের সঙ্গে দেখা করা কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এটা একটা অতিমানবিক ব্যাপার। গ্লোরিফায়েড ক্লার্ক সোহরাওয়ার্দী সেই অতিমানবিক কাজ করে চলেছেন। গোসল বাদ দিলেন। মনোনয়ন-প্রার্থীদের সামনেই টোস্ট বিস্কুট আর চা খেয়ে তাঁর ভোজ সারছেন।
ভাসানী আবার ঢাকা ত্যাগ করেছেন। যাবার আগে মুজিবের সঙ্গে ঝগড়া করেছেন, বলে গেছেন, ‘ওই সমস্ত লোকের সাথে কি কথা কওন যায়? কাজ করা যায়? আমি যুক্তফ্রন্টের ধার ধারি না। তোমগো যুক্তফ্রন্ট আমি মানি না। আমি যামু গা।’
ঢাকা তখন গমগম করছে। মনোনয়নপ্রার্থীরা ভিড় করে আছেন, সঙ্গে এনেছেন এলাকার বাচতুর ব্যক্তিটিকে, তাঁর সঙ্গে আছে সমর্থকেরা, নিজের শক্তি দেখানোর জন্য সমর্থকদের সমাবেশ একান্ত প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হচ্ছে। আর আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোর ছাত্রকর্মীরা। ছাত্রলীগই প্রধান ছাত্রশক্তি। তারা মিছিল করছে। ভিড় করে আছে যুক্তফ্রন্টের অফিসের সামনে। তারা স্লোগান দিচ্ছে মনোনয়ন ঘোষণায় কেন দেরি হচ্ছে তা জানতে চেয়ে। প্রার্থীদের সমর্থকেরাও অধৈর্য, এলাকায় গিয়ে কাজ করতে হবে না? ছাত্রলীগের ছেলেরা ঘেরাও করল এ কে ফজলুল হকের গাড়ি। তিনি ক্রুদ্ধ হলেন। বললেন, ‘আমি আর আসব না মনোনয়ন বোর্ডের কাজে।’
মুহূর্তে খবর ছড়িয়ে পড়ল, যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যাচ্ছে।
মুসলিম লীগাররা মহা উৎসাহে সেই খবর টেলিফোনে ছড়িয়ে দিতে লাগল সারা দেশে। মুসলিম লীগবিরোধী ছাত্রজনতা উৎকণ্ঠিত। তারা সবাই ভিড় করতে লাগল যুক্তফ্রন্ট অফিসে। অনেকেই গেল এ কে ফজলুল হকের বাড়ির সামনে।
মুসলিম লীগের কাগজ আজাদ। মাওলানা আকরম খাঁ এর সম্পাদক। তিনি নির্দেশ দিলেন তাঁর রিপোর্টারকে, যুক্তফ্রন্টের ভাঙনের খবর নিয়ে আসো। আজ রাতে এটাই হবে প্রধান সংবাদ। কাল দেশবাসী জেনে যাবে ভাঙনের খবর।
রিপোর্টার সন্তোষ বসাক। ঝানু সাংবাদিক। তিনি যুক্তফ্রন্ট অফিসের সামনে গিয়ে সারা দিন এর-ওর সাক্ষাৎকার নিয়ে দাঁড় করিয়ে ফেললেন চমৎকার রিপোর্ট : যুক্তফ্রন্ট ভেঙে চৌচির।
কিন্তু রাতেই ফজলুল হক বিবৃতি দিলেন, যুক্তফ্রন্ট ঠিক আছে। তিনিও যুক্তফ্রন্টেই আছেন।
আজাদ-এর বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন। হালকা-পাতলা মানুষটির ব্যক্তিত্ব প্রবল।
তিনি এপিপির একটা ছোট্ট তারবার্তা পেলেন, যাতে এ কে ফজলুল হকের বিবৃতিটা এসেছে।
তাঁর সহকর্মী এসে দিয়ে গেল একতোড়া কাগজ, বললেন, সম্পাদক সাহেব এটা দিয়েছেন, এইটা আজকা লিড হবে।
সিরাজুদ্দীন হোসেন পড়লেন খবরটা, যুক্তফ্রন্ট ভেঙে চৌচির। তিনি সেই খবরটাকে নিজের ড্রয়ারে তালা-চাবি দিয়ে রেখে শেরেবাংলা ফজলুল হকের বিবৃতি ছাপলেন : যুক্তফ্রন্ট ভাঙে নাই।
পরের দিন সকাল সকাল সিরাজুদ্দীন সাহেব পত্রিকা অফিসে এসে হাজির। বারান্দায় সাইকেল রেখে তিনি অফিস কক্ষে ঢুকলেন। নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলেন। পকেট থেকে বের করলেন সিগারেটের প্যাকেট। পিয়নকে ডেকে বললেন, ‘এই দেখো তো, দিয়াশলাইয়ের কাঠি কই পাওয়া যায়। যাও। দিয়াশলাই এনে দাও।’
পিয়ন একটা খাম হাতে তাঁর সামনে দাঁড়াল।
খামের ওপরে তাঁর নাম লেখা।
খামটা খুললেন সিরাজুদ্দীন হোসেন। ‘আপনার চাকরির আর প্রয়োজন নাই। আকরম খাঁ।
সিরাজুদ্দীন হোসেন সিগারেটটা ঠোঁটে ধরে বেরিয়ে এলেন আজাদ অফিস থেকে। বাইরে এসে দিয়াশলাই কিনে সিগারেটটা ধরালেন। আকাশে এক রাশ ধোঁয়া ছেড়ে মনে মনে বললেন, “উফ্, কী শান্তি, কী মুক্তি!’
শহীদ সাহেব আওয়ামী লীগ আর কৃষক শ্রমিক লীগের ২০ জন নেতা নিয়ে একটা সিলেকশন বোর্ড করলেন। তাঁরা প্রার্থীদের ভেতর থেকে যোগ্যতা বিবেচনা করে মনোনয়ন চূড়ান্ত করে ফেলতে লাগলেন। কিন্তু দিনরাত প্রার্থী আর তাদের সমর্থকেরা এসে ভিড় করছে অফিসে। তখন সোহরাওয়ার্দী পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিলেন হামিদুল হক চৌধুরীর বাড়িতে। সেখানেই বিরতিহীন বৈঠকে সব নমিনেশনই চূড়ান্ত হয়ে গেল। দু-একটা মনোনয়ন বদলাতে হলো মওলানা ভাসানী বা এ কে ফজলুল হকের চিরকুট পেয়ে। কফিলউদ্দিন চৌধুরীর উদারতা খুব কাজে লাগল। আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মনোনয়ন পেলেও তিনি তাতে আপত্তি তো করেনই নাই, বরং সমর্থন করে গেছেন। সবগুলো মনোনয়ন হলো সর্বসম্মতিক্রমে।
তাজউদ্দীন আহমদকে মনোনয়ন দেওয়া হলো তাঁর বাড়ি কাপাসিয়া এলাকা থেকে।
তাজউদ্দীনের ঢাকার ভাড়াবাসা। বাড়িটা একতলা। ভেতরে আঙিনা আছে। সেই আঙিনায় ঢাকার যুবকর্মীদের নিয়ে একটা সভা করে ফেললেন তাজউদ্দীন। খন্দকার ইলিয়াসকে সভাপতি করে একটা কর্মিশিবির গঠিত হলো সে সভায়। এঁরা ঢাকার যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালাবেন।
৩৭.
মুনীর চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন তাঁর স্ত্রী লিলি চৌধুরী।
ঢাকা জেলখানার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বন্দীরা একটু অধীর হয়ে আছেন। তাঁদের মুক্তির কোনো খবর আসে কি না! সামনে নির্বাচন। রাজবন্দীদের জেলে রেখে নির্বাচন হবে?
মুনীর চৌধুরী ফিরে এলেন জেলগেটের ভিজিটর রুম থেকে। সহবন্দীরা ধরলেন তাঁকে। অজিত গুহ বললেন, ‘মুনীর, লিলি কী বলল?’
মুনীর চৌধুরী বললেন, ‘লিলিকে আমি জিগ্যেস করলাম, লিলি, আমাদের মুক্তির ব্যাপারে কোনো খবর আছে? কিছু জানো। লিলি বলল, না, জানি না। আমি বললাম, আমরাও কিছু জানি না।’
বন্দীরা সবাই মুনীর চৌধুরীর কথা শুনে হেসে ফেললেন।
মুনীর চৌধুরী এরই মধ্যে বাংলায় এমএ পরীক্ষা দিচ্ছেন জেলখানা থেকেই। অজিত গুহ তাঁর শিক্ষক। মুনীর চৌধুরী পরীক্ষায় প্রথম পর্বে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছেন।
এখন তিনি লিখছেন একটা নাটক।
অজিত গুহ তাঁকে বললেন, ‘ও মুনীর, কী করো?’
‘একটা নাটক লিখছি অজিতদা। একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করতে হবে না? এই নাটক জেলখানার ভেতরে মঞ্চস্থ করা হবে। রণেশদা আমার কাছে নাটক চেয়েছেন।’
তাঁর নাটক লেখা সম্পন্ন হলো।
নাটকের পাণ্ডুলিপি মুনীর চৌধুরী দিয়ে দিলেন রণেশ দাশগুপ্তকে। তিনি এক কমিউনিস্ট বন্দী। সবাই তাঁকে ডাকে রণেশদা বলে। তিনি কারাগারের ১ নম্বর ও ২ নম্বর খাতায় যে কমিউনিস্ট বন্দীরা থাকেন, তাঁদের নিয়ে গোপনে রিহার্সাল করতে থাকেন। ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগ থেকে শুরু হলো রিহার্সাল। নাটকের নাম কবর। একুশের ভাষাশহীদেরা কিছুতেই কবরে যাবেন না।
জেলখানা কমিউনিস্ট বন্দীদের দিয়ে ভর্তি। ১৯৪৭ সাল থেকেই শুরু হয়েছে কমিউনিস্টবিরোধী অভিযান। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথম থেকেই ঘোষণা করেছেন কমিউনিজমের বিরুদ্ধে তাঁর কঠোর অবস্থানের কথা।
কমিউনিস্টদের জেলখানায় রাখা হয় খুবই মানবেতরভাবে। সন্ধ্যার পরে অনেককেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয় সেলে। তাঁদের খাবার দেওয়া হয় কম। এঁরা এইসব অত্যাচারের প্রতিবাদ করেন। তখন তাঁদের শাস্তি দেওয়া হয়। শাস্তির ধরনের মধ্যে আছে ‘সাত দিনের আট ডিগ্রি বাস’। আট ডিগ্রি মানে ওই দশ হাত বাই পাঁচ হাত সেলে দিনরাত তালা দিয়ে রাখা। ভেতরে একটা টুকরি রাখা থাকে। রাতে সেইখানে প্রাকৃতিক কাজ সারতে হবে।
কমিউনিস্টদের হয়তো বিছানাই দেওয়া হলো না। মাটিতে থাকো। মানবেতর পরিবেশের প্রতিবাদে কমিউনিস্ট বন্দীরা অনশন করেন। প্রথম ছয় দিন তাঁদের সামনে খাবার রাখা হয়। বন্দীরা তা স্পর্শ করেন না। তারপর শক্তপোক্ত কয়েদিদের ধরে আনা হয়। এরা এখন বন্দীদের নাকের ভেতরে নল ঢুকিয়ে দিয়ে জোর করে তরল খাবার পাকস্থলীতে ঢুকিয়ে দেবে। এই রকম করে খাওয়াতে গিয়ে শিবেন রায় নামে একজন শ্রমিকনেতা মারা যান। তাঁর নলটা অন্ননালিতে না ঢুকে শ্বাসনালিতে ঢুকে গিয়েছিল। তিনি চিৎকার করে তাঁর যন্ত্রণার কথা জানাচ্ছিলেন। কয়েদিরা তো আর ডাক্তার নয়। তারা বুঝতে পারেনি, জোর করে খাবার ঢুকিয়ে দিলে শ্বাস বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান। কমিউনিস্ট বন্দীরা অনশন করত, বিশ দিন বাইশ দিন। আটান্ন দিন পর্যন্ত অনশন করেছেন, এমন উদাহরণও আছে। তাঁদের কেউ কেউ পাগল হয়ে যেতেন ক্ষুধার যন্ত্রণায়। মেঝেতে গড়াগড়ি খেয়েছেন, কাপড়চোপড় ছেড়ে ছুটোছুটি করেছেন, কিন্তু অনশন ভঙ্গ করতেন না কেউ।
রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে কমিউনিস্ট বন্দীদের ওপরে গুলি চালানো হয়েছিল ১৯৫০ সালের এপ্রিলে। সাতজন নিরাপত্তা বন্দী, যাঁরা আসলে কমিউনিস্ট ছিলেন, নিহত হন। অনেকেই আহত হয়েছিলেন।
বিশে ফেব্রুয়ারির মধ্যরাতের পর সব বন্দী চুপি চুপি সমবেত হলেন ১ নম্বর ও ২ নম্বর খাতা থেকে বেরিয়ে। হারিকেন, প্রদীপ আর দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে আলোকসম্পাতের ব্যবস্থা হলো। মঞ্চস্থ হলো কবর
নেতা : অনেক কেতাব পড়েছ। তোমার মাথা গেছে।
মূর্তি : ছিল। এখন নেই। খুলিও নেই। উড়ে গেছে। ভেতরে যা ছিল রাস্তায় পড়ে সব নষ্ট হয়ে গেছে।
… …
নেতা : তুমিও এই দলে এসে জুটেছ নাকি?
মূর্তি ২: গুলি দিয়ে গেঁথে দিয়েছে। ইচ্ছে করলেও আলগা হতে পারবো না।…
মুর্দা ফকির : কোথায় গেলি? সব ঘুমিয়ে নাকি? উঠে আয়। সব মিছিল করে উঠে আয়। গুলি, গুলি হবে। স্ফূর্তি করে উঠে আয় সব। কোথায় গেলি? সব উঠে আয়। মিছিল করে আয় এদিকে। আজ গুলি—গুলি হবে আজ। কবর খালি করে সব উঠে আয়।
.
জেলখানার চার দেয়ালের ভেতরে সেই ‘আয় আয়’ আওয়াজ ধ্বনিত- প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে। কোরোসিন দীপের শিখা ওঠে কেঁপে।
৩৮.
হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী তিনজনই খুবই জনপ্রিয়। তাঁরা তিনজন একত্র হয়েছেন, এই খবরেই পূর্ব বাংলাজুড়ে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দিল।
ফজলুল হক ও ভাসানী দেশের দুই দিকে প্রচারাভিযানে নেমেছেন। তাঁদের জনসভায় লোকসমাগম হতে লাগল ব্যাপক।
সোহরাওয়ার্দী ডেকে বললেন কামরুদ্দীনকে, মুসলিম লীগের পক্ষে প্রচারে নেমেছেন স্বয়ং কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়া। আরও আছেন প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিন। আইজি, ডিআইজি, জিলা ম্যাজিস্ট্রেট কমিশনাররা তাঁদের পক্ষে কাজ করছেন। তার ওপর আবার মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতিমা জিন্নাহও চলে এসেছেন পূর্ব বাংলায়। পাকিস্তান থেকে বড় বড় আলেমরা এসেছেন পাকিস্তানের সংহতি আর ইসলাম রক্ষার পবিত্র উদ্দেশ্যে। এ অবস্থায় আমাদের চুপ করে বসে থাকা উচিত নয়।
তিনি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনালেন সীমান্ত গান্ধী আবদুল গফফার খাঁ, নবাবজাদা নসরুল্লাসহ নামীদামি নেতাদের। তিনি একা ছক কষলেন, পুরো পূর্ব বাংলায় কে কোথায় কীভাবে সফর করবেন। তিনি নিজেও বের হয়ে পড়লেন জনসভা করতে। তাঁর জনসভাগুলোতেও লোক উপচে পড়তে লাগল।
৩৯.
মানিক মিয়া চিৎকার করছেন, ‘আমার কোলবালিশ দুইটা কই?
স্বামীবাগের ছোট্ট ভাড়াবাড়িতে ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া থাকেন সপরিবারে। সেখানেই এম আর আখতার মুকুল বসে আছেন বৈঠকখানায়। রাত সাড়ে ১০টা। মানিক মিয়ার কণ্ঠস্বর ভেতরের ঘর থেকে ভেসে আসছে, ‘আমার কোলবালিশ দুইটা কই?’
রাত ১০টায় কেনই বা মানিক মিয়া তাঁর দৈনিক ইত্তেফাক-এর চিফ রিপোর্টার এম আর আখতার মুকুলকে বললেন, ‘মুকুল মিয়া। হাতের কাম- কাজ তাড়াতাড়ি সারিয়া ফেলান। আপনারে আমার লগে যাইতে হইবে।’ মুকুলও দ্রুত সেরে নিলেন হাতের বাকি কাজটুকু, তারপর প্রচণ্ড শীতের রাতে পাশাপাশি রিকশায় বসে ৯ নম্বর হাটখোলা রোডের প্যারামাউন্ট প্রেসের ইত্তেফাক অফিস থেকে চলে এলেন স্বামীবাগে। বাইরের ঘরে বসলেন।
মানিক ভাই অন্দরে ঢুকেছেন, আর ঢোকামাত্রই চিৎকার, ‘আমার কোল বালিশ দুইটা কই?’
মানিক মিয়া ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে মুকুলকে বললেন, ‘এখনই ফোন করেন তো অফিসে, বশিরকে আইতে কন।’
মুকুল ফোন করলেন ইত্তেফাক-এ, ‘এই বশিরকে কও এখনই মানিক ভাইয়ের বাসায় আসতে। খুব জরুরি।’
বশির ইত্তেফাক-এর বিখ্যাত পিয়ন।
মুকুল কিছুদিন আগেও চাকরি করতেন সংবাদ-এ। মুসলিম লীগ সরকার-সমর্থক পত্রিকা। বিয়ে উপলক্ষে ছুটি নিয়েছেন, গেছেন বগুড়া শহরে। বিয়ের রাতের খাদ্যতালিকায় ছিল সাদা ভাত আর খাসির মাংস, অসচ্ছল উভয় পরিবারের জন্য সেও অনেক। পরের দিন রেজিস্ট্রি খাম এল মুকুলের নামে, তাঁর অফিস থেকে, খাম খুলে জানতে পারলেন, সংবাদ-এ তাঁর চাকরিটা আর নাই।
ঢাকায় ফিরে এসে সোজা গেলেন ৯ নম্বর হাটখোলায়। প্যারামাউন্ট প্রেসের ভেতরেই ইত্তেফাক অফিস। সাপ্তাহিক ইত্তেফাক রূপান্তরিত হচ্ছে দৈনিক ইত্তেফাক-এ। লোক লাগবে।
একই রুমে বসেছেন ইত্তফাক-এর সম্পাদক মানিক মিয়া, পাশেই সহকারী সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক, সহ-সম্পাদকদের বসার জায়গা। বারান্দা ঘেরা হয়েছে বেড়া দিয়ে, সেখানে সার্কুলেশন, বিজ্ঞাপন ও জেনারেল সেকশন। ও পাশে আরেক ছোট বারান্দায় জেনারেল ম্যানেজার আর প্রুফ বিভাগের বসার জন্য কোনোরকমের ব্যবস্থা।
জীবনে এই প্রথম মুকুল দেখলেন ইত্তেফাক-এর বিখ্যাত সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে। পরনে হাওয়াই শার্ট। হিটলারি গোঁফ। নাতিদীর্ঘ মানুষ। কিন্তু কথা বলেন চিৎকার করে। ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন এম আর আখতার মুকুল, এরই মধ্যে সাংবাদিকতা করেছেন দু-তিনটা কাগজে, শুনে মানিক মিয়া রাজি হলেন মুকুলকে চাকরি দিতে।
‘সংবাদ-এ মাসে বেতন কত পাইতেন?’ মানিক মিয়া ভ্রু কুচকে বললেন।
‘১৭৫।’
‘১৭৫। বাম দিককার একের কথাটা ভুলিয়া যান। খালি ৭৫।
মুকুল মাথা চুলকাতে লাগলেন। সদ্য বিয়ে করে ফিরেছেন। ১৭৫ থেকে ১ গেলে থাকে কত?
মানিক মিয়া বললেন, ‘কাগজটা যদি টিকিয়া যায়, তা হইলে এইডারে কোঅপারেটিভ বেসিসে চালানো হইবে, রাজি থাকেন তো কইয়া ফেলান। না থাকলে যান গা। আধা ঘণ্টা টাইম দিলাম। ভাবিয়া কন।’
তখন ইত্তেফাক-এর বার্তা সম্পাদক ছিলেন আবদুল কাদের, শ্রমিক ফেডারেশন নেতা।
মুকুল ইত্তেফাক-এ যোগ দিলেন। এক দিন পর, ২৫ ডিসেম্বর, ১৯৫৩, সাপ্তাহিক ইত্তেফাক দৈনিক হয়ে গেল।
সামনে নির্বাচন। যুক্তফ্রন্টের একটা মুখপত্র চাই। মানিক মিয়া কোনো দলের মেম্বার নন। কাজেই ইত্তেফাকই হবে যুক্তফ্রন্টের জন্য উপযুক্ত কাগজ।
এর মধ্যে দৈনিক আজাদ থেকে চাকরি খোয়ানো সিরাজুদ্দীন হোসেনও চলে এসেছেন ইত্তেফাক-এ। তিনি এখন বার্তা সম্পাদক। সিরাজুদ্দীন হোসেনের চাকুরিচ্যুতির খবর শোনামাত্রই বিচলিত হয়ে উঠলেন মুজিব। তিনি মানিক মিয়াকে অনুরোধ জানালেন সিরাজ ভাইয়ের জন্য ব্যবস্থা করতে।
এর মধ্যে ইত্তেফাক-এ বার্তা সম্পাদক কাদের সাহেব পদত্যাগ করেছেন।
কাজেই সিরাজুদ্দীন হোসেনের ইত্তেফাক-এ যোগ দিতে কোনো অসুবিধা হলো না।
তিনি কঠোর এবং নিষ্ঠাবান। কোনো রিপোর্ট মিস হয়ে গেলে রিপোর্টারদের ভীষণ বকা দেন। আবার কেউ ভালো রিপোর্ট করলে প্রশংসার বন্যা বইয়ে দিতেও কার্পণ্য করেন না।
এম আর আখতার মুকুল একদিন সকালবেলা গেছেন সচিবালয়ে। সেখানেই তথ্য দফতর। ভেতরে গিয়ে দেখলেন তাঁর সম্পাদক মানিক মিয়াও বসে আছেন। খানিক পরে দৈনিক সংবাদ-এর চিফ রিপোর্টার সৈয়দ জাফর হন্তদন্ত হয়ে উপস্থিত। তিনি মুকুলের সঙ্গে ফিসফিসিয়ে কথা বলতে লাগলেন। ‘কী ব্যাপার জাফর ভাই, এত অস্থির লাগতেছে ক্যান? ঘটনা কী?’ মুকুল জিগ্যেস করলেন। সৈয়দ জাফর বললেন, ‘আরে ধানমন্ডিতে একটা সরকারি জমি পাইছি। তিন হাজার টাকা দরকার। আগামীকাল কিস্তির টাকা জমা দেওয়ার লাস্ট ডেট।’
‘ধানমন্ডিতে তো ধানের খেত। নিয়া কী করবেন? শিয়াল ডাকে।’
‘এখন ডাকে। একদিন কি ডেভলপড হবে না? আর আগের টাকা তো দেওয়া আছে। পিছাই কেমনে?’
মানিক মিয়া গলা উঁচিয়ে বললেন, ‘কী ব্যাপার, আপনেরা এত ফুসুরফাসুর করতাছেন ক্যান? কী হইছে, আমারে খুলিয়া কন দেহি?’
সৈয়দ জাফর বললেন, ‘না, মানিক ভাই, আপনার শুনে কাজ নাই।’
মানিক মিয়া শুনবেনই। অগত্যা সৈয়দ জাফরকে খুলে বলতেই হলো তাঁর সমস্যার কথা।
মানিক মিয়া বললেন, ‘কাইল একবার খোঁজ করিয়েন।’
সমস্ত দিন মুকুল কাজের তোড়ে ভেসে বেড়ালেন। রাতে অফিসে এসে রিপোর্ট লিখছেন।
রাত ১০টায় মানিক মিয়ার আদেশ, ‘চলেন, আমার লগে চলেন।’
এখন মানিক মিয়ার বাসায় এসে তো কিছুই বুঝছেন না মুকুল। মানিক ভাই কোল বালিশ খোঁজেন কেন?
বশির চলে এসেছে। মানিক ভাই বললেন, ‘বশির, পাশের বাড়ি যা। বিয়া পড়ানো হইয়া গেলে বরের দুই পাশ থাকিয়া বালিশ দুইটা লইয়া একেবারে সোজা আমার দারে আইবি। যা।’
মানিক মিয়া বাথরুমে গেলেন হাতমুখ ধোয়ার জন্য। তাঁর স্ত্রী এলেন খাবারদাবার নিয়ে। বললেন, ‘দুইটা বালিশের জন্য এত চিল্লাচিল্লির কী হইল। হীরু মিয়া বালিশ দুইটা বিয়াবাড়ির বররে ধার দিছে। আসিয়া যাইবে তো।’
বালিশ দুটো এল। মানিক মিয়া ব্লেড দিয়ে একটা বালিশের সেলাই কেটে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিলেন। টাকা বেরোল।
তিনি অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বললেন, ‘মুকুল মিয়া, এইবার বুঝবার পারলেন তো ঘটনা। লন দুই হাজার টাকা। সৈয়দ জাফররে দিয়েন।’
.
ইত্তেফাক-এর পিয়ন বশির। সকালবেলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে পত্রিকা ফেরিও করে। পিয়ন কাম হকার।
একদিন সকালবেলা সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ইত্তেফাক হাতে চিৎকার করতে লাগল, ‘ভাসানীর কোনো খবর নাই। ভাসানীর কোনো খবর নাই। ‘
চারদিকে এমনিতেই রব, এই বুঝি যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যায়। মওলানা ভাসানী প্রায়ই এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে মন-কষাকষি করে ঢাকার বাইরে চলে যাচ্ছেন, মানুষের মধ্যে এই নিয়ে নানান কথা।
এর মধ্যে কী খবর ছাপা হলো ইত্তেফাক-এ! জনতা উৎসুক। ভাসানী কি আবার ঢাকার বাইরে গেছেন গা ঢাকা দিতে? নাকি কোনো দুর্ঘটনার শিকার হলেন তিনি?
কাগজ কেনার পরে পাঠক ভাসানীসংক্রান্ত কোনো খবর আর খুঁজে পায় না।
‘কই, ভাসানীর খবর কই?’ ক্রেতা জিগ্যেস করল বশিরকে।
বশির চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘কইছিলাম কি না, ভাসানীর কোনো খবর নাই।’