Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প620 Mins Read0

    ল্যাংড়া পাহান

    ০১.

    গরমের ছুটিতে বহু বছর পরে একসঙ্গে কোথাও এলাম আমরা। তাই না?

    তিতির বলল।

    যা বলেছ।

    আমি বললাম।

    পাশের কটেজ থেকে ঋজুদাও এসে যে কটেজে আমি আর ভটকাই রাতে ছিলাম তার বারান্দাতে উঠল, পাজামা-পাঞ্জাবি পরে। লংক্লথের পাজামা আর আদ্দির পাঞ্জাবি। ঋজুদা কখনও স্লিপিং-স্যুট পরে না। পুরোপুরি বাঙালিয়ানাতে বিশ্বাসী সে, শুধুমাত্র পাজামা-পাঞ্জাবিটা ছাড়া। আজকাল অবশ্য খুব কম বাঙালিই ধুতি পরেন। কিন্তু ঋজুদা বলে, প্রত্যেক বাঙালির ধুতিই পরা উচিত। তামিলনাড়ু, কর্ণাটক এবং কেরালার মানুষেরা তো ধুতিই পরেন, পাঞ্জাবী, কাশ্মিরী সকলেই নিজেদের পোশাক। তখন আমাদের এই সাহেবি অথবা জগাখিচুড়ি পোশাক পরার কোনও মানে হয় না।

    তিতির, তার কটেজ থেকে আগেই এসে হাজির হয়েছিল।

    ঋজুদা এসে আমাকে বলল, কী রে রুদ্র? চা আনতে বলেছিস?

    তিতির বলল, কাল রাতেই তো বলে দিয়েছি সব কটেজেই ভোর ছটাতে বেড-টি দিতে। কিন্তু এখনও তো ছ’টা বাজেনি।

    বাবাঃ। হল কী রে তোর রুদ্র? আজ কি সে সানরাইজ দেখবি নাকি? নাও। বাঙালি এবারে সত্যি সত্যিই জাগবে বলে মনে হচ্ছে।

    কলকাতার সব পাড়ার চারদিকের দেওয়ালে কারা যেন লিখত না একসময়ে, বাঙালি গর্জে ওঠো।

    তিতির বলল।

    হ্যাঁ।

    আমি বললাম, তার নীচে অন্য কারা আবার লিখে রাখত, আঃ। কাঁচা ঘুম ভাঙিও না।

    ঋজুদা হেসে উঠল আমার কথাতে।

    বলল, যাই বলিস, আমরা, মানে বাঙালিরা অনেক দোষেই দোষী, ভাগ্য আমাদের সহায় হয়নি, আর আমাদের নেতারাও আমাদের জন্যে করার মতন কিছুই করেননি এত বছরেও কিন্তু তবু এত দুর্দশার মধ্যেও এই সেন্স অফ হিউমার এখনও বেঁচে আছে বলেই বাঙালি বেঁচে আছে।

    বলেই বলল, আরে! মিস্টার ভটকাই-কে তো দেখছি না! সে কোথায় গেল? একা একা অ্যাডভেঞ্চার করতে বেরিয়ে গেল না তো এই সাতসকালে! শেষে এই বান্দিপুরের অভয়ারণ্যে ভীরাপ্পানের হাতে পড়বে না তো?

    পড়লেই হল। তা হলে তোমাকে বাধ্য হয়েই ভীরাপ্পানের কেসটা হাতে নিতে হবে। কিন্তু বেচারা ভটকাইকে বাগে পেলেও ভীরাপ্পান কিছু করবে না।

    আমি বললাম।

    ঋজুদা বলল, কেন?

    কারণ সে মাথা ন্যাড়া করেছিল তামিল ব্রাহ্মণ সাজবার জন্যে, মনে আছে? আমরা মণিপুর আর নাগাল্যান্ডে সেই হত্যা-রহস্য সমাধান করতে যাওয়ার আগে?

    হ্যাঁ। তা ঠিক।

    তিতির বলল।

    তুই তো সেই কাহিনী তোর কাঙ্গপোকপি বইয়েতে ইতিমধ্যে লিখেই ফেলেছিস।

    বাঃ। রুদ্র তো কাঙ্গপোকপি অভিযানের পরেও আমাদের বক্সার জঙ্গলের ট্রিপ নিয়েও লিখেছে ঋজুদার সঙ্গে বক্সার জঙ্গলে।

    তিতির বলল।

    এ কথা সত্যি যে ঋজু বোসকে বাংলা সাহিত্যে এই মিস্টার রুদ্র রায়ই বিখ্যাত করে দিয়েছে। নইলে, দেশে তো আমার মতো বনে-জঙ্গলে ঘোরা আর। রহস্যভেদী কত মানুষই আছেন যাঁরা আমার চেয়ে কোনও অংশে কম যোগ্য ও নলেজেবল নন কিন্তু ঋজুদা কাহিনীগুলির মাধ্যমে রুদ্র শুধু আমাকে একাই নয়, তোকে, ভটকাইকে এবং নিজেকেও বাংলার ঘরে ঘরের কিশোর-যুবা বৃদ্ধদের কাছে এত জনপ্রিয় করে তুলেছে। এই কারণেই আমাদের সকলেরই ওর কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

    আমি আমার এত প্রশংসাতে একটু লজ্জা লজ্জা ভাব করলাম মুখে, যদিও খারাপ লাগছিল না। আমি যদি অতগুলি ঋজুদা কাহিনী না লিখতাম তবে ঋজুদা  যেমন সাধারণের কাছে এত বিখ্যাত হত না, বাংলার পাঠক-পাঠিকারাও খুবই বঞ্চিত হতেন যে, সে বিষয়ে কোনওই সন্দেহ নেই। ঘনাদা, টেনিদা, ফেলুদার পরে ঋজুদার মতো এমন চরিত্র তো বাংলা কিশোর-সাহিত্যে হয়নি। তা ছাড়া, অনেকেই যা জানেন না, তা হচ্ছে এই যে ফেলুদা আর ঋজুদা সমসাময়িক। দু’জনের আবির্ভাব বাংলা সাহিত্যে প্রায় একই সময়ে। ভবিষ্যৎই বলবে এই দুই দাদার মধ্যে কোন দাদা বেশিদিন বেঁচে থাকবেন বাঙালির মনে। সময়ের চেয়ে। বড় পরীক্ষক আর নেই।

    ওই যে চা আনছে।

    তিতির স্বগতোক্তি করল।

    ভটকাই খালি গায়ে শুয়েছিল। গায়ে, পাঞ্জাবিটা গলাতে গলাতে বাইরে বেরিয়ে বলল, দে দে, চা দে রুদ্র।

    বাঃ। আমি কি তোর valet নাকি? কী ভেবেছিস নিজেকে?

    ভাবিনি কিছুই। তোদের এত করে বললাম যে বান্দিপুরে হল্ট না করে চল উটিতেই চলে যাই, তা না…

    সাহেবদের উটি নয় বা আমাদের উটাকামণ্ডও নয়, বল উধাগামণ্ডলম।

    যা বলেছ!

    তিতির বলল।

    তারপর স্বগতোক্তির মতন বলল, সারা দেশটাই ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশন হয়ে গেল।

    মানে?

    ঋজুদা বলল।

    মানে, কলকাতার রাস্তার নাম বদল করা ছাড়া যেমন তাঁদের আর কোনও কাজ আছে বলে মনে হয় না, তেমন সারা দেশেই এই নাম বদলের ধুম-ধাড়াক্কা পড়ে গেছে যেন।

    ভটকাই ফুট কেটে বলল, যা বলেছ তিতির। কোনওদিন দেখব আমার বাবার নামও বদলে দিল ওরা।

    ঠিকই বলেছ। আমি বললাম, বম্বে হল মুম্বাই, মাড্রাস হল চেন্নাই, উটি হল উধাগামণ্ডলম!

    যাকগে, থামা এবার তোদের কচকচানি, বেশ কড়া করে এক কাপ চা ঢালত দেখি। রাতে তো ঘুমই হয়নি।

    ভটকাই বলল।

    ঋজুদা পাতলা চা খায়। ঋজুদারটা আগে ঢালি, তারপর আমাদেরটাও ঢেলে তোকে সবচেয়ে শেষে কড়া চা দেব। প্রথমেই চা কড়া হবেটা কী করে?

    ঠিক আছে। কাজ কর। বাতেল্লা করিস না।

    ভটকাই বলল, মুখ ভেটকে।

    রাতে ঘুম হয়নি কেন রে?

    ঋজুদা জিগ্যেস করল।

    হবে কী করে? সারা রাত যদি বাংলোর চারপাশে খচরমচর করে পালে পালে হরিণ চরে আর খায়, তবে কি ঘুম আসে! এই সব কারণেই আমার এই সব অভয়ারণ্য-টন্য ভাল লাগে না। অরণ্যে যদি ভয়ই না থাকল, না বন্যপ্রাণীদের, না দু পেয়ে মানুষের বা অন্য চারপেয়ে বন্যপ্রাণীদের কাছ থেকে, তবে পুরো ব্যাপারটাই আর্টিফিসিয়াল বলে মনে হয় আমার। তুমিই বলো ঋজুদা, কাজিরাঙ্গার গণ্ডার, বা বান্ধবগড়ের বাঘ, বা হলং-জলদাপাড়ার বা পালামৌর বাইসন, মানে গাউর, অথবা কানহার বাঘ বা বারাশিঙাদের কি বন্যপ্রাণী বলা চলে? তারা তো প্রায় গৃহপালিতরই মতন ব্যবহার করে। বন্যপ্রাণীর মধ্যে যে স্বাভাবিক বন্যতা, মানুষের প্রতি ভয়, বা বনে মানুষের বন্যপ্রাণী থেকে যে ভয়, তার কিছুমাত্রই তো থাকে না।

    তা ঠিক। পূর্ব আফ্রিকার সেরেঙ্গেটির সিংহ বা লেক-মানিয়ারার চিতাবাঘেরই মতো তাদের দেখতে কোনওই চমক নেই।

    চায়ে চুমুক দিতে দিতে তিতির বলল, ঋজুকাকা তুমি চুপ করে যে!

    ঋজুদার পাইপটা ভরা হয়ে গেছিল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, যাই বলিস, এই নীলগিরির চা খেয়ে আনন্দ নেই। আমাদের দার্জিলিঙের চায়ের মতো চা ভূ-ভারতে পেলাম না। মকাইবাড়ি, লপচু, আরও কত বাগানের চা। গন্ধ আর স্বাদই আলাদা।

    চা খেয়েই কিন্তু আমাদের সেই মার্ফিগঞ্জের মানুষখেকো বাঘ ‘ল্যাংড়া পাহানে’র গল্পটা বলতে হবে। শোবার আগে আরম্ভ করেছিলে, এবারে শেষ করতে হবে ব্রেকফাস্টের আগে।

    তোরা এই বান্দিপুরের জঙ্গলে গেলি না অন্ধকার থাকতে, হাতির পিঠে অথবা জিপে করে?

    না।

    কেন না?

    বান্দিপুর আর মুদুমালাই-এর জঙ্গল আমার ভাল লাগে না।

    আমি বললাম।

    কেন?

    কেন, তা এক কথাতে বলতে পারব না। লাগে না, এইটুকুই বলতে পারি।

    আমি বললাম।

    তবে এলি কী করতে? না কি ভীরাপ্পানের ভয়ে জঙ্গলে যেতে চাস না?

    ঋজুদা বলল।

    না, তা নয়। এলাম তো উটি দেখতে। সেই ছেলেবেলা থেকে মায়ের কাছে গল্প শুনে আসছি উটির। দাদু তো মধ্যজীবনে বেশ কিছুদিন ছিলেনও এখানে।

    ভটকাই বলল, মধ্যে পড়ে, তুই বাগড়া দিস না, ঋজুদাকে শুরু করতে দে। মার্কিগঞ্জের ল্যাংড়া পাহানের গল্প।

    ভারী মজার নামটা, না? ল্যাংড়া পাহান। একবার শুনলে আর ভোলার নয়।

    তিতির বলল।

    তা ঠিক।

    আমি বললাম।

    ল্যাংড়া পাহান কি জিম করবেট-এর Temple Tiger-এরই মতন?

    ভটকাই অধৈর্য গলাতে বলল।

    আহা শোনই না। অত অধৈর্য কেন তুই?

    আমি বললাম।

    তোর নাম রুদ্র না হয়ে ধৈর্যশীল হলে ভাল হত।

    ওরে ওরে ভটকাই আয় তোরে চটকাই।

    হঠাৎ বলে উঠল ঋজুদা, ভটকাই-এর পাড়ার ছেলেরা যেমন করে বলে তেমন করে।

    আমরা হেসে উঠলাম।

    তিতির বলল, নাও ঋজুকাকা চা-টা শেষ করো, আর এক কাপ আমি বানিয়ে দিচ্ছি। এবার কিন্তু পাইপটা ধরিয়ে নিয়ে শুরু করতে হবে।

    ওক্কে। যা তোমরা করতে আজ্ঞা করবে, তাই করব।

    চা-টা ঢাল কাপে। এবারে শুধুই লিকার কিন্তু। চা-টা কড়া হয়ে গেছে। ওটা ভটকাইকে দিয়ে দে। আর এক পট চা আনতে বল রুদ্র।

    বলছি।

    আমি বললাম।

    কিন্তু ল্যাংড়া পাহানের গল্পটা শুরু করে দাও।

    তিতির বলল।

    ঋজুদা তার সুললিত, ব্যক্তিত্বমণ্ডিত কণ্ঠস্বরে শুরু করল:

    মার্ফিগঞ্জে ঢুকতে হলে তখন সিজুয়াবাগ হয়ে ঢামনা অবধি আসতে হত ফিলফিলার পিচ-রাস্তা দিয়ে। তারপরই অনেকটা টাঁড়মতো জায়গা, লাল মাটির মস্ত তেমাথা। সেই তেমাথা থেকে অসমান কাঁচা রাস্তা চলে গেছে গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে।

    এক ফার্লং মতো গিয়েই পথের পাশে একটা মস্ত বড় গাছ। বনস্পতি। বট না অশ্বত্থ, এতদিনে আর মনে নেই। অনেকইদিন আগের কথা।

    জঙ্গলে-জঙ্গলে অনেকখানি গিয়ে পথের ডানদিকের ফরেস্ট বাংলো পেরিয়ে গিয়ে বাঁ দিকে এক গভীর উপত্যকা। ঘন জঙ্গলে ভরা। সেই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে ঝরনা পেরিয়ে ছোটবড় পাহাড়ের দোলায়-দোলায় দুলতে-দুলতে বড় বড় গাছের ছায়ায় অন্ধকার হয়ে থাকা পাকদণ্ডী। এই পাকদণ্ডীর মোড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সেই উপত্যকার দিকে মুখ করে পেছনে তাকালে দেখা যেত উঁচু পাহাড়টার চুড়োর কাছে মাফিজ নোজ। অর্থাৎ, মার্ফি সাহেবের নাক। মস্ত, কালো কোনও মানুষের মুখের আকৃতির পাথরটার সামনে-বেরিয়ে-থাকা ন্যাড়া পাথরটাকে একটি অতিকায় নাকের মতোই দেখতে লাগত।

    যে-সমস্ত লোকের খুব গর্ব থাকে, অথবা যাঁরা বরেন্দ্রভূমির ব্রাহ্মণ, তাঁদের নাক যেমন দেখতে হয়, মার্কিজ নোজও তেমনই দেখতে ছিল।

    মাঝে-মাঝেই টপিং-হাউস থেকে বেরিয়ে, মাইল-চারেক হেঁটে মাফিজ নোজ-এর কাছে এসে পথের পাশের বড় পাথরটাতে বসে থাকতাম। ভারী শান্তি ওখানে। দিনমানে বা রাতে গাড়ি বা জিপ যায় একটি বা দুটি। বাস যায় একটিই। সকালে রাঁচী গিয়ে সন্ধেতে ফিরে আসে। মানুষজনেরও যাতায়াত নেই বিশেষ। কখনও-সখনও একলা বার্কিং-ডিয়ার জঙ্গলের এদিক থেকে ওদিকে সাবধানে ইতিউতি চেয়ে সেই লালমাটির পথটি পেরোত। নইলে পাখির ডাক, হাওয়ার শব্দ, পাতার সঙ্গে পাতার কানে কানে কানাকানি। ব্যাস। নিস্তব্ধ, সুনসান।

    কখনও গরমের দিনের বিকেলের পড়ন্ত রোদ্দুরে চিত্রল হরিণদেরও সেই পথ পেরোতে দেখা যেত, লাফাঝাঁপি করে আমলকী বনে, আমলকী খাওয়ার পর।

    এক দারুণ শীতের সকালে ওই গভীর জঙ্গলাবৃত উপত্যকাতেই দেখেছিলাম প্রথমবার ল্যাংড়া পাহানকে।

    পাহান শব্দটির মানে কী ঋজুদা?

    তিতির শুধোল।

    ‘পাহান’শব্দটার মানে হচ্ছে পুরোহিত, ওঁরাও ভাষাতে। প্রতি গ্রামেই একজন করে পুরোহিত থাকে। তাকে মান্যও করে সকলে। বাঘের মতো বাঘ ছিল সে। মান্য করারই মতো। তাই সাতগাঁয়ের মানুষে ভালবেসে তার নাম রেখেছিল ল্যাংড়া পাহান।

    জঙ্গলের মধ্যে সেই জায়গাটিতে গত শীতে ক্লিয়ার-ফেলিং হওয়াতে কয়েকশো বর্গগজ মতন এলাকাতে একটিও গাছ ছিল না। সেই পুরো এলাকাটিই ঘনঘোর বর্ষার জল পেয়ে ঝকঝকে-জেল্লা-দেওয়া কচি-কলাপাতা-রঙা সবুজ ঘাসে ভরা ছিল। ল্যাংড়া পাহান ধীরে-সুস্থে সেই ঘাসে-ভরা সবুজ প্রান্তরটি পেরোচ্ছিল। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ে, এদিক-ওদিক দেখছিল মাথা ঘুরিয়ে। তখনও তার গায়ে রাতের শিশির লেগে ছিল। প্রথম সকালের সোনারঙা রোদ তার গায়ে পড়ে, তাকে সত্যিই দেখাচ্ছিল রাজারই মতো। রাজা তো নয়! পুরোহিত-রাজা।

    কে ওর নাম দিয়েছিল জানি না। তবে পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা মার্কিগঞ্জে তো বটেই তার চারদিকের পুরো এলাকার সব বস্তির মানুষেরাই ল্যাংড়া পাহান বললেই এক ডাকেই তাকে চিনত। ছেলে বুড়ো-মেয়ে সকলেই। চেনবার কারণও ছিল।

    যদিও সেই সময়ে আমাদের বনে-জঙ্গলে বড় বাঘের অভাব ছিল না কিন্তু অত বড় বাঘ সে সময়ে এ-অঞ্চলে আর দ্বিতীয় ছিল না। অনেক দূর থেকে এবং অনেক উঁচু থেকে তাকে দেখেছিলাম, তাই বহুদিন ধরে তার পুত্থানুপুঙ্খ বর্ণনা শুনে আসা সত্ত্বেও সে যে ল্যাংড়া পাহানই সে সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত হতে পারিনি। কিন্তু বাংলোতে ফিরে মালীর কাছে তার নিখুঁত বর্ণনা দিতে সে সঙ্গে-সঙ্গেই বলেছিল যে, ও বাঘ ল্যাংড়া পাহান না হয়েই যায় না।

    ওর জন্ম হয়েছিল নাকি সেই জঙ্গলের গহনের বনদেওতার ভাঙা দেউলে। ও যখন ছোট ছিল, তখন সামনের বাঁ পায়ে কোনও চোট পেয়ে থাকবে। কী করে পেয়েছিল তা জানা নেই। কিন্তু ও খুঁড়িয়ে হাঁটত। তাই ওঁরাও শিকারিরা আদর করে ওর নাম দিয়েছিল ল্যাংড়া পাহান। ল্যাংড়া পাহান কখনও কারও ক্ষতি করেনি! সিজুয়াবাগ থেকে মার্কিগঞ্জ এবং ঢামনা থেকে ফিলফিলা অবধি ছড়ানো গভীর জঙ্গলের মধ্যে-মধ্যে যেসব গ্রাম ছিল, সেসব গ্রামের একটি থেকেও কখনও সে বর্ষাকালেও গোরু-মোষ নেয়নি। এমন কী, বাঘেদের ঘুঘনি বা চাট যে দিশি ঘোড়া, যা ওরা বড় ভালবেসে খায়, সেই ঘোড়াও ধরেনি একটাও। যদিও গগর, ফুলাটোলি এবং বতরু গ্রামের মুসলমান চাষিদের অনেকেরই টাটু ঘোড়া ছিল। কোনও মানুষেরও ক্ষতি করেনি কখনও সে। তাই পথ চলতে বা কাঠ কাটতে গিয়ে বা হাটবারে হাট সেরে রাত করে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নিজের নিজের দূর গ্রামে ফিরে যাবার সময়ে তার সঙ্গে হঠাৎ কখনও কারও নির্জনে দেখা হয়ে গেলে, এ তল্লাটের সব মানুষই সহর্ষে ‘ল্যাংড়া পাহান’! ল্যাংড়া পাহান’!বলে। চেঁচিয়ে উঠত অনেকটা, আদর করেই। যেমন করে পোষা অ্যালসেশিয়ান বা গ্রেট ডেন কুকুরকে মানুষে ডাকে।

    ল্যাংড়া পাহানের চোখে এবং নখেও কোনও পাপ ছিল না।

    .

    ০২.

    সেই প্রথম দেখার প্রায় বছর পনেরো পরের ঘটনা।

    এখন আর আগের সেই জঙ্গল নেই, আবহাওয়া নেই, পুরনো লোকজনও নেই। পুরো জায়গাটাই দ্রুত বদলে গেছে, বদলে যাচ্ছে। শুনতে পাচ্ছি, কাঁচা রাস্তাটাও নাকি পাকা হয়ে যাবে। তবে একথা শুনে আসছি প্রায় গত দশ বছর হল। আসলে কবে হবে, তা ঈশ্বরই জানেন। জঙ্গলের জাদু সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন কিছু নতুন বড়লোক আর আপস্টার্টদের ভিড়ও ক্রমশই বাড়ছে। এত জায়গা থাকতে তারা মরতে এমন জঙ্গলের জায়গায় বাড়ি করে কেন, ভেবে পেতাম না। করে হয়তো, রাঁচী শহরের থেকে বেশি দূরে নয় বলেই। জমি-বাড়ির মতো ইনভেস্টমেন্ট তো হয় না। অনেকে থাকেও না। অনেকেই জায়গা নিয়ে নতুন বাড়ি করেও সে বাড়ি ফেলে রাখছে। তাতে অবশ্য আমি অসুখী হইনি। মানুষ যতদিন কম আসবে, থাকবে, পরিবেশ অমলিনই থাকবে। ট্রানজিস্টর, টিভি বাজবে না।

    মাঝে, বহুবছর বাইরে বাইরেই ছিলাম।

    এটুকু বলে ঋজুদা থামল। পাইপটা নিভে গেছিল। ধরিয়ে নিল। তারপর বলল, স্টেটস-এ, কানাডাতে, স্পেইন-এ। ভারতে পৌঁছেই সময় করে এসেছি মার্কিগঞ্জে অনেক নেমন্তন্ন ও মিটিং-টিটিং ক্যানসেল করে।

    এক শেষ বিকেলে, বাংলোর বাইরে বসে আছি, পেয়ারাগাছগুলোর তলায়। মালী বউকে দিয়ে খুব ভাল করে গোবর-নিকিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করানো হয়েছে, যাতে সাপ-খোপ না আসে। একটু পরেই সন্ধে হয়ে যাবে। বাংলোর কম্পাউন্ডের পাশের নালা থেকে তিতির ডাকছে ঘন ঘন। চিহা-চিহা-চিহা করে।

    এমন সময়ে ডগলাস এসে হাজির।

    গুড ইভনিং মিস্টার বোস। বলে, সে আমাকে উইশ করে নিজেই বেতের চেয়ার টেনে বসল।

    গুড ইভনিং।

    বিরক্ত গলায় বললাম, আমি।

    এই ডগলাস লোকটাকে আমি পছন্দ করতাম না। ভীষণ পরনিন্দা-পরচর্চা করে। আর সব বাড়ি-বাড়ি ঘুরে সকলের হাঁড়ির খবর নিয়ে বেড়ানোই ওর কাজ ছিল। বউ মরে গেছে অনেকদিন আগে। কিছু করারও ছিল না। যখন বউ ছিল, তার সঙ্গে ঝগড়া করে অনেকটা সময়ই কেটে যেত ওর। ডগলাস প্রায়ই বলত, বউ মরে যাওয়াতে বুঝি, ঝগড়া করার আর দ্বিতীয় কোনও লোক নেই। পরের সঙ্গে ঝগড়া করে সুখ নেই একেবারেই।

    ডগলাস বলল, এক কাপ কফি হবে?

    কফি আনতে বললাম মালীর বউকে।

    ও না চাইলে খাওয়াতাম না। কফি খাওয়া মানেই আরও কিছুক্ষণ বসে থাকা।

    ডগলাস বলল, মিঃ বোস, তোমার বন্দুক কোথায়?

    কেন? বন্দুক-রাইফেল সবই গান-স্ট্যান্ডেই আছে। যেখানে থাকার। সবসময়েই কি বন্দুক-রাইফেল কাঁধে করে বসে থাকব নাকি? আমি তো ব্যাঙ্কের দ্বারী নই!

    তারপর বললাম, কী ব্যাপার বলো তো? হঠাৎ এই প্রশ্ন?

    সে কী! তোমাকে কেউই বলেনি এখনও? মালীও না?

    আমি একটু অবাক হয়ে বললাম। নাঃ। কী বলবে? তা ছাড়া আমি তো মাত্র কয়েকদিন হল এসেছি।

    মালীর বউও বলেনি?

    না। বলেনি। কী? তা বলবে তো?

    আমাদের গুড ওল্ড ল্যাংড়া পাহান ম্যান ইটার হয়ে গেছে। গত ছ’ মাসে দশজন মানুষ ধরেছে। তোমার এমন করে খালি হাতে বাইরে বসে থাকা ঠিক নয়। অন্ধকারও তো হয়ে এল।

    আমি অবাক হলাম। বললাম, বলো কী? পেট্রোম্যাক্স-আলো জ্বলছে বাড়ি বাড়ি। প্রত্যেকের বাবুর্চিখানাতে রান্না হচ্ছে। এর মধ্যে বাড়িতে আসবে বাঘ? টাইগার? মার্কিগঞ্জের সব বাড়ি কি সুন্দরবনের জেলে-মউলে-বাউলেদের নৌকো হয়ে গেল নাকি?

    ডগলাস আমার কথার উত্তর না দিয়ে ওর খাঁকি ট্রাউজার্সের পকেট থেকে টর্চটা বের করে জ্বেলে বারকয়েক চারপাশে ঘুরিয়ে দিল। অন্ধকার হয়ে গেছে ততক্ষণে।

    তারপর একটু চুপ করে থেকে ওর বুক পকেট থেকে আধখানা-খাওয়া সিগারেটটি বার করে, ইঙ্গিতে আমার সামনের গোল বেতের টেবলের উপরে রাখা লাইটারটি চাইল।

    লাইটারটি এগিয়ে দিতেই আগুন জ্বেলে সিগারেটটি ধরিয়ে এক রাশ ধুয়ো ছেড়ে বলল, তুমি যা ভাবছ, তা নয়। ল্যাংড়া পাহান মার্কিগঞ্জের বাংলো থেকেও মানুষ নিয়েছে।

    কাকে?

    হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

    মিসেস ভাওয়ালের মালীর ছেলেকে। এবং মিস্টার জনসনকেও।

    কোন জনসন? রোনাল্ড জনসন?

    ইয়েস স্যার! তবে আর বলছি কী! চলো, আমরা ভেতরে গিয়ে বসি।

    এতই যদি ভয়, তা হলে খালি হাতে অন্ধকারে তুমি এতটা হেঁটে এলে কী করে তোমার বাংলো থেকে?

    বিরক্ত হয়ে বললাম, আমি।

    ডগলাস হাসল। অন্ধকারেও সোনা দিয়ে বাঁধানো দাঁতদুটো ঝিলিক মেরে উঠল।

    বলল, লুক! মিস্টার ঋজু বোস। আমার কথা আলাদা। আমি তো মরতেই চাই। জেনিফারই চলে গেল আমাকে ফেলে, আমার জীবনে বাকি আর কী আছে। আমি মরতে চাই বলেই অন্ধকারে একা-একা ঘুরে বেড়াই। আত্মহত্যা করলে মানুষে কাপুরুষ বলবে। কিন্তু বাঘে খেলে তো আর বলবে না। জঙ্গলে যাই। রাতের বেলাও। কিন্তু পাহান তো আমাকে নেবে না। যে যা চায়! বুঝলে মিস্টার বোস, সে, তা ছাড়া, আর সবই পায়। গড ইজ ভেরি মীন। ইয়েস! দ্যাট জেন্টলম্যান ইজ ভেরি মীন ইনডিড!

    তুমি এক সেকেন্ড বোসো, আমি রাইফেলটা নিয়েই আসি।

    আমি বললাম, ডগলাসকে। বসব বাইরেই। হাতের কাছে রাইফেল থাকতেও আমাদের তুলে নিয়ে যাবে এমন মানুষখেকো বাঘ এখনও ভারতে জন্মায়নি।

    ভিতরে গিয়ে প্রথমেই বাবুর্চিখানার দিকে এগোলাম। বাবুর্চিখানাটা খাওয়ার ঘরের সঙ্গে একটি ঢাকা প্যাসেজ দিয়ে জোড়া। বাবুর্চিখানাতে গিয়ে দেখি, ভিতর থেকে দরজাটা বন্ধ। মালী আর তার বউ ঘরের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলছে। প্রেসার কুকারে মুরগি সেদ্ধ হচ্ছে। তার সি-সিঁ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। দরজায় টোকা মারতেও ওরা দরজা খুলল না। তারপর ডাকতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে দরজা খুলল।

    শুধোলাম, বাঘোয়া হিয়েপর? আদমি…?

    হাঁ মালিক। বড়া তংক করলথু। বড়কা বাঘোয়া।

    মালী বলল।

    মালীর বউ যোগ করল, ল্যাংড়া পাহান।

    আমাকে বলোনি কেন?

    না মালিক। ভয়ে বলিনি। যদি আপনি ল্যাংড়া পাহানকে মারতে যান।

    তার মানে? তাতে ভয়ের কী? আমি কি বাঘ কখনও দেখিনি? না মারিনি?

    না সাহাব। বনদেওতা কা দোয়া হ্যায় উসকো পর, গোলিসে কুছ ভি নেহি কিয়া যায়গা। এ পর্যন্ত তিনজন শিকারি মারতে গিয়েছিল। তিনজনকেই ল্যাংড়া পাহান মেরেছে। একজনকে খেয়েও নিয়েছে। সেই শিকারি রাতে একা বসে ছিল মাচাতে, পাহানকে মারবে বলে। আর মারল পাহানই তাকে। ও, সেই লাশ যদি দেখতেন মালিক!

    বললাম, ডগলাস সাহেবের জন্যে কফির জল চড়াও। আমিও খাব এক কাপ। তবে, ব্ল্যাক।

    সে বলল, নিয়ে যাচ্ছি কফি হয়ে গেলেই। তারপর বলল, যেমন উনি ভালবাসেন, কফির সঙ্গে ওমলেটও করব কি?

    করো।

    আমি বললাম।

    তারপর বললাম, তোমরা আমাকে ল্যাংড়া পাহানের কথা বলেনি কেন?

    ভয়ে।

    ভয়ে! কীসের ভয়ে?

    আপনার ভয়ে।

    মানে?

    ওই বাঘ কেউই মারতে পারবে না। ও বন-দেওতার বাঘ। মধ্যে দিয়ে আপনারই প্রাণ যাবে। আপনার প্রাণ গেলে আমাদের কী হবে সাহেব?

    যত্তসব বাজে কথা।

    ধমকে বললাম আমি।

    ওমলেটও ভেজে নিয়ে যাচ্ছি।

    মালী বউ বলল।

    তা হলে দরজাতে খিল লাগিয়েই থাকবে। আর আরও একটা পেট্রোম্যাক্স ধরিয়ে পেছনের বারান্দাতে রাখো।

    বলে, থ্রি-সেভেন্টি-ফাইভ ম্যাগনাম রাইফেলটা এবং দু-রাউন্ড গুলি নিয়ে বাইরে গেলাম। পাঁচ ব্যাটারির টর্চটাও নিয়ে গেলাম। যদিও আমার বাংলোর চারপাশে বড় গাছ নেই, বড়গাছ সব কম্পাউন্ড-এর সীমানার কাছাকাছি। তবু একটা পাহাড়ি নালা আছে বাংলোর কম্পাউন্ডের চারধার দিয়ে। যে-কোনও জানোয়ারের পক্ষেই নালার ভিতরে এবং কম্পাউন্ডের সীমানার বড় বড় হরজাই গাছেদের ছায়াতে লুকিয়ে থাকা খুবই সহজ। গত বছরই মালীর কুকুরটাকে নিয়ে গিয়েছিল একটা চিতা, সন্ধে লাগার সঙ্গে-সঙ্গেই। ওই নালাতেই লুকিয়ে ছিল সেটা।

    বাইরে এসেই, চমকে উঠলাম। ডগলাস নেই চেয়ারে। টর্চটা চারধারে ঘুরিয়ে ডাকলাম, ডগলাস, ডগলাস, হোয়ার আর উ্য?

    সাড়া নেই। টর্চটা এবার উলটো দিকে ফেললাম।

    দেখলাম প্যান্টের বোতাম আটকাতে-আটকাতে ডগলাস অন্ধকার কুঁড়ে আমার দিকে আসতে-আসতে বলল, সুইচ ইট অফফ মিস্টার বোস। মাই মেডালস আর শোয়িং।

    এর উত্তরে আর কী বলা যায়। জঙ্গলের জায়গাতে ছোট বাইরে করতে পুরুষেরা বাথরুমে যানই না। রাতে তো নয়ই।

    রাইফেলটাকে কোলের উপর আড়াআড়ি করে রেখে, গুলি দুটি টেবলের উপরেই রাখলাম। মার্কিগঞ্জে নিজের বন-বাংলোতে সন্ধেবেলা গুলি-ভরা রাইফেল হাতে বসে থাকতে হবে এমন ভাবনাও নিজেকে বে-ইজ্জৎ করল।

    ডগলাস কাছে এসে চেয়ারে বসলে, বললাম, তোমার কথা সব দেখছি সত্যিই! মালী তো তাই বলল। তুমি কিন্তু এমন কোরো না। প্রিকশান নিয়ো।

    ডগলাস ইংরিজিতে যা বলল, তার সারাংশ করলে দাঁড়ায়: ও যমেরও অরুচি। তাই যমের নৈবেদ্য হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই দারিদ্র্য, আর একাকিত্বর জীবন ও আর বইতে পারছে না। তবু যম তাকে দয়া করছে কোথায়?

    রাতে তুমি যেয়ো না। আমার এখানেই থেকে যাও। আমি বললাম।

    মাথা খারাপ! জেনিফার বুঝি রাগ করবে না? আমি সময়ে না ফিরলে! ও খুব চিন্তা করে আমি সময়মতো না ফিরলে। ওর খাটটা, ওর চেয়ারটা সব আমাদের বেডরুমে যেমন থাকার তেমনই আছে। ওই চেয়ারে বসেই ও উল বুনত, লেস বুনত, বাইবেল পড়ত। আর ওই খাটেই ও শুত। ও চলে গেছে বটে, কিন্তু ও আমার কাছে কাছেই থাকে সবসময়।

    তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, আচ্ছা, মিস্টার বোস, মানুষ মরে কোথায় যায় বলতে পারো?

    জানি না। ভাবিনি, তেমন করে কখনও। নিজে মরলে বলতে পারব।

    আমি কিন্তু সবসময়ই ভাবি। তুমিও একটু ভেবো। জেনির সঙ্গে আমার কি দেখা হবে? আমি যদি তাড়াতাড়ি যাই?

    মালীর বউ, কফি, আর ওমলেট নিয়ে এল।

    বললাম, ডগলাস, আজ আমার সঙ্গে ডিনার খেয়ে এখানে থেকেই যাও রাতটা।

    ডগলাস কথা বলার সময়ে বাঁ হাতটাকে হাতপাখার মতো নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলত সবসময়। হাত নাড়িয়ে বলল, আউট অফ দ্যা কোয়েশ্চেন।

    তা হলে, তুমি আমার একটা বন্দুক নিয়ে যাও সঙ্গে। গুলি ভরে দিচ্ছি।

    আই ডোন্ট নিড ওয়ান। আমি তো মরতেই চাই। ল্যাংড়া পাহানের হাতে মরলে, ডেথ উইল বি অ্যাজ শিওর অ্যাজ ডেথ অ্যালোন কুড বি। পাহান আমাদের ওল্ড চ্যাপ। নোন চ্যাপ। নাইস-গাঈ।

    তারপর বলল, আ গান টু অ্যাভয়েড ডেথ?

    তারপরই বলল, ওর কি দয়া হবে? আমার উপরে?

    এই কথা বলে ও অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। আমিও চুপ করে রইলাম। অনেকক্ষণই।

    অনেক বছর পরেই এসেছি আমার এই বড় প্রিয় জায়গায়। মাঝে চার বছর। বাইরে বাইরেই ছিলাম। দেশে ফিরেছি মাত্র দেড় মাস হল। সপ্তাহখানেক হল এসেছি মার্কিগঞ্জে। স্বদেশের সঙ্গে কোন দেশের তুলনা?

    ভাবছিলাম, ডগলাসের বোধহয় একটু মাথার গোলমাল হয়েছে। পরে মিঃ হল্যান্ডকে জিজ্ঞেস করতে হবে। মিঃ সেটনই ডগলাসের বাড়ির সবচেয়ে কাছে থাকেন যদিও।

    ওর ওমলেট আর কফি খাওয়া হয়ে গেলে বললাম, তোমাকে আমি এভাবে ছেড়ে দিতে পারি না। চলো, তোমার বাংলো অবধি পৌঁছে দিয়ে আসি।

    ডগলাস হেসে উঠল।

    বলল, ইটস ভেরি সুইট অব ইউ ইনডিড টু হ্যাভ সেইড দ্যাট। জোকস এপার্ট, আই রিয়্যালি ওয়ান্ট টু ডাই! আমি সত্যিই মরতে চাই। মিস্টার বোস।

    মরতে চাও, সে খুউব ভাল কথা। কিন্তু আমি তোমার খুনের দায়ে পড়তে রাজি নই। তোমার বাড়ির পথ গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গেছে প্রায় দু-ফার্লং। যেখানে ম্যানইটার বাঘ অপারেট করছে, সেখানে অমন পথে কেউ রাতে যায়?

    ডগলাস বেগতিক দেখে একটু ভেবে বলল, চলো, তা হলে। তুমি যখন মরতে দেবেই না।

    উঠলাম আমরা। মালীকে ডেকে সাবধানে থাকতে বললাম বাবুর্চিখানার দরজা বন্ধ করে। আমি না-ফেরা অবধি।

    আমার বাংলোর কম্পাউন্ড প্রায় কুড়ি বিঘার। নানা জংলি গাছও আছে। তবে এখন এপ্রিলের শেষ, গাছগুলোর পাতা প্রায় সবই ঝরে গেছে। তবে আমাদের বনে প্রায় সব গাছই পর্ণমোচী যদিও, সব গাছেরই পাতা যে একই সময়ে ঝরে, তা কিন্তু নয়। কিছুর পাতা ঝরে শীতে, কিছুর বসন্ত-শেষে, কিছুর আবার শরতে। প্রকৃতির এমন নিতুই-নব-লীলা পৃথিবীর আর কোথায় আছে?

    নীচেও আর আগাছা নেই এখন। অনেক দূর অবধি পরিষ্কার দেখা যায়। কোনও জানোয়ার, বিশেষ করে বাঘের মতো বড় জানোয়ার এমন ফাঁকা জায়গাতে এলে, যার কিছুমাত্র শিকারের অভিজ্ঞতা আছে, তার চোখ বা কান এড়িয়ে আসতে পারবে না। পারবে না বলব না। বাঘের মতন এমন ক্যামোফ্ল্যাজ করার ক্ষমতা পৃথিবীর খুব কম প্রাণীরই আছে। এমন নিঃশব্দে চলাফেরাও আর কোনও জানেনায়ারই করতে পারে না। তবু যদি পারে, তবে তারও মুশকিল হবে। বাঘও শিকারি কিন্তু শিকারিও তো শিকারি। বাঘের কিছু গুণ তো তাদেরও আছে!

    সেদিন বোধহয় শুক্লপক্ষের অষ্টমী কি নবমী হবে। ক্রমশই চাঁদটা জোর হচ্ছে। মার্চের শেষে দোল গেছে। এপ্রিলের পূর্ণিমাও বনে-জঙ্গলে এবং আমার এই মার্ফিগঞ্জে বড় চমৎকার। নেশা লাগে দমক-দমক হাওয়ায় মহুয়া আর করৌঞ্জের। আর বাংলোগুলির হাতার মধ্যে মধ্যে লাগানো আম কাঁঠালের মঞ্জরী আর মুচির গন্ধে।

    চলতে চলতে ডগলাস বলল, আমি তো চাকরির কারণে মধ্যপ্রদেশে ছিলাম এত বছর। গভীর জঙ্গলে। যত ম্যানইটারের কথা শুনেছি সেখানে, লেপার্ডের কথা বলছি না, টাইগার, তারা তো দিনের বেলাই মানুষ ধরত। রাতে ধরতে তো বিশেষ শুনিনি।

    ল্যাংড়া পাহান তো তার ছেলেবেলা থেকেই এই বস্তিগুলোর আর মার্কিগঞ্জের চারপাশের জঙ্গলেই বড় হয়ে উঠেছে। এই অঞ্চলের লোকজনকে এবং তাদের অভ্যাস-অনভ্যাস ল্যাংড়া পাহানের লেপার্ডদের মতোই ভাল করে জানা হয়ে গেছে। মানুষের ভয়-ডরও আর ওর নেই। সে কারণেই বোধহয়…।

    আমি একটু চুপ করে থেকে বললাম, ইটস আ গেসস ডগলাস। তুমি যা বলেছ, তাই ঠিক। বড় বাঘ মানুষখেকো হলে দিনেই মানুষ ধরে সাধারণত। রাতে যে একেবারেই ধরে না, তা যদিও নয়।

    ছোট, জরাজীর্ণ ওর দু’কামরার বাংলোতে পৌঁছে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাকে গুডনাইট করল ডগলাস। আমিও গুডনাইট করে ফিরলাম।

    কিছুটা আসার পরই সেই জঙ্গলে এসে পড়লাম। জঙ্গলটার মধ্যে দিয়ে সাবধানে ফিরছিলাম। হঠাৎ হিস্ শব্দ শুনে চমকে উঠে টর্চ ফেললাম। মস্ত একটা অশ্বত্থ গাছ এখানটাতে। কখনওই এর পুরো টাক পড়ে না মাথায়। পিছনে একটা নালা থাকায় অনেক পাতাই সবুজ থাকে। আশ্চর্য। তার ঠিক গুঁড়ির কাছেই একজোড়া বিরাট শঙ্খচূড় সাপ প্রায় এক মানুষ উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাটি থেকে। ফণায়ফণায় জড়াজড়ি করে। শঙ্খ লেগেছে।

    কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ওরা নিজে থেকেই সরে গেল। আমি আবার আমার পথে এগোলাম। জংলি লোকেরা বলে, এমন ভাবে সাপকে দেখলে নাকি মানুষ রাজা হয়।

    আমিও হব হয়তো কোনওদিন, কে বলতে পারে?

    চলতে-চলতে ভাবছিলাম, ডগলাস এরকম নির্জন জায়গাতে একেবারেই একা থাকে। ওর নিয়ারেস্ট নেবার সেটন। কিন্তু মার্কিগঞ্জের প্রত্যেক বাংলোর সঙ্গেই দশ পনেরো কুড়ি তিরিশ বিঘা করে জঙ্গল থাকে। তা পরিষ্কার করে চাষাবাদও করেন খুবই স্বল্প মানুষে। তা ছাড়া জঙ্গল আছে বলেই না এত জায়গা থাকতে আমি এখানের এই বাংলো কিনেছিলাম। যে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ভদ্রলোকের ছিল বাংলোটি, তিনি অস্ট্রেলিয়াতে চলে যাচ্ছিলেন এটি বিক্রি করে দিয়ে। এ অঞ্চলের অধিকাংশ বাংলোই এক সময়ে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদেরই ছিল।

    প্রত্যেক বাংলোর সঙ্গেই বিরাট জঙ্গল থাকে বলেই পাশের বাংলোতে যেতে হলেও অনেকখানি পথ হেঁটে যেতে হয়।

    তা ছাড়া, পথ তো জঙ্গলের আর পাহাড়ের মধ্যে দিয়েই।

    ডগলাসের বাড়িতে এখন আর কোনও চাকর-বাকর, মালীও নেই। ওদের একটিই মাত্র মেয়ে। সে একটি বিহারী আই. পি. এস. ছেলেকে বিয়ে করে, জব্বলপুরে। তার স্বামী পুলিশের ডিআইজি, বিহার ক্যাডারের। মেয়েও টাকা পয়সা পাঠায় না কিছু। বছরে একটি চিঠি লিখেও খোঁজ নেয় না। জেনিফারের মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গে তার পেনশানও বন্ধ হয়ে গেছে। ডগলাস যা পেনশান পায়, তাতে কুকুরেরই চলে না, তায় মানুষের! একা থাকে বলেই ওর জন্যে আমার চিন্তা হতে লাগল। এমন নির্জনে যখন-তখন যা-তা ঘটতে পারে, যদি ল্যাংড়া পাহান সত্যি সত্যিই মানুষখেকো হয়ে গিয়ে থাকে। কে জানে! কেন ও ম্যানইটার হল?

    চারদিকের জঙ্গল কাটা হচ্ছে। শুয়োরের মতন, গিনিপিগের মতন বাড়ছে। মানুষ। পৃথিবীর সব গাছ, সব মাঠ, সব ফুল, সব পাখি ধ্বংস না করা অবধি এই খাই-খাই করা দুপেয়ে জন্তুরা থামবে না!

    .

    পরদিন সকালেই ব্রেকফাস্টের পরে রেঞ্জারের অফিসে গিয়ে পাহান কোথায় কোথায়, কবে কবে মানুষ নিয়েছে, তার সঠিক একটা বিবরণ বিস্তারিত লিখে নিলাম। একটা ম্যাপও এঁকে ফেললাম।

    আমি আসার একদিন আগেই, তেরো বছরের একটি মেয়েকে নিয়েছে ফুলফুলিয়া গ্রাম থেকে। মেয়েটির মা অজ্ঞান হয়ে রয়েছে এখনও মেয়ের শোকে।

    রেঞ্জার সাহেব বললেন, আমাকে নাকি কলকাতায় চিঠিও পাঠিয়ে ছিলেন। কনজারভেটর সাহেবকেও উনি গতকালই খবর পাঠিয়েছেন। জানিয়েছেন আমার আসার কথা। আমি এসে পড়ায়, অন্য কোনও শিকারিকে ওই বাঘ মারার পারমিট ওঁরা আপাতত দেবেন না।

    বললেন যে, চিপাদুরার ঠিকাদার সর্দারজি গুরনাম সিংকে দিনদশেক আগে পারমিট দিয়েছিলেন। কিন্তু সর্দারজির এ বাঘ মারাতে বিশেষ উৎসাহ নেই। সে হরিণ-শম্বরের চোরাশিকারি।

    যে-তিনজন শিকারিকে ল্যাংড়া পাহান এ-পর্যন্ত মেরেছে, তাদের মধ্যে একজন চিপাদুরার, একজন সদরের আর অন্যজন এখানেরই।

    রেঞ্জারসাহেবকে আমি শুধোলাম, কেউ কি এ পর্যন্ত বিট করিয়েছিল বাঘকে বের করার জন্যে?

    রেঞ্জারসাহেব হাসলেন।

    বললেন, ম্যানইটার বাঘ বা লেপার্ডকে বিট করতে তো রাজি হয় না গ্রামের লোক। তা ছাড়া, এ বাঘ, এদের সকলেরই ধারণা, এক বিশেষ বাঘ। যারাই তাকে ইদানীং দেখেছে, তাকে শিকার করতে গেছে সকলেই এ কথা বলে। আপনিও বিশেষ সাবধান হবেন বোসোহেব। বহতই খতরনাগ হ্যায় ঈ বাঘোয়া। মামুলি বাঘোয়া মত শোচিয়ে ইসকো!

    পরদিন সকালে পেয়ারাতলিতে বসে চা খেয়ে সবে জমিয়ে পাইপটা ধরিয়েছি, ঠিক এমন সময় প্রচণ্ড গতিতে সাইকেল চালিয়ে খাকি পোশাকের একজন ফরেস্ট-গার্ড গেট দিয়ে ঢুকল, চাকায় লাল ধুলো উড়িয়ে, লাল কাঁকুড়ে-মাটিতে কিরকির আওয়াজ তুলে।

    এতই আচম্বিতে খোলা-গেট দিয়ে ঢুকে পড়েছিল সে কারও অনুমতি না নিয়ে এবং এত জোরে সাইকেল চালাচ্ছিল লোকটা যে, তার বদতমিজীতে চটে গিয়ে মালীর কালো কুকুর কালু তাকে ধাওয়া করে সাইকেলের পেছন পেছন আসতে লাগল তারস্বরে চেঁচাতে-চেঁচাতে।

    গার্ড সাইকেল থেকে নেমেই সেলাম করল। একটা চিঠি দিল। রেঞ্জারের চিঠি।

    তাড়াতাড়ি খুলে দেখি, লিখেছেন, কাল ভোরে একটা নতুন কিল হয়েছে। মার্কিজ নোজ-এর কাছে। কাল খুব দেরিতে জানতে পারায় গার্ড রেঞ্জ অফিসে এসে জানাতে পারেনি, রাতে জানিয়ে লাভও ছিল না। তার আসার সাহসও ছিল না। এই গার্ড কিল কোথায় আছে, তার আন্দাজ জানে। যা ভাল মনে করার করবেন। চিঠি পাওয়া মাত্র রওনা হতে পারেন। কিন্তু আবারও বলছি, খুব সাবধান। এ বনদেওতার বাঘ।

    তক্ষুনি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে, মালী আর তার বউকে আমাদের দু’জনের জন্যে খুব তাড়াতাড়ি নাস্তা তৈরি করতে বলে, চান করতে চলে গেলাম। হাতে অনেকই সময় আছে।

    গার্ডের নাম যুগলপ্রদ। জাতে সে কাহার। নাস্তা করতে করতে ও ল্যাংড়া পাহানের কীর্তিকলাপ সম্বন্ধে আমাকে অনেক কিছুই বলল। বলল, কীভাবে মানুষ নিচ্ছে, কী করে আমাদের নির্বিরোধী ভালমানুষ প্রতিবেশী ল্যাংড়া পাহান মানুষখেকো হল মানুষেরই দোষে, সেই সব গল্প।

    যুগলপ্রসাদ এবং রেঞ্জারসাহেবেরও দৃঢ় ধারণা যে, বছরখানেক আগে রাঁচী থেকে যে একদল শিকারি জিপে করে রাতে ফরেস্ট-গেট ভেঙে এসেছিল স্পট লাইট নিয়ে, চুরি করে শিকার করতে, তাদেরই এলোপাথাড়ি চালানো গুলিতে পাহান আহত হয়ে থাকবে।

    এরা আসলে সব হরিণ-মারা, খরগোশ-মারা শিকারি। বাঘের মোকাবিলা করার সাহস বা ইচ্ছা এদের কোনওকালেই ছিল না। ল্যাংড়া পাহান’ তাদের সামনে পড়ে যাওয়াতে  বাঘ-শিকারি হওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে, জিপ এর উপরেই দাঁড়িয়ে শটগান-এর এল-জি দিয়ে দু-তিনজন একসঙ্গে গুলি করে। ল্যাংড়া পাহানের নাকি দাঁত ভেঙে যায় তাতে। এবং সামনের ডানদিকের পাটাও চোট পায়। বেচারার আর দোষ কী? স্বাভাবিক জীবন যদি যাপন করতে পারত তবে সে কেন মানুষ মারতে যাবে?

    যুগলপ্রসাদ উষ্মার সঙ্গে বলল, প্রথমে ওইসব শিকারিদেরই গুলি করে মারা উচিত সাহেব আপনার। তার পরেই না হয় আমাদের বচপনকা সাথী ল্যাংড়া পাহানকে মারার তোড়জোর করবেন।

    আমি বললাম, বলেছ তুমি ঠিকই।

    রওনা হওয়া গেল। আমি যুগলপ্রসাদের সাইকেলের কেরিয়ারে বসলাম। রাইফেল কাঁধে ঝুলিয়ে। বন্দুকটার ব্যারেল আর স্টক ‘Lamb’s Leg’-এ পুরে ওকে দিলাম। আলাদা করে ঝুলিয়ে নিল যুগলপ্রসাদ, সাইকেলের হ্যান্ডলে। অন্য জিনিসপত্রও ওইভাবেই নিল।

    মাইল-দুয়েক ঢামনার দিকে গিয়ে বড় কাঁচা রাস্তা ছেড়ে, একটা সরু পায়ে-চলা ফরেস্ট রোডে ঢুকে পড়ল যুগলপ্রসাদ। বলল, মাফিজ নোজ-এ যাবার এটাই সবচেয়ে শর্টকাট রাস্তা।

    যাকে মেরেছে, সে ছেলে না মেয়ে?

    আমি জিজ্ঞেস করলাম।

    হুজৌর! সকাল বেলা দূর থেকে দেখেছে হুডকু। দেখেছে, ল্যাংড়া পাহান তার বাবা লক্ষ্মণকে কিছুটা খেয়ে, তার লাশ টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

    হুডকু? হুকুটা আবার কে?

    আমি জিজ্ঞেস করলাম।

    লক্ষ্মণই বা কে?

    হুডকু হচ্ছে আমাদের লক্ষ্মণ সিং শিকারির ছেলে। ল্যাংড়া পাহানকে মারবার পারমিট লক্ষ্মণ সিংকে দেওয়া হয়নি। ওর গাদা-বন্দুক আছে একটা। লক্ষ্মণের জিগরী দোস্ত ঝাড়কে ল্যাংড়া পাহান মেরে খেয়ে ফেলার পরই ওই গাদা বন্দুক নিয়েই বাহাদুরি এবং বদলাও নেবার জন্যে তক্কে তক্কে ছিল লক্ষ্মণ। লক্ষ্মণের ওরকম মর্মান্তিক মৃত্যুর পর থেকেই হুকু ছেলেটা সারা দিন বাবার বন্দুকটা হাতে করে জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেরিয়েছে।

    হুকুর বয়স কত?

    কত আর হবে! তেরো-চোদ্দো।

    অতটুকু ছেলে! ও কী করছে জঙ্গলে? এই বাঘ মারবে ও?

    বন্দুকটার নল ওর প্রায় কাঁধ-সমান লম্বা। তাতে কী হয়? ছেলের উৎসাহ এবং সাহসের কমতি নেই। বাপকা বেটা সিপাহিকো ঘোড়া, কুছ নেহি তো থোড়া-হোড়া!

    তোমরা সব আশ্চর্য মানুষ তো! সদ্য বাবা-হারানো ছেলেটাকে একা ছেড়ে দিলে যমের মুখে!

    যমের মুখে কে আর শখ করে যেতে চায় হুজৌর।

    তারপর আমি জিজ্ঞেস করলাম, শিকার করতে জানে হুডকু?

    তা জানে। তবে, বড়জোর খরগোশ বা কোটরা মেরে থাকবে দু একটা। বাপই শিখিয়েছিল। একটা মাত্র ছেলে। মা কেঁদে-কেঁদে মরছে। কারও কোনও কথাই শোনেনি। ও-ও মরবে। ওয়াক্ত হয়েছে। ও একেবারে ভোরভোর দেখেছে ল্যাংড়া পাহান কী যেন হেঁচড়ে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে চলে যাচ্ছে, মার্কিকা নাককা তল্লেমে। কিন্তু কারোকে জানায়নি৷ রেঞ্জারসাহেবকে, মোষের গাড়ি আসছিল চারটে সিজুয়া বাগ থেকে, সেই গাড়োয়ানেরাই সন্ধের মুখে মার্কিগঞ্জে খবর দিয়েছে। মৃত্যুভয় বড় ভয় হুজোর।

    আরও মাইল-তিনেক গিয়ে যুগলপ্রসাদ বলল, এবার সাইকেল ছেড়ে আমাদের হেঁটে যেতে হবে হুজৌর।

    সাইকেলটা একটা বড় শিমুল গাছের গোড়ায় রেখে, আমার হ্যাঁভারস্যাক, জলের বোতল আর ল্যাম্বস-লেগটাকে কাঁধে নিয়ে এগোল যুগলপ্রসাদ, পিছন-পিছন আমি, রাইফেল-হাতে।

    অনেক অচেনা পথ, শুকিয়ে-যাওয়া পাহাড়ি ঝরনা দুটি ছোট পাহাড় টপকে আমরা একটি চওড়া নদীর শুকনো বুকে এসে পৌঁছলাম।

    নদীটিকে দেখেই চিনলাম। ঘুংঘটিয়া নদী। এ নদীটি এখন প্রায় শুকনো। মার্ফিগঞ্জের চারপাশ দিয়ে, মালার মতো গোল হয়ে ঘুরে গেছে। এবং মিশেছে গিয়ে সব-সময় জল-থাকা সিতাওন নদীতে।

    মনে পড়ল, এই ঘুংঘটিয়া নদীরই পুবদিকে নদীর পাশের গুহার কাছে। ভালুকের ছবি তুলতে গিয়েছিল একবার ডগলাস। তখন তার ফ্লানেলের প্যান্ট এবং পেছনের এক কেজি দু’শো গ্রাম মতো মাংস একটি পয়সাও না দিয়ে খুবলে নিয়েছিল অভদ্র কিন্তু রোগা-দুর্বল একটা ভালুক। সে অনেক বছর আগের কথা।

    সেই মাংস দিয়ে সেই ভালুক ভিডালু বানিয়েছিল, না কাবাব, তা অবশ্য জানা নেই।

    এই এলাকাতেই হুডকু নাকি ল্যাংড়া পাহানকে দেখেছে।

    বালিতে ভাল করে খুঁজতে লাগলাম আমরা বাঘের পায়ের দাগ।

    কাল মাঝরাতে এক চোট ঝড়-বৃষ্টি হয়ে গেছে। থাবার দাগ-টগ সব মুছে গেছে। ঝড়ে-ওড়া লাল-হলুদ-খয়েরি শুকনো পাতা আর কুটো ছড়িয়ে আছে বালির উপর। এখনও বেশ ঠাণ্ডাই আছে।

    একটা বনমোরগ ডেকে উঠল হঠাৎই আমাদের সামনে থেকে কক কক করে। ভয়-পাওয়া ডাক। এখানে বাঁদর বেশি নেই। ময়ুরও নেই। টিটি পাখির একটি ছোট্ট দল হঠাৎ ওদের ল্যাগব্যাগে পা-দুলিয়ে উড়ে গেল আমাদের থেকে একশো গজ দূরের একটি ঝোপ থেকে।

    বন্দুকে গুলি ভরে আমি জায়গাটার দিকে সোজাসুজি না গিয়ে একটু ঘোরা পথে এগোলাম।

    যুগলপ্রসাদকে ফিসফিস করে বললাম, নদীর পাড়ের একটা বড় পাথরের উপর বসে থাকতে। রাইফেলটা গুলি ভরে ওর হাতে দিলাম।

    ও বলল, একবার চালিয়েছিল ও, ওর বড় সম্বন্ধীর টোপিওয়ালাবন্দুক। জেঠ-শিকারের সময়।

    টোপিওয়ালা বন্দুক মানে, গাদা বন্দুক।

    বললাম, বড় সম্বন্ধীর টোপিওয়ালা বন্ধুক ছুঁড়েছ, বেশ করেছ। বাঘ একেবারে তোমার ঘাড়ে এসে না চড়লে, এই যন্ত্র গুলি করবে না। আর পেছন দিকে নজর রাখবে।

    যুগলপ্রসাদ বলল, কার পেছন দিকে?

    আঃ তোমার পেছন দিকে।

    ও বলল, জী হাঁ! অব সমঝা।

    তারপরই আমার কী মন হওয়াতে রাইফেলটা ‘সেফ’ করে ওকে দিয়ে বন্দুকটাই আমি নিলাম। কারণ শর্ট-রেঞ্জে বন্দুক রাইফেলের চেয়ে অনেকই বেশি কার্যকরী। তা ছাড়া, ধাক্কাটাও বেশি লাগে। যার গায়ে গুলি লাগে তার।

    ওকে সেই পাথরের উপরে চড়িয়ে দিয়ে খুব সাবধানে কিছুটা এগিয়েছি। কিল অথবা ড্রাগ-মার্ক কিছুরই হদিশ নেই। বাঘের পায়ের থাবার দাগেরও নয়।

    হঠাৎই একটা শিস শুনে চমকে উপরে তাকালাম। একটা শিশু গাছের উপরের ডাল থেকেই শিসটা এল। কিন্তু ঠিক কোথা থেকে এল তা অনুমান করার চেষ্টা করছি, এমন সময় হঠাৎ চোখে পড়ল ছেলেটাকে। ভেঁড়া, আধ-নোংরা ধুতি-পরা, খালি-গায়ের ছেলেটা আঙুল দিয়ে ওর সামনের, কিন্তু দুরের কোনও কিছুর প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ও বারে বারে আঙুল তুলছিল। কিন্তু নিঃশব্দে। বেশ অনেকখানি সাবধানে, নিঃশব্দে এগিয়ে যাবার পর দেখলাম সামনে একটা বেশ বড় কালো পাথর। বেশ উঁচুও। তার উপরে খুব সাবধানে নিঃশব্দে উঠেই দেখি, বাঘটা! বাঘটার দিকেই ছেলেটা আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছিল। বাঘটা যে ল্যাংড়া পাহান, তা দেখেই বুঝলাম। অদ্ভুতভাবে একটু সামনে ঝুঁকে ও এগিয়ে চলেছিল। তবে অনেকই দূরে ছিল বাঘ। হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছিল আমার রাইফেলটা যুগলপ্রসাদকে দিয়ে বন্দুকটা আনলাম বলে। ল্যাংড়া পাহান বন্দুকের রেঞ্জের বাইরে ছিল, যখন প্রথম দেখলাম তাকে, তখনও।

    ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে-মধ্যে ঢাল বেয়ে চলে-যাওয়া ল্যাংড়া পাহানের দিকে তাকিয়ে কী করব ভাবছি, এমন সময়েই ব্যাপারটা ঘটল। গদ্দাম করে, গাছে বসা হুকু তার হাতের একনলা গাদা বন্দুক দিয়ে আমার পেছন থেকে বাঘের দিকে গুলি করে দিল।

    গুলির শব্দে চমকে উঠে আমি ওর দিকে তাকালাম। ওকে দেখা গেল না কিন্তু পরক্ষণেই প্রচণ্ড গর্জনের সঙ্গে ঝোপ-ঝাড় ভাঙার আওয়াজ হল। এবং সঙ্গে সঙ্গেই আড়াল নিল বাঘ। আড়াল নিয়ে অতি দ্রুত ল্যাংড়া পাহান কানাডিয়ান স্টিম ইঞ্জিনের মতো জঙ্গল-পাহাড় গাছ-পাথর ভেঙে তছনছ করে অদৃশ্য হয়ে গেল। হুকুর বন্দুকের আওয়াজ গাছের ওপর থেকে হয়েছিল। তবু শিকারি কোথায় ছিল তার একটা আন্দাজ পাহান করেছিল সঙ্গে সঙ্গেই।

    বেশ কিছু দূরে চলে গিয়ে আবারও গর্জন করল একটা। সারা বন পাহাড় থরথর করে কেঁপে উঠল তাতে। এবং সেই দ্বিতীয় গর্জনের দাপটেই বোধহয়, পাকা ফলেরই মতো হুডকু গাছ থেকে সোজা নীচে পড়ল ধুপ করে। তখুনি দৌড়ে তার কাছে গেলাম। নীচে বালি ছিল বলে, সে-রকম চোট লাগেনি। তা ছাড়া, সে তো আর শহুরে মাখনবাবু নয়। কিন্তু লাফিয়ে পড়াতে বন্দুকটার নল পাথরে ঠুকে গেছিল। বন্দুকটার নলের মুখের উপর নিশানা নেবার জন্যে যে মাছি থাকে, সেটা দুমড়ে মুচড়ে বেঁকে গেছে দেখলাম। ততক্ষণে যুগলপ্রসাদও দৌড়ে এসেছে।

    ল্যাংড়া পাহানের গর্জন আরও একবার শোনা গেল। সিতাওন উপত্যকার দিক থেকে। মনে হল, আরও দূরে চলে গেল সে।

    বুঝলাম যে, কপালে অশেষ দুর্ভোগ আছে আমার!

    যুগলপ্রসাদ হুডকুকে অনেক করে জিজ্ঞেস করল। কোনও উত্তরই দিল না হুডকু। চোখ বড় বড় করে আমার দিকে ফিরে যুগলপ্রসাদ বলল, বোবা হয়ে গেছে ছেলেটা। সেদিনও আমার সঙ্গে কত্ত কথা বলল!

    হুকুর চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল, আর ও আঙুল দিয়ে ল্যাংড়া পাহান যে দিকে গেছে, সেদিকেই দেখাচ্ছিল বারবার। ওর মনের মধ্যে ওর মৃত বাবার প্রতি ওই ভালবাসা আর বাঘের প্রতি প্রতিহিংসা মিলে এক আশ্চর্য ভাব ফুটে উঠেছিল।

    ভারী কষ্ট হল ছেলেটাকে দেখে। বেপরোয়া, সাহসী এবং পিতৃভক্ত ছেলে যে-বাবার থাকে, সে বাবা ভাগ্যবান নিশ্চয়ই!

    যুগলপ্রসাদ বলল, মড়ি কোথায়?

    হুডকু আঙুল দিয়ে, পাহান যেদিকে গেছে, সেদিকেই দেখিয়ে দিল।

    যুগলপ্রসাদ যখন ওর সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলছিল, আমি উঠে রাইফেলটা যুগলপ্রসাদের হাত থেকে নিয়ে এগিয়ে গেলাম। বেশি দূর যেতে হল না। হঠাৎই সকালের সুগন্ধি হাওয়াটা ফিরল। এবং ফিরতেই দুর্গন্ধে নাক ভরে উঠল। বমি পেতে লাগল। একটু গিয়েই একটা দোলামতো ছায়াতে দেখা গেল দেহটা। জুতো-মোজা সুদ্ধ অক্ষত মানুষের একটি পা বেরিয়েছিল অদ্ভুত ভঙ্গিমায়।

    অবাক কাণ্ড। ভাবলাম অবশ্যি, এখানের গাঁয়ের মানুষেরা তো জুতো পরে না। কাছে গিয়ে দেখি, শরীরের প্রায় পুরোটাই খেয়ে গেছে। কিন্তু মুখটা অবিকৃত। বাঁ গাল থেকে এক খাবলা মাংস খেয়েছে শুধু। আর বাঁ কানটা। আরও কাছে যেতেই চমকে উঠলাম আমি। এ কী! এ যে ডগলাস!

    চেঁচিয়ে ডাকলাম যুগলপ্রসাদকে। ও দৌড়ে এল। কিন্তু হুকু যেমন বসেছিল, তেমনিই বসে রইল।

    বললাম, দ্যাখো কে?

    হা রাম! ইয়ে তো ডগলস সাব! হা রাম!

    চেঁচিয়ে উঠল যুগলপ্রসাদ।

    ডগলাসকে ওরা ডগলস সাব বলত। যেমন ম্যাকফার্সনকে বলত ম্যাকফু। ওই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের কলোনিতে সাহেবদের ছড়াছড়ি। যদিও এখন বেচারাদের মধ্যে অনেকেই উপোসি।

    এতক্ষণ ল্যাংড়া পাহানের সঙ্গে আমার ঝগড়াটা ছিল ন্যায়-অন্যায় নিয়ে। এখন ঝগড়াটা হয়ে দাঁড়াল ব্যক্তিগত আক্রোশের। ডগলাস-এর মুখটা মনে পড়ল।

    মরতেই তো চাই। আমি তো তাই চাই।

    কানে ভেসে উঠল ওর গলার স্বর।

    ভেবে পেলাম না ডগলাস কী করতে রাতের বেলা জঙ্গলে ঢুকেছিল? এবং এতদূর এসেছিল। পাহান তাকে মার্কিগঞ্জে ধরলে, এত কষ্ট করে তাকে টেনে আনবে কেন? একজনকে যখন ধরে কাছাকাছিই খেয়েছে।

    ডগলাস যেখানে পড়ে আছে, সেখানে ল্যাংড়া পাহান খুব সম্ভব আর ফিরবে না গুলির শব্দের পর। মাথার মধ্যে চক্কর উঠল। ডগলাসকেই যদি মারল পাহান তবে লক্ষ্মণ শিকারি কোথায় গেল? তার লাশ?

    ফুলদাওয়াই আর জিরহুল সবে ফুটতে আরম্ভ করেছে এ দিকের জঙ্গলে। আমরা সকলে অনেক ফুল মুঠো করে এনে মৃতদেহের উপর ছড়িয়ে দিলাম।

    ওদের দুজনকে তক্ষুনি চলে যেতে বললাম আমি। যাতে সন্ধের আগে আগেই মার্ফিগঞ্জে পৌঁছতে পারে। এখন প্রায় একটা বাজে। সকালে আমরা কম পথ আসিনি। সবটাই প্রায় চড়াইয়ে। হ্যাঁভারস্যাক আর রাইফেলটা যুগলপ্রসাদের কাছ থেকে নিয়ে দোনলা বন্দুকটাতে একটা বল আর একটা এল-জি পুরে হুকুর হাতে দিলাম।

    সে, কথা না বলে ফিরিয়ে দিল বন্দুকটি আমারই হাতে।

    যুগলপ্রসাদকে বললাম, কাল সকালে মালীর কাছ থেকে কিছু খাবার আর ফ্লাস্কে গরম চা নিয়ে রিহানতোড়ির বড় মহুয়াগাছটার নীচে অপেক্ষা করতে। আর বললাম, বন্দুকটাও যেন সঙ্গে আনে আসার সময়। খালি হাতে আমার অপেক্ষায় না-বসে থাকে। আর কাল বেলা বারোটার মধ্যে যদি আমি না ফিরি, তা হলে যেন রেঞ্জারসাহেবকে খবর দেয় আমার লাশের খোঁজ করার জন্যে।

    হুডকু ঘোলা দৃষ্টিতে একবার আমার দিকে তাকাল। আশ্চর্য! একটাও কথা বলল না আমাদের কারও সঙ্গেই।

    যুগলপ্রসাদ বলল, লওট চালিয়ে হুজৌর! ইয়ে শের তো নেহি হ্যায়, ইয়ে বন-দেওতাকা…।

    আমি উত্তর না দিয়ে, ওদের চলে যেতে বললাম, হাত দিয়ে।

    .

    ওরা চলে গেল। আমিও হ্যাঁভারস্যাকটা কাঁধে তুলে জলের বোতলটা নিয়ে এগোলাম। মনটা বড়ই খারাপ লাগছিল ডগলাসের জন্যে।

    ডগলাস একসময় মার্ফিগঞ্জে আমার বাংলোর কেয়ারটেকারও ছিল। অনেকদিনেরই পরিচয়। অনেক স্মৃতি, সুখ-দুঃখের।

    যে কোনও মানুষই, মরে গেলে বোধহয় তার দোষগুলো আর মনে পড়ে না, শুধু গুণগুলোর কথাই স্মৃতিতে ভাসে।

    মন খারাপ লাগছিল হুকুর জন্যেও। আর অবাক লাগছিল ওর সাহসের কথা ভেবে। অতটুকু ছেলে! ভাল করে বন্দুক ওঠাতে পর্যন্ত পারে না হাতে, সে কিনা বাবার মৃত্যুর বদলা নেবার জন্যে এমন সাংঘাতিক মানুষখেকোর পেছনে একনলা গাদাবন্দুক সম্বল করে একা-একা ঘুরে বেড়াচ্ছে! যার হাতে তিন-তিনজন ঝানু শিকারি ঘায়েল হয়েছে, সেই বাঘের কাছে ও তো নিতান্ত শিশুই। তার জীবন, তার পরিবেশ, তার চারদিকের প্রতিকূল অবস্থা এবং শত্রুতাই তাকে জেদি আর সাহসী করেছে। নইলে, এমন দুর্জয় সাহসের কথা ভাবা যায় না। এ তো সাহস নয়, এ তো জেনেশুনে আত্মহত্যা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের এয়ারফোর্সের কামিকাজে’ পাইলটরা যেমন করত, তেমনই।

    হাওয়াটা বন্ধ হয়ে গেছে এখন। প্রথম গ্রীষ্মের বিকেলের জঙ্গলে যে একটা গরম ভাপ ওঠে, সেই ভাপ উঠছে এখন। যদিও কাল বৃষ্টি হওয়াতে গরম ততটা নেই।

    একদল চিতল হরিণ দৌড়ে চলে গেল পাহাড় থেকে নেমে উপত্যকার দিকে। বন্দুক হাতে, খুব সাবধানে চারধার দেখতে দেখতে আমি খুব আস্তে আস্তে এগোতে লাগলাম। কিছুদূর যাবার পর একটা প্রকাণ্ড বেজি দৌড়ে পায়েচলা পথটা পেরুল। বাঁ দিক থেকে ডান দিকে গেল। তিতির আর কালি তিতিরের ডাকে চারপাশ সরগরম হয়ে আছে। সিতাওন উপত্যকা থেকে সম্বরের গম্ভীর ঢাংক-ঢাংক আওয়াজ এল। আশ্চর্য। দিনের বেলা!

    পাহান অবশ্য ওই দিকেই গেছে।

    শেষ বসন্তের বনের সকালের মিশ্র গন্ধে আমার নাক ভরে গেল। কী শান্তি, কী সুখ এখানে। আমাদের ওই সুন্দর দেশের বন-পাহাড়ের নানা জায়গাতে যে কী গভীর আনন্দময়, শান্তি আছে তা আমরা নিজেরাই জানলাম না। সারা পৃথিবী ঘুরেছি বলেই আমি জানি যে, আমার দেশ কী সুন্দর!

    হুডকু যেখানে গুলিটা করেছিল, সেখানে পৌঁছে কিন্তু রক্ত পেলাম না। কিন্তু তার একটু পরেই রক্ত পেলাম। পিটিসের ঝোপে, সাবাই ঘাসে, লেগেও আছে। নীচেও দাগ আছে মাঝে-মধ্যে। গাদা বন্দুকের গুলি। ঢুকেছে, কিন্তু বেরোয়নি। রাইফেলের গুলি হলে এ-ফোঁড় ওফোঁড়ই করে দিত। অতদুর থেকে ছোঁড়া বন্দুকের গুলি শরীরে ঢুকলেও গভীরে যে ঢোকেনি তা জানাই ছিল। কতখানি বারুদ গেদেছিল এবং সীসের কতবড় বল দিয়েছিল কিছুই জানা নেই। তবে কাঁধে নয়। গুলিটা সম্ভবত লেগেছে শরীরের নীচের দিকে। ওপরে যদি লাগত, তবে রক্তের দাগ গাছগাছালির লতাপাতার আরও উপরে থাকত। পেছনের পায়ে লাগলে, পেছনের পায়ের থাবার চিহ্নে তা একটু অন্তত বোঝা যেত। তা হলে, পা টেনে, বা উপরে তুলে চলত। লাগল তো লাগল সামনেরই পায়ে?

    গুলি করার সময় নিশ্চয়ই পাহান হুকুর দিকে ঘুরে ছিল, নইলে, পেছন থেকে গুলি করলে সাধারণত পেছনের পায়েই লাগার কথা।

    কাল রাতের বৃষ্টির পরে ছায়াচ্ছন্ন জায়গায়, যেখানে-যেখানে মাটি বা বালি ভিজে আছে, যেখানে-সেখানেই দাগ পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে অনেকখানি পথ দাপাদাপি লণ্ডভণ্ড করে গেছে পাহান।

    কী আর করবে বেচারা! ডগলাসও যেমন আমার বহুদিনের বন্ধু ছিল, পাহানও তাই। ছোটবেলাতেই কোনও নিষ্ঠুর আনাড়ি শিকারি তার সামনের পায়ে চোট করে দেয়। তবু সে এতদিন মানুষের ক্ষতি করেনি। তারপরও যখন তাকে একেবারে অক্ষম করে দিল মানুষ, কী ও করবে? বেঁচে তো থাকতে হবে!

    আগে আমাদের এই সব বন-জঙ্গল অনেকই গভীর ছিল। অনেক বেশি এবং অনেকরকমের জানোয়ার ও পাখি ছিল। পথে বেরোলে মনে হত ওপেন-এয়ার চিড়িয়াখানায় বেড়াতে এসেছি। এখন জঙ্গল পাতলা হয়ে গেছে, হয়ে যাচ্ছে প্রতি বছরই। পশু-পাখি কমে আসছে। সব কেমন ন্যাড়া, ফাঁকা-ফাঁকা লাগে। এ জঙ্গলে শুক্লপক্ষের রাতের বনে ছমছম করবে ছায়া-ভরা জ্যোৎস্না।

    এবার সিতাওন উপত্যকার মুখে এসে পৌঁছলাম। এখানে নদীটা গভীর এবং জলও থাকে সবসময়ই। এক জায়গায়, নদী থেকে বেরুনো নদীর একটি প্রশাখাতে, পাথরের মধ্যে, দেখলাম, জমা-জল রক্তে লাল হয়ে আছে। বুঝলাম, পাহান এখানে বসেছিল, নিশ্চয়ই। জলও-খেয়েছিল।

    নদীটা পেরোতেই অনেকগুলো সম্বরের খুরের দাগ দেখলাম। এইখানেই সম্বরগুলো পাহানকে আসতে দেখে চিৎকার করেছিল যে, তা বোঝা গেল।

    সেখানটায় দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ। এবারে আবার রক্তের অথবা পায়ের দাগ পাওয়া যাবে। যতক্ষণ আলো থাকে ততক্ষণ ওকে পিছা করা যাবে। তবে রাত হলেও চিন্তা নেই। কারণ, পুর্ণিমা সামনেই। এপ্রিলের শুক্লপক্ষের রাতের বনে আঁচল ওড়াবে ডাইনি জ্যোৎস্না।

    হ্যাভারস্যাকটাকে নদীর পারে একটা আমলকী গাছের শুকনো ডালে ঝুলিয়ে দিলাম। জল খেয়ে, ওয়াটার বটলটাকেও। ডগলাস-এর ওই মূর্তি দেখে কিছু খাওয়া-দাওয়ার স্পৃহা আমার মনে জাগেনি!

    বন্দুকটা হাতে নিয়ে আর ছুরিটা বেল্টে ঝুলিয়ে এগোলাম। এদিকের জঙ্গলটা সারান্ডা ডিভিশনের শাল-জঙ্গলের মতো। গরমের দাপটও এখনও পুরো হয়নি, তাই এদিকে আন্ডারগ্রোথ এখনও যথেষ্টই আছে। মে মাসে হয়তো জ্বলে-পুড়ে মরে যাবে এসব। ঘাস-পাতা ঝোপঝাড়। সিতাওনের এই ছায়াচ্ছন্ন উপত্যকাতে গরমও তেমন নেই। চোট-খাওয়া পাহানের পক্ষে লুকিয়ে থাকার আইডিয়াল, জায়গা।

    ভাবলাম, ছায়াচ্ছন্ন আন্ডারগ্রোথ বেশি বলেই পায়ের দাগ এখানে এসেই হারিয়ে গেল। রক্তের দাগও দেখা গেল না। অবাক হলাম আমি। ঘন আন্ডারগ্রোথের জন্যে ভাল করে দেখাই যায় না। গুলি খাওয়া পাহান যে-কোনও মুহূর্তেই লাফিয়ে উঠতে পারে। খুবই সাবধানে বন্দুকটা আড়াআড়ি ধরে ট্রিগার-গার্ডে আঙুল রেখে এগোতে লাগলাম উত্তেজনাতে টানটান হয়ে। উত্তেজনায় এবং ভয়েও হাতের পাতা ঘেমে উঠতে লাগল।

    আধ মাইলটাক যাওয়ার পরই মনটা যেন কেমন করে উঠল। শিরদাঁড়া শিরশির করে উঠল। দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। আমার তিরিশ গজ দূরে একটি ছাতারে পাখির পরিবার শব্দ করে উড়ে গেল। এবং সঙ্গে সঙ্গেই একটা ময়ূর ডেকে উঠল প্রচণ্ড ভয় পাওয়া কর্কশ স্বরে। ডেকেই, লম্বা লেজ নিয়ে আধো-অন্ধকার বনের চাঁদোয়ার নীচে শপ-শপ আওয়াজ করে উড়ে গেল।

    সামনেই ঘন শালবনের মধ্যে কতগুলো পাথরের স্তূপের মতো ছিল। যেন কেউ এনে, একটার পর একটা সাজিয়ে দিয়েছে। পুব-আফ্রিকার সেরেঙ্গেটির KOPJE র মতো। খুব মোটা একটা শালগাছের আড়াল নিয়ে আমি নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমার পায়ে পাতলা রাবার-সোলের কাপড়ের জুতো জঙ্গলে নিঃশব্দে চলা-ফেরা করার অভ্যাসও আছে ছেলেবেলা থেকেই। আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, একেবারে নিঃশব্দেই এবং পরিবেশে কোনওরকম আলোড়ন না-ঘটিয়েই সেখানে পৌঁছেছিলাম। আমাকে দেখে ছাতারে এবং ময়ুর অবশ্যই ভয় পায়নি।

    তবে?

    কী দেখে ভয় পেল?

    ভাবলাম, এখন বনের কী বলার আছে আমাকে, তা মনোযোগ দিয়ে শোনা দরকার। নইলে, আমার অবস্থাও ডগলাস এবং হুডকুর বাবা লক্ষ্মণের মতোই হবে। প্রায় মিনিট-পাঁচেক সেখানে নিঃশব্দে অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কোনও আওয়াজ নেই, পিছনের নদীর একটানা কুলকুলানি আওয়াজ ছাড়া। ঝিরঝির করে একটা হাওয়া বইছে। চৈত্রশেষের বিকেলের হাওয়া। বনের মধ্যে এই সুগন্ধি হাওয়া যে কী সুখ বয়ে আনে আগন্তুকের মনে, তা কী বলব। বছরের এই সময়ে জঙ্গল দাবদাহতে আধ-পোড়া কিন্তু তবুও একটা সোঁদা-সোঁদা গন্ধ পাচ্ছি নাকে।

    আরও অপেক্ষা করতাম। কিন্তু অধৈর্য লাগল। কোনও আওয়াজ শুনলাম না, কোনও নড়াচড়াও চোখে পড়ল না। তাই আবারও এগোলাম। এবং এগোতেই বিস্ময়ে এবং ভয়ে স্তব্ধ হয়ে দেখলাম ওই পাথরগুলোর মধ্যে একটি বাঘ আরামে দু-থাবার মধ্যে মুখ রেখে নাক লম্বা করে শুয়ে আছে। তার পেটটা একবার উঠছে, একবার নামছে। পাশের একটা বড় সাদা পাথরের চাঙ্গড় থেকে একটা লতা নেমে এসেছে। তাতে নীলরঙা জংলি ফুল। হলুদকালো ডোরাকাটা বাঘ, জঙ্গলের চাঁদোয়া ছেদ করে আসা নরম আলোর টুকরো-টাকরা, এইসব মিলিয়ে এক দারুণ ছবি হয়েছে। মুগ্ধ হয়ে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেই মুগ্ধতা রইল সামান্যক্ষণ। পরক্ষণেই আমার চোয়ালের পেশি শক্ত হয়ে এল। বন্দুকটা তুলে নিলাম কাঁধে।

    গুলি করতে যেতেই হঠাৎ মনে হল, ও তো পাহান নয়। পাহানের তো এখন ঘুমোবার কথা নয়। তা ছাড়া, বাঘটার শরীরের কাছাকাছিও কোথাও রক্ত নেই। বাঘটা গভীর ঘুম ঘুমুচ্ছে।

    পাহান নয়, তা বুঝতে পেরেই আবার সাবধানে পিছু হটে এলাম পায়ে-পায়ে। হাতে একটি আহত নরখাদক আছে, তাই-ই যথেষ্ট। অক্ষত কোনও বাঘকে গুলি করার সময় এটা আদৌ নয়, তা ছাড়া তাকে মারবার পারমিটও আমার নেই।

    তা ছাড়া যখন দেশে বাঘ প্রচুর ছিল যথেষ্টই মেরেছি বাঘ। কোনও খেদ নেই। আমার অন্তত নেই। আমার মতো শিকারিকে শিকার করতে পারেনি বলে বাঘেদের খেদ ছিল কিনা তা অবশ্যই জানা হয়নি। থাকতে পারে।

    তা হলে, পাহান কি নদী না-পেরিয়ে নদী বরাবর গেছে? সে কারণেই সিতাওন উপত্যকাতে ঢুকে রক্ত অথবা পায়ের দাগ কিছুই দেখিনি! আর যদি তাই-ই গিয়ে থাকে, তবে সে তো মার্কিগঞ্জের দিকেই গেছে! তার শক্তির শেষ বিন্দুটিও কি মার্কিগঞ্জের প্রতি ঘেন্না দেখিয়ে তার ওপর প্রতিশোধ নিয়ে সে খরচ করবে?

    নদীর কাছে ফিরে এলাম। ফিরে এসেই নিজের ভুল বুঝলাম। পাহান নদী পেরিয়েছে ঠিকই সিতাওন উপত্যকার কাছে, কিন্তু নদী ধরেই চলে গেছে। এবং মার্কিগঞ্জেরই দিকে। হুডকুর গাদা বন্দুকের চোট যে গুরুতর কিছু হয়নি, তা এখন বোঝা যাচ্ছে। হবার কথাও ছিল না। পাহান যদি বন্দুকের রেঞ্জের মধ্যেই থাকত, তবে তো আমার গ্রিনার বন্দুক দিয়েই গুলি করতে পারতাম। ঘৃণাতে কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে হুডকু তাকে গাদা বন্দুকে গুলি করেছিল, আর পাহানও বোধহয় মানুষের প্রতি ঘৃণাবশে যতটা রাগ দেখিয়েছিল, ততটা যন্ত্রণার কারণে দেখায়নি।

    এদিকে বেলা পড়ে আসছে দ্রুত। এবং এ জঙ্গলে দেখছি মানুষখেকো এবং সদ্য-আহত পাহানই নয়, তার একজন জাতভাইও আছে। নাকি সঙ্গিনী? পায়ের দাগ না দেখতে পেলেও, চেহারা দেখে বাঘিনী বলেই মনে হয়েছিল। পাহান কি এ-জঙ্গলে থাকে না? হয়তো থাকে না। থাকলে জেনেশুনেই অন্য বাঘের এলাকাতে ঢুকে পড়ত না। অথবা ওই-ই থাকে। ওই বাঘিনীই বে-এক্তিয়ারে ঢুকে পড়েছে হয়তো। যাই-ই ঘটে থাকুক, এখান থেকে বেলা থাকতে-থাকতে মার্ফিগঞ্জে ফেরা সম্ভব নয়। রাতে পাহানকে খুঁজে বেড়ানোও সম্ভব নয়। খুঁজলে পাহানই আমাকে অনেকই সহজে খুঁজে পাবে হয়তো। তার এই চোট যখন মারাত্মক হয়নি, তখন তার সম্বন্ধে খুবই সাবধানে থাকতে হবে।

    এই সব ভেবে রওনা হলাম নদী বরাবরই। কী করব, চলতে-চলতে ঠিক করা যাবে। এখনও সন্ধে হতে ঘণ্টাখানেক বাকি আছে।

    নদীটা সামনেই বাঁক নিয়েছে একটা। সেই বাঁকের মুখে দেখি কয়েকটা নীল-গাই জল খাচ্ছে চকচক শব্দ করে। আর সে জায়গার উজানে, একশো গজ দূরে একদল শুয়োর জমিয়ে চান করছে জলে ঝাঁপাঝাঁপি করে। আমাকে নীলগাইদের প্রহরীটি দেখতে পেতেই ওরা সকলেই খুরে-খুরে খটাখট আওয়াজ তুলে পালিয়ে গেল। কিন্তু শুয়োরের বাচ্চারা তখনও নির্বিকার। আরও এগোতে তারাও সিংগল-ফাইলে পড়ি কি মরি করে লেজগুলো উপরে তুলে দৌড়ল। ওদের দেখে আফ্রিকার ওয়ার্টহগসদের কথা মনে পড়ে গেল আমার। সেই সঙ্গেই আফ্রিকার এবং তোদেরও অনেকই কথা মনে পড়ে গেল। শিগগিরি যাব আরেকবার।

    এবারে ভটকাইকে নেব না। তুমি রাম অথচ হনুমানকেই চিনলে না।

    ভটকাই বলল, শুয়োরগুলো যখন দৌড়ে চলে গেল, তখন আমার মনে পড়ল যে, পাহান যদি মাগিঞ্জের দিকেই গিয়ে থাকে, অথবা এখানেই কোথাও জল খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে, জখমের জায়গা জিভ দিয়ে চেটে চেটে পরিষ্কার করার পরই যদি রাতে আবার নতুন শিকার ধরার জন্যে ওই দিকেই যায়, তবে ও মার্কিগঞ্জের থেকে আধমাইল দূরে নদীটা যখন সরু হয়ে এসে ফরেস্ট রোডের উপর দিয়েই বয়ে গেছে, হয়তো ঠিক সেখানে গিয়েই ফরেস্ট রোড ধরে মার্কিগঞ্জে ঢুকবে। ঢোকাটা স্বাভাবিক অন্তত। সেইখানে কোনও গাছে যদি বসে থাকতে পারতাম, তবে নির্ঘাত তার সঙ্গে দেখা হতে পারত।

    এসবই অবশ্য ইন্টেলিজেন্টগেস-ওয়ার্ক। বাস্তবের সঙ্গে মিলতেও পারে, নাও মিলতে পারে।

    হয়তো মার্কিগঞ্জের দিকেই যাবে। কারণ ডগলাস-এর শরীরে তার একদিনের খাবার জন্য বিশেষ কিছু নেই। দৈনিকও যদি খায়, তবে বাঘের দশ থেকে পনেরো কেজি মাংস হলেই চলে যায় কিন্তু দৈনিক খেতে না পেলে বেশি লাগে। পেট ভরে গেলে, সে দু একদিন না-খেয়েও থাকতে পারে এবং থাকেও। এ দিকের বাঘ।

    আমি কিন্তু নদীর পারের ঘাসের উপর দিয়েই চলেছি। ল্যাংড়া পাহানের পায়ের দাগ যেন ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেছে নদী পেরিয়েই। সামনেই নদীটা আরেকটা বাঁক নিয়েছে। সেই বাঁকে পৌঁছে ভাবলাম যে, এখানে নদী পেরিয়ে সিতাওন উপত্যকাকে পেছনে ফেলে একটা পাহাড় টপকে গেলেই নদী আর ফরেস্ট-রোডের জাংশানে গিয়ে পৌঁছব। এ কথা ভেবেই নদী পেরোলাম জলে ছপ ছপ শব্দ করে এবং পেরিয়েই দেখলাম, নদীর বালিতে বাঘের থাবার দাগ। বাঘটা একটু আগে জল পেরিয়ে আমি যেদিকে যাব ভাবছি, সেদিকেই গেছে। বালি তখনও ভিজে। থাবার দাগ অন্য কোনও বাঘের নয়, ল্যাংড়া পাহানেরই। সামনের ডানদিকের থাবাটাতে যে জখম আছে, তা বালির উপরের স্পষ্ট দাগ থেকে বোঝা যাচ্ছে।

    ডগলাসের ছিন্নভিন্ন লাশ দেখার পর থেকে আমার মাথার ঠিক ছিল না। তার উপর আবার চোখের সামনে একটা বারো-তেরো বছরের সবে বাবা-মরা বোবা ছেলেকে দেখলাম। হাতে বড় কাজ থাকলে অনেক ব্যাপার নিয়েই তখন মাথা ঘামালে চলে না। কিন্তু পরে ভাবলে মাথার মধ্যে মাদল বাজে, শিঙা ফোঁকে যেন কারা। কান ঝাঁঝাঁ করে।

    আমার মনে হল, আমি একেবারেই প্রকৃতিস্থ নই। মাথার গোলমালই হয়ে গেছে যেন। সকালের পর কিছু খাইওনি। এদিকে হ্যাঁভারস্যাক ও জলের বোতল, দূরে গাছে টাঙিয়ে রেখে এসেছি। এক্ষুনি পাহান জল পেরিয়ে গেছে, জলে বা বালিতে এখানে কিন্তু কোথাও একটুও রক্তের দাগ নেই। নানা রকমের ম্যাজিক হচ্ছে যেন সকাল থেকে। ডগলাস, যাকে সেদিন সন্ধেবেলা বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এলাম, তাকে এইভাবে আবিষ্কার করার পর থেকে হুকুর অবিবেচকের মতো গুলি করা, হুডকুর বোবা হয়ে যাওয়া, পাহানের বন-পাহাড় গুঁড়ো করা গর্জন-ত জন, তারপরও এই হঠাৎ-আসা বাঘিনী। এত সব ঘটনা এত দ্রুত ঘটে যাওয়াতে সত্যিই মাথার মধ্যে সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।

    প্রচণ্ড জলপিপাসা পেল আমার। ওয়াটার বটল ফেলে এসেছি সত্যি, কিন্তু এই বহতা নদী সিতাওনের পাশে-পাশেই হেঁটেও আসছি এতক্ষণ! পিপাসাতে বুক ফাটলেও, জলের কথা একবারও মনে হয়নি। আশ্চর্য!

    .

    আমার মাথার মধ্যে কে যেন বলে উঠল; আমি তো মরতেই চাই।

    কে? ডগলাস?

    গালের মাংস খুবলে-নেওয়া গলাকাটা ডগলাস বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে চেয়েছিল। ওই দৃশ্য যে কত বীভৎস, তখন বুঝিনি। অথচ কত চেনা ডগলাস। আমার মধ্যের পিপাসাটা হঠাৎ ভীষণ তীব্র হয়ে উঠল।

    কে যেন আমার মাথার মধ্যে আবার বলল: আমি তো মরতেই চাই। মরতেই চাই!

    কেন? কে?

    চ্যাঁ-চ্যাঁ-চ্যাঁ করতে করতে একদল সবুজ টিয়া অস্তগামী সূর্যের অয়ন পথের হদিস নিতে আমার মাথার মধ্যের ‘কেন’র উত্তরটাকে ওদের লাল ঠোঁটে তুলে নিয়ে চলে গেল।

    বন্দুকটাকে আমি নদীর পারের একটা বড় বেঁটে মহুয়া গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে রেখে, নদীর দিকে ফিরে গেলাম খুব নিশ্চিন্ত হয়ে। যেন এখানে কোনও বিপদ নেই, যেন বাঘে কোনও মানুষ ধরে না এখানে, যেন ডগলাস বা হুডকু, বা হুকুর বাবা এবং আরও দু’জন শিকারির পরিণতির ঘটনা সত্যি নয়। আমি জলের কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে জল খেতে লাগলাম আঁজলা ভরে। ঠিক সেই সময় কে যেন আবার আমার মাথার মধ্যে বলে উঠল, হরিণরা কি এমন ভাবে জল খায়?

    হরিণদের কি হাত থাকে? জিভ দিয়ে চকচক করে খায়।

    অমনি আমি যন্ত্রচালিতের মতো দু-হাত পিছনে মুঠো করে ধরে, জিভ বের করা কুকুর বা হরিণদের মতোই চকচক শব্দ করে জল খেতে লাগলাম। মুখ নীচে নামিয়ে জলের সঙ্গে মুখ ছুঁইয়ে।

    ঠিক সেই সময়ে আবার কে যেন বলল মাথার মধ্যে, তুমি হরিণ, তোমার ঘাড়ে এক্ষুনি বাঘ লাফাবে।

    অমনি আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। তাড়াতাড়িতে হরিণের মতো চারপায়ে পিছন ফিরতেই বালির মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম। এবং পড়ে গিয়েই দেখলাম, বড় মহুয়া গাছটার গুঁড়িতে হেলান দিয়ে যেখানে বন্দুকটা রেখেছিলাম, ঠিক সেইখানেই বন্দুকটাতে প্রায় লেজ ঠেকিয়ে দিয়ে একটি সুন্দরী বাঘিনী কায়দা করে বসে আছে। তার মুখে মৃদু-মুদু হাসি৷ একটু আগেই যাকে দেখে এলাম সেই বাঘিনীটাই! যাকে আমি ঘণ্টাখানেক আগে পাথরগুলোর মধ্যে নীল জংলি ফুলের আর রোদের টুকরো-টাকরার মধ্যে দেখেছিলাম।

    বাঘিনী কথা বলল না। তেড়েও এল না। শুধু হাসতে লাগল মিটি মিটি, আমার গুলি-ভরা বন্দুকটাতে লেজ ঠেকিয়ে।

    আমার মাথার মধ্যে অনেক লোক একসঙ্গে কথা বলে উঠল। তিরিশ বছর আগে যে মা আমার চলে গেছেন, সেই মা ডাকলেন, বললেন, খোকন আয়। আজ জন্মদিন, তোর জন্যে পায়েস করেছি। খাবি আয়। সাদা পাথরবাটিতে খেজুরের পাটালি আর লাল-চালের ঘন পায়েস। আয়, খাবি আয়।

    আমার ঘুম পেতে লাগল। আজ যে আমার জন্মদিন। আমার গুলিভরা ডাবল-ব্যারেল বন্দুকের কাছে বসে থাকা বাঘিনীর হাসি-হাসি মুখের দিকে মুখ করে আমি মায়ের হাতে পায়েস খাওয়ার আনন্দে, জন্মদিনের আনন্দে, ঘুমিয়ে পড়লাম।

    আমি জানি, তোরা ভাবছিস এ কী গাঁজাখুরি গল্প শোনাচ্ছি কিন্তু শেষ অবধিই শোন।

    আজ আমারও তা-ই মনে হয়।

    কিন্তু যা ঘটেছিল, তাই-ই বলছি।

    .

    ০৩.

    প্রচণ্ড গর্জনে আমি ঘুম ভেঙে চমকে উঠলাম। কাছেই কোথাও একটি বাঘ আর একটি বাঘিনী একই সঙ্গে গর্জন করছে। মনে হচ্ছে গাছপালা, পাহাড়-পর্বত সব ভেঙে পড়বে।

    চাঁদ উঠেছে চমৎকার। পরিষ্কার আকাশ। হাওয়া বইছে ঝিরঝির করে। করোঞ্জ আর নানা রকম ফুলের গন্ধে ভরে আছে সে হাওয়া। পিউ-কাঁহা পাখি ডাকছে। মাথা খারাপ করে দেবে। সাধে কি সাহেবরা এদের নাম দিয়েছে ব্রেইন ফিভার। আমি নদীর পাশে বালির উপরে শুয়ে আছি। ফুটফুটে চাঁদের আলোয় অবাক হয়ে দেখতে পেলাম, আমার বন্দুকটা মহুয়া গাছের গুঁড়িতে হেলান দেওয়া আছে। কে যে এখানে বন্দুকটা আনল, কিছুতেই মনে করতে পারলাম না।

    কী ব্যাপার তা ভাল করে বোঝার আগেই আমি রাইফেলটার কাছে দৌড়ে গিয়ে ওটাকে তুলে নিলাম। কেন, কোন আক্কেলে যে আমি নদীর পাশে এমন রাতে নদীর বালিতে ঘুমিয়ে ছিলাম, বন্দুকটাকে পনেরো কুড়ি হাত দূরে এমনভাবে রেখে, কিছুতেই তা ভেবে পেলাম না।

    গরমের দিন। জলের পাশে, সাপ, বিছে তো বটেই, সমস্ত জন্তু-জানোয়ারেরই আনাগোনা। আমি কেন এখানে এসেছিলাম? আমার হাতে বন্দুকই বা কেন? শত চেষ্টা করেও মনে পড়ল না। শুধু মনে পড়ল যে, মালীর বউ বলেছিল, সন্ধের আগে-আগে ফিরবেন সাহেব। শুয়োরের ভিণ্ডালু রাঁধব আজকে।

    যা বাঘ আর বাঘিনীর কাছে খেলা, তাই-ই সমস্ত বনের জানোয়ার, পাখি, পোকামাকড় সকলের নাভিশ্বাস। মনে হচ্ছিল, তর্জনে-গর্জনে পাহাড় চৌচির হবে বুঝি, গাছ পড়ে যাবে, ভূমিকম্পে যেমন পড়ে। অন্যরা সব শান্ত। চুপচাপ। আমি যেন ঘোরের মধ্যে হেঁটে যেতে লাগলাম সেই বাঘ-বাঘিনীর আওয়াজের বিপরীত দিকে। কিন্তু বন্দুক কাঁধে নিয়ে। হাতে পর্যন্ত নিয়ে নয়।

    আমি এখানে রাইফেল হাতে কী করতে যে এসেছিলাম, তাও মনে পড়ল না আমার।

    চাঁদনি রাত ছিল বলে তাই রক্ষে। নিজের মনে, চাঁদের বনে বিভোর হয়ে নদী ধরে হাঁটতে-হাঁটতে এগোচ্ছিলাম আমি। এ সব নদী, বন, পাহাড় আমার সম্পূর্ণ অচেনা। এ কোন দেশের, কোন গ্রহের রাত? তবু নদী ধরেই হাঁটতে লাগলাম গন্তব্যহীনভাবে। রাত তখন বেশ গভীর। অথচ কত রাত তা দেখতেও ইচ্ছে করল না হাত-ঘড়িতে। আমি নিজেকেই নিজে বললাম, অনেক রাত!

    চলতে-চলতে একটা জায়গায় এসে পৌঁছলাম। যেখানে নদীটা একটা কাঁচা লাল মাটির ফরেস্ট রোডের উপর দিয়ে গড়িয়ে গেছে। সেইখানে পৌঁছেই আমি, ডান দিকে মোড় নিলাম। অথচ কেন নিলাম জানি না। কিছু ভেবে নিইনি। পথও চিনি না। আমাকে চলতে হবে বলেই যেন আমি চলছি। ডানদিকে কেন? ডানদিকে চলতে হবে বলেই যেন আমি চলছি। ডানদিকে কেন? ডানদিকে কী আছে?

    আরও আধ মাইল চলার পর যখন ডগলাসের সাদা-রঙা ছোট্ট বাংলোটা চোখে পড়ল, চাঁদের আলোয় ধবধবে, দাঁড়িয়ে আছে জঙ্গলের মধ্যে, তখন হঠাৎ একই সঙ্গে সকাল থেকে ঘটা সব ঘটনার কথা আমার হুড়মুড় করে মনে পড়ে গেল। মনে পড়তেই ডগলাসের বাঘের নখে কাটা বীভৎস মুখোনির কথাও মনে পড়ে গেল। তখন ভীষণই গা ছমছম করে উঠল। হঠাৎই এক দারুণ ভয় আমাকে আছন্ন করে ফেলল।

    ওখান থেকে বড়-বড় পায়ে এগিয়ে, জঙ্গলটা পেরোতেই আমার বাংলো দেখা গেল। বাইরের বারান্দাতে একটি লণ্ঠন জ্বলছে। মালী রেখেছে। সারা রাতই জ্বলবে। মালীর ঘরের সামনে গিয়ে ওদের বন্ধ দরজায় একবার ধাক্কা দিলাম। তখন আমার আর দাঁড়াবার মতো জোরও গায়ে ছিল না। শরীর আর মনও ভেঙে পড়েছিল।

    দরজায় ধাক্কা দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই ভিতর থেকে হাঁউমাঁউ আওয়াজ শোনা গেল। এবং সঙ্গে সঙ্গেই গুডুম করে একটি গুলি হল। গুলিতে, মালীর খাপরার চালের ঘরের দু-তিনটে খাপরা উড়েও গেল। সঙ্গে সঙ্গে ভেতরের শোরগোল আরও বাড়ল। কিন্তু গুলির শব্দ হবার পরেও মার্কিগঞ্জে যে একজনও জীবন্ত মানুষ থাকে এবং অন্তত পাঁচজনের বাড়িতে দোনলা বারো বোরের টোটাবন্দুকও আছে, একথা মনে হল না। তখন আমি মালী আর তার বউয়ের নাম ধরে ডাকতে লাগলাম। কোমর থেকে টর্চ খুলে আলো ফেললাম দরজার দিকে। তারই পরে ওরা জবাব দিল।

    বিরক্ত গলায় বললাম, এসো তোমরা। চলো, এখানে এতই ভয় পাও তো খাবার ঘরের মেঝেতে শোবে আজ থেকে। ঘর, তালা বন্ধ করো।

    আসলে ভয়টা ওদের নয়। আমার নিজের ভয়টাই তখনও কাটেনি। অবশ্য ভয়টা বাঘের নয়। ভয়টা ভূতেরও নয়। তবে ভয়টা কীসের? ভয়টা স্মৃতিনাশের। ভয়টা আমার ভয় না-পাওয়ার কারণে। এমন অবস্থাতে তো জীবনে পড়িনি কখনও এর আগে!

    মালী বউ বাংলোর ভিতরে ঢুকে বলল, কিছু খাবেন সাহেব?

    বললাম, জল। শুধু জল।

    কফি? কফিও না?

    না।

    বলেই, মনে পড়ল; পোর্ক-ভিন্ডালুর কথা। ওকে বললাম, আচ্ছা! তুমি না আজ শুয়োরের ভিডালু রান্না করবে বলেছিলে?

    ও অবাক হল। ওর স্বামীর দিকে একবার তাকাল।

    তারপর আড়ষ্ট ভাবে বলল, সে তো গতবারে যখন এসেছিলেন, তখন বলেছিলাম। আর আমিও বলিনি। ডগলাস সাহাব খেতে চেয়েছিলেন, তাই আপনি রান্না করতে বলেছিলেন। কত্তোদিন আগে!

    মালীর বউ-এর চোখে বিস্ময় আর মুখে ভয় ফুটে উঠল।

    আমি পাগলের মতো হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলাম, শুয়োর? কী শুয়োর? বুনোশুয়োর?

    না সাহাব!

    অবাক হয়ে, মালীর বউ বলল, বস্তির শুয়োর। শুক্রবারের হাট থেকে মালী কিনে এনেছিল। চারবছর আগে তো আপনি এসেছিলেন, শেষ।

    বলেই, সে হাঁউমাউ করে কেঁদে উঠল।

    বলল, হু-উ-উ ডগলাস সাহাব।

    কে বলেছে? যুগলপ্রসাদ?

    হাঁ সাহাব?

    বলেই বলল, যুগলপ্রসাদ তো পাগল হয়ে গেছে!

    পাগল হয়ে গেছে? কবে, মানে কখন?

    যখন ফিরে এল আপনাকে জঙ্গলে ছেড়ে। নিজের বাবার নাম পর্যন্ত ভুলে গেছে। নিজের নামও ভুলে গেছে। খালি নেচে-নেচে বলছে, হাঃ! হাঃ! যিসকা বান্দারিয়া, ওহি নাচায়ে! হাঃ! হাঃ! যিসকা বান্দারিয়া, ওহি নাচায়ে!

    আমার মুখের মধ্যে থুথু ক্রমশ ঘন হয়ে আসছিল। বুঝতে পারছিলাম যে, এবার আমার পাগল হবার পালা! বললাম, যুগলপ্রসাদের সঙ্গে আর কেউ ছিল? ছিল না?

    হাঁ। ছিল তো? হুডকু। লখমন ওরাওঁয়ের বেটা। উও ভি বোবা কালা হয়ে গেছে বিলকুল। আপনি ঠিক আছেন তো সাহাব?

    বিলকুল!

    ধমক দিয়ে বললাম ওদের। কিন্তু ওদের মুখ দেখেই মনে হল যে, ওরা বোধ হয় বিশ্বাস করছে না আমাকে।

    আমাকে জল খাওয়াও এক গ্লাস। আর এক বোতল জল মাথার কাছে রেখে তোমরা শুয়ে পড়ো। কাল কথা হবে।

    মালী যখন জলটা নিয়ে এল, তখন বললাম, আজ ল্যাংড়া পাহান কি এদিকে এসেছিল?

    না তো? বাঘোয়ার কোনও খবর নেই।

    ভাল। এবার ভাল করে দরজা-টরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ো তোমরা। বন্দুকটা কাছেই রেখো। কিন্তু সেটা আমাকে মারবার জন্যে তোমাকে দিইনি। একটু আগেই গুলিটা দরজার দিকে নল করে করলেই তো দরজা ফুটো করে ফর্দাফাঁই করে দিত আমাকেই! এমন গুলিখোর আমি হতে চাই না। তোমার মতন শিকারির হাতে মরলে আমার নরকবাস নিশ্চিত।

    ও বলল, খুউব দোষ হয়ে গেছে সাহাব। হা রাম। শোবার সময়ে একবার টর্চ জ্বালিয়ে হাতঘড়িটা দেখলাম। সকাল পৌনে তিনটে। মালীকে বললাম, আলো ফুটলেও আমাকে চা দিয়ে ঘুম ভাঙাবে না। যখন ওঠার, তখনই উঠে চা চাইব। কারও সঙ্গে দেখাও করব না, চান না করে।

    শোবার পরও আধ ঘণ্টা ঘুম এল না। তারপর আবার বাংলোর উজলা কম্পাউন্ডের পরিচিত গন্ধ ও শব্দ এক-এক করে সব নাকে ও কানে আসতে লাগল ধীরে-ধীরে, খুবই ধীরে-ধীরে, বালির মধ্যে জল যেমন করে চুঁইয়ে যায়, তেমনি করে। ক্রমশ আমি স্বাভাবিকতার দিকে ফিরতে লাগলাম অনেক পথ মাড়িয়ে এসে। কাল সকাল থেকে এখন অবধি কী করে যে কাটল, তার হিসেব-নিকেশ, পারলে, দিনের আলোতেই করা যাবে। তারপর চোখ বুজে এল এক সময়।

    .

    ০৪.

    যখন ঘুম ভাঙল, তখন অনেক বেলা। বিছানা ছেড়ে উঠে দেখি জুতো-মোজা পরেই শুয়েছিলাম। জামা-কাপড়ও ছাড়িনি। উঠেই, বন্দুকটা থেকে গুলি খুলে, মুখ হাত ধুয়ে, চান করে, পেয়ারাতলিতে এসে বসলাম।

    মালী চা দিয়ে গেল।

    ওকে বললাম, বুধন, সামসের, নিয়ামত এবং মংলু শিকারিদের একই সঙ্গে খবর দাও। তারা যেন এক্ষুনি সব কাজ ফেলে এখানে চলে আসে। আমার সঙ্গে নাস্তাও করবে এবং সারাদিন থাকবে। সাতদিনের রোজ আমি দেব। সাতদিন আমার কাজ আছে খুবই ওদের সঙ্গে। সব কাজ ফেলে যেন আসে। বুঝিয়ে বলবে, আমার নাম করে। আর যুগলপ্রসাদের কাছ থেকে আমার বন্দুকটাকেও নিয়ে আসতে হবে।

    এই শিকারিদের ডেকে পাঠালাম, কারণ, এরা খুবই সাহসী এবং এক সময়ে আমার সঙ্গে অনেক শিকার-টিকার করেছে। এ অঞ্চলের সব জঙ্গল এদের নখদর্পণে। কিন্তু সকলেরই মাঝবয়েস হয়ে গেছে। ঘরসংসার কাজকর্ম নিয়ে থাকে। মাঝেমধ্যে চুরি করে হরিণ-শুয়োর-খরগোশ যে মারে না তা নয়, তবে বিপদের শিকারে আর যায় না। আমি জানি, এদের মধ্যে দুজনের লাইসেন্সড আর অন্য দুজনের আন-লাইসেন্সড গাদা বন্দুকও আছে।

    আমার প্রথম কাপ চা খাওয়া শেষ হতে না হতে মালীর বউ গরম-গরম পরোটা আর মেটের চচ্চড়ি করে নিয়ে এল। কাল সারাদিনই প্রায় কিছু খাওয়া হয়নি, তা ও জানে। শিকারিদের সকলের জন্যেও নাস্তা তৈরি করতে বলে বললাম, পুরো এক পট চা দিয়ে যেতে। চা আর পাইপ খেয়ে বুদ্ধি আর সাহসের গোড়ায় ভালমতো ধোঁয়া না দিলে কালকের কোনও রহস্যই পরিষ্কার হবে না।

    এখানে খবরের কাগজ-টাগজের ঝামেলা নেই। পুরো মার্কিগঞ্জে তিনজন কাগজ রাখেন। অন্যরা চেয়ে-চিন্তে পড়েন। তবে কাগজ আসেও পুরো দু দিন পর। রাঁচি থেকে অনেক ঘোরা পথে।

    এক পট চা আর দু-ফিল পাইপ শেষ করার পরও যখন মালী এল না, তখন আবার ঘুমিয়ে পড়লাম পেয়ারাতলির ইজিচেয়ারে।

    বেশ কিছুক্ষণ পরে মালীর বউ ঘুম ভাঙিয়ে বলল, সাহাব, রেঞ্জার সাহাব আয়া।

    চেয়ে দেখি, রেঞ্জার ভূপতনারায়ণ মিশ্র সামনে দাঁড়িয়ে। ওঁকে বসতে বলে, ওঁর জন্যে চা-নাস্তা আনতে বলে সোজা হয়ে বসলাম।

    যুগলপ্রসাদ কেমন আছে রেঞ্জার সাহাব।

    ভাল। মানে ওরকমই আছে। ওর চেয়ে খারাপ কিছু হয়নি। আমি আসলে একটা কথা বলার জন্যে এলাম। পথে, মালীর কাছে সব শুনেছি আমি। এ বাঘ আপনি মারতে পারবেন না। সকলের কপালে যা আছে, তাই-ই হবে। আপনি এখানে থাকেন না, কেন মিছিমিছি হয় পাগল হবেন, নয় মারা যাবেন? আমাদের জন্যে?

    আমিও পিঠটা যথাসম্ভব চেয়ারের পেছনে করে সোজা হয়ে বসে বললাম, ব্যাপারটা একটু খুলে বলুন।

    রেঞ্জার মিশ্রসাহেব বললেন, এটা বনদেওতার বাঘ। একে কেউই মারতে পারবে না বোধহয়। কাছ থেকে রাইফেলের গুলি খেলেও ওর কিছু হয় না। গুলিতে বুক এ-ফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যায়। রক্তে বনের পথ ভেসে যায়। তারপর সিতাওন নদীতে আর একবার চান করে নেয় ও। ব্যস! সঙ্গে-সঙ্গে রক্ত বন্ধ হয়ে যায়। শরীরের আর কোনওই কষ্ট থাকে না। হুডকুর বাবা গুলি করেছিল একেবারে মাথায়, মাত্র পাঁচ গজ দূর থেকে।

    তবু গাছে লাফিয়ে উঠে ওকে মুখে করে নিয়ে চলে গিয়েছিল সে। হুডকু’র মামা সেই গাছের উঁচু মগ ডালে বসে ছিল। তার নিজের চোখে দেখা। সেও পরদিন নিজের গ্রামে চলে গেছে। খবর এসেছে যে, সেও নাকি পাগল হয়ে গেছে।

    কী যে সব গাঁজাখুরি গল্প বলেন আপনারা! এ-সব জেনে-শুনেও হুকু বা যুগলপ্রসাদ কেন গেল তাহলে ওই বাঘের কাছে? আমার সঙ্গেই বা যুগলপ্রসাদ কোন সাহসে গেল?

    ওদের সাহস! যুগলপ্রসাদ একা হাতে একবার দশজন ডাকাত ঠেকিয়েছিল। তা ছাড়া ও ভূত-ভগবান মানে না। আর হুডকু গিয়েছিল তার বাবার মৃত্যুর বদলা নিতে। লাভ কী হল? একজন বোবা কালা আর একজন পাগল হয়ে গেল। এবার আপনি কলকাতা ফিরে যান বোস সাহেব। নইলে এবার কিন্তু আপনার পালা!

    আমি মানি না। কিন্তু বনদেওতার বাঘ হলে এই বাঘ এমন করে মানুষ ধরে খেত না। বনদেওতার বাঘের কথা আমি নানা জায়গা থেকে শুনেছি। নিজেও একবার গুলি করেছিলাম, কিন্তু আশ্চর্যভাবে সেই ওড়িশার জঙ্গলের বাঘ অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই বাঘ কখনও মানুষের কোনও ক্ষতি করেনি। কোনওদিনও না।

    তা আপনি কী করবেন ঠিক করলেন? আপনাকে আমিই কাল এই বাঘ মারতে অনুরোধ করেছিলাম। আজ আমিই এসে বারণ করছি।

    শিকারিদের খবর দিয়েছি। তারা আসুক। পরামর্শ করব। আচ্ছা আমাকে বলুন। তো মিশ্রসাহেব, সিতাওনের উপত্যকাতে আর কতগুলো বাঘ-বাঘিনী আছে?

    রেঞ্জার সাহেব বললেন, এক এলাকায় তো একটার বেশি বাঘ সচরাচর থাকে না। তবে কখনও-সখনও খেলা করতে আসে, সংসার পাততে, অল্পদিনের জন্যে, বাঘের কাছে বাঘিনী, বাঘিনীর কাছে বাঘ। কিন্তু এখন এ জঙ্গলে পাহান ছাড়া দ্বিতীয় বাঘ নেই কোনও। কুড়ি-পঁচিশ মাইল এলাকার মধ্যেই নেই। আমার ফরেস্ট গার্ডরা তা হলে আমায় জানাত। কোনও বাঘিনী থাকার প্রশ্নই ওঠে না।

    বাঘিনী নেই?

    গত তিন বছরে কোনও বাঘিনী আসেনি। পাহান এ জঙ্গল ছেড়ে অন্য জঙ্গলে দেখা করতে গেছে তাঁদের সঙ্গে হয়তো, কিন্তু তারা কেউ আসেনি।

    আমার চোখের সামনে নীল জংলা ফুলের পাতা আর রোদের সোনালি টুকরো-টাকরায় মোড়া বাঘিনীটির চেহারা কালো পাথরের উপর আবার ভেসে উঠল। তারপর মহুয়া গাছে হেলান-দেওয়ানো আমার রাইফেলের সামনে হাসি-হাসি মুখে বাঘিনীটার চেয়ে থাকার কথাও।

    না, আমিও বোধহয় পাগল হয়ে যাব, যদি এখনও না হয়ে থাকি।

    কিছুক্ষণ পরে মালী ফিরল। সঙ্গে কেবল মংলু একা।

    কী ব্যাপার?

    ওরা কেউ এল না। বলল, ওদের প্রাণের ভয় আছে। আণ্ডাবাচ্চা নিয়ে ঘর করে। ওদের পক্ষে এই ভূতুড়ে বাঘ মারতে আপনাকে সাহায্য করা সম্ভব নয়।

    আর মংলু কী বলে?

    বলেই, মংলুর দিকে তাকালাম আমি।

    মংলু নমস্কার করে বলল, পরনাম সাহাব। আমি আপনার সঙ্গে অনেক শিকার করেছি। সাহস আমার কমতি নেই। সাহাবেরও নেই। আমি জানি। কিন্তু এই বাঘ মারতে আপনি যাতে না যান, তাই-ই আপনাকে বারণ করতে পাঠিয়েছে ওরা সবাই আমাকে। ওরা সকলেই আপনাকে ইজ্জত দেয়। আপনার ভাল চায়।

    আশ্চর্য তো! তোমরা সবাই কুসংস্কারের বশে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে, আর পাহান মানুষের পর মানুষ মেরেই যাবে।

    এ যে এমনি বাঘ নয় সাহাব। বড় টাইগার, মানুষ-খেকো হলে দিনেই যখন সহজে মানুষ ধরতে পারে তখন রাতে মানুষ নেয় শুনেছেন কখনও? তাও মানুষ নেয়, বাংলোতে-বাংলোতে ঘুরে বেড়িয়ে?

    নেবে না কেন? তোমরা আর কতটুকু জানো। জিম করবেট সাহেবের লেখা পড়লে জানতে।

    তবে ওর মৃত্যুর বন্দোবস্ত হচ্ছে।

    মংলু বলল।

    কী ভাবে? হাড্ডিতোড়িতে আমরা এই পূর্ণিমার দিনই জোর পুজো চড়াচ্ছি বনদেওতার থানে। পাঁচটা পাঁঠা বলি দেব। দেওতাকে পাহানের সব হরকতের কথা জানালে, তাকে শাস্তি দিতেন উনি এতদিনে। আমরা পুজো চড়িয়ে সব কথা বলে দেব তাঁকে। দেওতাই ওর ঘাড় মটকাবেন। দেওতা আমাদের উপর চটতে পারেন। শাস্তিও দিয়েছেন সেই জন্যে। কিন্তু এতদিনেও কি শাস্তি পুরো হল না?

    বললাম, শোনো, আমি এক্ষুনি সিতাওন উপত্যকার দিকে আবার যাব। আমার সঙ্গে যাবে মংলু?

    না সাহাব।

    শক্ত অথচ বিনয়ী গলার মংলু বলল।

    আমার জীবনের ভয় আছে। পাগল হয়ে গেলেই বা আমার বাল বাচ্চা কে দেখবে? আমরা তো বড়লোক নই!

    যাবেন না বোস সাহাব।

    রেঞ্জার মিশ্র আমার হাত ধরে বললেন।

    আমি বললাম, কী! টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরিতে বাস করেও আপনারা লেখাপড়া শিখে এমন আশ্চর্য সব দেবতা-ভূতের কথা বলেন কী করে, ভাবতেও পারি না। ওরা বলে বলুক, আপনিও?

    রেঞ্জারসাহেব চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে পড়লেন।

    বললেন, শুনুন সাহাব, আপনারা ভারী শহরে থাকেন, ইংল্যান্ড, আমেরিকা চষে বেড়ান, আর মাঝে-মাঝে শখ করে জঙ্গলে আসেন। আমরা, যারা, সারা জীবন জঙ্গলে-জঙ্গলেই কাটিয়ে দিলাম, আমরা যা বিশ্বাস করি, তা না করে উপায় নেই বলেই করি। ভূত বা দেওতা যেমন ফার্স্ট সেঞ্চুরিতে ছিল, তেমনি টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরিতেও আছে। এই জঙ্গলে-পাহাড়ে আছে। ফ্লুরোসেন্ট, হ্যালোজেন আর মাকারি-ভেপারের আলোতে তারা থাকে না। আপনি অনেক জানতে পারেন, সব জানেন না।

    ভূপতনারায়ণ মিশ্র রেঞ্জারসাহেব চলে যেতেই আমি উঠে চান করতে গেলাম। মালীর বউকে ফ্লাস্কে করে চা দিতে বললাম। সঙ্গে নিয়ে যাব। ফোর-সেভেন্টি ডাবল ব্যারেল রাইফেলটা বইতে বড়ই অসুবিধে। রাইফেলটা কিন্তু যুগলপ্রসাদ মালীকে দিয়ে গেছিল। থ্রি-সিক্সটি-সিক্স ম্যানলিকার শুনার রাইফেলটা পুল-থু দিয়ে পরিষ্কার করে ছ’টি নতুন সফট-নোজড গুলি বেছে রেখে, খাঁকি শর্টস আর ফুলশার্ট পরে বেরিয়ে পড়লাম।

    মালী আর মালীর বউ এসে হাত জোড় করে দাঁড়াল। বলল, হামলোঁগোকো কেয়া হোগা হুজৌর?

    কুছ নেহি হোগা। ম্যায় রাতমে লওটেঙ্গে, খানা কামরামে শো যনা তুম দোনো। খিচুড়ি বনাকে রাখনা হামারা লিয়ে। বন্দুকভি বগলমে রাখনা। ম্যায় গ্যায়া, ঔর আয়া।

    ওরা দু’জনে, জী মালিক! হাঁ মালিক! বলে উঠল।

    গেট পেরিয়ে, কাল যে পথে গিয়েছিলাম সেই পথেই গিয়ে পাকদণ্ডী ধরলাম। জায়গাটা চিনে গেছি। যুগলপ্রসাদ ভেবেছিল, আমার অতখানি হাঁটতে কষ্ট হবে, তাই সাইকেল করে নিয়ে গেছিল যতটা পারে। কিন্তু সে পথে অনেকই ঘোরা হয়ে ছিল।

    আজকে আমি একা। রাইফেলটা সঙ্গে আছে বটে, কিন্তু এটা কি কাজে লাগবে? অনেক জঙ্গলেই অনেক আশ্চর্য ব্যাপার ঘটতে দেখেছি কিন্তু আমার নিজেরই বন-বাংলোর পাশে, এমন গোছানো, সাহেবসুবো-ভরা মার্কিগঞ্জের মতন জায়গাতেও এমন ঘটনা যে ঘটতে পারে, তা অভাবনীয়। মার্কিগঞ্জে এতগুলো বন্দুক থাকা সত্ত্বেও এবং এত ভাল-ভাল শিকারি থাকা সত্ত্বেও কেন পাহানকে মারতে গেলেন না কেউ! অথবা গেলেও, কেন পারলেন না মারতে এখন একটু-একটু বুঝতে পারছি।

    প্রথমেই বাঘিনী-রহস্যটা ভেদ করতে হবে। তারপর ডগলাস-রহস্য।

    ভাবছিলাম যে, যে-ডগলাসকে, মানে তার অবশিষ্টাংশকে, আমরা তিনজনে মিলে কবর দিলাম, সে কিনা ডগলাস নয়! ডগলাস কিনা, তার শোওয়ার ঘরের স্কাইলাইটের সঙ্গে ঝুলে মরেছে। তবে যাকে কবর দিলাম সে কে? হাওয়া? কী করে হয়?

    যে-বাঘিনীর পেট কালকে ওঠা-নামা করতে দেখলাম পর্যন্ত গুহামতো জায়গাটায়, যে আমার রাইফেল পাহারা দিয়ে শুয়ে-শুয়ে আমার দিকে চেয়ে হাসছিল, সেই-ই বা কে? সেও কি হাওয়া? চোখের ভুল?

    আর বনদেবতার ভাঙা দেউলের মধ্যে ছোটবেলা থেকে বড় হয়ে ওঠা আমাদের সকলেরই এক সময়কার প্রিয় ল্যাংড়া পাহান? যাকে যেতে দেখলাম নিজের চোখে, যাকে হুডকু চোখে দেখেই গাদা বন্দুক দিয়ে গুলি করল, যার রক্তের ও পায়ের দাগ সিতাওন নদী অবধি এসেই মুছে গেছিল আশ্চর্যভাবে, সেই-ই বা কে? সেও কি বাঘ নয়? এত সব ভাবতে-ভাবতে মোহগ্রস্তর মতে সিতাওন নদীর দিকে চলতে লাগলাম। ডগলাসকে যেখানে খেয়েছিল সে-জায়গাটাও ঘুরে যাব, মন বলল।

    এপ্রিলের সকালবেলা আমাদের এদিককার বন-পাহাড় বড় সুন্দর দেখায়। পলাশ শিমুলের লাল পতাকা এখন দিগন্তে-দিগন্তে ওড়ে। মহুয়াও শেষ হয়নি এখনও। ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা একটা হাওয়া বইতে থাকে। বাতাসে মিষ্টি গন্ধ। ঘুম পেয়ে যায়।

    পাকদণ্ডী দিয়ে আসতে খুব তাড়াতাড়িই পৌঁছে গেলাম ডগলাসের লাশটা যেখানে পড়েছিল সেই জায়গাতে। সেখানে পৌঁছে, খুব সাবধানে এগোতে লাগলাম, রাইফেল হাতে। ওই নরখাদক বাঘের এতই কুখ্যাতি হয়েছে যে, এদিককার বনে বহুদিন হল কেউই আসে না। বহুদিন হল। তাই বাঘের সঙ্গে ফাঁকা জায়গাতে দিনের বেলাতেই হয়তো মোলাকাত হয়ে যেতে পারে। তবে, যে-জায়গাতে ডগলাসকে খেয়েছিল, সে জায়গাটা ফাঁকা আদৌ নয়। তাছাড়া ওই জায়গাটা দেখা দরকার। কিছুই যে বুঝতে পারছি না! ধাঁধার পরে ধাঁধা!

    সাবধানে আড়াল নিয়ে-নিয়ে নিঃশব্দে এগোতে লাগলাম।

    সেই জায়গাটার কাছাকাছি এসে, মনে হলো একটা আওয়াজ পেলাম। আমার নিশ্বাস দ্রুত পড়তে লাগল। পাথর ও গাছের আড়ালে আড়ালে ওই দিকেই এগোতে লাগলাম রাইফেল হাতে নিয়ে।

    কোনও জানোয়ার কড়মড়িয়ে কিছু খাচ্ছে। শব্দটির কাছাকাছি গিয়েই আড়াল নিয়ে বসে পড়লাম। একটা ময়ূর আমাকে দেখতে পেয়েই কেঁয়া-কেঁয়া-আ-আ করে ডেকে উঠল। ডাকতেই, দেখলাম একটা প্রকাণ্ড চিতাবাঘ মাথা উঁচু করে আমার দিকে তাকাল। রক্তে তার বুক, মুখ, গোঁফ, নাক সব লাল হয়ে গিয়েছিল। সে আমাকে দেখামাত্র এক লাফে ডানপাশে জঙ্গলে উধাও হল। তাকে মারারও কোনও ইচ্ছা আমার ছিল না। চিতাটা উধাও হতেই দু-পাশের গাছে এতক্ষণ অদৃশ্য ও নিথর হয়ে বসে থাকা শকুনগুলো একে-একে উড়ে এসে বসতে লাগল নীচে। চিতাটা কী খাচ্ছিল, তা দেখার জন্যে এগোতেই দেখি একটা বড় শিঙাল চিতল হরিণ। ভোরবেলার দিকে মেরেছে। কিন্তু দিনের বেলায় এরকম অপেক্ষাকৃত অগভীর জঙ্গলের জায়গায় মড়ির উপরে খোশমেজাজে বসে থাকবে চিতা, এটাও অভাবনীয়।

    এই জঙ্গলে এখন যা কিছুই ঘটেছে, সবই অভাবনীয় ব্যাপার-স্যাপার।

    পড়ে-থাকা এবং পেট-চেরা চিতলটার কাছে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কাল যে-পথে পাহানকে অনুসরণ করেছিলাম, সে পথেই নেমে গেলাম তাড়াতাড়ি।

    যখন সিতাওন নদীর পারে পৌঁছলাম, তখন প্রায় একটা বাজে। ক্লান্তও হয়ে গেছিলাম। সকালে যে বেরিয়েছি নাস্তা করে তারপর চলছি তো চলছিই। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডা ভাবটা চলে গেছে। তবে এসময়ে জঙ্গলে পথ চলতে তেমন কষ্ট হয় না। এত রঙের বাহার, চারদিকে এত ফুল, এত পাখির ডাকাডাকি, এত হরজাই বনগন্ধ যে, পথ যেন উড়িয়ে নিয়ে যায় এখন পথিককে।

    নদীর পারে একটা বড় অর্জুন গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে চা খেলাম। কালকের হ্যাঁভারস্যাকে স্যান্ডউইচ আর জলের বোতল কালকের জায়গাতেই পড়ে আছে দেখলাম। মানুষের কথা আলাদা, ও জিনিস কোনও জানোয়ারই ছোঁবে না, এক বাঁদর আর ভালুক ছাড়া। তাদের বিষমই কৌতূহল।

    কুলকুল করে জল বয়ে যাচ্ছে সিতাওন নদী দিয়ে। ওপাশের গভীর জঙ্গলের মধ্যে থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে এই দুপুর বেলাতেও।

    চা খেতে-খেতে এর পরে কী করা যায়, তাই-ই ভাবছিলাম। পাইপ ধরিয়ে, বুদ্ধির গোড়ায় একটু ধোঁয়াও দিয়ে নিলাম। কালকের রক্তের দাগ এবং থাবার দাগ আজও পেলাম। পুরনো হয়েছে, এই-ই যা।

    এমন সময় জঙ্গলের গভীর থেকে প্রচণ্ড জোরে বাঘ ডাকতে লাগল। মনে হল, যেন নদীর জলও সেই ডাকে ভয় পেয়ে আরও জোরে দৌড়তে লাগল। থার্মোফ্লাক্সটার মুখ বন্ধ করে ধীরেসুস্থে আমি আওয়াজের দিকে এগোলাম নদী পেরিয়ে। জুতো মোজা পরেই পেরোলাম। গরমের দিনে জুতো মোজা শুকোতে সময় লাগে না। বিশেষ করে গলফ-শু বা অন্য কাপড়ের জুতো। যতক্ষণ ভিজে থাকে, পায়ে আরামই লাগে। শব্দও কম হয়। জঙ্গলে ঢুকেই বুঝলাম কালকের ওই পাথরগুলোর দিক থেকেই আসছে আওয়াজটা। বাঘ একটা কি দুটো, তাও অজানা। কাল যেখানে বাঘ-বাঘিনীকে খেলা করতে দেখেছিলাম, সেখানে আজ গিয়ে পায়ের দাগ আছে কি নেই, তা দেখা হয়নি।

    অত্যন্ত সাবধানেই এগোতে লাগলাম। আধমাইল পথ, এ-ভাবে এক-পা এক-পা করে এগোতে কম সময় লাগল না এ-গাছের আড়াল থেকে ও-গাছের আড়ালে আড়ালে চলে। তারপর পাথরগুলোর কাছাকাছি আসতেই মস্ত একটা শালগাছের গুঁড়ির পেছনে একেবারে থিতু হয়ে বসলাম। ভাবলাম, জঙ্গলের কী বলার আছে শুনি।

    ঘন জঙ্গলের মধ্যে এ-গাছ থেকে ও-গাছে হাওয়ার দোলনায় দুলে সবুজ টুই, হলুদ বসন্ত এবং ব্রেইন-ফিভার পাখি আসছে-যাচ্ছে। অদূরেই একটা কাঠঠোকরা কাঠ ঠুকতে লাগল। বাঘের গর্জনে ভয় পেয়ে বোধহয় চুপ করে ছিল এতক্ষণ। কিন্তু বাঘ কোথায় আছে, বোঝা যাচ্ছে না। অথচ আছে, কাছেই। হাওয়ায় গন্ধ আসছে বাঘের গায়ের। দু-পাশের অনেক গাছে বাঘের নখ-আঁচড়ানোর দাগ স্পষ্ট। বাঘের শরীর থেকে যে, তীব্র-গন্ধী তরল মার্কার পিচকিরির মতো বাঘ ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ফেলে, তার এলাকা নির্দেশ করে, তারও গন্ধ আসছে, তীব্র।

    এমন সময়ে হঠাৎ একটা চাকুম-চাকুম আওয়াজ শোনা গেল। বাঘ কিছু খাচ্ছে।

    কিন্তু বাঘ একটা, না দুটো?

    নিশ্বাস বন্ধ করে প্রায় বুকে হেঁটে-হেঁটে আবার এগোলাম। একটা ঝোপের আড়ালে পৌঁছে, রোদ আর ছায়ার ডোরাকাটা শতরঞ্জির মধ্যে একেবারেই মিশে যাওয়া বাঘের ডোরাকাটা শরীরটা চোখে পড়ল। বাঘটা আমার দিকে পিছন ফিরে ছিল। তার ডান কাঁধের একটু নীচে একটা মস্ত ঘা। রক্ত জমে কালো হয়ে আছে। অথচ জিভ পৌঁছয় না বলে, জায়গাটা চাটতেও পারেনি। পোকাও বসছে উড়ে-উড়ে। আমার হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে গেল। এই যে মানুষখেকো পাহান, সে বিষয়ে সন্দেহ রইল না।

    কিন্তু খাচ্ছেটা কী সে?

    মানুষ?

    আবারও?

    এবার কোন মানুষ?

    ঠিক সেই সময়েই বাঘের মুখোমুখি মস্ত ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছটা থেকে অসংখ্য ধাড়ি-বাচ্চা, মাদি-মদ্দা বাঁদর একসঙ্গে ডেকে উঠল। আমার সঙ্গে বাঁদরের সর্দারের হঠাৎই চোখাচোখি হয়েছিল। ডেকে উঠল ওরা আসলে আমাকে দেখেই, কিন্তু বাঘ বিরক্ত হল, ভাবল ওকে দেখেই অমন করছে, কারণ ল্যাংড়া পাহানের মুখটা ওদের দিকেই ছিল। বাঘ উঠে দাঁড়িয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে, আবার প্রচণ্ড গর্জন করে উঠল। মনে হল কানের কাছে বাজ পড়ল। চ্যাঁ-চ্যাঁ-চ্যাঁ করতে করতে দু-তিনটে ছোট বাঁদর বাঘের বোমা-ফাটা গর্জনে ভয় পেয়ে হাত-আলগা হয়ে নীচে পড়ে গেল পাকা ফলের মতো, আর বাঘটা এক লাফে এগিয়ে গিয়ে দু-হাতে দু-থাপ্পড় মেরে দুটি বাঁদরকে সঙ্গে-সঙ্গে মেরে ফেলল। তৃতীয়টি চ্যাঁ-চ্যাঁ করতে করতে দৌড়ে গিয়ে আবার গাছে উঠল। উঠতে গিয়েও, তার হাত পা ভয়ে পিছলে-পিছলে যাচ্ছিল। সদ্য-মরা বাঁদর দুটোর শরীর তখনও থরথর করে কাঁপছিল।

    লাংড়া পাহান যখন উঠে দাঁড়াল, তখনই তার পায়ের ফাঁক দিয়ে দেখলাম, তার পায়ের কাছে একটা ময়ূর লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ে আছে। ভীষণ রোগা হয়ে গেছে পাহান।

    মনে হল, ওর স্বাভাবিক শিকার ধরতে পারে না বোধহয় অনেকদিন থেকেই ভাল করে। নইলে কি বেচারির শুধু মানুষ বা ময়ূর ধরেই খেতে হয়!

    এবার পাহান আমার দিকে ফিরবে। ময়ূর শেষ করে বাঁদর দুটোকে খাবে হয়তো। আমাকে দেখতে পেলে আর রক্ষে নেই। ছিঁড়ে-খুঁড়ে ছ্যাদরা-ভ্যাদরা করে দেবে। থ্রি-সিক্সটি-সিক্স রাইফেলটা না এনে, কেন যে, হেভি-বোরেরটা আনলাম না, তা মনে করে নিজের ওপর ভীষণ রাগ হতে লাগল। কিন্তু পাহান আমার দিকে ফেরবার আগেই আমি ঝোপের মধ্যে মড়ার মতো শুয়ে পড়লাম রাইফেলটাকে সামনে করে।

    পাহান ফিরে এসে, আবার ময়ুরটাকে খেতে লাগল। চাকুম-চাকুম শব্দ শুনে বুঝলাম, সে আবার পিছনে ফিরেছে। অত কাছ থেকে, একেবারে নিরুপায় না হলে, খুব হেভি রাইফেল দিয়েও বাঘের মুখোমুখি গুলি করতে নেই। করলে, বিশেষ করে বাঘ যদি শিকারিকে দেখে ফেলে, তবে মরবার আগেও তাকে একেবারে মণ্ড করে দিয়েই মরবে। কিছুক্ষণ সময় যেতে দিয়ে এবার আবার আস্তে-আস্তে মাথা তুললাম। পেছনের দু’পায়ে ভর দিয়ে সোজা হয়ে বসে সে ময়ূর খাচ্ছিল।

    ময়ূরের মতো সুস্বাদু হোয়াইট-মিট পৃথিবীতে নেই। কী চমৎকার কাবাব হত ময়ুরটার! আর পাহান তাকে কীভাবে খাচ্ছে!

    নষ্ট করার মতো সময় নেই আর। পাহান আমার কাছ থেকে খুব বেশি হলে, পনেরো গজ দূরে বসে আছে। রাইফেল তুলে, খুব ভাল করে তার ঘাড়ে এইম করলাম।

    এই রাইফেলটা আমার বড় প্রিয় রাইফেল। এ দিয়ে ওড়িশাতে আমি রোগ-বাইসনও মেরেছি।

    বুকের ওঠা-নামা একটু কমলে, নিশ্বাস বন্ধ করে ট্রিগারে চাপ দিলাম। রাইফেলের আওয়াজ গভীর বনে গমগম করে উঠল। এবং সঙ্গে-সঙ্গে, বাঁদরের দল এবং ভয়-পেয়ে-ওঠা নানা পাখির ডাকের আওয়াজের মধ্যে এক লাফ মেরে, পাহান সামনের জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গেল। বসা-অবস্থা থেকেই আহত এবং দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও বড় বাঘ যে কত বড় লাফ দিতে পারে, তা যারা নিজের চোখে না দেখেছেন, তাঁরা কল্পনাও করতে পারবেন না।

    ভেবেছিলাম, লাফ দিয়ে যেখানে পড়বে, সেখানেই মরবে। কিন্তু সে অবলীলায় আরও একটি লাফ দিয়ে ঝোপ-জঙ্গল ভেঙে জঙ্গলের আরও গভীরে অনেক দূরে চলে গেল।

    আমি হতবাক হয়ে বসে রইলাম। ব্যাপারটা সম্পূর্ণই অভাবনীয়। কিছুক্ষণ আমি ওখানেই বসে থাকলাম। তারপর মনে ও গায়ে জোর করার জন্যে আবার ফ্লাস্ক থেকে ঢেলে চা খেলাম একটু। পাইপও টানলাম কিছুক্ষণ। সফট-নোজড গুলিতে ওর শ্বাসনালি ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবার কথা ছিল। ঘাড়ও। মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যাওয়ার কথা ছিল। অত শর্ট-রেঞ্জে মারা! কী করে যে লাফের পর লাফ মেরে সে এত দূরে চলে গেল, সত্যিই তা ভেবে আমার বুদ্ধি আরও ঘোলা হয়ে গেল।

    মিনিট-পনেরো পর, সদ্য-আহত বাঘের রক্ত-ঝরিয়ে দুর্বল হয়ে যাবার সময় দিয়ে, ফ্লাস্কটা একটা ডালে ঝুলিয়ে রেখে, রাইফেল রেডি-পজিশনে ধরে আবার এগোলাম আমি।

    প্রথম লাফে যেখানে গিয়ে পড়েছিল পাহান, সেখানে এসে পৌঁছলাম। প্রথম লাফেই প্রায় পঁচিশ গজ এসেছে। রক্ত ছিটকে পড়েছে সেখানে পিচকিরির রঙের মতো। সেখান থেকে আরও সাবধানে এগোলাম। কিছুটা এগোতেই সেই পাথরের স্তূপ। সেখানে গিয়েই আশ্রয় নিয়েছে কি? খুবই সাবধানে সেখানে পৌঁছে দেখলাম, নাঃ। রক্তের দাগ নেই কোনও। আরও আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, সেই স্কুপের মাথার উপর কিছুটা টাটকা রক্ত পড়ে আছে। তার মানে, এক লাফে বাঘ ওই আহত অবস্থাতেও সেই পাথরের স্তূপটি পেরিয়ে গেছে। স্তূপটি কম করে দু-মানুষ উঁচু হবে।

    আস্তে-আস্তে খুবই সাবধানে ওই পাথরের স্তূপের উপর গিয়ে উঠলাম। উঠেই শুয়ে পড়লাম। নীচের সেই জংলি লতার নীল ফুলগুলি আমার দিকে অবাক চোখে নীরবে চেয়ে রইল।

    দম ফিরে পেয়ে, রাইফেলের নল সামনে করে, খুবই সাবধানে এবং অত্যন্ত আস্তে-আস্তে মাথা তুললাম। মাথা তোলবার সময়ে আমার রাইফেলের নলের সঙ্গে পাথরের ঘষা লেগে টং করে শব্দ হল একটা। সঙ্গে সঙ্গে দেখলাম, পাহান! আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল, সামনে যেখানে সে বসেছিল, সেখান থেকে বিদ্যুৎচমকের মতন উঠে বসে। ঘুরে দাঁড়িয়েই, লাফাবার জন্যে তৈরি হল। এ সমস্তই ঘটে গেল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। ওর সারা ঘাড় ও পিঠ রক্তে লাল হয়ে গেছিল। আর এক সেকেন্ডও দেরি না করে গুলি করলাম আমি একেবারে ওর বুক লক্ষ্য করে। পর পর দুটি গুলি করলাম। যাতে এবার আর কোনওরকর্ম ভেলকি না দেখাতে পারে ও। একবার ওঠার চেষ্টা করেই ল্যাংড়া পাহান পড়ে গেল। তারপর সামনের পা-দুটো জড়ো করে দু-থাবার উপরে মাথাটা রেখে যেন ঘুমিয়ে পড়ল।

    অনেক বছর আগে কোনও গুহার মধ্যে তাকে তার মা জন্ম দিয়েছিল। তখনও তার চোখ ফোটেনি। গুহার অন্ধকারে সে বোধ হয় এমনি করেই সামনের দু-পায়ের থাবার উপর মাথা রেখে তার জীবনের প্রথম ঘুম ঘুমিয়েছিল। তারপরও বন-দেওতার ভাঙা দেউলের চাতালে আর গভীরে সে এমনি করে কতবারই না ঘুমিয়েছিল! আর, আজ ঘুমোল শেষ ঘুম।

    মনটা খারাপ হয়ে গেল হঠাৎ। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে তার সব কীর্তিকলাপ মনে পড়ে যাওয়ায় আনন্দও হল খুব।

    আমি পাহাড়ের স্তূপ থেকে নেমে এসে, যেখানে ফ্লাক্সটা রেখেছিলাম সেখানে ফিরে এলাম। ওখানেই বসে আবার চা খেলাম। তারপর একটা শালগাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে অনেকক্ষণ শুয়ে-শুয়ে পাইপ খেলাম। কাল থেকে মনের মধ্যে যে টেনশান, টানটান শরীরের মধ্যে যে ক্লান্তি জমে উঠেছিল, সে সমস্ত সরে গেলে, শরীরের পেশী সব আবার ঢিলেঢালা বোধ করলে, ধীরেসুস্থে রাইফেলটা কাঁধের স্লিং-এ ঝুলিয়ে পাহানের কাছে ফিরে গেলাম। স্তূপটাকে বাঁ পাশে রেখে আন্দাজ-আন্দাজে জায়গাটাতে গিয়ে পৌঁছলাম। কিন্তু পাহান ঠিক কোথায় যে আছে, তা ঘন আগাছার জন্যে দূর থেকে ঠিক ঠাহর করতে পারলাম না।

    পাথরের স্তূপের উপর থেকে সব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। নীচের ঘন আন্ডারগ্রোথের জন্যে নীচে থেকে জায়গাটা ঠাহর করতে পারছিলাম না কিছুতেই। তাই আবার ফিরে গিয়ে পাথরের স্তূপটার উপরে উঠলাম। এবং উঠেই, প্রায় অজ্ঞান হয়ে গেলাম।

    পাহান নেই। না, পাহান যেখানে পড়েছিল, সেখানে তার চিহ্নমাত্র, নেই। তার রক্তে যেখানে মাটি ভিজে লাল হয়ে ছিল, ঠিক সেইখানে একটি লাল ফুলদাওয়াই-এর ঝাড় কে যেন পুঁতে দিয়ে গেছে। অজস্র লাল ফুলদাওয়াই ফুটে আছে তাতে, যেন, ঝাড়টি চিরদিন ওখানেই ছিল। সকালের হাওয়ায় ফুলগুলো দোলাদুলি করছে। সিতাওনের ওই উপত্যকাতে কোথাও ফুলদাওয়াই নেই। ফুলদাওয়াই ফোটে আলো যেখানে বেশি পড়ে, সেই সব জায়গায়। এখানে ফুলদাওয়াই-এর ঝাড় কোথা থেকে এল, কে জানে!

    আমার সমস্ত বুদ্ধি জড়ো করেও ব্যাপারটার কোনও কূল-কিনারা পেলাম না। হঠাৎ চারিদিকের গাছ থেকে নানা রকম পাখি, ময়ূর, বাঁদর, কাঠঠোকরার মিলিত আওয়াজ উঠল। এবং সেইরকম হঠাৎই ভীষণ জোরে হাওয়া বইতে লাগল জঙ্গলের মধ্যে শ্রাবণের ঝড়ের মতো, এই বৈশাখের ভোরে। অথচ আকাশে খটখটে রোদ। হাওয়াটা যে মিথ্যে নয়, বুঝলাম গাছগাছালি থেকে মরা কুটো, ফুল, পাতা সব উড়ে এসে যখন আমার গায়ে মাথায় পড়তে লাগল।

    সেই মুহূর্তে হঠাৎ আমার ভীষণ ভয় করতে লাগল। এত মানুষের নিজেদের পাওয়া ভয় এবং আমাকে দেখানো ভয় সবই যেন একসঙ্গে আমার বুকে ফিরে এল। মনে হল, অজ্ঞান হয়ে যাব আমি।

    দৌড়ে পাথরের স্তূপ থেকে নেমে যে পথে এসেছিলাম, সেই পথেই দৌড়ে ফিরতে লাগলাম। যেখানে ময়ূরের পালক ও লেজ পড়ে ছিল এবং মরা বাঁদরদুটো, সেখানে এসেও আরেকবার অবাক হলাম। কোনও চিহ্ন নেই তাদের। না রক্তের, না ছিন্নভিন্ন পালকের। না, কোনও কিছুরই চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। একঝাঁক লাল-কালো বন-মুরগি সেখানে চড়ে বেড়াচ্ছিল। আমাকে আসতে দেখেই কঁক কঁক করে উড়ে ছড়িয়ে গেল ঝুমকো-জবার মতো চারপাশে। ফুটে উঠল লাল কালো তারার মতো ফুল হয়ে আলোছায়ার ডোরাকাটা শূন্যে।

    আমি দৌড়তে লাগলাম। দৌড়ে নদী পার হলাম। তারপরও দৌড়তে লাগলাম। স্কুল কলেজের স্পোর্টস এবং ক্রিকেটের ফিল্ডিং করার পরে, এত জোরে এবং এতক্ষণ ধরে আমি কখনওই দৌড়ইনি। আমার পিছনে পিছনে আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে ভয়টা তাড়া করে আসতে লাগল। আমার মনে পড়ল, কোথায় যেন পড়েছিলাম বক্সার জো-লুই-এর কথা: You can run but you can not hide।

    ঘোরের মধ্যে দৌড়তে-দৌড়তে আমি বাংলোতে ফিরে এলাম। মালী হাওয়ায়-ঝরা মরা-পাতা ঝাঁট দিচ্ছিল বাংলোর সামনের হাতাতে। আমাকে ওইভাবে আসতে দেখেই চেঁচিয়ে সে তার বউকে ডাকল। ওর বউ দৌড়ে এসে দরজায় দাঁড়িয়ে আমাকে দেখেই কঁকিয়ে কেঁদে উঠল। কী দেখল, আমার মধ্যে তা ওই-ই জানে। ওরাই জানে। নিজে তো আমার মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। সে মুখ দেখার কোনও ইচ্ছাও ছিল না আমার।

    সোজা গিয়ে ঘরে ঢুকলাম। বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে শুয়ে পড়লাম।

    .

    কতক্ষণ বা কতদিন যে ঘুমিয়ে ছিলাম মনে নেই। ঘুম যখন ভাঙল তখন অনেকই বেলা। বালিশের তলা থেকে রিস্টওয়াচ টেনে বের করে দেখলাম, দুটো বাজে।

    বাইরে এসে দেখি, অনেকই লোক বসবার ঘরে, পেয়ারাতলিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গোমড়া মুখে বসে নিজেদের মধ্যে কী সব বলাবলি করছে। রেঞ্জার মিশ্রসাহেব, আমার পেয়ারের সব শিকারিরা, সকলেই আছেন ও আছে।

    মংলু বলল, আমার জন্যে চিন্তিত হয়ে ফিলফিলা থেকে হেকিমসাহেবকে আনবার জন্যে টাটুঘোড়া এবং বন্দুক সঙ্গে দিয়ে পাঁচজন লোক পাঠিয়েছেন রেঞ্জার সাহেব, যাতে মারিজের ইলাজের কোনও রকম ত্রুটি না হয়।

    কেমন আছেন? তবিয়ৎ ঠিকে না হ্যায় হুজৌর?

    ইত্যাদি সব প্রশ্নের জবাবে ভাল ভাল বললাম বটে সকলকেই, কিন্তু শরীর ভাল মোটেই ছিল না। মাথা ভার। কেউ যেন ঝিকা-গাছের ডাল দিয়ে আমাকে খুব পিটিয়েছে। বাইরে থেকে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। অথচ হাড়গোড়, মাংস যেন সব আলাদা হয়ে গেছে। তবু বনদেওতার কাছে খুবই কৃতজ্ঞ ছিলাম আমি। যা-কিছুই ঘটে গেল আমার জীবনে গত দু’দিনে, তার অনেক কিছুরই ব্যাখ্যা হয় না বুদ্ধি দিয়ে।

    মালী এসে বলল, কালকে আমরা সকলে পুজো চড়াতে যাব বনদেওতার থানে। মার্কিগঞ্জ এবং আশেপাশের বস্তির সমস্ত ঘর থেকে একজন করে যাবে।

    কোন থানে? উদাসীন গলায় আমি শুধোলাম।

    সিতাওনের উপত্যকার গভীরে যে থান আছে, সেই থানে। আপনি যাবেন তো? আমরা চাঁদা তুলছি সকলের কাছ থেকে।

    সিতাওনের উপত্যকার নাম শুনেই আমার গা ছমছম করে উঠল।

    বললাম, না। আমার যাওয়া হবে না। আজই বিকেলে আমি সিজুয়াবাগ থেকে বাস ধরে রাঁচী যাব। কাল কলকাতা চলে যাব। জরুরি কাজ আছে।

    আমি যে ভয় পেয়েছি, সেটা ওরা সকলেই বুঝল। আমিও ভয়টা গোপন করলাম না। গোপন করার প্রয়োজনও বোধ করলাম না।

    রেঞ্জারসাহেব পান-জর্দা খাওয়া ঘোরতর লাল ও কর্কশ একটা জিভ বের করে চুকচুক করে একটা শব্দ করলেন। সমবেদনা। বললেন, আপনি যে প্রাণে বেঁচে, পাগল-না-হয়ে, বোবা-কালা না হয়ে ফিরেছেন এইই ঢের।

    নিয়ামত অত্যন্ত নিষ্ঠুরের মতো বলল, পাগল বা বোবা কালা হয়ে যাওয়ার এখনও সময় যায়নি। যুগলপ্রসাদ তো কত পরে…।

    মংলু ওকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল।

    রেঞ্জার সাহেব বললেন, আপনি কলকাতায় ফিরে, কোনও ম্যাগাজিনে এই আশ্চর্য ঘটনা নিয়ে লিখুন। খবরের কাগজের লেটার্স ট্যু দ্য এডিটর কলামে চিঠি লিখুন।

    চুপ করে থাকলাম আমি।

    ভাবছিলাম, শহরের লোকে কতটুকু বোঝে বনকে? কতটুকু জানে বন সম্বন্ধে? কোথাওই এ গল্প ছাপা হবে না। উলটে আমাকেই পাগল বলবে, টিটকিরি দেবে। বলবে, মশাই, মানুষ যখন চাঁদে পা দেব-দেব করছে বিজ্ঞানের দৌলতে, তখন আপনি যত গাঁজাখুরি ভূতের গল্প চালাচ্ছেন?

    মিশ্রসাহেব যেন আমার মনের কথা বুঝতে পেরেই বললেন, ওঁরা ভগবান বা ভূত মানেন না বলেই কি ভূত-ভগবান নেই? মানুষের বড়ই গর্ব হয়েছে।

    মংলু খৈনি টিপতে টিপতে বলল, উও সব শহরবাঁলোকো লে আইয়ে না সাহাব হিয়েপর ইক মরতবা। ছোড় দিজিয়ে ল্যাংড়া পাহানকা হরকতকা সামনা। সামনা করনে দিজিয়ে। হুঃ সামনা! লম্বে-লম্বে বাঁতিয়া সব্বে বিত যায়েগা। ঘামণ্ড বিলকুল লুটা যায়েগা। বড়া হিম্মতদার ঔর পড়েলিখে শোচতা না উনলোগোঁনে খুদলোগোঁকো!

    নিয়ামত বলল, খুদা হাফিজ। কে জানে কী হবে? বনদেওতার অভিশাপ শহরের লোকের উপরও পড়বে। খরা হবে, ভূমিকম্প হবে, বন্যা হবে। বন, বনের প্রাণী নষ্ট করার অপরাধ বনদেওতা কখনও ক্ষমা করবেন না। আমাকেও না, আপনাকেও না, শহরের ওঁদেরও না।

    খুশি হয়ে-দেওয়া আমার মোটা চাঁদা নিয়ে ওরা সকলে চলে গেলেও, পেয়ারাতলিতে বসে ছিলাম একা। ভাবছিলাম, আমার বিদ্যা, শিক্ষা, আধুনিকতা, পৃথিবী-ভ্রমণের অভিজ্ঞতা, সব কিছুরই গর্বকে সিতাওনের উপত্যকাতে পুঁতে দিয়ে কলকাতার দিকে রওয়ানা হব আজ বিকেলে। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর, জঙ্গল সম্বন্ধে জ্ঞান, নিজের সাহস এবং রাইফেলের উপর সম্পূর্ণ আস্থাবান এই ঋজু বোস নামের মানুষটা এইখানেই মরে রয়ে গেল। এখন থেকে যুগলপ্রসাদ, হুডকু, বা মংলুর সঙ্গে আমার কোনওই তফাত রইল না। এক গভীর প্রচ্ছন্ন গর্ব ছিল আমার নিজের সম্বন্ধে। দেওয়াল ও মেঝে-জোড়া এইসব সার-সার ট্রফি…।

    ঘামণ্ড শব্দটার মানে, আমি যতটুকু জানি, তা হচ্ছে গর্ব, অহঙ্কার। ভাবছিলাম, মানুষখেকো ল্যাংড়া পাহানকে মারতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু আমার বুকের মধ্যের আলো-ছায়ায়, পাহাড়নদীতে সযতনে যে ঘামণ্ড শব্দটিকে এতদিন পুষে বড় করেছিলাম নিজের অজানিতে, সেই ভয়ঙ্কর মানুষখেকো শব্দটি যে বিনা-গুলিতে, বুকের মধ্যেই মরে গেল, এইটেই মস্ত বড় লাভ। পুরোপুরি ব্যক্তিগত লাভ।

    ডগলাস বলত, হোয়াটেভার হ্যাপেনস, হ্যাপেনস ফর গুড!

    হয়তো ও ঠিকই বলত।

    আমরা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলাম।

    .

    ঋজুদা পাইপটাকে আবার ভরল, কথা না বলে।

    ভটকাই হঠাৎ বলল, “There are many things in heaven and Earth, Horatio??…”

    আমি বললাম, চুপ কর। বেশি শেকসপিয়ার ফুটোস না।

    তিতির বলল, আমি চানে যাব।

    ঋজুদা বলল, আমিও। ব্রেকফাস্ট অ্যাট এইট-থার্টি। ডাইনিং রুমে।

    তিতির আর ভটকাই উঠে গেল। তিতির তিতিরের ঘরে আর ভটকাই আমার ঘরে।

    ঋজুদা পাইপটাতে আগুন দিয়ে বলল, ভটকাই কিন্তু শেকসপিয়ার আউড়ে খুব একটা অন্যায় করেনি। সত্যিই! কত কিছু থাকে এই ভূলোক দ্যুলোকে বুদ্ধিতে যার সত্যিই কোনও ব্যাখ্যা চলে না।

    আমি বললাম তুষারকান্তি ঘোষ মশায়ের বই ছিল না? বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে না এই নামে?

    ছিল বুঝি? আমি তো পড়িনি। পড়াস তো আমাকে কলকাতা ফিরে।

    বলেই, ঋজুদা উঠে পড়ে তার নিজের ঘরের দিকে এগোল।

    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ
    Next Article ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ২. ভালোবাসার শালিখ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.