Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    এইসব দিনরাত্রি – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প477 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০২. বাবু হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে

    বাবু হাত-পাছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে।

    ঘুমের মধ্যেই কী কারণে যেন তার নিচের ঠোঁট বেঁকে গেল। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল নীলু। কী অপূর্ব দৃশ্য! এমন মায়া লাগে! চোখে পানি এসে যায়, বুকের কাছটায় ব্যথা-ব্যথা করে। নীলুমৃদুস্বরে ডাকল, এই বাবু এই! বাবুর বাঁকা ঠোঁট আবার ঠিক হয়ে যাচ্ছে। আঁহ কেন এত মায়া লাগে? নীলু নিচু হয়ে তার কপালে চুমু খেল। কেমন বাসি শিউলি ফুলের গন্ধ বাবুর গায়ে। কী অদ্ভুত সেই গন্ধ!

    ভাবী।

    নীলু চমকে সরে গেল। কারো সামনে বাবুকে আদর করতে তার বড়ো লজ্জা লাগে। শাহানা হাসিমুখে দরজার পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

    বাবু জেগেছে ভাবী?

    নাহ্!

    জাগলেই আমাকে খবর দেবে। আমি কোলে নেব।

    ঠিক আছে, দেব।

    এ তো দেখি রাতদিনই ঘুমায়! এত ঘুমায় কেন?

    কি জানি।

    শাহানা এসে বসল বাবুর পাশে।

    কী ছোট ছোট কান দেখেছ? ইদুরের কানের মতো। তাই না ভাবী?

    হুঁ।

    ছোট কান যাদের, তাদের রাগ খুব বেশি হয়। ওর খুব রাগ হবে, মার চেয়েও ও বেশি রাগী হবে।

    নীলু কিছু বলল না। শাহানা বাবুর হাত ধরে বসে রইল। কিছুক্ষণ, তারপর ইতস্তত করে বলল, ওকে কোলে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে একটু বসব ভাবী?

    ঘুম ভাঙার আগেই?

    হুঁ।

    ঠিক আছে, নিয়ে যাও। এসো, আমি কোলে তুলে দিই।

    শাহানা হাত পেতে বসল। নীলু। ছোট একটা নিঃশ্বাস গোপন করল। বাবুকে সে খুব কম সময়ের জন্যেই কাছে পায়। ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই তার শাশুড়ি মনোয়ারা এসে বাবুকে নিয়ে যান।

    রোদ উঠলেই বাচ্চাকে তেল মাখাতে বসেন। তেল মাখানো এত প্রবল বেগে চলে যে নীলুর ভয়-ভয় লাগে। পট করে একটা নরম হাড় হয়তো ভেঙে যাবে। তেল মাখানোতেই শেষ নয়। তিনি নাক ঠিক করতে বসেন, দীর্ঘ সময় ধরে নাক টিপে টিপে ধরেন, যাতে ভবিষ্যতে বাচ্চার খাড়া নাক হয়। তারপর বুড়ো আঙুল দিয়ে থুতনিতে অল্প অল্প চাপ দেন। দীর্ঘ সময় ধরে। এরকম করলে বাচ্চার মুখ পরবর্তী সময়ে ফজলি আমের মতো হবে না।

    বেলা এগারটার দিকে বাবুর গোসল হয়। নীলুর খুব ইচ্ছা গোসলটি সে নিজে করায়, কিন্তু এখন পর্যন্ত সে সুযোগ পায় নি। এক দিন ভয়ে-ভয়ে বলেছিল, আমার কাছে দিন মা, আমি করিয়ে দিই।

    মনোয়ারা বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, তুমি এসব পারবে না। কানে পানি ঢুকবে। কান পচবে। তোমাকে যেটা করতে বলছি, সেটা কর। গরম পানি মিশিয়ে গোসলের পানিটাকে কুসুম গরম কর।

    পানি কুসুম গরম করাও একটা দীর্ঘ ঝামেলার কাজ। লাল প্লাষ্টিকের গামলায় নীলু। কেতলি থেকে গরম পানি ঢালে। মনোয়ারা হাত ড়ুবিয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন, এ কি কাণ্ড বৌমা! এ তো আগুন-গরম পানি! যাও, ঠাণ্ডা পানি এনে মেশাও।

    ঠাণ্ডা পানি মেশানোর পর তিনি আবার চেঁচিয়ে ওঠেন, এ তে দেখি বরফের মতো ঠাণ্ডা করে ফেললে। কোনো একটা কাজও কি ঠিক মতো পার না?

    গোসলের পরপরই বাচ্চার খিদে পায়। সেই দুধ খাওয়ানোর পর্বেও মনোয়ারা পাশে বসে থাকেন। নীলুর বড়ো লজ্জা লাগে। কিন্তু কোনো উপায় নেই।

    মনোয়ারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারটা ঠিকমতো হচ্ছে কি না সেদিকে লক্ষ রাখেন।

    এ কি বৌমা, বুকের সঙ্গে এভাবে চেপে ধরে আছ কেন? দম বন্ধ করে মারতে চাও নাকি? মাথাটা আরেকটু উঁচু করে ধর। আহ আঁচল ধরে এত টানাটানি করছ, কেন? এখানে পুরুষমানুষ কি কেউ আছে যে লজ্জায় মরে যাচ্ছে?

    দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর মনোয়ারা খানিকক্ষণের জন্যে ঘুমুতে যান। তখন আসেন নীলুর শ্বশুর হোসেন সাহেব। তিনি মাস ছয়েক হল রিটায়ার করেছেন। ঘরে বসে থাকার নতুন জীবনযাত্রায় এখনো নিজেকে পুরোপুরি অভ্যস্ত করে তুলতে পারেন নি। নানান ধরনের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করছেন। কোনোটিতেই সফল হন নি। ইদানীং হোমিওপ্যাথির বইটই খুব পড়ছেন। তাঁর ধারণা হয়েছে, হোমিওপ্যাথির পরে চিকিৎসাশাস্ত্রে এখনো কিছু তৈরি হয় নি। ঠিক মতো লক্ষণ বিচারটাই হচ্ছে আসল কথা।

    নীলু তার শ্বশুরকে খুবই পছন্দ করে। সব সময় চেষ্টা করে তাঁর জন্যে বাড়তি কিছু করতে। সেটা কখনো সম্ভব হয় না। বাঁধা আয়ের বড় সংসারে কারো জন্যে বাড়তি কিছু করা যায় না।

    দুপুরে মনোয়ারা ঘুমিয়ে পড়লে হোসেন সাহেব আসেন। দরজার বাইরে থেকে চাপা গলায় বলেন, টুনী কি ঘুমাচ্ছে বৌমা?

    জ্বি, বাবা। আসুন।

    তিনি এসে হাসিমুখে বিছানার পাশে বসেন। নিচুস্বরে ডাকেন, টুনি, টুনি। টুনটুনি, ঝুনঝুনি, খুনখুনি, শুনশুনি।

    বাবুর এখনো নাম ঠিক হয় নি। যখন যার যা ইচ্ছা তাই ডাকে।

    একমাত্র হোসেন সাহেব প্রথম দিন থেকে টুনি ডেকে আসছেন।

    এই নাম মনোয়ারার মোটেই পছন্দ নয়। প্রথম দিনেই তিনি বিরক্ত হয়ে বলেছেন, কী টুনি টুনি করছ? টুনি একটা নাম নাকি?

    টুনি নামটা খারাপ কি?

    টুনি নামের ছেলেপুলেরা বড়ো হয় না। টুনটুনি পাখির মতো ছোট থাকে।

    মানুষের বাচ্চা বড়ো হয়ে মানুষের মতোই হবে; কারো নাম হাতি রাখলেই সে হাতির মতো হবে নাকি?

    বাজে তর্ক করবে না।

    বাজে তর্ক কী করলাম?

    আমার সামনে তুমি টুনি ডাকবে না, ব্যস। যদি ডাকতে ইচ্ছা হয় আড়ালে ডাকবে।

    হোসেন সাহেব প্ৰায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্ত্রীর কাছে পরাজয় স্বীকার করে নেন। এই একটি ক্ষেত্রে করেন নি। দিনের মধ্যে বেশ কয়েক বার তিনি বেশ উঁচুস্বরেই ডাকবেন!——টুনি, টুনি! ব্যাপারটা উদ্দেশ্যমূলক। তিনি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে একটা চাল চালছেন। নিজের পছন্দের নামটি প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন। তাঁর সাধনা যে পূরোপুরি বিফলে যাচ্ছে, সেটা বলা ঠিক হবে না। তিনি ছাড়াও এ বাড়ির লোকজনও এক-আধা বার মনের ভুলে টুনি বলে ফেলছে। মনোয়ারা নিজেই একদিন বলেছেন।

    হোসেন সাহেবের ধারণা, এ-রকম ভুল এরা করতেই থাকবে এবং একসময় টুনি নামটিই স্থায়ী হবে।

    হোসেন সাহেব নিচু গলায় বললেন, দেখতে কার মতো হয়েছে বৌমা?

    বুঝতে পারছিনা তো। সবাই বলছে। ওর বাবার মতোই হয়েছে।

    শফিকের মতো হয়েছে? আরে না। শফিকের সাথে কোনো মিল নেই। তোমার সাথে কিছু মিল আছে। গায়ের রঙটা পেয়েছে তোমার শাশুড়ির। একেবারে গোলাপের মতো রঙ।

    নীলু হাসি গোপন করবার জন্যে মুখ অন্য দিকে ফেরাল। সে বুড়ো মানুষটির এই দুর্বলতাটা খুব ভালো জানে, ফাঁক পেলেই তিনি স্ত্রীর প্রসঙ্গে একটি প্রশংসাসূচক মন্তব্য করে নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। এখন যেমন হয়েছেন। নীলু বলল, চা খাবেন বাবা? এক কাপ চা করে দিই?

    দাও। চিনি দিও না। চিনিটা শরীরের জন্যে মারাত্মক ক্ষতিকর।

    তাই নাকি বাবা?

    হুঁ চিনি যেমন ক্ষতি করে, লবণও সে-রকম ক্ষতি করে। এই জন্যে প্রেসার হলে লবণ খাওয়া কমাতে বলে ডাক্তারেরা। সাদা রঙের সব খাদ্যদ্রব্যই শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর।

    নীলু হেসে বলল, দুধ? দুধও তো সাদা?

    হোসেন সাহেব অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বসে রইলেন। নীলুর নিজের কাছেই খারাপ লাগতে লাগল। দুধের প্রসঙ্গটা না তুললেও হত।

    আপনার চায়ে দুধ দেব বাবা?

    নীলু তার শ্বশুরকে খুব ভালো মতোই চেনে। লিকার চা এক চুমুক খেয়েই তিনি বলবেন, এক চামচ চিনি দাও তো মা। চিনি দেবার পর বলবেন, আধ চামচ দুধ ও দাও, কেমন কষা-কষা লাগছে চাটা। জাল বোধহয় বেশি হয়েছে।

    নীলু চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকে দেখল, হোসেন সাহেব বাবুকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। তিনি নীলুকে দেখে লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, হাত-পা নাড়ানাড়ি করছিল। ভাবলাম, উঠে পড়ে কিনা। কোলে নিতেই শান্ত।

    চা নিন বাবা।

    চায়ে চুমুক দিয়ে হোসেন সাহেব তৃপ্তির স্বরে বললেন, আহ ফাস ক্লাস চা হয়েছে মা, একটু বোধহয় চিনি দিয়েছ?

    এক চামচ দিয়েছি।

    ভালো করেছ। বিনা চিনির চা বিষের মতো লাগে।

    নীলু বলল, সিগারেট খাবেন? দেব?

    দেখি, দাও! তোমার শাশুড়ি উঠে না পড়লে হয়।

    উনার উঠতে দেরি আছে।

    নীলু ড্র্যার খুলে সিগারেটের প্যাকেট বের করল! হোসেন সাহেব এবং নীলুর মধ্যে এই গোপন ব্যাপার আছে! মনোয়ারা যখন ঘুমিয়ে থাকেন কিংবা বাইরে কোথাও যান, তখন হোসেন সাহেব ইতস্তত করে বলেন, বৌমা, দেখ তো শফিক তার সিগোরটের প্যাকেট ফেলে গেছে কিনা। ফেলে গেলে দাও একটা।

    শফিক সিগারেটের প্যাকেট ফেলে যাবার লোক না। নীল তার শ্বশুরের জন্যে সিগারেট আনিয়ে আলাদা লুকিয়ে রাখে। মাঝে মাঝে শফিকের ছোট ভাই রফিক সেখানে ভাগ বসায়।

    ভাবী, গোপন জায়গা থেকে একটা সিগারেট ছাড় তো।

    নীলু এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে, আমার কাছে নেই।

    দও না ভাবী, প্লিজ। এ-রকম কর কেন?

    উপায় নেই, দিতে হয়। রফিক আয়েস করে সিগারেটে টান দিয়ে বলে, তোমার চেহারা এত মায়া-মায়া, কিন্তু আচার-আচরণ এত কঠিন কেন?

    কঠিন কোথায়? দিলাম তো একটা।

    তুমি বলেই একটা দিলে, পৃথিবীর অন্য সব ভাবীরা গোটা একটা প্যাকেট আনিয়ে দিত।

    তাই নাকি?

    হ্যাঁ। এখন শোন ভাবী, তুমি তোমার মেয়েলি বুদ্ধি দিয়ে একটা সমস্যার সমাধান কর। একটা কঠিন সমস্যা।

    রফিক আজগুবি একটা সমস্যা হাজির করবে। সেই সমস্যার কোনো আগা নেই, মাথা নেই। যেমন, গত সপ্তাহেই সে গম্ভীর মুখে বলল, আচ্ছা! ভাবী, ধর একটা ছেলের একটা মেয়েকে পছন্দ হয়েছে। খুবই পছন্দ। রীতিমত লত যাকে বলে। এখন ছেলেটা মেয়েটাকে সেই কথাটা বলতে চায়, বা নিজের অনভূতির ব্যাপারটা মেয়েটাকে বুঝতে দিতে চায়। কী ভাবে সেটা করা উচিত?

    নীলু হাসিমুখে বলল, মেয়েটা কে?

    মেয়ে যেই হোক। তুমি সমস্যাটার সমাধান কর।

    ছেলেটা একটা চিঠি লিখবে কিংবা বলবে মুখে।

    তুমি একেবারে পাগল-ছাগলের মতো কথা বলছি ভাবী। আমি চাচ্ছি। একটা ইউনিক কিছু। যেখানে হাই ড্রামা থাকবে, সাসপেন্স থাকবে।

    তাহলে এক কাজ কর। মেয়েটার সামনে হঠাৎ বুকে হাত দিয়ে শুয়ে পড়। তারপর গড়গড়ি খেতে থাক। যখন চারদিকে লোকজন জমে যাবে এবং মেয়েটিও এসে পাশে দাঁড়াবে তখন ফিসফিস করে বল।

    একটা সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে তোমার কাছ থেকে এরকম ঠাট্টা-তামাশা আশা করি নি। মোষ্ট আনফরচুনেট।

    খুব সিরিয়াস নাকি?

    রফিক জবাব না দিয়ে উঠে পড়ে। ভাইয়ে ভাইয়ে এমন অমিল হয় কী করে, নীলু। প্রায়ই ভাবে। শফিকের সঙ্গে রফিকের কোনো মিল নেই। শফিক উত্তর মেরু হলে রফিক দক্ষিণ মেরু।

    শফিকের চরিত্রে হালকা কোনো ব্যাপারই নেই। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠবে। কনকনে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল সারবে। নাশতা খেয়ে অফিসের জন্যে তৈরি হবে। এক ফাঁকে শুধু বলবে-নীলু দেখ তো পত্রিকা এসেছে নাকি। সকালবেলা কথাবার্তা এই পর্যন্তই। তাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে হ্যাঁ হাঁ ছাড়া অন্য কোনো জবাব দেবে না।

    পারিবারিক সমস্যার ব্যাপারগুলি সে শুনবে খুব মন দিয়ে। কখনোই কোনো প্রশ্ন করবে না। সমস্যার সমাধান করবে এক লাইনে। নীলু। প্রথম দিকে বলত, কথা কম বল কেন? কথা বলতে কি তোমার কষ্ট হয়? শফিক বলত, না, কষ্ট হয় না।

    তাহলে? দিন-রাত মুখ বন্ধ করে থাক কী ভাবে?

    অন্যের কথা শুনতেই আমার বেশি ভালো লাগে।

    এটাও সত্যি নয়। সবাই মিলে হয়তো কথাবার্তা বলছে, হঠাৎ দেখা যাবে শফিক নিঃশব্দে উঠে চলে গেছে। যেন কোথাও তার কোনো ভূমিকা নেই।

    ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে, এই নিয়েও তার তেমন কোনো উৎসাহ নেই। শাহানা একবার বলল, ভাইয়া, তুমি তো কখনো বাবুকে কোলে নাও না। সে হেসে বলেছে, ছোট বাচ্চা, ঘাড় শক্ত হয় নি, এই জন্যেই নিই না। একটু বড়ো হোক।–বড়োসড়ো হলে দেখবি, কোল থেকে আর নামাব না। নীলুর প্রায়ই মনে হয় শফিকের ভেতর মায়া-মমতাটা বোধহয় একটু কম। একটু না, হয়তো অনেকটাই কম। নীলুর যখন এবোেরশন হল, কী ভয়াবহ অবস্থা। হাসপাতালেই কাটাতে হল। পনের দিনের মতো। এই পনের দিনে শফিক তাকে দেখতে গেল মাত্র তিন দিন। যেন বাইরের কোনো অল্প পরিচিতি আত্মীয় তাকে দেখতে গিয়েছে। চার-পাঁচ মিনিট বসেই উঠে দাঁড়িয়ে বলেছে, যাই নীলু?

    নীলুর চোখে প্রায় পানি এসে গিয়েছিল। সে কিছু বলল না। চোখের পানি গোপন করবার জন্যে অন্য দিকে তাকাল। শাহানা অবাক হয়ে বলল, এখনই যাবে কি ভাইয়া, এইমাত্র তো এলে!

    বসে থেকে করব কী?

    ভাবীর সঙ্গে গল্প কর।

    শফিক অবাক হয়ে বলেছে, কী গল্প করব?

    মানুষ এমন অদ্ভূত হয় কেন? প্রায় পাঁচ বছর হয়েছে তাদের বিয়ের। এই দীর্ঘ দিনে এক বারও সে বলে নি-নীলু, এই নাও তোমার জন্যে একটা শাড়ি কিনলাম।

    এই যে সংসারে নতুন একটি বাবু এসেছে—সবার মধ্যে কত আনন্দ, কত উত্তেজনা, অথচ শফিক নিবিকার। রাতের খাওয়াদাওয়া চুকে গেলে ঘণ্টাখানিক বারান্দায় চুপচাপ বসে থাকবে, তারপর অত্যন্ত সহজভাবে ঘুমুতে যাবে। নীলু। মাঝে মাঝে কথাবার্তা চালাবার চেষ্টা করে।

    বাবুর জন্যে কোনো নামটাম ভেবেছ?

    তোমরাই ঠিক কর একটা।

    বাবা টুনি রাখতে চান। টুনি কেমন লাগে তোমার?

    ভালোই তো। টুনিই রাখ।

    মার টুনি নাম একেবারেই পছন্দ না। বাবার সঙ্গে এই নিয়ে তাঁর লেগে যাচ্ছে।

    শফিক হাই তুলে বলে, সামান্য একটা নাম নিয়ে এত ঝামেলা কেন?

    নামটাকে এত সামান্য ভাবছ কেন? সারা জীবন এটা থাকবে। এক জীবনে কত লক্ষ লক্ষ মানুষ তাকে এই নামে ডাকবে। নামটা তো একটা গুরুত্বপুর্ণ জিনিস। ঠিক না?

    হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। তুমি মাঝে মাঝে খুব গুছিয়ে কথা বল।

    নীলুর আরো কত কথা বলতে ইচ্ছা করে। কিন্তু শফিকের নিঃশ্বাস অল্প সময়ের মধ্যেই ভারি হয়ে ওঠে।

    সে ইদানীং খুব পরিশ্রম করছে। জয়দেবপুরে তাদের নাকি কি কনস্ট্রাকশন হচ্ছে। রোজ তিনটার সময় মতিঝিল থেকে চলে যেতে হয় জয়দেবপুরে। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত নটা-দশটা। খাওয়াদাওয়া শেষ করে বিছানায় যেতে-না-যেতেই ঘুম।

     

    নীলুর ঘুম কমে গেছে। অনেক রাত পর্যন্ত সে জেগে থাকে। ঘরে একটা জিরো পাওয়ারের বান্ধ জ্বলে সারা রাত। নামেই জিরো পাওয়ার, আসলে বেশ আলো। স্পষ্ট সবকিছু দেখা যায়! সে প্রায়ই চুপচাপ বসে বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। এত ভালো লাগে তাকিয়ে থাকতে; লাল কম্বলের ফাঁকে টুকটুকে ফর্স একটা মুখ। ভাগ্যিস মেয়েটি তার মতো কালো হয় নি। ওর চাচার রং পেয়েছে। নীলুর মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে সারা রাত বাবুকে কোলে নিয়ে বসে থাকতে। সে তার মেয়ের সঙ্গে মৃদুস্বরে কথাবার্তাও বলে, কি হয়েছে সোনামনি। ওমা ওমা, ঠোঁট বাঁকা করছে কেন আবার, স্বপ্ন দেখছি মা? ভয়ের স্বপ্ন? দূর বোকা মেয়ে, এই তো আমি পাশে। এই তো তোমার হাত ধরে বসে আছি।

    উষ্ণ একটি শয্যা। এক পাশে মা, অন্য পাশে বাবা, তবু ছোট বাবু মাঝে মাঝে ভয় পেয়ে বা অন্য কোনো কারণে চেঁচিয়ে কেঁদে ওঠে। সে কান্না সহজে থামে না।

    মনোয়ারা উঠে দরজায় ধাক্কা দেন, কী হয়েছে, এই বৌমা?

    কিছু না মা, এমনি কাঁদছে।

    আহ্ দরজাটা খোল না। দেখি কী ব্যাপার।

    শফিক ঘুম-ঘুম চোখে দরজা খুলে দেয়। মনোয়ারা বিরক্ত স্বরে বলেন, নিশ্চয়ই পিঁপড়া কামড়েছে। কত বার বলি-শোবার সময় বিছানার চাদর ভালো করে ঝাড়বে। কোনো একটা কাজও ঠিকমতো করতে পার না কেন?

    পিঁপড়া খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু দুটি মশা পাওয়া যায়। রক্ত খেয়ে লাল হয়ে আছে।

    বৌমা, শোবার আগে মশারিটাও দেখে নিতে পার না?

    বাচ্চা কাঁদতেই থাকে। হোসেন সাহেব টর্চ হাতে উপস্থিত হন। গম্ভীর গলায় বলেন, পেট ব্যথা। পেট ব্যথার কান্না এ-রকম থেমে থেমে হয়। এক ডোজ আর্নিকা টু হানড্রেড খেলে আরাম হবে।

    মনোয়ারা চোখ লাল করে তাকাতেই তিনি চুপ করে যান। চটি ফটফট করতে করতে রফিক এসে উপস্থিত হয়।

    বড্ড বেশি ক্রাইং হচ্ছে। হোয়াট হ্যাপেণ্ড? দেখি, আমার কোলে দাও তো ভাবী। এক মিনিটের মধ্যে কুল ডাউন করে দিচ্ছি।

    মনোয়ারা ধমকে ওঠেন, ভ্যাজর ভ্যাজর করিস না। যা এখান থেকে।

    আমি অসুবিধা কী করলাম? এ রকম শকুন চক্ষুতে আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন?

    কান্না যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল, তেমনি হঠাৎ করে থেমে যায়। বাবু হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমুতে শুরু করে। কে বলবে এই কয়েক মিনিট আগেই সে রীতিমতো একটা বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলেছিল।

    রফিক হাই তুলে বলে, কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে, এখন ঘুমানো মুশকিল হবে। এক কাপ চা খেলে মন্দ হত না। কি বল ভাবী?

    নীলু জবাব দেয় না। হোসেন সাহেব ক্ষীণস্বরে রফিককে সমর্থন করেন।

    দুধ চিনি ছাড়া হালকা লিকারের এক কাপ চা খাওয়া যায়। আইডিয়াটা খারাপ না।

    মনোয়ারা রাগী গলায় বলেন, ঘুমুতে আসা। রাত দুটোর সময় চা বানাতে হবে? মাথাটা খারাপ হয়েছে নাকি?

    হোসেন সাহেব ঘুমুতে যান। নীলু। সত্যি সত্যি, রাত দুটোর সময় চা বানাতে যায়। চারদিকে শুনশান নীরবতা। গ্যাসের চুলার নীল আগুন জ্বলছে। বিজবিজ শব্দ হচ্ছে কেতলিতে। কেন জানি অন্য রকম একটা ভাব আসে নীলুর মনে। অন্য এক ধরনের আনন্দ। পৃথিবীটাকে বড়ো সুন্দর মনে হয়। ছোটখাট দুঃখ তো থাকবেই, তবু সব কিছু ছাড়িয়ে আমাদের চারদিকে গভীর একটা আনন্দ আছে। এটা যে আছে, তা সব সময় ধরা পড়ে না। কিছু রহস্যময় মুহূর্তেই শুধু ধরা পড়ে।

    গাঢ় আনন্দে নীলুর চোখ ভিজে ওঠে। সে গায়ের চাদর দিয়ে চোখ মোছে। রফিক চায়ের তাগাদা দিতে এসে দৃশ্যটি দেখে থমকে দাঁড়ায়।

    কাঁদছ কেন ভাবী?

    কাঁদছি না।

    রফিক ইতস্তত করে বলল, এ বাড়ির আমরা সবাই তোমাকে খুব ভালবাসি, এই কথাটা কি তুমি জান?

    জানি।

    এর পরও যদি দুপুর রাতে একা একা কাঁদ, তাহলে খুব মন খারাপ হয়ে যায়। আর কাঁদবে না।

    নীলু হাসল।

    তুমি যদি চাও তাহলে একটা খুব মজার গল্প বলে তোমাকে হাসাবার চেষ্টা করতে পারি।

    রফিক কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক থেকে মৃদুস্বরে বলল, কাল ভোরে তুমি আমাকে এক শটা টাকা দিতে পোর? ধারা। আমি দুই সপ্তাহের মধ্যে ফেরত দেব। অনেষ্ট।

    এইটা তোমার মজার গল্প?

    মজার গল্পটা একটু পরে বলছি। আগে সমস্যার কথাটা বলে নিই। ভাবী, পারবো?

    এক শ পারব না। পঞ্চাশ দিলে হয়?

    বাকি পঞ্চাশ পাব কোথায়?

    খুব যদি দরকার হয়, তাহলে তোমার ভাইকে বলে দেখতে পারি। বলব?

    বল। তবে ভাবী, আমার কথা বলতে পারবে না। বলবে, তোমার নিজের দরকার।

    ঠিক আছে, বলব! এখন শোনাও তোমার হাসির গল্প।

    তারা দু জন চায়ের কাপ হাতে বসার ঘরে এসে বসল। রফিক তার নতুন গজানো দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে গল্প শুরু করল:

    এক লোক মসজিদে গেছে নামাজ পড়তে। বদনায় পানি বেশি ছিল না, কাজেই একটি মাত্র পা ধোয়া গেল।

    নামাজ যখন শুরু হল তখন দেখা গেল ঐ লোক বকের মতো এক পায়ে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছে। অন্য পা-টি গুটিয়ে রেখেছে। তখন ইমাম…

    এই পর্যন্ত শুনেই নীলু মুখে শাড়ির আঁচল গুঁজে হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ল। রফিক বিবক্ত স্বরে বলল, গল্প না-শুনেই হাসছ যে। সবটা শুনে নাও। মেয়েছেলেদের সাথে হাসির গল্প বলাও একটা মুসিবত। না শুনেই হাসি। হোয়াট ইজ দিস?

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএকটি সাইকেল এবং কয়েকটি ডাহুক পাখি – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই বসন্তে – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    এই মেঘ, রৌদ্রছায়া – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    একটি সাইকেল এবং কয়েকটি ডাহুক পাখি – হুমায়ূন আহমেদ

    December 23, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Our Picks

    আসমানীরা তিন বোন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    ইস্টিশন – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025

    উড়ালপঙ্খী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }