Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    এই আমি – হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ এক পাতা গল্প116 Mins Read0
    ⤶

    এই আমি

    এই আমি

    আমার বড় মেয়ে তার কলেজে একটা কোয়েশ্চেনীয়ার জমা দেবে। সেখানে অনেকগুলি প্রশ্নের ভেতর একটা প্রশ্ন হচ্ছে – “তােমার প্রিয় ব্যক্তি কে?” সে লিখলো, ‘আমার মা’।

    আমি ভেবেছিলাম সে লিখবে – বাবা।

    আমার সব সময় ধারণা ছিল আমার ছেলেমেয়েরা আমাকে খুব পছন্দ করে। অন্তত তাদের মা’র চেয়ে বেশি তাে বটেই। করারই কথা, আমি কখনাে তাদের বকা-ঝকা করি না। অথচ তাদের মা এই কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে করছে –

    “বাথরুম ভেজা কেন?”
    “সন্ধ্যা হয়ে গেছে, পড়তে বসনি। পড়তে বােস।”
    “টুথপেস্টের মুখ লাগানো নেই, এর মানে কি?”
    “বন্ধুর সঙ্গে এতক্ষণ টেলিফোনে কথা কেন?”
    “ফ্রকে ময়লা কি ভাবে লাগলো?”
    “মাছ তাে গোটাটাই ফেলে দিলে। বােন-প্লে থেকে তুলে এনে খাও। তােল বলছি। তােল।”

    এই সব যন্ত্রণা আমি তাদের দেই না। খাবার টেবিলে আমি ওদের সঙ্গে মজার মজার গল্প করি। ভিডিও ক্লাবে কোন ভাল ছবি পাওয়া গেলে সবাইকে নিয়ে এক সঙ্গে দেখি। তারচেয়েও বড় কথা, এমন সব কাণ্ড-কারখানা মাঝে মাঝে করি যা বাচ্চাদের কল্পনাকে উজ্জীবিত করবেই। যেমন শহীদুল্লাহ হল-এ যখন থাকতাম তখন ভরা জোছনার রাতে বাচ্চাদের খুম থেকে তুলে পুকুরে গােসল করতে নিয়ে যেতাম। বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে সবাইকে নিয়ে পানিতে ভেজা তাে আমার চিরকালের নিয়ম। সব সময় করছি। যে মানুষটি এমন সব কাণ্ডকারখানা করে সে কেন প্রিয় হবে না? আমার বড় মেয়ের কোয়েশ্চেনীয়ার দেখে হঠাৎ করে আমার মনে হল আমি কি এদের কাছ থেকে দূরে সরে গেছি? যদি দূরে সরে গিয়ে থাকি তাহলে তা কখন ঘটলো ?

    সারাদিন নানান কাজে ব্যস্ত থাকি। ইউনিভার্সিটির কাজ, নাটকের কাজ, লেখার কাজ। এর ফাকে ফাকে লোক আসছে। প্রকাশকরা আসছেন লেখার তাগাদা নিয়ে। এসেই চলে যাচ্ছেন না, বসছেন, গল্প করছেন। চা খাচ্ছেন। নাটকে অভিনয় করতে ইচ্ছুক তরুণ-তরুণীরা আসছে। যে ভাবেই হােক তাদের টিভি নাটকে সুযোগ দিতে হবে। আমার গল্প-উপন্যাস পড়ে খুশি হয়েছে এমন লােকজন আসছে। খুশি হয়নি এমন লােকজন আসছে। আসছে পত্রিকা অফিসের মানুষ। কেউ বুঝতে পারছে না, আমি ক্লান্ত ও বিরক্ত। আমার বিশ্রাম দরকার, নিরিবিলি দরকার। আমার অনেক দূরে কোথাও চলে যাওয়া দরকার। আমার সবটুকু সময় বাইরের লোজজন নিয়ে নিচ্ছে । আমার ছেলেমেয়েদের জন্যে, আমার স্ত্রীর জন্যে একটুও সময় আলাদা নেই।

    একটা শট ফিল্ম বানাচ্ছি। সেই ছবির শ্যুটিং এর কারণে এক সপ্তাহের জন্যে বাইরে যেতে হল। যাবার আগ মুহূর্তেও লােকজন এসে উপস্থিত। তাদেরকে বিদেয় করতে করতে অনেক দেরি হয়ে গেল। ট্রেন মিস করব। ছুটে গিয়ে গাড়িতে উঠলাম। ড্রাইভারকে বললাম, খুব স্পীডে চালাও। ড্রাইভার উল্কার গতিবেগে ছুটল। আর তখন মনে হল, আসার সময় বিদেয় নিয়ে আসা হয়নি। বাচ্চারা হয়ত মনে মনে অপেক্ষা করছে, রওনা হবার আগে আমি বলব – বাবারা, যাই কেমন? সেটা বলা হয়নি। তারা দেখছে অসম্ভব ব্যস্ত এক মানুষকে। একে তারা হয়তো ভালমত চেনেও না। একজন অতি-চেনা মানুষ এম্নি করেই আস্তে আস্তে অচেনা হয়ে যায়। সম্ভবত আমিও অচেনা হয়ে গেছি। তবু ক্ষীণ আশা নিয়ে একদিন মেঝে মেয়েকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গেলাম। গলা নিচু করে কথা বলছি যেন অন্য কেউ কিছু শুনতে না পায়।

    “কেমন আছ গো মা?”
    “খুব ভাল, না মোটামুটি ভাল?”
    “খুব ভাল।”
    “এখন বল দেখি তােমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ কে ?”
    “কোন প্রিয় মানুষ নেই বাবা।”
    “না থাকলেও তাে এমন মানুষ আছে যাদের তােমার ভাল লাগে। আছে না?”
    “মা তোমার সবচেয়ে প্রিয়?”
    “হু–মা।”
    “আর কেউ আছে?”
    “আর ছােট চাচী।”
    “আর কেউ?”
    “শাহীন চাচা।”

    আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম লিস্ট লম্বা হচ্ছে – কিন্তু সেই দীর্ঘ লিস্টে আমার নাম নেই। আমাকে সে হিসেবের মধ্যেই আনছে না। এ রকম কেন হবে। দু’দিন আমি খুব চিন্তা করলাম। ভেবেছিলাম ব্যাপারটা নিজের মধ্যেই রাখবো। আমার স্ত্রী গুলতেকিনকে জানাব না। এক রাতে তাকেও বললাম। সে বললো, “কি অদ্ভুত কথা বলছো? বাচ্চারা তােমাকে অপছন্দ করবে কেন? তুমি ওদের খুবই প্রিয়।”
    “তুমি আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে বলছো?”
    “মােটেই না। আমার ধারণা তােমার মত ভালো বাবা কমই আছে।”
    “সত্যি বলছো?”
    “হ্যা সত্যি। শীলার দুধ খাওয়ার ব্যাপারটা মনে করো। ক’জন বাবা এরকম করবে? শীলার দুধ খাওয়ার কথা মনে আছে?”
    “আছে।”

    আমার মেয়ের দুধ খাওয়ার গল্পটা বলি তার কাছে এই পৃথিবীর সবচেয়ে অপছন্দের খাবার হল দুধ। দুধের বদলে তাকে বিষ খেতে দেয়া হলেও সে হাসিমুখে খেয়ে ফেলবে। সেই ভয়াবহ পানীয় তাকে রােজ বিকেলে এক গ্লাস করে খেতে হয়। আমি আমার কন্যার কষ্ট দেখে, এক বিকেলে তার দুধ চুমুক দিয়ে খেয়ে ফেললাম! তাকে বললাম, মাকে বলিস না আমি খেয়েছি। এরপর থেকে রােজ তার দুধ খেতে হয়। এক সময় নিজের কাছেও অসহ্য বােধ হল। তখন দু’জন মিলে মুক্তি করে বেসিনে ফেলে দিতে লাগলাম। বেশিদিন চালানাে গেল না। ধরা পড়ে গেলাম।

    বাবা হিসেবে আমি যা করেছি তা আদর্শ বাবার কাজ না। তবে শিশুদের পছন্দের বাবার কাজ তাে বটেই। গুলতেকিন আমার কন্যার দুধের গল্প মনে করায় আমার উদ্বেগ দূর হল। আমি মােটামুটি নিশ্চিত হয়েই ঘুমুতে গেলাম। যাক, আমি খারাপ বাবা নই একজন ভাল বাবা। তবু সন্দেহ যায় না।

    পরদিন ছােটমেয়ে বিপাশাকে আইসক্রীম খাওয়াতে নিয়ে গেলাম। সে বিস্মিত, তাকে একা নিয়ে যাচ্ছি। অন্য কাউকে নিচ্ছি না। ব্যাপারটা কি ?

    তাকে ডলসি ভিটায় কোন আইসক্রীম কিনে ফিস ফিস করে বললাম, “আচ্ছা মা বল তাে, কাকে তােমার বেশি পছন্দ ? তােমার মা’কে, না আমাকে?”
    সে মুখভর্তি আইসক্রীম নিয়ে বললো, “তােমাকে”।
    তার বলার ভঙ্গি থেকে আমার সন্দেহ হল। আমি বললাম, “তােমার মা শিখিয়ে দিয়েছে এরকম বলার জন্যে, তাই না?”
    “হুঁ।”
    “সে আর কি বলেছে ?”
    “বলেছে–বাবা যদি তােমাদের জিজ্ঞেস করে কে সবচেয়ে প্রিয় তাহলে আমার নাম বলবে না, তােমার বাবার নাম বলবে। না বললে সে মনে কষ্ট পাবে। লেখকদের মনে কষ্ট দিতে নেই।”

    সত্যকে এড়ানাে যায় না, পাশ কাটানাে যায় না। সত্যকে স্বীকার করে নিতে হয়। আমি স্বীকার করে নিলাম। নিজেকে বুঝালাম – আমার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা যে কোন ব্যস্ত বাবার ক্ষেত্রেই ঘটবে। একদিন এই ব্যস্ত বাবা অবাক হয়ে দেখবেন এই সংসারে তার কোন স্থান নেই। তিনি সংসারের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। সংসারও তার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। এই এক আশ্চর্য খেলা।

    এই খেলা আমাকে নিয়েও শুরু হয়েছে। আমি একা হতে শুরু হতে করেছি। বন্ধু-বান্ধব কখনােই তেমন ছিল না। এখন আরো নেই। যারা আসেন কাজ নিয়ে আসেন। কাজ শেষ হয়, সম্পর্কও ফিকে হতে শুরু করে। পুরানাে বন্ধুদের কেউ কেউ আসেন তখন হয়তো লিখতে বসেছি। লেখা ছেড়ে উঠে আসতে মায়া লাগছে। তবু এলাম। গল্প জমাতে পারছি না। সারাক্ষণ মাথায় ঘুরছে – এরা কখন যাবে? এরা কখন যাবে? এরা এখনো যাচ্ছে না কেন?

    যে আন্তরিকতা, যে আবেগ নিয়ে তারা এসেছেন আমি তা ফেরত দিতে পারলাম না। তারা মন খারাপ করে চলে গেলেন। আমিও মন খারাপ করেই লিখতে বসলাম। কিন্তু সুর কেটে গেছে। লেখার সঙ্গে আর যােগসূত্র তৈরি হচ্ছে না। যে চরিত্ররা হাতের কাছে ছিল তারা দূরে সরে গেছে। তবু তাদের আনতে চেষ্টা করছি। অনেক কষ্টে কয়েক পৃষ্ঠা লেখা হল। ভাল লাগলো না। ছিড়ে কুচি কুচি করে ঘুমুতে গেলাম! মাথা দপ দপ করছে, ঘুম আসছে না। চা খেলে হয়ত ভালো লাগবে। গভীর রাতে কে চা বানিয়ে দেবে? রান্নাঘরে গিয়ে নিজেই খুটখাট করছি । গুলতেকিন এসে দাঁড়াল। ঘুম ঘুম চোখে বললো, “তুমি বারুদায় বস, আমি চা বানিয়ে আনছি।”

    সে শুধু আমার জন্যে চা আনলো না, নিজের জন্যেও আনলো। আটতলা ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে দুজনে চুক চুক করে চা খাচ্ছি। আমি খানিকটা লজ্জিত বােধ করছি। আমার কারণে এত রাতে গুলতেকিনকে উঠতে হল। লজ্জা কাটানোর জন্যে অকারণেই বললাম, “চা খুব ভাল হয়েছে। একসেলেন্ট।
    সে কিছু বললো না।
    আমি বললাম, “একটা লেখা মাথায় চেপে বসে আছে, নামাতে পারছি না। কি করি বল তাে?”
    সে হালকা গলায় বলল, “লাঠি দিয়ে তােমার মাথায় একটা বাড়ি দেই, তাতে যদি নামে তাে নামলো। না নামলে কি আর করা।”
    আমরা দুজনেই হেসে উঠলাম। এতে টেনশন খানিকটা কমল। আমি বললাম, “গল্পটা কি শুনতে চাও?”
    “বল।”
    আমি বুঝতে পারছি তার শােনার তেমন আগ্রহ নেই। সারাদিনের পরিশ্রমে সে ক্লান্ত। ঘুমে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তারপরেও আমাকে খুশি করার জন্যে জেগে থাকা। আমি প্রবল উৎসাহে গল্পটা বলতে শুরু করেছি–
    — “মতি নামের একটা লোক। তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। গ্রামের লােকজন মিলে ঠিক করেছে খেজুরের কাঁটা দিয়ে তার দুটা চোখই উপড়ে ফেলা হবে।”
    — “মতির চোখ তােলা হবে কেন? সে কি করেছে ?”
    — “এখনাে ঠিক করিনি সে কি করেছে। তবে গ্রামবাসীর চোখে সে অপরাধী তাে বটেই, নয়ত তার চোখ তােলা হবে কেন? তাকে ভয়ংকর কোন অপরাধী হিসেবে আমি দেখাতে চাই না। ভয়ংকর অপরাধী হিসেবে দেখালে আমার পারপাস সার্ভড হবে না।”
    — “তোমার পারপাসটা কি?”
    — “চোখ তােলার ব্যাপারটা যে কি পরিমাণ অমানবিক সেটা তুলে ধরা। এমনভাবে গল্পটা লিখবো যেন যেন ”
    — “যেন কি ?”
    — “তোমাকে ঠিক বুঝতে পারছি না। মানে ব্যাপারই হল কি ”

    গুলতেকিনকে বলতে বলতে গল্প লেখার আগ্রহ আর বোধ করতে লাগলাম। আমার মনে হতে লাগল, এক্ষুণি লিখে ফেলতে হবে। এক্ষুণি না লিখলে আর লিখতে পারব না। আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে বারান্দায় বসে আছি। আকাশে এক ফালি চাদও আছে। বারান্দায় সুন্দর জোছনা। অথচ এই জোছনায় আমি গুলতেকিনকে দেখছি না। দেখছি তার জায়গায় মতি মিয়া বসে আছে। তাকে দড়ি দিয়ে বাধা হয়েছে। সে অসহায়ভাবে তাকাচ্ছে আমার দিকে। চোখের দৃষ্টিতে বলছে – “আমার ঘটনাটা লিখে ফেললে হয় না? কেন দেরি করছেন?”
    আমি ক্ষীণ গলায় ডাকলাম, “গুলতেকিন।”
    “কী?”
    “ইয়ে, তুমি কি আরেক কাপ চা বানিয়ে দিতে পারবে?”
    “শুবে না?”
    “না, মানে ভাবছি গল্পটা শেষ করেই ঘুমুতে যাই।”
    “সকালে লিখলে হয় না?”
    “উহু”।

    সে উঠে চলে গেল। রান্নাঘরে বাতি জ্বললো। কিছুদূর লিখলাম। না, ভাল হচ্ছে না। মতিকে আমি নিজে যে ভাবে দেখছি সেভাবে লিখতে পারছি না। নিজের উপর রাগ লাগছে, সেই সঙ্গে আশেপাশের সবার উপর রাগ লাগছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মনে হল, পৃথিবীর কুৎসিততম চায়ে চুমুক দিলাম। না হয়েছে লিকার, না হয়েছে মিষ্টি। নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম, “এটা কি বানিয়েছো?”

    ছোট ছেলে নুহাশের ঘুম ভেঙে গেছে। ঘুম ভাঙলেই সে খানিকক্ষণ কাঁদে। সে কাদছে। আমি বিরক্ত হয়ে গুলতেকিনকে বললাম, “দাড়িয়ে দেখছো কি? কান্নাটা থামাও না।”

    গুলতেকিন কান্না থামাতে গেল। সে কান্না থামাতে পারছে না। কান্না আরাে বাড়ছে। কাঁদতে কাঁদতেই নুহাশ দু’বার ডাকলো, “বাবা! বাবা!” সে নতুন কথা শিখেছে। কি সুন্দর লাগে তার কথা ! আমার উচিত উঠে গিয়ে তাকে কোলে নিয়ে আদর করা। ইচ্ছা করছে না। বরং রাগে শরীর জ্বলছে। মনে হচ্ছে, এরা সবাই মিলে প্রাণপণ চেষ্টা করছে যেন আমি লিখতে না পারি। আমি ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত গলায় বললাম, “সামান্য একটা কান্নাও থামাতে পারছো না। তুমি কি করো ?”

    গুলতেকিন ছেলে কেলে নিয়ে দরজা খুলে বাইরে যাচ্ছে। খােলা বারান্দায় খানিকক্ষণ হাঁটবে। নুহাশ আমাকে দেখে আবারও কাঁদতে কাঁদতে ডাকলো, “বাবা, বাবা!” আমি বিচলিত হলাম না। আমার সামনে মতি। কিছুক্ষণের মধ্যে মতির চোখ উপড়ে ফেলা হবে। এমন ভয়াবহ সময়ে ছেলের কান্না কোন ব্যাপারই না। বাচ্চার অকারণেই কাদে। আবার অকারণেই তাদের কান্না থেমে যায়। এর কান্না থামবে। এর দুঃখের অবসান হবে কিন্তু মতি মিয়ার কি হবে ।

    ছেলের কান্না থেমেছে। সে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার মা তাকে বিছানায় শুইয়ে নিজে মাথার কাছে মূর্তির মত বসে আছে। আমার এখন খারাপ লাগতে শুরু করেছে। আমার মনে পড়েছে, নুহাশের সকাল থেকে জ্বর। তার মা তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছেলো। আমি নিয়ে যাইনি। ডাক্তারের চেম্বারে তিন ঘণ্টা বসে থেকে নষ্ট করার মত সময় আমার নেই। তা ছাড়া অসুখ-বিসুখ আমার ভাল লাগে না। একগাদা রােগীর মাঝখানে বসে থাকা ! হাতে নম্বর ধরিয়ে দেয়া বিয়াল্লিশ। ডাক্তার সাহেব দেখছেন সাত নাম্বার। কখন বিয়াল্লিশ আসবে কে জানে?

    ডাক্তার নিয়ে যা করার গুলতেকিন করবে। আমি এর মধ্যে নেই। বাজারে যেতে হবে? নােংরা মাছ বাজারে থলি হাতে ঘােরা এবং প্রতিটি আইটেমে ঠকে আসা আমাকে দিয়ে হবে না। সেও গুলতেকিনের ডিপার্টমেন্ট। বাচ্চা কাচ্চাদের পড়াশােনা দেখা ? অসম্ভব ব্যাপার। নিজের পড়া নিয়েই কুল পাচ্ছি না। এদের পড়া কখন দেখব? যা হবার হবে। সংসার জলে ভেসে যাচ্ছে? যাক ভেসে।

    খুব স্বার্থপরের মত কথা। আমি অবশ্যই স্বার্থপর। নিজেরটাই দেখি – আর কিছু না। টিভিতে নাটক চলছে আমার সমস্ত মমত নাটকের জন্যে। রেকর্ডিং থেকে রাত বারটা-একটায় ফিরি। কোন রকম ক্লান্তি বােধ করি না। বাসার সবাই যে না খেয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা করছে তা আমার চোখে পড়ে না। নাটক ছাড়া তখন মাথায় আর কিছুই ঢুকে না। এই মুহুর্তে নটিক ছাড়া আমার ভুবনে আর কিছু নেই।

    মেয়ের জন্মদিন হবে। সে তার সব বান্ধবীকে দাওয়াত দিয়েছে। না, আমি তাে থাকতে পারবো না। নাটকের রিহার্সেল আছে। জন্মদিন প্রতি বছর একবার করে আসবে। রিহার্সেল তাে প্রতি বছর একবার করে আসবে না। এরা বুঝতে পারে না – নাটকের রিহার্সেল আমার জন্যে এত জরুরি কেন। আমি বুঝতে পারি না জন্মদিন ওদের এত জরুরি কেন? ক্রমে ক্রমেই আমরা দূরে সরে যাই। আমরা ব্যথিত হই। সেই ব্যথা কেউ কাউকে বুঝাতে পারি না।

    অন্যসব ছেলেদের মত আমারও ইচ্ছা ছিল নিজেকে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবো। অন্য দশজনের মত হলে আমার চলবে না। আমাকে আলাদা হতে হবে চারপাশের মানুষদের মধ্যে যা কিছু ভাল গুণ দেখেছি তাই নিজের মধ্যে আনার চেষ্টা করেছি – চেষ্টা পর্যন্তই, লাভ কিছু হয়নি। মানুষ পরিবেশ দিয়ে পরিচালিত হয় না, মানুষের চালিকাশক্তি তার ডি এন এ। যা সে জন্মসূত্রে নিয়ে এসেছে। তার চারপাশের জগৎ তাকে সামান্যই প্রভাবিত করে। আমি আমার ডি এন এ অণুর গঠন কি জানি না। আমাদের জ্ঞান সেই পর্যন্ত পৌছেনি। একদিন পৌছবে, তখন সবার ডি এন এ অণুর প্রিন্টআউট তাদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হবে। তা দেখেই সে বুঝবে সে কেমন। অন্যরাও বুঝবে। সব রকম অস্পষ্টতার অবসান হবে।

    মায়েরা তখন বাচ্চার রেজাল্ট কেন খারাপ হয়েছে এ নিয়ে বাচ্চাকে বকা-ঝকা করবেন না, কারণ তারা ডি এন এ প্রিন্ট আউট দেখেই বুঝবেন এ পরীক্ষায় কখনােই তেমন ভাল করবে না। প্রতিদিন একটা করে প্রাইভেট টিউটর খুলে খাইয়ে দিলেও লাভ হবে না। সেই সময় একটি শিশুর জন্মের পর পরই সবাই জানবে, বড় হয়ে এ হবে অন্যদের চয়ে একটু আলাদা। সে জােছনা দেখলে অভিভূত হবে, বৃষ্টি দেখলে অভিভূত হবে, সারাক্ষণ তার মাথায় খেলা করবে অন্য এক বােধ।

    ব্যাপারটা হয়তো খুব সুখকর হবে না, কারণ তখন মানুষের ভেতর রহস্য বলে কিছু থাকবে না। একজন অন্য একজনকে পড়ে ফেলবে খেলা বইয়ের মত। মানুষের সবচেয়ে বড় অহংকার হল, সে বই নয়। তাকে কখনাে পড়া যায় না। তারপরেও মানুষকে বই ভাবতে আমার ভাল লাগে। একেকজন মানুষ যেন একেকটা বই। কোন বই সহজ তড়তড় করে পড়া যায়। কোন বই অসম্ভব জটিল। আবার কোন কোন বইয়ের হরফ অজানা। সেই বই পড়তে হলে আগে হরফ বুঝতে হবে। আবার কিছু কিছু বই আছে যার পাতাগুলি শাদা। কিছু সেখানে লেখা নেই। বড়ই রহস্যময় সে বই।

    আমার নিজের বইটা কেমন ? খুব জটিল নয় বলেই আমার ধারণা। সরল ভাষায় বইটি লেখা। যে কেউ পড়েই বুঝতে পারবে। কিন্তু সত্যি কি পারবে? সারল্যের ভেতরেও তাে থাকে ভয়াবহ জটিলতা। যেখানে আমি নিজেই নিজেকে বুঝতে পারি না সেখানে বাইরের কেউ আমাকে কি করে বুঝবে? আমার নিজের অনেকটাই আমার কাছে অজানা। কিছু কিছু কাজ আমি করি কেন করি নিজেই জানি না। অন্য কেউ আমাকে দিয়ে করিয়ে নেয় বলে মাঝে মাঝে মনে হয়। আমার এই স্বীকারোক্তি থেকে কেউ মনে না করেন যে, আমি আমার কর্মকাণ্ডের দায়-দায়িত্ব অন্য কোন অজানা শক্তির উপর ফেলে দেবার চেষ্টা করছি। আমি ভাল করেই জানি, আমার প্রতিটি কর্ম কাণ্ডের দায়দায়িত্ব আমার। অন্যের নয়।

    লেখালেখির ব্যাপারটাই ধরা যাক। অনেকবার আমার মনে হয়েছে, লেখালেখির পুরো ব্যাপারটা আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। নিয়ন্ত্রণ করছে অন্য কেউ। যার নিয়ন্ত্রণ কঠিন। যে নিয়ন্ত্রণের আওতা থেকে বের হওয়ার কোন ক্ষমতা আমার নেই । নিজের একটা লেখা থেকে উদাহরণ দেই – ‘কৃষ্ণপক্ষ।’ মিষ্টি প্রেমের উপন্যাস লিখবো – এই ভেবে শুরু করলাম। শুরুটা হল এই ভাবে “নােটটা বদলাইয়া দেন আফা, ছিড়া নোট।”

    প্রথম বাক্যটি লিখেই পুরাে গল্প মাথায় সাজিয়ে নিলাম। সমস্যা দেখা দিল তখন। দ্বিতীয় বাক্যটি আর লিখতে পারি না। কত পৃষ্ঠা যে নষ্ট করলাম। প্রতিটিতে একটা বাক্য লেখা – “নোটটা বদলাইয়া দেন আফা, ছিড়া নােট।” বাসার সবাই অস্থির – হচ্ছে কি এসব? তাদের চেয়েও বেশি অস্থির আমি। পুরাে গল্প আমি সাজিয়ে বসে আছি, অথচ লিখতে পারছি না। এ কী যন্ত্রণা। শেষে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ঠিক করুলাম, যা হবার হবে। আগে থেকে ঠিকঠাক করা গল্প লিখবো না। যা আসে আসুক।

    শুরু হল লেখা। পাতার পর পাতা লেখা হতে লাগল। এমন এক গল্প । আনি লিখতে চাই নি। উপন্যাসের নায়কের ভাগ্য যেন পূর্ব-নির্ধারিত। লেখক হিসেবে তা বদলানাের কোন রকম ক্ষমতা আমাকে দেয়া হয়নি। আমি একজন কপিরাইটার। কপি করছি, এর বেশি কিছু না। কে করাচ্ছে কপি? আমার ডিএনএ অণু, না অন্য কিছু? আমি জানি না। মাঝে মাঝে এই ভেবে কষ্ট পাই – নিজের সম্পর্কে আমরা এত কম জানি কেন? প্রকৃতি কি চায় না আমরা নিজেকে জানি?

    এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা বলি। সন্ধ্যা থেকেই কাজ করছি। খাটের পাশে।ছােট্ট টেবিল নিয়ে মাথা গুজে লিখে যাচ্ছি। এক মুহূর্তের জন্যেও মাথা তুলছি না। হঠাৎ কি যেন হল। মনে হল কিছু একটা হয়েছে। অদ্ভুত কিছু ঘটে গেছে। বিরাট কোন ঘটনা, আর আমি তাতে অংশগ্রহণ না করে বােকার মত মাথা গুজে লিখে যাচ্ছি। লেখার খাতা বন্ধ করে উঠে পড়লাম, কিন্তু বুঝতে পারলাম না ব্যাপারটা কি। অস্থিরতা খুব বাড়লো। একবার মনে হল, এইসব মাথা খারাপের পূর্ব লক্ষণ। মাথা খারাপের আগে আগে নিশ্চয়ই মানুষের এমন ভয়ংকর অস্থিৰতা হয়। বারান্দায় এসে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে অস্থিরতার কারণ স্পষ্ট হল – আজ পূর্ণিমা। আকাশভরা জোছনা। প্রকৃতির এই অসাধারণ সৌন্দর্য উপেক্ষা করে আমি কি-না ঘরের অন্ধকার কোণে বসে আছি?

    অনেকেই বলবেন, এটা এমন কোন অস্বাভাবিক ঘটনা না। যেহেতু জোছনা আমার প্রিয়, আমার অবচেতন মন খেয়াল রাখছে কবে জোছনা। সেই অবচেতন মনই মনে করিয়ে দিচ্ছে। আর কিছু নয়। অবচেতন মনের উপর দিয়ে অনেক কিছু আমরা পার করে দেই। ডাক্তারদের যেমন ‘এলার্জি’, মনােবিজ্ঞানীদের তেমনি ‘অবচেতন মন’। যখন রােগ ধরতে পারেন না তখন ডাক্তাররা গম্ভীর মুখে বলেন ‘এলার্জি’, মনােবিজ্ঞানী যখন সমস্যা ধরতে পারেন না, তখন বিজ্ঞের মত মাথা ঝাঁকিয়ে বলেন – ‘অবচেতন মনের কারসাজি। আর কিছুই না।’

    সেই অবচেতন মনটাই বা কি? কতটুক তার ক্ষমতা? লেখকদের লেখালেখি কি অবচেতন মন নামক সমুদ্রে ভেসে উঠে? সেখান থেকে চলে আসে চেতন জগতে? ইপ্রিয় অগ্রাহ্য জগত থেকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতে তার আগমন ? সেই ইন্দ্রীয় অগ্রাহ্য জগতটি আমার জানতে ইচ্ছে করে, বুঝতে ইচ্ছে করে।

    অনার্স ক্লাসে আমি কোয়ান্টাম বলবিদ্যা পড়াই। আমাকে পড়াতে হয় ভাবনার হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা সূত্র। আমি বলি শােন ছেলেমেয়ে, কোন বস্তুর অবস্থান ও গতি একই সময়ে নির্ণয় করা যায় না! এই দুয়ের ভেতর সবসময় থাকে এক অনিশ্চয়তা। তুমি অবস্থান পুবােপুরি জানলে গতিতে অনিশ্চয়তা চলে আসবে। আবার গতি জানলে অনিশ্চয়তা চলে আসবে অবস্থানে। ছাত্ররা প্রশ্ন করে, “স্যার কেন?”

    আমি নির্বিকার থাকার চেষ্টা করতে করতে বলি – এটা প্রকৃতির বেঁধে দেয়া নিয়ম। প্রতি চায় না আমরা গতি ও অবস্থান ঠিকঠাক জানি। জ্ঞানের অনেকখানি। প্রকৃতি নিজের কাছে রেখে দেয়। প্রকাশ করে না।
    “কেন স্যার?”
    “জানি না।”

    কোয়ান্টাম বলবিদ্যার শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের অনেক প্রশ্নের উত্তরে আমাকে বলতে হয় -“জানি না।” জ্ঞানের তীব্র পিপাসা দিয়ে মানুষকে যিনি পঠিয়েছেন তিনিই আবার জ্ঞানের একটি অংশ মানুষের কাছ থেকে সরিয়ে রেখেছেন।
    “কেনো?”
    “উত্তর জানা নেই।”

    এই মহাবিশ্বের বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তরই আমাদের জানা নেই। আমরা জানতে চেষ্টা করছি। যতই জানছি ততই বিচলিত হচ্ছি। আরো নতুন সব প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। বিজ্ঞানীরা নিদারুণ আতঙ্কের সঙ্গে লক্ষ্য করছেন তাদের সামনে কঠিন কালাে পর্দা। যা কোনদিনই উঠানাে সম্ভব হবে না। কি আছে এই পর্দার আড়ালে তা জানা যাবে না। আমার যাবতীয় রচনায় আমি ঐ কালে পর্দাটির প্রতি ইংগিত করি। আমি জানি না আমার পাঠক-পাঠিকারা সেই ইংগিত কি ধরতে পারেন, নাকি তার গল্প পড়েই তৃপ্তি পান। উদাহরণ দেই।

    কৃষ্ণপক্ষ উপন্যসের নায়ক মুহিবের বিয়ের দিন। একটা কটকটে হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পরে এসেছিল। সবাই তাই নিয়ে খুব হাসাহাসি করলো। ছেলেটি মারা গেল।বিয়ের পর দিন। তার স্ত্রী অরুর বিয়ে হল অন্য এক জায়গায়। কোটে গেল দীর্ঘ কুড়ি বছর। কুড়ি বছর পর সেই অরুর মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। বাড়িতে তুমুল উত্তেজনা। বর এসেছে, বর এসেছে। অরু আগ্রহ করে নিজেও তার কন্যার বর দেখতে গেলেন। ছেলেকে দেখেই তিনি চমকে উঠলেন। তার গায়েও কটকটে হলুদ রঙের পাঞ্জাবি। যেন এই ছেলে কুড়ি বছর আগের মুহিবের পাঞ্জাবিটা পরে চলে এসেছে।

    অনেকেই আমাকে বলেছেন, কৃষ্ণপক্ষ উপন্যাস থেকে হলুদ পাঞ্জাবির অংশটা বাদ দিলে উপন্যাসটা সুন্দর হত। উপন্যাসে এই অংশটুকুই দুর্বল। হিন্দী ছবির মত মেলোড্রামা। অথচ উপন্যাসটা লেখাই হয়েছে হলুদ পাঞ্জাবির ব্যাপারটির জন্যে। আমি কি আমার বােধ পাঠকদের কাছে ছড়িয়ে দিতে ব্যর্থ হচ্ছি? এরা হিমুর বাইরের রূপটি দেখে। তার উদ্ভট কাণ্ডকারখানায় মজা পায় কিন্তু এর বাইরেও তো হিমুর অনেক কিছু বলার আছে। হিমু ক্রমাগত বলেও যাচ্ছে । কেন কেউ এ ধরতে পারছে না? লেখক হিসেবে এরচেয়ে বড় ব্যর্থতা আবে কি হতে পারে ?

    আমি আমার গল্পটা লিখে শেষ করেছি। মতির চোখ উপড়ে ফেলার গল্প। সাধারণত গল্পগুলি আমি গভীর রাতে শেষ করি। এই প্রথম শেষ করলাম বিকেলে। আনন্দে চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে শােবার ঘরে এসে দেখি, আমার মেয়েরা সবাই সাজ-পােশাক পরছে। একেকজনকে পরীর মত দেখাচ্ছে।
    — আমি বললাম, “ব্যাপার কি ?”
    — ওরা ঝলমল করতে করতে বললো, “তুমি কাপড় পরে নাও। দেরি করছ কেন? আমরা বিয়েতে যাব না?”
    — ওদের মা বললো, “তাের বাবার চোখ দেখে বুঝতে পারছিস না, সে যাবে না? সে ঘরে চুপচাপ একা একা বসে থাকবে।”
    — বড় মেয়ে দুঃখীত গলায় বললো, “বাবা তুমি যাবে না?”
    — আমি বললাম, “অবশ্যই যাব। কে বলেছে যাব না?”

    শার্ট-প্যান্ট ইস্ত্রি করা নিয়ে অতিরিক্ত রকম ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বিয়েবাড়িতেও সবার সঙ্গে খুব হৈ-চৈ করলাম। গল্পগুজব, রসিকতা। সবাই ভাবলো, বাহ লােকটা বেশ মজার তো। কেউ আমার নিঃসঙ্গতা বুঝতে পারলো না। শুধু এক ফাকে গুলতেকিন এসে বললো, “তোমার কি হয়েছে?” আমি জবাব দিলাম না। আমার কি হয়েছে আমি নিজেই কি ছাই জানি? শুধু জানি, মতি মিয়ার গল্প লিখে শেষ করেছি। মতি মিয়া এখন আর আমার দিকে তাকিয়ে থেকে কাতর অনুনয় করবে না – ‘স্যার, আমার ব্যাপারটা লিখে ফেলুন।’

    জীবনের গভীরতম ব্যাথাকে আমি অনুভব করতে পারি। জোছনার অপূর্ব ফুলকে আমি দেখতে পাই – কিন্তু তারা অন্তরের এতই গভীরে যে, আমি তুলে আনতে পারি না। বার বার হাত ফসকে যায়। দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী জেগে আমি অপেক্ষা করি। কোন দিন কি পারবো সেই মহান বােধকে স্পর্শ করতে? নিজেকে বােঝাই – ভাগ্যে যা আছে তা হবে।
    Every man’s fate
    We have fastened
    On his own neck
    (সুরা বনি ইস্রায়িল)

    আমরা কি করবো, না করবো সবই পূর্ব নির্ধারিত। কি হবে চিন্তা করে ? নিয়তির হাতে সব ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে অপেক্ষা করাই ভাল।

    আমি অপেক্ষা করি।

    ⤶
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমীরার গ্রামের বাড়ী – হুমায়ূন আহমেদ
    Next Article হুমায়ূন আহমেদ রচনাবলী ১১

    Related Articles

    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    হুমায়ূন আহমেদ রচনাবলী ১১

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    মীরার গ্রামের বাড়ী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 12, 2025
    হুমায়ূন আহমেদ

    দেবী – হুমায়ূন আহমেদ

    December 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }