Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    এই তো সেদিন

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প156 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ২. দাওয়ার পৈঠেয়

    বিনোদবালা দাওয়ার পৈঠেয় একটা আঙুল ঘষে বলে, এই চুন ছুঁয়ে বলতেচি, আনিমা, বেটিছাওয়ালডার আমার কুননো দোষঘাট নাই। জামাইডাই হতভাগা পাজি। মিচে করে বদনাম দেচে। বলে কিনা, এমন বাউণ্ডুলে পরিবার পুষতি পারবুনি। পেট না কুম্বোকর্ণ। পাঁচদিনের রসদ একদিনে খতোম করে। তাই তিনটে ছাঁ সমেত ফেলে রেকে দেচে বাপের ঘরে। …আপনারে কই মা, নষ্টদুষ্ট পরিবার না, গতর পোষা, চোপাবাজ বিছুটি না, শুধু একটু অদিক খায় বলি তেজি দিবি তুই সিই পরিবারকে?…বলি ও একা খায়? তোর নিজের তিন তিনটে পুষ্যি এঁড়েয় খায় না? খুদে খুদে তিনটে বেটা যেন তিনটে বক আক্কোস! অ্যাকোন তুমি হকতা কও মা, আমরা দীনদুঃক্কি দুটো মনিষ্যি, ওই চার চারটে রাবণের চিলুকে সব্বোদা জ্বাইলে রাকি কেমোন করে? ভাণ্ডটি তো কারও কম না। বম্ভাণ্ড ঢুকে যায়।

    সরমা মনে মনে না হেসে পারেন না।

    বেচারি বিনোদবালা! নিজের অস্ত্রেই নিজে সংহার হচ্চিস।…

    নিজের মুখেই স্বীকার করছিস, ভাণ্ডটি কারও কম নয়, ব্রহ্মাণ্ড ঢুকে যেতে পারে। সেই কথাই বলেছে জামাই। অবশ্য তার বলাটা ন্যায্য নয়।

    বিনোদবালা বলে, আপনি হুকুম দে সেই হতভাগাকে আজি করান মা, ছানাপোনা সমেত যেন পরিবারকে নে যায়। …আর দুব্যভার যেন না করে। উটতি বসতি পেটনচণ্ডী করে মা আমার পঞ্চিডারে।

    প্রথম প্রথম এ রকম কথা শুনে কাঠ হয়ে যেতেন সরমা। ক্রমশ আর হন না। ক্রমশ জেনেছেন, ও ঘটনা রাজরাজড়ার ঘরেও বিরল নয়। রুদ্রপ্রসাদই নাকি ব্যতিক্রম। মদমত্ত অবস্থায় তিনি স্ত্রীর ঘরে আসেন না।

    এটাই হয়তো আমার শতজন্মের ভাগ্য।

    কখনও ভেবেছেন সরমা!

    হয়তো এর জন্যেই আমার ভাগ্যের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

    একটু হেসে বলেন, পরিবারকে নে যাওয়াটা নয় হুকুমের জোরে হল পঞ্চির মা, কিন্তু দুব্যভারটা বন্ধ করা যাবে কী করে?

    বিনোদবালা হতাশ গলায় বলে, সেই তো কতা আনিমা! ঘরের মদ্যি যে কালশত্রুর পোষা আচে। জমমো বেখোবা একডা জ্ঞেয়াতি ভাজ আচে, জামায়ের মায়ের মিত্যুকালে কন্না করতি এস্যে সিই যে ঢুকেছেল আর নড়লোনি। তার সাতে জামায়ের যত নষ্টিঘটি, তার কতায় ওটে বসে হারামজাদা। বলি পঞ্চি আমার এত অসৈরণ সইবি কেন? বে করা পরিবার না? ব্যস! তাই ওই কুম্বোকন্নের বদনাম দে তাইড়ে দে রেকেচে। বলে, গতরকচুড়ে, অষ্টোপহর খায় আর ঘুমোয়, এমন অলী মেয়েছেলে সোক্সারে আকতে নাই।…তা আপনিই বলোতো মা, গতর নড়াবেই বা কেননা আমার মেয়ে? সিই কালসাপড়া য্যাখোন সোরে জাঁইকে বসি আচে? তার গতরই ছারেগোল্লায় যাক!

    বিনোদবালার কথায় কেউ কেউ হাসছে, কেউ বা কান দিচ্ছে না।

    সরমা আস্তে বলেন, তা এমনি যদি অবস্থা, হুকুমের জোরে সেখানে পাঠিয়ে দিলে তোমার মেয়ের সুখ হবে?

    সুক!

    বিনোদবালা কপালে হাত চাপড়ে বলে, এ পিরথিমিতে মেয়েছেলের জন্যি সুক বলি কোনও বস্তু আচে নাকি আনিমা? অপরের হাতে জেবন, অপরের তাঁবে বাস। সে জেবনে ঘেন্না ধরলি, মদ্দছেলেদের মতন তোরছেই বলে বেবাগী হয়ে বেইরে যাবার পতও তো আকেনি ভগোমান। তার উপুর আবার জ্ঞেয়ান না হতিই পেটে গুষ্টির ছানাপোনা। মদ্দছেলে সিদিকে তাকায়? কিন্তুক মেয়েছেলে সন্তানের মায়ায় মরবি। …সিই যে বলে না বিষ খেয়ে বিষ্যোম্বরী, সিই বিষেই গড়াগড়ি মেয়েছেলের জেবন হচ্ছে তাই। সুকের আশা করিনে মা, পেটের ভাত কড়া তো জোগাবে সোয়ামি।

    সরমা হঠাৎ অবাক হয়ে যান।

    এই মুখ্যু অবোধ গ্রাম্য মেয়েটার মধ্যে জীবনদর্শনের যে ছাঁচ, সেটাই কি সমাজ জীবনের আসল ছাঁচ নয়?

    বিনোদবালা সরমাকে নীরব দেখে আরও ব্যাকুলতায় বলে ওঠে, আপনি ওর ঘাড়ে ধরে এইডি করি দ্যান আনিমা!…আমি আর টানতি নারচি।

    সরমা একটা নিশ্বাস ফেলে বলেন, আচ্ছা পঞ্চির মা, দিনে কত করে খোরাকি লাগে তোমার মেয়ের আর নাতিদের?

    এই প্রশ্নটায় হঠাৎ সকলেই সচকিত হয়ে ওঠে। কী রে বাবা! রানিমা কি ওই খোরাকিটার ব্যবস্থা করে দেবেন নাকি? ধুরন্ধর মেয়েছেলেটা তো তা হলে খুব বাগিয়ে নিল।

    কিন্তু বিনোদবালার মুখ দেখে মনে হল না, সে কথা। সে শিথিল কণ্ঠে বলল, ওর আর ঠিক হেসাব কী দেব মা। যিদিন যেমন জোটে। জুটলে ওদের চার মা ব্যাটার দিনে সের তিনেক তোনাগেই। তেমন গজকচ্ছপ হয়ে খেতি পেলি সাড়ে তিনও উটে যায়।

    আরামের নিশ্বাস ফেলে অন্যেরা।

    যাক। দৈনিক এই এতগুলি চালের প্রতিশ্রুতি কিছু আর দিয়ে বসবেন না রানিমা।

    কিন্তু ঘুচে যায় আরামের নিশ্বাস।

    রানিমার কণ্ঠ হতে সেই অমোঘ বাণীই উচ্চারিত হয়।

    আচ্ছা! তুমি নিশ্চিন্দি থাকো পঞ্চির মা, দৈনিক পাঁচ সের চালের বরাদ্দ করে দিচ্ছি তোমায়। অতিথশালার ভাঁড়ার থেকে যাবে।

    কোনও অলক্ষ্য লোক থেকে আঁতকে ওঠেন দুই পিসি, আঁতকে ওঠে আরও অনেকেই। জামাই নিয়ে অশান্তি, ব্যাটার বউ নিয়ে জ্বালা, এ সব আর কোন সংসারে নেই। কেমন দুটো দুঃখের গাথা কয়ে চিড়ে ভিজিয়ে নিল মেয়েছেলেটা। দিনে পাঁচ সের? মাসের হিসেবটা কত হল গো?

    কিন্তু ধুরন্ধর মেয়েছেলেটা?

    তার মুখে কাজ হাসিল করে নেবার দীপ্তি কোথায়?

    সে আর একবার সাষ্টাঙ্গে গড় করে ভক্তি জানিয়ে নিষ্প্রভ গলায় বলে, আপনার দয়ার শরীল, কুবিরের ভাঁড়ার, নক্কীর ঘর, আপনারে আর কী বলব বলেন। আমার ঘরের নীছাড়া বুড়ো এ যাত্রা শুনলি দু বাড়ি তুলে ঠেই ঠেই নেত্য করবে। তবে বলি–এখোন দিচ্চো দাও, সোমসারটা বাঁচুক। কিন্তুক আমার নালিশডার কথা স্মরণে রেকো মা। সেই হারামজাদাকে আপনি

    কে একজন কর্কশ গলায় বলে ওঠে, খুব তো হল। আবার ফস ফস্যি কীসের র‍্যা পঞ্চির মা?..বলি সমিস্যে তো ছেলে তোর ভাতের, সেটা মেটলো, আবার জামাই জামাই ক্যানো?

    তুই থাম তো হারান। …বিনোদবালা ঝংকার দিয়ে ওঠে, ভাত হলিই সমিস্যে মিটে গেল? সোমত্ত বেটিছেলে, বাপের ঘরে বসে পার ওপর পা তুলে দে বসি বসি দাতোব্যের অন্ন ধ্বংসানিই হবে? গাঁয়ে ঘরে কতা উটবেনি? শোউর বাড়িতে সন্দ করবেনি, হঠাৎ এত ভাত এদের আসে কোথা থেকে? আনিমার দয়ার কতা বিশ্বেস করবি? না সে কতা জনি জনি বলি বেড়াব আমি? মেয়েছেলের সোয়ামির ভাতই হল মান্যির ভাত। বজুলি হারান।

    সরমা শান্ত গলায় বলেন, কিন্তু মান্যি যেখানে নেই বিনোদবালা?

    বিনোদবালা অনায়াসে বলে, ঘরের মদ্যি কার কী অবস্তা কে দেকতে যাচ্ছি মা? লোকদরবারে তো থাকবে মান্যি? সিডাই দরকার। আপনি যে করে হোক হতভাগাডারে একবার ডাইকে এনে চোক আঙিয়ে শাসিয়ে দ্যান, তাতিই কাজ হবে। …পঞ্চি যে আমার ফেলনা না, মাতার ওপর পেষ্টোবল আচে, সেডা জানতি পেলে সমজে যাবে ছোঁড়া।

    হাঁপিয়ে সরে গিয়ে জলপানি নিতে এগোয় বিনোদবালা।

    ওদের দাওয়ার উপর বড় বড় ধামায় মুড়ি চিড়ে মুড়কি বাতাসা। তার সঙ্গে ছোট-বড় নানা মাপের কয়েকটা রেক। এই রেকগুলিতেই ন্যায্য প্রাপ্তির হিসেব রক্ষিত।

    তা ছাড়া

    পরিবেশনকারী জ্বালাবৃদ্ধিকর ঘটনা এই, যতক্ষণ না শেষ প্রাণীটিও জলপানি পেয়ে বিদায় না নেবে ততক্ষণ তো রানিমা এখান থেকে নড়বেন না।

    বিনোদবালার পরে আসে বিধবা চাঁপারানি! নিঃসন্তান যুবতী, স্বামী হঠাৎ মারা যাওয়ায় দেওর ভাশুর বলছে জমিজমায় নাকি তার কোনও অধিকার নেই। অথচ আছে তাদের জমিজমা মন্দ নয়।…

    বড় জা বলছে, দাসীবাঁদির মতন খেটেপিটে কাজ তুলতে পারিস তো দুবেলা দুমুঠো ভাত জুটবে, নচেৎ পত্ দ্যাক।

    চাঁপারানি কেঁদে ফেলে বলে, আমার এই ভরা বয়েস, কোতায় পত্ দেকতে যাব রানিমা?… বাপ নাই, মা নাই, থাকতে শুদু অ্যাকটা সততা দাদা, তা তার শরীলে যদি বা একটু মায়াদয়া আচে, ভাজ খাণ্ডার। হয়তো বা ওই মায়াদয়া নে আকতা কুকতা বলে বসবি।…

    সরমা হতাশ গলায় বলেন, তা জমিজমার ভাগ পেলে তুই কি নিজে তার ব্যবস্থা করে টিকতে পারবি?

    চাঁপারানি সখেদে বলে, তাই কি সাদ্যি আমার মা? চান্দিকে রাক্কোস খোক্কোস। ডবকা দেওরডা তো ছুতোয় নাতায় পায়ে পায়ে ঘুরতে আসে। এমনি কপাল আমার মা, শাউড়ি পয্যোন্তো ওদের দলে। আপনি ওদের বলেকয়ে আমার ভাগের ট্যাকাটা আদায় করে আমায় আপনার চরণে একটু ঠাঁই দ্যাও।

    আমার চরণে?

    সরমা হেসে উঠে বলেন, আমারই চরণ রাখার ঠাঁইটা কোথায় তা তো জানি না রে।

    কী কতা কও মা। আপনি মন কল্লি আমার মতন দশটা অবাগিনীকে পুষতে পারেন। যা করতে বোলবেন করব মা, ক্রেতোদাসী হয়ে থাকব। শুধু একটা ফোঁট্টা আচ্ছ্বয়। নইলে শ্যালকুকুরে ছিঁড়ে খাবে মা। এই উমোন ধারে পড়ে থাকব মা। আপনার কোনও অসুবিদে ঘটাবো না।

    সরমা স্তব্ধ হয়ে যান।

    মনে মনে এই বিরাট প্রাসাদখানার দিকে তাকিয়ে দেখেন। কত ঘর, কত বারান্দা, কত দালান গলি, সিঁড়ির তলা, চোরকুঠুরি, চিলে কোঠা। এতকালেও বোধ হয় বাড়ির সবটা মুখস্থ হয়ে ওঠেনি তাঁর। একটা মেয়েকে এর মধ্যে আশ্রয় দেওয়া কি খুব শক্ত? পুরনো দাসীরা তো একে একে কত জনাকেই তাদের দেশ থেকে এনে এনে হাজির করেছে, করছে। বোনঝি ভাইঝি দেওরঝি, ভাশুরঝি, ভাগ্নে, ভাইপো, দূর সম্পর্কের নাতি, জামাইয়ের ছোট ভাই।…।

    আনে হয়তো দোলদুর্গোৎসবের ছুতোয়, বলে বাবুদের বাড়ি পুজো দেকবো বলে বায়না করলো, নে এনু।

    কিন্তু তারপর আর দেশে চালান করে না, এইখানেই কোথাও চালু করে দেয়। তবে ক্রমশই মনুষ্য চরিত্রে অভিজ্ঞ হয়ে উঠছেন সরমা, অনুভব করছেন গাঁয়ের একটা বউ, যে নাকি আপন ধর্ম সম্মান রক্ষার্থে আশ্রয় নিতে চায় খোদ মালিকের কাছে, তাকে ওই পুরনোরা টিকতে দেবে কিনা সন্দেহ আছে।

    ক্লান্ত গলায় বলেন, তা হ্যাঁ রে, তুই ক্রেতোদাসী হয়ে থাকলেই তো চলবে না? বলছিস তো তোর শশুর বেঁচে থাকতে ছিল পাড়ার মোড়ল। তাদের তো বংশের মান সম্মান আছে? রাগ করবে না?

    আপনি যদি চরণে ঠাঁই দ্যাও তো মা তাদের আগে আমার বয়েই গেল।

    তোর তো বয়ে গেল। আমাকে যদি কিছু বলতে আসে।

    তা তো আসবিই!

    চাঁপা উত্তেজিত গলায় বলে, জা-ভাশুর শাউড়ি বুড়ি সবাই আসতি পারে। বলবি বউ মন্দ, চরিত্তির ভাল না–মিচে করে বলতি পারে কত কি হঠাৎ চুপ করে যায় চাঁপা।

    সরমা ঈষৎ কঠিন গলায় বলেন, তা তাদের কথা সত্যি না তোর কথা সত্যি তা বুঝব কী করে?

    চাঁপা চোখ তুলে তাকায়।

    জলে ভরা দুই চোখ। বলে, মেয়েছেলে হয়ে মুক দেকে মেয়েছেলের চরিত্তির বুজতে পারবেনি?

    সরমা লজ্জিত হন।

    অপ্রতিভ হন।

    বলেন, আচ্ছা থাক এসে! দেখি কে কী বলে। রান্নাবাড়িতে বামুনদির কাছে ভর্তি হয়ে যা।

    চাঁপার চাহিদা আরও বেশি।

    বলে, না গো মা। আপনার পার তলে একটুক ঠাঁই দ্যাও। আপনার পা টেপবো, চুল ইলে দেবো

    সর্বনাশ!

    সরমা বলেন, রক্ষে কর বাবা! ও সবে আমার কাজ নেই। আমি কি রুগি?

    ওমা শোনো কতা! ভাগ্যিমানীর ঘরে জলজেয়ন্ত মানুষরা তো উগীর মনই থাকে গো মা! থাকে না? নড়তি চড়তি লোকজনের সায়ায্য নাগে।…তা নইলে আর ভাগ্যির ঘরে অভাগ্যির ঘরে তফাত কী।…বেশ আমি নয় খোকারাজাবাবুর খিদমদগারী করবো।

    হ্যাঁ সেদিনও বলেছিল এ কথা!

    সরমা হেসে উঠে বলেন, ও বাবা। তা হলে কিন্তু পিঠ শক্ত করতে হবে। পিটুনি খেতে হবে।

    চাঁপা বিগলিত হাস্যে বলে, বালকের হাতের মারে কি নাগে গো মা? তালে ওই কই রইল। কালকে চলি আসবো। তবে ওই আমার জমাজমির নেয্য দামড়া

    কর্কশ কণ্ঠী কোনও মহিলা বলে ওঠে–তুই যে দেকি গাচেরও খাবি, তলারও কুড়োবি রে মোড়লদের বউ।…বলি এখেনেই যদি আচ্ছ্বয় নিবি তো আবার দেওর ভাশুরের সঙ্গে নড়ানড়ি করে ভাগ নেবার চেষ্টা ক্যানো?

    চাঁপারও গলা ওঠে, তা জুটলই বা আচ্ছ্বয়। তাই বলে হকের জিনিস ছাড়ব? তিনি ভাগের একটা ভাগ নেই আমার? আজ রানিমা ঠাঁই দিচ্চে, চেরকাল যদি না দেয়? আখের ভাবতি হবে না?

    হঠাৎ হারান বলে ওঠে, তোর পেটের ব্যাটাবেটি নাই, তোর কোনও ভাগই নাই। যাঃ। শুদুগে যা গাঁয়ের মোড়ল, কি উকিল মুছুদ্দিকে।

    হঠাৎ ডুকরে কেঁদে ওঠে চাঁপা।

    করুণ তীক্ষ্ণ।

    ওগো আনিমা তো তবে আমায় তোমার সোমার থেকে একটুক বিষ দ্যাও। খেয়ে সকল জ্বালা জুড়োই।

    আমার সংসার থেকে বিষ!

    সরমা প্রায় শব্দ করে হেসে ফেলেন।

    তারপর মুখে ফুটে ওঠে অলৌকিক একটু হাসি। কিন্তু প্রায় কঠিন গলায় বলেন, তুই কান্না থামাবি? যা জলপানি খেগে যা। যা অবস্থা হয় দেখছি!

    এরপর একে একে আসে বুড়ি সিন্ধুবালা, খোঁড়া মাতুঙ্গী, অথর্ব কানাইয়ের মা।…আসে পদ্ম, ব্ৰজরানি, পুঁটু, সুশীলা।

    জনে জনে যা বলে চলে, তা প্রায় একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। দুঃখীর জীবন একই খোলা রঙের। বিশেষ করে গ্রামের এই অবোধ অসহায় মূর্খ মেয়েদের। এদের সমস্যা শুধু দারিদ্রই নয়, সমস্যা মানুষের সহানুভূতিহীনতা, সমতাহীনতা, অকারণ নিষ্ঠুরতা, অহেতুক বিদ্বেষ। ওদের উপর নির্দয় ব্যবহার করে বাপ ভাই স্বামী শ্বশুর দেওর ভাশুর ভাশুরপো সতীনপো, এমনকী পেটের ছেলেও। যারা ভাত জোগাতে বাধ্য হয়, তারাই অত্যাচারীর ভূমিকা নিয়ে বসে।

    হ্যাঁ পেটের ছেলেও।

    বুড়ি সিন্ধুবালা কেঁদে কেঁদে বলে, তোমারে কী বলব মা, পেটের ব্যাটা, অ্যামোন বেভার করে যে, ইচ্ছে হয় গলায় কলসি বেঁদে ডুবে মরি। বলে, বুড়ি ডাইনি, আলী, আকোন্দোর ডাল মাতায় নে জন্মেচে, মরণের নাম নাই। যম তোরে ভুলে বসে আছে। দু-দুটো বেটার মাতা খেয়ে বসে আছিস, অ্যাকোন আমায় খাবার তাল।.মা রে বড় মেজ দুটো ব্যাটা গেল সিকি আমার দোষ? আমার প্রাণ ছারখার হয়ে যায়নি তাতে? করবোডা কী? বলে ভগমানের মার দুনিয়ার বার। সহ্যি করতেই হবে। কিন্তুক মাষের মার সহ্যি হয় না গো মা,–ও আবার পেটের সন্তান। আমারে খেতে বসতি দেকলো কি অগ্নিমূত্তি। ঠ্যাঙা নে তেড়ে আসে, বলে, বেরাল ডিঙোতে পারেনি, অ্যাতো ভাত নে বোসেছিস! বুড়ো বয়েসে অ্যাতো খিদের বহর? তুলে রেখে দে অদ্দেক, ওবেলা গিবি।…

    ….এতে আপ্তোঘাতী হতি ইচ্ছে হয় কি না তুমিই বল মা? তা মিচে বোলবনি, পরের বেটি বৌ আমার বরোং ভাল। আমারে বুজ দে বলে, পূববো জন্মের কতো পাপে এ জন্মে, এমন পিচেশ ব্যাটার মা হইচো। এ জন্মে আবার বেদ্ধ বয়েসে আপ্তঘাতী হইয়ে পাপ বিদ্ধি করুনি! যমের খাতায় হিসেব তো নেকা আচে।…যে কদিন খোয়ারের ভোগ আচে ভুগতিই হবে।…মুকপোড়া ছেলে য্যাকোন বাড়িতি না থাকে, ত্যাকোন লুকিয়ে লুকিয়ে আমারে খেতে দ্যায়।…সোয়ামীর সঙ্গে আকোচ তো।

    সরমা বলেন, তবু একজনও যে মায়ামমতা করে এই ঢের বুড়ো মা! কতজনের তাও দেখি না।

    সিন্ধুবালা বলে, সিডা সত্যি। তবে টের পেলে মুকপোড়া যে বৌডাকেও তুলো ধোনে।…ত্যাকোন বড়ো নজ্জা নাগে মা! আমি এই অখদ্যে বুড়ি, আমার লেগে ওদের দুমাষে ঝটাপটি।…বলে, আমার অসাক্ষাতে বুড়িকে গেলাতে বসাস ক্যানে? খবরদার বসাবি না। বউ বলে, তোর টহল দেয়ার রীতিনীতি আচে? কখোন ফিরিস, কখোন না। বুড়ি মনিষ্যি উপোস নেগে যদি ভিরমি নাগে, পাড়ার নোক দুষবে কাকে? আমারে, না তোরে? জেনে ঘিন্না ধরি গেচে মা। তুমি যদি ওই ছোঁড়াডারে ডাইকে অ্যাকটু শাসন করি দ্যাও। আর কয়ে দাও জমিজমা তো সিন্ধুবালারই সোয়ামীর, দুদুটো বেটাও তোরেই সব্বস্ব দে মরে গেছে। তো ওকে দুমুঠো ভাতের জন্যি অ্যাতো হ্যাঁনোস্তা ক্যানো?

    তবে শুধুই কি যারা ভাত জোগায় তারাই অত্যাচারী হয়?

    এক মেয়ে আর মেয়ের প্রতি তো কম নিষ্ঠুর নয়? বরং আরও বেশি। আসল কথা দারিদ্র্য, বঞ্চনা আর নিজের উপর ঊর্ধ্বতনদের অত্যাচারের স্মৃতি তাদের সকলকেই মানবিকতাবোধশূন্য করে ছেড়েছে। পদ্মর তো নিজের মা-ই পরম নির্দয়। বিধবা হয়ে এসে ঘাড়ে পড়া মেয়েকে সে দাসীবাঁদি জনমজুরের অধম করে খাটায়, ভাতের গঞ্জনা দেয়, আবার স্বভাব চরিত্তির নিয়ে এত শাসন করে যে পদ্মর ইচ্ছে হয় বিনিদোষেই যখন এত শাসন, তখন ধর্মের মুখে নুড়ো জ্বেলে কুলে কালি দিয়ে বেরিয়ে গেলেই বা দোষ কী? ধর্ম কি তাকে দেখছে?

    তবু পারে না। তাই বিহিত চাইতে আসে রানিমার দরবারে।

    সরমা হতাশ হয়ে ভাবেন, আমার কতটুকু ক্ষমতা, আমি বড়জোর ওদের দুদশ দিনের ভাতের সংস্থান করে দিতে পারি। ওদের অনুরোধ অনুযায়ী না হয় বাড়ির লোকগুলোকে ডাকিয়ে এনে সুমতি দেবার চেষ্টা করতে পারি।…কিন্তু সেইটুকুতেই কি সমস্যা মিটবে?

    মনুষ্যত্ব যেখানে লুপ্ত, যুগ যুগ ধরে শুধু অপ্রেমের সঞ্চয়, আর কুসংস্কারে, অন্ধ সংস্কারে এবং হিংসায় যেখানে হৃদয় বস্তুটা অন্তর্হিত, সেখানে কোথায় আশা, কোথায় আলো?

    ব্যতিক্রম কি নেই?

    আছে অবশ্যই। কিন্তু তারা তো এসে এসে আছড়ে পড়ে না। যারা পড়ে, মনে হয় বুঝি তারাই সব। তাই না হতাশা।

    আরও হতাশা আসে এই দেখে, ভাগ্য যাকে মেরেছে, তাকে মারবার জন্যে এগিয়ে আসে শতখানা হাত। হ্যাঁ এগিয়ে আসে। রক্ষা করবার জন্যে নয়, আরও মারবার জন্যে। যেন পৃথিবীতে আর কোনও দাবি-দাওয়া নেই তার, যেন সংসারে সে একান্তই অবান্তর।

    একটি দুটি দুঃখী মেয়ে এসে রানিমায়ের সঙ্গে দেখা করব বলে বায়না করে প্রশ্রয় পেয়ে পেয়ে ক্রমশ অবস্থা এতখানিটি করে তুলেছে। মেয়েদের ভিড় বাড়ার পর পুরুষও আসতে শুরু করেছে কেউ কেউ।

    ননী দাসী আড়ালে বলে, আসবে না ক্যানো? যে নোভ দেইকেচে বউরানি, এর পর গেরাম ঝেটিয়ে যত হাবাতের গুষ্টি এসে পড়বে।… গুড় খাবে, জল খাবে, আঁচল পুড়ে চিড়ে-মুড়কি জলপানি পাবে, আর কেঁদে ককিয়ে গিন্নির মন ভিজিয়ে কত কিছু আদায়ের ব্যবস্থা করে নেবে। কী বলব আমাদের না হয় ভাল ভাল রংদার জরিদার কাপড় পরবার উপায় রাকেনি মুকপোড়া ভগমান, কিন্তুক দেশে ঘরে তো আচে আমাদের ঝি বউ, বুনঝি ভাইঝি। তাদের নেগে না রেখে, এই সব হাড় দুঃখী মাগীদের গোচা গোচা ভাল ভাল পেয়োনো কাপড় বিলোনো হচ্ছে! ই কি উড়নচণ্ডী বুদ্ধি, জানিনে মা।

    বসুমতী দাসী অবশ্য স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল ননীকেননীর বোনঝির বিয়েতে বউরানি চেলির কাপড় থেকে শুরু করে গয়না টাকা কত কী দেছলো। ননী বেজার মুখে উঠে গিয়েছিল।

    এই জন্যেই বসুমতাঁকে কেউ দেখতে পারে না। মুখের উপর এইসব ভুলে যাওয়া কথা মনে পুড়িয়ে দেয়।

    আবার বলে কিনা, নিজে পেনি না পেনি সিডাই দ্যাক, অপরে পাচ্চে দেকে গার জ্বালা ক্যান লা?

    তা মজাটা সত্যিই তাই।

    যারা নালিশ জানাতে এসেছে, দয়া চাইতে এসেছে, তারাও একে অপরের সুরাহা সুবিধের ঈর্ষা কণ্টকিত। যেন আমি পাব সেটা ন্যায্য। কিন্তু অন্যে কেন পাবে? অন্যের পাওয়া অন্যায়। দাতার বেশি আতিশয্য।

    মেয়েদের বক্তব্য মিটলে, হারান প্রভৃতি কজন পুরুষও হাতজোড় করে বলল, এবার আমাদের আর্জিডায় কান দ্যান রানিমা।…

    কিন্তু তাদের আর্জিটা ঠিক পারিবারিক নয়।

    অভিযোগ নায়েবমশাইয়ের নামে।

    দুক্কে ধান্দায় খাজনা কিছু বাকি পড়ে গেচে মা, তাই নায়েবমশাই ঘর জ্বাইলে দেবে বলে শাসিয়েচে।

    হ্যাঁ সেদিন পর্যন্তও নায়েব ব্ৰজেন এ শাসানো শাসিয়েচে। সেদিন পর্যন্তও সে দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি এ হুকুম তার উপরেও কখনও পড়তে পারে।

    অতএব নিজেই সে প্রজাদের দুঃস্বপ্ন হয়ে বিরাজ করেছে।

    সরমা কোমল মিনতির গলায় বলেন, তোমাদের ঘরসংসারী সুখদুঃখের কথা শুনি বাছা। যা পারি করি। এই যে খুদুর জ্যাঠা বলল টাকার অভাবে বাপমরা ভাইঝিটির বিয়ে দিয়ে উঠতে পারছে না। সে কথাটি আমি মনে রাখলাম, যা খরচ-খরচা হবে আমায় জানিও…কিন্তু কাছারি বাড়ির ব্যাপারে আমার কি হাত আছে বাবা?

    আচে। আচে! আপনিই তো সব মা। আপনিই নিষেদ করে দিলে কেউ আর ট্যাঁ ফোঁ-টি করতে নারবে।

    তা হয় না হারান। আগেও তো বলেছি, ও নিয়ে আমায় বলে লাভ নেই।

    সে বললে শুনবনি রানিমা। বলে কিনা ভিটে মাটি উচ্ছেদ করবে। আপনি বলে দ্যাও আসচে বচরের তরে ধারটা রাকতে। দেব না তো বলিনি মা, তবে চোকের উপরই তো দেকলে, গেল বচর বানে ধান পান সব ভেসে গেল, তার আগের বচর, খরায় সব জ্বলল–এই কতাগুলো তুলে বলে দিবে মা যেন গরিবের উপুর এতো অত্যেচার না করে। মাতার ঘাম পায়ে ফেলে খাটতেছি তো।…ভগমান মারলে কী করব? তো মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা, এই নায়েবমশার অত্যচার।

    সরমা তাকিয়ে দেখেন। দেখেন

    ওই আধপেটা খাওয়া চেহারার দিকে।

    এদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা পরিশ্রমের ফসলে বাবুদের বাড়ির মেঝেয় মার্বেল মোড়া হয়, মাথার উপর ঝাড়লণ্ঠন জ্বলে, সাটিনের বিছানায় লেসের ঝালর দোল খায় টানা পাখার হাওয়ায়।

    এই লোকগুলোকে আখমাড়াইয়ের মতো মাড়াই করে রস নিংড়ে বার করে, তা থেকে বাবুদের বেপরোয়া ভোগের উপচার সাজান হয়।

    কী বিবেকবর্জিত নির্লজ্জ সেই ভোগ।

    আর তারপর?

    আমরা বাবুরা? ওদের শতছিন্ন আঁচলের খুঁটে দুমুঠো মুড়ি চিড়ে ঢেলে দিয়ে আত্মতুষ্টি, বোধ করি কতই দয়া করলাম। আমাদের মাত্রাহীন বিলাসের পরাকাষ্ঠা উৎসব অনুষ্ঠানে ওদের পথেঘাটে কোথাও দুখানা পাত পেতে বসিয়ে দুটি অবহেলার অন্ন ঢেলে দিয়ে আত্মপ্রসাদ অনুভব করি, কী উদারতা দেখালাম। কী প্রজাবাৎসল্যের নমুনা রাখলাম।

    তীব্র একটা বিদ্রোহে প্রবল কণ্ঠে বলে উঠতে ইচ্ছে করে সরমার, কেন? কেন এত ভীরু তোরা? কেন মুখ বুজে এত অত্যাচার সহ্য করিস? তোরাই তো পারিস কাছারি বাড়ি জ্বালিয়ে দিতে। পারিস খাজাঞ্চিখানা লুঠ করে জমিদারবাড়ির এই সুখের শয়নের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বাবুদের ভিটেমাটি উচ্ছেদ করতে।

    মাথার ঘাম যদি পায়ে ফেলিসই, তো উচিত জায়গায় ফ্যাল। অন্যায় দখলের হাত থেকে নিজেদের ভাগ কেড়ে নিতে, নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে খাট প্রাণপণে। এতখানি শক্তির আধার হয়ে, তোরা এত দুর্বলের ভূমিকায় পড়ে আছিস কেন রে ভীরু কাপুরুষের দল?

    বলতে ইচ্ছে হল।

    কিন্তু ইচ্ছে করলেই কি বলা যায়?

    যায় না।

    তাই শান্তকণ্ঠে বলতে হয়, মানুষের উপর মানুষের অত্যাচার আটকানোর সাধ্যি স্বয়ং ভগবানেরও আছে কিনা জানিনে বাছা। আমি নিষেধ করতে গেলে আক্রোশ বাড়বে, তলে তলে অত্যাচারের মাত্রা বাড়াবে। ওতে কোনও লাভ হবে না।

    ওরা একটুক্ষণ নিজেদের মধ্যে চুপিচুপি কী একটা বলাবলি করে, তারপর মুখে ফুটে ওঠে একটি স্বর্গীয়ের হাসি। অতঃপর বুড়ো জলধর একটু এগিয়ে এসে বলে, ধেষ্টতা মার্জনা করো মা জননী। আপনি রাজাবাবুর ঠাঁই একটু ইচ্ছে প্রকাশ করলেই রাজাবাবু ধমকের চোটে নায়েবমশায়কে ঠাণ্ডা কোরে দিতে পারে!

    আমি একটু ইচ্ছে প্রকাশ করলেই!

    সরমার মাথা থেকে পা অবধি একটা বিদ্যুতের শিহরন বয়ে যায়।

    কী অলীক ধারণা!

    কী অবোধ এরা।

    সরমা কি চেঁচিয়ে উঠে বলবেন, বোকার মতো কথা বোলো না তোমরা! ভুল ধারণা! ভুল ধারণা। তোমাদের রাজাবাবুর কাছে তোমাদের বড় মান্যভক্তির, রানিমার ইচ্ছের কোনও মূল্যই নেই। কানাকড়ারও না।

    না কি হেসে উঠবেন, তোরা কী মুখ রে-বলে।

    কিন্তু তাই কি বলা যায়?

    ওই নির্বোধ নিরক্ষর বিনোদবালাও জানে, ঘরের মধ্যে কী হচ্চে কে দেখতে যাবে? লোক দরবারটাই আসল।

    আর সরমা জানবেন না সে কথা?

    বারো বছর বয়েসেই সরমার স্কুলে পড়া বন্ধ হয়ে গেছে বটে, তবু অক্ষরের জগৎ থেকে নির্বাসিতা হতে হয়নি তাঁকে। বৈভবের একটা সুবিধে বৈভবশালীরা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে অনেক কিছু আহরণ করে করে আপন পার্শ্বসীমায় জড় করে রাখে। দেখাবার জন্যে, সাজাবার জন্যে, মানমর্যাদা বাড়াবার জন্যে।

    বই এদের কাছে তেমনি একটা অপ্রয়োজনীয় মান। সাজিয়ে রাখা আছে সারি সারি আলমারি বোঝাই করে। আছে দোতলার হল-এ যে হল-এ ঘর সাজাবার আরও বহুবিধ মূল্যবান জিনিস সাজান আছে।

    কিন্তু এত মূল্যবান কি আর কোনওটা?

    ঘরটা প্রথম দেখে এই কথাটা মনে হয়েছিল সরমার।

    সরমার অনেক সুখও আছে বইকী!

    এই বিরাট সংসারের সব কিছুতেই তার অপ্রতিহত অধিকার।…শক্তিপ্ৰসাদ বলেছিলেন মাঝিহীন নৌকোখানা কাদায় পুঁতে বসে আছে, হাল বৈঠা সব তোমার হাতে তুলে দিলাম। দেখি কেমন চালাতে পারো। দেখি আমার বাছাইয়ে ভুল বেরোয়, না, ধন্যি ধন্যি পড়ে।

    ছেড়ে দিয়েছিলেন সব কিছু। হাতে দিয়ে দিয়েছিলেন সব চাবি।

    তা সেই পাওয়া অধিকারটা কেউ খর্ব করতে আসেনি। এটা সুখ বইকী!

    কে জানে, রুদ্রপ্রসাদ যদি টের পেতেন, এই ঐশ্বর্যমোড়া প্রাসাদখানার মধ্যে সরমার কাছে সব থেকে মূল্যবান ওই আলমারিগুলো, তা হলে সেগুলোকে অন্দরের এলাকা থেকে নির্বাসন দিয়ে বসতেন কি না।…টের পাননি হয়তো। সরমার কতটুকুই বা তাঁর লক্ষে পড়ে? ভারপ্রাপ্ত কাউকে ভার দেওয়া আছে বছর বছর পুজোর আগে যখন কলকাতায় যাবে পুজোর বাজার করতে, যখন কলকাতার বাজার ছুঁড়ে সব থেকে নতুন ফ্যাশানের দামি দামি সব শাড়ি নিয়ে আসবে বউরানির জন্যে। সে নির্দেশের ব্যতিক্রম হয় না। কিন্তু রুদ্রপ্রসাদ কি কোনওদিন লক্ষ করেছেন সে শাড়ির কোনওটা সরমার অঙ্গে উঠেছে কিনা?

    তেমনি লক্ষ করেন না, বছর বছর যে সব বই আসে কলকাতার বাজার থেকে, সেগুলো কে রাখে, কে তোলে, কে পড়ে।

    অগ্রাহ্য ঔদাসীন্যটা দুঃখের।

    আবার হয়তো বা আরামেরও।

    এই যে সরমার এই এজলাস বসানো, এটাও তত বন্ধ হয়ে যেতে পারত।…চেষ্টা তো করেছিলেন মানদা নীরদা। সুকৌশলে কোনও এক মহামুহূর্তে রুদ্রপ্রসাদের কানে তুলে, মন্তব্য করে বসেছিলেন, ছোটলোকের মরণ তো! বসতে পেলে শুতে চাইবে। আজ চিড়ে মুড়ি টাকাটা সিকেটার উপর দিয়ে যাচ্চে, এরপর না পাত পেতে বসে পড়তে বায়না ধরে। এই ভয়।

    কিন্তু এই মন্তব্যটাতেই পিসিরা খুঁটি কাঁচিয়ে বসলেন। একে তো ছোট থেকেই পিসিদের দুচক্ষে দেখতে পারেন না রুদ্রপ্রসাদ। কতকটা স্ত্রীজাতি বলে। এবং কতকটা তাঁদের নিজ নিজ প্রকৃতির দোষে। তার উপর আবার ওই ভয় শব্দটার উচ্চারণ।

    শুনে ভুরু কুঁচকে উঠেছিল রুদ্রপ্রসাদের, ভয়? ভয় কীসের?

    একজন তাড়াতাড়ি সামলে নিতে চেষ্টা করেছিলেন, আহা হা আমরা কি আর ভূতের ভয়ের কথা বলতেচি? এই ভাঁড়ার ধ্বংসের ভয় আর কি!…ব্যাঙালকে ম্যাগের খেত দেকালে যা হয়!

    রুদ্রপ্রসাদ কড়া গলায় বলেছিলেন, দুটো চারটে হতভাগা যদি পাতই পাতে, লাহিড়ীবাড়ির ভাঁড়ার শুন্য হয়ে যাবে?

    না না, তা কি বলতেচি, তা কি বলতেচি? বউরানিকে জ্বালাতন-পালাতন করে নীছাড়িরা, তাই

    জ্বালাতন!

    বউরানিকে।

    রুদ্রপ্রসাদ হঠাৎ পিসিদের হতচকিত করে হা হা করে হেসে উঠে বলেছিলেন, তা করুক না একটু জ্বালাতন। তোমাদের কাজের সাহায্যই করছে।

    এরপর আর কে কোন কৌশল ফাঁদতে সাহস করবে?

    অতএব এখানেও সরমা অপ্রতিহত।

    সরমার উচিত নয় নিজেকে দুঃখী ভাবা।

    হৃদয়যন্ত্রের সব তার কি উচিত বোধের সদর্পে বাজে?

    শুধু কণ্ঠযন্ত্রটাকে উচিত অনুচিতের নির্দেশে আয়ত্ত রাখতে হয়।

    তাই সরমা ওদের ওই অবোধ উক্তিতে একটু মৃদু হাসি হেসে কৌতুকের গলায় বললেন, আমি ইচ্ছে প্রকাশ করলেই তোমাদের রাজাবাবু সেটি করবেন, এ কথাটি কে বলল তোমাদের বাছা?

    এখন জলধরকে থো করে হারান একগাল হেসে বলে, একতা কি আর ডেকে হেঁকে বলে বেড়াতে হয় মা? চোক নাই আমাদের? দেকচিনে?

    তা একটা দৃশ্য দেখছে বটে তারা। পুরুষানুক্রমে এই বাবুদের বাড়ির চিরাচরিত যে দৃশ্য দেখতে চোখ মন অভ্যস্ত, রুদ্রপ্রসাদের আমলে সে দৃশ্য নেই। নেই নিত্যনতুন সুন্দরী জোগানের দৃশ্য, নেই দিনের পর দিন বেহুশ হয়ে বাগানবাড়িতে পড়ে থাকার দৃশ্য, রাজকোষ উজাড় করে মেম বাইজি পোষার দৃশ্য।

    প্রজার ঘরের বউ ঝি একটু রূপসী হলে, ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকার অবস্থাও নেই এখন।…বাইজি টাইজি আসে বটে মাঝে মাঝে, নাচনা গাওনা হয়, তবে সেটা যতটা মানমর্যাদা বজায়ের জন্য ততটা অন্য কারণে নয়!…

    এর মূল কারণটা কী?

    দুই আর দুইয়ে চারের হিসেবই জানে তারা। সেই হিসেবই করে। তাই অনায়াসে একগাল হেসে বলে, এ কি আর হেঁকে ডেকে বলে বেড়াতে হয় মারানি!

    সরমা বিনোদবালার মন্ত্র মনে রেখে আর একটু হেসে বলেন, বলছ যখন, তখন বলে দেখব তোমাদের রাজাবাবুকে। তবে বেশি আশা রেখো না বাপু। তিনি তোমাদের নায়েববাবুর থেকেও শক্ত।

    কী যে বলেন রানিমা। কীসের সাতে কীসের তোলানা! সিংঘে আর শ্যালে।

    বলে রানিমার জয়গান দিয়ে আর জলপান নিয়ে বিদায় নেয় তারা।

    তবে তক্ষুনি যে ননীর কাজ মেটে, তা নয়।

    হাড় দুঃখী মেয়েমানুষগুলো তখনও পাল পাল ছেলেপুলে নিয়ে জটলা করছে। ধামায় পড়ে থাকা শেষ মালটুকু তারা ঘরে ওঠাতে দিতে রাজি নয়।..তাই পুরুষ কটা চলে যেতেই ধেয়ে আসে। খ্যাচমেচিয়ে বলে চলে, মাসি, আমার এই ছাওয়ালডারে আর দুটোখান দ্যাওগো মা।…ঘরে একটা খুকিরে থুয়ে এইচি মাসি, তার নেগে দুটো ফেলে দ্যাও এই আঁচলে।…

    অ মাসি, এই খোকাড়া বলতেচে পায় নাই।…যে, ইদারে আর এট্টা বসি। ইদিকে সরি আয় না মুকু বাঁদর।

    ননী ক্রোধ আর ঘৃণা মিশ্রিত তিক্ত কণ্ঠে বলে ওঠে, পঙ্গপালের ঝাড় ফুরোয়ও না গা! বেরো বেরো। যার হয়ে গ্যাচে সে বেইরে যা।…পেরাণ বের করে দে লো।

    সরমা উঠে দাঁড়ান। স্থির দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, কাজটা যদি তোমার এত ভার লাগে ননী, এরপরের খেপ থেকে এটা তুমি আর কোরো না। আর কেউ করবে অখন।

    কিন্তু তারপরের খেপ কি আর এল?

    আর উঁচু দাওয়ায় বসল, ধামা ধামা মুড়ি, চিড়ে, মুড়কি, বাতাসা! ননীর বদলে আর কাউকে নিয়োগ করতে পেলেন সরমা? কোনও মধুরভাষিণী দয়ার্দ্রচিত্ত মহিলাকে?…

    না, সে খেপ আর আসেনি।

    আজকেও হাটবার না?

    হঠাৎ মনে পড়ল সরমার।

    এখন সন্ধে হয়ে গেছে। এ সময় লোকগুলো বিদায় নেয়। …বাগদি বউ উঠোন সাফ করতে লাগে।

    আচ্ছা আজ কি হাট বসেছিল?

    হাটের বাজনা বেজেছিল?

    চিরাচরিত নিয়মে দেবীপুরের ওই হাটটায় যতক্ষণ হাট চলে, ততক্ষণ ডুগডুগ বাজনা বাজে মেলাতলার মতো। এই রাজবাড়ির বারান্দা থেকে শুনতে পাওয়া যায়। ..কই, শুনতে কি পেয়েছিলেন কোনও সময়! সরমা?…সরমা কি ছিলেন এখানে? না বোধহয়! সরমা নামের একটা মেয়ে আজ সাতদিন ধরে একটা গভীর অরণ্যের মধ্যে দিশেহারা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভেবে পাচ্ছে না কোনখান দিয়ে বেরিয়ে পড়বে।

    এই অরণ্যটা দীর্ঘ দশটা বছর সময়।

    সেই সময়টার জটিল জটাজালের ফাঁকে ফাঁকে সহস্র স্মৃতির ফণাধরা সাপ। সরমা যে ফাঁকটুকু দিয়ে বেরিয়ে পড়তে চাইছেন অমোঘ নিয়তি বলে সেইখান দিয়েই ওই সাপের ছোবল খাচ্ছেন।

    স্মৃতি এত যন্ত্রণাদায়ক?

    প্রাণের ভিতরটা ছিঁড়েখুঁড়ে দেয়।

    দীপ্তিপ্রসাদ যদি অসুখ করে মারা যেত, এত যন্ত্রণা হত? বারবার ভাবতে চেষ্টা করেছেন সরমা দীপ্তিপ্রসাদের রোগশয্যায় পড়ে থাকা মূর্তি। ভাবতে চেষ্টা করেছেন, মৃত্যুর সঙ্গে মানুষের লড়াইয়ে মানুষের হার হল, বিজয়ী মৃত্যু নিয়ে গেল একটা জ্বলজ্বলে ছটফটে প্রাণের কণা।…লুটিয়ে পড়লেন সরমা।….

    তখন? তখন কি সরমা এই রকম ভয়ংকর জ্বালায় বিদীর্ণ হতেন?

    বুঝতে পারেন না।

    মনে হয়, বুঝি তাতে কিছুটা সান্ত্বনা থাকত। এ যে সান্ত্বনাহীন এক অগ্নিদাহ। এ যে কেবলই মনে হচ্ছে, আমারই দোষে! আমারই অবোধ অসতর্কতায়। আমি কেন তার সেই জন্মক্ষণের মুহূর্তটি থেকে বুক দিয়ে আগলে রাখিনি। কেন তাকে এক খামখেয়ালি দস্যুর হাতে ছেড়ে দিয়েছিলাম? কেন লড়ালড়ি করিনি? কেন মিনতি করিনি, পায়ে পড়িনি, কান্নায় ভেঙে পড়িনি? কেন বলিনি আমার ওই প্রাণপুতুলটাকে তুমি তোমার নিষ্ঠুর হাতে ছিনিয়ে নিয়ে যেও না।

    সরমা তাই সেই দশটা বছর সময়ের অরণ্যে পাক খেয়ে বেড়াচ্ছেন আজ সাতদিন ধরে। সরমার হাতে একখানা বৃহৎ সাম্রাজ্যের মালিকানার দলিল ছিল, পাকা দলিল।

    সাম্রাজ্যটা পেয়েছিলেন সরমা সম্পূর্ণ স্বত্বে। সেই সাম্রাজ্যটা রাখতে পারেননি, তিনি হারিয়ে ফেলেছেন।…এখন আর সেই দশ-দশটা বছরের প্রতিটি দিন হাতে করে তুলে তুলে তন্নতন্ন করে দেখলে কী হবে, কোথায় ভুল ঘটেছিল, কোথায় ভুল ঘটেছিল!

    হঠাৎ সন্ধ্যার অন্ধকারটা নেমে এল।

    সরমা জানেন, এত বড় ওলটপালট কাণ্ডেও এই দৈত্যের সংসার নির্ভুল নিয়মে চলবে। এখুনি বন্ধু ঘরে ঘরে আলো জ্বেলে দিয়ে যাবে, সন্ধ্যার শাঁখ বেজে উঠবে, মন্দিরে আরতির ঘণ্টাধ্বনি ধ্বনিত হবে।

    জোর করে মনটাকে অন্যত্র ফেলতে চেষ্টা করলেন। ভাবতে চেষ্টা করলেন তারপর কী হল? বাকি খাজনার দায়ে মধু মিস্ত্রি, জলধর আর হারানের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে নায়েবমশাই?

    হয়তো দিয়েছে এতদিনে।

    সরমা তাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন।

    বলেছিলেন, আচ্ছা বলে দেখব তোমাদের রাজাবাবুকে।

    বলার এক পলক আগেও ভাবেননি এটা সত্যি সম্ভব। হঠাৎই সংকল্প করে ফেলেছিলেন। আচ্ছা দেখিই না বলে। অপমানিত হব? হলামই না হয়। সে অপমান গায়ে মাখব না।

    বলব, আপনার কাছে তো কখনও কিছু চাইনি, আজ একটা প্রার্থনা জানাব–

    কে বলতে পারে প্রার্থনা মঞ্জুর হয়ে যেতে পারে কিনা।

    নতুন বউয়ের আসনে সরমা নামের সেই বালিকাটি তার নবীন বরকে আপনি করে কথা বলছে দেখে বর দু-একবার বলেছে, আমায় আপনি বলল কেন? বরকে কি কেউ আপনি বলে?

    মেয়েটা বলেছিল, গুরুজন তো।

    আমার অত গুরুজন-টুরুজন ভাব ভাল লাগে না।

    তবু মেয়েটা বলেছিল, আমার লজ্জা করে।

    সেই প্রথম ভুল।

    এখন ভাবেন সরমা।

    আর সে কথা বলেনি মানীবর।..সরমাও তাই আর কোনওদিন আপনি থেকে তুমিতে নামতে পারলেন না। …হয়তো সেটা পারলে ভাল হত। কিংবা কে জানে কোথায় নামতে হত।… কিন্তু সেদিন ভেবেছিলেন সরমা নিজের জন্যে তো নয়, গরিব প্রজার জন্যে, না হয় নামলামই একটু, খোয়ালামই একটু মান।

    সংকল্প করেছিলেন।

    কিন্তু সরমার সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্য কে জানে, সেই মান খোয়াবার অবকাশটা আর পাননি তিনি।

    সে রাত্রে অন্দরমহলে খেতে শুতে আসেনইনি রুদ্রপ্রসাদ। না কি সারাদিন শিকার করে ফিরে এসে ক্লান্ত হয়ে বারবাড়িতেই থেকে গিয়েছিলেন।

    অন্দরমহলে এই চকমিলানো দোতলার একটা অংশ সরমার এলাকাভুক্ত, আর একটা অংশ রুদ্রপ্রসাদের। ও দুটোর মধ্যখানের যোগসূত্র এলাকাটা খোকারাজাবাবুর। তার জন্যে বড়দের মতোই সাজসজ্জা আরাম আয়েসের উপকরণ মজুত। বাকি অংশটায় সিঁড়ি, হল, ছোট ছোট ঘর, দাসীদের ব্যবহারের। যাতে ডাকলেই পাওয়া যায় তাই তাদের নিকটে রাখা।

    দীপ্তিপ্রসাদের মহলে রাজাবাবুর দিকের দরজাগুলো থাকত খোলা। সরমার দিকের গুলো থাকে বন্ধ। অলিখিত এক আইনে এই ব্যবস্থা।

    রুদ্রপ্রসাদ যে রাত্রে অন্দরে আসেন, সে ওই ছেলের জন্যেই। মানে আসতেন। এই কদিন আগে পর্যন্ত।…রাত্রে ছেলের কাছে গল্প করতেন, তাঁর সারাদিনের কীর্তিকলাপের কাহিনী। পাখি শিকারের, মাছ ধরার, মাঝে মাঝেই বন্যজন্তু শিকারের। তা ছাড়া বেয়াদপ কোনও প্রজাকে এমনকী হয়তো পথচলতি লোককেও কীভাবে শায়েস্তা করেছেন, ক্ষেত্রবিশেষে ছালচামড়া তুলেছেন, তার গল্প। পথচলতি লোকটা রুদ্রপ্রসাদের টমটম হাঁকানোর পথে নাকি বাইসিকেল চালিয়ে যাচ্ছিল, থেমে পড়েনি।…লাগাও চাবুক, কেড়ে নাও ওর অহংকারের মাল বাইসিকেলখানা।

    ছেলে শুনে হেসে কুটিপাটি হত। বলত, বেশ হয়েছে, খুব হয়েছে। আর প্রজা-টজা? তাদের তো শুধু শুধুই শাসানো দরকার, নইলে শায়েস্তা থাকবে কেন?

    শায়েস্তা যে আর বেশিদিন থাকবে না, সে খেয়াল নেই রুদ্রপ্রসাদের, থাকে না এইসব বাবুদের। অথবা সকল কেষ্ট-বিষ্ণুদেরই। কারণ তাঁরা, পরিবৃত থাকেন একদল চতুর ফন্দিবাজ, দিনকে রাত আর রাতকে দিন করা আমলা শামলা মোসাহেবের দ্বারা। ওই মোসাহেবদের চোখ দিয়েই পৃথিবী দেখেন।

    তারা বলে, সব ঠিক হ্যায়।

    এঁরা ভাবেন, সব ঠিক হ্যায়।

    ভাবেন যাবৎ সূর্য তাবৎ আমি, আর তাবৎ আমার অটল অনড় আসন।

    রুদ্রপ্রসাদও তাই ভেবে এসেছেন, ভেবে চলেছেন। তাই ছেলেকে সেই মন্ত্রেই তালিম দিচ্ছিলেন। রাত্রে মায়ের কাছে ছেড়ে রাখেন নিশ্চয়, তার মা ন্যাকা ন্যাকা রূপকথার গল্প শোনাবে, শোনাতে বসবে নীতিকথার ধর্মকথার গল্প। তার মানে বোষ্টমবাড়ির হাওয়া ভরে দেবে ছেলের মধ্যে।

    সেটি হতে দেওয়া চলে না।

    তাই রুদ্রপ্রসাদের এই অন্দরে অবস্থিতি।

    কিন্তু সেদিন এলেন না।

    যেদিন সরমা মান খোয়াবার সংকল্প করে বসে ছিলেন।

    অনেক রাতে শুনেছিলেন, বাবু আজ বারমহলে খাবেন শোবেন। কারণ তিনি শিকার ক্লান্ত।…সরমা লক্ষ করেছিলেন পিসিরা আশাভরা মুখে পুরনো দাসীদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন বংশোধারার বাতাস এসে লাগল বুঝি।…যশোদা দেখে আয় তো, কোতায় কেমন বিচানার ব্যাবোস্তা হয়েছে। কোনও মাল আমদানি হয়েছে কি না। কর্তাদের আমলে তো হামেশাই এমন হত। অন্দরে আর কদিন রাত কাটাতে আসতেন তাঁরা?

    এ আলোচনা যে সরমার কানে তোলবার জন্যেই অসতর্কতার ভান, তাও চোখ এড়ায়নি সরমার। নিঃশব্দে নিজের আহার সেরে চলে এসেছিলেন।

    আর এসে, আস্তে দীপ্তিপ্রসাদের দিকের দরজাটা খুলে তার শোয়ার ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। ঝাড় লণ্ঠন নেভান হয়েছে তখন, মৃদু মোমবাতির আলোয় গোলাপি সাটিনের বিছানায় দেবদূতের মতো ছেলেটা অঘোরে ঘুমোচ্ছে।…এমন করে তো দেখতেই পান না ছেলেকে। তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারেননি সরমা কতক্ষণ যেন।

    তারপর নিশ্বাস ফেলে সরে এসেছিলেন।

    দরজাটা খোলাই রেখেছিলেন। দেখতে পেয়েছিলেন ঘরের মেঝের দেয়ালের ধারে প্রায় দেয়ালের সঙ্গে লেপটে শুধু মাটিতে শুয়ে আছে দীপ্তির খাসভৃত্য কেষ্ট! হ্যাঁ একটা করে খাসভৃত্য তো থাকেই সব ধনী ঘরের ছেলেদের। খোকারাজাবাবুর থাকবে, এতে আর বিচিত্র কী। এই খাসটির অবশ্য বয়েস তার মনিবের থেকে খুব বেশি নয়, হয়তো বা সমানও হতে পারে। তবু ফাইফরমাশ যা খাটে, অমানুষিক।

    খোকারাজার যখন মেজাজ ভাল থাকে, তখন কেষ্টর স্বর্গসুখ। আবার যখন সেই মেজাজটি বিগড়োয়, তখন কেষ্টর কেষ্টপ্রাপ্তি ঘটার মতো অবস্থা ঘটে। এই মেজাজের পারা কেন ওঠে-নামে, তা কেষ্ট জানে না, কাজেই অবহিত হবার উপায় থাকে না। সর্বদা মাথার উপর উদ্যত খাঁড়া নিয়েই থাকতে হয় খিদমদগারদের।

    তবু কেষ্ট খোকারাজাবাবুকে প্রাণতুল্য ভালবাসে। মরতে বললে মরে, বাঁচতে বললে বাঁচে। কেষ্ট রাতে ঘুমোয় সতর্ক প্রহরীর মনোভঙ্গি নিয়ে। পাছে হঠাৎ জেগে উঠে ডেকে সাড়া না পায় রাজাবাবু।

    ছেলের ঘরের দরজা থেকে সরে আসবার সময় বড় গভীর একটা নিশ্বাস পড়েছিল সরমার। ওই তো একগোছা ফুলের মতো ছেলেটা (বাপের মতো বলিষ্ঠ গঠনভঙ্গি নয় দীপ্তির, মায়ের মতো সুকুমার সুডোল ছিপছিপে, তাই একগোছা ফুলের মতোই লাগে।) তবু সরমার সাহস নেই ঝুপ করে তার বিছানার একাংশে শুয়ে পড়ে ঘুমন্ত ছেলের গায়ে হাতটা রাখেন, তার ঘুমন্ত নিশ্বাসের বাতাসে শাস নেন। …কে বলতে পারে তেমন সাহস করতে গেলে কী অভ্যর্থনা জুটবে।

    সরে আসবার সময় আরও একটা নিশ্বাস পড়ল। সেও গভীর পরিতাপের।

    স্রেফ মাটিতে শুয়ে পড়ে আছে কেষ্ট, মাথার তলায় বালিশের বদলে নিজের ছোট গামছাখানা বিড়ে পাকিয়ে রেখে।…অথচ এই সাবেকি সংসারে কত আলতু ফালতু বিছানা।..সরমা জানেন পুরনো দাসীরা রাজার হালে আশেপাশে বালিশ নিয়ে চৌকির উপর পুরু গদিতে বিছানা পেতে শোয়।…কিন্তু এখানে করার কিছু নেই।

    সরমা জানেন মনিবের সামনে বালিশ বিছানায় গা ঢেলে শোয়ার মতো বেয়াদব দৃশ্য বরদাস্ত করতে রাজি হবেন না রুদ্রপ্রসাদ। অতএব তাঁর ছেলেও হবে না রাজি।

    টানাপাখা টানা ছেলেটাকে একদিন মাঝরাত্রে কান ধরে ওঠবোস করিয়েছিল দীপ্তিপ্রসাদ।…আর হি হি করে বলেছিল, ঘুম ছাড়ল? ঘুম ছাড়ল?

    চারদিক খোলা, বৃহৎ বৃহৎ জানলাদার এই বিরাট শয়নঘরে প্রকৃতি প্রেরিত বাতাসের অভাব নেই, তবু পাঙ্খবরদার হঠাৎ হাত শিথিল করে চুলবে? আবদার?

    হয়তো সরমা একটা বালিশ দান করলে দীপ্তিপ্রসাদ সেটা তার মাথার তলা থেকে টেনে নিয়ে দুর করে ফেলে দিয়ে বলবে, বালিশে মাথা দিয়ে শোবেন বাবু? আবদার।

    সরে এসেছিলেন সরমা।

    তখন কল্পনা করতে পারেননি হঠাৎ মাঝরাতে কী হতে পারে। আর রাত পোহালে সকালবেলা আরও কী হতে পারে। মাঝরাতে একটা ঝড় উঠেছিল।

    হঠাৎ একটা প্রচণ্ড আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিলেন সরমা। আচমকা আততায়ীর আঘাতে মানুষ অজ্ঞাতসারে যেমন অকস্মাৎ আর্তনাদ করে ওঠে, তেমনি।

    এ কার গলা?

    বালকেরই তো মনে হল। ওই আর্তনাদের পরই চুপ হয়ে গেছে। উঠি পড়ি করে ছুটে দীপ্তিপ্রসাদের ঘরের দরজায় এসে একটা অভাবিত দৃশ্য দেখতে পেলেন সরমা।…দেখলেন কেষ্টটা যেমনভাবে দেয়ালের ধারে লেপটে শুয়ে ছিল, তেমনিই রয়েছে, আর দীপ্তিপ্রসাদ তার উপর যথেচ্ছ লাথি চালিয়ে যাচ্ছে। পেটে বুকে মুখে।

    কেষ্টর মুখে আর শব্দমাত্র নেই। দীপ্তিপ্রসাদেরও নেই। শুধু প্রত্যেকবার পদতাড়নার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখ দিয়ে হিঃ হিঃ গোছের একটা হিংস্র শব্দ বেরোচ্ছে।

    ছুটে এলেন সরমা, ছেলেকে পিছন থেকে টেনে ধরে বলে উঠলেন, এটা কী হচ্ছে?

    দীপ্তিপ্রসাদ মায়ের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে করতে ততোধিক হিংস্র গলায় বলে, ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও বলছি।

    না, ছেড়ে দেব না।

    সরমা দৃঢ় গলায় বলেন, তুমি ওকে মেরে ফেলবে নাকি?

    হ্যাঁ মেরে ফেলব। একেবারে মেরে ফেলব। ছেড়ে দাও বলছি।

    বলার সঙ্গে সঙ্গে হাত পা দাঁত সব কিছুই চালাতে কসুর করে না। তবে সরমার সঙ্গে জোরে পেরে ওঠে না! সরমার শাড়ি ছিঁড়ে যায়, চুল খুলে যায়, তবু ছেলেকে সবলে ধরে রেখে বলেন, কেষ্ট, তুই শিগগির পালা। আমার মহল দিয়ে পশ্চিমের সিঁড়ি দিয়ে নেমে ছুটে পালিয়ে যা। বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে যাবি।

    কিন্তু কেষ্টর পক্ষে তখনি ছুটে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। কেষ্ট বুক পেট ধরে একটুক্ষণ দাঁড়াতে বাধ্য হয়।

    সরমা তীব্রস্বরে ছেলেকে বলেন, দেখতে পাচ্ছ ওর অবস্থা? বুকে ধাক্কা লেগে যদি মরে যায় তো, তোমায় ফাঁসি যেতে হবে তা জানো?

    ফাঁসি? হুঁ!

    দশ বছরের তিরতিরে ছিপছিপে ছেলেটা মায়ের উপর সমানে হাত পা চালাতে চালাতে অগ্রাহ্যের গলায় বলে ওঠে, ফাঁসি! কুকুর বেড়াল মারলে ফাঁসি হয়?

    কুকুর বেড়াল? কেষ্ট কুকুর বেড়াল?

    না তো কী?

    আচ্ছা তোমার এই কথার জবাব একদিন ভগবানের কাছে পাবে।

    বলে ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে তার খাটের উপরই বসে পড়েন সরমা।…কারণ কেষ্ট এবার পালাতে সক্ষম হয়েছে। এবং সরমার ঘরের সিঁড়ির দিকের দরজাটা যে বাইরে থেকে বন্ধ করে দিতে পেরেছে, তা শব্দেই বোঝা গেছে।

    অতএব কেষ্টর পিছু পিছু ছুটে মারতে যাবার উপায় দীপ্তির নেই।…সরমার হাতের উপর ছেলের কামড়ের দাগ। তার উপর আস্তে ফুঁ দিতে দিতে বলেন সরমা, শিক্ষা উপযুক্তই হয়েছে। এখন বরং আমাকেই মেরে ফেল। আমিই গরিবের মেয়ে, বেড়াল কুকুরেরই সমান।

    মার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে দীপ্তি ঝগড়ারত হিংস্র জন্তুর মতো হাঁপাচ্ছিল। এখন চেঁচিয়ে বলে উঠল, কেন তুমি ওকে ছেড়ে দিলে? আমি ঠিক মেরে ফেলতাম ওকে!

    সরমা ছিঁড়ে খুঁড়ে এলোমেলো হয়ে যাওয়া শাড়িটাকে গোছাতে গোছাতে শান্ত গলায় বলেন, কী করেছিল ও?

    এখন হঠাৎ, হয়তো এই শান্তকণ্ঠের স্পর্শে দীপ্তিপ্রসাদ প্রায় কেঁদে ফেলার মতো হয়। ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে ওঠে, ও কেন বলল, রাজাবাবু কোথায়, আমি কেমন করে জানব?..কেন বলল, রাজাবাবু যে রেতে এখানে আসেনাই তাই জানিনে।

    এই! এই কথার জন্যে তুমি ওকে মেরে ফেলছিলে?…

    সরমা হতাশ গলায় বলেছিলেন, ঠিকই বলেছি। তুমি আমায় মেরে ফেল। রেহাই পাই তোমাদের হাত থেকে।

    তুমি চলে যাও।

    কেন? মার আমায়?

    আ, চলে যাও না। যাও বলছি শিগগির

    দীপ্তিপ্রসাদ মাকে ঠেলতে ঠেলতে ঘরের দরজা পার করে দিয়ে দরজায় খিল লাগিয়ে দেয়।

    ভগবান জানেন তারপর বিছানায় পড়ে ফুলে ফুলে কাঁদে, না ওর বাপের ভঙ্গিতে খাঁচায় বন্ধ বাঘের মতো পায়চারি করতে থাকে।

    নিজের ঘরে ফিরে এসে সরমা পাথর হয়ে বসে ছিলেন অনেকক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে চেতনা ফিরেছে…ওর কী দোষ। ওকে যেভাবে তৈরি করা হচ্ছে।

    মাঝরাতে ঘুম ভেঙে সহসা এই এক ঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে ক্লান্ত সরমা শেষরাতে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। জেগে উঠে দেখলেন সকালের আলো ফুটে গেছে। সর্বনাশ! মন্দিরে মঙ্গল আরতি হয়ে গেছে তা হলে বোধহয়। কে গোছ করে দিল?…ভোরের এই মঙ্গল আরতির সময় সরমার অনুপস্থিতি। মনে তো পড়ে না। লজ্জিত হয়ে তাড়াতাড়ি স্নান করতে ঢোকার আগে ছেলেটাকে একবার দেখতে গেলেন। মায়ের প্রাণ মনে হল, ছেলেটাকে যেন অভিসম্পাত দিয়ে বসেছিলুম আমি। বুকটা কেমন করে এল। গেলেন তার দরজায়, কিন্তু দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। সেই বন্ধ করে দিয়েছিল রাতে, ঘুমোচ্ছে। কি উঠে গেছে জানার উপায় নেই। ইচ্ছে হলে বেলা অবধি ঘুমোয় ও, ইচ্ছে হলে ভোরবেলা নেমে পড়ে, বাপের কুস্তির মাস্টার বোলন বক্সকে ভাঙিয়ে জাগিয়ে তুলে কুস্তি শিখতে লেগে যায় অথবা বুড়ো কাসেম আলিকে জাগিয়ে ঘোড়া বার করবার জন্যে তাগাদা লাগায়।

    খাওয়াদাওয়া যথেচ্ছ।

    কোনওদিন সক্কালবেলাই ছানা সন্দেশ মাখন মিশ্রী কচুরি গজা খেতে চাইবে, দেদার খেয়ে নেবে, কোনওদিন হয়তো শুধুই বোলন বক্সের ছোলাভিজে আর বাদামভিজেগুলো সাবড়াতে বসবে মুঠো মুঠো।

    হাতে করে খাবার সাজিয়ে কবে দিতে পান সরমা?

    সরমার কোনওদিক থেকেই মাতৃহৃদয়ের স্নেহক্ষুধা পরিতৃপ্তির উপায় নেই।

    বন্ধ দরজার বাইরে থেকে চলে এসেছিলেন নিশ্বাস ফেলে। স্নানের ঘরে ঢুকে পড়েছিলেন।…আরাম আয়েসের উপকরণে ত্রুটি নেই, ত্রুটি নেই কোনও অনুষ্ঠানের।…শয়নঘর সংলগ্নই মার্বেলমোড়া স্নানের ঘর। বৃহৎ সেই ঘরের একধারে চিনেমাটির টানা লম্বা বিলিতি ফ্যাশানের বাথটব। যার মধ্যে শুয়ে বসে স্নান করা যায়!…ঘরের বাইরে চৌবাচ্চাভর্তি জল, তার মধ্যে পাইপ বসিয়ে স্নানের ঘরের দেয়ালে গর্ত কেটে ঝরনাধারার ব্যবস্থা। এ ছাড়া দুটো চকচকে মাজা পিতলের ঘড়াও ভরা হৃদয় নিয়ে অপেক্ষা করছে।

    আলনায় কোঁচানো শাড়ি, গরদের শাড়ি শেমিজ।

    সরমা বলেন, আমার শুধু ওই ঘড়ার জল হলেই চলে বাপু, এতোর দরকার হয় না।

    কিন্তু সে কথা শুনবে কেন তারা?

    হঠাৎ কোনওদিন, কোনও ত্রুটি চোখে পড়লে রাজাবাবু কার গর্দান নিয়ে বসেন কে বলতে পারে!

    গায়ে ঠাণ্ডা জল ঢালতে ঢালতে দেহের ক্লান্তি এবং মনের ভারও নেমে গেল খানিকটা। সিঁথিতে সিঁদুর লাগিয়ে শাড়ি শেমিজ পরে সদ্য স্নাতা সরমা দেখলেন এদিকেও পথ বন্ধ। কেষ্টর সেই নিশীথ অভিযান। হাসলেন একটু মনে মনে, দাসীদের ডাকাডাকি করে লোক হাসাবেন? রাত্রের ঘটনা ব্যক্ত করে বসবেন?

    নাঃ থাক।

    স্নানের ঘরের পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে ঘোরানো লোহার সিঁড়িটা দিয়েই নেমে এলেন। এই পথেই জল সরবরাহ করে দাসদাসীরা।

    নেমে এসেই সোজা চলে গেলেন মন্দিরে।

    বংশের প্রতিষ্ঠিত দেবতা রামসীতা। তিন-চার পুরুষ আগে কেউ বানিয়ে রেখেছেন। আলাদা দৈবত্র সম্পত্তি আছে এঁর ভোগরাগের জন্যে। সরমা কত সময় মনে মনে হাসেন। ভাবেন, পূর্বপুরুষেরা বুদ্ধিমান ছিলেন। বুঝতেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহ উত্তরপুরুষের কাছে ক্রমশ গলগ্রহ হয়ে দাঁড়াতে পারে। দেবতার ভাত কাপড়ের ব্যবস্থার জন্যে আলাদা জমিজমা থাকাই ভাল।

    প্রণাম করে দেখলেন, আরতি হয়ে গেছে যথাসময়ে। ছোটপিসি নীরদা চন্দন ঘষছেন। পূজারী ব্রাহ্মণ অদূরে ঠাকুরবাড়ি সংলগ্ন বাগান থেকে পুজোর ফুল তুলছেন ঝকঝকে পিতলের সাজি হাতে নিয়ে।…

    নীরদা ভালবাসার গলায় প্রশ্ন করলেন, বউরানিমার শরীল স্বাস্থ্যো কি ভাল নাই?

    সরমা এ প্রশ্নের অর্থ অনুধাবন করেন।

    বলেন, ঠিকই আছি। হঠাৎ ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়ে–আচ্ছা কেষ্টর দিদিমাকে দেখছি না?

    কেষ্টর দিদিমা ঠাকুরবাড়ির কাজ করে। এ বাড়িতেই বুড়ো হয়েছে, সে এখন বার্ধক্যের পেনসনজাতীয়ই সামান্য কাজ নিয়ে থাকে। পুজোর দালান মোছা, পুজোর বাসন মাজা, আরতির সলতে পাকানো, এইসব কাজ কেষ্টর দিদিমার।

    নীরদা মুখ বাঁকিয়ে বলেন, আজ সব দিকেই আতান্তর। আসেনি তো ইদিকে। বসুমতাঁকে পাটিয়ে দেচলো। নাতির নাকি জ্বর।…এই তত…রাতিরে গাণ্ডে পিণ্ডে গিলে গেচে নাতি। জ্বর যে আবার কখন এল

    সরমা সরে আসেন।

    উঠতে বসতে এই সহানুভূতিহীনতা দেখে আসছেন, তবু আশ্চর্য, এখনও এতে ক্লিষ্ট হন। এখনও না ভেবে পারেন না দোষটা এদের, না এদের সৃষ্টিকর্তার?

    কেষ্টর জ্বর শুনেই বুকটা কেঁপে উঠেছে তাঁর। এ আর কিছুই নয়, গত রাত্রের প্রতিক্রিয়া। ভগবান, কেষ্টকে তাড়াতাড়ি ভাল করে দাও। রাত্রের ঘটনাটা যেন বিশদ প্রচার না হয়ে পড়ে।…বেচারি কেষ্টর অধিক কিছু না হয়।

    একতলায় রান্নাবাড়ির পিছন দিকে দাসীমহল। অবশ্য সাবেককালের কোনও কোনও গিন্নি পরিচারিকা, যাদের বিশেষণ হওয়া উচিত সংসার পরিচালিকা–তারা প্রয়োজন অনুসারে ভিতরবাড়িতে রাত্রে থাকে। নীরদা আর মানদার তো চাইই একজন করে খাস সঙ্গিনী।…তাঁদের পুত্রবধূদেরও লাগে কচি ছেলে সামলাতে।…তবে নিজস্ব আস্তানাটা সকলেরই এখানে।

    কেষ্টর দিদিমাকে এখানেই পাওয়া যাবে। সরমা দাসী মারফত দাসীদের ডাকার পথে যান না বিশেষ, নিজেই সে পথে এগোন। কেষ্টর দিদিমা বউরানিকে দেখেই তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বলে, যেতে পারিনি মা, ছোঁড়াডা এমন করি চেপে চেপে ধরতিচে। গা পুড়ি যেতেছে।

    সরমা আস্তে আস্তে বলেন, কখন জ্বর হল?

    জানিনে মা। মাজ রেতে ছেলে হঠাৎ হাওয়া বাতাস নাগায় কাঁপতি কাঁপতি ছুটি এসে আমারে জইড়ে ধরি কইল, দিদিমা জ্বর আসতেছে। আমারে ধর।

    ত্যাখোন গা ঠাণ্ডা ছেল গো মা, এই ভোর আত থে গা পুড়ি যেতেচে।

    সরমা কেষ্টর দিদিমার ঘরে এসে ঢোকেন।

    এখন সকাল। সকলেরই খাঁচা খালি, কারও চোখে পড়ে না এই অসম্ভব দৃশ্য, কেষ্টর দিদিমাই হাঁ হাঁ করে ওঠে, আপনি কেন রে মা

    সরমা কেষ্টর কাছে গিয়ে আস্তে ডাকেন, কেষ্ট! কেষ্ট একবার চোখ মেলে তাকিয়ে আবার চোখ বোজে।

    সরমা বলেন, শশীডাক্তারকে একবার খবর দেওয়াই, এসে দেখে যাক।

    কেষ্টর দিদিমা সসংকোচে বলে, ঠাওর হচ্চে হাওয়া বাতাস লেগেছে, মদ্দিদগা নামাজের জলপড়া এনে গা মাতায় বুইলে দিলিই ভাল হয়ে যাবে মা।

    সরমা বলেন, ভাল হলেই ভাল। তবে ডাক্তারকে একবার দেখানোও ভাল কেষ্টর দিদিমা। আমি কাউকে পাঠাচ্ছি খবর দিতে।

    তারপর ইতস্তত করে বলেন, আচ্ছা তোমাদের খোকারাজাকে দেখেছ? না কি ওঠেনি এখনও?

    কেষ্টর দিদিমা তাড়াতাড়ি বলে, ওমা, উটেচে বইকী! এই তো তেনার চাবুকখানা নাচাতে নাচাতে বেইরে গ্যালো উটোন ধারের থামগুলানকে চাবকাতে চাবকাতে।

    যাক তাও ভাল।

    সে তা হলে ভাল আছে, ঠিক আছে। আপন নিয়মে আছে।

    কেষ্টর জ্বরটা হয়তো শাপে বর, ওই চাবুক নিয়ে ঘুরছে হয়তো কেষ্টর জন্যেই।

    শাপে বর। কেষ্টর জ্বরটা শাপে বর।

    তখন তাই ভেবেছিলেন সরমা।

    ভেবেছিলেন কেষ্টকে না পেয়ে তার চাবুক ঠাণ্ডা মেরে যাবে। ভেবেছিলেন। কারণ বেশিরভাগ সময় তো ভুলই ভাবে মানুষ।…

    ঘণ্টা দুই পরেই টের পেয়েছিলেন চাবুক সহজে ঠাণ্ডা মারে না।…একজনের জন্যে ভোলা চাবুক, হয়তো অপরের উপর আছড়ে পড়ে।

    .

    কতক্ষণ সময় গিয়েছিল তারপর?

    এখন আর হিসেব নেই।

    দু ঘণ্টা? দেড় ঘণ্টা? তিন ঘণ্টা?

    হঠাৎ যদি মাথার উপর বাজ ভেঙে পড়ে, যদি প্রলয়ংকর ঝড়ে আদি-অন্ত তছনছ করে দেয়, যদি প্রচণ্ড ভূমিকম্প পৃথিবী ওলটপালট করে পায়ের তলার মাটি কেড়ে নিয়ে শূন্যতার গহ্বরে আছড়ে ফেলে দিয়ে যায়, কে হিসেব রাখতে পারে সেই সময়টার ঘণ্টা মিনিটের?

    কে হিসেব রাখতে পারে ওইগুলোর কোনও একটাই এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জীবনের উপর, না কি সবগুলোই একসঙ্গে?

    মনে নেই সরমার।

    শুধু মনে পড়ছে সমস্ত পৃথিবী জুড়ে একটা বীভৎস আর্তনাদ উঠছিল..মারা গেছে…মারা গেছে…একেবারে শেষ হয়ে গেছে খোেকারাজাবাবু, খোকারাজাবাবু…

    কে উচ্চারণ করছে এমন অবিশ্বাস্য মিথ্যা কথা? কে খেলছে আগুন নিয়ে?…

    এমন ভয়ংকর একটা শব্দ নিয়ে পরিহাসের খেলা খেলে কেউ?…

    প্রাণে ভয় নেই?

    রুদ্রপ্রসাদকে চেনে না? তাঁর শাস্তির বহর জানে না?

    সরমা ছুটে বারবাড়িতে চলে আসতে আসতে শুনতে পেলেন, রুদ্রপ্রসাদের গলার স্বরটা বাজের মতো প্রচণ্ড শব্দে প্রাসাদের ভিত্তি পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে, যেমন করে পারিস খুঁজে আন সেই শয়তানটাকে! তাকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারব।…মাটিতে পুঁতে ডালকুত্তা দিয়ে খাওয়াব।…গুলি করে মাথার খুলি ঝাঁজরা করে দেব।..

    ছুটতে শুরু করলেন সরমা।

    ওই তো!

    ওই তো ভয়ংকর ওই শাস্তির ব্যবস্থা হচ্ছে মিথ্যাবাদী বোকাটার জন্যে। তামাশা করবার আর বিষয় খুঁজে পায়নি! বলে কিনা খোকারাজা

    রানিমা, আপনি ভিতরে যান।

    বৃদ্ধ সরকারমশাই সামনে এসে সাবধানে বললেন।

    সরমা হঠাৎ ওই সরকারমশাইয়ের চোখের দৃষ্টিতে, গলার স্বরে সত্য মিথ্যার হিসেব বুঝে ফেললেন। সরমা সহসা দিঘির জলের মতো শান্ত হয়ে গেলেন। আস্তে বললেন, আমি কিছু করব না সরকারমশাই! একবার শুধু দেখব।

    দেখবেন বইকী! দেখবেন বইকী মা

    হাউহাউ করে কেঁদে উঠলেন সরকারমশাই, ভিতরবাড়ির মধ্যে নিয়ে আসার ব্যবস্থা হচ্ছে। সদর থেকে ডাক্তার আনতে পাঠানো হয়েছে

    ডাক্তার!…সরকারমশাই!

    সরমা নিজের গলার শব্দ চিনতে পারেননি।

    সরকারমশাই। ডাক্তার এসে চিকিৎসা করবে বলছেন?

    সরকার কপালে একটা হাত ঠেকালেন।

    নিশ্বাস ফেলে বললেন, নাঃ! চিকিচ্ছের আর কিছু নাই মা! আসবেন অন্য কোর্তব্যে! অন্দরে চলে যান মা, রাজাবাবু উন্মাদ হয়ে রয়েছেন। আপনাকে এখানে দেখলে

    ওঃ!

    সরমা নিঃশব্দে ফিরে এসে সদর অন্দরের মধ্যবর্তী চলন দালানে এসে বসে পড়েছিলেন।

    রাজাবাবু উন্মাদ হয়ে আছেন।

    রাজাবাবুর উন্মাদ হবার অধিকার আছে।

    কিন্তু রানিমার?

    নাঃ তাঁর কোনও অধিকার নেই। উন্মাদিনী হবার নয়, উদভ্রান্ত হবার নয়।

    সেখানে বসে বসে শুনতে লাগলেন, পুরবাসীবৃন্দের বিনিয়ে বিনিয়ে কান্না! শুনতে লাগলেন, কী রূপেগুণে আলোকরা ছেলে ছিল সে।

    আশ্চর্য।

    কী অনায়াসে এরা বলে চলেছে ‘ছিল’।

    দীপ্তিপ্রসাদ নামের একটা উজ্জ্বল নক্ষত্রকে বলছে, ছিল! এখনি অতীতের ইতিহাস হয়ে গেছে সে।

    কেষ্ট জ্বর গায়ে উঠে এসেছে, মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে, ও রাজদাবু গো কাল এতের বেলা তুমি আমারে মেরে ফেলালে না ক্যানো? অ্যাক্কেবারে শেষ করে দিলে না ক্যানো? আমি যে সইতি পাচ্ছিনে–

    সরমা আস্তে বললেন, কেষ্ট চুপ কর। আমার কাছে এসে বোস!

    ছবির মতো সব মনে পড়ছে।

    মনে পড়ছে বুড়ো কাসেম আলির ভাঙা গলায় হাউহাউ চিৎকার।

    কাসেম আলিই প্রত্যক্ষদর্শী।

    তার টুকরো টুকরো এলোমেলো কথার মধ্যে থেকে আবিষ্কার হয়েছে

    অন্য অনেক দিনের মতো সকালবেলাই কাসেম আলির আস্তানায় গিয়ে জোর তাড়া লাগিয়েছিল দীপ্তিপ্রসাদ, ঘোড়া বার করার জন্যে। কিছুক্ষণ কথা ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে ভুলিয়ে ভুলিয়ে নিজেকে আর টাটুটাকে প্রস্তুত করে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল কাসেম।…গ্রামটা চক্কর দেওয়াও হয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ খেয়ালি রাজকুমার বলে উঠেছিল, কাসেম চাচা তুমি পাইক হতে পারবে?

    কাসেম হেসে বলেছিল, নানা কানের কাল থেকে সইস হতিই শিকিচি খোকাবাবু। পাইক হতি শিকি নাই।

    শেখোনি, শিখে নেবে। আমি শিখিয়ে দেব। একটা পেরজা ঠাঙানো দরকার হয়েছে।

    শুনে কাসেম আলি হেসে উঠেছিল।

    বলেছিল, পেরজাটা কে হবে গো খোকাবাবু?

    সেই তো মুশকিল। বলে খোকাবাবু ঘোড়াটার কান দুটো বাগিয়ে ধরে ঘোড়ার উপর টগবগ করছিল, হঠাৎ

    কাসেম আলির ভাঙা গলা আরও ভেঙে নেমে গিয়েছিল, হঠাৎ নেয়তির মতো চোকের সামনে এসে পড়ল ভুজঙ্গ গোয়ালার ছেলে গোবিন্দ।

    তারপর গোবিন্দর হাতে ছিল বড় একঘটি দুধ, বাপের হয়ে জোগান দিতে যাচ্ছিল কোনও খদ্দেরের ঘরে। গোবিন্দর পিছনে পিছনে আসছিল মিশকালো একটা মস্ত কুকুর, আহ্লাদে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে।

    খোকারাজের ঘোড়ার পথ থেকে পাশ কাটিয়ে চলেই যাচ্ছিল গোবিন্দ, হঠাৎ খোকারাজা তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল, এই গোবিন্দ সেলাম না করে গটগটিয়ে চলে যাচ্ছিস যে বড়? পাজি নচ্ছার।

    থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল গোবিন্দ।

    কোথা থেকে যে কী হল। কোন জিন এসে কার উপর ভর করল। ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল দীপ্তিপ্রসাদ নামের সেই অহংকারী খুদে রাজাটি।

    লাফিয়ে পড়ে সপাসপ চাবুক বসাতে লাগল গোবিন্দর মুখের উপরে। আঁ আঁ করে চিৎকার করে উঠল গোবিন্দ, হাত থেকে দুধের ঘটিটা ছিটকে পড়ে গিয়ে দুধের ঢেউ বইল।

    আর প্রভুর এই দুর্দশায় শয়তানে ভর করা সেই মিশকালো কুকুরটা হঠাৎ এলোমেলো খেপে গিয়ে ঘেউ ঘেউ করতে করতে প্রচণ্ড বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ল সেই একগোছা ফুলের উপর।…তার মুখের উপরও চাবুক বসিয়েছিল, বসিয়ে কোনও লাভ হল না। বরং আরও খেপে উঠল সে।

    ডুকরে কেঁদে উঠেছিল কাসেম, আটকাতে নারুণ গো, সেই বাঘের তুল্যি শয়তানডারে হিঁচড়ে আনতে নারুণ। বুড়ো হয়ে গেচি মা, খোদা অ্যাখোন দেওয়া জিনিস হরণ করে নিয়েছে। চোকের সামনে–দেখনু ওইখেনে তারে ফেলে

    হ্যাঁ সেই জায়গা।

    যেখানে রুদ্রপ্রসাদ নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মিস্ত্রি খাটাচ্ছিলেন। যেখানটার মাটি একটা মূঢ় শিক্ষার শিকার বিপথচালিত বালকের রক্তে ভিজে উঠেছিল।

    ওই রক্তের দাগ মুছতে দেননি রুদ্রপ্রসাদ।

    ওই রক্তে যেন কারও পা না পড়ে। তাই জমিটা ঘিরিয়ে দিয়েছেন…।

    কুকুরটার শাস্তিবিধান হয়ে গেছে।

    কিন্তু সেই ছেলেটার?

    যে ওই ভয়ংকর মুহূর্তে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কোনদিকে যেন ছুটে পালিয়ে গিয়েছিল। তার মাথার জন্যে পাঁচশো টাকা পুরস্কার ধার্য করা হয়েছে। তার শাস্তির জন্যে নিত্যনূতন উপায় উদ্ভাবনের কাজ চলছে।

    সরমার সঙ্গে সেই ভয়ংকর মুহূর্তে দেখা হয়েছিল রুদ্রপ্রসাদের। তারপর আর নয়। সরমা জানেন না ওই জায়গায় কী করবেন রুদ্রপ্রসাদ। লোকমুখে কানে আসছে ভয়ংকর এক প্রতিজ্ঞার মূর্তি হয়ে বসে আছেন তিনি, আর একটা অসহায় বালকের উপর বজ্র হয়ে ভেঙে পড়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে।…শুনেছেন ভুজঙ্গ গোয়ালা কাছারিবাড়িতে আটকে থেকে রোজ বিশ-পঁচিশ ঘা চাবুক খাচ্ছে।

    সরমার কিছু করার নেই।

    সরমার মনের মধ্যে এক কুসংস্কারের তোলপাড়।…মায়ের অভিসম্পাত যদি এত দ্রুত কার্যকরী হয়, তা হলে স্ত্রীর অভিসম্পাতও কিছু কাজ করবে তো? এখন আমি কী করব? আমি যে ভগবানের কাছে অহরহ প্রশ্ন করে চলেছি। এত পাপ তুমি সহ্য করে চলবে ভগবান? এত পাপ তুমি ক্ষমা করবে? এই দম্ভের শেষ হবে না?

    তা হলে? সেই প্রশ্নের প্রতিক্রিয়াটা কী হতে পারে?

    আমি যদি এই প্রাসাদ ছেড়ে চলে যাই, তা হলে কি ভগবানের আর ওই প্রশ্নের জবাব দেবার দায় থাকবে?

    প্রথম দু-তিনদিন অহরহ ভেবেছেন সরমা, আমি কেন দুর্বিনীত উদ্ধত মূঢ় ছেলেটাকে নিজেই দু চারটে চড় বসিয়ে দিইনি? সেটাই তো মায়ের উপযুক্ত হত। আমি কেন ভগবানের উপর ভর দিলাম ওকে উচিত জবাব দেবার?

    ক্রমে মন শক্ত করতে চেষ্টা করছেন। নিয়তিকে মেনে নেবার শক্তি অর্জন করতে চাইছেন।

    তাই এই হাটবারের সন্ধ্যায় জোর করে ভাবতে চেষ্টা করছেন বিনোদবালার মেয়েকে কি তার বর নিয়ে গেছে? চাঁপারানি তো আমার কাছে আশ্রয় পেতে আসতে পারল না, সে কি আত্মহত্যা করল?

    বসুমতীর সঙ্গে বঙ্কু এসে ঘরের দেয়ালে দেয়ালে দেয়ালগিরি বসিয়ে জ্বেলে দিয়ে গেল। চার দেয়ালে চারটে। একজন দাসী সঙ্গে করে ভিন্ন বউরানির ঘরে ঢুকে পড়া চলে না। যদিও বন্ধু রুদ্রপ্রসাদের বাল্যকাল থেকে এ বাড়িতে। বিয়ে দিয়ে নিয়ে এসেছে সরমাকে।

    আলো দিয়ে যাবার পর বসুমতী এসে নিচুগলায় বলল, বউরানি, আপনার ভাই এয়েছে মালদা থেকে।

    আমার ভাই।

    সরমা চমকে ওঠেন, কেন?

    সরমার কদিনের খাদে নামা মৃদুকণ্ঠ হঠাৎ তীক্ষ্ণ শোনায়।

    বসুমতী নিশ্বাস ফেলে বলে, কেন আর? এত বড় দুঘঘটনাটা ঘটে গ্যালো, দ্যখা করতে আসবেনি? কোর্তব্যো আচে তো অ্যাকটা।

    ও। তাও তো বটে।

    সরমা স্থির হয়ে যান।

    বসুমতী আরও নিচু গলায় বলে, এখেনে নে আসব বউরানি? না আপনি ওই মদ্যিখানের বোসবার হল-এ যাবেন?

    সরমা চেতনায় ফিরে আসেন। বলেন, তোমাদের রাজাবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছে তার?

    না বউরানি। এসে অবদি তিনি চাও খায়নি শরবতও খায়নি, সরকার মশায়ের ঘরে বসে আছে। আপনাকে খপর দিতে বলল। বলতেচে অ্যাকবার দ্যাকা করেই চলে যাবে।

    সরমা স্থির হয়ে বলেন, তা হয় না মাসি। রাজাবাবুর সঙ্গে দেখা না করে অন্দরে চলে আসা চলে না।

    বসুমতী কাতর গলায় বলে, রাজাবাবু তো অ্যাখোন ক্ষেপ্তো হয়ে আচে বউমা?কখোন কী মেজাজ। যদি বলে বসে, অন্দরে যাওয়া হবেনি। তালে?

    তা হলে হবে না।

    শোনো কতা। এইটি কি অ্যাকটা বুদ্ধির কতা হল? কোন ধুর থে এয়েছে মানুষ, ছোটভাই হয়। দিদির শোকতাপের খপরে দ্যাকা করতি, আর আপনি বলে দিচ্ছ, তাহলি হবেনি?

    অতঃপর বসুমতী যা বলে, তার মর্মার্থ হচ্ছে সরকারমশাই চুপি-চুপি বলেছেন, বউরানিমার ভাই নাকি–চাষি খেপিয়ে বেড়ায়, না কি তাদের মন্ত্রণা দেয়, লাঙল যার ফসল তার। তোরা খেটেপিটে মরে জমিতে ধান ফলাবি, আর বাবুরা তার সবটুকু কেড়ে নিয়ে নবারি করবে। তোদের পেটে দুবেলা দুমুঠো অন্ন জুটবে না? কেন? কেন এ অন্যায় বরদাস্ত করবি তোরা? জমিদারকে আর মানবি না। খাজনা দিবি না। জোতদারের সর্বস্বান্ত হতে জোতদারের দাদন নিবি না, সকল ফসল তুলে দিবি না। এখন থেকে জানবি তোরাই তোদের জমির মালিক। বলে বেড়ায়, রাজাদের রাজাগিরি ঘুচবে এবার, ঘুচাব বাবুদের বাবুগিরিও। নতুন আইন হয়েছে, তারা কেউ নয়। এতদিন ধরে যে প্রজা ঠেঙিয়ে খেয়েছে আর নবাবি করেছে, তার শেষ হচ্ছে এবার। দিকে দিকে সত্যিকার রাজা মহারাজারাই নাকি বিতাড়িত হবে।

    তা ও-তল্লাটে ওই চন্দন সান্যালের নাম সবাই জানে। মালদা জেলায় এই লাহিড়ীবাবুদেরও তো মহাল-টহাল আছে। সেই সব প্রজা বিগড়েছে। তারা আর খাজনা দিতে চায় না।…এ খবর আর নায়েব গোমস্তারা রাজাবাবুর কাছে চেপে রাখতে পারছে না।

    এই সব কারণে রাজাবাবু তাঁর শালার নামে খাপপা। অতএব দেখা করার ফল কী হয় কে জানে। অমৃত ফল যে ফলবে এমন আশা করা যায় না। কেন আর তবে মিছিমিছি ঝুটঝামেলা বাড়ানো?

    তবু আশ্চর্য, সরমা বললেন, যাই হোক। রাজাবাবুর অজানিতে দেখা করা যায় না।

    কী জানি। বউরানিমা, কী সব আপনাদের বড় মানুষের ঘরের জিদ!

    বসুমতী হতাশ গলায় বলে, সেদে দুকু ডেকে আনা। তিনিও তো চায় না বোনাইয়ের সাতে দ্যাকা করতে, তবে?

    বলে দুই হাত উলটে চলে যায় বসুমতী। তবে বন্ধু যে বলে যায় দোতলার হলঘরে ঝাড়লণ্ঠনের আলো জ্বেলে দিতে।…যদি রাজাবাবুর মেজাজ ঠিক থাকে ওইখানেই এসে বসবে তো মামাবাবু।

    সবই জানি মাসি। তবু সরকারমশাইকে বলগে রাজাবাবুর কাছে নিয়ে যেতে।

    .

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleলোহার গরাদের ছায়া
    Next Article নীটফল

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }