Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    একজন মিসেস নন্দী – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প133 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    উজান

    শালাদের খালি গান, ফুর্তি, গল্প, ঝগড়া। নিকুচি করেছে তোর—

    ফুঁসতে ফুঁসতে, ঘরের নিরালা কোণের অন্ধকার ছেড়ে প্রায় একটা খ্যাপা জানোয়ারের মতো এসে নারান বেমালুম দুই থাপ্পড় কষাল গাইয়ে বেচনের গালে।

    বেচনের সঙ্গে সমস্ত আসরটাই হাঁ করে তাকিয়ে রইল খ্যাপা নারানের দিকে। একে শনিবারের সন্ধ্যা, তায় কাল কারখানায় রবিবারের ছুটি। আসরের আর দোষটা কি?

    দোষ নারানেরও বা কোথায়। একে লোকজনই সহ্য হয় না, তায় আবার গান বাজনা, ঢলাঢলি, হাসাহাসি।

    এই আধো অন্ধকারে নারানকে একটা সাংঘাতিক কিছু মনে হয় না। মনে হয় যেন একটা ভূতে পাওয়া মানুষ। চোখে তার ক্ষিপ্ততা নেই, আছে অসহ্য চাপা যন্ত্রণার ছাপ। গোঁফ জোড়া অনেক দিন কাটছাঁট না হওয়ায় অসমানভাবে ঝুলে পড়েছে। মুখের হাড় বেরিয়ে, বাঁকা চোরা অনেকগুলো রেখা সুস্পষ্ট হয়ে তাকে একেবারে বুড়ো করে ফেলেছে এ বয়সেই।

    সে চাপা গলায় প্রায় টেনে টেনে আর্তনাদ করে উঠল, শালার জগতে লোকজন, গাড়ি-ঘোড়া, কলকারখানা, গান, সোহাগ আর কাঁহাতক সওয়া যায়? পঙ্গপালের জাত এ মানুষগুলোন শালা একদিনে সাবাড় হয় না কেন? অ্যা, কেন হয় না?

    কিন্তু বেচন ছেড়ে দিলে না। সে প্রায় লাফ দিয়ে উঠে সজোরে এক ঘুষি মারলে নারানের মুখে। শালা, তবে যা না, সাধু হয়ে বনে বনে ঘোরগে। এখানে কেন?

    সবাই ভাবলে এখুনি একটা মারামারি শুরু হয়ে যাবে এবং একটা শশারগোলও উঠল সেই রকমের। কিন্তু কিছুই হল না। কারণ নারান একেবারে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল মুখে হাত দিয়ে।

    আসলে সে তো মারামারি করতে আসেনি, এসেছে আর চুপ করে থাকতে না পেরে। মানুষের কোনও কিছুই যে তার আর সহ্য হয় না। কোনও বন্ধুর দুটো কথা বললো, মেয়েমানুষের একটু হাসি মসকরা বলল, ছাপোনার একটু সোহাগ বলো, মায় কারখানা, কাজ, বস্তি কিছুই ভাল লাগে না। মানুষের সমাজ তার কাছে বিষের মতো লাগে। অথচ সে একটা কাজের মানুষ। বনস্পতি ঘিয়ের কারখানায় সে কাজ করে। হাঁকে, ডাকে, হাসিতে, গানে সেও কিছু কম ছিল না।

    তবে হ্যাঁ, তখন তার বউ ছিল, তিনটে ছেলে-মেয়ে ছিল। আর বউটা ছিল যেমনি চেহারায় শক্ত, তেমনি এক মুখেই কত কথা, ঝগড়া, হাসি, সোহাগ। তিনটে ছেলে-মেয়ে কাছে কাছে ঘুরত, যেন ধাড়ি শুয়োরের পায়ে পায়ে ফেরা বাচ্চাগুলোর মতো।

    সেগুলো বছর ভরে ভুগল, পাকিয়ে পাকিয়ে গেল। তারপর মরল একটা একটা করে। আগে। যেমন রাগলে নারান বলত, তোরা মলে আমার হাড় জুড়োয় ঠিক তেমনি করে মরল। কিন্তু একে ঠিক হাড় জুড়ানো বলে কিনা, সেটা ঠাউরে উঠতে পারল না।

    সেই থেকে মানুষই যেন তার কাছে বিষ হয়ে উঠল। মানুষকে সে ঘৃণা করে। গান বাজনা তো দূরের কথা, কোনও বউ সোয়ামীকে এক রত্তি হাসতে দেখলে তার ঠ্যাঙাতে ইচ্ছে করে। আসলে, এ সবই তার কাছে মিথ্যে, ভাঁড়ামি, শয়তানি!

    কে নারানের নাম ধরে ডাকতেই সে আসরের সকলের দিকে তাকিয়ে দেখল। এর মধ্যে অনেকেই তার প্রাণের বন্ধু, বেচনও তাই। আর সকলেই তার দিকে করুণাভরে তাকিয়ে আছে যেন সে কেমন অসহায় অস্বাভাবিক একটা জীব। ঝি বউরা এমনভাবে তাকিয়ে আছে, যেন মরদ নারানের সব শোক পারলে ওরা এখনি হরণ করে নিত।

    এতগুলো চোখকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঘৃণায় যন্ত্রণায় রি-রি করে উঠল তার গায়ের মধ্যে। এখনি হয় তো সবাই তাকে সান্ত্বনা দিতে আসবে, যেন কতই ভালবাসে।

    পিশাচতাড়িতের মতো সে সেখান থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। কিন্তু সর্বত্রই মানুষের ভিড়, হাসি, গান, কান্না, মার, ধোর, হল্লা, যেন প্রেতের তাণ্ডবলীলা, জানোয়ারের সংসার!

    শেষটায় সে গেল বাবুসাহেব দীনদয়াল সাহুর কাছে তার ধাপার মাঠের কাজের জন্য। সে জানত বাবুসাহেব এক জোড়া লোক খুঁজছে, স্বামী আর স্ত্রী। নারান জোর দিয়ে বলল, সে একলাই সব কাজ করতে পারবে, তবু মাঠের কাজটা তার চাই-ই। যতই অল্প পয়সা হোক, একটা পেট তো! দুনিয়াতে সে কার ধার ধারে? দীনদয়াল ভারী অবাক হলেও কাজটা দিয়ে দিল।

    পরদিন নারান তার খুঁটিনাটি জিনিসপত্র নিয়ে, ইয়ার বন্ধুদের হাজার অনুরোধ উপরোধ ঠেলে, অমন একটা ভাল কাজ ছেড়ে চলে গেল পুবের জনমানবহীন শূন্য মাঠে।

    শহর ছাড়িয়ে রেল লাইন। এ-পারে ময়লা বিশুদ্ধীকরণের যন্ত্রঘর, ও-পারে চারটে বড় বড় পুকুর, তাতে চালান যায় যন্ত্রের ভেতরের সব নির্দোষ শেষাংশটুকু। তার পরেই মাঠ, লোকে বলে ধাপা।

    তার পূর্ব সীমানায় একখানি মেটে ঘর। আরও খানিক পুবে মিউনিসিপ্যালিটির সীমান্ত ধরে সুদীর্ঘ গভীর খাদ কাটা। তার ধারে কতগুলো মরকুটে খেজুর আর কুল গাছের সারি, একটা ধান খেতের সীমানা। সেটাও পুবে আর উত্তর দক্ষিণে দিগন্তবিস্তৃত, তার ওপারে ধু-ধু করে একটা গাঁয়ের কালচে রেখা।

    দীনদয়াল সাহু এবার মাঠের ডাক নিয়েছে, উদ্দেশ্য তরকারি ও পুকুরে মাছের চাষ। চাষ বলতে বেগুন, কপি ইত্যাদি।

    এখানে এসে বিস্ময়ে ও আনন্দে নারান যেন মাতাল হয়ে উঠল। তার ছোট্ট ঘর, পাশে বিস্তৃত একটি মাত্র পিটুলি গাছ! তার পর যে দিকে চাও শুধু মাঠ আর মাঠ। লোক নেই, জন নেই, নিঃশব্দ, বিস্তৃত, উদার অসীম আকাশ। সেই শূন্যতাকে দু-হাতে সাপটে ধরে সে যেন শিশুর মতো বিচিত্রভাবে হেসে উঠল, অসীমের মাঝে সে একান্ত হয়ে গেল যেন নির্জনতার মধ্যে একটানা ঝিঁঝিঁর ডাকের মতো।

    কোনও ভিড় নেই, কোলাহল নেই, মানুষের সামান্যতম চিহ্ন নেই, এখানে শুধুই সে। নিশ্বাসের পর নিশ্বাসে বুকটা তার খালি হয়ে গেল। ঝড়ের পর এক মহাপ্রশান্তির শব্দহীন নিস্তব্ধতা। সেই শৈশবের কল্পনায় মনে হল, আকাশের অশরীরীরা এখানে এই ঘরেরই আনাচে কানাচে চলাফেরা করেন। আহা! জীবনটাকে যেন ফিরে পাওয়া গেল।

    হেমন্তকাল। নারানের কাজ শুরু হয়ে যায়। অনেকখানি জায়গা জুড়ে প্রথমে আরম্ভ হয় বেগুনের চারা বোনা, আর একদিকে ফুলকপির। আরও খানিক দীর্ঘ জায়গা তৈরি করে রাখল বাঁধাকপির জন্য। পশ্চিম ঘেঁসে দিল গাজরের বীজ ছড়িয়ে, ঘরের পাশে করল বিলিতি বেগুনের খেত।

    কোনখান দিয়ে সময় কাটে, নারান যেন চোখের পলকে ঠাওর পায় না। সেই ভোর থেকে কাজ শুরু হয়। দেখতে দেখতে বেলা হয়। তখন সে রান্না করে। খেয়ে খানিকক্ষণ খাটিয়াতে শুয়ে মুখে গামছা চাপা দিয়ে থাকে। তার পরেই আবার কাজ। সন্ধ্যা নেমে আসে, তারই মাথার উপর দিয়ে নানান পাখির দল বাড়ি ফিরে যায়। সে রেললাইনের ও-পারের কল থেকে জল নিয়ে আসে, রান্না করে। তার পর কোনও কোনওদিন বসে থাকে তার ঝকঝকে উঠোনে খাটিয়া পেতে, নয় তো তালা-চাবিকারিগরি বা স্বাধীন ব্যবসা নামের বই, অথবা কৃষ্ণলীলা, রামায়ণ খুলে বসে। তার পর খেয়ে-দেয়ে ঘুমোয়। মাসখানেক পরে কাজ একটু কমে এল তার। যা চাষ হয়েছে এখন তাকে বাঁচানোই সবচেয়ে বড় কাজ। পোকা মারা, আগাছা বাছা, জল নিকাশের পথটা একটু পরিষ্কার করা। জায়গাটাই সারের জমি, তবুও সে নানা রকম সার নিজে তৈরি করে।

    এই অখণ্ড নৈঃশব্দ্যের মধ্যে কোনও কোনও সময় সে হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। হেমন্তের আকাশে থেকে থেকে সাদা মেঘ কেমন করে আকৃতি বদলে ধীরে ধীরে উড়ে যায়, তাই দেখে তার সময় কেটে যায়। কখনও শালিকের ঝগড়া ও ঝুটোপুটি খেলা দেখে হেসে ওঠে। পায়রার ঝাঁক উড়ে আসে, ধাপার মাঠের পোকার লোভে আসে বকের দল। কাঠবেড়ালি এলে তাড়া করে, ওরা কচি পাতা পেলেই সাবড়ে দেয়।

    রোজ ভোরবেলা ওই পিটুলি গাছটায় অসংখ্য পাখির কলকাকলীতে আগে তার ভারী বেজার লাগত। ভেবেছিল, ওটার ডালপালাগুলো কেটে দেবে, যাতে আর পাখি বসতে না পায়। পরে সে পাখিদের এ দাবিটা মেনে নিয়েছে।

    সকালবেলার দিকে পশ্চিমের ময়লা-বিশুদ্ধির যন্ত্রটার দিকে কিছু কথাবার্তা শোনা যায়, কোনও কোনও সময় পুবের মাঠ থেকে ভেসে আসে হাঁকডাকের শব্দ গোরু বাছুরের হাম্বা রব। তার ছোট ঘরটাকে কাঁপিয়ে এবেলা ওবেলা যায় অনেকগুলো রেলগাড়ি। তার এ জনহীন প্রান্তরে আগে এসব বিরক্তির কারণ হলেও এখন আর তার যেমন কোনও কৌতূহল নেই, এ-সব কানেও তেমনি যায় না।

    এর মধ্যে বার দু-তিনেক দীনদয়াল এসেছিল। কিন্তু নারান এমন ভাবে কোনও কথার জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকত যে, দীনদয়ালের বিস্ময়-বিরক্তির সীমা থাকত না। তবু কিছু বলত না, কারণ, সত্যি, একলা মানুষটা কী করে মাটির বুক এত সম্ভারে পরিপূর্ণ করে তুলেছে ভাবলেও অবাক লাগে। নারানের মাথাটা খারাপ বলে সে ধরে নেয়। কিন্তু লোকটার আগমনে নারানের বিরক্তি আরও বাড়ে।

    প্রায় রোজই একটা হলদে কুকুর কোত্থেকে সকালবেলা এসে তার গা শুঁকতে আরম্ভ করে, খেলার ভঙ্গি করে, ছুটে দাওয়ায় ওঠে! রাগে তার সর্বাঙ্গ জ্বলে যায়। মারলে ধরলেও আবার ঠিক আসে।

    গৃহস্থের কোনও পোষমানা প্রাণীও এখানে তার অসহ্য লাগে।

    শুধু মনটা নয়, চেহারাটাও নারানের কেমন বদলে গেছে। মুখটা যেন ভাবলেশহীন বোবার মতো, সমস্ত নৈঃশব্দ্য যেন সেখানে এঁটে বসেছে। সে নিজে একটি কথাও বলে না, এমন কী একটু গুনগুনও করে না। তবু এ মাঠ ও আকাশের সঙ্গে যেন তার একটা নিয়ত বিচিত্র ধারার বিনিময় চলেছে, তার কোনও শব্দ নেই।

    কেবল ভর দুপুরবেলা যখন মাঠ ও আকাশ কেমন ঝিম মেরে থাকে, তখন ওই আকাশের বুক থেকে চিলের তীক্ষ্ণ চি চি আর্তস্বরে তার বুকের মধ্যে কেমন ধ্বক করে ওঠে। মনে হয় যেন কোনও শিশু মৃত্যুযন্ত্রণায় চিৎকার করছে।

    এমনি রাতেও যখন কোনও পাখি বিলম্বিত সুরে ডেকে ওঠে, তার বুকের মধ্যে যেন দম আটকে আসে। মনে হয়, বুঝি কোনও বউ কাঁদছে ক্ষুধা ও রোগের যন্ত্রণায়। তখন সে একটা নিশাচর প্রেতের মতো সারা মাঠে প্রায় দাপাদাপি করে ফেরে। মাঠটা যেন তাকে গিলতে আসে।

    এই সঙ্গেই কতগুলো ছবি পর পর তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তার ফেলে আসা জীবন, তার পরিবেশ, সে জীবনের ঝড়ো বেগ, তার কলকোলাহল, তার কাজের উদ্দামতা। এক কথায় একটা বন্যার পাগলামি।

    কিন্তু আবার তার মনটা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। সে নতুন করে শিম লাউয়ের মাচা বাঁধতে আরম্ভ করে, উত্তরের তে-কোণ জমিটাকে তৈরি করে মটরশুঁটির জন্য।

    হেমন্ত গিয়ে শীত এসে পড়ে।

    পাতাল থেকে কচি শিশুর মুখের মতো যেন একটু একটু করে ফুলকপি তার পাতার আড়াল মেলে দেয়। বড় বড় নধর বেগুন উঁকি দেয় বড় বড় পাতার আড়াল থেকে। অনুক্ষণ সতর্ক থাকতে হয় ইঁদুর আর বেজীর জন্য। সোনার মতো গাজরগুলোর জন্য ওদের নোলা ছোঁক ছোঁক করে।

    তার পর কাজের শেষে সেই আকাশের মুখোমুখি বসে থাকা, এই প্রকৃতিরই এক জনের মতো মিশে যাওয়া। একি জীবনের গা মেলে দেওয়া, শূন্যের মাঝে হারিয়ে যাওয়া বোঝা যায় না।

    আরও একটা মাস কেটে গেল।

    এমনি একদিন সকালবেলা বাঁধাকপির গোড়াগুলোতে সে মাটি তুলে দিচ্ছে। এমন সময় দেখল, ধাপা ও ধানখেতের সীমানায়, যেখানটায় খাদ খুব সরু এবং ঝোপঝাড় শুন্য খানিকটা ফাঁকা, সেখান দিয়ে একটা মেয়েমানুষ কোলে একটা বছর দু-তিনেকের বাচ্চা ও মাথায় একটা শাকের চুবড়ি নিয়ে লাফ দিয়ে তার সীমানায় এসে পড়ল। নারানের মনে হল, লাফটা যেন তার বুকেই পড়েছে। অত্যন্ত বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ চোখে সে ব্যাপারটা দেখতে লাগল।

    মেয়েমানুষটি নারানকে দেখতেই পায়নি। সে তার কালো শক্ত পুষ্ট শরীরে দৃঢ় পদক্ষেপে, ডাগর ডাগর চোখে কিছুটা বিস্ময় কিছুটা কৌতূহল ও সংকোচ নিয়ে সোজা নারানের উঠোনে গিয়ে প্রথমে ছেলেটাকে নামাল, তারপরে শাকের চুবড়িটা। সেয়ানা বয়স, কপালে সিঁদুর নেই। সে কয়েকবার উঁকি ঝুঁকি দিল, ভ্রূ টেনে আপন মনে বুঝি একটু হাসল, তারপর এই মাঠের সমস্ত নৈঃশব্দ্যকে যেন মুহূর্তে ঝংকৃত করে তার সরু মিষ্টি গলায় ডেকে উঠল, কই গো কেউ নেই নাকি?

    সে শব্দে যেন মাঠটা হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠল।

    নারান তো খেপে বারুদ! দীনদয়ালই যেখানে পাত্তা পায় না সেখানে কিনা একটা মেয়েমানুষ, একেবারে বাচ্চা নিয়ে! সে রাগে খ্যাঁক খ্যাঁক করতে করতে একেবারে হামলে পড়ল এসে, কেন, কেন? কাউকে দিয়ে তোমার কী দরকার?

    খ্যা^কানি শুনে বাচ্চাটা চমকে মাকে জাপটে ধরল। মেয়েটিও একেবারে ভড়কে গিয়ে প্রায় ড়ুকরে উঠল, ওমা! এ কেমন মিনসে গো বাবা।

    নারানও যেন স্বপ্নের ঘোরে এক যুগ পরে নিজের গলার স্বরে চমকে গেল। তবুও খিঁচিয়ে উঠল, যেমন হই। তোমার দরকারটা কী?

    কিন্তু সেই ডাগর চোখে ও মিঠে গলায় ভয় ফুটল না যেন তেমন। বলল, দরকার আবার কী, বাজারে যাব এটু শাক-মাক বেচতে, এখান দিয়ে অল্পে হুস করে যাওয়া যায়, তাই।

    কর্কশ গলায় ভেংচে উঠল নারান, আর হুস্ করে যায় না, ওই ঘুর পথেই এট্টু ঠায়ে যেও।

    মেয়েটা ভ্রূ তুলে বাঁকা চোখে এক মুহূর্ত নারানকে দেখে, এক হ্যাঁচকায় চুড়িটা মাথায় তুলে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, এ-ঘরে একদিন আমিই ছিলুম, ছিলুম আমার সোয়ামীর সঙ্গে। তার আবার অত কথা কী। মানুষটা মল, তাই, নইলে…

    মনে হল ওর গলার স্বরটা ভেঙে আসছে। এখন শাক ঢেরো বেচে খাই..

    থাক। চেঁচিয়ে উঠল নারান, এখন পথ দেখো। শালা যত ঝুট ঝামেলা…।

    মেয়েটি আর একবার তার ভেজা চোখে নারানের দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে ছেলে কোলে নিয়ে ফরফর করে চলে গেল পশ্চিমে।

    নারানের গায়ে যেন বিষ ছড়িয়ে দিয়েছে ওই আপদটা, এমনি করে গা ঝাড়তে লাগল সে। মনে হল তার সমস্ত মাঠটা যেন লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে একেবারে এমনি ভাবে সে ঘুরে ঘুরে তার বেগুন কপি দেখতে থাকে। দীর্ঘ দিন পরে তার নিঝুম শান্তিকে ছরকুটে দিয়ে গেল মেয়েমানুষটা।

    কিন্তু একটু পরেই আবার তার সে প্রশান্তি নেমে এল নিস্তরঙ্গ হয়ে এল সমস্ত কিছু। দিনের শেষে সন্ধ্যা আকাশ নেমে এল হাতের কাছে। আর মৌন সন্ধ্যায় রোজকার সেই বিলে পাখিটা ডিগবাজি খেয়ে ডেকে হেঁকে চলে গেল। ঝরে ঝরে পড়ল পিটুলির পাতা।

    আশ্চর্য। পরদিন সকালে মেয়েটা এল এবং পুব প্রান্তে শিমের মাচার কাছেই একেবারে নারানের মুখোমুখি দেখা।

    আর যায় কোথায়। নারান খ্যাঁক করে উঠল, ফের?

    মেয়েটার চোখে প্রায় হাসিই ফোটে বুঝি। বলে, এই মরেছে। তা চটো কেন?

    নারান আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠল, চটি কেন?

    ছেলেটা মায়ের কোলে কুঁকড়ে যায়। মেয়েটাও হাঁপায়। পথের আলে শিশিরে ভেজা পা দুখানি ধুয়ে গিয়েছে। মুখ চোখও যেন ভেজা ভেজা গায়ে জামা নেই, শাড়িটাই জড়ানো। তাতেই যেটুকু শীত মানে। গলায় আবার একটা পেতলের হার। বলে, তা অতটা ঘুরে যাওয়ার চেয়ে

    সবাই যায়। ধমকে ওঠে নারান।

    তা বলে আমিও যাব? ভ্রূ তুলে কথাটা বলেই ছেলেকে নামিয়ে, মাথার বোঝাটা নামায়। কোমরে হাত দিয়ে বলে বাব্বা! কম পথ? কোমর যেন ধরে যায়। পথে এট্টু জিরোনোও হয়। আর…এলে পরে এখানটায় না এলে মনটা কেমন করে।

    নারানের বুকের মধ্যে কেমন ধ্বক ধ্বক করে। যেমন চিলের ডাকে করে ওঠে। কার কথা যেন তার বারবারই মনে আসতে থাকে আর রাগে বিরক্তিতে তার মেজাজ চড়ে যায়।

    মেয়েটা বলেই চলে, তা-পরে জানো, মিনসেটা ভারী বোকা ছেল। পশ্চিমে দিলে উনুনের জায়গা করে। তা সে বোশেখী। রাত ঝড় জল মানবে কেন? আবার আমি উত্তুরে উনুন পাতি, তবে না তুমি ওখানে খুন্তি নাড়তে পারো। তা তোমার বুঝি বউ-টউ

    দুত্তোরি তোর বউয়ের নিকুচি করেছে। রাগে চিৎকার করে ওঠে নারান, তুমি ভাগবে কি না। শালা যত আপদ এসে জুটবে এখানে।

    অমনি মেয়েটার চোখেমুখেও রাগ ফুটে ওঠে। বলে, অমন মানসের মুখ দেখতে নেই।

    বলে ছেলে চুপড়ি নিয়ে ফরফর করে চলে যায়। খানিকটা গিয়ে কুঁদুলে মেয়েমানুষের মতো ঘাড় বেঁকিয়ে চেঁচিয়ে বলে গেল, আমি রোজ যাব, দেখি কী করো তুমি।

    নারানের ইচ্ছে হল, ছুটে গিয়ে ঠেঙিয়ে দেয়। কিন্তু যায় না।

    সকালের ছড়ানো সোনার রোদ যেন কালো হয়ে ওঠে, মেয়েটার গোমড়া মুখের মতো মাঠটার সমস্ত নীরবতা ও সৌন্দর্য যেন কোথায় উবে যায়। আজ এ মাঠের সঙ্গে মনটাকেও তার লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গিয়েছে, এমনিভাবে সে অনেকক্ষণ ছটফট করে ঘোরে। শহরের সেই ঘুপচি ঘরটায় একপাল ছেলেমেয়ে আর একটি বউয়ের কথা বারবারই তার মনে আসে আর বলে, ভ্যালা আপদ এসে জুটেছে। টকের জ্বালায় পালিয়ে এলুম, তেঁতুলতলায় বাস! শালার দুনিয়ায় কি কোথাও শান্তি নেই?

    কিন্তু একটু পরেই আবার তার শান্তি নেমে আসে। সীমাহীন নৈঃশব্দের মাঝে আবার নিজেকে হারিয়ে ফেলে, নিজেকে ছড়িয়ে দেয় সারা মাঠে। দাঁড়ায় আকাশের মুখোমুখি, চুপচাপ রাঁধে, খায়। পিটুলির ঝরা পাতাগুলো তুলে রাখে। গাছটা ন্যাড়া হয়ে যাচ্ছে।

    পুবের দিগন্তবিস্তৃত মাঠটা ফাঁকা, ধান কাটা হয়ে গিয়েছে। সেখানে আর কাউকে দেখা যায় না।

    ইতিমধ্যে ফুলকপি আর বেগুন অনেক নিয়ে গিয়েছে দীনদয়ালের লোক। নারান যেন কোলের শিশুকে দেওয়ার মতো করে সেগুলো দিয়েছে। আবার সেখানে ভরে দিয়েছে নটে পালং ছড়িয়ে।

    এ মাঠের কোথাও শস্যহীন শূন্য থাকবে এটা যেন সে ভাবতেই পারে না। শরতের শুঁয়ো পোকারা রুদ্ধশ্বাস বেদনার ভেতর দিয়ে আদায় করেছে নবজন্ম। নতুন পালকে তারা প্রজাপতি হয়ে ভিড় করেছে শিম লাউয়ের মাচায়।

    মৌন রাতের তারাভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবে নারান, সে ফুলের বাগান করবে এখানে। অজস্র সাদা আর লাল ফুল। তার পর তার ঘুমন্ত চোখের পাতায় কারা এসে যেন নাচানাচি করে। কয়েকটি শিশু, একটি সলজ্জ হাসি মুখ, ঢাক, ঢোল, কাঁসি, বিয়ে, কারখানা, বস্তি, মৃত্যু আর শ্মশানের চিতার লেলিহান শিখা।

    পরদিন সকালবেলা মেয়েটি আবার এল, এবং রোজই আসতে থাকে। আর রোজই চলে সেই চেঁচামেচি, খেঁচাখেচি। যত না খিঁচোয় নারান, তত জবাব দেয় মেয়েটা।

    মেয়েটি এ ধাপার পাঠে কিছুতেই তার অধিকারকে ক্ষুন্ন হতে দেবে না। আর নারানের পক্ষে এ ঝামেলা প্রাণান্তকর।

    কিন্তু মেয়েটির এখন ভাব দেখে মনে হয়, নারানের তর্জন গর্জনকে সে যেন তেমন আমলই দিতে চায় ন। শুনুক বা নাই শুনুক, সে নিত্য নতুন প্রসঙ্গ পেড়ে বসে। কোনওদিন বলে, তা পরে জানো, একে বর্ষার রাত, তার ধাপা, মিনসে আর রাতে ফিরল না। আমি তো ব্যাথায় উলটি পালটি খাচ্ছি। ভোর রাতে বিয়োলুম এ ছেলে। তাই না এর নাম রেখেছি ধাপা। ও যেন ধাপার ছেলে।

    কোনওদিন বা কুকুরটাকে দেখিয়ে বলে, গাঁয়ের থেকে নিয়ে এসেছিল মিনসে, এই এতটুকুন। নাম ওর রাঙি। আর কুকুরটারও আজকাল আসা বেড়ে গিয়েছে। ধাপা আর তার মায়ের সঙ্গে গায়ে পড়ে খেলা করে। মেয়েটি সারা মাঠে চোখ বুলোয় আর বলে, তা বাপু সত্যি, তুমি একটা মিনসে বটে। একলাই যা ফলিয়েছ, চারজনে তা পারে না।

    তার পর একটু বা উৎকণ্ঠাভরেই বলে, এ তোমার কী ভুতুড়ে বাই বাপু, ঠাণ্ডার মধ্যে খালি গায়ে কাজ করো? একটা কিছু জড়িয়ে নিতে পারো না?

    ধাপার ভয়টাও আজকাল কমে গিয়েছে। সে বেমালুম টলতে টলতে গিয়ে কখনও নারানের ঘরে ঢুকে পড়ে, কিংবা বড় বড় রক্তহীরের মতো বিলাতি বেগুনগুলো ছিঁড়তে যায়।

    অমনি নারান তেড়ে গিয়ে শক্ত হাতে ছেলেটাকে আছাড় দিতে গিয়েও না দিয়ে ওর মায়ের কোলের কাছে বসিয়ে দিয়ে যায়, আর গালাগাল দিতে থাকে।

    তাই দেখে মেয়েটি খিলখিল করে হেসে ওঠে। সে হাসিতে এ নির্জন প্রধন্তর যেন শিউরে ওঠে আচমকা। ফিরতি পথেও এখানে হয়ে যায়। আপন মনেই বলে, সেই কখন বেরিয়েছি! দুপুরে দুটো মুড়ি খেয়েছি, এখন গিয়ে রাঁধব, তবে খাব। মোড়লের বাড়িতে ধান ভানা থাকলে তো কথাই নেই। সেই রাত দু-পহরে খাওয়া।

    তারপর পিটুলি তলায় শুকনো পাতার উপর ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে এলো চুল আঁট করে বাঁধে। ঘুমন্ত ধাপাকে হয়তো মাটিতেই শুইয়ে দেয়। তখন যেন তারও নীরব হওয়ার পালা আসে। নারানের বিরক্তি-রাগকে তুচ্ছ করে হঠাৎ মিহি ভরাট গলায় বলে ওঠে, আর পারিনে এ জীবনের ভার বইতে। মনে হয় এখেনে…অমনি করে সারাটা রাত কাটিয়ে দিই। এই এখেনে…।

    তারপর হঠাৎ নারানের কাছে ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে বলে, তা বাপু বলে রাখি, এ ধাপার ব্যামো বড় বিদঘুটে। কেমন হাত পায়ের শির টেনে, বেঁকে দুমড়ে মানুষ মরে যায়। এক মুহূর্ত যেন সে মৃত্যুকে দেখে হুতোশে বলে ওঠে, এট্টো সাবধানে থেকো বাপু।

    নারানের মনে হয় কে যেন তার শ্বাসনালিটা চেপে ধরেছে। মেয়েটির গরম নিশ্বাস আর বিচিত্র ছবি ও কথার গোলমালে তার মাথাটা ঘুরে ওঠে।

    সে হঠাৎ আচমকা তেপান্তর কাঁপিয়ে চিৎকার করে ওঠে, যাও যাও…যাও এখান থেকে।

    ধাপার মা চমকে ওঠে, বলে, আ মলো! এটা কে রে!.বলে তাড়াতাড়ি ধানকাটার মাঠের ওপর দিয়ে চলে যায়।

    উত্তরের হিমেল চাপ ঠেলে হুস করে বা একটু দক্ষিণে হাওয়া আসে। পিটুলির পাতা উড়িয়ে, লাউ শিমের মাচা সরসরিয়ে, নটে পালং-এর মাথা দুলিয়ে দিয়ে যায়।

    তালা কারিগরী আর স্বাধীন ব্যবসার বই খোলাই থাকে কোলের উপর। প্রদীপের শিখা পুড়তেই থাকে। অসীম রাত্রি আর মহাকাশ, মাঠ আর ঘর সব একাকার হয়ে যায়। সংসার নিশ্চল, নিঃশব্দ। এই ভাল, এই শান্তি।

    তবু, ধাপার মা-ই বলো, আর মেয়েই বলল, সে রোজই যায় আর আসে। সেও যেন ওই দক্ষিণ হাওয়ার মতো একটু একটু করে উত্তরে চাপ ঠেলে আসছে। রোজ যেন একটা নতুন উপসর্গের মতো।

    হয়তো ঠাট্টা করে বলেই ফেলে, আজকের রাতটা থেকেই যাব। কিংবা তা-পরে জানো, তোমাকে এ ধাপায় দেখে আমার ভারী ভাল লাগে। তবে মানুষটা তুমি ঠিক নও।

    পুঁটকে ধাপাটাও কখন নিঃসাড়ে এসে কৌতূহলবশত নারানের পায়ের লোম ধরে টান দেয়।

    নারান দাঁত খিঁচিয়ে ভাবল, শালা তেল দেও, সিঁদুর দেও, ভাবি ভোলবার নয়। আচ্ছা! রাত করেই সে খাদটা যেখানে খুবই সরু, সেখানে হাত পাঁচেক লম্বা একটা খুঁটির বেড়া খাড়া করে দিল। তারপর নিশ্চিন্তে ঘুমোল।

    পরদিন মেয়েটি এসে বেড়া দেখে অবাক হয়ে গেল। যেন বিশ্বাসই করতে পারেনি, এমনি ভাবে বড় বড় চোখে মাঠের চারদিকে নারানকে খুঁজতে লাগল।

    নারান লাউ মাচাটার পেছনেই কোদাল দিয়ে মাটি কোপাচ্ছিল কিছু ধনে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য। জেনেও সে ফিরে দেখল না।

    মেয়েটি বারকয়েক ডেকে ডেকে চেষ্টা করল ছেলেটাকে বেড়া টপকে এ-পাশে দিতে। না পেরে আপন মনেই হেসে ফেলল। আবার খানিকটা ডাকাডাকি করেও যখন কিছু ফল হল না, তখন নারানকে যা-তা বলে গালাগালি দিতে লাগল।

    নারান লাউপাতার আড়াল থেকে দেখল, জলভরা দুই ডাগর চোখে মেয়েটা এদিকেই দেখছে কটমট করে, আর বলছে, ধাপার ভূত কমনেকার, ওকে যেন চেরকাল মাঠে মুখ দিয়েই পড়ে থাকতে হয়।

    তারপর ছেলে চুবড়ি নিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে হনহন করে চলে গেল ধান কাটা মাঠের উপর দিয়ে।

    নারানের মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে ওদের চলার পথের দিকে তাকিয়ে রইল।

    অনেকক্ষণ পর নিজেরই নিশ্বাসে চমকে উঠে নারান দেখল বেলা অনেক হয়ে গিয়েছে, ধান কাটা মাঠটা ফাঁকা।

    যাক! যেন একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সে নিজের কাজে মন দিল। সেই একই কাজ, একই রকম। কেবল নৈঃশব্দ্য যেন আরও ভারী হয়ে এল।

    পরদিন নারান কাজে হাত দিতে যায় আর চমকে চমকে ওঠে কেবলি। চোখ দুটো বার বার গিয়ে পড়ে ওই বেড়ার গায়ে। ধেনো মাঠটা দুলে ওঠে চোখের সামনে।

    তাকিয়ে দেখে বেলা কোনখান্ দিয়ে চলে যাচ্ছে, অথচ আজ কিছুই হয়নি।

    হঠাৎ হাওয়া আসে হু হু করে। পিটুলি গাছটার আর একটাও পাতা নেই। রুক্ষ, রিক্ত।

    মাঠটাও কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছে। দীনদয়ালের নোক এসে রোজই শাক তরকারি শিম লাউ নিয়ে যায় বাজারে। এই নিয়ম-যত ফলন, তত বিক্রি।

    রাত্রি আর আকাশ যেন বড় তাড়াতাড়ি নেমে এসে সব কিছু গ্রাস করে ফেলে। কেবল বোবা রাত্রির চোখে ঘুম নেই।

    পরদিনও অকাজের মাঝেই কেটে যায়। মরশুম শেষ। মাঠ খালি হয়ে আসছে। কেবল অসহ্য যন্ত্রণাভরা একটা পরীক্ষার মধ্যে প্রাণটা দুমড়ে যেতে থাকে। ওই বেড়াটা যেন মাথার মধ্যে খাঁচার মতো ঘুরতে লাগল।

    সন্ধ্যাবেলা নারান নিঃসাড়ে গিয়ে বেড়াটাকে কেটে ভেঙে খুলে ফেলে দিল। দিয়ে তাড়াতাড়ি এসে আবার শুয়ে পড়ল। যেন লুকিয়ে চুরিয়ে সে একটা বন্দিশালার দরজা ভেঙে দিয়ে এসেছে। এসে নিশ্চিন্ত হয়েছে।

    পরদিন পলে পলে বেলা গেল। খাদের ধারে বেড়াহীন কুল খেজুরের ফাঁকা জায়গাটা যেন খাঁ-খাঁ করতে লাগল। নিঃশব্দ, শুন্য। কেবল কুল খেজুরের মাথা দুলল হাওয়ায়।

    নারানের চোখ দুটো টনটন করে উঠল। তবু কেউ এল না সেখানে চোখ জুড়োতে।

    তেপান্তরের রাত্রি যেন দু হাতে জাপটে ধরল নারানকে। অসহ্য ছটফটানিতে একট বোবা পশুর মতো অন্ধকারে মাঠ আর ঘর করে বেড়াল।

    তার পরদিন দূর আকাশে লেপটানো চিমনির দিকে তাকিয়ে সে স্থির করে ফেলল, শহরে যাবে। শহরে…তার বন্ধু আর পড়শিদের কাছে।

    তাড়াতাড়ি একটা চুবড়ি নিয়ে অবশিষ্ট কয়েকটা ফুলকপি থেকে একটা তুলে নিল। একটা বাঁধাকপি, কয়েক সের বেগুন, মটরশুঁটি, কিছু শিম, একটা কচি লাউ, কিছু নটে পালং।

    তারপর স্নান করে, কাপড় পরে, ধোয়া জামাটি গায়ে দিয়ে, মাথায় গামছা জড়িয়ে ঘরে শিকল তুলে দিল। তরকারির চুবড়িটা মাথায় নিয়ে উঠোনে এক মুহূর্তে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে একেবারে পুবের খাদের মুখে গিয়ে দাঁড়াল।

    কিন্তু শহর যে পশ্চিমে! তা হোক।

    ধাপার মা যেমন করে লাফ দিয়ে এ-পারে পড়ত, তেমনি করে মাথায় বোঝা নিয়ে নারান ও-পারে লাফ দিয়ে পড়েই একেবারে সিঁটিয়ে গেল। মনে হল, কে যেন হেসে উঠল তার পিছনে। সন্তর্পণে চোখ ঘুরিয়ে এ-দিকে ও-দিকে দেখল কেউ নেই।

    দেখে হনহন ধান কাটা মাঠের উপর দিয়ে চলল দূরের ওই গাঁয়ের রেখাটার দিকে। গাঁয়ে যখন পৌঁছুল, তখন অনেক বেলা। ভাবল, কী করে যেত এত পথ? কিন্তু কোথায় বা তার ঘর, গাঁয়ের কোন সীমানায়। অনেক ঘোরাঘুরির পর এক কিষাণ দেখিয়ে দিল, গাঁয়ের বাইরে মাঠের ধারে ধাপার মায়ের ঘর। নারান দেখল, ঘর তো নয়। উঁচু ভিটেয় একটা বিচুলির ছাউনি হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। উঠোনের খুঁটোয় একটা রোগা ছাগল বাঁধা। কটা পায়রা যেন কী খাচ্ছে খুঁটে খুঁটে। আর ধাপা, কালো ন্যাংটা ছেলেটা, পায়রাগুলোর সঙ্গে আবোল তাবোল বকছে।

    কিন্তু নারানকে দেখেই তার চক্ষু চড়কগাছ। সে একেবারে টলতে টলতে হেই মা হেই মা করতে করতে ঘরে ঢুকে কী একটা কথা বার বার বলতে লাগল।

    তার মায়ের ভারী গলা শোনা গেল, কে রে?

    নারান একেবারে দরজার কাছে এসে মাথার চুবড়িটা নামিয়ে একটু হাসতে চেষ্টা করল। মেয়েটার দিকে একবার চোখ পড়তেই বলে ফেলল, এলুম।

    ধাপার মা কাঁথা ঢাকা দিয়ে শুয়েছিল। এক মুহূর্ত নারানের মুখের দিকে দেখে ঝাঁজ দিয়ে বলল, আদিখ্যেতা! কে বা আসতে বলেছে।

    নারান চুবড়ি হাতায়, মাটি খোঁটে। খালি বলে, এসে পড়লাম।

    কী বলতে গিয়ে আটকে গেল ধাপার মার গলায়। তাড়াতাড়ি মুখটা ঢেকে ফেলে কাঁথার তলায়। কেবল কাঁথার সঙ্গে যেন শরীরটাও ফুলে ওঠে।

    অনেকখানি সময় চলে যায়। ধাপা হাঁ করে বসে বসে দুজনকে দেখে।

    হঠাৎ নারান জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে?

    জবাব আসে চাপা গলায়, জ্বর।

    তা হলে—

    থাক। বাধা দেয় ধাপার মা। বলে, ও-সব বারোমেসে, সেরে যায় আবার।

    আবার অনেকক্ষণ চুপচাপ।

    থেকে থেকে খাপচি কেটে কেটে নারান বলে, এই..এট্টু সবজি। ধাপা খাবে। তা—তুমি…আর তো তুমি যাও টাও না…

    থাক, রুদ্ধ গলায় কথাটা বলে মুখের ঢাকনাটা খুলতেই দেখা যায়, মেয়েটার ডাগর জলভরা চোখ দুটো কান্নায় লাল হয়ে উঠেছে। বলে কান্নাভরা গলায়, কেন…কেন? এমন শেয়াল কুকুরের মতো তাড়ানোই বা কেন, আবার..

    বলতে পারে না আর।

    নারান বলল, তেমনি থেমে থেমে, পারলুম না থাকতে।…চলে এলুম।

    তেমনি ফুঁপিয়ে বলে মেয়েটি, কেন—কেন এ আদিখ্যেতা?

    নারানের ঠোঁট নড়ে, থুতনিটা কাঁপে। হঠাৎ ধাপাকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে মোটা গলায় বলে ওঠে, ফাঁকা মাঠ…আর কেউ নেই! লোক নেই..জন নেই…সাড়া শব্দ নেই..শুধু…শুধু..

    থেমে গিয়ে আবার বলে, কাঁহাতক পারা যায়…বলো?

    মেয়েটা মুখ ফিরিয়ে ফিসফিস করতে থাকে, কে বলেছে পারতে,…কে বলেছে?

    নারান তবুও বলতে থাকে, আমি…আমি যেন পালিয়ে আছি।…হ্যাঁ…শুধু মাঠ..ফাঁকা।

    বলতে বলতে একটা নিঃশব্দ অসহ্য গুমোট যন্ত্রণাকে ভেঙে চুরে, একটা লেদ মেশিনের বিরাট পালিশ করা চাকা যেন বনবন করে তার চোখের সামনে ঘুরতে লাগল। যন্ত্রের ঘর্ঘর শব্দ যেন চাপা পড়া প্রাণের অসীম নৈঃশব্দ্য ও বোবা নিস্তব্ধতাকে খানখান করে হেসে উঠল। একটা বিচিত্র ঝোড়ে যেন লোকজন গাড়ি ঘোড়া ধুলো ধোঁয়া, হাসি গান কান্না হল্লা তার লুকোনো প্রাণটাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল। সেখানে জীবনের ঝড়। বন্ধু, বস্তি, মহল্লা অষ্টপ্রহর কেবলি বাঁচাতে চাওয়া।

    নারান আপন মনেই বড় বড় চোখে ফিসফিস করে উঠল, যাব, চলে যাব সেখানে।

    ধাপার মা গালে হাত দিয়ে বলল, কোথা?

    শহরে..কাজে। বলে ধাপার মুখটা তুলে বলে, যাবি তো রে ধাপা?

    ধাপা জবাব দিল, মার চঙ্গে।

    ধাপার মা মুখ টিপে বলল, মরণ!

    বলে চুবড়িটা টেনে নিল কোলের কাছে। বিচুলির ছাউনিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল হাওয়া।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকথামালা – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
    Next Article মুখোমুখি – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }