Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    একজন মিসেস নন্দী – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

    লেখক এক পাতা গল্প133 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    এসমালগার

    রাত পুইয়ে এল। তবু খানিক দেরি আছে। সময়ের মাপে নয়। আকাশের মুখ কালো। আশ্বিনের শেষ। হেমন্ত আসছে। তবুও আকাশে বর্ষার মেঘবতীর গোমড়া মুখের ছায়া।

    এ সময়ে কলকাতা থেকে কিছুর উত্তরে মাঠের মাঝে রেল স্টেশনটা যেন একটা বোবা বদ্ধভূমি। স্তিমিত কয়েকটা আলো যেন অতন্ত্র প্রহরীর মতো নিষ্পলক চোখে কিসের প্রতীক্ষা করছে। প্ল্যাটফর্ম, টিনের ছাউনি, দরজা বন্ধ আপিস, খোঁচা লোহার বেড়া আর অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া মাঠ, জলা, সব বোবা, তবু জীবন্ত। নিশ্চল, তবু অনুভূতিময়।

    থেকে থেকে আসছে একটা পুবে হাওয়ার ঝোড়ো ঝাপটা। পূর্ব আকাশে সামান্য আলোর ইশারা। সে আলোয় মেঘ দেখাচ্ছে যেন ছড়ানো লটবহর।

    ঘটাং করে একটা শব্দ এল দূর থেকে। সিগনালের খবরদারি লাল চোখ বুজে গেল, ভেসে উঠল নীল চোখের আমন্ত্রণ। আসছে। ভীত পাখি কিচির মিচির করে উঠল সিগন্যালের মাথার বাসা থেকে। আবার চুপচাপ।

    দু-একজন করে লোক আসছে স্টেশনে। ধীরে নিঃশব্দে। বড় বড় ছায়া ফেলে, গা হাত পা এলিয়ে। স্টেশনের বাইরে আচমকা কালো আঁধার থেকে যেন হঠাৎ প্রতীক্ষাতে আততায়ীর দল বেরিয়ে আসছে। আসছে।

    তারপর বোঝা গেল সেই চির পরিচিত কাশি। ঘুংরি কাশি। কাশি নয়, যেন কামারের নেহাই-এর বুকে হাতুড়ির ঘা। তীব্র শ্বাসরোধী, একটানা। কাশি শুনে বোঝা যায় না লোকটার বয়স, বোঝা যায় না মেয়ে না পুরুষ।

    স্টেশনের পূর্বদিকের অন্ধকার মাঠ থেকে কাশিটা ধেয়ে এল প্ল্যাটফর্মের দিকে। সেই সঙ্গে কাশির প্রতি ক্ষমাহীন অস্ফুট কটূক্তি, শালার কাশির আমি ইয়ে করি।

    গাড়ি এসে পড়ল। তার কপালের তীব্র আলোয় দেখা গেল দুটো ভেজা লাল চোখ, শুকনো মোটা ঠোঁটের ফাঁকে লালচে ছোট ছোট দাঁত, কোঁচকানো মুখ, তামাটে রং, চট ফেঁসোর মতো চুল, চটের বস্তা কাঁধে, গায়ে বুক-খোলা একটা তালি মারা হাঁটু পর্যন্ত হাফশার্ট, তার তলায় প্যান্ট বা কাপড় কিছু আছে কিনা বোঝবার জো নেই! তার তলা থেকে নেমে এসেছে দুটো কঞ্চির মতো পা আর পায়ের পাতা যেন পাতি-হাঁসের চ্যাটালো পা। থ্যাবড়া, মোটা ফাঁক ফাঁক আঙুল। লম্বায় আড়াই হাত। সমস্তটা মিলিয়ে এমন একটা তীক্ষ্ণতা, যেন তলোয়ার নয়, বেখাপ্পা খাপে ঢাকা একটা শানিত গুপ্তি।

    বয়স বিশ কি পঞ্চাশ কি বারো, বোঝার উপায় নেই।

    তবে আসল বয়স তেরো। নাম গৌরাঙ্গ। অর্থাৎ গোরা।

    তবে যদি জিজ্ঞেস করো, তোর নাম কী র‍্যা?

    শুনবে দোঁ-আঁশলা স্বরের জবাব, গোরাচাঁদ এসমালগার।

    এসমালগার অর্থে সমাগলার। কীসের সমাগল? অমনি শুনবে যাত্রার সুরে,

    চাল চুলো নেই বেচালেরে
    আমি জোগাই চাল।

    দেখা যাবে, গাড়ির কামরার মধ্যে সে গানের দোয়ার আছে গণ্ডা কয়েক। তারাও গেয়ে উঠবে। সবাই এসমালগার।

    আশি মাইলের মধ্যে যে কটা জংশন স্টেশন আছে, সবগুলোর পুলিশ রিপোর্টের খাতায় একটু নজর করলেই দেখা যাবে নাম, গৌরাঙ্গচন্দ্র দাশ, বয়স তেরো, অপরাধ বে-আইনি চাল বহন (পনেরো সের), কোর্টে প্রডিউসের অযোগ্য। অতএব…।

    গোরাচাঁদ তিনবার জেল খেটেছে। একবার পুরো একমাস, একবার পঁচিশ দিন আর আঠারো দিন একবার। জেলে ছোকরা ফাইলে থেকে জীবনের নোংরামি ও সর্বনাশের এক ধরনের শেষ তলা অবধি সে দেখেছে। বুঝেছে কিছু কম। তবে নেশা তার নোংরামি ও সর্বনাশের এক ধরনের শেষ তলা অবধি সে দেখেছে। বুঝেছে কিছু কম। তবে নেশা তার জীবনের যেটা ধরেছে সেটা সর্বনাশের।

    একবার ট্রেনের মধ্যে শুনল, সামনের স্টেশনে পুলিশ রয়েছে চাল ধরার জন্য। গাড়ি স্টেশনে ঢোকার আগেই গোরা প্রথমে ফেলে দিল তার পনেরো সেরের ব্যাগ, তারপর লাফ দিয়ে পড়ল নিজে।

    একমাস পরে যখন হাসপাতাল থেকে এল তখন তার গায়ে মাথায় অনেকগুলো ক্ষতের দাগ আর সামনের মাড়ির একটা দাঁতের অর্ধেক নেই, বাকিটা নীল হয়ে গিয়েছে। ফলে, তার পাকা পাকা মুখে যেটুকু ছিল ছেলেমানুষির অবশিষ্ট, তা হল এক মহা ফেরেব্বাজের হাসি।

    তার পঞ্চান্ন বছরের বুড়ো এসমালগার বন্ধু রসিকতা করে বলল, বাবা গোরাচাঁদ, তোমার সেই চালগুলান অ্যাদ্দিনে গাছ হয়ে আবার ধান ফেলেছে।

    অর্থাৎ যে চাল নিয়ে সে লাফিয়ে পড়েছিল। যেমনি বলা, তেমনি দেখা গেল এক রাশ বাদামের খোসা ও ধুলো বুড়োর মুখ চোখ ঢেকে দিয়েছে। সুতরাং গালাগাল আর অভিশাপ। কিন্তু এসব তুচ্ছ ব্যাপারে গোরাচাঁদ মাথা ঘামায় না।

    গাড়ি এল। গোরা তখন দম নিচ্ছে কাশির দমকের। স্টেশনের কুলিটা বিরক্তি ভরে এমন করে এসে ঘণ্টা বাজাল, যেন কোনও রকমে কর্তব্য সারা গোছর পাড়ার নেড়ি কুকুরটার খিঁচোনি। গাড়ি যখন ছাড়ল তখন গোরা তার পছন্দসই কামরা খুঁজতে লাগল।

    গাড়ির গতি বাড়ল তবু কামরা আর পছন্দ হয় না। সেই মুহূর্তে একটা কামরা থেকে কে চেঁচিয়ে উঠল, অ্যাই শালা গোরা!

    চকিতে কী ঘটে গেল। দেখা গেল, গোরা সেই কামরার হাতলে বাদুড়ের মতো ঝুলছে আর তার বন্ধুরা চিৎকার জুড়েছে তাকে পেয়ে।

    ব্যাপারটা বিপজ্জনক, কিন্তু ওটা অভ্যাস। একদিন ছিল, ক্রু আর পুলিশের ফাঁদে পড়ার ভয়ে দেখে শুনে নিতেই গাড়ি ছেড়ে দিত, দৌড়ে উঠতে হত। এখন তো দুটো চোখ নয়, চোখ চারটে এবং সচকিতে। তবু ধীরে সুস্থে থামানো গাড়িতে উঠবে, মনের এতখানি সুষ্ঠুপনা ভাবাই মুশকিল।

    এর মধ্যে টিকেট কাটার কথা কল্পনা করাই যায় না। মূলধন তো পনেরো সের চাল। এ পনেরো সের আর কোনওদিন আধমণে পৌছল না। অর্থাৎ ষাট মাইল দূর থেকে পনেরো সের চাল আনলে, প্রতি সেরে কোন দিন দু-আনা, দশ পয়সা, কখনও বা মেরে কেটে তিন আনা তার থাকে। সারা দিনে খাবার বরাদ্দ চার আনা থেকে পাঁচ আনা। বাকিটা বাড়িতে দিতে হয়। সেখানে আছে ছোট ছোট পাঁচটা ভাই বোন, আর একটি তার মায়ের পেটে বাড়ছে। বাপ না থাকার মধ্যে। অন্তত গোরার কাছে। সে লোকটি এককালে ছিল নিম্নবিত্তের ভদ্রলোক। আশা ছিল বিত্তবান হওয়ার। এখন কলকাতার বাইরে রিফিউজি ক্যাম্পে বসে সে আশা তো কবেই উধাও হয়েছে। উপরন্তু সে এখন গোরাচাঁদের রোজগারে নির্ভরশীল একজন অবাঞ্ছিত রুগ্ন ভার মাত্র।

    সুতরাং এ যুগের বাঙালিরা বাঙালি গোরাকে চেনে না। দুবছর আগে ওদের এলাকার রেশন ইনস্পেকটর এসে যখন গোরার মাকে জিজ্ঞেস করলে, হেড অব দি ফ্যামিলি কে, তখন ইঞ্জিরি কথা শুনে গোরার মা হাঁ করে তাকিয়েছিল। ইনস্পেকটর ব্যাপারটা বুঝে বললে, তোমাদের সংসারের কর্তা কে? তখন গোরার মা গোরার হাত ধরে এনে তার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। ইনস্পেকটর তো থ।

    এর উপরে ষাট মাইলের ভাড়া দুটো টাকা যদি গোরা খরচই করতে পারবে। তবে আর এসমালগার হওয়ার কী দরকার ছিল।

    এর পরে গাড়ির মধ্যে সে এক তুমুল কাণ্ড! মস্ত লম্বা কামরাটার মধ্যে আর কোনও যাত্রীকে চোখে পড়ে না কেবল গোরা আর তার সমবয়সী সঙ্গীদের ছাড়া। তারা সকলেই গোরার সহগামী ও সহধর্মী, সকলের প্রায় একই ছাঁচ, একই গড়ন। তবে নেতা হিসাবে তারা যে-কোনও কারণেই হোক, গোরাকেই মেনে নিয়েছে।

    সমস্ত গাড়িটার মধ্যে তারা এক কোণে দলা পাকিয়ে বসল। যেন এক গাদা কুকুর ছানা জড়াজড়ি করে পড়ে আছে।

    একজন বলল, সেই গানটা ধর এবার।

    কোনটা?

    সেই ঠাকুরের নাম রে। আমাদের গোরা শালার নাম।

    বলতে বলতেই তারস্বরে চিৎকার উঠল : এহ গৌরাঙ্গ, কহ গৌরাঙ্গ, লহ গৌরাঙ্গের নাম হে

    সেই সঙ্গে এ ওর আর ও এর পিঠে চালাল খোলের চাঁটি। এ ভজনার মধ্যেও ছিল গোরার চিল গলার সখী হে বলে টান।

    হঠাৎ একটা চিৎকারে ওরা সবাই থামল। দেখল, কামরাটাতে যাত্রী একজন আছে। কিন্তু যাত্রীটি ছিল বেঞ্চির তলায়। বোধ করি আত্মগোপনের আশায়। বুড়ো। দুটো ভাঁটার মতো চোখ, একমুখ দাড়ি আর সারা গায়ে একটা অজস্র তালিমারা আলখাল্লা।

    খেঁকিয়ে উঠল, বলি কোন্ সুখে র‍্যা, অ্যাই কোন্ সুখে?

    অর্থাৎ কোন্ সুখে এ চেঁচামেচি। গোরাদের দলটা এ বেঞ্চির তলার যাত্রীর দিকে এক মুহূর্ত হাঁ করে তাকিয়ে রইল। লোকটা শাসিয়ে উঠল, ফের আমাকে জ্বালাতন করলে—

    অমনি গোরা টকাস্ করে তার এক বন্ধুর মাথায় চাঁটি মেরে বলল, এই, কেন জ্বালাতন করছি রে?

    বন্ধু আর এক বন্ধুর মাথায় মেরে বলল, আমি নাকি? এই শালা তো।

    আবার সে মারল আর একজনের মাথায়। তারপরে দেখা গেল, গানের চেয়ে চেঁচামেচি আরও বেড়ে গেল, সেই সঙ্গে হুড়োহুড়ি আর কোস্তাকুস্তি। বুড়ো অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত মুখে ঘটনাটা লক্ষ করতে করতে তেলচিটে আলখাল্লাটা এমনভাবে ঝাঁকানি দিল যে একরাশ ধুলো ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। বললে—শালারা হনুমানের জার—।

    তারপর গাড়িটা একটা স্টেশনে দাঁড়াতেই বুড়ো দৃপ্তভঙ্গিতে আলখাল্লা ঝাপটা দিয়ে নেমে গেল, যেন রাজা দরবার ত্যাগ করছেন। বললে, আচ্ছা দেখে লোব।

    এতক্ষণে গোরাদের দলটা পাছায় চাঁটি মেরে হেসে গড়িয়ে পড়ল। ছুটে নেমে পড়ল বাইরে। একজন চেঁচিয়ে উঠল, ও দাদু, ও জগাই, ও মাধাই—

    বুড়ো ততক্ষণে আর একটা কামরাতে উঠে একটা বেঞ্চির তলায় আশ্রয় নিয়েছে আর বলছে, শালার মাথায় উকুনের হদ্দ।

    উকুনের হদ্দ দল আবার তেমনি জড়াজড়ি করে বসেছে। কিন্তু প্রত্যেক স্টেশনে তারা নামবেই। চুপচাপ বসেই যদি যাবে তা হলে আর ভাবনা ছিল কি। বোধ করি এই গান, মারামারি, খেলা, নিজেকে আর নিজের সব কিছুকে ভুলে থাকার এ অবিশ্রান্ত উন্মাদনা না থাকলে এ দীর্ঘ পথ, সময় হত মরুভূমি ও রুদ্ধশ্বাস যন্ত্রণা। তা ছাড়া, পথ অতি দুর্গম। কোথায় বাঘের মতো ওত পেতে আছে ক্রু, মোবাইল কোর্ট, পুলিশ, ওয়াচ অ্যান্ড ওয়ার্ড আর কালকেউটের মতো সিভিল সাপ্লাইয়ের গুপ্তচর, বলা তো যায় না।

    ভোর হয়ে আসছে। হাজারো মেঘের ভিড় আকাশে, তবু মেঘে মেঘে অপ্রতিরোধ্য বেলা আসছে। পুবের ধূসরতায় যেন ছাই চাপা মুক্তোর জেল্লা। টেলিগ্রাফের তার যেন একটা দিকপাশহীন বেহালার তার। সেই তারে তারে জটলা ন্যাজঝোলা পাখির।

    . যাত্রী বাড়ছে। বাড়ছে কোলাহল। ভিড় বাড়ছে, গোরার সহধর্মীদের। মেয়ে, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ। যেতে হবে দূরে, বহুদুরে। এক জেলা থেকে আর এক জেলায়, পথ মাঠ ভেঙে, গাঁয়ে হাটে। তারপর ফিরে আসতে হবে এখানে, রেশন এলাকায়, কর্ডনের অবরোধ ভেঙে।

    বিড়ি খাচ্ছে গোরা। খাচ্ছে না, ফুঁকছে। বুড়ো মদ্দ হদ্দ হয় তার নাক মুখ থেকে ধোঁয়া বেরুনো দেখলে। স্টেশনের ধারে কোয়ার্টারের জানালায় বসে একটা ছেলে পড়ছিল, সাজাহান অ্যা সাজাহান অত্যন্ত হৃদয়– কিন্তু থেমে গেল পড়া, চোখাচোখি হয়ে গেল গোরার সঙ্গে।

    গোরা চোখ নাচিয়ে এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, কী পড়ছিস? বিড়ি খাবি?

    বিড়ি? ছেলেটার চোখে কৌতূহল, বিস্ময় ও ভয়। বুক জোড়া কপাটে কপাটে যেন হাজারো করাঘাত পড়ল। খিলখিল করে হেসে চলন্ত গাড়িটাতে গোরা ন্যাকড়ার ফালির মতো উড়ে গেল। হাসির রেশটা একটা ভয় ব্যথা আনন্দের শিহরন রেখে গেল শুধু জানালায়।

    হঠাৎ যেন থমকে যায় গোরা। বুকের দ্রুত তালে ভাটা পড়ে মন উজানে চলে। জলা মাঠে ছিটে বেড়ার ঘর, এক গাদা পুতুল আর পেট-উঁচু মা। পেটের বোঝার ভারে নত, চোখের কোল বসা, চোপসানো গাল, একটা অর্থহীন যন্ত্রণাকাতর চাউনি। সেখানে জানালা নেই, সবটাই খোলা, নয়তো সবটাই বন্ধ। ভয় কৌতূহল বিস্ময় আনন্দ নেই। একটা তীব্র হাহাকারের অসহ্য নৈঃশব্দ্য আর কীসের তাড়নায় দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছুটে চলা কিংবা আচমকা একটা সুরতালহীন ভাঙা স্বর, আর বিড়ি খাসনি বাবা!

    চকিতে গোরার মুখের উপর একটা থাবা পড়ে আবার উঠে গেল। দেখা গেল তার মুখের বিড়িটা আর একজনের মুখে চলে গিয়েছে। সেটা নিয়ে আর একজন, তারপরে আর একজন, তারপরে আবার হল্লা ও চিৎকার।

    শহরতলীর ভিড়। রেল লাইনের ধারে ধারে কারখানা, বস্তি, ধুলো, ধোঁয়া আর মানুষ। মানুষ গাড়িতে। যাত্রী, অ-যাত্রী, ভিখিরি, হকার। বৈরাগী গাইছে

    গৌর বিনা প্রাণে বাঁচে না। কি যন্ত্রণা—

    গোরা বলল চেঁচিয়ে, কী যন্তনা বলো না গো! এখেনেই আছি।

    সবাই হেসে উঠল গাড়িসুদ্ধ। গোরা আরও গম্ভীর হয়ে বললে, অ! ঠিক ধরেছি, আর বলতে হবে না! দুটো পয়সার যন্ত্রণা তো! আবার হাসি। কিন্তু বৈরাগী ভিখিরির পিত্তি জ্বলে গেল। গোরা আবার বলল, তা কী করব বলো। আমি যে এখন গোরা এসমালগার হইছি গো!

    গাড়ি থামতেই এক গাদা মেয়েমানুষ হুড়মুড় করে ঢুকল। তাদের কাঁধে আর কোমরে চটের ব্যাগ। এরা সব গোরাদেরই সহযাত্রিণী গোরা বলে এসমালগারিনী। এদের মাঝে সুবালা হল গোরার বান্ধবী। গোরা বলে, আমার বিষ্ণুপ্রিয়া।

    সুবালার ডাঁটো বয়স। আঁটো মেয়ে, খাটো গড়ন। ঘরে আছে পিঠোপিঠি দুই ছেলে। তারা একটু বড়ো হয়েছে। তিনবছর ধরে স্বামী নিখোঁজ, আর সুবালা রেফিউজি কলোনিবাসিনী! কপালে আর সিঁথিতে জ্বল জ্বল করে সিঁদুর আর কী করে জানি না তার কালো মুখে সাদা দাঁতে নিয়ত ঝলমল করে হাসি। অতএব যা বলতে হয় তাই কলোনিঘরণীরা বলাবলি করে, পোড়া কপাল তোর বেঁচে থাকার আর সিঁদুর পরার। তোর কোন যমের ঘরে রইল সিঁদুর। তাকে রাখলি তুই মাথায়। ও, চাল না টিপেই বুঝি, ক-ফুট হল। সুবালারও নাম আছে পুলিশের খাতায়। সাতদিন হাজতবাস করেছে সে বেআইনি চাল বহনের অপরাধে।

    আর এ পেশায়, এ পথে, সহস্র চোখ ও তার দিকে বাড়ানো হাতের মাঝে সে নজর করল গোরাকে। ঘরে তার দুই ছেলে, বাইরে সারা দিনের জীবনে সে বোধ হয় স্নেহ দিয়ে বাঁধতে চেয়েছিল তাকে। কিন্তু গোরার জীবনধারণের ক্ষেত্রে স্নেহ শাসন ভয় আইন শৃঙ্খলাটাই বে-আদবি।

    সে পরিষ্কার বলে দিয়েছিল, তুমি কিন্তুন আমার বিষ্ণুপ্রিয়া।

    সুবালা খিলখিল করে হেসে উঠে বলেছিল, কেন, আমি–আমি তো শচীমাতা।

    একটা অদ্ভুত গোঁ ধরেছিল গোরা, সে আমার ঘরে আছে। তা হবে না।

    ফিক করে হেসে উঠতে গিয়ে চকিত যন্ত্রণায় আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল সুবালার গলা। দেখেছিল, তার সামনে সেই উসকো-খুসকো ক্ষুধার্ত ছেলেটার বয়স গৌণ, এ সংসারে ও একটা মস্ত দিগগজ। বয়সটার কথা গোরা নিজেও ভুলে গেছে। তাই তার দাবি আর দশটা বয়স্ক পুরুষের মতোই।

    কান্না চেপে অদ্ভুত হেসে বলেছিল সুবালা, আচ্ছা, তাই হল গো গোরাচাঁদ।

    হোক মিথ্যে, তবু সেই ভাল। সুবালার হৃদয় তো আর মিথ্যা নয়, আর সেই থেকে তাদের দলের মধ্যে এ মজার কাহিনী রাষ্ট্র হয়ে গেল। আসলে যেটা ঘটল, সেটা সুবালার কাছ থেকে গোরাচাঁদের দৈনিক এক আনা চায়ের বরাদ্দ। সম্পর্কের মধ্যে এ নগদ আদায়ের আত্মীয়তা ছাড়া আর কারও কিছু বোধকরি দরকার ছিল না। এ নিয়ে যারা টিপ্পনি কাটত, তারা হল সুবালার বয়স্ক মেয়ে পুরুষ সঙ্গীরা।

    কে চেঁচিয়ে উঠল, গোরা, তোর বিষ্ণুপিয়ে এয়েছে।

    অমনি গোরা গান ধরল,

    পরান ধরে বসে আছি, তোমারি পথ চেয়ে গো—

    সুবালা খিলখিল করে হেসে ওঠে। অচেনা যাত্রীর দল অবাক হয়। একটু রসসন্ধানীও হয়ে ওঠে। মুহূর্তে সুবালা চুম্বক হয়ে ওঠে একটা।

    সুবালার মনের মধ্যে একটা চাপা লজ্জাও হয়। তার সঙ্গিনীরা বিরক্ত হয় কেউ, কেউ হাসে।

    গোরা বলে ঠোঁট উলটে, তোমাদের ইস্টিশানটা বাপু বড় দূরে।

    সুবালা হেসে বলে, তোর বুঝি তর সয় না?

    গোরা তার কোঁচকানো গালে হাসে আর ভাঙা নীল দাঁতটা জিভ দিয়ে ঠেলে। ভাবে, কীসের তরের কথা বলছে সুবালা। সেই চারটে পয়সার, না, সুবালার। বলে, তর আবার কীসের?

    সুবালা বলে, আমার জন্যে?

    গোরা সমানে সমানে জবাব দেয়, হ্যাঁ গো, তুমি যে বিষ্ণুপিয়া।

    বেশি ঘাঁটায় না সুবালা। জানে, গোরার ছোট বড়, চেনা অচেনা, কোনও মানামানি নেই। চারটে পয়সা দিয়ে বলে, যা পালা।

    বলতে হয় না। পয়সা পেয়েই লাফ দিয়ে উঠে পড়ে গোরা। জংশন স্টেশনে নামতে গিয়ে দরজার দিকে ছুটতে গিয়ে কারও হাঁটুর গুঁতো মাথায় চাঁটি ঠকাঠক পড়ে সে সব যেন গোরার গায়েই লাগে না। যেন কার পিঠে বা পড়ছে। জংশন স্টেশনটা আসতেই সে কোনও রকমে লাফ দিয়ে নেমে পড়ে। একা নয়, সঙ্গীরাও আছে পিছে পিছে।

    চার পয়সা দিয়ে এক গেলাস চা নিয়ে গোরা দু-এক চুমুক না দিতেই আর একজন চুমুক দেয়। সঙ্গে সঙ্গে আর একজন, তারপর আর একজন। সেই সঙ্গে কাড়াকাড়ি খেলার হাসি। যেন একটা পাত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এক গাদা কুকুরের বাচ্চা। মুহূর্তে দেখা যায়, তপ্ত চা ভরতি গেলাস একেবারে সাফ।

    এমন সাফ, বুঝি ধুতেও হবে না।

    চা-ওয়ালা কটূক্তি করে এক হ্যাঁচকায় গেলাসটা ছিনিয়ে নেয়, শালা ভিখমাঙার দল।

    ভিখমেগো লয় হে, এসমালগার। জবাব দিল গোরা।

    চা-ওয়ালা বুঝল না, জবাবও দিল না।

    কিন্তু চা চেটে ওদের অতৃপ্ত রসনা যেন লকলকিয়ে ওঠে। খাওয়ার পয়সাটা ওরা আরও দূর মফস্বলে গিয়ে খরচ করবে। সেখানে ভাত দুটো বেশি পাওয়া যায়।

    একজন বলল, মাইরি, আমারও যদি এট্টা বিষ্ণুপিয়ে থাকত।

    আফসোসটা বোধ করি সকলের। সকলেই চুপ করে থাকে।

    গোরা খুব নির্বিকারভাবে তাচ্ছিল্য ভরে বলে, বে-টা এবার করে ফেলব।

    এমন গম্ভীরভাবে বলে যে তার সঙ্গীরা সন্দেহ করলেও প্রশ্ন করতে সাহস করে না।

    একজন বলে ফেলে, তোর চে তো বড়।

    গোরা বলে, কীসে?

    বয়সে?

    ফুঃ! যেন ফুঁ দিয়ে ওড়ানো ছাড়া গোরার এতে জবাবই নেই।

    গাড়ি ছোটে পুবে উত্তরে বাঁক নিয়ে। শহরতলীর কারখানা এলাকা ছেড়ে এসে পড়ে দিগন্তবিসারী মাঠ গ্রাম। বেড়ে যায় স্টেশনের দূরত্ব।

    বেলা বাড়ে মেঘে মেঘে। কখনও বা গোমড়া মুখে হঠাৎ হাসির মতো চকিত রোদ দেখা দেয়।

    গোরাদের জীবনটাও এই মেঘেরই মতো। বয়সটা যেন মেঘ চাপা সূর্য। হাজারো কষ্ট, যন্ত্রণা, নিষ্ঠুরতা ও পাকামি থাক, চাঞ্চল্য যেন উপচে পড়ে। চুপ করে বসে থাকা যে কুষ্টিতে লেখা নেই। তাই চলন্ত গাড়িতেই শুরু হয় খেলা। ইঁদুর আরশোলার মতো এর পায়ের তলা দিয়ে, ওর ঠ্যাঙের তলা দিয়ে। কখনও বা একেবারে পা-দানি ধরে ঝুলে পড়ে বাইরে, নয়তো কামরা থেকে কামরায় যায় ছুটে।

    যাত্রীরা গালাগালি দেয়, খেঁকিয়ে ওঠে। ওরা ভ্রূক্ষেপ করলেও আবেগ বাগ মানে না।

    সে খেলার দিকে চেয়ে চেয়ে সুবালা শিউরে শিউরে ওঠে। তারও জীবনের বিড়ম্বনাটা যেন মেঘের মতো আর বুকের ভেতরে যেখানটায় শিহরন, সেখানটা মেঘচাপা সুর্যের মতো। হাজারো অভিশাপ ওইখানে ম্লান। ঘরে দুটোকে রেখে আসার জন্য উৎকণ্ঠা ও ব্যাকুলতা এখানে গোরাকে ঘিরে বুঝি মগ্ন হয়ে থাকে। সুযোগ বুঝে গোরার সেই পঞ্চান্ন বছরের বন্ধু সুবালার কাছেই গোরার ব্যবহার সম্পর্কে নালিশ করতে বসে। ছোঁড়া ভারী হারামজাদা, দেখ, যাচ্ছিস বিনি টিকিটে, করছিস বেআইনি কাজ, আবার প্যাসেঞ্জারের গায়ে পড়বে। সুবালা বলে, ধরে আনো না।

    কে আমি? মাথা ঝাঁকিয়ে বলে বুড়ো, রামো রামো। আমার একটা মানজ্ঞান নেই?

    সুবালা অবশ্য বলে না বুড়োকে যে, গোরা যখন রোজ তার চালের বস্তা মাথায় করে এনে গাড়িতে তুলে দেয় তখন কোথায় থাকে এ মানজ্ঞান।

    একজন চেঁচিয়ে উঠল, গোরা, একটা মামা রয়েছে রে।

    মামা মানে ক্রুম্যান। গোরা বলল, কোথা?

    ফ্যাস্ট কেলাসে ঘুমোচ্ছে।

    গোরা বলল, খবরটা বিষ্ণুপিয়েকে দিয়ে আয়।

    অর্থাৎ সকলকে সাবধান করে দেওয়া হচ্ছে। একটা ক্রুম্যানের পক্ষে এ চাল বহনকারী বাহিনীকে অবশ্য ধরে নামানো সম্ভব নয়। তবু সাবধানের মার নেই। একজনকে মাঝপথে নামিয়ে দিলেই তো সে গেল। আর গোরার ভাষায় এ এসমালগার দলের সমস্ত খবর পাওয়া যাবে গোরাদের কাছেই। এদের ধরবার জন্যে কোথায় কোন শত্রু আত্মগোপন করে আছে, এরা নানান রকমে সে সন্ধান জোগাড় করে নেয়।

    মোশায়, এট্টুস আগুন দেবেন? গোরা বিড়ি মুখে দিয়ে দাঁড়াল একজনের সামনে।

    লোকটি ভদ্রলোক। তিনি সিগারেট খেতে খেতে একবার খালি রাগে কটমট করে গোরার দিকে তাকালেন।

    কিন্তু বৃথা। ওর কাছে এ আত্মসম্মান, অপমান, ছোট বড়র কোনও স্থান নেই। এ সমাজের শৃঙ্খলা ও আইনকে যে-কোনও উপায়ে ভেঙে পলে পলে ওকে নিশ্বাস নিতে হয়। ও কিশোর নয়, বালক নয়, ছাত্র নয়, এমন কী একটা আপিসবয়ের আনুগত্যও ওর জানা নেই। ও এ যুগের হেড অব দি ফ্যামিলি। একটা মস্ত পরিবারকে পালন করে। ও এসমালগার। সভ্যতা ভদ্রতা এখানে অচল।

    আবার বলল,দেবেন না?

    ভদ্রলোক পাশের লোকটিকে বললেন, দেখলেন মশাই সাহসটা?

    কিন্তু যাকে বললেন, বোধ হয় দেখে বলেননি লোকটা কোন্ কোয়ালিটির। সে বলে উঠল, শালাদের খালি উঠতে বসতে লাগাতে হয়।

    মাইরি! বলেই গোরা খানিকটা সরে গিয়ে অন্যদিকে মুখ করে গেয়ে উঠল;

    যে বলে আমাকে শালা
    তার বোনেরে দিব মালা।

    অমনি একটা রাগ ও হাসির রোল পড়ে গেল। আর শালা বলেছিল যে লোকটা, সে একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ল এসে গোরার উপর। চলল কিল, চড়, লাথি, ঘুড়ি আর গালাগাল।

    গোরার বন্ধুরা হঠাৎ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল। একটা ক্ষীণ প্রতিবাদও উঠল কামরাটার মধ্যে। সুবালা ওইখান থেকেই চেঁচিয়ে উঠল গোরা গোরা বলে।

    ততক্ষণে গোরাকে মুক্ত করে নিয়েছে তার বন্ধুরা, আর সে লোকটা আস্ফালন করেই চলেছে, মেরে ফেলে দেব আজ কুত্তার বাচ্চাটাকে।

    কিন্তু সবাই দেখছিল গোরাকে। মার খেয়ে তার তামাটে মুখটা আরও তামাটে হয়ে উঠেছে। চুলগুলো ঢেকে ফেলেছে প্রায় অর্ধেক মুখটা। তার ভেতরে শুকনো চোখ দুটো জ্বলছে ধকধক করে।

    পরের স্টেশনে যখন লোকটা নামতে গেল, সবাই দেখল একটা প্রকাণ্ড শরীর ধপাস করে আছড়ে পড়ল প্ল্যাটফর্মের উপর আর আঁট কাছাটা পড়ল ঝুলে।

    পড়াটা এমনি মোক্ষম হয়েছে যে, সে ওঠবার আগেই গাড়ি ছেড়ে দিল আর সেই সঙ্গে একটা কাঁচা পাকা দোআঁশলা গলার সমবেত হাসির শব্দ ভরে দিয়ে গেল আকাশটা।

    আবার খেলা। বোঝবার উপায় নেই কিছুক্ষণ আগে গোরা মার খেয়েছে। এরকম ঘটনা তো প্রায় রোজই ঘটছে। বিড়ি খাচ্ছে, থুতু ফেলছে এখানে সেখানে বকবক করছে, পানের বোঁটা চিবোচ্ছে পানওয়ালার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে ফেরিওয়ালার কাছ থেকে আচারের নমুনা চেয়ে খাচ্ছে। কাশছে ঘং ঘং করে। যেন জ্বরের ঘোর। যেন পাগলাটে নিশি ওদের তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে। যেন থামলেই সব শেষ হয়ে যাবে এখুনি। সময় নেই।

    আর কতদূর? দুটো জংশন স্টেশন পেরিয়ে গিয়েছে। দূরের ওই স্টেশনটায় ওগুলো কী দেখা যায় সারি সারি? মোবাইল? না, জলার কাশবন।

    বেলা বাড়ছে। রোদ নেই, পুবের ঝোড়ো হাওয়া জলো জলো।

    চোখ জ্বলছে, খালি তেষ্টা পাচ্ছে, পেটটা চোঁ চোঁ করছে। কিন্তু এখনও যে অনেক দূর।

    কী দরে আজ চাল পাওয়া যাবে, কে কত সের কিনবে, কে কত নিয়ে এসেছে, সবাই আলোচনা করে।

    গোরা হঠাৎ কখনও কখনও ছুটে আসে সুবালার কাছে। ডাকে বিষ্ণুপ্রিয়ে।

    সে ডাক যেমনি অদ্ভুত, তেমনি হাস্যকর। বলে, তুমি কবে আমার সঙ্গে যাবে?

    সুবালা যেন ছোবল খেয়ে হাসে। বলে, যবে তুই নিয়ে যাবি।

    তারপরে হঠাৎ গোরা আনমনা হয়ে যায়। চোখ দুটো শুন্যে নিবদ্ধ, কিন্তু সেখানে যেন কত লুকোচুরি খেলা।

    নিঝুম গেঁয়ো স্টেশনটার জলা ঝোপ থেকে সেই পাখিটা ডাকে কুর কুর করে, ওগো, খোকা কোতায়! খোকা কোতায়। গোরার চোখে ভেসে ওঠে একটা গ্রাম, ঘর, আর নিকনো দাওয়া। মা সেই দাওয়ায় বসে নাদা-পেটা ছেলেকে তেল মাখায়। ছেলে কাঁদে তেলের ঝাঁজে। মা বলে, কেঁদোনি, সোনা, কেঁদোনি। তোমারে ফটিক জলে নাওয়াব, দুধে ভাতে খেতে দেব, সোনার কপালে চুমু খাব।

    সে কথা কোন জন্মের? আবার চোখে ভাসে, শহরতলীর কারখানায় রাবিশের স্তূপ। তার পাশে বিস্তৃত জলা ছোট ছোট ছিটে বেড়ার ঘর, সারি সারি কতগুলো রুগ্ন পুতুল আর পোয়াতী মা। মুখে কোনও কথা নেই শুধু নিষ্পলক অদ্ভুত দুটো চোখে চেয়ে থাকা, এ দুরন্ত জীবনেও এ চোখের কথা সরল, স্বরবর্ণের মতো সহজ!

    হঠাৎ গোরা আনমনে ফিসফিস করে ওঠে, মা।…মা!

    সুবালার নিষ্পলক চোখে কিছুই এড়ায় না। সে দেখে, গোরা যেন সত্যিই এক স্বপ্নাচ্ছন্ন তন্ময় কিশোর। সে অমনি ঝুঁকে পড়ে ডাকে, কী রে গোরা, কী হয়েছে?

    বিমুঢ় গোরা অবাক চোখে সুবালার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মুখটা ঠেকে সুবালার বিশাল বুকের কাছে। ভাবে, মা বুঝি ডাকছে। তার মা।

    পর মুহূর্তেই সম্বিত ফিরে আসে। ততক্ষণে কী যেন ঠেলে আসছে গলায় আর চোখে। কিন্তু তাকে কিছুতেই আসতে দেওয়া হবে না। এ জীবনে আর যাই হোক, চোখের জল ফেলে অধর্ম গোরা করবে না।

    হঠাৎ কাশিতে হাসিতে একটা বিকট শব্দ করে সে ছুটে খেলায় যোগ দিতে যায়। অমনি একটা হইহই পড়ে যায়। যেন ঝোড়ো হাওয়ায় সবাই শশব্যস্ত হয়ে পড়ে।

    কে প্রাণ খুলে গান ধরেছে,

    বৈরাগী না হইও নিমাই, সন্ন্যাসী না হইও,
    নগর ছানিয়া দিব, পরান ভরে খাইও।

    আর গোরা একজন যাত্রীকে হাত মুখের ভঙ্গি সহকারে বলছে, জেলের ভয় দেখাচ্ছেন? মোশাই, তিনবার ঘুরে এয়েছি। ভাঙা দাঁত আর মুখের দাগ দেখিয়ে বলছে, পড়ে মরব? তা-ও হাসপাতালে থেকে এয়েছি। আমার নাম গোরাচাঁদ। যাত্রীটি একমুহূর্ত ভ্যাবাচাকা খেয়ে বললে, ডেঁপো।

    ডেঁপো নয় বাবু, ভেঁপু। বলে মুখের একটা বিচিত্র শব্দ করে সরে গেল। তারপরই হঠাৎ, সখী একবার ফিরে চাও গো। বলে তীব্র চিৎকার।

    কিন্তু আর কতদূর! এ গাড়িটা মাঝে মাঝে থামতে পারে। ওরা যে পারে না। বিড়ি ভাল লাগে না। প্যাচ প্যাচ করে ফেলার মতো থুতুও নেই মুখে। চোখ ছোট হয়ে আসে, গা-টা ঘুলোয়। ওই লোকটা কি সিভিল সাপ্লাইয়ের বাবু? না, ওটা তো একটা এসমালগার।

    বেলা বাড়ে। এত তাড়াতাড়ি বাড়ে যেন রেলগাড়িটাকে মনে হয় ঠেলাগাড়ি। তবু রোদে নয়, ছায়ায় বাড়ে বেলা।

    তারপর একসময় সবাই হুড়মুড় করে নামতে আরম্ভ করে। একটা ছোট্ট স্টেশন, যেন কুলগোত্রহীন চালচুলোহীন গেঁয়ো ছেলের শহুরে ঢঙের মতো। সমান্তরাল পাথুরে প্ল্যাটফর্ম, টিকিট ঘর, সাইনবোর্ড, তারপরেই বেতবন ও আসশেওড়ার ঝোপ। ধার দিয়ে সরু পথ চলে গেছে মাঠের দিকে। বুনো বুনো গন্ধ।

    ওরা সব গাড়ি থেকে নামতেই যেন যাত্রীরা সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। বলে, শালা, মাথার উকুন নামল।

    উকুনের দল পিলপিল করে রাস্তায় নামে। যাবার সময় স্টেশনের কুলিটাকে সবাই দুটো করে পয়সা দিয়ে যায়। ওটাই রেওয়াজ। কে আর রোজ রোজ টিকিটের জন্য বিবাদ করে।

    চলে সবাই গঞ্জের দিকে। এখান থেকে ক্রোশখানেক দূর। তারপর ছোট নদী। নদীর ধারে গঞ্জ। সেখানে চালের আড়ত।

    মাটি পায়ে ঠেকতে যেন আবার একটু দম ফিরে পায় সবাই। এখানে নেমেছে একটা দল মাত্র। বাদবাকিরা আগে নেমেছে। পরেও নামবে কেউ কেউ।

    এ-দলটার সবার আগে চলেছে গোরা, তার বন্ধুরা, চলেছে জোয়ান বুড়ো, মেয়ে পুরুষ। যেন একটা মিছিল চলেছে। ধুলো আর ধূসর বেলায় যেন একটা ছায়া মিছিল।

    মাঠে মাঠে ধানে পাক ধরেছে। নিরালা, জনশূন্য মাঠ।

    হঠাৎ ধুলোয় গড়াগড়ি খেতে আরম্ভ করে গোরাদের দলটা। যেন উচ্ছ্বসিত চড়ুইদলের হুটোপুটি খেলা।

    তারপরে গঞ্জ। অমনি সকলে অন্য মানুষ হয়ে ওঠে। যে যার কোমরে পকেটে হাত দেয়। বার করে তাদের প্রত্যহের মূলধন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গোনে কত আছে। জানে না কত আছে, তবু গোনে। সন্তর্পণে মুঠো করে ধরে। তাদের জীবন, সেই সঙ্গে আরও অনেকের। যে পয়সা থেকে মরে গেলেও আধপয়সা ছাড়া যাবে না। এমন কী এক পয়সার লজেন্স, দুটো মুড়ি বিস্কুট কিংবা বুড়ির মাথার পাকা চুল। কিছুই না। সাধ আস্বাদ খিদে ভালবাসাও নয়।

    আড়ত দু-তিনটে। সবাই ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে ব্যাগ আর পয়সা নিয়ে।

    দেখা গেল দর একটু চড়েছে। শরতের শেষ, হেমন্তের শুরু। নতুন চাল বাজারে বেরোয়নি এখনও। চাষী বিক্রেতা একটাও নেই। শহরের লোকগুলো হন্যে হয়ে ফিরছে চালের জন্য। শহরে চাল নেই রেশনের আধপেটা ছাড়া। শহরের খুচরো দোকানওয়ালারা তাই এখন ভারী খাতির করে গোরাদের।

    ও-দিকে নদীর বুকে নৌকা বোঝাই হচ্ছে চাল। যাবে কলকাতায়, কালোবাজারে। যেমন যাবে গোরাদেরটা। কিন্তু ওদের নেই মোবাইল কোর্ট, পেছনে সিভিল সাপ্লাইয়ের গুপ্তচর, পথে পথে পুলিশের জুলুম। গোরা বলে, ওরা এসমালগার লয়, সরকারের বোনাই, তাই ঘর কারবার।

    তারপর সবাই যায় গঞ্জের হোটেলে খেতে। কাঁচা মেঝেয় শুকনো কলাপাতা। কিন্তু ভাতের গন্ধে যেন চারদিক ম ম করছে। একটু ডাল আর ভাত। রেট চার আনা।

    গোরারা সবাই পাতাপাতি করে খায়। কারও কারও কম কারও বেশি হয়। তারপর হঠাৎ খালি পাতার দিকে দেখে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে সবাই কেমন বোকার মতো হাসে। আর এঁটো পাতাগুলো যেন সদ্য ধোয়া মাজা হয়েছে।

    ম্যানেজারকে পয়সা দিয়ে, নদীর জলে আঁচিয়ে উঠে গোরা বলে, শালা কেষ্ট ঠাকুরের খুদ খাওয়া হল। এই দ্যাখ। বলে পেটটা ফুলিয়ে দেখায়। আর একজন সেটা বাজায়। হাসি আর হল্লায় মনে হয় যেন বর্গী এসেছে গঞ্জে।

    এসমালগারিনীর দলও খেতে বসে হোটেলে। সুবালা বাইরের দিকে তাকিয়ে আনমনে ভারতের গরাস তোলে মুখে। বাইরে সদ্য খাওয়ার ঢেকুর তুলে সেইজন সেই গান গেয়ে উঠেছে :

    বৈরাগী না হইও নিমাই, সন্ন্যাসী না হইও।…

    আবার ফিরে চলা। এবার আরও হুঁশিয়ার। পদে পদে আরও ভয়, আরও উৎকন্ঠা। আর সে শুধু প্রাণে নয়, ধনেও বটে। প্রাণ গেলেও এ ধন দেওয়া যায় না। এ যে মূলধন।

    সবাই অভিন্ন, একক এখানে। এক কথা, এক চিন্তা, এক ভয়, এক ভাবনা। এর বোঝা ও নেয়, ওর বোঝা এ নেয়। গোরা বলে, বিষ্ণুপিয়ে, তোমার বোঝাটা আমার মাথায় দেও।

    সুবালা হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, আর মরদগিরি করতে হবে না, চল দি নি।

    একটা বুড়ি তার বোঝাটা গোরার মাথায় তুলে দিয়ে বলে, নিবি তো, এটা নে বাবা।

    গোরা বলে, লোব গো বিষ্ণুপিয়ে?

    পারলে নিবি। জবাব দেয় সুবালা। কিন্তু ক্ষুব্ধ হয়, রুষ্ট হয় বুড়িটার উপর।

    পিঠটা বেঁকিয়ে ঝুঁকে চলে গোরা। যেন একটা দুমড়ানো কঞ্চি।

    দেখা যায়, সবাই নানান কথায় জমে উঠেছে। পারিবারিক আর অতীত জীবন। কে কবে কাঁড়ি কাঁড়ি ভোগবতী চাল বেঁধে খাইয়েছে, কার উঠোন ভরে একদিন আপন পনেরো সের চাল চড়ুই পায়রায় খেয়েছে। কার ছেলে একটা চাকরি পাবে, কে পাকিস্তানে গিয়ে তার জমিজমা বিক্রি করে দু-পয়সা নিয়ে আসবে, কার নিখোঁজ ছেলে নাকি সত্যি ডাক্তার ছিল।

    সুবালা ভাবতে চেষ্টা করে তার নিখোঁজ স্বামীর কথা। আশ্চর্য! কটা বছর, তবু মুখটা একদম মনে পড়ে না। গোরা হঠাৎ বলে, বিষ্ণুপিয়ে।

    কীরে।

    গোরা একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, আমার কিছু ভাল লাগে না।

    হঠাৎ যেন সুবালার ব্যথা লাগল বুকে গোরার গলা শুনে। দেখে গোরার ক্লান্ত হাঁ-মুখ, মাথার বোঝার তলায় দুটো ম্লান চোখ, সমস্ত মুখে যেন একটা কীসের আচ্ছন্নতা।

    সুবালা তাড়াতাড়ি তাকে একেবারে বুকের কাছে টেনে জিজ্ঞেস করে, কেন রে, কেন?

    জবাব দিতে গিয়ে ফিক করে গোরা হেসে বলে, তোমার গায়ে কী সোন্দর গন্ধ।

    ওমা! সে আবার কী?

    হাঁ গো, আমার মার মতন।

    সুবালা আছাড় খেতে গিয়ে সামলে নেয়।

    বেলা ঢলো ঢলো। আকাশ আরও কালো হয়। এবার স্টেশন, তারপরে গাড়ি।

    গাড়িতে তুমুল ব্যাপার। তবে প্রাত্যহিক। মালে-মানুষে ঠাসাঠাসি। দরজা দিয়ে জানালা দিয়ে গলে গলে ঢুকছে ব্যাগ আর মানুষ। গালাগাল, শিশুর কান্না, হকারদের চিৎকার। যেন গাড়ি নয়, চলন্ত হাট। কে ঠেলছে আর ঠেলা খাচ্ছে, কোনও ঠিক নেই।

    এক ফোঁটা গোরা যেন একটা অসুর। এরটা তুলে দেয়, ওরটা এগিয়ে দেয়। শেষটায় চালবহনকারীর দল গাড়ির ছাদে উঠতে আরম্ভ করে। প্রাণের আশঙ্কা, কিন্তু না হলে নয়।

    গোরা যেন জাদুকরের মতো ভেতরে জায়গা করছে। এ একটা লাঠি মারে, ও একটা চড়। যা-ই করো, উপায় নেই। বেশি কিছু বললে গাঁক করে কামড়েও দিতে পারে। কে যেন বললে, এই হারামজাদা!

    গোরা বললে, কে তবে কলির গাধা? বলেই সড়াত করে এক বেঞ্চির তলা দিয়ে আর এক বেঞ্চির তলায় চলে যায়। লোকজন চিৎকার করে ওঠে। কেউ বলে চোর, কেউ পকেটমার।

    সে বলে, আজ্ঞে না, গোরাচাঁদ এসমালগার।

    ছুটছে গাড়ি, আর প্রত্যেকটা স্টেশন থেকে উঠছে চালবহনকারীর দল। মেয়েপুরুষ বাছবিচার নেই। এ ওর বুকে, ও এর মুখে। তবে সেটা ভাববার অবকাশ নেই।

    এর মাঝেও আছে গোরাদের ছুটোছুটি। আর প্রত্যেকটা স্টেশনে নেমে নেমে সন্ধান করছে, সামনে বিপদ ওত পেতে আছে কি না। আবার দেখা যাচ্ছে দল বেঁধে সব স্টেশনে প্রস্রাব করতে বসেছে।

    তারপরে একটা আপগাড়ির সঙ্গে তাদের দেখা হাতে শোনা গেল সামনের জংশনেই মোবাইল আর সিভিল সাপ্লাই রয়েছে। অমনি কেউ কেউ ব্যাগসুদ্ধ লাফিয়ে নামতে আরম্ভ করে। যেন তাড়া খাওয়া ব্যাঙের দল ডোবায় পড়ছে কিন্তু সে আর ক-জন। গাড়ি ছেড়ে দেয়।

    ট্রেনের শিকল কাঠের ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করা। সবাই চিৎকার করে বলাবলি করছে ফিকিরের কথা। কিন্তু ফিকির নেই।

    গোরা হাঁ করে তাকিয়ে আছে শুন্যে। হাত দুটো ঝুলে পড়েছে। বিহ্বল, শুন্যমন। মনে পড়ল, জেল। সেটা কিছু নয়। কিন্তু মূলধন! ভাই বোন আর মা! তারা কী খাবে কাল? কেমন করে তাকাবে মা ওই অসহ্য অপলক দুটো চোখে। হঠাৎ সে তার ব্যাগ নিয়ে দরজার দিকে এগোয়।

    বন্ধুরা বলে, ঝাঁপ দিবি?

    না।

    তবে?

    সুবালা ছুটে আসে। কোথা যাচ্ছিস্?

    ছেড়ে দেও বিষ্ণুপিয়ে! হাত ছাড়িয়ে দিয়ে পা দানিতে নেমে পড়ে গোরা। আর নয় বিষ্ণুপ্রিয়াকে। তার চেয়েও কঠোরতর পরীক্ষা সামনে!

    একগাড়ি লোককে অসহ্য কৌতূহল ও উৎকণ্ঠার মধ্যে রেখে পা-দানির শেষ ধাপে নেমে গেল। নিমেষে হারানো পাথুরে খোয়ার স্তূপ যেন জমানো সিমেন্ট। তিন হাত দূরে লাইনের বুক পিষে চাকা ঘুরছে ঘরঘর করে। আধ হাত নীচেই মাটি।

    গোরার চোখ রক্তবর্ণ, মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠেছে। সারা মুখে ঘাম। হাতের নীল পেশিগুলো যেন ছিঁড়ে পড়বে। চকিতে মুখ বাঁধা চালের ব্যাগ হাতের মধ্যে গলিয়ে পা-দানির শেষ ধাপে ধীরে ধীরে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল আর একটু একটু করে তার দেহটা অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগল গাড়ির তলায়। আস্তে আস্তে উঠে গেল ঠিক চাকার উপরে দুটো বাঁকানো রড ও সংক্ষিপ্ত রেলিং-এর মাঝখানে। চাকার দু-তিন ইঞ্চি উপরেই তার একটা লিকলিকে ঠ্যাং ঝুলছে। কোনও রকমে, একবার ছুঁতে পারলেই মুহূর্তে ক্ষিপ্ত বাঘের মতো টুকরো টুকরো করে ফেলবে।

    তারপরে যেন অত্যন্ত রাগে ও ঘৃণায় চলন্ত চাকাটার গায়ে সে বার বার থুতু ছিটিয়ে দিতে থাকে। গাড়ির ওপরে হাজারো গেল গেল শব্দ, বন্ধুদের উৎকণ্ঠা সুবালার মৃত্যু যন্ত্রণা সব যেন কেমন স্তব্ধ আড়ষ্ট বিকল হয়ে গেল।

    তারপর জংশন স্টেশনের উন্মত্ত তাণ্ডব। পুলিস, মোবাইল কোর্ট, সিভিল সাপ্লাই গাড়িটাকে ঘিরে ধরে সবাইকে নামাতে থাকে। আর মার খিস্তি চিৎকার আর কান্না। ছড়িয়ে পড়ছে কারো চাল, ছিটকে পড়ছে মুখ থুবড়ে কেউ। মারো আর উতারো। পুলিশের লাঠিতে তৈরি হয় বেড়া। সেই বেষ্টনীর মধ্যে একদিকে মানুষের স্তূপ, আর দিকে চালের। চাল আর এসমালগার।

    গাড়ির ঘণ্টা পড়ল। সুবালা রুদ্ধ নিশ্বাসে বুক চেপে আপনমনে বলল, গোরা ধরা পড়বে না, কখনও না।

    কিন্তু পড়েছে। একটা তীব্র হট্টগোল ও ধস্তাধস্তির মধ্যে সবাই দেখল এক টুকরো ন্যাকড়ার মতো তাকে নিয়ে সবাই টানাটানি করছে।

    লাঠির বেষ্টনীর মধ্যে সবাই বড় বড় চোখে তাকিয়ে দেখল, অফিসারের সামনে তাদের গোরা, তাদের হিরো এসমালগার। কী বলছে অফিসার। কিন্তু গোরা নিশ্চুপ।

    তারপর এল একটা সরু বেত, খুলে দেওয়া হল গোরার জামা প্যান্ট। ছুড়ে ফেলে দেওয়া হল চালের স্তুপে তার পনেরো সেরের ব্যাগ। শেষবারের জন্য অফিসার চিৎকার করে উঠল, আর কোনওদিন করবি? গোরা শক্ত, নির্বাক। কেমন করে বলবে। সেখানে যে ওরা রয়েছে, মা আর ভাই বোন। তার বোবা মা। পরমুহূর্তেই বেতের ঘায়ের সপাং সপাং শব্দ ওই মানুষের স্তূপটাকে, স্টেশনটাকে, সর্বচরাচরকে কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে শিউরে তুলল। নেমে আসা রাত্রি যেন যন্ত্রণার কালিমা হয়ে ছড়িয়ে পড়ল।

    স্টেশনে আলো জ্বলছে। যেন অন্ধকার এখানে অনেক নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছে।

    গোরা এসে দাঁড়াল সেই মানুষগুলোর কাছে। উলঙ্গ, সারা গায়ে চিতাবাঘের মতো লম্বা দাগ, হাতে জামা আর প্যান্ট। কিন্তু চোখে জল নেই, নাক দিয়ে শুধু শিকনি বেরিয়ে পড়েছে, ঠোঁটের দুই কষে ফেনা। ছায়াটা পড়েছে যেন উলঙ্গ আদিম কিম্ভূতাকৃতি একটা ওত পাতা মানুষের।

    অসহ্য যন্ত্রণায় যেন সুবালার হৃৎপিণ্ডটা ফেটে গেল। ঠাণ্ডা পাথরে জোরে ঠোঁট দুটো চেপে সে কেঁপে কেঁপে উঠল। সেই লোকটা অকারণ গুনগুন করছে,

    বৈরাগী না হইও নিমাই…

    গোরার শূন্য চোখে ভাসছে, সেই কারখানার রাবিশের জলার ধারে, অন্ধকার আকাশের তলায় দুটো দিশাহারা চোখের অসহ্য প্রতীক্ষা। ঘরে ঘুমন্ত পুতুল, রুগণ একটা মানুষ, আর বাইরের অন্ধকারে বোবা মায়ের অপরিসীম তীব্র প্রতীক্ষা।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকথামালা – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়
    Next Article মুখোমুখি – আশুতোষ মুখোপাধ্যায়

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }