Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    একটি সন্ধ্যা একটি সকাল – আশাপূর্ণা দেবী

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প65 Mins Read0

    ১. ছুরিটা এসে বিধলো

    ০১.

    ছুরিটা এসে প্রথম বিধলো ডান দিকের রগে।

    তীক্ষ্ণ চকচকে ধারালো।

    মাথাটা একটু সরিয়ে নিলো শশাঙ্ক। তবু কানের গোড়াটায় বিধতেই লাগল। এবার মাথাটা ঝুঁকিয়ে ফেলল প্রায় টেবিলের কাছবরাবর। হাতের বইটার থেকে আধ ফুট মাত্র ব্যবধান থাকল।

    পড়ার একটু অসুবিধে হচ্ছে, তা হোক, তবু নড়েচড়ে উঠে গিয়ে আক্রমণের পথটা বন্ধ করার কথা মনে আনছে না শশাঙ্ক।

    কিন্তু মাথা হেঁট করেই কি সব সময় নিস্তার পাওয়া যায়? এ ক্ষেত্রে অন্তত যাচ্ছে না, ছুরিটা এবার এসে শশাঙ্কর হাতের বইয়ের পাতাটাই বিধছে। সমস্ত অক্ষরগুলো আলোয় আঁ আঁ করে উঠলে পড়া চলে না।

    শশাঙ্কর মনে হল পশ্চিমের জানলা দিয়ে আসা পড়ন্ত বেলার ওই রোদের ছুরিটা ঠিক যেন একটা জ্বালাতুনে মানুষের মত ব্যবহার করছে। একটু নিশ্চিন্ত শান্তিতে বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতে দেবে না। শশাঙ্কর এই নিরুপায়তাটা হাস্যকর অর্থহীন।

    ইচ্ছে করলেই এখুনি উঠে গিয়ে জানলাটা বন্ধ করে দেওয়া যায়। উঠতে ইচ্ছে না করলে চাকরদের কাউকে ডেকে বন্ধ করে দেবার হুকুম দেওয়া যায়। চেয়ারটাকে খানিকটা টেনে নিয়ে সরে বসা যায়।

    কিন্তু সে-সবের কিছুই না করে শশাঙ্ক বই থেকে চোখ তুলে ওই পশ্চিমের জানলাটার দিকেই রুক্ষ দৃষ্টি হেনে বসে বসে ভাবতে লাগল।

    জীবনে সে এর বেশি কিছুই চায় নি। একটি নিরুপদ্রব কোণ, আর নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগ একটু অবসরের শান্তি। শুধু এইটুকু পেলেই সারা জীবন কেটে যেতে পারত আনন্দরসের সমুদ্রে তলিয়ে থেকে!

    পৃথিবীতে কত বই!

    কত ভালো ভালো বই! একটা জীবনে পড়ে ফুরোবার নয়। বইগুলো আয়ত্ত করতে যদি নতুন নতুন ভাষার চাবি হস্তগত করতে হয়, তাতে তো আরও আনন্দ, আরও রোমাঞ্চ!

    কিন্তু কোথায় সেই দুর্লভ অবকাশ! কোথায় সেই নিরুদ্বেগ নিশ্চিন্ত!

    এই পড়ন্ত রোদটা যেমন রগে কপালে কানে বইয়ের পাতায় পর্যন্ত এসে বিধে উত্ত্যক্ত করছে, সারা জীবনই কে যেন এমনি করে উত্ত্যক্ত করছে শশাঙ্ককে।

    .

    ছেলেবেলায়?

    তখন তীব্র আকর্ষণ ছিল গল্পের বইয়ে।

    কিন্তু তাতে কী তীব্র বিরোধিতা ছিল বাবার! ছেলের হাতে অথবা তার টেবিলে শেলফে বালিশের তলায় গল্পের বই দেখেছেন কি হুঙ্কার দিয়ে কেড়ে নিয়েছেন। হয়তো বা শুধু কেড়ে নিয়েই ক্ষান্ত হন নি, ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছেন, পরের বই বলে মানেন নি।

    শশাঙ্কর মা এ নিয়ে মৃদু প্রতিবাদ করলে সদর্পে বলেছেন, এই ঠিক করলাম, জন্মের শোধ শিক্ষা হয়ে যাবে। একে কতকগুলো রাবিশ গেলার বদভ্যাস, তার ওপর আবার পরের কাছে চেয়ে ভিক্ষে করে আনার বদভ্যাস! দুটোই সমান খারাপ, এই রকম জব্দ হলেই তবে ওই অভ্যেস ছাড়বে।

    কিন্তু না। বাবার শত চেষ্টাতেও সে অভ্যাসটা ছাড়ে নি শশাঙ্ককে। উত্তরোত্তর গ্রাসই করেছে তাকে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পাঠ্যতালিকার গতি বদলেছে, কিন্তু মনের গতি বদলায় নি। অধ্যাপনা তার পেশা, কিন্তু অধ্যয়ন তার শুধু নেশাই নয়, আরও অনেক কিছু।

    এইটাই টের পেয়ে ফেলেছে বলেই বুঝি সোনালীরও শশাঙ্কর এই গ্রন্থজগার ওপর এত আক্রোশ! কিন্তু সোনালীর আক্রোশ শশাঙ্কর বাবার মত তীব্র বিরোধিতার বেশে দেখা দেয় না, দেখা দেয় ব্যঙ্গ আর অবজ্ঞার মূর্তিতে।

    শশাঙ্ককে সে বইপোকা বলে সম্বোধন করে। কৌতুকের হাসি দিয়ে নয়, তিক্ত রসাস্বাদিত ব্যঙ্গের হাসি দিয়ে।

    এমনিতেই সোনালীর ঠোঁটের গড়নটাই যেন ঈষৎ বাঁকারেখায় রহস্যময়, তার উপর

    আঃ, রোদটা ভেবেছে কী! যাবার আগে মরণকামড় দিয়ে যেতে চাইছে বুঝি! নইলে আবার কোন কোণাচে পথ দিয়ে ফের এসে বা রগটায় বিধছে!

    আশ্চর্য! এই এতক্ষণের মধ্যে বাড়ির কারুর কি একবার এ ঘরে আসতে নেই? একটা চাকরবাকর কিংবা…না, সোনালীর কথা ভাবছে না শশাঙ্ক, ভাববার প্রশ্ন ওঠে না। সোনালী এতক্ষণে তার টেনিস র‍্যাকেট ঘোরাতে ঘোরাতে কখন নেমে গেছে, কখন চলে গেছে নিজে হাতে ড্রাইভ করে।

    হ্যাঁ, বিকেলে খেলতে যাবার সময় কি বেড়াতে যাবার সময় নিজেই ড্রাইভ করে সোনালী। বলে, এ সময় ড্রাইভারের উপস্থিতিটাই তার কাছে বিরক্তিকর। অনেকক্ষণ ধরে চোখের সামনে একটা বুড়ো শিখের ঘাড় পিঠ আর পাগড়ী দেখতে রাজী নয় সে।

    পশ্চিমের ওই জানলাটা দিয়েই সোনালীর গতিবিধিটা দেখতে পাওয়া যায়। ওই দিকটাই বাড়ির গেট।

    কে জানে কখন চলে গেছে সোনালী। হয়তো পশ্চিম আকাশটা লালচে হয়ে ওঠবার অনেক আগেই। কিন্তু একটাও চাকরবাকর কেন আসছে না এ ঘরে? * শশাঙ্কর কি একবার তেষ্টা পেতেও পারে না? চেঁচিয়ে কাউকে ডাকতে ইচ্ছে হল শশাঙ্কর। যেমন করে সোনালী ডাকে অনন্তকে, বীরসিংকে, আছ কোথায় তোমরা? কাল হয়ে বসে আছ? সব কাজ বলে বলে তবে করাতে হবে, নিজেদের ডিউটি সম্বন্ধে জ্ঞান নেই?

    না, শশাঙ্কর সে সাধ্য নেই।

    চেঁচিয়ে কাউকে ডাকা শশাঙ্কর সাধ্যের বাইরে। নিজের গলার শব্দ নিজেই ভালো করে চেনে না শশাঙ্ক। তবু ওর ইচ্ছে হচ্ছিল এই মুহূর্তে কেউ এ ঘরে আসুক, অনন্ত কি বীরসিং, নিদেন পক্ষে ঠাকুর। জানলা দিয়ে রোদ আসা নিয়ে তাকেই বকে উঠবে শশাঙ্ক।

    কিন্তু গেটের সামনে গাড়িটা এসে দাঁড়িয়েছে কখন? সোজাসুজি রোদের দিকে তাকিয়েই ভুরু কুঁচকে দেখল শশাঙ্ক, হ্যাঁ তারই–মানে তাদেরই গাড়ি। সোনালী তাহলে এখনো বেলোয় নি। তার মানে আর একটুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই সোনালীকে দেখতে পাওয়া যাবে। সেই তার চকচকে ঝকঝকে আঁটসাঁট শরীরটা বেরিয়ে আসবে বাড়ির মধ্যে থেকে, ছোট্ট লনটুকু মুহূর্তে পার হয়ে গাড়িটার কাছে এসে একবার দাঁড়াবে। আর একবার চোখ তুলে দোতলার জানলার দিকে তাকাবে সে।

    এটা নিয়ম।

    রোজই তাকায়। টেবিলের ধারে চেয়ারে বসে বসেই দেখতে পায় শশাঙ্ক। আর দেখার পর মনে হয়, বোধ হয় জানলায় কাউকে আশা করে সোনালী।

    কাকে? শশাঙ্ককে?

    তাছাড়া আর কে আছে বাড়িতে? অন্তত আশা করবার মতো কে আছে? কিন্তু কেন? এত বড় দিনটায় একই বাড়িতে থেকেও স্বেচ্ছায় যে একবারও শশাঙ্কর সঙ্গে চোখাচোখি হবার ক্লেশটুকু স্বীকার করতে চায় না, সে কেন এ আশা করতে যাবে? দেখা এক এক দিন সমস্ত দিন-রাতেই হয় না। দুজনের গতিবিধি আলাদা, ঘুমের সময় আলাদা। রাতের খাওয়াটা একসঙ্গে বটে, তাও সব দিন নয়।

    .

    আশ্চর্য অঘটন ঘটল।

    সামনের ওই দূর রাস্তায় দেখা নয়, এই ঘরের মধ্যেই পিছনের দরজা দিয়ে এসে প্রবেশ করল সোনালীর প্রসাধনমার্জিত আঁটসাঁট ছিপছিপে শরীরটি।

    সঙ্গে সঙ্গে একটা বিরক্ত কণ্ঠস্বরও ছড়িয়ে পড়ল ঘরের হাওয়ায়, পড়ন্ত রোদটায় মুখ দিয়ে বসে আছো যে?

    শশাঙ্ক চমকে ঘাড় ফিরিয়ে অপ্রতিভ হাসি হাসল–এমনি!

    এমনি! বাঃ চমৎকার! তার মানে, উঠে জানলাটা বন্ধ করে দেওয়া তো দূরে থাক, একটু সরে বসবারও ক্ষমতা হয় নি, কেমন? তা বইয়ের মধ্যেও তো ডুবে ছিলে না যে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে গিয়েছিলে, রাস্তায় কি দেখছিলে হাঁ করে?

    শশাঙ্ক এবার মৃদু হাসে। হেসে বলে, হাঁ করে দেখার মত জিনিসের কি অভাব আছে জগতে?

    হুঁ, কথাবার্তা তো বেশ ভালোই শিখছ ক্রমশ। ব্যাপারটা কি?

    আমিও তো তোমাকে ওই প্রশ্নই করব ভাবছিলাম, ব্যাপারটা কি? এ সময় বাড়িতে? আবার এ ঘরে?

    সোনালী তার গাঢ় রঙে ছোপানো ভুরু দুটো কুঁচকে বলে, কেন, আমি কি কখনো আসি এ ঘরে?

    ও কথা থাক। আজ কি জন্যে?

    কেন, কারণ না থাকলে নিজের বরের ঘরে আসতে নেই?

    শশাঙ্ক একবার মুখ তুলে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল, তারপর মৃদু হেসে হাতের বইখানাতেই চোখ রাখল।

    রোদের সেই ছুরির ধারটা আর নেই, লালচে হয়ে এসেছে। আকাশ কত তাড়াতাড়ি বদলায়!

    শোনো, কিছু টাকা চাই!

    জানতাম। আর একবার মৃদু হাসল শশাঙ্ক।

    সোনালীর মুখটা একবার একটু বিবর্ণ দেখাল, একটু বা বিপন্ন, তারপরই সামলে নিলো সে। তীব্র কণ্ঠে বলে উঠল, জানাই স্বাভাবিক। আর কোনও সম্পর্ক তো নেই দুজনের মধ্যে। কেন, বেরিয়ে পড়তে পারো না আমার সঙ্গে? খোলা আকাশের নীচে, পৃথিবীর আলোয়? যেখানে মানুষ থাকে, জলজ্যান্ত রক্তমাংসের মানুষ।

    শশাঙ্ক বিব্রতভাবে বলে, ছুটি ফুরিয়ে আসছে, পড়াটড়া তো তেমন কিছুই হল না

    তেমন কিছুই হল না! প্রশ্ন নয়, ধিক্কার নয়, বিস্ময় প্রকাশ নয়, যেন একটা যান্ত্রিক শব্দ উচ্চারিত হল, তেমন কিছুই হল না! এই দুদুটো মাস গরমের ছুটি গেল, একখানা খাতা দেখার কাজ পর্যন্ত নিলে না, একবারের জন্যে বাড়ি থেকে বেরোও না, সারাদিন এই ভ্যাপসা গুমোট ঘরের মধ্যে পড়ে আছে। তবু আশ মেটে না, তবু পড়া হয় না! আশ্চর্য! যাক, আমার কিছুতেই কিছু এসে যায় না। পড়ো, আরও পড়ো, পড়ে পড়ে চোখের নার্ভগুলো জখম করে ফেলল, তারপর চিরতরে পড়ার ক্ষমতা ঘুচে যাক, মন্দ কি!

    শাপ দিচ্ছো?

    পারলে দিতাম। কিন্তু এটা শাপ নয়, শুধু ভবিষ্যৎ পরিণতির ছবিটা চোখের সামনে তুলে ধরা। বইপোকাদের ওই অবস্থাই ঘটে। যাক এই বলে যাই, নীপার মেয়ের জন্মদিনে নেমন্তন্ন করেছিল তাই যাচ্ছি। গোটা পঞ্চাশ টাকা দাও, যাবার সময় একটা প্রেজেনটেশন

    এতক্ষণে শশাঙ্ক কথা বলে। অথবা এতক্ষণে কথা বলার অবকাশ পায়। তাই বলে, টাকার জন্যে সব সময় অসুবিধে পাবার হেতু কি? সব টাকাকড়ি তুমিই রাখো না?

    নাঃ, ঝিলিক দিয়ে ওঠে সোনালী, ও আমার ভালো লাগে না। কোথা থেকে তোমার টাকা আসছে, কখন তোমার কোন বাড়ির ভাড়াটে ভাড়া দিচ্ছে না, আর কখন কোন বাড়ির ভাড়াটে উঠে যাচ্ছে, এইসব হিসেবও তো রাখতে হবে তাহলে? উঃ বাপস! তাছাড়া এই তোমার সংসারের তেল নুন লকড়ির হিসেব! রক্ষে করো। ও সবের মধ্যে আমি নেই। আমার দরকার মত পেলেই হল।

    শশাঙ্ক কি কষ্টে একটা রূঢ় কথা সংবরণ করে নিলো কে জানে। তবে কথা যা বলল সেটা মোলায়েমই।

    এমনও তো হতে পারে দরকারমত সময়ে আর পাওয়া যাচ্ছে না।

    তার মানে?

    মানে অন্য কিছু নয়। জানো তো আমাদের কলুটোলার বাড়ি দুটোর যা অবস্থা হয়েছিল, এই বেলা মেরামত না করলে কর্পোরেশন থেকে কোন দিন ভেঙে দিয়ে যেত, তাই ভাড়াটে তুলিয়ে দিয়ে মেরামত করানো হচ্ছে। ওতেই তো মাসে সাড়ে চারশো করে টাকা

    তোমার ওই সব দৈন্যদশার কথাগুলো আমার কাছে না বললেই বাধিত হব। ও সব। শোনবার রুচি নেই আমার। দিতে না পারো তো বলল, বাইরের কারও কাছ থেকে নিয়ে নিচ্ছি আপাতত

    শশাঙ্ক সহসা একটু দৃঢ় হয়ে উঠল। বুঝিবা একটু রুক্ষও, এই ধরনের কথা তুমিও আমার সামনে না বললেই বাধিত হব। ধার করাকে আমি কত ঘৃণা করি সে কথা তুমি জানো না তা নয়, তবু

    তবু বাধ্য হয়েই করতে হয়, উপায় কি! ধারকে ঘৃণা আমিও কম করি না! কিন্তু প্রয়োজনের সময় নিজের ঘর থেকে না পেলে–।

    প্রয়োজনের পরিধি অবিরত বাড়িয়ে চললে এ রকম অভাবও তো মুহুর্মুহুই দেখা দেবে।

    সহসা একটু গুম হয়ে যায় সোনালী, তারপর তিক্তকণ্ঠে বলে ওঠে, তবে তুমি কি চাও? মানুষের জীবনে প্রয়োজনের সীমা উত্তরোত্তর সংকীর্ণ হয়ে আসবে? তা তোমার মত ঘরকুনো বইপোকার উপযুক্ত কথাই বলেছ। কিন্তু আমাকে দিয়ে তা হবে না, বুঝেছ? আমি সামাজিক জীব, আমার মানসম্ভ্রম আছে, লোকসমাজে মুখ রাখবার দায় আছে, ইচ্ছে বাসনা শখ সাধ আছে—

    শশাঙ্ক হাতের ইশারায় কথাটা থামিয়ে দিয়ে গম্ভীর হাস্যে বলে, দ্যাখো ড্রয়ারটা খুলে এত চাহিদা মেটানোর যোগ্যতা ওর আছে কিনা।

    হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে একটা চাবি ঠেলে দেয় শশাঙ্ক বইয়ের স্কুপের খাঁজ থেকে।

    মুহূর্তে সামনের ড্রয়ারটা খুলে ফেলে দ্রুত অসহিষ্ণু হাতে সবকিছু ওলট-পালট করে একটা একশো টাকার নোট তুলে নিয়ে ড্রয়ারটা ফের এক ধাক্কায় ঠেলে বন্ধ করে দিল সোনালী। চলতিমুখো হয়ে আবার ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, খুচরো দেখছি না, আস্তটাই নিলাম। যাচ্ছি তাহলে।

    দলীপকে নিচ্ছ না?

    না।

    নীপার বাড়ি তো সেই দমদমের কাছে। ফিরতে রাত হবে অবশ্যই, অত রাত্রে একা আসার চাইতে।

    না, না। অসহিষ্ণু কণ্ঠে ঝঙ্কার তোলে সোনালী, একা বলে দরদ দেখাবার কোনও দরকার নেই। নেমন্তন্ন নীপা আমায় একা করে নি, তোমাকেও করেছিল।

    আমাকে! আমি কি কোথাও যাই?

    যাও না, সেটা বাহাদুরীর কিছু নয়। যাক, এ নিয়ে অনেক দিন অনেক তর্ক হয়ে গেছে, কতকগুলো কথার সৃষ্টি ছাড়া আর কিছু হয় নি।

    ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল সোনালী, আর বেরিয়ে গিয়েও সহসা আবার ফিরে এসে বলে উঠল, জানি দেরি হলেও বসে বসে ভাববে না, তবু বলে যাচ্ছি, বেশি রাত হতে পারে। অথবা একেবারে না ফিরতেও পারি।

    না ফিরতেও পারো!

    শশাঙ্কর কথাতেও প্রশ্নের সুর ফুটল না, না বা ফুটল বিস্ময়ের, শুধু সোনালীর বলা কথাটাই আবার উচ্চারণ করল।

    হ্যাঁ। সোনালীর মুখে একটা তিক্ত ব্যঙ্গের হাসি ফুটে উঠল, তোমার কাছে তুচ্ছ হতে পারি, কিন্তু এখনো একটু কৃপাকটাক্ষে ধন্য হয়ে যায় এমন লোকেরও অভাব নেই জগতে। সেই জগতটা যাচাই করতে বেরোব ভাবছি।

    গটগট করে বেরিয়ে গেল এবার সোনালী।

    সত্যিই গেল।

    .

    ০২.

    গাড়িতে কেউ নেই তাই হাত তুলে চোখ মোছবার দায় নেই। কিন্তু তপ্ত একটা অশ্রুবাষ্পে চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে সোনালীর।

    কী লজ্জা! কী অপমান!

    নেমন্তন্ন বাড়িতে সবাই যাবে যুগলে, শুধু সোনালীকে যেতে হবে বিধবার মতো একাকিনী।

    যখন যেখানে যাবে এই এক পদ্ধতি। সাধারণ নিয়মের ধার ধারবার দায় নেই শশাঙ্কর, তার একমাত্র যুক্তি, সবাই তো জানে আমি এই রকমই।

    আমি উকট, আমি অদ্ভুত, আমি অস্বাভাবিক–এইটা কি একটা যুক্তি?

    প্রথম প্রথম রেগে কেঁদে ঝগড়া করে কোথাও কোথাও সঙ্গে যেতে বাধ্য করেছে শশাঙ্ককে। কিন্তু নিয়ে গিয়ে পাঁচজনের মাঝখানে শশাঙ্কর আড়ষ্ট আড়ষ্ট বন্ধনদশাগ্রস্ত ভাব শুধু লজ্জাই দিয়েছে সোনালীকে।

    অতএব সে চেষ্টা ত্যাগ করতে হয়েছে।

    সোনালীর জন্যে ভাবনার শেষ নেই বাবুর!

    আচমকা একটা রাগের উত্তাপে চোখের জল শুকিয়ে উঠল। কর্তব্যের মধ্যে কি? না, রাতে একা ফেরার বিপদ কল্পনা করে ড্রাইভারকে সঙ্গে নেবার অনুরোধ!

    এইতেই আরও হাড় জ্বলে যায় সোনালীর। হলেও দলীপসিং বয়স্ক, লোকটার ভাবভঙ্গী ভালো লাগে না সোনালীর। চোখের চাউনিটাও যেন কেমন ধূর্ত-ধূর্ত।

    হতে পারে এটা সোনালীর ভুল ধারণা, কিন্তু ভুল জেনেও কি বদ্ধমূল একটা ধারণার মূল উৎপাটন করা সহজ?

    কিন্তু মনের এই ভয়কে প্রকাশ করা চলে না। সেটা খেলোমি। তাই সোনালী শশাঙ্কর কাছে অকারণ আপত্তি তুলে জানায়,–চোখের সামনে ওই বুড়ো শিখটার পাগড়ীপরা মাথাটা বেশিক্ষণ বরদাস্ত করতে পারি না।

    .

    গাড়ি চলছে। চলছে চিন্তার ধারা। দ্রুত উদ্দাম।

    সোনালীর ভাগ্যে সুখের সমস্ত উপকরণ মজুত থাকতেও সুখ নেই।

    এই তো এখুনি নিমন্ত্ৰণবাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই স্পষ্ট প্রকট হয়ে উঠবে সেই দৈন্য। যারা প্রত্যেকেই ভালো করে জানে, শশাঙ্ক ওই রকম, তারাও পরম অমায়িকমুখে হাসিচাপা সহানুভূতিতে বিগলিত হয়ে বলে উঠবে, ওমা, এল না! আজও এল না! আশ্চর্য!

    সোনালীর ইচ্ছে করে সেও বলে ওঠে, আশ্চর্য, আজও তোমরা আশ্চর্য হও, কিন্তু পারে না। গলা বুজে আসে। সেই বোজ বোজা গলায় যা হোক একটা কৈফিয়ৎ দিয়ে তাড়াতাড়ি গিয়ে বসে সে সভায়, যেখানে প্রায়শই যুগল ছবি।

    বাচ্চা ছেলেমেয়েদের নিয়ে নিমন্ত্ৰণবাড়িতে আসার ফ্যাসান আর নেই, ভাইবোন মা ইত্যাদির প্রশ্ন তো ওঠেই না। নিতান্ত যে বেচারা জোড়ভাঙা, সে বাদে সকলেই জোড়ে আসেন। আর সেই হেন সভায় সোনালী তার অসামান্য রূপ, অটুট বয়েস আর অনবদ্য সাজ নিয়ে বসে বসে নিষ্ফল আক্রোশে জ্বলতে থাকে।

    তবু আসেও তো!

    নিজেকে নিজে অনেক সময় এ প্রশ্ন করেছে সোনালী, কেন আমি যাই? শুধু খানিকটা দাহ ছাড়া আর কিছুই তো সঞ্চয় হয় না, তবে কেন যাই লোক্সমাজে?

    এর উত্তর স্পষ্ট হয় না।

    প্রতিজ্ঞা করে, আর কোথাও যাবে না, কিন্তু না গিয়ে পারে না। লোকসমাজ তাকে দুর্নিবার আকর্ষণে টানতে থাকে।

    .

    আঃ কি বিশ্রী জায়গাতেই বাড়ি করেছে নীপা!

    লোকালয় ছাড়িয়ে গাড়ি যাচ্ছে এখন পথের দুধারে ঝোঁপঝাড় গাছপালা মাঠ জঙ্গলকে রেখে রেখে। মাঝখানে অনেকখানি পথ এই রকমই চলবে।

    আবার ওদিকে জনবসতি। ভালো ভালো নতুন বাড়ি। যে রকম একখানি বাড়ির মালিক আজ সোনালীর বাল্যবান্ধবী নীপা।

    সোনালীর শ্বশুরের অনেক বাড়ি!

    তিন চারটে ভাড়া খাটে, একটাতে বাস করে সোনালীরা। সব থেকে ভালটাতেই করে তবু এক এক সময় হতাশ নিঃশ্বাস পড়ে সোনালীর। নিজের পছন্দমতন ছবির মত সুন্দর নতুন একটা বাড়ি সে এখনো করতে পারে না।

    হয়তো বা তেমন একটা বাড়ি তৈরি করতে পারলে, নতুন ধাঁচে আর নতুন নতুন আসবাবে তাকে সাজাতে পারলে, শশাঙ্ককেও খানিকটা নতুন করে তুলতে পারত সোনালী! পুরানো অভ্যাসের খাঁজে খাঁজে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া ওর স্তিমিত চেতনাকে নাড়া দিয়ে ধাক্কা দিয়ে খানিকটা প্রাণবন্ত করে তুলতে পারত।

    কিন্তু তা হবার নয়। এই বাড়িটাই শুধু দামী নয়, রাস্তাটাও কলকাতার সেরা রাস্তার একটি।

    কিসের অজুহাত তবে সৃষ্টি করা যায়? অতএব এখানেই কাটাতে হবে সোনালীকে মরণাবধি।

    কাটাতে হবে ওই গাঢ় গাঢ় মেহগিনীরঙা বহু বাহুল্যকারুকার্যখচিত আসবাবপত্রের মাঝখানে ওই বইপোকা মানুষটাকে নিয়ে। কত আর ছুটে ছুটে অন্যখান থেকে আহরণ করতে যাবে জীবনের রূপ রস রঙ?

    সহসা একটা ধিক্কারের আলোড়নে মনটা উত্তাল হয়ে উঠল। সহসাই মনে হল, মানুষের এত নিরুপায়তা কিসে? হাত-পা-ওলা আস্ত একটা গোটা মানুষের?

    আকাশে তখনও আলো। কিন্তু মাঠের ঝোঁপঝাড়ে অন্ধকার নেমেছে। আর একটু পরেই চারিদিক গাঢ় অন্ধকারে ভরে যাবে। অন্ধকারে ভরে যাবে আকাশটাও। টানা বড় রাস্তাটায় খানিক ব্যবধানে আলোর ব্যবস্থা।

    কিন্তু বড় রাস্তা ছাড়িয়ে যেদিকে সেদিকে ইচ্ছে ওই আলভাঙা মেঠো রাস্তায় গিয়ে পড়লে?

    একটা মানুষের হারিয়ে যাওয়া কি এতই কঠিন?

    ধরিয়ে দেবে গাড়ির নম্বর? হারিয়ে যেতে দেবে না? গাড়িটাই যদি ত্যাগ করা যায়?

    দুরন্ত অভিমান বুদ্ধিবৃত্তি আচ্ছন্ন করে দিতে চাইছে।

    দমদমের কাছে নীপার বাড়ি। সেই কাছ ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর ছাড়িয়ে চলে গেলে ক্ষতি কি?

    অন্তত এই উত্তপ্ত মন নিয়ে চট করে এক্ষুনি নিমন্ত্ৰণবাড়ি ঢুকতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া সবচেয়ে অসুবিধের ব্যাপার বটুয়ার মধ্যে সেই একশো টাকার নোটখানা অভঙ্গ অবস্থাতেই রয়ে গেছে, কিছু কিনে নেওয়া হয়নি। খেয়াল হয়নি।

    এখন এই লোকালয়শূন্য জায়গায় কোথায় কি? অথচ উপহারশূন্য হাতে উৎসববাড়িতে ঢোকাও তো অসম্ভব!

    জীবনে একবার বেপরোয়া হয়ে দেখলে কী হয়? গাড়ির স্পীডটা বাড়িয়ে দিলো সোনালী। বেপরোয়া বেগে।

    তেল আছে, অনেক তেল!

    .

    ০৩.

    তেল নেই!

    এক ফোঁটাও না।

    টিনটা কাৎ করে, উপুড় করে ঝাঁকিয়ে, কোনও প্রকারেই এক ফোঁটা বার করা গেল না।

    মুখখানা পেঁচার মতন করে মিনিট দুই বসে রইল অনন্ত, তার পর উঠে পড়ল দুমদুম্ করে।

    ভালো এক জ্বালা হয়েছে তার! পুরনো ঠাকুরটা চলে গিয়ে পর্যন্ত তার ঘাড়ে পড়েছে ভাঁড়ারের তদারকি। নতুন ঠাকুর তো উজবুকের রাজা।

    রোজ রোজ কে এত হিসেব রাখেকখন তেল ফুরোললা, আর কখন চিনি ফুরোলো!

    শুধু হিসেব রাখাই তো নয়, বাবুর কাছ থেকে টাকা চেয়ে এনে আবার যোগান রাখা।

    অনাছিষ্টি ছিষ্টিছাড়া এ সংসার! অনন্তর এত বন্ধুবান্ধব আছে, তার মনিববাড়ির মতন মনিববাড়ি কারুর নয়। বাড়ির যিনি গিন্নী তিনি যেন কুটুম্ব, যেন স্বর্গের পরী! তার পান থেকে চুনটি খসবার জো নেই, তারপর তোমাদের যা হয় তোক! ভাঁড়ারের আছে নেই বলতে গেলেই তিনি নাক কুঁচকে বলেন, ও সব কথা আমায় বলতে এসেছ কেন?

    এ আবার কেমন আদিখ্যেতা, ভগবান জানেন। বাড়ির গিন্নী, উনি রাতদিন সাজবেন গুজবেন আর হাওয়া-গাড়ি নিয়ে হাওয়া হয়ে যাবেন! ধন্যবাদ!

    বাড়ির কর্তা অবিশ্যি গঙ্গাজল, কিন্তু বই-কেতাব নিয়ে বসে থাকা মানুষটার কাছে গিয়ে টাকা দাও, টাকা দাও করে উৎপাত করতে লজ্জা করে না?

    টাকার হিসেব ওঁকে দিতে হয় না সত্যি, সেদিকে সুবিধে অনেক, তবু এক-এক সময় ভারি বেজার লাগে অনন্তর। কেন রে বাপু, অনন্তরই বা যত দায় কেন?

    পুরনো ঠাকুর একেবারে সংসার খরচের মাসের টাকা নিয়ে নিত! তার থেকে কত গুছিয়েই নিল লোকটা! দেশে জমিজমা চাষবাস মাছের পুকুর! দুদুটো মেয়ের বিয়েও দিয়ে ফেলেছে।

    অনন্তকে তোকই পুরো মাসের মাসকাবারির টাকা দিয়ে দেয় না বাবু! বিশ্বাস নেই, না অভ্যাস নেই? যা থাকে কুল-কপালে, আজ অনন্ত সেই প্রস্তাব করে বসবে। যতদিন না ঠাকুর দেশ থেকে আসছে!

    এ বাড়ির না আছে বাপ, না আছে মা, না আছে ছাত, না আছে মাটি। এ সংসারে কাজ করা ঝকমারি!

    .

    ঠাকুরের মুখেই সব শোনা, বাবুর মা যখন বেঁচেছিলেন, তখন নাকি সোনার সংসার ছিল। মাইনে করা লোকজন ভাড়ার ঘরে ঢুকতেই পেত না। গিন্নী নিজে স্নানান্তে তসর-গরদ পরে তবে ভঁড়ারে ঢুকতেন। তা সেও ভালো ছিল, সংসারে লক্ষ্মীশ্রী ছিল।

    কিন্তু এ কী! সংসার, না মেসবাড়ি! মেয়েমানুষ অলক্ষ্মী হলে কি আর সংসারের আঁটবাঁধ থাকে? আমি তো ওনাদের সোনার সংসারের আমলের নই, তবু এ ভূতুড়ে বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করে না। বামুন-ঠাকুরের মতন অনন্তর অমন শুধু পয়সা গুরু, পয়সা ইষ্ট নয়।

    তাছাড়া সংসারের গিন্নী কর্তার কড়া হুসিয়ার চোখের ওপর দিয়ে দুপয়সা হাতাতে পারলে তবেই না ফুর্তি। এ কী বাবা, সমুদুর শুষলেও কেউ তাকিয়ে দেখবার নেই। দশ টাকার নোট ভাঙিয়ে তিন টাকার জিনিস কিনে বাকী সাত টাকা ফেরত না দিলেও কেউ বলবে না, সে টাকাটা কই?

    এ রকম জায়গায় টাকা সরাতে যেন গা ছমছম করে। নিজেকে পাষণ্ড পাষণ্ড লাগে।

    এমন সংসারে থেকে নিয়েও সুখ নেই, খেয়েও সুখ নেই।

    .

    তেলের টিনটা ঠক্ করে বসানোর শব্দে নতুন ঠাকুর চমকে উঠল। তারপর অনন্তকে দুমদুম্ করে দোতলায় উঠে যেতে দেখে ব্যাপার বুঝে নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবল, অনন্তটা আছে ভালো। আহা, অনন্ত যদি একবার দেশে যেত!

    উজবুকের রাজা হলেও পয়সা সরানোর ব্যাপারটা বোঝে না এমন নয়!

    অনন্ত এসে ঘরের আলোটা জ্বেলে দিতেই চমকে উঠলো শশাঙ্ক!

    কী আশ্চর্য, এতক্ষণ সে অন্ধকারে বসেছিল? হাতের বইটা হাতেই ধরে?

    কিন্তু কতক্ষণ? কই, মনে তো পড়ছে না কী ভাবছে এতক্ষণ ধরে? কোনও কিছুই কি ভেবেছে?

    বাবুর কি মাথা ধরেছে?

    অনন্তর অপ্রতিভ কণ্ঠের প্রশ্নে আর একবার চমকালো শশাঙ্ক, কেন, মাথা ধরবে কেন? কে বলেছে মাথা ধরেছে?

    আজ্ঞে, অন্ধকারে রয়েছিলেন তাই।

    ও তাই। তা তুই আর লোকের বাড়ি ঘরমোছা বাজার করার চাকরি করছিস কেন, যা না ডাক্তারী করগে না, পশার হবে।

    ডাক্তারী।

    না তো কি। এত সহজে যখন রোগলক্ষণ বুঝে ফেলিস। কিন্তু এখন আগমনের হেতু?

    আজ্ঞে বাবু কি বলছেন?

    বলছি–কি চাই?

    অনন্ত মাথা নীচু করে ঘাড়ে হাত বুলোতে বুলোতে বলে, আজ্ঞে তেল ফুরিয়েছে, তাই

    তেল ফুরিয়েছে।

    কী বিশ্রী, কী কদর্য, কী কটু? শব্দজগতে এর চাইতে কুৎসিত শব্দ আর আছে?

    শশাঙ্কর মনে হয়, এর চাইতে কদর্য শব্দও আর নেই, আর শশাঙ্কর মতো হতভাগাও বুঝি জগতে আর নেই! সত্যি, এমন কোনো বিবাহিত হতভাগা আছে, যাকে জটিলতম কোনও দার্শনিক চিন্তার মাঝখানে সহসা শুনতে হয় তেল ফুরিয়েছে!

    সংসারে অবিরত তেল ফুরোয়, চিনি ফুরোয়, আটা ফুরোয়, ময়দা ফুরোয়, হলুদ পাঁচফোড়ন লঙ্কা সর্ষে ফুরোয়, শুধু ফুরোয় না মানুষের সংসার করার বাসনা।

    নিজের ওপর ভয়ঙ্কর রাগ হয় শশাঙ্কর। কেন সে মার একটু চোখের জল একটু আক্ষেপোক্তিতে ভুলে এই অলাতচক্রের ফাঁদে পা দিয়েছিল!

    শুধু সে একা থাকলে একরাশ টাকা ওই বামুন-চাকরগুলোর হাতে ধরে দিয়ে বলতে পারত, যা, যা খুশি করগে যা। শুধু আমায় দুবেলা দুটি খেতে দিবি এই শর্তে, ব্যস। জ্বালাতন করতে আসবি তো পিটুনি খাবি।

    কিন্তু তা হল না।

    এখন বারবার আয়ব্যয়ের হিসেব দেখতে হয়। নইলে সোনালীর সব চাহিদা মিটিয়ে ওঠা শক্ত হয়ে ওঠে।

    এ নিয়ে অনেক তর্ক হয়ে গেছে সোনালীর সঙ্গে। সে সাফ জবাব দেয়, আমারও ওসব ভালো লাগে না। আমারও অসহ্য ওই হলুদ পাঁচফোড়ন আলু মাছ। তোমার যাতে বিরক্তি আসে, আমারই বা তাতে আনন্দে আসবে ভাবছ কেন? আমি পারব না, আমার দায় কিসের?

    গৃহের গৃহিণী যদি বলে, আমায় দায় কিসের? কতক্ষণই বা তর্ক চালানো যায় তার সঙ্গে?

    অথচ মাঝে মাঝেই সে হেসে হেসে বলে, তোমার সংসারের ম্যানেজারী করে করে তোমার বামুন-ঠাকুর তো দেশে জমিদারী করে ফেলল!

    সেটাই স্বাভাবিক। বলে শশাঙ্ক গম্ভীর মুখে।

    সোনালী নাক বেঁকিয়ে বলে, তা বটে। শুধু আমি টাকার কথা বললেই মুখ শুকিয়ে যায়। ঠাকুরের কত দেশভাই বারোমাস এখানে এসে রামরাজত্বে থাকে, সন্ধান রাখো?

    ওটা আমার সন্ধান রাখার কথা নয়।

    কথায় কথা বেড়ে উঠেছে, শেষ পর্যন্ত শশাঙ্ককে থেমে যেতে হয়েছে।

    .

    নোটে টাকায় খুচরোয় মুঠো ভর্তি করে অনন্তর দিকে বাড়িয়ে ধরে শশাঙ্ক, এই নাও, হবে এতে?

    অনন্ত হাত বাড়ায় না, ভারী মুখে বলে, আমার ওপর রাগ করছেন কেন বাবু? আমার কি দোষ?

    রাগ? তোর ওপর রাগ করছি? হেসে উঠল শশাঙ্ক, রাগ জিনিসটা কি এতই সস্তা রে অনন্ত?

    এ সব ঝামেলা আমার ভালো লাগে না বাবু!

    কিসের ঝামেলা রে?

    এই এটা নেই ওটা নেই, আনতে হবে, পয়সা চাইতে হবে। মা কিছু দেখবেন না।

    আর টাকার দরকার আছে তোমার?

    অনন্ত সহসা এই গম্ভীরকণ্ঠের ব্যঙ্গে থতমত খেয়ে টাকাগুলো নিয়ে অনুচ্চকণ্ঠে গজগজ করতে করতে চলে গেল।

    .

    চমৎকার সংসার করছি আমি! মনে মনে বলল শশাঙ্ক। তারপর ভাবল আর সব লোকেদের মতন হতে পারি না আমি? সোনালী যেমন চায়? সোনালীর জামাইবাবুর মতন রোজ সকালে বাজারে গিয়ে বেছে বেছে মাছ তরকারি

    .

    টেলিফোনটা বেজে উঠল।

    বাঁচা গেল, ওই বিদঘুটে কল্পনাটার হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেল আপাতত।

    উঃ, কী করে যে মানুষ ইচ্ছে-সুখে বাজার যায়! কে?

    আমি নীপা কথা বলছি। সোনালী এত দেরি করছে কেন? চলে আসুক তাড়াতাড়ি..কী বললেন, বেরিয়ে পড়েছে? কখন?…পাঁচটা নাগাদ?..সে কী? পথে আর কোথাও যাবার কথা আছে?…নেই? তাহলে? এত দেরি হবার তো কথা নয়।..কি বললেন, প্রেজেনটেশান কিনতে?… আঃ কী মুশকিল, এ সব নিয়ে আবার দেরি করা কেন, শুভেচ্ছাই তো যথেষ্ট। যাক, এসে পড়বে বোধহয় এখুনি। আচ্ছা, ছাড়লাম!

    .

    কিন্তু সেই ছাড়া রিসিভারই যে আবার ঘণ্টাখানেক পরে তুলে নিয়ে ডাকাডাকি করতে হবে নীপাকে, এ কথা কি নীপাই ভেবেছিল না শশাঙ্কই ভেবেছিল।

    এখনো পৌঁছোয় নি সোনালী–এই সংবাদটাই পরিবেশন করতে হচ্ছে নীপাকে।

    এখনো পৌঁছোয় নি। স্তব্ধ বিস্ময়ে মুহূর্ত কয়েক কাটে, তারপর প্রশ্নাঘাত শশাঙ্কর দিক থেকেই, কী বলছেন! আমি কি ভেবে নিশ্চিত হতে পারি না, আপনার বান্ধবী আপনাকে দিয়ে আমার সঙ্গে খানিকটা কৌতুক করছেন?

    কৌতুক! আপনি বলছেন কি মিস্টার সেন? এটা কি একটা কৌতুকের বিষয়? আপনার ড্রাইভার কি–কী বললেন? ড্রাইভার ছিল না? সোনালী নিজেই ড্রাইভ করে? ব্যস, আর কিছু ভাববার নেই, নির্ঘাত অ্যাকসিডেন্ট কেস। আশ্চর্য, আপনি এই একা আসাটা অ্যালাউ করলেন কি করে? জানেন তো ফিরতে রাত বেশি হয়ে যাবে। এতটা রাস্তা! উঃ, আমার তো ভেবে হাত পা আসছে না। ইস্, কেন যে আমি নেমন্তন্ন করতে গেলুম! ইমিডিয়েটলি থানায় হসপিটালে খবর নিন, আমিও নিচ্ছি এদিক থেকে। কোনখানে যে কি হল! উঃ, এ কী কাণ্ড!

    এবার না বলেই ছেড়ে দিল নীপা!

    গলার স্বর কাঁপছিল তার, উদ্ভ্রান্ত সুর। এ কখনো কৌতুক হতে পারে না। যেটা একটু আগেও আশা করছিল শশাঙ্ক। শশাঙ্ককে জব্দ করতে সোনালী বান্ধবীকে দিয়ে এই উদ্বেগের চাল চেলেছে।

    কিন্তু আর সে কথা মনে করা চলছে না। এ খবর ঠিক। এ বিধাতার অমোঘ দণ্ড।

    .

    এবার তবে উঠে পড়ো শশাঙ্ক! খেসারৎ দাও তোমার জড়ত্বের, তোমার অলসতার, তোমার অপৌরুষের।

    কিন্তু থানায় হাসপাতালে খোঁজাখুঁজি করলে কি হবে?

    সত্যিৎ কি এ্যাকসিডেন্ট?

    .

    বিদ্যুৎচমকের মতো সোনালীর শেষ কথাটা মনে পড়ল।

    .

    ০৪.

    দুরন্ত অভিমানে উত্তপ্ত মস্তিষ্ক অনেকক্ষণ ধরে খোলা হাওয়া পেয়ে যখন কিছুটা ঠাণ্ডা হয়ে এল, এল বিচার-বুদ্ধির কোঠায়, তখন কতটা যে রাত হয়েছে বুঝতে পারল না সোনালী।

    অবিশ্বাস্য রকমের বিশ্বাসঘাতকতা করে বসেছে হাতে বাঁধা ঘড়িটা। যথাসময়ে দম দিতে ভুলে গিয়েছিল কি ঘড়িটাতে?

    ভুলের কথা মনে করবার উপায় নেই, তবু ঘড়িটার এই অদ্ভুত অসময়ে এমন নির্লিপ্ত নিরাসক্ত হয়ে যাওয়াটা যেন পরিকল্পিত হিংস্রতার মত লাগল সোনালীর।

    সবে ছটা বেজে থেমে আছে কাঁটা দুটো, অথচ এখন বেশ রাত মনে হচ্ছে। চারিদিকে ঘন জঙ্গল। আশেপাশে বসতির কোনও চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না।

    হয়তো দিনের বেলা হলে দেখতে পাওয়া যেতো ওই ঝোঁপজঙ্গলের মাঝখান দিয়েই এখানে সেখানে বিধবার সিঁথির মত সাদা সরু একটু পায়ে চলা পথ, যে পথ চলে গেছে লোকবসতির মাঝখানে।

    দেখা যেত দূরে দূরে ঘর-বাড়ির আভাস, যেগুলো সারা দিনের ছিটকে পড়ে থাকা মানুষগুলোর দিনান্তের আশ্রয়। যেখানে নিতান্ত দীনদুঃখী মানুষটার জন্যেও প্রতীক্ষায় উন্মুখ হয়ে আছে উষ্ণ শয্যা, উষ্ণ অন্ন আর প্রেপোষ্ণ হৃদয়।

    কিন্তু এখন চারিদিকে নিঃসীম অন্ধকার। এখন কিছু দেখা যাচ্ছে না।

    কলকাতার এত কাছাকাছি এত অন্ধকার আছে? আছে এমন জঙ্গল?

    রাত্রে ভয়াবহতা বেশিই লাগছে। গাড়ির হেলাইট জ্বালিয়ে আসছিল, চারিদিকে খেয়াল করে নি, একটিমাত্র খেয়াল মাথার মধ্যে কাজ করছিল–শশাঙ্ককে বুঝিয়ে ছাড়া যে সোনালী : একটা অবহেলার বস্তু নয়। তার মূল্য আছে।

    কিন্তু কী সেই পথ?

    গল্পে উপন্যাসে যেমন মাঝে মাঝে পড়া যায়, অন্যের সঙ্গে মিথ্যা প্রেমের ভান করে স্বামীর অথবা প্রেমাস্পদের মনোযোগ আকর্ষণ করা, তেমনি একটা কিছু করে দেখা যায় না? ঈর্ষাই শশাঙ্ককে তার ঔদাসীন্যের দুর্গ থেকে বার করে আনবে তাহলে।

    কিন্তু সোনালীর এই অভিনয়ের পার্টনার কে হবে?

    সম্ভব অসম্ভব নানা কল্পনায় কখন যে এতটা সময় কেটে গেছে। এখন প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার বাসনা দূর হয়ে গিয়ে জেগে উঠলো একটা ভয়ের ব্যাকুলতা।

    .

    ছি-ছি-ছি, এ কী করে বসেছে সে! বুদ্ধিসুদ্ধি একেবারে লোপ পেয়ে গিয়েছিল নাকি?

    কে জানে এসে পড়েছে কোথায়, কে জানে কত রাত হয়ে গেছে? কে জানে কী বলছে তাকে নীপা?

    উৎসবকক্ষের সকলেই যে আজ সোনালীর সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছে তাতে আর সন্দেহ কি?

    আচ্ছা, নীপা কি খবর নেবে না, তার সবচেয়ে প্রিয়বান্ধবী এল না কেন? কারণে অকারণে ফোন তো প্রায় একটা ব্যাধি তার। সোনালীর যেতে দেরি দেখলে অবশ্যই শশাঙ্ককে ফোন করবে সে।

    হঠাৎ একটা প্রতিশোধের উল্লাস অনুভব করে সোনালী। নিশ্চয় ফোন করেছে নীপা, আর? ঠিক হয়েছে, বেশ হয়েছে শশাঙ্কর।

    খুঁজুক, সারারাত ছুটোছুটি করে বেড়াক সে। সোনালী এবার গিয়ে নীপার বাড়িতে আত্মগোপন করে বসে থাকবে, জানতে দেবে না সে এসেছে।

    দেখা যাক, শশাঙ্ক কতটা কর্মক্ষমতা দেখায় নিরুদ্দিষ্টা স্ত্রীর সন্ধান করতে।

    কিন্তু তাই কি হবে?

    হয়তো শশাঙ্ক তার বইরাজ্যের মধ্যে মশগুল অবস্থাতেই ফোনটা ধরে বলবে, যায় নি ওখানে? কেন? বাড়ি থেকে তো বেরিয়েছে অনেকক্ষণ। তা আর কোথাও গেছে বোধহয়। বলে স্বামী-কর্তব্য সমাপনান্তে আবার ফিরে যাবে নিজের রাজ্যে।

    সহসা চোখে এক ঝলক জল এসে যায়।

    আজ যদি সোনালী মোটর অ্যাকসিডেন্ট করে মারা পড়ে যেতে পারত! বাড়ি থেকে অনেক দূরে কোথাও কোনও এক অপরিচিত অখ্যাত গ্রামের ধারে পথের একপাশে পড়ে থাকত সেই মৃতদেহ।

    শশাঙ্ক এসে দেখত। দেখতো নিজের কীর্তি!

    তা নিজের কীর্তি ছাড়া আর কি!

    সোনালী কি মরতে উৎসুক? তার কত সাধ, কত বাসনা।

    হঠাৎ বুকটা হু হু করে উঠল সোনালীর। এই অজানা গ্রামের ধারে পথের প্রান্তে মারা গিয়ে পড়ে থাকবার চিন্তাটা যেন ভয়ঙ্কর একটা শোকের মত হাহাকার এনে দিল।

    না না, জীবনের এমন ভয়ানক পরিণতি চায় না সোনালী।

    তাড়াতাড়ি গাড়ি ঘুরিয়ে নিল সোনালী আবার ফেলে আসা পথ পাড়ি দিতে।

    আর মাত্র কয়েক গজ গিয়েইহা, কয়েক গজ মাত্র গিয়েই–গাড়িটাও ঘড়ির মতই একটা অবিশ্বাস্য বিশ্বাসঘাতকতা করে বসল।

    হঠাৎ অচল হয়ে গেল!

    বনের মধ্যে ঝিঁঝি পোকারা একতানে বেজে চলেছে নিরবচ্ছিন্ন সুরে।

    কিন্তু বাজছে শুধুই কি বনের মধ্যে?

    .

    ০৫.

    নীপা পাখাটার স্পীড শেষ সীমায় ঠেলে দিয়ে বসে পড়ে হতাশ স্বরে বলল, এই কথা বলেছিল সে?

    শশাঙ্কও বসেছে হেঁটমুণ্ডে। মরীয়া হয়ে বলে ফেলেছে সে, সোনালীর চলে গিয়েও ফিরে এসে বলে যাওয়া শেষ কথাটা।

    তবু এতর মধ্যেও কাণ্ডজ্ঞানটি একেবারে হারায় নি। সবটা বলে নি।

    শুধু নীপার বারবার প্রশ্নে এক সময় জানিয়ে ফেলেছিল, যাবার সময় বলে গেল, হয়তো না ফিরতেও পারি।

    এই কথা বললে, আর আপনি–নীপা প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, কেন স্টেপ নিলেন না? একলা চলে যেতে দিলেন?

    ওটাকে আমি একটা কথা বলেই ধরি নি।

    ধরেন নি! আশ্চর্য!

    অবশ্য আশ্চর্য হওয়াটাই নীপার বাড়াবাড়ি। দৈবাৎ একটা অভাবনীয় ঘটনা ঘটল বলেই না ওই কথার কথাটায় গুরুত্ব আসছে!

    শশাঙ্কদের সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর বাড়ি থেকে নীপাদের দমদমের বাড়ি পর্যন্ত সম্ভাব্য অসম্ভাব্য সব রাস্তাগুলো গাড়ি ছুটিয়ে খোঁজ নেওয়া হয়েছে কোথাও কোন মোটর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে কি না।

    গাড়ির নাম্বার জানিয়ে থানায় থানায় খোঁজ নেওয়া হয়েছে। খোঁজ নেওয়া হয়েছে সম্ভাব্য হাসপাতালগুলিতে।

    আপাতত আর কি করবার আছে?

    কে আর ভাবতে বসবে নীপার বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে গেছে সোনালী নীপার বাড়ি ছাড়িয়ে অনেক অনেকটা দূরে।

    .

    ইচ্ছাকৃত নিরুদ্দেশ! বললেন নীপা-পতি মিস্টার দাশগুপ্ত, দেখাই যাচ্ছে স্বেচ্ছায় হারিয়ে যাওয়া। পুলিশ কেসে তো পড়তেই হবে মিস্টার সেন, এখন ঠিক করুন কি কি বলবেন।

    কি বলব মানে?

    আহা, আনুপূর্বিক বলতে তো হবেই? কোনও রকম কথা কাটাকাটি কলহ অথবা মনোমালিন্য হয়েছিল কি না, আর কারও সঙ্গে বিশেষ কোনও মেলামেশা ছিল কি না–

    আঃ, থামো তো তুমি। ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে নীপা, সবাইয়ের সব কিছুই তোমার আদালতের নথিপত্তর নয়। কথা বলার সময় একটু বুঝেসুঝে বলতে হয়।

    কী আশ্চর্য, আমি কি মন্দ ভেবে কিছু বলেছি, মিস্টার দাশগুপ্ত হতাশভাবে মাথা নাড়েন, ব্যাপারটা গোলমেলে এটা তো ঠিক?

    অ্যাকসিডেন্ট ছাড়া আর কিছু আমি ভাবতেই পারছি না, বলে শশাঙ্ক।

    কিন্তু অ্যাকসিডেন্ট ঘটাবেই এই সঙ্কল্প নিয়ে সে কি উত্তরপথের বদলে দক্ষিণপথ বেছে নিয়েছিল? অথবা পূর্ব-পশ্চিম যে কোনও পথ? তাহলে অবশ্য স্বীকার করতেই হবে, আমাদের অনুসন্ধানটা নিতান্তই আংশিক ব্যাপার হয়েছে। আমরা সম্ভাব্যটুকুই দেখেছি। দিকে দিকে খোঁজ করতে হলে–।

    আঃ, থামো তুমি, সব সময় আর সব কিছু নিয়ে ঠাট্টা করা তোমার একটা রোগের মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলল নীপা।

    উৎসবশেষের বাড়িটা যেন ভাঙা মেলার মত দেখাচ্ছে।

    অতিথি অভ্যাগত সকলেই একে একে বিদায় নিয়েছেন সহানুভূতি আর উদ্বেগ জানিয়ে। অনেকেই আশ্বাস দিয়ে গেছেন সকালবেলাই ফোনে খবর নেবেন।

    এবং প্রত্যেকেই ঘরে ফিরে এই নিরুদ্দেশ পর্বটিকে একটি রোমান্সের রঙে ছুপিয়ে নিয়ে বহুবিধ রসালো আলোচনায় মুখর হচ্ছেন।

    সোনালীর সঙ্গে যে তার স্বামীর সম্পর্কটা খুব একটা আদর্শ নয় কে না জানে?

    নীপাই কি জানে না? তাই না নীপার মনের মধ্যেও ভয়ের কাপন! কে জানে সর্বনাশী পোড়ারমুখী কি করে বসল!

    কিন্তু নীপা তার একান্ত বান্ধবী, আবাল্যের বান্ধবী, নীপা কিছু টের পেল না?

    এই তো আজ সকালেও টেলিফোনে কত উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে–বাবলীর জন্মদিন নিয়ে। দমদমে বাড়ি করা পর্যন্ত দেখাসাক্ষাৎ দূরবর্তী হয়ে গেছে, এইসব নিয়ে করেছে আক্ষেপ। ইতিমধ্যে এমন কি ঘটা সম্ভব?

    আর শশাঙ্ক লোকটা আর যাই হোক, হঠাৎ ভয়ানক রকম একটা কিছু ঝগড়াঝগড়ি করে বসবার লোক নয়।

    নীপা তো বরং মনে করে ওই রকম শান্তশিষ্ট স্বল্পবাক স্বামীই সংসারযাত্রার পক্ষে সুবিধেজনক।

    কিন্তু সে যাক, এখন করণীয় কি?

    করণীয় আর কি! দাশগুপ্ত বলেন, গাড়ির নাম্বারটাই এখন প্রধান ভরসা। সন্ধান নিতে হবে ওই সময়ের মধ্যে ওই রকম একটা গাড়ি শহরতলীর কোনও পেট্রলপাম্প থেকে তেল নিয়েছে কিনা, নিয়ে থাকে তো কোন দিকে গেছে?

    কেউ যদি ইচ্ছা করে হারিয়ে যায়, তাকে কি খুঁজে পাওয়া যায়? অদ্ভুত সুরে বলে শশাঙ্ক।

    আর সঙ্গে সঙ্গে ধমকে ওঠে নীপা, থামুন আপনি! রাখুন মেয়েলি কাদুনী। আশ্চর্য দায়িত্বহীনতা আপনার, না বলে পারছি না এ কথা–

    বান্ধবীর স্বামী বে-পোট অবস্থায় পড়লে যতটা রসনা সঞ্চালন করা চলে তাতে ত্রুটি করে না নীপা।

    1 2 3
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগাছের পাতা নীল – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article উত্তরণ – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }