Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    একটুখানি বিজ্ঞান – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল এক পাতা গল্প204 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৬. মস্তিষ্ক

    মস্তিষ্ক

    11. মস্তিষ্কের ডান বাম

    আমার একজন ছাত্র একবার মস্তিষ্কে আঘাত পেয়ে মারা গিয়েছিল। ডাক্তাররা তাকে বাঁচানোর সব রকম চেষ্টা করলেও আমাদেরকে বলেছিলেন সে বেঁচে গেলেও কখনো দৃষ্টি শক্তি ফিরে পাবে না, মানুষের মস্তিষ্কের যে অংশটুকু দেখার কাজে ব্যবহৃত হয় তার সেই অংশটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ডাক্তারদের আশঙ্কা সত্যি কি না সেটা আমরা কখনো জানতে পারি নি কারণ হতভাগ্য ছাত্রটি কখনো জ্ঞান ফিরে পায় নি। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে বের করেছেন মস্তিষ্কের বিশেষ বিশেষ অংশবিশেষ বিশেষ কাজ ব্যবহৃত হয়। কোনো কোনো অংশ দেখার কাজে, কোনো অংশ শোনার কাজে, কোনো অংশ স্পর্শের অনুভূতির জন্যে। এমনকি ভয়ংকর দুর্ঘটনার কারণে আরও কিছু বিচিত্র ব্যাপার জানা গেছে, মস্তিষ্কের সামনের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর পুরাপুরি একজন নীতিবান সৎ মানুষ দুর্নীতিবাজ দুশ্চরিত্র রেপ্টিলিয়ান ব্রেন হয়ে গিয়েছিল! কাজেই মস্তিষ্কের রহস্য বোঝা এখনো শেষ হয় নি, খুব তাড়াতাড়ি শেষ হবে সেরকম সম্ভাবনাও নেই।

    খুব সরলভাবে মানুষের মস্তিষ্ককে দেখলে সেটাকে 11.1 নং ছবির মতো দেখা যেতে পারে। ছবিটির দিকে তাকালেই বোঝা যায় যে, মানুষের মস্তিষ্কে তিনটি স্তর। ভেতরের স্তরটি নাম রেপ্টিলিয়ান ব্রেন, নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে কোটি কোটি বছর আগে পৃথিবীতে যখন সরীসৃপ যুগ ছিল তখন এই অংশটি গড়ে উঠেছে। এই অংশটি নিয়ন্ত্রণ করে ক্ষুধা বা ভয়ের মতো জৈবিক বা পাশবিক অনুভূতি। বিবর্তনের কারণে যখন প্রাণিজগতের আরো উন্নতি হয়েছে তখন ধীরে ধীরে রেপ্টিলিয়ান ব্রেনের উপরে লিম্বিক ব্রেন গড়ে উঠেছে। লিম্বিক ব্রেন আমাদের অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমার দুঃখ-কষ্ট-ভালোবাসা-ক্রোধ এই অনুভূতিগুলো এই অংশটুকু থেকে জন্ম নেয়। (লিম্বিক ব্রেনের একটা বড় অংশের নাম এমিগডালা, যেটা যৌন প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে।) লিম্বিক ব্রেনের উপরে রয়েছে নিওকর্টেক্স বা উচ্চতর ব্রেন। মানুষের চিন্তা মনন, বুদ্ধিমত্তা বা নান্দনিক চেতনা সবকিছুর জন্ম হয় নিওকর্টেক্সে। এই নিওকর্টেক্সই আমাদের মানুষ হিসেবে আলাদা স্থান করে দিয়েছে।

    নিওকর্টেক্স বা উচ্চতর ব্রেন দুই ভাগে বিভক্ত। একটা বাম গোলার্ধ অন্যটি ডান গোলার্ধ। এটি এমন কিছু বিচিত্র নয়, কারণ আমাদের প্রায় সবকিছুই দুটি করে–আমাদের হাত দুটি, পা দুটি, চোখ, ফুসফুস কিডনী দুটি, কাজেই মস্তিষ্কের সবচেয়ে বিকশিত অংশটিও দুই ভাগে ভাগ থাকবে তাতে অবাক হবার কী আছে? তবে এখানে যে জিনিসটি বিচিত্র সেটি হচ্ছে মস্তিষ্কের এই বাম এবং ডান গোলার্ধ একজন মানুষের চরিত্রের সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি দিককে নিয়ন্ত্রণ করে। একেবারে এক কথায় যদি বলতে হয় তাহলে বলতে হবে বাম গোলার্ধ হচ্ছে যুক্তি এবং বিশ্লেষণের জন্যে (critical analysis) এবং ডান গোলার্ধ হচ্ছে অর্ন্তজ্ঞান (intution) এর জন্যে। মস্তিষ্কের এই দুটি গোলার্ধ একেবারে ভিন্ন ভিন্ন দুটি দায়িত্ব পালন করলেও তারা একেবারে আলাদা নয়। এই দুটি আলাদা গোলার্ধ কর্পাস কেলুসাম নামে এক ধরনের নিউরাল তন্তু দিয়ে যুক্ত। অর্থাৎ, বাম এবং ডান গোলার্ধের মাঝে যোগাযোগ আছে এবং একজন মানুষ একই সাথে যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারে আবার নিজের অর্ন্তজ্ঞানও খানিকটা ব্যবহার করতে পারে।

    মস্তিষ্কের বাম গোলার্ধে যুক্তিবাদী চিন্তা এবং বিশ্লেষণ ছাড়াও ভাষা, নিয়ম, পদ্ধতি, গণিত, পরিমিতি বোধ এই বিষয়গুলোও নিয়ন্ত্রণ করে। আবার ডান গোলার্ধে রয়েছে একটা বস্তুকে দেখে তার জ্যামিতিক বা ত্রিমাত্রিক রূপ বোঝার শক্তি, দার্শনিক চিন্তা, অবচেতন এবং উপমা বা কল্পনার জগৎ অনুভব করার ক্ষমতা। বাম গোলার্ধে সবকিছু ঘটে পরপর, ডান গোলার্ধে সামগ্রিকভাবে একসাথে। একেবারে ভিন্ন ধরনের দুটি মননশীল প্রক্রিয়া দুই গোলার্ধে আলাদা আলাদাভাবে ঘটে এবং কর্পাস কেলুসামের সেতু দুধরনের প্রক্রিয়ার মাঝে একটা সামঞ্জস্য নিয়ে আসে। কাজেই যে মানুষটির ভেতর কল্পনার একটা জগৎ রয়েছে, জীবন সম্পর্কে দার্শনিকভাবে চিন্তা করে সেই একই মানুষ জীবনের খুঁটিনাটি হিসেবগুলোও করে সতর্কভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তারপরেও আমরা কিন্তু একজন মানুষের মাঝে তার মস্তিষ্কের একটা গোলার্ধের প্রাধান্য খুঁজে পাই। যাদের ভেতর বাম গোলার্ধের প্রাধ্যনা বেশি তারা অত্যন্ত হিসেবী এবং সতর্ক। যার ভেতরে ডান গোলার্ধের প্রাধান্য সে একটু কল্পনাপ্রবণ, অন্তজ্ঞানের উপর একটু বেশি নির্ভরশীল মানুষ।

    মানুষের মস্তিষ্কের বাম এবং ডান গোলার্ধ যে একেবারে ভিন্ন ভিন্ন কাজ করে সেটি নিয়ে বিজ্ঞানীরা খুব চমৎকার গবেষণা করেছেন। এই গবেষণাটি করা সম্ভব হয়েছে কিছু দুর্ভাগা মানুষের কারণে। এই মানুষগুলো মৃগী রোগাক্রান্ত এবং তাদের অবস্থা এতই ভয়ানক যে প্রতি ঘণ্টায় কয়েক বার মৃগী রোগের খিচুনি শুরু হয়ে যায়। কোনো উপায় না দেখে মস্তিষ্কের ডাক্তাররা অনেক চিন্তাভাবনা করে তাদের মস্তিষ্কের বাম এবং ডান গোলার্ধের যে যোগসূত্র সেই কর্পাস ফেলুসামটিকে কেটে দিলেন। এর ফলে তাদের মৃগী রোগের খিচুনির সমস্যা প্রায় পুরাপুরি মিটে গেল এবং আপাতঃদৃষ্টিতে তাদেরকে পুরাপুরি স্বাভাবিক মানুষ মনে হতে লাগল। কিন্তু কর্পাস কেসাম কেটে দেয়ার কারণে বাম গোলার্ধ এবং ডান গোলার্ধের মাঝে আর কোনো যোগাযোগ রইল না। তাদের মস্তিষ্কে দুটো গোলার্ধই আছে কিন্তু সেগুলো আর একসাথে সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারে না। সেগুলো কাজ করে সম্পূর্ণ আলাদা ভাবে।

    এই মানুষগুলোকে আপাতঃদৃষ্টিতে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক মানুষ মনে হলেও তাদের ভেতর কিছু অস্বাভাবিক বিষয় লক্ষ করা গেল। সেই অস্বাভাবিক বিষয়গুলো বোঝার জন্যে আরেকটা বিষয় জানা দরকার, মানুষের শরীরের ডানদিকের অংশ–হাত, পা, চোখের ডান পাশের দৃশ্যমান এলাকা, নাকের ডান অংশের গন্ধ নেবার ক্ষমতা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের বাম দিকের গোলার্ধ। ঠিক সেরকম তার শরীরের বাম দিকের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে ডানদিকের অংশ। এবারে বিজ্ঞানীদের পরীক্ষাগুলোর কথা বলা যেতে পারে। তারা দ্বিখণ্ডিত মস্তিষ্কের এই মানুষগুলোকে ত্রিমাত্রিক কিছু ছবি দেখিয়ে সেগুলো আঁকতে বললেন, একবার বাম হাতে আরেকবার ডান হাতে। আমরা আগেই বলেছি মস্তিষ্কের ডান গোলার্ধ ত্রিমাত্রিক রূপ বুঝতে পারে ডান গোলার্ধ বাম হাতকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাই দেখা গেল বাম হাত দিয়ে মানুষগুলো বেশ সুন্দর করে ত্রিমাত্রিক ছবি একেঁছে। আবার সেই একই মানুষ যখন ডান হাত দিয়ে সেই একই ছবি আঁকার চেষ্টা করেছে (যদিও সে ডান হাত দিয়েই সবকিছু করে) দেখা গেল কিছুই আঁকতে পারছে না। তার ডান হাতটি নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের বাম গোলার্ধ সেটি ত্রিমাত্রিক রূপ ধরতে পারে না। যেহেতু মস্তিষ্কের দুই গোলার্ধের মাঝে সব যোগাযোগ কেটে দেয়া হয়েছে তাই এক গোলার্ধ আর অন্য গোলার্ধকে সাহায্য করতে পারছে না। দ্বিখণ্ডিত মস্তিষ্কের মানুষগুলোকে নিয়ে সবচেয়ে চমকপ্রদ পরীক্ষাটি ছিল এ-রকম (11.4নং ছবি): তার সামনে বাম চোখের দৃষ্টি সীমার মাঝে “বই” লেখা শব্দ রেখে মানুষটাকে জিজ্ঞেস করা হলো এখানে কী লেখা আছে? মানুষটাকে পুরাপুরি বিভ্রান্ত দেখা গেল, সে দেখছে শব্দটা বই কিন্তু সেটা বলতে পারছে না। কারণ, যেহেতু বাম চোখের দৃষ্টি সীমার মাঝে সেটা গিয়েছে মস্তিষ্কের ডান গোলার্ধে, কিন্তু মস্তিষ্কের ডান গোলার্ধে ভাষার ব্যাপারটি নেই তাই মানুষ “বই”য়ের মতো পরিচিত শব্দটাও মুখে বলতে পারছে না। তখন তাকে বলা হলো শব্দটা লেখো মানুষটা বাম হাতে পরিষ্কার লিখে ফেলল “বই”। যেহেতু সেটা মস্তিষ্কের ডান গোলার্ধে আছে সেটা নিয়ন্ত্রণ করছে বাম হাত তাই বাম হাতে লেখা তার জন্যে কোনো সমস্যা নয়। দ্বিখণ্ডিত মস্তিষ্কের এই মানুষটি শব্দটি লিখতে পারে কিন্তু বলতে পারে না!

    যে বিজ্ঞানী মানুষের ডান এবং বাম মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করে এই বিষয়গুলো আবিষ্কার করেছিলেন তার নাম রজার স্পেরী, তিনি তার এই কাজের জন্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।

    মস্তিষ্কের বাম এবং ডান গোলার্ধের এই চমকপ্রদ বিষয়গুলো কিন্তু আমরা নিজেরাও পরীক্ষা করে দেখতে পারি। ধারণা করা হয় আমাদের সচেতন সময়ে বাম গোলার্ধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা যখন ঘুমাই তখন বাম গোলার্ধ দমিত হয়ে থাকে। হঠাৎ করে যদি কাউকে ঘুম থেকে জাগানো হয়, দেখা যায় সে পরিষ্কার জানে কী বলতে হবে কিন্তু কথা বলতে পারে না! ভাষার নিয়ন্ত্রণ বাম গোলার্ধে ঘুমের মাঝে সেটা দমিত ছিল তাই হঠাৎ করে নিয়ন্ত্রণটা নিতে পারছে না। পুরাপুরি জেগে ওঠার পরেই শুধু একজন মানুষ গুছিয়ে কথা বলতে পারে।

    ধারণা করা হয় আদিকালে নিওকর্টেক্সের দুই অংশই একই ধরনের দায়িত্ব পালন করতো। বিবর্তনের ধারায় ধীরে ধীরে দুই গোলার্ধ যুক্তিতর্ক এবং অবচেতন মনের অন্ত জ্ঞানসংক্রান্ত কাজ এই দুটি দায়িত্ব পালন করতে শুরু করেছে। বাম গোলার্ধ একটু বেশি হিসেবি, ডান গোলার্ধ একটু বেশি কল্পনা প্রবণ। নূতন পৃথিবীতে চেষ্টা করা হচ্ছে সফল মানুষকে তাদের মস্তিষ্কের দুই গোলার্ধকেই সুষম উপস্থাপন করে সমন্বয় করা শিখতে।

    তা হলেই হয়তো তারা সত্যিকার মানুষ হতে পারবে।

    .

    12. বুদ্ধিমত্তা : মস্তিষ্কের ভেতরে এবং বাইরে

    প্রাণিজগতে সবারই কমবেশি বুদ্ধিমত্তা রয়েছে–মানুষ হিসেবে আমাদের বুদ্ধিমত্তা সবচেয়ে বেশি। এই বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে আমরা কী করতে পারি চারপাশে তাকালেই সেটা চোখে পড়ে। তার সবগুলোই যে খুব ভালো সেটা খুব জোর দিয়ে বলা যাবে না। যেমন আমাদের এই বুদ্ধিমত্তা আছে বলেই আমরা সমস্ত পৃথিবীটাকে অনেকবার ধ্বংস করে ফেলার মতো অস্ত্রভাণ্ডার তৈরি করে মহানন্দে বসে আছি। তবে মানুষের শুভ বুদ্ধির ওপরে আমাদের বিশ্বাস আছে, শেষ পর্যন্ত মানব জাতি সভ্যতার পথ ধরে সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হবে এটা আমরা সব সময়েই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।

    আমাদের কিংবা অন্য প্রাণীদের বুদ্ধিমত্তা শরীরের যে জৈবিক অংশ থেকে আসে সেটাকে আমরা বলি মস্তিষ্ক। “অমুকের কলিজা খুব শক্ত” “অমুকের হৃদয়টা খুব নরম” কিংবা “অমুকের বুকে খুব কষ্ট” এ রকম কথাবার্তা বলে আমরা মানুষের চরিত্র বা অনুভূতির জন্যে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যেঙ্গের নাম ব্যবহার করলেও আসলে সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু কিন্তু মস্তিষ্ক। মানুষের মস্তিষ্কের ওজন দেড় কেজি থেকে একটু কম (1375 gm)। মস্তিষ্কের ঘনত্ব শরীরের অন্যান্য টিস্যুর মতো পানির ঘনত্বের কাছাকাছি। কাজেই মস্তিষ্কের আয়তন দেড় লিটারের মতো (1375cc)। অর্থাৎ, মাঝারি মিনারেল ওয়াটারের একটা বোতলে মানুষের পুরো মস্তিষ্কটা এঁটে যায়।

    তবে সব মানুষের মস্তিষ্কের আয়তন সমান নয়। পূর্ব দেশীয় মানুষের মস্তিষ্ক তুলনামূলকভাবে পশ্চিম দেশীয় মানুষ থেকে বড়। আবার পুরুষের মস্তিষ্ক তুলনামূলকভাবে মহিলাদের মস্তিষ্ক থেকে বড়। তবে আয়তনের এই পার্থক্যটুকু কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ নয়। পৃথিবীতে আয়তনে বড় মস্তিষ্কের মানুষের মাঝে রয়েছেন কবি বায়রন বা ইভান তুর্গনেভ (2,200 gm)। তবে মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ ব্যবহারে পৃথিবী থেকে একজনকে বেছে নিতে হলে যে মানুষটিকে বেছে নিতে হবে তিনি হচ্ছেন বিজ্ঞানী আইনস্টাইন, তার মস্তিষ্ক কিন্তু বায়রন বা তুর্গনেভের মতো বড় ছিল না। আবার পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ থেকেও বেশি প্রতিভাবান নোবেল পুরস্কার বিজয়ী সাহিত্যিক আনাতলি ফ্রান্সের (Anatolc Frana) মস্তিষ্কের আয়তন ছিল রীতিমতো ছোট (মাত্র 1100 gm) বায়রনের অর্ধেক। কাজেই একজন মানুষের মস্তিষ্কের আয়াতন বা ওজন যেটুকু হওয়া উচিৎ, তার চাইতে দুই একশ গ্রাম বেশি বা কম হলে সেটা বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে কোনোই পার্থক্য সৃষ্টি করে না, সেটাই হচ্ছে বিজ্ঞানীদের অভিমত।

    একটা বড় প্রাণী হলে তার বড় শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করতে তুলনামূলকভাবে একটা বড় মস্তিষ্ক দরকার আবার প্রাণীটা ছোট হলে তার ছোট শরীরের নিয়ন্ত্রণের জন্যে মস্তিষ্কটা ছোট হলেই চলে। কাজেই মস্তিষ্কের প্রকৃত পরিমাণ থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সেটি তার শরীরের ওজনের কত অংশ। গবেষকরা পৃথিবীর সকল প্রাণীর মস্তিষ্কের ওজনকে শরীরের ওজন দিয়ে ভাগ দিয়ে একটা চমকপ্রদ তথ্য খুঁজে পেয়েছেন। তারা দেখেছেন প্রাণিজগতকে সুনির্দিষ্টভাবে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একভাগে পড়ে স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখি, অন্যভাগে পড়ে মাছ এবং সরিসৃপ জাতীয়  প্রাণী। সব সময়েই দেখা গেছে স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখিদের মস্তিষ্কের আকার মাছ এবং সরিসৃপ থেকে প্রায় দশগুন বেশি। গবেষকদের এই তথ্য ছাড়াও আমরা কিন্তু এই তথ্যের কথা অনুমান করতে পারতাম। অনেক মানুষই সঙ্গী হিসেবে কুকুর কিংবা বেড়াল পুষে । সার্কাসে বাঘ, ভালুক, হাতি, ঘোড়া এমন কি পাখিদের ট্রেনিং দিয়ে খেলা দেখানো হয়। মাছ কিংবা সরীসৃপদের ট্রেনিং দিয়ে খেলা দেখানোর কোনো রেওয়াজ নেই। আমাদের দেশে সাপুড়েরা সাপের খেলা দেখায় কিন্তু সেটা কোনো বুদ্ধির খেলা নয়। সাপুড়েরা ঝাপি থেকে তাদের বের করে এবং সাপগুলো ফণা তুলে বসে থাকে, এই পর্যন্তই। পৃথিবীর অনেক বিনোদন কেন্দ্রে ডলফিন এবং তিমি মাছ খেলা দেখায় কিন্তু সেগুলোকে মাছ বলা হলেও আসলে তারা মাছ নয়, আসলে সেগুলো স্তন্যপায়ী প্রাণী।

    একটা প্রাণীর শরীরের তুলনায় তার মস্তিষ্ক কত বড় সেটা বুদ্ধিমত্তার একটা পরিমাপ হতে পারে জানার পর স্বাভাবিকভাবে যে প্রশ্নটা প্রথমে আসে সেটা হচ্ছে। কোন প্রাণী এই তালিকায় সবার আগে? কার মস্তিষ্ক তার শরীরের তুলনায় সবচেয়ে বড়? উত্তরটা অনুমান করা খুব কঠিন নয়–প্রাণীটা হচ্ছে মানুষ। এদিক দিয়ে মানুষের সবচেয়ে কাছাকাছি প্রাণী হচ্ছে ডলফিন। সম্ভবত এটা মোটেও কাকতালীয় ব্যাপার নয় যে ডলফিনের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে নাবিক এবং জাহাজীদের মাঝে অসাধারণ কিছু গল্প প্রচলিত আছে। অতি সাম্প্রতিক সুনামির সময়েও ডলফিনদের বুদ্ধি ব্যবহার করে কিছু মানুষের প্রাণরক্ষার খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে।

    পৃথিবীর অতিকায় প্রাণীদের মাঝে অন্যতম হচ্ছে ব্লু হোয়েল এবং অবলুপ্ত প্রাণীদের মাঝে হচ্ছে ডাইনোসর। ডাইনোসর সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী তাই তাদের মস্তিষ্কের আকার ছোট হওয়ারই কথা কিন্তু ব্লু হোয়েল জাতীয় তিমিদের তুলনায় তার মস্তিষ্ক একশ গুণ ছোট। মানুষের মস্তিষ্ক থেকে সেটা প্রায় সাড়ে ছয় গুণ বড়, এই তিমিরা তাদের এত বড় মস্তিষ্ক নিয়ে কী করে সেটা অনেকের কাছেই রহস্য। তাদের কী চিন্তা করার ক্ষমতা আছে? দূরদৃষ্টি আছে? দুঃখ বা ভালোবাসার মতো উন্নত অনুভূতি আছে? মাঝে মাঝেই যে তিমি মাছেরা দল বেঁধে সমুদ্রের তীরে বালুবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দেয় তার পিছনে কী কোনো বেদনা বা বিষণ্ণতা কাজ করে? কে তার উত্তর দেবে!

    মস্তিষ্কের আয়াতন বা ওজন নিয়ে কথা বলতে চাইলেই তার ভেতরকার তথ্য বা বুদ্ধিমত্তাকে কোন একধরনের সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করার ইচ্ছে করে। মানুষের মস্তিষ্কের কোষ বা নিউরণের সংখ্যা হচ্ছে দশ বিলিওন (এক হাজার কোটি)। এই নিউরনগুলো অন্য নিউরনের সাথে যে যোগসূত্র দিয়ে যুক্ত তার নাম হচ্ছে সিনান্স। প্রতিটি নিউরণের গড়ে এক হাজারটি করে সিনান্স রয়েছে এবং সেই এক হাজার সিনান্স দিয়ে প্রত্যেকটি নিউরন আরো এক হাজার নিউরনের সাথে যোগাযোগ রাখে। আজকাল কম্পিউটারের সাথে পরিচিত হওয়ার কারণে তথ্যকে আমরা বিট (bit) হিসেবে গুণতে শিখেছি। কোনো একটা তথ্যকে যদি একটি “হ্যাঁ” কিংবা একটি “না” দিয়ে প্রকাশ করা যায় সেটা হচ্ছে একটি বিট। কাজেই আমরা যদি ধরে নিই সিনান্স সংযোগ শুধু মাত্র ‘হ্যাঁ’ কিংবা না দিয়ে তথ্যের আদান-প্রদান করা হয় তাহলে যেহেতু মোট সিনালের সংখ্যা হচ্ছে দশ হাজার বিলিওন (দশ লক্ষ কোটি) কাজেই মস্তিষ্কের রাখা তথ্যের পরিমাণও হবে দশ হাজার বিলিওন বিট বা কম্পিউটারের ভাষায় এক টেরা বাইট।

    এটি বেশি কিংবা কম সেই বিষয়ে যাবার আগে আমরা অন্য একটা বিষয় : দেখতে পারি। যদি মাথায় শুধু একটা সিনা থাকত তাহলে পুরো মন্ত্রিক শুধু দুটো অবস্থায় থাকতে পারতো (একটি হচ্ছে ‘হ্যাঁ’ অন্যটি হচ্ছে না’)। যদি সিনা সংখ্যা হতে দুই তাহলে মস্তি ষ্কের সম্ভাব্য অবস্থা হতে পারতো চার (প্রথমটি ‘হ্যাঁ’ দ্বিতীয়টি ‘হ্যাঁ,’ প্রথমটি হ্যাঁ’ দ্বিতীয়টি ‘না’, প্রথমটি ‘না’ দ্বিতীয়টি ‘হ্যাঁ’ এবং প্রথমটি ‘না’ দ্বিতীয়টিও ‘না’)। সিনান্সের সংখ্যা যদি হতো তিন তাহলে মস্তিষ্কের সম্ভাব্য অবস্থা হতো আট। এভাবে আমরা দেখাতে পারি সিনা সংখ্যা যখন দশ হাজার বিলিওন তখন আমাদের মস্তিষ্কের সম্ভাব্য অবস্থার মোট, সংখ্যা হচ্ছে 10^39, ছোট একটুখানি জায়গায় লিখে ফেললেও সংখ্যাটি অনেক বড়, আমাদের এই সৃষ্টিজগৎ, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যত অনু-পরমাণু আছে এটি তার থেকেও বড়। মানুষের মস্তিষ্ক এই অচিন্ত্যনীয় সংখ্যক অবস্থায় মাঝে যেতে পারে। একজন মানুষ তার জীবদ্দশায় কখনোই তার সকল সম্ভাবনাগুলোর ভেতর দিয়ে যেতে পারে না। সব মানুষের মস্তিষ্কেই অসংখ্য অজানা অবস্থাগুলো রয়ে যায় তাই প্রত্যেকটা মানুষই এত স্বতন্ত্র এত ভিন্ন। মানুষের মাঝে তাই এত রহস্য। মনে রাখতে হবে কম্পিউটারে ব্যবহৃত ট্রানজিস্টরে শুধু ‘হ্যাঁ’ ‘না’ এই দুটি পর্যায় থাকতে পারে বলে আমরা সিনান্সের বেলাতেও তাই ধরেছি। মানুষের সিনান্সে ট্রানজিস্টরের সীমাবদ্ধতা নেই, সেগুলোকে শুধু ‘হ্যাঁ’ ‘না’ এই দুই পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকতে হয় না, প্রতিটি সংযোগ আরো বেশি পর্যায়ের ভেতর দিয়ে যেতে পারে। কাজেই মস্তিষ্কের প্রকৃত অবস্থার সংখ্যা আরো অনেক বেশি।

    মানুষের মস্তিষ্কের সাথে কম্পিউটারের তুলনা করা এক অর্থে ছেলেমানুষি একটি প্রক্রিয়া হলেও সেটা যখন শুরু করা হয়েছে সেটাকে আরো একটু এগিয়ে নেয়া যায়। আমরা যদি তথ্য সংরক্ষণের ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক চীপস বা ইন্টেগ্রেটেড সার্কিটের সাথে মস্তিষ্কের তুলনা করি তাহলে দেখব আমরা প্রতি একক আয়াতনে তথ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এখনো দশ হাজার গুণ পিছিয়ে আছি। অন্যভাবে বলা যায় মানুষের মস্তিষ্কে যেটুকু আয়াতনে যতটুকু তথ্য রাখা যায়, ইন্টোগ্রটেড সার্কিটে একই পরিমাণ তথ্য রাখতে হলে তার জন্যে জায়গা লাগবে দশ হাজার গুণ বেশি!

    বিজ্ঞানীরা ল্যাবরেটরিতে প্রাণীর মাঝে পরীক্ষা করে একটা গুরুত্বপূর্ণ এবং সাধারণ মানুষের জন্যে আশাব্যঞ্জক তথ্য পেয়েছেন। তারা দেখেছেন একটা প্রাণীকে যদি খুব সাদামাটাভাবে রাখা হয় তাহলে তার মস্তিষ্কও হয় সাদামাটা। কিন্তু প্রাণীটাকে যদি খুব উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশে নতুন নতুন চিন্তাভাবনার ক্ষেত্র তৈরি করে নানারকম সমস্যা সমাধানের সুযোগ করে রাখা হয় তাহলে তার মস্তিষ্কের গুণগত পরিবর্তন হয়ে যায়। তার মস্তিষ্কের সিনালের মাঝে নূতন নূতন সংযোগ তৈরি হতে থাকে। আমরা মানুষের মেধা বলে একটা কথা ব্যবহার করি, সেই ‘মেধা’ শব্দটি দিয়ে আমরা যদি চিন্তাভাবনা বা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাকে বুঝিয়ে থাকি তাহলে বুঝতে হবে একজন মানুষ যেটুকু মেধা নিয়ে জন্ম নিয়েছে তাকে ততটুকু নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে না। সে ক্রমাগত তার মস্তিষ্ক ব্যবহার করে নূতন কিছু শিখে তার নিউরনের নূতন সিনান্স সংযোগ বাড়াতে পারে, অন্য কথায় বলা যায় তার মেধা বাড়াতে পারে।

    আমরা জানি সব প্রাণীই এক ধরনের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বড় হয়। বাঘ যখন হরিণ শিকার করে তখন সে তার বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে। মাকড়াশা যখন জাল বুনে সেখানেও সে তার বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে। আরও ক্ষুদ্র প্রাণী বা জীবাণু যখন অন্য কোনো প্রাণীকে আক্রমণ করে তখনও সে তার বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করে। যে সব প্রাণীর মস্তিষ্ক রয়েছে তাদের বুদ্ধিমত্তার বড় অংশ থাকে মস্তিষ্কে কিন্তু যাদের মস্তিষ্ক নেই সেই জীবাণুর মতো ক্ষুদ্র প্রাণীদের বুদ্ধিমত্তা থাকে কোথায়? সেগুলো থাকে তাদের জীনস এর মাঝে ডি.এন.এ সাজানো নিওক্লিওটাইডে। এই বুদ্ধিমত্তা কিংবা তথ্য কিন্তু কম নয়। একজন মানুষের শরীরের একটি ক্রমোজমে প্রায় 5 বিলিওন নিওক্লিওটাইডের জোড়া। A,T,C এবং G এই চার ধরনের নিউক্লিওটাইড দিয়ে 20 বিলিওন বিটস তথ্য রাখা সম্ভব। মানুষে মস্তিষ্কের মাঝে রাখা তথ্যের তুলনায় সেটি মোটেও কম নয়। তবে এই তথ্যগুলো নিজের প্রয়োজনে। পরিবর্তন করা যায় না, বাড়ানো যায় না, কমানো যায় না। প্রকৃতির নীল নকশা অনুযায়ী এটা পাকাপাকিভাবে রেখে দেয়া হয়েছে। ‘ প্রাণিজগৎ বিবর্তনের মাঝে দিয়ে এ-রকম অবস্থায় পৌঁচেছে। একটা সময় ছিল যখন প্রাণিজগতের পুরো বুদ্ধিমত্তাটাই ছিল এই জিন্স বা ডি.এন.এ.র ভেতরে। ধীরে ধীরে প্রাণিজগতের মাঝে মস্তিষ্কের বিকাশ হলো এবং এই মস্তিষ্কে বুদ্ধিমত্তার জন্ম হতে শুরু করল। আজ থেকে প্রায় একশ মিলিওন (দশ কোটি) বছর আগে প্রথমবারের মতো একটা প্রাণীর মস্তিষ্কের বুদ্ধিমত্তা তার ডি.এন.এ.তে রাখা বুদ্ধিমত্তাকে অতিক্রম করে যায়। বিবর্তনের পরিমাপে নিঃসন্দেহে সেটা ছিল খুব বড় একটা মাইলফলক। ধীরে ধীরে সরীসৃপের জন্ম হলো স্তন্যপায়ী প্রাণী এলো এবং একসময় মানুষের জন্ম হলো।

    বুদ্ধিমত্তার হিসেবে মানুষ কিন্তু অন্যসব প্রাণী থেকে একটি বিষয়ে একেবারে আলাদা। মানুষ হচ্ছে প্রথম প্রাণী যে তার বুদ্ধিমত্তার জন্যে শুধুমাত্র তার মস্তিষ্কের উপর নির্ভরশীল নয়। মানুষের অনেক বুদ্ধিমত্তা তার মস্তিষ্কের বাইরে, বইপত্রে, কাগজে জার্নালে। অনেক তথ্য কম্পিউটারে, লাইব্রেরিতে, ইন্টারনেটে। একটা প্রাণী যখন বুদ্ধিমত্তার জন্যে হঠাৎ করে শুধুমাত্র তার মস্তিষ্কের উপর নির্ভরশীল না থাকে সে মস্তিষ্কের বাইরে থেকে বুদ্ধিমত্তা সংগ্রহ করতে পারে তখন পুরো বিষয়টা অন্যরকম হয়ে যায়।

    এ-রকম একটা প্রাণীর বিবর্তন কেমন করে অগ্রসর হয় আমরা আজ সেটা বলতে পারব না। আজ থেকে লক্ষ বৎসর পরের মানুষ সেটা সে খুব কৌতূহলী হয়ে দেখবেন সে ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই।

    .

    13. ঘুমের কলকব্জা

    আমাদের জীবনে যে কয়টা নিয়মিত বিষয় রয়েছে ঘুম হচ্ছে তার মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি। আমাদের সবার প্রত্যেকদিন ঘুমাতে হয়। কেউ একটু বেশি ঘুমায় কেউ একটু কম। বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন ঘুমটাকে সময় নষ্ট বলে মনে করতেন তাই তিনি রাতে মাত্র চার ঘণ্টা ঘুমাতেন। আবার বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলতেন রাতে যদি তিনি দশ ঘণ্টা না ঘুমান তিনি ঠিক করে কাজ করতে পারেন না। যেহেতু চব্বিশঘণ্টার মাঝে সবাইকে একবার হলেও ঘুমাতে হয় তাই সবারই জানা উচিত তার আসলে কতটুকু ঘুমের দরকার। দেখা গেছে যার যেটুকু ঘুমের দরকার সে যদি তার থেকে কম সময় ঘুমায় তাহলে সে হয়তো এক দুই ঘণ্টা সময় বাঁচিয়ে ফেলে ঠিকই কিন্তু আসলে খুব একটা লাভ হয় না। কম ঘুমানোর কারণে সে সারা দিন ঘুমঘুম ভাব নিয়ে থাকে, তার মাঝে সতেজ উৎফুল্ল ভাবটা থাকে না, খিটখিটে মেজাজ হয়ে থাকে বলে সে আসলে যতটুকু কাজ যত সুন্দরভাবে করতে পারতো তার কিছুই পারে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গবেষণা করে দেখেছে কম ঘুমনোর কারণে গাড়ি চালাতে চালাতে ঘুমিয়ে পড়ার কারণে সেই দেশে বছরে প্রায় দুই লক্ষ একসিডেন্ট হয়ে মানুষ মারা যায় প্রায় পাঁচ হাজার। একটা সময় ছিল যখন দিনের বেলা সবাই কাজকর্ম করতো, রাত্রিবেলাটি ছিল বিশ্রামের। লাইট বাল্ব অবিষ্কার হওয়ার পর হঠাৎ করে রাত আর রাত থাকল না। বলা যায় রাতারাতি দিন রাতের পার্থক্যটা ঘুচে যাওয়ায় মানুষের ঘুমের সময় কমে এলো। পৃথিবী এখন রাতে ঘুমায় না, রাতের পৃথিবী সচল রাখার জন্যে অনেক মানুষকে রাতে কাজ করতে হয়। দেখা গেছে যারা রাতে কাজ করে তাদের অর্ধেক মানুষই কখনো-কখনো কাজের মাঝে ঘুমিয়ে পড়ে। কাজের ক্ষতি হয়, একসিডেন্ট হয়, হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়, সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই বছরে সত্তর বিলিওন ডলার (প্রায় চাশ বিশ হাজার কোটি টাকা)। শুধু যে আর্থিক ক্ষতি তা নয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুটি নিউক্লিয়ার একসিডেন্ট চেরনোবিল এবং থ্রি মাইল আইল্যান্ড হয়েছিল ভোররাতে, যখন মানুষ হয় সবচেয়ে ঘুমকাতুরে সবেচেয়ে ক্লান্ত। দু জায়গাতেই দুর্ঘটনাগুলি ঘটেছিল কারণ রাতের শিফটের কর্মকর্তরা বিপদ সংকেতগুলো সময়মতো ধরতে পারে নি।

    আধুনিক পৃথিবীতে আমরা এখন শুধু ছুটছি, আমাদের বিশ্রাম নেবার সময় নেই। আমরা চেষ্টা করি কম সময় ঘুমিয়ে কত বেশি কাজ করতে পারি। কিন্তু বিজ্ঞানীরা ঘুম নিয়ে গবেষণা করে আবিষ্কার করেছেন যে, ঘুম এমন একটা বিষয় যে এখানে ফাঁকি দেবার কোনো সুযোগ নেই। একজন মানুষের যেটুকু ঘুমের দরকার তাকে ততটুকু ঘুমাতেই হবে, যদি না ঘুমায় তাহলে তাকে জীবনের অন্য জায়গায় অনেক বেশি মূল্য দিতে হবে।

    আশ্চর্যজনকভাবে মানুষ জন্মের পর থেকেই। নিয়মিতভাবে ঘুমাচ্ছে কিন্তু ঘুম বিষয়টা কী। সেটা নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞান মাথা ঘামাতে শুরু করেছে তুলনামূলকভালো অনেক পরে। 1931 সালে হ্যাঁন্স বার্গার নামে একজন জার্মান। মনোবিজ্ঞানী প্রথমবার মানুষের মাথায় ইলেকট্রড লাগিয়ে মানুষের মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সিগনাল মাপার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি দেখলেন মানুষ জেগে থাকলে তার মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সিগনালগুলো (EEG) হয় দ্রুত কম্পনশীল। যখন সে ঘুমিয়ে যায় তখন কম্পন কমে আসে কিন্তু সিগন্যালগুলো হয় বড়। সোজা কথায় বলা যেতে পারে একজন মানুষ ঘুমিয়ে আছে নাকী ঘুমের ভান করে ঘাপটি মেরে পড়ে আছে সেটা তার মস্তিষ্কের ইলেকট্রিক সিগন্যালটা দেখেই বুঝে ফেলা যাবে!

    1935 সালে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা দেখলেন ঘুমের বিভিন্ন স্তর রয়েছে এবং ঘুমের বিভিন্ন স্তরে (প্রাথমিক থেকে গভীর ঘুম) মানুষের মস্তিষ্কের (EEG) বৈদ্যুতিক সিগনালগুলোরও সুনির্দিষ্ট পরিবর্তন হয়। মানুষ যেহেতু শোয়ার ঘণ্টাখানেকের ভেতরেই গভীর ঘুমে ঢলে পড়ে তাই গবেষকরা প্রথম ঘণ্টা দুয়েকের তথ্য নিয়েই সুন্তষ্ট ছিলেন। গভীর ঘুমে অচেতন হওয়ার পরেও যে মানুষের মস্তিষ্কে অত্যন্ত চমকপ্রদ কিছু ব্যাপার ঘটতে থাকে তারা সেটা কখনো জানতে পারেন নি। সেই ব্যাপারটা প্রথম চোখে পড়েছে। প্রায় দুই দশক পরে, ইউজিন আজেরিনস্কী নামে ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো এর “ঘুম ল্যাবরেটরির” একজন ছাত্র-গবেষকের চোখে। তার চোখে প্রথম ধরা পড়েছে যে গভীর ঘুমের পর মানুষের ঘুম আবার হালকা হয়ে যায় তখন হঠাৎ করে ঘুমের মাঝে তাদের চোখ নড়তে শুরু করে, মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সিগনাল দ্রুততর হয়ে উঠে। ঘুমের এই স্তরে চোখ দ্রুত নড়তে থাকে বলে এটাকে বলা হয় ‘দ্রুত চোখ সঞ্চালন স্তর’ (Rapid Eye Movement) সংক্ষেপে REM। এ-রকম সময়ে যদি ঘুমন্ত মানুষকে ডেকে তোলা হয় তাহলে তারা প্রায় সব সময়েই বলে থাকে যে তারা কিছু একটা স্বপ্ন দেখছিল। ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো এর গবেষকরা ঘুমের উপর এই নতুন স্তর আবিষ্কার করার পর পৃথিবীর অন্যান্য গবেষকরা গবেষণা করে আবিষ্কার করলেন, ঘুম বললেই আমাদের মস্তিষ্ক পুরাপুরি অচেতন হয়ে যাচ্ছে বলে যে রকম ধারণা হয় সেটা একেবারেই সত্যি নয়। ঘুমের মাঝে আমাদের মস্তিষ্কে হঠাৎ হঠাৎ পুরাপুরি কাজ করতে শুরু করে, শুধু মস্তিষ্ক নয় সাথে সাথে আমাদের শরীরও প্রায় সচেতন হয়ে উঠে। ঘুম হঠাৎ করে আমাদের সচেতন জীবনের কর্মদক্ষতার সাথে গভীরভাবে যুক্ত হয়ে উঠে।

    13.5 নং ছবিতে মানুষের ঘুমের বিভিন্ন স্তরে তার মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সিগনালগুলো (EEG) দেখানো হয়েছে। বিছানায় শোয়ার পর যখন একটু তন্দ্রামতো এসেছে, এখনো ঘুম আসে নি বলে জাগ্রত অবস্থা তবে শরীর শিথিল হয়ে এসেছে তখন মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সিগনালের কম্পন থাকে সেকেন্ডে আট থেকে বারো, এটাকে বলে আলফা তরঙ্গ। আলফা স্ত রে কয়েক মিনিট থাকার পর মানুষ ধীরে ধীরে নিশ্বাস নিতে শুরু করে, মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক সিগনালের কম্পনও কমে সেকেন্ডে চার থেকে আটে নেমে আসে। এই স্তরটির নাম থিটা স্তর বা ঘুমের প্রথম স্তর। এই স্তরে মানুষ দশ সেকেন্ড থেকে দশ মিনিটের মতো থাকতে পারে। ঘুমের প্রথম স্তরে থাকা কাউকে ডেকে তুললে সে সাধারণত চট করে জেগে উঠতে পারে। তার চারপাশের অবস্থা সম্পর্কে তখনো সে মোটামুটি সজাগ থাকে।

    থিটা স্তর বা ঘুমের প্রথম স্তর থেকে মানুষ ঘুমের দ্বিতীয় স্তরে প্রবেশ করে, এখানে দশ থেকে বিশ মিনিটের মতো থাকতে পারে এবং এটাকে বলা যায় মানুষের সত্যিকার ঘুমের শুরু। এই স্তরে পৌঁছানোর পর মানুষ তার চারপাশের অবস্থার কথা পুরাপুরি ভুলে যায়।

    ঘুমের দ্বিতীয় স্তর থেকে মানুষ তৃতীয় স্তরে প্রবেশ করে। তখন থিটা তরঙ্গের সাথে খুব ধীরে ধীরে লয়ের ডেলটা তরঙ্গ এসে হাজির হতে থাকে। কিছুক্ষণের ভেতরে থিটা তরঙ্গ পুরাপুরি অদৃশ্য হয়ে যায় এবং তার বদলে ধীরে লয়ের বড় বড় ডেলটা তরঙ্গ এসে হাজির হয়। এটাকে বলা হয় ঘুমের চতুর্থ স্তর বা গভীর ঘুম। ঘুমের চতুর্থ স্তর থেকে কাউকে জাগিয়ে তুললে চারপাশে কী হচ্ছে সে বুঝতে পারে না, ছোট বাচ্চারা এ-রকম অবস্থায় পৌঁছে গেলে তাদের কিছুতেই জাগিয়ে তোলা যায় না। মানুষ যখন গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে তখন তাদের রক্তচাপ তাপমাত্রা, হৃৎস্পন্দন এবং নিশ্বাসের গভীরতা কমে আসে। মস্তি ষ্কে রক্তের প্রয়োজন হয় সবচেয়ে কম এবং সারা শরীর পুরাপুরি শিথিল হয়ে আসে। মানুষের গ্রোথ হরমোন তখন সবচেয়ে বেশি শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, এইজন্যে শিশু কিশোরের শরীর গড়ে তোলার জন্যে চতুর্থ স্তর বা ডেলটা স্তরের ঘুমের খুব প্রয়োজন।

    ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিনিটের গভীর ঘুমের পর মানুষ আবার আগের স্তরে ফিরে যেতে শুরু

    করে। চতুর্থ স্তর থেকে তৃতীয়, তৃতীয় থেকে দ্বিতীয় কিন্তু দ্বিতীয় থেকে ঘুম এবং জাগরণের মাঝামাঝি প্রথম স্তরে না গিয়ে “দ্রুত চোখ সঞ্চালন” (Rapid Eye Movement বা REM) স্তরে চলে আসে। মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়, হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, নিশ্বাস দ্রুততর হয়ে উঠে, রক্তচাপ বেড়ে যায়। মানুষ জেগে থাকলে যা হওয়ার কথা প্রায় সেরকমই হয় কিন্তু মানুষটা তখন ঘুমিয়েই থাকে এবং সাধারণত রাতের প্রথম স্বপ্নটি তখন দেখে।

    এই স্তরে মানুষ এক থেকে দশ মিনিট থাকতে পারে তারপর আবার আগের মতো দ্বিতীয় তৃতীয় স্তর থেকে চতুর্থ স্তর বা গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে। প্রতি নব্বই থেকে একশ বিশ মিনিটে মানুষ একবার করে এই পুরো চক্রটির ভেতর দিয়ে যায়। প্রথম দ্রুত চক্ষু সঞ্চালন (REM) স্তর থেকে দ্বিতীয় বারের স্থায়িত্ব আরো বেশি হয় এর পরের স্থায়িত্ব হয় আরো বেশি। ঘুমের এই বিভিন্ন স্তরগুলো 13.6 নং ছবিতে দেখানো হয়েছে।

    “দ্রুত চক্ষ সঞ্চালন” (REM) ঘুম মানুষের জন্যে খুব জরুরি। গবেষকরা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছেন মানুষ সারা দিন সচেতনভাবে যেটা শিখে ঘুমের এই পর্যায়ে সেটাকে তার মস্তিষ্কে। সঠিকভাবে সাজিয়ে রাখা হয়। অর্থাৎ বিভিন্ন নিউরণের মাঝে সংযোগ তৈরি করে দেয়া হয়। এই সংযোগ করার প্রক্রিয়াটির কারণে মস্তিষ্কে তুমুল কর্মকাণ্ড হতে থাকে তাই মস্তিষ্কের তরঙ্গ দেখলে মনে হয় মস্তিষ্কটি বুঝি পুরোপুরি সচেতন কিন্তু প্রকৃত অর্থে মানুষটি ঘুমিয়ে আছে। একজন মানুষের পুরো জীবনটিই হচ্ছে নূতন নূতন যায় যেটা জেগে থাকার মতোই, মস্তিষ্কে তখন তুমুল কর্মকাণ্ড হতে থাকে। বিষয় জানা, শেখা স্মৃতিতে। ধরে রাখা যেন পরবর্তীতে সেটা ব্যবহার করতে পারে। মস্তিষ্কের মাঝে পাকাপাকিভাবে সংরক্ষণে এই কাজটি করা হতো “দ্রুত চক্ষু সঞ্চালন” (REM) স্তরে। এই স্তরটিতে না গেলে আমরা কখনোই আমাদের স্মৃতিটিকেই গড়ে তুলতে পারতাম না।

    পরীক্ষার আগে অনেক ছাত্র-ছাত্রী প্রায় সারারাত পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিতে যায়। তারা নিজের অজান্তেই নিজেদের অনেক বড় ক্ষতি করে বসে থাকে, সারারাত জেগে তারা যেটি পড়ে সেই বিষয়টা তাদের মস্তিষ্কে নাড়া চাড়া করে। কিন্তু না ঘুমানোর কারণে তারা মস্তিষ্কে সেটা পাকাপাকিভাবে বসাতে পারে না। তাই পরীক্ষার হলে যখন সেই তথ্যের প্রয়োজন হয় তারা আবিষ্কার করে সেটি তাদের মস্তিষ্কে নেই।

    .

    14. প্রাণীদের ভাবনার জগৎ

    আমরা যখন কোনো চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্যের মুখোমুখি হই তখন প্রায় সময়েই আমাদের মাথায় একটা প্রশ্ন খেলা করে সেটি হচ্ছে আমি যেটা যেভাবে দেখছি অন্যেরাও কি সেটা সেভাবে দেখছে? আমি যেটাকে সবুজ বলি অন্য একজনের কাছে কি সেটা আমার দেখা সবুজ নাকি অন্য কোনো রং! আমি যেটাকে লাল বলছি অন্যেরাও সেটাকে লাল বলছে কিন্তু তারা কী লাল রংটা ঠিক আমার মতো করেই দেখছে নাকি অন্য কোনোভাবে দেখছে? (আমরা জানি যারা কালার ব্লাইন্ড তারা কিছু-কিছু রং দেখতে পারেন না কিন্তু সেটা অন্য ব্যাপার) ঠিক এইভাবে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা যখন হঠাৎ করে দেখি রাস্তার ঠিক মাঝখানে একটি গরু উদাসভাবে তাকিয়ে আছে তখন কি আমাদের ভেতরে এক ধরনের কৌতূহল হয় না যে এই গরুটা এখন কী ভাবছে? নিশ্চিতভাবেই তাদের চিন্তার প্রক্রিয়াটি অনেক ভিন্ন কিন্তু কতটুকু ভিন্ন? তাদের ভেতরে কী ধরনের চিন্তা খেলা করে? তাদের ভেতরে কি মানবিক অনুভূতি আছে?

    একদিন হঠাৎ পথের ধারে একটা পাখির ছানা আবিষ্কার করেছিলাম, সে তারা বাসা থেকে পড়ে গেছে। পাখির ছানার কাছেই তার মা, বাচ্চাটিকে রক্ষা করার জন্যে তার মায়ের যে আকুতি সেটা দেখে আমি নিঃসেন্দেহ হয়েছিলাম পাখিদের মাতৃস্নেহ আছে, কিন্তু সেই স্নেহটা কেমন? কতটুকু গভীর? আমরা কি সেটা কোনোদিন অনুভব করতে পারব?

    বিজ্ঞানীরা ব্যাপারটা নিয়ে গবেষণা করছেন। পশুদের মানবিক অনুভূতি নিয়ে ষাটের দশকে একটা খুব বিখ্যাত এক্সপেরিমেন্ট করা হয়েছিল। এক্সপেরিমেন্টটা এ-রকম : একটা বানরকে (rhesus প্রজাতির বানর) প্রথমে শেখানো হলো যে একটা লিভার টানলে তার খাবারটুকু চলে আসে। বানরকে এটা শেখানো এমন কিছু কঠিন নয়–আমরা পথেঘাটে বানরের খেলা দেখি সেখানে বানর শ্বশুরবাড়িতে নববধূ কেমন আচরণ করে এ-রকম কঠিন বিষয় পর্যন্ত অনুকরণ করে দেখিয়ে ফেলে! যাই হোক বানরকে লিভার টেনে তার প্রাত্যহিক খাবার আনার ব্যবস্থাটা শিখিয়ে দেবার পর বিজ্ঞানীরা একটা খুব বিচিত্র কাজ করলেন, এই বানরের খাঁচার পাশেই আরেকটা খাঁচায় ভিন্ন একটা বানর রাখলেন। এখন তারা লিভারের সাথে এমনভাবে কিছু বৈদ্যুতিক যোগাযোগ করিয়ে দিলেন যে, এখন লিভারটি টানা হলে শুধু যে খাবার আসে তা নয়, তার সাথে সাথে একটা ভয়ানক ব্যাপার ঘটে। পাশের খাঁচায় যে বানরটা রাখা হয়েছে সেট বানরটি তখন একটা ভয়ংকর ইলেকট্রিক শক খায় বলা বাহুল্য ইলেকট্রিক শক কোনো আরামদায়ক অনুভূতি নয় কাজেই বানরটি যন্ত্রণায় চিৎকার করে লাফঝাঁপ দিয়ে তার কষ্ট এবং আতঙ্কটুকু খুব ভালোভাবে প্রকাশ করে দেয়। এখন বিজ্ঞানীরা একটা অত্যন্ত চমকপ্রদ বিষয় আবিষ্কার করলেন। প্রথম বানরটি যখন দেখল তার লিভার টানার কারণে তার খাওয়া আসা বন্ধ হয়ে গেছে, বেচারা বানর দিনের পর দিন অভুক্ত থাকা শুরু করল তবুও লিভার টেনে অন্য বানরকে কষ্ট দিল না। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষাটি নানাভাবে করে মোটামুটি নিশ্চিত হলেন যে বানরের ভেতর চমৎকার একটা “মানবিক” অনুভূতি আছে। এই অনুভূতিটি অনেক বেশি স্পষ্ট হয় যদি সেই বানর নিজে অতীতে ইলেকট্রিক শক খেয়ে তার যন্ত্রণাটা অনুভব করে থাকে। পরিচিত এবং স্বজাতির জন্যে তাদের অনুভূতি বেশি থাকে, অপরিচিত কিংবা ভিন্ন প্রজাতির পশু হলে তাদের অনুভূতি কমে আসতে থাকে। বলা যেতে পারে বিজ্ঞানীরা নানাভাবে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন, আমরা সেটাকে সমবেদনা বা মানবিক অনুভূতি বলি বানরের ভেতর সেটা বেশ ভালো পরিমাণেই আছে।

    বিজ্ঞানীদের এই এক্সপেরিমেন্ট দেখে উৎসাহিত হয়ে স্ট্যানলি মিলগ্রাম নামে একজন মনোবিজ্ঞানী প্রায় এ ধরনের একটি এক্সপেরিমেন্ট করার উদ্যোগ নিলেন–তারা মানবিক অনুভূতিটি খোঁজার চেষ্টা করলেন মানুষের ভেতর! তাদের এক্সপেরিমেন্টেও একজন অন্যকে ইলেকট্রিক শক দেবে তবে দুজনেই হবে মানুষ–একজন মানুষ অন্য মানুষকে ইলেকট্রিক শক দেবে! একটা খাঁচার ভেতরে একটা মানুষকে আটকে রাখা হলো, বাইরে একটা সুইচ। সেই সুইচটা টিপে ধরলেই ভেতরের হতভাগা মানুষটা একটা ভয়াবহ ইলেকট্রিক শক খাবে–যন্ত্রণায় বিকট স্বরে চিৎকার করবে মানুষটি।

    এক্সপেরিমেন্ট করার জন্যে প্রথমে একটা মানুষকে বেছে নেয়া হয় যার মানবিক অনুভূতি পরীক্ষা করা হবে। তাকে বলা হয় তাকে নির্দেশ দিলে সে যেন সুইচ টিপে ধরে। তখন ল্যাব কোর্ট পরা গুরুগম্ভীর একজন বিজ্ঞানী আসেন, এসে মানুষটিকে আদেশ দেন সুইচ টিপে ধরতে, মানুষটি তখন সুইচ টিপে ধরে আর ভয়াবহ ইলেকট্রিক শক খেয়ে খাঁচার ভেতরের মানুষটা বিকট চিৎকার করতে থাকে!

    আমি নিশ্চিত সবাই একমত হবেন যে, এই ধরনের একটা এক্সপেরিমেন্ট দাঁড় করানোই একটা ভয়ংকর অমানবিক ব্যাপার। তবে আসলে বিষয়টা অন্যরকম। যে মানুষটির মানবিক অনুভূতি পরীক্ষা করা হচ্ছে যে জানে না খাঁচার ভেতরের মানুষটি একজন চৌকস অভিনেতা, তাকে মোটেও ইলেকট্রিক শক দেয়া হচ্ছে না–সে ইলেকট্রিক শক খেয়ে যন্ত্রণার বিকট চিৎকার করার অভিনয় করছে। তার চেয়ে বড় কথা এই এক্সপেরিমেন্টটি মানুষের মানবিক অনুভূতি যাচাই করার জন্যে দাঁড়া করা হয় নি, এটি দাঁড়া করা হয়েছে কর্তৃত্বের প্রতি মানুষের আনুগত্যের বিষয়টি যাচাই করার জন্যে। এই পরীক্ষায় দেখা গেছে যাদের ভেতর কর্তৃত্বের ভাব আছে, তারা যখন হুকুম দেয় তাদের অনুগত মানুষেরা মুখ বুজে সেই হুকুম পালন করে ঘোরতর একটা অন্যায় কাজ করে ফেলতে দ্বিধা করে না।

    প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানী স্ট্যানলি। মিলগ্রাম এক্সপেরিমেন্ট করে বিষয়টি প্রমাণ করার চেষ্টা করলেও আমরা কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে এটা অনেকদিন থেকে জানি। 1971 সালে উপরওয়ালার হুকুমে সাধারণ সৈনিক পাখির মতো গুলী করে এই দেশের মানুষকে হত্যা করেছে, কারো মনে এতটুকু অপরাধবোধ জন্মে নি। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে র‍্যাবের সদস্যরা। ক্রসফায়ারের নাম করে একজনকে মেরে ফেলতে দ্বিধা করে না এই একই কারণে–কর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্যে!

    এটি খুবই বিচিত্র একটি ব্যাপার–আমরা বানরের ভেতরে মানবিক অনুভূতি খুঁজে পাই কিন্তু অনেক মানুষের ভেতর সেটা খুঁজে পাই না!

    যাই হোক আমরা শুরু করেছিলাম একটা পশুর অনুভূতি অনুভব করার প্রশ্নটি দিয়ে। সেটি কি কখনো সম্ভব হবে? বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সেটি হতে পারে। মানুষের অনুভূতির ব্যাপারটি থাকে মস্তিষ্কে। ইতোমধ্যে মস্তিষ্কের টিস্যু স্থানান্তর করা সম্ভব হয়েছে। একজনের মস্তিষ্কের টিস্যু যদি আরেকজনের মস্তিষ্কে বসানো হয় তাহলে কি সেটি মানুষটির অনুভূতি স্থানান্তরের মতোই একটি ঘটনা নয়? শুধু যে একই প্রজাতির প্রাণীর মস্তিষ্কের টিস্যু স্থানান্তর করা হয়েছে তা নয়, ভিন্ন ভিন্ন। প্রজাতির প্রাণীদের ভেতরেও মস্তিষ্কের টিস্যু স্থানান্তর করা হয়েছে। এটি মাত্র শুরু হয়েছে, আশা করা যায় আগামী পঞ্চাশ বছরে মানুষ সত্যিকার অর্থে বুঝতে পারবে কেমন করে মস্তিষ্ক গড়ে উঠে, কেমন করে সেটা কখনো বুদ্ধিমত্তা, কখনো অনুভূতির জন্ম দেয়।

    একজনের অনুভূতি অন্য একজনের অনুভব করার সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা পদ্ধতির সূত্রপাত হয়েছে। মস্তিষ্ক বিজ্ঞানী মিজুয়েল নিকোলেলিস একটা চমকপ্রদ এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। একটা বানরের (Owl প্রজাতির) মস্তিষ্কের অসংখ্য নিউরনের ইলেকট্রিক ডিসচার্জ শনাক্ত করে সেটাকে ব্যবহার করে একটা রবোটের হাতকে নাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এটা বুঝি একটা ছেলেমানুষী খেলনা, মাথার মাঝে কিছু মনিটর লাগানো, সেই মনিটর মস্তিষ্কের ভেতরকার ইলেকট্রিক সিগন্যাল শনাক্ত করে কিছু একটা নাড়াচ্ছে। খেলনা যদি বলতে না চাই–বড় জোর একটা সায়েন্স ফিকশান লেখার আইডিয়া, হাত পা ব্যবহার না করে শুধুমাত্র চিন্তা করে কোনো একটা-কিছু নাড়ানো বা সরানো! কিন্তু আসলে সেটি এই গবেষণায় সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা মাত্রার জন্ম দিয়েছে। আমরা এই পদ্ধতি ব্যবহার করে একটা প্রাণীর মস্তিষ্কের ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যালগুলো সংগ্রহ করে একটা বিশাল ডাটাবেস তৈরি করতে পারি। প্রাণীটি যখন ক্ষুধার্ত, যখন শীতার্ত বা যখন ঘুমন্ত, যখন আতঙ্কিত বা ক্রুদ্ধ এ-রকম ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার মস্তিষ্কের ইলেকট্রিক্যাল সিগন্যাল যদি জানা থাকে তাহলে সেগুলো দেখেই প্রাণীটির মস্তিষ্কের ভেতরে উঁকি দেয়া সম্ভব। আশা করা যায় আগামী কয়েক দশকে প্রযুক্তির আরো উন্নতি হবে, এই মুহূর্তে যেটা জটিল সেটা সহজ হয়ে আসবে, মানুষ তখন সত্যি সত্যি একটা প্রাণীর মস্তিষ্কের ভেতর উঁকি দিতে শুরু করবে।

    একদিন হয়তো আসবে যখন আমরা যদি দেখি রাস্তার মাঝখানে একটি গরু উদাস মুখে দাঁড়িয়ে আছে, আমরা জানতে পারব সে কী ভাবছে! হয়তো অবাক হয়ে আবিষ্কার করব, গরু আসলে ‘গরু’ নয়, সেটি বিশাল একজন দার্শনিক! জগৎসংসার নিয়ে তারও বিশাল একটা চিন্তার জগৎ রয়েছে। কে জানে স্বার্থপর কৌশলী কূটবুদ্ধি অনেক মানুষ থেকে একটা গরুই হয়তো অনেক মহৎ!

    .

    15. চোখ আলো ও রঙ

    আমি যখন পিএইচ. ডি. করছি তখন একদিন ল্যাবরেটরিতে আমার প্রফেসর এসে হাজির, কনুইয়ের কাছে কোথায় জানি কেটে গেছে, হাত রক্তে মাখামাখি। আমাকে তার হাতটা দেখিয়ে বলল, এই দেখো, এটা রক্ত! আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, অবশ্যই রক্ত! আমার প্রফেসর নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি ভেবেছিলাম গ্রীজ! আমি তো কালার ব্লাইন্ড, রং দেখতে পাই না!’

    আমার প্রফেসর কালার ব্লাইড ছিলেন, (শব্দটার যথার্থ বাংলা প্রতিশব্দ আমার জানা নেই। আমি কোথাও কোথাও এটাকে রং অচেতন হিসেবে বলেছি, রঙ্গান্ধ থেকে রঙ অচেতন নিশ্চয়ই ভালো শোনায়!) যারা পুরাপুরি কালার ব্লাইন্ড, কোনো রঙই দেখতে পান না তাদের জন্যে সবারই নিশ্চয়ই এক ধরনের মায়া হয়। পৃথিবীর এত সৌন্দর্য তারা পুরাপুরি উপভোগ করতে পারেন না। যিনি রঙ দেখেন না তিনি পৃথিবীর পুরো সৌন্দর্য কীভাবে দেখবেন। কিন্তু রঙটা কী? আমরা কেমন করে দেখি? সেটা নিয়ে নিশ্চয়ই আমাদের ভেতরে এক ধরনের কৌতূহল রয়েছে।

    দেখা শব্দটার অর্থ চোখের ভেতরে আলো প্রবেশ করা, চোখের রেটিনাতে সেই আলোটা এক ধরনের অনুভূতির জন্ম দেয় যেটা অপটিক নার্ভ দিয়ে আমাদের মস্তিষ্কে পৌঁছায়। মস্তি ষ্কের যে অংশটা দেখার কাজে ব্যবহার হয় সেটা আমাদের মাথার পিছন দিকে। একবার আমার এক ছাত্র দুর্ঘটনার মাথায় আঘাত পেয়ে মৃত্যুর সাথে প্রায় এক মাস যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত মারা গিয়েছিল। এই দীর্ঘ সময়ে সে জ্ঞান ফিরে পায় নি, ডাক্তার বলেছিলেন, জ্ঞান ফিরে পেলেও দৃষ্টিশক্তি সম্ভবত ফিরে পাবে না। মস্তিষ্কের যে অংশটুকু দেখার কাজে ব্যবহার হয় তার সেই জায়গাটুকু সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছিল।

    আমাদের চোখের ভেতর এক ধরনের লেন্স রয়েছে, কোনো কিছু থেকে আলো সেই লেন্সে পড়লে সেটা রেটিনাতে সেই জিনিসটার উল্টো প্রতিবিম্ব তৈরি করে (15.1নং ছবি)। আমরা কোনো কিছুকে উল্টো দেখি না কারণ দেখা নামের পুরো প্রক্রিয়াটা ঘটে মস্তিষ্কে। মস্তিষ্ক সেগুলো সামলে নেয়। চোখের মাঝে আলো এসে পড়া, অপটিক নার্ভ দিয়ে সেই অনভূতি মস্তিষ্কে গিয়ে পৌঁছানো মানেই কিন্তু দেখা নয়, এর মাঝে শেখারও একটা ব্যাপার আছে। নূতন জন্ম হয়েছে সে-রকম শিশুদের দেখলে সেটা বোঝা যায়, তারা ‘তাকায়’ কিন্তু তখনো দেখাটা শিখে উঠে নি তাই চোখের দৃষ্টিতে এক ধরনের শূন্যতা দেখা যায়। একটা শিশুর জন্মের পর যদি তার চোখ দুটো কালো কাপড় দিয়ে দীর্ঘদিনের জন্যে ঢেকে দেয়া হয় তাহলে একটা ভয়ংকর ব্যাপার ঘটবে। তার মস্তিষ্কের যে অংশটুকু দেখার কাজে ব্যবহার হয় সেখানে কোনো সংকেত না এলে মস্তিষ্ক সেই অংশটুকু অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে দেবে। যদি পরে চোখের কালো কাপড়টুকু খুলে দেয়া হয়, তাহলে চোখ থেকে অপটিক নার্ভ হয়ে অনুভূতিটুকু মস্তিষ্কে পৌঁছাতে শুরু করবে কিন্তু কোনো লাভ হবে না। মস্তিষ্কের যে অংশটুকুর দেখার কাজে ব্যবহার হবার কথা ছিল মস্তিষ্ক সেটা অন্য কাজে ব্যবহার করে ফেলেছে, কাজেই সে আর কোনোদিন দেখতে পাবে না। বিজ্ঞানীরা এই ধরনের নিষ্ঠুর পরীক্ষা করে এটা বের করেন নি, কোনো কোনো শিশু চোখের সমস্যা নিয়ে জন্মায়। সেই সমস্যাটি ধরা পড়তে এবং দূর করতে যদি কয়েক বছর সময় লেগে যায়। তাহলে দেখা যায় বাচ্চাটি আর দেখতে পারছে না।

    আমাদের দেখার জন্যে চোখের ভেতর আলো এসে পড়তে হয়। আলো হচ্ছে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ, এবং তরঙ্গ হলেই তার একটা তরঙ্গ দৈর্ঘ্য থাকে। তরঙ্গ দৈর্ঘ্য যদি মিটার খানেক লম্বা হয় তাহলে সেটাকে বলে রেডিও ওয়েভ, যদি হয় কয়েক এস্ট্রম (এক মিটারের দশ কোটি ভাগের এক ভাগ) তাহলে সেটাকে বলে এক্সরে। বলাই বাহুল্য সেগুলো আমরা চোখে দেখতে পাই না। সত্যি কথা বলতে কী বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের খুব ক্ষুদ্র একটা অংশ দেখতে পাই সেটা হচ্ছে 0.4 মাইক্রন (এক মিটারের এক মিলিওন ভাগের এক ভাগ) থেকে 0.7 মাইক্রন (15.2নং ছবি)। এর বাইরে কিছুই আমরা দেখতে পাই না। প্রকৃতি ঠিক কী কারণে এই ছোট্ট একটা অংশের জন্যে আমাদের চোখকে সংবেদনশীল করে রেখেছে এবং এর বাইরের কোনো কিছু আমরা দেখতে পাই না সেটা একটা রহস্যের মতো মনে হতে পারে। আসলে ব্যাপারটা একেবারেই রহস্যময় নয়। সূর্যের আলোর শুধুমাত্র এই অংশটুকুই সবচেয়ে ভালোভাবে পৃথিবী পৃষ্ঠে আসতে পারে, বাকি অংশটুকু বাতাসের জলীয় বাষ্পে শোষিত হয়ে যায়। এই শোষণটুকু ছোটখাট শোষণ নয়–প্রায় লক্ষগুণ শোষণ। কাজেই আমাদের চোখ যদি আলোর এই তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে সংবেদনশীল না হয়ে অন্য অংশে সংবেদশীল হতো তাহলে সবচেয়ে রৌদ্রোজ্জ্বল দিনেও পৃথিবীটাকে মনে হতো ঘুটঘুটে অন্ধকার!

    আলোর এই তরঙ্গ দৈর্ঘ্যই আসলে হচ্ছে রঙ। সবচেয়ে ছোট তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বেগুনি এবং সবচেয়ে বড় তরঙ্গ দৈর্ঘ্য হচ্ছে লাল। বেগুনির তরঙ্গ দৈর্ঘ্য থেকেও ছোট হলে আমরা সেটাকে বলি অতিবেগুনী আলট্রাভায়োলেট এবং লাল থেকে বড় হলে আমরা সেটাকে বলি অবলাল বা ইনফ্রারেড। অতিবেগুনী রশ্মি জীবাণু মুক্ত করার জন্যে ব্যবহার করা হয়, অবলাল রশ্মি ফাইবার অপটিক্স কমিউনিকেশান্সে ব্যবহার হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এর কোনোটাই আমরা চোখে দেখি না।

    সবচেয়ে ছোট তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বেগুনি এবং সবচেয়ে বড় তরঙ্গ দৈর্ঘ্য লালের ঠিক মাঝখানে হচ্ছে সবুজ। মানুষের চোখ সবচেয়ে বেশি সংবেদশীল হচ্ছে সবুজ রঙে (15.3 নং ছবি)। এজন্যেই সম্ভবত পৃথিবীর সবুজ গাছ দেখতে আমাদের এত ভালো লাগে! তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের সাথে মিল রেখে রঙগুলো যদি সাজাই সেগুলো হচ্ছে বেগুনি নীল সবুজ হলুদ কমলা এবং লাল। সূর্যের আলোতে এইসব রঙগুলোই আছে এবং যখন সব রঙগুলো মিশে থাকে আমরা আলাদাভাবে কোনো রঙই দেখতে পাই না। আলোটাকে বর্ণহীন বা সাদা আলো বলে মনে হয়।

    এখন আমরা মোটামুটি অনুমান করতে পারব কেন আমরা নানা রঙ দেখতে পাই। একটা ফুলকে যদি লাল মনে হয় তাহলে বুঝতে হবে সেই ফুলটা লাল রঙ ছাড়া অন্য সব রঙ শোষণ করে নিচ্ছে। ফুল থেকে শুধুমাত্র লাল রঙটি বিচ্ছুরিত হয়ে আমাদের চোখে আসছে। গাছের পাতাকে সবুজ (15.4 নং ছবি) মনে হওয়ার কারণ হচ্ছে পাতাটি সবুজ রঙ ছাড়া অন্য সব রঙ শোষণ করে নিচ্ছে। শুধুমাত্র সবুজ রঙটি গাছের পাতা থেকে আমাদের চোখে আসছে বলে সেটাকে মনে হচ্ছে সবুজ! যদি কোনো কারণে সবগুলো রঙই শোষণ করে নেয় তাহলে সেটাকে আমরা বলি কালো। যদি কোনো রঙই শোষণ করতে না পারে তাহলে সেটা হচ্ছে সাদা।

    এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে পৃথিবীতে রঙের কোনো অভাব নেই। আমরা বেগুনি নীল সবুজ হলুদ কমলা এবং লাল এই ছয়টি রঙের নাম বলেছি, এর কোনোটিই হঠাৎ করে শেষ হয়ে পরেরটা শুরু হয় না খুব ধীরে ধীরে একটি আরেকটির সাথে মিশে যায়। রঙগুলো আলাদাভাবে দেখা একসময় খুব কঠিন ছিল। নিউটন প্রিজম ব্যবহার করে রঙগুলো আলাদা করে সারা পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এখন আমাদের সবার কাছেই রয়েছে গান কিংবা কম্পিউটারের সিডি। তার মাঝে সূর্যের আলো ফেলে সেটাকে সাদা দেয়ালে প্রতিফলিত করলেই আমরা আসলে এই রঙগুলো দেখতে পাব। যারা কখনো দেখে নি তারা একবার যেন দেখে নেয়, প্রকৃতি কত রঙিন শুধু তাহলেই সেটা অনুভব করা যাবে!

    কাজেই আমাদের মনে হতে পারে দৃশ্যমান এই রঙগুলো তৈরি করা নিশ্চয়ই খুব কঠিন। টেলিভিশন কিংবা কম্পিউটারের মনিটরে আমরা এমন কোনো রঙ নেই যেটা দেখতে পাই না। সম্ভাব্য সবগুলো রঙ পেতে না জানি কতগুলো রঙ ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে এইসব রঙ তৈরি করতে আসলে শুধুমাত্র তিনটি রঙ ব্যবহার করা হয়। সেগুলো হচ্ছে লাল, সবুজ এবং নীল। যারা আমার কথা বিশ্বাস করে না তাহলে টেলিভিশন কিংবা কম্পিউটারের মনিটরের উপর সাবধানে এক ফোঁটা পানি দিয়ে দেখতে পার। পানির ফোঁটাটা একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস হিসেবে কাজ করবে এবং সেখানে পরিষ্কার দেখা যাবে তিনটি রঙ। কোন রঙ মিশে কোন রঙ তৈরি হয় সেটা 15.5 নং ছবিতে দেখানো হয়েছে। ছবিটা বোঝার জন্যে কল্পনা করে নেয়া যায় যে সাদা দেয়ালে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন আলোর টর্চ লাইট এমনভাবে ফেলা হয়েছে যেন সেগুলো একটা আরেকটার উপর পরে। এখানে লাল নীল আর সবুজ হচ্ছে প্রাইমারি রঙ। সেগুলো মিলে যে রঙ হয়েছে সেগুলো হচ্ছে সেকন্ডারি রঙ। যে জিনিসটা উল্লেখযোগ্য সেটা হচ্ছে তিনটি রঙই যখন সমানভাবে মিশে যায় তখন তৈরি হয় সাদা রঙ। রঙ মিশিয়ে এভাবে নূতন রঙ তৈরি করার পদ্ধতিটার নাম রঙের যোগ জাতীয় মিশ্রণ। এখানে একটা রঙের সাথে আরেকটা রঙ যোগ করা হয়।

    কেউ কেউ নিশ্চয়ই রঙের এই মিশ্রণ প্রক্রিয়াটি পরীক্ষা করার জন্যে তাদের জল রংয়ের বাক্স নিয়ে রঙ মিশিয়ে পরীক্ষা করতে চাইবে। তারা লাল এবং সবুজ রঙ মিশিয়ে নিলে অবাক হয়ে আবিষ্কার করবে যে সেটা মোটেও হলুদ না হয়ে কেমন জানি কালচে হয়ে গেছে। তার কারণ এভাবে রঙ মেশানো হলে সেটা যোগ জাতীয় মিশ্রণ হয় না সেটা হয়ে যায় বিয়োগ জাতীয় মিশ্রণ। তার কারণ জল রংয়ের ছোট ছোটকণাগুলো তখন পাশাপাশি থাকে না। তারা থাকে একটার উপর আরেকটা। সে কারণে তখন একটা রঙকে দেখতে হয় অন্য আরেকটা রঙের ভেতর দিয়ে অনেকটা রঙের ফিল্টারের মতো। প্রত্যেকটা ফিল্টার তখন তার নিজস্ব রঙ ছাড়া অন্য সব রঙ শোষণ করে নেয়। রঙের এই বিয়োগ জাতীয় মিশ্রণ দিয়ে কোন কোন প্রাইমারি রঙ দিয়ে কোন কোন সেকেন্ডারি রঙ তৈরি করা হয় সেগুলো 15.6 নং ছবিতে দেখানো হয়েছে।

    যারা ছাপা ছাপির কাজের সাথে যুক্ত তারা হয়তো জিজ্ঞেস করতে পারেন, যদি তিনটি রং দিয়েই সব রঙ তৈরি করা যায় তাহলে রঙিন ছবিকে ফোর কালার বা চার রঙা ছবি বলে কেন? কারণটি আর কিছুই না, রঙকে আরো ঝকঝকে বা স্পষ্ট করার জন্যে আলাদা করে কালো রঙটি ব্যবহার করা হয়।

    মজার ব্যাপার হচ্ছে কালো কিন্তু রঙ নয়। কালো হচ্ছে রঙের অভাব! যখন কোনো রঙ থাকে না সেটাই হচ্ছে কালো–সেটা কী আমাদের সব সময় মনে থাকে?

    .

    16. অটিজম

    কম্পিউটার নিয়ে কাজ করার সময় হঠাৎ করে মনিটরটি যদি নষ্ট হয়ে যায় তখন কী হবে? কী-বোর্ড এবং মাউস কাজ করছে বলে কম্পিউটারকে নির্দেশ দেয়া যাবে, তথ্য পাঠানো যাবে। সি.পি.ইউ.টি সবল রয়েছে বলে সেই নির্দেশ এবং তথ্য অনুযায়ী কম্পিউটার তার কাজও করতে থাকবে কিন্তু মনিটরটি নষ্ট থাকার কারণে আমরা তার কিছুই জানতে পারব না। কম্পিউটারটা কাজ করছে কিন্তু তার সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না, আমরা নিশ্চয়ই হতাশায় ছটফট করতে থাকব। এই হতাশা নিশ্চয়ই লক্ষগুণ বেড়ে যাবে যদি বিষয়টা একটা কম্পিউটারকে নিয়ে না হয়ে একটা মানুষকে নিয়ে হতো। আমরা যদি কখনো দেখি একজন মানুষ, আপাতঃদৃষ্টিতে তাকে বুদ্ধিমান মনে হচ্ছে–সে শুনতে পায়, দেখতে পায়, তার স্পর্শের অনুভূতি আছে, তার কথা বলার ক্ষমতা আছে কিন্তু কথা বলতে চায় না, কারো চোখের দিকে তাকায় না, নিজের ভেতরে একটা রহস্যময় জগতে আটকা পড়ে আছে শত চেষ্টা করেও তার মনের খোঁজ পাওয়া যায় না তাহলে তার চারপাশের মানুষের ভেতরে কী ধরনের হতাশার জন্ম নেবে সেটা কি আর ব্যাখ্যা করতে হবে? সারা পৃথিবীতেই এ ধরনের একটা রহস্যময় অবস্থার মানুষের খোঁজ পাওয়া গেছে, এই মানুষগুলোকে বলে অটিস্টিক (Autistic) এবং অবস্থাটির নাম অটিজম (Autism)। 1970 সালে হার্ভাডের শিশু হাসপাতালে যখন প্রথম একটি অটিস্টিক শিশুকে ভর্তি করা হয় তখন হাসপাতালের প্রধান সব ডাক্তারদের এই বলে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, “তোমরা সবাই এই রহস্যময় শিশুটিকে দেখে যাও, কারণ ভবিষ্যতে আর কখনো এ-রকম একজনকে দেখার সুযোগ পাবে না।” সেই বিখ্যাত শিশু হাসপাতালের প্রধান নিশ্চয়ই কল্পনাও করেন নি যে, তিন দশকের মাঝে সেই দেশে পরিসংখ্যান নিয়ে দেখা যাবে প্রতি 166 টি শিশুর মাঝে একটি শিশু অটিস্টিক। দরিদ্র বা স্বল্পোন্নত দেশে এ-রকম পরিসংখ্যান নেয়ার সুযোগ হয় না। যদি হতো তাহলে সংখ্যাটি এরকমই হতো বলে বিশেষজ্ঞেদের ধারণা। বর্তমান পৃথিবীতে এ-রকম বিপুল সংখ্যক অটিস্টিক শিশুর একটা বিস্ফোরণ কেন ঘটছে কেউ এর উত্তর জানে না।

    অটিজম এর বিভিন্ন স্তর রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই সেটা খুব মৃদু। কাজেই সেই অটিস্টিক শিশুটি হয়তো কষ্ট করে সমাজে টিকে থাকতে পারে। তার ভেতরকার যন্ত্রণার খবর কেউ কোনোদিন জানতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে অটিজম এত তীব্র যে, সেই শিশুটির পক্ষে স্বাভাবিক জীবন প্রায় অসম্ভব, সারাটি জীবন অন্যের সাহায্যের উপর তার নির্ভর করতে হয়। পৃথিবীতে এত বেশি অটিস্টিক শিশু রয়েছে যে, মোটামুটি নিশ্চিতভাবে বলা যায় আমরা সবাই কখনো না কখনো হয়তো এক-দুজন অটিস্টিক শিশু দেখেছি কিন্তু সেটা বুঝতে পারি নি। অটিস্টিক শিশুদের চালচলনে কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, যেমন তারা চোখাচোখি তাকাতে পছন্দ করে না, ক্রমাগত হাত নাড়ানো বা মাথা নাড়ানো এ ধরনের একটানা কোনো একটা কাজ করে যেতে থাকে। ছোট বাচ্চারা যে-রকম হইচই করে একসাথে খেলাধুলা করে অনেক সময়ই তারা এটা করতে চায় না, নিজের ভেতরে গুটিয়ে থাকে। একেবারে সহজ কাজটিও তাদের হাতে ধরে করিয়ে দিতে হয়। রুটিনবাঁধা জীবনে তারা অভ্যস্ত হয়ে যায় এবং সেই রুটিনের একটু উনিশ-বিশ হলেই তারা খুব বিচলিত হয়ে পড়ে। একটা ছোট অটিস্টিক শিশুকে দেখা যাবে সে একই ধরনের খেলনা ঠিক একইভাবে সাজিয়ে রাখছে এবং কেউ যদি সেটা একটুও পরিবর্তন করে তাহলে সে সেটা সহ্য করতে পারে না। কেউ কেউ ছোটখাট শব্দও সহ্য করতে পারে না, দুই হাতে কান চেপে ধরে রাখে। অনেক অটিস্টিক শিশু কথা বলতে পারে না, কেউ কেউ কথা বললেও সেটা হয় এক ধরনের সীমাবদ্ধ কথা। অনেক সময়েই দেখা যায় একটা শিশু একেবারে স্বাভাবিকভাবে বড় হতে হতে হঠাৎ করে অটিস্টিক হতে শুরু করেছে। সাধারণত তিন বছর বয়সের দিকে এই পরিবর্তনটি শুরু হয় এবং আর আগের অবস্থায় ফিরে আসে না। ঠিক কী কারণ কেউ জানে না একটি মেয়ের থেকে একটি ছেলের অটিস্টিক হবার সম্ভাবনা প্রায় চার গুণ বেশি।

    অটিজম কেন হয়, কীভাবে হয় বিজ্ঞানীরা এখনো বের করতে পারেন নি। সাধারণভাবে অনুমান করা হয় এর পেছনে একটা নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই, অনেকগুলো কারণ। খুব হালকাভাবে অটিস্টিক (যাকে হয়তো অমিশুক বা দুরন্ত শিশু হিসেবে ধরে নেয়া হয়) থেকে গুরুতর অটিস্টিক (যেখানে শিশুটি কিছুই করতে পারে না, একেবারে পুরাপুরি অচল) শিশু রয়েছে বলে আজকাল এ.এস.ডি. (অটিস্টিক স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার) শব্দটি ব্যবহার করা হয়, বোঝানো হয় এটি একেবারে নির্দিষ্ট এক ধরনের সমস্যা নয় এর ব্যাপ্তি বিশাল।

    অন্যান্য মানসিক বা মস্তিষ্কের সমস্যা থেকে অটিজমকে একটু আলাদা করে দেখা হয় তার একটা কারণ আছে। আনুমানিক একশ জন অটিস্টিক শিশুর ভেতরে এক দুজন শিশু বের হয়ে যায় যাদের এক ধরনের অসাধারণ ক্ষমতা থাকে। আমি একটি অটিস্টিক কিশোরকে দেখেছি তাকে যে কোনো তারিখ বলা হলে সেটি কী বার সে বলে দিতে পারে। শত শত বছরের হাজার হাজার দিনের ভেতর কোনটি কী বার সেটি একজন সাধারণ মানুষ কিন্তু কিছুতেই বলতে পারবে না। খুব সুন্দর ছবি আঁকতে পারে সেরকম অটিস্টিক শিশু রয়েছে। সঙ্গীতে অসাধারণ প্রতিভা এ-রকম অটিস্টিক শিশু রয়েছে। একবার শুনেই সুরটুকু পিয়ানোতে তুলে ফেলতে পারে এ-রকম অজস্র উদাহরণ। রয়েছে। এই ধরনের অটিস্টিক শিশুদের বলা হয় স্যাভান্ট (Savant)। রেইনম্যান নামে একটা ছায়াছবিতে ডাস্টিন হফম্যান এ-রকম একজন স্যাভান্টের অভিনয় করে বিখ্যাত হয়েছিলেন।

    যে শিশু, কিশোর বা মানুষটিকে আপাতঃদৃষ্টিতে বুদ্ধিহীন বা বোধশক্তিহীন বলে মনে হয় কিন্তু তার ভেতরে অসম্ভব ক্ষমতাশালী একটা মস্তিষ্ক লুকিয়ে আছে সেটি পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের খুব কৌতূহলী করে তুলেছে, তারা দীর্ঘদিন থেকে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করছেন। টাইম ম্যাগাজিনে 2006 সালের মে মাসে একটি অটিস্টিক কিশোরীর কথা ছাপা হয়েছে। কিশোরীটি কোনো কিছু শিখতে অক্ষম, লেখাপড়া দূরে থাকুক কথা পর্যন্ত বলতে পারে না। বাবা-মা অনেক চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে এই মেয়েটির জন্যে একটি অক্ষম অর্থহীন কঠিন জীবনের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মেয়েটির চিকিৎসক একদিন কৌতূহলবশত তাকে একটি বিশেষ ধরনের কম্পিউটারের কী বোর্ড ধরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি কিছু বলতে চাও?” অনভ্যস্ত হাতে মেয়েটি কী বোর্ড চাপ দিয়ে লিখল, “মা, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি!” সবাই একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন, কেউ ভুলেও ধারণা করে নি মেয়েটি কোনো ভাষা জানে! যখন বোঝা গেল এই বিশেষ কী বোর্ড দিয়ে সে বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করতে পারে তখন তার জন্যে একটি নূতন জগৎ উন্মুক্ত হয়ে গেল। কিছুদিনের ভেতর জানা গেল কিশোরী মেয়েটির রয়েছে ভাষার উপর অসম্ভব দক্ষতা, চমৎকার তার রসবোধ। দেখতে-দেখতে সে কলেজের এলজেবরা আর জীববিজ্ঞান পড়তে শুরু করল। এই মেয়েটির মস্তিষ্ক একজন মেধাবী মানুষের মস্তিষ্ক, শুধুমাত্র শুনে-শুনে সে অনেক কিছু শিখেছে কিন্তু কীভাবে অন্যের সাথে যোগাযোগ করতে হয় জানে না বলে কেউ সেই খোঁজ পায় নি। বিজ্ঞানীদের কাছে এখনো বিষয়টা একটা রহস্যের মতো। সৃষ্টি জগতের সবচেয়ে জটিল জিনিস হচ্ছে মানুষের মস্তিষ্ক, সেই মস্তিষ্কের রহস্যের মাঝেই লুকিয়ে আছে অটিজমের প্রশ্নের উত্তর।

    বিজ্ঞানীরা কিছু-কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে শুরু করেছেন। একসময় মনে করা হতো এটি বুঝি মস্তিষ্কের সেরেবেলাম নামক অংশের একটি ত্রুটি, এই অংশটি অনুভূতি এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নাড়াচাড়ার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে। এখন বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে, আসলে মস্তি ষ্কের ভেতরটুকু কিভাবে জুড়ে দেয়া হয়েছে সেটার অস্বাভাবিকতাই হচ্ছে অটিজমের কারণ। জন্মের সময় একজন অটিস্টিক শিশুর মস্তিষ্ক স্বাভাবিক আকারের হলেও দুই বছরের ভেতরে সেটি খুব দ্রুত বড় হতে শুরু করে। অনেক সময় দেখা গেছে চার বছরের একজন অটিস্টিক শিশুর মস্তিষ্কের আকার তেরো-চৌদ্দ বছরের একজন কিশোরের সমান। শুধু তাই নয়, মস্তি ষ্কের বিশেষ বিশেষ অংশ অন্য অংশ থেকে বড়। যেমন যে অংশটি দুশ্চিন্তা, ভয় বা এ ধরনের অনুভূতিটি নিয়ন্ত্রণ করে (এমিগডালা) সেই অংশটুকু আকারে বড় থাকার কারণে অনুমান করা হয় অটিস্টিক শিশুরা সম্ভবত সাধারণ শিশুদের থেকে বেশি ভয় বা দুর্ভাবনা অনুভব করে। যে অংশটুকু স্মৃতির জন্যে ব্যবহার করা হয় সেই অংশটুকুও আকারে বড়। বিজ্ঞানীরা অনুমান করেন অটিস্টিক শিশুদের মস্তিষ্ক যেহেতু স্বাভাবিক মানুষের মস্তিষ্কের মতো কাজ করে না তাই তাদের অনেক সময়েই স্মৃতির উপরে নির্ভর করে কাজ করতে হয়। স্মৃতির উপর বেশি নির্ভর করতে করতে সেই অংশটুকু তুলনার থেকে বেশি বিকশিত হয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা আরও কিছু কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় বের করেছেন, মস্তিষ্কে স্থানীয়ভাবে যোগাযোগ অনেক বেশি কিন্তু মস্তিষ্কের দূরবর্তী অংশের ভেতর যোগাযোগ তুলনামূলকভাবে কম। শুধু তাই নয় একজন স্বাভাবিক মানুষ বা শিশু যে কাজের জন্যে মস্তিষ্কের যে অংশ ব্যবহার করে অটিস্টিক শিশুরা তা করে না। যেমন সাধারণ মানুষ তাদের মস্তিষ্কের যে অংশ আকার আকৃতি বোঝার জন্যে ব্যবহার করে, অটিস্টিক শিশুরা সে অংশটি ব্যবহার করে অক্ষর বোঝার জন্যে। তাই আমরা যেভাবে একটা জিনিস বুঝি, যেভাবে চিন্তাভাবনা করি কিন্তু তারা বোঝে অন্যভাবে চিন্তাভাবনাও করে অন্যভাবে। তাদের ভাবনার জগৎটি কীভাবে কাজ করে সেটি আমরা এই মুহূর্তে কল্পনাও করতে পারি না।

    অটিস্টিক শিশুদের স্বাভাবিক একটা জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্যে নানা ধরনের চেষ্টা করা হয়। দেখা গেছে খুব শৈশবে যখন বোঝা যায় বাচ্চাটি অটিস্টিক তখন তাকে যদি বিশেষ পদ্ধতিতে চেষ্টা করা যায় তখন তারা অনেকাংশেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বাভাবিক স্কুলে গিয়ে পড়তে পর্যন্ত পারে। এধরণের একটি স্কুলে আমার একবার যাবার সুযোগ হয়েছিল। যে বিষয়টি প্রথমেই চোখে পড়ে সেটি হচ্ছে তাদের বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। মানুষের সাথে সামাজিকভাবে যোগাযোগ করার খুব সাধারণ বিষয়টুকু আমরা করি অনায়াসে। এই শিশুগুলোর জন্যে সেটি অসম্ভব কঠিন একটি কাজ, তাই সেই বুদ্ধিদীপ্ত চোখের পিছনে লুকিয়ে থাকা মেধাবী, প্রতিভাবান, কৌতুকপ্রিয় সৃজনশীল হাসি খুশি মানুষটিকে আমরা বুঝতে পারি না।

    বিজ্ঞানীরা একদিন এই রহস্যের জটাজাল উন্মুক্ত করবেন আমরা সবাই তার জন্যে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগাব্বু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    Next Article ইস্টিশন – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    Related Articles

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    ছোটগল্প – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সাদাসিধে কথা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মেকু কাহিনী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    আমার বন্ধু রাশেদ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সায়েন্স ফিকশান সমগ্র ১ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    টুনটুনি ও ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }