Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    একটু উষ্ণতার জন্য – বুদ্ধদেব গুহ

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প406 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৯-১০. ছুটির একটা চিঠি

    কালকের ডাকে ছুটির একটা চিঠি এসেছিল।

    ছুটি লিখেছিল, আপনি লিখেছেন যে আমার তৈরি সোয়েটার গায়ে দিলেই আপনার মনে হয় যে আমি আপনাকে দুহাতে জড়িয়ে আছি। এ কথা ভাবতেই ভালো লাগছে। আমি এবার থেকে প্রতি বছর আপনাকে একটা করে সোয়েটার বুনে দেব, আমি যেখানেই থাকি না কেন। আপনি কেমন আছেন, আগের থেকে ভালো কি না, খুব জানতে ইচ্ছে করে।

    কাল আমাদের অফিস বন্ধ ছিল, কোম্পানির হেড অফিসের একজন ডিরেক্টর মারা যাওয়ার জন্যে।

    এরকম হঠাৎ-ছুটিগুলো বেশ লাগে। কলিগরা অনেকেই দল বেঁধে সিনেমা দেখতে গেল। এখানে রাজেশ খান্না-শর্মিলা ঠাকুরের একটা জমজমাট ছবি হচ্ছে। আমি যাইনি। আমারও একজন রাজেশ খান্না আছে, যে ম্যাটিনী আইডলের চেয়ে অনেক সত্যি, অনেক কাছের। কি? নেই?

    হঠাৎ ছুটি পেয়ে খুব ভালো করে চান করলাম, তারপর ঘর গুছোতে বসলাম।

    বইগুলোতে এমন ধুলো পড়ে যে, বলার নয়।

    বই ঝাড়তে ঝাড়তে বইয়ের তাক থেকে আপনার লেখা তিন-চারটে বই বেরিয়ে পড়লো। আপনি নিজে হাতে লিখে দিয়েছেন আমার নাম। এসব বই আমি মনে ধরে কাউকে পড়তে দিতে পারি না। বইয়ের পাতায় পাতায় কত চেনা ঘটনা, কত হারিয়ে-যাওয়া স্মৃতি ঝিলিক মারে, আর আমি অমনি ভাবতে বসে যাই, কত কী ভাবি, কত কি!

    বারে বারেই মনে হয়, আপনি আমাকে কত কি দিয়েছেন কিন্তু বদলে আমার আপনাকে দেওয়ার মত কিছুই নেই, যা আছে, তার দাম অতি সামান্য।

    আমি আপনাকে যা দিতে পারি তা যে-কোনো মেয়েই হয়ত দিতে পারে। অন্তত আমার ত তাই মনে হয়। অথচ আপনি আমাকে যা দিয়েছেন, প্রতিনিয়ত যা দেন, তা আমি পৃথিবীর অন্য কোনো পুরুষের কাছ থেকে পেতাম না। মাঝে মাঝে ভগবানের কাছে আমার অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা জানাই, জানাই এ জন্যে যে, এ জন্মে কোনো এক আশীর্বাদ-স্বরূপ আপনাকে পেয়েছিলাম, সেই প্রাপ্তির জন্যে স্বাভাবিক কারণে আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।

    আমি একজন সামান্য মেয়ে। আমি ভগবান মানি, এই চাঁদে-পাড়ি দেওয়া যুগেও। আমি অনেক ভেবে দেখছি, আমার যা আছে আপনাকে আমি সবই সহজ সমর্পণে দিতে পারি। আমি চিরদিনই আপনার। আমি নিশিদিনই আপনাকে ভালোবাসি, আপনার কখন সময় হবে সেই অপেক্ষায় আমি ক্ষণ গুনি।

    আমার সম্বন্ধে আপনার এখনও কি দ্বিধা আছে কোনো? এখনও কি আপনি বোঝেননি, আপনি জানেননি, পুরোপুরি আমাকে?

    আপনার আত্মবিশ্বাস এত কম কেন?

    আপনার চিঠি পড়ে আমার ভালো লাগেনি। আপনি আমার চোখে কি, তা আপনি কখনও জানেননি, তাই নিজের সম্বন্ধে অহেতুক দ্বিধা প্রকাশ করে নিজেকে আমার কাছে ছোট করেন।

    অমন আর কখনও করবেন না।

    আপনি কি মনে করবেন জানি না, মাঝে মাঝে রমাদির জন্যে আমার খুব কষ্ট হয়। কষ্ট হয় এই ভেবে যে, যা তাঁর একান্ত ছিল, তাঁর সর্বস্ব ছিল, তা ধীরে ধীরে আমার হস্তগত হচ্ছে। এতে হয়ত আমার জয়ের আনন্দ বোধ করা উচিত ছিল স্বাভাবিক কারণে, কিন্তু সত্যি বলছি, এতে আনন্দের বদলে এক গভীর দুঃখ বোধ করি আমি।

    আমি জীবনে কাউকে ঠকাতে চাইনি, নিজের সুখের জন্যে ত নয়ই। হয়ত এই বাবদেই আপনার চরিত্রের সঙ্গে আমার সবচেয়ে বড় মিল।

    আপনিও ত দেখলেন যে, আপনি কাউকে ঠকান আর নাই-ই ঠকান, আপনার দুঃখ আপনাকে পেতেই হয়।

    আপনি লিখেছিলেন যে, রমাদির ব্যবহার আপনার আত্মবিশ্বাসের মূলে এক দারুণ আঘাত হেনেছে। আপনার মনে হয়, আপনি যেন কখনও কোনো মেয়ের ভালোবাসা পাবেন না, যেমন করে আপনি চান, যা আপনি চান; তা।

    এ কথা আপনার ভুলে যাওয়া উচিত। যতদিন না এই নির্গুণ নিরূপ মেয়েটির চেয়ে আরো ভালো কেউ, যোগ্য কেউ এসে আপনাকে ছিনিয়ে নিচ্ছে ততদিন আপনি আমার। রমাদি যদি তাঁর প্রাপ্তির অমর্যাদা করে থাকেন ত, তিনি নিজেকেই ঠকিয়েছেন, এতে আপনার মনোবেদনার কারণ কি তা ত আমি বুঝতে পারি না।

    আমার দুঃখ এই যে, আমার ম্যাটেরিয়াল যোগ্যতা যদি আরো বেশি থাকত, অন্তত হাজারখানেক টাকা মাইনে পেতাম কোথাও যদি, তাহলে আপনাকে কোর্ট-কাছারি ছাড়িয়ে শুধুমাত্র লেখকে পর্যবসিত করতাম। আমি আপনার কাছ থেকে কিছুই চাইতাম না–শুধু আপনার চাওয়ার দিকে মুখ করে দিন গুনতাম।

    আমার বেশ একটা ছোট্ট ছিমছাম কোয়ার্টার থাকত–একফালি বারান্দা থাকত কাছেপিঠে বড় বড় মেহগিনী গাছ থাকত শীতের রোদে মেহগিনীর পাতা কাঁপত–আপনি শাল গায়ে দিয়ে বসে চশমা-নাকে একমনে লিখতেন আর আমি আপনাকে আড়াল থেকে দেখতাম–দেখতাম, আর গর্বে মরে যেতাম। আমার এ জন্ম সার্থক হত।

    একজন লেখকের অনুপ্রেরণা হবার চেয়ে মহত্তর আর কিছু হবার কথা আমার মত সামান্য একজন মেয়ের ভাবনার বাইরে। এর চেয়ে বড় সার্থকতা একজন নারীর জীবনে আর কি হতে পারত?

    আসলে রমাদির মত অত লেখাপড়া জানা, অত ডাই-হার্ড মেয়েকে বিয়ে করা আপনার উচিত হয়নি।

    কিছু মনে করবেন না, রমাদিকে হাসপাতালের ডাকসাইটে মেট্রন বা কোনো কলেজের প্রলয়ংকরী প্রিন্সিপাল হলে মানাত। রমাদিরা কোনো পুরুষকে নির্ভর করে তার জন্য বাঁচতে শেখেননি। তাঁরা যেহেতু শিক্ষিতা, যেহেতু তাঁরাও মাস পোয়ালে মোটা অঙ্কের চেক নিয়ে বাড়ি ফেরেন, তাঁরা ভাবেন তাঁরা বুঝি পুরুষের সমকক্ষ!

    আমার কিন্তু চিরদিন মনে হয় এ ভাবনাটা ভুল। ঘরের বাইরে আমাদের বিদ্যাবুদ্ধির যতই বড়াই থাক না কেন, ঘরের মধ্যে পুরুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামাটা মূর্খামির কাজ। প্রাকৃতিক নিয়মেই আমরা জীবনের সব নরম ক্ষেত্রে পুরুষের পরিপ্রেক্ষিতে প্যাসিভ রোলেই অভিনয় করি। আপনারা ভালোবাসতে জানেন, আমরা ভালোবাসা গ্রহণ করতে জানি। এমনকি আমাদের সবচেয়ে বড় গর্ব, মাতৃত্বের সমস্ত গর্বও আপনাদেরই দান-নির্ভর। ঘরের মধ্যে অথবা শয্যালীন হয়ে যে মেয়ে পুরুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে চায়, তার কপালে দুঃখ অবশ্যম্ভাবী। আমি এ যুগের মেয়ে হয়েও এ কথা জোর গলায় বলতে ভয় পাই না। আমি গোঁড়া নই, আমি প্রাচীন-পন্থী নই, (নই যে তার প্রমাণ হয়ত আপনি পেয়েছেন) তবু আমি বলব যে, আমি একজন মেয়ে এবং সেই সুবাদেই আমার স্থান কোথায় তা আমি জানি। ভাগ্যক্রমে আমাদের স্থান এত সুবিন্যস্ত যে, যে-সব মেয়ে সেই উচ্চাসন থেকে নেমে এসে পুরুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে গার্হস্থ্য পরিবেশ অসহনীয় করে, তাদের বোকা না বলে পারি না।

    আর কিছু লিখব না। অনেক এক্তিয়ার বহির্ভূত কথা বলে ফেললাম। হয়ত এত কথা কলমের ডগায় আসত না, যদি না আমি রমাদিকে ভালোবাসতাম। আমি জানি, আমি আপনাকে ভালোবাসি বলে রমাদির অনেক অত্যাচার আপনার সহ্য করতে হয়। কিন্তু তাতে আমার জেদই যে বাড়ে, আপনাকে পুরোপুরি করে পাওয়ার ইচ্ছেই যে আরো তীব্র হয়, এ কথা রমাদি বুঝলে আরো ভালো করতেন। আপনাকে আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি, আপনি ডাইভোর্স পান কি না.পান অথবা পেতে চান কি না চান, তাতে আমার কিছুই আসে যায় না। আমি শুধু জানি যে, আপনি আমার; আমার একান্ত। আপনি বিশ্বাস করেন কি না জানি না, কিন্তু সুকুদা, আপনাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। আমি যতদিন বাঁচব আপনার পাশে থাকব। আপনার মনের পাশে; আপনার শরীরের পাশে। বদলে আমি কিছু চাই না। আমি স্বাবলম্বী। আমাকে আপনার খাওয়াতে-পরাতে হবে না, আমার কোনো জাগতিক দায়িত্ব নিতে হবে না; আমার সন্তানের বাবা বলে পরিচয় দিতেও হবে না। বাৎসল্য রস আমার নেই। আমি বড় স্বার্থপর। আমার শরীর, আমার জীবন, আমার সুখ, মনের সুখ, আমার শরীরের সুখকে আমি বড় ভালোবাসি।

    আমি আমার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে ভালোবাসি, আমি অনেক অনেকদিন বাঁচতে চাই। শুধু আমার এই আপনাকে ঘিরে যা ইচ্ছা তা আমাকে এ জন্মে সফল করতে দিন। আপনার কাছে আমার শুধু এইটুকুই প্রার্থনা।

    সমাজকে আমি ভয় করি না। আমি কাউকে ভয় করি না। আপনাকে আমার করে পাবার জন্যে আমার সমস্ত সামাজিক সম্পর্ক আমি ছিন্ন করতে রাজি।

    ভাবাবেগের বশে এ সব কথা বলছি না। এ আমার বহু বছরের ভাবনালব্ধ কথা। এ কথা লেখবার আগে আমি অনেক অনেক দিন ভেবেছি। আমার কাছে জীবন এক দারুণ আনন্দময় অনুভূতি–এই আনন্দে আমার নরম লাজুক মন আমার অনেক বিপদ-আপদ ও শ্বাপদের হাত থেকে বাঁচিয়ে-রাখা অনাঘ্রাত অনভিজ্ঞ নারীশরীর সবাই সোৎসাহে ভাগ নেবে।

    আপনার জীবনের আমাকে শুধু অংশীদার করুন।

    আগে থাকতে দেবার মত মূলধন আমার কিছু নেই; আমাকে আপনার জীবনের ওয়ার্কিং পার্টনার করে নিন–শেষবেলায় দেখবেন, জীবনের ব্যালান্সশিটের পাতাগুলি ভারী হয়ে উঠেছে পাওয়ার পুঁজিতে। আমার জীবন, আমার জীবন সম্বন্ধে উচ্ছ্বাস, আমার বাঁচার তাগিদই আমার একমাত্র মূলধন। এই মূলধন আমি আপনাতে লগ্নী করতে চাই–সুদ ছাড়াই, কোনোরকম শর্ত ছাড়াই।

    কি? নেবেন না? আমাকে নেবেন না আপনি?

    –ইতি, আপনার পাগলী ছুটি।

    চিঠিটা পড়ে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকলাম।

    এবারে ছুটি যখন এসেছিল তখন ওর মুখ ও হাবভাব দেখে ওকে খুবই ডেসপারেট বলে মনে হয়েছিল–আজ ওর চিঠির মধ্যে ওকে সম্পূর্ণভাবে দেখা গেল।

    কি করব আমি জানি না। আমি জানি না আমার কি করা উচিত। রমার প্রতি আমার অভিযোগের অন্ত নেই, হয়ত রমারও আমার প্রতি অনেক অভিযোগ আছে। হয়ত কেন, নিশ্চয় আছে।

    হয়ত আমার দোষ ওর চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু আমি এখনও ওকে ভালোবাসি। একে ঠিক ভালোবাসা বলা উচিত কি না জানি না, হয়ত এটা কর্তব্যবোধ, হয়ত এটা অনেকদিন একসঙ্গে থাকতে থাকতে যে যুক্তিহীন মমতা জন্মায় অন্যের প্রতি, তাই। হয়ত এ আমাদের একমাত্র ছেলের প্রতি, তার ভবিষ্যতের প্রতি মমত্ববোধ।

    হয়ত আমাদের মতই আরো লক্ষ লক্ষ বিবাহিত দম্পতি এমনি করে দাম্পত্যের অভিনয় করে চলেছেন, ক্লাবে, পার্টিতে, সামাজিক উৎসবে। সকলের সামনে ভাব দেখাচ্ছেন। কত প্রেম। হাসছেন, একে অন্যকে ডার্লিং বলছেন, তারপর বাড়ি ফিরে এয়ার কন্ডিশনড বেডরুমে মোটা ডানলোপিলোর গদির উপর দুটি প্রাণহীন মোমের মূর্তির মতো দুজন দুদিকে শুয়ে থাকছেন। গায়ে গায়ে লেগে থেকেও হাজার মাইল ব্যবধানে আছেন।

    কিন্তু কেন? কেন আমার সাহস হয় না, আমার জোর আসে না হৃদয়ে এই মিথ্যে সম্পর্ক ছিঁড়ে ফেলার? জীবন কি সত্যিই এত অবহেলার জিনিস? জীবন তো একটাই–একবারই আসে। তবে সে জীবনও আমরা নিজেদের ইচ্ছা নিজেদের সাধ অনুযায়ী ভোগ করতে পারি না কেন?

    এখনও পরিষ্কার মনে পড়ে সেসব দিনের কথা। আমি তখন লিঙ্কনস্ ইন-এ। আমার এক ইংলিশ বন্ধু স্টিভের বাবার কান্ট্রি-হাউসে ডে-স্পেন্ড করার নেমন্তন্ন ছিল এক রবিবার। সেখানে সুইমিং পুলের পাশে উইলো গাছের নোয়ানো ডালের নীচে প্রথম দেখেছিলাম কলকাতার নরম মেয়ে রমাকে। প্রথম দেখাতেই দারুণ ভালো লেগেছিল। সবচেয়ে প্রথমে যা চোখে পড়েছিল তা রমার মিষ্টি ব্যবহার ও ওর ফিগার।

    ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের ফিগার সম্বন্ধে আমার ভীষণ একটা ভীতি ছিল। হয়ত অতিমাত্রায় রোম্যান্টিক ছিলাম বলে। অনেক দিন পর্যন্ত খারাপ ফিগারের মহিলাদের মহিলা বলে স্বীকার করতেই চাইতাম না। আমার মাইডিয়ার জ্যাঠামশায় (যাঁর কাছে আমি ছোটবেলা থেকে মানুষ, আমার মা-বাবার একসঙ্গে প্লেন-ক্র্যাশে মৃত্যুর পর থেকে) বলতেন, সুকু, তোর এত ফিগার-ফিগার বাতিক কেন?

    কেন তা ছিল, আমি নিজেও তা বুঝিয়ে বলতে পারতাম না। আজও পারি না। হয়ত মেয়েদের আমি ফুল, প্রজাপতি, হলুদ বসন্ত পাখিদের মত ভালোবাসতাম বলে, হয়ত মেয়েদের সঙ্গে প্রকৃতির, প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতির এবং সঙ্গতির সঙ্গে সৌন্দর্যের একটা ওতপ্রোত ও অঙ্গাঙ্গি সম্বন্ধ খুঁজতে চাইতাম বলে।

    জানি না, কেন? কিন্তু নিজেদেরই অযত্নে ও অবহেলায় যারা অসুন্দরী সে-সব মেয়েদের উপর খুব রাগ হত তখন। ভগবান মুখ, চোখ, গায়ের রঙ এসব সকলকেই সমান দেন না। কিন্তু যাকেই যা দেন না কেন, যা দিয়েছেন তাকে সুন্দর করে সযত্নে রাখতে, নিজেদের অন্যের চোখে সুন্দরভাবে প্রতিভাত করতে যে মেয়েরা পারত না, জানত না, তাদের উপর আমার একটা অহেতুক বোকা-বোকা নিষ্ফল ছেলেমানুষী রাগ ছিল।

    রমার ফিগার দেখে আমার ওকে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বলে মনে হয়েছিল–সে সংজ্ঞার পরিপূরক হয়েছিল ওর লাজনম্র শান্ত ব্যবহার।

    মেয়েরা যদি মেয়েসুলভ না হয় তাহলে আমার তাদের মেয়ে বলে স্বীকার করতেও আপত্তি ছিল।

    কিছুদিন মেলামেশার পর দেশে আমার কোনো রকম সম্পত্তি নেই, হাইকোর্টের ব্যারিস্টার পাড়ায় মামা-মেসো কেউ নেই, সমস্ত জানার পরও বিত্তশালিনী, রূপবতী উচ্চশিক্ষিতা রমা আমাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। তাই একথা আমার বলা অন্যায় হবে যে ও আমাকে ভালো না বেসে আমার পটভূমিকে ভালোবেসেছিল; কারণ কোনো সামাজিক বা আর্থিক পটভূমি আমার ছিলো না।

    সেদিন ও হয়ত সুকুমার বোস মানুষটাকেই ভালোবেসেছিল।

    রমার কোর্স শেষ হল, আমি ব্যারিস্টার হলাম। তারপর দুজনে একসঙ্গে দেশে ফিরলাম বিয়ের এক বছর পরে।

    এখানে এসে প্রথম চার-পাঁচ বছর রমা চাকরি করেছিল। ভালো চাকরি। আমার জন্মদিনে, আমাদের ছেলে রুণের জন্মদিনে রমা নিজের রোজগারে ঘটা করে পার্টি দিত। যা ছুটি জানে না, তা হচ্ছে, রমা গত দুবছর হল চাকরি ছেড়ে দিয়েছে।

    ও চাকরি করুক তা আমার কোনো দিনও ইচ্ছা ছিল না। ওকে বলেছিলাম নিজে একটা পলি-ক্লিনিক করতে–তাতে নিজেও ব্যস্ত থাকবে এবং দশজনের উপকারও হবে। কিন্তু ও শোনেনি।

    এখন পিছন ফিরে তাকালে মনে হয়, যা ঘটেছে তার দোষটা সম্পূর্ণই আমার।

    অথচ তবুও পুরোপুরি নিজেকে দোষী করতে পারি না।

    আমার অপরাধ এই যে, জীবনে আমি বড় হতে চেয়েছিলাম, আমার বাবা ছোটবেলায় বলতেন, দশজনের মধ্যে একজন হতে হবে তোমায়। দশজনের মধ্যে একজনই হতে চেয়েছিলাম আমি, চেয়েছিলাম যেখানে যাব সেখানে সবাই আমায় সম্মান করবে, সবাই আমাকে চিনবে, জানবে। হাইকোর্টে আমি নাম করতে চেয়েছিলাম।

    বিয়ের পর পর দেশে ফিরে এসে আমার ছিপছিপে সুন্দরী গুণবতী স্ত্রী পায়ে পায়জোর পরে, নাকে শখ করে নথ পরে, দারুণ সাজে সেজে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলত, তোমাকে কিন্তু ডিস্টিঙ্গুইসড হতে হবে।

    বড় হতে চেষ্টা করতে লাগলাম। সকালে লাইব্রেরিতে বসে ঠিক দশটায় কোর্টে বেরিয়ে বিকেলে ফিরে কোনো রকমে একটু চা খেয়ে আবার লাইব্রেরিতে গিয়ে বসতাম। উঠতে উঠতে দুটো-তিনটে হয়ে যেত রাত।

    দাঁতে দাঁত চেপে বলতাম, আমাকে বড় হতে হবে। আমার সিনিয়র পাইপ-মুখে বলতেন, ইউ মাস্ট বার্ন অল দা ব্রিজেস বিহাইন্ড। বুঝলে সুকুমার, প্রফেশান ইজ আ জেলাস মিসট্রেস। তোমার স্ত্রীও নয়। মিসট্রেস্। একটু হেলা করেছ কি অন্যের ঘরে গিয়ে পৌঁছবে।

    আমি যখন শুতে যেতাম তখন আমার সুন্দরী যুবতী স্ত্রী শুকিয়ে যাওয়া ফুলের মত ঘুমিয়ে থাকত। আমারও শরীর বলে একটা জৈবিক ব্যাপার ছিল। মাঝে মাঝে সেটা স্বাভাবিক কারণে ক্ষুধার্ত বোধ করত। কিন্তু তখন রমাকে ঐ অবস্থায় দেখে সেই জৈবিক ব্যাপারটাকে চাবুক মেরে স্লিপিং-স্যুট পরে শুয়ে পড়তাম।

    আমার খুব খারাপ লাগত। রমাকে সঙ্গ দিতে পারতাম না, ওকে নিয়ে একদিনও সিনেমায় যেতে পারতাম না, কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানেও না। রমা তখন যে কি করে দিন কাটাতো আমি এখনও ভেবে পাই না। ওর কথা ভাবলে এখনও খুব কষ্ট হয়।

    কিন্তু দোষ কি আমারই একার? রমা যদি বলত, তোমাকে ডিস্টিঙ্গুইসড হতে হবে না–বলত, তুমি নাম নাই বা করলে, তুমি সাধারণ হও, মোটামুটি রোজগার করো, কোর্ট থেকে ফিরে সামান্য কাজ করে তারপর আমায় নিয়ে বেড়াতে যেও–কোনোদিন ক্লাবে, কখনও বাপের বাড়িতে, কখনও কোথাওই না, শুধু গাড়ি করে একটু ঘুরে আসবার জন্যে। কিন্তু জানি না, বললেও কি পারতাম! পুরুষরা কি কাজে সফল না হয়ে বাঁচতে পারে?

    কিন্তু যা হবার তা হয়ে গেছে। শুধু প্রফেশনাল কাজ করলেও না হয় হত, আমি তার উপরে লেখক হতে চাইলাম।

    টাকা আমি কোনোদিনও চাইনি। চেয়েছিলাম যশ, চেয়েছিলাম মান। আর প্রফেশানের এমনই মজা যে, নাম যদি কারো হয়ই, তখন টাকা এমনিতেই আসে–টাকাটা তখন ইনসিডেন্টাল হয়ে যায়। আমি বড় হলাম, আমার নাম হল, আমার টাকা হল, অথচ জীবনে আমি যা সবচেয়ে চেয়েছিলাম সেই সবকিছুই আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেল। আজ আমার মত নিঃস্ব রিক্ত কেউ নেই।

    আমার দোষ নেই; রমারও দোষ নেই।

    কিন্তু হারিয়ে গেল।

    এই অল্পবয়সে অনেক নাম হল, অনেক টাকা হল, কিন্তু আমার অনেকানেক বন্ধু যারা বোকার মত নাম করতে চায়নি, তারা আমার চোখের সামনেই আমার চেয়ে অনেক সুখী হল। তারা কোম্পানির গাড়িতে পাঁচটায় বাড়ি ফিরে, বগলে সুগন্ধি সাবান ঘষে চান করে, তাদের হাতকাটা ব্লাউজ পরা সুখের বুদবুদ-তোলা স্ত্রীদের নিয়ে ফুলফুল হাওয়াই শার্ট গায়ে দিয়ে সিনেমা অথবা ক্লাবে যেতে পারল প্রায় রোজই।

    রমা বোধহয় আমাকে বড়ও হতে বলেছিল–সেই সঙ্গে আবার আমার বন্ধুদের মতই হতে বলেছিল। ঐ ডাবল স্ট্যান্ডার্ড রাখা আমার মত সাধারণ লোকের পক্ষে সম্ভব হল না। কর্মজীবনের, লেখক-জীবনের প্রথম কয়েক বছর আমার নিজের কোনো অধিকার ছিলো না আমার উপর। আমি তখন মক্কেলদের, প্রকাশকদের। আমার নিজের উপর কোনো দাবী ছিলো না আমার।

    হঠাৎ, একেবারে হঠাৎই একদিন আবিষ্কার করলাম যে, আমার সুন্দরী ছিপছিপে স্ত্রী একেবারে কর্পূরের মত উবে গেছে। সে যেন কী রকম হয়ে গেছে, অন্য কেউ হয়ে গেছে। অথচ তার কোনো রকম অসুখ ধরা পড়ল না।

    নার্সিংহোমে এক মাস থাকল, তবুও কিছু ধরা পড়ল না।

    ও যখন নার্সিংহোমে চেক-আপের জন্যে থাকত তখন ওকে রোজই একবার কোর্ট-ফেরতা দেখে আসতাম। তখন মাঝে মাঝে সীতেশের সঙ্গে দেখা হত। সীতেশ ইংলন্ডে গেছিল চাটার্ড এ্যাকাউন্ট্যান্সী পড়তে। পরীক্ষায় পাশ না করতে পেরে, ইন্টিরিয়র ডেকরেশনে একটা কোর্স করে ফিরে এসেছিল। বড়লোকের ছেলে, বাপ-ঠাকুর্দার অনেক পয়সা ছিল, ওন্ড আলিপুরে বাড়ি ছিল, তা ছাড়া ছেলেটা ছোটবেলা থেকেই ছবি-টবি ভালোই আঁকত। ওর কানেকশানও খুব ভালো ছিল। সীতেশ বেশ ভালো ব্যবসা করছিল।

    নার্সিংহোমে ওর স্ত্রী ছিলেন, ডেলিভারির জন্যে। সেই সুবাদে বহুদিন পর ওর সঙ্গে দেখা হতে আলাপটা আবার ঘন হল।

    এক সময়ে সীতেশের স্ত্রী বাড়ি চলে গেলেন কিন্তু সীতেশের নার্সিংহোমে আসা বন্ধ হলো না।

    একদিন কোর্টে লাঞ্চের আগে আমার কোনো মামলা ছিলো না। মেনশান করার কাজ ছিল কয়েকটি–সে ভার জুনিয়রদের উপর দিয়ে আমি রমার নার্সিংহোমে গেলাম সাড়ে দশটা নাগাদ।

    হঠাৎ গিয়ে পড়তে দেখি, সীতেশ বসে আছে রমার হাতে হাত রেখে।

    সীতেশ খুব স্মার্ট–হেসে বলল, রুগীর হাত ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, হাত গরম করে দিচ্ছি।

    আমি বললাম, খুব ভালো, বেচারী ত সব সময়ই একা থাকে, ওকে ত আমি কখনোই কম্পানি দিতে পারি না, তুই যে দিচ্ছিস সে জন্যে আমি কৃতজ্ঞ।

    আমার চোখের দিব্যি আমার সেদিনের সে কথায় কোনো শ্লেষ, কোনো ভণ্ডামি বা মিথ্যা ছিলো না। আমি সত্যি সত্যিই যা বলেছিলাম তাই-ই বুঝিয়েছিলাম।

    মনে মনে হয়ত সেদিন থেকে আমি সাবধান হতে আরম্ভ করেছিলাম। সেই দিনই প্রথম আমি কোলকাতার সবচেয়ে বড় সলিসিটরকে ফোন করে বলেছিলাম, আমাকে কম করে ব্রিফ পাঠাতে, সেদিন থেকে আমি বিশ মোহর ফী বাড়িয়ে দিয়েছিলাম যাতে আমার জীবনের সমস্ত সুখের বিনিময়ে যেন মক্কেলদের না পেতে হয়।

    কিন্তু মানুষের মন এক দুর্জ্ঞেয় জিনিস।

    ব্রিফ সহজে বোঝা যায়, কোর্টে জজসাহেবদের মেজাজ বোঝা যায়, বিরোধী পক্ষের উকিলের প্রতিটি মুভ এন্টিসিপেট করা যায়; যা বোঝা যায় না, অন্তত আমি যা বুঝতে পারলাম না, তা রমার মন।

    আমার যতটুকু অপারগতা, ঘাটতি, সমস্তটুকু সম্বন্ধেই আমি সম্পূর্ণ সচেতন ছিলাম সব সময়ে, মনে এবং মুখে সব সময়েই তা স্বীকার করতাম। তবু রমা আমাকে ক্ষমা করল না।

    যে-দোষ ক্ষমা করা যেত, সে দোষের জন্যে আমাকে চরম শাস্তি দিল।

    ইতিমধ্যে আমি কিন্তু বদলে ফেলেছিলাম নিজেকে। ভীষণভাবে চেষ্টা করছিলাম বদলে ফেলার। কোর্ট থেকে বাড়ি ফিরেই কাজে বসতাম না। যাতে রমার সঙ্গে বসে চা খেতে পারি, আমার সুমাতা সুগন্ধি স্ত্রীর মুখোমুখি বসে একটু গল্প-গুজব করতে পারি সেই চেষ্টা করতাম। রাতেও ডিনারের সময় ও তার পরে রাত নটা থেকে সাড়ে দশটা অবধি কাজ করতাম না। যাতে ধীরে-সুস্থে ডিনার খেতে পারি, ডিনারের পর ইচ্ছে করলে এবং রমার ইচ্ছে হলে রমাকে আদর করতে পারি।

    কিন্তু তখন আমার এই পুনর্মূষিক হবার ইচ্ছা, নিজের কাছে নিজে ফিরে আসার সব ইচ্ছাই বিফল হল। বোধহয় খুব দেরি হয়ে গেছিল।

    বোধহয় দেরী হয়ে গেলে আর নিজের কাছে, নিজের স্ত্রীর কাছে, নিজের ঘরে আর কখনোই ফেরা যায় না।

    প্রায়ই মক্কেলদের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করে রমার সঙ্গে চা খাব, গল্প করব বলে উপরে উঠে এসে শুনতাম রমা ওর আকাশী-নীল হেরাল্ড চালিয়ে বেরিয়ে গেছে।

    কোথায় গেছে, কেউ তা জানে না। ছেলের আয়া জানে না, বাবুর্চি জানে না, বেয়ারারা জানে না।

    যদি কখনও বলতাম, কোথায় যাও না যাও একটু বলে যেও-কখন কি দরকার হয়

    কে বলতে পারে?

    রমা উত্তরে ঝাঁঝালো গলায় বলতো, বলব না কোথায় যাই, কেন? তুমি কি আমাকে সন্দেহ করো?

    সন্দেহ করিনি কখনো কারণ যদি আমার স্ত্রীর আজ আমাকে পছন্দ না হয় সেই জানাটাই আমার কাছে যথেষ্ট অপমানের। তাই সন্দেহ করে নিজেকে আরো ছোট করতে চাইনি। সন্দেহ হত না; যা হত তা দুঃখ। নিদারুণ দুঃখ। একজনকে সুখী না করতে পারার দুঃখ। অথচ জীবনে নিজের জন্যে আমি কিছুই করিনি–যা করেছি, যতটুকু করেছি, জেঠিমা-জ্যাঠামশায়, রমা, আমার ছেলে, তাদেরই সুখের জন্যে। আমার সময়, আমার বিশ্রাম, আমার সব আনন্দের বিনিময়ে যাতে এদের সকলের ভালো হয়, সকলের সুখ হয়, সেই ভাবনায় সমস্ত সময় ব্যয় করেছিলাম।

    মনে পড়ছে, একদিন খাওয়ার জন্যে রাতে উপরে এসেছি। সেদিন ভীষণ গরম গেছিল। টানটান করে বসবার ঘরে ডিভানে হেলান দিয়ে বসে বসে ঘুমিয়ে পড়েছি। রমা আসবে, এলে একসঙ্গে খাব, এই জন্যে অপেক্ষা করতে করতে।

    অনেক রাতে বেয়ারা এসে আমাকে ডেকে তুলল, বলল, সাহেব, লাইব্রেরি কি বন্ধ করে দেব?

    আমি বললাম, কটা বাজে?

    বারোটা।

    বৌদি আসেনি এখনও।

    হ্যাঁ! বৌদি এসে খেয়ে-দেয়ে শুয়ে পড়েছেন।

    আমার সেদিন এমন এক দুঃখ-মিশ্রিত রাগ হয়েছিল যে, সে বলার নয়। ইংরাজিতে বলে না, এনাফ ইজ এনাফ, আমার তাই মনে হয়েছিল।

    শোবার ঘরে গিয়ে দেখলাম, রমা বেড-লাইট জ্বালিয়ে শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে।

    আমি বললাম, তুমি আমার সামনে বাইরে থেকে এলে, দেখলে আমি ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছি, তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি; তবু একবার জিগগেস করতে পারলে না আমি খেয়েছি কি না খেয়েছি, আমার শরীর খারাপ হয়েছে কি না? বললাম, বাড়ির কুকুর-বেড়ালের প্রতিও ত মানুষের এর চেয়ে বেশি সহানুভূতি থাকে।

    রমা বলল, কেন করব? তোমার জন্যে আমার কোনো ফিলিং নেই। তোমার সম্বন্ধে আমার কোনোই ইন্টারেস্ট নেই। কিছুই আর নেই। তোমাকে আমার ভালো লাগে না।

    সেদিনের পর থেকে আর কখনও রমাr সঙ্গে খাওয়ার কথা বলিনি আমি। আমি এখন লাইব্রেরিতে খাই, বেয়ারা খাবার নিয়ে আসে। বিকেলের চাও তাই খাই।

    রমার প্রতি সমস্ত রকম দায়িত্ব ও কর্তব্য ছাড়া আর কিছু আজ করণীয় নেই। অথচ করতে আমি চাই সব কিছুই ভালোবাসতে চাই, ভালোবাসা পেতে চাই। এখনও।

    এত কাজ, এত টাকা, এত খ্যাতির মাঝেও বড় শীতার্ত লাগে–স্ত্রীর কাছে একটু বসে, তার চোখের দিকে চেয়ে, তার সুগন্ধি গ্রীবায় আলতো করে একটু চুমু খেয়ে, তার কবোষ্ণ বুকের রেশমী স্বস্তিতে একটু মুখ ঘষতে ভারী ইচ্ছা করে।

    কিন্তু আজ বহুদিন, বহু বছর রমা আমার কাছে পর্যন্ত আসে না, আমাকে শেষ আমার স্ত্রী কবে চুমু খেয়েছে ভালোবেসে, তা ভাবতে গেলে স্পষ্ট মনে পড়ে না। আমার শরীরের সব আর্তি, আমার মনের সব উষ্ণতা আমায় দিনের পর দিন একা একা বয়ে বেড়াতে হয়।

    এভাবে, ঠিক এভাবে একজন বাঙালি গোবেচারা ভদ্রলোকই বেঁচে থাকতে পারে, জীবনের প্রতি পদক্ষেপে গুরুজন, লঘুজন, সকলের অন্যায় ব্যবহার সহ্য করে প্রতি মুহূর্তে নিজের একটা মাত্র একবারের মাত্র জীবনকে মর্মান্তিকভাবে নষ্ট করে তারাই প্রশ্বাস নিতে পারে, নিঃশ্বাস ফেলতে পারে।

    এর নাম কি বাঁচা? সব দিক দিয়ে নিজেকে এর চেয়ে বেশি করে কি ভাবে ঠকানো যেতে পারে?

    অথচ টাকা আমার রোজগার করতেই হবে। পান থেকে চুন খসলে চলবে না। সব কিছুই চাই। সব জাগতিক কিছু। অথচ তার বদলে কারো কাছে আমার পাওনা ছিলো না কোনো কিছু।

    প্রায় বছর তিনেক হল রমার সঙ্গে কথা কাটাকাটি হলেই রমা বলত, তোমার সঙ্গে আমার কোনো কথা নেই, আমি তোমাকে ডিভোর্স করব, যে ভালো, যে আমাকে ভালোবাসে, আমি তার সঙ্গে থাকব। এ সব বলত চাকর-বাকরদের সামনেই।

    আমি বলতাম, আমি ত তোমাকে দয়া করে এখানে থাকতে বলিনি। তুমি মুক্ত, তুমি এই মুহূর্তে যেখানে দুচোখ যায় চলে যেতে পারো। যা করো, যা করবে, তা শুধু ডিসেন্টলি কোরো। কত লোকেরই ত ডিভোর্স হয়–ডিভোর্স ত গ্রেসফুলিও হতে পারে।

    কিন্তু রমা ডিভোর্স আমাকে করবে না। অথচ আমার সঙ্গে যে-অমানুষিক দুর্বোধ্য অত্যাচার করার, তা করেই যাবে।

    আশ্চর্য! ওকে কিছুতেই বুঝতে পারি না।

    এখনও আমি ওকে খারাপ ভাবতে পারি না, এখনও মনে হয় ও কোনো ভুল করছে, কোনো সর্বনাশে ভর করে ও এমন বিনা-দোষে বিনা কারণে আমার সঙ্গে এরকম করছে। তাই এখনও ওকে ত্যাগ করার কথা ভাবতে পারি না। আমার এখনও ভাবতে কষ্ট হয় যে ওর প্রতি আমার কোনো ফিলিং নেই কারণ আমি এখনও ওকে ভালোবাসি। তা ছাড়া রুণের কথাও ভাবতে হয়।

    আমার জীবনের ঠিক এমনই নিরুপায় অন্ধ আঁধির সময়ে ছুটি আমার জীবনে খস-আতরের গন্ধ মেখে এসেছিল, তাকে ঠেকানো যায়নি। সে নিজের দাবীতেই আত্মপ্রকাশ করেছিল।

    রমা কোনোদিন বুঝতে চায়নি, বোঝেনি যে আমি ব্যারিস্টার হলেও আমি একজন লেখকও। বোঝেনি যে একজন লেখকের জীবন কখনোই একজন সাধারণ লোকের মত হতে পারে না। তারা সাধারণের মতো হয় না। তারা অসম্ভব অনুভূতিপ্রবণ হয়, তাদের কল্পরাজ্যে অনেক ভাবনা ছেঁড়া-মেঘের মত আসে যায়। তাদের কোনো-না-কোনো অনুপ্রেরণার দরকার হয়ই লিখতে গেলে।

    অথচ আমি কিন্তু আমার কেজো সত্তা ও লেখক সত্তাকে আশ্চর্যরকমভাবে দুটো পাশাপাশি ঘরে বন্দী করে রেখেছিলাম–ওয়াটারটাইট কম্পার্টমেন্টে–। সওয়াল করা মানুষটার এবং গৃহী মানুষটার সঙ্গে লেখক মানুষটার কোনো সংঘাত ছিল না।

    রমার জীবনে আমি গৃহী ও সাধারণ মানুষ, সাধারণ একজন কৃতী স্বামী হিসেবেই পরিচিত ছিলাম। পরিচিত হতে চেয়েছিলাম।

    রমা তাতেও সন্তুষ্ট না হয়ে আমার কল্পলোকের নায়িকাদের নিয়ে পড়ল। গল্পে যাই লিখি না কেন, আমার সম্পূর্ণ কল্পিত নায়িকারা যেরকমই হোক না কেন, প্রত্যেককে ও চিনে ফেলতে লাগল। মানে ও মনে করতে লাগল ও চিনে ফেলেছে। ও কখনও বুঝতে চাইল না, নায়িকারা লেখকের মনের মধ্যেই থাকে–কোনো রক্ত-মাংসের মেয়ে হয়ত সেই মেয়ের ছায়ায় প্রতিফলিত হয় অথবা তার মুখ চিবুক তার চরিত্র হয়ত সেই কল্পনার নায়িকার মধ্যে সংক্রমিত হয় মাত্র।

    এমন একটা অবস্থা হল যে, আমি যা করি তাই ওর কাছে খারাপ লাগতে লাগল।

    কোনো পার্টিতে গিয়ে কম কথা বললে, বাড়ি ফিরে ও বলত, তুমি এত দাম্ভিক কেন? গোমড়ামুখে রামগরুড়ের ছানা হয়ে থাকলে কি তুমি মনে করো তোমাকে ভালো দেখায়?

    যদি বা কখনো কথা বলতাম, হাসতাম, সহজ হতাম, লোককে মজার কথা বলে হাসাতাম, ও বাড়ি ফিরে বলত, তুমি এত ছ্যাবলা কেন? সব জায়গায় গিয়েই কি তোমার ভাঁড়ামো করতে হবে?

    আসলে, আমার সমস্ত অস্তিত্বটাই একটা অনস্তিত্বে পৌঁছে দিয়েছিল রমা। এমন কি কোর্টে দাঁড়িয়ে সওয়াল করার সময়েও আজকাল আমার মনে সংশয় জাগত বোধহয় জজসাহেবদের ইমপ্রেস করতে পারছি না। লিখতে বসলে, কেবলি মনে হত বোধহয় লেখাটা ভালো হচ্ছে না–যাঁরা পড়বেন, তাঁরা বোধহয় আমাকে বুঝবেন না–তাঁরাও বোধহয় রমার মত আমাকে নস্যাৎ করে দেবেন। কোথাও কোনো সুন্দরী মেয়ে হঠাৎ মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমার মুখে তাকালে আমার ভয় হত, লজ্জা হত; আমি মুখ নামিয়ে নিতাম। আমার দুকান লাল হয়ে গরম হয়ে যেত। আমার মন বলত ও চাউনি ফেরত দিও না-তোমার মধ্যে ভালো লাগার মত কিছুই নেই। তোমাকে কারোই ভালো লাগবে না। তুমি জীবনের রেসে খোঁড়া ঘোড়ার মত বাতিল হয়ে গেছ চিরদিনের মত।

    আমার জীবনের সেই দুর্দৈবদিনে ছুটি কালবৈশাখীর ঝড়ে ওড়া সুগন্ধি আম্রমুকুলের মত রাশ রাশ নরম আশায় আমার জীবন ভরে দিল।

    ভেবেচিন্তে না বললেও, বলল যে আমাকে ওর ভালো লাগে, ডাকসাইটে উকিল হিসেবে নয়, বাড়ি-গাড়ির মালিক হিসেবে নয়, একজন নিছক পুরুষমানুষ হিসেবে, একজন স্বল্পপরিচিত নতুন লেখক হিসেবে।

    সেদিন আমার মনে হয়েছিল আমার লেখা যদি আর কেউ নাও পড়েন, যদি কখনও এ লেখা কারো ভালো লাগার মত নাও হয়, তবুও মাত্র একজনের ভালো-লাগার জন্যেও আমার কষ্ট করেও লেখা উচিত। শুধু ছুটির জন্যেই লেখা উচিত।

    লেখা মাত্রই কষ্ট করে লিখতে হয়। এমন কোনো লেখা, সত্যিকারের ভালো লেখা নেই, যা কষ্ট না পেয়ে এবং কষ্ট না করে লেখা যায়। কিন্তু আমার কষ্টটা অন্য কষ্ট। ওকালতী করতে করতে লেখাটা আরো বেশি কষ্টের। নিজের নিজস্ব অবকাশের বিনিময়ে লেখা। তাই ও লেখা খারাপ হলে, যাদের জন্যে লেখা, তাঁদের খারাপ লাগলে, সে বড় মর্মান্তিক।

    যখন কোথাও কোনো আশা ছিলো না, হৃদয়ে, আমার নরম লজ্জানত লতার মত কোমল হৃদয়ে, যখন কাঁটার বন গজিয়ে উঠেছিল, যখন মানুষ কেন বাঁচে, বাঁচার মানে কি জীবন বলতে কি বোঝায়, এ সব কথার একটাই নীরেট অন্ধকার উত্তর আমার সামনে ছিল–সে উত্তর ছিল আত্মহত্যা–ঠিক সেই সময় ছুটি, আমার চেয়ে অনেক ছোট ছুটি একটা হলুদ তাঁতের শাড়ি আর কালো ব্লাউজ পরে বেণী ঝুলিয়ে এক রবিবার আমার সঙ্গে আলাপ করতে এল–তার ভালো-লাগার লেখককে দেখতে।

    তারপর কোথাও কিছু একটা ঘটে গেছিল আমার মধ্যে হয়ত ছুটির স্বপ্নময় মুঠি-ভরা বুকের মধ্যেও যার ব্যাখ্যা আমি জানি না।

    একটা আচ্ছন্ন আকূতি বোধ করেছিলাম সেদিন, অন্ধকার নিচ্ছিদ্র কারাগারের মধ্যে বসে, আলোয়-ভরা আকাশের দিকে বুঝি হঠাৎ চোখ পড়েছিল।

    ছুটি তার ছোট্ট মুখে ধীরে ধীরে আমাকে অনেক বড় বড় কথা শুনিয়েছিল।

    ওর চেয়ে বয়সে অনেক বড় হয়েও সেসব কথা আমি আগে বিশ্বাস করতাম না। সেসব কথা আগে হয়ত অনেকের কাছে শুনেছিলাম, অনেক বইয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু অন্তরের মধ্যে কখনও তা গ্রহণ করিনি। যদি কেউ কিছু বলে এবং যাকে তা বলা হয় তারা যদি একই ওয়েভ-লেংথে ভাবের আদান-প্রদান না করে তাহলে সে কথা বুঝি বিফল হয়।

    হয়ত কারো অভিশাপে আমার ও রমার এই ওয়েভ-লেংথের গণ্ডগোল হয়ে গেছিল। ও যখন মিডিয়াম-ওয়েভে ওর যা বলার বলেছিল, আমি তখন শর্ট-ওয়েভে কান পেতে ছিলাম। আমি আবার যখন কিছু বলব বলে মিডিয়ম ওয়েভের মাউথপীসের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম তখন রমা সেই রিসিভারের কাছ থেকে হয়ত সরে গেছিল।

    রমার সঙ্গে যদি বা কখনও মিটমাটের সম্ভাবনা ছিল, ছুটি আমার জীবনে আসার পর সে সম্ভাবনা আরো ক্ষীণ হয়ে গেল।

    আমার কোনো উপায় ছিলো না। রমার জন্যে আমি দীর্ঘদিন প্রতীক্ষা করেছিলাম, ও আবার ওর পুরানো মনের ঘরে ফিরে আসবে বলে। অনেক বিবাগী হিয়াই বাহির পথে অনেক কিছুর খোঁজে যায়; কিন্তু খোঁজা শেষ হলে আবার সেই সুখের পুরানো ঘরেই ফিরে এসে ছেঁড়া আসন পেতে দুয়ার দিয়ে বসে।

    আমি ভেবেছিলাম রমাও তাই ফিরবে।

    কিন্তু রমাও বুঝি আমারি মত ভীষণ দেরি করে ফেলল–যে খোলা দরজাটি দিয়ে সে বেরিয়ে গেছিল সেই দরজা দিয়েই ছুটি অবলীলায়, সম্মানের সঙ্গে তার সরল ঋজুতায় ও ছেলেমানুষী সততায় ভর করে আমার মনে প্রবেশ করল। আমার শীতের রাতগুলি, আমার একঘেয়ে আনন্দহীন দিনগুলি হঠাৎ এক চঞ্চল আনন্দঘন বাসন্তী উষ্ণতায় ভরে গেল।

    আমার আবার বাঁচতে ইচ্ছা করল নতুন করে। পৃথিবীর অন্য কোনো লোকের অন্যায় মর্জি ও খেয়াল-খুশির উপর যে আমার বেঁচে থাকা-না-থাকা নির্ভরশীল নয়, ছুটিই তা আমাকে শেখাল। আমাকে বোঝাল যে, এ জগতে কেউই কাউকে কিছু নিজে থেকে দেয় না–যা পাবার তা নিজের অধিকারে শক্ত হাতে সুপুরুষের মত কেড়ে নিতে হয়। শেখাল যে আমাকে শুধু আমার নিজের জন্যে আমার একার জন্যেই বাঁচতে হবে। আমার জীবন আমার নিজের কাছে সবচেয়ে দামী। ও আমাকে স্বার্থপর হতে বলল।

    অগ্নিসাক্ষী করে কাউকে কোনোদিন বিয়ে করেছিলাম বলেই, কাউকে সমস্ত উষ্ণতায় ভরা হৃদয় দিয়ে একদিন ভালোবেসে ছিলাম বলেই যে আমার সেই নিবে-যাওয়া যজ্ঞের আগুনে সেই ডিপ-ফ্রিজে-রাখা কোঁকড়ানো ঠাণ্ডা হৃদয়ের কবরে বাকি জীবন হাহাকারে কাটাতে হবে একথা ঠিক নয়।

    ছুটিই বলেছিল, এখনো কাউকে নতুন করে ভালোবাসা যায়, এখনো হিম-হয়ে যাওয়া হৃদয়ে তাপ সঞ্চারিত হতে পারে, এখনও আকাশ-ভরা আলোর মত নম্র নতুন কারো উষ্ণ নরম নগ্ন নির্জন হাতে হাত রাখার যোগ্যতা অর্জন করা যেতে পারে।

    কখন অনবধানে তখন বলে ফেলেছিলাম, আমি আবার নতুন করে বাঁচব ছুটি। তোমার হাত ধরে আমি আবার বাঁচব।

    আমার বড় শীত করে ছুটি, আমার ভীষণ শীত করে। তুমি আমাকে একা ফেলে কোথাও যেও না, তুমিও আমাকে ধুলোয় ফেলো না, তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই ছুটি, তুমি ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না। আজ তুমিই আমার শেষ অবলম্বন।

    যে লোকটা একা একা বাঁচতে চাইত, প্রশ্বাস নেওয়া ও নিঃশ্বাস ফেলাকেই বাঁচা বলে জানত, সে লোকটা মরে গেছে।

    এখন সে তার জীবনে আবারও একান্ত পরনির্ভর।

    ছুটি তুমি সেই দয়ার, ভালোবাসার, ভালো ব্যবহারের কাঙাল মানুষটাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চল। তোমাকে ছাড়া আমি কারুকে জানি না, কারুকে মানি না; কারুকে জানতে চাই না।

    তুমি কি শুনতে পাচ্ছ ছুটি? ও ছুটি; তুমি আমার এই অন্তরের একান্ত কথা কি শুনতে পাচ্ছ? সব কথাই কি মুখে অথবা লিখেই জানাতে হয়, এক হৃদয়ের কথা শব্দতরঙ্গে ভেসে কি অন্য হৃদয়ে পৌঁছায় না? যদি নাই-ই পৌঁছায় ত কিসের ভালোবাসায় বিশ্বাস করি আমরা, কিসের আন্তরিকতা আমাদের?

    তুমি আমার এই এলোমেলো একরাশ নীরব স্বগতোক্তি নিশ্চয়ই শুনতে পাচ্ছ। পাচ্ছ না ছুটি? ছুটি?

    .

    ১০.

    একদিন সকালে লাবু এসেছিল।

    লাবু বলল, আমাদের বাড়ির দিকে যাবেন? আপনাকে একটা জিনিস দেখাব।

    আমি বললাম, আগে রসগোল্লা খাও, তারপর যাব।

    লাবু অত্যন্ত আপাত-আপত্তিসহকারে গোটা আষ্টেক রসগোল্লা খেল। তারপর বলল, দাদাকে বলবেন না যেন আমি রসগোল্লা খেতে চেয়েছিলাম।

    আমি বললাম, তুমি ত খেতে চাওনি। আমিই তোমাকে সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম তুমি কি খেতে ভালোবাস। তোমার এতে দোষ কি? আর তুমি না আমাকে দাদা বলো। দাদার কাছে যদি আবদারও করতে, তাতেও বা দোষের কি ছিল।

    লাবু বলল, জানেন সুকুদা, এই পাহাড়ে আমার বাবা ভালুক শিকার করেছিলেন।

    বললাম, তোমার বাবাকে তোমার মনে আছে?

    মনে নেই। আমার কিছুই মনে নেই। আমি ত তখন দু বছরের ছিলাম যখন বাবা হঠাৎ অসুখে মারা যান। আমি মার কাছে গল্প শুনেছি।

    পলাশ, কেঁদু, জংলীঘাস ও শাল-সেগুনের জঙ্গলে বেশ কিছুক্ষণ যাওয়ার পর কতগুলো আম ও পেয়ারাগাছের ঝুপড়ির আড়ালে একটা জরাজীর্ণ দুকামরা বাড়ি চোখে পড়ল। দূর থেকে।

    বাড়িটা প্রায় ভেঙে পড়েছে।

    দরজা-জানালা যে-কোন সময়ে খুলে পড়ে যেতে পারে। বাইরের বারান্দার একটা পাশ চট দিয়ে ঘেরা। মহুয়া–গত বছরে ভোলা মহুয়া ডাঁই-করা আছে এক কোণায়, তার পাশে খোঁটায় বাঁধা একটা লাল-রঙা বাছুর বড় বড় চোখ মেলে পায়ের উপর মুখ রেখে শুয়ে আছে।

    লাবু সেই বারান্দায় একটা হাতল-ভাঙা কাঠের চেয়ারে আমাকে বসতে বলে বলল, বসুন সুকুদা, আমি মাকে ডেকে আনছি।

    আমি বললাম, তুমি আমাকে কি যেন দেখাবে বলেছিলে?

    লাবু ওর ভাঙা দাঁত বের করে সরল লাজুক হাসি হাসল, হেসে বলল, দেখাব; দেখাব। আপনি ত এক্ষুনি পালাচ্ছেন না।

    আমাকে বসিয়ে রেখে লাবু চলে গেল।

    চারিদিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম।

    দারিদ্র্য চতুর্দিকে বাত্ময় হয়ে রয়েছে। দারিদ্র্য মানে, চরম দারিদ্র্য!

    জানি না কি করে ওদের দিন চলে। হয়ত এই রকম জায়গা বলেই এখনো চলে, কোনরকমে চলে–কোলকাতার মত কোন নিষ্ঠুর নির্দয় জায়গা হলে হয়ত এতদিনে এদের চলা থেমে যেত।

    চারিদিক থেকে ঘুঘু ডাকছে। বাড়ির পিছনের জঙ্গল থেকে গরু ডেকে উঠল : বোঁয়াও। কোথায় কে যেন কাঠ কাটছে–তার শব্দ পাহাড়ের তলা অবধি গাছে গাছে প্রতিধ্বনি তুলে ছড়িয়ে যাচ্ছে। এক দল ছাতারে বাড়ির হাতার পিটীস ঝোপের বাইরে বেরিয়ে এসে শীতের রোদে সভা বসিয়েছে।

    চারিদিকে নিবিড় শান্তি, স্তব্ধ সৌন্দর্য, তার মাঝে এই জরাজীর্ণ বাড়ি। বাড়ির মধ্যে লাবু থাকে তার মা ও দাদাকে নিয়ে। এ বাড়িতে বর্ষায় ওরা কি করে থাকে ভাবছিলাম। ভাবতেও অবাক লাগছিল।

    দরজার দুপাশে অযত্নবর্ধিত দুটি লতানে গোলাপের গাছ। ছোট ছোট সাদা ফুল ধরেছে তাতে। একজোড়া বুলবুলি ফিসফিস করে কি যেন বলতে বলতে তাতে দোল খাচ্ছে।

    ওখানে বসে নিজের ভাবনার মধ্যে নিজে কখন বেহুঁশ হয়ে গেছিলাম খেয়াল ছিল না।

    হঠাৎ লাবুর গলা শুনলাম, সুকুদা, এই যে আমার মা।

    আমি উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করলাম।

    ভদ্রমহিলা তাঁর তোরঙ্গের কোণা থেকে বের করা ভাঁজ-ভাঙা ন্যাপথলিনের গন্ধ ভরা সবচেয়ে ভালো কাপড়খানি পরে এসেছিলেন।

    বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। আগুনের মত গায়ের রঙ এক সময় ছিল–এখন রোদে-জলে-ঝড়ে তামাটে হয়ে গেছে। তবু চেহারার মধ্যে আভিজাত্যের ছাপ সুস্পষ্ট।

    আভিজাত্য বুঝি সহজে মুছে যায় না–তার রঙ বড় পাকা-রোদ জল, দুঃখ-দারিদ্র্য, কিছুই পারে না সেই রঙকে স্নান করতে–যদি অন্তরে দারিদ্র্য না থাকে।

    উনি বললেন, বসো বাবা বসো। লাবুর কাছে তোমার অনেক গল্প শুনেছি। সেদিন তুমি মান্দার থেকে লাবুর জন্যে মিষ্টি পাঠিয়েছিলে তা পেয়েছিলাম। লাবু তোমার খুব ভক্ত হয়ে গেছে।

    আমি বললাম, ডাবু কোথায়?

    সে ত স্কুলে গেছে। সেই ভোরে বেরিয়ে যায়-পাঁচ মাইল পথ–আবার স্কুল সেরে ফিরতে সন্ধ্য। ফিরে এসেও বাড়ির কাজ করতে হবে। আমার অসুখ হলে রান্না-বান্না সব ওই করে।

    তারপর বললেন, আমার লাবুও কিন্তু অনেক কাজ করে। না করলে চলবে কি করে বল? ওদের কপালে ছিল কষ্ট করা, কষ্ট করতেই হবে, যতদিন না ওরা মানুষ হয়, নিজেদের পায়ে নিজেরা দাঁড়ায়। আমি নিজের সুখের আশা আর রাখি না। ওরা যদি বড় হয়ে একটু সুখের মুখ দেখে এই ভেবেও আমার ভালো লাগে।

    বললাম, লাবুর বাবা এখানে কি করতেন?

    উনি খিলাড়ির সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন। সে সময়ে এই বাড়ি বানিয়েছিলেন উইকএন্ডে এসে পিকনিক করার জন্যে, ছুটি কাটাবার জন্যে। তখন ত ভাবিনি যে উইক-এন্ডে ছুটি কাটানোর আস্তানায় সারাজীবন কাটাতে হবে।

    এই অবধি বলেই উনি বললেন, বসো বাবা, তোমার জন্য একটু চা করে আনি।

    আমি বললাম, আমি তো চা এক্ষুনি খেয়ে এলাম।

    তা না হয় খেয়েই এলে, এই প্রথমবার আমার বাড়িতে এলে, একটু কিছু না খেলে হয়।

    তারপর যাবার সময় বললেন, লাবু, ততক্ষণে তোমার দাদাকে তোমার বাবার ছবিগুলো দেখাও।

    লাবু একটু পরে একটা রুপোর পানের ডিবে নিয়ে এল। বেশ বড় সাইজের ডিবে–ধুলো পড়ে রুপোর রূপ আর কিছু অবশিষ্ট নেই তার।

    ডিবি খুলে আমার হাতে দিয়ে, লাবু বলল, এই যে ছবি দেখুন সুকুদা। তারপরই অনেকগুলো ছবি ঘেঁটে লাবু একটা ছবি বের করে বলল, এটা আমার অন্নপ্রাশনের ছবি, দেখুন আমি কেমন গোল ছিলাম।

    দেখলাম একটি বাচ্চা ছেলে সোনার মুকুট মাথায় দিয়ে তার সুন্দরী যুবতী মায়ের কোলে বসে আছে। চতুর্দিকে সুবেশা আত্মীয়াদের ভিড়। বিরাট প্যান্ডেলের পটভূমিতে লাবুবাবু মায়ের কোলে চড়ে তার অন্নপ্রাশনের দিনে ভীষণ কাঁদছেন।

    আমি বললাম, আরে, তোমাকে ত চেনাই যায় না, তুমি ত দারুণ ফর্সা আর গোলগাল ছিলে।

    লাবু সগর্বে ও সলজ্জে বলল, হ্যাঁ।

    লাবুর বাবার ছবি দেখলাম।

    লম্বা-চওড়া সুপুরুষ ভদ্রলোক। সিডান-বড়ি গাড়ির পাশে, স্যুট পরে অফিসে বসে কাজ করছেন। কোনোটা বা শিকারের পোশাকে; বন্দুক-হাতে ছবি।

    উনিশশ সাতচল্লিশের পরই পূর্ব বাঙলার রিফিউজিরা তাঁদের কখনও পূর্ব বাংলায় কিছু যে ছিল একথা বললেই, পশ্চিমবঙ্গীয় স্থায়ী বাসিন্দারা যেমন অনেকেই তা শ্লেষের সঙ্গে অকারণে অস্বীকার করতেন, এই ছবিগুলো প্রমাণস্বরূপ না থাকলে লাবুদের অতীতকেও বোধহয় সকলে তেমনি অক্লেশে অবিশ্বাস করত।

    অন্তত বেশির ভাগ লোকই করত।

    তা-ই বোধহয় এত যত্ন করে ছবিগুলোকে রাখা–কেউ এলেই প্রথমেই তাকে ছবিগুলো দেখানো–তাকে মিনতি করে চোখের ভাষায় বলা যে, আজ যা দেখছ এইটেই সত্যি নয়–আমরা আগে অন্যরকম ছিলাম।

    টাকা-পয়সা স্বচ্ছলতা এ সব নাকি কিছুই নয়। আজ আছে কাল নেই। অথচ স্বচ্ছলতা থাকা আর না থাকায় কতবড় তফাত। স্বচ্ছলতা থাকার সময় অস্বচ্ছলতার গ্লানি ও ক্লেশের কথা ভাবাও মুশকিল। সে কথা মনেও পড়ে না।

    বসে বসে ফটোগুলো নাড়তে-চাড়তে ভাবছিলাম, রমা এ দিকটাও কখনো ভাবে না। ভাবার প্রয়োজন মনে করে না কারণ লাবুর মার কাছে যেমন, রমার কাছেও তেমন, স্বচ্ছলতাই বড় কথা।

    লাবুর মা স্বচ্ছলতার জন্যে লাবুর বাবার উপর নির্ভরশীল ছিলেন। রমা আমার উপর তা নয়। সে নিজের রোজগারে নিজে খেতে পারে, সে কোনো ব্যাপারেই আমার উপর নির্ভরশীল নয়। আমি তার জন্যে কিছুমাত্র করিনি, আর যে কিছু করব সে ভরসাতেও ও বসে নেই। ইদানীং এ কথাটা সে কারণে-অকারণে আমাকে বহুবার শোনায় যে, ইচ্ছা করলেই আমি যা রোজগার করি তার চেয়ে অনেক বেশি গুণ সে রোজগার করতে পারে।

    মাঝে মাঝে মনে হয়, রোজগার করাটাই কি দাম্পত্য জীবনের সিমেন্টিং ফ্যাক্টর? লাবুর মার রোজগার করার ক্ষমতা নেই বলেই কি আজও লাবুর বাবার অভাব উনি এমনভাবে বোধ করেন? তাঁর মৃত্যুর পর ওঁদের অবস্থা এতটা অস্বচ্ছল না হলে কি সহজেই উনি তাঁর স্বামীকে ভুলে যেতেন? জানি না। হয়ত যেতেন।

    তা-ই যদি হয় তাহলে ভালোবাসা কি? ভালোবাসা বলে কি কিছুই নেই?

    আজকাল মনে হয় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সব বদলে গেছে। অথবা আমার সঙ্গে আমার স্ত্রীর সম্পর্কটা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে আমার একারই বুঝি এই সম্পর্কটা সম্বন্ধে অত্যন্ত সন্দেহ উপস্থিত হয়েছে। আর সব বিবাহিত লোকই বোধহয় দারুণ খুশি। অথবা তাঁরা বোধহয় স্বচ্ছলতা পেলেই, শনিবারে সিনেমা দেখলেই, রবিবার দুপুরে ভরপেট খেয়ে পান মুখে দিয়ে স্ত্রীকে জড়িয়ে শুতে পেলেই নিজেদের পরম সার্থক স্বামী বলে মনে করেন?

    তাও কি সত্যি? তবে ভালোবাসা কী?

    যথার্থ সুখী দম্পতি হয়ত নিশ্চয়ই আছেন–অন্তত অনেককে ত দেখি। তাঁরা কি অন্য কারো সুখ ছিনিয়ে নিয়ে নিজেরা সুখী হয়েছেন?

    না কি তাঁরা সুখের ভান করেন? জানি না।

    একটু পরে লাবুর মা এলেন, একটা কাঠের ট্রেতে বসিয়ে ট্রের উপর হাতে-বোনা লেসের বহু পুরোনো ম্যাটস্ পেতে পুরোনো দিনের জাপানী রেকাবে করে চা নিয়ে এলেন। সঙ্গে দুটি বিস্কুট।

    বললেন, খাও বাবা। খেয়ে নাও, ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।

    তারপর বললেন, বৌমাকে নিয়ে একবার এসো আমাদের বাড়ি। তুমি ত এখানে অনেকদিন আছ, থাকবেও ত শুনি বেশ কিছুদিন। কই? বৌমা ত এলেন না?

    আমি বললাম, তিনি কোলকাতাতেই আছেন, নানারকম ঝামেলা, তার উপর ছেলের স্কুলের পড়াশুনা দেখতে হয়–তিনি আসতে পারেন না। যদি আসেন এখানে ত নিয়ে আসব।

    চা খেতে খেতে ভাবছিলাম যে, যদি রমা কখনও আসেও এখানে, তাহলেও কোনদিনও এ বাড়িতে আসবে না।

    না-আসার অন্য কোন কারণ নেই যেহেতু আমি অনুরোধ করব, সেজন্যেই আসবে না।

    আমি জানি, ও বলবে, পাবলিক রিলেশান্স করতে ত এখানে আসিনি–আমার যার তার সঙ্গে কথা বলার সময় নেই। আমি একজন যথেষ্ট ইম্পর্ট্যান্ট লোক।

    আমাকে অন্যমনস্ক দেখে লাবু বলল, কি? চা-টা খান। তারপরে ত আপনাকে নিয়ে যাব।

    বললাম, কি, দেখাবে কি?

    লাবু বলল, চলুনই না।

    চায়ের কাপটা শেষ করে উঠে লাবুর মাকে বললাম, চলি মাসীমা।

    উনি হেসে বললেন, যাওয়া নেই, এসো বাবা। আবার এসো।

    লাবুর সঙ্গে জঙ্গলের ভিতরে যেতে যেতে ভাবছিলাম, আমাদের এই মাসীমা-পিসীমারা একেবারেই বদলাননি। স্ত্রীরা বদলে গেছে, ভাই-বোনেরা বদলে গেছে বড় তাড়াতাড়ি। গত প্রজন্ম থেকে এ প্রজন্মের অনেক তফাত অনেক ব্যাপারে। কিন্তু এই জরাজীর্ণ দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা জঙ্গলের মধ্যের পর্ণকুটিরের মাসীমা–গত প্রজন্মে যেমন ছিলেন এ প্রজন্মেও তেমনই আছেন। তাঁদের উপরে এই দ্রুত পরিবর্তনশীল জগতের হৃদয়হীনতার, যান্ত্রিকতার, কোনো প্রভাব পড়েনি।

    লাবু আমাকে ওদের বাড়ি থেকে অনেক দূর হাঁটিয়ে নিয়ে এল।

    জায়গাটায় ভীষণ জঙ্গল। একটা নুড়ি-ভরা টিলা মত আছে সামনেই। তার পিছনেই একটা ঝরনা। টিলার গায়ে একটা গুহা। ছোট্ট গুহা।

    লাবু সাবধানে গিয়ে গুহার মুখ থেকে পাথরটা সরালো। তারপর বলল, ভিতরে যেতে হবে।

    বললাম, ঢুকব কি করে?

    ও বলল, আমি যা-করে ঢুকছি।

    বলেই, লাবু অবলীলায় ভিতরে ঢুকে গেল।

    ওর দেখাদেখি আমিও মাথা নীচু করে ভিতরে ঢুকলাম।

    ভিতরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেলাম।

    গুহাটা বেশ বড়। চার-পাঁচজন লোক পাশাপাশি আরামে শুয়ে থাকতে পারে।

    গুহার একদিকে একটা পুরোনো চট পাতা। সেই চটের উপর বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা জরাজীর্ণ একটি চাঁদের পাহাড় বই। একটা লালরঙা ছেঁড়া তাঁতের শাড়ি, একটা প্রমাণ সাইজের জুতো এবং যাত্রাদলে ব্যবহার করা রাংতা-মোড়া একটা তলোয়ার।

    লাবু ফিসফিস করে বলল, এটা রাজার গুহা।

    তারপর বলল, রাজার সব আছে, শুধু টুপি নেই। একটা টুপি হলেই রাজা ঠিকমত রাজত্ব চালাতে পারে।

    আমি অবাক হয়ে ওখানে বসে পড়লাম।

    গুহাটার গড়ন আশ্চর্য। মাথাটা পুরো ঢাকা অথচ চারপাশে এমন ফাঁক-ফোঁক যে প্রচুর আলো আসে ভিতরে–এত আলো যে, স্বচ্ছন্দে বই পড়া যায়।

    লাবু বলল, বর্ষাকালে আমি এখানে বসে বৃষ্টি দেখি, অথচ আমার গায়ে একটুও ছাঁট লাগে না। এমনকি মাথাতেও জল পড়ে না।

    আমি বললাম, সত্যি?

    তারপর বললাম, তোমার সিংহাসনটা দারুণ।

    লাবু আবার হাসল, নির্মল খুশিতে ওর লালচে রুক্ষ মুখটা আর কটা চোখটা ভরে গেল।

    লাবু বলল, শুধু টুপি নেই; আর রাণী নেই।

    বললাম, তোমাকে একটা টুপি আমি আনিয়ে দেব রাঁচী থেকে।

    লাবু সোজাসুজি ওর খসখসে গলায় আমার চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করল, কবে?

    যত তাড়াতাড়ি পারি।

    পরক্ষণেই লাবু বলল, আর রাণী?

    এবার আমি হেসে ফেললাম।

    বললাম, কোনো রাজাকে কি কেউ রাণী দিতে পারে। রাজার নিজে যেতে হয় ঘোড়ায় চেপে রাণীর স্বয়ংবর সভায় পৌঁছতে হয়রাণীর পছন্দ হলে তবে রাণী তোমার গলায় মালা পরিয়ে দেবে। তখন ঘোড়ায় চড়িয়ে রাণীকে নিয়ে আসতে হবে।

    লাবু দুহাত দুদিকে তুলে প্র্যাকটিক্যাল গলায় বলল; আমার তবে রাণী হবে না। হবে। না।

    খুব মজা লাগছিল ওর হাবভাব দেখে। বললাম, কেন? রাণী হবে না কেন?

    লাবু দার্শনিকের মত বলল, সে অনেক ঝামেলা।

    লিনটন সাহেবের একটা টাট্টু ঘোড়া ছিল। একদিন গরু চরিয়ে ফিরছি, দেখি সেটা একা একা পানুয়ানা টাঁড়ে চরে বেড়াচ্ছে। আমি ভাবলাম, এই বেলা একটু ঘোড়া চড়ে নিই। ছাগলে চড়েছি, গরুতে চড়েছি, শুধু ঘোড়া চড়িনি। তারপর না সুকুদা–যেই-না তড়াক করে ওর পিঠে চড়ে ওর কান ধরেছি, পেছনের দুপা তুলে এমন এক লাফ লাগালো যে আমি শূন্যে তিন ডিগবাজী খেয়ে একেবারে ধাঁই করে গিয়ে পড়লাম একটা পাথরে। হাঁটুতে যা লেগেছিল না। সেই থেকে আমি ঐ হাঁটুটা মুড়ে বসতে পারি না।

    থাক সুকুদা, রাণী-টানির দরকার নেই। নিজেই চড়তে পারি না, তার আবার রাণীসুন্ধু ঘোড়ায় চড়া।

    কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমি বললাম, রাজপাট ত দেখা গেল, কিন্তু প্রজারা কোথায়?

    লাবু দুষ্টুমির হাসি হাসল। বলল, আছে; দেখবে।

    বলেই গুহার মধ্যে থেকে একটা শিল পাটার সাইজের চ্যাটানো পাথর সরিয়ে ফেলল দুহাত দিয়ে। পাথরটি সরাতেই একটা ফোকর হয়ে গেল–আর সে ফোকর দিয়ে যা দেখলাম, তাতে দুচোখ জুড়িয়ে গেল।

    বুঝতে পারলাম, টিলাটা একটা চড়াই-এর শেষে–গুহাটার অন্য পাশে সোজা খাদ নেমে গেছে প্রায় পঞ্চাশ ফিট।

    নীচ দিয়ে একটা পাহাড়ি নদী বয়ে চলেছে। গুহাটার ঠিক সামনে একটা বাঁক নিয়েছে নদীটা। নদীর ওপাশে গভীর জঙ্গল। এখন দুপুরের রোদে শান্ত সবুজ জেল্লা দিচ্ছে গাছ-পাতা থেকে।

    লাবু বলল, সন্ধ্যের আগে আগে এখানে এলে, এসে বসলে, দেখতে পাবে, কত প্রজা আমার। কত পাখি—কত্ব-কত্ব–ঘুঘু, টিয়া, ছাতারে, বুলবুলি, বনমুরগী, তিতির, বটের, ঢাবপাখি, টি-টি পাখি, আরো কত কি!

    হরিয়াল পাখিরাও ঐ দিকের অশত্থের ডাল থেকে নদীতে জল খেতে নামে। যখন নামে, তখন ঠোঁটে করে পাতা ভেঙে নিয়ে এসে বালির উপর রেখে তার উপর পা দিয়ে দাঁড়ায়। হরিয়ালেরা কখনো পা মাটিতে ফেলে না, জানেন না তো?

    বললাম, না ত।

    তারপর বললাম, আমাকে আপনি করে বোলো না, কেমন দূরের দূরের লোক বলে মনে হচ্ছে। আমি কি তোমার দূরের লোক?

    লাবু লজ্জা পেয়ে হাসল।

    বলল, ধ্যাৎ।

    তারপর বলল, আচ্ছা, তাই হবে, শোনো, আরো কত প্রজা আমার। কাঠবিড়ালি, খরগোেশ, সজারু, বুনোশুয়োর, হায়না, লুমড়ী, নেকড়ে সবাইকেই দেখতে পাবে। একসঙ্গে নয়, মাঝে মাঝে।

    এই অবধি বলে, লাবু হঠাৎ চুপ করে গেল।

    তারপরই বলল, আচ্ছা, রাজা মরে যাবার পর রাজত্ব কে পায়?

    বললাম, কেন? রাজার ছেলে পায়।

    লাবু বলল, ধ্যাৎ। দেখছ রাণীই নেই আমার, হবেও না। ছেলে পাব কোত্থেকে?

    বললাম, এতটুকু রাজার মরার কথা উঠছে কি করে?

    লাবু চোখ বড় বড় করে বিজ্ঞের মত বলল, মরার কথা কেউ বলতে পারে? মাথা নাড়িয়ে বলল, মরার কথা কেউই বলতে পারে না।

    তারপর বলল, বলো না সুকুদা, রাজার ছেলে না থাকলে রাজত্ব কে পায়?

    নিরুপায় হয়ে বললাম, রাজা যাকে দিয়ে যান, সেই পায়।

    তাইই। সত্যি? তাইই? লাবু আমাকে শুধোল।

    তারপর বলল, তাহলে ভালোই হল। তোমাকেই আমি দিয়ে যাব। আমি মরলে।

    বললাম, এবার অন্য কথা বল।

    লাবু নাছোড়বান্দা। বলল, আচ্ছা রাণী আনতে ত ঘোড়া করে যায়, স্বর্গে যেতে কিসে করে যায়?

    বললাম, কি করে জানব। আমি কি গেছি?

    তুমি যাওনি ত কি? বাবা ত গেছে। মা বলেছিলেন আমাকে, ঢাব পাখির পিঠে করে যায়।

    বললাম, ঢাব পাখি মানে ঐ বড় বাদামী লেজ-ঝোলা পাখিগুলো? ওগুলোকে আমি কুম্ভাটুয়া বলি।

    তুমি যা-খুশি বল, ওগুলো ঢাব পাখি। গভীর রাতে কেমন ডাকে দ্যাখোনা? ঢাব-ঢাব-ঢাব- ঢাব-ঢাব। স্বর্গে যেতে হলে ঢাব পাখির পিঠে চড়েই যেতে হয়। আমার রাজত্বে ত ওরা অনেক আছে। স্বর্গে যেতে তাহলে আমার কোনো অসুবিধে নেই? কি বল?

    তারপরেই বলল, ধ্যাৎ তেরী যা বলছিলাম, আমার তোমাকে খুব ভালো লাগে। আমার রাজত্ব আমি তোমাকে দিয়ে যাব।

    আমি হাসলাম, শুধোলাম, আমাকে কেন ভালো লাগে লাবু? কি কারণে?

    লাবু আর আমি গুহা থেকে বাইরে আসছিলাম, গুহার পাথরটা ঠিক করে বসিয়ে রাখতে রাখতে লাবু লাজুক মুখে বলল, এমনিই।

    এমনিই আবার কারো কাউকে ভালো লাগে না কি? আমি বললাম।

    মানে, এই গুহার মধ্যে আমার এই ছোট্ট ঘরে এলে যেমন লাগে, তোমার কাছে গেলে আমার তেমন লাগে সুকুদা। তোমার কাছে গেলে আমার ভালো লাগে।

    লাবু পাথরটা বসিয়ে রেখে আগে আগে নামছিল।

    আমি ওর পিছনে পিছনে নামছিলাম।

    কি করে এই সরল অপাপবিদ্ধ শিশুকে বলব জানি না, ওকে বলা যায় না যে, নিজের উষ্ণতার জন্যে অন্য কারো উপরে নির্ভরশীল হতে নেই, হলেই তার কপালে আমারই মত দুঃখ।

    এসব কথা ও এখন বুঝবে না। ও এক্ষুনি অনবধানে ওর শিশুসুলভ ভাষায় যে দামী কথাটা বলে ফেলল, ওর যন্ত্রণাময় যৌবনে, ওর প্রসন্ন প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে ঐ কথাটাই ও নতুন করে শিখবে, জানবে, ভাববে।

    সেদিন ও বুঝতে শিখবে, পরনির্ভরতার মত অর্বাচীনতা আর বুঝি কিছু নেই। ও সেদিন জানবে, নিজের হৃদয়ের উষ্ণতায়, নিজের মধ্যের জেনারেটরে তাপ সঞ্চারণ করে এই ঠাণ্ডা নির্দয় পৃথিবীতে যে বাঁচতে না পারে, তার বাঁচা হয় না। তার জন্য এই পৃথিবী একটি চলমান প্রাগৈতিহাসিক হিমবাহ।

    টিলা থেকে নেমে লাবুকে বললাম, লাবু, তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে। তোমার যখনই ইচ্ছা করবে, চলে আসবে। কোনো লজ্জা করবে না; আমার বাড়িতে যদি অতিথি থাকে তখনও লজ্জা করবে না, বুঝেছো?

    তুমি এলে আমারও সত্যিই খুব ভালো লাগে।

    লাবু বলল, বেশ। তারপর বলল, আমার গুহাটা, মানে, আমার রাজত্ব তোমার ভালো লাগেনি?

    বললাম, ভালো মানে? দারুণ লেগেছে। আজ থেকে তোমার নাম দিলাম, রাজা লাবু।

    লাবু হেসে ফেলল। বাঁ হাত দিয়ে কপালে-পড়া চুল সরিয়ে বলল, তুমি ভীষণ মজার। তুমি খুব ভালো, জানো সুকুদা, বলেই এগিয়ে এসে লাবু আমার হাত ধরে ঝুলে পড়ল।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Article৫-৬. আমুর ডায়েরি-৩
    Next Article ঋক – বুদ্ধদেব গুহ

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }