Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    একাত্তরের দিনগুলি – জাহানারা ইমাম

    জাহানারা ইমাম এক পাতা গল্প451 Mins Read0

    ৮ আগস্ট, রবিবার ১৯৭১

    ৬ আগস্ট, রবিবার ১৯৭১

    আজ জ্বর নেই কিন্তু শরীর এখনো বেশ দুর্বল। সকাল থেকে মেহমানের ভিড় বাড়িতে। একে একে এসেছেন দাদাভাই, মোর্তুজা, ফকির, নূরজাহান, মান্নান, শরীফের আরো দুই ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু ওয়াহিদ ও মিকি, লালু, ডাক্তার, সানু, খুকু, অ্যাডভোকেট মোল্লা, চিশতী। এতগুলো মেহমান, সকাল নটা থেকে দুপুর দুটো পর্যন্ত কিন্তু আলোচ্য বিষয় একটাই। গতকাল সন্ধ্যার পর ফার্মগেটের মিলিটারি চেকপোস্টে গেরিলা অপারেশন।

    ফার্মগেটের মিলিটারি চেকপোস্টটা বেশ বড়সড়। ওখানকার ট্রাফিক আয়ল্যান্ডের মধ্যখানে দুটো তাঁবুতে অনেকগুলো মিলিটারি পুলিশ। কাছাকাছি ফুটপাতে লাইট মেশিনগান হাতে মিলিটারি। একটু দূরেগ্রীন রোডে ঢোকার মুখে মোড়ে একটা সিনেমা হল তৈরি হচ্ছে, সেটার মাথাতেও লাইট মেশিনগান হাতে এক মিলিটারি। অর্থাৎ সব মিলিয়ে এলাহি ব্যাপার-স্যাপার। এই রকম মারাত্মক বিপজ্জনক জায়গায় বিন্দুরা যে কাণ্ডটি করল, সেটাও এলাহি কাণ্ড-কারখানাই বটে।

    মোর্তুজা চোখ বড় বড় করে বললেন, কি কাণ্ড দেখুন তো, কি বুকের পাটা! ওই রকম কড়া সিকিউরিটির মধ্যে দশ-বারোটা খানসেনা মেরে দিয়ে চলে গেল!

    দাদাভাই খুশির হাসি হাসতে হাসতে বললেন, তাও চোখের পলকে! এক মিনিটও লেগেছে কি না সন্দেহ।

    ফকির বললেন, ওদের কাছে নিশ্চয় মেশিনগান ছিল।

    মিকি–অবশ্যই। ব্রাশ ফায়ার ছাড়া অত অল্প সময়ে অতগুলো শেষ করে পালানো যায়?

    শরীফ মুচকি হাসল, তা নইলে আর বিচ্ছু বলেছে কেন ওদের।

    নূরজাহান ধরা পড়েনি তো কেউ?

    মান্নান প্রায় ধমকে উঠলেন, কি যে বল তুমি? ওদের ধরা যায়?

    আমি বললাম, ওদের চোখেও দেখা যায় না। কদিন আগে চরমপত্রে এই নিয়ে বলেছে–জামী ব না।

    জামী বেশ ভালো ক্যারিকেচার করতে পারে, ওর স্মরণশক্তিও খুব তীক্ষ। মাঝে মাঝেই ও চরমপত্র দুচার লাইন আওড়ায়। এখন এতগুলো চাচা-চাচীর সামনে প্রথমে একটু লজ্জা পেল, তারপর চরমপত্রের গলা নকল করে বলতে লাগল : চাইর মাস ধইরা পাইট করনের পর হানাদার সোলজাররা তাগো কমান্ডার গো জিগাইছে মুক্তিবাহিনীর বিন্দুগুলো দ্যাখতে কি রকম? এই বিচ্ছুগুলা কি রকমের কাপড় পেদে? এই সব না জানলে কাগো লগে পাইট করমু? আর দুশমনগো খালি চোখে দ্যাখতে পাই না ক্যান?

    মনটা বেশ ফুরফুর করছে। সন্ধ্যার মুখে বাগানে বসে শরীফ, ফকির, আমি গল্প করছিলাম। ফকির দুপুরে আর বাড়ি যান নি। আমাদের সঙ্গেই খেয়েছেন। গেটের সামনে রিকশা থেকে নামল লালু। একটু অবাক হলাম, সকালেই বেরিয়ে গেল, আবার এসেছে–কি ব্যাপার? কোন খারাপ খবর নয়তো? মনে হয় না, কারণ মুখ তার চাপা হাসিতে উদ্ভাসিত। রিকশা থেকে নেমে দাঁড়াল না। বুবু একটু ভেতরে এসো বলে সোজা ঘরে চলে গেল। আমি পিছু-পিছু উঠে এলাম। লালু খুব আস্তে বলল, রুমী এসেছে আমাদের বাড়িতে। শরীফ ভাইকে গিয়ে নিয়ে আসতে বলেছে।

    হঠাৎ যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। দাড়িয়ে থাকতে পারলাম না। চেয়ারে বসে পড়লাম। বাইরে ফকির রয়েছেন শরীফের সাথে। মিনিট খানিক ঝিম মেরে বসে রইলাম, তারপর বাইরে বেরিয়ে বললাম, মার হঠাৎটাকার দরকার হয়ে পড়েছে, তাই লালুকে পাঠিয়েছেন। ওকে টাকা দিলাম। তুমি একটু গাড়ি করে পৌঁছে দিয়ে এসো। সন্ধ্যে হয়ে গেছে।

    জামী হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে বলল, সারাদিন বাড়ি বসে আছি, আব্দু, আমিও একটু ঘুরে আসি তোমার সঙ্গে।

    ওরা দুজনে লালুকে নিয়ে চলে গেল। আমি স্থির হয়ে বসতে পারছি না, মনে হচ্ছে একশো তিন ডিগ্রি জ্বর গায়ে। কান, গলা, চোখ সব যেন গল্প করছে। ফকির বোধ হয় কিছু আঁচ করে বললেন, সারাদিন বাড়ি ছাড়া আমিও যাই এবার। সঙ্গে সঙ্গে হেলিয়ে হাত কপালে তুলে বললাম, আচ্ছা, খোদা হাফেজ।

    সদর দরজা বন্ধ করে একবার রান্নাঘরে উঁকি মেরে দেখলাম বারেক কি করছে। সে নিবিষ্টমনে চুলোর সামনে কিছু একটা করছে। দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখে একটা দরজা আছে, এটা দিয়েও বাইরে বেরোনো যায়। এই দরজার কাছে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলাম, হেঈশ্বর। এখন যেন কেউ বেড়াতে বা ফোন করতে না আসে। বুক দুরদুর করছে। রুমী সোজা বাড়ি চলে এলেই তো পারত। এই প্রতীক্ষার উদ্বেগ আর তো সহ্য হয় না।

    গাড়ির শব্দ পেলাম। গাড়ি এসে পোর্চে থামল। নিঃশব্দে দরজাটা খুলে দিয়েই দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় বেড রুমে চলে গেলাম।

    রুমী এসে ঢুকল ঘরে। রুমীর মুখভর্তি দাড়ি, চুল ঘাড় পর্যন্ত লম্বা, তামাটে গায়ের রঙ রোদে পুড়ে কালচে, দুই চোখে উজ্জ্বল ঝকঝকে দৃষ্টি, গোঁফের জঙ্গল ভেদ করে ফুটে রয়েছে সেই ভুবন ভোলানো হাসি। রুমী দুই হাত বাড়িয়ে এগিয়ে এলো, ওকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। রুমী ফিসফিস করে বলল, আম্মা, আম্মা, থামো। দাদা শুনতে পাবে। তোমার কান্না শুনলে ঠিক সন্দেহ করবে। দরজার পর্দা পেরিয়েই সিঁড়ির সামনের চারকোণা মাঝারি হল–সেখানে ইজিচেয়ারে বাবা শুয়ে থাকেন। শরীফ আর জামী একদৃষ্টিতে রুমীর দিকে চেয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। রুমী একবার আমার, আরেকবার শরীফের দিকে তাকিয়ে বলল, দেখলে? কেমন তোমাদের বিবাহবার্ষিকীর আগের দিনটাতে এসে গেলাম!

    একটু সামলে নিয়ে বললাম, সোজা বাড়িতে এলি না কেন? আবেগের উচ্ছ্বাস কমতেই কল্পনার চোখে ভেসে উঠল মায়ের মুখের বিজয়িনীর হাসি, সেই সঙ্গে না-বলা উচ্চকিত বাণী–কেমন, এবার হল ত? আমাকে বলা হয় নি। এখন তো সব ফাঁস হয়ে গেল।

    রুমী বলল, কি জানি, ভয় পেলাম রিস্ক নিতে। যদি গলির মোড়ে কোন মিলিটারির সামনে পড়ে যাই, যদি সন্দেহ করে?

    মাসুম বাসায় ছিল না, সে যখন ফিরল, তখন আমাদের আবেগ প্রশমিত, রুমী দাদার সাতকাহন প্রশ্নের অলীক সব জবাব দিয়ে বাথরুমে ঢুকেছে গোসল করতে।

    আমরা স্থির করলাম মাসুমের কাছে সত্য গোপন করব না। করা সম্ভবও নয় এক বাড়িতে থেকে।

    রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর আমাদের বিছানায় সবাই গোল হয়ে বসলাম। বললাম, এবার বল তোর কাহিনী।

    রুমী একটু হাসল কাহিনী যা, তা প্রায় রূপকথার মতই। মেলাঘরে গিয়ে দেখি ঢাকার যত কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা, ধানমন্ডি-গুলশানের বড়লোক বাপের গাড়ি হাকানো ছেলেরা, খেলার মাঠের চৌকস ছেলেরা, ছাপোষা চাকুরে বাপের ছেলেরা, সবাই ওখানে জড়ো হয়েছে। সবাই যুদ্ধ করবার জন্য গেছে। ওখানে গিয়ে আমার আগের চেনা কতো ছেলেকে যে দেখলাম! ঢাকা থেকে আগরতলার দিকের এই বর্ডারটা সবচেয়ে কাছে বলে ঢাকার প্রায় সব ছেলেই এই রাস্তা দিয়ে বর্ডার ক্রস করে। তারপর সেক্টর টুর ওপর দিয়েই অনেকে অন্য সেক্টরে চলে যায়। ঢাকা জেলা কিন্তু সেক্টর টুর আন্ডারে, তাই আমরা বেশিরভাগ ঢাকার ছেলেরা সেক্টর টুতেই আছি। দেশের চারদিকের বর্ডার ঘিরে যুদ্ধ চলছে, বর্ডারের ঠিক ওপাশেই ভারতের মাটিতে আমাদের সেক্টরগুলোর হেড কোয়ার্টার্স। রেগুলার বাংলাদেশ আর্মির পাশাপাশি আমরা আছি গেরিলা বাহিনী।

    স্বাধীন বাংলা বেতার, আকাশবাণী, বি.বি.সি. থেকে এ সবই শুনে আসছি, কিন্তু সে যেন নেহাৎ শোনা কথা ছিল। বিশ্বাস করতাম, সত্য বলে জানতাম কিন্তু তবু যেন মন ভরত না। এখন রুমীর মুখে শুনে সমস্তটাই যেন একেবারে বুকের ভেতরে গেঁথে গেল।

    খানিক পরে একটু উসখুস করে রুমী বলল, আম্মা, আমি কিন্তু সিগারেট ধরে ফেলেছি। তোমাকে প্রমিস্ করেছিলাম না, যে ধরবার আগে জানাব? তা আর হলো না।

    মনে পড়ল, রুমী যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখনই বলেছিলাম, দ্যাখ, সিগারেট যদি ধরিস তো বলে-কয়ে ধরবি। নইলে লুকিয়ে সিগারেট খাবি, আমি জানব না, তারপর আমার বান্ধবী এসে বলবে, রুমীকে সিগারেট খেতে দেখলাম সে আমার সইবে না।

    রুমী বলেছিল, আম্মা, আব্ব যখন খায় না, খুব সম্ভব আমিও ধরব না। তবে যদি ধরিই, অবশ্য তোমাকে আগে জানাব।

    এখন রুমী হাসতে হাসতে বলল, ওখানে সিগারেট না ধরে উপায় নেই আম্মা। খাওয়া-দাওয়ার কোন ঠিক-ঠিকানা থাকেনা অ্যাকশানে গেলে, অনেক সময় না খেয়েও থাকতে হয়, কাছে-ভিতে কোন খাবারই জোটে না। এই সিগারেটটাই একমাত্র জিনিস, যা সঙ্গে রাখা যায়। আম্মা, তোমাদের সামনে খাব, না আড়ালে যাব।

    আমার চোখ পানিতে ভরে গেল। ফেব্রুয়ারি মাসে–মাত্র ছমাস আগে আমাদের এই বাড়িতেই আমার সামনে সিগারেট ধরাবার অপরাধে ইশরাককে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলাম। বন্ধুর অপরাধে রুমীকেও কম বকুনি খেতে হয় নি। এখন ধরা গলায় বললাম, না, সামনেই খা। অল্প কদিনের জন্য এসেছিস। সিগারেট খাবার সময়টুকুও তোকে চোখের আড়াল করতে চাই নে।

    রুমী একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, আম্মা, ডককে তোমার মনে আছে? সেই যে গত বছর ডিসেম্বরে আমরা বরিশালের চরে রিলিফ ওয়ার্ক করতে গিয়েছিলাম–

    মনে আছে। সেই যে নতুন পাস করা, নতুন বিয়ে করা ডাক্তারটা, আসল নাম। আখতার আহমদ। তার কি হয়েছে?

    সেই ডক সেক্টর টুতে আছে। তার বউ-ও।

    বলিস কি? অদ্ভুত যোগাযোগ তো!

    শুধু কি এইটুকু? আরো আছে। লুলু আপা, টুলু আপাও ওখানে।

    ওরাও? ওরা ওখানে কি করছে?

    সেক্টর টুতে একটা হাসপাতাল করা হয়েছে। ডক ওখানে ডাক্তার, খুকু ভাবী, লুলু টুলু আপারা ওখানে নার্স।

    শুনে আমি চমকৃত। রুমীর কপালটা নেহাৎ ভালো বলতে হবে। অচেনা জায়গায় গিয়ে ওর কয়েকজন প্রিয় পরিচিত মানুষকে পেয়েছে। গত বছর নভেম্বরের গর্কির পর বেগম সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে একটি রিলিফের দল বরিশালের কয়েকটি বিধ্বস্ত চরে রিলিফ ওয়ার্ক করতে যায়। সে দলে ছিল সদ্য পাস করা ডাক্তার আখতার আহমদ (ডক), রুমী, সুফিয়া কামালের দুই মেয়ে লুলু ও টুলু, কাজী নূরুজ্জামানের স্ত্রী সুলতানা জামান ও দুই মেয়ে নায়লা এহমার ও লুবনা মরিয়ম, রেবা-মিনি ভাইয়ের বড় ছেলে জাহির এবং আরো অনেকে। এই রিলিফ ওয়ার্কের সময় থেকেই রুমী ওদের সকলের সঙ্গে, বিশেষ করে ডক, তার বউ খুকু, লুলু ও টুলুর সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে।

    রুমী বলল, আরো কি মজা জানো আম্মা? আমি ঢাকা থেকে যাই ১৪ জুন, লুলু টুলু আপারা অনেকে মিলে একটা বিরাট দল যায় ১৫ জুন। ১৩ জুন আমি ওদের বাসায় দেখা করতে গিয়েছিলাম, কিন্তু কেউ কাউকে যাওয়ার কথা বলি নি। আমরা যাই মনু ভাইদের সঙ্গে, ওদের দলকে নিয়ে যায় শাহাদত ভাই। ওরা সোনামুড়ার হাসপাতালে যায়। তিন-চারদিন পরে আখতার ভাই ওদেরকে নিয়ে মেলাঘরে বেড়াতে আসে, তখন নাটকীয়ভাবে ওদের সঙ্গে আমার দেখা?

    আখতার কোন সময় ওদিকে যায়?

    ক্র্যাকডাউনের পরপরই। আখতার ভাইয়ের কাহিনী তো আরো রোমাঞ্চকর। আখতার ভাই এ বছর জানুয়ারি মাসে আর্মিতে ডাক্তারের চাকরি পেয়েছিল। কুমিল্লায় ফোর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে ওর পোস্টিং হয়েছিল। মার্চের মাঝামাঝি ঐ ফোর্থ ইস্ট বেঙ্গলের দুটো কোম্পানিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বদলি করা হয়। মেজর শাফায়াত জামিল, আখতার ভাই এঁরাওব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে যান। আসলে এই বদলি করাটা পাকিস্তানিদের একটা ষড়যন্ত্র ছিল। খালেদ মোশাররফকেও মার্চের শেষে কুমিল্লায় ঐ ফোর্থ ইস্ট বেঙ্গলে বদলি করা হয়। তার আগে খালেদ ভাই ঢাকায় কোন এক ব্রিগেডে, ব্রিগেড মেজর ছিলেন। ক্র্যাকডাউনের ঠিক আগে আগে খালেদ ভাইকে তার কম্যান্ডিং অফিসার একটা ছুতো করে সিলেটের শামসেরনগরে পাঠিয়ে দিল। ওখানে নাকি নকশালরা ভারত থেকে ঢুকে উৎপাত করছে। তাদের দমন করার জন্য এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে তাকে যেতে বলা হয়। খালেদ ভাই ঠিকই সন্দেহ করেছিলেন পাকিস্তানিরা কিছু একটা সাংঘাতিক ষড়যন্ত্র আঁটছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই কোম্পানি সৈন্য পাঠানো হয়েছে। আবার তাকে এখন আরেক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে শামসেরনগর যেতে বলা হয়। খালেদ ভাই বুঝতে পারছিলেন এভাবে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে কোম্পানি এদিক-ওদিক সরিয়ে দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে। খালেদ ভাই একটুখানি সাবধান হয়েছিলেন। যার জন্য তাঁর জীবন বেঁচে যায়। তিনি মেইন রোড দিয়ে না গিয়ে অন্য একটা কাঁচা রাস্তা ধরে শামসেরনগর যান। গিয়ে দেখে কোথায় কি। নকশালদের চিহ্নমাত্র নেই। পরে জানতে পারেন মৌলভীবাজারের কাছে মেইন রোডের পাশে এক কোম্পানি পাকিস্তানি সৈন্য লুকিয়ে ছিল খালেদ ভাইদের অ্যামবুশ করার জন্য।

    এদিকেব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হয়েছে কি–মেজর শাফায়াত জামিল, আখতার ভাই আর অন্য যারা ছিলেন, সবাই জেনে গেছেন ঢাকায় কি হয়েছে, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে কি হয়েছে। রাগে, উত্তেজনায় তাদের রক্ত টগবগ করে ফুটছে। কাজেই ২৭ মার্চ সকালেই শাফায়াত জামিলের সঙ্গে আখতার ভাই আর অন্য সবাই রিভোল্ট করে ওখানকার পাকিস্তানি অফিসারদের গ্রেপ্তার করে ফেলেন। শাফায়াত জামিল আগেই আখতার ভাইকে একটা স্টেনগান ইস্যু করে দিয়েছিলেন লুকিয়ে কারণ ডাক্তারদের অস্ত্র দেবার কোনো নিয়ম ছিল না। ওদিকে মেজর খালেদ মোশাররফও শামসেরনগর থেকে ফেরত এসে শাফায়াত জামিলদের সঙ্গে যোগ দেন। জানো আম্মা, আখতার যখন ওঁদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে থাকে, তখন কিন্তু সে খুকু ভাবীর

    কোন খবরই জানত না। খুকু ভাবী কুমিল্লায় ছিল। খালেদ মোশাররফের সঙ্গে আখতার ভাই সিলেটের তেলিয়াপাড়ায় চলে যায়। সেখানকার চা-বাগানে খালেদ ভাই ঘাটি করে। সেখানে নিত্যনতুন ছেলেরা জড়ো হতে থাকে ট্রেনিং নেবার জন্যে। খালেদ মোশাররফ আখতার ভাইকে বলে, তোমার তো এখন কোন কাজ নেই, তুমি আপাতত এই ছেলেদেরকে ট্রেনিং দিতে শুরু কর। ট্রেনিং কোম্পানি করা হল, আখতার ভাই তার কমান্ডার। ক্যাপ্টেন হায়দারও কিন্তু ওইরকম সময়েই কুমিল্লা থেকে পালিয়ে তেলিয়াপাড়ায় চলে যায় পায়ে হেঁটে। তেলিয়াপাড়ায় সেকেন্ড বেঙ্গল আর ফোর্থ বেঙ্গলের বহু বাঙালি মিলিটারি অফিসার পালিয়ে গিয়ে জড়ো হয়। নাদিমের আব্বাও প্রথমে পালিয়ে এই তেলিয়াপাড়াতেই যান। মেজর জিয়াও তেলিয়াপাড়ায় গিয়েছিলেন খালেদ ভাইদের সঙ্গে মিটিং করার জন্য।

    কিছুদিন পর খালেদ মোশাররফ যখন ভারতের ভেতরে সোনামুড়ায় তাঁর ঘাটি সরিয়ে নিয়ে যায়, তখন আখতার ভাইও সেখানে যায়। খালেদ ভাই এবার তার ক্যাম্প হাসপাতাল তৈরির উদ্যোগ নিতে বলে। ততদিনে বর্ডারে যুদ্ধটুদ্ধ বেশ হচ্ছে। দুএকজন করে মুক্তিযোদ্ধা জখমও হচ্ছে।

    সোনামুড়ায় একেবারে বর্ডার ঘেঁষে শ্ৰীমন্তপুর বলে একটা বর্ডার আউট-পোস্ট আছে। সেইটার কাছে একটা স্কুলঘরে খালেদ মোশাররফ তার ক্যাম্প করেছে। পাশেই একটা গোয়ালঘর আখতার ভাইকে দেওয়া হল রুগী দেখার ব্যবস্থা করার জন্য। আখতার ভাই দুটো লম্বা তক্তা যোগাড় করে ঘরের দুপাশে খুঁটির ওপর পাতল, একটা হল রুগীর বেড, অন্যটায় ওষুধপাতি, গজ ব্যান্ডেজ সাজিয়ে রাখল। সেইটাই হলো সেক্টর টুর সর্বপ্রথম এক বেডের ক্যাম্প হাসপাতাল।

    পরে সোনামুড়া ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের একটা বড় ডাকবাংলোয় হাসপাতাল সরিয়ে নেয়া হয়। এখন হাসপাতাল আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। আরো অনেক ডাক্তার-নার্স এসে যোগ দিচ্ছে।

    খুকু কবে গেল?

    আখতার ভাই শ্ৰীমন্তপুরে থাকার সময়ই কুমিল্লায় মুক্তিযোদ্ধা পাঠিয়ে খুকু ভাবীর খবর বের করে। তারপর তাকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে। সেটা এপ্রিলের মাঝামাঝি কি তার একটু পরে হবে।

    আমি নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, সত্যিই। রূপকথার চেয়েও রোমাঞ্চকর এসব কাহিনী। শুনে বড় ভালো লাগছে। তুই যে ওখানে গিয়ে আপনজন পেয়েছিস, তাতেই আমার শান্তি। তা সোনামুড়া মেলাঘর থেকে কতদূর? প্রায়ই যাস্ নাকি?

    হাসপাতাল এখন আর সোনামুড়ায় নেই তো। জায়গাটা বর্ডারের খুব কাছে ছিল, ওখান থেকে দারোগা বাগিচা বলে একটা জায়গায় সরানো হয়। এখন বিশ্রামগঞ্জ বলে আরেকটা জায়গায় সরানো হয়েছে। এখানেই স্থায়ীভাবে থাকবে বলে ঠিক হয়েছে। মেলাঘর থেকে মাইল আষ্টেক দূরে। আমি মাঝে-মাঝে ছুটি নিয়ে যাই ওখানে।

    কি রকম হাসপাতাল? বেড়ার ঘরে বাঁশের মাচার বেড়, তাতে খড়ের গদি। ডাক্তার, নার্সদের থাকার জায়গাও ওইরকম বেড়ার ঘরেমাচায় বেড। আখতার ভাই শুধু ডাক্তারিই করেনা, ফাঁক পেলেই স্টেনগান হাতে অ্যাকশনে বেরিয়ে যায়। একবার হলো কি, হাসপাতালে ওষুধপত্র নেই, আখতার ভাই একটা জীপে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সঙ্গে নিয়ে এক জায়গায় বর্ডার ক্রস করে ইস্ট পাকিস্তানের ভেতরে ঢুকে এক হাসপাতাল লুট করলো। ফ্রিজ থেকে শুরু করে ওষুধপত্র, অপারেশনের যন্ত্রপাতি, গজ-ব্যান্ডেজ সব একেবারে সাফ তুলে নিয়ে এলো। আবার, মজা করে একটা রসিদ লিখে রেখে এলো–বাংলাদেশের সৈন্যদের ব্যবহারের জন্য এসব জিনিস নেয়া হলো।

    মেলাঘরে তোরা কিভাবে থাকিস? কি খাস? জায়গাটা কি রকম? গ্রাম? না আধাশহর?

    গ্রামও না, আধাশহরও না, একেবারে পাহাড়ী জঙ্গুলে জায়গা। টিলার ওপরে বেড়ার ঘরে, তাঁবুতে আমরা সবাই থাকি। খাওয়া-দাওয়ার কথা আর জিগ্যেস করো না। ওইটার কষ্টই সবচেয়ে বেশি।

    জামী ফোড়ন কাটল, হ্যাঁ, তুমি তো আবার একটু খেতে ভালোবাস!

    কি খাবার দেয় সাধারণত?

    ভাত আর ডাল। কখনো লাবড়া, কখনো মাছ। সকালের নাশতা রুটি আর ঘোড়ার ডাল।

    আমি আঁতকে উঠলাম, ঘোড়ার ডাল? সে আবার কি?

    চোকলা-মোকলাসুদ্ধ এক ধরনের গোটা গোটা ডাল, নর্মাল টাইমে বোধ হয় ঘোড়াকে খাওয়ানো হয়। আর রুটি? জানো আম্মা, কতোদিন সে রুটির মধ্যে সেঁকা পোকা পেয়েছি।

    পেয়ে কি করতিস? রুটি ফেলে দিতিস?

    ফেলে দেব? তুমি কি পাগল হয়েছে আম্মা? সেঁকা পোকাটা নখে খুঁটে ফেলে দিয়ে রুটি খেয়ে নিতাম।

    আমি একটা নিঃশ্বাস চাপলাম। এই রুমী! যে প্লেট বা গ্লাস আমার চোখে ঝকঝকে পরিষ্কার মনে হত, তার মধ্যেও সে এককণা ময়লা আবিষ্কার করে ফেলত। আবার ধোয়াত। তার জন্য গমের আটা দুবার করে চেলে নিতে হত। ডাল ধুতে হত যে কতবার, তার হিসাব নেই, কারণ রান্না ডালে একটা খোসা দেখলে সেই ডাল আর খাবে না।

    কিন্তু যাই বলো আম্মা, ঐ খাবার যে কি অমৃতের মতো লাগত। ওই খাবারও তো

    সব দিন জুটত না। কতদিন গাছ থেকে কাঁঠাল পেড়ে খেয়ে থেকেছি। মাঠ থেকে তরমুজ, বাঙ্গী, আনারস এসব তুলে খেয়ে থেকেছি।

    যুদ্ধ মানুষকে কি রকম বদলে দেয়। নইলে তোর মতো খুঁতখুঁতে পিপিতে ছেলে—

    রুমী একটু দুষ্টু হেসে বলল, সত্যিই যুদ্ধ মানুষকে বদলে দেয়। নইলে তোমার মতো কট্টর মা ও–

    আমি হেসে ফেললাম, থাম!হয়েছে। এখন বল্ মেলাঘরে কি কি ট্রেনিং নিয়েছিস?

    উঁহু, ওইটি বলা যাবে না। শুধু এটুকু জেনে রাখ ক্যাপ্টেন হায়দার আমাদের। কম্যান্ডো-টাইপ গেরিলা ট্রেনিং দিয়েছে। এবং আমরা কিছু নির্দিষ্ট কাজের ভার নিয়ে ঢাকা এসেছি। এর বেশি আর কিছু জানতে চেয়ো না।

    জামী আর মাসুম ঢুলছে। শরীফ হাই তুলে বলল, রাত তিনটে। এখন শোয়া যাক। বাদবাকি আগামীকাল শোনা যাবে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103 104 105 106 107 108 109 110 111 112 113 114 115 116 117 118 119 120 121 122 123 124 125 126 127 128 129 130 131 132 133 134 135 136 137 138 139 140 141 142
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনিঃসঙ্গ পাইন – জাহানারা ইমাম
    Next Article দুধ চা খেয়ে তোকে গুলি করে দেব – জাহিদ হোসেন

    Related Articles

    জাহানারা ইমাম

    নিঃসঙ্গ পাইন – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    জাহানারা ইমাম

    সাতটি তারার ঝিকিমিকি – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    জাহানারা ইমাম

    বুকের ভিতর আগুন – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    জাহানারা ইমাম

    বিদায় দে মা ঘুরে আসি – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    জাহানারা ইমাম

    বীর শ্রেষ্ঠ – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    জাহানারা ইমাম

    নয় এ মধুর খেলা – জাহানারা ইমাম

    August 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }