Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    এক ডজন একজন – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল এক পাতা গল্প145 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০২. যখন পাঁচ নাতি-নাত্নী

    ২. যখন রাহেলা খাতুনের পাঁচ নাতি–নাত্নী পাঁচ রকম।

    সময়টা হচ্ছে ২০০৫ সালের মাঝামাঝি। প্রত্যেকদিন সকালে জোবেদা খাতুন পত্রিকাটা খুলেই ওয়াক থু! ওয়াক থু! করে চেঁচামেচি শুরু করেন। তার স্বামী আসাদ রহমান এই দেশটার জন্যে যুদ্ধ করে মরেই গেছেন, শুধু যে মরে গেছেন তাই না একেবারে হারিয়েই গেছেন মানুষটা, মাটি পেয়েছেন কী না সেইটাও কেউ জানে না। সেই দেশে দুইজন রাজাকার এখন মন্ত্রী, পত্রিকায় তাদের ছবি ছাপা হলে রাহেলা খাতুন ওয়াক থু। বলতেই পারেন।

    এমনিতে রাহেলা খাতুন খুবই হাসি খুশি মানুষ। কিন্তু আজকাল মাঝে মাঝেই মন খারাপ করে ফেলেন, কিছুতেই বুঝতে পারেন না এই দেশে কেমন করে রাজাকাররা মন্ত্রী হয়ে যাবে। তার ছেলে মেয়েরা এই বিষয়টা নিয়ে মায়ের সাথে কথা বলতে চায় না, বলার কিছু নাই সেটা হচ্ছে প্রধান কারণ। তবে তার নাতি নাতনিরা তাকে নানাভাবে ভরসা দিয়ে যাচ্ছে, তারা একেবারে কসম কেটে বলেছে একটু বড় হয়েই তারা দেশটাকে পরিষ্কার করে ফেলবে। কীভাবে কাজটা করা হবে সেটা নিয়ে কারোই কোনো ধারণা নাই কিন্তু সে জন্যে তাদের কোনো সমস্যা আছে বলে মনে হয় না।

    রাহেলা খাতুনের পাঁচ নাতি নাতনির মাঝে সবচেয়ে বড় জনের নাম রিতু। তার বয়স এখন চৌদ্দ এবং সে ক্লাশ নাইনে পড়ে। আমাদের সাথে জমি দেখতে যাবার সময় মিলি নামে রাহেলা খাতুনের যে মেয়েটি পানিতে ডুবে গিয়েছিল রিতু তার বড় মেয়ে। এক কথায় রিতুর পরিচয় দিতে হলে বলা যায় সে হচ্ছে তার মায়ের মতো তেজী একজন মেয়ে। এই তেজের জন্যে মাঝে মাঝেই সে বড় বড় ঝামেলায় পড়ে যায় কিন্তু সেজন্যে তার তেজ কখনো কমে নাই, বরং বেড়েছে।

    যেমন ধরা যাক কয়েকদিন আগে তাদের স্কুলের পদার্থবিজ্ঞান স্যারের কথা। এই স্যার নতুন এসেছেন, ক্লাশে পড়ানোর সাথে সাথে ছাত্রীদের নানারকম উপদেশ দেন, ঠিক কী কারণ জানা নেই উপদেশের সুরটা রিতুর বেশি পছন্দ না। সেদিন ক্লাসে এসে প্যাস্কেলের সূত্র পড়াতে পড়াতে থেমে গিয়ে দেশের কথা বলতে শুরু করলেন। গলা কাঁপিয়ে বললেন দেশ হচ্ছে দেশ মাতৃকা! আমাদের সবার দায়িত্ব হচ্ছে মায়ের সেবা করা, দেশও যেহেতু মা আমাদের সবার দেশের সেবা করতে হবে। বুঝেছ?

    খুবই ভালো কথা তাই সবার সাথে সাথে রিতুও মাথা নাড়ল। প্যাস্কেলের সূত্র নিয়ে একটা প্রশ্ন রিতুর মাথায় মাঝে কুট কুট করছে কিন্তু যখন দেশ মাতৃকার কথা হচ্ছে সেখানে প্যাস্কেলের সূত্র নিয়ে কথা বলাটা ঠিক হবে না বলে রিতু চুপ করে রইল। কিন্তু স্যারের পরের কথাটা শুনেই তার ভুরু কুঁচকে উঠল। স্যার বললেন, দেশকে এগিয়ে নিতে হলে সবাইকে নিয়ে একসাথে এগিয়ে যেতে হয়। সকল রকম ভেদাভেদ ভুলে যেতে হয়। সেই কবে দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু তখন কে কী করেছিল সেটা নিয়ে এখনো দেশের মানুষের মাঝে বিভাজন, সেটা কী দেশের জন্যে মঙ্গল?

    রিতু বলল, জী স্যার, মঙ্গল।

    স্যার চমকে উঠলেন, এদিক সেদিক তাকিয়ে বললেন, কে? কে কথা বলেছে?

    রিতু হাত তুলে বলল আমি স্যার।

    স্যারের মুখটা কঠিন হয়ে উঠল, তুমি বলছ দেশের মানুষের মাঝে বিভাজন মঙ্গল?।

    আমি বলতে চাইনি স্যার আমি আসলে প্যাস্কেলের সূত্র নিয়ে একটা প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু-

    কিন্তু কী?

    আপনি যেহেতু একটা প্রশ্ন করেছেন তাই বললাম।

    তাই কী বললে?

    রিতু এবার দাঁড়িয়ে গেল, বলল, আপনি ঠিক কী বলছেন পরিষ্কার বুঝি নাই। কিন্তু যদি রাজাকার আর মুক্তিযোদ্ধার কথা বলে থাকেন তাহলে বিভাজন তো থাকতেই হবে। রাজাকারদের বিচার করতে হবে স্যার। মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের বিচার করবে। বিচার করে ফাঁসি দিতে হবে। সবগুলোকে ফাঁসি দিতে হবে।

    স্যারের মুখটা জানি কেমন হয়ে গেল, বললেন ফাঁ -ফাঁ- সি?

    ক্লাশের বেশির ভাগ মেয়ে হঠাৎ কুট কুট করে হাসতে শুরু করল কয়েকজন টেবিলে থাবা দিয়ে শব্দ করল। স্যার ধমক দিয়ে বললেন, চোপ!

    রিতু আগেও লক্ষ্য করেছে, শব্দটা হচ্ছে চুপ কিন্তু চুপ না বলে চোপ বলা হলে সেখানে অনেক বেশি জোর দেওয়া যায়। বেশি করে জোর দেওয়ার জন্য মেয়েরা সবাই চুপ করে গেল। স্যার বিষ দৃষ্টিতে রিতুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। কেউ সরাসরি তাকিয়ে থাকলে তার দিকে পাল্টা তাকিয়ে থাকা অস্বস্তির ব্যাপার, তাই রিতু এদিক সেদিক তাকাতে লাগল। একটু পরে বলল, প্যাস্কেলের সূত্রের প্রশ্নটা করব স্যার?

    স্যার এবারে হুংকার দিলেন, চোপ। বেশি আঁতেল হয়েছ? আমারে মুক্তিযোদ্ধা শেখাও?

    মুক্তিযোদ্ধা শব্দটা বলার সময় স্যার কেমন জানি মুখটা বিকৃত করে ফেললেন। রিতু কিছু না বলে বেশ শান্ত ভাবে চুপ করে রইল। সেটা দেখে স্যার মনে হয় আরো খেপে উঠলেন। জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী বেয়াদপ মেয়ে?

    চুপ করে থাকাটা কীভাবে বেয়াদপি রিতু বুঝতে পারল না, কিন্তু সেটা নিয়ে সে মাথা ঘামাল না। সে নিজের নাম বলল এবং স্যার দাঁড়িয়ে কেমন জানি ফোঁস ফোঁস করতে লাগলেন। প্যাস্কেলের সূত্র নিয়ে প্রশ্নটা আর করা হলো না।

    পরের পিরিওডে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম রিতুকে ডেকে পাঠালেন। রিতু বলল আজকে তার খবর আছে, কিন্তু সে সাহসে ভর করে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের ঘরে গেল। পর্দা ঠেলে যখন রিতু প্রিন্সিপাল ম্যাডামের বিশাল ঘরটায় ঢুকল তখন সেখানে আরো কয়েকজন স্যার আর ম্যাডাম বসেছিলেন। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি এই মেয়েটার সাথে একা কথা বলতে চাই, আমাকে দুই মিনিট সময় দিবেন?

    সব স্যার, ম্যাডাম তখন ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। প্রিন্সিপাল ম্যাডামকে ছাত্রীরা যেরকম বাঘের মত ভয় পায় স্যার ম্যাডামরাও মনে হয় সেরকম ভয় পান। রিতু নিজেকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করল, এখন তাকে খুব গুছিয়ে কথা বলতে হবে, তা না হলে বিপদ আছে।

    প্রিন্সিপাল ম্যাডাম চশমার ফাঁক দিয়ে রিতুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি ক্লাসে রাজ্জাক স্যারের সাথে বেয়াদপি করেছ?

    পদার্থ বিজ্ঞান স্যার হচ্ছেন রাজ্জাক স্যার। রিতু বলল, না ম্যাডাম।

    কিন্তু রাজ্জাক স্যার আমার কাছে তোমার নামে কমপ্লেন করেছেন। একজন স্যার যখন মনে করেন তার সাথে বেয়াদপি করা হয়েছে তখন বুঝতে হবে আসলে বেয়াদপি হয়েছে। বুঝেছ?

    কিন্তু ম্যাডাম-।

    এর মাঝে কোনো কিন্তু নেই। বুঝেছ?

    আসলে কী হয়েছে আপনি শুনবেন না ম্যাডাম?

    না। আমি শুনতে চাই না। তুমি রাজ্জাক স্যারের কাছে গিয়ে মাপ চাইবে। বুঝেছ?

    রিতুর ভিতরে কেমন যেন সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। হঠাৎ করে সে মুখ তুলে বলল, না ম্যাডাম। আমি স্যারের কাছে এইটার জন্যে মাপ চাইতে পারব না।

    ম্যাডাম ভুরু কুঁচকে রিতুর দিকে তাকালেন, শীতল গলায় বললেন, কী বললে?

    রিতুর চোখে পানি চলে আসছিল, কিন্তু সে পানি আটকে রেখে বলল, যে স্যার মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে টিটকারী করেন আমি তার কাছে মাপ চাইতে পারব না। রিতু এক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, আমার নানা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।

    ম্যাডাম রিতুর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, রিতুর চোখে পানি চলে আসছিল তবুও সে চোখ নামাল না। একটু পরে বলল, আমি যাই ম্যাডাম?

    যাও।

    রিতু যখন দরজা পর্যন্ত গিয়েছে তখন প্রিন্সিপাল ম্যাডাম ডাকলেন, বললেন, শোনো।

    রিতু দাঁড়াল, ম্যাডাম বললেন, কাছে এসো।

    রিতু ম্যাডামের কাছে এল। ম্যাডাম রিতুর হাত ধরে বললেন, আই এম সরি, আমি তোমার মনে কষ্ট দিয়েছি। আসলে সময়টা খুব খারাপ। বদরবাহিনীর দুইজন কমান্ডার এখন দেশের মন্ত্রী। সবাইকে এখন খুব সাবধান থাকতে হবে। আমরা সবাই এখন খুব বিপদে আছি। দুঃসময়ে টিকে থাকাটাই হচ্ছে বিজয়। বুঝেছ?

    রিতু হাসল বলল, ম্যাডাম। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমরা যখন বড় হব, তখন সব রাজাকারকে ফিনিস করে দেব।

    রিতুর কথা শুনে প্রিন্সিপাল ম্যাডাম চোখ বড় বড় করে রিতুর দিকে তাকালেন। এই হচ্ছে আমাদের রিতু। যখন তেজ দেখালে বিপদ হতে পারে সেখানেও সে তেজ দেখায়।

    রিতুর একজন ছোট ভাই আছে। রিতুর নামের সাথে মিল রেখে তার নাম রাখা হয়েছে তিতু, এই মিল ছাড়া দুইজনের ভেতর আর কোনো মিল নাই। রিতুর বয়স চৌদ্দ, তিতুর বারো। তিতুকে দেখলে অবশ্য মনে হয় তার বয়স আরো অনেক কম। রিতু যেরকম তেজী এবং জেদি এবং ছটফটে তিতু ঠিক সেরকম নরম এবং মোলায়েম এবং শান্ত। কেউ কখনো তাকে কোনো কিছু নিয়ে অস্থির কিংবা রাগ হতে দেখেনি। তার মুখে সবসময়েই একটা মিষ্টি হাসি, সবকিছু নিয়েই সে খুশি। সে কারো মনে কষ্ট দিতে পারে না, সেটি মানুষই হোক আর বিড়ালই হোক।

    এই বাসার যতগুলো বিদখুটে প্রজেক্ট হাতে নেওয়া হয়েছে, শুধুমাত্র তিতু সেই প্রজেক্টগুলো নিয়ে একটু আপত্তি করেছে। এই বাসায় যে সবুজ এবং গোলাপি ছাগল দুটো ঘুরে বেড়ায় তারা যদি জানতো তাহলে তিতুর কাছে ছাগলগুলো আজীবন কৃতজ্ঞ থাকতো। কারণ তিতুর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার কারণে কোরবানী ঈদের আগের রাতে তারা প্রাণে বেঁচে গেছে। বাসার বিড়ালটাকে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতো রং করার আগেও তিতু বিড়ালটাকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু অন্য সবার প্রবল আগ্রহের কারণে বিড়ালটাকে এই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে। বাসার সামনে কুমির পালার জন্যে যে গর্ত করা হয়েছিল এবং যেখানে রাহেলা খাতুনকে কোনোকুনি কবর দেওয়ার আলোচনা হয়েছে সেটা তিতু কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। যেদিন প্রথম এটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে তখনই সে সারাক্ষণ মাথা নেড়ে আপত্তি করে গেছে। সবাই চলে যাবার পর সে তার নানি রাহেলা খাতুনের কাছে গিয়ে একেবারে তার গলা জড়িয়ে ধরে ফিস ফিস করে বলেছে, মা।

    রাহেলা খাতুন যদিও বাচ্চাদের নানি কিংবা দাদি কিন্তু বাচ্চারা মাঝে মাঝেই তাকে মা ডেকে ফেলে। রাহেলা খাতুন তিতুর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললেন কী হয়েছে সোনা।

    তোমাকে যে কবর দেবে বলেছে সেটা তো সত্যি সত্যি বলেনি, তাই না মা?

    রাহেলা খাতুন মুচকি হাসলেন বললেন, কিন্তু একদিন তো বুড়ি হয়ে মারা যেতেই হবে, কবর দিতেই হবে?

    তিতু রাহেলা খাতুনের মুখে হাত দিয়ে বলল, না না না। তুমি মারা যাবে না, মা। তুমি কখনো মারা যাবে না।

    রাহেলা খাতুন তিতুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ঠিক আছে সোনা, আমি কখনো মারা যাব না।

    সবাই যে বলেছে তোমাকে কোনাকুনি কবর দেবে সেটা কিন্তু ঠাট্টা করে বলেছে। বুঝেছ?

    হ্যাঁ বুঝেছি।

    আমরা কিন্তু কেউ আসলে তোমাকে মারা যেতে দেবো না। বুঝেছ মা? সবাই তোমার সাথে ঠাট্টা করেছে। কিন্তু মা, ঠাট্টা করেও এগুলো বলতে হয় না। এগুলো খুব খারাপ কথা।

    ঠিক আছে সোনা।

    তুমি মন খারাপ করো নাই তো? কেউ কিন্তু আসলে আসলে বলে নাই, সবাই ঠাট্টা করে বলেছে।

    রাহেলা খাতুন হাসি গোপন করে মাথা নাড়লেন, বললেন, না, মন খারাপ করি নাই।

    তুমি মন খারাপ করো না, প্লিজ। তাহলে আমারও অনেক মন খারাপ হবে।

    ঠিক আছে আমি মন খারাপ করব না।

    তিতু তখন আবার তার নানির গলা জড়িয়ে ধরল।

    এই হচ্ছে তিতু। তিতুকে নিয়ে সবাই অল্পবিস্তর দুশ্চিন্তা করে, এরকম নরম একজন মানুষ, বড় হলে যখন চারপাশের সবগুলো মানুষ হবে ডাকাতের মতো তখন সে না জানি কোন ঝামেলায় পড়বে।

    তিতুর বয়স বারো এবং এই বাসায় ঠিক তিতুর বয়সী আরেকজন ছেলে আছে তার নাম টিটন। টিটন হচ্ছে রাহেলা খাতুনের বড় ছেলে, মাসুদের বড় ছেলে। টিটনের মাথায় চুল এলোমেলো এবং চেহারাটা ভাবুকের মতো। বেশিরভাগ সময় সে শান্ত হয়ে বসে থাকে, মনে হয় সে বুঝি কিছুই করছে না। কিন্তু কেউ যদি তার মাথায় ভিতরে উঁকি দিয়ে দেখতে পারত তাহলে আবিষ্কার করতো সেটা মোটেও শান্ত হয়ে নাই, সেখানে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। হাজার রকম বৈজ্ঞানিক ভাবনা সেখানে কিলবিল কিলবিল করছে। মাঝে মাঝেই সেই সব বৈজ্ঞানিক ভাবনা কাজে লাগান হয়। কোনো কোনো সময় সেটা কেউ লক্ষ্য করে না আবার কোনো কোনো সময় সেটা একটা কেলেংকারি হয়ে যায়। এই বাসায় সবাই সবকিছু সহ্য করে বলে টিটন তার বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজ চালিয়ে যেতে পারছে অন্য যে কোনো বাসা হলে অনেক আগেই বিছানার নিচে এবং চারতলায় ছাদের বিভিন্ন কোনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তার ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি নালায় ফেলে দেয়া হতো।

    যেমন ধরা যাক বাসার কাছে গাছের উপর ঝুলে থাকা মরা কাকটার কথা। একদিন দেখা গেল টিটন স্কুল থেকে আসার সময় হাতে একটা মরা কাক ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে বাসায় আসছে এবং রাজ্যের কাক তার পিছু পিছু কা কা করে চিৎকার করে সবার কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। দৃশ্যটি দেখে রাস্তার লোকজন বেশ অবাক হলেও এই বাসার কেউ সেরকম অবাক হলো না। তার মা জিজ্ঞেস করলেন এই কাক কই পেলি?

    ডাস্টবিনে।

    ও। কী করবি এটা দিয়ে?

    গাছে ঝুলাব।

    ও। যা, গাছে ঝুলিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে আয়।

    টিটন তখন মরা কাকটা গাছে ঝুলিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে এল। গাছে ঝোলানোর কাজটা খুব সহজ হল না, অনেক কাক তাকে রীতিমতো আক্রমণ করার চেষ্টা করল। কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্যে টিটন সবরকম বাধা বিপত্তি সহ্য করতে রাজি আছে।

    কাকের চিৎকারের কারণে পুরো দুই দিন এই এলাকার মানুষের প্রায় পাগল হয়ে যাবার অবস্থা হলো কিন্তু তারপর হঠাৎ করে সকল কাক এই এলাকা ছেড়ে অন্য কোনো জায়গায় দেশান্তরী হয়ে গেল।

    বাসার পাশে খোলা জায়গাটার পোড়া দাগটার ইতিহাস অবশ্য মরা কাকের ইতিহাসের মতো এত নিরীহ নয়। একেবার ছোট বাচ্চাও জানে যে রকেট তৈরি করতে হলে তার জন্যে জ্বালানী দরকার, সেই জ্বালানি কীভাবে তৈরি করা যায় সেটা নিয়ে গবেষণা করা রীতিমতো সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই টিটন একটা শর্টকাট পদ্ধতি বেছে নিল। সে ঠিক করল, বিভিন্ন জিনিস মিশিয়ে সেখানে আগুন ধরিয়ে দেখবে সেটা রকেটের জ্বালানি হিসেবে কাজ করে কিনা। টিটন অনুমান করেছিল তার এই গবেষণাটা সবাই খুব সহজে মেনে নাও নিতে পারে। তাই যখন কেউ লক্ষ্য করছে না তখন রান্নাঘর থেকে লোহার কড়াইটা নিয়ে সে বাসার বাইরে চলে এল। সেখানে ছিল তিনশ একান্নটা ম্যাচের কাঠি, দেড় লিটার কেরোসিন, দুই চামুচ ভিনেগার, আব্বর আধ বোতল আফটার শেভ লোশন, আম্মুর সবচেয়ে পছন্দের একুশ ফোঁটা পারফিউম, ছয়টা ন্যাপথলিন, এগারোটা মোমবাতি, আধ লিটার পোড়া মোবিল, চারটা অ্যাসপিরিন এবং এক প্যাকেট সাদা গুড়ো- এই সাদা গুড়োটা টিটন রাস্তার পাশে খুঁজে পেয়েছে, ভিতরে কী আছে কেউ জানে না।

    লোহার কড়াইয়ে সবকিছু ভালো করে ঘুঁটে ঠিক যখন আগুন লাগাবে তখন কোথা থেকে মিঠুন এসে হাজির হলো। মিঠুনের পরিচয় সময় মতো দেওয়া হবে। আপাতত বলে দেয়া যায় মানুষটা মিঠুন না হয়ে অন্য কেউ হলে জ্বালানীর এই গবেষণাটা অগ্রসর নাও হতে পারত, কিন্তু মিঠুনের প্রবল উৎসাহের কারণে টিটন সেখানে আগুন লাগিয়ে দিল। আগুনটা লাগতে চাইছিল না, প্রথমে ধিকি ধিকি করে জ্বলল, তারপর হঠাৎ করে আগুনটা ছড়িয়ে পড়ল। প্রথমে নীল রঙের একটা আগুন তারপর একটা ভয়াবহ বিস্ফোরণ করে দাউ দাউ করে সেই আগুন জ্বলে উঠল। কড়াই থেকে আগুনের গোলা এদিকে সেদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, একটুর জন্যে টিটন। আর মিঠুন বেঁচে গেল। আগুনের শিখা একেবারে বাসার ছাদ পর্যন্ত উঠে গেল তার সাথে কুচকুচে কালো ধোঁয়া। আশেপাশের কিছু গাছের গুঁড়িতেও আগুন লেগে গেল, এবং এই এলাকার লোকজন মজা দেখার ভিড় করে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। রাহেলা খাতুনের একেবারে ছোট ছেলে জয় ঘুমিয়েছিল, হৈ চৈ শুনে সে বের হয়ে দেখে চারিদিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। কী হচ্ছে বুঝতে একটু সময় লাগল। যখন বুঝতে পারল এটা টিটন এবং মিঠুনের আরো একটি কীর্তি তখন সে বাসার ভেতর থেকে বালতি ভর্তি করে পানি এনে কোনোভাবে আগুনটা নিভিয়ে দিল।

    অন্য যে কোনো বাসা হলে এরপর টিটনের সব রকম গবেষণা বন্ধ হয়ে যেতো কিন্তু এই বাসায় তার গবেষণা বন্ধ হলো না। শুধুমাত্র নতুন একটা নিষেধাজ্ঞা জারি হলো যে যদি কখনো কোনো গবেষণায় আগুন জ্বালানোর দরকার হয় তাহলে আগে কোনো একজন বড় মানুষকে সেটা জানিয়ে রাখতে হবে।

    টিটনের কথা বলার সময় যেহেতু মিঠুনের নামটি ব্যবহার করা হয়ে গেছে তাই বয়স অনুযায়ী সবচেয়ে ছোট হওয়ার পরেও তার কথাই আগে বলে নেয়া যাক। তার বয়স মাত্র আট এবং সে রাহেলা খাতুনের তিন নম্বর ছেলে মতিনের সন্তান। মতিন এবং তার স্ত্রী দুজনেই ডাক্তার এবং তাদের বিয়ের কিছুদিন পরেই তারা বুঝতে পারল স্বাভাবিকভাবে তাদের বাচ্চা হতে পারবে না। তারা হাল ছেড়ে না দিয়ে দেশ বিদেশ ঘুরে টেস্ট টিউব বেবী হিসেবে মিঠুনের জন্ম দিয়েছে। বাসার সবারই ধারণা টেস্ট টিউবে বেবী বড় করার সময়ে কোনো একটা গোলমাল হয়ে যাবার কারণে মিঠুন এতো দুষ্টু হিসেবে জন্ম নিয়েছে। এই বাসার একমাত্র বিজ্ঞানী টিটন সবাইকে বুঝিয়ে গেছে যদিও এরকম বাচ্চাদের টেস্টটিউব বেবী বলে কিন্তু তাদের মোটেও টেস্টটিউবে বড় করা হয় না, কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয় নাই। সবারই বদ্ধমূল ধারণা সে একটা ছোট ব্যাঙ্গাচির মতো টেস্টটিউবের ক্যামিকেলে সাঁতার কেটে কেটে বড় হয়েছে। মিঠুল নিজেও এটা বিশ্বাস করতে পছন্দ করে যে সে ছোট থাকতে একটা টেস্টটিউবের ভেতর ব্যাঙ্গাচির মতো সাঁতার কাটত।

    মিঠুনের দুষ্টুমির বর্ণনা দিতে হলে শুধু তাকে নিয়েই মোটা একটা বই লিখতে হবে। একজন মানুষের মাথা থেকে কীভাবে এতো দুষ্টু বুদ্ধি বের হতে পারে সেটা একটা রহস্য। শুরুতে যে দুষ্টুমির কথাগুলো বলা হয়েছে তার সবগুলোর নায়ক (কিংবা ভিলেন) হচ্ছে মিঠুন। একেবারে জন্মের পর থেকে সে দুষ্টু। ছোট বাচ্চার যখন জন্ম হয় তারা আস্তে আস্তে সবকিছু করতে শিখে। মিঠুন সবকিছু শিখেছে আগে আগে। যখন গড়াগড়ি দেওয়ার কথা তখন সে হামাগুড়ি দিয়েছে। যখন হামাগুড়ি দেওয়ার কথা তখন হাঁটাহাঁটি করেছে, যখন হাঁটাহাঁটি করার কথা তখন দৌড়াদৌড়ি করা শুরু করেছে। শুধু দৌড়াদৌড়ি করে শান্ত থাকলে একটা কথা ছিল সে একটা মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে বাসায় ঘুরে বেড়িয়েছে। তার প্রিয় কাজ ছিল টেবিলক্লথ ধরে টান দিয়ে টেবিলের সবকিছু নিচে ফেলে দেওয়া। এক মুহূর্তে চোখের আড়াল হলেই সে এরকম কিছু একটা অঘটন করে ফেলতো।

    মিঠুনের আপু রাণী দাবী করেন মিঠুনের জন্মের আগেই বুঝে গিয়েছিলেন সে খুবই দুষ্টু একটা বাচ্চা হবে। পেটের ভেতরেই সে নাকি সারাক্ষণ এদিক সেদিক ঢুশঢাশ করত। জন্ম হবার পর যখন ন্যাপি বদলানোর সময় হতো তখন হিস্যু করে সবাইকে ভিজিয়ে দিয়ে সে মাঢ়ি বের করে হাসতো! যখন একটু বড় হয়েছে কেউ তাকে কোলে নিলেই সে খামচি দিয়ে মুখের চামড়া খাবলে নিত। চোখে চশমা থাকলে তো কথাই নেই খপ করে চশমাটা ধরে টান দিয়ে নাক থেকে খুলে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিত।

    এখন স্কুলে ভর্তি হয়েছে, প্রায় প্রত্যেকদিন সেখান থেকে বাসায় একটা নালিশ আসে। নালিশের ধরনটাও বিচিত্র, সে যে শুধু দুষ্টুমি করছে তা না, ক্লাশের যতগুলো শান্ত শিষ্ট বাচ্চা ছিল তাদেরকেও দুষ্টুমি শিখিয়ে দিয়েছে এখন পুরো ক্লাস মিলে দুষ্টুমি করে! সেই দুষ্টু দলের লিডার হচ্ছে মিঠুন।

    সেই তুলনায় বাসাতেই সে বরং একটুখানি শান্ত হয়ে থাকে। বাকি চার ভাই বোন মিলে তাকে মোটামুটি নিয়ন্ত্রণের মাঝে রাখতে পারে। মিঠুন জানে তার চার ভাই বোন তাকে শুধু যে সামলে রাখে তা নয় যখন কোনো বিপদের মাঝে পড়ে তখন তারাই তাকে সেই বিপদ থেকে রক্ষা করে।

    সেদিন তার আব্দুর টেলিফোন বেজেছে, দেশে নূতন মোবাইল ফোন এসেছে সবারই সেটা নিয়ে কৌতূহল, সবচেয়ে বেশি কৌতূহল মিঠুনের। তার আলু বা আম্মু আশেপাশে নেই তাই সে লাফ দিয়ে টেলিফোনটা ধরে ফেলল, বলল, হ্যালো।

    অন্য পাশ থেকে জিজ্ঞেস করল, ডক্টর মতিন বাসায় আছেন?

    মিঠুন খুবই ভদ্রভাবে বলল, জী, বাসায় আছেন।

    তার সাথে কী কথা বলা যাবে?

    জী বলা যাবে।

    তাকে টেলিফোনটা দিতে পারবে?

    পারব।

    ভেরি গুড।

    মিঠুন টেলিফোনটা রেখে খেলতে চলে গেল। রাত্রে যখন মতিন মিঠুনকে জিজ্ঞেস করল কেন তাকে টেলিফোনটা দিল না মিঠুন দাঁত বের করে হেসে বলল, আমাকে দিতে বলে নাই আব্দু। আমাকে খালি জিজ্ঞেস করেছে দিতে পারব কী না। আমি বলেছি পারব। ভুল তো বলি নাই!

    অকাট্য যুক্তি, সেই যুক্তি শুনে মিঠুনের বাবা পারলে নিজের চুল ছিঁড়ে ফেলেন। এই হচ্ছে আমাদের মিঠুন।

    বাসার পাঁচজন ছেলে মেয়ের চার নম্বর হচ্ছে টিয়া। সে হচ্ছে রাহেলা খাতুনের বড় ছেলে মাসুদের ছোট মেয়ে। বয়সে সে দুষ্টু মিঠুন থেকে দুই বছর বড় এবং বিজ্ঞানী টিটন কিংবা মহাপুরুষ তিতুর থেকে দুই বছরের ছোট। তবে তাকে চোখ বুজে এই বাসার সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষ বলা যায়। টিয়ার জন্ম হবার পর তার আম্মু কোনো একটা লেখায় পড়লেন যে ছোট বাচ্চাদের বই পড়ে শোনালে তারা নাকি নিজেরা নিজেরা পড়তে শিখে যায়। বিষয়টা সত্যি কিনা পরীক্ষা করার জন্য টিয়াকে তার আম্মু বই পড়ে শোনাতে শুরু করলেন এবং দেখা গেল টিয়া গভীর মনোযোগ দিয়ে বই পড়া শুনতে লাগল। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, টিয়ার যখন বয়স তিন বৎসর তখন সে বই পড়া শিখে গেল। টিয়াকে বই পড়তে দেখে মিঠুনের আম্মুও মিঠুনকে বই পড়ে শোনাতে চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু মিঠুন বই পড়ার থেকে বইয়ের পৃষ্ঠা ছিঁড়ে সেটা মুখে ঢুকিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে বেশি আগ্রহ দেখানোর কারণে মিঠুনের আম্মু আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন!

    চার বছর বয়সে টিয়া বাসায় ছোটদের সব বই পড়ে শেষ করে ফেলল। পাঁচ বছর বয়সে সে তার দাদি রাহেলা খাতুনকে ভোরবেলা পত্রিকা পড়ে শোনাতে লাগল। এখন তার বয়স দশ, সে এর মাঝেই এই বাসার পড়ার মতো সব বই পড়ে শেষ করে ফেলেছে, তার জন্যে এখন লাইব্রেরি থেকে বই আনতে হয়। টিয়া যে শুধু বড় বড় মোটা মোটা বই পড়ে তা নয় সে খুব তাড়াতাড়ি বই পড়তে পারে। সবাই একটা লাইনের সবগুলো শব্দ আলাদা আলাদা করে পড়ে কিন্তু টিয়া পুরো লাইনটা এক সাথে পড়ে। তাই সে যখন একটা বই পড়ে তখন দেখে মনে হয় সে বুঝি কিছু না পড়ে শুধু চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে। প্রথম প্রথম কেউ বিশ্বাস করতো না যে সে পড়ছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবাইকে বিশ্বাস করতে হয়েছে যে আসলেই সে পুরোটুকু খুবই মনোযোগ দিয়ে পড়ে।

    মাত্র কিছুদিন আগে তাদের স্কুলে একজন নতুন ম্যাডাম এসেছেন। ক্লাশের ছেলে মেয়েদের ব্যস্ত রাখার জন্যে সবাইকে তাদের বইয়ের একটা গল্প পড়তে দিয়েছেন। সবাই যখন পড়ছে তখন টিয়া পড়া শেষ করে বইটা বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। ম্যাডাম ভুরু কুঁচকে টিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই মেয়ে আমি সবাইকে পড়তে বলেছি না?

    আমি পড়েছি ম্যাডাম।

    মিথ্যা কথা বলবে না। তুমি পড় নাই। আমি দেখেছি তুমি শুধু পৃষ্ঠা উল্টে গেছ।

    না ম্যাডাম, আমি পড়েছি।

    ম্যাডাম এবারে ধমক দিলেন, তুমি পড় নাই।

    টিয়া কী করবে বুঝতে পারছিল না তখন টিয়ার পাশে বসে থাকা ছেলেটা তাকে সাহায্য করল, সে ম্যাডামকে বলল, ম্যাডাম, টিয়া পড়েছে। টিয়া খুব তাড়াতাড়ি পড়তে পারে।

    তাড়াতাড়ি পড়তে পারে?

    ছেলেটা চোখ বড় বড় করে বলল, জী ম্যাডাম, টিয়া এই মোটা মোটা বই এক টানে পড়ে ফেলতে পারে!

    ম্যাডাম আবার ভুরু কুঁচকে তাকালেন, কিন্তু ততক্ষণে ক্লাশের অন্য ছেলে মেয়েরাও কথা বলতে শুরু করেছে। তারা বলতে লাগল, জী ম্যাডাম, টিয়া খুব তাড়াতাড়ি পড়তে পারে। আমরা যখন এক লাইন পড়ি সে তখন এক পৃষ্ঠা পড়ে ফেলে। বিশ্বাস না করলে তাকে পড়তে দেন ম্যাডাম! পড়তে দেন।

    ম্যাডাম তখন তার ব্যাগ থেকে একটা বই বের করে বইটার একটা পৃষ্ঠা বের করে টিয়ার হাতে দিয়ে বললেন, পড় দেখি এই পৃষ্ঠাটি।

    টিয়া বইটি হাতে নিল পৃষ্ঠাটার উপর চোখ বুলিয়ে বইটা ফিরিয়ে দিল। ম্যাডাম অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে টিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, তুমি তো পড় নাই, শুধু চোখ বুলিয়েছ।

    না ম্যাডাম পড়েছি। ভালো করে পড়েছি।

    বল দেখি কী লেখা আছে এখানে।

    টিয়া প্রায় দাড়ি কমাসহ কী লেখা আছে বলে দিতে শুরু করল এবং পৃষ্ঠার মাঝামাঝি আসার পর ম্যাডাম বললেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে, আর বলতে হবে না। আমি বিশ্বাস করেছি।

    টিয়ার জন্যে পুরো ক্লাস এবার আনন্দে চিৎকার করে উঠল, যেন টিয়া নয় তারাই ম্যাডামকে চমৎকৃত করেছে।

    ম্যাডাম অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, কী আশ্চর্য! কী চমৎকার! কী অসাধারণ! তারপর টিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কীভাবে এটা করতে শিখেছ?

    টিয়া লাজুক মুখে বলল, পড়তে পড়তে হয়ে গেছে ম্যাডাম।

    তুমি কী অনেক বই পড়?

    জী ম্যাডাম।

    কার কার বই পড়েছ?

    সবার বই পড়েছি। এখন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই পড়ছি।

    ম্যাডাম একটু খাবি খেলেন, মা-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়?

    জী ম্যাডাম। শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ শেষ করেছি।

    রবীন্দ্রনাথ?

    শুধু গল্পগুচ্ছ পড়েছি। আর নৌকাডুবি।

    ম্যাডাম চোখ বড় বড় করে টিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন ক্লাশের ছেলে মেয়েরা আনন্দে চিৎকার করতে লাগল। তাদের চিৎকার শুনে মনে হতে লাগল, শুধু টিয়া নয় যেন তারা সবাই গল্প গুচ্ছ আর নৌকাডুবি পড়ে শেষ করে ফেলেছে!

    এই হচ্ছে রাহেলা খাতুনের পাঁচজন নাতি নাতনির পরিচয়। সবচেয়ে বড় জন হচ্ছে রিতু, রীতিমতো তেজী একজন নেতা। টিটন একজন খাঁটি বিজ্ঞানী, সবচেয়ে ভালো ছাত্র হওয়ার পরেও রোল নম্বর সব সময় পনেরো না হয় ষোলো। কারণ অঙ্ক আর বিজ্ঞান ছাড়া আর সব সাবজেক্টে তাকে টেনে টুনে পাস করতে হয়! তিতু হচ্ছে ছোট একটা শরীরে আটকে থাকা একজন মহাপুরুষ। টিয়া হচ্ছে জ্ঞানতাপস, পাঁচজনের ভেতর একমাত্র মানুষ যার চোখে চশমা এবং সবচেয়ে ছোট জন হচ্ছে মিঠুন, পৃথিবীর সেরা দুষ্টুদের একজন। যার সম্পর্কে যত কম কথা বলা যায় তত ভালো। একদিন বিকেলে দেখা গেল রাহেলা খাতুনের এই পাঁচ নাতি-নাতনি একটা জরুরি মিটিংয়ে বসেছে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকাবিল কোহকাফী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
    Next Article আমার সাইন্টিস মামা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    Related Articles

    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    ছোটগল্প – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সাদাসিধে কথা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    মেকু কাহিনী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    আমার বন্ধু রাশেদ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    সায়েন্স ফিকশান সমগ্র ১ – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    টুনটুনি ও ছোটাচ্চু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

    November 19, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }