Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    এক ডজন গপ্‌পো – সত্যজিৎ রায়

    উপন্যাস সত্যজিৎ রায় এক পাতা গল্প226 Mins Read0

    ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি – ৩য় পর্ব

    ৩

    ‘আর সাতাত্তর পা।’

    ‘আর যদি না হয়?’

    ‘হবেই, ফেলুদা। আমি সেবার গুনেছিলাম।’

    ‘না হলে গাঁট্টা তো?’

    ‘হ্যাঁ—কিন্তু বেশি জোরে না। জোরে মারলে মাথার ঘিলু এদিক ওদিক হয়ে যায়।’

    কী আশ্চর্য—সাতাত্তরে রাজেনবাবুর বাড়ি পৌঁছলাম না। আরো তেইশ পা গিয়ে তবে ওর বাড়ির গেটের সামনে পড়লাম।

    ফেলুদা ছোট্ট করে একটা গাঁট্টা মেরে বলল, ‘আগের বার ফেরার সময় গুনেছিলি, না আসার সময়?’

    ‘ফেরার সময়।’

    ‘ইডিয়ট! ফেরার সময় তো ঢালু নামতে হয়। তুই নিশ্চয়ই ধাঁই ধাঁই করে ইয়া বড়া বড়া স্টেপ্‌স ফেলেছিলি!’

    ‘তা হবে।’

    ‘নিশ্চয়ই তাই। আর তাই স্টেপস্ সেবার কম হয়েছিল, এবার বেশি হয়েছে। জোয়ান বয়সে ঢালু নামতে মানুষ বড় বড় পা ফেলে দৌড়নোর মত। আর বুড়ো হলে ঢালুর বেলা ব্রেক ক’ষে ক’ষে ছোট ছোট পা ফেলতে হয়—তা নাহলে মুখ থুবড়ে পড়ে।’

    কাছাকাছি কোন বাড়ি থেকে রেডিওতে গান শোনা যাচ্ছে। ফেলুদা এগিয়ে কলিং বেল টিপল।

    ‘কী বলবে সেটা ঠিক করেছ ফেলুদা?’

    ‘যা খুশি তাই বলব। তুই কিন্তু স্পীকটি-নট। যতক্ষণ থাকবি এ বাড়িতে একটি কথা বলবিনে।’

    ‘কিছু জিজ্ঞেস করলেও না!’

    ‘শাটাপ!’

    একটা নেপালী চাকর এসে দরজা খুলে দিল।

    ‘অন্দর আঈয়ে।’

    বৈঠকখানায় ঢুকলাম। বেশ সুন্দর পুরোনো প্যাটার্নের কাঠের বাড়ি। শুনেছি রাজেনবাবু দশ বছর হল রিটায়ার করে দার্জিলিং-এ আছেন। কলকাতায় বেশ নাম-করা উকিল ছিলেন।

    চেয়ার টেবিল যা আছে ঘরে সব বেতের। যেটা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে সেটা হচ্ছে চারিদিকে দেয়ালে টাঙানো সব অদ্ভুত দাঁত খিচোনো চোখ রাঙানো মুখোশের সারি। আর আছে পুরোনো ঢাল, তলোয়ার, ভোজালি, থালা, ফুলদানি এইসব। কাপড়ের উপর রং করা বুদ্ধের ছবিও আছে—কত পুরোনো কে জানে? কিন্তু তাতে যে সোনালি রংটা আছে সেটা এখনও ঝলমল করছে।

    আমরা দু’জনে দুটো বেতের চেয়ারে বসলাম।

    ফেলুদা দেয়ালের এদিক ওদিক দেখে বলল, ‘পেরেকগুলো সব নতুন, মর্চে ধরেনি। ভদ্রলোকের প্রাচীন জিনিসের শখটা বোধহয় বেশি প্রাচীন নয়।’

    রাজেনবাবু ঘরে ঢুকলেন।

    আমি অবাক হয়ে দেখলাম ফেলুদা উঠে গিয়ে ঢিপ্‌ করে এক পেন্নাম ঠুকে বলল, ‘চিনতে পারছেন? আমি জয়কৃষ্ণ মিত্তিরের ছেলে ফেলু।’

    রাজেনবাবু প্রথমে চোখ কপালে তুললেন, তারপর চোখের দু’পাশ কুঁচকিয়ে একগাল হেসে বললেন, ‘বা-বা! কত বড় হয়েছো তুমি, অ্যাঁ? কবে এলে এখানে? বাড়ির সব ভালো? বাবা এসেছেন?’

    ফেলুদা জবাব দিচ্ছে, আর আমি মনে মনে বলছি—কী অন্যায়, এত কথা হল, আর ফেলুদা একবারও বলল না সে রাজেনবাবুকে চেনে?

    এবার ফেলুদা আমার পরিচয়টাও দিয়ে দিল। রাজেনবাবুর মুখ দেখে মনেই হল না যে এই সাতদিন আগে আমাকে লজঞ্চুস দেবার কথাটা ওঁর মনে আছে।

    ফেলুদা এবার বলল, ‘আপনার খুব প্রাচীন জিনিসের শখ দেখছি।’

    রাজেনবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ। এখন তো প্রায় নেশায় দাঁড়িয়েছে।’

    ‘কদ্দিনের ব্যাপার?’

    ‘এইতো মাস ছ’য়েক হবে। কিন্তু এর মধ্যেই অনেক কিছু সংগ্রহ করে ফেলেছি।’

    ফেলুদা এবার একটা গলা খাঁকরানি দিয়ে, আমার কাছ থেকে শোনা ঘটনাটা বলে বলল, ‘আপনি আমার বাবার মামলার ব্যাপারে যেভাবে সাহায্য করেছিলেন, তার প্রতিদানে আপনার এই বিপদে যদি কিছু করতে পারি…’

    রাজেনবাবুর ভাব দেখে মনে হল তিনি সাহায্য পেলে খুশিই হবেন, কিন্তু তিনি কিছু বলবার আগেই তিনকড়িবাবু ঘরে ঢুকলেন। তাঁর হাঁপানোর বহর দেখে মনে হল বোধহয় বেড়িয়ে ফিরলেন। রাজেনবাবু আমাদের সঙ্গে ভদ্রলোকের আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমার বিশেষ বন্ধু জ্ঞানেশ সেন অ্যাডভোকেট হচ্ছেন তিনকড়িবাবুর প্রতিবেশী। আমি ঘরভাড়া দেবো শুনে জ্ঞানেশই ওঁকে সাজেস্ট করে আমার এখানে আসতে। গোড়ায় উনি হোটেলের কথা ভেবেছিলেন।’

    তিনকড়িবাবু হেসে বললেন, ‘আমার ভয় ছিল আমার এই চুরুটের বাতিকটা নিয়ে। এমনও হতে পারত যে রাজেনবাবু হয়ত চুরুটের গন্ধ সহ্য করতে পারেন না। তাই সেটা আমি আমার প্রথম চিঠিতেই লিখে জানিয়ে দিয়েছিলাম।’

    ফেলুদা বলল, ‘আপনি কি বায়ুপরিবর্তনের জন্য এসেছেন?’

    ‘তা বটে। তবে বায়ুর অভাবটাই যেন লক্ষ করছি বেশি। পাহাড়ে ঠাণ্ডাটা আরেকটু বেশি এক্সপেক্ট করে লোকে।’

    ফেলুদা হঠাৎ বলল, ‘আপনার বোধহয় গানবাজনার শখ?’

    তিনকড়িবাবু অবাক হাসি হেসে বললেন, ‘সেটা জানলে কী করে হে?’

    ‘আপনি যখন কথা বলছেন তখন লক্ষ করছি যে লাঠির উপর রাখা আপনার ডান হাতের তর্জনীটা রেডিওর সঙ্গে তাল রেখে যাচ্ছে।’

    রাজেনবাবু হাসতে হাসতে বললেন, ‘মোক্ষম ধরেছো। উনি ভালো শ্যামা সঙ্গীত গাইতে পারেন।’

    ফেলুদা এবার বলল, ‘চিঠিটা হাতের কাছে আছে?’

    রাজেনবাবু বললেন, ‘হাতের কাছে কেন, একেবারে বুকের কাছে।’

    রাজেনবাবু কোটের বুকপকেট থেকে চিঠিটা বার করে ফেলুদাকে দিলেন। এইবার সেটা দেখার সুযোগ পেলাম।

    হাতে লেখা চিঠি নয়। নানান জায়গা থেকে ছাপা বাংলা কথা কেটে কেটে আঠা দিয়ে জুড়ে চিঠিটা লেখা হয়েছে। যা লেখা হয়েছে, তা হল এই—‘তোমার অন্যায়ের শাস্তি ভোগ করিতে প্রস্তুত হও।’

    ফেলুদা বলল, ‘এ চিঠি কি ডাকে এসেছে?’

    রাজেনবাবু বললেন, ‘হ্যাঁ। লোক্যাল ডাক—বলা বাহুল্য। দুঃখের বিষয় খামটা ফেলে দিয়েছি। দার্জিলিং-এরই পোস্টমার্ক ছিল। ঠিকানাটাও ছাপা বাংলা কথা কেটে কেটে লেখা।’

    ‘আপনার নিজের কাউকে সন্দেহ হয়?’

    ‘কী আর বলব বলো! কোনদিন কারুর প্রতি কোন অন্যায় বা অবিচার করেছি বলে তো মনে পড়ে না।’

    ‘আপনার বাড়িতে যাতায়াত করেন এমন কয়েকজনের নাম করতে পারেন?’

    ‘খুব সহজ। আমি লোকজনের সঙ্গে মিশি কমই। ডাক্তার ফণী মিত্তির আসেন অসুখ-বিসুখ হলে…’

    ‘কেমন লোক বলে মনে হয়?’

    ‘ডাক্তার হিসেবে বোধহয় সাধারণ স্তরের। তবে তাতে আমার এসে যায় না, কারণ আমার ব্যারামও সাধারণ—সর্দি জ্বর ছাড়া আর কিছুই হয়নি দার্জিলিং এসে অবধি। তাই ভালো ডাক্তারের প্রয়োজন হয় না।’

    ‘চিকিৎসা করে পয়সা নেন?’

    ‘তা নেন বইকি। আর আমারও তো পয়সার অভাব নেই। মিথ্যে অব্‌লিগেশনে যাই কেন?’

    ‘আর কে আসেন?’

    ‘সম্প্রতি মিস্টার ঘোষাল বলে এক ভদ্রলোক যাতায়াত…এই দ্যাখো!’

    দরজার দিকে ফিরে দেখি একটি ফরসা, মাঝারি হাইটের, সুট পরা ভদ্রলোক হাসিমুখে ঘরে ঢুকছেন।

    ‘আমার নাম শুনলাম বলে মনে হল যে!’

    রাজেনবাবু বললেন, ‘এইমাত্র আপনার নাম করা হয়েছে। আপনারও আমার মত পুরোনো জিনিসের শখ সেটাই এই ছেলেটিকে বলতে যাচ্ছিলুম। আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই—’

    নমস্কার-টমস্কারের পর মিস্টার ঘোষাল—পুরো নাম অবনীমোহন ঘোষাল—রাজেনবাবুকে বললেন, আপনাকে আজ দোকানে দেখলুম না, তাই একবার ভাবলুম খোঁজ নিয়ে যাই।’

    রাজেনবাবু বললেন, ‘নাঃ,—আজ শরীরটা ভালো ছিল না।’

    বুঝলাম রাজেনবাবু চিঠিটার কথা মিস্টার ঘোষালকে বলতে চান না। ফেলুদা মিস্টার ঘোষাল আসার সঙ্গে সঙ্গেই চিঠিটা হাতের তেলোর মধ্যে লুকিয়ে ফেলেছে।

    ঘোষাল বললেন, ‘আপনি ব্যস্ত থাকলে আজ বরং…আসলে আপনার ওই তিব্বতী ঘণ্টাটা একবার দেখার ইচ্ছে ছিল।’

    রাজেনবাবু বললেন, ‘সে তো খুব সহজ ব্যাপার। হাতের কাছেই আছে।’

    রাজেনবাবু ঘন্টা আনতে পাশের ঘরে চলে গেলেন। ফেলুদা ঘোষালকে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি এখানেই থাকেন?’

    ভদ্রলোক দেয়াল থেকে একটা ভোজালি নামিয়ে সেটা দেখতে দেখতে বললেন, ‘আমি কোন এক জায়গায় বেশি দিন থাকি না। আমার ব্যবসার জন্য প্রচুর ঘুরতে হয়। আমি কিউরিও সংগ্রহ করি।’

    বাড়ি ফেরার পথে ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম, ‘কিউরিও’ মানে দুষ্প্রাপ্য প্রাচীন জিনিস।

    রাজেনবাবু ঘণ্টাটা নিয়ে এলেন। দারুণ দেখতে জিনিসটা। নিচের অংশটা রূপোর তৈরী, হাতলটা তামা আর পেতল মেশানো, আর তার উপরে লাল নীল সব পাথর বসানো।

    অবনীবাবু চোখ-টোখ কুঁচকে বেশ অনেকক্ষণ ধরে ঘণ্টাটা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন।

    রাজেনবাবু বললেন, ‘কী মনে হয়?’

    ‘সত্যিই দাঁও মেরেছেন। একেবারে খাঁটি পুরোনো জিনিস।’

    ‘আপনি বললে আমার আর কোনই সন্দেহ থাকে না। দোকানদার বলে এটা নাকি একেবারে খোদ লামার প্রাসাদের জিনিস।’

    ‘কিছুই আশ্চর্য না। …আপনি বোধহয় এটা হাতছাড়া করতে রাজী নন? মানে, ভালো দাম পেলেও?’

    রাজেনবাবু মিষ্টি করে হেসে ঘাড় নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘ব্যাপারটা কী জানেন? শখের জিনিস—ভালবেসে কিনেছি। সেটাকে বেচে লাভ করব, বা এমন কি কেনা দরেও বেচব—এ ইচ্ছে আমার নেই।’

    অবনীবাবু ঘণ্টাটা ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আজ আসি। কাল আশা করি বেরোতে পারবেন একবার।’

    রাজেনবাবু বললেন, ‘ইচ্ছে তো আছে।’

    অবনীবাবু বেরিয়ে যাওয়ার পর ফেলুদা রাজেনবাবুকে বলল, ‘ক’টা দিন একটু না বেরিয়ে-টেরিয়ে সাবধানে থাকা উচিত নয় কি?’

    ‘সেটাই বোধ হয় ঠিক। কিন্তু মুশকিল কী জান? সেই চিঠির ব্যাপারটা এতই অবিশ্বাস্য যে এটাকে ঠিক যেন সিরিয়াসলি নিতেই পারছি না। মনে হচ্ছে এটা যেন একটা ঠাট্টা—যাকে বলে প্র্যাক্‌টিক্যাল জোক।’

    ‘যদ্দিন না সেটা সম্বন্ধে ডেফিনিট হওয়া যাচ্ছে, তদ্দিন বাড়িতেই থাকুন না! আপনার নেপালী চাকরটা কদ্দিনের?’

    ‘একেবারে গোড়া থেকেই আছে। কম্‌প্লীটলি রিলায়েব্‌ল।’

    ফেলুদা এবার তিনকড়িবাবুর দিকে ফিরে বলল, ‘আপনি কি বেশির ভাগ সময় বাড়িতেই থাকেন?’

    ‘সকাল বিকেল ঘণ্টাখানেক একটু এদিক ওদিক ঘুরে আসি আর কি। কিন্তু বিপদ যদি ঘটেই, আমি বুড়ো মানুষ খুব বেশি কিছু করতে পারি কি? আমার বয়স হল চৌষট্টি, রাজেনবাবুর চেয়ে এক বছর কম।’

    রাজেনবাবু বললেন, ‘উনি চেঞ্জে এসেছেন, ওঁকে আর বাড়িতে বন্দী করে রাখার ফন্দি করছ কেন তোমরা? আমি থাকব, আমার চাকর থাকবে, এই যথেষ্ট। তোমরা চাও তো দু’বেলা খোঁজ-খবর নিয়ে যেও এখন।’

    ‘বেশ তাই হবে।’

    ফেলুদার দেখাদেখি আমিও উঠে পড়লাম।

    আমরা যেখানে বসেছিলাম তার উল্টোদিকেই একটা ফায়ারপ্লেস। ফায়ারপ্লেসের উপরেই একটা তাক, আর সেই তাকের উপর তিনটে ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। ফেলুদা ছবিগুলোর দিকে এগিয়ে গেল।

    প্রথম ছবিটা দেখিয়ে রাজেনবাবু বললেন, ‘ইনি আমার স্ত্রী। বিয়ের চার বছর পরেই মারা গিয়েছিলেন।’

    দ্বিতীয় ছবি, একজন আমার বয়সী ছেলের, গায়ে ভেলভেটের কোট।

    ফেলুদা জিজ্ঞেস করল, ‘এটি কে?’

    রাজেনবাবু হো হো করে হেসে বললেন, ‘সময়ের প্রভাবে মানুষের চেহারার কি বিচিত্র পরিবর্তন ঘটতে পারে সেইটে বোঝানোর জন্য এই ছবি। উনি হচ্ছেন আমারই বাল্য সংস্করণ। বাঁকুড়া মিশনারি স্কুলে পড়তাম তখন। আমার বাবা ছিলেন বাঁকুড়ায় ম্যাজিস্ট্রেট।’

    সত্যি, ভারী ফুটফুটে চেহারা ছিল রাজেনবাবুর ছেলেবয়সে।

    ‘অবিশ্যি, ছবি দেখে ভুলো না। দুরন্ত বলে ভারী বদনাম ছিল আমার। শুধু যে মাস্টারদের জ্বালিয়েছি তা নয়, ছাত্রদেরও। একবার স্পোর্টসের দিন হান্ড্রেড ইয়ার্ডস-এ আমাদের বেস্ট্‌ রানারকে কাত করে দিয়েছিলাম, ল্যাং মেরে।’

    তৃতীয় ছবিটা একজন ফেলুদার বয়সী ছেলের। রাজেনবাবু বললেন সেটা তাঁর একমাত্র ছেলে প্রবীরের।

    ‘উনি এখন কোথায়?’

    রাজেনবাবু গলা খাঁক্‌রিয়ে বললেন, ‘জানি না ঠিক। বহুকাল দেশ ছাড়া! প্রায় সিক্সটীন ইয়ার্স্‌।’

    ‘আপনার সঙ্গে চিঠি লেখালেখি নেই?’

    ‘নাঃ।’

    ফেলুদা দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলল, ‘ভারি ইন্টারেস্টিং কেস।’

    আমি মনে মনে বললাম, ফেলুদা একেবারে বই-এর ডিটেকটিভের মত কথা বলছে।

    বাইরেটা ছম্‌ছমে অন্ধকার হয়ে এসেছে। জলাপাহাড়ের গায়ের বাড়িগুলোতে বাতি জ্বলে উঠেছে। পাহাড়ের নিচের দিকে চেয়ে দেখলাম রংগীত উপত্যকা থেকে কুয়াশা ওপর দিকে উঠছে।

    রাজেনবাবু আর তিনকড়িবাবু আমাদের সঙ্গে গেট অবধি এলেন। রাজেনবাবু গলা নামিয়ে ফেলুদাকে বললেন, ‘তুমি ছেলেমানুষ, তাও তোমাকে বলছি—একটু যে নারভাস বোধ করছি না তা নয়। এমন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে এ-চিঠি যেন বিনামেঘে বজ্রপাত।’

    ফেলুদা বেশ জোরের সঙ্গেই বলল, ‘আপনি কিছু ভাববেন না। আমি এর সমাধান করবই। আপনি নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করুন গিয়ে।’

    রাজেনবাবু ‘গুডনাইট অ্যান্ড থ্যাঙ্ক ইউ’ বলে চলে গেলেন।

    এবার তিনকড়িবাবু ফেলুদাকে বললেন, ‘তোমার—তোমাকে তুমি বলেই বলছি—তোমার অবজারভেসনের ক্ষমতা দেখে আমি সত্যিই ইম্‌প্রেসড হইচি। ডিটেক্‌টিভ গল্প আমিও অনেক পড়িচি। এই চিঠিটার ব্যাপারে আমি হয়ত তোমাকে কিছুটা সাহায্যও করতে পারি।’

    ‘তাই নাকি?’

    ‘এই যে টুকরো টুকরো ছাপা কথা কেটে চিঠিটা লেখা হয়েছে, এর থেকে কী বুঝলে বল তো?’

    ফেলুদা কয়েক সেকেণ্ড ভেবে বলল, ‘এক নম্বর—কথাগুলো কাটা হয়েছে খুব সম্ভব ব্লেড দিয়ে—কাঁচি দিয়ে নয়।’

    ‘ভেরি গুড।’

    ‘দুই নম্বর—কথাগুলো নানারকম বই থেকে নেওয়া হয়েছে কারণ—হরফ ও কাগজে তফাত রয়েছে।’

    ‘ভেরি গুড। সেইসব বই সম্বন্ধে কোন আইডিয়া করেচ?’

    ‘চিঠির দুটো শব্দ ‘শাস্তি’ আর ‘প্রস্তুত’—মনে হচ্ছে খবরের কাগজ থেকে কাটা।’

    ‘আনন্দ বাজার।’

    ‘তাই বুঝি?’

    ‘ইয়েস। ওই টাইপটা আনন্দবাজারেই ব্যবহার হয়—অন্য বাংলা কাগজে নয়। আর অন্য কথাগুলোও কোনটাই পুরোন বই থেকে নেওয়া হয়নি, কারণ যে হরফে ওগুলো ছাপা, সেটা হয়েছে মাত্র পনর বিশ বছর হল।…আর যে আঠা দিয়ে আটকানো হয়েছে সেটা সম্বন্ধে কোন ধারণা করেছ?’

    ‘গন্ধটা গ্রিপেক্স আঠার মত।’

    ‘চমৎকার ধরেছ।’

    ‘কিন্তু আপনিও তো ধরার ব্যাপারে কম যান না দেখছি।’

    তিনকড়িবাবু হেসে বললেন, ‘কিন্তু তোমার বয়সে আমি ডিটেক্‌টিভ কথাটার মানে জানতুম কিনা সন্দেহ!’

    বাড়ি ফেরার পথে ফেলুদা বলল, ‘রাজেনবাবুর মিষ্ট্রি সল্‌ভ করতে পারব কিনা জানি না—কিন্তু সেই সূত্রে তিনকড়িবাবুর সঙ্গে আলাপটা বেশ ফাউ পাওয়া গেল।’

    আমি বললাম, ‘তাহলে উনিই ব্যাপারটা তদন্ত করুন না। তুমি আর মিথ্যে মাথা ঘামাচ্ছ কেন?’

    ‘আহা—বাংলা হরফের ব্যাপারটা জানা আছে বলে কি সবই জানবেন নাকি?’

    ফেলুদার কথাটা শুনে ভালোই লাগল। ওর মত বুদ্ধি আশা করি তিনকড়িবাবুর নেই। মাঝে মাঝে ফোড়ন দিলে আপত্তি নেই, কিন্তু আসল কাজটা যেন ফেলুদাই করে।

    ‘কাকে অপরাধী বলে মনে হচ্ছে ফেলুদা?’

    ‘অপরা—’

    কথাটার মাঝখানেই ফেলুদা থেমে গেল। তার দৃষ্টি দেখলাম একজন লোককে ফলো করে পিছন দিকে ঘুরছে।

    ‘লোকটাকে দেখলি?’

    ‘কই, না তো। মুখ দেখি নি তো। ‘ল্যাম্পের আলোটা পড়ল, আর ঠিক মনে হল’—ফেলুদা আবার থেমে গেল।

    ‘কি মনে হল ফেলুদা?’

    ‘নাঃ, বোধহয় চোখের ভুল। চ’ পা চালিয়ে চ’, ক্ষিদে পেয়েছে।’

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleবাদশাহী আংটি – সত্যজিৎ রায়
    Next Article সোনার কেল্লা – সত্যজিৎ রায়

    Related Articles

    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }