Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    ড্যান ব্রাউন এক পাতা গল্প575 Mins Read0

    ০৯. বিশাল-বপু হিটাচি টেলিভিশন

    ৮১.

    পোপের অফিসের বিশাল-বপু হিটাচি টেলিভিশনটা লুকানো থাকে ডেস্কের  বিপরীতে একটা কেবিনেটের ভিতরে। সবাই আশপাশে জড়ো হচ্ছে। এগিয়ে গেল ভিট্টোরিয়াও। কমবয়েসি এক রিপোর্টার উদিত হল স্ক্রিনের সামনে।

    এম এস এন বি সি নিউজের পক্ষ থেকে, বলল মেয়েটা, দিস ইজ ক্যালি হরান জোন্স, লাইভ ফ্রম ভ্যাটিকান সিটি। তার পিছনে আলোয় ঝলমল করছে সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা।

    তুমি সরাসরি সম্প্রচার করছ না। চিৎকার করে উঠল রোচার, ব্যাসিলিকার সব আলো নিভিয়ে দেয়া হয়েছে আরো আগেই।

    ওলিভেট্টি একটু হিসহিস করে তাকে থামিয়ে দিল।

    রিপোর্টারের কথা চলছে। একটু যেন উত্তেজিত হয়ে আছে সে। অত্যন্ত শকিং একটা খবর বিশ্বস্ত সূত্রে পাওয়া গেছে। আমরা খবর পেয়েছি যে কলেজ অব কার্ডিনালসের দুজন সদস্য নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন আজ রাতে। রোমে।

    ভিড়মি খেল ওলিভেট্টি।

    রিপোর্টারের কথা চলার সময় গার্ড হাজির হল সামনের দরজায়। স্যার, সেন্ট্রাল সুইচবোর্ডের সব আলো জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা অনুরোধ করছে যেন আমরা…

    ডিসকানেক্ট ইট! চোখ টিভি থেকে না সরিয়েই বলল কমান্ডার, তার চোখ বিস্ফারিত।

    অপ্রস্তুত দেখাচ্ছে গার্ডকে, কিন্তু, কমান্ডার—

    যাও!

    দৌড়ে চলে গেল গার্ড।

    দেখল ভিট্টোরিয়া, কিছু একটা বলতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিল ক্যামারলেনগো। তার বদলে সে ওলিভেট্টির কথার দিকে নজর দিল।

    এম এস এন বি সি এবার ভিডিও ফুটেজ প্রচার করা শুরু করল। কার্ডিনালের ডেডবডি বহন করছে সান্তা মারিয়া ডেল প্রোপোলো গির্জা থেকে, সবাই মিলে আড়াল করে। ফ্রাঙ্কফুর্টের ঐ কার্ডিনালের মরদেহ বহন করা হল একটা আলফা রোমিও পর্যন্ত। গাড়ির ট্রাঙ্কে শরীরটা বসিয়ে দেয়ার আগে টেপ জুম করে তার বিবস্ত্র অবয়ব আরো স্পষ্টভাবে দেখা গেল।

    কোন জানোয়ার এই ফুটেজ নিয়েছে? গর্জে উঠল ওলিভেটি।

    এম এস এন বি সি রিপোর্টার এখনো কথা বলেই যাচ্ছে। বলা হচ্ছে একটা ফ্রাঙ্কফুর্টের কার্ডিনাল ইবনারের মৃতদেহ। তিনি একজন জার্মান। তার শরীর বয়ে আনছে যারা মনে করা হচ্ছে তারা ভ্যাটিকান সিটির সুইস গার্ড।

    একটু যেন অপ্রস্তুত দেখাচ্ছে রিপোর্টারকে। তারপর মেয়েটা সামলে নিতে নিতে জুম করা হল তার মুখের দিকে ক্যামেরা।

    এম এস এন বি সির দর্শকদের জন্য আরো একটা দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। একটা সতর্কতা। ছবিগুলো আরো অন্যরকম লাগবে। কোন কোন দর্শকের কাছে তা ভাল নাও লাগতে পারে।

    খেই হারিয়ে ফেলছে ভিট্টোরিয়া। বুঝে উঠতে পারছে না কী বলবে বা কী বলবে না।

    আবারও বলছি। দৃশ্যগুলো সবার কাছে সহনীয় নাও হতে পারে।

    আবার কী ফুটেজ? তেতে উঠছে ওলিভেট্টি ক্রমেই, এইমাত্র মরার ফুটেজ দেখানো শেষ হল তোমাদের।

    এবার যে দৃশ্য দেখা গেল সেটা খুব পরিচিত। সেখানকার মানুষ দুজনও পরিচিত। সেন্ট পিটার্স স্কয়ারের দুজন মানুষ। দেখতে সাদাসিধা ট্যুরিস্ট। সাথে সাথে চিনে ফেলল ভিট্টোরিয়া। এই দুজন সে আর ল্যাঙডন। স্ক্রিনের উপরে ছোট লেখা উঠলঃ বিবিসির সৌজন্যে।

    একটা ঘন্টি বেজে উঠল কোথাও।

    ওহ.. নো! জোরে চিকার করে উঠল ভিট্টোরিয়া। ওহ, নো!

    বিভ্রান্ত দেখাল ক্যামারলেনগোর চোখমুখ। তাকাল সে সুইস গার্ডের প্রধানের দিকে। আপনারা বলেছিলেন যে এই ফুটেজটা দখল করে নেয়া হয়েছে।

    হঠাৎ টিভিতে দেখা গেল একটা বাচ্চা চিৎকার করছে। মেয়েটা একটা লোকের দিকে আঙুল তাক করে আছে আপাতত যাকে একজন রক্তাক্ত ঘরহীন লোক বলে ভুল হয়। রবার্ট ল্যাঙডন ফ্রেমের ভিতরে চলে এল। চেষ্টা করল মেয়েটাকে সামলানোের। শটটা আরো কাছিয়ে এল।

    পোপের অফিসের প্রত্যেকে এক নিঃশ্বাসে তাকিয়ে থাকল টিভির দিকে যখন অবিশ্বাস্য ব্যাপারটা দেখানো হচ্ছে। পেভমেন্টের উপর উপুড় হয়ে পড়ে গেল শরীরটা আর ফ্রেমে এবার চলে এল ভিট্টোরিয়া। চারধার রক্তে ভেসে যাচ্ছে। বুকে একটা নকশা আকী।

    এই অবাক করা ফুটেজ, আবার কথা বলছে রিপোর্টার, মাত্র কয়েক মিনিট আগে ভ্যাটিকানের বাইরে ধারণ করা হয়। ফ্রান্সের কার্ডিনাল ল্যামাসের মৃতদেহ এটা, এমনই দাবি আমাদের সোর্সের। কেন তিনি এমন সাজে সজ্জিত হয়ে এখানে এলেন এবং কেন তিনি কনক্লেভের ভিতরে নেই সেটা এখনো এক বিরাট প্রশ্নচিহ্নের মত দাড়িয়ে আছে আমাদের সামনে। এখন পর্যন্ত কোন মন্তব্য দিতে রাজি হয়নি ভ্যাটিকান।

    আবার টেপটা রোল করা শুরু করল।

    মন্তব্য দিতে রাজি হইনি! চিৎকার করে উঠল রোচার, আমাদের একটা মিনিট সময় দাও!

    এখনো কথা বলে যাচ্ছে রিপোর্টার। উত্তেজনায় কুচকে গেছে তার। এ এ্যাটাক সম্পর্কে এখনো এম এস এন বি সি খুব বেশি কিছু জানে না কিন্তু আমাদের সোর্স বলছে যে এই খুনগুলো হয়ে যাবার পিছনে অন্যরকম কিছু ইশারা আছে। এমন এক গ্রুপ এই হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে যারা নিজেদেরকে ইলুমিনেটি হিসেবে দাবি করে।

    ফেটে পড়ল ওলিভেট্টি, কী!

    … ইলুমিনেটি সম্পর্কে আরো জানতে পারবেন আমাদের ওয়েবসাইট ঘাটলে। আমাদের ঠিকানা–

    ননে পসিবলে! উত্তেজনায় ইতালিয় এসে পড়েছে কমান্ডারের কণ্ঠে। সাথে সাথে সে চ্যানেল পাল্টে দিল।

    সেখানে কথা বলছে এক পুরুষ রিপোর্টার।–একটা শয়তানি সংঘ, ইলুমিনেটি নামে পরিচিত, অনেক ইতিহাসবেত্তা মনে করেন তারা।

    সাথে সাথে আরো ভাল করে রিমোট বাটন চাপতে শুরু করল। বেশিরভাগ খবরই ইংরেজিতে প্রচারিত হচ্ছে।

    -আজ সন্ধ্যায় একটা চার্চ থেকে সুইস গার্ডরা একটা মরদেহ তুলে এনেছে। মনে করা হচ্ছে সেটা কার্ডিনাল-

    -ব্যাসিলিকা আর মিউজিয়ামের আলো নিভিয়ে দেয়া হয়েছে

    -কথা বলব কন্সপিরেসি থিওরিস্ট টেইলর টিঙ্গলের সাথে, এই দুঃখজনক ঘটনার ব্যাপারে

    –গুজব উঠেছে আজ রাতেই আরো দুটা হত্যাকান্ড ঘটতে যাচ্ছে–

    –প্রশ্ন হচ্ছে, পাপাল কার্ডিনাল বা প্রেফারিতিদের মধ্যে সবচে বেশি সম্ভাবনাময় ব্যক্তি, কার্ডিনাল ব্যাজ্জিয়া কি হারানো লোকদের মধ্যে আছেন-

    ঘুরে দাঁড়াল ভিট্টোরিয়া। সব এত দ্রুত ঘটে যাচ্ছে যে ঠিখ তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না সে। মনে হচ্ছে বাইরের এলাকায় মানুষের ভিড় অনেক বেশি বেড়ে গেছে। মজা দেখতে আসা লোকজন, কৌতুহলী লোকজন, পোপ ও ভ্যাটিকানকে ভালবাসা লোকজন, সংবাদপত্রের লোকজনে সয়লাব হয়ে যাবে আশপাশ।

    চারধারে থিকথিক করতে শুরু করেছে মানুষ। জড়ো হয়েছে অনেকেই। আরো কয়েকটা মিডিয়া ভ্যান তাদের মাল-সামান নামাতে নামাতে চিৎকার করছে ভিতরে ঢোকার জন্য।

    হাত থেকে রিমোট নামিয়ে রেখে ওলিভেট্টি তাকাল ক্যামারলেনগার দিকে, সিনর, আমরা জানি না কী করে সম্ভব হল এ ব্যাপার। আমরা ক্যামেরা থেকে টেপটা ঠিকই বের করে নিয়েছি।

    মুহূর্তকালের জন্য মনে হল স্থাণু হয়ে গেছে ক্যামারলেনগো। কিছু বলতে পারছে না।

    কেউ কিছু বলল না। সুইস গার্ড একেবারে এ্যাটেনশন ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে সামনে।

    দেখে মনে হচ্ছে, অবশেষে রা ফুটল ক্যামারলেনগোর মুখে, আমরা আর এই ক্রাইসিসের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছি না। আগে যা ভেবেছিলাম ব্যাপারগুলো সেভাবে এগুচ্ছে না।

    বাইরের দিকে তাকাল সে, তাকাল উদ্বিগ্ন জনতার দিকে, আমার মনে হয় এবার মুখ খোলার সময় এসেছে।

    না, সিনর, বলল সাথে সাথে কমান্ডার, ঠিক এ ব্যাপারটাই চাচ্ছে ইলুমিনেটি। এ মুহূর্তের অপেক্ষায় আছে তারা। জয় হবে তাদেরই। চুপ থাকতে হবে আমাদের।

    আর এই লোকজন? ক্যামারলেনগো আঙুল নির্দেশ করল বাইরের দিকে, এখন এখানে আছে অযুত লোক, এরপর সংখ্যা বেড়ে যাবে। দাঁড়িয়ে থাকবে শত সহস্র মানুষ। চুপ করে থাকার আরেক নাম এই লোকগুলোকে বিপদে ফেলা। তাদের সতর্ক করে দিতে হবে। হাল ছেড়ে দিচ্ছি আমরা, কমান্ডার। তাদের সরিয়ে নিতে হবে এক্ষুণি। সরাতে হবে কলেজ অব কার্ডিনালসকে।

    এখনো সময় আছে। এন্টিম্যাটারটা খুঁজে বের করার সুযোগ দিন ক্যাপ্টেন রোচারকে।

    ঘুরে দাঁড়াল ক্যামারলেনগো, তার চোখ দিয়ে অগ্নিবাষ্প ঠিকরে বের হচ্ছে, আপনি কি আমাকে নির্দেশ দেয়ার চেষ্টা করছেন?

    না। আমি আপনাকে উপদেশ দিচ্ছি। আপনি যদি বাইরের লোকজনের উদ্বেগ নিয়ে চিন্তিত থাকেন তাহলে আমাদের হাতে উপায় আছে। আমরা বলতে পারি গ্যাস লিক করেছে। পরিষ্কার করে ফেলতে পারি চত্বরটা মুহূর্তে। কিন্তু আমরা যে পণবন্দি সে কথা ফাঁস করা যাবে না।

    অনেক হয়েছে, কমান্ডার, আমরা এ অফিসকে সারা দুনিয়াজুড়ে মিথ্যা কথার ফুলঝুরি ছোটানোর কাজে ব্যবহার করতে পারি না। আমি যদি কিছুই ঘোষণা না করি তো সেটাই সবদিক থেকে শ্রেয় হয়। এটাই হয় সত্যি।

    সতি? ভ্যাটিকান সিটিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে যাচ্ছে একটা শয়তানি সংঘ এ সত্য জানিয়ে দিতে চাচ্ছেন আপনি? এর ফলে আমাদের পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে যাবে।

    ঘোঁৎ ঘোঁৎ করল ক্যামারলেনগো, ঘোলাটে হয়ে যাওয়া? আর কত ঘোলাটে হবে। আমাদের পরিস্থিতি?

    রোচার হঠাৎ করে চিৎকার জুড়ে দিল। হাত থেকে কেড়ে নিল রিমোটটা। বাড়িয়ে দিল আওয়াজ, শুনতে পাচ্ছে প্রত্যেকে।

    সেই মেয়ে রিপোর্টারের সামনে এবার নতুন গল্প ফাঁদছে এম এস এন বি সি। সংবাদদাতার পাশে বিদেহি পোপের একটা ছবি। … ব্রেকিং ইনফরমেশন। খবরটা এইমাত্র বিবিসি থেকে আসছে…

    মেয়েটা চোখ ফিরিয়ে নিল ক্যামেরা থেকে, যেন নিজের সাথে যুদ্ধ করছে এই খবর প্রকাশের জন্য। বেশ কয়েকটা মুহূর্ত সময় নিয়ে সে যুঝল নিজের সাথে, তারপর চোখ ফিরাল দর্শকদের দিকে। এইমাত্র ইলুমিনেটি একটা দায়িত্ব স্বীকার করেছে… আরো একটু দ্বিধান্বিত দেখাল তাকে, পনের দিন আগে পোপের মৃত্যুর দায় তারা স্বীকার করেছে।

    একেবারে ঝুলে পড়ল ক্যামারলেনগোর চোয়াল।

    হাত থেকে রিমোটটা ফেলে দিল রোচার।

    খবরটা হজম করতে পারছে না ভিট্টোরিয়া।

    ভ্যাটিকান নিয়ম অনুসারে, বলছে মেয়েটা হড়বড় করে, কোন পোপের মরদেহ ময়না তদন্ত করা যাবে না। তাই ইলুমিনেটির এই দাবির সত্যতা যাচাই করার কোন উপায় থাকছে না। ইলুমিনেটি জোর গলায় দাবি করছে যে বিগত পোপের মৃত্যুর কারণ স্ট্রোক নয়, বরং পয়জনিং।

    পুরো ঘর জুড়ে আবারও নেমে এল নিরবতা।

    ফাঁক বুঝে কথা বলে উঠল ওলিভেট্টি, নির্জলা মিথ্যাচার!

    আবার চ্যানেল পাল্টানো শুরু করল রোচার। খবরটা চাউর হয়ে যেতে এক বিন্দু সময় নিল না। প্লেগের মত তা ছড়িয়ে পড়ল চ্যানেল থেকে চ্যানেলে। সুবখানে এক কথা, এক গুজব।

    ভ্যাটিকানে খুন।
    পপাপ বিষপ্রয়োগে দেহান্তরিত
    শয়তান তার পাখা বিস্তার করেছে ঈশ্বরের আবাসভূমিতে

    পচাখ ফিরিয়ে নিল ক্যামারলেনগো, গড হেল্প আস।

    পরাচার এখনো হাল ছেড়ে দেয়নি। সে হাজির হল বিবিসিতে।–এইমাত্র আমাকে সান্তা মারিয়া ডি পোপোলোতে ঘটে যাওয়া খুনের ব্যাপারে বিস্তারিত জানাল

    থাম! বলল ক্যামারলেনগো, ব্যাক।

    পিছনে নিয়ে গেল রোচার। স্ক্রিনে দেখা গেল একটা হোল্কা লেকি ডেস্কের পিছনে বসে আছে। লোকটাকে ঠিক মানাচ্ছে না। তার দাড়ি লাল। নিচে লেখাঃ।

    গুন্থার গ্লিক-লাইভ ইন ভ্যাটিকান সিটি

    রিপোর্টার গ্লিক কথা বলছে ফোনে। তাই তার ইমেজ নড়াচড়া করছে না। একটু ঘড়ঘড় আওয়াজ উঠছে লাইন থেকে। … চিগি চ্যাপেল থেকে নেয়া ফুটেজটা আমার ভিডিওগ্রাফার গ্রহণ করে।

    ব্যাপারটা আবার আমাদের দর্শকদের জন্য দেখাতে দিন। বিবিসিতে বসা লোকটা বলল, বিবিসি রিপোর্টার গুন্থার গ্নিকই প্রথম ব্যক্তি যে এ খবর আনেন। তিনি ইলুমিনেটির খুনির সাথে ফোনে দুবার কথা বলেছেন। গুহার, একটু আগে তুমি বলছিলে যে ইলুমিনেটির এ্যাসাসিন একটু আগেও তোমাকে কিছু খবর জানিয়েছিল।

    ঠিক তাই।

    আর তার মেসেজটা এমন যে পোপের মৃত্যুর জন্য তারাই দায়ি? লোকটার কথাবার্তা একেবারে কঠিন।

    সঠিক। লোকটা এইমাত্র আমাদের জানায় যে পোপের মৃত্যু মোটেও কোন স্ট্রোক থেকে হয়নি। ভ্যাটিকান ভুল বুঝেছে। তার মৃত্যুর জন্য দায়ি পয়জনিং। আর সেই বিষ প্রয়োগ করা হয় ইলুমিনেটির পক্ষ থেকে।

    পোপের অফিসের প্রত্যেকে জমে বরফ হয়ে গেল।

    বিষ দেয়া হয়েছে? যেন খাবি খাচ্ছে বিবিসিতে বসে থাকা লোকটা, কিন্তু কীভাবে?

    তারা কোন ব্যাখ্যা দেয়নি। জবাব দিল গ্লিক, শুধু এটুকুই বলেছে যে তারা এক ধরনের ড্রাগ প্রয়োগ করে খুন করে। এর নাম হেপারিন বা এমন কিছু একটা।

    ক্যামারলেনগো, ওলিভেট্টি আর বরাচার সবার চোখে বিভ্রান্তির দৃষ্টি।

    হেপারিন? বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে রোচারকে, কিন্তু আমরাতো জানি…

    সাথে সাথে জবাব দিল ক্যামারলেনগো, পোপের ওষুধ।

    চোখ ফিরিয়ে তাকাল ভিট্টোরিয়া, পোপ হেপারিন নিচ্ছিলেন?

    তার থ্রম্বোফ্লিবিটিস ছিল, বলল ক্যামারলেনগো, দিনে একটা করে ইঞ্জেকশন নিতে হত তাকে।

    এখনো ঘোর কাটেনি রোচারের, কিন্তু হেপারিন মোটেও কোন বিষ নয়। ইলুমিনেটির দাবি অনুযায়ী বলা চলে…

    ডোজে সমস্যা হলে হেপারিন প্রাণঘাতি হতে পারে। তথ্য জানাতে পেরে একটু তৃপ্তি বোধ করছে ভিট্টোরিয়া, হেপারিন একটা শক্তিশালী এন্টিকোএল্যান্ট। একটা ওভারডোজ প্রচন্ড ইন্টারনাল ব্লিডিং ঘটাতে পারে, হতে পারে ব্রেন হেমারেজ।

    ওলিভেট্টি সন্দেহের চোখে তাকাল ভিট্টোরিয়ার দিকে, এ খবর আপনি জানেন কোত্থেকে?

    মেরিন বায়োলজিস্টরা এই একই ওষুধ ব্যবহার করে সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর উপর। তারা যেন পরিবেশের তারতম্যের কারণে কোন প্রকার সমস্যায় না পড়ে, রক্ত যেন জমাট বেধে না যায় সেজন্যে। ড্রাগটার উল্টাপাল্টা ব্যবহারের কারণে অনেক প্রাণী মারা পড়েছে। এই ড্রাগের অসঠিক মাত্রায় প্রয়োগ হলে মানুষ মারা যেতে পারে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে। এর ফলে সহজেই ব্যাপারটাকে স্ট্রোকের সাথে তুলনা করা যায়। বিশেষত কোন ময়না তদন্ত না হলে বোঝার বা ধরার কোন উপায় থাকে না।

    এবার সত্যি সত্যি যেন খাদে পড়ে গেছে ক্যামারলেনগো।

    সিনর, বলল ওলিভেট্টি, এটা নিশ্চই ইলুমিনেটির কোন চালবাজি। কেউ পোপকে ওভারডোজ দিচ্ছে সে কথা চিন্তাই করা যায় না। কারো প্রবেশাধিকার থাকে না। এমনকি আমরাও তার সামনে সব সময় আসতে পারি না। আর পাপাল নিয়ম অনুসারে, কখনোই মারা যাবার পর পরীক্ষা করা যাবে না। আর যদি পরীক্ষা আমরা করতাম, সেখানেও ঘাপলা থাকছে। আমরা জানতেই পারতাম না। প্রতিদিন তিনি এই ড্রাগ নেন। রক্তে এটার চিহ্ন পেতাম, এইতো? তাতে কিছুই প্রমাণিত হয় না।

    সত্যি। তীক্ষ্ণ্ণ হয়ে উঠেছে ক্যামারলেনগোর কষ্ঠ, এখনো একটা অন্য ব্যাপার আমাকে ভাবাচ্ছে। বাইরের কেউ জানত না হিজ হোলিনেস এ ওষুধ নিচ্ছেন।

    আবার নিরবতা নেমে আসে ঘর জুড়ে।

    তার গায়ে যদি বাড়তি হেপারিন থেকে থাকে তাহলে সে চিহ্নও থাকবে। গডগড করে বলল ভিট্টোরিয়া।

    তেতে উঠল ওলিভেট্টিও, মিস ভেট্রা, আপনি হয়ত ভুলে যাচ্ছেন যে আমি আগেই বলেছি যে পাপাল ল অনুসারে কখনোই কোন পোপের মৃতদেহের উপর পরীক্ষা চালানো যাবে না। এটাই ভ্যাটিকানের রীতি। আমরা কোন শত্রুর করা দাবির কথা রাখতে গিয়ে হিজ হোলিনেসের দেহ কাটাছেঁড়া করতে পারি না?

    একটু লজ্জিত দেখাচ্ছে ভিট্টোরিয়াকে। আমার কথার উদ্দেশ্য এমন নয়। আমি আপনাদের সম্মানিত পোপের মরদেহ কাটাছেঁড়ার কথা বলছি না…

    কোন ধরনের সিগন্যাল? জিজ্ঞেস করল ক্যামারলেনগো।

    ভয়ে দুরুদুরু করছে ভিট্টোরিয়ার বুক, ওভারডোজ হলে একটা চিহ্ন থেকে যায়। ওরাল মিউকোসায় রক্তক্ষরণ হতে পারে।

    ওরাল কী?

    ভিকটিমের মুখের ভিতর রক্তক্ষরণ হবে। পোস্ট মর্টেম করলে দেখা যাবে মুখের ভিতরে রক্ত এসে জমাট বেঁধে কালো বর্ণ ধারণ করেছে।

    ভিট্টোরিয়ার মনে পড়ছে লন্ডন এ্যাকুরিয়ামসের একটার মধ্যে একজোড়া কিলার তিমিকে বাড়তি ডোজ দেয়ার কারণে তাদের ট্রেইনারের হাতে মরণ হয়। তিমিগুলো মরে ভেসে ওঠে, ঝুলে ছিল তাদের চোয়াল, আর ভিতরে কালো রক্তের রঙ।

    কোন জবাব দিল না ক্যামারলেনগো। সে ঘুরে দাঁড়াল, মুখ ফিরিয়ে নিল জানালার দিকে।

    রোচারের কণ্ঠ গমগম করে উঠল, সিনর, এই খুনের কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে…

    সত্যি নয়, আবারও নিজের কথায় অটল ওলিভেট্টি, পোপের কাছে ধারে একটা মশাও আসতে পারে না। বাইরের মানুষ তো দূরের কথা।

    যদি এই দাবি সত্যি হয়, নিজের কথায় ফিরে গেল রোচার, এবং আমাদের হোলি ফাদার পয়জন্ড হয়ে থাকেন, তাহলে এন্টিম্যাটার খুঁজে বের করার কাজে আমাদের অনেক অনেক গুণ বেশি সতর্ক হতে হবে। আমরা যা ভাবছি তারচে অনেক অনেক গভীরে প্রোথিত তাদের মূল। হোয়াইট জোনে সার্চ করার কথা ভুলে যেতে হবে আমাদের। আমরা যদি এ হারে এগিয়ে যই, ভয় হচ্ছে, সময় মত খুঁজে নাও পেতে পারি।

    ওলিভেট্টির শীতল চোখের দৃষ্টি আরো উষ্ণতা হারল, ক্যাপ্টেন, আমি আপনাকে বলব কী ঘটতে যাচ্ছে।

    না। বলল ক্যামারলেনগো, হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে, আমি আপনাদের বলছি কী ঘটতে চলেছে। সরাসরি সে তাকাল ওলিভেট্টির দিকে। অনেক হয়েছে, অনেকদূর পর্যন্ত হয়েছে, আর বিশ মিনিটের মধ্যে আমি সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি কনক্লেভ চলবে কি চলবে না, ভ্যাটিকানে কোন মানুষ থাকবে কি থাকবে না সে বিষয়ে। আমার সে সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার?

    চোখের পলক ফেলল না ওলিভেট্টি, জবাবও দিল না কোন।

    এবার কথা বলল ক্যামারলেনগো, আরো জোরের সাথে। তার ভিতরে এমন তেজদীপ্তি আছে তা আগে বোঝা যায়নি। ক্যাপ্টেন রোচার, আপনি হোয়াইট জোনের সার্চ শেষ করবেন এবং রিপোর্ট করবেন আমার কাছে। সরাসরি আমার কাছে।

    নড করল ক্যাপ্টেন সাথে সাথে, একটা অপ্রস্তুত দৃষ্টি হানল ওলিভেট্টির দিকে।

    এবার ক্যামারলেনগো ফিরল দুজন সুইস গার্ডের দিকে। আমি সেই বিবিসি রিপোর্টারকে, মিস্টার গ্লিককে, এই পাপাল অফিসে চাই। ইমিডিয়েটলি। তার সাথে যদি সত্যি সত্যি ইলুমিনেটি এ্যাসাসিন যোগাযোগ করেই থাকে, তাহলে সে হয়ত আমাদের কোন না কোন ভাবে সাহায্য করতে পারবে। যাও।

    উবে গেল দুজন সৈন্য।

    এবার ক্যামারলেনগো ঘুরে দাঁড়াল আবার, তাকাল অন্য সৈনিকদের দিকে, জোয়ানগণ, আমি আর কোন প্রাণঘাতি ঘটনা দেখতে চাই না এই সন্ধ্যায়। রাত দশটার মধ্যে তোমরা সেই দানবটাকে ধরবে, দুজন কার্ডিনালকে উদ্ধার করবে। আমি কি পরিষ্কার করে বলতে পারছি আমার কথা?

    কিন্তু সিনর, বলল ওলিভেট্টি, আমরা মোটেও জানি না কী করে

    মিস্টার ল্যাওডন এ নিয়ে কাজ করছেন, দেখে মনে হচ্ছে তার উপর ভরসা রাখা যায়। আমি রাখছি।

    এই কথার সাথে সাথে দরজার দিকে এগিয়ে গেল ক্যামারলেনগো, তার পদক্ষেপে কী এক সৌকর্য ভর করেছে। বেরিয়ে যেতে যেতে তিনজন প্রহরীর দিকে আঙুল নির্দেশ করে সে, তোমরা তিনজন, এসো আমার সাথে।

    আদেশ পালন করল গার্ডরা।

    দোরগোড়ায় গিয়ে ফিরে দাঁড়াল ক্যামারলেনগো। তাকাল ভিট্টোরিয়ার দিকে, মিস ভেট্রা, আপনিও, দয়া করে আসবেন আমার সাথে?

    একটু অপ্রস্তুত বোধ করে ভিট্টোরিয়া, কোথায় যাচ্ছি আমরা?

    একটু অস্বস্তি যেন বোধ করে ক্যামারলেনগোও, এক পুরনো বন্ধুকে দেখতে।

     

    ৮২.

    সার্নে, সেক্রেটারি সিলভিয়া বোডেলক ক্ষুধার্ত। তার একটা মাত্র আশা, কখন বাসায় হাজির হওয়া যায়। কোনমতে কোহলারের শরীরটা টিকে গেছে। সে ফোন করেছিল। সরাসরি জানিয়েছে, সে চায় যেন সিলভিয়া থাকে। কোন ব্যাখ্যা নেই, নেই কোন ইশারা।

    আজ অনেক বছর ধরে সিলভিয়া কোহলারের অনাকাক্ষিত আচার-ব্যবহারের তোয়াক্কা না করতে শিখেছে। তার নিরব ট্রিটমেন্ট, গোপন মিটিংগুলোতে হুইল চেয়ারের ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও করার চিন্তাধারা-সবই অনেকটা অসুস্থ মনে হয় সিলভিয়ার কাছে। সে আশা করে, একদিন বদমেজাজি লোকটা সার্নের বিনোদনমূলক স্যুটিং রেঞ্জে নিজেকেই গুলি করে বসবে। সে দিন আর আসে না।

    এখন, ডেস্কে একা একা বসে থেকে সে টের পায় পেটের ভিতর ছুচো ছোটাছুটি করছে। কোহলার না তাকে কোন কাজ দিয়ে গেছে, না কোন উপদেশ। শুধু বসে থাক, ব্যস! ফিরেও আসেনি লোকটা। এখানে একেবারে হাত-পা গুটিয়ে বসে বসে মাছি। মারার চেয়ে দোজখে যাওয়া অনেক তৃপ্তির ব্যাপার। ভাবে সে। অবশেষে তার আর তর সয় না। সে একটা নোট রেখে যায় কোহলারের জন্য, তারপর স্টাফ ক্যান্টিনে গিয়ে দু-চার গ্রাস গোগ্রাসে গিলে নেয়ার জন্য পা বাড়ায়।

    আফসোস, তা আর করা হয় না।

    সে যখন সার্নের রিক্রিয়েশন এরিয়া, সুইটস ডি লোইজার পেরিয়ে যেতে থাকে তখনি থমকে দাঁড়ায় বিশাল হলওয়েটার সামনে। যাদের এখানে এখন থাকার কথা নয়

    এমন সব লোকজনের উপচে পড়া ভিড় সেখানে। সবাই তাকিয়ে আছে টেলিভিশনের দিকে। খাবার-দাবারের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে। বড় কিছু না কিছু ঘটছে। সিলভিয়া খাবারের কথা বাদ দিয়ে ঢুকে পড়ে প্রথম স্যুটটায়। এখানে তরুণ কম্পিউটার প্রোগ্রামারার আসর মাতাচ্ছে। টিভিতে হেডলাইন দেখে একটা ভিড়মি খেল সে সাথে সাথে।

    মনোযোগ দিয়ে সিলভিয়া খবরটা দেখে। বিশ্বাস করতে পারছে না নিজের কানকেও। কোন এক পুরনোদিনের ব্রাদারহুড কিনা হত্যা করেছে কার্ডিনালদের! এ দিয়ে কী প্রমাণিত করতে চায় তারা? তাদের ঘৃণা? তাদের ক্ষমতা? তাদের অবজ্ঞা?

    আর এখনো, অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এ ঘরের আবহাওয়া খুব বেশি শোকাতুর নয়।

    দুজন তরুণ স্পেশালিস্ট তাদের হাতের টি শার্ট নাড়াচ্ছে যেখানটায় বিল গেটসের ছবি আকা আর সেই সাথে লেখাঃ এবং গ্লিকরাই পৃথিবীতে শাসন করবে।

    ইলুমিনেটি! চিৎকার জুড়ে দিল একজন, আমি বলেছিলাম না এরা বাস্তব?

    অসম্ভব! আমি মনে করেছিলাম এটা সামন্য এক গেম।

    তারা পোপকে খুন করেছে, ম্যান! দ্য পোপ!

    জিজ! ভেবে পাই না এ দিয়ে তুমি আর কত বাহাদুরি দেখাবে।

    হাসতে শুরু করল তারা।

    ক্যাথলিক মত প্রচার করে সিলভিয়া এখানে। যে কোন ধর্মে অবিশ্বাসীর সাথে তর্ক জুড়ে দেয়। কিন্তু এখানে ওরা কী করছে? এমন অসুস্থ মানসিকতা হয় কী করে কারো কারো? আরে, ক্যাথলিক চার্চ অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বলে নেচেকুদে বাড়ি মাথায় তুলতে হবে নাকি?

    সিলভিয়ার কাছে চার্চ মানে অনেক বড় এক ব্যাপার। সামাজিক সৌহার্দ্যের কেন্দ্রবিন্দু… কখনো কখনো এটা এমন এক জায়গা, যেখানে খোলা গলায় গান। গাইলেও কেউ আড়চোখে তাকাবে না। গির্জাই তার জীবনের বড় বড় ব্যাপারগুলো জুড়ে দিয়েছে জীবনের সাথে… শেষকৃত্য, বিয়ে, ব্যাপ্টিজম, ছুটির দিন… আর তার বদলে চার্চ আর কিছুই চায়নি। এমনকি চাঁদা দেয়ার ব্যাপারটাও একেবারে ঐচ্ছিক। তুমি যদি চাদা দাও তো ভাল, খ্রিস্টবাদের উপকার হচ্ছে, আর যদি না দাও তো আরো ভাল, তুমি এসো। তার সন্তানেরা সানডে স্কুল থেকে হাসিখুশি মনে বাড়ি এসে পৌছে, তাদের হাত থাকে মাথার উপরে তোলা, মন থাকে প্রফুল্ল, অন্তরে গেঁথে যায় হৃদ্যতা, যা আজকাল খুব একটা দেখা যায় না। এর সাথে এমন কান্ড বঁধিয়ে দেয়ার মানে কী!

    সে ভেবে খুব একটা অবাক হয় না যে পৃথিবীর সেরা সেরা প্রতিভাবান তরুণ তুর্কীর মধ্যে বেশিরভাগই নাক সিঁটকায় চার্চের ব্যাপারে। এটা এখন এক ফ্যাশন। তারা কি আসলেই মনে করে কোয়ার্ক আর মেসনই মানব জীবনের সব? কিম্বা সেই ইকুয়েশনগুলো কি মানুষের আত্মিক আর আধ্যাত্মিক সব প্রয়োজন মিটিয়ে ফেলতে পারে?

    স্তম্ভিত মনে সিলভিয়া এগিয়ে যায়, পেরিয়ে যায় হলওয়ে। সব টিভি রুমেই উপচে পড়া ভিড়। এবার তার মাথায় অন্য পোকা জাঁকিয়ে বসেছে। ভ্যাটিকান থেকে কেন কোহলারের কাছে ফোর আসবে, কেনই বা সে এমন ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়বে, তাকে অফিসে থাকতে বলবে বাড়তি সময় সহ এবং সবশেষে নিজেই উধাও হয়ে যাবে। এগুলো কি কোইনসিডেন্স? হয়ত।

    ভ্যাটিকান এমনিতেও সার্নের সাথে মাঝে মাঝেই যোগাযোগ করে, প্রতিষ্ঠানটার নতুন নতুন আবিষ্কারের কারণে সাধুবাদ জানায়। এই কিছুদিন আগেও ন্যানন টেকনোলজির ব্যাপারে তারা যোগাযোগ করেছে সার্নের সাথে। যোগাযোগ করেছে। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যাপারে। কখনো কেয়ার করেনি সার্ন। কোহলার সাধারণত চার্চের সাধুবাদের খবর শোনার পরই ঝুলিয়ে দিত ফোনটাকে। কারণ একটু পরই চটকদার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অযুত নিযুত ফোন আসতে শুরু করবে। তারা নানা ধরনের প্রলোভন দেখাবে নতুন আবিষ্কারটাকে নিজেদের ঝােলায় পুরে নেয়ার ধান্ধায়। তিতিবিরক্ত হয়ে একটা কথাই বারবার বলে কোহলার, খারাপ সংবাদপত্রের মত খারাপ আর কিছু নেই।

    ভেবে পাচ্ছে না সিলভিয়া কী করবে। কোহলারকে একটা ফোনকল কি করবে? তাকে কি বলবে টিভি খুলতে? সে কি কেয়ার করবে? শুনেছে কি এর মধ্যে? অবশ্যই শুনতে পেয়েছে। সে হয়ত তার শয়তানি হাত ব্যবহার করে ক্যামকর্ডারে পুরো রিপোর্টটা গলাধকরণ করছে, বছরে একবার মুচকি হেসে।

    সামনে আরো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল তার জন্য। সেখানে জড়ো হয়েছে সার্নের সর্বজন শ্রদ্ধেয় আবিষ্কৃতীরা। সে যখন কাচুমাচু হয়ে একটা সিট দখল করল তখন কেউ চোখ তুলে তাকাল না তার দিকে।

     

    ভেট্রার বেডসাইড টেবিল থেকে জার্নালটা তুলে এনে পড়ছে ম্যাক্সিমিলিয়ান কোহলার। জায়গাটা লিওনার্দো ভেট্রার এ্যাপার্টমেন্ট। হিমশীতল। এখন আর পড়তে ভাল লাগছে না। তুলে রাখল সে সেটাকে। দেখতে শুরু করল টেলিভিশন। তারপর সে পাট চুকিয়ে বন্ধ করল যন্ত্রটাকে। বেরিয়ে এল এ্যাপার্টমেন্ট থেকে।

    অনেক দূরে, ভ্যাটিকান সিটিতে, কার্ডিনাল মর্টাটি আরো একটা ট্রে তুলে আনলেন, তারপর সেই ব্যালটভর্তি ট্রে টা নিয়ে গেলেন চিমনির দিকে। পুড়িয়ে দিলেন সেগুলো। বেরুল কালো ধোঁয়া, সিস্টিন চ্যাপেলের বিখ্যাত চিমনি দিয়ে।

    দুবার ব্যালটিং হয়েছে, কোন পোপ নির্বাচিত হয়নি।

     

    ৮৩.

    সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় আঁধারের ছড়াছড়ি। উপর থেকে অন্ধকার নেমে এসেছে তারাহীন রাতের মত। সেখানে আলোর উৎস নেই। এক সিমাহীন বিষণ্ণতা জেকে বসছে ভিট্টোরিয়ার সারা অস্তিত্বে! এক একাকী মহাসাগরের মত। ক্যামারলেনগগা আর সুইস গার্ড এগিয়ে যাবার সময় সে কাছাকাছি থাকে কী এক অব্যক্ত আতঙ্কে। অনেক উঁচুতে কোথাও একটা একলা ঘুঘু মন উদাস করে দেয়া আওয়াজ তোলে। শব্দ ওঠে তার অস্থির ডানা ঝাঁপটানোর।

    অস্বস্তি টের পেয়েই যেন একটা হাত রাখে ক্যামারলেনগো তার কাঁধে। যেন জাদুমন্ত্রের মত একটা নিশ্চয়তা আর নির্ভরতা চলে আসে স্পর্শের সাথে সাথে। যা করার তা করতে হবে। হাল ছাড়া যাবে না।

    কী করতে যাচ্ছি আমরা? ভাবে সে, এই পাগলাটে অবস্থার অবসান হচ্ছে কখন?

    এখানে কী করে যেন একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে তার মনে। আমি যা মনে করছি তাই কি করতে যাচ্ছি আমরা? সত্যি সত্যি কি পোপকে ইলুমিনেটি খুন করেছে? তাদের হাত কি এত লম্বা? আমিই কি কোন পোপর মৃতদেহের উপর পোস্ট মর্টেম করা প্রথম মানুষ?

    সে ভেবে পায় না অবশেষে এই আঁধার কেটে যাবে কিনা। আবার সে খোলা সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে কিনা, মনের আনন্দে ব্যারাকুড়ার সাথে সাতরে বেড়াতে পারবে কিনা। প্রকৃতির সাথে তার একটা গাটছড়া বাধা হয়ে গেছে, সেটাকে আর ফিরিয়ে নেয়া যাবে না। আর প্রকৃতিকে দূরে ঠেলা যাবে না একবারও। সে প্রকৃতিকে বোঝে প্রকৃতি বোঝে তাকে। কিন্তু এখন যে দিকটা নিয়ে খতিয়ে দেখতে হচ্ছে তা পুরো ভিন্ন প্রকারের। এখানে মানব আর ধর্ম মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে যার কোনটাকেই সে কোনদিন বুঝে উঠতে পারেনি। খুনে মাছ তিমিরে যেমন মুখ ব্যাদান করে থাকে ঠিক তেম্নি হ করে আছে বাইরের মিডিয়া আর প্রেস ভ্যান, সেসবের মানুষ। ব্র্যান্ডেড মৃতদেহের কথা যতবার মনে পড়ে, যতবার মনে পড়ে টিভি ফুটেজের কথা ততবার বাবার শরীরের কথাটা জাপ্টে ধরে তাকে… মনে পড়ে যায় হত্যাকারির গা জ্বালানো হাসির কথা। লোকটা বাইরে কোথাও আছে। আশপাশেই। ভয়কে পার করে যে বীভৎস রাগ উঠে আসে রি রি করে, সেটাকে ভয় পেতে থাকে ভিট্টোরিয়া।

    এগিয়ে যেতে যেতে আলোর একটা রেশ উঠে আসে উপরে। টের পায় সে, কেমন। অধিভৌতিক এক আলো। ব্যাসিলিকার ঠিক মধ্যখান থেকে। কাছে এসে সে চিনতে পারে, এটাই সে স্যাঙ্কেন স্যাঙচুয়ারি। সেই গোপন চেম্বার যেখানে ভ্যাটিকানের সবচে বড় বড় রথী-মহারথীরা শুয়ে আছেন শান্তিতে। সামনেই সেই তেলের বাতি জ্বলছে নিভু নিভু হয়ে।

    সেন্ট পিটারের হাড়? প্রশ্ন তোলে সে। যদিও জানে এখানে আসা সবার জানা আছে সেই সোনালি সিন্দুকে কী আছে।

    আসলে, না। বলল ক্যামারলেনগো, এ ভুলটা প্রায় সবাই করে। সেটার ভিতরে আছে প্যালিয়াম। নতুন কার্ডিনালদের পোপ যেই পশমী বস্ত্র দান করেন তা।

    কিন্তু আমি মনে করেছিলাম–

    সবাই তাই মনে করে। গাইডবুকে এটাকে সেন্ট পিটারের টম্ব হিসাবে অভিহিত করে। কিন্তু সত্যিকার কবরটা আমাদের দোতলা নিচে অবস্থিত। মাটির গভীরে। ভ্যাটিকান সেখানেই পুঁতে রেখেছে তাকে। কারো যাবার অনুমতি নেই সেখানে।

    একটু ধাক্কামত খেল ভিট্টোরিয়া। সে কতশত মানুষের মুখে শুনেছে একথা! কত মানুষ হাজার হাজার মাইল দূর থেকে আসে একটা বারের জন্য এ জায়গা দেখতে! কত মানুষ এই সোনালি বাক্সটাকে সেন্ট পিটারের শেষ আশ্রয় ভেবে আবেগে আপ্লুত হয়! ভ্যাটিকানের কি উচিৎ নয় সত্য কথাটা জানানো?

    আমরা সবাই এর ফলে একটা সুযোগ পেয়ে যাই। ঐশ্বরিকতার এক মহান স্পর্শ অনুভব করে সবাই।

    ভিট্টোরিয়া, একজন বিজ্ঞানী হিসাবে কথাটাকে ঠিক মেনে নিতে পারল না। সে ভাল করেই জানে মানসিক শক্তি কত বড় শক্তি। কত মানুষ এ্যাসপিরিনকে ক্যান্সারের অষুধ মনে করে ব্যবহার করে! অবাক হলেও সত্যি, তাদের অনেকেই বিশ্বাসের জোরে টিকে যায়। আসলে বিশ্বাস ব্যাপারটা কী?

    পরিবর্তন, বলল ক্যামারলেনগো, এমন একটা ব্যাপার যা আমরা ভ্যাটিকান সিটির ভিতরে দেখতে পছন্দ করি না। আমাদের ভুলগুলোকে মেনে নিয়ে সবার সামনে সব সত্যি সব সময় উপস্থাপিত করতে পারি না। অনেক সমস্যা আছে তাতে। তার পরও, কেউ যে সে চেষ্টা করেনি তা নয়। হিজ হোলিনেস এমন প্রচেষ্টা দেখিয়েছিলেন। তার আরো অনেক পরিকল্পনা ছিল। একটু থমকে দাঁড়াল ক্যামারলেনগো, আমরা আধুনিক বিজ্ঞানের সাথে তাল মেলাতে চাই, আসলে আমরা সবাই যে চাই এমন নয়, চাইতেন হিজ হোলিনেস। তিনি ঈশ্বরের সাথে মিশে যাবার নতুন, বিজ্ঞান সম্মত চেষ্টা করতেন।

    আঁধারে একটু হোচট খেল ভিট্টোরিয়া, যেমন আধুনিক বিজ্ঞান?

    সত্যি বলতে গেলে, বিজ্ঞানের কোন ঠিক ঠিকানা নেই। প্রতিনিয়ত এর পথ বদলে যাচ্ছে। আজ আমরা বিজ্ঞানে যাকে ঠিক বলে ধরে নিই সেটা পরদিনই একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া, বিজ্ঞান ঠিক স্থিত নয়।

    স্থিত নয়?

    ঠিক তাই। বিজ্ঞান বাঁচাতে জানে, বিজ্ঞান জানে কী করে খুন করতে হয়ে আরো নিখুতভাবে। আমি আত্মার ডাকে বিশ্বাসী।

    প্রথম ডাকটা কখন পান আপনি? একটু যেন শ্লেষ মিশে ছিল ভিট্টোরিয়ার কণ্ঠে।

    আমার জন্মের আগে।

    চোখ তুলে তাকাল মেয়েটা ক্যামারলেনগোর দিকে।

    আমি দুঃখিত। ব্যাপারটা সব সময় একটু বেখাপ্পা ঠেকে। আসলে জ্ঞান হবার আগে থেকেই আমি জানতাম ঈশ্বরের সাথে সেবার একটা সম্পর্ক হয়ে যাবে আমার। চিন্তার প্রথম মুহূর্ত থেকেই। এটা সুপ্ত ছিল। তারপর প্রথমবারের মত আমি সেনাবাহি নীতে যোগ দেই। তখনি ভেসে ওঠে মনে, কী হতে চাই আমি, কী হওয়া আছে আমার ভাগ্যে-তা বুঝে উঠতে শুরু করি।

    ভিট্টোরিয়া বোঝার চেষ্টা করছে একজন তরুণ প্রিস্ট কী করে একটা হেলিকপ্টার চালানোর চেষ্টা করছে। অবাক হলেও সত্যি কথা, সে চোখ বন্ধ করে ঠিক ঠিক দেখতে পেল ক্যামারলেনগো ভেস্ট্রোকে, বসে আছে দীপ্ত ভঙ্গিতে, হেলিকপ্টারের কন্ট্রোলের পিছনে। আপনি কি কখনো পোপকে নিয়ে উড়েছেন?

    হায় খোদা! না। সে কাজ আমরা ছেড়ে দিতাম প্রফেশনালদের হাতে এমন ঝুঁকি নিতে রাজি হইনি কোনদিন। তবে ছুটির সময়, অবকাশযাপনের সময় মাঝে মাঝে আমাকে কপ্টার চালাতে দিতেন তিনি। থামল একটু ক্যামারলেনগো, মিস ভেট্টা, সত্যি সত্যি আমরা আপনার কাছে এই দিনের সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞ। আপনার পিতার ব্যাপার আন্তরিকভাবে দুঃখিত। সত্যি।

    থ্যাঙ্ক ইউ।

    আমি কখনো বাবাকে দেখিনি। আমার জন্মের আগেই তিনি মারা যান। দশ বছর বয়সে হারাই মাকেও।

    চোখ তুলে আবার তাকাল ভিক্টোরিয়া, তার চোখ মায়ায় আর্দ্র। আপনি এতিম হয়ে পড়েছিলেন?

    আমি একটা দুর্ঘটনা থেকে কোনক্রমে বেঁচে যাই। এমন এক দুর্ঘটনা যেটা আমার মাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়।

    আপনার দেখভাল করত কে?

    ঈশ্বর। নির্দ্বিধায় বলল ক্যামারলেনগো, যেন এতে কোন সন্দেহ নেই, নেই কোন নাটকীয়তাও, সাথে সাথেই তিনি আরেক বাবার কাছে আমাকে পাঠিয়ে দেন। পালার্মো থেকে একজন বিশপ এগিয়ে আসেন। আমার বিছানার কাছে বসেন। তুলে নেন। আমাকে। সে সময়টাতেও আমি মোটেও অবাক হইনি। আমি যেন জানতাম, ঈশ্বর এমনই চাচ্ছেন। বিশপকে দেখে আমি চমকাইনি, ভয় পাইনি, উত্তেজিত হইনি। আমি জানতাম, ঈশ্বর আমাকে রক্ষা করবেন তার সেবার জন্যই।

    আপনি বিশ্বাস করতেন ঈশ্বর আপনাকে বেছে নিয়েছেন?

    আমি করতাম। আজো আমি তাই বিশ্বাস করি। ক্যামারলেনগোর কণ্ঠে বিন্দুমাত্র উত্তেজনা নেই, অহংকার নেই, শুধু আছে অপার কমনীয়তা, আমি সেই বিশপের কাছে অনেক বছর ছিলাম। আস্তে আস্তে তিনি একজন কার্ডিনাল হন। সে সময়টাতেও তিনি। আমাকে একটুও ভুলে যাননি। আমার স্মৃতিতে তিনিই আমার পিতা। আলোর একটা ঝলক পড়ল লোকটার মুখে, আর সেখানে কী এক অচেনা একাকীত্ব ধরা পড়ল, বুঝতে পারছে ভিট্টোরিয়া।

    একটা উঁচু পিলারের নিচে পৌছে গেল দলটা। তাদের আলো পড়ল নিচের দিকে একটা পথে। নিচের নিঃসীম আঁধারের দিকে এক পলক ফেলেই ভিট্টোরিয়া পিছু ফিরতে চায় সাথে সাথে। এরই মধ্যে ক্যামারলেনগোর দুহাত ধরে গার্ডরা তাকে নিচে নামতে সাহায্য করছে।

    কী হয়েছিল তার? নামতে নামতে অন্যমনস্কতার ভান করে ভয় ঢাকার চেষ্টা করতে ভিট্টোরিয়া, অবিরত, যে কার্ডিনাল আপনাকে গ্রহণ করলেন?

    তিনি কলেজ অব কার্ডিনালসে গেলেন, বলল ক্যামারলেনগগা। অন্য একটা পদের জন্য।

    বিস্ফারিত নয়নে তাকাল ক্যামারলেনগোর দিকে ভিট্টোরিয়া।

    আর তারপর, আমার বলতে কষ্ট হচ্ছে, তিনি চলে গেলেন আমাদের সবাইকে ছেড়ে।

    লে মি কন্ডোগলিয়াঞ্জে! বলল ভিক্টোরিয়া, সম্প্রতি?

    ঘুরে দাঁড়াল ক্যামারলেনগো। তার চোখমুখের অপার বেদনা ঢেকে দিল আশপাশের অন্ধকার। আজ থেকে ঠিক পনের দিন আগে। এখনি আমরা তাকে দেখতে যাচ্ছি।

     

    ৮৪.

    আর্কাইভাল ভল্টের ভিতরে নিভু নিভু আলো কেমন এক ভূতুড়ে ছায়া তৈরি করছে। আগের যে ভল্টটায় ল্যাঙডন ঢুকেছিল সেটার তুলনায় এটা অনেক ছোট। বাতাস কম। কম সময়। সে ভাবছে ওলিলেভেট্টিকে রিসার্কুলেশন ফ্যান ছাড়তে বলবে কিনা।

    ব্যালে আর্টি লেখা শাখাটা নিয়ে সে উঠেপড়ে লেগেছে। সেকশনটাকে হারানোর কোন উপায় নেই। এখানে আটটা তাক জুড়ে শুধু দলিল-দস্তাবেজ সাজানো। থরে বিথরে। ক্যাথলিক চার্চের হাতে অযুত নিযুত শিল্পকর্ম আছে সারা দুনিয়া জুড়ে।

    সেলফগুলোতে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে ল্যাঙডন, গিয়নলরেঞ্জো বার্নিনি লেখা আছে কিনা কোথাও তা নিয়ে সব উলট পালট করছে সে। প্রথম সেল্কের মাঝামাঝি থেকে দেখা শুরু করল সে। আন্দাজ করল, এখানেই বি শুরু হবে। কিন্তু দেখা গেল তা ঠিক নয়। ফাইলগুলো অক্ষর অনুসারে সাজানো নয়। মহাবিপদ। তার পরও তার বিস্ময়ের কারণ অন্য। কেন সে এটা দেখেও অবাক হচ্ছে না?

    উপরের দিকে উঠে গেল একটা মই বেয়ে। দেখতে পেল, প্রথম দিকের দলিলগুলো অনেক বেশি মোটা। সেগুলোতে রেনেসার আমলের সব অগ্রবর্তী শিল্পীর কাজের কথা লেখা। মাইকেলেঞ্জেলো, রাফায়েল, দা-ভিঞ্চি, বত্তিচেল্লি। বোঝা যাচ্ছে, ভ্যাটিকান তাদের সবচে মূল্যবান শিল্পীদের কাজ আগে এগিয়ে রাখছে। এভাবেই সাজাচ্ছে লেজার বুকগুলোকে। রাফায়েল আর মাইকেলেঞ্জেলোর বিশাল কর্মের মাঝখানে স্যান্ডউইচ হয়ে আছে একটা অপেক্ষাকৃত ছোট ফাইল। বার্নিনি। এটাও পাঁচ ইঞ্চির চেয়েও বেশি মোটা।

    এখনি বাতাস ফুরিয়ে আসছে ছোট্ট বদ্ধ কামরায়। গলদঘর্ম হচ্ছে সে মোটা বই হাতে নিয়ে। একলাফে নিচে নেমে এল সে। তারপর ছোট্ট বাচ্চার হাতে কমিক থাকলে যা হয় তেমনি হল। সোজা সে শুয়ে পড়ল মেঝেতেই, মেলে ধরল বার্নিনির বর্ণিলতার কাহিনী। বইটা কাপড়ে বাঁধানো। পুরো বইটা হাতে লেখা। ইতালিয়ানে। প্রতি পৃষ্ঠায় একটা করে কাজের স্বাক্ষর। ছোট্ট বর্ণনা আছে, আছে স্থান, তারিখ, বস্তুর মূল্য আর কোথাও কোথাও শিল্পকর্মের একটা রাফ স্কেচ। সবগুলো পাতা উল্টেপাল্টে দেখল সে। সব মিলিয়ে আটশোর বেশি পাতা। বার্নিনি ব্যস্ত লোক ছিল। বোঝাই যাচ্ছে।

    আর্টের নবীন ছাত্র হিসাবে ল্যাঙডন সব সময় ভিড়মি খেত এত এত কাজ একজন শিল্পী এক জীবনে কী করে করে সেটা ভেবে। তারপর অত্যন্ত হতাশ হয়ে সে লক্ষ্য করে আসলে শিল্পীরা তাদের কাজের খুব কম অংশই নিজহাতে করে। তাদের হাতের নিচে থাকত স্টুডিও, সেখানে শিখতে আসা তরুণ উদীয়মান শিল্পীরা তাদের শিক্ষকের গড়ে দেয়া ধারণা এবং সামান্য কাজের উপর বাকীটা সেরে ফেলত। শিক্ষানবীশদের উপর ভর করে খ্যাতনামারা তাদের ঝান্ডা উড়িয়ে দিতেন।

    বার্নিনির মত শিক্ষকের কাজগুলো গড়ে নিতেন নিজহাতে, তবে তিনি অনুসরণ করতেন ভিন্ন পন্থা। কাজটার ছোট একটা মডেল গডতেন কাদামাটি দিয়ে। তারপর ছাত্ররা সোৎসাহে সেটাকে মার্বেল পাথরের রূপ দিত। আজ ভাল করেই জানে ল্যাঙডন, বার্নিনির মত জগদ্বিখ্যাত আর্টিস্টরা এখনো সব কাজ নিজের হাতে করতে থাকতেন যদি পুরোটা তাদেরই গডতে হত।

    ইনডেক্স! বলল সে ছোট ছেলের মত। দেখতে হবে সেটা। সেখান থেকে আগুনের স্পর্শ পেতে হবে। ফায়ার-ফিউসো-পেতে হবে। দেখতে হবে এফ। কিন্তু এখানেও হতাশ হতে হচ্ছে। এফ একত্রে নেই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার। কোন দুঃখে এই লোকগুলো এ্যালফাবেটিক্যালি সাজায় না লেখাকে। কী দোষ করল বর্ণক্রম?

    এখানেও ভ্যাজাল বাধিয়ে বসেছে কাজ। বর্ণক্রম নয়, পর্যায়ক্রমে সাজানো আছে কাজগুলো। প্রথমে কোনটা গডলেন তিনি, তারপর কোনটা… তারিখ অনুযায়ী সাজানো আছে সব। এতে কোন সাহায্য পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

    লিস্টের দিকে তাকিয়ে আরো হতাশা আকড়ে ধরল তাকে। যে কাজটার খোজ সে করছে সেটায় যে ফায়ার থাকবে এমন কোন কথাও নেই। আগের দুটা কাজ হাব্বাকাক এ্যান্ড দ্য এ্যাঞ্জেল এবং ওয়েস্ট পনেন্টে- কোনটাতেই আর্থ ও এয়ারের নাম-গন্ধ ছিল না।

    দু-এক মিনিট সে বিরাট হতাশা নিয়ে উল্টে গেল পাতাগুলো। যদি চোখে পড়ে যায়! কিন্তু এটা খড়ের গাদায় সঁচ খোজার নামান্তর। ডজন ডজন অচেনা কাজের উপর তার চোখ পড়ল। চোখ পড়ল অনেক জানা কাজের উপরও… ড্যানিয়েল এন্ড দি লায়ন, এ্যাপোলো এ্যান্ড ড্যাফানে, একই সাথে হাফ ডজন ঝর্ণার উপরও চোখ পড়ল তার।

    সাথে সাথে চোখে একটা আশার আলো ঝিকিয়ে উঠল। এই ঝর্ণাগুলো দিয়ে কি ফোর্থ অল্টার অব সায়েন্সের কোন আশা পাওয়া যায়? ওয়াটার? একটা ঝর্ণা দিয়ে ঠিক ঠিক বোঝানো যায় পানিকে। কিন্তু এতে একটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে, পাওয়া যাবে খুনিকে। বার্নিনি ডজন ডজন স্থাপত্যে ঝর্ণা রেখেছেন। বিশেষত চার্চের বাইরে অনেক ঝর্ণা আছে খোদ রোমে।

    আবার চোখ ফেলল সে হাতের ইয়া মোটা বইটার দিকে। একটা কথাই তাকে শান্তনা দিচ্ছে। ভিট্টোরিয়া বলেছিল, তুমি দুটা শিল্পকর্মই চিনতে। সুতরাং তৃতীয়টাও তোমার চেনা কাজের মধ্যে পড়তে পারে…

    আবার বইটার দিকে সোৎসাহে চোখ ফেলল সে। একটা দুটা পরিচিত নাম আসছে না যে তা নয়। কিন্তু তার উপর খুব বেশি ভরসা রাখা যায় না।

    এবার ল্যাঙডন ঠিক ঠিক বুঝতে পারছে এত অল্প সময়ে সব দেখে শেষ করা যাবে না। ভিতরের বাতাস ফুরিয়ে আসছে, ক্ষীণ হয়ে আসছে হাতের সময় বের করতে হবে বইটাকে ভল্ট থেকে। সাথে করে নিয়ে যেতে হবে। এটা নামমাত্র একটা লেজার, বলল নিজেকে, আশ্বাসের মত করে, এটা কোন গ্যালিলিয়ান মাস্টারপিস নয় যে ভল্ট থেকে বের করে আনলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে। আবার বুকপকেটে সেই বইটার অস্তিত্ব অনুভব করল ল্যাঙডন। নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিল,যাবার আগে এটাকে জায়গামত বসিয়ে রাখতে হবে।

    এবার লেজারটাকে তুলে আনার সময় চট করে এক জায়গায় চোখ আটকে গেল তার। একটা ব্যাপারে খটকা লাগল। যদিও এ বইতে এমন অনেক কিছুর নিদর্শন আছে, তবু এটা কেমন যেন বেমক্কা লাগে।

    দ্য এক্সটাসে অব সেন্ট টেরেসা তার চোখ আটকে নিয়েছে। কী এক ব্যতিক্রমী ব্যাপার এখানে আছে তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না ল্যাঙড়ন। এটাকে প্রথমে বসানো হয়েছিল ভ্যাটিকানে। তারপর বাধ সাধলেন পোপ আরবান এইট। অস্টম আরবান বললেন, এটা এত বেশি যৌনাবেদনময় যে ভ্যাটিকানে এটাকে রাখার কোন যুক্তি নেই। শহরের কোন এক অখ্যাত চ্যাপেলে সেটাকে স্থানান্তরিত করেন তিনি। অন, কোন প্রান্তে। যে ব্যাপারটা বেশি ভাবাচ্ছে তা হল, তার লিস্টের পাঁচ চার্চের কোন একটায় সেটা অবস্থিত। সেখানে খটকা লাগানোর মত আরো একটা ব্যাপার আছে।

    আর্টিস্টের সাজেশন অনুযায়ী সেটাকে স্থানান্তর করা হয়।

    ল্যাঙডন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে একটু। এটা একেবারে বেমক্কা লাগছে। বার্নিনি তার মাস্টারপিসগুলোর মধ্যে একটাকে নিজেই কোন অখ্যাত চ্যাপেলের অন্ধকুঠুরীতে সরিয়ে নেয়ার কথা বলবেন। তা কী করে হয়! সব শিল্পী তার আসল আসল কাজকে প্রদর্শিত করতে চায় আসল আসল জায়গায়।

    এখনো দোনোমনা করছে ল্যাঙডন। যদি…

    এমন কি হতে পারে যে বার্নিনি ইচ্ছা করেই তার সবচে সেরা কাজগুলোর একটা বেশি বেশি উত্তেজনা রেখে সেটাকে ভ্যাটিকানের দ্বারা দূরে কোথাও সরিয়ে নেয়ানোর চাল চেলেছিলেন? এমন কোথাও যেখানে বার্নিনি সহজেই পাথ অব ইলুমিনেশন গড়ে তুলতে পারবেন? আসলে কি ওয়েস্ট পনেন্টে ব্রিথের সাথে সোজা পথে সেটাকে বসানো তার পক্ষে অসম্ভব?

    যত বেশি বিশ্বাস করার চেষ্টা করছে ল্যাঙডন ততই আহত হতে হচ্ছে তাকে। এর সাথে আগুনের কোন সম্পর্ক আছে কি? নেই। এটা আর যাই হোক কোন সায়েন্টিফিক ব্যাপার নয়। পর্নোগ্রাফিক হতে পারে, বৈজ্ঞানিক নয়। একবার এক ব্রিটিশ সমালোচক বলেছিলেন, এই শিল্পকর্মটা আর যাই হোক না কেন, কোন ক্যাথলিক চার্চে জায়গা পাবার মত পবিত্রতা রাখে না। বরং তাতে সবচে খোলামেলা যৌনতা প্রকাশ পায়।

    তাইতো, ভেবে পায় না ল্যাঙডন, সেন্ট টেরেসার যে চিত্র তুলে ধরেছিলেন তিনি সেটা নিতান্তই কদর্য বলা চলে। সেন্ট টেরেসা যৌন স্থলনের সময় বেঁকে আছেন এমন একটা স্কাল্পচারকে আর কোথাও রাখা যাকনা যাক, ভ্যাটিকান সিটিতে রাখা সম্ভব নয়।

    খুব দ্রুতহাতে লেজারের পাতা উল্টে শিল্পকর্মটার ব্যাখ্যার দিকে নজর দেয় ল্যাঙড়ন। কিন্তু চোখ চলে যায় স্কেচের দিকে। আবারো আশার একটা ক্ষীণ রেখা দেখা দেয়। সেন্ট টেরেসা সত্যি সত্যি মুহূর্তটাকে উপভোগ করছেন, সেইসাথে আরো একটা ব্যাপার তার চোখে ধরা পড়ে।

    একজন ফেরেস্তা।

    সেই বিখ্যাত কথা হঠাৎ ফিরে আসে…

    একবার সেন্ট টেরেসা বলেছিলেন যে রাতে তার সাথে এক এ্যাঞ্জেলের দেখা হয়। তার পরই বিশ্লেষকরা জোর গলায় বলে, এই দেখা হওয়াটা যত না স্পিরিচুয়াল তারচে অনেক বেশি সেক্সয়াল। তার সাথে আছে বর্ণনা। সেন্ট টেরেসার নিজের বর্ণনাঃ

    … তার বিশাল সোনালি বর্শা… আগুনের লেলিহান শিখায় অত্যুজ্জ্বল… আমার ভিতরে প্রবেশ করে কয়েকবার… এমন এক তৃপ্তি, যা কেউ হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যেতে দিতে রাজি হবে না।

    মুচকে হাসল ল্যাঙডন।

    এটা যদি কোন সত্যিকার যৌন মিলনের বর্ণনা না হয় তবে কীসের বর্ণনা তা আর বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। আরো আশার আলো দেখা দেয় বারবার। যদিও লেখাটা ইতালিয়তে, তবু ঠিক ঠিক বোঝা যায় এখানে আগুনের কথাটা কয়েকবার এসেছে।

    … এ্যাঞ্জেলের বর্শা আগুনের শিখায় ভাস্বর…

    .. এ্যাঞ্জেলের মাথা থেকে অগ্নি আভা ঠিকরে বেরুচ্ছে…

    … মেয়েও আগুনে আগুনে হতবিহ্বল হয়ে যায়, আগুন ধরে যায় তার অন্ত রাত্মায়…

    আবার স্কেচটার দিকে চোখ না ফিরিয়ে ল্যাঙডন নিশ্চিত হতে পারে না। এ্যাঞ্জেলের আগুনে বর্শা উঠে আছে উপরের দিকে। দেখাচ্ছে কোন এক অদেখা পথ।

    … তোমার পথের দ্বিধায় এ্যাঞ্জেলের নির্দেশিত পথেই এগিয়ে যাও…

    এর নাম, সারাফিম। যার অর্থ অগ্নিপুরুষ।

    আবারও পরীক্ষা না করে ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয় রবার্ট ল্যাঙডন। যখন সে দেখতে পেল আসল ব্যাপারটা, ম্রিয়মান হয়ে গেল। যে চার্চে আছে কাজটা সেটার নাম জ্বলছে তার চোখের সামনে।

    সান্তা মারিয়া ডেলা ভিট্টোরিয়া।

    ভিট্টোরিয়া! ভাবল সে, পারফেক্ট।

    পায়ের উপর ভর করে এ্যাঞ্জেলের শিল্পকর্মটার দিকে চোখ রেখে আলতো করে তুলে ধরল সে বইটাকে। তাকাল সিড়ির দিকে। সেখানে আবার সেটাকে রাখা উচিৎ হবে কিনা তা ভাবছে।

    এত ভাবাভাবির কিছু নেই, বলল সে মনে মনে, ফাদার জ্যাকুই কাজটা নিজের গরজেই করবে।

    তারপর রেখে দিল বইটাকে সেই তাকের ঠিক নিচে।

    কপাল কী ভাল তা ভাবতে ভাবতে সে এগিয়ে যেতে থাকে ভল্টের ইলেক্ট্রনিক এক্সিটের দিকে।

    কিন্তু সেখানে পৌঁছার আগেই কপূরের মত উবে যায় তার সৌভাগ্য।

    এক কদম এগুলেই যাওয়া যাবে বহির্গমন পথের দিকে। কিন্তু সেই মুহূর্তেই ফিকে হয়ে গেল আলো। তারপর কালিগোলা অন্ধকারে ডুবে গেল তামাম আর্কাইভ।

    কেউ একজন পাওয়ার অফ করে দিয়েছে।

     

    ৮৫.

    বিদেহী পোপদের শেষ আশ্রয় হচ্ছে সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার তলা।

    ভিট্টোরিয়া সেখানে পৌঁছল এবং গ্রোট্টোতে প্রবেশ করল গোলাকার সিঁড়ি বেয়ে। এই অন্ধকার আর বিশাল ঘরের দিকে তাকিয়ে তার মনে পড়ে যায় সার্নের অতিকায় হ্যাড্রন লিডারের কথা। অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং শিতল। সুইস গার্ডের ফ্ল্যাশলাইটে আলোকিত হয়ে আছে এ জায়গাটা।

    কেমন একটা অস্থিরতা ভর করে ভিট্টোরিয়ার মনের উপরে। তাদের দেখা হচ্ছে। , কোন,গোপন ক্যামেরায় নয়, নয় কোন মানুষের দ্বারা। দেখছেন ক্ষমতাবান কয়েকজন অশরীরী।

    সামনে আছে পোপদের সেই বিখ্যাত সব কফিন। যেগুলোতে শুয়ে আছেন তারা। সেখানে আছে একটা করে ছবি। মৃত পোপর ছবি। সেগুলোতে তারা সবাই বুকে হাত ভাঁজ করা অবস্থায় শুয়ে আছেন। পাশেই পাথুরে কফিন। একে একে তাদের উপর সুইস গার্ডের আলো পড়ছে। আবার চলেও যাচ্ছে। যেন আলো পেয়ে তারা যার পর নাই আনন্দিত। যেন বেরিয়ে আসতে চাচ্ছেন খাচা ভেঙে। এই জীবন যেন আর তাদের ভাল লাগে না। এগিয়ে চলল ভিট্টোরিয়াদের মিছিল। এগিয়ে চলল পোপদের উপর আলো পড়ে আবার অন্ধকারে ডুবে যাবার পালা।

    একটা নিরবতা জেকে বসেছে চারধারে। শ্বাসরোধ করার মত করে চেপে বসেছে তাদের উপর। ভিক্টোরিয়া ভেবে পায় না এই নিরবতার অপর নাম শ্রদ্ধা, নাকি বিচিত্র পরিবেশে চলে আসা গাম্ভীর্য। বন্ধ চোখে এগিয়ে চলেছে ক্যামারলেনগো। যেন প্রতিটা পদক্ষেপ তার অতি চেনা। যেন ঠিক ঠিক সে জায়গামত চলে যেতে পারে না দেখেই। বোঝাই যাচ্ছে সে ফাঁক পেলেই গত পনেরদিনে অনেকবার এসেছে এই জায়গাটায়… সম্ভবত তার এই দিন পনেরর কঠিন পথচলার জন্য আশীর্বাদ কামনা করতে।

    আমি এই কার্ডিনালের সাথে অনেকদিন কাজ করেছি। বলেছিল ক্যামারলেনগো, তিনি আমার কাছে ছিলেন বাবার মত। ভিট্টোরিয়ার মনে পড়ে যায় বারবার বলেছিল ক্যামারলেনগো যে তাকে সেনাবাহিনীর হাত থেকে উদ্ধার করেছিলেন এই কার্ডিনাল। বাকীটা এম্নিতেই বুঝে নিতে পারে ভিট্টোরিয়া। কালক্রমে সেই কার্ডিনাল হয়ে ওঠেন খ্রিস্টবাদের দন্ডমুন্ডের বিধাতা। তারপর নিজের স্নেহের সন্তানতুল্য লোকটাকে দেন চ্যাম্বারলেইনের কঠিন দায়িত্ব। সুযোগ করে দেন সত্যিকার অর্থেই ঈশ্বরের সেবা করার।

    এ দিয়ে অনেক ব্যাপারের ব্যখ্যা করা যায়, ভাবে ভিক্টোরিয়া। সে প্রথম থেকেই দেখে আসছে মুষড়ে পড়া ক্যামারলেনগোর কীর্তিকলাপ। লোকটার ভিতরে পোপকে হারানোর চেয়েও বড় কোন ব্যথা দানা বেঁধেছিল। এমনকি এখনকার এই অবিশ্বাস্য ক্রাইসিসের চেয়েও বড় কোন ব্যাপার ঘটছিল তার ভিতরে। তার ধার্মিক নিরবতার বাইরেও রক্তক্ষরণের মত বিশাল কিছু চলছিল। ঠিক বুঝে ওঠা যায় না ব্যাপারটা। ঠিক ঠিক ভেবেছিল ভিট্টোরিয়া, আর আজ সত্যি সত্যি প্রমাণিত হচ্ছে তার যোগ্যতা। সত্যি সত্যি দেখা যাচ্ছে ঈশ্বর তাকে কোন না কোন বড় বিপদের মুখে কাজ করার জন্যই বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। ভ্যাটিকানের হাজার বছরের ইতিহাসে সবচে বড় বিপদের মুখে লোকটা বীরদর্পে এগিয়ে যাচ্ছে। উড়ে বেড়াচ্ছে অনেকটা একলা পাখির মত।

    এবার একটু ধীর হয়ে যায় গার্ডরা। যেন ইতস্তত করছে কোথায় থামতে হবে সে বিষয়ে। অন্ধকারে আর সব কবরখানার চেয়ে বেশি উজ্জ্বলতায় ভাস্বর হয়ে আছে যেটা, সেটার সামনে গিয়ে থামল ক্যামারলেনগো। সেখানে খোদিত আছে বিগত পোপের চেহারা। মৃত্যুতে মলিন। একটা কেমন যেন অচেনা ভয় জাপ্টে ধরল ভিট্টোরিয়াকে। কী করতে যাচ্ছি আমরা?

    আমি জানি, হাতে একদম সময় নেই। বলল ক্যামারলেনগো, কিন্তু তবুও আমি আশা করি একটা মুহূর্ত জুড়ে আমরা সবাই এখানে ছোট একটা প্রার্থনায় যোগ দিব।

    যার যার জায়গায় দাড়িয়ে থেকে সুইস গার্ডরা বো করল। ধুকপুক করছে ভিট্টোরিয়ার অন্তরাত্মা। এক বিচিত্র ব্যাপার ঘটবে এখন। সম্ভবত ভ্যাটিকানের ইতিহাসে প্রথমবারের মত। ক্যামারলেনগো হাঁটুতে ভর করে বসল। তারপর শুরু করল ইতালিয়তে প্রার্থনা করা।

    কান্নার একটা বাষ্প উঠে আসে ভিট্টোরিয়ার ভিতর থেকে। শুধু মৃত পোপের জন্য নয়, সেই প্রার্থনা যেন আসছে তার নিজের পবিত্র পিতার জন্যও, যার এখন থাকার কথা ছিল সার্নে।

    সর্বপিতা, কাউন্সেলর, বন্ধু, গমগম করে উঠছে ক্যামারলেনগোর অরুদ্ধ কণ্ঠস্বর। ধ্বণিত প্রতিধ্বণিত হচ্ছে বিশাল কক্ষের কোণায় কোণায়। আমার তারুণ্যে  আপনি বলেছিলেন যে আমার হৃদয়ে ঝংকার তোলে যে আওয়াজ তা আমার নয়, ঈশ্বরের। আপনি বলেছিলেন, আমাকে অবশ্যই এটাকে অনুসরণ করে চলতে হবে যে পর্যন্ত না বিপদ এসে গ্রাস করে নেয়। হাজার বিপদেও আপনি সেই ঐশ্বরিক স্পর্শ মেনে চলার আদেশ দিয়েছিলেন। আজ আমি সেই শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমার ভিতরে। শুনতে পাচ্ছি, অসম্ভবকে সম্ভব করতে হবে। আশীর্বাদ করুন আমাকে, শক্তি দিন, আমি যা করব তাই যেন করতে থাকি সারাক্ষণ। আপনি যা বিশ্বাস করতেন তাই যেন পালন করতে পারি বিনা দ্বিধায়। আমেন।

    আমেন। সাথে সাথে বলল গার্ডরা। ফিসফিস করে।

    মনে মনে বলল ভিট্টোরিয়া, চোখের জল মুছতে মুছতে, আমেন, ফাদার।

    একটু ধীর হয়ে এগিয়ে গেল ক্যামারলেনগো, সরে এল, তারপর তাকাল টম্বের দিকে, কভারটাকে অন্যদিকে সরাও। বলল সে সুইস গার্ডদের।

    ইতস্তত করল সুইস গার্ডরা। সিনর, বলল অবশেষে একজন, আমতা আমতা করে, আইন অনুযায়ী আমরা আপনার আদেশ মানতে বাধ্য; আইন অনুসারে, আমরা আপনার অধীন… থামল সে, আমরা তাই করব যা করতে বলবেন আপনি…

    তরুণ লোকটার মন্ত্র পড়ার চেষ্টা করল ক্যামারলেনগো। কোন একদিন তোমার আর আমার এই কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইব আমি। করব। কিন্তু আজ আমি তোমার কাছে আনুগত্যের নিদর্শন চাই। ভ্যাটিকান ল বানানো হয়েছে রোমান ক্যাথলিক চার্চকে রক্ষা করার জন্য। সোজাসাপ্টা আমি তোমাকে সেই আইন ভাঙার আদেশ দিচ্ছি, ভালর জন্য।

    একটা দীর্ঘ মুহূর্ত জুড়ে অস্বস্তির হল্কা বয়ে গেল। তারপর চিফ গার্ড আদেশ করল। গার্ড তিনজন ফ্ল্যাশলাইট নামিয়ে রাখল মাটিতে, তাদের ছায়া লাফিয়ে উঠে গেল মাথার উপরে।

    এগিয়ে গেল তারা। হাত লাগাল। পাথরের ঢাকনাটা সরানো যাচ্ছে না। কালোঘাম ছুটে যাচ্ছে তাদের। গার্ডদের মধ্যে যে সিনিয়র সে তেমন গা করল না। ভিতরে কী দেখবে সে বিষয়ে একটু চিন্তায় পড়ে গেল ভিট্টোরিয়া।

    আরো জোর খাটাল লোকগুলো। কাজের কাজ কিছুই হল না।

    এ্যাঙ্কোরা! বলল ক্যামারলেনগো, গুটিয়ে নিচ্ছে আস্তিন। ওরা! প্রত্যেকে এগিয়ে গেল পুনরোদ্যমে।

    ভিট্টোরিয়াও হাত লাগানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল এমন সময় নড়তে শুরু করল স্ল্যাব। দেখা যাচ্ছে পোপের বাঁকা হয়ে থাকা মুখাবয়ব, দেখা যাচ্ছে পা।

    প্রত্যেকে সরে দাঁড়াল।

    একজন গার্ড নিচু হয়ে তুলে নিল তার ফ্ল্যাশলাইট, তাক করল টম্বের দিকে। তুলে নিল অন্যরাও। সাফল্যের ক্ষীণ রশ্মি দেখা যাচ্ছে সবার চোখেমুখে। ক্রস করল তারা নিজেদের।

    ক্যামারলেনগো চোখ ফিরিয়ে নিল টম্বের দিকে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল সেদিকে।

    ভিট্টোরিয়ার একটু ভয় হচ্ছিল। লাশের মুখ রিগর মর্টিস হয়ে থাকলে কী করতে হবে ভেবে পাচ্ছিল না সে। তাহলে হয়ত ভেঙে ফেলতে হবে চোয়াল। এবার সে দেখতে পেল ভিতরটা। মুখটা ভোলাই ছিল। আর তার ভিতরের দিকটায়, ভয় নিয়ে তাকিয়ে থাকল মেয়েটা।

    কালো। মৃত্যুর মত কালো।

     

    ৮৬.

    কোন আলো নেই। নেই কোন শব্দ।

    অন্ধকারে ডুবে আছে সিক্রেট আর্কাইভস।

    ভয়, ভাবল ল্যাঙডন, এক বিচিত্র ব্যাপার। এম্নিতেই বদ্ধ জায়গা সম্পর্কে ল্যাঙডনের একটু একটু ভয় আছে। অনেকটা মানসিক রোগের মত। তার উপর এখানে বাতাস একেবারে পা। রিভলভিং ডোরের দিকে হতাশা নিয়ে তাকিয়ে আছে সে।

    দেয়ালের পাশে সুইচটাকে কোনমতে দেখতে পেল সে, চাপ দিল, খুলল না সেটা। অনড় দাঁড়িয়ে আছে দরজা।

    চারধারে তাকাতে তাকাতে সে চেষ্টা করল আওয়াজ তোলার, কিন্তু তাতে লাভের লাভ নেই কোন। কেউ শুনতে পাবে না। আর্কাইভ একেবারে জনমনুষ্যহীন। এ শব্দ আর্কাইভের ভল্টের বাইরেই যাবে না, আর বাইরে যাবার তো কোন প্রশ্ন নেই। টের পেল সে, কেউ একজন যেন বুকে পাথর চাপা দিয়েছে। বাতাস পাচ্ছে না ফুসফুস, শক্তি পাচ্ছে না হৃদপিন্ড।

    প্রথমবার দরজায় ধাক্কা দিয়ে তার মনে হল নড়াতে পারছে একটু একটু। কিন্তু পরের বার সে চেষ্টাও যেন বৃথা মনে হল। চরমপন্থা অবলম্বন করবে, ভাবল সে, পুরো শরীর ছুঁড়ে দিল দরজার গায়ে। ঘাম হচ্ছে খুব। এবার চেষ্টা করল মইটা দিয়ে দরজা ভাঙীর। হাত বাড়াল মইয়ের জন্য।

    পেল জিনিসটাকে হাতের কাছে। আশা করেছিল এটা কাঠ বা লোহার মত শক্ত কিছু দিয়ে গড়া হবে। কিন্তু বিধি বাম, মইটা বানানো হয়েছে এ্যালুমিনিয়াম দিয়ে। এগিয়ে গেল সর্বশক্তি দিয়ে। কিন্তু এবারো কোন উপায় নেই। অনেক আগেই লাগল কাচের গায়ে মইটা। কাজ হল না। ভাঙতে হলে এ্যালুমিনিয়ামের চেয়ে ভারি কিছুর প্রয়োজন পড়বে, ভাল বুঝতে পারছে সে।

    মনে পড়ে যাচ্ছে তার পোপের অফিসের কথা। সেখানে দরজা ভাঙার মত অনেক কিছু আছে। আর কিনা এখানে, সামান্য কাঁচের একটা দরজা ভাঙা যাচ্ছে না!

    আবার চিৎকার করল ল্যাঙডন। এবারকার শব্দটা আগের চেয়ে অনেক কম শক্তি নিয়ে বেরুল।

    তারপর তার মনে পড়ল ওয়াকি-টকিটার কথা। গার্ড সেটাকে ভল্টের বাইরে নামিয়ে রেখেছিল। কোন দুঃখে সেটাকে ল্যাঙডন ভিতরে আনেনি সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ল সে। রক্তিম তারা তার চোখের চারধারে নেচে বেড়াতে শুরু করার সাথে সাথে ল্যাঙডন মনে মনে জোর আনল। ভাবতে হবে। তুমি আগেও ফাঁদে পড়ে  গিয়েছিলে। সেবার পরিস্থিতি ছিল আরো ভয়ানক। সেটা থেকে বেঁচে গেছ তুমি। সেসময় তুমি ছিলে ছোট্ট এক ছেলে। কিন্তু পথটাকে ঠিক ঠিক বের করতে পারছিলে সে সময়। জোর দিল সে। এবার ভেবে বের কর!

    সোজা চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়ল সে মেঝেতে। এবার সবার আগে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

    রিল্যাক্স, নিজের নিয়ন্ত্রণ আন।

    ল্যাঙডনের হৃদপিন্ড রক্ত সঞ্চালনের কাজে আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে আসছে। এ পথে সাঁতারুরা তাদের দম বাড়িয়ে নেয়।

    এখানে অনেক অনেক বাতাস আছে, বলল সে নিজেকে, অনেক বাতাস। এখন ভাব। পড়ে থাকল মড়ার মত। একটা আশা, কোনক্রমে যদি বাতাস ফিরে আসে। ফিরে আসে কারেন্ট, তাহলেই হল। একটা শিতলতা এগিয়ে আসছে সামনে। কেমন একটা শান্তির ভাব অনুভব করছে সে নিজের পরতে পরতে। যুদ্ধ করল ল্যাঙডন এই অনুভূতির বিরুদ্ধে।

    তুমি কোন না কোন পথ খুঁজে পাবে। হায় খোদা! কী করে? কোথায়?

    তার হাতে, টকটকু করে এগিয়ে চলেছে চিরসুখী মিকিমাউস। যেন নটা তেত্রিশ বাজাটা খুব সুখের একটা ব্যাপার। ফায়ার আসতে আর আধঘণ্টাও বাকি নেই। তার মনে হাজারটা প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। পাওয়ার অফ করল কে? সার্চের এলাকা কি বাড়িয়েছে রোচার? ওলিভেছি কি রোচারকে বলেনি যে আমি এখানে? ল্যাঙডন জানে, তা জানানো আর না জানানোর মধ্যে তেমন কোন ফারাক নেই আর।

    চোখমুখ গোলা পাকিয়ে, যত বড় সম্ভব তত বড় করে একটা দম নিল ল্যাঙডন। প্রতি শ্বাসে আগের চেয়ে একটু করে কমে আসছে স্বস্তির পরশ। তার মাথা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা হয়ে আসছে। এবার আর সহ্য করা যাবে না। উঠে দাঁড়াতে হবে, উপায় বের করতে হবে।

    কাঁচের দেয়াল! বলল সে নিজেকে, কিন্তু মরার দেয়াল অনেক অনেক মোটা!

    এখানে কি কোন ফাইল কেবিনেট নেই যেটাকে ফায়ারপ্রুফ করার জন্য ধাতব আকৃতি দেয়া হয়েছে? থাকার কথা। মনে পড়ছে না তার। এমন কিছু পেলে একটা সমঝোতায় আসা যেত নিজের সাথে। দরজা ভাঙার কাজে হাত দেয়া যেত। বর্তমান সময়ে সে কিছুতেই চিন্তাকে একত্রে রাখতে পারছে না।

    একজামিনেশন টেবিলের ব্যাপারে কী বলা যায়? ভাবছে সে, প্রতিটা ভল্টেই একটা একজামিনেশন টেবিল থাকবে। একেবারে মধ্যখানে। কিন্তু এখানেও আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। এই মরার টেবিলগুলো এত বেশি ভারি যে একজনে টেনে আনার আশার গুড়েবালি। কিন্তু যদি নাড়ানো যায়,তবু কিছু কথা থেকে যাবে। কী করে সেটাকে এখানে আনা সম্ভব? স্ট্যাকগুলো একেবারে একত্রে মিলে মিশে আছে। একটার সাথে আরেকটার দূরত্বও অনেক কম। সেটাকে এখানে টেনে আনা সম্ভব হলেও আঘাত করে কাচ ভেঙে ফেলা মুখের কথা নয়।

    দুটা স্ট্যাকের মাঝখানের পথ খুব সরু…

    হঠাৎ একটা পথ পেয়ে গেল সে।

    একলাফে উঠে দাঁড়াল সে। সোজা এগিয়ে গেল স্ট্যাকের দিকে। ধরল একটা বইয়ের গাদা, তারপর নাড়ানোর চেষ্টা করল। কাজ হলে হতেও পারে। কিন্তু সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে হবে।

    যদি একবার এটাকে সরানো যায়! ভাবছে সে। সর্বশক্তি দিয়ে নাড়ানোর চেষ্টা করল। হাঁটু গেড়ে ফুটবল খেলোয়াড়ের মত জোর একত্র করে ধাক্কা দিল সেদিকে। কিন্তু একচুল নড়ল না বিশাল বিশাল বইয়ের বিশাল তাক। একটু কেপে উঠল শুধু। অপরদিকে তার পা পিছলে গেল অনেকটা।

    তার আরো শক্তির প্রয়োজন। প্রয়োজন ধৈর্যের।

    আরো শক্তি জড়ো করে সে পুনরোদ্যমে কাজে লেগে পড়ল। পিছনের কাঁচের দেয়ালই তার লক্ষ্য। গালাগালি দিতে দিতে ল্যাঙডন আবারও স্ট্যাকের চারপাশে ঘুরল, তারপর চোখের লেভেলের সমান সমান জায়গায় বইয়ের ঘাটিটাকে আকড়ে ধরল। তারপর একদিক দিয়ে ধরে সে চেষ্টা করল উপরে ওঠার। তার চারধারে বইয়ের স্তুপ পড়া শুরু করল, অন্ধকারে ভূলুষ্ঠিত হতে লাগল মহামূল্যবান বইয়ের তাল। কিন্তু

    সে মোটেও কেয়ার করে না। বাঁচার তাগাদা অনেক অনেক বেশি মূল্যবান। এখানে একটা আর্কাইভের কী ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে ভাবার সময় নেই। এবার আর তার চারধারের নিরবতা এবং বাতাসের অভাব কাবু করে ফেলছে না। বরং অন্ধকার কেমন যেন আঘাত হানছে তার গায়ে। কোন পরোয়া না করে সে বই ফেলতে লাগল একাধারে। তারপর অনেক কষ্টে উঠতে পারল উপরের তাকের কাছাকাছি। কেমন একটা আত্মবিশ্বাস কাজ করছে তার ভিতরে।

    এখন অথবা কখনো নয়। সাহস দিল সে নিজেকে।

    আরো আরো চাপ দিতে থাকল সে বইয়ের তাকটায়। আরো বেশি করে নাড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু কাজের কাজ এখনো কিছু হচ্ছে না।

    আর মাত্র তিনবার আঘাত হানা হবে। নিজেকে আবার সাহস দিচ্ছে সে। তারপরই কেল্লা ফতে হয়ে যাবে।

    কিন্তু তার আর প্রয়োজন পড়ল না। দুবার চেষ্টা করতেই সাফল্য ধরা দিল।

    প্রথম মুহূর্তে একটা ওজনহীনতার অনুভূতি, তারপর পড়ে যাবার।

    এবার সাফল্য ধরা দিল। একটা একটা করে বই পড়ে যাচ্ছে। সে শব্দ পাওয়া যাচ্ছে একে একে। এগিয়ে চলছে সে আর বইয়ের স্ট্যাক। সামনের দিকে। দেয়ালের দিকে। কাঁচের দেয়ালের দিকে।

    এবার অনেকখানি এগিয়ে গিয়ে স্ট্যাকটা, পরের ধাপকে আঘাত করল। সেটা আঘাত করল তার পরেরটাকে। একটা মুহূর্ত ভয়, তারপর সেগুলোও একে একে পড়তে শুরু করল। আবার পড়ে যাবার অনুভূতি হচ্ছে।

    অনেক বড় কোন খেলনার মত একে একে পড়তে শুরু করল স্ট্যাকগুলো। এখনো তার মনে অন্য চিন্তা খেলা করছে, কতগুলো স্ট্যাক আছে? শেষ পর্যন্ত কতটুকু ওজন হবে সবগুলোর? কতটা ভরবেগ নিয়ে সেগুলো আঘাত করবে কাঁচের উপর? কাচটা অনেক মোটা…

    এবার আর ধাতব আকৃতির ধাতব আকৃতিকে আঘাত করার আওয়াজ নয়, দূরপ্রান্তে সে শুনতে পেল কাঁচের গায়ে আক্রমণ আসার শব্দ। কেঁপে উঠল সমস্ত ভল্ট। অনেক অনেক ওজন নিয়ে ভল্টের শেষপ্রান্তে হামলে পড়েছে বইয়ের তাকগুলো। কিন্তু হতাশ হতে হল ল্যাঙডনকে।

    নিরবতা।

    মড়ার মত আবারও পড়ে আছে ল্যাঙডন, দূরপ্রান্তে। তার চোখমুখ বিস্ফারিত। এরচে বেশি কিছু করার মত মানসিক বা শারীরিক শক্তি অবশিষ্ট নেই।

    এরপর শুধুই অপেক্ষার পালা। এক সেকেন্ড, দু সেকেন্ড…

    একটু পরে একটু একটু করে ভাঙনের শব্দ পেতে শুরু করল সে। আর কত! এরচে বেশি কিছু করার নেই। আর শুধু একটু কাঁচ ফাটার শব্দ শুনেই তুষ্ট থাকতে হচ্ছে তাকে! এরপর, যখন সে আশা ছেড়ে দিয়েছে এমন সময় একটা শব্দ উঠল বাইরের দিক থেকে। বোঝা গেল, কিছু একটা ঘটছে। আর কিছু ঘটার আগেই, একেবারে হঠাৎ করে কাঁচে বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাওয়া গেল। ল্যাঙডনের নিচের স্ট্যাকগুলো পড়ে গেল মাটিতে।

    মরুভুমির তৃষিত বুকে প্রথম বৃষ্টিপাতের মত শব্দটা কী আনন্দ এনেছে সেটা বলে বোঝানো সম্ভব না ল্যাঙনের পক্ষে।

     

    ত্রিশ সেকেন্ড পরে, ভ্যাটিকান গ্রোট্রোসে, ভিট্টোরিয়া দাঁড়িয়ে ছিল একটা লাশের সামনে। এমন সময় নিরবতা ভাঙল একটা ওয়াকিটকি। বলে উঠল সেটা, দিস ইজ রবার্ট ল্যাওডন, আমার কথা কি কেউ শুনতে পাচ্ছেন?

    সাথে সাথে তাকাল ভিট্টোরিয়া, রবার্ট! সে ভেবে পাচ্ছে না কী ব্যাকুলতা ছিল তার। মনে তাকে এখানে পাবার আশায়।

    অপ্রস্তুত দৃষ্টি বিনিময় করল দুজন গার্ড। তারপর একজন কোমর থেকে ওয়াকিটকি বের করল, মিস্টার ল্যাঙডন? আপনি চ্যানেল থ্রিতে আছেন। চ্যানেল ওয়ানে কমান্ডার আপনার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছেন।

    আমি জানি তিনি চ্যানেল ওয়ানে অপেক্ষা করছেন। ড্যাম ইট! আমি চাই ক্যামারলেনগোকে। এই মুহূর্তে। কেউ কি তার ধারেকাছে আছেন? এই মুহর্তে?

     

    আর্কাইভের বিশ্রী একাকীত্ব আর অন্ধকারে একপাশে দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে ল্যাঙডন তার দম ফিরে পাবার চেষ্টা করছে। হাতের একপাশে গরম তরলের স্পর্শ তাকে মনে করিয়ে দিল যে কেটে গেছে সেখানটা। রক্তপাত হচ্ছে। বাম হাতে।

    সাথে সাথে ক্যামারলেনগোর কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল। চমকিত করে দিল ল্যাঙডনকে।

    দিস ইজ ক্যামারলেনগো ভেস্কো। কী হয়েছে?

    একটা বাটন প্রেস করার চেষ্টা করল সে। পারল। তারপর বলল, আমার মনে হয় এইমাত্র কেউ একজন আমাকে খুন করার চেষ্টা করেছে।

    লাইনে নিরবতা বিরাজ করছে।

    একটু থামল ল্যাঙডন। নিজেকে শান্ত করে নিয়ে বলল, আমি এ-ও জানি, পরের হত্যাকান্ডটা কোথায় ঘটতে যাচ্ছে।

    এবার যে কটা বাদ সাধল সেটা ক্যামারলেনগোর নয়। কমান্ডার ওলিভেরি। মিস্টার ল্যাওড়ন, আর একটা অক্ষরও আপনি বলবেন না।

     

    ৮৭.

    ল্যা ঙডনের মিকি মাউস টিকটিক করছে এখনো। কোন বিরাম নেই তার। পার্থক্য

    একটাই, রক্তে ভেসে গেছে মিকি। এখনো জ্বলছে। নটা একচল্লিশ মিনিট। বেলভেদ্রের কান্ট্রিইয়ার্ড দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে সে। সামনেই সুইস গার্ড সিকিউরিটি সেন্টার। হাতের রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে কিন্তু বিকট আকার ধারণ করেছে আঘাতটা। সে এগিয়ে গিয়ে দেখল সবাই হাজির হয়েছে–ওলিভেষ্টি, রোভার, ক্যামারলেনগো, ভিট্টোরিয়া, জনা কয়েক গার্ড।

    ভিট্টোরিয়া এগিয়ে গেল ল্যাঙডনের দিকে, রবার্ট! তুমি আহত!

    কথা বলে ওঠার কোন সময় পেল না সে। চোখের সামনে চলে এল ওলিভেট্টি। মিস্টার ল্যাঙডন, আপনার চোট লেগেছে দেখে আমি দুঃখিত। একই সাথে স্বস্তি পাচ্ছি মোটামুটি ঠিক আছেন তা দেখে। আর্কাইভের ক্রস সিগন্যালের ব্যাপারে আমি সত্যি দুঃখিত।

    ক্রস সিগন্যাল? দাবি করল ল্যাঙডন, আপনি ঠিক ঠিক জানতেন

    ভুলটা আমার। বলল রোচার। এগিয়ে গেল সে সামনে, একটু ব্ৰিত দেখাচ্ছে তাকে, একই সাথে সামরিকতার একটা লেশ আছে যেখানে বিব্রতবোধের কোন জায়গা নেই, আমার কোন ধারণাই ছিল না যে আপনি আর্কাইভসের ভিতরে ছিলেন। আমাদের হোয়াইট জোনের ক্রস ওয়্যারে পড়ে গেছে সিক্রেট আর্কাইভস। আমাদের আরো অনেক জায়গায় ব্যাপক সার্চ করার প্রয়োজন পড়ে যায়। আমিই নিজের হাতে সেখানকার পাওয়ার অফ করে দিয়েছি। আমি যদি আগেভাগে জানতে পারতাম…।

    রবার্ট! ভিট্টোরিয়া বলল, হাতে আহত হাতটা তুলে নিতে নিতে, পোপকে সত্যি সত্যি পয়জন দেয়া হয়েছিল। ইলুমিনেটি তাকে হত্যা করে।

    একটু স্থাণুর মত হয়ে গেছে ল্যাঙডন। সে কথাগুলো শুনতে পায়, কিন্তু তার মর্ম ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। শুধু অনুভব করে ভিট্টোরিয়ার উষ্ণ স্পর্শ।

    ক্যামারলেনগো তার পকেট থেকে একটা সিল্কের রুমাল বের করে দেয় যেন সেটা দিয়ে ল্যাঙডন নিজেকে পরিষ্কার করে নিতে পারে। মুখে লোকটা কিছুই বলল না। তার সবুজ চোখে অচেনা আগুনের হল্কা দেখা যাচ্ছে।

    রবার্ট, বলল ভিট্টোরিয়া, তুমি বলেছিলে জান কোথায় পরের কার্ডিনালকে হত্যা করা হবে?

    আমি জানি। জায়গাটা হল–

    না। বাধা দিল ওলিভেড়ি, মিস্টার ল্যাঙডন, আমি যখন আপনাকে  ওয়াকিটকিতে আর একটা অক্ষরও না বলতে বলেছিলাম, সেটার পিছনে একটা কারণ ছিল। সে হাত দেখাল আর সব সুইস গার্ডের দিকে, জেন্টলমেন, এক্সকিউজ আস।

    সাথে সাথে সব গার্ড চলে গেল সুইস গার্ড সিকিউরিটি সেন্টারে। কোন বাক্যব্যায় করা তাদের রীতিতে নেই।

    এবার আর একবার তাকাল সে আর সবার দিকে। আমি বলতে অত্যন্ত দুঃখ পাচ্ছি যে যেহেতু আমাদের হোলি ফাদার খুন হয়েছেন সেহেতু এই দেয়ালের ভিতরেই বিষ দানা বেঁধেছে। সবার কল্যাণের জন্যই আমরা কাউকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আমাদের গার্ডদের ব্যাপারেও একই কথা প্রযোজ্য।

    তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে কথাগুলো বলতে কত কষ্ট হচ্ছে তার। রোচারের বাদানুবাদে একটু অস্থিরতার চিহ্ন। ভিতরের বেঈমানী প্রমাণ করে

    ইয়েস, বলল ওলিভেন্তি, তোমার সার্চের মর্যাদা নষ্ট হয়েছে। এখন এটা জুয়া ছাড়া আর কিছু নয়। পাবার আশা এত তাড়াতাড়ি করা যায় না। তবু, একটু বাড়তি নিরাপত্তার জন্য এই সার্চ চলবে।

    দেখে মনে হল রোচার কিছু একটা বলতে চায়। তারপর নিজের সাথে বুঝে ফিরে গেল।

    বড় করে দম নিল ক্যামারলেনগো। সে এখনো ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি। কিম্বা পেরেছে, কিন্তু নিজেকে সামলে উঠতে পারেনি। একটা কথাও বলেনি সে এখন পর্যন্ত। আর ল্যাঙডন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তার ভিতরেও আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে।

    কমান্ডার? অবশেষে কথা বলল ক্যামারলেনগো, আমি কনক্লেভ ব্রেক করতে যাচ্ছি। নিজের ঠোঁট চেপে ধরল ওলিভেট্টি, আমি এর বিপরীতে আমার মত দিচ্ছি। এখনো আমাদের হাতে দু ঘণ্টা বিশ মিনিট সময় আছে।

    একটা হার্টবিট।

    আপনি তাহলে কী করতে চান? কার্ডিনালদের খালি হাতে বের করে আনতে চাচ্ছেন?

    আমি এই চার্চকে রক্ষা করার চেষ্টা করছি সে সমস্ত ক্ষমতা দিয়ে যা ঈশ্বর আমাদের দিয়েছেন। আমি কীভাবে এগুব সেটা আর আপনার চিন্তার বিষয় নয়।

    একটা ঝগড়া বেঁধে যাবার উপক্রম হল ওলিভেট্টির কথায়, আপনি যাই করার চেষ্টা করেন না কেন… থামল সে একটু, আপনাকে থামানোর কোন ক্ষমতা আমাকে দেয়া হয়নি। আমি বলছি, আমার নিজের এ্যাপার্টমেন্টের সুরক্ষার খাতিরে, আপনি আর মিনিট বিশেক… রাত দশটার পর পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। মিস্টার ল্যাঙডনের কথা সত্যি হলে এখনো খুনীকে ধরার একটা সুযোগ আমার থাকছে। এখনো প্রটোকল এবং সৌজন্যবোধ রক্ষার একটা সুযোগ থেকে যাচ্ছে।

    সৌজন্য? একটা তিক্ত হাসি কোনমতে ঝুলে পড়ল ক্যামারলেনগোর ঠোঁটে, আপনি লক্ষ্য করেছেন কিনা জানি না, অনেক আগে থেকেই এখানে আর কিছু নেই।

    অবশিষ্ট কিছুই নেই। আছে শুধু যুদ্ধ। এটা এখন স্রেফ একটা যুদ্ধ, কমান্ডান্টে।

    একজন গার্ড বেরিয়ে এল ভিতর থেকে, সেও সরাসরি ক্যামারলেনগোর দিকে তাকিয়ে বলল, সিনর, এইমাত্র আমরা সেই বিবিসি রিপোর্টারের খোঁজ পেয়েছি।

    মিস্টার গ্লিককে কজা করতে পেরেছি।

    তাকে আর তার মহিলা ক্যামেরাম্যানকে আমার সামনে হাজির কর। সিস্টিন চ্যাপেলে।

    বড় বড় হয়ে গেল ক্যামারলেনগোর চোখ, কী করতে যাচ্ছেন আপনি?

    বিশ মিনিট, কমান্ডার, এটুকু সময়ই দিচ্ছি আপনাকে আমি। বলল সে। তারপর সোজা চলে গেল।

    :

    ভ্যাটিকান সিটি থেকে যখন ওলিভেট্টির আলফা রোমিও শোর তুলে বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন আর তার পিছনে পিছনে আলফা রোমিওর কোন সারি ছিল না। গ্লাভ বক্সে পাওয়া একটা ফার্স্ট এইড কিট থেকে জিনিসপত্র বের করে ল্যাঙডনের হাত বেঁধে দিচ্ছিল ভিট্টোরিয়া সযত্নে, পিছনের সিটে বসে।

    সোজা সামনে তাকিয়ে ছিল ওলিভেষ্টি, ওকে, মিস্টার ল্যাওড়ন, কোথায় যাচ্ছি আমরা?

     

    ৮৮.

    এমনকি মাথায় আলো জ্বালিয়ে পুরনো রোমের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে যাওয়া রকেটের বেগের গাড়িটাকে খুব বেশি মানুষ ঠিকমত দেখতেও পায়নি। আর সব গাড়িঘোড়া যাচ্ছে বিপরীতে। ভ্যাটিকানের দিকে। যেন রোমের সবচে বড় দর্শনীয় এলাকা হয়ে উঠেছে ভ্যাটিকান সিটি। যেন এটার চেয়ে আমোদের জায়গা আর কোথাও নেই।

    ভেবে পাচ্ছে না ল্যাঙডন, যদি তারা খুনিকে ধরে ফেলতেও পারে, যদি তাকে জ্যান্ত পাওয়া যায়, যদি সব সাফল্য আসে, তবু, অনেক বেশি দেরি হয়ে গেছে। কতক্ষণ আগে ক্যামারলেনগো ভ্যাটিকানের চত্বরে জড়ো হওয়া মানুষের দিকে তাকিয়ে তাদের ঝুঁকিতে থাকার কথা বলেছে? একটা ভুল।

    সান্তা মারিয়া ডেলা ভিট্টোরিয়ার দিকে যাবার সময় একবারো ব্রেকে হাত দেয়নি কমান্ডার ওলিভেট্টি। ঝড়ের বেগে উড়িয়ে নিয়েছে গাড়িটাকে। আর যে কোন দিন হলে, ঠিক ঠিক জানে ল্যাঙডন, তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যেত, কাপত হাঁটু। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। আজ তার মনে হচ্ছে তার উপর কেউ অজ্ঞান করার ওষুধ প্রয়োগ করেছে।

    মাথার উপর সাইরেন তুলে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। মনে মনে একটা আশা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সান্তা মারিয়া ডেলা ভিট্টোরিয়ার কাছাকাছি পৌঁছার পর তাদের এই শব্দ। করার অভ্যাসটা কেটে যাবে।

    এতক্ষণে তার মনে উদয় হচ্ছে পোপের হত্যাকান্ডের ব্যাপারটা। কথাটাকে কোনমতেই মেনে নেয়া সম্ভব নয়। আবার এটা যে সত্যি তাও প্রমাণিত হয়েছে। ব্যাপারটা এমন নয় যে আর কোনদিন কোন পোপকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়নি। এমন ব্যাপার রোজ ঘটছে। কোন পোপ নিহত হননি এমনও নয়। কিম ইলুমিনেটির হাত যে এত লম্বা সেটা আগেভাগে ভেবে রাখতে পারেনি কেউ। সমস্যাটা বেঁধে যাচ্ছে ভিতরে ভিতরে। পোপ সেলেস্টিন পঞ্চম নিহত হয়েছিলেন তার অগ্রগামী অষ্টম বোনিফেসের হাতে। ভ্যাটিকানে এক্স রে আনার অনুমতি দেয়ার পর দেখা যায় বেশিরভাগ পোপের টম্বেই পরীক্ষা করা হচ্ছে। তার হাড়ের উপর পরীক্ষা করার সময় একটা আশা ছিল সবার, কোন না কোন প্রমাণ পাওয়া যাবে, হাড়গোড় হয়ত ভাঙা থাকবে। কিন্তু সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে প্রমাণিত হয় যে তার খুলিতে একটা দশ ইঞ্চি গভীর ক্ষত ছিল।

    কয়েক বছর আগে তার কাছে আসা একাধারে কয়েকটা আক্রমণের কথা তার মনে পড়ে যায়। প্রথমে আর্টিকেলগুলোকে মোটেও পাত্তা দেয়নি সে। সোজা হার্ভার্ডের আর্কাইভে ধর্ণা দিয়েছে এগুলোর সত্যতা যাচাইয়ের জন্য। সে অবাক হয়ে দেখতে পায়, সত্যি সেগুলো অথেন্টিক। আর কী, সাথে সাথে সেগুলোকে নোটিশ বোর্ডে ঝুলিয়ে দেয়া হয় একথা জানানোর জন্য, এমনকি বড় বড় সংবাদ মাধ্যমগুলোও মাঝে মাঝে মোলা জলে খাবি খায়। ইলুমিনেটির জুজুবুড়ির কাহিনীতে ডুবে যায়। তার মনে পড়ে যায় অনেকগুলো কাহিনী। অনেকগুলো রিপোর্ট ছিল।

    দ্য ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন
    জুন, চৌদ্দ, উনিশো আটানব্বই

    পোপ প্রথম জন পল, যিনি উনিশো আটাত্তুরে মারা যান, পিটু মেসনিক লজের বাঁধনে জড়িয়ে পড়েন তিনি… পিটু সিক্রেট সোসাইটি তার উপর হামলে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয় যখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে আমেরিকান আর্চবিশপ পল মার্সিনকাসকে ভ্যাটিকান ব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হবে। ব্যাঙ্কটা অন্ধকারে মেসনিক লজের সাখে লেনদেন কত…

    দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস
    আগস্ট, চর্বিশ, উনিশো আটানব্বই

    কেন মৃত পোপ প্রথম জন পল তার বিছানাতেই দিনের বেলা পরার শার্ট পরে ছিলেন? প্রশ্নগুলো সেখানেই থেমে নেই। কোন মেডিক্যাল ইনভেস্টিগেশন করা হয়নি। কার্ডিনাল ভিলট একটা বাধা দেন এই বলে যে কোন পোপের কোনকালে মৃত্যুর পর ময়নাতদন্ত করা হয়নি। আর জন পলের ওষুধগুলো তার বিছানার পাশ থেকে হাপিস হয়ে যায়। হাপিস হয়ে যায় তার গ্লাস, শেষ ইচ্ছা, শেষ পত্র।

    লন্ডন ডেইলি মেইল
    আগস্ট, সাতাশ, উনিশো আটানব্বই

    …একটা চক্রান্ত চলছে। ভিতরে আছে শক্তিমান এবং অবৈধ এক দল। তারা মেসনিক। ছড়াচ্ছে ভ্যাটিকানের ভিতরেই।

    ভিট্টোরিয়ার পকেটের সেলুলারে রিঙ হচ্ছে। ল্যাঙডনের মন থেকে চিন্তাগুলো হাপিস হয়ে যাওয়ায় সে যার পর নাই খুশি।

    জবাব দিল ভিট্টোরিয়া। তার আগেই দেখে নিয়েছে কলার কে। ল্যাঙডন ফোনের ভিতরের তীক্ষ্ণ্ণ কষ্ঠ শুনতে পাচ্ছে কয়েক ফুট দূর থেকেই।

    ভিট্টোরিয়া? ম্যাক্সিমিলিয়ান কোহলার বলছি। এখনো এন্টিম্যাটারটা পাওয়া যায়নি?

    ম্যাক্স? ঠিক আছেনতো আপনি?

    খবর দেখেছি। সেখানে সার্ন বা এন্টিম্যাটারের নাম-গন্ধ নেই। ভালই। কী হচ্ছে চারপাশে?

    এখনো আমরা ক্যানিস্টার খুঁজে পাইনি। পরিস্থিতি ক্রমেই আরো জটিল আকার ধারণ করছে। রবার্ট ল্যাঙডন না থাকলে কী হত আল্লা মালুম। কার্ডিনালদের খুন করার লোকটাকে খুঁজে বের করার কাজে লেগেছি আমরা। এখন আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।

    মিস ভেট্রা, শিতল কণ্ঠ ওলিভেট্টির, আপনি অনেক বলেছেন।

    বিরক্ত হল ভিট্টোরিয়া, কমান্ডার, কথা বলছেন সানের প্রেসিডেন্ট। অবশ্যই তার একটা অধিকার আছে

    তার একটা অধিকার আছে, কথার মাঝখানে বাঁধা দিল ওলিভেট্টি, এখানে থেকে এ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করার অধিকার আছে। আপনারা একটা ওপেন সেলুলার লাইনে আছেন। সে তুলনায় যা বলা হয়েছে তাই যথেষ্ট।

    বড় করে একটা শ্বাস নিল ভিট্টোরিয়া, ম্যাক্স?

    তোমার জন্য আমার কাছে কিছু খবর আছে, বলল ম্যাক্স, তোমার বাবার ব্যাপারে… আমি সম্ভবত জানতে পারব কাকে কাকে তিনি এন্টিম্যাটারের ব্যাপারটা বলেছেন।

    ভিট্টোরিয়ার সারা মুখে আঁধারের ছায়া পড়ল, ম্যার, আমার বাবা আমাকে বলেছেন যে কাউকে জানানো হচ্ছে না ব্যাপারটা।

    ভয় হচ্ছে, ভিট্টোরিয়া, তোমার বাবা কাউকে না কাউকে বলেছেন সেটার কথা। কিছু সিকিউরিটি রেকর্ড খতিয়ে দেখলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে পানির মত। আমি নিয়মিত যোগাযোগ রাখব।

    বন্ধ হয়ে গেল লাইন।

    পকেটে ফোনটা রাখার সময় ভিট্টোরিয়াকে মোমের পুতুলের মত দেখাল।

    ঠিক আছতো? জিজ্ঞেস করল ল্যাঙডন।

    নড করল ভিট্টোরিয়া। তার কাঁপতে থাকা আঙুল অন্য কথা বলছে।

     

    চার্চটা আছে পিয়াজ্জা বার্বারিনিতে। বল ওলিভেট্টি, সাইরেনের গলা টিপে ধরে সেটাকে বধ করে হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখতে দেখতে, আমাদের হাতে সময় মাত্র ন মিনিট।

    দূরে কোথাও চার্চের ঘণ্টা বেজে যাচ্ছে। সেইসাথে কোন এক অচেনা কথা গোত্তা দিচ্ছে তার মনের ভিতরে। পিয়াজ্জা বাবারিনি। এ নামটার সাথে কীভাবে পরিচিত ল্যাঙডন? হিসাব মিলছে না। এবার বোঝা গেল। পিয়াজ্জা আসলে একটা সাবওয়ে লাইনের স্টেশন।

    মনে পড়ছে, বছর বিশেক আগে যখন নিচ দিয়ে ট্রেন লাইন বানানোর কথা তখন আর্ট হিস্টোরিয়ানরা হৈ চৈ করে দুনিয়া মাথায় তুলছিল। তারা বলছিল সমস্বরে, যদি, সত্যি সত্যি লাইনটা খোদাই করা হয় তাহলে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে। পিয়াজ্জার কেন্দ্রে অবস্থিত কয়েক টনের ওবেলিস্ক নড়ে যেতে পারে। নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। সিটি প্ল্যানাররা কূল রাখি না শ্যাম রাখি অবস্থায় পড়ে যায়। তারা না পেরে অবশেষে ওবেলিস্কটা সরিয়ে সেখানে ট্রাইটন নামের ছোট একটা ঝর্ণা বসিয়ে দেয়।

    বার্নিনির দিনগুলোয়, কল্পনার চোখে দেখে নিল ল্যাঙডন, পিয়াজ্জা বার্বারিনিতে একটা ওবেলিস্ক ছিল! এটাই সেই স্থাপত্য কিনা কে জানে!

    পিয়াজ্জা থেকে এক ব্লক দূরে ওলিভেট্টি একটা গলি ধরল। গুলির মত কারটাকে চালিয়ে নিয়ে চট করে দাঁড়িয়ে যায় একটা জায়গায়। সে খুলে ফেলল তার ভদ্রোচিত স্যুটটাকে, গুটিয়ে নিল আস্তিন, তারপর একহাতে লোড করল গানটাকে।

    আপনাদের দুজনকে কেউ চিনে ফেলুক সে ঝুঁকি আমরা নিতে পারব না। আপনারা দুজনেই টিভিতে এসেছেন। আপনারা পিয়াজ্জা ধরে এগুবেন। আলাদা আলাদা। যেন দেখা না যায়। আমি যাচ্ছি পিছন দিয়ে।

    সে একটা পিস্তল তুলে দিল ল্যাঙডনের হাতে, বিশেষ প্রয়োজন পড়লে।

    কোনক্রমে তুলে নিল সেটাকে ল্যাঙডন। আজকে দ্বিতীয়বারের মত সে হাতে আগ্নেয়াস্ত্র তুলে নিল। তারপর নিশ্চিন্তে সেটাকে চালান করে দিল বুক পকেটে। এবং একই সাথে আবারও তার মনে পড়ে গেল গ্যালিলিওর ডায়াগ্রামা ফোলিওটা এখনো সেখানে চুপ মেরে পড়ে আছে। সে ভেবে পেল না কেন তখন সেটাকে সেখানে ফেলে চলে আসেনি!

    অনেক ঝামেলা পাকিয়ে এসেছে সে আর্কাইভে। প্রথমত, ডায়াগ্রামাকে সেখানে ফেলে আসা হয়নি। সেটা এখন এক অর্থে নিখোঁজ। আবার তার উপর সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে থাকা ভ্যাটিকানের সম্পদের খতিয়ানকে উল্টে পাল্টে বিনাশ করেছে। ফেলে দিয়েছে স্ট্যাকগুলো। নষ্ট করেছে একটা কাচের ভল্ট এবং, কিউরেটরের কপালে অনেক অনেক ভোগান্তি আছে… যদি আজ রাতটা কোনক্রমে টিকে যায় ভ্যাটিকান, তাহলে…।

    গাড়ি থেকে বের হল ওলিভেট্টি, পিয়াজ্জায় ঐপথে যাওয়া যায়। চোখকান খোলা রাখুন। আর খেয়াল রাখুন যেন আপনাদের কেউ চিনে না ফেলে। তারপর সে ভিট্টোরিয়ার দিকে তাকিয়ে নিজের সেলফোনটা তুলে আনল, মিস ট্রো, চলুন আমরা আরেকবার আমাদের অটো ডায়াল চেক করে নিই।

    প্যান্থিয়নে সে আর ওলিভেট্টি যেভাবে অটো ডায়াল নাম্বারটা বসিয়েছিল সেভাবে আরেকবার চেক করে দেখল ভিট্টোরিয়া। ওলিভেট্টির বেল্টের ফোনটা ভাইব্রেট করল তার বেল্টে থেকেই। কোন শব্দ তুলল না। সাইলেন্ট মোড়ে আছে তার সেল।

    তুষ্ট দেখাল ওলিভেট্টিকে, গুড, আশা করি আপনি যদি বেখাপ্পা কিছু দেখেন তাহলে আমাকে জানাবেন। সে তার আগ্নেয়াস্ত্র কক করল, আমি ভিতরে অপেক্ষা করব। এবারের দানটা আমার।

     

    একই মুহূর্তে, আরেক কোণায় আরেকটা ফোন বেজে উঠল। সাইলেন্ট এ্যালার্টে।

    জবাব দিল হ্যাসাসিন, ম্পিক।

    আমি বলছি, বলল অপরপ্রান্ত, জ্যানাস।

    হাসল হ্যাসাসিন, হ্যালো, মাস্টার।

    তোমার পজিশন কীভাবে যেন জানাজানি হয়ে গেছে। কেউ না কেউ আসছে তোমাকে ধরার জন্য।

    বেশি দেরি করে ফেলেছে তারা। আমি এর মধ্যেই সব ব্যবস্থা করে বসেছি।

    ভাল। জীবিত বেরিয়ে এসো। আরো অনেক কাজ করতে হবে।

    আমার পথে যারা বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে, স্রেফ মারা পড়বে।

    তোমার পথে যারা বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে তারা গোণায় ধরার মত লোক।

    আপনি কি কোন আমেরিকান স্কলারের কথা বলছেন?

    তার কথাও জান তুমি?

    মুখ ভেংচে হাসল হ্যাসাসিন, ঠান্ডা মস্তিষ্কের, কিন্তু সেকেলে। সে আগেই আমার সাথে ফোনে কথা বলেছে। তার সাথে আরেক মহিলা আছে, তার চরিত্র আবার একেবারে বিপরীত।

    থামল খুনি! সে আবার মনে মনে স্বাদ নিল লিওনার্দো ভেট্রার মেয়ের তেজদীপ্ত কথার।

    লাইন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। তার সেই জ্যানাস কর্তা হয়ত নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে। অবশেষে কথা বেরুল মাস্টারের কণ্ঠ চিরে, মেরে ফেল তাদের, যদি প্রয়োজন মনে কর।

    হাসল আবার হ্যাসাসিন, অন্ধকারের হাসি, ধরে রাখুন কর্ম সারা। তার মনটা কী করে যেন একটা বিচিত্র তৃপ্তি পাচ্ছে। আমি অবশ্য মেয়েটাকে রেখে দিতে পারি একটা  বাড়তি উপহার হিসাবে…।

     

    ৮৯.

    সেন্ট পিটার্স স্কয়ারের মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ছে।

    পিয়াজ্জায় সবাই দৌড়াদৌড়ি করছে আলুথালু বেশে। এগিয়ে আসছে মিডিয়া ভ্যানগুলো ক্ষুধার্ত হায়েনার মত। দল বেঁধে। হাজারটা বিচিত্র আর শক্তিশালী যন্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে রিপোর্টারের দল, যেমন করে প্রস্তুতি নেয় সেনাবাহিনী। তারা সবাই স্কয়ারের সামনের সারিয়ে জায়গা পাবার আশায় পাগল হয়ে গেছে। হাতে তাদের নানা প্রকার আর আকারের যন্ত্র। কিন্তু কম যায় না কেউ। সবার কাছেই আছে বিজ্ঞানের সর্বশেষ আশীর্বাদ, ফ্ল্যাট স্ক্রিন।

    এগুলো অনেক কাজে লাগে। সাজানো থাকে ভ্যানের উপরে বা পোর্টেবল কোন যন্ত্রের সাথে লাগানো থাকে। হরেক কাজে লাগার মধ্যে অন্যতম হল, ভ্যানের সামনে তাদের নেটওয়ার্কের নাম লাগানো থাকবে, কখনো সেটা বাদ দিয়ে ভিডিও প্রচার করা হবে সেখানে, এ্যাড যাবে তাদের নেটওয়ার্কের কিম্বা রিপোর্টার এবং ভিডিওগ্রাফার কী করছে সেসবও জানানো চলে। সেগুলোকে জায়গামতই বসানো হয়। ভ্যানের সামনে। বলা চলে প্রতিদ্বন্দী দলগুলোর সামনে নিজেদের ক্ষমতা জাহির না করে তারা থাকতে জানে না।

    স্কয়ারের অবস্থা শোচনীয়। প্রথমেই ভিড় করল মিডিয়া ভ্যানগুলো। তার সাথে আছে ভ্যান বিহীন খুচরা সাংবাদিক, ফ্রি-ল্যান্সার, আগ্রহী মানুষ আর খবর সরাসরি শুনতে চাওয়া লোকজনু। এলাকাটা একেবারে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির কারখানায় পরিণত হল।

     

    শত গজ দূরে, সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার মোটা দেয়ালের ভিতরে, পৃথিবী একেবারে শান্ত। লেফটেন্যান্ট চার্ট্রান্ড আর তিনজন গার্ড অন্ধকারের ভিতরে এগিয়ে চলছে। চোখে তাদের ইনফ্রারেড গগলস, হাতে ডিটেক্টর। দুলে চলেছে সেটা এখান থেকে সেখানে। ভ্যাটিকান সিটির যেসব অঞ্চলে সাধারণ মানুষ চলাচল করতে পারে এমন সব জায়গার সার্চ শেষ, কোন সুফল বয়ে আনেনি সে কাজ।

    এখানে গগলস খুলে ফেললেই ভাল, সিনিয়র গার্ড বলল।

    চার্ট্রান্ড এর মধ্যেই কাজটা করে ফেলেছে। নিসে অব প্যালিয়ন্সে তারা প্রবেশ করেছে–ব্যাসিলিকার ডুবে থাকা এলাকায়। এখানে আলো আনা হয় নিরানব্বইটা তেলের বাতি দিয়ে। ফলে এখানে ইনফ্রারেড যে আলো আসবে সেটা ধাঁধিয়ে দিবে চোখ।

    ভারি গগলস চোখ থেকে খুলে ফেলে বেশ তৃপ্ত বোধ করছে চার্ট্রান্ড। সে তার ঘাড়ের একটু ব্যায়াম করে নেয় এলাকায় প্রবেশের আগে। ঘরের সৌন্দর্য অনিন্দ্য… সোনালি এবং দীপ্তিময়। এর আগে সে এখানে কখনো আসেনি।

    ভ্যাটিকানে প্রবেশের পর থেকে প্রতিনিয়ত, প্রতিদিন সে নতুন কিছু না কিছু শিখেছে। জানতে পেরেছে ভ্যাটিকানের নতুন নতুন গুপ্ত রহস্য। তেলের বাতিগুলো সেসবের অন্তর্ভুক্ত। সব সময় এখানে ঠিক নিরানব্বইটা বাতি জ্বলতে থাকে। এটাই ঐতিহ্য। ক্লার্জি নিয়মিত এখানে সংগোপনে তেল দিয়ে যায়। গোপনীয় তৈল। বলা হয় এই বাতিগুলো জ্বলছে আদ্যিকাল থেকে, জ্বলবে সময়ের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত।

    অথবা আজ মধ্যরাত পর্যন্ত, নিজেকেই শোনাল সে ফিসফিস করে।

    চার্লাভ তেলের বাতিগুলোর উপর দিয়ে তার ডিটেক্টর চালাল। এখানে কিছুই লুকানো নেই। তার তেমন কোন দ্বিধা নেই। জানে সে ভাল করেই। ক্যানিস্টারটা লুকানো আছে ছায়াময় কোন স্থানে। অন্তত ভিডিও ফুটেজ সে কথাই বলে।

    সে নিসের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে মেঝেতে একটা মোটামুটি অতিকায় গর্ত দেখতে পায়। ঢাকা। সরাসরি নিচের দিকে সেটার সিঁড়ি চলে গেছে। এখানকার কত গল্প শুনেছে সে! ভাগ্য ভাল, সেখানে যাবার প্রয়োজন পড়ছে না। মোছর সুস্পষ্ট আদেশ দিয়েছে। শুধুমাত্র পাবলিক এক্সেসগুলোতে মার। হোয়াইট জোনের কথা ভুলে যাও।

    গন্ধ কিসের! বলল সে। একটা অসহ্য মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে আছে আশপাশে।

    বাতিগুলো থেকে যে বাষ্প উঠে আসে সেটার গন্ধ। বলল একজন।

    অবাক হল চার্ট্রান্ড, গন্ধ পেয়ে তো মনে হচ্ছে ক্যারোসিন থেকে আসছে না। এটা কলোজেনের গন্ধ।

    তেলটা ক্যারোসিন নয়। পাপাল এরিয়ার কাছাকাছি অবস্থিত বাতিগুলো। তাই সেগুলোতে ক্যারোসিন দেয়া হয় না। বদলে দেয়া হয় একটা মিশ্রণ। ইথানল, শুগার, বিউটান, পারফিউম।

    বিউটান?

    নড করল গার্ড, ঠিক তাই। সুঘ্রাণ স্বর্গীয়, জ্বলে নরকের মত।

     

    ওয়াকিটকি বন্ধ হয়ে যাবার সময়টায় গার্ডরা প্যালিয়াম সার্চ করা শেষ করে হাত বাড়িয়েছে ব্যাসিলিকার আর সব জায়গায়।

    তারপর একটা আপডেট পেয়ে একেবারে হতভম্ব হয়ে পড়ে প্রহরীরা।

    একটা আহত করে দেয়ার মত সংবাদ। ক্যামারলেনগো নিয়ম ভঙ্গ করার প্রতিজ্ঞা করেছে। সে এগিয়ে গিয়ে কনাক্লেভে প্রবেশ করবে। তারপর কথা বলবে কার্ডিনালদের সাথে। এমন কোন ঘটনা ঘটেনি ইতিহাসে কখনো। একই সাথে টের পায় চার্ট্রান্ড, আসলে এর আগে কখনো পারমাণবিক বোমার উপর বসে ছিল না ভ্যাটিকান।

    ভেবে একটু স্বস্তি পায় চান্ডি যে ক্যামারলেনগো দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নিয়েছে। ভ্যাটিকান সিটির ভিতরে ক্যামারলেনগোই সেই লোক যার জন্য চার্ট্রান্ড এত সম্মান পাচ্ছে। সবাই জানে, চারদেয়ালের মধ্যে ঈশ্বরভক্ত এমন আর একটা লোকও নেই। নমনীয়, সৎ, নিবেদিতপ্রাণ। এক কথায়, আদর্শ। আবার সবাই এ-ও জানে, যদি কখনো ঈশ্বরের বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্র হয়, সবার আগে যে এগিয়ে যাবে তার নাম ভেস্কো, ক্যামারলেনগো ভেস্কো।

    গত সপ্তাহখানেক ধরে ক্যামারলেনগোর অন্যরূপ দেখতে পাচ্ছে ভ্যাটিকান, সুইস গার্ড। আর তারা একমত হয়েছে, কাজের ক্ষেত্রে সে পাথর-কঠিন। একটু রাফ। তার সবুজ চোখের এত দীপ্তি আগে কখনো ধরা পড়েনি। সবাই এক কথায় মেনে নেয়, ক্যামারলেনগো শুধু কনক্লেভের কাজে দক্ষতার পরিচয় প্রকাশ করেনি, একই সাথে ঢেকে রেখেছে তার সত্যিকার পালক পিতার জন্য মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা শোক। পোপের জন্য শোক।

    এখানে আশার কয়েক মাস পরে বাট্রান্ড জানতে পারে ক্যামারলেনগোর কাহিনী। তার চোখের সামনে টম্বে তার মায়ের প্রাণ হারানোর কথা। চার্চের ভিতরে কোন টম্ব,.. এবং একই ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে আবার। দুঃখজনক হলেও সত্যি, বোমা বিস্ফোরণের জন্য দায়ি বেজন্মাটাকে ধরার কোন উপায় পায়নি গির্জা। তারা বলেছে, সম্ভবত খ্রিস্টবাদের কোন শত্রুর কাজ এটা, এমন কোন গ্রুপের কাজ… তারপর চুপ মেরে গেছে। কোন সন্দেহ নেই, জীবনের শিক্ষাগুলো, খ্রিস্টবাদের শিক্ষাগুলো আর সবার চেয়ে বেশি হারে বেশি বাস্তবতা দিয়ে শিখতে পেরেছে ক্যামারলেনগো।

    মাস কয়েক আগে, চার্ট্রান্ড একবার উঠান পেরিয়ে যাবার সময় ক্যামারলেনগোর মুখোমুখি পড়ে যায়। ক্যামারলেনগো সাথে সাথে চিনে ফেলে নবীন সুইস গার্ডকে। দাওয়াত করে তাকে তার সাথে একটু সময় কাটানোর জন্য। তারা কোন ব্যাপারে গুরুগম্ভীর আলোচনা করেনি অনেকক্ষণ ধরে। কিন্তু তাদের সেই হাল্কা আলাপচারিতায় চার্ট্রান্ড বেশ স্বস্তি বোধ করে। মুহূর্তে ভ্যাটিকানকে তার আপন বলে মনে হয়।

    ফাদার, বলেছিল চার্ট্রান্ড, আমি কি আপনাকে একটা কিন্তু প্রশ্ন করতে পারি?

    হেসেছিল ক্যামারলেনগো, স্বর্গীয় হাসি, তখনই, যখন আপনাকে আমি একটা বিচিত্র উত্তর দিতে পারব।

    হাসল চার্ট্রান্ড, আমি আজ পর্যন্ত যত প্রিস্টের মুখোমুখি পড়েছি, প্রশ্ন করেছি সবাইকে। কেউ জবাবটা ঠিক ঠিক দিতে পারেননি।

    কোন ব্যাপারটা আপনাকে বিরক্ত করছে? পথ দেখিয়ে দিতে দিতে বলেছিল ক্যামারলেনগো, তার ফ্রক সামনে সামনে দুলছিল হাটার চালে চালে। কালো জুতা এগিয়ে যাচ্ছিল সামনে সামনে। চার্ট্রান্ড বুঝতে পারছিল, লোকটা আধুনিক, কিন্তু প্রাচীণত্বের কোন কণা ছেড়ে দেয়নি,…

    বড় করে দম নিল চার্ট্রান্ড, আমি এই ওমনিপটেন্ট-বেনিভোলেন্ট ব্যাপারস্যাপারগুলো বুঝি না।

    ম্লান একটা হাসি ঝুলল ক্যামারলেনগোর ঠোঁটে, আপনি স্ক্রিপচার পড়েন?

    চেষ্টা করি।

    পবিত্র লেখা, গোপনীয় লেখা পড়ার চেষ্টা করেন?

    জি।

    আপনি দ্বিধায় আছেন কারণ বাইবেল ঈশ্বরকে ওমনিপটেন্ট-বেনিভোলেন্ট হিসাবে আখ্যায়িত করে?

    ঠিক তাই।

    ওমনিপটেন্ট মানে অত্যন্ত ক্ষমতাবান, সর্বশক্তিমান। বেনিভেলেন্টের অর্থ একটু কঠিন। সহজ কথায়, নিস্পাপ, সরল… ঠিক কথায় বোঝানো যাবে না।

    আচ্ছা!

    ওমনিপটেন্ট-বেনিভোলেন্ট মানে ঈশ্বর সর্বশক্তিমান এবং ভাল অর্থের অধিকারী।

    আমি ধারণাটার মোটামুটি একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারি। ব্যাপারটা… দেখে মনে হয় একটু বৈপরীত্য আছে কোথাও।

    ঠিক তাই। আসলে দ্বন্দটা অন্য কোথাও। ব্যাথা। মানুষ তাহলে কেন খারাপ কাজ করে, কেন যুদ্ধ হয়, রোগ কেন আসে…

    একজাক্টলি! চার্ট্রান্ড জানত ঠিক ঠিক ধরতে পারবে ক্যামারলেনগো, কত ভয়ানক ব্যাপার প্রতিনিয়ত ঘটছে এই পৃথিবীতে! মানুষের ভোগান্তি দেখে বারবার একটা কথাই মনে হয়, একই সাথে ঈশ্বরের সর্বশক্তিমান এবং সর্বকল্যাণময় হওয়ার মধ্যে কোথাও ফাঁক আছে। যদি তিনি আমাদের ভালবাসেন এবং আমাদের সমস্ত কল্যাণের চিন্তাই থাকে তার মধ্যে আর যদি সর্বশক্তিমানই হয়ে থাকেন, সব কাজে হাত দেয়ার ক্ষমতা থাকে কল্যাণের চিন্তার সাথে, তাহলে আমাদের সমস্ত দুঃখ আর জরা তিনি মুহূর্তেই নষ্ট করে দিতেন। পারতেন না কি?

    ক্যামারলেনগো বলল সাথে সাথে, পারতেন, কিন্তু করতেন কি?

    একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায় চার্ট্রান্ড, সে কি তার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে? এটা কি এমন কোন ধর্মীয় প্রশ্ন যা উপস্থাপিত করার মধ্যে পাপ আছে, আছে নিষেধাজ্ঞা? যাক… যদি ঈশ্বর আমাদের ভালবেসেই থাকেন, আর তিনি আমাদের রক্ষা করতে জানেন, তার অবশ্যই এমন কিছু করার কথা। তাই বোঝা যায়, তিনি হয় সর্বশক্তিমান কিন্তু কেয়ার করেন না, অথবা প্রেমময় কিন্তু পরিস্থিতিতে হাত দেয়ার মত শক্তি তার নেই।

    আপনার কি সন্তান আহে, লেফটেন্যান্ট?

    না, সিনর।

    কল্পনা করে নিন, আপনার একজন আটবছর বয়েসি ছেলে আছে… আপনি কি তাকে ভালবাসবেন?

    অবশ্যই।

    আপনি কি তার জীবন থেকে সমস্ত দুঃখ আর ভোগান্তি দূর করার চেষ্টা করবেন?

    অবশ্যই।

    আপনি কি তাকে টেবোর্ড কিনে দিবেন?

    এবার একটু দ্বিধায় পড়ে যায় চার্ট্রান্ড। বুঝতে পারছে সে, আশপাশ থেকে খুব আলতো করে একটা জাল তার চারধারে ছড়িয়ে দিয়ে সেটাকে কাছিয়ে আনা হচ্ছে। ক্যামারলেনগোর সব কাজ কারবার দেখলেই বোঝা যায় লোকটা একান দক্ষ ধার্মিক, ধর্মীয় মানুষ। আসলেই। আমি তাকে একটা স্কেটবোর্ড কিনে দিতাম, একই সাথে সাবধান থাকতে বলতাম সব সময়।

    তাহলে, এই ছোট্ট ছেলেটার পিতা হিসাবে আপনি তাকে কিছু বেসিক দিবেন। তারপর তাকে নিজের মত চলতে দিয়ে ভুল করতে দিবেন, তাই না?

    আমি তার পিছনে সত্যি সত্যি সর্বক্ষণ ছুটতাম না। আপনি যদি সে কথাই বলে থাকেন,..

    কিন্তু যদি সে পড়ে যায়, তারপর ব্যাথা পায় হাঁটুতে?

    সে আরো বেশি কেয়ারফুল হতে শিখবে।

    হাসল ক্যামারলেনগো, একটা নির্মল হাসি, যদিও আপনার সে ক্ষমতা থাকে, ছেলেকে আগলে রাখার ক্ষমতা, তবু আপনি তা করবেন না অষ্টপ্রহর। তার নিজের শিক্ষা নিজেকে নিতে দিতে বেশি ইচ্ছুক থাকবেন, তাই না?

    অবশ্যই, ব্যথা বেড়ে ওঠার অঙ্গ।

    আবার হাসল ক্যামারলেনগো, আমরা সবাই যতদিন দুনিয়ায় থাকছি, বেড়ে উঠছি। তারপর এক সময় সেই শিক্ষা নেয়ার দিন শেষ হবে। তখন আমরা থাকব স্বর্গে, সেখানে কিন্তু জৱা নেই। দুঃখ নেই। কিন্তু এই বেড়ে ওঠার সময়টাতে ঈশ্বর চান আমরা যেন নিজেরা শিখে নিতে পারি।

     

    ৯০.

    ল্যাঙডন আর ভিট্টোরিয়া পশ্চিম কোণা ধরে পিয়াজ্জার দিকে এগিয়ে গেল। তাদের  বিপরীত দিকে চার্চ অবস্থিত। দেখতে পেল তারা অবাক হয়ে, চত্বরে কেউ নেই। লোকজন সব হাপিস হয়ে গেছে। নেই কোন জনমনুষ্যের ছোয়া আশপাশে। উপরের ভবনগুলোর দিকে তাকিয়ে টিভির আলো ঠিকরে বেরুতে দেখে ঠিক ঠিক তারা বুঝে নেয় কোথায় হাওয়া হয়ে গেল লোকজন সব।

    … ভ্যাটিকান এখনো কোন মন্তব্য করেনি… ইলুমিনেটি দুজন কার্ডিনালকে হত্যা করেছে… রোমে শয়তানের ছায়া… পরের তথ্য খুব দ্রুত জানানো হবে সার্বক্ষণিকভাবে…।

    রাতটা হাল্কা শীতের। যেন ঠান্ডা তাদের শিতল অভ্যর্থনা জানাচ্ছে।

    সম্রাট নিয়ে তার প্রিয় শহরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে যেভাবে বসে বসে বাঁশি বাজাচ্ছিল সেভাবেই যেন বসে আছে ভ্যাটিকান। আর সংবাদটা ছড়িয়ে যাচ্ছে বাতাসের বেগে, নিরোর লাগানো আগুনের মত। হতবাক হয়ে পড়েছে রোম, থমকে গেছে পুরো বিশ্ব।

    ভেবে কুল পায় না সে, এই এক্সপ্রেস ট্রেনকে থামানোর উপায় আছে কি কোন! কে জানে!

    আশপাশের আধুনিক ভবনের মাঝখানেও পিয়াজা এখনো মধ্যযুগকে হারিয়ে যেতে দেয়নি। এখনো সেখানে প্রাচীণত্বের ছায়া। আধুনিকতার প্রমাণস্বরূপ, উপরে, অনেক উপরে একটা নিয়ন সাইন জ্বলজ্বল করছে। বিরাট, বিলাসবহুল এক হোটেলের চিহ্ন সেটা। ভিট্টোরিয়া আগেই ল্যাঙডনকে সেটা দেখিয়েছে।

    হোটেল বার্নিশি

    দশটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি, বলল ভিট্টোরিয়া, তার বিড়ালচোখ সারা চত্বর সার্চ করছে সতর্কভাবে। কথাটা শেষ করার পর পরই মেয়েটা তার হাত সরিয়ে নেয়। টেনে নেয় একটা অন্ধকার কোণায়। পিয়াজ্জার কেন্দ্রস্থলে কেমন এক নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে।

    ল্যাঙডন তার দৃষ্টি অনুসরণ করল। তারপর জমে গেল ঘটনা দেখে।

    তাদের ক্রস করে দুটা অবয়ব এগিয়ে গেল সামনে। কালো অবয়ব। দুজনের পরনেই গা ঢাকা আলখাল্লা, মাথা ঢেকে আছে হুড়ে। ক্যাথলিক বিধবাদের পোশাক। ধরে নিতে পারত ল্যাঙডন, তারা মহিলা। কি এখান থেকে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। একজন, অসুস্থের মত এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। অন্যজন, দেখতে বোঝা যায়, একটু বেশি শক্তিমান, সাহায্য করছে তাকে।

    আমাকে গানটা দাও। দাবি করল ভিট্টোরিয়া।

    তুমি আন্দাজের উপরে–

    বিড়ালের মত প্রায় তরলভাবে সে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল। তারপর বের করে আনল পিস্তলটা। তারপর, যেন হাওয়ায় ভর করে, তার পা এগিয়ে চলল তাদের দিকে। একেবারে নিঃশব্দে। ছায়ায় ছায়ায়। তাদের পিছনদিকে।

    এক মুহূর্ত থমকে থাকল ল্যাঙডন। তারপর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে এগিয়ে চলল পিছনে পিছনে।

    মানুষ দুজন ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। আর তারপর মাত্র ত্রিশ সেকেন্ড লাগল ল্যাঙডন আর ভিট্টোরিয়ার তাদের পিছনে যেতে। সে যেন এখনো উড়ে উড়ে যাচ্ছে পিছনে পিছনে। একটুও শব্দ উঠছে না পা ফেলার। তার সাথে তাল মিলিয়ে যেতে

    যেতে গলদঘর্ম হল ল্যাঙডন। তার পা যখন একটা নুড়িকে আঘাত করে একটু শব্দ করল তখন কটমট করে তার দিকে তাকাল ভিট্টোরিয়া। কিন্তু দেখে মনে হয় না দুজন কোন শব্দ পেয়েছে। একমনে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। কোনদিকে নজর নেই। কথা বলছে ফিসফিস করে।

    ত্রিশ ফুট দূর থেকে ল্যাঙডন শব্দ শুনতে পেল। কোন অক্ষর নেই। শুধু ধীর শব্দ। অস্পষ্ট, অস্ফুট। প্রতি পদক্ষেপে পায়ের গতি বেড়ে যাচ্ছে ভিট্টোরিয়ার।

    তার হাত আরো শক্ত হচ্ছে, উঠে যাচ্ছে হাতের গান।

    বিশ ফুট।

    এখনো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে গুনগুন শব্দ। একটু যেন রাগান্বিত। ল্যাঙডন মনে করছে এটা কোন বৃদ্ধা মহিলার কণ্ঠ। বোঝা যাচ্ছে, নিঃশব্দে কথা বলছে সে। অন্যজন কোন কথা বলছে না।

    মি স্কুসি! ভিট্টোরিয়ার কোমল কণ্ঠ চিরে দিল স্কয়ারের নিরবতা।

    থমকে গেল ল্যাঙডনের হৃদস্পন্দন, যখন সে দেখল ধীরে ধীরে মানুষ দুজন পিছন ফিরে তাকাচ্ছে।

    আরো দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে ভিট্টোরিয়া, আগের চেয়ে অনেক বেশি দ্রুত। যে কোন সময় তাদের মধ্যে সংঘর্ষ হতে পারে। তাদের হাতে কোন সময় নেই। হঠাৎ টের পেল ল্যাঙডন, তার পা থেকে যেন শিকড় গজিয়েছে। এগিয়ে যেতে পারছে না সে।

    দেখতে পেল সে ঠিক ঠিক, ভিট্টোরিয়ার দু হাত প্রসারিত হচ্ছে, উঠে আসছে হাতের আগ্নেয়াস্ত্র। তারপর, তার কাঁধের উপর দিয়ে, একটা মুখাবয়ব দেখা যাচ্ছে স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোয়।

    একটা আতঙ্ক তার সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ল। বলল, ভিট্টোরিয়া, না!

    দেখে মনে হয় ভিট্টোরিয়া তারচে এক সেকেন্ডও এগিয়ে নেই। সামলে নিল মেয়েটা নিজেকে। ঠাণ্ডা রাতে ডেটিংয়ে বেরুনো জোড়ার মত আচরণ করল তারা একে অন্যের প্রতি। হাত ছড়িয়ে দিল ভিট্টোরিয়া দুপাশে। হাতে কোন পিস্তল নেই। তাদের সামনেই ঘোমটা দেয়া জোড়া।

    বুনা সেরা, বলল সে, ফিরে আসছে নিজের পথে।

    দুজন মহিলা দাড়িয়ে পিছন ফিরল। তাদের চোখেমুখে বিস্ময় এবং খানিকটা বিরক্তি। এখনো তারা বুঝতে পারছে না কোথা থেকে ভোজবাজির মত উদিত হল এই জোড়া। মহিলা দুজনই বয়েসি। তার মধ্যে একজন ঠিকমত দাঁড়াতেই পারে না। অন্যজন তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করছে।

    কোনক্রমে একটা হাসি যোগাড় করল ভিট্টোরিয়া। ডোভে লা চেসিয়া সান্তা মারিয়া ডেলা ভিট্টোরিয়া? কোথায় সান্তা মারিয়া ডেলা ভিট্টোরিয়া?

    ই লা। বলল একজন।

    গ্রাজি, বলল ল্যাঙডন। ভিট্টোরিয়ার কাধে একটা হাত রেখে বলল সে। টেনে নিল তাকে প্রেমিকের মত। সে ভেবে পাচ্ছে না আর একটু হলেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ত দুজন বয়েসি মহিলার উপর।

    নন সি পুয়ো এন্টারে, সতর্ক করল মহিলা, হা চিউসো প্রেসততা।

    আগেই বন্ধ হয়ে গেছে! দেখে মনে হবে ভিট্টোরিয়া বিষম খেল, পার্সে?

    এবার দুজন মহিলাই একত্রে অনর্গল কথা বলা শুরু করল। ঝাঝালো ইতালিয়র মধ্যে খুব একটা বুঝে উঠতে পারল না ল্যাঙডন।

    এটুকু বোঝা যায়, তারা দুজন মনেপ্রাণে চার্চে গিয়ে ভ্যাটিকানের বিপদের সময়ে প্রার্থণা করতে বসেছে এমন সময় এক লোক এসে তাদের বলল যে গির্জা খুব দ্রুত বন্ধ হয়ে যাবে।

    হ্যান্নো কনোসিয়েস্তা লিউমো? দাবি করল ভিট্টোরিয়া, লোকটাকে আপনারা চেনেন?

    এবারও দুজন একত্রে তাদের মাথা নাড়তে শুরু করল। সে তাদের সবাইকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। তাড়িয়ে দিয়েছিল তরুণ প্রিস্টকেও। সে বলেছিল যে পুলিশের খোঁজে যাচ্ছে তারা। তখন লোকটা বলে যে পুলিশ যে ক্যামেরা আনবে সে ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে হবে।

    ক্যামেরা?

    একটু রাগান্বিত হয়ে উঠল মহিলা বলল যে লোকটা একটা অসভ্য। তারপর এগিয়ে চলল তাদের পথে।

    অসভ্য? জিজ্ঞেস করল ভিট্টোরিয়াকে ল্যাঙডন।

    বার্বারিয়ান নয়। অসভ্য নয়। বার আরাববা… এরাবিয়ান।

    সাথে সাথে একটা ঝাঁকি খেল ল্যাঙডন। এক ঝটকায় চোখ ফেরাল চার্চের দিকে। সে একদৃষ্টে তাকাল গির্জার দিকে। তারপরই হিম শিতল হয়ে উঠল তার রক্ত। সেখানে কোন এক জানালায় একটা বিচিত্র ব্যাপার দেখা যাচ্ছে।

    খেয়াল করেনি ভিট্টোরিয়া। সেলফোন বের করে সে বলল, আমি ওলিভেটিকে সতর্ক করে দিচ্ছি।

    বোবা হয়ে তার হাত ধরল ল্যাঙডন। কোন কথা না বলে চার্চের দিকে তার চোখ ফিরিয়ে নিল।

    কোনমতে একটা ধাক্কা সামলাল ভিট্টোরিয়া।

    চার্চের জানালায় চোখ দিয়ে নির্বাক হয়ে গেল সে। তাকাল ভাল করে। ঘষা কাঁচের ভিতর দিয়েও ঠিক ঠিক দেখা যাচ্ছে একটা অগ্নিকুন্ডের শিখা।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদ্যা লস্ট সিম্বল – ড্যান ব্রাউন
    Next Article দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    Related Articles

    ড্যান ব্রাউন

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    ড্যান ব্রাউন

    দ্যা লস্ট সিম্বল – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    ড্যান ব্রাউন

    অরিজিন – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    ড্যান ব্রাউন

    ইনফার্নো – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    ড্যান ব্রাউন

    ডিসেপশন পয়েন্ট – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    ড্যান ব্রাউন

    ডিজিটাল ফরট্রেস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025

    দ্য দা ভিঞ্চি কোড – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025

    এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস – ড্যান ব্রাউন

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.