Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    এবং মার্কেট ভিজিট – অভীক সরকার

    লেখক এক পাতা গল্প376 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    মার্কেট ভিজিট ১৫

    গেসলুম আদিত্যদা’র কাছে! কি বললেন? কোন আদিত্য? ইক্কিরে বাওয়া, চিনলেন না? আরে আদিত্যদা, ইউপি”র সিএম, আরে আমাদের যোগীজী!

    মানে?

    এই দ্যাখো, ঘাবড়ে গেলেন নাকি? আরে ঘাবড়াবেন না মশাই। মানে আর কিছুই না, সামান্য এয়ার্কি কচ্ছিলুম আর কি! আমি গোরখপুর গেসলুম মার্কেট ভিজিটে, তাই একটু…আরে এই দ্যাখো, তেড়েমেড়ে আসছে কেন লোকজন? আরে উনি যে খুবই ভালোমানুষ সে কি আর জানি নে? মুক্তন্ট্রে স্বীকার করি সে কথা। যেমন সাহস, তেমন তেজোময় মূর্তি, তেমনই জ্বালাময়ী ভাষণ! আর কি প্রশস্ত ললাট, কি অম্লানকুসুম হাসি, কি চিকনিচামেলী গাল, এককথায় কি উচ্চবংশ, ক্কি উচ্চবংশ!

    দাঁড়ান, ব্যাপারটা খুলে বলি।

    সদ্য যে কম্পানিটি আমার আর আমার বউ বাচ্চার ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নিয়েছে, তারা ভালোবেসে নিভৃতে যতনে ইস্টার্ন ইণ্ডিয়ার সঙ্গে ইস্ট ইউপিও জুড়ে দিয়েছে। আমি অবশ্য মিনমিন করে বলার চেষ্টা করছিলুম, ‘হাম প্রচণ্ড দুবলা হ্যায় স্যার, তাকাকে দেখিয়ে, গাল দুখানা শুকাকে আমসি হো গ্যায়া হ্যায়। উসকে উপর আমার আবার প্রচণ্ড ভূতের ভয় স্যার, আর ইউপির গোভূতগুলো যে কি জঘন্য হোতা হ্যায় স্যার যে কেয়া বোলেগা, তাড়া করনে সে দৌড়তে দৌড়তে আমার ঠ্যাং খুল যায়েগা স্যার’ ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু ভবী তো আমার এইসব নানা প্রকারে কাতর আর্তনাদে ভুললেনই না। তার উপর ভাইস প্রেসিডেন্ট লোকটা মশাই দেখলুম বিচ্ছিরি বিচ্ছিরি সব ভাইসে ভর্তি! খ্যা খ্যা করে হাসতে হাসতে পেটে একটা খোঁচা মেরে বললো, ‘ওহে কুমড়োপটাশ, সামান্য দৌড়াদৌড়ি করলে আখেরে তোমার ভালোই হবে হে। বডিখান যা বানিয়েছো বাপু, বলি একটা আয়নায় আঁটে?’

    ইনসাল্টিং না? আপনারাই বলুন।

    অবশ্য পরে ভেবে দেখলুম প্রস্তাব খারাপ না। ইস্ট ইউপি বলতে লাখনৌ থেকে বেনারস আর বালিয়া পজ্জন্ত আর কি! আমিও শুনেটুনে আর আপত্তি করিনি। কম্পানি বলছে লাখনৌ থেকে বেনারস, আমি শুনছি গলৌটি কাবাব থেকে রাবড়ি! বস দেখাচ্ছে বেহরৌচ থেকে সিদ্ধার্থনগর হয়ে গোরখপুর, আমি ম্যাপে পষ্ট দেখছি আঙুল সামান্য এদিকওদিক হলেই কপিলাবস্তু থেকে লুম্বিনী হয়ে কুশীনগর ! যাদৃশী ভাবনার্যস্য ইত্যাদি প্রভৃতি!

    যাক গে। আমিও ভেবেছি গরমটা একটু কমুক, বিষ্টিটিষ্টি একটু পড়ুক, হাসি হাসি মুখে একদিন না হয় এলাহাবাদ বা বেনারসে বডি ফেলবো হপ্তাখানেকের জন্যে। আহা আমার মতন প্রতিভার সঙ্গ কি এক হপ্তার কমে কেউ পেতে চায়, বলুন? একটা ”এয়ার” নিয়ে ফ্লাইট থেকে নামবো, লোকজন গাড়িফারি হাজির থাকবে, সামান্য মার্কেট ভিজিট, তারপর চন্নামেত্তর মতন চাট্টি উপদেশ ছিটিয়ে দিয়ে হোটেলে ফিরে রাজকীয় অভ্যর্থনা, আর কি চাই? অবস্থাগতিকে সন্ধেবেলায় মিটিং, হোটেলরুমেই অবিশ্যি.. চাইতেই কোল্ড ড্রিঙ্কস, না চাইতেই…. হেঁ হেঁ সেসব বোঝেনই তো!

    কিন্তু ও হরি, ম্যান প্রপোজেস, ভাইগ্য ডিজপোজেস বলে ঈশপ ফেবলস না রসময় গুপ্তের কাব্যসঙ্কলনে একটা কথা আছে না? হাতেনাতে ফলে গেলো মশাই!

    গোরখপুরের আমাদের একটি ডিস্ট্রিবিউটর আছেন, যিনি কিঞ্চিৎ বাহুবলী বলে বাজারে দুর্নাম আছে। এসব অবিশ্যি ওদিকে জলভাত, লোকে দুচারটে খুন করাকে গৌরবজনক বলেই মনে করে। বেয়াইমশাই চারটে খুন করেছেন, আর উনি নিজে মাত্তর দুটো, এ দুর্নাম ঘোচাবার জন্যে মেয়ের বাপ মেয়ের বিয়ের আগে নিজের ”ওজন” বাড়াতে অনিচ্ছাসত্ত্বেও, নেহাৎ বাধ্য হয়েই, আরও দুটো খুন করেছে এসব স্বচক্ষে দেখা, স্বকর্ণে শোনা (‘চারগো হাম ভি কিয়ে হ্যাঁয়, হাম কিসিসে কম হ্যায় কা রে বাবুয়া?’)। কলকাতায় যেমন মিষ্টির দোকান, ইউপি বড় বড় শহরে তেমন বন্দুকের দোকান। আর শুধু কি ”দম্বুক”? ওয়ান শটার, তামাঞ্চা, দেসি কাট্টা, রামপুরিয়া … ভ্যারাইটি আর অ্যাসর্টমেন্ট দেখলে চোখ টেরিয়ে যাবে মশাই! আর দুচারটে নীচু জাতের দোসাদ, চামার বা কুর্মি মারলে ওখানে ওসব তেমন দোষের বলে ধরা হয় না, ‘অ্যাঃ, টিকটিকি’ বলে কাটিয়ে দেয়।

    তা আমাদের ডিস্ট্রিবিউটরটি বছরখানেক বেগড়বাঁই করছেন খুবই। বাহুবলী বলে কেউ বিশেষ কিছু বলতেও সাহস পায় না। আরে মশাই, যে লোকটা দশ বছর আগে গোরখপুরে দশ হাজার টাকা দিয়ে পানের দোকান খুলেছিলো, আজ সে আড়াইশো কোটি টাকার সাম্রাজ্যের মালিক, তার কুছ তো ইজ্জত করো গে কে নেহি, হাঁয়?

    তা গত মাসে বাবুর ষাট লাখ টাকা টার্গেট ছিলো। তিনি বলে পাঠালেন যে তিনি পাঁচ লাখের বেশি করবেন না, তাঁর নাকি মুড নেই! তাতে আমি সবিনয়পূর্বক ফোন তুলে বল্লুম যে যেহেতু আমার বাবা এই ব্যবসায় নেই, তাই তাঁর পক্ষে বাকি পঞ্চান্ন লাখের ভরপাই করা তো সম্ভব হবে না রে ভাই! তোর মুড নেই শুনে দুঃখ পেয়েছি খুবই। তবে কিনা বড় মানুষের মুড, পালিয়ে আর যাবে কোথায়, কাছেপিঠেই আছে কোথাও। তাকে একটু খুঁজেপেতে এনে অর্ডারটা দিতে হচ্চে যে কত্তা!

    তাতে উনি বললেন যে এভাবে কাজ করতে উনি অভ্যস্ত নন। আমি মশাই পোচ্চণ্ড বিনয়ী ম্যান, তাঁর অভ্যেসের সবিশেষ প্রশংসা করে বল্লুম তাহলে আর কি, পেয়েছি ছুটি বিদায় দেহো ভাই, ব্যবসা আমি অন্যত্র লইয়া যাই!

    দুদিন পরে মহাসিন্ধুর ওপার থেকে আমারই সেলস টিমের আর্তনাদ ভেসে এলো, সে বাবু নাকি পিস্তলটিস্তল দেখিয়ে আমার ছেলেছোকরাদের সামান্য চমকেছেন। এখানে স্বীকার করতে আমি বাধ্য যে পিস্তল জিনিসটা শরীরের পক্ষে খুবই উপকারী, ওতে অজ্ঞান নাশ হয়, শুভবুদ্ধির উদয় ঘটে, পিত্ত থেকে চিত্তবিকার অবধি ক্যুইক সেরে যায়, আর দ্রুত কর্মক্ষমতা বাড়ানোর ব্যাপারে তো লাজবাব! কিন্তু আমি মাইরি সেলসটিমগতপ্রাণাং, তন্নামশ্রবণপ্রিয়াং, মানে বাংলায় বলতে গেলে তাদের কান্নাকাটি মোটে সইতে পারিনে। ফলে দিন চারেক আগের এক দুপুরবেলা ”পূর্বাঞ্চল এক্সপ্রেস” নামের একটি অতি খাজা ট্রেনে চড়ে বসতে বাধ্য হলাম।

    পুর্বাঞ্চল এক্সপ্রেস একটি অতি বেয়াক্কেলে ট্রেন মশাই, এই বারণ করে দিলুম, ঘুণাক্ষরেও চড়বেন না। একে প্যান্ট্রি নাই, তার ওপর যেমন জঘন্য সার্ভিস, তেমনই নোংরা টয়লেট! সে যাই হোক, অশেষ নরকযন্ত্রণা ভোগ করে, গোরখপুর পৌঁছে, সেই মহামহিম বাহুবলীটির সঙ্গে মিটিং করে, তারই কথার জালে তাকে পেড়ে ফেলে, তৎক্ষণাৎ তাকে স্যাক করে, পরের দিন একখান ইনোভা গাড়িতে বেনারস পৌঁছবো বলে উঠে পড়লুম। সে বেচারা বুঝলোই না কোথা হইতে কি হইয়া গেলো, দস্যু মোহন কি করিয়া যেন তাহারই টুপি তাহাকেই পরাইয়া গেলো!

    বেনারস আমার প্রিয় শহর, এখানেই একবার নাম বিভ্রাটে আমার এক মর্মান্তিক দুঃখভোগ ঘটেছিলো ( মার্কেট ভিজিট ৩ অবলোকন করহ), তদসত্বেও আমি এ শহরের চার্ম থেকে মুক্ত হতে পারিনি। কিছু কিছু শহর গেলেই আমার বড় আপন মনে হয়, যেমন পুনে, যেমন জলপাইগুড়ি, যেমন ভাইজ্যাগ, তেমনই বেনারস। কিন্তু এবার সময় বড় কম ছিলো, ঘন্টা ছয়েকের মধ্যে মার্কেট ভিজিট ও ডিস্ট্রিবিউটার্স মিট সেরে রাতে চড়ে বসলুম কলকাতাগামী একটি ট্রেনে।

    আর সেখানেই তেনাকে দেখলুম।

    রাতের ট্রেন। আমি দিব্য আমার প্যাকড ডিনার এবং ব্যাগপত্তর নিয়ে আমার লোয়ার বার্থের সিটটিতে বেশ আয়েশ করে বসেছি। খানিকক্ষণ বাদেই এক মোটাসোটা গোলগাল হাফপ্যান্ট পরিহিত, সোনালি রিমলেস চশমা পরিহিত, ফ্রেঞ্চকাট শোভিত এক ভদ্রলোক, তাঁরই সুন্দরী সুতনুকা স্ত্রী এবং সাক্ষাৎ তেনাকে সমভিব্যাহারে এসে আমার সামনের সিটটি অধিগ্রহণ করলেন!

    তেনার হাইট চার ফুটের মতন, বয়েস পাঁচ বছর, পরনে মিষ্টি একটি বেবি পিঙ্ক ফ্রক, এবং একগাদা চুল মাথায় ঝুঁটি করে বাঁধা। তিনি এসেই প্যাসেজের মধ্যে দুদিকের দুটি লোহার হ্যাণ্ডেল পাকড়ে ( যা বেয়ে লোক ওপরের বার্থে ওঠে) ঝুলতে লাগলেন। তাঁর মাতৃদেবী তাতে হাঁ হাঁ করে উঠলে তিনি সলজ্জ মুখে জবাব দিলেন ‘ব্যায়াম কচ্চি তো’। বলাবাহুল্য, অমন ব্যায়ামে লোকজনের চলাচলের বিলক্ষণ অসুবিধা হচ্ছিলোই, ফলত তেনার মা তাঁর কান পাকড়ে তাঁকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন, কিন্তু হা হতোস্মি! তিনি মায়ের কোল থেকে নেমে ফের সেই প্যাসেজের মুখে দাঁড়িয়ে প্যাসেজ পেরিয়ে যাতায়াতকারী সব্বার কাছে, ‘টিকিট, টিকিট দিজিয়ে’ বলে টিকিট দাবি করতে লাগলেন। যাত্রীরা ফিক করে হেসে তেনার গালে হাত দিয়ে একটি করে টিকেটের দাবি মিটিয়ে চলে যেতে লাগলেন। মাতৃদেবী হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘এই শুরু হলো!’

    বুঝলাম, একটি যন্ত্র ট্রেনে উঠিয়াছেন বটেক!

    তা ট্রেন চলতে তিনি খানিকক্ষণ ‘ও বাবা, বোর হচ্চি তো, ও মা, স্টোন পেপার সিজার খেলো না’ বলে ঘ্যান ঘ্যান করে বুঝলেন যে সে লাইনে জুত হচ্ছে না।পিতৃদেব একটি ম্যাগাজিন বার করে ঘুমোতে লাগলেন, মাতৃদেবী চোখ বুঝে বোধহয় কিঞ্চিৎ জিরিয়ে নিয়ে লাগলেন, তাঁর ফুররফুৎ নাসিকাধ্বনিতে মালুম হলো তিনি এই ছুরি পাথরের জগতের মধ্যে আর নেই। তাতে কি এই ক্ষুদ্র লক্ষ্মীবাইটিকে আর থামানো যায় মশাই? তিনি খানিকক্ষণ আমার দিকে জুলজুল করে চেয়ে রইলেন, তারপর তারপর কথা নেই বার্তা নেই রীতিমতো দাঁত বার করে ইঁ ইঁ ইঁ করে ভয় দেখাতে লাগলেন! আমিও তো ‘আমি কি ডরাই সখী’ বলে তেড়েমেড়ে দাঁত বার করে, দুই কানের পাশে দুই হাত নিয়ে গিয়ে বিচ্ছিরি ভাবে নাড়িয়ে খুবই ভয় দেখাতে লাগলুম। তিনি আমাকে বক দেখালেন, আমি তাঁকে কাক দেখালুম। তিনি ঘোর্ৎ করলেন, আমি ঘুঁৎ করলুম। শেষে তিনি হেসে ফেলে দয়ার্দ ন্ট্রে বললেন, ‘তুমি দেখছি কিচ্ছু জানো না, হিঁ.. ওই ভাবে আমার ভয় লাগে নাকি?’ জিজ্ঞেস করলুম, ‘তা তোমার কিসে ভয় লাগে?’ তিনি খানিকক্ষণ ভাবলেন, তারপর ঠেঁট বেঁকিয়ে বললেন ‘ভূতের সিনেমা, ইঞ্জেকশন আর পড়ার আন্টি’।

    বলা বাহুল্য, এরপর অট্টহাস্য করা ছাড়া উপায় থাকে না।

    আমার মৃদুন্ট্রের মিষ্টালাপেই নাকি মুমূর্ষু রোগী রোগশয্যা থেকে উঠে বসে ট্রেকিং কিংবা তীর্থযাত্রায় বেরিয়ে পড়ে, অন্তত আমাদের ফ্যামিলিতে তো তেমনই প্রবাদ। বাকিদের ছেড়ে দিন, স্বয়ং আমার গিন্নি তো প্রকাশ্য আদালতে দাঁড়িয়ে তামা তুলসী হাতে এই বক্তব্যে সায় দেবেন! তা সেই অট্টহাস্যে ট্রেনটা সামান্য থরথর কেঁপে উঠে দ্বিগুণ জোরে ছুটতে লাগলো। তেনার বাবা মা দুজনেই জেগে উঠে খানিকক্ষণ থুম মেরে বসে রইলেন, তারপর সকাতরে আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘আপনার সঙ্গে খুব দুষ্টুমি করছে, না?’

    যার নিজের মেয়ের বয়েস আট, সে পঞ্চমবর্ষীয়া একটি বালিকার অসীম অত্যাচারে ঠিক কতটা বিচলিত হতে পারে সে আপনারা জানেনই! আমি সজোরে ঘাড় নেড়ে বল্লুম, ‘কৈ, না তো!’

    কিন্তু তিনি কোথায়?

    খেয়াল হলো যে এরপর তিনি নেমে পরে একবার তাঁর বর্তমান সাম্রাজ্য, মানে সমস্ত কামরাটি সরেজমিনে তদন্ত করতে বেরিয়েছেন। শুধু কি তদন্ত? প্রত্যেককে ডেকে ডেকে ‘হ্যাল্লো আঙ্কেল, হোয়াটস ইওর নেম? হ্যলো আন্টি হোয়াটস ইওর নেম? হোয়ের ডু ইউ স্টে, হুইচ স্কুল ইউ রিড ইন’ ইত্যাদি বলে সবাকার তত্ত্বতালাশ নিয়ে সে প্রায় সি আই ডি ডিপার্টমেন্ট খুলে ফেলেন আর কি। তার ওপর আরও অন্য এক রগড়। ঠিক আমাদের পাশে কম্পার্টমেন্টে যাচ্ছিলেন এক ”এম্লেসাহিব”, মানে জনৈক বিধায়ক মহোদয়। তা পৃথিবীর এই অংশে সমস্ত সরকারি বাবুলোগ, মানে আর্দালি ও চাপরাশি অবধি যা সমাদর পেয়ে থাকেন, তা সভ্য দুনিয়াতে বড় বড় ”অফসর”দের কপালে তা মুশকিলহি নেহি, একদম না মুমকিনভি হ্যায়। এই অম্লসাহিবটিও তিন চারজন পুলিশ প্রহরাবেষ্টিত হয়ে, খানচারেক মোসাহেব ও চামচা সমভিব্যাহারে রাজপাট জাঁকিয়ে বসেছিলেন প্রায়। অকস্মাৎ সেই রাজ্যপাটে ভদ্রমহোদয়ার ব্লিৎজক্রিগ! তিনি সপাট গিয়ে এম্লেসাহিবের প্রায় কোলে উঠে প্রশ্ন করলেন, ‘হোয়াটস ইওর নেম?’

    ভদ্রলোকের চোখ প্রায় গোলগোল হয়ে কপালে উঠে যাচ্ছিল আর কি! ওঁরই এলাকায় ওঁকে নামধাম জিজ্ঞেস করে, হ্যার ঘাড়ে কয়ডা মাথা! কিন্তু প্রশ্নকর্তীর হাইট দেখে বুঝলেন কেসটা কি! তারপর দুজনে মিলে অনেকানেক ভব্য আলোচনান্তে, দুজনেই দুজনকে মাঝেমধ্যে কল করবেন এমন প্রতিশ্রুতি আদায় করে ইনি ফের নিজের রাজপাটে ফিরে এলেন।

    কিন্তু চলে এলেই তো আর হলো না মশাই। সামান্য এন্টারটেইনমেন্ট না হলে রাজারাজড়াদের মনই বা উঠবে কি করে বলুন? এখন ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো সেই আমি। দুর্ভাগ্যক্রমে সেই সময় আমি একটি রহস্যোপন্যাসে ডুবে ছিলুম। তিনি খানিকক্ষণ আমাকে অভিনিবেশ সহকারে পর্যবেক্ষণ করে প্রশ্নবাণ ছুঁড়লেন, ‘তোমাকে সামার হলিডেতে খুব হোমটাস্ক দিয়েছে, তাই না?’

    দ্রুত একমত হয়ে পড়ি, তদুপরি মুখখানা খুবই কাঁদোকাঁদো করে রাখতে হয়, ‘সে তো বটেই, একগাদা হোমটাস্ক, তার ওপরে প্রোজেক্ট ওয়ার্ক, তারও ওপরে একগাদা সামেশন আর সাবস্ট্রাকশন, আর আমাদের স্কুল টীচার কি স্ট্রিক্ট কি বলবো কি বলবো, ইয়া ম্মোটা ম্মোটা স্কেল দিয়ে….’আমার গলা থেকে হাহাকার ঝরে পড়ে। সেই আগত দুর্ভোগের চিন্তায় ব্যাকুল কান্নার শুনে পাথরও গলে যেতে বাধ্য, আর ভক্তের কান্নায় ভগবান দ্রবীভূত না হলে শাস্ত্র টাস্ত্র সব মিথ্যে , মুনি ঋষিরা সেইরকমই বলে গেছেন শুনেছি না? তেনারও চোখটা ছলছল করে এলো বোধহয়, আমার পাশে বসে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সান্ত্বনা দেন, ‘আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে, ঠিক আছে, ম্যাথসটা না হয় আমি হেল্প করে দেবো, কেমন? আমাদের তো সামেশন শেখাচ্ছে এখন!’

    এত বড় আশ্বাসের পরেও যে খুশিতে মাতোয়ারা হয়ে যে না ওঠে স্বীকার করতেই হয় যে সে ব্যাটা এক্কেরে ঘোর পাষণ্ড বিভীষণ! ফলে বইটই বন্ধ করে হাঁটু মুড়ে সিটের ওপর গুছিয়ে বসতেই হলো, আলাপ পরিচয়টা সেরে ফেলি, এই ছিলো মতলব!

    ‘তোমার নাম কি শুনি?

    ‘মৌটুসি। তোমার নাম কিইইইই?’

    ‘উমমম আমার নাম কুমড়োপটাশ বকবকম’।

    ‘ইশশশশ, মিথ্যেবাদী। কুমড়োপটাশ কারও নাম হয় নাকি?’

    ‘হয় হয় যানতি পারো না। আচ্ছা তুমি কোথায় থাকো মৌটুসি?’

    ‘আমি তো খিদিরপুরে থাকি। তুমি?’

    দিব্য মজা লাগছিলো, বানিয়ে বানিয়ে বললাম, ‘আমিও খিদিরপুরে থাকি, হুমহুম, তাই তো তোমাকে চেনা চেনা লাগছে। তোমাদের বাড়িতে একটা বুদ্ধুভুতুম থাকে না?’

    ‘ইসশশ, তুমি কি মিথ্যুক, কি মিথ্যুক গো! আমাদের ক্লাসের বিভানও এত মিথ্যে বলে না। তুমি তো হাওড়ায় থাকো’।

    চমৎকৃত হই, সামনে স্বয়ং হারমাইওনি গ্র্যা ঞ্জার সশরীরে নাকি?, ‘কি করে বুঝলে?’

    ‘হি হি হি হি, তোমাকে কেমন হাওড়া হাওড়া দেখতে!’

    স্তম্ভিত হওয়ার কিছু বাকি থাকে না আর, সত্যি বলেছে বলে খুশি হবো, নাকি রেসিস্ট কমেন্ট বলে ক্ষোভে ফেটে পড়ে ফেসবুকে স্টেটাস দেবো বুঝে উঠতে পারি না। ওদিক থেকে মহোদয়ার মাতৃদেবীর কাংস্যনিন্দিত কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ‘ছি মামমাম, ওসব কি বাজে কথা? বারণ করেছি না ওরকম বলতে?’

    আমি কাষ্ঠহাসি হেসে বলি, ‘না না ঠিক আছে, বাচ্চা তো, হেঁ হেঁ ‘, এই বলে ফের অটল ধৈর্যের সঙ্গে আলাপ জমাতে ব্রতী হই, ‘আচ্ছা, তোমাদের স্কুলে কী কী পড়ায়?’

    তিনি ভাবুক ও স্বপ্নালু চোখে অনেক্ষণ উর্ধনেত্র হয়ে থাকেন, তারপর ক্ষীণ স্বরে শুরু করেন, ‘ম্যাথস, ইংলিশ, বেঙ্গলি, সায়েন্স…’ এরপরে ভাণ্ডার ফুরিয়ে যায়, তিনি গভীর চিন্তার সঙ্গে কর গুনতে থাকেন। আমারও মায়া হয়, আহা, এই বয়সে আর কত কিই বা শিখবে বলুন তো? সময় তো পড়ে আছেই সামনে,অত্ত তাড়াহুড়ো কিসের অ্যাঁ? অতএব অন্য প্রশ্নে যেতে হয়, ‘তোমার বেস্ট ফ্রেণ্ড কে?’

    ‘স্কুলে না বাড়িতে?’

    তাই তো! এই বয়সে এসে যখন চারিদিকে তাকিয়ে দেখি শুধু ঈর্ষাকাতর সহকর্মী আর কাঠিচালনায় বীরোত্তমকেশরী প্রতিবেশীদের, তখন ভুলেই যাই শিশু বয়সে আমারও কিছু বন্ধু ছিলো, তাদেরও আমরা স্কুলের বন্ধু আর পাড়ার বন্ধুতে ভাগ করতাম। তখন ছোট শরীরে বড় মন ছিলো, সর্বত্র বন্ধু খুঁজে পেতাম, আর এখন?

    ‘আচ্ছা, দুটোই বলো’

    ‘স্কুলে প্রেরণা আর সানা। আর সোসাইটিতে সানিয়া আর ফারহা। মল্লিকা আর ঈশানীও ফ্রেন্ড বটে, কিন্তু বেস্ট ফ্রেণ্ড না। মানে প্রেরণার মত বেস্ট ফ্রেণ্ড না। তবে আইশরইয়ার থেকে বেশি ফ্রেণ্ড। তবে ঈশানী যতটা ফ্রেণ্ড আইশরইয়া তার থেকে বেশি ফ্রেণ্ড। মল্লিকা আর সানিয়াকে তুমি সেম সেম ধরতে পারো। তবে সত্যি করে বলতে গেলে কিন্তু ফৌজিয়াও আবার গুড ফ্রেণ্ডসদের মধ্যে আছে, বুঝলে? ধরো আইশরইয়া আর মল্লিকার থেকে বেশি, কিন্তু ফারহার মতন অতটা নয়….’

    ঈশ্বর পরম কারুণিক, বেশিক্ষণ এই ক্লাসিফিকেশন আর পেকিং অর্ডার শুনতে হলে মাইরি অজ্ঞান হয়ে যেতুম, জিএসটি বিলের সাবক্লজ বোঝা বরং এর থেকে ঢের সহজ। এর অর্ধেক মেহনতে শার্লক হোমসের নতুন সিরিজ বার করা যায়, হ্যারি পটার তিনবার নতুন করে লেখা যায়, গেম অফ থ্রোন্সের জি বাংলা ভার্শান বার করা যায় (টিরিয়ন ল্যানিস্টারের চরিত্রে রুদ্রনীল!)। আমি খানিকক্ষণ শিবনেত্র হয়ে তাকিয়েছিলুম, হাফ বোতল হুইস্কি সাবড়ে তার ওপর দু’পুরিয়া গাঁজা মারলে ওর থেকে বেশি হ্যাল হওয়া সম্ভব না। পরে ধাতস্থ হতে দেখি তিনি আমার কেনা চানাচুরের প্যাকেটটি খুলে খুবই মন দিয়ে সেটি সাফ করার চেষ্টায় আছেন। সেদিকে খুবই করুণ চোখে তাকাতে (স্প্রাইটে হাফ হাফ করে মিশিয়ে বাকার্ডি এনেছিলুম বটে। এখন বিনা চানাচুরে কি করে … থাক এযাত্রা বোধহয় বাড়িতে গিয়েই…), তিনি দয়াপরবশ হয়ে বললেন, ‘তুমিও একটু খাবে নাকি? দেখো, খুব ঝাল কিন্তু’! এই বলে সামান্য প্রসাদ আমার হাতে দিলেন। আমিও বুভুক্ষুর মতন মায়ের প্রসাদ, যা পাওয়া যায় তাই ভালো, ভেবে গালে চালান করে দিলুম। তারপর আড়চোখে আরেকবার চাইতেই তিনি চোখ পাকিয়ে বললেন ‘খুব ঝাল বল্লুম যে, আবার চাইছো? তোমার মা বলেনি যে গ্রিডি হওয়া ভালো নয়?’

    এরপর আরেকটু চানাচুর চায়, এমন সাহস কার? আমিই বা কোন বাহুবলী হে? হাত চাটতে চাটতে জুলজুল করে চেয়ে রইলাম, আর তিনি প্যাকেটটা শেষ করে হু হা করতে করতে তাঁর জন্যে নির্দিষ্ট বোতল থেকে আধ বোতল জল সাবাড় করে দিলেন। আমি আর কি করি, অগত্যা হতাশ্বাস হয়ে ফের একেনবাবু খুলে বসেছি, (আহা, সুজন দাশগুপ্ত মহাশয়ের জয় হউক), তিনি দেখি ফের কাছে ঘেঁষে এলেন, ‘তোমার আরও খেতে ইচ্ছে করছিলো, তাই না?’

    ছোট্টবেলা থেকে শিখেছিলাম মিথ্যে বলা পাপ, তাই দ্রুত ঘাড় নাড়িয়ে সম্মত হলাম।

    ও ম্মা, এইটে শোনামাত্র তিনি দেখি গুটিগুটি পায়ে গিয়ে তেনার মায়ের পাশ থেকে একটা এত্তবড় হলুদ রঙের প্যাকেট বার করলেন, মুখে সলজ্জ হাসি। ওটা কি রে? ত্তাই ব্বলো, একটা আস্ত পট্যাটো চিপসের প্যাকেট! এইটে না বার করে আপনি আমারই চানাচুর আমাকেই দয়াদাক্ষিণ্য করে দিয়ে…. কি নিষ্ঠুর কি নিষ্ঠুর…

    তিনি সন্তর্পণে প্যাকেটটা ছিঁড়লেন, যাতে আওয়াজ তেনার মায়ের কানে না যায়। তাঁর সেই চার্লস শোভরাজকে লজ্জা দেওয়া সূক্ষ্ম হাতের কাজ দেখে মালুম হয় যে একাজে তিনি রীতিমতো দক্ষ…শশশকরে অবশ্য আওয়াজও করলেন আমার মতন বুরবককে সতর্ক করার জন্যে … তারপর … তারপর… তারপর… ভাবতেও জিভে লাল গড়াচ্ছে.. লিখতেও এই পাতি কলমচির আঙুলগুলি শিহরিত হচ্ছে…তিনি একটি মাত্র চিপস তুলে, সেটি ভেঙে এক চতুর্থাংশ মাত্র আমার হাতে দিয়ে অত্যন্ত গম্ভীরভাবে বললেন যে, ‘বেশি চিপস খেলে পেট ব্যাথা করে, তোমার মা তোমায় বলেনি?’ এই বলে তিনি একমুঠো চিপস নিজের মুখের মধ্যে পুরে কড়মড় করে চিবোতে চিবোতে আমার দিকে সপ্রশ্ন চোখে চেয়ে রইলেন। আমিও সমুদ্রশোষণকারী অগস্ত্যকে চামচে করে জল খেতে দেওয়া হয়েছে এমন মুখ করে আঙুল চেটেচুটে বসে রইলুম।

    বল্লাম না, মায়ের প্রসাদ, যা পাওয়া যায় তাইই ভালো!

    এরপর অনেক রাত হয়েছে, এই বিধায় আমি আমার সিটে বিছানা বিছোতে লাগলুম, এরপর খেয়ে দেয়ে শোবো এই অভিপ্রায়। আমার দেখাদেখি এঁর মা’ও তাঁদের বিছানা তৈরি করতে লাগলেন। তিনিও অবশ্য সোৎসাহে তাঁর মা’কে সেই পুণ্যকর্মে সহায়তা করতে লাগলেন। মাতৃদেবী যথারীতি বিস্তর বিরক্ত হচ্ছিলেন। এখন কাজ এবং আকাজের মধ্যে এক্স্যাক্টলি কি পার্থক্য সেই নিয়ে ভিন্নরুচির্হি লোকাঃ বলে একটা ভারী দামি কথা আছে। মুশকিল হচ্ছে যে বড়রা কথাটা একদম মানতে চান না।।ফলে তেনার পিঠে উপর্যুপরি দুইবার দুম দুম করে কার্পেট বম্বিং হওয়ার পর তিনি গম্ভীর মুখে যেন ডানকার্কের সেই বন্দর থেকে, ‘গ্লোরিয়াস রিট্রিট’ করে ফের আমার কাছে ফিরে এলেন।

    তিনি গম্ভীর মুখে বসে আছেন দেখে সামান্য মায়া হলো। আরেকটু কাছে ঘেঁষে এলাম,

    ‘তোমরা কোথায় গেছিলে মৌটুসি’।

    ‘এলাহাবাদ’, অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত উত্তর, যা লোকে সচরাচর ক্ষিপ্ত হলেই দেয়।

    ‘ইয়ে, ঘুরতে?’ প্রশ্নটা করা সঙ্গত হলো কি না বুঝলাম না।

    ‘আঙ্কলের বিয়ে’। নাহ, বুঝলাম, ন্যায়শাস্ত্রে যে বলে পর্বতো বহ্নিমান ধূমাৎ, এই সেই ধূম! অবশ্য পিঠে দুম করে পড়লে…

    ‘হুমম। তা মৌটুসি, তুমি ঘুরতে যেতে ভালোবাসো?

    ‘হুঁ’।

    ‘বাহ বাহ। তা এবার সামার হলিডেতে কোথাও ঘুরতে গেছিলে তোমার?’

    ‘না। সামার তো শেষই হয়ে গেলো।’

    যাক, মনোসিলেবলের গেরোটা কেটেছে। জ্জয়ক্কালী। হাত দিয়ে ঘাম মুছে অতি সন্তর্পণে পরের প্রশ্নে যাই।

    ‘তা দুর্গাপুজোতে কোথায় যাচ্ছ তোমরা?’

    ‘এইবার? দার্জিলিং ‘, এইবার খুশিতে মুখটা ঝলমল করে উঠলো, যেন সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় উড়ে গেলো একঝাঁক রঙীন প্রজাপতির দল। আহা, কে লিখেছিলেন গো, মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি? ‘আমি, আমরা সবাই, আর সানিয়া আর ফারহা আর সানিয়া ফারহার পেরেন্টসরা, আর..’

    ‘সে কি? তুমি দুর্গাপুজোতে কলকাতায় থাকবে না?’ ছদ্মবিষ্ময়ে বলি।

    ‘না তো, আমরা প্রত্যেকবার কোথাও না কোথাও ঘুরতে যাই। লাস্ট ইয়ার কেরালা গেছিলাম। পরের বছর কুলু মানালি যাবো। তাই না মা?’ তিনি সমর্থন খোঁজার জন্যে ওদিকে ফেরেন।

    ‘মৌ, আঙ্কলকে ঘুমোতে দাও এবার। অনেক বকবক করেছো, খাবে এসো, খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ো’, মাতৃদেবীর কড়া নির্দেশ ভেসে আসে। দেখতে পাই ওদিকে ডিনার প্যাক খোলা হয়ে গেছে।

    অগত্যা, তিনি গুটিগুটি পায়ে অগ্রসর হন, ফিসফিস করে বলেন, ‘আচ্ছা, দুগগা ঠাকুরের দশটা হাত, আর কি বড় বড় চোখ, আমাদের হেডমিস্ট্রেসের মতন। তোমার ভয় করেনা?’

    রাত দশটায় পাঁচ বছরের শিশুকে মা দুর্গার দশপ্রহরণধারণের তাত্ত্বিক ব্যাখা শোনানোটা নেহাৎ চাইল্ড অ্যাবিউজ হয়ে যাবে বলে নিজেকে শাসন করতে বাধ্য হই। খেয়েদেয়ে, পর্দাটা টেনে দিয়ে মোবাইলে ”অয়ি গিরিনন্দিনী” শুনতে শুনতে গভীর ঘুম।

    পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙলো দেরিতে, তাও তিনি আমার চুল ধরে টানছিলেন বলে। উঠেই দেখি কামরায় একটা ব্যস্ত হুড়োহুড়ির ভাব, সবাই তৈরি হচ্ছেন নামার জন্যে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি ডানকুনি ক্রস করে যাচ্ছে ট্রেন, মানে আর আধঘণ্টার মধ্যে হাওড়া পৌঁছবো। তড়াক করে উঠে বেসিনে গিয়ে চোখেমুখে জল দিয়ে আসি। ফিরে এসে সিটে বসে জুতো পরছি, এমন সময় তিনি এলেন, এসেই চ্যালেঞ্জের সুরে, ‘ কাল তুমি আমাকে তো বললে না তুমি কোথায় থাকো?’

    গালটা টিপে দিয়ে বলি, ‘ আমি লেকটাউনে থাকি মৌ। কেন তুমি কি আমাদের বাড়ি আসবে?’

    খানিকক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তিনি কি ভাবেন, তারপর বলেন, ‘আগে তুমি আমাদের বাড়িতে এসো, তারপর ভেবে দেখছি।’ সেই গুরুগম্ভীর গিন্নিবান্নী হাবভাব দেখে এবার ফিক করে হেসে ফেলি, ‘আচ্ছা তোমাদের বাড়ি কি করে যেতে হয় বলো, দেখি। আমি অ্যড্রেসটা নোট করে নিই। বলো, ‘ বলে মিছিমিছি কিছু টাইপ করার ভঙ্গিতে মোবাইল বাগিয়ে ধরি। তিনিও বলতে থাকেন, ‘লিখে নাও, ভালো নাম শবনম আখতার, ডাক নাম মৌটুসি, খিদিরপুর সেকেন্ড বাই লেন, বাড়ির নাম পার্ক প্যালেস, আর আমার নাম করলেই সব্বাই দেখিয়ে দেবে, না চিনলে বলবে মোগলি যাদের বাড়ি থাকে। ও তোমাকে মোগলির কথা কিছু বলিনি, না? মোগলি হচ্ছে আমাদের সোসাইটির সওওওবচেয়ে কিউট বেড়াল। লেজখানা তো দেখোনি, এই ইয়্যাত্তোবড়…..’

    কোথাও কি সূক্ষ্ম কিছু ঘটে গেলো আমার মধ্যে? মানে নামটা শোনামাত্র কি এই নিষ্পাপ অপাপবিদ্ধ শিশুটির যে চারিত্রিক অবয়ব আমার চেতনায় ও ইন্দ্রিয়ে ছিলো, তাতে কি আমারই অবচেতন মন থেকে অনাবশ্যক কিছু রঙের ছিটে এসে পড়লো? কোথাও কি সামান্য হলে, অতি সামান্য হলেও একটা অস্বচ্ছন্দ দূরত্ব তৈরি হলো? মানে যদি সত্যিই এর নাম মৌটুসিই হতো, পদবী হতো মুখার্জি কি মণ্ডল ,নিদেনপক্ষে গঞ্জালভেস কি কউর, তাহলে কি আমার এই যে হঠাতই ‘ও আচ্ছা, মেয়েটা মুসলিম?’ চিন্তাটা মাথায় আসতো?

    না, বোধহয় আসতো না। কোথায় যেন আমরা দুপক্ষই একে অন্যকে অন্যভাবে দেখাটা অভ্যেস করে ফেলেছি। এ দায় কার কে জানে!

    জোর করে এই অস্বস্তিকর চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছি, এমন সময় আরেকটা চিন্তা মাথায় উদয় হলো, ও আচ্ছা, মুসলিম ফ্যামিলি। তাই দুর্গাপুজোয় কলকাতায় থাকে না, তাই মা দুর্গাকে দশ হাতে অত ভয়ঙ্কর লাগে তাই না?

    এবং মুহূর্তের মধ্যেই বুকের ভেতরে বসে থাকা আদ্যন্ত মদ্যপ, খিস্তিবাজ, এবং কাউকে রেয়াত না করা কিঞ্চিৎ উদ্ধত লোকটা বলে উঠলো, ‘বটে? তোমার মামাশ্বশুররা যে গুষ্টিসুদ্ধ ফিবছর পুজোতে বেড়াতে যায় তার বেলা? আর এর পদবী আখতার বলে বিচার করছো দুগগাঠাকুরকে কি বললো, বলি তোমার নিজের মেয়ে গত বছর ভদ্রমহিলাকে পলিগন বলে ডেকেছিলো, সে কথাটা মনে আছে?’

    খানিকক্ষণ মাথাটা ঝাঁকিয়ে নিলাম। না হে, ভুলই করছিলাম বোধহয়, বুদ্ধিশুদ্ধি সোজা রাখা খুবই জরুরি, খারাপকে খারাপই বলতে হয়, কিন্তু ঘণ্টাকর্ণ হওয়াটা কোনও কাজের কথা নয়।

    এমন সব ভাবছি, এমন সময় তিনি খুবই অন্তরঙ্গ ভাবে এসে কোলে উঠে বললেন, ‘শোনো না, তুমি এলে সাতাশ তারিখে এসো কেমন? মানে ঈদের দিন এসো বুঝলে? অনেক রান্নাবান্না হবে তো, আর তুমি যা হ্যাংলা..হি হিহি…আর শোনো, তোমার সঙ্গে ফারহা সানিয়া মল্লিকা ঈশানী এদের সঙ্গে ফ্রেণ্ডশিপ করিয়ে দেবো, কেমন? তোমারও অনেকগুলো নতুন ফ্রেণ্ড হয়ে যাবে, তাই না?’

    এমন লাভজনক প্রস্তাবে একমত হবো না এমন পাষণ্ড এখনও হইনি, ফলে দ্রুত সম্মতি দিয়ে ফেলি। তারপর কি একটা মনে পড়ে যেতে ফিসিফিসিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘আচ্ছা মৌটুসি, তুমি ঈদে ঈদী কি নেবে?’

    তিনি অপাঙ্গে মায়ের দিকে চেয়ে নেন, তারপর আরও ফিসফিস করে বলেন, ‘অ্যানা আর এলসার দুটো ডল এনো কেমন?’, বলেই চকাম করে একটা হামি খেয়ে ফেলেন! চোখ বুজে সেই হামি উপভোগ করতে থাকি, একটা মিষ্টি দুধেদাঁতের শিশুগন্ধ বুকের মধ্যে নরম অমাভুক জ্যোৎস্নার মতই ছেয়ে যায়। কচি গলায় কে যেন ভেতরে বলে ওঠে এক্সপেক্টোওওও পেট্রোনাম…

    বলেছিলাম না, মায়ের প্রসাদ, যা পাওয়া যায় তাইই ভালো!

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকাউরীবুড়ির মন্দির – অভীক সরকার
    Next Article এবং ইনকুইজিশন – অভীক সরকার

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }