Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    এবারো বারো – সত্যজিৎ রায়

    উপন্যাস সত্যজিৎ রায় এক পাতা গল্প1107 Mins Read0

    জুটি

    ‘আজ আমি একজন ফিল্মস্টারের কথা বলতে যাচ্ছি,’ চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন তারিণীখুড়ো।

    ‘কে তিনি? তাঁর নাম কি?’ আমরা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম।

    ‘তাঁর নাম তোরা শুনিসনি,’ বললেন তারিণীখুড়ো। তিনি যখন রিটায়ার করেন তখন তোরা সবে জন্মেছিস।’

    ‘তবু আপনি নামটা বলুন না,’ বললে নাছোড়বান্দা ন্যাপলা। ‘আজকাল টেলিভিশনে অনেক পুরোনো ফিল্মস্টারের ছবি আমরা দেখি।’

    ‘তাঁর নাম হল রতনলাল রক্ষিত।’

    ‘জানি, জানি,’ বিজ্ঞের মতো বলল ন্যাপলা। ‘মাস তিনেক আগে জয় পরাজয় বলে একটা ছবি টিভিতে দেখিয়েছিল, তাতে হিরোর বাবার পার্ট করেছিলেন রতন রক্ষিত।’

    ‘তাহলে ত ভালোই হল’, বললেন তারিণীখুড়ো। ‘তাঁকে ছবিতে দেখে থাকলে গল্পটা আরো জমবে।’

    ‘এটাও কি ভূতের গল্প?’ ন্যাপলা জিগ্যেস করল।

    ‘না, ভূত নয়। তবে ভূত বলতে ত শুধু প্রেতাত্মা বোঝায় না, ভূতের আরো মানে আছে। একটা মানে হল অতীত, অর্থাৎ যা ঘটে গেছে। ভবিষ্যতের উল্টো। সেই অর্থে এটা ভূতের গল্প বলতে পারিস।’

    ‘বেশ, তাহলে শুরু হোক।’

    তাকিয়াটাকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে তারিণীখুড়ো শুরু করলেন তাঁর গল্প—

    রতন রক্ষিত রিটায়ার করেন ১৯৭০-এ সত্তর বছর বয়সে। শরীরটা হঠাৎ ভেঙে পড়েছিল, তাই ডাক্তার বললেন কমপ্লীট রেস্ট। তার আগে পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে একটানা অভিনয় করে গেছেন রক্ষিতমশাই। তার মানে সেই সাইলেন্ট যুগ থেকে। অগাধ টাকা করেছিলেন ছবি করে, আর সেই টাকার সদ্ব্যবহার কি করে করতে হয় সেটাও জানতেন। তিনখানা বাড়ি ছিল কলকাতায়। নিজে থাকতেন অ্যামহার্স্ট স্ট্রীটে, আর অন্য দুখানা ভাড়া দিয়ে দিয়েছিলেন।

    এই রতন রক্ষিত কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন যে তাঁর একজন সেক্রেটারি চাই। আমি তখন কলকাতাতেই ছিলাম, বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। সারা জীবন টো টো করে ঘুরে নানান রোজগারের পন্থা ট্রাই করে সবে ভাবছি এবার ঘরের ছেলে যখন ঘরে ফিরেছি তখন সেট্‌ল করা যায় কিনা, এমন সময় বিজ্ঞাপনটা চোখে পড়ল। দিলুম অ্যাপ্লাই করে। রতন রক্ষিতের নামের সঙ্গে যথেষ্ট পরিচয় ছিল, ভদ্রলোকের ছবিও দেখেছি বিস্তর। তাছাড়া আমার যে সিনেমার প্রতি একটা স্বাভাবিক আকর্ষণ আছে সেটা ত তোরা জানিস।

    দরখাস্তের রিপ্লাই এসে গেল সাত দিনের মধ্যে। আমার ডাক পড়েছে ইন্টারভিউ-এর জন্য।

    গিয়ে হাজির হলুম রক্ষিত মশাইয়ের বাড়িতে।

    জানি ভদ্রলোকের শরীর খারাপ, কিন্তু চেহারা দেখে সেটা বোঝার কোনো উপায় নেই। বেশ টান-টান চামড়া, ঝকঝকে দাঁতগুলো ওরিজিন্যাল বলেই মনে হল। প্রথমেই আমাকে জিগ্যেস করলেন তাঁর ছবি দেখেছি কিনা। বললুম, পরের দিকের ছবি ত দেখেইছি, গোড়ার দিকেরও কিছু সাইলেন্ট ছবি দেখা আছে, যখন রক্ষিত মশাই কমিক ছবি করতেন।

    উত্তর শুনে দেখলুম ভদ্রলোক খুশিই হলেন। বললেন, ‘আমি গত কয়েক বছর ধরে আমার সব সাইলেন্ট ছবি সংগ্রহ করছি। আমার এই বাড়িতে একটি আলাদা ঘর আছে যেখানে এই সব ছবি দেখার জন্য একটা প্রোজেক্টর বসিয়েছি এবং সে প্রোজেক্টর চালাবার জন্য একটি লোকও রেখেছি। সাইলেন্ট ছবি আজকাল প্রায় পাওয়াই যায় না। জানেন ত, ফিল্মের গুদোমে দুবার দুটি অগ্নিকাণ্ডে প্রায় সব বাংলা সাইলেন্ট ছবি পুড়ে যায়, ফলে সে সব ছবি এখন দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু আমি হাল ছাড়িনি। আমি কাগজে বিজ্ঞাপন দিই। তার ফলে জানতে পারি যে আমার অনেকগুলো সাইলেন্ট ছবি মীরচান্দানি নামে আমার এক প্রোডিউসারের গুদোমে সযত্নে রাখা আছে। তার কারণ আর কিছুই না, মীরচান্দানি যে শুধু আমার প্রোডিউসার ছিলেন তা নয়; তিনি ছিলেন আমার “ফ্যান”। মীরচান্দানি মারা গেছেন বছর চারেক আগে; তার ছেলেকে বলে আমি ছবিগুলো কিনে নিই। এই ভাবে বার বার কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে আমি আমার সংগ্রহ তৈরি করি। অসুস্থতার জন্য আমাকে রিটায়ার করতে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ফিল্মের জগত থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা অসম্ভব। এই সব পুরোনো ছবি দেখে আমার সন্ধ্যাগুলো দিব্যি কেটে যায়। আপনার কাজ হবে আমার এই ফিল্ম লাইব্রেরির তদারক করা, ছবিগুলোর একটা ক্যাটালগ তৈরি করা, আর আমার সংগ্রহে নেই এমন ছবি খুঁজে বার করা। পারবেন ত?’

    আমি বললাম চেষ্টার ত্রুটি হবে না। যেগুলো রয়েছে সেগুলোকে ক্যাটালগ করে ঠিক করে রাখা কঠিন কাজ নয়; যে ছবি নেই, তার সন্ধানের কাজটা অবিশ্যি সহজ নয়। রক্ষিত বললেন, ‘আমি যে শুধু সাইলেন্ট ছবির কথা বলছি তা নয়, গোড়ার দিকের কিছু টকি ছবিও আমার সংগ্রহে নেই। আমার মনে হয় ধরমতলা পাড়ায় প্রযোজক-পরিবেশকদের অফিসে খোঁজ করলে সে সব ছবি নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। মোটকথা, আমার সংগ্রহে যেন কোনো ফাঁক না থাকে। বুড়ো বয়সে আমার অবসর বিনোদনের পন্থাই হবে আমার নিজের পুরোনো ছবি দেখা।’

    চাকরি হয়ে গেল। অদ্ভুত মানুষ। ভদ্রলোকের স্ত্রী মারা গেছেন বছর পনের হল। দুই ছেলে আছে, দুজনেই থাকেন দক্ষিণ কলকাতায়। এক মেয়ে থাকে এলাহাবাদে, স্বামী সেখানকার ডাক্তার। নাতি নাতনীরা মাঝে মাঝে আসে দাদুর সঙ্গে দেখা করতে; ছেলেরাও যে আসে না তা নয়, তবে ফ্যামিলির সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই বললেই চলে। বাড়িতে থাকে দুটি চাকর, একটি রান্নার লোক, আর একটি খাস বেয়ারা, নাম লক্ষ্মীকান্ত! লক্ষ্মীকান্ত বাঙালি, বয়স ষাটের উপর এবং অত্যন্ত অনুগত। এমন একজন বেয়ারা পাওয়া খুব ভাগ্যের কথা।

    এই লক্ষ্মীকান্তর সাহায্যে কাজ করে আমি দিন দশেকের মধ্যে রক্ষিত মশাইয়ের সংগ্রহের একটা ক্যাটালগ করে দিলাম। তাছাড়া ধরমতলায় ঘুরে উনি টকির আদি যুগে যে সব ছবি করেছিলেন তার অনেকগুলোর হদিস জোগাড় করে দিলাম। ভদ্রলোক সেগুলোর একটা করে প্রিন্ট কিনে নিজের লাইব্রেরিতে রেখে দিলেন।

    আমার কাজ দশটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত; কিন্তু মাঝে মাঝে সন্ধ্যাটাও রক্ষিত মশাইয়ের সঙ্গে কাটিয়ে যাই। সাড়ে ছটায় ভদ্রলোক ছবি দেখতে শুরু করেন, থামেন সাড়ে আটটায়। প্রোজেকশনিস্টের নাম আশুবাবু, বয়স পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন, কাজে কোনো ক্লান্তি নেই। দর্শক মাত্র তিনজন—রক্ষিত মশাই, বেয়ারা লক্ষ্মীকান্ত, আর আমি। বেয়ারাকে থাকতে হয়, কারণ বাবু গড়গড়ায় তামাক খান; সেই তামাক মাঝে মাঝে ফিরিয়ে দিতে হয়। তবে লক্ষ্মীকান্ত যে ছবিগুলো উপভোগ করে সেটা অন্ধকারে তার মুখের দিকে চেয়ে আমি বুঝেছি।

    সবচেয়ে মজা লাগে যখন সাইলেন্ট যুগের ছবিগুলো দেখান হয়। আগেই বলেছি যে রতন রক্ষিত সেই সময় হাসির ছবি করতেন। এই সব ছবির মধ্যে অনেকগুলো ছিল যাকে বলে শর্ট ফিল্ম। দু রীলের ছবি, কুড়ি মিনিট ছিল তাদের দৈর্ঘ্য। এই ছবিতে দেখান হত লরেল-হার্ডির মতো এক জুটির কীর্তিকলাপ। ছবিতে তাদের নাম ছিল বিশু আর শিবু। বিশু সাজতেন রতন রক্ষিত, আর শিবুর পার্ট করতেন শরৎ কুণ্ডু নামে এক অভিনেতা। দুই কমিক অভিনেতার হৈ হুল্লোড়ে বিশ মিনিট দেখতে দেখতে বেরিয়ে যেত। কখনো তারা ব্যবসাদার, কখনো জুয়াড়ী, কখনো সার্কাসের ক্লাউন, কখনো জমিদার আর মোসাহেব—এই রকম আর কি? কুণ্ডু-রক্ষিতের এই জুটি তখন খুব পপুলার হয়েছিল এটা মনে আছে। বড় ছবির আগে এই কুড়ি মিনিটের শর্ট ফিল্ম দেখানো হত।

    এই ছবি চলার সময় দেখবার জিনিস হত রক্ষিত মশাইয়ের হাবভাব। নিজের ভাঁড়ামো দেখে তিনি নিজেই হেসে গড়িয়ে পড়তেন। কোনো কমিক অভিনেতা যে নিজের অভিনয় দেখে এত হাসতে পারে এটা বিশ্বাস করা কঠিন। তাঁর দেখাদেখি অবিশ্যি আমাকেও হাসতে হত। রক্ষিত মশাই বলতেন, ‘জানো তারিণী, এইসব ছবি যখন করেছি, তখন এগুলো দেখে মোটেই হাসি পায়নি। বরং নির্লজ্জ ভাঁড়ামো দেখে বিরক্তই লাগত। কিন্তু এতদিন পরে দেখছি এর মধ্যে একটা নির্মল হাস্যরস আছে যেটা আজকের হাসির ছবির তুলনায় অনেক ভালো।’

    একটা প্রশ্ন কিছুদিন থেকে আমার মাথায় ঘুরছিল, একদিন সেটা রক্ষিত মশাইকে জিগ্যেস করে ফেললাম। বললাম, ‘একটা ব্যাপারে আমার একটু কৌতূহল হচ্ছে; আপনি ত বিশু সাজতেন, কিন্তু শিবু যিনি সাজতেন সেই শরৎ কুণ্ডুর কি হল? তাঁর সঙ্গে আপনার কোনো যোগাযোগ নেই?’

    রক্ষিত মশাই মাথা নেড়ে বললেন, ‘আমি যতদূর জানি, শরৎ কুণ্ডু সাইলেন্ট যুগের পর আর ছবিতে অভিনয় করেনি। আমরা যখন একসঙ্গে কাজ করেছি তখন আমাদের দুজনের মধ্যে যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। ভেবে ভেবে নানা রকম ভাঁড়ামোর ফন্দি বার করতুম দুজনে। ডিরেক্টর যিনি ছিলেন তিনি নাম-কা-ওয়াস্তে। ছবির সঙ্গে মাল মশলা সব আমরাই জোগাতুম। তারপর একদিন কাগজে দেখলুম হলিউডের ছবিতে শব্দ যোগ হচ্ছে, পাত্র-পাত্রীরা এবার থেকে কথা বলবে, আর সেই কথা দর্শকে শুনতে পাবে। সেটা ছিল ১৯২৮ কি ’২৯ সাল। যাই হোক, হলিউডে সত্যিই টকি এসে গেল। আমাদের এখানে আসতে লাগল আরো তিন চার বছর। সে এক হৈ হৈ ব্যাপার। সিনেমার খোল নলচে পালটে গেল। তার সঙ্গে অভিনয়ের রীতিও। আমার কিন্তু একটা থেকে আরেকটায় যেতে কোনো অসুবিধা হয়নি। গলার স্বরটা ভালো ছিল, তাই টকি আমাকে হটাতে পারেনি। তখন আমার বয়স ত্রিশ-বত্রিশ। বাংলা ছবিতে সুকণ্ঠ হিরোর দরকার। সেই হিরোর পার্টে আমি অনায়াসে খাপ খেয়ে গেলুম। বিশ মিনিটের ভাঁড়ামোর যুগ শেষ হয়ে গেল। আমি হয়ে গেলুম ছবির নায়ক। কিন্তু সেই সময় থেকেই শরৎ কুণ্ডু কেমন যেন হারিয়ে গেল। যদ্দূর মনে পড়ে, দু-একজনকে জিগ্যেসও করেছিলুম ওঁর কথা, কিন্তু কেউ সঠিক জবাব দিতে পারেনি। লোকটার অকালমৃত্যু হয়েছিল কিনা কে জানে।’

    তাই যদি হয়, তাহলে অবিশ্যি অনুসন্ধান করার কোনো মানে হয় না। কিন্তু আমার মনে তাও একটা খট্‌কা থেকে গেল। ঠিক করলুম যে শরৎ কুণ্ডু সম্বন্ধে খোঁজ খবর চালিয়ে যেতে হবে। সত্যি বলতে কি, বিশ মিনিটের ছবিগুলো দেখে একটা জিনিস বুঝতে পারছিলাম যে কমিক অভিনেতা হিসেবে রতন রক্ষিতের চেয়ে শরৎ কুণ্ডু কোনো অংশে কম ছিলেন না।

    টালিগঞ্জ পাড়ায় ঘোরাঘুরি করে জানলুম যে নরেশ সান্যাল বলে এক ভদ্রলোক বাঙলা ফিল্মের আদিযুগ নিয়ে রিসার্চ করছেন। ইচ্ছে একটা প্রামাণ্য বই লেখার। ভদ্রলোকের ঠিকানাটাও জোগাড় হল। তারপর এক রবিবার সকালে তাঁর বাড়িতে গিয়ে হাজির হলুম। ভদ্রলোক বললেন যে হ্যাঁ, শরৎ কুণ্ডু সম্পর্কে কিছু তথ্য তাঁর জানা আছে। বছর পাঁচেক আগে একবার অনেক খোঁজ করে তাঁর বাড়িতে গিয়ে শরৎ কুণ্ডুর একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন সান্যাল মশাই। ‘সে বাড়ি কোথায়?’ আমি জিগ্যেস করলুম। ‘গোয়াবাগানের এক বস্তিতে’, বললেন সান্যাল মশাই। ‘ভদ্রলোকের তখন চরম দুরবস্থা।’

    আমি জিগ্যেস করলুম, ‘আপনি কি সাইলেন্ট যুগের অভিনেতাদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন নাকি?’

    ‘খুব বেশি ত বেঁচে নেই’, বললেন সান্যাল মশাই। ‘যে ক’জন রয়েছেন তাঁদের নিতে চেষ্টা করছি।’

    আমি রতন রক্ষিতের কথা বলে দিলাম, আর বললাম যে তাঁর সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা আমি করে দিতে পারি। ভদ্রলোক তাতে বেশ উৎসাহ প্রকাশ করলেন।

    এরপর আমি আসল প্রশ্নে চলে গেলুম।

    ‘টকি আসার পর কি শরৎ কুণ্ডু আর ছবিতে অভিনয় করেননি?’

    ‘আজ্ঞে না,’ বললেন নরেশ সান্যাল। ‘ভয়েস টেস্টেই ভদ্রলোক বাতিল হয়ে যান। তারপর যে কী করেছেন সেটা ভদ্রলোক খোলাখুলি বললেন না। মনে হল খুবই স্ট্রাগ্‌ল গেছে, তাই নিজের কথা বেশি বলতে চান না। তবে সাইলেন্ট যুগ সম্বন্ধে অনেক তথ্য আমি ভদ্রলোকের কাছে পেয়েছি।’

    এর পর টালিগঞ্জ পাড়ার আরো কয়েকজন পুরোনো কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানলুম যে টকি আসার পরেও বেশ কয়েক বছর শরৎ কুণ্ডু সিনেমা পাড়ায় নিয়মিত যাতায়াত করতেন। সে সময় ওঁর অবস্থা নাকি খুব খারাপ। টালিগঞ্জেরই মায়াপুরী স্টুডিওর ম্যানেজার ধীরেশ চন্দর সঙ্গে কথা বলে জানলুম যে শরৎ কুণ্ডু নাকি মাঝে মাঝে ছবিতে ‘একস্ট্রা’র পার্ট করে পাঁচ-দশ টাকা করে রোজগার করতেন। এই সব পার্টে অভিনেতা সাধারণত ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকে; তার কথা বলার কোনো দরকার হয় না।

    এই মায়াপুরী স্টুডিওতেই দ্বারিক চক্রবর্তী বলে এক বৃদ্ধ প্রোডাকশন ম্যানেজার আমাকে বললেন, ‘বেনটিংক্‌ স্ট্রীটে নটরাজ কেবিনে গিয়ে খোঁজ করুন। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত সেখানে আমি শরৎ কুণ্ডুকে দেখেছি।’

    শরৎ কুণ্ডুকে বিস্মৃতির অন্ধকার থেকে টেনে বার করার জন্য নটরাজ কেবিনে গিয়ে হাজির হলুম। এর মধ্যে—এ কথাটা বলা হয়নি—গোয়াবাগান বস্তিতে গিয়ে খোঁজ করে জেনেছি যে শরৎ কুণ্ডু আর সেখানে থাকেন না। এটাও বলা দরকার যে আমার উৎসাহের সঙ্গে তাল রেখে চলেছেন রক্ষিত মশাই। ছোঁয়াচে ব্যারামের মতো তাঁরও এখন ধ্যান জ্ঞান চিন্তা হল শরৎ কুণ্ডু। তাঁদের দুজনের মধ্যে যে কত সৌহার্দ্য ছিল সেটা এখন মনে পড়েছে রক্ষিত মশাই-এর। যুবা বয়সের স্মৃতি, আর দুজনে তখন ডাকসাইটে জুটি। লোকে আসল ছবির কথা চিন্তাই করে না; ছবির আগে বিশু-শিবুর দু রীলের কীর্তিকলাপই হল তাদের কাছে আসল। সেই জুটির একটি রয়েছে, একটি উধাও। এমন হলে কি চলে?

    নটরাজ কেবিনের মালিক পুলিন দত্তকে জিগ্যেস করাতে ভদ্রলোক বললেন, ‘শরৎদা বছর তিনেক আগে অবধি এখানে রেগুলারলি আসতেন। তারপর আর আসেন নি।’

    ‘তিনি কি কোন কাজ-টাজ করতেন?’

    ‘সে কথা তাঁকে অনেকবার জিগ্যেস করেছি;’ বললেন পুলিন দত্ত, ‘কিন্তু কোনো সোজা উত্তর কখনো পাইনি। কেবল বলতেন, “পেটের দায়ে এমন কোনো কাজ নেই যা আমি করিনি।” তবে অভিনয় যে ছেড়ে দিয়েছিলেন সেটা আমি জানি, আর সেই সঙ্গে ছবি দেখাও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। টকিই যে তাঁর কাল হয়েছিল সেটা বোধহয় উনি কোনোদিন ভুলতে পারেননি।’

    এর পরে আরো মাসখানেক নানান জায়গায় খোঁজ করেও শরৎ কুণ্ডুর কোনো পাত্তা পেলাম না। লোকটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কথাটা রক্ষিত মশাইকে বলতে উনি সত্যিই মর্মাহত হলেন। বললেন, ‘এমন একটা গুণী অভিনেতা, টকি এসে তার পসার মাটি করল, আর ক্রমে সে মানুষের মন থেকে মুছেই গেল। এখন আর তাকে কে চেনে? সে ত বেঁচে থেকেও প্রায় মরারই সামিল।’

    শরৎ কুণ্ডুর ব্যাপারে আর কিছু করার নেই বলে আমি কাজের কথায় চলে গেলুম। ভদ্রলোককে একটা প্রশ্ন করার ছিল। বললুম, ‘আপনার একটি সাক্ষাৎকার দিতে কোনো আপত্তি আছে কি?’

    ‘কে চাইছে সাক্ষাৎকার?’

    আমি নরেশ সান্যালের কথা বললুম। ভদ্রলোক সেদিনই সকালে ফোন করেছিলেন, আগামী কাল আসতে চান।

    ‘বেশ ত, সকালে দশটায় আসুক। তবে বেশি সময় যেন না নেয়।’

    নরেশ সান্যাল ফোন নম্বর দিয়ে দিয়েছিলেন, আমি তাঁকে খবরটা জানিয়ে দিলুম।

    সেদিন সন্ধ্যায় প্রোজেকশন ঘরে রয়ে গেলুম। বিশু-শিবুর কীর্তিকলাপ দেখার জন্য। বিশু-শিবুর ছবি হয়েছিল সবসুদ্ধ বেয়াল্লিশটা। তার মধ্যে সাঁইত্রিশটা আগেই জোগাড় হয়েছিল, বাকি পাঁচখানা আমার চেষ্টায় জোগাড় হয়েছে। আজ এই নতুন পাঁচখানা দেখতে দেখতে আবার মনে হল যে শরৎ কুণ্ডু সত্যিই বেশ জোরদার কমিক অভিনেতা ছিলেন। রক্ষিত মশাইকে দু-একবার চুক্‌-চুক্‌ করতে শুনলুম, তাতে বুঝলুম যে তিনি শরৎ কুণ্ডুর অন্তর্ধানের জন্য আক্ষেপ করছেন।

    পরদিন সকালে আমি আসার দশ মিনিটের মধ্যেই নরেশ সান্যাল এসে পড়লেন। রক্ষিত মশাই তৈরিই ছিলেন; বললেন, ‘আগে চা হোক, তারপর ইন্টারভিউ হবে।’ সান্যাল মশাই কোনো আপত্তি করলেন না।

    সকালে দশটায় রোজই রক্ষিত মশাই চা খান এবং সেই সঙ্গে আমিও খাই। এই সময়টাতেই আমাদের যা কিছু আলোচনা করবার তা হয়ে যায়, তারপর আমি বসে পড়ি কাজে, উনি চলে যান বিশ্রাম করতে। ক্যাটালগিং হয়ে যাবার পর আমি যে কাজটা করছি সেটা হল বিশু-শিবুর প্রত্যেকটি ছবির গল্পের সারাংশ তৈরি করা এবং তাতে কে কে অভিনয় করেছে, পরিচালক কে, ক্যামেরাম্যান কে—এই সবের একটা তালিকা তৈরি করা। একে বলে ফিল্মোগ্রাফি।

    যাই হোক্‌, আজ অতিথি এসেছেন বলে দেখি চায়ের সঙ্গে কচুরি এসেছে। ট্রে সমেত চা টেবিলে রাখা হতেই সান্যাল মশাই হঠাৎ একটা কথার মাঝখানে খেই হারিয়ে চুপ করে গেলেন। তাঁর দৃষ্টি ভৃত্যের দিকে। ভৃত্য স্বয়ং খাস বেয়ারা লক্ষ্মীকান্ত।

    আমার দৃষ্টিও চলে গেছে লক্ষ্মীকান্তের দিকে, এবং সেই সঙ্গে রক্ষিত মশাইয়েরও। এই নাক, এই থুতনি, এই চওড়া কপাল, চোখের এই তীক্ষ্ণ চাহনি—এ কোথায় দেখেছি? অ্যাদ্দিন ত এর মুখের দিকে ভালো করে চাইনি। কেন চাইব? অকারণে বেয়ারার দিকে কে চেয়ে থাকে?

    প্রায় তিনজনের মুখ দিয়েই একসঙ্গে বেরিয়ে পড়ল একটা নাম—

    ‘শরৎ কুণ্ডু!’

    হ্যাঁ, কোনো সন্দেহ নেই, শরৎ কুণ্ডু এখন হলেন তাঁর এককালের ফিল্মের জুটি রতন রক্ষিতের খাস বেয়ারা।

    ‘কী ব্যাপার হে শরৎ?’ এতক্ষণে চেঁচিয়ে উঠলেন রতন রক্ষিত। ‘তুমি আমার বাড়িতে—?’

    শরৎ কুণ্ডুরও মুখে কথা ফুটতে সময় লাগল।

    ‘কী আর করি,’ অবশেষে কপালের ঘাম মুছে বললেন ভদ্রলোক, ‘নেহাৎ ইনি চিনলেন বলেই ত তোমরা চিনলে; অ্যাদ্দিন ত বুঝতে পারনি! আর চল্লিশ বছর বাদে দেখে বুঝবেই বা কী করে!—একদিন মীরচান্দানির ওখানে চাকরির আশায় গিয়ে শুনি তুমি নাকি এসে আমাদের সেই আদ্যিকালের ছবির অনেকগুলো কপি কিনে নিয়ে গেছ নিজের সংগ্রহের জন্য। ভাবলাম তোমার এখানে এসে নিশ্চয়ই সে সব ছবি আবার দেখতে পাব। এমনিতে ত দেখার কোনো সুযোগ নেই। সে সব ছবি যে এখনো টিকে আছে তাই জানতাম না। তাই বেয়ারার চাকরির জন্য চলে এলাম তোমার কাছে। তুমি আমায় চিনলে না, চাকরিও হয়ে গেল। কুলিগিরিও করেছি, বেয়ারার কাজ ত তার কাছে স্বর্গ। আর ভালোও লাগছিল। সে যুগের ছবিতে কথা না বলে অভিনয় করেছি, সে ত নেহাৎ নিন্দের নয়। অবিশ্যি সে সব দেখার সুযোগ বোধহয় এখন বন্ধই হয়ে গেল!’

    ‘কেন, বন্ধ হবে কেন?’ রক্ষিত মশাই চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েছেন। ‘তুমি এখন থেকে হবে আমার ম্যানেজার! তারিণীর সঙ্গে এক ঘরে বসবে তুমি; আমার এখানেই থাকবে, সন্ধেবেলা একসঙ্গে বসে ছবি দেখব আমরা। এক কালের জুটি ভেঙে গিয়েছিল দৈব দুর্বিপাকে, আবার এখন থেকে জোড়া লেগে গেল। কী বল তারিণী?’

    আমি দেখছি নরেশ সান্যালের দিকে। তাঁর মতো এমন হতভম্ব ভাব আমি অনেকদিন কারুর মুখে দেখিনি। তবে তাঁর পক্ষে নির্বাক যুগের এই বিখ্যাত জুটির পুনর্মিলন যে একটা বড় রকম সাংবাদিক দাঁও হল সে বিষয় সন্দেহ আছে কি?

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকৈলাসে কেলেঙ্কারি – সত্যজিৎ রায়
    Next Article একের পিঠে দুই – সত্যজিৎ রায়

    Related Articles

    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }