Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    এম্পায়ার অভ দা মোগল : দি টেনটেড থ্রোন – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড

    লেখক এক পাতা গল্প617 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ২.০৪ এক ভিনদেশী খবরগির

    কাশ্মীরের নৈসর্গিক ভূস্বর্গে সবকিছুরই রং বেগুনী–ডাল হ্রদের দিকে নেমে যাওয়া প্রথম বসন্তে ফোঁটা কুঙ্কুমে ছেয়ে থাকা মাঠ, সূর্যের আলোয় হ্রদের পানির মাঝ থেকে ঝিলিক দেয়া নীলা, বৃত্তাকারে চারপাশ ঘিরে থাকা পাহাড়ের চূড়া… জাহাঙ্গীর প্রথম বসন্তে ফোঁটা ফুলের মাঠে পিঠ দিয়ে শুয়ে থাকে, প্রাণ ভরে তাঁদের তীব্র মিষ্টি সুগন্ধ নেয় আর মাঝে মাঝেই ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে উপরের দিকে ছুঁড়ে দেয় যাতে তাঁর চারপাশে তুষারকণার মত তাঁরা ঝরে পড়ে। নিজেকে তার ভীষণ পরিতৃপ্ত মনে হয়… সত্যিকারের তুষারপাত শুরু না হওয়া পর্যন্ত সে এখানে শুয়ে থাকতে পারবে, তাঁর সমস্ত শরীর ঝুলের মত পড়তে থাকা তুষারের পাতলা কণায় পুরোপুরি ঢেকে যাবে…

    ‘জাহাপনা। একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে এবং তাঁর স্বপ্নের মাঝে বাস্তবতা এসে হানা দেয়। আগ্রা দূর্গে নিজের ব্যক্তিগত আবাসন কক্ষে দুধের সরের মত রঙের রেশমের কারুকাজ করা নিচু বিছানার উপরে যেখানে সে শুয়েছিল জাহাঙ্গীর মৃদু গোঙানির মত শব্দ তুলে ঘুরে শোয়। সে তখন টের পায় একটা হাত আলতো করে তাঁর কাধ ধরে ঝাঁকাচ্ছে। জাঁহাপনা, যুবরাজ খুররমের কাছ থেকে একজন বার্তাবাহক এসেছে।’

    জাহাঙ্গীর নিজের ছেলের নাম শুনে ধীরে ধীরে চোখের পাতা খুলে এবং ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে বসে। সুরা-আর আফিমের ধোয়ায় সৃষ্ট তাঁর চমৎকার, শব্দহীন কোমল পৃথিবীর স্বপ্ন ধীরে মিলিয়ে যায় এবং সে চোখ কচলায়। তার বিছানার উল্টো দিকের কারুকাজ করা জালির ভিতর দিয়ে চুঁইয়ে ভিতরে প্রবেশ করা আলোর স্তম্ভের মাঝে সবকিছুই ভীষণ উজ্জ্বল আর নিখুঁত দেখায়। ডিভানের পাশে একটা নিচু তেপায়ার উপরে রাখা রত্নখচিত পানপাত্রের প্রতি তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় যার ভেতর তখনও লাল সুরার কিছুটা অবশিষ্ট আছে। সে কাঁপা কাঁপা হাতে পানপাত্রটা তুলে নিয়ে একটা চুমুক দেয়, চোখ বন্ধ করে গলার পেছনে তিতকুটে তরলের প্রলেপ অনুভব করে। সে হঠাৎ কাশতে শুরু করে এবং তরুণ পরিচারক যে একটু আগে তার নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটিয়েছে তাঁর দিকে পানি ভর্তি আরেকটা পানপাত্র এগিয়ে দিতে সে পানিটা পান করে।

    ‘তুমি এইমাত্র কি বললে?

    ‘আপনার পুত্র, যুবরাজ খুররম, একজন বার্তাবাহক পাঠিয়েছেন। বার্তাবাহক আপনার সাথে দেখা করার অনুমতি প্রার্থনা করছে।

    খুররম? জাহাঙ্গীর এক মুহূর্ত মনে মনে কিছু একটা ভাবে। সে মাঝে মাঝে নিজের প্রাঞ্জল বুনটের স্বপ্নে তার তৃতীয় পুত্রকে দেখেছে কিন্তু সবসময়েই দূর থেকে–নদীর অপর পাড়ে, বা দূর্গের প্রকারবেষ্টিত উঁচু ছাদে বা ধূলোর মেঘের মাঝে ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছে–সবসময়েই এত দূরে জাহাঙ্গীরের পক্ষে তাকে উদ্দেশ্য কিছু বলা হয়নি এবং আপাতদৃষ্টিতে তাঁর পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক। তিনি খুররমকে শেষবার যখন দেখেছিলেন তারপরে অতিক্রান্ত বছরগুলোতে তিনি জেগে থাকা অবস্থায়ও প্রায়ই তাঁর কথা ভেবেছেন, তার আচরণের ফলে সৃষ্ট ক্রোধ আর কষ্টের সাথে মিশে থাকতো অতীতের জন্য একটা আক্ষেপ যখন যুবরাজ ছিল তার সবচেয়ে অনুগত সন্তান যাকে নিয়ে তিনি এতটাই গর্ববোধ করতেন যে তিনি তাকে স্বর্ণমুদ্রা আর মূল্যবান রত্নপাথরে রীতিমত সাত করেছিলেন… সুরা আর আফিমের কারণে তার মন রীতিমত বিভ্রান্ত হয়ে থাকলেও তিনি এটা ঠিকই বুঝতে পারেন যে খুররমের কাছ থেকে এখন কোনো বার্তার একটাই সম্ভাব্য মানে হতে পারে–আত্মসমর্পণ, বিশেষ করে মহবত খান আর তাঁর বাহিনী যখন তাকে প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছে।

    ‘আমি দেওয়ানি আমে আসছি,’ তিনি পরিচারককে বলেন, তাঁর কণ্ঠস্বর চাপা শোনায়। দরবার ডাকতে বলো আর সম্রাজ্ঞীর কাছে সংবাদ পাঠাও। বার্তাবাহক কি বলতে চায় তিনি হয়ত জেনানাদের জন্য নির্ধারিত দর্শনার্থী কক্ষ থেকে শুনতে আগ্রহী হবেন… আর এটা আমার সামনে থেকে সরাও, রত্নখচিত পানপাত্রটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে, তিনি একটু থেমে যোগ করেন।

    *

    জাহাঙ্গীর প্রায় এক ঘন্টা পরে নিজের সিংহাসনে আসন গ্রহণ করে এবং তাঁর ইঙ্গিতে তূর্যবাদক তাঁর হাতের পিতলের বাদ্যযন্ত্রটা নিজের ঠোঁটে স্থাপন করে ধারাবাহিকভাবে ছোট ছোট ধ্বনির একটা সংকেত দিতে যার অর্থ দর্শন দানের জন্য সম্রাট প্রস্তুত। জাহাঙ্গীর তার সিংহাসনের একপাশের দেয়ালের অনেক উঁচুতে স্থাপিত কারুকাজ করা বেষ্টনীর দিকে তাকাতে তার মনে হয় তিনি মুক্তার উষ্ণীষের নিচে একজোড়া কালো চোখের দীপ্তি দেখতে পেয়েছেন। স্বস্তির বিষয়–মেহেরুন্নিসা সেখানে রয়েছেন।

    মোগলদের ঐতিহ্যবাহী সবুজ আলখাল্লা পরিহিত চারজন প্রহরীর পেছনে মন্থর গতিতে খুররমের প্রেরিত বার্তাবাহক সামনে এগিয়ে আসবার সময় তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। বার্তবাহক প্রহরীদের পেছনে, অর্ধেক আড়াল হয়ে থাকায় জাহাঙ্গীর তার মুখটা ঠিকমত দেখতে পান না, যারা সিংহাসন থেকে বিশ ফিট দূরে পৌঁছে চৌকষ ভঙ্গিতে দুপাশে সরে যায়। বার্তাবাহক এবার খানিকটা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে, মনে হয় যেন সে এসবের সাথে খুব একটা অভ্যস্থ নয়, মুখ নিচের দিকে রেখে নিজেকে ভূমিতে শায়িত করে, প্রথাগত অভিবাদনের রীতি কুর্ণিশের অনুসারে দুই হাত দুপাশে ছড়ানো। কালো পাগড়ির নিচে, জাহাঙ্গীর দগদগে-লাল ত্বক দেখতে পায়। বার্তাবাহক একজন ইউরোপীয়।

    ‘আপনি এবার উঠে দাঁড়াতে পারেন, ভালোভাবে দেখার জন্য সামনের দিকে ঝুঁকে এসে, তিনি বলেন। লোকটা নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াতে এবং নিজের মাথা তুলতে জাহাঙ্গীর রোদে পোড়া একটা তরুণ মুখাবয়বের মাঝে একজোড়া নীল চোখ দেখতে পান। এই চোখ তার পরিচিত কিন্তু তাঁর মন তখনও মাদকের নেশায় আংশিকভাবে আচ্ছন্ন থাকায় তিনি বার্তাবাহকের দিকে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। কে তুমি?

    ‘অধমের নাম নিকোলাস ব্যালানটাইন। আমি একসময় মোগল দরবারে ইংল্যান্ডের রাজার প্রেরিত রাজদূত স্যার টমাস রো’র ব্যক্তিগত সহচর ছিলাম। নিকোলাস তাঁর কথা শেষ করার মাঝেই সে নিজের ডান পা সামনের দিকে প্রসারিত করে সামান্য নতজানু হলে জাহাঙ্গীরের মনে পড়ে যে স্যার টমাস প্রায়ই এমন ভঙ্গি করতেন। সেসব এখন যেন কয়েক যুগ আগের কথা মনে হয়… রো’র সাথে অতিবাহিত সন্ধ্যাবেলার কথা ভেবে জাহাঙ্গীরের মনটা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে।

    ‘আমি এখন আপনার সন্তান যুবরাজ খুররমের সহচর, তিনি আমার উপর বিশ্বাস করে মহামান্য সম্রাটের জন্য একটা চিঠি পাঠিয়েছেন। নিকোলাস তাঁর কাঁধে ঝুলতে থাকা উটের চামড়ার তৈরি লাল রঙের থলের ভেতর থেকে চিঠিটা বের করে। জাহাঙ্গীর দেখতে পায় উত্তেজনার কারণে তাঁর আঙুল মৃদু কাঁপছে যদিও সে যখন তাঁর উদ্ভট বাচনভঙ্গিতে ফার্সীতে কথা বলে তাঁর কণ্ঠস্বর স্পষ্ট আর সংযত শোনায়।

    ‘বদমাশটা কি বলার মত ধৃষ্টতা দেখিয়েছে আমি সেটা নিজে পড়ে দেখতে আগ্রহী, জাহাঙ্গীর তাঁর উজির মাজিদ খানকে ইঙ্গিত করতে, তিনি জাহাঙ্গীরের বেদীর ডানপাশে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখান থেকে সামনের দিকে এগিয়ে আসেন এবং তাকে দেবার জন্য নিকোলাসের হাত থেকে চিঠিটা গ্রহণ করেন। জাহাঙ্গীর ধীরে ধীরে সীলমোহর ভাঙেন, চিঠিটা খোলেন এবং মুক্তার মত ঝরঝরে হস্তাক্ষরে লেখা ঘন সন্নিবদ্ধ পংক্তির দিকে তাকান। তাঁর নিজের আব্বাজান মহামতি আকবর–যিনি নিজে লিখতে বা পড়তে অপারগ ছিলেন–খুররমের মার্জিত লিপিকলার জন্য গর্বিত ছিলেন। তিনি সহসা মানসপটে আকবরকে দেখতে পান প্রথমদিন মক্তবে যাবার সময় লাহোরের রাস্তা দিয়ে চার বছরের খুররমকে বহনকারী হাতি নিয়ে বিজয়দৃপ্ত শোভাযাত্রা সহকারে এগিয়ে যাচ্ছেন যখন পুরোটা সময় তিনি নিজে একপাশে কেবল দাঁড়িয়ে ছিলেন, নিজের জন্মদাতা পিতা আর আপন সন্তান উভয়ের কাছেই সেই মুহূর্তে তিনি ছিলেন অনুপস্থিত।

    তার মাথা যেন যন্ত্রণায় ছিঁড়ে পড়তে চাইছে কিন্তু নিরবে এবং ধীরে পড়তে শুরু করে, তিনি নিজেকে মনোনিবেশ করতে বাধ্য করেন চিঠিতে কি লেখা রয়েছে সেটা বোঝার জন্য।

    আব্বাজান, কোনো কারণবশত যা আমার বোধগম্যতার অতীত, আপনার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবার এবং আমার বিরুদ্ধে আপনার ক্রোধের উদ্রেক ঘটাবার দুর্ভাগ্য আমায় বরণ করতে হয়েছে। আপনি আমায় ত্যাজ্য করেছেন। আমায় বন্দি করার জন্য আপনি সেনাবাহিনী প্রেরণ করেছেন এমনকি আমায় অপরাধী ঘোষণা করে আপনি আপনা সাম্রাজ্যের সবাইকে আমাকে হত্যা করার অধিকার দিয়েছেন। আমি আপনার কাছে এসবের কারণ জানতে চাই না। আপনি একজন সম্রাট যার নিজের সাম্রাজ্য নিজের পছন্দমত শাসন করার অধিকার রয়েছে। কিন্তু আমি আমার জন্মদাতা পিতা আর সেই সাথে আমার সম্রাট হিসাবে আপনার কাছে এই আবেদন করছি। আপনাকে ক্রুদ্ধ করার মত কোনো কিছু আমি হয়তো করেছি সেজন্য আমি দুঃখিত এবং আমি নিজেকে আপনার করুণার কাছে সমর্পণ করছি। আমার স্ত্রী আর সন্তানেরা এই যাযাবর জীবন আর সহ্য করতে পারছে না, বিশেষ করে কোথায় বা আদৌ আমরা নিরাপত্তা খুঁজে পাবো সেটাই যখন অজানা। আমার জন্য যদি নাও হয়, তাঁদের কথা বিবেচনা করে হলেও, আমি আপনার কাছে মিনতি করছি আমাদের বিরোধ নিষ্পত্তির একটা সুযোগ দেওয়া হোক। আপনি আমাকে যে আদেশ দেবেন আমি সেটা অবশ্যই পালন করবো–সাম্রাজ্যের যে প্রান্তেই আপনি আমাকে পাঠাতে চান আমি সেখানেই যেতে প্রস্তুত–কিন্তু আমাদের মাঝে বিদ্যমান এই বিরোধ সমাপ্ত করেন। আমি নিজের নামে এবং আমার পুরো পরিবারের নামে কসম করে বলছি যে আমি আপনার অনুগত আর বাধ্য সন্তান। আমায় অন্ধকারাচ্ছন্নতা থেকে আপনার ক্ষমার সূর্যালোকে ফিরিয়ে নিন।

    জাহাঙ্গীর চিঠিটা নামিয়ে রাখে এবং নিজের সামনের দিকে চোখ তুলে তাকায়। তার অমাত্যদের সবাই তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তাদের কৌতূহলের তীব্রতা তিনি অনুভব করতে পারেন। তিনি আবারও দৃষ্টি নত করে চিঠিটা দেখেন। আপনি একজন সম্রাট যার নিজের সাম্রাজ্য নিজের পছন্দমত শাসন করার অধিকার রয়েছে। খুররম কি আসলেই কথাটা বোঝাতে চেয়েছে?

    ‘যুবরাজ খুররম আমার অনুগ্রহ ভিক্ষা করেছে, জাহাঙ্গীর অবশেষে বলেন এবং নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সারিবদ্ধ অমাত্যদের মাঝে একটা গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়তে দেখেন, আমি আমার সিদ্ধান্ত বিবেচনা করবো। তার সামনে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকা নিকোলাসের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আমি সিদ্ধান্ত নেয়ার পরে তোমায় ডেকে পাঠাব।’ তারপরে, খানিকটা কম্পিত ভঙ্গিতে এবং তখনও খুররমের চিঠি আঁকড়ে ধরে রেখে তিনি নিজের সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়ান, বেদী থেকে নেমে আসেন এবং মন আর মানসিকতায় একটা বিক্ষোভ নিয়ে দরবার ত্যাগ করেন।

    *

    হেরেমে নিজের কক্ষে জাহাঙ্গীরের আগমনের অপেক্ষায় প্রতিক্ষারত মেহেরুন্নিসা একাকী পায়চারি করে সে খুব ভালো করেই জানে তিনি আসবেন। খুররম চিঠিতে আসলেই কি লিখেছে? সে জানবার জন্য ছটফট করে কিন্তু একই সময়ে খানিকটা শঙ্কিতও বোধ করে। খুররম তার আব্বাজানের সাথে বিরোধের প্রথম মাসগুলোতে যে চিঠিগুলো লিখেছিল সেগুলোর মত এটাও যদি সে কোনোমতে অভিগ্রহণ করতে পারতো। খুররম চিঠিতে যাই লিখে থাকুক, সে খুব ভালো করেই দেখেছে তার চিঠি পেয়ে জাহাঙ্গীর ঠিক কতটা আবেগতাড়িত হয়েছেন। খুররমের প্রতি প্রচণ্ড ক্রোধ যা পুরো বিষয়টা তার জন্য সহজ করে দিয়েছিল তাকে অপরাধী ঘোষণা করতে সম্রাটকে রাজি করাতে প্রশমিত হতে আরম্ভ করেছে। শারীরিক আর মানসিকভাবে জাহাঙ্গীর বৃদ্ধ হচ্ছেন। বার্ধক্যের শীতল বাতাসের প্রথম ঝাপটা যখন পুরুষের উপর বইতে শুরু করে তখন তাদের মাঝে কখনও কখনও যখন সময় রয়েছে তখন নিজেদের জীবনের ভুলগুলি শুধরে নেয়ার একটা আকাঙ্খ জন্মে। জাহাঙ্গীর হয়ত নিজের মনের গহীনে খুররমের সাথে বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন।

    দুই মাস পূর্বে, সুরার প্রভাবজনিত চিত্তবৈকল্যের কারণে উচ্চস্বরে প্রলাপ বকতে বকতে পারভেজের মৃত্যু তাকে প্রচণ্ড দুঃখ দিয়েছে, তিনি নিজেই নিজের সুরা আর মাদক সেবনের পরিমাণ সম্পর্কে অনেক বেশি সতর্ক হয়ে উঠেছেন আর সম্ভবত তার অন্যান্য সন্তানদের ভুলগুলোর প্রতিও তাঁর মনোভাব অনেকবেশি নমনীয় হতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক সময়গুলোয় তিনি বেশ কয়েকবার খসরুর বন্দিদশার কঠোরতা হ্রাস করার বিষয়ে আলোচনা করেছেন…

    মেহেরুন্নিসা বাইরে পায়ের শব্দ আর কণ্ঠস্বর শুনতে পায় হুশিয়ার সম্রাট আসছেন। তারপরে তুতকাঠের উপর গজদন্তের কারুকাজ করা দুই পাল্লার দরজা খুলে যায়। জাহাঙ্গীর তার কক্ষে প্রবেশ করা মাত্র সে তার দিকে দৌড়ে যায় এবং তাঁর হাত ধরে। আপনাকে অসুস্থ আর বিব্রত দেখাচ্ছে। বা-দৌলত এমন কি লিখেছে যা আপনাকে এতটা বিপর্যস্ত করে তুলেছে? তুমি নিজে তাঁর চিঠিটা পড়ে দেখো।

    মেহেরুন্নিসা তাঁর হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে দ্রুত সেটায় চোখ বুলায়। ‘খুররম খুব ভালো করেই মহবত খানের বিরুদ্ধে সে কোনো রকম প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারবে না তাই সে আপনার কাছে এমন ইনিয়ে বিনিয়ে চিঠি লিখেছে। সে যদিও আপনার করুণা ভিক্ষা করেছে কিন্তু তারপরেও সে এখনও তার দোষ স্বীকার করে নি। এই দেখেন সে কি লিখেছে।’ মেহেরুন্নিসা নিজের মেহেদী রঞ্জিত হাতের আঙুলের অগ্রভাগ একটা পংক্তির উপর রাখে কোনো কারণবশত যা আমার বোধগম্যতার অতীত, আপনার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবার এবং আমার বিরুদ্ধে আপনার ক্রোধের উদ্রেক ঘটাবার দুর্ভাগ্য আমায় বরণ করতে হয়েছে। সে এখনও অহঙ্কার আর ছলনা ভুলেনি। আপনি না চিঠির বক্তব্য অনেকটাই যেন সেই বরং আপনাকে ক্ষমা করছে।

    “কিন্তু সে যদি সত্যিই আন্তরিকভাবে আপোষ করতে চায়, জাহাঙ্গীর যুক্তি দেখাতে চেষ্টা করে, আমার বোধহয় বিষয়টা বিবেচনা করে দেখা উচিত। মহবত খান আমার সেরা সেনাপতিদের একজন–আমি সেজন্যই খুররমকে বন্দি করার জন্য তাকে মনোনীত করেছিলাম–আর আমাদের গুপ্তচরেরা যেমন সংবাদ এনেছে যে পারস্যের শাহ আরো একবার কান্দাহার আক্রমণের পরিকল্পনা করছে সেটা যদি সত্যি হয় পারস্যের বাহিনী আক্রমণ করে সেক্ষেত্রে আমি পারস্যের বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রেরণের জন্য তার বাহিনীকে প্রস্তুত অবস্থায় পাবো। সে নিজে একজন পার্সী এবং শাহের প্রাক্তন সেনাপতি হবার কারণে সে তাদের কৌশল আর চিন্তাধারার সাথে বেশ ভালোভাবেই পরিচিত। আর তাছাড়া আমার সন্তানকে পুনরায় আমার কর্তৃত্বের প্রতি বশ্যতা প্রদর্শন করতে দেখলে, স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আনুগত্য প্রদর্শন করছে, আমার সম্মান অনেকটাই বৃদ্ধি করবে।’

    মেহেরুন্নিসা তাঁর স্বামীর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সে বহুদিন তাকে এমন স্পষ্টভাষায় কথা বলতে শোনেন নি। সে যদিও মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে শেষ পর্যন্ত সে যা চাইবে সেদিকেই তাকে সে নিয়ে যেতে পারবে, সম্ভবত তিনি ঠিকই বলছেন। একটা পরিবর্তনের সময় বোধহয় হয়েছে। সে জাহাঙ্গীরকে এইমাত্র যা বলেছে তারপরেও কোনো নিশ্চয়তা নেই যে মহবত খান, যোগ্য আর দক্ষ সেনাপতি হিসাবে তাঁর যতই সুনাম থাক, তিনি খুররমকে বন্দি করতে পারবেন, সে যতদিন বিদ্রোহী থাকবে ততদিনই সে জাহাঙ্গীরের জন্য তাঁর নিজের আর শাহরিয়ার এবং লাডলিকে নিয়ে তার পরিকল্পনার জন্য একটা হুমকি হয়ে থাকবে। খুররম নিজেও একজন দক্ষ আর যোগ্য নেতা। মহবত খানকে মোকাবেলা করতে সক্ষম এমন একটা বিশাল বাহিনী সে হয়ত গঠন করতে পারবে এই সম্ভাবনাকে কখনও উড়িয়ে দেয়া যায় না। সে গুজব শুনতে পেয়েছে যে মালিক আম্বার ইতিমধ্যে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে তার সাথে মৈত্রীর একটা প্রস্তাব দিয়েছে। সে হয়ত এমন একটা বাহিনী গঠনের অভিপ্রায়ে সাম্রাজ্য থেকে একেবারেই পালিয়ে যেতে পারে। পারস্যের শাহ ভৌগলিক ছাড়ের বিনিময়ে তাকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতে পারলে খুশিই হবে কোনো সন্দেহ নেই। খুররম যদি শাহকে কান্দাহার শহর যা তিনি ভীষণভাবে অধিকারের কামনা করেন। প্রত্যার্পণের প্রস্তাব দেয় তাহলে কি হবে? মোগল শাসকদের তাঁর নিজের দেশবাসী পূর্বে আরো দুবার সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছিল–প্রথমবার বাবর, দ্বিতীয়বার হুমায়ুন–প্রতিবারই তাঁদের কাঙ্খিত কোনো কিছুর বিনিময়ে।

    ‘তোমার কি মনে হয়? আমার কি রাজি হওয়া উচিত? জাহাঙ্গীর তার হাতের ব্যাঘের মস্তক খোদিত অঙ্গুরীয় যা একটা সময় তাঁর পূর্বপুরুষ মহান তৈমূরের হাতে শোভা পেত, অস্থির ভঙ্গিতে ঘোরাতে ঘোরাতে নাছোড়বান্দার মত জানতে চায়।

    মেহেরুন্নিসার মস্তিষ্ক সহসা ঝড়ের বেগে চিন্তা করতে আরম্ভ করে কিন্তু তার অভিব্যক্তি শান্ত দেখায় যখন সে ধীরে কথা বলতে শুরু করে, আপনি সম্ভবত ঠিকই বলেছেন। বহুদিন ধরে এই বিরোধ চলছে এবং এর নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। আমার নিজের পরিবারের ভিতরেও এই বিরোধের ফলে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে যা আমার নিজের জন্যও অনেক দিন ধরেই কষ্টের একটা কারণ হয়ে উঠেছে। আমি জানি আমার ভাই আসফ খান কতটা খুশি হবে যদি এই দ্বন্দ্বের উপশম ঘটে। কিন্তু আমাদের যত্নের সাথে চিন্তা করতে হবে। আসুন এবং আমার পাশে বসুন।

    জাহাঙ্গীর সবুজাভ-নীল রঙের একটা রেশমের তাকিয়ায় পিঠ ঠেকিয়ে মেহেরুন্নিসার পাশে আধশোয়া হতে, সে খুররমের চিঠিটা এমন ভঙ্গিতে পুনরায় হাতে তুলে নেয় যেন সে পুরো বিষয়টা বিবেচনা করতে আগ্রহী কিন্তু সে আসলে নিজে চিন্তা করার জন্য খানিকটা সময় নিতে চাইছে। তার মনে ইতিমধ্যেই একটা পরিকল্পনা রূপ নিতে শুরু করেছে কিন্তু তার নিজেকে আগে নিশ্চিত হতে হবে যে সে প্রতিটা আঙ্গিক বিবেচনা করেছে। খুররমকে সে কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারে না সে যদি একবার দরবারে ফিরে আসে ভালো করেই জানতে পারবে–যা সে করবেই–যে সেই ছিল তার আব্বাজানের ক্রোধের মূল উস্কানিদাতা আর ধারণকারী। সে অবশেষে নিজের প্রতিটা শব্দ যত্নের সাথে বাছাই করে মৃদু কণ্ঠে আর ধীরে কথা শুরু করে।

    ‘আমি প্রায়ই একটা বিষয় ভাবি কি পরিতাপের বিষয় যে খুররম উচ্চাকাঙ্খার দ্বারা নিজেকে এভাবে প্রলুব্ধ হবার সুযোগ দিয়েছে। সে এখন পর্যন্ত নিজের কর্মকাণ্ড দ্বারা একটা বিষয় নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেছে যে শাসক হবার অধিকার খসরুর চেয়ে–বা বস্তুতপক্ষে হতভাগ্য পারভেজের চেয়ে যে সুরার প্রতি নিজের আসক্তি কখনও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি কোনোভাবেই তার বেশি প্রাপ্য নয়। কিন্তু তাঁর গুণ আছে এবং সে যদি আপনার প্রতি বাস্তবিকই অনুগত হয়ে থাকে তাহলে সাম্রাজ্যের মঙ্গলের জন্য তার গুণাবলী কেন নিয়োগ করা হবে না? আর আপনি একটু আগে যেমন বললেন, আপনি যদি তার সাথে উদারতাপূর্ণ আচরণ করেন তাহলে সেটা আপনার প্রতি প্রজাদের শ্রদ্ধাই কেবল বৃদ্ধি করবে।’

    জাহাঙ্গীর মাথা নাড়ে, স্পষ্টতই খুশি হয়েছে। মেহেরুন্নিসা উৎসাহিত বোধ করে, কথা অব্যাহত রাখে। কিন্তু আপাতত তাকে কিছুদিন দরবার থেকে দূরে রাখাটাই হয়ত বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তাকে কোনো দুর্গম প্রদেশের রাজ্যপালের দায়িত্ব দেন। ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে অবস্থান করে কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যবসায় দ্বারা পুনরায় তাকে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে দেন। আপনি তারপরেই কেবল জানতে পারবেন যে তাঁর এই বশ্যতা স্বীকার ঠিক কতখানি আন্তরিক।’

    ‘আমি তাকে বালাঘাটের সুবেদার হিসাবে প্রেরণ করতে পারি…’

    হিন্দুস্তানের মধ্যভাগের এই প্রত্যন্ত প্রদেশের নাম উল্লেখ করায় যেখান থেকে খুব কমই খাজনা পাওয়া যায়-যা নিশ্চিতভাবেই বিশাল একটা বাহিনীকে সুসজ্জিত করার জন্য যথেষ্ট নয়–মেহেরুন্নিসা হাসে। সে নিজেও এরচেয়ে উপযুক্ত কোনো প্রদেশের নাম ভাবতে পারে না। ‘চমৎকার একটা প্রস্তাব, সে বলে। বালাঘাট, কিন্তু সেই সাথে দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলো থেকে খুব একটা দূরে নয় যারা সবসময়ে আপনার জন্য সমস্যা সৃষ্টির চেষ্টা করে এসেছে। আপনার বিরুদ্ধে তাঁরা যুবরাজকে হয়তো বিদ্রোহী করার প্রয়াস নেবে। তারা বলছে যে যৌথ বাহিনী গঠন করার পরামর্শ মালিক আম্বার খুররমকে দিয়েছে।’

    ‘আমি হয়তো তার জন্য অন্য কোনো স্থান খুঁজে বের করবো? সেটা কাবুল হতে পারে?’ জাহাঙ্গীর তাঁর আব্বাজানের রক্ষিতা আনারকলিকে প্ররোচিত করার পরে সেখানে নিজের নির্বাসনের কথা ভেবে ক্ষণিকের জন্য হেসে উঠে। মেহেরুন্নিসাকে তখনই সে প্রথমবারের মত দেখেছিল।

    না। কাবুল অনেকবেশি গুরুত্বপূর্ণ আর সমৃদ্ধশালী এলাকা, জাহাঙ্গীরের ভাবনা তাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে সে সম্বন্ধে উদাসীন, মেহেরুন্নিসা বলে। তাঁর ধৃষ্টতার জন্য এটা রীতিমত পুরষ্কার হিসাবে বিবেচিত হবে। বালাঘাট সেই তুলনায় অনেক ভালো। সে যদি সেখানে যায় তাহলে তাকে নিজের অহঙ্কার বিসর্জন দিতে হবে। কিন্তু আমাদের তার আগে নিশ্চিত হতে হবে সে আবারও বিদ্রোহ করার জন্য আগ্রহী হবে না।’

    ‘কিন্তু কীভাবে? তাঁর সম্বন্ধে খবর পাঠাতে গুপ্তচর প্রেরণ করা যায়।

    না। গুপ্তচরদের কেনা সম্ভব। আমার ধারণা খুররম নিজেই হয়তো উত্তরটা দিতে পারবে। সে তাঁর চিঠিতে নিজের জীবনের কসম করে সে আপনার প্রতি নিজের আনুগত্যের কথা বলেছে–কিন্তু সেই সাথে সে নিজের পরিবারের কথাও বলেছে। আপনি সেটাই পরীক্ষা করে দেখেন।

    কীভাবে?

    আপনি আপনার ক্ষমার শর্ত হিসাবে তার বড় ছেলে দারা শুকোহকে দরবারে পাঠাবার আদেশ দেন–আর সেইসাথে দারার কোনো এক ভাই তার সাথে আসতে পারে।’

    ‘তুমি বলতে চাইছে বন্দি হিসাবে?’

    ‘হ্যাঁ, এক অর্থে দেখতে গেলে আপনি তাই বলতে পারেন। খুররমে ছেলেরা যদি আপনার কাছে থাকে তাহলে সে আপনার বিরুদ্ধে কোনো কিছু করার সাহস পাবে না।

    ‘আমি বিশ্বাস সেটা… কিন্তু তাকে তার সন্তানদের কাছ থেকে আলাদা করাটা কি ঠিক হবে? আমি আমার নিজের ছেলেবেলার অভিজ্ঞতা থেকে জানি পিতামাতার ভালোবাসা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।’ জাহাঙ্গীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে যেন পুরান একটা অন্ধকার ছায়া তাঁর মনের প্রান্তরে ভেসে উঠেছে।

    তাঁদের সাথে ভালো আচরণ করা হবে এবং তারা তাদের দাদাজানের কাছে দরবারে অবস্থান করলে যেসব সুবিধা ভোগ করবে সেটার কথাও বিবেচনা করবেন। আর খুররম যদি সত্যিই চিঠিতে যা লিখেছে সেটা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের প্রশ্নই উঠবে না।’

    জাহাঙ্গীর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। মেহেরুন্নিসা বুঝতে পারে তার পরামর্শ তাকে বিস্মিত করেছে, সম্ভবত তাকে চমকে দিয়েছে, কিন্তু তিনি যখন বিষয়টা নিয়ে ভাবতে শুরু করবেন তিনি অবধারিতভাবে এর মাঝে বিচক্ষণতার ছায়া দেখতে পাবেন। সে নিজে যতই বিষয়টা নিয়ে ভাবে, ততই তার ধারণাটা পছন্দ হয়, যদিও তাকে একটা বিষয় নিশ্চিত করতে হবে যে বস্তুতপক্ষে জাহাঙ্গীর যেন তার নাতিদের খুব বেশি একটা দেখতে না পায়…

    ‘আমি কেবল আপনার বিষয় ভাবছি,’ জাহাঙ্গীরের আরেকটু নিকটে সরে এসে সে কিছুক্ষণ পরে বলে এবং নিজের মাথাটা তার কাঁধে রাখে। সে টের পায় তিনি প্রায়শই যেমন করে থাকেন ঠিক সেভাবে তাঁর লম্বা চুলে বিলি কাটতে শুরু করেছেন। খুররমের আচরণের কারণে আপনি যথেষ্ট দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়েছেন। কিন্তু আপনি বিরোধ নিষ্পত্তি করতে রাজি হয়ে একজন মহান সম্রাটের ন্যায় ক্ষমাপ্রদর্শন করেছেন কিন্তু আপনাকে নিজের জন্যও সতর্ক থাকতে হবে। আমার পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেন এবং আমি নিশ্চিত তাহলে সবকিছু আপনি যেমন চান সেরকমই হবে। খুররমকে আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করতে হবে এবং আপনি মহবত খান আর তার বাহিনীকে প্রত্যাহার করতে পারবেন তাকে অনুসরণ করা বন্ধ করে। অকৃতজ্ঞ আর বিদ্রোহী সন্তানদের কারণে আপনি ইতিমধ্যে অনেক সহ্য করেছেন। এসবের একটা সমাপ্তি হওয়া দরকার।’

    জাহাঙ্গীর তার হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে নিজের চোখ কচলায় তারপরে সে হাসে যদিও সেটা একটা বিষণ্ণ আর ক্লান্ত হাসি। আমি নিশ্চিত, তুমি ঠিকই বলেছো। তুমি সবসময়ে তাই বলে থাকো। আগামীকাল আমি আমার মন্ত্রণাদাতাদের ডেকে পাঠাব এবং তাদের আমার সিদ্ধান্ত জানাব। খুররমের সাথে বিরোধ নিষ্পত্তি হলে ভালোই হয়। আমি আমার নাতিদের সঙ্গ উপভোগই করবো। দারা শুকোহ নিশ্চয়ই এতদিনে অনেকটাই বদলে গিয়েছে।

    *

    পরের দিন সকালবেলা, নিকোলাস জাহাঙ্গীরের ব্যক্তিগত কক্ষে যাবার আদেশ লাভ করে। আগ্রায় পৌঁছাবার পর থেকেই সে খসরুর হুশিয়ারি স্মরণ করে আতঙ্কিত হয়ে রয়েছে। কিন্তু অনাকাঙ্খিত কিছুই এখনও ঘটেনি এবং সে নিরাপদে জাহাঙ্গীরের হাতে তাঁর চিঠিটা পৌঁছে দিয়েছে।

    নিকোলাসকে একজন কর্চি যখন পথ দেখিয়ে একটা কক্ষে নিয়ে আসে সে জাহাঙ্গীরকে কক্ষের কেন্দ্রে নিজের রাত্রিবাস পরিহিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাঁর মাথার ধুসর চুল অবিন্যস্ত। নিকোলাসের মাথা নত করা অভিবাদনের প্রতি তিনি স্বীকৃতি দেয়ার সময় তাঁর ঝুলে পড়া মুখের মাঝে অতীতের সেই কর্তৃত্বপরায়ণতার একটা ছাপ ঠিকই ফুটে উঠে কিন্তু ইংরেজ দূত তাকে এখন যখন তাঁর একান্ত কক্ষে দেখে সে স্পষ্টই দেখতে পায় তিনি আর স্যার টমাস যখন পানাহারের সাথী ছিলেন আর সকাল না হওয়া পর্যন্ত সারারাত ভর গল্প করতেন সেই সময়ের তুলনায় তিনি কতটা বৃদ্ধ হয়ে পড়েছেন।

    ‘এটা আমার ছেলের কাছে নিয়ে যাও।’ জাহাঙ্গীর তার দিকে কারুকাজ করা একটা চামড়ার থলে এগিয়ে দেয়। তার চিঠির উত্তর ভেতরে রয়েছে। যত্ন করে রাখবে। আমি তোমার আর তোমার দেহরক্ষীদের জন্য তাজা ঘোড়ার বন্দোবস্ত করতে বলেছি যাতে তোমরা দ্রুত যেতে পারো।

    ‘জাহাপনাকে ধন্যবাদ।’ নিকোলাস থলেটা নেয়, জাহাঙ্গীর কি লিখেছেন জানবার জন্য তাঁর ভীষণ আগ্রহ হয়। সে এক মুহূর্ত ইতস্তত করে আশা করে যে জাহাঙ্গীর হয়ত তাকে কোনো ইঙ্গিত দেবেন কিন্তু সম্রাট ইতিমধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন এবং একজন পরিচারকের ধরে থাকা পানি ভর্তি রূপার পাত্রে মুখ প্রাক্ষালণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

    জাহাঙ্গীর আধ ঘন্টা পরে একটা গবাক্ষ থেকে নিকোলাস আর তার দেহরক্ষীদের আগ্রা দূর্গ থেকে নিচে আগ্রার ঘিঞ্জি রাস্তার দিকে নেমে যাওয়া ঢালু পথ দিয়ে দুলকি চালে নামতে দেখে। তাঁর চিঠির প্রতি খুররমের প্রতিক্রিয়া কি হবে? তিনি ভাবতে চেষ্টা করেন। আর ঠিক তখনই আরেকটা ভাবনা প্রথমবাবের মত তার মনে উদিত হয়। আরজুমান্দ কীভাবে–তাঁর প্রিয় মেহেরুন্নিসার বংশের আরেকজন রমণী–প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে? সে কি নিজের সন্তানদের যেতে দিতে রাজি হবে নাকি খুররমকে অনুরোধ করবে বিষয়টা প্রতিহত করতে?

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleএম্পায়ার অভ দ্য মোগল : দ্য সার্পেন্টস্ টুথ – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড
    Next Article রুলার অভ দা ওয়ার্ল্ড : এম্পায়ার অভ দা মোগল – অ্যালেক্স রাদারফোর্ড

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }