Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    এ্যারিস্টটল-এর ‘পলিটিকস’ – সরদার ফজলুল করিম

    এ্যারিস্টটল এক পাতা গল্প496 Mins Read0

    প্রথম পুস্তক – রাষ্ট্রের সংজ্ঞা এবং সংগঠন

    প্রথম পুস্তক – রাষ্ট্রের সংজ্ঞা এবং সংগঠন

    সূচনা

    [এ্যারিস্টটল তাঁর এথিকস বা নীকিকথা থেকে রাষ্ট্রকথায় গমনের জন্য নিম্নোক্ত বক্তব্যটি ‘এথিকস’-এর আলোচনা শেষে পেশ করেছেন।(১)]

    আমাদের পূর্বগামীগণ আইন প্রণয়নের বিষয়টির উপর কোন অনুসন্ধান পরিচালিত করেন নি। এ কারণে এ কাজটি আমাদের নিজেদেরই করা আবশ্যক। বস্তুত পলিটিয়া বা সংবিধানের সমগ্র বিষয়টি নিয়েই আমাদের আলোচনা করা প্রয়োজন। তাহলেই মানুষ সংক্রান্ত আমাদের আলোচনা পূর্ণ হতে পারবে। অবশ্য আংশিকভাবে এ ক্ষেত্রে পূর্বসূরীদের কেউ কেউ কিছু উত্তম কথা বলেছেন। আমাদের উচিত প্রথমে তাদের মূল্যায়ন করা। এর পরে আমার সংগৃহীত সংবিধানসমূহ নিয়ে আলোচনা করা যাবে। এর মাধ্যমে আমরা দেখতে পাব, কোন্ প্রক্রিয়া বা ব্যবস্থার ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রকার রাষ্ট্র এবং সংবিধান ক্রিয়াশীল থাকে; কোন্ কোন্ কারণেই বা এগুলির জীবন প্রবাহে বাধার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া কোন রাষ্ট্র যে উত্তমরূপে শাসিত হয় এবং কোন রাষ্ট্রে যে উত্তম শাসনের অভাব ঘটে তার কারণ কি, তাও আমরা এ আলোচনায় দেখতে পাব। এ সমস্ত বিষয়ের আলোচনা যখন শেষ হবে তখন হয়ত আমরা অধিকতর সঠিকতার সঙ্গে বলতে পারব, কোন্ সংবিধান বা রাষ্ট্র সর্বোত্তম? সকল প্রকার রাষ্ট্রব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্য কি? এদের প্রতিষ্ঠিত আইন এবং নীতিসমূহই বা কি?

    —

    ১. T. A. Sinclair : Aristotle, The Politics, Penguin Books, 1969, P. 24

    প্রথম অধ্যায় – রাষ্ট্রের সংজ্ঞা

    আমাদের নিজেদের পর্যবেক্ষণ এরূপ সাক্ষ্য দেয় যে প্রত্যেকটি রাষ্ট্র হচ্ছে কোন উত্তম উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মানুষের সমবায়ে গঠিত একটি সংস্থা। আমি ‘উত্তম’ কথাটি ব্যবহার করেছি। কারণ মানুষ তাদের কর্মকাণ্ডে বস্তুত তাকেই সাধন করার চেষ্টা করে যাকে তারা উত্তম বলে বিবেচনা করে। এ থেকে এটা পরিষ্কার যে, সংস্থা মাত্রেরই লক্ষ্য যেখানে কোন উত্তমকে সাধন করা সেখানে যে সংস্থা সকল সংস্থার সেরা এবং অপর সকল সংস্থা যে সংস্থার অন্তর্ভুক্ত সে সংস্থার লক্ষ্যও হচ্ছে চরম উত্তমের সাধন। এরূপ সংস্থাকেই আমরা রাষ্ট্র বলে অভিহিত করি এবং এরূপ সংস্থাকেই আমরা রাজনৈতিক বলে বিবেচনা করি। অনেকে এরূপ মনে করেন যে, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে শাসক এবং শাসিতের মধ্যে, রাজা এবং প্রজার মধ্যে, পরিবারের কর্তা এবং পরিবারের মধ্যে কোন বৈশিষ্ট্য বা পার্থক্যের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু এরূপ ধারণা ভ্রান্ত। এদের মধ্যে আকারগত পার্থক্য অবশ্য বিদ্যমান। কিন্তু আকারগত পার্থক্যই একমাত্র পার্থক্য নয়। কিংবা আকারই এখানে বিচারের নিয়ামক নয়। কারণ, এরূপ আমরা বলতে পারিনে যে, লোকের সংখ্যা কয়েকটি হলে দাস-প্রভুর সম্পর্কটি তৈরি হয় এবং তার চেয়ে অধিক হলে পরিবারের সৃষ্টি হয় এবং তার চেয়েও অধিকে রাজা-প্রজার সম্পর্ক কিংবা বলা চলে একটি রাষ্ট্র-সংস্থার সৃষ্টি হয়ে যায়। এ থেকে ধারণাটি এই হয় যেন একটি বৃহৎ পরিবার এবং একটি ক্ষুদ্র নগর (রাষ্ট্র)—এ দু’এর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। অথচ রাজা-প্রজার সম্পর্কটি যথার্থই পৃথক। এটি একটি রাজনৈতিক বা শাসনগত সম্পর্ক। এখানে একটি নাগরিক-সংস্থার পার্থক্য বিদ্যমান। একটি গুণগত পার্থক্যের অস্তিত্বকে এখানে আমাদের স্বীকার করতে হয়। এবং রাজকীয় বলতে একথা বলাই যথেষ্ট নয় যে, একের শাসন হলেই সম্পর্কটি রাজকীয় হয়ে যাবে। কিংবা এও যথেষ্ট নয় যে, আমাদের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নীতির ভিত্তিতে নাগরিকগণ পালাক্রমে সকলে শাসক এবং শাসিত হলেই সম্পর্কটির চরিত্র রাষ্ট্রনীতিক হয়ে দাঁড়াবে। আমার বক্তব্য এখনো স্পষ্ট নয়। কিন্তু বিশ্লেষণের যে পদ্ধতি আমরা নির্দিষ্ট করেছি তার ভিত্তিতে আমাদের আলোচ্য বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখলে আমার বক্তব্যটি অবশ্যই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আমরা সাধারণত কি করি? আমরা একটি যৌগিক বা মিশ্র বস্তুকে তার অন্তর্গত উপাদানে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি। এই বিশ্লেষণের প্রক্রিয়াটি নিয়ে আমরা অগ্রসর হতে থাকি এবং যতক্ষণ না তার অন্তর্গত উপবিভাগুলি নিঃশেষ করে তার মূল উপাদানে আমরা পৌঁছতে পারি ততক্ষণ বিশ্লেষণের কাজটি শেষ হল বলে আমরা মনে করিনে। অনুরূপভাবে রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে যদি আমরা তার অন্তর্ভুক্ত উপাদানগুলিতে বিশ্লেষণ করি তাহলে অধিকতর উত্তমরূপে আমরা এর অংশগুলির পারস্পরিক পার্থক্য অনুধাবন করতে সক্ষম হব এবং এই উপাদানগুলির মধ্যে ক্রিয়াশীল কোন নিয়মকে স্থির করা যায় কিনা—সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাও আমাদের পক্ষে তখন সহজতর হয়ে দাঁড়াবে।

    দ্বিতীয় অধ্যায় – উপাদানের বিশ্লেষণ : পরিবারের প্রকৃতি

    আমার মনে হয়, অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন তেমনি বর্তমান ক্ষেত্রেও আমরা যদি সূচনা থেকে কোন কিছুর বৃদ্ধিকে লক্ষ্য করার পদ্ধতি অনুসরণ করি তাহলে সর্বোত্তম ফল লাভ করতে পারব। বিষয়টির সর্বোত্তম উপলব্ধি তখন আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে। এখানে প্রথম কথা হচ্ছে : এক যেখানে অপর ব্যতিরেকে নিষ্ফল, সেখানে উভয়কে পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হতে হবে। দৃষ্টান্ত হিসাবে আমরা বলতে পারি, জীবন সৃষ্টির জন্য স্ত্রী এবং পুরুষের মিলন অত্যাবশ্যক। কারণ জীবন সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই দুই-এর এক অপর ব্যতিরেকে নিষ্ফল। এবং এ মিলন যে কেবল অত্যাবশ্যক তাই নয়। এ মিলন অনিবার্য। এখানে কোন গত্যন্তর নেই। এটা প্রকৃতির বিধান। প্রজাতি সৃষ্টির জন্য মানুষ, পশু এবং উদ্ভিদ : সকলের মধ্যে প্রকৃতি মিলনের এই অনিবার্য কামনা বপন করে দিয়েছে। ঠিক অনুরূপভাবে শাসক এবং শাসিতের মিলনেরও আবশ্যকতা রয়েছে। শাসক-শাসিতের মিলনের লক্ষ্য হচ্ছে উভয়ের মঙ্গল সাধন। কারণ, শাসক এবং প্রভু কে? শাসক এবং প্রভু হচ্ছে সে, যে তার বুদ্ধির শক্তিতে প্রয়োজনীয়কে পূর্ব থেকে অনুমান করতে পারে। আবার শাসিত এবং দাস বলব আমরা তাকে যে তার দেহের শক্তিতে সেই প্রয়োজনকে নিষ্পন্ন করতে পারে। কাজেই শাসক এবং শাসিত, প্রভু এবং দাস—এ দুয়ের মধ্যে স্বার্থের সাযুজ্য যে বিদ্যমান, তা বুঝতে আমাদের কষ্ট হয় না।

    প্রকৃতি স্ত্রী এবং দাস—এ দুয়ের মধ্যেও পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। কারণ, কর্ম থেকে কর্মের পার্থক্য প্রকৃতির স্বীকৃত পার্থক্য। ডেলফি দেবীর ছুরিকা বহুমুখী হতে পারে। কিন্তু প্রকৃতি মানুষকে বহুমুখী ডেলফি-ছুরিকা করে তৈরি করে নি। প্রতিটি কার্যের জন্য উপযুক্ত হাতিয়ার প্রকৃতি নির্মাণ করেছে। এবং এক্ষেত্রে প্রকৃতি অকৃপণভাবে হাতিয়ারের প্রকার সৃষ্টি করেছে। এবং এ কারণে প্রকৃতির বিধানে যার কর্ম যা, সেই মাত্র তাকে সর্বোত্তমরূপে সাধন করতে পারে। কাজেই কোন হাতিয়ারকে একাধিক কর্মে নয়, তার উপযুক্ত কর্ম সম্পাদনে নিযুক্ত করা শ্রেয়। নারী এবং দাস—এদেরও কর্মের বিভিন্নতা আছে। কিন্তু এমন সব অ-গ্রীসীয় সম্প্রদায় দৃষ্ট হয় যারা এ দুয়ের কর্মের ভিন্নতা উপলব্ধি করতে অক্ষম। তারা নারী এবং দাস—উভয়কে এক স্তরে নির্দিষ্ট করে। এর কারণ, এদের মধ্যে এমন কোন অংশকে আমরা পাইনে প্রকৃতি যাদেরকে শাসনের কিংবা আদেশ দানের ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছে। আসলে এদের সমাজ কেবল দাসের সমাজ : পুরুষ এবং নারী দাসের সমাজ। আর এ কারণেই আমাদের কবিরা বলেছেন : “ হেলেনীয়গণ বর্বরদের উপর প্রভুত্ব করবে, এটাই স্বাভাবিক’। কবিরা এখানে দাস এবং বর্বর—উভয়ের প্রকৃতিকে এক বলে গণ্য করেছেন।

    এবার পরিবারের গঠনের কথায় আসা যাক। নারী এবং দাসদের কথা আমরা বলেছি। নারী, এবং দাস, এবং পুরুষ—এই তিনের সমন্বয় বা মিলন যখন সংঘটিত হল, প্ৰথম পরিবার তখন সৃষ্ট হল। এবং এ কারণে কবি হিসিয়ড যখন বলেন : ‘প্রথমে প্রয়োজনে একটি গৃহের এবং স্ত্রীর এবং লাঙ্গলটাকে টানার জন্য একটা বলদের’ তখন তিনি সত্য কথাই বলেন। এখানে বলদই হচ্ছে দরিদ্র কৃষকের দাস। প্রকৃতির বিধানের ভিত্তিতে মানুষের এই সম্মিলন যখন কালের বুকে স্থায়িত্ব পেতে থাকে তখন পরিবারের উদ্ভব ঘটে। আইনদাতা চারোন্দাজ এই গৃহ কিংবা পরিবারের সদস্যদের ‘আহারের সঙ্গী’ বলে অভিহিত করেছেন। ক্রিটের এপিমিনাইডিস এদের বলেছেন, নির্ভরযোগ্য সঙ্গী। এর পরবর্তী স্তর হচ্ছে গ্রামের স্তর। প্রতিদিনকার প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে একাধিক পরিবারের যখন সম্মিলন ঘটল তখন সৃষ্টি হল গ্রামের। প্রকৃতির নিয়মেই এই বিকাশ সাধিত হয়। পরিবারের পুত্র পৌত্রগণ যখন সংখ্যায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে তাদের মূল পরিবারকে অতিক্রম করে নতুন পরিবারের পত্তন করে তখন এরূপ গ্রামের উদ্ভব ঘটে। এরূপ গ্রামের সদস্যদের এজন্য অনেকে একই স্তন্যের সন্তান বলে অভিহিত করেন। গঠনের এই বৈশিষ্ট্যের কারণে অতীতে গ্রামের শাসনব্যবস্থা অনিবার্যরূপে ছিল রাজকীয়। নগররাষ্ট্রগুলিও গোড়ার দিকে রাজকীয় শাসনের অধীন ছিল। কারণ পরিবারের শাসক হচ্ছে পরিবারের প্রধান। পরিবারের প্রধান রাজার মতোই পরিবারকে শাসন করে। আবার পরিবারের শাখা-প্রশাখাগুলিও রক্তের সম্পর্কের কারণে একইরূপে শাসিত হয়। হোমারের মধ্যে এই পিতৃতান্ত্রিক শাসনের উল্লেখ পাওয়া যায়। হোমার বলেছেন : ‘সন্তান এবং স্ত্রীর উপর কর্তৃত্ব হচ্ছে পুরুষের।’ কিন্তু হোমার এখানে পরস্পর বিচ্ছিন্ন পরিবারের উল্লেখ করেছেন। একাধিক পরিবার-সমন্বিত গ্রামের নয়। কারণ, আদিম অবস্থায় মানুষের সংগঠনের প্রধান রূপ ছিল বিচ্ছিন্ন জনবসতির রূপ। এই কারণে দেবতাদের রাজ্যেও রাজকীয় শাসনের কথাই মানুষ কল্পনা করেছে। রাজার শাসন মানুষের মধ্যে এখনো যে অবশিষ্ট নেই, তা নয়। এখনো অনেক মানুষ রাজার শাসনে শাসিত। মানুষ মনে করে দেবতাদের আকার মানুষের মত। সুতরাং তাদের জীবন-প্রণালীও মানুষের মত।

    কিন্তু সর্বোচ্চ বা চরম সংস্থা হচ্ছে নগর বা রাষ্ট্র। একাধিক গ্রামের সম্মিলনে গঠিত হয় রাষ্ট্র। বিকাশের যে ধারার আমরা বর্ণনা করেছি তাতে বলা চলে, রাষ্ট্রে এই বিকাশের সমাপ্তি ঘটেছে। স্বয়ংসম্পূর্ণতার বৈশিষ্ট্য এবার অর্জিত হয়েছে। এর সূচনা ঘটেছিল জীবনধারণের উপায় হিসাবে। কিন্তু কেবল জীবন-ধারণ নয়, মানুষ এবার রাষ্ট্র-মধ্যে উত্তম জীবন-যাপন করার ক্ষমতা অর্জন করেছে। কাজেই আমরা বলতে পারি, প্রকৃতিগতভাবে যে সকল সংস্থা থেকে রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে, রাষ্ট্র তাদের মতোই প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক। পূর্ববর্তী সকল সংগঠনের পরিণতি হচ্ছে রাষ্ট্র এবং তাদের স্বভাব হচ্ছে রাষ্ট্রের রূপ গ্রহণ করা। এদের লক্ষ্যে হচ্ছে রাষ্ট্রের পরিণতি লাভ করা। এদের লক্ষ্যই হচ্ছে এদের স্বভাব। কারণ, কোন কিছুর স্বভাব বলতে আমরা কি বুঝি? কোন কিছুর স্বভাব বা প্রকৃতি বলতে আমরা তার চরম পরিণাম বা বিকাশ বুঝি। মানুষ কিংবা পরিবার কিংবা অপর যা কিছুই হোক না কেন, এদের চরম বিকাশই হচ্ছে এদের স্বভাব। এবং চরম বিকাশ বা লক্ষ্য অবশ্যই চরম উত্তম। সেদিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণতা মানুষের স্বভাবের যেমন লক্ষ্য, তেমনি তা চরম উত্তম।

    আমাদের পূর্বের বক্তব্যের অনুসিদ্ধান্ত হচ্ছে এই যে, রাষ্ট্র শ্রেণী বা প্রকারগতভাবে সেই বস্তুরই অন্তর্গত যার প্রাকৃতিক সত্তা রয়েছে এবং মানুষ প্রকৃতিগতভাবে রাষ্ট্রনৈতিক প্রাণী। মানুষের স্বভাব হচ্ছে রাষ্ট্রে বাস করা। এমন মানুষ যদি পাওয়া যায়, যে কোন দুর্ভাগ্যের কারণে নয়, বরঞ্চ স্বভাবগতভাবে রাষ্ট্রহীন, অর্থাৎ তার বাস করার জন্য কোন রাষ্ট্র নাই, তাহলে আমরা সে মানুষকে হয় অধমের অধম, নয়ত উত্তমের উত্তম, অমানুষ কিংবা অতিমানুষ বলে গণ্য করব। মানুষের অধম হলে সে হবে হোমারের ভাষায় পরিবারহীন, নীতিহীন এবং গৃহহীন যুদ্ধোন্মাদ এবং অভিশপ্ত। কারণ, এমন মানুষ স্বভাবগতভাবে রণোন্মাদ। দাবার ছকে সে হচ্ছে বিচ্ছিন্ন এক খুঁটি। কারুর সঙ্গে তার সহযোগিতার কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে মানুষ যে কেবল সহযোগিতার প্রাণী, তা নয়। মানুষ রাজনৈতিক প্রাণী। কারণ, মানুষ এর অধিক অর্থে রাষ্ট্রনৈতিক প্রাণী। আমরা জানি, প্রকৃতির কোন কাজ নিরর্থক নয়। এবং প্রকৃতি সকল প্রাণীর মধ্যে মানুষকেই মাত্র যুক্তির শক্তিতে সমৃদ্ধ করেছে তাকে রাষ্ট্রনৈতিক প্রাণী হিসাবে বিশিষ্ট করার জন্য। মানুষের যুক্তি আছে এবং ভাষা আছে। ভাষা এবং বাস্ফূর্তির মধ্যে পার্থক্য আছে। বাস্ফূর্তি সকল পশুরই আছে। তাদের আনন্দ এবং বেদনা প্রকাশের জন্য তারা তাদের বাক্শক্তি ব্যবহার করে। বস্তুত এমন অনেক পশু আছে যারা কেবল যে বাক্শক্তির মারফত আনন্দ এবং বেদনাকে প্রকাশ করতে পারে, তাই নয়। তারা তাদের এ বোধ পরস্পরের মধ্যে বিনিময় করতেও সক্ষম। কিন্তু ভাষার ক্ষমতা ভিন্নতর এবং অধিকতর। মানুষের ভাষা বুঝাতে পারে কি মঙ্গলকর এবং কি অমঙ্গলকর। ভাষা বুঝাতে পারে, কোন্টা ন্যায়, কোটা অন্যায়। মানুষ এবং পশুর যথার্থ পার্থক্য এখানে। মানুষেরই মাত্র খারাপ এবং ভাল, ঠিক এবং বেঠিক, ন্যায় এবং অন্যায়ের বোধ আছে। এবং এই বোধের পারস্পরিক বিনিময়ই সৃষ্টি করে পরিবার এবং রাষ্ট্র।

    তাছাড়া রাষ্ট্র যে কেবল পরিণাম, তা নয়। পরিবার এবং ব্যক্তির পূর্বগামীও হচ্ছে রাষ্ট্র। কারণ, সমগ্র হচ্ছে অংশের পুরোগামী। সমগ্রের মধ্যেই অংশের অস্তিত্ব। দেহ থেকে হাত কিংবা পা বিচ্ছিন্ন করলে যথার্থভাবে সে আর হাত কিংবা পা থাকে না। তখন সে নামে মাত্র হাত কিংবা পা। যেমন পাথর কেটেও আমরা হাত কিংবা পা তৈরি করতে পারি। কিন্তু যে কর্মের ভিত্তিতে হাত এবং পা, হাত এবং পা বলে স্বীকৃত, দেহবিচ্ছিন্ন কিংবা পাথুরে হাতের সে কর্মক্ষমতা নাই। কাজেই এমন অবস্থায় একই শব্দের ব্যবহার করলেও আমরা বলতে পারিনে যে, আমরা একই বস্তু সম্পর্কে কথা বলছি। কাজেই এটা স্পষ্ট যে, রাষ্ট্র যেমন স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক তেমনি সে ব্যক্তির পুরোগামী। কারণ, রাষ্ট্রের বাইরে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যক্তির স্বয়ংসম্পূর্ণতা যখন আর রক্ষিত হতে পারে না তখন সমগ্রের সঙ্গে অংশের যে সম্পর্ক বিদ্যমান, রাষ্ট্রের সঙ্গেও অংশরূপে ব্যক্তির সেই সম্পর্ক বিদ্যমান। আর এ কারণে যে সংস্থাকে আমরা রাষ্ট্র বলেছি তার গঠনে মূলত পশুর ন্যায় যে অংশগ্রহণে অক্ষম কিংবা দেবতার মতো যার রাষ্ট্রের কোন প্রয়োজনীয়তা নাই, যে পরিপূর্ণরূপে স্বয়ম্ভর, সে রাষ্ট্রের আদৌ অংশ নয়। আমরা বলব, সকল মানুষের মধ্যেই রাষ্ট্রের এই অংশীদারিত্বের একটি স্বাভাবিক আবেগ বিদ্যমান। এবং যে ব্যক্তি প্রথম রাষ্ট্রকে গঠন করেছে সে অবশ্যই মানবজাতির প্রভূত উপকার সাধন করেছে এবং এজন্য সে কৃতিত্বের দাবীদার। কারণ, প্রাণী হিসাবে বিকাশের চরমে মানুষ যেমন সর্বশ্রেষ্ঠ, তেমনি আইন ও নীতিহীন অবস্থাতে সে সবচাইতে অধম। সশস্ত্র বর্বরতার মোকাবেলা করা সবচাইতে কঠিন। জন্ম থেকে মানুষ বুদ্ধিমান। বুদ্ধি তার অস্ত্র। কিন্তু একে যেমন সে ন্যায়ের পক্ষে ব্যবহার করতে পারে, তেমনি তাকে ব্যবহার করতে পারে সর্বাধিক অন্যায় সাধন করার জন্য। ন্যায় এং উত্তমের বোধশূন্য মানুষ দানবের অধিক। সে বর্বরের অধম। সে চরম অন্যায়কারী, সে যৌন আচরণে বল্গাহীন। সে ভোজনে উদরসর্বস্ব। কাজেই রাষ্ট্রে ন্যায় আবশ্যক। কারণ, রাষ্ট্রনৈতিক সহযোগিতা ন্যায়ের ভিত্তিতেই মাত্র সম্ভব। ন্যায়ের ভিত্তিতে আমরা করণীয় এবং অকরণীয় নির্দিষ্ট করতে পারি।

    তৃতীয় অধ্যায় – প্রভু এবং দাসের সম্পর্ক : দাসত্বের সংজ্ঞা

    রাষ্ট্রের উপাদানসমূহ কি, তা আমরা ব্যাখ্যা করেছি। এবং পরিবার এই উপাদানেরই অন্তর্গত। এবার তাহলে পরিবারের অর্থনীতি নিয়ে আমাদের আলোচনা শুরু করা আবশ্যক। এ বিষয়টিকে অবশ্য আমরা এর অংশের মধ্যে বিভক্ত করতে পারি। একথা বলা যায়, একটি সম্পূর্ণ পরিবার দুটি অংশ দিয়ে তৈরি। একটি হচ্ছে পরিবারের স্বাধীন সদস্য এবং অপরটি দাস। কিন্তু যে বিশ্লেষণী পদ্ধতি আমরা অনুসরণ করছি, সে পদ্ধতি অনুযায়ী একটি সমগ্রের ক্ষুদ্রতম অংশকেও আমাদের পরীক্ষা করা কর্তব্য। একটি পরিবারের ক্ষুদ্রতম উপাদান হিসাবে তিনটি সম্পর্কের আমরা সাক্ষাৎ পাই। এদের একটি হচ্ছে প্রভু এবং দাসের সম্পর্ক; অপরটি স্বামী এবং স্ত্রীর সম্পর্ক। তৃতীয়টি পিতা এবং সন্তানের সম্পর্ক। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, এই তিনটি সম্পর্কের কোনটির বৈশিষ্ট্য কি? এক্ষেত্রে আমরা দেখি, প্রথম সম্পর্কটিকে স্বৈরতান্ত্রিক বলে অভিহিত করা হয়। বাকি দুটির একটিকে আমরা বলতে পারি ‘বৈবাহিক’ এবং অপরটিকে ‘পিতৃগত’। এর অধিক নির্দিষ্ট কোন শব্দ আমাদের হাতে নেই, যা দিয়ে এই সম্পর্ক আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি। পরিবারের এই তিনটি উপাদান, অর্থাৎ প্রভু-দাস, স্বামী-স্ত্রী এবং পিতা-সন্তান, অবশ্য স্বীকার্য। কিন্তু চতুর্থ অপর একটি উপাদানকেও আমরা অস্বীকার করতে পারি নে। কারণ এটি যে কেবল গুরুত্বপূর্ণ তাই নয়। এটিকেই অনেকে পরিবারের প্রধান উপাদান বলে গণ্য করেন। আমি পরিবারের অর্থনীতিক কার্যক্রমের উল্লেখ করতে চাচ্ছি। এই উপাদানটিকে সাধারণত : এই নামেই অভিহিত করা হয়।

    প্রথমে প্রভু এবং দাসের সম্পর্কটি বিচার করে দেখা যাক, পরিবারের ক্ষেত্রে এ সম্পর্ক কোন্ অপরিহার্য প্রয়োজন সাধন করে। যে সমস্ত ধারণার ভিত্তিতে বিষয়টি সাধারণত : আলোচিত হয়, আমাদের কর্তব্য হচ্ছে বিষয়টির সম্যক উপলব্ধির জন্য তার চেয়ে উত্তম কোন উপায়কে নির্দিষ্ট করা। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, অনেকে আছেন যাঁরা মনে করেন, প্রভু হওয়ার জন্য একটা বিশেষ গুণ বা দক্ষতা আবশ্যক। তাঁদের মতে এ দক্ষতা হচ্ছে পরিবার পরিচালনার অনুরূপ দক্ষতা। কিংবা বলা চলে, এ গুণ হচ্ছে রাজনীতিক অথবা রাজা হওয়ার গুণ। কিন্তু এটি একটি ভুল ধারণা। এ বিষয়ে আমরা প্রথমেই উল্লেখ করেছি। আবার অনেকে আছেন যাঁরা মনে করেন, দাসের উপর প্রভুর ন্যায় শাসন করা প্রকৃতি-বিরুদ্ধ। তাঁদের মতে, দাস এবং প্রভুর পার্থক্য একটি কৃত্রিম পার্থক্য। কারণ, প্রকৃতির মধ্যে এরূপ কোন পার্থক্যের অস্তিত্ব নেই। এরূপ শাসনের ভিত্তি হচ্ছে জবরদস্তি। এবং এ কারণে এ শাসন অন্যায়।

    চতুর্থ অধ্যায় – সম্পদ সম্পর্কে : সম্পদের প্রকার

    এবার সম্পদের কথাতে আসা যাক। সম্পদ পরিবার বা গৃহের একটি অংশ। এবং সম্পদের সংগ্রহ পারিবারিক অর্থনীতির একটি অংশ। কারণ জীবন ধারণ বলি কিংবা উত্তম জীবন যাপন বলি, এর কোনটি ন্যূনতম পরিমণ সম্পদ বা অর্থের যোগান ব্যতীত সম্ভব নয়। তাছাড়া যে কোন কার্য সাধনের জন্য উপযুক্ত যন্ত্র বা উপায়ের আবশ্যক। যন্ত্র অবশ্য দু-রকমের হতে পারে : সজীব যন্ত্র এবং অ-জীব যন্ত্র। একটি নৌযানের নাবিক যেমন একটি অ-জীব হালকে ব্যবহার করে, তেমনি তাকে ব্যবহার করতে হয় দিক-নিরীক্ষণকারী সজীব মানুষকে। এ ক্ষেত্রে মানুষও যন্ত্র। কারণ, কোন কিছু উৎপাদনের ক্ষেত্রে একজন মজুরও একটি যন্ত্র বা হাতিয়ার, উৎপাদনের হাতিয়ার। কাজেই সম্পদ বা অর্থের যে কোন উপাদানকেই জীবন যাপনের দিক থেকে যন্ত্র বলা চলে। কারণ, এর মধ্যেমে আমরা জীবন ধারণ করি। আর এদিক থেকে সম্পদ বলতে আমরা জীবন-যাপনের উপায়ের সমষ্টিকে বুঝাব। জীবন-যাপনের উপায়ের সমষ্টির মধ্যে দাসও অন্তর্ভুক্ত। এবং দাস যেহেতু যে কোন ভৃত্যের ন্যায় একজন মানুষ, সে কারণে সে একটি নয়, বরঞ্চ একাধিক যন্ত্রেরই সমান। কারণ, যদি এমন হোত যে, আমাদের যন্ত্রগুলি আমাদের নির্দেশে কিংবা আপন বোধের ভিত্তিতে নিজ নিজ কার্য সম্পাদনে সক্ষম, যেমন সক্ষম ছিল ডিডালাসের* তৈরি প্রস্তরমূর্তিগুলি কিংবা হিপাসটাসের সেই ত্রিপদ সরঞ্জাম যে গুলি স্বয়ং চালিত হয়ে সম্মেলন ক্ষেত্রে উপস্থিত হতে সক্ষম ছিল, অথবা এমন যদি হোত যে আমাদের বস্ত্রবয়নের তাঁতের মাকুগুলি নিজের ইচ্ছাতেই এদিক থেকে ওদিক দৌড়ে যেয়ে কাপড় বোনার কাজটি সমাধা করতে পারত এবং আমাদের বীণার তারগুলির সঞ্চালক নিজে থেকে সঞ্চালিত হয়ে বীণায় ঝঙ্কার তুলতে পারত তাহলে অবশ্যই বস্ত্রবয়নের জন্য আমাদের কোন মজুরের আবশ্যক হোত না এবং প্রভুর কোন দাসেরও প্রয়োজন হোত না।

    [* ডিডালাস – গ্রীক উপাখ্যানে বর্ণিত বিখ্যাত শিল্পী]

    সাধারণ অর্থে একটি যন্ত্র বা হাতিয়ারকে আমরা বলতে পারি উৎপাদনী হাতিয়ার। অন্য কথায় উৎপাদনের হাতিয়ার। হাতিয়ারের আবশ্যক দ্রব্য উৎপাদনের জন্যে। কিন্তু যাকে আমরা বলি সম্পত্তি বা সম্পদ সে উৎপাদিত। অর্থাৎ সে নিজেই প্রয়োজনীয়। কথাটির ব্যাখ্যা আবশ্যক। আমি বলতে চাচ্ছি : একটি মাকু তার নিজের অস্তিত্বের বাইরে অপর একটি বস্তুকে তৈরি করে। কিন্তু একটি তক্তপোষ কিংবা একটি পরিচ্ছদ নিজের অস্তিত্বের বাইরে অপর কোন বস্তু উৎপাদন করে না। আবার উৎপাদন এবং কর্মসম্পাদন—এ দু’য়েরই হাতিয়ার আবশ্যক বটে, তবু এদের মধ্যে যেহেতু একটা চারিত্র্যগত পার্থক্য বিদ্যমান সে কারণে এদের প্রয়োজনীয় হাতিয়ারের মধ্যেও চারিত্র্যগত পার্থক্য রয়েছে। উৎপাদনের উৎপাদনী হাতিয়ার এবং সম্পদের সম্পাদনী হাতিয়ার। এদিক থেকে আমরা জীবনকে কার্য-সম্পাদক বলে বিবেচনা করব, উৎপাদক হিসাবে নয়। এবং দাস আমাদের সম্পদ এই হিসাবে যে, সে কর্মসম্পাদনী হাতিয়ার, উৎপাদনী নয়। আমাদের গৃহের আসবাবপত্রকে আমরা গৃহের অংশ বলে অভিহিত করি। কারণ, যে অংশ সে কেবল কোন কিছুর অংশমাত্র নয়। সে পরিপূর্ণরূপে অপরের অঙ্গীভূত। কাজেই একজন দাস যে কেবল তার প্রভুর দাস, তাই নয়। যে দাস সে পরিপূর্ণরূপেই তার প্রভুর সম্পত্তি। অপর দিকে যে প্রভু সে তার দাসের প্রভু বটে, কিন্তু তাই বলে সে তার দাসের অংশ নয়। অর্থাৎ দাস প্রভুর বটে, কিন্তু প্রভু দাসের নয়।

    এ বিবেচনার ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি, দাসের প্রকৃতি কি এবং কি কর্মসম্পাদনের জন্য সে নির্দিষ্ট হয়েছে। আমরা বলতে পারি : যে-মানুষ প্রকৃতিগতভাবে নিজের প্রভু নয়, অপরে যার প্রভু—অর্থাৎ অপরের মধ্যে যার অস্তিত্ব নিহিত, সে-মানুষ প্রকৃতিগতভাবে একজন দাস। এবং একজন মানুষ যখন অপর একজন মানুষের অস্তিত্বে নিহিত তখন সে গৃহের দ্রব্যসামগ্রীর অন্তর্গত। অন্য কথায় সে একটি যন্ত্র কিংবা হাতিয়ার। হাতিয়ারটির অস্তিত্ব আছে, এ কথা ঠিক। কিন্তু সে অস্তিত্ব জীবন ধারণের উপায় হিসাবে মাত্র।

    পঞ্চম অধ্যায় – প্রকৃতিগতভাবে কে দাস, কে প্ৰভু

    কিন্তু যথার্থই প্রকৃতিগতভাবে কোন মানুষ এরূপ কিনা এবং একজন মানুষ অপর একজন মানুষের দাস, এটি উত্তম এবং ন্যায়সঙ্গত কিনা কিংবা সমস্ত রকম দাসত্বকে প্রকৃতিবিরুদ্ধ বলে আমাদের বিবেচনা করা উচিত—এ প্রশ্নগুলির অবশ্যই আলোচনা আবশ্যক।

    এক্ষেত্রে তত্ত্বগত আলোচনা কিংবা বাস্তব অবস্থার পর্যবেক্ষণে তেমন কোন অসুবিধা নেই। নীতিগতভাবে কেবল এ বক্তব্যে কোন আপত্তি হতে পারে না যে, কারুর আদেশ দান করা উচিত এবং অপর কারুর আদেশ মান্য করা উচিত। এটা যেমন প্রয়োজনীয়, তেমনি সুবিধাজনকও। বস্তুত কতগুলি সৃষ্টি জন্ম থেকেই এভাবে বিভক্ত : এদের এক অংশ শাসনের জন্য, অপর অংশ শাসিত হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট। শাসক শাসিতের এই সম্পর্কটি বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে।* এ ঘটনার সাক্ষাৎ আমরা সর্বত্রই পেতে পারি। যেমন, যেখানেই একাধিকের সংযোগ ঘটে এবং এ সংযোগ ক্রমিক কিংবা ক্রমহীন যাই হোক না কেন এবং যে সংযোগের মাধ্যমে একটি ঐক্যসূত্রের সৃষ্টি হয় সেখানেই শাসক শাসিতের সম্পর্কটির প্রকাশ দেখা যায়। জীবনের প্রকৃতির কারণেই এর উদ্ভব। সজীব প্রাণীর প্রথম সংগঠন হচ্ছে মন এবং দেহের ভিত্তিতে। এখানে প্রথমটি হচ্ছে শাসক, দ্বিতীয়টি শাসিত। যে বিষয় নির্ভর করে তার প্রকৃতিগত বুদ্ধির উপর সে বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্তের ভিত্তি হবে প্রকৃতির স্বভাবের দৃষ্টান্ত, তার ব্যতিক্রম কিংবা বিকারের দৃষ্টান্ত নয়। সুতরাং মন শাসক এবং দেহ শাসিত, একথা বলতেও আমরা নির্ভর করব মানসিক এবং দৈহিকভাবে একজন সুস্থ মানুষের উপর অর্থাৎ যে মানুষের মধ্যে দেহের উপর মনের শাসন সুস্পষ্ট। এর বিপরীত, অর্থাৎ মনের উপর দেহের শাসন সংঘটিত হয় অধম মানুষ কিংবা অধম অবস্থার মানুষের মধ্যে। সে যাই হোক, আমার বক্তব্য হচ্ছে, জীবিত প্রাণীর মধ্যেই শাসনের এই নীতির প্রথম কার্যকারিতার সাক্ষাৎ পাই। বস্তুত দাসের উপর প্রভুর নিরঙ্কুশ শাসন এবং নিয়মগত শাসন—এই উভয় প্রকার শাসনের সাক্ষাৎই জীবিত প্রাণীর মধ্যে পাওয়া যায়। দেহের উপর মনের শাসন হচ্ছে নিরঙ্কুশ বা একচ্ছত্র শাসন এবং প্রবৃত্তির উপর প্রজ্ঞার শাসন হচ্ছে নিয়ম বা বিধানগত শাসন। এ সমস্ত দৃষ্টান্ত থেকে এটি পরিষ্কার যে, দেহের উপর মনের শাসন কিংবা আমাদের স্বভাবের যে অংশে আবেগের প্রাবল্য তার উপর যে অংশে যুক্তির প্রাবল্য তার—অর্থাৎ বুদ্ধির শাসন যেমন স্বাভাবিক তেমনি কল্যাণকর। এর বিপরীত কিংবা দুইয়ের মধ্যে কোন সম অবস্থা বিরজ করলে সর্বোতভাবেই মারাত্মক হত। মানুষ এবং পশুর সম্পর্কের ক্ষেত্রেও কথাটি সত্য। কারণ, দেখা যায় বাধ্য পশু চরিত্রগতভাবে বন্য পশুর চেয়ে উত্তম। এবং তাদের পক্ষে মানুষ দ্বরা শাসিত হওয়াই মঙ্গলকর। কারণ, এ শাসন তাদের নিরাপত্তা প্রদান করে। আবার পুরুষ এবং মেয়ের মধ্যে প্রথমোক্ত প্রকৃতিগতভাবে উত্তম এবং শাসক, দ্বিতীয়োক্ত প্রকৃতিগতভাবে অধম এবং শাসিত। সমগ্র মানবজাতির ক্ষেত্রেই এ কথা সত্য। সুতরাং আমরা বলতে পারি : দুই শ্রেণীর মানুষের মধ্যে যেখানেই মন এবং দেহ কিংবা মানুষ এবং পশুর মধ্যকার ব্যবধানের ন্যায় বিরাট ব্যবধান বিদ্যমান সেখানে দুইয়ের মধ্যে যে অধম অর্থাৎ যাদের সব করণীয় তাদের দেহ ব্যবহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং এর চেয়ে অধিকতর উত্তম যাদের কাছ থেকে আশা করা যায় না তারাই হচ্ছে প্রকৃতিগতভাবে দাস। এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে আমরা যেরূপ বলেছি তেমনি এদের ক্ষেত্রেও শাসিত হওয়াই উত্তম।

    [* অবশ্য শাসনের চরিত্র প্রধানত : নির্ভর করে শাসিতের চরিত্রের উপর। মানুষের উপর শাসন পশুর উপর যে শাসন তার চেয়ে উন্নততর। কারণ, উত্তম মানুষ যা উৎপন্ন করে, কিংবা উত্তম মানুষ থেকে যা উ ৎপাদিত হয় তা একটি উত্তম সৃষ্টি। আর এক্ষেত্রে বলা যায়, শাসক-শাসিতের সম্পর্কটি এই সম্পর্কের মধ্যে বিজড়িত মানুষ থেকেই সৃষ্টি।—এ্যারিস্টটল, দ্র. টি. এ. সিনক্লেয়ার প্রাগু]

    কাজেই ‘প্রকৃতিগত দাস’ হচ্ছে সে, অপরে যার মালিক হতে পারে এবং যার মালিক অপরে এবং যার বুদ্ধি বোধের অধিক নয়। তাদের সেবা বোধশূন্য নিরুদ্যোগ সেবা। ব্যবহৃত হওয়ার ক্ষেত্রেও দাস এবং গৃহপালিত পশুর মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। কারণ, উভয়ের দ্বারাই আমরা আমাদের িৈদহক প্রয়োজন পূরণ করি। এ কারণেই প্রকৃতি স্বাধীন নাগরিকের দেহ দাসের দেহ থেকে পৃথকভাবে গঠন করেছে। এই শেষোক্তর দেহ যেখানে দৈহিক পরিশ্রমের উপযোগীভাবে শক্ত, প্রথমোক্ত সেখানে সেরূপ কাজের অনুপযুক্ত এবং তার দেহ ঋজু। কিন্তু এর দেহ একজন নাগরিকের কাজের জন্য উত্তমরূপেই গঠিত, যুদ্ধ এবং শান্তির মধ্যে যার জীবন বিভক্ত। তবে প্রকৃতির মধ্যে এর ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। কারণ, অনেক সময় এর বিপরীতেরও সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এমন মানুষও দেখা যায়, যার দেহ স্বাধীন মানুষের উপযোগী, কিন্তু তার বুদ্ধি নেই। অপরদিকে আছে, যাদের উপযুক্ত বুদ্ধি আছে কিন্তু দেহ নেই। মোট কথা এটা স্পষ্ট যে, দেহের দিক থেকে যদি কারুর দেবতাদের মতো অতি-মানবিক বিরাট বিপুল দেহ থাকতো তাহলে সাধারণ আকারের অবশিষ্ট মানবজাতি নিশ্চয়ই তার দাস হোত এবং দেহের ক্ষেত্রে যদি একথা সত্য হয়, তাহলে মনের ক্ষেত্রে এ কথাটি অবশ্যই অধিকতর সত্য হবে। অবশ্য দেহের আধিক্যের চেয়ে মনের আধিক্য অধিকতর দুর্লভ। এটা তাহলে পরিষ্কার হল : প্রকৃতিগতভাবে কিছু মানুষ স্বাধীন ও কিছু মানুষ দাস। এবং যারা দাস তাদের জন্য দাসত্ব যেমন ন্যায়সঙ্গত তেমনি কল্যাণকর।

    ষষ্ঠ অধ্যায় – দাস সংগ্রহের উপায়

    অপরদিকে এটিকে অস্বীকার করা যায় না, যাঁরা এ বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন তাঁদের অভিমতেও কিছুটা সত্যতা আছে। ‘দাসত্ব’ এবং ‘দাস’, এই শব্দ দুটির মধ্যে আমরা দুটো অর্থ দেখতে পাই। আমি প্রকৃতিগত দাসত্বের কথা বলেছি। কিন্তু এর বাইরে আইনগত বা প্রথাগত দাসত্বের অস্তিত্বও বিদ্যমান। এর উদ্ভব এরূপ প্রথার মধ্যে যে, যুদ্ধে যা কিছু দখল করা হয় তা সবই দখলকারীর। কিন্তু যারা আইনজ্ঞ তাঁরা এরূপ অধিকারের প্রতিবাদে বলেন : এরূপ অধিকার আইনবিরুদ্ধ। আইন জবরদস্তিকে বাধা দানেরই চেষ্টা করে। তাঁরা বলেন, জবরদস্তির নিকট পরাভূত দুর্বল শক্তিমানের সম্পত্তিতে পর্যবসিত হবে, এরূপ অভিমত গ্রহণের অযোগ্য। আবার অনেকে আছেন যাঁরা বিষয়টিতে কোন অন্যায় আছে বলে মনে করেন না। এ দুটো অভিমতই আইন-বিশেষজ্ঞদের অভিমত। মতামতের এই পার্থক্য এবং পরিবর্তমানতার মূল হচ্ছে উৎকর্ষ বা আধিক্য শব্দটি। এক অর্থে এটা অবশ্য সত্য যে, উত্তমতা কিংবা দক্ষতা যখন আদেশ দানের অবস্থা প্রাপ্ত হয় তখন সেইই সর্বোতভাবে শক্তি প্রয়োগে সক্ষম। এবং যে বিজয়ী সে নিশ্চয়ই তার কোন গুণের উত্তমতার কারণে বিজয়ী। কাজেই শক্তির কোন উত্তমতা নেই, একথা ঠিক নয়। আসলে মূল তর্কটি হচ্ছে, ন্যায় কি, তার ওপর। অর্থাৎ এখানে এক পক্ষ বলছেন : ন্যায়ের অর্থ হচ্ছে মানবতাবোধ। অপর পক্ষ বলছেন : যে অধিকতর শক্তিমান সে শাসন করবে, এটাই হচ্ছে ন্যায়। এখানে কোন আপোস সম্ভব বলে আমি মনে করিনে। এক পক্ষের যুক্তি অপরপক্ষের নিকট বিশ্বাসযোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য বলে বোধ হবে না। ফলে ‘উত্তমেরই শাসনের অধিকার’ বলে আমরা যে নীতিটি গ্রহণ করেছি সেটি আমাদের অস্বীকার করতে হয়।

    অনেকে বলেন, যুদ্ধে বন্দী করার যেহেতু আইন রয়েছে সে কারণে যুদ্ধে দাস করার মধ্যে ন্যায়সঙ্গতাও রয়েছে। অবশ্য এঁরা এ কথাটি যে সব সময়ে বলেন, এমন নয়। কারণ, সূচনাতে যুদ্ধটা তো অন্যায় হতে পারে। আবার যে দাস হবার উপযোগী নয় তার ওপর আমরা ‘দাস’ শব্দটি ব্যবহার করতে পারিনে। তেমন হলে যুদ্ধে বন্দী এবং বিক্রিত অতি উত্তম বংশজাত কোন ব্যক্তি এবং তার সন্তানবর্গকেও আমাদের দাস বলে গণ্য করতে হবে। এ কারণে যুদ্ধের যুক্তির যাঁরা বিরোধী তাঁরা এরূপ লোককে দাস বলে অভিহিত করতে চান না। ‘দাস’ শব্দটি তাঁরা কেবল বর্বরদের উপর প্রয়োগযোগ্য বলে মনে করেন। কিন্তু তাঁদের এরূপ যুক্তির অর্থ হচ্ছে, তাঁরা আসলে প্রথাগত নয়, প্রকৃতিগত দাসত্বেরই একটি সংজ্ঞাদানের চেষ্টা করছেন। আমরাও এই উদ্দেশ্য নিয়ে আমাদের আলোচনা শুরু করেছিলাম। আমাদের প্রধান বক্তব্য ছিল : মানুষের মধ্যে কিছু আছে যারা সর্বত্রই দাস এবং কিছু আছে যারা কোথাও দাস নয়। উত্তম জন্ম বা বংশের ক্ষেত্রেও আমরা একথা বলতে পারি। যারা অভিজাত তারা কেবল স্বগোত্রীয়দের মধ্যে নিজেদেরকে অভিজাত বলে বিবেচনা করে না। সর্বত্রই তারা নিজেদেরকে অভিজাত বলে দাবী করে। কিন্তু অ-গ্রীসীয়দের ক্ষেত্রে এরূপ দাবীর সার্বজনীনতা তারা স্বীকার করে না। অ-গ্রীসীয়গণ কেবল অ-গ্রীসীয়দের মধ্যে অভিজাত হতে পারে। এর ফলে স্বাধীনতা এবং উত্তম জন্ম—উভয়েরই দুটি প্রকার আমাদের নির্দিষ্ট করতে হয় : একটি শর্তহীন, অপরটি শর্তাধীন।* কিন্তু এই শর্ত আরোপের মাধ্যমে এরা আসলে স্বাধীন ব্যক্তি এবং দাস, অভিজাত এবং অনভিজাত—এদের পার্থক্যের ভিত্তি হিসাবে উত্তমতা এবং অধমতাকেই নির্দিষ্ট করতে চান। এঁদের যুক্তি হচ্ছে, মানুষ যেমন মানুষ থেকেই জাত হয়, পশু জাত হয় পশু থেকে, তেমনি উত্তম উত্তম থেকেই জাত হয়। কিন্তু এ সত্যকে প্রকৃতির প্রবণতা বলে যদি আমরা স্বীকার করি তবু একথাও সত্য যে, প্রকৃতির এমন উদ্দেশ্য সব সময়ে বাস্তবায়িত না হতে পারে। তাহলে এটা পরিষ্কার যে, এখানে মতামতের পার্থক্যের অবকাশ আছে। একদিকে যেমন একথা বলা চলে না, কিছু লোক প্রকৃতিগতভাবে দাস এবং কিছু লোক প্রকৃতিগতভাবে স্বাধীন, তেমনি এমন ক্ষেত্র আছে সেখানে দাস এবং স্বাধীন মানুষের মধ্যে যথার্থই পার্থক্য করা হয়, যেখানে কারুর পক্ষে দাস এবং কারুর পক্ষে প্রভু হওয়া যেমন প্রয়োজনীয়, তেমনি ন্যায়সঙ্গত। কারণ, শাসক ও শাসিত হওয়া যেমন প্রকৃতিগত গুণের উপর নির্ভর করে, তেমনি প্রভু এবং দাস হওয়াও প্রকৃতিগত গুণের উপর নির্ভর করে। প্রভু যদি প্রভুর ভূমিকা যথার্থভাবে পালনে অক্ষম হয় তাহলে প্রভু এবং দাস উভয়েরই তাতে ক্ষতি সাধিত হয়। কারণ অংশ এবং সমগ্র, আত্মা এবং দেহ এদের স্বার্থ অভিন্ন। এদিক থেকে দাস প্রভুরই অংশ : দাস প্রভুর দেহের একটি সজীব এবং বিশিষ্ট অংশ। আর এ কারণে, যেখানে প্রকৃতি একজনকে দাস এবং অপরকে প্রভু হিসাবে নির্দিষ্ট করেছে সেখানে উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক হৃদ্যতার সম্পর্ক থাকা উত্তম ফলদায়ক। কিন্তু শক্তি এবং প্রথার মাধ্যমে কাউকে দাস করার যে প্রশ্নটি নিয়ে আমরা আলোচনা করছি সেখানে এ সম্পর্কটি যে থাকতে পারে না, সেটি আমাদের স্বীকার করতে হবে।

    [* থিওডাকটিস রচিত একটি নাটকে চরিত্র হেলেন বলছে : ‘পিতা এবং মাতা উভয়ত : যার বংশধারা দেবতার, সেই আমাকে দাস বলে, এমন স্পর্ধা কার?’—এ্যারিস্টটল]

    সপ্তম অধ্যায় – দাসের উপর প্রভুর শাসন

    তাহলে এ আলোচনা থেকে এ কথাটি পরিষ্কার হচ্ছে, দাসের উপর প্রভুর শাসন এবং রাজনৈতিক শাসন—এ দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। সকল শাসন এক নয়। প্রকৃতিগতভাবেই দাসের শাসন থেকে স্বাধীন নাগরিকের উপর শাসন ভিন্নতর। গৃহের শাসনকে আমরা বলতে পারি রাজকীয় শাসন। কারণ গৃহের শাসনকর্তা একজন। রাষ্ট্রের শাসন হচ্ছে স্বাধীন এবং সমর্যাদাসম্পন্ন নাগরিকদের উপর শাসন। আমরা কাউকে প্রভু বলি সে জ্ঞানী বলে নয়। সে প্রভু বলেই তাকে আমরা প্রভু বলে অভিহিত করি। এ কথা দাস এবং স্বাধীন মানুষের ক্ষেত্রেও সত্য। এ কথা বলার অর্থ এই নয় যে, প্রভুর জ্ঞান বা দাসের জ্ঞান বলে কিছু নেই। এ কথা আমরা সাইরাকুসের এক অধিবাসীর দৃষ্টান্ত দিয়েও বুঝাতে পারি। এ ব্যক্তি অর্থের বিনিময়ে গৃহভৃত্যকে তাদের কর্তব্য সম্পর্কে শিক্ষা দান করত। এরূপ শিক্ষাদানের কথা আমরা রন্ধন প্রণালী এবং গৃহের অন্যান্য কার্যের ক্ষেত্রেও চিন্তা করতে পারি। কারণ গৃহের প্রয়োজনীয় কাজ অনেক। এর মধ্যে কোন কাজ কেবল দৈহিক। আবার কোন কাজের মর্যাদা এর অধিক। প্রবাদেও বলে, ভৃত্যকে ভৃত্য হতে হবে, প্রভুকে প্রভু। কথাটির অর্থ হচ্ছে : দক্ষতার ক্ষেত্রে ভৃত্য যেমন ভৃত্য থেকে পৃথক হতে পারে, প্রভুও প্রভু থেকে পৃথক হতে পারে। ভৃত্য বা দাসের জ্ঞানের কথা ছেড়ে দিয়ে আমরা যদি প্রভুর জ্ঞানের কথা বলি তাহলে দেখব, প্রভু হিসাবে প্রভুর জ্ঞান নির্ভর করে তার দাসকে ব্যবহার করার দক্ষতার উপর। সে দাসের প্রভু কেবল দাস সংগ্রহ করার কারণে নয়, সে দাসের প্রভু দাসকে ব্যবহারের কারণে। তবে দাসকে ব্যবহার করার জ্ঞান যে খুব গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান, এমন আমরা মনে করিনে। এ জ্ঞানের যে বড় রকমের কোন মর্যাদা আছে এমনও নয়। কারণ, দাস পরিচালনার জ্ঞানের অর্থ হচ্ছে দাসের যা করণীয় সে করণীয়ের ক্ষেত্রে দাসের উপর নির্দেশ দান। আর তাই যে প্রভু সঙ্গতিসম্পন্ন সে দাসের এরূপ পরিচালনার জন্য কর্মচারী নিযুক্ত করে নিজে রাষ্ট্রনীতি বা দর্শনের বিষয়ে নিজেকে নিয়োজিত রাখে। অবশ্য দাস সংগ্রহ করার ব্যাপার এ থেকে ভিন্ন। দাস সংগ্রহের আদি এবং যথার্থ পদ্ধতি ছিল লুণ্ঠন এবং শিকার।

    অষ্টম অধ্যায় – সম্পদ সংগ্রহের উপায়

    দাস হচ্ছে গৃহের সম্পদ বা সম্পত্তির অংশ। তাই যদি হয় তাহলে দাসের আলোচনা শেষ করে আমরা এই সম্পত্তি সংগ্রহ এবং অর্থ উপার্জনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারি। এ আলোচনাতেও আমরা আমাদের নির্ধারিত বিশ্লেষণের পদ্ধতি অনুসরণ করব। এ ক্ষেত্রে প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে : অর্থোপার্জনকে আমরা কি বলব? অর্থোপার্জন কি গৃহ ব্যবস্থাপনার সমতুল্য, অথবা অর্থোপার্জন গৃহব্যবস্থাপনার একটি অংশ এবং গৃহের একটি আনুষঙ্গিক মাত্র। অর্থাৎ গৃহ বা পরিবারের দিক থেকে এ মুখ্য কিংবা গৌণ? এবং যদি গৌণ হয় তাহলে এর গৌণতা কি বস্ত্রবয়নের ক্ষেত্রে মাকু তৈরি কিংবা ভাস্করের মূর্তি তৈরির ক্ষেত্রে ধাতব খণ্ডের যে গৌনতা তার সমতুল্য? কারণ, এ উভয় গৌণতাকে আমরা এক বলতে পারিনে। একটি যেখানে উৎপাদনের যন্ত্র, অপরটি সেখানে উপকরণ। উপকরণ, কারণ পশম থেকে যেমন বয়নকারী বস্ত্রবয়ন করে, ধাতব খণ্ড থেকে তেমনি ভাস্কর মূর্তি গঠন করে। এখানে এটা পরিষ্কার যে গৃহের ব্যবস্থাপনা এবং অর্থোপার্জন এক নয়। কারণ একটির কাজ যেখানে উপকরণের সরবরাহ, অপরটির কাজ সেখানে উপকরণের ব্যবহার। গৃহ ব্যবস্থাপনা মানে হচ্ছে গৃহের অন্তর্গত উপকরণের ব্যবহার। কিন্তু অর্থোপার্জনকে আমরা গৃহব্যবস্থাপনার অংশ বলব, না তাকে একটি ভিন্নতর কর্ম, অর্থাৎ কোন্ উপায়ে সম্পদ এবং অর্থ সংগৃহীত হতে পারে তা অনুসন্ধান করে দেখার ন্যায় কর্ম বলে অভিহিত করব—এ প্রশ্ন তর্ক সাপেক্ষ।

    এখানে অসুবিধা হচ্ছে এই যে, সম্পদ এবং অর্থ—এই পদগুলি সাধারণত খুব ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। এ কারণে এখানে প্রথম প্রশ্ন এই হতে পারে, কৃষিকার্যকে কি বলা হবে? কৃষিকার্য কি সম্পদ ব্যবস্থাপনার একটি অংশ, অথবা এ ভিন্নপ্রকৃতির এমন একটি কাজ যে কাজে কৃষি বলতে শস্য সংগ্রহ এবং সংরক্ষণ, উভয়ই অন্তর্ভুক্ত হবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও প্রশ্ন থাকে, শস্য সংগ্রহের উপায় তো বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। আর এ উপায়ের সঙ্গে জড়িত আছে বিভিন্ন প্রকার জীবন ধারণ। মানুষের জীবন ধারণ এবং পশুর জীবন ধারণ। আর খাদ্য ব্যতীত যেখানে জীবন সম্ভব নয়, সেখানে খাদ্যের প্রকারের ভিত্তিতে জীবনেরও প্রকার নির্দিষ্ট হয়। খাদ্যের রকমভেদের কারণে কোন জাতীয় পশু দলবদ্ধভাবে বাস করে। কোন জাতীয় পশু বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করে। কোন পশু মাংসাশী। কোন পশু তৃণভোজী। আবার কতগুলো আছে যারা সর্বভূক। আর তাই এরা সকলেই যার যে খাদ্য তা যেন পেতে পারে সে উদ্দেশ্যে প্রকৃতি এদের জীবনধারণ প্রণালীতে বিভিন্নতা প্রদান করেছে। আবার পশুদের মধ্যে খাদ্যের রুচিতেও ভিন্নতা আছে। এ কারণে মাংসাশীদের মধ্যে যেমন, তৃণভোজীদের মধ্যেও তেমন জীবনপ্রণালীর ভিন্নতা দেখা যায়। মানুষের ক্ষেত্রেও একথা সত্য। মানুষের মধ্যেও বিভিন্নপ্রকার জীবন প্রণালী আছে। প্ৰথমে যাযাবরদের কথা ধরা যাক। এদের প্রায় কোন কাজ করার আবশ্যক হয় না। কারণ পোষণ করা পশুদের কাছ থেকে খুব সহজে এবং খুব কম পরিশ্রমে এরা জীবন ধারণের খাদ্য লাভ করতে পারে। কিন্তু পশুদের যখন নতুন চারণভূমিতে নিয়ে যেতে হয় তখন মানুষকেও তাদের সঙ্গে যেতে হয়। ফলে এটা একটা চলন্ত চারণভূমির আকার ধারণ করে। এর পরে শিকারী কিংবা যারা জীবন ধারণ করে কোন কিছু ধরে খাওয়ার উপর, তাদের কথা বলা যায়। এদের মধ্যে কেউ ডাকাত বা লুণ্ঠনকারী, কেউ মৎস্য শিকারী। মৎস্যজীবীদের বাস করতে হয় কোন হ্রদ, জলখণ্ড, নদী বা মৎস্যধারী সমুদ্রভাগে। আবার কেউ আছে যারা বনের পাখী বা পশুর উপর জীবন নির্বাহ করে। মানুষের মধ্যে তৃতীয় দলই বৃহত্তম। এরা মাটিতে শস্যের চাষ করে জীবন ধারণ করে।

    জীবন ধারণের এগুলিই হচ্ছে প্রধান উপায়। এগুলি হচ্ছে সয়ম্ভর বা স্বনির্ভর উপায়। এরা ব্যবসায় বা বিনিময় পদ্ধতি নয়। কাজেই এদের মধ্যে আমরা পাই যাযাবর, কৃষিজীবী, লুণ্ঠনজীবী, মৎস্যজীবী, এবং শিকারী। অনেকে এ সমস্ত উপায়ের একাধিককে যুক্ত করে একটির অপূর্ণতা অপরটির দ্বারা পূরণ করে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করে। যেমন যাযাবরগণ অনেক সময়ে জলদস্যু বা লুণ্ঠনকারী হয় এবং কৃষিজীবীরা শিকারী হয়। এদের জীবন ধারণ কেবল প্রয়োজন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এরূপ স্বয়ম্ভরভাবে জীবন ধারণের উপায় প্রকৃতি সকল প্রাণীকেই দিয়েছে। যেমন অনেক পশু দেখা যায় যারা সন্তান সৃষ্টির সময়েই সন্তানের জন্য এমন খাদ্যের ব্যবস্থা করে, যাতে সন্তান বড় হয়ে নিজের খাদ্য সংগ্ৰহ না করা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। গুটি বা ডিম্ব আকারে যে সমস্ত প্রাণীর সৃষ্টি তাদের দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করা যায়। এমন কি জীবন্ত সন্তান যারা জন্ম দেয় তাদের মধ্যেও বেশ কিছুকাল জীবন ধারণের উপযোগী খাদ্যের ব্যবস্থা থাকে। জননীর দুগ্ধ এরূপ খাদ্য। আবার সন্তান বড় হলেও তার খাদ্যের ব্যবস্থা রয়েছে। এদিক থেকেই আমরা বলতে পারি,

    তৃণের অস্তিত্ব যেমন পশুর জন্য, পশুর অস্তিত্ব তেমনি মানুষের জন্যে। পোষমানা পশুকে যেমন মানুষ খাদ্য হিসাবে, তেমনি অপরাপর উদ্দেশ্যেও ব্যবহার করতে পারে। বন্য পশুর সবগুলি না হলেও অনেকগুলিকে মানুষ খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করতে পারে। এদের অন্য ব্যবহারও আছে। কারণ মানুষ এদের দেহ থেকে নিজের পরিচ্ছদ এবং প্রয়োজনীয় হাতিয়ার তৈয়ার করতে পারে। সুতরাং আমাদের এ কথা যদি ঠিক হয় যে, প্রকৃতির কোন সৃষ্টিই উদ্দেশ্যহীন নয়, কারণশূন্য নয়, তাহলে এ কথা আমরা বলতে পারি, প্রকৃতি যা কিছু তৈরি করেছে তা সে নির্দিষ্টরূপে মানুষের জন্যই করেছে। এ কথার অর্থ, যুদ্ধ এবং শিকার, জীবনের সম্পদ সংগ্রহেরই প্রকৃতি নির্ধারিত একটি উপায়। আর এ কারণে, এ উপায় যেমন ব্যবহৃত হবে পশুর উপর, তেমনি সে ধরনের মানুষেরও উপর, যারা প্রকৃতি দ্বারা শাসিত হওয়ার জন্য সৃষ্ট হলেও শাসিত হতে অস্বীকার করে। প্রকৃতি নির্দিষ্ট ন্যায্য যুদ্ধ আমরা একেই বলব।

    [ জীবন ধারণের একটি উপায় হিসেবে লুণ্ঠন এবং যুদ্ধের মাধ্যমে দাস সংগ্রহকে এ্যারিস্টটল এভাবে প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক বলে যুক্তি দেওয়ার প্রয়াস পাচ্ছেন। ]

    সম্পদ সংগ্ৰহ তথা জীবিকা অর্জনের এ উপায়কে তাই আমরা প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতিময় বলে বিবেচনা করব। এবং এ কারণে একে আমরা আর্থিক ব্যবস্থাপনার অংশ বলে গণ্য করব। জীবন ধারণের জন্য দ্রব্য সামগ্রীর আবশ্যক। এ জন্য শুরুতেই এর কিছু সঞ্চয় থাকতে হবে কিংবা সংগ্রহের এই উপায়গুলির মাধ্যমে আমাদের তা লাভ করতে হবে। এ দ্রব্যগুলিকে যেমন সংরক্ষণযোগ্য হতে হবে, তেমনি জীবন ধারণের জন্য এগুলির উপযোগিতা থাকতে হবে। এ কথা একটি পরিবার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে যেমন সত্য, রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও তেমনি সত্য। এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যথার্থ অর্থে সম্পদ আমরা একেই বলব। কারণ একটি উত্তম জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক স্বাচ্ছল্য যে পরিমাণ সম্পদ আমাদের দিতে পারে তার পরিমাণ নিশ্চয়ই সীমাহীন নয়। সালোন* অবশ্য তাঁর একটি কবিতায় বলেছেন, সম্পদের কোন সীমা নেই। কিন্তু নিশ্চয়ই তার একটি সীমা আছে। কারণ, অর্থ বা সম্পদ একটি উপায় বা মাধ্যম। যে কোন কার্যের একটি হাতিয়ার বা মাধ্যমের আকার ও সংখ্যার ক্ষেত্রে একটা সীমা থাকে। এই সীমার বাইরে তার উপযোগিতা বিনষ্ট হয়। অর্থ বা সম্পদও একটি পরিবার বা রাষ্ট্রব্যবস্থার হাতিয়ার বা মাধ্যম। কাজেই আমরা বলতে পারি, এক প্রকার সম্পদ সংগ্রহ আছে যার ব্যবস্থা করা একটি পরিবার বা একটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব-প্রাপ্ত-ব্যক্তির স্বাভাবিক কর্তব্য। এবং এর কারণ কি তাও এখন আমাদের নিকট পরিষ্কার।

    [* সলোন (৬৫০-৫৫৯ খ্রি. পূ.) : প্রাচীন এথেন্সের রাষ্ট্রনেতা এবং আইনদাতা। অভিজাত এবং সাধারণ নাগরিকদের বিরোধ নিরসনে এবং এথেন্সের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিধানের প্রগতিমূলক সংস্কার সাধনে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন।]

    [ এ্যারিস্টটলের অভিমত : অর্থের জন্য অর্থ নয়। অর্থ বা সম্পদ আমরা সংগ্রহ করব জীবন ধারণের জন্য। এ্যারিস্টটল এর পর ‘অর্থ-সংগ্রহ’ কথাটিই ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এই ‘অর্থ’ দ্বারা তিনি সীমাহীন সম্পদ সংগ্রহের সেই প্রবণতাকে বুঝাচ্ছেন যাকে তিনি উত্তম বা বাঞ্ছনীয় বলে মনে করেন না। অবশ্য আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, ‘অর্থ” শব্দের এরূপ অভিধাও সর্বদা রক্ষিত হয় নি। এ্যারিস্টটলের মতে সীমাহীন অর্থকে আমরা গৃহ কিংবা রাষ্ট্রের অপরিহার্য উপাদান বলে গণ্য করতে পারিনে। ]

    নবম অধ্যায় – অর্থনীতির বিবর্তন : বিনিময় থেকে মুদ্রা

    কিন্তু সম্পদ সংগ্রহের আর একটি ধরন আছে যাকে সাধারণত এবং যথার্থভাবেই অর্থসংগ্রহ বা অর্থোপার্জন বলে অভিহিত করা হয়। সম্পদ সংগ্রহের এই ক্ষেত্রের যুক্তিতেই মনে করা হয়, অর্থোপার্জনের কোন সীমা নেই। সম্পদ সংগ্রহের যে ধরন নিয়ে আমরা এইমাত্র আলোচনা করেছি তার সঙ্গে অর্থোপার্জনের নিকট-সাদৃশ্যের কারণে অনেকে মনে করেন যে, সম্পদ সংগ্রহ এবং অর্থ সংগ্রহ এক এবং অভিন্ন। অথচ এরা অভিন্ন নয়। অবশ্য একথা সত্য, এরা খুব ভিন্ন নয়। কিন্তু এদের একটি যেখানে স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক, অপরটি সেখানে স্বাভাবিক নয়। এই দ্বিতীয় ধরনের সম্পদ সংগ্রহ মানুষের জন্য প্রকৃতিদত্ত নয়। এটা মানুষের অর্জন করতে হয় ক্রম প্রচেষ্টার দ্বারা। এর আলোচনাটি আমরা এভাবে শুরু করতে পারি : প্রত্যেকটি দ্রব্য বা সম্পদের দু’রকমের ব্যবহার আছে। দুটো ব্যবহারই দ্রব্যটির ব্যবহার বটে। কিন্তু ব্যবহার দুটি এক রকম নয়। কেননা এর একটি ব্যবহার যেখানে যথার্থ ব্যবহার, অপরটি সেখানে যথার্থ ব্যবহার নয়। দৃষ্টান্ত হিসাবে এক জোড়া পাদুকার কথা ধরা যাক। এক জোড়া পাদুকা বিনিময় হিসাবে ব্যবহার করে অপর কোন দ্রব্য আমরা সংগ্রহ করতে পারি। এখানে উভয় ব্যবহারই পাদুকার ব্যবহার। কারণ, যে এক জোড়া পাদুকা অপর কাউকে, যার প্রয়োজন,—তাকে প্রদান করে বিনিময়ে নগদ টাকা কিংবা খাদ্য সংগ্রহ করে, সেও পাদুকাকে পাদুকা হিসাবে ব্যবহার করছে। তবু পাদুকার এই ব্যবহারটি যথার্থ নয়। কারণ, পাদুকা আমরা তৈরি করি স্পষ্টত পরিধানের জন্য, বিনিময়ের জন্য নয়। অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রীর ক্ষেত্রেও একথা সত্য। বিনিময়ের প্রক্রিয়াটি যে কোন দ্রব্যের উপরই প্রয়োগ করা চলে। আর এর সূচনা ঘটেছে বাস্তব সেই অবস্থার মধ্যে যেখানে একের নিকট যখন দ্রব্য সামগ্রী রয়েছে তার প্রয়োজনের অধিক, অপরের তখন সেগুলি প্রয়োজনীয় পরিমাণে নেই। কিন্তু এখানে স্বাভাবিক হচ্ছে, বিনিময়ের ব্যবহার প্রয়োজনকে অতিক্রম করবে না। দ্রব্যের অভাব পূরণের জন্যই বিনিময়কে ব্যবহার করা হবে। এটা পরিষ্কার থাকা উচিত, বিনিময় এবং ক্রয়-বিক্রয় এক ব্যাপার নয়। ক্রয়-বিক্রয় বিনিময় থেকে ভিন্ন এবং ক্রয়-বিক্রয় প্রকৃতির ব্যাপার নয়। কারণ, সংগঠনের আদিরূপ হচ্চে পরিবার। পরিবারের মধ্যে দ্রব্যের বিনিময়ের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। বিনিময়ের উদ্ভব ঘটেছে কেবল মাত্র তখন যখন মানুষের সংগঠন বৃহত্তর আকার ধারণ করেছে। একটি পরিবারের সদস্যবর্গ পরিবারের সমগ্র দ্রব্যসামগ্রী যৌথভাবে ভোগ করত। কিন্তু বিভিন্ন পরিবারের সদস্যদের মধ্যে অনেক জিনিসের আদান প্রদান হত। পারস্পরিক প্রয়োজনই এই আদান প্রদানের ভিত্তি ছিল। আর এ কারণেই এখনো আমরা অনেক বিদেশী জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিনিময়ের ব্যবহার দেখতে পাই। বিনিময়ের মানে হচ্ছে প্রয়োজনের ভিত্তিতে এক জিনিষের সঙ্গে অপর জিনিষের আদান প্রদান। যেমন এরা মদ্য এবং শস্য আদান-প্রদান করে। কিন্তু এই সমস্ত বৈদেশিক মানুষ এই প্রক্রিয়াটিকে বিনিময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে। বিনিময়ের সীমা তারা অতিক্রম করে না।

    জিনিষপত্রের এরূপ আদান প্রদান প্রকৃতিবিরুদ্ধ নয়। এবং এটাকে আমরা টাকা বানানোর কৌশল বলতে পারিনে। প্রকৃতির মধ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থেকেই এর উদ্ভব। কিন্তু আবার এই বিনিময় থেকেই টাকা বানানোর প্রক্রিয়ার বিকাশ ঘটেছে। এ বিষয়টি বেশ বোধগম্য। কারণ উদ্বৃত্ত জিনিষপত্রের রপ্তানী এবং প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির আমদানি যখন কোন একটি জনগোষ্ঠির মধ্যে পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়তে শুরু করল তখন একটি সাধারণভাবে গ্রাহ্য বিনিময় মাধ্যমেরও আবশ্যকতা দেখা দিল। কারণ বিনিময়ের ব্যাপারেও যে সমস্ত দ্রব্য সামগ্রী আমাদের স্বাভাবিকভাবে প্রয়োজন তার সবগুলিকে সহজে বহন করে চলা যায় না। এ কারণে বিনিময়ের জন্যও মানুষ লৌহ, রৌপ্য কিংবা অনুরূপ অন্য কোন প্রয়োজনীয় এবং ব্যবহারযোগ্য দ্রব্য একে অপরকে দিতে এবং অপরের নিকট হতে গ্রহণ করতে সম্মত হল। এই বিশেষ দ্রব্যের পরিমাণও গোড়াতে তার ওজন এবং আকার দ্বারা নির্দিষ্ট হত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দৈহিক আকারের পরিবর্তে দ্রব্যের গায়ে পরিমাণের নির্দেশক চিহ্ন থাকলেই চলত। এর ফলে এই নির্দিষ্ট মাধ্যমকেও আর প্রতিবার ওজন করে দেখার আবশ্যক হত না, এর পরিমাণ কত। কারণ পরিমাণের চিহ্ন দ্রব্যটির গায়ে উৎকীর্ণ থাকতো। এই চিহ্নিত মাধ্যমই হচ্ছে মুদ্রা। এবং একবার মুদ্রার প্রচলন যখন শুরু হল তখন এর বিকাশ ঘটল দ্রুত। এবং যে ব্যাপারের শুরু হয়েছিল প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির বিনিময় হিসাবে সেটাই এখন ব্যবসায় তথা টাকা তৈরির চরিত্র গ্রহণ করল। গোড়ার দিকে ব্যাপারটি হয়ত খুব সরল ছিল। কিন্তু ব্যবসায়গত বিনিময়ের মাধ্যমে কোথায় এবং কি প্রকারে সর্বাধিক লাভ সংগ্রহ করা যায় এ কৌশলে মানুষ যত অভিজ্ঞ এবং দক্ষ হয়ে উঠল, মুদ্রাব্যবস্থাও তত জটিল হতে লাগল। এ কারণেই সম্পদ বা অর্থ সংগ্রহ বলতে এখন আর সাক্ষাৎভাবে দ্রব্য সংগ্রহকে বুঝায় না। এখন অর্থ বা সম্পদ সংগ্রহ মানে হচ্ছে শুধু মুদ্রা সংগ্রহ। আর যারা এ ব্যবসায়ে লিপ্ত তাদেরও আজ লক্ষ্য কেবল এই সন্ধানেই নিবদ্ধ, মূল হচ্ছে টাকা। বস্তুত এখন সম্পদ বলতে টাকার পাহাড়কে বুঝানো হয়। কারণ, অর্থসংগ্রহ এবং ব্যবসায়ের লক্ষ্যই হচ্ছে টাকা সংগ্রহ করে স্তূপ করা।

    অনেক সময় আবার অপরাপর মাধ্যমের সঙ্গে মুদ্রাকেও প্রকৃতির সঙ্গে সূত্রহীন, কৃত্রিম এবং মূল্যহীন বস্তু বলে মনে করা হয়। কারণ, এক-প্রকার মুদ্রা যারা ব্যবহার করছে তারা যদি ইচ্ছা করে তাহলে সে মুদ্রাকে তারা বাতিল করে দিতে পারে। এবং তখন সেই বাতিল করা মুদ্রার মাধ্যমে জীবনের প্রয়োজনীয় কোন দ্রব্যকেই আর সংগ্রহ করা যাবে না। এবং তখন দেখা যাবে যে, কারুর হাতে হয়ত প্রচুর পরিমাণ মুদ্রা রয়েছে, কিন্তু একমুঠো খাদ্য সংগ্রহ করার তার উপায় নাই। এই যদি অবস্থা হয় তাহলে মুদ্রাকে আমরা কিভাবে সম্পদ বলে গণ্য করতে পারি? কারণ, যে-সম্পদের প্রাচুর্যও মানুষকে অনাহারে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারে না, সে সম্পদকে অদ্ভুত সম্পদ ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে! এ অবস্থা আমাদের মিডাসের কাহিনীকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আমরা জানি মিডাসের প্রার্থনার সীমাহীন লোভের কারণে তার সম্মুখে ধরে দেওয়া সবকিছুই তার স্পর্শে স্বর্ণে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। এ কারণেই সম্পদ এবং টাকা উপার্জনের সংজ্ঞা আমরা আলাদাভাবে প্রদানের চেষ্টা করেছি। এরূপ করা আমাদের ঠিকই হয়েছে। কারণ, সম্পদ সংগ্রহ এবং টাকা উপার্জন দুটো আলাদা বিষয়। যথার্থ সম্পদ একদিকে যেমন প্রকৃতির নিয়মেই পারিবারিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত এবং সে কারণে উৎপাদনক্ষম, সেখানে মুদ্ৰা বা টাকা উপার্জন কৃত্রিম বলে প্রকৃতির সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। এর সম্পর্ক ব্যবসায়ের সঙ্গে এবং যথার্থভাবে দ্রব্যের উৎপাদক বলতে যা বুঝায় টাকা বা মুদ্রা তেমনভাবে উৎপাদক নয়। মুদ্রা অনুৎপাদক। এরূপভাবে টাকা সংগ্রহ বা টাকা বানানোর ক্ষেত্রে টাকা একদিকে যেমন লক্ষ্য, অপরদিকে তেমনি সে তার মাধ্যম। মানুষ টাকার মাধ্যমেই টাকা বানাতে থাকে এবং এরূপ সম্পদের তখন আর কোন সীমা নির্দিষ্ট থাকে না।

    [ এ্যারিস্টটল এখানে লক্ষ্য এবং উপায় কিংবা যন্ত্র এবং তার কর্মের মধ্যকার প্রভেদ সম্পর্কে অবহিত না থাকার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছেন। ]

    রোগ নিরাময়ের কথা ধরা যাক। নিরাময়ের লক্ষ্য সুস্বাস্থ্য অর্জন। এর অবশ্য কোন সীমা নেই। প্রত্যেকটি কর্মের ক্ষেত্রেই একথা সত্য। কর্ম তার লক্ষ্যকে অর্জন করতে চায়। এর কোন সীমা নেই। সীমা নেই এই অর্থে যে, লক্ষ্যকে সর্বোত্তমভাবেই সে সাধন করতে চায়। কিন্তু তাই বলে যে উপায়ের মাধ্যমে এই লক্ষ্যের সাধন, সে উপায় সীমাহীন নয়। প্রত্যেকটি কর্মের ক্ষেত্রে লক্ষ্যই তার উপায়ের সীমা নির্দিষ্ট করে দেয়। কিন্তু টাকা বানাবার যে কর্মের কথা আমরা উল্লেখ করেছি সে কর্মের লক্ষ্য, উপায়ের কোন সীমাকে নির্দিষ্ট করে না। কারণ, এখানে টাকা বানানো বা অর্থোপার্জনটাই লক্ষ্য। কিন্তু আমাদের গৃহ সংরক্ষণ বা পরিবারের ব্যবস্থাপনার অর্থ টাকা বানানো নয়। এ কারণে এর একটা সীমা আছে। পরিবার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে টাকা সংগ্রহ লক্ষ্য নয়, পরিবার প্রতিপালনের সে একটি উপায় মাত্র। কাজেই যেখানে আমরা মনে করি প্রত্যেক ধরনের অর্থেরই একটা সীমা থাকবে সেখানে বাস্তবে আমরা এর বিপরীতই দেখতে পাই। কারণ, যারা টাকাকেই সম্পদ মনে করছে তারা মুদ্রা হিসাবে সীমাহীনভাবে তার ভাণ্ডার বৃদ্ধি করে চলেছে। এরা প্রকৃত সম্পদের সঙ্গে মুদ্রার কোন পার্থক্য স্বীকার করে না। সম্পদ এবং মুদ্রা বা অর্থ—এদের সদৃশ্যতা থেকে এরা এ দুইকে অভিন্ন মনে করে। এ দুইএর সাদৃশ্য এ কারণে যে, এ দুইএর মাধ্যমে দ্রব্য সামগ্রী সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু সংগ্রহের পদ্ধতির ক্ষেত্রে এরা বিভিন্ন একটা হচ্ছে কেবল বৃদ্ধি করা। বৃদ্ধিই তার লক্ষ্য। অন্যটি তা নয়। এ কারণে, অনেকে মনে করে পরিবার প্রতিপালনের অর্থও হচ্ছে কেবল অর্থকে বৃদ্ধি করা এবং এ অর্থবৃদ্ধির কোন সীমার কথা তারা চিন্তা করতে পারে না। অনেকে যে এরূপ আচরণ করে এর মূল কারণ বোধ হয় এই যে, এরা জীবন এবং উত্তম জীবনের মধ্যকার পার্থক্য বুঝে না। এরা কেবল জীবন ধারণ করতে চায়, উত্তম জীবন নয়। শুধু বেঁচে থাকা বা জীবন ধারণ যেখানে লক্ষ্য সেখানে সেই জীবনের আরামদায়ক বস্তুরাজি সংগ্রহের লক্ষ্যও তাদের সীমাহীন 1 আবার অনেকে আছে যাদের লক্ষ্য উত্তম জীবন হলেও তারা দৈহিক সুখেরই কেবল অন্বেষণ করে। এবং দৈহিক সুখ যখন দ্রব্যসামগ্রী সংগ্রহের উপরই নির্ভর করে তখন সেই দ্রব্যসামগ্রীর সংগ্রহই তাদের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায়। দ্বিতীয় ধরনের যে অর্থোপার্জনের কথা আমরা উল্লেখ করেছি তার মূল এখানে। কারণ, মানুষ যেখানে আধিক্যকেই উপভোগ মনে করে সেখানে সে কেবল আধিক্যকেই অন্বেষণ করে। আর তা যদি মুদ্রা বা অর্থোপার্জনের মাধ্যমে সাধিত না হয় তাহলে ভিন্নতর কোন উপায়ে হলেও সে উপায়ে তাদের সকল কর্মক্ষমতাকে নিয়োজিত করে তাকে সংগ্রহ করার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের কর্মক্ষমতাকে এরূপে ব্যবহার করা প্রকৃতির বিরুদ্ধ। যেমন, সাহসের কর্ম হচ্ছে আত্মবিশ্বাস তৈরি করা, টাকা উপার্জন করা নয়। সামরিক নেতৃত্ব বা ঔষধাদির করণীয় হচ্ছে বিজয় অর্জন এবং স্বাস্থ্য রক্ষা, অর্থোপার্জন নয়। কিন্তু যারা অর্থগৃধনু তারা তাদের দেহমনের সকল ক্ষমতা একমাত্র টাকার উপার্জনে নিয়োজিত করে। যেন এটাই তাদের পরম লক্ষ্য এবং অপর সব কিছুকে এই লক্ষ্য সাধনের উপায় হতে হবে।

    অর্থোপার্জনের বিষয়টির আলোচনা আমরা এভাবে শেষ করতে পারি : এর প্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয় দুটো দিক আছে। যেটা অপ্রয়োজনীয় সেটা কি এবং বাস্তবে কেনই বা আমরা তাকে ব্যবহার করি, সে কথা আমরা বলেছি। কিন্তু যে অর্থোপার্জন প্রয়োজনীয় সে প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে পরিবারের ব্যবস্থাপনা এবং তার প্রতিপালনের সঙ্গে সম্পর্কিত। অর্থোপার্জন যে সীমাহীন এবং সীমাবদ্ধ হতে পারে সে কথারও আমরা উল্লেখ করেছি।

    [ অষ্টম অধ্যায়ের বক্তব্য ছিল : অর্থোপার্জন এবং পরিবার প্রতিপালন এক নয়। কারণ ব্যবহারকারী এবং উৎপাদনকারী—এদের মধ্যে পার্থক্য আছে। কিন্তু এর পরে বলা হয়েছে যে, অর্থোপার্জন পরিবার প্রতিপালনের অংশ বলেও বিবেচিত হতে পারে যদি অর্থোপার্জন মানে পরিবারের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর সংগ্রহকে বুঝায় এবং অর্থোপার্জন যদি সাধারণভাবে ব্যবসায়ে পর্যবসিত না হয়। কিন্তু বর্তমানে আমরা দেখি যে, দশম অধ্যায়ের গোড়ার দিকে তার সম্পর্কেও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এখনে বলা হচ্ছে : আমাদের প্রতিপালনের ব্যবস্থা প্রকৃতিতেই রয়েছে। কাজেই প্রকৃতি তার কর্ম সম্পন্ন করলে সম্পদ সংগ্রহের কোন আবশ্যকতা থাকে না। অবশ্য এমন বক্তব্যটি যে চরমভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে তাও নয়। অধ্যায়ের শেষের দিকে একটি আপোষ ব্যবস্থারও উল্লেখ দেখা যায়। ]

    দশম অধ্যায় – অর্থোপার্জনের সীমা

    এ থেকে গোড়াতে আমরা যে প্রশ্ন তুলেছিলাম, তার জবাবও পরিষ্কার হয়। আমরা প্রশ্ন তুলেছিলাম, পারিবারিক বা রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রে অর্থোপার্জন বা সম্পদের বৃদ্ধি আবশ্যক কি না। আমাদের জবাব হচ্ছে, এটা অপরিহার্য নয়। উপার্জন বা বৃদ্ধি নয়, ব্যবহারের জন্য গোড়াতেই দ্রব্যসামগ্রী থাকা আবশ্যক। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অর্থ যেমন মানুষ তৈরি করা নয়, পরিবার প্রতিপালনের অর্থও তেমনি টাকার উপার্জন নয়। রাষ্ট্র মানুষকে তৈরি করে না। প্রকৃতির কাছ থেকেই রাষ্ট্র মানুষকে পায়। রাষ্ট্র সেই উপাদানকেই গ্রহণ করে এবং ব্যবহার করে। খাদ্যের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্য। জল কিংবা স্থল থেকে কিংবা অপর কোন উপায়ে প্রকৃতিই মানুষের খাদ্য সামগ্রীর ব্যবস্থা করে। অর্থনীতিবিদ প্রকৃতিদত্ত এই দ্রব্যসামগ্রী বণ্টনের দায়িত্ব পালন করে। এ কারণে বস্ত্রবয়নে যদি প্রয়োজনের বিভিন্নতার ভিত্তিতে তন্তুর প্রকারভেদ করার আবশ্যক হয় এবং কোন্ সুতাটা মন্দ এবং কোন্‌টা ভাল তা নির্দিষ্ট করার দক্ষতারও সেখানে দরকার, তবু বয়নশিল্পের কাজ নিশ্চয়ই পশমের উৎপাদন নয়। অপরদিকে অর্থোপার্জনকে যদি আমরা পরিবার প্রতিপালনের অঙ্গীভূত করি তাহলে সঙ্গতভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে, নিরাময় কর্ম পরিবার প্রতিপালনের অঙ্গীভূত হবে না কেন? কারণ, পরিবারের সদ্যদের জীবন ধারণের জন্য এবং দৈনন্দিন প্রয়োজন পূরণের জন্য যেমন আবশ্যক খাদ্যসামগ্রীর, তেমনি আবশ্যক সুস্থ থাকা। এরও জবাব হচ্ছে : একটি সীমা পর্যন্ত পরিবারের প্রতিপালক বা শাসককে স্বাস্থ্যের বিষয়টা অবশ্যই দেখতে হয়। কিন্তু এই সীমা পর্যন্তই। এই সীমার বাইরে দায়িত্ব চিকিৎসকের। টাকা পয়সা এবং সম্পদ সংগ্রহের ক্ষেত্রেও একই কথা। গৃহের প্রধানের জন্য এ ব্যাপারটা কিছু পরিমাণে অবশ্যই উদ্বেগের বিষয়। কিন্তু তার বাইরে ব্যাপারটা ভিন্নতর দক্ষতারই অন্তর্গত। তবে একথা আমরা পূর্বেই বলেছি, সর্বোত্তম হচ্ছে গোড়াতেই আমাদের প্রয়োজনীয় সম্পদকে প্রকৃতির কাছ থেকে লাভ করা। কারণ, প্রকৃতিরই দায়িত্ব হচ্ছে যা কিছু সে সৃষ্টি করে তার জন্য খাদ্যেরও সংস্থান করা। এবং প্রকৃতি তাই করে। কারণ, যা থেকে জীবের সৃষ্টি তার মধ্যে এমন উদ্বৃত্তের সংস্থান থাকে সে উদ্বৃত্ত তার খাদ্যের প্রয়োজন পূরণ করে।

    কাজেই আমাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, যে-অর্থোপার্জন শস্য সংগ্রহ এবং পশু প্রতিপালনে সীমাবদ্ধ সে অর্থোপার্জন প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

    তাহলে দেখা যাচ্ছে, অর্থোপার্জনকে আমরা দুইশ্রেণীতে ভাগ করতে পারি। এর একটি হচ্ছে প্রয়োজনীয় এবং আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য। একে আমরা ব্যবস্থাপনাগত বলে অভিহিত করতে পারি। অপরটি হচ্ছে ব্যবসায়গত। এর উৎস হচ্ছে বিনিময়। এটিকে আমরা যথার্থই অসঙ্গত বলে বিবেচনা করি। কারণ, এর উদ্ভব প্রকৃতি থেকে নয়। এর উদ্ভব ঘটে মানুষের পারস্পরিক আদান প্রদান থেকে। তাছাড়া সুদ আরোপের প্রথাটিও মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। সুদ আরোপকে নাকচ করা পরিপূর্ণরূপেই যুক্তি-সঙ্গত। কারণ, সুদের উৎস টাকা। যার জন্য টাকা প্রদত্ত হয় সে দ্রব্য নয়। টাকার মূল উদ্দেশ্য ছিল বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হওয়া। সুদের অর্থ হচ্ছে সেই টাকার বৃদ্ধি। সুদ সম্পর্কে আমরা এমনভাবে কথা বলি যেন সুদ হচ্ছে একটা উপার্জন বা ফসল, যেন এ উ ৎপাদিত কোন শস্য, কিংবা উৎপাদিত কোন শাবক। প্রাণীজগৎ যেমন নিজের সদৃশ সন্ততির জন্মদান করে, আমরা মনে করি সুদও হচ্ছে তেমনি টাকা থেকে উৎপাদিত টাকা একারণেই সকল প্রকার সম্পদ অর্জনের মধ্যে টাকা উপার্জনই হচ্ছে সর্বাধিক পরিমাণে প্রকৃতি-বিরুদ্ধ।

    [ এ্যারিস্টটলের বক্তব্য হচ্ছে : মানুষ বাস্তব জীবনে নানাভাবে জীবিকা অর্জন করতে পারে। এর মধ্যে যেগুলি প্রাকৃতিক অর্থাৎ প্রকৃতিদত্ত সেগুলিকে এ্যারিস্টটল গ্ৰহণীয় বলে সমর্থন করেন। অপরগুলিকে তিনি অবাঞ্ছনীয় বলে বিবেচনা করছেন। অবশ্য এ আলোচনায় এ্যারিস্টটলের আগ্রহ প্রধানত প্রশ্নটির তত্ত্বগত দিকে নিবদ্ধ। তবে বাস্তবকে যে তিনি অগ্রাহ্য করতে পারছেন না, তা এ থেকে বুঝা যায় যে, এ্যারিস্টটল অর্থোপার্জন নিয়ে বিস্তারিতভাবেই আলাচনা করেছেন। এমন কি টাকার ব্যবসায় যে, রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি সাধনের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বলে বোধ হতে পারে এবং প্রকৃতি যে কাউকে এমন উদ্বৃত্ত সম্পদের অধিকারী করতে পারে যে উদ্বৃত্ত রপ্তানি এবং বিনিময়ের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে, সে সত্যকেও এ্যারিস্টটল স্বীকার করেছেন। ]

    একাদশ অধ্যায় – জীবন ধারণের জন্য প্রকৃতির দান

    অর্থোপার্জনের তত্ত্বটি নিয়ে আমরা যথেষ্ট আলোচনা করেছি। এবার বাস্তবে এর প্রয়োগের দিকটি দেখা যাক। এ রকম বিষয়ের ক্ষেত্রে তত্ত্বগত আলোচনা অবাধ হতে কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি বাস্তব অবস্থা এবং প্রয়োজনের সীমায় কঠিনভাবে আবদ্ধ। আমরা এখানে স্বাভাবিক ধরনের অর্থোপার্জন এবং তার প্রত্যেকটির জন্য আবশ্যকীয় বাস্তব জ্ঞানের কথা উল্লেখ করব। এদের মধ্যে প্রথম হচ্ছে : পশুপালন। এখানে পশুর প্রজনন এবং কোন্ প্রকারের পশুপালন লাভজনক তার জ্ঞান আবশ্যক। তাছাড়া কখন কোথা থেকে অশ্ব, গবাদি, মেষ কিংবা অপরাপর পশু সংগ্রহ করা যায় তার জ্ঞানও আবশ্যক। দ্বিতীয়ত, প্রয়োজন কৃষিকার্যের জ্ঞান। কেমন করে মাটি চাষ করতে হবে এবং শস্য এবং ফলাদির জন্য বীজ বপন করতে হবে তার জ্ঞানও প্রয়োজন। তৃতীয়ত, মৌমাছি কিংবা অন্যান্য পাখী এবং মাছের যে চাষ প্রয়োজন তার জ্ঞানও আবশ্যক। উপযুক্তভাবে জীবন ধারণের জন্য এই তিনটিকে আমরা প্রধান উপায় বলে অভিহিত করতে পারি। অপর যে ধরনের উপায়ের কথা আমরা বলেছি তার প্রধান ভাগ হচ্ছে ১. ব্যবসায়। একে নিম্নোক্ত তিনটি উপবিভাগে আমরা বিভক্ত করতে পারি। ক. নৌযান, খ. দ্রব্যাদি বহন এবং গ. এগুলির বিক্রয় ব্যবস্থা। ২. টাকা ধার প্রদান এবং ৩. মজুরীর বিনিময়ে ক. দক্ষ কিংবা খ. অদক্ষ মজুর হিসাবে কাজ করা। টাকা পয়সা বা অর্থোপার্জনের স্বাভাবিক এবং অস্বাভাবিক যে দুটি উপায়ের কথা আমরা উল্লেখ করেছি তার. মাঝামাঝি একটি তৃতীয় উপায়েরও আমরা উল্লেখ করতে পারি। এটি উভয়ের মাঝামাঝি এ কারণে যে, এর মধ্যে প্রকৃতি এবং বিনিময় : এ দুইএর বৈশিষ্ট্যই মিশ্রিত হয়ে আছে। তৃতীয় উপায় বলতে কৃষিকার্য ব্যতিরেকেই আমাদের প্রয়োজন পূরণকারী যে সমস্ত দ্রব্যাদি আমরা মাটি কাছ থেকে লাভ করি তার কথা আমি বুঝাচ্ছি। এর অন্তর্গত হবে কাষ্ঠ খণ্ডন এবং সব রকমের খনিজ কাজ। এগুলিরও অবশ্য নানা উপবিভাগ হতে পারে। কারণ এভাবে মাটির কাছ থেকে আমরা নানা প্রকার দ্রব্য লাভ করে থাকি।

    জীবন ধারণের এই উপায়গুলি সম্পর্কে আমি এখানে সাধারণভাবে আলোচনা করে থাকলেও বর্তমানের জন্য এ আলোচনা যথেষ্ট। কারণ, বাস্তব জীবনে যারা এ সকল জীবিকার সঙ্গে যুক্ত তাদের কাছে এগুলির বিস্তারিত আলোচনার সার্থকতা থাকলেও এই মুহূর্তে এদের উপর অধিক সময় ব্যয় করা সঙ্গত হবে না। (এখানে শুধু এই কথা যোগ- করা যায় : দক্ষতার আবশ্যক সেখানেই সবচেয়ে বেশি যেখানে ভাগ্যের উপর আমরা নির্ভর করতে পারি সবচেয়ে কম। সবচেয়ে যান্ত্রিক কাজ হচ্ছে সেই কাজ যাতে মজুরদের দেহের ক্ষতি সাধন করে সবচেয়ে অধিক; যে কাজে দেহের পরিশ্রম সর্বাধিক সেখানে আসে দাস সুলভ আচরণ এবং উত্তম আচরণের প্রয়োজন যে কাজে একেবারেই অনুভূত হয় না সে কাজ হচ্ছে একেবারে অধম।)

    তাছাড়া এ সমস্ত বিষয়ের উপর রচিত গ্রন্থাদিও আছে। পারোস-এর চারিস এবং লেমনস-এর এ্যাপোলোডোরাস কৃষির ক্ষেত্রে শস্য উৎপাদন এবং ফল আহরণের বিষয়ে নীতিমালা রচনা করেছেন। অন্যান্য বিষয়েও অপর লেখকগণ লিখেছেন। সুতরাং এ সমস্ত বিষয়ে যাঁদের আগ্রহ রয়েছে তাঁরা এই লেখকদের রচনা পাঠ করতে পারবেন। জীবিকার এই বিষয়গুলি বিত্রস্ত হয়ে আছে। এ কারণে অর্থোপার্জনের ক্ষেত্রে যে পদ্ধতিতে মানুষ সাফল্য অর্জন করেছে সেগুলির তথ্য প্রথমে সংগ্রহ করা আবশ্যক। দার্শনিক থেলিস[২] এর ন্যায় যাঁরা অর্থোপার্জনের উপর গুরুত্ব প্রদান করেন তাঁদের জন্য এ কার্য খুবই ফলপ্রদ হবে। থেলিসের দক্ষতার প্রশংসা করে বলা হয় যে, থেলিস অর্থোপার্জনের একটি বিশিষ্ট উপায় উদ্ভাবন করেছিলেন। অবশ্য উপায়টি যে কেউই অবলম্বন করতে পারে। থেলিস সম্পর্কে কাহিনীটি এরূপ : দার্শনিক থেলিসের দারিদ্র্য দেখে লোকে বলতে লাগল, দর্শনের সার্থকতা কি? দর্শন থেলিসকে দরিদ্র করেছে। কিন্তু থেলিস কার্যক্ষেত্রে এর বিপরীতটি প্রমাণ করলেন। জ্যোতির্বিদ্যায় তাঁর ব্যুৎপত্তির ভিত্তিতে শীতের মরশুমেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, জলপাইয়ের ফলন এবার ভাল হবে। আর সে অনুমান থেকে কিছু পুঁজি সংগ্রহ করে মিলেটাস আর চিয়স-এর সব ঘানিগুলিতেই তিনি দাদন দিয়ে রাখলেন। এর ফলে জলপাইয়ের মরশুমে ঘানিগুলি ব্যবহারের একচেটিয়া এক্তিয়ার তিনি অর্জন করেছিলেন। এতে তাঁর খরচও তেমন কিছু হল না। কারণ, তখন তাঁর প্রতিযোগীও ছিল না। এর ফলে জলপাইয়ের মরশুম যখন এল এবং ঘানি ভাড়া করার চাহিদা যখন তীব্র হয়ে দাঁড়াল তখন থেলিস নিজের ইচ্ছামত মূল্যে দাদন দেওয়া ঘানিগুলোকে ভাড়া খাটাতে লাগলেন। এর দ্বারা তিনি প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন এবং তাঁর এই দাবীও প্ৰমাণ করেছিলেন যে, ইচ্ছে করলে দার্শনিকরাও অর্থবান হতে পারে, যদিচ দার্শনিকদের লক্ষ্য অর্থবান হওয়া নয়। থেলিস সম্পর্কে এ কাহিনীতে দেখা যাচ্ছে, থেলিস এভাবে তাঁর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন। তবে আমরা আগেও বলেছি, কৌশলটি খুব অসাধারণ নয়। সাধারণভাবে যে কেউ এটা প্রয়োগ করতে পারে। এর মূল কথা হচ্ছে, ব্যবসায়ে অর্থোপার্জনের পথ হচ্ছে, তোমার যদি সাধ্য থাকে তাহলে তুমি নিজের জন্য একচেটিয়া অধিকার সংগ্রহ কর। সিসিলিতে একটি লোকের কথা জানা যায় যে-লোকটিও তার নিকট গচ্ছিত টাকা দিয়ে লোহা ঢালাইকার থেকে সকল লোহা কিনে নিয়েছিল। আর তারপরে বিভিন্ন কারখানা থেকে লোহার ক্রেতারা যখন এসে উপস্থিত হল তখন এই লোকটি ছিল একমাত্র বিক্রেতা। আর বিক্রয় মূল্য অধিক বৃদ্ধি না করেও সহজেই সে নিজের পঞ্চাশ ট্যালেন্টের[২] পুঁজিকে এক শতে পরিণত করতে সক্ষম হল। সিসিলির শাসক ডায়োনিসিয়াস যখন ব্যাপারটি অবগত হলেন তখন তিনি একে দেশের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর বলে বিবেচনা করলেন। তিনি অবিলম্বে ঐ লোকটিকে সাইরাক্যুজ (সিসিলি) পরিত্যাগ করার আদেশ দিলেন। অবশ্য তার অর্জিত টাকাকে সঙ্গে নেওয়ার অনুমতি তাকে দেওয়া হয়েছিল।

    থেলিস এবং এই লোকিটর দৃষ্টান্ত মূলত এক। উভয়েই নিজেদের জন্য একটি একচেটিয়া শক্তি সৃষ্টি করেছিল। পণ্যের সরবরাহ এবং চাহিদার এরূপ জ্ঞান রাজনীতিকের জন্যও আবশ্যক। কারণ, অনেক নগরী আছে যাদের গৃহাদির চেয়ে অর্থ এবং অর্থোপার্জনের উপায় হিসাবে এই দ্রব্যগুলিরই প্রয়োজন অধিক। আর এ কারণেই আমরা কোন কোন সময়ে দেখতে পাই যে, রাষ্ট্রের পরিচালকগণ অর্থোপার্জনকেই তাদের সমগ্র নীতির কেন্দ্র করে তোলেন।

    —

    ১. থেলিস (৬২৪-৫৪৭ খ্রি. পূ. ) : প্রাচীন গ্রিসের অন্যতম প্রকৃতিবাদী দার্শনিক।

    ২. ট্যালেন্ট : প্রাচীনকালে গ্রিসে প্রচলিত মুদ্রা। ১ ট্যালেন্টের পরিমাণ ২০০ স্টারলিং মুদ্রা বলা যায়।

    দ্বাদশ অধ্যায় – পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের প্রকার

    আমরা পূর্বে দেখেছি, পরিবারের মধ্যে তিনটি সম্পর্কের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। তিন প্রকার শাসনের এরা প্রকাশ। এদের একটি হচ্ছে প্রভুর শাসন। এ শাসন স্বৈরতামূলক। এটার আলোচনা আমরা করেছি। অপর শাসন হচ্ছে পিতার শাসন। এবং তৃতীয়টির উদ্ভব ঘটে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তাদের বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত্তিতে। এটাও আলোচনার অন্তর্গত এ কারণে যে, একদিকে স্ত্রীর এবং সন্তানদের উপর যে শাসন সে শাসন স্বাধীন নাগরিকের উপর শাসন। অপরদিকে স্ত্রী এবং সন্তান উভয়ের ক্ষেত্রে শাসন এক নয়। স্ত্রীর উপর স্বামীর শাসন হচ্ছে রাজনৈতিক শাসন, রাষ্ট্রপ্রাজ্ঞের শাসন। কিন্তু সন্তানের উপর পিতার শাসন রাজার শাসন। রাজকীয় শাসন। এরও কারণ হচ্ছে, অবস্থা যদি একেবারে ভিন্নতর না হয় তাহলে আমাদের বলতে হবে, শাসনের ক্ষেত্রে মেয়েদের চেয়ে পুরুষ এবং অল্প বয়স্ক এবং অপরিপক্কের চেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ এবং পরিপক্করাই অধিকতর উপযুক্ত। এটা অবশ্য সত্য যে, যে-সকল রাষ্ট্রের শাসন যথার্থই রাজনৈতিক সে সব রাষ্ট্রের অধিকাংশেই শাসক এবং শাসিতের মধ্যে ভূমিকার পারস্পরিক পরিবর্তন ঘটে থাকে। এরূপ পরিবর্তনের লক্ষ্য হচ্ছে উভয়ের মধ্যে একটা সাম্য এবং পার্থক্যহীনতার অবস্থা তৈরি করা। কিন্তু এক্ষেত্রেও যতক্ষণ একজন শাসক এবং অপরজন শাসিত ততক্ষণ শাসকের প্রবণতা হবে মর্যাদার বাহ্যিক প্রকাশে, সম্বোধনের রীতিতে এবং সম্মান প্রদর্শনের পদ্ধতিতে নিজেকে শাসিত থেকে বিশিষ্ট বলে চিহ্নিত করার। (কোন নাগরিক যখন রাষ্ট্রের কোন ঊর্ধতন অফিসার হিসাবে নিযুক্ত হন তখন সম্মান তার প্রাপ্য হয়ে দাঁড়ায়। এ প্রায় স্নানঘরের পাথর দিয়ে তৈরি করা দেবতা আমাসিসের মত। স্নানঘরের পাথর দিয়ে তৈরি আমাসিসের মূর্তিকেও আমাদের সম্মানের পাত্র বলে আমরা মনে করি।) পুরুষ এবং মেয়েদের মধ্যে উত্তম এবং অধমের যে সম্পর্কের কথা বলেছি, তার পরিবর্তনের কথা চিন্তা করা যায় না। সন্তানদের উপর পিতার শাসন রাজকীয়। বয়স এবং স্নেহের কারণেই সে শাসক। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে রাজার শাসনেরও মূল হচ্ছে এই অবস্থা। এ কারণেই হোমার[১] যখন মহাদেব জিউসকে দেবতাকুল এবং মানুষ—উভয়ের পিতা বলে উল্লেখ করেন তখন তিনি ঠিক কাজই করেন। কারণ জিউস সকলের রাজা। রাজা প্রজাদের কাছ থেকে জন্মগভাবে পৃথক নয় বটে, কিন্তু গুণের ক্ষেত্রে তাকে অবশ্যই উচ্চতর হতে হবে। বয়োজ্যেষ্ঠ এবং বয়োকনিষ্ঠ এবং পিতা ও সন্তানের ক্ষেত্রেও এই কথা সত্য।

    —

    ১. হোমার : প্রাচীন গ্রিসের প্রখ্যাত কবি, আনুমানিক ৮৫০ খ্রি. পূ. কালের। মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’ এবং ‘ওডিসি’র রচয়িতা বলে পরিচিত।

    ত্রয়োদশ অধ্যায় – শাসক এবং শাসিত : দুইএর গুণ কি এক কিংবা ভিন্ন?

    তাহলে এটা পরিষ্কার যে পরিবারের ক্ষেত্রে দ্রব্য সামগ্রী অর্থাৎ যা দিয়ে সম্পদ তৈরি হয় তার চেয়ে মানুষ এবং তাদের গুণাগুণ অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। এবং দাসদের ব্যাপারেও বলব, দাসদের চেয়ে স্বাধীন নাগরিকের গুরুত্ব অধিক। দাসদের ক্ষেত্রে প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, গৃহের হাতিয়ার এবং ভৃত্য হিসাবে তাদের যে গুণ রয়েছে আমরা কি তার অতিরিক্ত অপর কোন গুণের কথা বলতে পারি যে গুণ দাসদের রয়েছে? যেমন আত্মসম্মান, সাহস, ন্যায়বোধ এবং এ রকম অন্যান্য গুণের অধিকারী কি দাসরা হতে পারে? প্রশ্নটা অন্যভাবেও করা যায়। নিজেদের দেহ দিয়ে সেবা করা ব্যতীত দাসদের কি আর কোন গুণ নেই?

    প্রশ্নটির দু’রকমের জবাব হতে পারে। অবশ্য দুটো জবাবেরই একটা অসুবিধার দিক রয়েছে। আমরা যদি বলি, যে গুণগুলোর উল্লেখ আমরা করেছি দাসদের সে সকল গুণ আছে, সেক্ষেত্রে প্রশ্ন দাঁড়াবে, তাহলে স্বাধীন নাগরিক থেকে দাসদের পার্থক্য কোথায়? আবার আমরা যদি বলি, দাসদের এ সকল গুণ নাই, তাহলেও ব্যাপারটাতে অসঙ্গতি দেখা দিবে। কারণ, দাসরা তো মানুষ এবং তাদের চিন্তার ক্ষমতা আছে। কথাটা কিন্তু সাধারণভাবে স্ত্রী এবং সন্তানের ক্ষেত্রেও বলা চলে। এদের কি এসব গুণ নাই? স্ত্রীলোক কি আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন, সাহসী এবং ন্যায়পরায়ণ হয় না? শিশুদেরও কি আমরা কখনো দুষ্ট এবং কখনো বা ভাল হতে দেখি না?

    শাসক এবং শাসিতের সম্পর্কের বিষয়ে আমাদের যে প্রশ্ন, বৃহত্তর সেই প্রশ্নের অংশ হিসাবেই এই প্রশ্নগুলোকেও দেখা যায়। বিশেষ করে কথা হচ্ছে, শাসক ও শাসিত—এ দুইয়ের গুণ কি এক, না ভিন্ন? ধরা যাক, আমরা বললাম, দু’য়েরই গুণ এক এবং উভয়ের ক্ষেত্রেই এগুণের সর্বোত্তমই অবশ্যক, তখন প্রশ্ন দাঁড়াবে, তাহলে শাসক কেবল শাসন করবে এবং শাসিত কেবল মান্য করবে, এর যুক্তি কি? (‘পরিমাণগত পার্থক্য’ কথাটি এখানে ঠিক হবেনা। শাসন করা এবং মান্য করার পার্থক্য গুণগত পার্থক্য। পরিমাণগত পার্থক্য এখানে প্রয়োজন নয়।) অপরদিকে এদের এক পক্ষকে যদি আমরা গুণের অধিকারী বলি এবং অপর পক্ষকে গুণহীন বলি তাহলেও একটি অদ্ভুত অবস্থার উদ্ভব ঘটে। কারণ, একথা যেমন সত্য, যে-শাসক তার যদি ন্যায় এবং আত্মসংযমের গুণ না থাকে তাহলে সে উত্তমরূপে শাসন করতে সক্ষম হয় না; তেমনি সত্য, যে-শাসিত তারও যদি গুণের অভাব ঘটে তাহলে সে উত্তমরূপে শাসিত হতে পারে না। কারণ, যে শাসিত তার চরিত্রে যদি শিথিলতা থাকে, যদি অবাধ্যতা থাকে তাহলে সে তার কর্তব্য পালন করবে না। কাজেই এটা পরিষ্কার যে, উত্তম গুণের প্রশ্নে শাসক এবং শাসিত—এদের উভয়েরই উত্তম গুণের আবশ্যক। অবশ্য গুণের প্রকৃতির ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকতে পারে : উভয়েরই ভিন্ন ভিন্ন উত্তম গুণের প্রয়োজন হতে পারে।

    উত্তম গুণের এই উল্লেখ থেকে আমাদের সরাসরি আত্মার আলোচনাটিতে যেতে হয়। কারণ, প্রকৃতিগতভাবে শাসক এবং প্রকৃতিগতভাবে শাসিত বলে গুণের যে পার্থক্য আমাদের বিবেচনার বিষয়, তার সাক্ষাৎ আমরা আত্মার মধ্যেই দেখতে পাব। আত্মার ক্ষেত্রে শাসক শাসিতের পার্থক্য হচ্ছে যুক্তিএবং অযুক্তির পার্থক্য। কাজেই এটা পরিষ্কার যে, অন্যান্য ক্ষেত্রেও স্বাভাবিকভাবেই পার্থক্যের উদ্ভব হবে। এবং শাসক এবং শাসিতের ক্ষেত্রে কথাটি সত্য। অবশ্য তার অর্থ এই নয় যে, উভয়ের ক্ষেত্রে পার্থক্যটা এক হবে। কারণ, দাসের উপর প্রভুর শাসন, স্ত্রীলোকের উপর পুরুষের শাসন এবং ছোটর উপর বড়র শাসনের কথা যদি আমরা বলি তাহলে দেখব যে এদের প্রত্যেকটি স্বাভাবিক, কিন্তু সকলে এক নয়। কারণ, এদের প্রত্যেকের মধ্যে আত্মার অংশ আছে বটে, কিন্তু তার বণ্টন বিভিন্ন। কারণ, একজন দাসের মধ্যে আত্মার যুক্তির অংশটি যেখানে আদৌ নেই, সেখানে স্ত্রীলোকদের মধ্যে তা নিষ্ক্রিয় এবং শিশুদের মধ্যে অবিকশিত। আমাদের তাই সিদ্ধান্ত হবে যে, নৈতিক গুণের ক্ষেত্রেও এ কথাটি সত্য। অর্থাৎ এ গুণ সকলের ক্ষেত্রে থাকতে হবে বটে, কিন্তু তার পরিমাণ সর্বত্র সমান হবে না। উত্তমরূপে দায়িত্ব পালনের প্রয়োজনীয় পরিমাণ গুণই থাকবে, অধিক নয়। এবার তাহলে আমরা বলতে পারি, শাসকের নৈতিক গুণ হবে সামগ্রিক। কারণ, শাসক হচ্ছে প্রধান নির্মাতা। কিন্তু সমাজের অন্যান্য সদস্যদের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ হবে তাদের কার্য অনুযায়ী। যা হোক, এটা এবার স্পষ্ট, শ্রেণী হিসাবে যাদের কথা আমরা উল্লেখ করেছি তাদের সকলেরই নৈতিক গুণ থাকতে হবে। এবং এটাও স্পষ্ট যে, পরিমাণের ক্ষেত্রে এর পার্থক্য ঘটবে। পুরুষের আত্মসম্মান এবং স্ত্রীলোকের আত্মসম্মান কিংবা তাদের ন্যায়বোধ বা সাহস, সক্রেটিস যেরূপ মনে করেছেন, সেরূপ এক নয়। যেমন একের ক্ষেত্রে সাহস হচ্ছে শাসকের সাহস, অপর ক্ষেত্রে সাহস হচ্ছে ভৃত্যের সাহস। এ দুটো এক নয়। অপরাপর গুণের ব্যাপারেও এই কথাটিকে আমরা সত্য বলব।

    বিষয়টির প্রতি আর একটু বিস্তারিত দৃষ্টি দিলে কথাটি অধিকতর পরিষ্কার হবে। কারণ, সাধারণভাবে যাঁরা বলেন যে, উত্তম গুণ হচ্ছে আত্মার অবস্থার শর্তবিশেষ, অথবা উত্তম গুণ হচ্ছে সঠিক আচরণ, কিংবা অনুরূপ অন্য কোন উক্তি যাঁরা করেন তাঁরা নিজেদেরকে ভ্রান্তির মধ্যে আবদ্ধ করেন। যাঁরা এসব ক্ষেত্রে সাধারণ সংজ্ঞার চেষ্টা করেন তাঁদের চয়ে গরজিয়াস[১]-এর ন্যায় উত্তম হচ্ছেন তাঁরা যাঁরা বিভিন্ন গুণের একটা বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ কারণে কবি সফোক্লিস[২] ‘নীরবতাকে’ মেয়েদের একটি গুণ বলে বর্ণনা করেন। কিন্তু পুরুষদের ক্ষেত্রে নীরবতা কোন গুণ নয়। কার্যের দ্বারা কোন গুণের বিচার করার এই পদ্ধতিটি উত্তম। সর্বদা এটিই আমাদের অনুসরণ করা উচিত। ধরা যাক একটি শিশুর কথা। ‘শিশু’র অর্থ হচ্ছে সে এখনো পূর্ণভাবে বিকশিত হয় নি। তার ধর্ম হচ্ছে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়া। সে-কারণে তার এই গুণটিকে আমরা কেবল তার মধ্যে আবদ্ধ বলতে পারি নে। এই গুণটিকে যেমন বুঝতে হবে তার বিকাশের অগ্রগতির ভিত্তিতে, তেমনি তার পরিচর্যায় নিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতেও। দাস এবং প্রভুর ক্ষেত্রেও কথাটি সত্য। আমরা নির্দিষ্ট করে বলেছি, দাসের কাজ হচ্ছে দৈহিক কার্য সাধন করা। এ কারণে তার প্রয়োজনীয় গুণের পরিমাণ অধিক হওয়ার কথা নয়। শিথিল জীবনযাপন কিংবা অসতর্কতার জন্য তার এই কার্য যেন অবহেলিত না হয় তার নিশ্চয়তার জন্য যে পরিমাণ গুণের আবশ্যক, দাসের গুণের পরিমাণ নিশ্চয়ই ততটুকু হবে। এর অধিক নয়।

    একজন দাস-শ্রমিক সম্পর্কে এ কথা সত্য হলে প্রশ্ন উঠবে, স্বাধীন শ্রমিকও যেন উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনের মাধ্যমে তার দায়িত্ব অবহেলা না করে সেজন্য তারও কি গুণের আবশ্যক হবে না? এর জবাব হবে : হাঁ, গুণের আবশ্যক হবে। কিন্তু দুটো দৃষ্টান্তকে একই সমান্তরালে দেখা চলে না। দুজনের কাজ একই প্রকারের হতে পারে। কিন্তু দুজনের জীবনপ্রণালী ভিন্ন প্রকারের। যে দাস সে তো প্রভুর পরিবারেই বাস করে। কিন্তু যে স্বাধীন শ্রমিক সে তার নিয়োগকারী থেকে আলাদা বাসস্থানে বাস করে। তাকে দাসের সমান এভাবে বলা চলে যে, তার কাজে সে যে পরিমাণ আবদ্ধ সেই পরিমাণে তারও দাসোচিত গুণের আবশ্যক। কারণ, দৈহিক শ্রমে আবদ্ধ যে-কেউই সীমাবদ্ধ অর্থে দাসত্বের অবস্থায় অবস্থিত। তবে দাস-শ্রমিক এবং স্বাধীন-শ্রমিকের পার্থক্য এখানে যে, দাস প্রকৃতিগতভাবে দাস। কিন্তু একজন হস্তশিল্পী বা পাদুকা-নির্মাণকারীকে আমরা প্রকৃতিগতভাবে দাস বলতে পারিনে। এ থেকে এটা পরিষ্কার যে, দাসের যে গুণের আবশ্যক প্রভুকেই তার উৎস হতে হবে। (আমি অবশ্য নৈতিক গুণের কথাই বলছি। প্রভু তার দাসদের উত্তম হতে শিক্ষা দিতে পারে। প্রভুর এরূপ শিক্ষা দেওয়ার গুণের কথা নয়।) কাজেই যারা বলবে যে, দাসদের আদৌ কোন বুদ্ধি নেই এবং প্রভুরও কেবল হুকুম দেওয়া বাদে অপর কোন গুণে আবশ্যকতা নেই, তাদের কথা ঠিক নয়। উপদেশ এবং পরামর্শ বরঞ্চ সন্তানদের চাইতে দাসদেরই অধিকতর উপযুক্তভাবে দেওয়া যায়।

    এ সমস্ত বিষয়ে আমাদের আলোচনা এ পর্যন্তই থাক। কিন্তু পরিবারের মধ্যে স্বামী এবং স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্ক, সন্তানবর্গ এবং পিতার মধ্যকার সম্পর্ক—এবং এই সম্পর্কের প্রত্যেকটির নিজস্ব গুণাগুণ কিংবা এদের মধ্যকার পারস্পরিক আচরণ, এর মধ্যে কোটি সঠিক এবং কোনটি সঠিক নয়, পরিবারের মধ্যে উত্তম সাধনের চেষ্টা এবং অধমকে পরিহারের চেষ্টা—এ সকল বিষয়ের আলোচনা শাসনব্যবস্থার প্রকারসমূহের আলোচনা প্রসঙ্গে করাই উত্তম হবে। কারণ, উপরোক্ত বিষয়গুলো পরিবারেরই অঙ্গীভূত এবং প্রত্যেকটি পরিবারই আবার রাষ্ট্রের অংশ। সেদিক থেকে অংশের গুণাগুণ সমগ্রের গুণাগুণের ভিত্তিতেই আলোচনা করা সঙ্গত। এ কথার অর্থ, সন্তানবর্গ এবং স্ত্রীলোক—তাদের সকলের শিক্ষাই পরিচালিত হওয়া উচিত রাষ্ট্রের স্বার্থের ভিত্তিতে। অন্ততঃপক্ষে আমরা যদি স্বীকার করি যে, শিশুরা এবং মেয়েরা উত্তম কিংবা উত্তম নয়—এ বিষয়টি রাষ্ট্রের ভালমন্দের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, তাহলে এদের শিক্ষার বিষয়ে আমাদের বক্তব্যকে সঠিক বলতে হবে। এদের উত্তম হওয়া, না-হওয়া রাষ্ট্রের ভালমন্দের ক্ষেত্রে অবশ্যই একটি পার্থক্য সৃষ্টি করে। কারণ, বয়ঃপ্রাপ্ত স্বাধীন অধিবাসীদের অর্ধেক স্ত্রীলোক। এবং শিশুদের মধ্য থেকেই ভবিষ্যতে যারা নাগরিক হবে এবং রাষ্ট্র পরিচালনে অংশগ্রহণ করবে তাদের আগমন ঘটবে।

    যাহোক, কতগুলো ব্যাপারের আলোচনা যখন আমরা সমাপ্ত করেছি এবং স্থির করেছি অবশিষ্টগুলির আলোচনা অন্যত্র করা যাবে, তখন পরিবার-সংক্রান্ত আলোচনার এখানে ইতি টেনে একটা নতুন আলোচনা আমরা শুরু করতে পারি। এবং এই নতুন বিষয়ের মধ্যে প্রথম আলোচ্য হিসাবে আমরা সর্বোত্তম প্রকারের শাসন সম্পর্কে যাঁরা অভিমত প্ৰকাশ করেছেন তাঁদের অভিমতসমূহই আমাদের সামনে রাখব।

    —

    ১. গরজিয়াস (খ্রি. পূ. ৪৮৩-৩৭৫) : প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক। জন্ম সিসিলিতে। সফিস্ট সম্প্রদায়ভুক্ত অজ্ঞেয়বাদী দার্শনিক হিসাবে ইনি দর্শনের ইতিহাসে পরিচিত।

    ২. সফোক্লিস (খ্রি. পূ. ৪৯৬-৪০৬) প্রাচীন গ্রিক কবি এবং নাট্যকারদের অন্যতম!

    1 2 3 4 5 6 7 8 9
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদিমেন্তিয়া – এম. জে. বাবু
    Next Article ও হেনরি রচনাসমগ্র
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    আলো হাতে সেই মেয়েটি – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    গোয়েন্দা গার্গী সমগ্র – তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

    August 20, 2025

    রবিনসন ক্রুসো – ড্যানিয়েল ডিফো

    August 19, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.