Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    এ ডলস হাউস – অগাস্ট স্ট্রিনডবার্গ

    লেখক এক পাতা গল্প166 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    বিবাহ অনিবার্য

    খুব অল্প বয়সে বাবাকে হারানোর পর মা, দুই বোন, আর খালাদের কাছেই ও মানুষ হয়েছিল। পুরো পরিবারে ছেলে-মানুষ বলতে ও একাই। সুইডেনের এক মফস্বল শহরে ওদের বসবাস। শহরটার নাম সোয়েডারম্যানল্যান্ড। চারপাশে এমন কোন প্রতিবেশী ছিল না যার সঙ্গে বসে প্রাণ খুলে একটু আলাপ করা যায়। সুতরাং, বাড়ির মধ্যেই পুরো পৃথিবী। ওর বয়স যখন সাত, তখন ওদের পড়ানোর জন্য একজন গভর্নেস রাখা হল। কিছুদিন পর এক খালাতো বোনও এসে যোগ দিল, বোনটি এখন থেকে ওদের বাড়িতেই থাকবে।

    ও সবসময় বোনদের সাথে সাথেই থাকত। একসঙ্গে খেলা করত, এমনকি গোসলেও যেত। কেউই ওকে ভিন্ন লিঙ্গের কেউ বলে গণ্য করত না। তবে, এই একসঙ্গে থাকায়, কিংবা খেলা করায় সবসময়ই ওকে বোনদের কর্তৃত্ব মেনে চলতে হত, নিজের মতামত প্রকাশ করার কোন সুযোগ ছিল না। ফলে অচিরেই বোনেরা ওর শিক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হল। অবশ্য, শিক্ষক না বলে প্রভু বলাটাই শ্রেয়তর; কারণ, বোনেরা যেভাবে যা করতে বলত তার বাইরে যাবার কোনও উপায় ছিল না।

    ছোটবেলায় ওকে দেখে বেশ শক্ত-পোক্ত একটা ছেলে বলেই মনে হত। কিন্তু এত রমণীর ভিড়ে ধীরে-ধীরে ও কেমন শান্ত, লাজুক প্রকৃতির হতে থাকলো। নিজের জগত্তাকে ঘরের ভেতরেই গুটিয়ে রাখতে শুরু করল। মুক্ত হবার একটা ক্ষীণ প্রচেষ্টা অবশ্য একবার ও করেছিল আশেপাশের সমবয়েসী ছেলেদের সঙ্গে খেলতে গিয়েছিল। সমস্ত দিন জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করেছিল, গাছে চড়েছিল, পাখির বাসা চুরি করেছিল, কাঠবিড়ালি তাড়িয়ে বেড়িয়েছিলো, আরও কত কি! ফ্রিদিওফকে দেখে তখন সদ্যমুক্ত কোন আসামির মত মনে হচ্ছিল–মুক্তির আনন্দ যার পরম আরাধ্য। সেদিন রাতে খাবার জন্য বাড়ি ফেরেনি ও। সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে কোথা থেকে গাদাগাদা বুনো জাম জোগাড় করে খেয়েছিল। তারপর লেকের পানিতে দলবেঁধে ঝাপাঝাপি। এটাই ছিল ফ্রিদিওফের জীবনের প্রথম সত্যিকার আনন্দের দিন।

    ফ্রিদিওফ যখন বাড়ি ফিরল, তখন সমস্ত বাড়ি কেমন থমথম করছে। মা এতক্ষণ ভীষণ দুশ্চিন্তায় ছিলেন; কিন্তু ফ্রিদিওফ ফেরার পর আর আনন্দ গোপন রাখতে পারলেন না–জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে দিলেন। এতকিছুর মধ্যেও একজনের আচরণ সবার থেকে আলাদা দেখালো–ফ্রিদিওফের খালা অগাস্থা। মহিলা বয়সে ওর মায়ের চেয়ে বড় হলেও বিয়ে করেননি বলে এ সংসার মূলত তার কর্তৃত্বেই চলে। ফ্রিদিওফ দেরি করে বাড়ি ফেরায় অগাস্থা ভীষণ রেগে গেল। রীতিমত অগ্নিশর্মা যাকে বলে! তার মনে হল, এই মুহূর্তে ওকে শক্ত শাস্তি না-দেয়াটা একটা অপরাধের সমতূল্য হবে। ফ্রিদিওফ কিছুতেই বুঝতে পারছিল না, এটা অপরাধ হয় কী করে! কিন্তু অগাস্থাকে বোঝায় কার সাধ্য, অবাধ্যতা তার কাছে পাপের শামিল। অবশ্য, ফ্রিদিওফেরও নিজের পক্ষে যুক্তি ছিল “আমাকেতো কখনো আশেপাশের ছেলেদের সঙ্গে খেলতে বারণ করা হয়নি।” অগাস্থা এসব কানে তুলতে নারাজ। তার স্পষ্ট ঘোষণা–“এ ব্যাপারে দ্বিতীয় কোন কথা শুনতে চাই না।” অতএব, মায়ের ক্ষীণ আপত্তি উপেক্ষা করে, ফ্রিদিওফকে শাস্তি দেবার জন্য জোর করে অগাস্থার ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। ওর বয়স বড়জোর আট হলেও দেখতে বেশ বড়োসড়ো না দেখায়। অগাস্থার চোখ-মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ফ্রিদিওফের কপালে । আজ খারাপ কিছু আছে। কিন্তু ঠিক কোন মুহূর্তে যে সেটা ঘটতে যাচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছিল না। হঠাৎ করেই ফ্রিদিওফের প্যান্ট টেনে খোলার জন্য অগাস্থা ওর কোমরের বেল্ট ধরে ঝাঁকুনি দিল। সাথে সাথে ফ্রিদিওফের সারা শরীর কেমন হিম হয়ে গেল। মনে হলো, যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে, বুকের ভেতর কে যেন গুমগুম হাতুড়ি পেটাচ্ছে। কিন্তু কোন শব্দ করল না; শুধু ভীতু শালিকছানার মত খালার দিকে চেয়ে রইল। অগাস্থা কিন্তু এতে কোন ভ্রুকুটি করল না। থমথমে গলায় বলল–“চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবি, কোনরকম বজ্জাতি করবি না।” এ-পর্যন্তও মেনে নিয়েছিল ফ্রিদিওফ, কিন্তু খালা যখন শার্টে হাত দিল তখন রাগে-লজ্জায় একেবারে লাল হয়ে গেল। চট করে লাফ দিয়ে সরে যেতে চাইল। মনে হল, অগাস্থার গা বেয়ে যেন কোন ঘৃণ্য-নোংরা কিছু বেড়িয়ে আসছে। চট করে ফ্রিদিওফের কাছে নিজের লিঙ্গ-পরিচয় আবিষ্কৃত হল। লাফ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করল ও, কিন্তু সফল হল না। অগাস্থা পাগলের মত হিংস্রতায় খপ করে ধরে ফেলল। তারপর, একটা চেয়ারে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এলোপাথাড়ি মারতে থাকল। সেই মুহূর্তে ফ্রিদিওফের মনে হল, ও যেন কোন ব্যথা অনুভব করছে না; কিন্তু রাগে চিত্তার করতে থাকলো। ক্রমাগত কিল-ঘুষি চালিয়ে নিজেকে মুক্ত করতে চাইল। কিন্তু হঠাৎ করে কী যেন হল–সমস্ত শরীর কেমন নিথর-নিস্তেজ হয়ে এল। অগাস্থা যখন ছেড়ে দিল, তখনও ঠিক অমনই নিথর পড়ে রইল ফ্রিদিওফ।

    “উঠে দাঁড়া!” কর্কশ গলার আদেশ শোনা গেল। উঠে দাঁড়াল ফ্রিদিওফ। খালার দিকে নিস্পলক চেয়ে রইল। মহিলার মুখের এক দিক। কেমন ফ্যাকাশে, আর অন্যদিকটা লালচে দেখাচ্ছিল, চোখ দুটো জ্বলছিল, সমস্ত শরীর কেমন থরথর করে কাঁপছিল। এবার আগ্রহ নিয়ে অগাস্থার দিকে তাকালো ফ্রিদিওফ–যেমনভাবে আগ্রহ নিয়ে মানুষ কোন বুনো জন্তুর। দিকে তাকায়। হঠাৎ ওর ঠোঁটে এক ধরনের অবজ্ঞার হাসি খেলে গেল। মনে হল ঘৃণা আর অবজ্ঞার প্রকাশই এই পরিস্থিতিতে ওকে জয়ী করবে। ‘ডাইনি মাগী!’ পাড়ার ছেলেদের থেকে নতুন শেখা গালিটা ভীষণ ঘৃণাভরে অগাস্থার মুখের ওপর ছুঁড়ে দিয়ে, জামা-কাপড় তুলে, দ্রুত পালিয়ে গেল। নীচতলায় বসে ওর মা কাঁদছিল। সেখানে গিয়ে খালার নামে অভিযোগ ঝেড়ে প্রাণ জুড়াতে চাইলে ফ্রিদিওফ; কিন্তু লাভ হলো না। বড় বোনের বিরুদ্ধে ছেলেকে সান্ত্বনা দেবার মত সাহস মায়ের ছিল না। অতএব, ফ্রিদিওফকে সরে পড়তে হল। এলোেমলো হাঁটাহাঁটি করতে করতে রান্নাঘরে চলে এল। এখানে অবশ্য সান্তনা পাওয়া গেল। বাড়ির কাজের লোকেরা ওকে খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে-শুনিয়ে শেষমেষ কতগুলো খুচরো টাকা হাতে গুঁজে দিল, এতে বেশ কাজ হল।

    ঐদিনের পর থেকে বোনদের সাথে নার্সারিতে ঘুমানো বন্ধ হল। মা। নিজের রুমে ফ্রিদিওফের খাট স্থানান্তর করলেন। কিন্তু ওর কাছে মায়ের। রুমটাকে ভীষণ বদ্ধ মনে হল। তাছাড়া, রাত-বিরাতে মা ঘুম থেকে ডেকে তুলে জিজ্ঞেস করতেন, ও সেরে উঠেছে কি না। ফ্রিদিওফের এতে বিরক্তির সীমা ছিল না। রাগে গজগজ করতে করতে মায়ের প্রশ্নের জবাব দিত।

    *** *** ***

    কেউ ঠিকঠাক মত সাজিয়ে-গুছিয়ে না-দেয়া পর্যন্ত বাইরে বেরোনো বারণ ছিল ফ্রিদিওফের। অনেকগুলো মাফলার ছিল ওর। নিজেও জানতো না কখন কোনটা পরতে হবে। কখনও মাফলার না পরে চুপিচুপি বাসা থেকে বেরোতে চেষ্টা করলেই কেউ-না-কেউ জানালা দিয়ে ঠিক দেখে ফেলত। তখন আবার ঘরে এসে মাফলার, ওভারকোট পরে তার পর বের হতে হত।

    দিনে দিনে বোনদের খেলাগুলি বিরক্তিকর হয়ে উঠছিল। ওর পেশীবহুল হাত বাচ্চাদের খেলনা র‍্যাকেট কিংবা শাটলককে আর আনন্দ পেত না। বরং, পাথর ছুঁড়ে খেলা করাকে বেশি অ্যাডভেঞ্চারাস মনে হত। ঘাসের মাঠে কাঠের বল ছুঁড়ে মারার খেলা নিয়ে প্যানপেনে ঝগড়াও ভীষণ বিশ্রী লাগত–“ধুর! এগুলোয় না লাগে কোন শক্তি, না কোন বুদ্ধি।” ওদিকে, এতসব যন্ত্রণার মাঝে আরেক মহাবিরক্তির কারণ ছিল–ওদের গভর্নের্স। এই মহিলা সব সময় ফ্রেঞ্চ ভাষায় নানা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করত। ফ্রিদিওফ নির্বিকারে সুইডিশে সেসবের জবাব দিত। এভাবে, দিনে দিনে চারপাশের সবকিছু মিলে কেমন একটা গুমোট পরিবেশ সৃষ্টি হতে লাগলো।

    ফ্রিদিওফের উপস্থিতিতে সবাই যেভাবে খোলামেলা আলোচনা করত সেগুলো ওর মোটেই পছন্দ হত না। ফলে, মাঝে মাঝেই বাড়ির সবার সঙ্গে। খারাপ ব্যবহার করত। একমাত্র মা-ই ওকে কিছুটা বুঝতে পারতেন। তাই মাঝেমাঝে খানিকটা সময় নিজের মত করে কাটানোর সুযোগ করে দিতেন, ফ্রিদিওফের খাটের চারপাশে তিনি বড় করে পর্দা টানিয়ে দিলেন। এতে লাভ যেটা হলো তা হচ্ছে, বাড়ির সবার সাথে দেখা করাই বন্ধ করে দিল ফ্রিদিওফ। ওদেরকে দেখলেই কেমন গা জ্বালা করে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ালো যে, শুধুমাত্র রান্নাঘর আর কাজের লোকদের বিশ্রামের। জায়গাগুলোই ফ্রিদিওফের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠলো। এই জায়গাগুলোতে ওর সবরকম আচরণ সহজেই গ্রহণযোগ্য ছিল। মাঝে মাঝে অবশ্য এমন সব। বিষয় নিয়ে আলোচনা হত যেগুলো যেকোন ছেলের মধ্যেই কৌতূহল জাগাবে; তবে ফ্রিদিওফের জন্য সেসব বিষয়েও কোন রাখঢাক ছিল না। অতএব, সে যখন যা ইচ্ছা তা-ই বলতে পারতো, তা-ই করতে পারতো। একবার তো ভুল করে কাজের মেয়েদের গোসলের জায়গাতেই চলে গেল! এ-দৃশ্য দেখে ওদের গভর্নের্স চিৎকার করে উঠলো। ফ্রিদিওফ অবশ্য কোন খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে যায়নি, তাই গভর্নেসের চিৎকারে কোন আমলই দিল না। বরং, আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কিংবা পানিতে ভেসে বেড়ানো মেয়েদের সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে থাকলো। ওদের নগ্নতা ফ্রিদিওফের মধ্যে কোনও ভাবান্তর সৃষ্টি করল না।

    এভাবেই ফ্রিদিওফ একসময় তারুণ্যে প্রবেশ করল। ওকে ফার্মের যাবতীয় কাজ শিখিয়ে-পড়িয়ে দেবার জন্য একজন ইন্সপেক্টর নিয়োগ করা হল। কারণ স্পষ্ট: কিছুদিন পর ওকেই তো সব দায়িত্ব নিতে হবে। প্রচলিত। রীতিনীতিতে বিশ্বাস করে এমন একজন বয়স্ক লোককে নিয়োগ দেয়া হল। ভদ্রলোকের সনাতন চিন্তা-ভাবনা কোন যুবককে আলোড়িত করার মত নাহলেও সেগুলো ফ্রিদিওফের মধ্যে বেশ পরিবর্তন আনলো, ওর চিন্তা জগতে কতগুলো নতুন দিক যোগ করলো, আর সর্বোপরি, ওকে কাজেকর্মে বেশ আগ্রহী করে তুললো। কিন্তু জট বাধলো অন্য জায়গায় বাড়ির ভেতর থেকে ভদ্রলোকের জন্য এত বেশি ফরমায়েশ আসে যে, সেগুলো নিয়েই তার সারা দিন কেটে যায়।

    *** *** ***

    পনেরো বছর বয়সে ফ্রিদিওফকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হল। এ-উপলক্ষে সে একটা স্বর্ণের ঘড়ি উপহার পেল। নিজেকে হঠাৎ বেশ বড় মানুষ মনে হতে লাগলো। এখন সে চাইলেই যখন-তখন ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াতে যেতে পারে। অবশ্য কিছু বিষয়ে বরাবরের মতই নিষেধাজ্ঞা ছিল, যেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ‘বন্দুক নিয়ে শিকারে যাওয়া, অথচ এটাই ছিল ফ্রিদিওফের সবচেয়ে বড় শখ। যাহোক, আনন্দের ব্যাপার হল, এখন আর খালার হাতে মার খাওয়ার ভয় নেই। খালাকে এতদিন সে ঘোরতর শত্রু বলেই মনে করে এসেছে। তবে, খালার মারের ভয় না-থাকলেও ভয় কিন্তু একটা ছিল ‘মায়ের চোখের জল’। মায়ের কাছে ও সেই শিশু হয়েই রইল। ফলে অন্য মানুষের কথামত নিজের পছন্দ ঠিক করার অভ্যাসটা আর কখনোই পরিবর্তন করতে পারলো না ফ্রিদিওফ।

    মাঝে কিছু বছর গেল।

    ফ্রিদিওফ এখন বিশ বছরের যুবক। একদিন ও রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে কাজকর্ম দেখছিল। একটা মেয়ে পিঁড়িতে বসে মাছ কুটছিল। সদ্যযৌবনা মেয়েটা দেখতে মন্দ নয়। এরই মধ্যে ওর সঙ্গে খানিকটা ভাবও হয়েছে। আজ ফ্রিদিওফ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটার সাথে মজা করছিল। এক পর্যায়ে খেলাচ্ছলে মেয়েটাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। মেয়েটা বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেল, কোনমতে বলল–“কী করছেন!”

    “যা করছি ঠিকই করছি” আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল ফ্রিদিওফ।

    “কেউ দেখে ফেলতে পারে” ভীত শোনাল মেয়েটাকে।

    –দেখলে দেখুক।

    রান্নাঘরের পাশ দিয়ে ফ্রিদিওফের মা হেঁটে যাচ্ছিলেন। অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়তেই তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে অন্য দিকে হাঁটা দিলেন। এইবেলা ফ্রিদিওফ বেশ অস্বস্তিতে পড়ল। কী করবে ভেবে না পেয়ে, চট করে নিজের রুমে সটকে পড়ল।

    *** *** ***

    সম্প্রতি বাড়ির বাগানে নতুন মালী রাখা হয়েছে। কাজের মেয়েরা যাতে কোন ঝামেলায় না পড়ে সেজন্য বুদ্ধি করে একজন বিবাহিত লোককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে কোন দিক থেকে আসে তা কি আর কেউ বলতে পারে? নতুন মালীর বিয়ের বয়স অনুযায়ী তার পক্ষে কোন সুন্দরী তরুণীর বাবা হওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। সুতরাং, বাগানের সমস্ত গোলাপের মাঝে হঠাৎ করেই একদিন এক ফুটন্ত গোলাপের দেখা পেল ফ্রিদিওফ। সঙ্গে সঙ্গে তার সমস্ত প্রেমাবেগ পাখনা মেলে দিলো। মেয়েটা যেমন সুশ্রী তেমন শিক্ষিত। প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে গেল ফ্রিদিওফ। ফলে শীঘ্রই ওর জীবনধারায় ব্যাপক পরিবর্তন এল। এখন ওকে যখন-তখন বাগানে দেখা যায়। মেয়েটার সাথে কথা বলার জন্য সবসময়। তক্কেতক্কে থাকে। কিন্তু মেয়েটা তেমন গা করে না। তবে এর ফলাফল হল বিপরীত–মেয়েটার আপাত-অবহেলা ফ্রিদিওফকে আরও বেশি আগ্রহী করে তুললো।

    একদিন ঘোড়ায় চড়ে বনের মধ্যে ঘুরছিল ফ্রিদিওফ, মাথায় ঘুরছিল মেয়েটার চিন্তা। ও ধরেই নিয়েছিল, কোন মেয়ে এতটা নিখুঁত কখনো হতে পারে না। মেয়েটার সঙ্গে একাকী দেখা করার ইচ্ছা ওকে পাগল করে তুলছিল। এতে যে কেউ খারাপ ভাবতে পারে তা মাথায়ই ছিল না। চিন্তাভাবনার উন্মত্ততায় এতটাই প্রভাবিত হয়েছিল যে, মেয়েটাকে ছাড়া জীবন অসম্ভব ঠেকছিল। হালকাভাবে ঘোড়ার লাগাম ধরে রেখেছিল। ফ্রিদিওফ, ফলে ঘোড়াটা ইচ্ছেমত এদিক-সেদিক ঘোরাফেরা করতে পারছিল। হঠাৎ, কোথা থেকে যেন একরাশ আলোর ঝলক খেলে গেল গাছের আড়ালে মালীর মেয়েকে দেখা গেল। ফুটপাথ ধরে হাঁটছিল মেয়েটা; দেখে ক্ষণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে রইল ফ্রিদিওফ। প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নিয়ে, চট করে ঘোড়া থেকে নেমে, মাথার হ্যাট খুলে, মেয়েটার পাশে পাশে হাঁটতে লাগলো। ঘোড়ার লাগাম হাতে ধরে রেখে এটা-সেটা নানান কথার ছুঁতোয়, ফিসফিস করে নিজের ভালোবাসার কথা জানাতেও ভুল করলো না। অথচ মেয়েটা কিন্তু শুরুতেই হতাশ করল। কষ্টজড়ানো কণ্ঠে। বলল,”এসব চিন্তা অবাস্তব, মিস্টার ফ্রিদিওফ”।

    “কোনটা অবাস্তব?” গর্জে উঠলো ফ্রিদিওফ

    –আপনার মত একজন ধনী ভদ্রলোক আমার মত গরীব ঘরের একটা মেয়েকে বিয়ে করবে, এই পুরো চিন্তাটাই অবাস্তব।

    কেন যেন কথাগুলো মেয়েটার মুখে খুব বাস্তবসম্মত লাগছিল। ফলে, ফ্রিদিওফ একেবারে মুষড়ে পড়ল। ও জানে, মেয়েটার প্রতি ভালোবাসা সত্য। কিন্তু এটাও সত্য যে, এ ভালোবাসাকে সসম্মানে বাড়িতে স্থান, দেয়াটা অনেকটা দিবাস্বপ্নেরই মত। কারণ বাড়িতে নারীকুল যে গুমোট পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে, সেখানে ভালোবাসার কোন স্থান নেই। ওরা কখনোই ভালোবাসার মূল্য বুঝবে না, হয়তো ফ্রিদিওফের ভালবাসাকে ওরা ছিঁড়েখুঁড়েই ফেলবে।

    মেয়েটার সাথে কথপোকথনের পর থেকে ফ্রিদিওফ যেন বাকশক্তিহীন হয়ে গেল। প্রচন্ড হতাশা গ্রাস করল ওকে। ওদিকে, শরৎকাল আসতে-না আসতেই বাগানের মালী চাকরি থেকে অব্যাহতি চাইল। কোনওরকম কারণ না জানিয়েই সে ফ্রিদিওফদের এলাকা ছেড়ে চলে গেল। পরবর্তী দু’সপ্তাহ ফ্রিদিওফ কোনভাবেই নিজেকে সান্ত্বনা দিতে পারল না। জীবনের প্রথম প্রেম, একমাত্র ভালোবাসাকে হারিয়েছে সে। প্রতিজ্ঞা করল, আর কখনোই ভালোবাসায় জড়াবে না।

    এভাবেই, ধীরে ধীরে শরঙ্কাল চলে গেল। দরজায় দাঁড়ালো শীত। এবার ক্রিসমাসে এক নতুন প্রতিবেশী পেল ফ্রিদিওফরা। ভদ্রলোক পেশায় একজন চিকিৎসক। তাঁর ছেলেমেয়েরা বেশ বড় বড়। ফ্রিদিওফের বাড়ির মহিলারা যেহেতু সারাবছরই অসুস্থ থাকেন, দুই পরিবারের মধ্যে বন্ধুত্ব জমতে সময় নিল না। বলে রাখা ভালো, ভদ্রলোকের সন্তানদের মধ্যে এক সদ্যযৌবনা কন্যাও ছিল। অচিরেই ফ্রিদিওফ তার প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করল। শুরুতে সে খুব দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল–মনে হচ্ছিল, এটা তার প্রথম প্রেমের সঙ্গে স্পষ্ট প্রতারণা। কিন্তু সময়ে সে এক ভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছল। তার মনে হল, ভালোবাসা বিষয়টা আসলে নৈর্ব্যক্তিক; পরিবেশ পরিস্থিতির বিবেচনায় কারও পছন্দ বদলে যেতেই পারে। সময়ের সাথে সাথে কর্তৃত্ব যেমন স্থানান্তরিত হয়, ভালোবাসার ব্যাপারটাও ঠিক তেমন।

    ফ্রিদিওফের বাড়িতে খবর চাউর হতে সময় লাগল না। এ-ব্যাপারে কথা বলার জন্য মা ওকে একদিন ডেকে পাঠালেন। বেশ নাটকীয়ভাবে শুরু করলেন তিনি, “ফ্রিদি, আমার মনে হয় তোমার এখন জীবনসঙ্গী খোঁজার মত বয়স হয়েছে মায়ের গলা থমথমে শোনাল।

    “এসব নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না, মা! আমি একজনকে পছন্দ করে রেখেছি” ফ্রিদিওফ যেন ঝলমল করে উঠল।

    মা এবারে আরও গম্ভীর। মনে হল, যেন খাদের কিনারা থেকে কথা বলছেন তিনি,

    –আমার মনে হয়, তুমি একটু বেশিই তাড়াহুড়ো করে ফেলছ। যে মেয়েটাকে তুমি পছন্দ করেছ বলে সন্দেহ হচ্ছে, তার নৈতিকতা-বোধ নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। কোন শিক্ষিত মানুষের নৈতিকতা কিছুতেই এমন হতে পারে না।

    –কী বলছেন আপনি? অ্যামির নৈতিকতা নিয়ে সংশয়! কে বলেছে আপনাকে এসব?

    –এসব কথা শুধু মেয়েটার জন্য বলছি না, বলছি ওর বাবার জন্যও। তুমি বোধহয় জানো না, ওর বাবা একজন নাস্তিক।

    -”আস্তিক-নাস্তিক জানি না, কিন্তু জাগতিক মোহকে পাশ কাটিয়ে, খোলা মনে চিন্তা করতে পারেন, এমন মানুষকে আমি শ্রদ্ধা করি।” বেশ দৃঢ়ভাবে কথাগুলো বলল ফ্রিদিওফ।

    –ঠিক আছে, এসব না-হয় বাদ দিলাম। কিন্তু তুমি কি ভুলে গেছ, অন্য জায়গায় তোমার বিয়ে ঠিক করা আছে?

    –“মানে কী?” আকাশ থেকে পড়ল ফ্রিদিওফ। “আপনি কি…?”

    –হ্যাঁ, লুসিয়ার কথাই বলছি। লুসিয়াও মনে মনে তোমাকে পছন্দ করে।–আমাদের খালাতো বোন লুসিয়া!

    মায়ের মুখে হাসি ফুটলো–“তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, ছোটবেলায় তোমরা যখন একসঙ্গে খেলা করতে, তখন একে-অন্যকে বাগদত্তা বলে ভাবতে?”

    –কক্ষনো না! আমি কক্ষনো এসব ভাবিনি; বরং, আপনারাই আমাদেরকে এক সাথে খেলতে পাঠিয়েছেন, আর মনে মনে এসব চিন্তা করেছেন।

    হঠাৎ করেই মায়ের সুর বদলে গেল, গলায় মিনতি ঝরে পড়ল। “তোমার বুড়ি মা আর বোনদের কথা একবার ভাবো, ফ্রিদি! আমরা সবাই মিলে এতদিন ধরে একটু-একটু করে নিজেদের মত যে পরিবেশ তৈরি করে নিয়েছি, তার মধ্যে তুমি অপরিচিত কাউকে আনতে চাও? হঠাৎ করে বাইরে থেকে কেউ এসে আমাদের ওপর খবরদারি করলে সেটা মানতে পারবে?

    –ও আচ্ছা! আপনারা তাহলে সব দিক চিন্তা করেই লুসিয়াকে বাড়ির কত্রী বানাতে চাইছেন!

    –না! কাউকে বাড়ির কত্রী বানাতে চাইছি না। তবে, ছেলের ভবিষ্যৎ স্ত্রী পছন্দ করার অধিকার একজন মায়ের অবশ্যই আছে। আর, এক্ষেত্রে লুসিয়া ছাড়া অন্য কাউকে আমার অতটা উপযুক্ত মনে হয় না। আমার পছন্দে তোমার ভরসা নেই, ফ্রিদি? তোমার কি কখনো মনে হয়েছে, মা তোমার খারাপের জন্য কিছু করবে?

    –ভালো-খারাপের কথা এটা নয়। আমি আসলে বলতে চাইছি, ছোটবেলা থেকেই লুসিয়াকে নিজের বোনের মত দেখে আসছি। ওকে আমি কখনোই অন্য দৃষ্টিতে দেখতে পারবো না, ভালোবাসতে পারবো না।

    –ভালোবাসা? ভালোবাসার মত অনিশ্চিত জিনিস জগতে আর দ্বিতীয়টি নেই, মুহূর্তের বাতাসেই এটি উবে যায়। তাই ভালোবাসার ওপর। আস্থা রাখা নিতান্ত বোকামি ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু বন্ধুত্ব, বিশ্বাস, ধর্মীয় আচরণ, সমমানসিকতা আর দীর্ঘদিনের পরিচয়, এই ব্যাপারগুলো একটা সুখী দাম্পত্য জীবনের নিশ্চয়তা দেয়। এর সবগুলো গুণ লুসিয়ার মধ্যে আছে। ও তোমার জীবনকে ভরিয়ে তুলবে। তুমি যেভাবে চাইবে ওকে নিয়ে সেভাবেই জীবন গড়ে তুলতে পারবে।

    ফ্রিদিওফের সামনে একটাই পথ খোলা ছিল–মায়ের কাছে সময় চেয়ে নেয়া। অগত্যা, সে তা-ই করল। চিন্তা-ভাবনার কথা বলে মায়ের থেকে কিছুদিন সময় চেয়ে নিল। ইতোমধ্যে, বাড়ির সবাই যেন রাতারাতি সুস্থ হয়ে উঠল! ফলে, ডাক্তার ভদ্রলোকের এ-বাড়িতে আসা বন্ধ হল। তবুও, হঠাৎ কেন যেন তাঁকে একদিন ডাকা হল। আসার পর ভদ্রলোক বেশ অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়লেন–সবার ব্যবহারে স্পষ্ট অবজ্ঞা। মানুষ। হিসেবে তিনি যথেষ্ট বিচক্ষণ–মূল ঘটনা বুঝতে তাঁর মোটেও সময় লাগল না। তাই কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলেন। পেছন থেকে ফ্রিদিওফ ডাকলেও, না-শোনার ভান করলেন। এভাবেই, দুই পরিবারের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ইতি ঘটলো।

    ফ্রিদিওফ কেমন ঝিমিয়ে পড়ল।

    ওদিকে, নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে বাড়ির ভেতর নানা অদ্ভুত কর্মকাণ্ড শুরু হল। ফ্রিদিওফের ওপর খালাদের ভালোবাসা ঝরে পড়তে শুরু করল। এমনভাবে তারা যত্নআত্তি শুরু করল যেন ফ্রিদিওফ নিতান্ত নাদান শিশু, আর তাদের দেখভাল ছাড়া ওর পক্ষে বেঁচে থাকাই সম্ভব নয়! বোনদের আচরণেও লক্ষণীয় পরিবর্তন–তারাও বেশি বেশি যত্নআত্তি করার জন্য একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ল! আর, এতকিছুর সমানতালে লুইসারও নিজের পোশাকআশাকের প্রতি সচেতনতা বাড়তে থাকল। সে এখন বেশ আটোসাটো জামা পড়ে, বেণি করে চুল বাঁধে। সুন্দরীতে তাকে কোনওমতেই বলা যায় না; তবে তার চোখ দুটো বেশ শান্ত, সে কথা সত্য। তার চেয়েও বড় সত্য হচ্ছে–তার বাকপটুতা!

    ফ্রিদিওফ আগের মতই উদাস হয়ে রইল। যতদিন লুইসার ব্যাপারে কোন চিন্তা ছিল না, ততদিন সে কখনোই লুইসাকে একজন পুরুষ মানুষের দৃষ্টি দিয়ে দেখেনি। কিন্তু ঐদিন মায়ের সাথে কথা বলার পর থেকে লুইসাকে দেখলেই কেমন যেন অস্বস্তি লাগে; বিশেষ করে, যখন মনে হয় লুইসা যেন গায়ে পরে ভাব জমানোর চেষ্টা করছে। ফ্রিদিওফ যেখানেই যায় সেখানেই লুইসার সঙ্গে দেখা হয়–সিঁড়িকোঠায়, বাগানে, এমনকি ঘোড়ার আস্তাবলেও! একদিনতো সকালবেলা ওর রুমের মধ্যেই এসে হাজির। ফ্রিদিওফ তখনও বিছানা ছাড়েনি। লুইসা এসে এমন ভাব করল যেন তার মোটেই আসার ইচ্ছা ছিল না। লাজুক-লাজুক ভাব দেখিয়ে ফ্রিদিওফের কাছে একটা সেফটিপিন চাইল! ফ্রিদিওফ শুরুতে বুঝতেই পারলো না ঘটনা কী। চোখ রগড়ে নিয়ে দেখল লুইসা একটা ড্রেসিং জ্যাকেট পরে সামনে দাঁড়িয়ে আছে! দেখে রীতিমত হতভম্ব হয়ে গেলেও সেটা প্রকাশ না করে, কেবল মুখ দিয়ে একটা বিরক্তিসূচক আওয়াজ করলো। এ-জাতীয় নানা কারণে লুইসার প্রতি একরকম বিতৃষ্ণা অনুভব করছিল ফ্রিদিওফ; কিন্তু ওকে মন থেকে একেবারে ঝেড়ে ফেলতেও পারছিল না। ওদিকে, মা ছেলের মধ্যে একের-পর-এক বৈঠক চলছিলো। সাথে খালা আর বোনদের নানা উৎসাহ-উদ্দীপনাতো আছেই। সব মিলিয়ে ফ্রিদিওফের জীবনটা যেন মস্ত এক বোঝায় পরিণত হল, যেন চারদিক থেকে একটা জালে আটকা পড়ে গেছে। এ জাল ছিন্ন করে বেরোবার পথ তার জানা নেই। লুইসাকে এখন বোন বা বান্ধবী কোনটাই মনে হয় না, আবার ভিন্ন কিছুও মনে করতে পারে না। তবে সারাক্ষণ ওর সাথে বিয়ের কথা শুনতে শুনতে এতদিনে মনে হয়েছে–“হ্যাঁ, লুইসা একজন নারী। যদিও এক অসহ্য নারী, তবু সত্যি কথাটা হচ্ছে, সে নারী। হয়তো ওর সাথে বিয়ে হলে হতেও পারে। যদি সত্যিই হয়, তবে দুজনের মধ্যে সম্পর্কের পরিবর্তন হবে। হয়তো নতুন সম্পর্কটা হবে আবেগ-অনুভূতিহীন শুধুই একটা বন্ধনের মত।” এসব নানা চিন্তায় বুঁদ হয়ে রইল ফ্রিদিওফ। বাড়ির আশেপাশে আপাতত কোন তন্বী-তনয়া ছিল না। অতএব, ওর চিন্তাগুলো বুদবুদের মত উড়ে যেতেও খুব বেশি সময় লাগলো না–“লুইসাও হয়ত আর দশটা মেয়ের মতই হবে।” এবারে ফ্রিদিওফই আগে মায়ের কাছে গেল–“বিয়ে আমি করতে পারি, তবে শর্তসাপেক্ষে: বাড়ির একাংশের পুরো কর্তৃত্ব আমার হাতে থাকবে, আমি যেভাবে চাইব সেভাবেই চলবে; আর আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্রে কেউ হাত দিতে পারবে না।” এরপর ফ্রিদিওফকে কিছুটা নির্ভার মনে হল। ফিরে আসার সময় আরও জানালো, বিয়ে নিয়ে আর কোন কথাই সে বলবে না, মাকেই পরবর্তী সকল পদক্ষেপ নিতে হবে।

    ফ্রিদিওফের শর্তাবলী সানন্দে গৃহীত হল। বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হতেও দেরি হল না।

    লুইসাকে ডেকে সিদ্ধান্তের ব্যাপারে জানানো হল। সেসময় ফ্রিদিওফও সেখানে উপস্থিত ছিল। হঠাৎ এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। ওরা দুজনেই কেন যেন কান্না করে দিল! আবার যেমন হঠাৎ শুরু হয়েছিল তেমন হঠাৎ করেই কান্নাকাটি থেমেও গেল। এ-নিয়ে দুজনে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। সারাদিন আর কেউ কারো মুখের দিকে তাকাতে পারল না। সবকিছু স্বাভাবিক হতে বেশ কিছুটা সময় নিল। ওদিকে খালা-বোনদের দরদ দিন দিন উথলে পড়ছে। কী ছেড়ে কী করবে তার কোন হিসেব নেই। বাড়ির দরজা-জানালায় নতুন রং পড়ল, ঘরদোর গোছগাছ হল, আরও কত কি! আর, এ সব হল ফ্রিদিওফের সঙ্গে ন্যূনতম আলোচনা বা পরামর্শ ছাড়াই।

    বিয়ের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন। যেখানে যে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আছেন সবাইকে দাওয়াত করা হল এবং…

    এবং বিয়ে সম্পন্ন হল।

    *** *** ***

    বিয়ের প্রথম সকালে খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠল ফ্রিদিওফ। বিছানা বালিশ ছেড়ে যত দ্রুত সম্ভব বাইরে বের হল। এমন একটা ভাব যেন বাইরে ভীষণ জরুরি কোন কাজ পড়ে আছে। লুইসা তখনও ঘুম থেকে না

    উঠলেও সঙ্গোপনে সব কিছুই লক্ষ্য করছিল। ফ্রিদিওফের ঠিক বেরোবার মুখে পেছন থেকে বলে উঠল

    “১১টায় ব্রেকফাস্টের কথা ভুলো না কিন্তু।” কথাগুলো অনেকটা আদেশের মত শোনালো।

    শোনার ভান করে নিজের পড়ার রুমে গেল ফ্রিদিওফ। শু্যটিং স্যুট আর ওয়াটারপ্রুফ জুতা পরল। তারপর, খুব সাবধানে ওয়্যারড্রোব থেকে নিজের বন্দুকটা বের করে নিল–এ জিনিসটার কথা এতদিন সে গোপনই রেখেছে। সবকিছু বেশ গুছিয়ে নিয়ে বনের পথে হাঁটা ধরলো।

    সময়টা অক্টোবর মাস। চারপাশ সাদা বরফে ঢাকা পড়েছে। ফ্রিদিওফ বেশ দ্রুত হাঁটছে। দেখে মনে হচ্ছে, যেন কোন পিছুটান এড়িয়ে পালাতে চাইছে। তবে সকালের নির্মল বাতাস কিছুক্ষণ পর ওর মনোভাবে পরিবর্তন আনল। ধীরে ধীরে নিজেকে ফিরে পেতে শুরু করল ফ্রিদিওফ। বেশ তরতাজা লাগছে এখন। নিজেকে একজন পূর্ণ-স্বাধীন মানুষ বলে মনে হচ্ছে। কারণ এই প্রথম তার আজন্ম লালিত স্বপ্ন–বন্দুক নিয়ে বাইরে। যাওয়া–সত্যি হল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই এই আপাত-স্বাধীনতার ভাব ফিকে হয়ে এল। এতদিন পর্যন্ত অন্তত একান্ত ব্যক্তিগত একটা শোবার ঘর ছিল, দিনের বেলা ওখানে বসে চিন্তা-ভাবনা করা যেত, রাতের বেলা সেখানে স্বপ্নেরা হানা দিত। এখন যে সেটুকুও অবশিষ্ট রইল না! আরেকজনেরর সঙ্গে শোবার ঘর ভাগ করে নেয়ার চিন্তাটা খুব বাজে লাগে। পুরো ব্যাপারটাকে কেমন একটা নোংরামি বলে মনে হয়। মানব চরিত্রের। বুনো বৈশিষ্ট্যটাকে এভাবে উন্মুক্ত করে দেয়ার কথা কখনো কল্পনাও করেনি ফ্রিদিওফ। কারণ ও বেড়ে উঠেছে অনেকগুলো আদর্শকে সামনে রেখে। নিজের পরিবারের ভেতর এমনটা কখনো হতে দেখেনি। সত্যি কথা বলতে কী, সংসার জিনিসটা ও কখনো কাছ থেকে দেখেইনি। তাই, একজন পুরুষ এবং একজন নারীর একসঙ্গে থাকার চিন্তাটা ওর কাছে নৈতিকতার স্পষ্ট স্থলন বলে মনে হয়। এ যেন লজ্জা-শরমের আবরণকে টেনে ছিঁড়ে ফেলা, সমস্ত পেলবতাকে ছুঁড়ে ফেলা, মানুষের শ্রেষ্ঠত্বকে ধ্বংস করা। এমনকি বিয়ে করা সত্ত্বেও, নারী-পুরুষের মিলনকে সে কিছুতেই মন থেকে মেনে। নিতে পারছে না। এ-তো মিলন নয়, এ-তো দুটো মানুষের মধ্যে নিছক নোংরামি! ফ্রিদিওফের মনে হল, এই জংলি ব্যাপারটার ভয় থেকেই হয়ত ‘নারীত্ব’ চিন্তাটার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে কি এ কথা খাটে? যদি ডাক্তারের মেয়ে কিংবা সেই মালির মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হত, তাহলে কি সেখানে ভয় বলে কিছু থাকত? বরং, একাকী তাকে কাছে পাওয়াটাকে এক ধরনের আশীর্বাদ বলে মনে হত। তখন তাদের মিলন শুধু ‘জৈবিক চাহিদা পূরণের মাধ্যম না হয়ে, আত্মিক বোঝাপড়ার আনন্দে উদ্বেলিত হতে পারত। আফসোস! লুইসার সঙ্গে এগুলোর কোনটাই সম্ভব নয়। এমনকি, ওর সঙ্গে একা দেখা করার চিন্তাটার মধ্যেও কেমন বিশ্রী একটা নিরাসক্ততা আছে।

    এ-জাতীয় এলোমেলো চিন্তা করতে করতে বনের মধ্যে উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াতে লাগত ফ্রিদিওফ। কী শিকার করবে, কীভাবে শিকার করবে, কোন কিছুই মাথায় এল না। শুধু মনে হচ্ছিল–একটা গুলির আওয়াজ হবে, আর কিছু একটা মারা পড়বে। কিন্তু, মরার জন্য কোন কিছুই বন্দুকের সামনে এল না। মনে হচ্ছে, যেন হঠাৎ করে কোন কারণ ছাড়াই পুরো বনটা পাখিশূন্য হয়ে গেছে, অন্য কোন জন্তু-জানোয়ারও নেই। সহসা একটা কাঠবিড়ালী চোখে পড়ল। সুড়সুড় করে পাইনগাছে উঠছিল, এক ফাঁকে ফ্রিদিওফের দিকে চকচকে চোখে চেয়ে, আবার সুরুৎ করে ছোট্ট লাফ দিল। সঙ্গে সঙ্গে ট্রিগার চেপে দিল ফ্রিদিওফ–ব্যর্থ প্রচেষ্টা। কাঠবিড়ালীটা এর মধ্যেই অন্যপাশে চলে গেছে। ফলে, গুলিটা গিয়ে গাছের গায়ে বিধে রইল। একটা লাভ অবশ্য হল–গুলির আওয়াজের পর কিছুক্ষণের জন্য চারপাশে এক ধরনের নিস্তব্ধতা তৈরি হল, পুরো বন যেন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রিদিওফ খুব উপভোগ করলো ব্যাপারটাকে, লম্বা করে শ্বাস নিলো। তারপর, হাঁটাপথ ছেড়ে হনহন করে বনের আরও গহীনে পা বাড়ালো। পথিমধ্যে যত ছত্রাক, ব্যাঙের ছাতা বা ছোটখাটো গাছপালা পড়ল সব দুমড়ে-মুচড়ে একাকার করে ফেললো। ফ্রিদিওফের ওপর যেন কিছু ভর করেছে আজ! সবকিছু ধ্বংস করে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কোন সাপ কী এ-জাতীয় কিছু যদি চোখে পড়ে, তাহলে পায়ের তলায় খুব করে পিষে মারবে ওটাকে; না-হলে গুলি করে শেষ করে দেবে, তাতে যদি গায়ের জ্বালা জুড়ায়!

    হঠাৎ করেই সম্বিত ফিরে পেল ফ্রিদিওফ–বাড়ি ফিরতে হবে, আজ তার বিয়ের প্রথম সকাল। কিন্তু বাড়ি ফিরলে সবাই যে দৃষ্টিবাণ নিক্ষেপ করবে, সেটা মনে করেই নিজেকে অপরাধী মনে হল। যেন সভ্যতার বিরুদ্ধে, প্রকৃতির বিরুদ্ধে, ঘোরর কোন অন্যায় করে ফেলেছে। “ইস! এই পৃথিবী ছেড়েছুঁড়ে যদি ভিন্ন কোথাও চলে যাওয়া যেত! কিন্তু সেটাই বা কীভাবে সম্ভব?” এই জাতীয় নানা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে-খেতে ক্লান্ত করে তুলল ফ্রিদিওফকে। কিছুক্ষণ পর ভীষণ ক্ষুধা অনুভব করলো–“নাহ্! বাড়ি ফিরতে হবে, ব্রেকফাস্ট করতে হবে।”

    বাড়ির গেটে এসে হতভম্ব হয়ে গেল ফ্রিদিওফ। মনে হল, যেন ওকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য গোটা বাড়ির অতিথিরা গেটে এসে দাঁড়িয়েছে। ওকে দেখামাত্র সবাই চিৎকার করে উঠল। এলোমেলো পা ফেলে বাড়ির দুয়ার পার হলো ফ্রিদিওফ। এদিক-ওদিক থেকে নানাজন, নানাভাবে, ‘শরীর কেমন আছে?’ জিজ্ঞেস করে হাসি-ঠাট্টা করছিল। কিন্তু ফ্রিদিওফ এসবের কোন কিছুতেই কান না-দিয়ে, মুখ ফিরিয়ে নিজের ঘরে চলে এল। লক্ষ্যই করল না, সবার মাঝে ওর স্ত্রী-ও ছিল। হয়তো আশা করেছিল, ফ্রিদিওফ এসে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করবে!

    খাবার টেবিলে বহুমুখি যন্ত্রণা সহ্য করতে হল। এ-এমনই যন্ত্রণা, মনে হল যেন অনন্তকাল দগ্ধ হতে হবে। অতিথিদের চটুল কথাবার্তা, আর ‘বিজ্ঞ পরামর্শে গা জ্বলতে থাকল। এর মধ্যে আবার যোগ হল লুইসার গায়েপরা ন্যাকামি! সবমিলিয়ে, যে-দিনটা জীবনের সবচেয়ে আনন্দের হতে পারতো, সেটাই আজ ফ্রিদিওফের জন্য সবচেয়ে জঘন্য দিনে পরিণত হল।

    *** *** ***

    কয়েক মাসের মধ্যেই নববধূ বাড়িতে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলল। এ ব্যাপারে ফ্রিদিওফের খালা আর বোনেরা হল তার বিশ্বস্ত সহযোগী। ফলে ফ্রিদিওফ বরাবরের মতই বাড়ির সবচেয়ে নিগৃহীত সদস্য হয়ে রইল। কালেভদ্রে অবশ্য, এটা-ওটা নিয়ে ওর পরামর্শ চাওয়া হত, কিন্তু সে পর্যন্তই পরামর্শের বাস্তবায়ন হত না কখনোই। এমন আচরণ করা হত যেন ও এখনও সেই শিশুটিই আছে!

    ফ্রিদিওফের সঙ্গে একা বসে খাওয়াটা কিছুদিনের মধ্যেই লুইসার কাছে অসম্ভব বলে মনে হতে লাগলো। কারণ খাবার টেবিলে ফ্রিদিওফ ইচ্ছে করেই ভীষণরকম নীরব থাকত। এরকমটি সহ্য করা লুইসার পক্ষে সম্ভব ছিল না। খাবার টেবিলে নানারকম গপ্পো করার অভ্যাস ছিল তার। অতএব, অচিরেই খাবার টেবিলে ফ্রিদিওফের বোনদের একজন এসে জুটলো। এহেন নানাবিধ যন্ত্রণায় জীবনটা কেমন বদ্ধ হয়ে গেল। একাধিকবার নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করলেও প্রতিপক্ষের সামর্থ্যের বিপরীতে সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হল। প্রতিপক্ষ সংখ্যায় অনেক বেশি হওয়ায় এরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক। ওরা এমনভাবে খোঁচা দিয়ে কথা বলত যে, অস্থির হয়ে ফ্রিদিওফকে বনে পালিয়ে বাঁচতে হত।

    রাত্রিগুলো ছিল সাক্ষাত আতঙ্ক! শোবার-ঘর জায়গাটাকে রীতিমত ঘৃণা করত ফ্রিদিওফ। ওটাকে মনে হত যেন ফাঁসির মঞ্চ! ধীরে-ধীরে ও আরও বেশি খিটখিটে হতে থাকল। আশেপাশের সবাইকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল।

    বিয়ের এক বছর পার হল। তখনও সন্তান হবার কোন লক্ষণ নেই মায়ের কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ। একদিন ফ্রিদিওফকে এককোনে ডেকে নিলেন তিনি,

    –“তোমার কি ছেলের মুখ দেখতে ইচ্ছে করে না?” মায়ের গলাটা মিনমিনে শোনালো।

    –“অবশ্যই করে” ফ্রিদিওফের জোরালো জবাব।

    –“কিন্তু… কিন্তু তুমি বোধহয় তোমার স্ত্রীর সঙ্গে খুব-একটা ভালো ব্যবহার করছ না।” যতটা সম্ভব অস্বস্তি এড়িয়ে, আলগোছে কথাগুলো বলে ফেললেন মা।

    এবারে ফেটে পড়ল ফ্রিদিওফ।

    –“কী বলতে চান আপনি? আমার দোষ? আপনি কি চান আমি সারাদিন এসব নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করি! লুইসাকে চেনেন না আপনি? ওর স্বভাব জানেন না? এগুলো কি শুধু আমার একার দায়িত্ব? আপনি এমন পক্ষপাতিত্ব করলে আমার পক্ষে কোন জবাব দেয়া সম্ভব না!”

    কথাগুলো মায়ের মুখের ওপর ছুঁড়ে ফেলে বাইরে চলে গেল ফ্রিদিওফ। তবে মা কিন্তু সময় পেলেই ওই একই অভিযোগ করেন।

    ধীরে-ধীরে ফ্রিদিওফ আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়ল, ভীষণ একাকীত্ব গ্রাস করল। শেষমেষ, বন্ধুত্ব পাতাললা বাড়ির কেয়ারটেকারের সাথে। কেয়ারটেকার লোকটা বয়সে তরুণ। মদ আর জুয়ায় দারুণ আসক্তি। অভ্যাসগুলো রপ্ত করতে ফ্রিদিওফেরও সময় লাগলো না। ফলে কেয়ারটেকারের রুমেই আজকাল বেশিরভাগ সময় কাটে। রাতে ঘরে ফেরে অনেক দেরি করে। এভাবেই দিন ফুরায়।

    এক রাতে বাড়ি ফিরে দেখলো স্ত্রী তখনও জেগে আছে–ওর জন্য অপেক্ষা করছে।

    –“কোথায় গিয়েছিলে?” কড়া গলায় জিজ্ঞেস করল স্ত্রী।

    –“সেটা আমার নিজস্ব ব্যাপার।” স্ত্রীর প্রশ্নটা উড়িয়ে দিল ফ্রিদিওফ। স্ত্রীও দমে যাওয়ার পাত্রী নয়,

    –বিয়ের পর স্বামী না-থাকাটা খারাপ না! অন্তত, একটা সন্তান যদি থাকত!

    –সেটা কি আমার দোষ?

    –নয়তো কি আমার?

    কার দোষ আর কার নয়, তা নিয়েই এক তুলকালাম কাণ্ড বাঁধলো। শুরু হলো বাকবিতণ্ডা, কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলতে রাজি নয়! যেহেতু দুজনেই ভীষণ একগুঁয়ে, কেউই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে গেল না। অতএব, যা হবার তা-ই হলো, বিবিধ মতের বিবিধ কানাঘুষা! স্বামীকে নিয়ে মানুষজন চটুল রসিকতা করে, আর স্ত্রীকে সহ্য করতে হয় অসহ্য গঞ্জনা। আশেপাশের মহিলারা স্বামীর কানে বিষ ঢালে, টিপ্পনী কাটে

    “বাজা মেয়েদেরকে আসলে ভক্তিই করা উচিত! ঈশ্বরের অভিশাপগুলো সব ওরা নিজেদের ঘাড়ে নিয়ে নেয় যে!”

    এই মহিলারা কখনো চিন্তাও করত না, ঈশ্বরের অভিশাপ পুরুষের ঘাড়েও পড়তে পারে।

    তবে ফ্রিদিওফের কোন সন্দেহ ছিল না, ঈশ্বরের অভিশাপ ওর ঘাড়েই পড়েছে। না-হলে জীবনটা কখনো এত বিবর্ণ, এত নিরানন্দ হতে পারে না। প্রকৃতি দুটি ভিন্ন লিঙ্গের মানুষ তৈরি করেছে–পুরুষ আর নারী। এ ভিন্ন লিঙ্গের মানুষদের মাঝে কেউ কখনো শত্রু, কখনোবা বন্ধুর দেখা পায়। নিজেকে অভিশপ্ত এ-কারণেই মনে হয় যে, সে দেখা পেয়েছে শত্রুর এক ভীষণ শত্রু, যাকে কোনভাবেই সহ্য করা যায় না।

    *** *** ***

    একদিনের ছোট্ট একটা ঘটনা ফ্রিদিওফের শেষ শক্তিটুকুও কেড়ে নিল। বোনদের একজনের সামনে দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ করে বোনটি জিজ্ঞেস করে উঠল,

    –আচ্ছা, ‘খোঁজা’ কাকে বলে?

    বোনটি আপনমনে সেলাই করছিল। বিশেষ কিছু বোঝানোর জন্য সে প্রশ্নটা করেনি। ফ্রিদিওফ প্রথমে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালেও পরক্ষণেই সান্তনা নিলো–“ও হয়ত আসলেই শব্দটার অর্থ জানে না! হয়ত কোথাও কারোও মুখে শুনে প্রশ্ন জেগেছে, তাই জিজ্ঞাসা করেছে।” তবুও বুকের ভেতর কোথায় যেন চিনচিনে একটা ব্যথা অনুভব করলো ফ্রিদিওফ। উত্তর পেতে দেরি হওয়ায় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল বোনটি। এবার সন্দেহের তীর এসে গায়ে বিধল। মনে হল, চারপাশের সবাই যেন আড়াল থেকে ওকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। কোনদিকে না-তাকিয়ে হনহন করে বাইরে চলে গেল ফ্রিদিওফ। কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে, রাগের মাথায়, কাজের মেয়েদের একজনকে ধর্ষণ করে বসল। ফলাফল পেতেও দেরি হল না। যথাসময়ে সন্তানের আগমন ঘটলো।

    এবার, মানুষের দৃষ্টিতে স্বামী-স্ত্রীর অবস্থান উল্টে গেল। লুইসার প্রতি সবার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল, যেন সে বিশাল কোন আত্মত্যাগ করে ফেলেছে, আর ফ্রিদিওফ হলো ‘কুলাঙ্গার’, ‘দুশ্চরিত্র। কিন্তু এসবের কোনকিছুই ওকে স্পর্শ করল না। ও বরং মনে মনে ব্যাপারটার একটা যুতসই ব্যাখ্যা দাঁড় করালো–“এ ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে, সন্তান না-হবার দোষটা আসলে তার নয়, সে নিখুঁত। আর, নিখুঁত হয়ে জন্মানোটা শুধু সৌভাগ্যেরই নয়, বিরাট সম্মানেরও ব্যাপার। তবে পুরো ব্যাপারটা লুইসার মধ্যে কেমন একটা ঈর্ষার ভাব জন্ম দিল। তার চেয়েও অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, ঈর্ষাটা কীভাবে যেন ‘পতিভক্তি’র রূপ নিল। কিন্তু এ জাতীয় ভক্তি-ভালোবাসায় ফ্রিদিওফ আগের চেয়ে বরং বেশি বিরক্ত হলো। অবিরাম নজরদারি আর ব্যক্তিগত ব্যাপারে অনধিকারচর্চা কারোরই ভালো লাগার কথা নয়। মাঝে মাঝে এমনকি ভীষণ ছোটখাটো বিষয় নিয়েও লুইসা এমন ব্যাকুলতা দেখাতো যে, ফ্রিদিওফ মেজাজ খারাপ না-করে পারত না–“বন্দুকটা ভুলে লোড করা নেইতো?” কিংবা বাইরে যাবার সময়, “ওভারকোট পরেছেতো?” দৈনন্দিন বিষয় নিয়ে এ-জাতীয় বাড়াবাড়ি মোটেই পছন্দ হচ্ছিল না ফ্রিদিওফের। ওর ঘরের প্রতিটি জিনিস ভীষণ পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা হত। সেই সাথে সারাদিনজুড়ে থোয়ামোছা তো আছেই! প্রতি শনিবার ঘরের সব জিনিসপত্র বাইরে বের করে কার্পেট পরিস্কার করা হত, কাপড়চোপড় রোদে দেয়া হত। এ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযানের যন্ত্রণায় ঘরে থাকার শান্তিটুকুও উধাও হল।

    সারাদিনে করার মত তেমন কোন কাজ ছিল না ফ্রিদিওফের। কাজের লোকেরাই সব করে দিত। মাঝে কিছুদিন চাষবাস নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখল ওতে আরও উন্নতি করা যায় কি না। কিন্তু কয়েক দিন পরই হাল। ছেড়ে দিলো–যে মানুষ নিজের ঘরের উন্নয়ন করতে পারে না, সে বাইরের উন্নয়ন কী করবে?

    একসময় পুরোপুরি হতোদ্যম হয়ে গেল ফ্রিদিওফ। কথাবার্তা বলা প্রায় ছেড়েই দিল; কারণ সে যা-ই বলার চেষ্টা করে তার-ই বিরোধিতা করা হয়। মনের মত কোনও বন্ধু-বান্ধবও নেই যার কাছে একটু হালকা হওয়া যায়। মাথার ভেতরটা সারাক্ষণ কেমন অসার হয়ে থাকে। আবেগ-অনুভূতিগুলোও আজকাল আর আগের মত কাজ করে না–কোনকিছুর প্রতিই কোন টান। অনুভব করে না। সব কিছু ভুলে শেষমেষ মদের নেশায় আসক্ত হলো ফ্রিদিওফ।

    *** *** ***

    ফ্রিদিওফ এখন বলতে গেলে বাড়িতেই ফেরে না। হরহামেশা ওকে বিভিন্ন হোটেলে বা ফার্মের মজুরদের ডেরায় মদ্যপ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। উঁচু-নিচু সব শ্রেণির মানুষের সাথে বসে মদ্যপান করে। সারাদিন মদের ওপরই থাকে। অপরিচিত মানুষের সাথে অনর্গল কথা বলতে ভালো লাগে ওর। আর এর সুবিধার্থে মদ্যপান করে মস্তিষ্ককে উত্তেজিত রাখে। ঐসব মানুষের সাথে বেশি বকবক করে যারা কখনো কোন ব্যাপারে বিরোধিতা করে না। তবে শুধুমাত্র এ-জাতীয় মানুষের সাথে বকবক করার সুবিধার্থেই, নাকি নিছক মাতাল হওয়ার জন্য, ঠিক কোন কারণে যে সে মদ্যপান করে তা বলা মুশকিল।

    বাড়ির টাকা-পয়সার হিসাব নারী সম্প্রদায়ের কাছেই থাকে। ফলে টাকা জোগাড় করতে ফার্মের জিনিসপত্র বেচতে শুরু করল ফ্রিদিওফ। শেষ। পর্যন্ত নিজের সিন্দুক থেকেও জিনিসপত্র সরাতে লাগলো।

    ইতোমধ্যে বাড়িতে একজন নতুন কেয়ারটেকার রাখা হয়েছে। আগের কেয়ারটেকারকে অসংলগ্ন আচরণের জন্য বরখাস্ত করা হয়েছে। নতুন লোকটা ভীষণ গোঁড়া। চার্চে নিয়মিত যাতায়াত তার। এখানে এসেই স্থানীয় পাদ্রিদের সহায়তায় মদের দোকানের লাইসেন্স বাতিল করিয়েছে। এতে ফ্রিদিওফ পড়লো মহা ফাঁপরে নতুন আখড়া খুঁজতে হল। অবশ্য পেতেও খুব-একটা দেরি হল না–ফার্মের মজুরদের ডেরায় বসে গেল। একের পর এক নতুন নতুন কেলেঙ্কারি রটতে লাগলো। ফ্রিদিওফ ওসবের তোয়াক্কা করে না। দিনে দিনে ও এমন পাড় মাতাল হয়ে গেল যে মদ্যপান করতে না-দিলে শরীরে খিচুনি শুরু হয়ে যায়।

    শেষ পর্যন্ত ফ্রিদিওফকে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হল। কিন্তু বিশেষ লাভ হলো না। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নিরাময় অযোগ্য রোগী হিসেবে ওকে আলাদা করে ফেলা হলো।

    *** *** ***

    সময় পেলেই ফ্রিদিওফ এখন জীবনের দিকে ফিরে তাকায়। পুরো জীবনকে একনজরে দেখতে চায়। সবাইকে নিয়েই চিন্তা করে নিজেকে নিয়ে, পরিবারকে নিয়ে, স্ত্রীকে নিয়ে, সবকিছু নিয়ে। সবচেয়ে মন খারাপ হয় মেয়েদের কথা চিন্তা করলে ভবিষ্যৎ স্বামীকে না চিনে, তার প্রতি কোন ভালোবাসা না-থাকা সত্ত্বেও যেসব মেয়ে বিয়ে করতে বাধ্য হয়, তাদের কথা চিন্তা করলে মনটা করুণায় ভরে যায়। ফ্রিদিওফ জানে এই অনুভূতি কতটা গভীর; কারণ, নিজের জীবন দিয়ে এ-অনুভূতির গভীরতা মেপেছে সে। এ-অনুভূতি এক অভিশাপের নামান্তর, যে অভিশাপ প্রকৃতির কোন নিয়ম ভঙ্গ করলে পেতে হয়। ফ্রিদিওফের বেলাতেও প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গ হয়েছে। তাই এখন তার সমস্ত দুঃখের কারণ হিসেবে সে পরিবারকে দায়ী করে–“সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে, পরিবার কখনোই একটি শিশুকে যথাসময়ে স্বতন্ত্র সত্ত্বা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে দেয় না।”

    স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই ফ্রিদিওফের–পবিত্র অনুশাসনের দোহাই দিয়ে বিয়ের নামে যেসব শর্তাবলী চাপিয়ে দেয়া হয়, সেগুলোর ভারে তার স্ত্রী-ও কি সমানভাবে জর্জরিত হয়নি?

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগোবিন্দ দাস কৃত পদাবলী – অক্ষয়চন্দ্র সরকার সম্পাদিত
    Next Article কল্লোল যুগ – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }