Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    এ ডলস হাউস – অগাস্ট স্ট্রিনডবার্গ

    লেখক এক পাতা গল্প166 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ফিনিক্স

    ছেলেটা যখন প্রথমবার পাদ্রির বাড়িতে মেয়েটাকে দেখল তখন সময়টা খুব সুন্দর ছিল। বুনো স্ট্রবেরিগুলোতে সবেমাত্র রং ধরেছে। এর আগেও ও অনেক মেয়ে দেখেছে; কিন্তু এমন কখনো মনে হয়নি। কেমন বুকের মধ্যে ধুকপুক করা, কেমন শিহরণ বয়ে যাওয়া–একেই বোধহয় প্রেম’ বলে! মুখ ফুটে বলার মত সাহস তখনো হয়নি, অথচ মেয়েটা কিন্তু ঠিকই ওকে ‘স্কুলবয়’ বলে খ্যাপাত।

    দ্বিতীয়বার যখন দেখা হল, ছেলেটা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। আগের চেয়ে সাহস বেড়েছে। ফলে দূরত্ব কমেছে। মেয়েটাকে ও জড়িয়ে ধরল, চুম্বন করল। তখন মনে হল, যেন চারপাশে আতশবাজি ফুটছে, ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজছে, বিউগলের সুরে চারদিক মুদ্রিত হচ্ছে, পায়ের নিচের দুনিয়া যেন থরথর করে কাঁপছে।

    মেয়েটার বয়স ১৪। শরীরে সবেমাত্র যৌবনের আনাগোনা। তার নিটোল কটিদেশ, ছন্দোবদ্ধ চলন, চারপাশে এক যাদুকরী মোহময়তা সৃষ্টি করে। বিশুদ্ধ মধুর মত স্বর্ণালী চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যখন বুক আর মুখের ওপর ছড়িয়ে পড়ে, মনে হয় যেন জ্যোতিষ্কের উজ্জ্বলতা ঠিকরে বেড়ুচ্ছে। চোখদুটো যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, যে-কেউ সে চোখে চোখ রাখলে মতিভ্রম হতে বাধ্য। মোলায়েম ত্বক যেন ঘুঘু পাখির মতই কোমল। ছেলেটার মনে হয়, ও যেন কোনো মর্তবাসী অপ্সরী।

    দুজনের বাগদান হয়ে গেল। সারাদিন ওরা পাখিদের মত কলকাকলিতে মুখরিত থাকে। জীবন যেন সবুজ ঘাসে মোড়ানো এক উদ্যান, যার একটি ঘাসও এখনও মাড়ানো হয়নি। হেসেখেলে দিন যায়। কিন্তু ছেলেটির লেখাপড়া এখনও শেষ হয়নি; বিশেষত খনিজ বিষয়ক পরীক্ষায় এখনও পাশ করা হয়নি। পরীক্ষায় পাশ করা, উচ্চতর গবেষণায় দেশের বাইরে যাওয়া ইত্যাদিসহ সবকিছু মিলিয়ে আরও প্রায় দশ বছর লাগবে। দ…শ বছর। অতএব, বিয়েটা দশ বছর পরেই হবে। এরকম পরিকল্পনা মাথায় নিয়েই ছেলেটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেল।

    গ্রীষ্মের ছুটিতে ছেলেটি আবারও সেই পাদ্রির বাড়িতে ছুটে গেল, প্রিয়তমার সাথে দেখা করল। প্রিয়তমা ঠিক আগের মতই আছে–কানায় কানায় পূর্ণ অটুট সৌন্দর্য। দেখে প্রাণটা ভরে গেল। কয়েকদিন পর ছুটি শেষ করে ছেলেটি আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেল। এভাবে পর পর তিনটি গ্রীষ্মে প্রিয়তমাকে একইভাবে পেল। কিন্তু চতুর্থবার কিঞ্চিৎ পরিবর্তন দেখা গেল–প্রিয়তমার নাকের গোড়ায় ছোট ছোট লাল দাগ, কাঁধটাও যেন খানিকটা ঝুলে পড়েছে।

    ষষ্ঠ গ্রীষ্মে, প্রিয়তমার ভীষণ দাঁত ব্যথা; সেই সঙ্গে স্নায়ুবিক দুর্বলতা। এগুলো তাকে ভীষণ কাবু করে ফেলল। চুলের উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়ে গেল, কণ্ঠস্বর কেমন কর্কশ হয়ে গেল, নাকের চারপাশ কালো-কালো দাগে ভরে উঠলো, চোয়াল বসে গেল। সর্বোপরি, চরম স্বাস্থ্যহানি ঘটল। সে বছর শীতে কাঁপুনি জ্বরও হল। ডাক্তারের পরামর্শে চুল কেটে ফেলতে হল। চুলগুলো যখন আবার বড় হল, দেখা গেল সেগুলো আর আগের মত উজ্জ্বল নেই, কেমন মলিন হয়ে গেছে।

    ছেলেটি প্রেমে পড়েছিল এক স্বর্ণকেশীর। সে স্বর্ণকেশীর মলিন কেশ এখন আর আকর্ষণ করে না তাকে। তাই বলে সে কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতাও করল না। চব্বিশ বছর বয়স্কা সেই মলিনকেশীকেই সে বিয়ে করল, যার উচ্ছ্বাস এখন অনেকটা ভাটার দিকে, যে এখন একটু বড় গলার জামা পড়তে অস্বস্তি বোধ করে। এসব মেনে নিয়েও ছেলেটি মেয়েটিকে ভালোবাসে। ভালাবাসার আবেগ অনেকটা কমে গেছে এই যা। বরং, সেখানে দায়িত্ব ভর করেছে। এই দায়িত্বপূর্ণ ভালোবাসা নিয়েই ওরা বেশ সুখে দিন কাটায়। খনির ছোট শহরটার কোন কিছুই ওদের সুখে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে না।

    সংসারে একে-একে দুটো পুত্র সন্তানের আগমন ঘটলো। স্বামী অবশ্য মনে-মনে কন্যার আশা করছিল। একদিন সে আশাও পূর্ণ হলো। চকচকে চুলের এক কন্যা সন্তান এলো তাদের সংসারে। মেয়ে যেন বাবার চোখের মণি। যত দিন যায় সে দেখতে তত তার মায়ের মত হয়ে ওঠে। দেখতে দেখতে ওর বয়স যখন আট হল, দেখলে মনে হয় যেন ওর মায়ের আট বছর বয়সের কোন ছবি। এই ছোট্ট মেয়েটির জন্য বাবা তার সমস্ত অবসর সময়গুলো উৎসর্গ করেন।

    কন্যার মা সারাদিনই ঘরের কাজে ব্যস্ত থাকেন। ঘর-গৃহস্থালির কাজ করতে-করতে তাঁর হাতে, কপালের কাছে, ভাঁজ পড়ে গেছে। রান্নাঘরে ক্রমাগত উবু হয়ে বসে কাজ করায় কাঁধও ঝুলে পড়েছে। এভাবেই, সংসারে তিনি একেবারে থিতু হয়ে গেছেন। স্বামীর সঙ্গে মন খুলে দুটো কথাও বলা হয় না। দুজনের দেখা হয় কেবল খাবার টেবিলে, আর রাতের বেলা। অবশ্য, এসব নিয়ে তাদের কোন অভিযোগও নেই–সত্যিটা তো এমনই, জীবনের গতি বদলায়।

    *** *** ***

    বাবার জীবনের একমাত্র সুখ তাঁর কন্যা। মনে হয়, বাবা যেন মেয়ের প্রেমে পড়েছেন! মেয়ের মধ্যে তিনি মেয়ের মায়ের ছায়া খুঁজে পান। মেয়ের মাকে প্রথম দেখে যে অনুভূতি হয়েছিল, মেয়েকে দেখেও তড়িৎ সে অনুভূতি খেলে যায়। যে-কারণে মেয়ের উপস্থিতিতে বাবা বেশ সচেতন আচরণ করেন। মেয়ের পোষাক-আশাক পরিবর্তনের সময় কখনো তার রুমে যান না। সর্বোপরি, মেয়েকে যেন পরম শ্রদ্ধায় পূজা করেন তিনি।

    এক সকালে মেয়ে হঠাৎ বিছানায় পড়ল। উঠে দাঁড়ানোর কোন লক্ষণ নেই। মা ভাবলেন মেয়েকে আলসেমিতে পেয়েছে। তাই তেমন গা করলেন না। বাবা কিন্তু দুঃশ্চিন্তায় পড়লেন। তড়িঘড়ি করে ডাক্তার ডাকলেন। ডাক্তার যা বললেন তাতে সমস্ত বাড়ি মৃত্যুপুরীর মত নীরব হয়ে গেল। “ডিপথেরিয়া”। এমতাবস্থায়, অন্য বাচ্চাগুলো এখানে থাকলে ওদেরও সংক্রমিত হবার আশঙ্কা আছে। অতএব, অন্য সন্তানদের নিয়ে বাবা কিংবা মায়ের যেকোন একজনকে কিছুদিন দূরে কোথাও থাকতে হবে। বাবা মেয়েকে ছেড়ে থাকতে রাজি নন। সুতরাং, সন্তানদের নিয়ে মা শহরের অন্য প্রান্তে একটা ছোট ঘর ভাড়া করলেন, আর বাবা রইলেন মেয়ের সেবাযত্ন করতে। মেয়ে কিন্তু বিছানাতেই পড়ে রইল।

    ঘরজুড়ে সালফারের গন্ধে টেকা দায়। বাঁধানো ছবিগুলো সালফারের তীব্রতায় কালচে হয়ে গেল, ড্রেসিং টেবিলের পেছনের রূপার প্রলেপও জায়গায়-জায়গায় ক্ষয় হল। আর নীরবে ক্ষয় হতে থাকলো মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখার স্বপ্ন। কান্না বুকে চেপে রেখে শূন্য ঘরে পায়চারি করেন বাবা। রাতে একা বিছানায় যন্ত্রণায় ছটফট করেন। নিজেকে বিপত্নীক বলে মনে হয় তাঁর। কিন্তু মেয়েকে এসবের কিছুই বুঝতে দেন না। মেয়ের জন্য নানা খেলনা কিনে আনেন, পুতুলনাচ দেখান, আরও কত কি! এসব দেখে মেয়ে তাঁকে শুষ্ক হাসি উপহার দেয়। সেই হাসিতেই বাবার ক্ষণিক-আনন্দ। মাঝে মাঝে সামান্য সময় বের করে মেয়ের মা-ভাইদের দেখতে যান। কিন্তু পাছে ওরা আবার সংক্রমিত হয়, এই ভয়ে কাছে যান না, দূর থেকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন, সন্তানদের চুম্বন ছুঁড়ে দেন। তাঁর স্ত্রী লাল নীল কাগজে লিখে লিখে দূর থেকেই নানা খোঁজখবর জানান।

    হঠাৎ একদিন পুতুলনাচের প্রতি মেয়ের আর আগ্রহ দেখা গেল না। তার মুখের হাসি বন্ধ হল, বন্ধ হল মুখের কথাও। অস্থি-চর্মসার শরীরটা থেকে শেষ অনুভূতিটুকুও কেড়ে নিল নিকষ কালো মৃত্যু। দীর্ঘ যন্ত্রণার অবসান হল।

    অতঃপর সন্তানদের নিয়ে মা বাড়ি ফিরে এলেন। তার অনুশোচনার সীমা রইলো না। কারণ সন্তানের মৃত্যুকালে তিনি কাছে থাকতে পারেননি। সমস্ত বাড়ি যেন শোকে-যন্ত্রণায়-হতাশায় বিদ্ধ হয়ে রইল। ডাক্তার এসে লাশের ময়নাতদন্ত করতে চাইলে বাবা কিছুতেই রাজি হলেন না। তিনি চান না তাঁর মেয়ের শরীর ছুরি-কাঁচি দিয়ে কাটাকুটি করা হোক। কারণ, তাঁর কাছে মেয়ে এখনও জীবন্ত। ডাক্তার সে কথায় কর্ণপাত করলেন না। বাবা ভীষণ রেগে গেলেন: চিৎকার-চাচামেচি করে, ডাক্তারকে এলোপাথাড়ি লাথি দিয়ে, কামড়াতে উদ্যত হলেন।

    মেয়েকে কবর দেয়ার পর বাবা সেই কবরের পাশে একটা স্মৃতি ফলক বানালেন। প্রতিদিন সেই ফলকের কাছে গিয়ে বসে থাকেন। এভাবে, পুরো একটা বছর পেরিয়ে গেল। দ্বিতীয় বছরে তাঁর যাতায়াত অনেকটাই কমে এল। কাজের চাপ আগের চেয়ে বেড়েছে। অবসর সময়ও তেমন একটা পান না। তাছাড়া তিনি এখন বুঝতে পারেন–বয়স হয়েছে, চলাফেরায় আগেকার সেই স্বাচ্ছন্দ্য আর নেই। একটু-একটু করে মেয়ের জন্য দুঃখ কমতে থাকল। মাঝে মধ্যে যখন মনে হয়–আজকাল মেয়ের জন্য তেমন দুঃখ করা হয় না–তখন অবশ্য তিনি নিজের কাছে নিজেই ভীষণ লজ্জায় পরে যান। এমনি করে এক সময় তিনি মেয়ের কথা ভুলেই গেলেন।

    এরপর তাদের আরও দুটো কন্যাসন্তান হল। কিন্তু কেউই আগের কন্যার মত হল না। একজন চলে গেলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয় অন্য কেউ এসে তা কখনোই পূরণ করতে পারে না।

    সংসার এখন একেবারেই রং-রূপহীন, বৈচিত্র্যহীন হয়ে গেছে। স্ত্রীর বয়স হয়েছে। আগেকার সেই সৌন্দর্যের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। স্বামীর আচরণেও বয়সের ছাপ স্পষ্ট। এক সময়ের সোনায়-মোড়ানো সংসার এখন সাদামাটা। ছেলেমেয়েগুলো বেশ চঞ্চল হয়েছে। বাড়িঘরজুড়ে তাদের দুরন্তপনার চিহ্ন ছড়ানো-ছিটানো। বাবা-মায়ের বিয়ের উপহার তো অনেক আগেই ভেঙ্গেচুরে একাকার করেছে, ঘরের আসবাবপত্রও তাদের অত্যাচার থেকে রেহাই পায়নি–খাটের তোষক ছেঁড়া, টেবিলের পায়া ভাঙ্গা, সোফার কভারের ফুটো দিয়ে শতচ্ছিন্ন ফোম উঁকি দিচ্ছে, আরও যে কত কি! পিয়ানোটা অনেকদিন মধুর সুরে বাজে না। পরিবর্তে বাচ্চাদের কর্কশ চাচামেচিতে বাড়িঘর ঢেকে থাকে। ‘আদর’, ‘ভালোবাসা’ শব্দগুলো অনেক আগেই পুরনো হয়ে গেছে। ওগুলোকে যেন ময়লা মোছার ন্যাকড়া দিয়ে মুছে ফেলা হয়েছে। প্রেমস্পর্শ’ বলতেও কিছু আর নেই এখন। স্পর্শ এখন শুধু প্রয়োজন ফুরানোর প্রচেষ্টা মাত্র। বাবাকে আর মায়ের সামনে হাঁটু মুড়ে বসতে দেখা যায় না। তিনি বসে থাকেন একটা জীর্ণশীর্ণ আর্মচেয়ারে। চুরুট জ্বালানোর দরকার হলে মাকে ডাকেন। এর বাইরে দুজনের তেমন কথাবার্তা হয় না। স্পষ্ট বুড়িয়ে যাচ্ছেন। জীবনের রং ফিকে হয়ে যাচ্ছে।

    *** *** ***

    বাবার বয়স যখন পঞ্চাশের কাছাকাছি, হঠাৎ করেই তখন মা মারা গেলেন। বাবাকে যেন এবার অতীত এসে জাপটে ধরল। মায়ের হালকা-পাতলা-রুগ্ন। শরীরটা কবরে নামানোর সময় তাঁর চোখে ভেসে উঠল চৌদ্দ বছরের এক কিশোরীর ছবি। অনেকদিন আগে হারানো কিশোরীটির শোকে পাগলপারা হলেন তিনি। সে শোক আজ আফসোস হয়ে ঝরে পড়ছে। বাবা অবশ্য কখনোই মাকে কোন অযত্ন বা অবহেলা করেননি। সেই চৌদ্দ বছরের। কিশোরী, পাদ্রির কন্যাটির প্রতি তিনি সব সময়ই বিশ্বস্ত ছিলেন। সেই কিশোরীকে পূজা করতেন তিনি, হাঁটু মুড়ে বসে প্রার্থনা করতেন। কিন্তু সে প্রার্থনার মন্দিরে প্রবেশ করার সুযোগ পাননি তিনি; কারণ তিনি বিয়ে করেছিলেন চব্বিশ বছর বয়সী এক মলিনকেশী নারীকে। অকপট স্বীকারে মানতেই হত, তিনি ঐ চৌদ্দ বছরের কিশোরীটির জন্যই শোক করছিলেন। তবে একথাও সত্য, বৃদ্ধা স্ত্রীর চমৎকার রান্না আর সীমাহীন যত্নআত্তির প্রচন্ডরকম অভাব বোধ করছিলেন তিনি। যদিও দুটো অনুভূতির মধ্যে বিস্তর ফারাক।

    এতদিনে সন্তানদের সঙ্গে বাবার বেশ ভালো বন্ধুত্ব হল। সবাই অবশ্য এখন আর বাড়িতে থাকে না। লেখাপড়া, চাকরীর জন্য কেউ কেউ অন্যত্র থাকে। যারা বাড়িতে থাকে তাদের সঙ্গেই বাবা সারাদিন গল্পগুজব করেন। তবে তিনি সন্তানদের সঙ্গ উপভোগ করলেও সন্তানরা তাঁর সঙ্গ কতটা উপভোগ করে সেটা নিয়ে সংশয় আছে। কারণ সন্তানদের নিয়ে বসলে তিনি একই গল্প বারবার বলেন, স্ত্রীর নানা মজার কাহিনি শোনান। বছর ঘুরতে-না-ঘুরতেই দেখা গেল, গল্পগুলো কেমন একঘেয়ে হয়ে গেছে। বাবা। অবশ্য সমান আগ্রহ নিয়েই বলে যান…

    *** *** ***

    একদিন এক কাকতালীয় ঘটলা ঘটল–বাবার সঙ্গে এক অষ্টাদশী স্বর্ণকেশীর দেখা হল। দেখতে ঠিক সেই কিশোরী প্রিয়ার মত। বাবার কাছে। এ কাকতালীয়তাকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলে মনে হল। তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করলেন, ঈশ্বর তাঁর ভালোবাসাকে ফিরিয়ে দিতে চাইছেন। মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেলেন তিনি, বিয়েও করলেন। এতদিনে তিনি যেন সেই কিশোরী প্রিয়াকে আপন করে পেলেন। কিন্তু বিপত্তি বাধলো সন্তানদের। নিয়ে। বিশেষত, তাঁর মেয়েরা এ ঘটনায় ভীষণ ক্ষেপে গেল। তাদের পক্ষে কিছুতেই এটা মেনে নেয়া সম্ভব নয়। বাবা তাদের মায়ের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বলেই ধরে নিল তারা। সুতরাং বাবার সঙ্গে আর থাকা সম্ভব নয়। সন্তানরা যার যার মত নিজের পথ বেছে নিল। তবে বাবা কিন্তু নিজের কাজে যথেষ্ট সন্তুষ্ট। নতুন স্ত্রীকে নিয়ে তাঁর যতটা না সুখ, তার চেয়ে বেশি গর্ব। বন্ধুদের কাছে স্ত্রীর গল্প করে তিনি বাহ্বা পাওয়ার চেষ্টা করেন। বন্ধুরা অবশ্য ভালোমন্দ কোন মন্তব্য করে না। দু’একজন শুধু বলেছে–“কয়েকটা দিন যেতে দাও, তখন দেখা যাক কী হয়।”

    বছর না-ঘুরতেই নতুন স্ত্রী এক সন্তান জন্ম দিল। বাবার অবশ্য এখন আর বাচ্চাকাচ্চার কান্নাকাটি শোনার মত যথেষ্ট ধৈর্য নেই, রাতের বেলার বিশ্রামই বেশি কাক্ষিত। স্ত্রীর ওজর-আপত্তি উপেক্ষা করে তিনি শোবার ঘর আলাদা করার জোর প্রচেষ্টা চালালেন। উপায় না-দেখে স্ত্রী তো কান্নাকাটি করে অস্থির। “উফ! মেয়েরা যে কী পরিমাণ বিরক্তিকর!” যন্ত্রণার এখানেই শেষ নয়। দেখা গেল নতুন স্ত্রী আজকাল প্রথম স্ত্রীকে হিংসা করতে শুরু করেছে। দোষটা অবশ্য স্বামীর অতি সরলভাবে তিনি দ্বিতীয় স্ত্রীকে প্রথম স্ত্রীর সমস্ত গল্প বলেছিলেন, প্রেমপত্রগুলো পড়তে দিয়েছিলেন এবং, সর্বোপরি, প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে দ্বিতীয় স্ত্রীর অস্বাভাবিক মিলের কথা বলেছিলেন। এত কিছুর জানার পর দ্বিতীয় স্ত্রীর মনে হয়েছে–স্বামী আসলে তাকে ভালোবাসে না; বরং ভালোবাসে তার মধ্যে প্রথম স্ত্রীর ছায়াকে। সে আরও আবিষ্কার করেছে তাকে যেসব আদরের নামে ডাকা হয় সেগুলোর সবই প্রথম স্ত্রীর নাম ছিল। অর্থাৎ, স্বামী আসলে তাকে অবহেলা করে। এই অবহেলা সহ্য করা সম্ভব নয়। অতএব, সে স্বামীর ভালোবাসা (যেটা শুধুই তার নিজের জন্য) আদায় করতে উঠে-পড়ে লাগল। নানা শয়তানী পরিকল্পনাও করলো। কিন্তু সেগুলোর কোনটাই স্বামীর মধ্যে বিরক্তির উদ্রেক ভিন্ন কিছু করতে পারল না। ওদিকে স্বামীর মনে দুই স্ত্রীর মধ্যে তুলনা করা শুরু হয়ে গেল। সবদিক বিবেচনায় প্রথম স্ত্রীকেই সেরা বলে মনে হল। সন্তানদের প্রতিও আবার ভালোবাসা জেগে উঠল। ওদের বাড়ি ছেড়ে যেতে দেওয়ায় নিজের প্রতি ভীষণ রাগ হল, অনুশোচনা হল। আজকাল তিনি ঘুমের মধ্যে খারাপ স্বপ্ন দেখে ধড়ফড় করে জেগে উঠেন। মনে হয়, প্রথম স্ত্রীর স্মৃতি যেন তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। সর্বোপরি, নিজেকে আজকাল বিশ্বাসভঙ্গকারী মনে হয়।

    ঘরে তিনি আর কোনও শান্তি খুঁজে পান না। সবসময় মনে হয়, যেন এমন একটা চুক্তি করেছেন যে-চুক্তির শর্তগুলো পূরণ না-করাটাই শ্রেয়। অতএব ঘরের বাইরে পা বাড়ালেন তিনি। আজকাল বেশির ভাগ সময় কাটে ক্লাবে-ক্লাবে। স্ত্রীর এ-নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। মাঝে মাঝেই দুজনের মধ্যে ভীষণ কলহ হয়। স্ত্রীর মতে, স্বামী তাকে ধোঁকা দিয়েছে। অমন বুড়ো ভামের ঘরে যুবতী বৌ থাকা ঠিক না। ঘরে যুবতী বৌ রেখে বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ালে তার ফল কক্ষনো ভালো হয় না। এজন্য পরে তাঁকে পস্তাতে হবে।

    কী! এতবড় কথা! ‘বুড়ো’! স্ত্রী তাকে বুড়ো বলল! সে-ও দেখিয়ে দেবে, সে আসলে বুড়িয়ে যায়নি।

    অতএব, দুজনের আবার এক-রুমে থাকা শুরু হল। তবে এবার যেটা ঘটল সেটা আগের চেয়েও শতগুণে খারাপ! বাচ্চার কান্নাকাটি সহ্য হয় না

    –স্ত্রীর সাথে রাগারাগি করেন –“বাচ্চারা থাকবে নার্সারিতে, ঘরের মধ্যে এত উৎপাত কিসের?”।

    স্ত্রী-ও ঠোঁট উল্টে প্রতিবাদ করে, “কই, আগের বৌয়ের বাচ্চাদের বেলায় তো এমন মনে হয়নি!”

    অতএব, স্বামীকে যাবতীয় অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে যেতে হয়…

    *** *** ***

    এ-পর্যন্ত দু’বার তিনি ফিনিক্স পাখির (রূপকথার পাখি। মৃত পাখির ছাই থেকে নতুন পাখির জন্ম হয়।) জাগরণে বিশ্বাস করেছেন। সে-জাগরণ তাঁর চৌদ্দ-বছরের কিশোরী বধূর জাগরণ। প্রথমবার, তাঁর মৃত কন্যার মধ্যে সেই জাগরণ দেখেছেন; পরেরবার দেখেছেন দ্বিতীয় স্ত্রীর মধ্যে। কিন্তু তাঁর স্মৃতি তাকে কখনোই সেই চৌদ্দ-বছরের কিশোরীটিকে ভুলতে দেয়নি। বুনো স্ট্রবেরিতে রং লাগার সময় পাদ্রির বাড়িতে সেই প্রথম দেখা, প্রথম চুম্বন, প্রথম প্রেমাবেগ সবই যেন স্মৃতিতে অমলিন হয়ে রয়েছে। কিন্তু সেই প্রথম প্রেমকে কখনোই আপন করে পাননি তিনি। এখন জীবনসায়াহ্নে এসে অন্ধকার হাতড়ে বৃদ্ধা স্ত্রীকেই বারেবারে মনে পড়ে, যে তাঁকে আর তাঁর সন্তানদের ভীষণ ভালোবাসত, আদরযত্ন করত; যে কখনোই তাঁর সঙ্গে রাগারাগি করেনি, যে সবসময়ই খুব সাধারণভাবে থাকত, নীরবে বসে স্বামী-সন্তানদের জামাকাপড় সেলাই করে দিত।

    এতদিনে নিজেকে জীবনযুদ্ধে পরাজিত বলে মনে হয়। সত্যিকারের ফিনিক্স পাখি তিনি আসলে কখনো চিনতেই পারেননি। হয়ত তাঁর বৃদ্ধা স্ত্রী ই ছিল সত্যিকারের ফিনিক্স পাখি! সেই চৌদ্দ-বছরের কিশোরীর ছাই থেকে জন্ম নিয়ে ধীরে-ধীরে সে পরিণত হয়েছে, ডিম দিয়েছে নতুন ছানা জন্ম দেবার জন্য। তারপর, সে-ডিমে তা দিতে বুকের পালক ছিঁড়ে বাসা বেঁধেছে, ডিমের যত্ন নিয়েছে, ছানাদের বাঁচিয়ে রাখতে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে নিজে পুড়ে ছাই হয়েছে। আফসোস! জীবনভর এই ধাঁধার পেছনে ছুটলেন তিনি! কিন্তু ক্লান্ত-শ্রান্ত মাথাটি শেষবারের মত বালিশের ওপর রাখার আগে, এই ভেবে তিনি স্বস্তি নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন শেষ পর্যন্ত ধাঁধাটির সমাধান তিনি করতে পেরেছেন।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগোবিন্দ দাস কৃত পদাবলী – অক্ষয়চন্দ্র সরকার সম্পাদিত
    Next Article কল্লোল যুগ – অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }