কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১০০
১০০
তখন আরো জোরে বৃষ্টি পড়ছে। সতী তাড়াতাড়ি আবার বাড়ির দিকে ফিরতে লাগলো। কয়েকটা গাড়ি হুশ হুশ করে চলে গেল পাশ দিয়ে। সেই লোকটা আশে-পাশে কোথাও লুকিয়ে আছে সেখানে। যেদিকে সতী গিয়েছে সেদিকেই পিছু নিয়েছে। সেই অন্ধকার সন্ধ্যেবেলায় সতী যেন বড় বিভ্রান্ত হয়ে গেল। কোথায় যাবে সে? কার কাছে গিয়ে সাহায্য চাইবে? কে তাকে বাঁচাবে? বাড়ি ফিরেই বা যাচ্ছে কেন সে? সেখানে সনাতনবাবুকে দিয়ে তার কতটুকু সাহায্য হবে? তাঁর কাছে গিয়েই বা কী লাভ? দীপুকে খবর দেওয়া যাবে কেমন করে?
হাতের কাছে পোস্ট আপিস নেই একটাও। থাকলেও এখন কি খোলা আছে? এই সন্ধ্যে ছ’টার পর?
সতীর মনে হলো হলো এই সময়ে একলা বেরোনো তার উচিত হয়নি হয়ত। হয়ত রঘুকে দিয়েই পোস্ট আপিসে টেলিগ্রামটা পাঠিয়ে দিলে হতো! কিন্তু রঘুই বা এত দেরি করছে কেন? প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে খবরটা দিয়ে আসতে কি এত সময় লাগে? বাড়ি ফিরলে তো রাস্তাতেই তার সঙ্গে দেখা হতো। তবু রঘু আসছে কিনা পেছন ফিরে দেখতে গিয়েই হঠাৎ আবার নজরে পড়লো। সেই লোকটা! সেই লোকটা আবার তাকে অনুসরণ করছে।
সতী থমকে দাঁড়াল।
সতীর মনে হলো লোকটা যেন সতীকে তার জন্ম থেকে অনুসরণ করে আসছে। যেদিন তার জন্ম হয়েছিল এই পৃথিবীতে, সেইদিন থেকেই। ওরই নাম বোধ হয় মৃত্যু। জন্মের সঙ্গে-সঙ্গেই বুঝি ভগবান মৃত্যুকে মানুষের পেছনে লেলিয়ে দেন। মৃত্যুর সঙ্গে বারবার তাই মুখোমুখি হয়ে যায় মানুষ। বারবার মৃত্যুকে দেখে তাই আঁতকে উঠি আমরা। বারবার তাই তাকে এড়িয়ে যেতে চাই। কিন্তু কার সাধ্য মৃত্যুকে এড়াবে? তার বাবা কি মৃত্যুকে এড়াতে পেরেছেন? পৃথিবীর কেউ কি এড়াতে পেরেছে? সতী কি তার খোকাকেও মৃত্যুর হাত থেকে কেড়ে নিতে পেরেছিল সেদিন?
লেভেল-ক্রসিং-এর ওপর তখন এসে পড়েছে সতী। সামনে দু জোড়া লাইন। ইস্পাতের মজবুত লাইন। এইখান দিয়েই প্রতিদিন ঘন্টায়-ঘন্টায় কত ট্রেন কত মানুষ বয়ে নিয়ে যায়। সেই সমস্ত মানুষগুলোর পেছনেও তো মৃত্যু অনুসরণ করে চলেছে ছায়ার মত! মৃত্যু কোথায় নেই? এই সংসারে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ করতে করতে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে মানুষ। সেই ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত মৃত্যু তাকে কি এই প্রথম অনুসরণ করেছে? লোভের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়ছে তাকে, রোগ-শোক- কামনা-বাসনা সমস্ত কিছুর সঙ্গেই তাকে প্রতি মুহূর্তে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয়েছে। তারা কি মিস্টার ঘোষালের চেয়ে কিছু কম হিংস্র, কিছু কম নিরাপদ, কিছু কম ভয়ঙ্কর?
একেবারে গুমটি-ঘরটার তলায় এসে দাঁড়াল সতী।
গুমটি-ঘরটার আড়ালে দাঁড়িয়ে আর একবার পেছন ফিরলো। তাকে অনুসরণ করতে করতে সেই লোকটাও যেন হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো আবার। যেন কুটিল-জটিল এক ষড়যন্ত্রের জালে তাকে ঘিরে ফেলেছে মিস্টার ঘোষাল। এরাই কাল যাবে শিলিগুড়িতে। এরাই শিলিগুড়িতে গিয়ে দীপুকে নিঃশেষ করে দেবে।
হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠলো মিস্টার ঘোষালের রিভলবারটা।
সতী চিৎকার করে উঠলো—না—না—
সেই অন্ধকারের পটভূমিকায় সতীর চিৎকার যেন হাহাকারে রূপান্তরিত হয়ে জলে স্থলে অন্তরীক্ষে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠলো। না, না, না! কিছুতেই না। দীপু কোনও দোষ করেনি। দীপু নিরপরাধ, দীপু নিষ্পাপ, দীপু নিষ্কলঙ্ক! দীপুকে মারবেন না! দীপুর সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। দীপু আমার কেউ নয়, দীপু আপনার কোনও ক্ষতি করেনি। দীপু কারোর কোনোও ক্ষতি করেনি। দীপু আমাদের সকলের ভালো চায়। আপনার ভালো চায়, আমার ভালো চায়, আমার স্বামীর, আমার শাশুড়ীরও ভালো চায়।
হঠাৎ নিজের উত্তেজনায় সতী নিজেই যেন অবাক হয়ে গেল। কই, তার গলা দিয়ে তো এতটুকুক শব্দ বেরোচ্ছে না! সে যদি এখন চিৎকার করে কাউকে ডাকে তা হলেও তো কেউ শুনতে পাবে না। সে কী তবে পাগল হয়ে গেল, উন্মাদ হয়ে গেল লক্ষ্মীদির মতন?
অনেক দূরে যেন কীসের একটা আলো দেখা গেল!
ট্রেন আসছে নাকি? ইস্পাতের লাইনের ওপর যেন ট্রেনের চাকার শব্দের প্রতিধ্বনি শুরু হলো। প্রথমে মৃদু, তারপর একটু স্পষ্ট। তারপর আরো স্পষ্ট হলো! অনেক দূর থেকে যেন হুইস্ বাজলো ইঞ্জিনের। তবে কি ট্রেনটা আসছে এই লাইন দিয়ে? এই গুমটি-ঘরের সামনে দিয়ে?
সতী গুমটি-ঘরের গা ঘেঁষে দাঁড়াল। ওপরে গুমটি ঘরের ভেতরে সেই বুড়ো গেট- ম্যানটা বোধ হয় টেলিফোন কথা বলছে।
—হ্যাঁ হুজুর, আমি ভূষণ! লাইন-ক্লিয়ার হয়েছে?
তারপর সজোরে যেন একটা কীসের শব্দ হলো। বোধ হয় লিভার টানলে। তারপর ক্রিং-ক্রিং করে গেটটা বন্ধ হয়ে গেল। আর কোনও গাড়ি আসতে পারবে না। টপ্প্ করে বৃষ্টি পড়তে লাগলো জোরে। হাওয়া দিচ্ছে পূব দিক থেকে। জলো হাওয়া। সমস্ত শরীর যেন শিরশির করতে লাগলো। থরথর করে কাঁপতে লাগলো। শাড়িটাকে আরো এঁটে গায়ে জড়িয়ে নিলে সতী। মাথার ওপর ঘোমটা টেনে দিলে। তারপর সেইখানে গুমটির নিচে দাঁড়িয়েই ট্রেনের চাকার প্রতিধ্বনি শুনতে লাগলো একমনে। ট্রেনটা আসছে অনেক দূর থেকে। সতীর মনে হলো, ও যেন ট্রেন নয়, ও যেন মিস্টার ঘোষালের পাঠানো মৃত্যু-দূত। সতীর অনাদি অতীত আর অনন্ত ভবিষ্যৎ আজ যেন তার এক মুহূর্তের বর্তমানের কাছে হঠাৎ একেবারে নিরর্থক হয়ে উঠলো। আর সতী সেই অবধারিত ভয়াবহতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মুহূর্ত-পল-দন্ড হিসেব করতে লাগলো অধীর আগ্রহে।