কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১০১
১০১
মানুষের ইতিহাসে জন্ম-মৃত্যু উত্থান-পতনের ঘাত-প্রতিঘাতে লক্ষ লক্ষ চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ- তারা আলো হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেখানে ছোট একটি জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষার দ্বন্দ্বের কোনও মূল্য নেই। কে মরলো কে বাঁচলো তা দেখবার দায় নেই মহাকালের। মহাকালের নিরিখে একটা যুগ কি একটা শতাব্দীর ইতিহাস হয়ত বড়ই অকিঞ্চিৎকর। কিন্তু সে জানে যে প্রবল আকর্ষণ সূর্য থেকে পৃথিবী, পৃথিবী থেকে সূর্যে প্রসারিত তার মহাবিক্রমে মানুষের ইতিহাস অনাদিকাল ধরে অব্যাহত চলবে। সে জানে মানুষের অস্তিত্ব রাজ্যের বিনাশ হতে পারে না। তাই গ্রহ-তারা-চন্দ্র-সূর্যের দল আলো হাতে বারবার মানুষের দরজায় এসে উঁকি দেয়। উঁকি দিয়ে দেখে কোথায় কোন্ মানুষ জেগে আছে, কোথায় কোন্ মানুষ ঘুমিয়ে আছে। তারা বলে—কোথায় তুমি? তোমার জন্যেই তো অনাদিকাল ধরে আমাদের যাত্রা, তোমার সন্ধানেই তো আমাদের অনন্ত পরিত্রাণ! এমনি অনাদিকালব্যাপী সন্ধানের পর কোটি কোটি বছর পার হয়ে যায়। পার হয়ে যায় যুগ-যুগান্তর। হঠাৎ কয়েক শতাব্দীর পরে আবির্ভাব হয় একজন বুদ্ধদেবের, আবির্ভাব হয় একজন যিশু খৃষ্টের, আবির্ভাব হয় একজন মহম্মদের, আবির্ভাব হয় একজন মহাত্মা গান্ধীর। আর সঙ্গে সঙ্গে স্বর্গলোকে জয়ডঙ্কা বেজে ওঠে, মরলোকে জয়-শঙ্খ।
দীপঙ্করবাবুর চলে যাবার আয়োজন হয়েছিল। রাত্রি দশটায় ট্রেন। আমরা তাঁর মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে তাঁর গল্প শুনেছিলাম। তিনি বলছিলেন—আমি মৃত্যু দেখেছি। মৃত্যুকে অনুভব করেছি, মৃত্যুকে উপলব্ধি করেছি। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা তা-ও নয়। আমি মৃত্যুকে কিনেছি—
মৃত্যুকে দীপঙ্করবাবু কিনেছেন! আমরা যারা শুনছিলাম তারা সবাই অবাক হয়ে গেলাম।
—হ্যাঁ, আমার টাকা ছিল, আমার ধার করা লক্ষ টাকা। সেই টাকা দিয়ে আমি সতীর সুখ কিনতে চেয়েছিলাম, সতীর শান্তি কিনতে চেয়েছিলাম। শুধু সতীর নয়, পৃথিবীর সকলের মঙ্গল কিনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা হলো না। আমি টাকা দিয়ে জীবন কিনতে পারিনি, মৃত্যু কিনলাম—অঘোরদাদু আমাকে ভুল শিখিয়েছিল—
তারপর একটু থেমে বলতে লাগলেন—যাঁরা তোমাদের টেক্স্ট বই লেখেন, যাঁরা তোমাদের টীচার, যাঁরা তোমাদের গার্জেন, তাঁরা সবাই অঘোরদাদু। সেই অঘোরদাদুরাই আজ আমাকে এখান থেকে তাড়িয়ে দিলেন। সব জায়গাতেই আছেন অঘোরদাদুরা। আমি বাঁকুড়া থেকে চলে এসেছি, বর্ধমান থেকে চলে এসেছি, হুগলী থেকে চলে এসেছি, সব জেলা থেকেই চলে এসেছি, এবার এখান থেকেও চলে যেতে হচ্ছে। তার জন্য আমার দুঃখ নেই। পৃথিবীর এক জায়গায় আমি মানুষ খুঁজে পাবোই। আমার সঙ্গে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারার দলও আলো হাতে খুঁজতে বেরিয়েছে। কোটি কোটি বছর ধরে তারা খুঁজছে, আরো খুঁজবে। আমি হতাশ হই নাই, আমি হতাশ হবো না—
বললাম-তারপর?
—তারপর?
যে অমৃতময় পুরুষ বিশ্ব-চরাচরের সমস্ত কিছুর মধ্যে বিরাজ করছেন, তিনি সেদিন সাক্ষী রইলেন। সাক্ষী রইল অনন্ত আকাশ, অসীম দিগন্ত, আর সাক্ষী রইল ‘কড়ি দিয়ে কিনলামে’র অসংখ্য পাঠক। তারা জানলো সতী সেদিন মৃত্যু চায়নি। সতী সেদিন সুখ চেয়েছিল, শান্তি চেয়েছিল, স্বামী চেয়েছিল। আর আর একটি জিনিস চেয়েছিল। সে চেয়েছিল মাতৃত্ব। সে চেয়েছিল সন্তান।
হুড়মুড় করে ট্রেনটা আসছে। সামনের হেডলাইটটা স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠলো। প্রত্যক্ষ থেকে প্রত্যক্ষতর। সতী গুমটি-ঘরের নিচে থেকে বেরিয়ে এগিয়ে এল এক জোড়া চকচকে ঝকঝকে লাইনের দিকে। চাকায় চাকায় তখন দুর্দান্ত বেগ, শিরায় শিরায় তখন দুর্দম উন্মাদনা! কাল সকাল সাতটা! কাল সকাল সাতটার মধ্যেই মিস্টার ঘোষাল এসে জবাবদিহি চাইবে। তার খেসারত চাইবে। হয় দীপঙ্করের মৃত্যু, নয় সতীর সতীত্ব!
এবার ট্রেনটা আরো কাছে এসে পড়েছে।
তুমি আমায় ক্ষমা করো। আজ সারা রাত বৃষ্টি হবে। তুমি বলেছিলে ঘরের ভেতরে আমরা দুজনে মিলে এক বিছানায় শুয়ে শুয়ে গল্প করবো। তুমি বলেছিলে তুমি অনেক রাত ঘুমোওনি। আমার কথা ভেবে-ভেবে তোমার ঘুম আসেনি অনেক দিন। আজ তুমি তোমার মাকে না বলে হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছিলে আমার কাছে। আমি তোমাকে আমার বিছানায় শুইয়ে এসেছি। আমি তোমাকে বলেছি—আমি এখনই আসবো। আমি বলেছিলাম—আমি যাবো আর আসবো! কিন্তু দীপু? দীপু যে শিলিগুড়িতে, কাল যে ওরা যাবে, কাল যে ওরা শিলিগুড়িতে যাবে। দীপু যে খবর পায়নি, দীপুকে যে সাবধান করে দেওয়া হয়নি! দীপু যে……
হঠাৎ সতীর মনে হলো পূব দিকের লাইনের ওপর দিয়ে কে যেন চিৎকার করতে করতে দৌড়ে আসছে—
—কে? কে ও? মিস্টার ঘোষাল? ঘোষাল কি জানতে পেরেছে? তার চারদিকে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে ষড়যন্ত্রের জাল ফেলেছে ঘোষাল!
সতী চিৎকার করে উঠলো—না, না, দীপুর কোনও ক্ষতি ক’রো না তোমরা, দীপু আমার কেউ নয়, দীপুর সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই, দীপু কিছু জানে না। সে নিষ্পাপ, সে নিরপরাধ, সে নিষ্কলঙ্ক…..
ট্রেনটা তখন আরো কাছে এসে পড়েছে। আর ওদিকে মিস্টার ঘোষাল দৌড়তে- দৌড়তে তার দিকে আসছে……আরো কাছে এসে পড়লো…..