কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৭
১৭
মনে আছে সে উনিশ শো একচল্লিশ সালের বাইশে জুনের কথা। হঠাৎ সকালবেলা পৃথিবীর সব মানুষ একসঙ্গে ঘুম থেকে উঠে জানতে, পারলো জার্মানীর আর্মি বলা-নেই কওয়া-নেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়েছে একেবারে সোভিয়েট রাশিয়ার বুকের ভেতরে। বাল্টিক্ থেকে ব্ল্যাক-সী পর্যন্ত সমস্ত এরিয়া জুড়ে জার্মান-আর্মি তচ্-নছ্ করে দিয়েছে রাশিয়ার ডিফেন্স লাইন। ফিল্যান্ড, হাঙ্গারী, বুলগেরিয়া, রুমেনিয়া—সবাই আছে হিটলারের সঙ্গে।
ক্রফোর্ড সহেব ডেকেছিল দীপঙ্করকে। দীপঙ্কর গিয়ে বসল সামনে। বড় গম্ভীর মানুষ ক্রফোর্ড সাহেব। রেলের অফিসের কোনও কাজ নিয়ে কখনও তাড়াহুড়ো করবার মানুষ নয়। ধীর স্থির মানুষটা। কোয়ার্টার থেকে এসে চুপ করে সারাদিন কাজ করে যায়, আবার ঠিক অফিস থেকে চলেও যায় নিজের সময়মত।
ক্রফোর্ড সাহেব একটু হাসলো। সাধারণত গোঁফের আড়ালে হাসতে সাহেবকে কখনও দেখেনি কেউ।
জিজ্ঞেস করলে—সেন, আর ইউ অ্যাফ্রেড্?
দীপঙ্কর একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল প্রশ্নটা শুনে। বললে—কেন স্যার? এ-কথা কেন জিজ্ঞেস করছেন?
হাতে ফাইলটা ছিল সাহেবের। হাতের ফাইলটা দেখিয়ে বললে—এই ফাইলটা দেখেছ? শুনছি, হোল্ ক্যালকাটার লোক নাকি অ্যাফ্রেড হয়ে উঠেছে—
সত্যিই কলকাতায় তখন শহর ছেড়ে বাইরে চলে যাবার হিড়িক পড়ে গেছে। কেউ মধুপুর, কেউ গিরিডি, কেউ গ্রামের বাড়িতে গিয়ে উঠেছে। জাপানের সঙ্গে রাশিয়ার আগেই নন্-য়্যাগ্রেশন প্যাক্ট হয়ে গিয়েছিল। কলকাতার হাতের কাছে তখন এগিয়ে এসেছ ওয়ার। পার্ল হারবারের লড়াই-এর পর জাপান আর একদিনও দেরি করেনি, এক দমে নিয়ে নিয়েছে ফিলিপাইনস, সিঙ্গাপুর, ডাচ ইস্ট ইন্ডিজ। কলকাতার পাশে বৰ্মা তখন টল্-মল্ করছে—
দীপঙ্কর বললে—আমি তা জানি স্যার—
—তুমি তোমার ফ্যামিলি পাঠিয়ে দিয়েছ নাকি বাইরে?
ক্রফোর্ড সাহেব জানতো না যে দীপঙ্করের ফ্যামিলি বলতে কেউই নেই। অথচ ফ্যামিলি না থাকলেও যে দীপঙ্করের কত আত্মীয় আছে তা কী করে বোঝাবে সাহেবকে। সাহেব হয়ত বুঝতেও পারবে না সে সব কথা!
—তোমার কী মনে হয় সেন, উই উইল্ লুজ্ দি ওয়ার? আমরা যুদ্ধে হেরে যাবো? দীপঙ্কর ক্রফোড় সাহেবের মুখের দিকে চেয়ে দেখলে। যে-মুখে কখনও কিছুর রেখাই পড়ে না, সেই মুখেই যেন ভয়ের রেখা ফুটে উঠেছে। উদ্বিগ্ন চার্চিল যেন চুরুট টানতেও ভুলে গেছে। হাওড়া স্টেশনে, শেয়ালদা স্টেশনে রোজ স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। শুধু ক্রফোর্ড সাহেবে কেন, সমস্ত অফিস-সুদ্ধ লোক ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে। সমস্ত কলকাতাই যেন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। যাদের ভাড়াবাড়ির ওপর আয়, তাদের আয় কমে যাচ্ছে। বিক্রি হয়ে যাচ্ছে অনেক বাড়ি। দর সস্তা হয়ে যাচ্ছে সম্পত্তির। প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের বাড়ির মালিক নয়নরঞ্জিনী দাসী তাই একে একে সব বাড়ি বিক্রি করে লিকুইড্ ক্যাশ করে রাখছে ব্যাঙ্কে। ফিক্সড্ ডিপোজিট্। দীপঙ্করের নিজের জীবনের মতই যেন সমস্ত পৃথিবীতে ভূমিকম্প শুরু হয়েছিল। হঠাৎ সেই সময়ে দেখা কিরণের সঙ্গে।
কিরণ একধারে টেনে নিয়ে এল দীপঙ্করকে। বললে—কেউ জানে না আমি এখানে—আমার নামে ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া য়্যাক্টের ওয়ারেন্ট ঘুরছে—
—কিন্তু তুই এই সময়ে এলি কী করে?
কিরণ বললে—সাবমেরিনে—
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে—কোথায় আছিস্?
হোটেলে। সবাই জানে আমি ইউরোপীয়ান, কিন্তু আর হোটেলে থাকা চলবে না, অলরেডি সাসপেক্ট করতে আরম্ভ করেছে সবাই, এই জিনিসটা তোর কাছে রাখতে এলুম—এটা রেখে দিবি? খুব সাবধানে রাখতে হবে কিন্তু—
একটা কাগজে মোড়া ছোট বান্ডিল। দীপঙ্কর হাতে নিয়ে বললে—কী এটা?
—তা জানতে চাসনি তুই, যা বলছি করবি কিনা বল্, আবার দু’ তিন দিন পরে আমিই নিয়ে যাবো।
হঠাৎ দীপঙ্করের মা’র কথাটা মনে পড়লো। বললে অজেক্শ্যানেল্ কিছু আছে?
—তাহলে দে, রাখবার দরকার নেই—বলে বান্ডিলটা আবার টেনে নিয়ে কিরণ চলে যাচ্ছিল। দীপঙ্কর তাড়াতাড়ি বললে—দে না, আমি কি বলেছি রাখবো না?
—আমি তাহলে চলি?
কিন্তু…..
কিরণ বললে—আর দেরি করবার সময় নেই, ট্যাক্সি-ড্রাইভারটা সন্দেহ করছে—
—তোর মা, তোর মার সঙ্গে দেখা হয়েছে?
কিরণ ততক্ষণে ট্যাক্সিতে উঠে পড়েছে। উঠতেই ট্যাক্সিটা স্টার্ট দিলে।
দীপঙ্কর আবার জিজ্ঞেস করলে-তোর মা’র সঙ্গে দেখা করেছিস?
ততক্ষণে ট্যাক্সিটা হু হু করে চলে গেছে অনেক দূর। দীপঙ্কর হাঁ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। তার মনে হলো যেন আবার বয়েস কমে গেল তার। আবার সেই তারা দুজনে লাইব্রেরী করবে, আবার তারা সেই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের জীবন ফিরে পাবে, আবার যেন কিরণের বাবা বেঁচে উঠবে, দীপঙ্করের মা-ও ফিরে আসবে-আমার সেই অঘোরদাদু. বিন্তিদি, আবার সেই পুরোনো ছোটবেলায় যেন ফিরে যেতে ইচ্ছে করতে লাগলো দীপঙ্করের।
সেই অন্ধকার রোয়াকের ওপর অনেকক্ষণ চুপ করে দঁড়িয়ে রইল দীপঙ্কর।
কিরণের ট্যাক্সি চলে গেছে। স্টেশন রোডের রাস্তার গ্যাসের আলোগুলো অন্ধকারে মুখ ঢেকে ঠায় দাঁড়িয়ে। বড় নিরিবিলি রাত। বড় নিঃসঙ্গ অন্ধকার। বহু যুগ পরে যেন দীপঙ্কর এক মুহূর্তের মধ্যে পৃথিবী পরিক্রমা করে এল। এ কী করলে কিরণ! এক মুহূর্তে এ কী রূপান্তর ঘটিয়ে দিয়ে গেল তার? সেইখানে সেই রোয়াকের ওপর দাঁড়িয়েই তার মনে হলো বড় দেরি হয়ে গেল। কিরণকে ধরে রাখলেই ভালো হতো! কিরণকে তার মার কাছে পৌছিয়ে দিলেই ভালো করতো। কেন যেতে দিলে কিরণকে? আর যদি কিরণ না আসে? আর যদি না দেখা হয়! আর যদি ধরা পড়ে? ধরা পড়ে যদি জেল হয়? ফাঁসি হয়?
—দাদাবাবু!
টপ্ করে হাতের বান্ডিলটা দীপঙ্কর নিজের অজ্ঞাতেই লুকিয়ে ফেলেছে। কাশী দীপঙ্করকে এই অবস্থায় দেখে কেমন অবাক হয়ে গেল। অনেকদিন থেকেই কাশী সব লক্ষ্য করছিল। কোথায় যেন কি বিপর্যয় ঘটেছে। মা’র মারা যাবার পর থেকেই দাদাবাবু যেন অন্যরকম হয়ে গেছে। এক-একদিন সকলের আগে ঘুম থেকে উঠে ছাদে গিয়ে বেড়ায়। অনেক রাত্রে বাড়ি আসে। অনেক রাত্রে ঘুমোতে যায়। কখন যে ঘুমোয় টের পায় না কেউ। কাশী একা-একা লক্ষ্য করে। একা-একা দেখে।
এক-একদিন সকাল-সকাল বাড়ি ফিরে দীপঙ্কর ইজি-চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিয়ে চুপ করে বসে থাকে। সমস্ত শরীর কান্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। পাশ দিয়ে কাশী গেলেই ডাকে। বলে—কাশী—
কাশী কাছে আসে। বলে—কিছু বলছিলেন আমাকে?
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করে—কাজ করছিলি?
কাশী বলে—না, আপনাকে খেতে দেব?
দীপঙ্কর বলে—না—
তারপর কী যেন বলতে গিয়েও বলতে পারে না দীপঙ্কর। বলতে যেন দ্বিধা হয়, যেন বেধে যায় গলায়। কেমন করে বলতে হবে সেইটেই যেন ভেবে নেয় মনে মনে। অনেক দিন ধরেই কথাটা ভাবছে দীপঙ্কর! অনেক দেখলে দীপঙ্কর, অনেক দেখেছে। সেই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন থেকে শুরু করে অনেক পথ পরিক্রমা করে এসেছে। অনেক মৃত্যু অতিক্রম করেছে, অনেক জীবন অতিবাহিত করেছে। কোথাও কোনও সান্ত্বনা পায়নি, কোথাও কোনও সমাধানও পায়নি। এখন মনে হয় একমাত্র কাশীর মধ্যেই দীপঙ্কর নিজেকে দেখতে পাবে।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে—হ্যাঁ রে, তুই লেখাপড়া করবি?
লেখা-পড়া! লেখাপড়ার কথা কখনও কল্পনা করেনি কাশী।
—লেখাপড়া করলে মানুষ হতে পারবি। লেখাপড়া করলেই তবে মানুষ মানুষ হতে পারে। লেখাপড়া করলে অন্তত বুঝতে পারবি পৃথিবীর কে কী-রকম মানুষ। কোটা ভালো, কোন্টা মন্দ।
কাশী বললে—কখন লেখাপড়া করবো?
—কেন, আমি আপিস থেকে ফিরে এসে তোকে পড়াবো। একটু খালি মন দিস্, তাহলেই খুব শিগির বুঝতে পারবি, তারপর যদি চাস্ তো তোকে আমাদের আপিসে চাকরি করে দেব। চিরকাল কি এমনি করে পরের বাড়িতে চাকরের কাজ করবি তুই— চিরকালই কি বাসন মাজবি, ঘর ঝাঁট দিবি?
—তাহলে কে বাসন মাজবে? কে আর ঘর ঝাঁট দেবে তখন?
দীপঙ্কর বললে—দু’টো কাজই করবি, লেখাপড়া করলে কি আর সংসারের কাজ করা যায় না?
তারপর অনেকক্ষণ ধরে অনেক-কথা বলে যায় দীপঙ্কর। কাশী কিছু বুঝতে পারে না। দীপঙ্কর যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলছে। নিজের কাছেই নিজের জবাবদিহি করছে। যেন আত্মবিশ্লেষণ করছে আপন মনে। একদিন সমস্ত পৃথিবী থেকে অন্যায়-অত্যাচার উঠে যাবে। একদিন মাষ সমস্ত কলুষ থেকে মুক্ত হবে। কাশী এ-সব কথা বুঝতে পারে না।
দীপঙ্কর বললে—কাল তোর জন্যে একটা প্রথমভাগ কিনে আনবো, তুই পড়বি, বুঝলি?
রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর শুতে গিয়ে কী মনে হলো। বিছানা থেকে আবার উঠলো দীপঙ্কর। সমস্ত নিস্তব্ধ। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। অনেক দূরে থেকে থেকে কোথায় যেন কামানের শব্দ হচ্ছে—তারই প্রতিধ্বনি এখানে এই কলকাতা শহরে এসে যেন পৌঁছুল এখন। কত লোক প্রাণ দিচ্ছে, কত লোক নিঃসন্তান হচ্ছে, কত লোক নিরাশ্রয় হচ্ছে, এখানে এই কলকাতা শহরে বসে তা যেন কল্পনা করা যায়। মস্কো আর লেনিনগ্রাডের দিকে এগিয়ে চলেছে জার্মানী। আর এদিকে জাপান এগিয়ে আসছে বর্মার পথ ধরে। বর্মার পরই কলকাতা। ক্রফোর্ড সাহেব ভয় পেয়েছে। রেলের আপিসের সমস্ত লোক ডিফেন্স অব ইন্ডিয়ার ইউনিটে নাম লিখিয়েছে। যে ক্লার্ক পঞ্চাশ টাকা মাইনে পাচ্ছে— এই ইউনিটে নাম লেখালে পাবে আরো পঞ্চাশ টাকা। দিল্লী বোর্ড থেকে চিঠি এসেছে। যার খুশী সে-ই নাম লেখাতে পারবে। খাকী বুশ-কোর্ট, খাকী প্যান্ট, খাকী ক্যাপ। সমস্ত আপিসসুদ্ধ লোক মিলিটারিতে নাম লিখিয়েছে।
ক্রফোর্ড সাহেব সেদিন ডেকেছিল। বললে—তুমি নাম লেখাওনি সেন?
দীপঙ্কর বললে—না স্যার, সবাই আছে, আমি না-ই বা থাকলাম—
—কিন্তু, তুমি নাম লেখালে কিংস কমিশন পাবে—ল্যোন্ট হবে, মেজর হবে—
দীপঙ্কর বললে—আমি জানি স্যার—
—তাহলে তুমি কি ভয় পেয়েছো? তুমি কি অ্যাফ্রেড্?
দীপঙ্কর বললে—ভয় নয়, ঠিক উল্টো, আমি ভয় পাইনি বলেই সই করিনি—
—কিন্তু টাকা? ডি অব্ আইতে সই করলে আরো দেড় শো টাকা এক্সট্রা পাবে— টাকার বেনিফিট্ তুমি চাও না?
সত্যিই, জিনিস-পত্রের দাম বাড়বার জন্যে পুওর-ক্লার্করা সবাই মিলিটারিতে নাম লিখিয়েছে। শুধু দীপঙ্করই নাম লেখায়নি। বাড়ো বুড়ো ক্লার্ক, যারা জীবনে সংসার আর চাকরি ছাড়া আর কিছুই বোঝে না, তারাও সবাই দুপুর-বেলা প্যারেড করে। মাঠে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে লেফট রাইট করে। রোদে ঘেমে নেয়ে হাঁপায়। শুধু দু’টো টাকার মুখ দেখতে পাবে বলে। কোথায় রইল কংগ্রেস কোথায় রইল স্বরাজ, কোথায় রইল মহাত্মা গান্ধী—সবাই টাকার জন্যে দাসখৎ দিয়ে দিলে কাগজে। রেলের আপিসকে আর রেলের আপিস বলে চেনা যায় না। অন্য চেহারা হয়ে গেছে রাতারাতি। সবাই মিলিটারি-সবাই সেপাই। তালপাতার সেপাই সব। টাকার দাস। সুধীরবাবু, মধু, রঞ্জিতবাবু, পাসবাবু— কাউকেই আর চেনা যায় না। মাদ্রাজ আর কলকাতা-রেঙ্গুনে বোমা পড়বার পরই চেহরা বদলে গেল। দলে দলে দুটো শহরের লোক পালাচ্ছে। শহরের লোক সব হাওড়া আর শেয়ালদ’স্টেশনের দিকে ছুটছে। ছেলেরা চুপ-চাপ বসে থাকে। স্কুল কলেজ বন্ধ, ইউনিভার্সিটি বন্ধ। কেউ নেই। কোথাও কেউ নেই। সমস্ত পৃথিবীতে যেন মানুষ নিরাশ্রয়ের মত আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ছুটছে।
—তাহলে তুমি কি ভিক্টরি চাও না?
ভিক্টরি! কাদের ভিক্টরি, কীসের ভিক্টরি! কেন ভিক্টরি চইবে দীপঙ্কর। যদি মানুষের জয় হয় তো নিশ্চয়ই দীপঙ্কর সে-দলে থাকবে। কিন্তু কই, পাঁচ বছর ধরে চায়নার ওপর বোমা ফেলেছে জাপান, তবু চাইনিজরা তো পালায়নি! গ্রেট ব্রিটেনের ওপর জার্মানী তো কত বোমা ফেলেছে, কই, এমন করে তো ইংরেজরা পালায়নি সেখান থেকে! কেন তবে কলকাতার লোক পালায়! কেন তারা অসহায় বোধ করে! কেন তারা অভিভাবকহীন হয়ে গ্রামে মফস্বলে গিয়ে প্রাণের ভয়ে লুকোয়।
সন্তোষ-কাকা সেদিন এল। একেবারে দৌড়তে দৌড়তে ঘরে এসে ঢুকলো। দীপঙ্কর তখন আপিসে যাচ্ছে।
সন্তোষ-কাকা বললে—তুমি তো আমাদের যেতে দিলে না রসুলপুরে, এখন এদিকে কী কান্ড হলো দেখছো তো?
দীপঙ্কর বললে—কী কান্ড?
—কেন, তুমি জানো না কী কান্ড? তুমি জানো না? আমার সঙ্গে আবার চালাকি হচ্ছে?
দীপঙ্কর একটু চুপ করে রইল। তারপর বললে—কী বলতে চান, আপনি সোজা করে বলুন আমাকে?
—সোজা করে বলুন মানে? আমি কি তোমার সঙ্গে ইয়ারকি করছি বলতে চাও? মানুষের প্রাণ নিয়ে ইয়ারকি করার সময় এইটে? আমরা গরীব লোক বলে আমাদের প্রাণের কি দাম নেই ভেবেছ?
—তার মানে?
সন্তোষ-কাকা বললে—তোমার না-হয় আপিস আছে, যদি বোমা পড়ে তো আমরা কোথায় থাকবো শুনি? আমরা কোথায় থাকবো? আমরা বাপ-বেটিতে বেঘোরে মারা যাবো, এই কি তোমার মনোবাঞ্ছা?
দীপঙ্কর এতক্ষণে বুঝতে পারলে। বললে—কিন্তু বোমা পড়লে দেশে পালিয়ে গিয়েই কি বাঁচতে পারবেন কাকাবাবু?
—তোমায় আর অত দরদ দেখাতে হবে না বাবাজী, খুব দরদ দেখিয়েছ। তোমার নিজের রান্না-খাওয়া চলে যাচ্ছে কিনা, তাই আর উচ্চবাচ্য করছো না, এদিকে যে পাড়া ফাঁকা হয়ে গেল, পাড়ায় যে আর কেউ নেই—আমরা কি মরতে এসেছি এখানে?
দীপঙ্করের উত্তর দেবার আগেই সন্তোষ-কাকা বাধা দিয়ে বললে—কিন্তু আর আমায় রাখতে পারবে না তুমি এই বলে রাখছি, আর আমায় ধরে রাখতে পারবে না—আমার মেয়ে আর তোমার আপিসের পিন্ডি রাঁধতে পারবে না—এই বলে দিলুম—
দীপঙ্কর বললে—তা ভাত রান্নাটা তো বড় কথা নয় কাকাবাবু, আমার কাশীই ভাত রাঁধতে পারবে—আপনারা আরাম করে থাকুন না এখানে—বিপদ হলে তো আর একলা আপনার হবে না, সকলেরই হবে! দেশে গিয়ে কী করবেন?
সন্তোষ-কাকা বললে—তার মানে? দেশে গিয়ে কী করবো? তুমি তো বেশ বললে, এদিকে আমার মেয়ের বয়েস হচ্ছে না? লড়াই যদি এখন দশ-বছর চলে তো আমার মেয়ে আইবুড়ো হয়ে থাকবে! তার বিয়ে দিতে হবে না?
দীপঙ্কর বললে—বিয়ের জন্য অত ভাবছেন কেন? আমি তো আছি—
সন্তোষ-কাকা এবার রেগে উঠলো। বললে—দেখ, খবরদার বলছি আমার সঙ্গে ইয়ারকি কোরো না, তোমার সঙ্গে আমার ইয়ারকির সম্পর্ক নয়—জানো, আমি রসুল- পুরের দত্ত?
বলে ঘর থেকে তেড়ে-মেড়ে বেরিয়ে গেল সন্তোষ-কাকা। যাবার সময় বলে গেল—আমি দেখাচ্ছি তোমার ইয়ারকি দেওয়া, আমার সঙ্গে ইয়ারকি দেওয়া আমি দেখাছি—
বলে চিৎকার করে শাসাতে শাসাতে সন্তোষ-কাকা একতলায় নেমে এল। তারপর সোজা উঠোন পেরিয়ে একেবারে রান্নাঘরে।
—এই ক্ষিরি, ক্ষিরি, আয় ইদিকে—হাতা-বেরি রাখ্ তো—রাখ্—
ক্ষীরোদা রান্না করছিল। হঠাৎ সন্তোষ-কাকা হাতা ধরে টান দিলে। বললে—রাঁধতে হবে না আর—
ক্ষীরোদা প্রথমটা অবাক হয়ে গিয়েছিল। তারপর সামলে নিয়ে বললে—বাবা তুমি কি পাগল হয়ে গেলে?
সন্তোষ-কাকা বললে—না, পাগল হইনি, তবে পাগল হতে আর দেরি নেই, তুইও পাগল হয়ে যাবি, আমিও পাগল হয়ে যাবো! ভেবেছে কী সব? আমি মেয়ের বিয়ে দিতে পারিনে? আমার ক্ষমতা নেই? আম িসবাইকে দেখিয়ে দেব রসুলপুরের সন্তোষ দত্ত কী করতে পারে? আমি লঙ্কাকান্ড বাধিয়ে দিতে পারি—তা জানিস, আমি কিছু বলিনে বলে তাই—
ক্ষিরি খানিকক্ষণ বাবার কথা শুনতে লাগলো। তারপর বললে—এমন করে চেঁচিও না তুমি—দুটো মুড়ি দিচ্ছি, খাও বসে বসে —
—কী? মুড়ি দিয়ে তুই আমার মুখ বন্ধ করতে চাস? খাবো না আমি মুড়ি—আমি চুপ করবো না, আমি আজ এর একটা হেস্তনেস্ত করবোই—রাখ তুই হাতা-বেড়ি, চল আমার সঙ্গে,—চল্—
ক্ষিরিকে সন্তোষ-কাকা যত টানছে, ক্ষিরিও তত ভয়ে পেছু হাঁটে।
ক্ষিরি বলে—কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমাকে? কোথায় যাবো?
সন্তোষ-কাকা তখনও হাত ছাড়েনি। বলে—চল্, রাস্তায় গিয়ে ভিক্ষে করবো তবু এখানে থাকবো না, ভেবেছে আমার থাকবার জায়গা নেই, এ-বাড়ি ছাড়া আমার গতি নেই—
—কিন্তু তা বলে এই অবস্থায় যাবো?
—হ্যাঁ, যা বলছি শোন্ —
—এখনও যে খাওয়া-দাওয়া হয়নি তোমার? তুমি ভাত খাবে না?
সন্তোষ-কাকা বললে—আমি পিন্ডি খাবো না, উপোস করবো তবু এখানে থাকবো না—একদিন না-খেলে কী হয় শুনি? একদিন না-খেলে কী হয়? মরে যায় লোক? মরে যায় না। তুই চলে আয়—
ক্ষিরিকে টানতে টানতে সন্তোষ-কাকা প্রায় উঠোনের মধ্যেখানে এসে হাজির হয়েছে। তখনও ছাড়ে না।
হঠাৎ দীপঙ্কর ওপর থেকে শব্দ পেয়েই একেবারে সিঁড়ি দিয়ে নিচেয় নেমে এসেছে। একেবারে সন্তোষ-কাকার হাতটা ধরে ফেলেছে। বললে—করছেন কী? করছেন কী কাকাবাবু? হাত-টানাটানি করছেন কেন? ছেড়ে দিন, ছেড়ে দিন—
সন্তোষ-কাকার হাতটা জোর করে ছাড়িয়ে দিতেই, সন্তোষ-কাকা দীপঙ্করের দিকে কেমন কট্ট্ করে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর বললে—তুমি আমার গায়ে হাত দিলে শেষকালে? শেষকালে তুমি আমার গায়ে হাত দিয়ে হেনস্থা করলে? আচ্ছা দেখাচ্ছি—দাঁড়াও—
বলে আর কথাবার্তা নেই, একেবারে চিৎকার করতে করতে লাফাতে লাফাতে সদর দরজা দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে গেল। রাস্তার বাইরেও সন্তোষ-কাকার চিৎকার শোনা গেল—আচ্ছা দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা, মজা টের পাওয়াচ্ছি আমি—
তারপর আর সন্তোষ-কাকার গলা শোনা গেল না।
সেই উঠোনের ওপরেই দীপঙ্কর আর ক্ষীরোদা তখনও চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। যেন দু’জনেই হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল সন্তোষ-কাকার কান্ড দেখে।
দীপঙ্কর ক্ষীরোদার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললে—তুমি কিছু ভেবো না, কাকাবাবু ক্ষিদে পেলেই বাড়ি ফিরে আসবেন—তুমি ভেবো না কিছু—
ক্ষিধে পেলে যে সন্তোষ-কাকা বাড়ি ফিরে আসবে, তা ক্ষীরোদা জানতো। কিন্তু এও জানতো যে তার খেয়ালী বাবা খেয়ালের ঝোঁকে সারাদিন উপোস করেও কাটিয়ে দিতে পারে। ক্ষীরোদা তার বাবাকে ভাল করেই চিনে নিয়েছিল তার ছোট জীবন- পরিধির মধ্যে। বাবা যেমন খেতে পটু, তেমনি না-খেতেও যে পটু, সে-খবর বাইরের কেউ না-জানুক, ক্ষীরোদা জানতো। জানতো বাবা যখন রাগ করে, সে বড় কঠিন রাগ। তখন সে-রাগে বিশ্ব-ব্রহ্মান্ড পুড়িয়ে নিঃশেষ করে ফেলতে পারে। আবার যখন ভালোবাসে, তখন সে ভালবাসা বুঝি কখনও অমন করে পরকে আপন করেও নিতে জানে না। আরো জানতো বাবা গ্রামের লোক বটে, কিন্তু গ্রামেও বুঝি অমন লোক দু’টি পাওয়া যাবে না। তাই গ্রামেও বাবা টিঁকতে পারেনি, শহরেও টিকতে পারলো না।
তারপর এক সময় আরো বেলা হলো। বাবা এল না। দীপঙ্কর আপিসে চলে গেল খেয়ে-দেয়ে। রান্নাঘরের পাট চুকিয়ে কাশীও খেয়ে নিলে। কাশী জিজ্ঞেস করলে—তুমি খাবে না দিদিমণি?
ক্ষীরোদা বললে—না—
কাশী বললে—কাকাবাবুকে একবার খুঁজতে বেরোব?
ক্ষীরোদা বললে—একবার তুমি যেতে পারো তো ভালো হয়—বুড়ো মানুষ তো—
কাশী বললে—কোথায় দেখবো? কোন্ দিকে যেতে পারেন?
ক্ষীরোদা বললে—আমি কি কোনওদিন বাইরে বেরিয়েছি এখানে যে বলবো! কোথায় আর যাবে বাবা, কাছেই হয়ত আছে কোথাও—দেখ না বাইরে গিয়ে—
কাশী বেরোল। ক্ষীরোদা জানালা ধরে দাঁড়িয়ে রইল রাস্তার দিকে চেয়ে। রাস্তাটা নিঝুম হয়ে আছে। দুপুরের কলকাতা শহর। কয়েকমাস হলো রাস্তাটা আরো নিঝুম হয়ে গেছে। গলিটার ওধারে একটা নর্দমা। তার ওপাশে বেশি দূর আর নজর চলে না। একটা বাড়ির আড়ালে রাস্তাটা কোথায় গিয়ে ট্রাম-রাস্তায় ঠেকেছে—কিছুই জানে না ক্ষীরোদা। শুধু কর্কশ ঘড়-ঘড় আওয়াজ কানে আসে। দু’একটা বাড়ির ঝি-চাকর এধার থেকে ওধারে যায়। পাশের বাড়ির একটা বুড়ী-ঝি যাচ্ছিল। ক্ষীরোদা আস্তে আস্তে ডাকলে। বললে-ও মেয়ে শুনছো?
—কী মা? কাছে এর বুড়ী-ঝি’টা।
ক্ষীরোদা বললে—তুমি কোন্ দিকে গিয়েছিলে গা? আমার বাবাকে দেখেছ? বুড়ি-ঝিটা অবাক হয়ে তাকালো। বললে—তোমার বাবা? কই দেখিনি তো মা? কোথায় গেছে?
বুড়ী-ঝি’টা আরো দু’একটা কথা বলে নিজের কাজে চলে গেল। ক্ষীরোদা গরাদে মাথা ঠেকিয়ে যতদূর দৃষ্টি যায় ততদূর দেখতে লাগলো। ঝাঁ-ঝাঁ করছে রোদ। কাঠ ফেটে যাচ্ছে রোদের ঝাঁজে! আর একজন কে আসছিল। ক্ষীরোদার একবার দ্বিধা হলো। কিন্তু তখন আর উপায় নেই। বললে—হ্যাঁ গো, একজন বুড়ো মানুষকে দেখেছ তুমি?
—বুড়ো মানুষ? কী-রকম বুড়ো মানুষ?
সত্যিই তো বুড়ো মানুষ তো সংসারে কতই আছে, রাস্তাতেও কত ঘোরা-ফেরা করছে। কে আর তার সন্ধান করছে। কে তার বাবার নাম-ধাম চেহারা মুখস্ত করে রেখে দিয়েছে! ক্ষীরোদা আরো অনেকক্ষণ ধরে জানালার বাইরে চেয়ে রইল। মাথার ওপরের সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়লো। চারটে বাজলো ঘড়িতে। পাঁচটা বাজলো, ছ’টা বাজলো। সন্তোষ-কাকা আর ফিরে এল না।