Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    কড়ি দিয়ে কিনলাম ২ – বিমল মিত্র

    বিমল মিত্র এক পাতা গল্প950 Mins Read0

    কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৮

    ১৮

    লক্ষ্মীদি সকালবেলাই ঘুম থেকে উঠেছে। সকাল থেকেই তার বড় তাড়া। দাতারবাবুও তৈরি হয়ে নিয়েছে। সকাল থেকেই লক্ষ্মীদির দরজার সামনে গাড়ি দাড়িয়ে থাকে। সকালবেলাই চা চড়ায় কেশব। চা মুখে পড়লেই লক্ষ্মীদির আর জড়তা থাকে না। আগের রাত্রে দেরি করে ঘুমোলেও চায়ের একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে।

    বিছানায় শুয়ে-শুয়েই লক্ষ্মীদি এপাশ-ওপাশ করে।

    দাতারবাবু সেজে-গুজে ঘরে এসে বলে—কী হলো, এখনও ওঠোনি?

    লক্ষ্মীদি বললে—ক’টা বাজলো?

    দাতারবাবু বললে—পাঁচটা—

    —এখনও যে চা দিলে না কেশব?

    দাতারবাবু চিৎকার করে ডাকে—কেশব, কেশব—শিগগির চা দাও—

    খানিক পরে সুধাংশু এসে হাজির। সুধাংশুও সকাল-সকাল উঠেছে আজ। উঠেই চলে এসেছে।

    বললে—মিসেস দাতার, এত দেরি যে আপনার?

    লক্ষ্মীদি বললে—কালকে তুমি বড্ড বেশি খাইয়ে দিয়েছিলে সুধাংশু—

    কেশব ততক্ষণে চা দিয়ে গেছে। চায়ের কাপে একটু চুমুক দিতেই সমস্ত জড়তা কেটে গেল শরীরের। তাড়াতাড়ি উঠে পড়লো। বলে—তুমি বোস সুধাংশু একটু, আমি তৈরি হয়ে আসছি—

    দাতারবাবু তৈরি হয়েই বসেছিল। সুধাংশু বললে—সাতটায় প্লেন আসবে, এখনও তো টাইম আছে—

    দাতারবাবু বললে—আমার সেই ভোর চারটেতেই ঘুম ভেঙে গেছে সুধাংশুবাবু— আমি অনেকক্ষণ আগে থেকে তৈরি—

    আজকাল কেমন আছেন আপনি মিস্টার দাতার?

    দাতারবাবু বললে—এখন আর কোনও কষ্ট হয় না—আগে মাথাটা কেমন করতো, আজকাল তাও সেরে গেছে—

    সুধাংশু বললে—তবু ওষুধটা এখনও খেয়ে যান—ওষুধ ছাড়বেন না—

    কোথা থেকে যে সুধাংশু ওষুধ এনে দেয়! যে ওষুধ বাজারে কোথাও পাওয়া যায় না, সুধাংশু একটা টেলিফোন করলেই হাতের কাছে এসে যায় সেই ওষুধ। শুধু ওষুধ নয়, সব কিছুই সুধাংশুর হাতের নাগালের ভেতরে। যে হুইস্কি বাজারে ব্ল্যাকে আশি টাকা নব্বই টাকা, সেই হুইস্কি পঁয়তাল্লিশ টাকা ফেললেই চলে আসে সুধাংশুর কাছে। সুধাংশু বলে—আমাকে শুধু আপনি বলুন না আপনার কী চাই, আমি এনে দিচ্ছি। হরলিকস্ নেবেন? বাঘের দুধ নেবেন? খাঁটি ঘি নেবেন?

    এই গড়িয়াহাটের এই বাড়িটা কি এমনি ছিল আগে? দীপঙ্কর একদিন দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। দীপঙ্কর লক্ষ্মীদির বাড়িতে এসে প্রথমে চিনতে পারেনি। এ কী বাড়ি? এ কার বাড়ি? বিকেল বেলা তখন। দীপঙ্কর বলেছিল—এ হঠাৎ কী হলো লক্ষ্মীদি?

    লক্ষ্মীদি বলেছিল—বাড়িটা আমি কিনলুম যে!

    তুমি এই বাড়ি কিনলে?

    দীপঙ্করের যেন বিশ্বাস হবার কথা নয়। যে-বাড়িতে একদিন ভাড়াটে হয়ে এসেছিল, সেই বাড়ির মালিক হয়ে বসেছে লক্ষ্মীদি। বাইরে থেকে একেবারে সমস্ত বাড়িটার ভোল বদলে গেছে। নতুন কনক্রীটের হাল ফ্যাসানের বাড়ি। সামনে গ্রীলের গেট। লম্বা টাওয়ার। গ্লাস-ফিটিং আঁটা উইনডো।

    দীপঙ্কর বলেছিল—এত সিমেন্ট কোথায় পেলে এখন?

    লক্ষ্মীদি বলেছিল—কেন, সুধাংশু আছে আমার, ভাবনা কী?

    —তা কত দিয়ে বাড়িটা কিনলে?

    সত্যিই, লক্ষ্মীদির অনেক সাধ ছিল জীবনে। স্বামী হবে, সংসার হবে, টাকা হবে, বাড়ি হবে, গাড়ি হবে, ছেলে হবে। সব হয়েছে। সব হয়েছে লক্ষ্মীদির। লক্ষ্মীদির যা কিছু চেয়েছিল, সমস্ত পেয়েছে। আর কিছু হতে বাকি নেই।

    —এখন তোমার ছেলের কোন্ ক্লাশ হলো?

    হঠাৎ যেন মনে পড়লো। বললে—মানস? মানস তো আসছে রে কলকাতায়– তোকে বলতে ভুলে গেছি—

    তারপর একটু থেমে বলেছিল—জানিস দীপু, সেই ছোটবেলা থেকে মনসকে দূরে সরিয়ে রেখেছি—একদিনের জন্যে কাছে আনতে পারিনি। বরাবর কষ্ট করে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি সেখানে—কিন্তু কাছে এনে রাখতে কখনও সাহস পাইনি—

    —কেন?

    লক্ষ্মীদি গলা নিচু করে বলেছিল—ছি, তুই বলিস কী—আমি মা হয়ে কি ছেলেকে এখানে আসতে বলতে পারি কখনও? এই জুয়া হুইস্কি আর এইসব পাপের মধ্যে? দীপঙ্করের চোখের সামনে লক্ষ্মীদির যেন আর এক রূপ ফুটে উঠেছিল।

    লক্ষ্মীদি আরো বলেছিল আমি তো জানি আমি কী! আমি তো জানি আমি কী ভাবে টাকা রোজগার করেছি, কী ভাবে শম্ভুকে সারিয়ে তুলিয়েছি, কীভাবে ছেলে মানুষ করেছি—তুইও তা কিছু কিছু জানিস তো! তাই তো ছেলেকে বরাবর বাইরেই রেখেছিলাম—

    —তোমার ছেলেকে আমি কখনও দেখিনি, লক্ষ্মীদি!

    —দেখবি কী করে? আমিই কি দেখেছি? শুধু মাঝে মাঝে কয়েকবার গিয়েছিলাম ছেলেকে দেখতে। তার ভেকেশনের সময় পর্যন্ত তাকে অন্য জায়গায় পাঠিয়েছি। তবু এখানে আসতে দিইনি। লিখেছি—তোমার বাবার অসুখ, এখানে এলে তোমার অসুবিধে হবে। কিন্তু এমন করে আর কতদিন আটকে রাখতে পারবো? একদিন তো মানস বড় হবে, একদিন তো মানস সব বুঝতে শিখবে, সব জানতে পারবে, তখন?

    দীপঙ্কর এ-কথার কিছু উত্তর দিতে পারেনি।

    তারপর লক্ষ্মীদি আবার বলেছিল—এবার মানস লিখেছে—এবার এখানে আসবেই—

    দীপঙ্কর বলেছিল—এখন তো তোমার সব হয়েছে, বাড়ি হয়েছে, এখন দাতারবাবুকে দিয়ে আবার বিজনেস্ করাও না—আবার একটা ব্যবসা ফাঁদোনা—সেই আগেকর মত অর্ডার সাপ্লাইএর ব্যবসা—

    লক্ষ্মীদি বলেছিল—এখনও তো শম্ভুই ব্যবসা করছে। এখন তো শম্ভুর নামেই কন্‌ট্র্যাক্ট দিচ্ছে সুধাংশু—। আসলে এ-সবই তো সুধাংশুর দেওয়া, কিন্তু নামটা তো শম্ভুর—

    তারপর হঠাৎ দেয়ারের একটা ছবির দিকে দেখিয়ে বলেছিল—ওই দ্যাখ্, ওই মানসের ছবি—

    দেয়ালের গায়ে ফ্রেমে আঁটা ফোটোগ্রাফ ঝুলছিল। দীপঙ্কর সেই দিকে চেয়ে দেখলে! কী আশ্চর্য! এমন চমৎকার ছেলে লক্ষ্মীদির। কী চমৎকার বড় বড় চোখ। চোখও যে কথা বলতে পারে, ছবিখানা না দেখলে যেন বোঝা যায় না।

    —সুধাংশু বলছিল মানসকে ওখান থেকেই লন্ডনে পাঠিয়ে দিতে। অক্সফোর্ড কিম্বা কেমব্রিজে কোথাও পড়ুক গিয়ে।

    দীপঙ্কর বলেছিল—কিন্তু তুমি কি থাকতে পারবে ছেলেকে অতদূরে পাঠিয়ে?

    —না পারলেও তো পারতে হবে। এতদিনই বা পারছি কী করে?

    —তাহলে?

    —কিন্তু মানস শুনবে না। আমাকে চিঠি লিখেছে কলকাতায় এবার আসবেই। এখানে বাড়িতে আমার কাছে থাকবে—

    দীপঙ্করের জিজ্ঞেস করেছিল—কবে আসবে?

    —এই মার্চের শেষে!

    এই সেই মার্চের শেষ। সকাল সাতটার প্লেনে আসছে মানস। লক্ষ্মীদি, দাতারবাবু, সুধাংশু সবাই তৈরি, সবাই আজ আনতে যাবে।

    লক্ষ্মীদি তৈরি হয়ে এল। ডার্ক গ্রীন রং-এর ব্লাউজের ওপর লাইট ইয়োলো কলারের শিফন শাড়ি।

    সুধাংশু বললে—রেডি?

    —রেডি!

    হঠাৎ লক্ষ্মীদির কী যেন একটা কথা মনে পড়লো। এতদিন পরে খোকা আসছে। মা’র কাছে আসছে।

    লক্ষ্মীদি বললে—দাঁড়াও সুধাংশু, আমি আসছি—এক মিনিট—

    বলে লক্ষ্মীদি আবার পাশের ঘরে চলে গেল। তারপর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আবার ঘরে এসে ঢুকেছে। বললে—চলো চলো, আর টাইম নেই—

    বলে নিজের রিস্ট-ওয়াচটা একবার দেখে নিলে।

    সুধাংশু তখন যেন সামনে ভূত দেখছে। দাতারবাবুও অবাক হয়ে গেছে। সুধাংশু বললে—এ কি, শাড়িটা বদলে এলেন যে মিসেস দাতার?

    মিসেস দাতারের সত্যিই তখন অন্য চেহারা। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই শাড়ি ব্লাউজ সব বদলে এসেছে। সেই ডার্ক গ্রীন ব্লাউজ আর লাইট ইয়োলো শাড়ির বদলে পরে এসেছে একটা সাদা পলিনের ব্লাউজ আর শান্তিপুরী তাঁতের শাড়ি।

    সুধাংশু বললে—এ কী করলেন মিসেস দাতার? সে শাড়িটা বদলে এলেন কেন? রঙিন শাড়িতেই তো আপনাকে বেশি মানায় —

    লক্ষ্মীদি বললে—ছি, আমার লজ্জা করছিল বড্ড—

    সুধাংশু তবু বুঝতে পারলে না। বললে—কেন?

    লক্ষ্মীদি বললে—না না সুধাংশু, ছেলেকে আনতে অত সাজ-গোজ করতে যেন কেমন লজ্জা করছিল—

    —কেন তাতে কী হয়েছে?

    লক্ষ্মীদি বললে—না সুধাংশু, আমি যে তার মা—

    তারপর গাড়িতে উঠেই লক্ষ্মীদি বললে—চলো, আগে দীপুর বাড়িতে যাই, দীপুকেও সঙ্গে নিয়ে যাবো, ও-ও মানসকে দেখবে বলেছিল—

    .

    সেদিনও এস্টাবলিশমেন্ট সেকশান থেকে সুধীরবাবু এসে মিস্টার ঘোষালের সামনে ফাইলটা খুলে দাঁড়ালো।

    বললে—স্যার, সেই মিস্ মাইকেলের ভেকেন্সিটা—

    মিস্টার ঘোষাল কাজ করতে করতে বললে—নট নাউ—

    —স্যার অনেকদিন দেরি হয়ে গেল—

    মিস্টার ঘোষাল আবার গর্জন করে উঠলো—নট নাউ—

    সুধীরবাবুর আর সামনে দাঁড়াবার সাহস হলো না। একেবারে ঘরের বাইরে এসে বাঁচলো। ঘরের বাইরে আসতেই দ্বিজপদ বললে—কেমন মেজাজ দেখলেন বাবু সায়েবের?

    সুধীরবাবু বললে—তোর সাহেবের মেজাজের বালাই নিয়ে এবার আমরা মরে যাবো দ্বিজপদ—এবার সমস্ত আপিসটাই মারা যাবে তোর সাহেবের জন্যে—! কবে তোর সাহেব নিজে মারা যাবে বলতে পারিস?

    দ্বিজপদ বললে—শালা আমার সায়েব নয় তো শুয়োরের বাচ্চা—

    বাইরে মুখে যাই বলুক, মনে মনে কিন্তু দ্বিজপদ সাহেবের দীর্ঘ-জীবনই কামনা করে, বলে—জয় বাবা জগন্নাথ, জয় বাবা বলরাম, সাহেবকে আমার বাঁচিয়ে রেখ বাবা। আর ক’টা মাস বাঁচিয়ে রাখলে দ্বিজপদকে আর চাকরি করে খেতে হবে না। পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে আয়েস করে দেশে গিয়ে শেষ জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবে! আর ক’টা মাস, বেশি দিন নয়। মাত্র আর ক’টা মাস।

    রেলের বাবুরা মিলিটারি পোশাক পরে প্যারেড করে—আর হাঁপায়। কখনও তো অভ্যেস নেই। ক’টা টাকার জন্যে বেমালুম দাসখত লিখে দিয়েছে বাবুরা। জীবনে কখনও ধূতি-কামিজ ছাড়া পরেনি, তারাই আবার পরছে প্যান্ট-কোট।

    দ্বিজপদ হাসে বাবুদের দিকে চেয়ে। বলে—দেবে যখন গরু খাইয়ে তখন বুঝবেন ঠেলাটা—

    —কেন গরু খাওয়াবে কেন?

    বাবুরা রেগে যায় দ্বিজপদর কথা শুনে। বলে—গরু ওমনি খাওয়ালেই হলো?

    দ্বিজপদ বলে—তা বাবু, লড়াইয়ে গেলে খাওয়াবে না? লড়াইতে নিয়ে গিয়ে কি কালিঘাটের পাঁঠার মাংস খাওয়াবে ভেবেছেন—

    সত্যিই, বাবুদেরও ভয় লেগে গিয়েছে। দু’টো টাকার জন্যে শেষ কালে হয়ত জাতটা খোয়াতে হবে। দ্বিজপদর কী? দ্বিজপদর কিসের ভাবনা! ঘোষাল-সাহেব যদ্দিন আছে তদ্দিন মজা লুঠে নাও। তারপর বুঝবে ঠেলা। দ্বিজপদ ছাড়া আর সবাই মিলিটারিতে নাম সই করেছে। ট্র্যাফিক আপিসে এক দ্বিজপদ সই করেনি। আর সই করেনি সেন-সাহেব। সেন-সাহেব তখনও আপিসে আসেনি। একজন বাঙালীবাবু এসে মধুকে জিজ্ঞেস করলে—সেন-সাহেব আছে?

    মধু বললে—না—

    —কখন আসবে সাহেব?

    মধু বললে—আসবে দেরিতে-আসতে দেরি হবে সায়েবের—

    লোকটা তখনও ঘোরাঘুরি করতে লাগলো। কোণের দিকে একটা বেঞ্চি পাতা ছিল। তার ওপর বসলো গিয়ে।

    মধু বললে—আপনি বরং কাল আসবেন বাবু, আজকে দেখা হবে না—

    -–কেন? আজকে কী হলো?

    —এখন অনেক কাজ সায়েবের। আপিসে এসে কারো সঙ্গে দেখা করেন না আজকাল।

    লোকটা বললে—আমার সঙ্গে দেখা করবে—সেন-সাহেব আমার বন্ধু, এক সঙ্গে এক ক্লাশে এক ইস্কুলে আমরা পড়েছি এককালে—

    লোকটার কথা শুনে মধু যেন কেমন অবাক হয়ে গেল। সেন-সাহেবের বন্ধু- এ কেমন বন্ধু আবার!

    সেন-সাহেবের আপিসে আসতে অনেক দেরি হয়ে গেল। বেলা যখন বারোটা তখন আপিসে এসে হাজির দীপঙ্কর। সমস্ত সকালটা কেটেছে রাইটার্স বিল্ডিংএ। বর্মা ইভাকুয়ীজ আপিসের সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়াতে হয়েছিল। সেদিনও খুব ভিড়।

    দীপঙ্কর রসিদটা দিতেই ভেতরের ক্লার্ক বললে—ভুবনেশ্বর মিত্র?

    তারপর ঠিকানা দেখলে। অনেক কাগজপত্র খোঁজাখুঁজি করলে। অনেক ফাইল, অনেক পুঁথি অনেক নথি।

    তারপর বললে—না স্যার, এখনও ট্রেস পাওয়া যায়নি—

    দীপঙ্কর বললে—এর আগে অনেকবার এসে ফিরে গিয়েছি, একটু দেখুন ভাল করে—

    ক্লার্কটা বললে—খুব ভাল করে দেখেছি স্যার, যাদের ট্রেস পাওয়া গেছে তাদের লিস্ট দেখেছি, আর যাদের ট্রেস পাওয়া যায়নি তাদের লিস্টও দেখেছি, কোনও লিস্টেই তাঁর নাম নেই—

    তারপর লম্বা একখানা লিস্ট দেখিয়ে বললে—আর এই দেখুন ক্যাজুয়েল্টি লিস্ট— যারা বোমা পড়ে মারা গেছে, তাদের লিস্টেও নাম নেই—আপনি পরে আর একদিন আসবেন—

    দীপঙ্কর সেখানে আর দাঁড়ায়নি। তারপর সেখান থেকে সোজা আপিসে আসতেই নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়ে কে যেন পাশ থেকে ডাকলে—দীপু—

    দীপঙ্কর চেয়ে দেখলে।

    —কে?

    লোকটা এতক্ষণে সামনে এসে দাঁড়াল। বললে—আমায় চিনতে পারলে না?

    –কে তুমি?

    —আমি লক্ষ্মণ সরকার। সেই কালিঘাট স্কুলের ইনফ্যান্ট ক্লাশে এক সঙ্গে—

    —এসো এসো, তুমি লক্ষ্মণ!

    আশ্চর্যই বটে! আশ্চর্য ঘটনাই বটে! সেই ছোটবেলাকার লক্ষ্মণ সরকার! সেই ছোটবেলায় যখন-তখন মাথায় চাঁটি মারতো! রাস্তায়, পথে, বাজারে সব জায়গায় অপমান-অত্যাচারের একশেষ করতো যে লক্ষ্মণ, সেই আজ এসেছে দীপঙ্করের কাছে!

    ততক্ষণে দীপঙ্কর নিজের ঘরে এসে চেয়ারে বসেছে। বললে—বোস বোস -কী মনে করে?

    —তুমি আমায় চিনতে পেরেছ তো ভাই?

    দীপঙ্কর বললে—খুব চিনেছি—হঠাৎ কী জন্যে?

    লক্ষ্মণ বললে—ভাই, আমি ভীষণ বিপদে পড়ে তোমার কাছে এসেছি— ছোটবেলাকার কথা সব ভুলে যাও—আমিও এখন অনেক বড় হয়েছি, সে বয়েসও নেই, তুমিও এখন অনেক বড় হয়ে গেছ—

    —আসল কথাটাই বলে ফেল না!

    লক্ষ্মণ বললে—আমায় একটা চাকরি করে দিতে হবে ভাই—

    চাকরি! চমকে উঠলো দীপঙ্কর। সেই লক্ষ্মণ সরকার আজ এত লোক থাকতে চাকরি চাইতে এল তার কাছে! এত সাহস হলো তার! একটু লজ্জাও করছে না দীপঙ্করের কাছে চাকরি চাইতে! সেই লক্ষ্মণ সরকার আজ নিজে এসে তার কাছে প্রার্থী হয়ে দাঁড়িয়েছে। দীপঙ্করের মনে হলো এক চড় কসিয়ে দেয় লক্ষ্মণ সরকারের গালে। বলে—মনে নেই? মনে নেই সেই সব দিনের কথা! যেদিন রাস্তায় অকারণে অপমান করেছে, বই কেড়ে নিয়েছে, খাতা কেড়ে নিয়েছে, মেডেল কেড়ে নিয়েছে, খাবার কমলালেবু, কদমা কেড়ে নিয়েছে। মনে নেই!

    কিন্তু নিজেকে সামলে নিলে দীপঙ্কর। আত্মসম্বরণ করে নিলে হঠাৎ।

    লক্ষ্মণ সরকার তখনও মুখের দিকে চেয়ে চুপ করে প্রতীক্ষা করছিল।

    দীপঙ্কর অনেকক্ষণ পরে বললে—আচ্ছা যাও—দেখি আমি কী করতে পারি—

    লক্ষ্মণ বললে—আমি ভীষণ বিপদে পড়েই তোমার কাছে এসেছি ভাই—আমি একেবারে খেতে পাচ্ছি না—

    দীপঙ্কর বললে—তুমি যাও এখন, পরে দেখা করো—

    —কবে আসবো? আমি একটা দরখাস্ত এনেছিলাম, এই নাও—

    দীপঙ্করের হঠাৎ রাগ হয়ে গেল। বললে—চাকরি কি আমার হাতের জিনিস যে তুমি চাইলেই আমি দিয়ে দেব?

    লক্ষ্মণ সরকার কী বলবে বুঝতে পারলে না। দরখাস্তখানা রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেল।

    দীপঙ্কর অনেকক্ষণ পরে দরখাস্তখানা হাতে তুলে নিলে। তারপর ছিঁড়েই ফেলতে যাচ্ছিল সেখানা। কিন্তু কী মনে হলো আবার রেখে দিলে টেবিলে। তারপর সুধীরবাবুকে ডাকলে।

    সুধীরবাবু আসতেই দীপঙ্কর বললে—কোথাও ভেকেন্সি আছে ট্র্যাফিকে?

    সুধীরবাবু কিছুক্ষণ ভাবলে। তারপর বললে—আছে স্যার—

    —কোথায়?

    —জার্নাল সেকশানে!

    —জার্নাল সেকশানে ভেকেন্সি কোথায়?

    সুধীরবাবু বললে—আজ্ঞে, গাঙ্গুলীবাবুর জায়গায় একটা টেম্পোরারী ভেকেন্সি আছে—গাঙ্গুলীবাবু তো অনেকদিন আসছেন না—তিনি সেই যে সেই কাশ্মীর চলে গিয়েছেন—

    দীপঙ্কর বললে—ঠিক আছে, এই ভদ্রলোককে ওই ভেকেন্সিতে রাখুন, যতদিন না গাঙ্গুলীবাবু আসেন—

    —আর একটা কথা।

    সুধীরবাবু যেতে যেতে দাঁড়িয়ে গেল।

    দীপঙ্কর বললে—আর একটা কথা, মিস্ মাইকেলের ভেকেন্সিতে কোনও লোক নেওয়া হয়েছে?

    সুধীরবাবু বললে—হ্যাঁ স্যার—

    কে? কাকে নেওয়া হয়েছে?

    সুধীরবাবু বললে—মিস্টার ঘোষালের একজন ক্যান্ডিডেট—

    —কে? নাম কী?

    সুধীরবাবু বললে-মিসেস ঘোষ।

    সেন-সাহেব একেবারে লাফিয়ে উঠেছে। কে মিসেস ঘোষ! কোন্ মিসেস ঘোষ? পুরোপ নাম কী?

    এক সঙ্গে অনেকগুলো প্রশ্নের ঝড় বয়ে গেল যেন। সুধীরবাবু সেন-সাহেবের মুখ দেখে ভয়ে আতঙ্কে একেবারে শিউরে উঠেছে।

    —বলুন, বলুন কোন্ মিসেস ঘোষ?

    — আজ্ঞে মিসেস সতী ঘোষ!

    .

    লক্ষ্মীদি ভেবেছিল অত ভোরে বোধহয় দীপু ঘুম থেকে উঠবে না। সকাল সাতটায় প্লেন এসে পৌঁছোবে। এতদিন পরে, এত বছর পরে মানস আসছে। এক ঘন্টা কি দেড় ঘন্টা অন্তত পৌছোতে লাগবে দম্দমে। গাড়ির ভেতরে উঠেছিল দাতারবাবু আর লক্ষ্মীদি। আর গাড়ি চালাচ্ছিল সুধাংশু।

    স্টেশন রোডের ঠিকানা সুধাংশু চেনে। অনেকবার মিসেস দাতারকে নিয়ে এসেছে। ট্রাম রাস্তা থেকে মোড় ঘুরতেই দেখা গেল অনেক মানুষের ভিড় জমেছে দীপুদের বাড়ি সামনে।

    সুধাংশু বললে—ওখানে অনেক ভিড় দেখছি মিসেস দাতার—

    লক্ষ্মীদিও বুঝতে পারলে না। এত ভোরে ওখানে ভিড় কিসের! কিছু পুলিসও দাঁড়িয়ে আছে।

    গাড়িটা কাছে যেতেই মেয়েলী গলায় কান্না শোনা গেল যেন। কে যেন ভেতরে কাঁদছে গলা ফাটিয়ে। ভিড়ের মধ্যে সেই ভোরবেলাই দীপঙ্করের লম্বা চেহারাটা দেখা যাচ্ছিল। স্পষ্ট দীর্ঘ চেহারা। আর তার পায়ের কাছেই যেন কার ক্ষত-বিক্ষত শরীর মাটিতে শোয়ানো। দর দর করে রক্ত পড়ছে। আর পাড়ার লোকজন চাকর-বাকর-ঝি চারদিকে ঘিরে রয়েছে।

    লক্ষ্মীদির গাড়িটার শব্দ পেয়েই দীপঙ্কর মুখ ফিরিয়ে চাইলে।

    সুধাংশু গাড়িটা থামাতেই লক্ষ্মীদি একেবারে ভিড় ঠেলে দীপঙ্করের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বললে—এ কে দীপু?

    দীপঙ্কর বললে—আমার এক কাকা—

    —তোর তো কাকা ছিল না কখনও! কী হয়েছিল এঁর?

    দীপঙ্কর বললে—মিলিটারি লরীতে ধাক্কা খেয়ে মারা গেছেন —

    —কখন হলো? কোথায়? কোন্ রাস্তায়?

    দীপঙ্কর বললে—কাল সকাল বেলা বাড়ি থেকে রাগ করে না খেয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন, কেউ খোঁজ পায়নি—এখন ভোর রাত্রে পুলিস নিয়ে এল—

    লক্ষ্মীদি বলবার মত কোনও কথা খুঁজে পেলে না। সমস্ত জায়গাটা শোকাচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে। বাড়ির দরজার আড়াল থেকে মেয়েটার আর্তনাদে আবহাওয়াটা কেমন মর্মন্তুদ হয়ে উঠেছে। সুধাংশু, দাতারবাবু, লক্ষ্মীদি সবাই বোবার মত একদৃষ্টে রক্ত মাখা নিষ্প্রাণ দেহটার দিকে অপলক-দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো। দীপঙ্করের মুখেও যেন ভাষা ফুরিয়ে গিয়েছে।

    লক্ষ্মীদি বললে—আমি আসি ভাই দীপু, আমার জরুরী কাজ আছে—আমার ছেলে আসছে আজ সাতটায়—

    —কে? মানস?

    —হ্যাঁ, দেরি হলে হয়ত অসুবিধে হবে তার, এত বছর পরে আসছে তো—তোকে নিয়ে যেতেই এসেছিলাম—তা—

    দীপঙ্কর বললে—তাহলে এসো—

    সবাই আবার গাড়িতে উঠলো। দীপঙ্কর বললে-তোমার সঙ্গেও আমার অনেক কথা ছিল লক্ষ্মীদি—

    —কী কথা?

    দীপঙ্কর বললে—পরে বলবো সব! সারা জীবনটার আমি কোনও মানে খুঁজে পাচ্ছি না লক্ষ্মীদি, এ কেন হয়? কেন হয় এমন কে জানে! কে বলে দেবে আমায়?

    লক্ষ্মীদি হাসলো। বললে—কেন রে? কী হলো?

    দীপঙ্কর বললে—জানো, সতী আমাদের আপিসে চাকরি করতে ঢুকেছে—

    —সে কী রে?

    লক্ষ্মীদিও খানিকক্ষণের জন্যে স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে রইল দীপঙ্করের মুখের দিকে। কিন্তু তখন আর বেশি কথা শোনবার সময় নেই। সুধাংশু গাড়িতে স্টার্ট দিয়েছে।

    লক্ষ্মীদি যেতে যেতে বললে—পরে সব শুনবোখন, আসিস্ একদিন—

    .

    সেদিন সন্তোষ-কাকার সেই অপঘাত-মৃত্যুটা দেখে মনে হয়েছিল যেন শুধু সেটা অপঘাত-মৃত্যুই নয়, সে-মৃত্যু যেন মানুষের সঙ্গে মানুষের যুদ্ধের প্রথম বলি। প্রথম হত্যা। মানুষের সঙ্গে মানুষের যুদ্ধ আরো বেধেছে। যুদ্ধের শেষ হয়নি পৃথিবীতে। মানুষ শিক্ষা পেয়েছে, সভ্যতা পেয়েছে, ধর্ম পেয়েছে, সমাজ পেয়েছে—সব পেয়েও মানুষ যে কিছুই পায়নি, সন্তোষ-কাকার মৃত্যু যেন তারই প্রথম প্রমাণ! সন্তোষ-কাকা কি পৃথিবীতে একজন! হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি সন্তোষ-কাকারা আত্মবলিদান দিয়েছে মানুষের লড়াইতে। সন্তোষ-কাকারা জানেনি কী তাদের অপরাধ, আর কেনই বা তাদের এই শাস্তি! সন্তোষ-কাকারা বুঝতে পারেনি কে তাদের ভাগ্যবিধাতা, আর কী-ই বা তাঁর বিচার। শুধু কলকাতার এই পূর্ব-প্রান্তেই নয়, শুধু বাঙলা দেশের প্রান্তরে প্রান্তরেই নয়, শুধু ভারতবর্ষের প্রদেশে-প্রদেশেই নয়, সমস্ত পৃথিবীর জলে স্থলে জনপদে-জনপদে সন্তোষ-কাকারা আত্মবলি দিয়েছে অকারণে। তারা জানতেও পারেনি কেন এই যুদ্ধ, কেন এই শত্রুতা। তারা জার্মানী দেখেনি, ইটালী দেখেনি, ইংল্যান্ড দেখেনি, আমেরিকা দেখেনি, জাপানও দেখেনি। তারা বোঝেনি কেন জার্মানী তাদের শত্রু, আবার কেন আমেরিকা তাদের বন্ধু। কিছু দেখতে পায়নি তারা শুধু দেখেছে প্রচন্ড দুর্ভিক্ষ, শুধু দেখেছে প্রাণঘাতী মৃত্যু! মৃত্যুই সন্তোষ-কাকাদের সব প্রশ্নের নির্বাক উত্তর দিয়ে দিয়েছে। মৃত্যুই সন্তোষ-কাকাদের সব সমস্যার সমাধান করে দিয়েছে। যদি বেঁচে থাকতো সন্তোষ-কাকারা তাহলে হয়তো দীপঙ্করের মতই জানতে পারতো তাদের মৃত্যুর জন্যে মিলিটারি লরী দায়ী নয়, বোমা, বারুদ, রাইফেল, কিছুই দায়ী নয়। দায়ী আমেরিকার ডলার, দায়ী ইংলন্ডের পাউন্ড, ইটালীর লিরা, জার্মানীর মার্ক, ফ্রান্সের ফ্রাঙ্ক, জাপানের ইয়েন, আর ইন্ডিয়ার টাকা!

    সমস্ত বাড়িটা ফাঁকা। ক্রমে আরো রাত হলো। আরো গভীর রাত। ফাঁকা হয়ে এল ভিড়। ফাঁকা হয়ে এল পৃথিবী। দীপঙ্করের পৃথিবীতে তখন সমস্ত নিস্তব্ধ। শুধু একতলার ঘরখানা থেকে একটানা একটা কান্নার আওয়াজ তখনও ক্ষীরোদার বুক চিরে বাইরে বাতাসের কানে এসে বিঁধছে।

    অনেক সান্ত্বনা দিয়েছিল দীপঙ্কর। কিন্তু কাকে সান্ত্বনা দেবে? কে সান্ত্বনা চাইছে? শোকের প্রতিকার কেমন করে করবে দীপঙ্কর? পৃথিবীর সমস্ত মানুষের শোকার্ত আত্মাকে সান্ত্বনা স্তোক দিয়ে দীপঙ্কর একলা কেমন করে ভোলাবে?

    প্রত্যেক দিনের মত কাশী এসে দাঁড়িয়েছিল দরজার কাছে। প্রত্যেক দিনই আসে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রথম-ভাগখানা নিয়ে পড়তে আসে। প্রথম পাতা থেকে আরম্ভ করে ক’দিনের মধ্যেই অনেকখানি শিখে ফেলেছে, মুখস্থ করে ফেলেছে। একটা শ্লেটও কিনে দিয়েছে দীপঙ্কর। চমৎকার হাতের লেখা হয়েছে কাশীর। এই প্রথম-ভাগ শেষ করেই দ্বিতীয়-ভাগ ধরবে, সঙ্গে সঙ্গে ধারাপাত।

    কাশী বলে—ইংরিজী পড়াবেন না দাদাবাবু?

    দীপঙ্কর বলে—সব পড়াবো তোকে, ইংরিজী ফাস্ট-বুকও কিনে দেব, তুই পারবি তো ইংরিজী শিখতে?

    আজ কিন্তু দীপঙ্কর নিজেই বারণ করলে। বললে—আজ থাক কাশী, আজকে আর পড়াতে ভালো লাগছে না—

    প্রত্যেকদিন সন্ধ্যের পর বাড়ি এলেই দীপঙ্কর পড়াতে বসে কাশীকে। মনে হয় কাশীর মধ্যে দিয়েই দীপঙ্কর যেন নতুন করে নিজেকে গড়ে তুলবে। দীপঙ্কর যা পায়নি, তাই পাবে কাশীর মধ্যে দিয়ে। দীপঙ্কর যা জানেনি, কাশীর মধ্যে দিয়েই তা জানবে। এই সংসার, মা’র নিজের হাতে গড়া সংসারকে কাশীকে দিয়ে যেন নতুন করে গড়ে তুলবে। দীপঙ্কর যে যন্ত্রণা পেয়েছে, কাশী যেন তা না পায়, কাশী যেন দীপঙ্করের না- পাওয়া সম্পদে সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে! কিন্তু আজ আর ভালো লাগলো না কিছুই। সন্তোষ- কাকার মৃত্যু যেন বিকল করে দিলে সমস্ত চৈতন্যকে।

    তারপর আরো রাত হলো। জীবনে কতবার শ্মশানে যেতে হয় মানুষকে। সেই শ্মশানেই আর একবার যেতে হয়েছিল আজ। শ্মশানে গেলেই যেন সেই পুরোন ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের কাছাকাছি যেতে হয়। যেতে হয় একেবারে নিজের জীবনের ছোটবেলাকার কাছাকাছি। সমস্ত জীবনটাই পরিক্রমা করে আসতে হয়। ছোটবেলা থেকে এতখানি পথ যেন বড় ছোট, যেন বড় সঙ্কীর্ণ মনে হলো। যেন এই সেদিন সে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হলো, এই সেদিন সে বড় হলো। বড় হলো আর দু চোখ ভরে দেখে নিলে পৃথিবীকে। কিন্তু কই, পৃথিবী কি দীপঙ্করের সঙ্গে এতটুকু এগিয়েছে? দীপঙ্করের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর মানুষ কি এতটুকু বড় হয়েছে?

    বাড়িতে কেউ ছিল না। পাশের বাড়ির দু’একজন মহিলা এসে ক্ষীরোদার পাশে বসেছিলেন। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে ভোলাবারও চেষ্টা করেছিলেন। দীপঙ্করেরা শ্মশান থেকে এসেও শুনতে পেয়েছে ক্ষীরোদার অব্যক্ত কান্নার আওয়াজ। দীপঙ্করের মনে হলো—ও ক্ষীরোদা নয়, যেন ক্ষীরোদার গলার কান্নাই নয় ওটা। একটা অস্ফুট অপরিণত আর্তি, ধরিত্রীর অন্তঃস্থল ভেদ করে ওপরে উঠে আসছে অক্লান্ত ধারায়। বলছে—আমাকে মুক্তি দাও, আমাকে শাস্তি দাও, আমার দুঃখের ভার লাঘব করো তুমি—

    দীপঙ্কর অনেকক্ষণ ধরে শুনতে লাগলো কান পেতে। তারপর এক সময়ে নিচে নামলে। তারপর ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ক্ষীরোদা তখনও দেখতে পায়নি।

    দীপঙ্কর বললে—

    বলতে গিয়ে কিন্তু থেমে গেল। এতদিন সন্তোষ-কাকার মেয়ে এ-বাড়িতে আছে, কিন্তু কখনও মুখোমুখি একটা কথাও বলেনি। জিভটা কেমন আটকে গেল। কেমন করে কথা বলতে হবে তাই-ই যেন ভেবে পেলে না।

    তারপর অনেক চেষ্টা করে বললে—কেঁদে তো কিছু লাভ নেই, যিনি গেলেন তাঁকে তো কেঁদে ফেরাতে পারা যাবে না—

    যেন মন্ত্রের মতো কাজ হলো। হঠাৎ কান্না থেমে গেল ক্ষীরোদার

    দীপঙ্কর বললে—আজ রাতটা তুমি বরং ওপরে শোও আমি নিচেয় শুচ্ছি—আমি কাল থেকে ঝি রাখবার ব্যবস্থা করছি একটা—

    তারপর কাশীকে ডাকলে—কাশী—

    কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ক্ষীরোদা এক কান্ড করে বসলো। একেবারে হুড়মুড় করে দীপঙ্করের পায়ের ওপর মাথা রেখে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো। বললে–আপনার দু’টি পায়ে পড়ি, আমায় আপনি আর যন্ত্রণা দেবেন না—

    হঠাৎ ক্ষীরোদার এই ব্যবহারে দীপঙ্কর যেন স্তম্ভিত হয়ে গেল। তার মুখ দিয়ে আর একটা কথাও বেরোল না। আস্তে-আস্তে সেখান থেকে পা দু’টো সরিয়ে নিলে। না-জেনে ক্ষীরোদার মনের কোন্ তন্ত্রীতে আঘাত দিয়ে ফেলেছে সে কিছুই বুঝতে পারলে না। দীপঙ্করও হতবাক্, কাশীও হতবাক্। তারপর বিস্ময়ে লজ্জায় আতঙ্কে দীপঙ্কর আবার তার নিজের ঘরের ভেতরে গিয়ে ঢুকে পড়লো।

    .

    সকাল দশটা থেকেই কানা-ঘুষো চলছিল। প্রথমে চুপি চুপি, তারপর প্রকাশ্যে। দ্বিজপদই প্রথমে দেখেছিল। লাল শাড়ি, কোঁকড়ানো চুল, সিঁথিতে সিঁদুর। ঘোষাল- সাহেবের গাড়ি থেকেই নামলো, তারপর সোজা ঘোষাল-সাহেবের সঙ্গেই ঢুকে পড়লো। তারপর এক কান থেকে আর এ কানে উঠলো কথাটা।

    কে-জি-দাশবাবু নিজের চোখে দেখে এল। এসে বললে—ওহে, দেখে এলাম তোমাদের মিসেস ঘোষকে—

    মিসেস ঘোষ নামটা ক’দিন থেকেই মুখে মুখে রটছিল। এতদিন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়েরাই এই পোস্টে একচেটিয়া ছিল। এই প্রথমবার এল বাঙালী মেয়ে। একেবারে সিঁদুর-পরা বাঙালী হিন্দু মেয়ে। ট্র্যাফিক সেকশানেও কথাটা গিয়ে পৌঁছুলো। যারা ডেলি-প্যাসেঞ্জার, তারা একটু দেরি করে এসেছিল। আপিসে। এসেই খবরটা শুনলে। বললে—কী রকম দেখতে?

    এস্টাবলিশমেন্ট সেকশানে সুধীরবাবুর কাছেই বেশি ভিড়। সুধীরবাবু নিজে গিয়ে সই-সাবুদ করিয়ে নিয়ে এসেছে। প্রথম চাকরির দিন। নামধাম লেখা, অনেক রকমের ফর্মালিটি আছে রেলের আপিসে। মিসেস ঘোষকে কিছুই করতে হয়নি। মিস্টার ঘোষাল নিজেই ডেকে পাঠিয়েছিল সুধীরবাবুকে। সুধীরবাবুই নিজে এসে পার্সোন্যাল্ ফাইলে যা কিছু লেখবার দরকার সব লিখে নিয়েছে।

    সুধীরবাবু জিজ্ঞেস করেছিল—এঁর কী ডেজিগনেশন লিখবো স্যার? স্টেনোগ্রাফার?

    সতী বলেছিল—আমি তো শর্টহ্যান্ড জানি না—

    মিস্টার ঘোষাল বলেছিল—লিখুন পি-এ। পার্সোন্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট—

    —তাহলে আপনার স্টেনোগ্রাফারের কাজ কে করবে?

    মিস্টার ঘোষাল বলেছিল—টাইপিস্ট সেকশান্ থেকে একজন টাইপিস্ট দাও আমাকে—

    তা সেই ব্যবস্থাই হয়েছিল। আসলে গভর্নমেন্ট আপিসে সবই হয়। আইন মানতেও যতক্ষণ আইন ভাঙতেও ততক্ষণ। আইনের অত কড়াকড়ি বলেই, গভর্নমেন্ট আপিসে আইন অত ঢিলে। যেখানে আইন আছে, সেখানে আইনের ফাঁকিও আছে। সেই অসবর্ন সাহেবের আমল থেকেই এইরকম চলে আসছে। মিস্টার ঘোষালেরা সমস্ত জানে। সুধীরবাবুরাও সমস্ত জানে। গাঙ্গুলীবাবুর প্রমোশনের বেলাতে আইনের কড়াকড়ি দেখানো হয়, আবার মিসেস ঘোষের চাকরির সময়ে আইনের ফাঁকটাও কাজে লাগানো হয়। আইন আছে বলেই আইন ভাঙার এত দরকার হয়। আর আইন ভাঙবার দরকার হয় বলেই আইন তৈরি করতে হয়। আসলে আইনটা কিছু নয়, স্বার্থসিদ্ধিটাই বড় কথা। আইনই যদি মানতে হবে তাহলে সুধীরবাবুকে অত মাইনে দিয়ে রাখা কেন? সুধীর- বাবুদের সৃষ্টিই হয়েছে আইন মানবার জন্যে ততটা নয়, যতটা আইন ভাঙার পথটা বাতলে দেবার জন্যে।

    রঞ্জিতবাবু বললে—তাহলে এবার থেকে কি বাঙালি মেয়েও আপিসে ঢুকবে নাকি সুধীরবাবু?

    সুধীরবাবু বললে—আমাকে বলছিস্ কেন তুই, আমি তো হুকুমের চাকর রে—

    —তাহলে আড়াই শো টাকা গ্রেড্‌ কোন্ আইনে হয় সুধীরবাবু! শর্টহ্যান্ড জানে না কিছু না—

    সুধীরবাবু বললে—হয় রে বাপু হয়, ঘোষাল-সাহেব বললে সবই হয়—ঘোষাল- সাহেবের ইচ্ছে হলে নতুন করে আইনও তৈরি হবে—

    পাসবাবু সকালবেলাই দেখেছিল। ঘোষাল সাহেব গাড়ি থেকে নামতেই পাসবাবু মাটি পর্যন্ত মাথা নিচু করে বলেছিল—গুড মর্নিং স্যার—

    মাথা তুলতেই দেখে সঙ্গে আর একজন মেয়েমানুষ। হয়ত বউ, কিংবা হয়ত বউ নয়, বন্ধুর বউ। দরকার কী অত ঝঞ্ঝাটে। তাকেও মাথা নীচু করে নমস্কার করলে-গুড মর্নিং ম্যাডাম্—

    রঞ্জিতবাবু জিজ্ঞেস করলে—কেমন চেহারা দেখলেন পাসবাবু? পাসবাবু বললে—

    আহা যেন সাক্ষাৎ মা আমার—

    —তা আপনি তাকে গুড মর্নিং করতে গেলেন কেন?

    পাসবাবু বললে—আরে বাবা, তোরা আজকালকার ছেলে কিছুই জানিস না, সব দেত্তাকেই খুশী রাখা ভালো, তখন কে বিগড়ে যাবে আর চাকরিটি চলে যাবে কিছু বলা যায়?

    সমস্ত আপিসের কথা-বার্তাগুলো আপিসের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। সব সেকশানেই ওই এক আলোচনা। ওই একই বিষয়বস্তু। এতদিন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়েরাই একচেটিয়া কাজ চালিয়ে এসেছে আপিসে। তারা গাউন পরে, লিস্টিক্ মেখে, হিল্ তোলা জুতো পরে খটাখট্ করে আপিসে এসেছে গেছে, কেউ তাদের নিয়ে মাথা ঘামায়নি। তারাও মেয়েমানুষ, কিন্তু মেয়েমানুষ হয়েও তারা বাঙালী পুরুষের আলোচনার বিষয়বস্তু হতে পারেনি। এবার এসেছে খাঁটি বাঙালি মেয়ে! খাঁটি বাঙালী বাড়ির বউ!

    —ও কী পাস সুধীরবাবু?

    সুধীরবাবু বললে—বি এ পাস—

    —কত বয়েস?

    পার্সোন্যাল ফাইলে সবই লিখতে হয়! এজ্‌, এডুকেশন, হাসব্যান্ডের নাম—সব কিছু।

    —কাদের বাড়ির বউ? হাসব্যান্ডের নাম কী?

    প্রথমে মিস্টার ঘোষাল ওসব লিখতে চায়নি। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের যেমন ফাদারের নাম লেখবার নিয়ম নেই, তেমনি।

    মিস্টার ঘোষাল বলেছিল—ও কলটা ব্ল্যাঙ্ক থাক্ —

    সুধীরবাবু তখনও ফাইলটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সতীও চুপ করে বসে ছিল। বললে—কেন, ব্ল্যাঙ্ক থাকবে কেন? লিখে নিন্ আপনি, আমি বলছি—

    মিস্টার ঘোষাল বললে—কেন, মিসেস ঘোষ, ও কলম্ এখনি ফিল-আপ করবার দরকার নেই, পরে করলেও চলবে—

    সতী বললে—না, লিখে নিন্ হাসব্যান্ড সনাতন ঘোষ,–ঠিকানা……

    স্বামীর নাম, ঠিকানা, বংশ কুলজী সমস্তই লিখে নেওয়া হলো। সতী যেন নিশ্চিন্ত হলো সমস্ত পরিচয় প্রকাশ করে দিয়ে। যেন দরকার হলে সে শাশুড়ীর নামও প্রকাশ করে দিতে কুণ্ঠিত হতো না। রেলের চাকরির খাতায় লেখা থাক্ কোন্ বংশের বউ, কার বউ, কার পুত্রবধূ, কোন্ প্রয়োজনে এখানে এই রেলের আপিসে চাকরি করতে আসতে বাধ্য হয়েছে। লোকে জানুক অগাধ টাকা থাকলেও কেন একজন মেয়ে কোন্ পরিচয়ে এসে রেলের চাকরিতে ঢোকে। এবং কোন্ প্রয়োজনে!

    সতী বললে-আমি কোন্ ঘরে বসবো মিস্টার ঘোষাল?

    মিস্টার ঘোষালের তখন কাজ আরম্ভ করবার কথা। আজকাল কাজের শেষ নেই মিস্টার ঘোষালের। বাইরে সবাই দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। মার্চেন্ট্রা শিল্প দিয়েছে ভেতরে। সবাই চায় ওয়াগন্। সোনা নয়, রূপো নয়, হীরে নয়, মুক্তোও নয়। টাকা-কড়ি সম্মান প্রতিপত্তি কিছুই নয়। এমন কি ভগবানও নয়। শুধু ওয়াগন্। পৃথিবীসুদ্ধ মানুষ একখানা ওয়াগনের জন্যে স্বর্গ-মর্ত্য চষে বেড়াচ্ছে। আর কোনও কথা নেই কারো মুখে। শুধু ওয়াগন আর ওয়াগন। একখানা ওয়াগন পেলে ধর্ম-অর্থ-মোক্ষ-কাম সমস্ত পাওয়া হবে।

    দীপঙ্কর যখন আপিসে এসে পৌঁছুলো তখন সবাই এসে ঢুকছে আপিসে। প্রতিদিনের মত হাতে কলম তুলে নিয়েছে। ড্রয়ার থেকে কাগজ বার করে ক্লার্করা দুর্গা- নাম লিখতে শুরু করবে। তারপরে ঢিমে চালে ফাইল আসবে, ফাইল যাবে, আর তারপর রেলের চাকা চলতে শুরু করবে। কোথায় কতদূরে রেল-লাইন, কোথায় লাইন-ক্লিয়ার, আর কোথায় ইঞ্জিন, কিন্তু এখানে এই হেড়-আপিসে বাবুদের কলমের কালি কতবার শুকোবে, বাবুদের চোখে কতবার ঘুম নেমে আসবে, কতবার অ্যালুমিনিয়ামের গ্লাসে চা আসবে, কিন্তু ওয়াগন সাপ্লাই বন্ধ হবে না মিস্টার ঘোষালের। দশটা ওয়াগন যাবে মণিহারিঘাটে, বারোটা শিলিগুড়িতে, তিরিশটা ময়মনসিং-এ। সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত মিস্টার ঘোষালের কলমের একটা খোঁচায় বেঙ্গলের একশোটা মার্চেন্ট রাতারাতি কোটি- পতি হয়ে উঠবে!

    .

    কাজ তখন খুব চললে সেন-সাহেবের ঘরেও। হঠাৎ মধু ঢুকে একটা শ্লিপ্ দিয়ে গেল।

    দীপঙ্কর কাজের মধ্যেও শিপটা তুলে নিলে। বললে—কে দিয়েছে?

    মধু বললে—নতুন মেমসাহেব—

    নতুন মেমসাহেব! দীপঙ্কর তাড়াতাড়ি ভাঁজ খুলে পড়লে—ছোট শ্লিপ্। নিচেয় সই করেছে সতী। সতী লিখেছে—

    ‘দীপু, আজ থেকে তোমাদের আপিসে চাকরি নিয়েছি। কখন তোমার হাত খালি থাকবে? আমি একবার দেখা করতে চাই।

    ইতি—সতী—’

    .

    শ্লিপ্‌টা পড়েই দীপঙ্কর দাঁড়িয়ে উঠলো। বাইরে এসেই সোজা গেল মিস্ মাইকেলের ঘরের দিকে। চাকরির প্রথম দিকে এই ঘরেই বসতো একদিন দীপঙ্কর। দরজাটা বন্ধ ছিল। সেন-সাহেবকে দেখেই দ্বিজপদ এগিয়ে এল। বললে—সেলাম হুজুর—

    দীপঙ্কর বললে-এ-ঘরের দরজা বন্ধ কেন?

    —ঘোষাল-সাহেব বন্ধ করে দিয়েছে হুজুর! সাহেবের ঘরের ভেতর দিয়ে রাস্তা, নতুন মেম-সাহেব এসেছে ভেতরে—

    মিস্টার ঘোষালের ঘরের ভেতর দিয়েই দীপঙ্কর ঢুকছিল। তারপর ডান দিকে মিস্ মাইকেলের ঘরে যাবার রাস্তা। ঘরে তখন একজন মার্চেন্ট বসে। আপিসের নানা কাজে পাবলিক এসে দরবার জমিয়েছে ঘরে।

    —ওয়েল্!

    মিস্টার ঘোষাল মুখ তুলে দীপঙ্করকে দেখেই রেগে আরো কালো হয়ে উঠলো। বললে—ওখানে কী চাও সেন? ওদিকে কী?

    দীপঙ্কর বললে—মিসেস ঘোষ এখানে আছে?

    —হ্যাঁ আছে, কিন্তু তাতে তোমার কী? তুমি ওখানে যাচ্ছো কেন? সি ইজ্‌ মাই পি-এ—

    —আমার কাজ আছে।

    বলে দীপঙ্কর ভেতরে ঢুকতেই যাচ্ছিল। মিস্টার ঘোষাল উঠে দাঁড়িয়ে বললে—স্টপ্ দেয়ার—

    দীপঙ্কর হঠাৎ বাধা পেয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লো। এক মুহূর্তের মধ্যে তাকে কর্তব্য ঠিক করে নিতে হবে। গুজরাটি ভদ্রোলোকও অবাক হয়ে মুখ তুলে চাইলো। মিস্টার ঘোষাল বললে—তোমার কী কাজ মিসেস ঘোষের সঙ্গে?

    দীপঙ্কর সোজাসুজি মিস্টার ঘোষালের চোখে চোখ রাখলে!

    —আমার পারমিশন্ ছাড়া কেউ দেখা করতে পারবে না মিসেস ঘোষের সঙ্গে! ডু ইউ হিয়ার মী?

    দীপঙ্কর যেন তখনও কী তার কর্তব্য বুঝতে পারছে না।

    —দিস্ ইজ্ অফিস, দিস্ ইজ্ নট ইওর পার্লার!

    অপমানে দীপঙ্করের সমস্ত মুখটা রাঙা হয়ে উঠলো এক নিমেষে। হাতের মুঠোর মধ্যে সতীর শিপ্‌টা টিপে পিষে জানলার দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিলে। সেটা অতদূর গেল না। ঘরের কোণে গিয়ে পড়ে দেওয়ারে গায়ে ধাক্কা লেগে স্থির হয়ে গেল। দীপঙ্কর আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছিল।

    —দীপু!

    দীপঙ্কর মুখ ঘুরিয়ে দেখলে—সতী তার ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। লাল একটা শাড়ি পরেছে। কপালে সিঁদুরের একটা মোটা টিপ। মাথার কোঁকড়ানো চুলগুলো খোঁপা করে বেঁধেছে আজ।

    —আমার শিপ পেয়েছিলে তুমি?

    একটি মুহূর্ত শুধু! তারপর দীপঙ্কর ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

    —দীপু!

    ডাকটা আরো কাছে সরে এল যেন। দীপঙ্করের মনে হলো দুই হাত দিয়ে নিজের কান দুটো এঁটে বন্ধ করে দেয়। সতী হয়ত দীপঙ্করের পেছন-পেছনই আসছিল। কিন্তু মিস্টার ঘোষাল একেবারে সামনে এসে পথ আটকে দিয়েছে। বললে—কোথায় যাচ্ছো?

    সতী মিস্টার ঘোষালের মুখের দিকে চেয়ে থমকে দাঁড়াল।

    মিস্টার ঘোষাল আবার বললে—কোথায় যাচ্ছ তুমি? গো টু ইওর রুম মিসেস ঘোষ। তোমার ঘরে গিয়ে বোস! তোমার কাজ আছে—ইউ আর পি-এ টু ডি-টি-এস—

    গুজরাটি ভদ্রলোক অবাক হয়ে দেখতে লাগলো ঘটনাটা। কিন্তু সেদিকে মিস্টার ঘোষালের খেয়াল নেই তখন। মিসেস ঘোষেরও খেয়াল নেই।

    মিস্টার ঘোষাল আবার বললে—যাও, ডু হোয়াট আই সে! যাও—

    —হোয়াট ডু ইউ মীন?

    মিস্টার ঘোষাল সতীর চেহারা দেখে অবাক হয়ে গেল। যে-মেয়ে কাঁদতে পারে, যে-মেয়ে তার আশ্রয় পেয়ে কৃতার্থ হতে পারে, সে-মেয়ের গলায় এত তেজ! যেন কেউটে সাপের মত ফণা তুলে দাঁড়িয়েছে মিসেস ঘোষ!

    —হোয়াট ডু ইউ মীন?

    —কিন্তু এটা আপিস, এটা ড্রয়িং-রুম নয় তোমার। এখানে আমি সিনীয়র অফিসার। আই অ্যাম ডি-টি-এস্ হিয়ার—

    জাঁদরেল মিস্টার ঘোষালের আওয়াজে যেন একটা ক্ষীণ কৈফিয়তের সুর বেজে উঠলো। বললে—তুমি আগে কখনও আপিসে কাজ করোনি মিসেস ঘোষ, আপিসেরও একটা ডিসিপ্লিন আছে, আপিসেরও একটা মর্যাল কোড় আছে,

    গুজরাটি ভদ্রলোক এতক্ষণে একটু নড়ে চড়ে বসলো। ভাষা না বুঝুক, ব্যাপারটা কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিল। বললে—আমি তাহলে পরে আসবো স্যার—

    বলে নিজেই বাইরে চলে গেল। গিয়ে একেবারে গাড়িতে গিয়ে উঠলো। দ্বিজপদ সঙ্গে সঙ্গে পেছনে দৌড়িয়েছে। গাড়ি তখন চলতে শুরু করে-করে। কাছে গিয়ে মাথা নিচু করে বললে—সেলাম হুজুর—

    গুজরাটি মার্চেন্ট পুরোন খদ্দের মিস্টার ঘোষালের। রামপুরহাটে তিনটে রাইস্-মিল্ দেশাইজীর। রামমনোহর দেশাই বহুদিন থেকে ওয়াগন চাইতে আসে। দশখানা চাইলে একখানা পায়। মিস্টার ঘোষালকে কিছুতেই খুশী করতে পারে না। দিনে কুড়িখানা হলে তবে কাজ চলে দেশাইজীর। সামনে আছে রাইমিল্। মিলের নাম করে ওয়াগন চেয়ে সেই ওয়াগনে টিম্বার, স্ট্র, ফায়ার-উড্ যা-কিছু পাঠাতে পারে। তাতে কারো কিছু বলবার থাকে না।

    —সেলাম হুজুর।

    দেশাইজী বললে—উও কৌন হ্যায় চাপরাসী?

    —হুজুর, ও তো ঘোষাল সাহেবকা নয়াবিবি হুজুর!

    গুজরাটি দেশাইজী একটু ভেবে নিলে। তারপর বললে—আচ্ছা ঠায়রো, ম্যয় আতা হুঁ—

    গাড়িটা স্টার্ট দিলে। আপিস-কোয়ার্টার পেরিয়ে একেবারে মেন রাস্তায় গিয়ে পড়লো। দেশাইজী বললে—জলদি ম্যানু, জলদি…….

    গাড়ি আরো জলদি চলতে লাগলো। লালবাজার পেরিয়ে বৌবাজার। একটা জুয়েলারির দোকানে সামনে আসতেই দেশাইজী লাফিয়ে উঠলো—রোকে—

    হীরালাল মোতিলাল কোম্পানীতে দেশাইজীর আসা-যাওয়া আছে। গাড়ি থেকে নামতেই আয়নায় দোইজীর ছায়া পড়লো। দেশাইজী একবার চেহারাখানা দেখে নিলে। কিন্তু দোকানের মালিক দাঁড়িয়ে উঠে অভ্যর্থনা করতে আরম্ভ করেছে তখন।

    —আইয়ে শেঠজী, আইয়ে!

    দেশাইজী বললে—জলদি কীজিয়ে জনাব। আচ্ছা সোনেকো হার দেখলাইয়ে—

    দুপুরবেলার দিকে জুয়েলারী দোকানে ভিড় কম থাকে। দোকানের পাখা জোরে খুলে দেওয়া হলো, পান-জর্দা লেমনেড় আইসক্রীম সব এল। সঙ্গে সঙ্গে আচ্ছা সোনেকা হারও এল।

    দেশাইজী বললে—এ কী চীজ্‌ দেখাচ্ছ জনাব, বঢ়ীয়া দেখলাও—

    আরো বঢ়ীয়া চীজ রাখা হলো দেশাইজীর সামনে।

    —কেনা ভাউ?

    —পাশো রুপেয়া।

    দেশাইজী হাত দিয়ে কেস্টা পাশে ঠেলে দিলে। ঔর বঢ়ীয়া দেখলাও—

    হাজার টাকার জিনিস দেখানো হলো। তবু ঔর বঢ়ীয়া। দু’হাজার টাকার জিনিস এল। তাও ঔর বঢ়ীয়া। তিন হাজার, চার হাজার, পাঁচ হাজার টাকার চীজ্ এল। তাও দেশাইজী বলে—ইসে ঔর বঢ়ীয়া—

    শেষে দশ হাজার টাকার চীজ এল সামনে। জড়োয়া হার। রুবি, ডায়মন্ড, স্যাফায়ার সেট্ করা নেকলেস্।

    দেশাইজী জিজ্ঞেস করলে-কেয়া ভাউ ইসকো!

    —দশ হাজার!

    তখন চেক বই বার করলে দেশাইজী। আরে, দশ হাজার টাকার জন্যে রামমনোহর দেশাই পরোয়া করে না। ঘোষাল-সাহেব কৃপা করলে দশ হাজার টাকা মুনাফা করতে এক মিনিট! এক মিনিটের তোয়াক্কা। ওয়ান মিনিট ওলি।

    দেশাইজী বললে—আচ্ছা করে চীজ বেন্ধে দাও জনাব, নয়া বিবি, নজরানা ভি নয়া—

    —পান লিয়া নেই শেঠজী?

    দেশাইজী ততক্ষণে গাড়িতে উঠে বসেছে। বললে—পান খাবার অনেক মওকা মিলবে জনাব-লেকিন্ ওয়াগন মিলনেকা মওকা জিন্দিগী মে কৌন্ দেনেওয়ালা!

    রেলের আপিসের বড় সাহেবের ঘরে তখনও সেই একই দৃশ্য চলছে। সেই তখনও ফণা তুলে রয়েছে সতী।

    —তুমি কি ভেবেছ আমি তোমার চাকরির জন্যে কেয়ার করি?

    মিস্টার ঘোষাল বললে—ভুলে যেওনা, এটা আপিস সতী! এ প্যালেস-কোর্ট নয়। এখানে চেঁচিয়ে কথা বললে আমার চাপরাসী শুনতে পারে, আমার ক্লার্করা শুনতে পাবে—

    –তোমার চাপরাসী আর ক্লার্কদের তুমি ভয় করবে! আমি ভয় করবো কেন? হোয়াই ডীড় ইউ ইনসাল্ট্ দীপু? কেন তুমি ওকে অপমান করলে? জানো আমি তাকে শিপ পাঠিয়েছি দেখা করবার জন্যে?

    —কিন্তু আমার পারমিশন নিয়েছিলে তুমি? তুমি আমার পি-এ তা জানো না!

    সতী দরজার দিকে ততক্ষণ এগিয়ে গেছে। বললে—এই তো আমি যাচ্ছি দীপুর কাছে, দেখি তুমি কী করতে পারো—

    —আই ক্যান স্যাক্ ইউ মিসেস ঘোষ!

    সতী সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলে—হ্যাঙ্ ইওর স্যাকিং! আমি নিজের হাসব্যান্ডকে ছেড়ে চলে এসেছি, আমি নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি, আমাকে তুমি আড়াইশো টাকা মাইনের চাকরির ভয় দেখাও! আমাকে তুমি স্যাকিং-এর ভয় দেখাও—

    বলতে বলতে সতীর বুকটা ফুলে-ফুলে উঠতে লাগলো। মাথার ওপর পাখার হাওয়া লেগে কোঁকড়ানো চুলগুলো উড়তে লাগলো ঘন-ঘন। হাত নাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে সোনার চুড়িগুলো ঠিন্ ঠিন করে বেজে উঠলো।

    সতী আবার বললে—আমাকে তুমি মিস্ মাইকেল পাওনি মিস্টার ঘোষাল—আই য়্যাম মেড্ অব্ ডিফারেন্ট মেট্যাল—

    —মিস্ মাইকেলের কথা তুলছো কেন তুমি?

    সতী সত্যিই রাগী মেয়ে। রাগলে আর জ্ঞান থাকে না। বললে—তুলবো না? তুমি ভেবেছ আমি জানি না, কে মিস্ মাইকেলকে খুন করেছে?

    সতী!!

    মিস্টার ঘোষাল দৌড়ে কাছে এসে সতীর মুখটা চেপে ধরতে গেল। কিন্তু তার আগেই সতী পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এসেছে। ঘরের বাইরে এক গাদা লোক দাঁড়িয়ে ছিল। গুজরাটি ভাটিয়া সিন্ধী। সকলেরই ওয়াগন চাই।

    —সেলাম হুজুর।

    সতী বেরোতেই দ্বিজপদ মাথা নিচু করে সেলাম করলে। সতীও মাথা হেলিয়ে বললে—সেলাম—

    তারপর সোজা চলে এল দীপঙ্করের ঘরের সামনে। পাসবাবু সেলাম দিয়ে যাচ্ছিল। সারাদিন কোনও কাজ থাকে না পাসবাবুর। এই আপিসের মধ্যে এখানে-ওখানে ঘোরাটাই কাজ। আর সাহেব-মেমসাহেবদের দেখে সেলাম করাই কাজ। আসলে এইটেই আসল কাজ। বলতে গেলে আখেরের কাজ। নতুন মেমসাহেব। ঘোষাল সাহেবের সঙ্গে এক-গাড়িতে আপিসে আসতে দেখেছে। সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে এক হাত কপালে ঠেকিয়ে বললে—সেলাম মেমসাহেব—

    পুলিনবাবু পাসবাবুর কান্ড দেখে অবাক। বললে—এ কি পাসবাবু, ওকে সেলাম করতে গেলেন কেন?

    পাসবাবু বললে—তুমি ও বুঝবে না ভায়া, তোমরা আজকালকার নতুন ছোকরা সব—

    —তা ওকে সেলাম করলে কি আপনার প্রমোশন হবে?

    পাসবাবু বিজ্ঞের মত হেসে বলে—আরো কিছুদিন রেলে থাকো, বুঝবে কিসে কী হয় কিছু বলা যায় না—

    তা পাসবাবু ওই রকমই। ক্রফোর্ড সাহেবের আয়া বিকেল-বেলা কোয়ার্টারের সামনে ঘোরা-ফেরা করে, পাসবাবু তাকে দেখলেও সেলাম বাজায়। কেউ জিজ্ঞেস করলেই বলে—ও তোমরা বুঝবে না ভায়া, ওই আয়ার পেটেই হয়ত একদিন ফিউচার ডি-টি-এস জন্মাবে—তখন?

    কিন্তু ওদিকে ততক্ষণ সতী একেবারে সোজা দীপঙ্করের ঘরে ঢুকে পড়েছে। দীপঙ্কর মুখ তুলতেই সতীকে দেখে আবার মুখ নামিয়ে নিলে।

    সতী দৌড়তে দৌড়তেই এসেছে। তখনও হাঁপাচ্ছিল। বললে—দীপু, এ কী করলে তুমি?

    দীপঙ্কর মাথা না তুলেই ফাইল নিয়ে কাজ করতে লাগলো।

    সতী বসলো একটা চেয়ার টেনে নিয়ে। বললে—তুমি আমার শ্লিপ্ পাওনি?

    দীপঙ্কর এবার মাথা তুলে বললে—আমি এখন একটু ব্যস্ত, তুমি যাও এখন—আমি পরে দেখা করবো—

    —কিন্তু তুমি আমাকে ডেকে না-পাঠিয়ে নিজে গিয়েছিলে কেন? আমার জন্যে কেন তুমি এমন অপমানিত হতে গেলে? তুমি জানতে না মিস্টার ঘোষাল কী-রকম লোক? তুমি ডেকে পাঠালে না কেন আমাকে?

    দীপঙ্কর উঠে দাঁড়াল। সতী দীপঙ্করের মুখের চেহারা দেখে চমকে উঠলো। বললে—কী হলো তোমার?

    দীপঙ্কর বললে—আমি এখানে চাকরি করি—

    —কিন্তু আমিও তো চাকরি করতে এসেছি দীপু!

    দীপঙ্কর বললে—তোমার কথা আলাদা!

    —কিন্তু আলাদা বলে কি কথা বলাও বারণ? আলাদা বলে তোমার কাছেও আমি আলাদা! আমি এখানে এলে কি তোমার কাজের ক্ষতি হয়? যদি ক্ষতি হয় তো বলো, আমি আর আসবো না।

    দীপঙ্কর বললে—হ্যাঁ ক্ষতি হয়!

    সতী চুপ করে রইল দীপঙ্করের দিকে মুখ করে। কী বলবে যেন ভেবে পেলে না। দীপঙ্করের গলার আওয়াজে কেমন যেন একটা গাম্ভীর্য ছিল। দীপঙ্করের এ-গাম্ভীর্যের সঙ্গে তার যেন কোনও পরিচয় ছিল না এতদিন। এ যেন নতুন দীপঙ্কর।

    —তাহলে আমি চলে যাবো তোমার ঘর থেকে?

    দীপঙ্কর বললে—আমার অনেক কাজ রয়েছে হাতে—

    —কিন্তু তুমি নিজের মুখে চলে যেতে বলো, তবে আমি যাবো।

    দীপঙ্কর বললে—তোমার প্যালেস-কোর্টে তুমি যা খুশি করো, এটা প্যালেস-কোর্ট নয়।

    —তা বলে আমাকে তুমি এই রকম করে অপমান করবে দীপু?

    –তোমার আরো অপমান হওয়া উচিত। কিছুই হয়নি এখনও।

    সতী খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বললে—বুঝেছি—

    —কী বুঝেছ তুমি?

    —বুঝেছি আজকে সুযোগ পেয়ে তুমি আমার সেদিনকার অপমানের প্রতিশোধ নিলে। আজ আমার অবস্থার সুযোগ নিয়ে তুমি আমাকে এত অপমান করবার সাহস পেলে।

    দীপঙ্কর বললে—বাইরে হলে তোমার এ-কথার জবাব দিতুম, কিন্তু এটা আপিস।

    —কিন্তু আপিস বলে কি মান-সম্মান-মর্যাদা-ভদ্রতা সব জলাঞ্জলি দিতে হবে? আপিস বলে কি এখানে মানুষ নয় কেউ?

    —মানুষ আছে কি না, আর কিছুদিন চাকরি করলেই তা বুঝতে পারবে।

    সতী বললে—কিন্তু তোমার সঙ্গে যে আমার অনেক কথা ছিল দীপু। অনেক কথা ছিল। সব বলবার জন্যেই যে আমি এসেছিলুম তোমার কাছে! তুমি দাঁড়িয়ে কেন, বোস না, বোস!

    দীপঙ্কর তবু দাঁড়িয়ে রইল। বললে—তুমি ঘর থেকে চলে গেলে বসবো

    এবার সতীও দাঁড়িয়ে উঠলো। বললে—তাহলে তুমি কিছুই শুনবে না?

    দীপঙ্কর বললে—সেদিন প্যালেস-কোর্টে মিস্টার ঘোষালের রিভলবারের মুখে তুমি আমাকে দাঁড়াতে দাওনি, বোধহয় আজকে নতুন করে অপমান করবার জন্যেই দাঁড়াতে দাওনি তুমি!

    –তোমার হলো কী দীপু? তোমার কী হলো? তুমি তো এমন ছিলে না?

    দীপঙ্কর সে-কথার উত্তর না-দিয়ে বললে—তুমি যাও এখান থেকে, আর কথা বাড়িও না—

    —আমায় তাড়িয়ে দিচ্ছ তুমি?

    দীপঙ্কর বললে—বাঙলা ভাষায় তো সেই মানেই দাঁড়ায়!

    সতী নিঃশব্দেই চলে যাচ্ছিল, দীপঙ্কর ডাকলে—শোন—

    সতী ফিরে দাঁড়াল। মুখ ফিরিয়ে বললে—

    —কী?

    দীপঙ্কর বললে—তুমি কি সত্যিই তোমার ভাল চাও?

    সতী হাসলো এতক্ষণে। ব্যঙ্গের হাসি। তারপর বললে—আমার ভাল-মন্দ নিয়ে তুমি এখনও ভাবো তাহলে?

    —বাজে কথা থাক, তুমি নিজের ভাল চাও তো এ-চাকরি ছেড়ে দাও—

    —তারপর?

    –প্যালেস-কোর্টও ছেড়ে দাও। অন্য বাড়িতে গিয়ে থাকো তুমি। যেখানে তোমার খুশি। কলকাতায় না থাকতে চাও, কলকাতার বাইরে গিয়ে থাকতে পারো। এখন কলকাতা থেকে সবাই বাইরে চলে যাচ্ছে, তুমিও বাইরে গিয়ে থাকো। আমি তোমার সমস্ত খরচ দেবো, তোমার সুখ-স্বচ্ছন্দ্য সমস্ত কিছুর দায়িত্ব নেবো, আমি কথা দিচ্ছি, তুমি এ-পথ ছাড়ো—

    —থাক আর বলতে হবে না, বুঝেছি…….

    বলে সতী আবার পেছন ফিরে চলে যাচ্ছিল। সুইং-ডোরটার কাছে গিয়ে আবার মুখ ফেরালে। বললে—ভেবেছিলাম তুমি অন্তত অন্য পুরুষের মত নও, কিন্তু তুমিও একটা জানোয়ার, তুমিও একটা পশু—

    বলতে বলতে ঝড়ের মত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সতী! আর দীপঙ্কর সতীর মুখের চেহারা দেখে পাথরের মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

    রামমনোহর দেশাইরা সময় বোঝে, মেজাজ বোঝে, সুযোগও বোঝে। এই সব বুঝেই তিনটে রাইস মিল করেছে। পাঁচটা খাঁটি ভেজেটেবল ঘি আর তিনটে ভেজাল ভেজিটেবল ঘি-এর কারবার চালাচ্ছে।

    মিস্টার ঘোষাল সত্তরটা ওয়াগনের ইনডেন্ট অর্ডার ফর্মে সই করে কাগজটা দেশাইজীর দিকে এগিয়ে দিলে।

    বললে—এটা আবার কেন দিলে দেশাইজী—? এ হার আমার কী হবে?

    দেশাইজী হেসে বললে—এ কিছু না জী, গরীব আদমী কিছু নজরানা দিলে আপনার মিসেসের জন্যে!—আপনার মিসেসের নজরানা—

    —কত দাম পড়লো?

    ভাল করে কেসটা খুলে পরীক্ষা করতে লাগল মিস্টার ঘোষাল।

    —দাম কী লাগবে হুজুর? দাম কেন লাগবে? আমার তো নিজের জুয়েলারীর দুকান আছে হুজুর! দুকান থেকে নিয়ে এলুম!

    —তোমার কি আবার জুয়েলারীর কারবারও আছে নাকি দেশাইজী?

    —হুজুর আপনার কৃপায় সবই আছে, সব কারবার থেকে কুড়িয়ে কুড়িয়েই কিছু হয়, আপনি যদি ওয়াগন দেন তো আমি একটা সরষু-তেলের কারবার করতে পারি, সরষু- তেলের কারবারে বহুত নাফা হুজুর

    মিস্টার ঘোষাল হারটা তখনও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। বললে—আর কতদিন নাফা করবে দেশাইজী!

    —কেন হুজুর? যতদিন হুজুরের কিরূপা থাকবে, ততদিন নাফা করবো!

    মিস্টার ঘোষাল হাসলো। বললে—আর বেশিদিন নাফা করতে পারবে না দেশাইজী—

    —কেন হুজুর? হুজুর কি বদলি হয়ে যাচ্ছেন?

    মিস্টার ঘোষাল বললে—না, তা নয়, ক্রিপস্ সাহেব তো বিলেত থেকে এসেছিল, মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেছে, জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে দেখা করেছে— হয়ত আজাদী হয়ে যাবে ইন্ডিয়া, তখন কী করবে? তখন তো স্বদেশী—জমানা—

    দেশাইজী হো হো করে হেসে উঠলো। বললে-আজাদী হয়ে গেলে তো আরো সুবিস্থা হবে হুজুর।

    —কেন? তখন কি দিশী সাহেবদের ভেট দিতে পারবে? তারা কি ভেট নেবে তোমার? তারা তো সব জেল-খাটা লোক?

    দেশাইজী আরো জোরে হাসলো। বললে—আমরা বেওসাদার আদমী আছি হুজুর—এখন যেমন বেওসা করছি, তখনও তেমনি বেওসা করবো—দেখে লেবেন।

    —কী করে করবে?

    দেশাইজী বললে—তা করবো হুজুর! আমি তো কংগ্রেস-পার্টির মেম্বার ভি আছি—

    —তুমিও কংগ্রেসের মেম্বার?

    দেশাইজী বললে—জী হুজুর! জামান বদ্‌লালেও আমরা বদলাবো না হুজুর, স্বদেশী জমানায় আমরা বেওসা ভি করবো, আরো বেশী নাফা ভি করবো। এ ইংরেজ-শালারা হারামী আছে হুজুর—ও-শালারা যাওয়াই ভালো। ওরা দেশ থেকে চলে গেলে ওদের বেওসা ভি আমরা লিয়ে লেব—

    ততক্ষণে দেশাইজীর কাজ হয়ে গেছে। ইনডেন্ট-ফর্মগুলো ব্যাগের ভেতর পুরে নিয়ে উঠলো। বললে—রাম রাম হুজুর—রাম রাম—

    বাইরে বেরোতেই দ্বিজপদ পেছন নিলে। বললে—সেলাম হুজুর—

    রামমনোহর দেশাই তখনও সত্তরখানা ওয়াগনের আনন্দে ডগমগ করছে। সে কথায় কানই দিলে না। গট্ গট্ করে সদরের গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।

    দ্বিজপদ পেছন-পেছন যেতে-যেতে বললে—সেলাম হুজুর —

    একেবারে গাড়ির ভেতর উঠে বসেছে দেশাইজী। গাড়ি ছাড়লো বলে।

    দ্বিজপদ মাথা নিচু করে আবার বললে—সেলাম হুজুর—

    এতক্ষণে বুঝি নজরে পড়লো। দেশাইজী বুক পকেট থেকে একটা দশ টাকার আস্ত নোট বার করে ছুঁড়ে রাস্তায় ফেলে দিলে। ফেলে দিতেই গাড়িখানা হুশ হুশ করে চলে গেল। আর ওদিকে হাওয়ায় তখন নোটখানা উড়তে উড়তে চলেছে—

    নোটও দৌড়োয়, জিপদও দৌড়োয়—

    শেষকালে নর্দমার ধারে গিয়ে ধরে ফেলেছে। তারপর নোটটাকে পকেটে পুরে নিজের মনেই বলে—শালা যেন ভিক্ষে দিচ্ছে, শালা যেন ভিখিরি পেয়েছে আমাকে— যেমন হয়েছে শুয়োরের বাচ্চা, তেমনি হয়েচ্ছে শারার খদ্দের, সত্তরখানা ওয়াগন পেলি, আর আমার বেলাতেই যত বুড়ো আগুল—

    .

    মিস্টার ঘোষালের ঘরের সামনে তখনও লাল আলো জ্বলছে। লাল আলো জ্বললে কারোর ভেতরে যাবার অধিকার নেই। কিন্তু ঝড়ের বেগে সতী ঘরে ঢুকলো। আপিসের আর যার জন্যে যে-নিয়মই থাক, পি-এ’র জন্যে সে নিয়ম নয়!

    মিসেস ঘোষের চেহারা দেখে মিস্টার ঘোষাল চমকে উঠলো।

    ততক্ষণে জুয়েলারী কেসটা সরিয়ে ফেলেছে মিস্টার ঘোষাল। হোয়াটস্ আপ? কী হলো?

    সতী সোজা নিজের কামরার দিকেই চলে যাচ্ছিল। মিস্টার ঘোষালও চেয়ার ছেড়ে উঠলো। বললে—কী হলো? কোথায় গিয়েছিলে? সেন-এর সঙ্গে দেখা করে এলে?

    সতী মুখ ঘুরিয়ে একেবারে সোজা মিস্টার ঘোষালের দিকে চাইলে। বললে—তুমি আমার একটা কথা রাখবে?

    মিস্টার ঘোষাল অবাক হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলে—কী কথা?

    —তুমি রাখবে কিনা আগে বলো?

    মিস্টার ঘোষাল হঠাৎ ড্রয়ার থেকে কেসটা বার করে বললে—এটা দেখেছ? তোমার জন্যে কিনে এনেছি—

    সতীও দেখলে চেয়ে। রুবি, ডায়মন্ড, স্যাফার বসানো নেকলেস।

    সতী বললে—কখন কিনলে?

    মিস্টার ঘোষাল বললে—তোমাকে বলিনি, কাল কিনেছি, ভেবেছিলাম আজকে রিসেস-এর সময় চা খেতে খেতে তোমার চমকে দেব! কিন্তু তুমি যে-রকম রেগে গেলে তখন—

    সতী বললে—আমি রাগিনি, তুমিই আমাকে রাগিয়ে দিলে—

    —তোমার পছন্দ হয়েছে? কত প্রাইস হবে বলো তো?

    —জীবনে কখনও তো নিজে কিছু কিনিনি, দাম কত কী করে বলবো?

    মিস্টার ঘোষাল বললে-থার্টিন থাউজ্যান্ড ক্যাশ্ ডাউন—

    —কিন্তু এত টাকা দিয়ে কেন মিছিমিছি কিনতে গেলে আমার জন্যে? আমার তে সব গয়নাই আছে।

    মিস্টার ঘোষাল বললে—সে থাক, সে তো তোমার শ্বশুর-বাড়িতে আছে— সতী হাতে তুলে নিলে কেসটা। মিস্টার ঘোষাল বললে—আর ইউ হ্যাপি মিসেস ঘোষ?

    আই অ্যাম, কিন্তু দাম দিয়ে কেন কিনতে গেলে?

    মিস্টার ঘোষাল হাসলো। বললে—তোমার জন্যে আমি আর কী করতে পারি মিসেস ঘোষ?

    সতী বললে—সত্যি তুমি আমার জন্যে কিছু করতে চাও?

    —আই য়্যাম য়্যাট ইওর সার্ভিস মিসেস ঘোষ! অলওয়েজ—

    —তাহলে মিস্টার সেনকে ট্রান্সফার করে দাও—

    মিস্টার ঘোষালও এতটা আশা করেনি। অবাক হয়ে চেয়ে দেখলে সতীর দিকে। বললে—আর ইউ শিওর?

    সতী বললে—হ্যাঁ যা বলছি তুমি করো, আর নয়তো ওকে—। যেখানে হোক, যে কোনও ডিভিশনে—

    —কিন্তু কেন? কী হলো হঠাৎ?

    সতী তখনও হাঁফাচ্ছে। যেন দীপঙ্করের সমস্ত কথাগুলো আবার মনে পড়ে গেল। বললে—ও একটা জানোয়ার, ও একটা পশু—

    মিস্টার ঘোষাল কঠিন হয়ে উঠলো। বললে—তোমাকে ইনসাল্ট করেছে সেন?

    —সব কথা আমি তোমাকে বলতে পারবো না। কিন্তু ওর চোখের সামনে একই আপিসে আমি চাকরি করতে পারবো না—ওকে আমি আর টলারেট করতে পারছি না— হি ইজ এ ড্যাম নুইসেন্স হিয়ার—

    মিস্টার ঘোষাল বললে—অলরাইট, আমি মিস্টার ক্রফোর্ডকে আজই নোট দিচ্ছি—

    বলে চেয়ারে বসেই মিস্টার ঘোষাল কলিং-বেলের ওপর জোরে ঘা মারলে।

    বাইরে থেকে আওয়াজ এল-হুজুর—

    দ্বিজপদ ঘরে এসে দাঁড়াল। মিস্টার ঘোষাল বললে—টী—

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64 65 66 67 68 69 70 71 72 73 74 75 76 77 78 79 80 81 82 83 84 85 86 87 88 89 90 91 92 93 94 95 96 97 98 99 100 101 102 103 104
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী
    Next Article কড়ি দিয়ে কিনলাম ১ – বিমল মিত্র

    Related Articles

    বিমল মিত্র

    সাহেব বিবি গোলাম – বিমল মিত্র

    May 29, 2025
    বিমল মিত্র

    বেগম মেরী বিশ্বাস – বিমল মিত্র

    May 29, 2025
    বিমল মিত্র

    আসামী হাজির – বিমল মিত্র

    May 29, 2025
    বিমল মিত্র

    কড়ি দিয়ে কিনলাম ১ – বিমল মিত্র

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }