কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.১৯
১৯
রেলের আপিসের বাবুদের টেবিলে তখন অনেক কাজ। ওয়ার-ট্র্যাফিক মাথা খারাপ করে দিয়েছে সকলের। এজেন্টের আপিস থেকে সকালবেলা একটা অর্ডার আসে, দিল্লীর বোর্ড থেকে আসে উল্টো অর্ডার বিকেল বেলা। তারপর আছে লোক্যাল ট্র্যাফিক। কলকাতার সমস্ত লোক সার বেঁধে চেলেছে রেল-স্টেশনের দিকে। ডালহৌসী, স্ট্রান্ড রোড, হাওড়া-ব্রীজ ধরে একেবারে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে চলেছে মানুষের মিছিল। মানুষের কোলে ছেলে, মাথায় মোট! ঘোড়ার গাড়ির মাথায় মানুষের দল বসে বসে চলেছে। সমস্ত খাটাল উজাড় করে হিন্দুস্থানীরা চলেছে—সঙ্গে সঙ্গে চলেছে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ গরু-মোষ-ছাগল-ভেড়া। গরু-মোষের পাশাপাশি মানুষও চলেছে। কলকাতার মানুষ মরতে চায় না, তাই কলকাতা থেকে পালিয়ে বাঁচবে।
সমস্ত আপিস যখন ছুটি হয়ে গেল, মধু এল ঘরে।
দীপঙ্কর বললে—কিছু বলবি মধু?
মধু বললে—সবাই চলে গেছে হুজুর!
দীপঙ্কর বললে—তুইও যা, আমার যেতে দেরি আছে—
তারপর ক্রমে সমস্ত আপিসই ঠান্ডা হয়ে এল। কোথাও কোনও শব্দ নেই। ওয়ার- ট্যাফিকের কাজ করতে করতে হঠাৎ মনে হলো কোথায় যেন একটা কী শব্দ হচ্ছে। হয়ত পাশের বাথরুমে করে জল পড়ছে টপ্ টপ্ করে। কিম্বা হয়ত ফাইলের গাদায় ইঁদুর ঢুকেছে। কিম্বা হয়ত সে-সব কিছুই নয়। অন্য শব্দ! বহুদিন আগে কলেজে পড়বার সময় হাইনের লেখা লাইনগুলো মনে পড়লো —
In the silence one can hear a soft monotonous dripping. It is the dividends of the capitalists continously trickling in, continuously mounting up. One can literally hear them multiply, the profits of the rich. And one can hear too, in between, the low sobs of the destitute, and now and then a harsher sound, like a knife being sharpened.
আজ এতদিন পরে দীপঙ্কর সেই পুরোন কথাগুলোর মানে যেন বুঝতে পারলে। কোথায় কিয়েভ, কোথায় ওডেসা, কোথায় খারকভ, কোথায় লেনিন-গ্র্যাড, কোথায় সেভাস্টোপল্–সেখানে যুদ্ধ করছে কারা, আর এখানে রেলের আপিসে চলেছে আর এক যুদ্ধ, আর এক লড়াই। টাকার লড়াই ডিভিডিন্ডের লড়াই, ব্রাইব আর ডিবচারির লড়াই।
দীপঙ্কর উঠলো। তখনও সেই শব্দটা কানে আসছে। একটানা একঘেয়ে শব্দ। ডিভিডেন্ড, শেয়ার, ইন্টারেস্ট, প্রপার্টি। একটানা, একঘেয়ে। প্রমোশন, ট্র্যান্সফার, ইনক্রিমেন্ট।
নির্মল পালিত সেই কথা বোঝাচ্ছিল প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের বাড়িতে।
—তোমরা যাবে না বাবা কলকাতা ছেড়ে?
নির্মল পালিত বললে—আমি তো যেতে পারলে বাঁচতাম মা-মণি—কিন্তু যাই কী-করে বলুন?
—কেন?
নির্মল পালিত বললে—এই আপনার প্রপার্টির একটা ব্যবস্থা না করে যাই কী করে? আমি আপনার সব প্রপার্টি বেচে লিকুইড ক্যাশ করে দিয়ে তবে ছুটি পাবো, তার আগে নয়।
মা-মণি বললে—তোমার বাবাই তো এর জন্যে দায়ী বাবা! আমি কি এ-সব চেয়েছিলুম? আমি বিধবা মানুষ, একটু ধর্ম-টর্ম করে শেষের ক’টা দিন কাটিয়ে দিতে পারলেই যথেষ্ট মনে করতুম। কিন্তু তোমার বাবাই সব কাল করে গেলেন—
—কিন্তু রাতারাতি তো আর সংসার ছেড়ে যেতেও পারেন না আপনি।
—হ্যাঁ, আমার আবার সংসার। সংসারের ওপর আমার ঘেন্না ধরে গেছে বাবা! টাকাগুলো ব্যাঙ্কে রেখে মাসে মাসে সুদ পেলেই আমি খুশী, সেই সুদ নিয়ে একটা জীবন আমার কাশীতেই কেটে যাবে—
—কিন্তু সনাতনবাবু? তাঁকে দেখবার কে থাকবে এখানে?
—যে-যার কপাল নিয়ে সংসারে এসেছে বাবা। আমি কী করবো। আমি তো তার ভাল করতেই চেয়েছিলুম আর তার ভালোর জন্যেই ছেলের বিয়ে দিয়েছিলুম। আজ যদি বউ ভাল হতো আমার তো ভাবনা ছিল না। এতদিনে ছেলে-পিলেতে ঘর ভরে যেত! কত বাড়িতে তো যাই, কত আনন্দ করে আছে সবাই দেখি। কিন্তু দেখ না, এ যেন ভূতের বাড়ি হয়েছে। যেন শ্মশানের মধ্যে বাস করছি বাবা! যেন শ্মশান, বাড়ি নয় তো! এবার একপাল শকুন এসে বাগানে বসে না কেন তাই ভাবি। এই দেখ না বাবা, আগে তবু মালী ছিল, গাড়িটা ছিল, ড্রাইভারও ছিল, রাগ করে সব বেচে দিলাম! সকলকে ছাড়িয়ে দিলাম—
—কিন্তু কেন বেচলেন? টাকার জন্যে?
মা-মণি আর কথা বাড়ালে না। বললে—থাকগে ও-সব কথা। ও-কথা ভাবতেও খারাপ লাগে বাবা। তুমি আসো তাই একটু যা কথা বলে সুখ পাই। তুমি তো সবই জানো, তোমাকে বলতে দোষ নেই—ছেলের সঙ্গেও আমার বাক্যালাপ পর্যন্ত বন্ধ!—আমি শ্মশানের বাস করছি বাবা, ক্যাওড়াতলার শ্মশানও এর চেয়ে ভাল আমার কাছে—
হঠাৎ বাইরে কার জুতোর আওয়াজ পেতেই নির্মল পালিত মুখ ফেরালে। মা-মণিও ফিরে দেখলে।
নির্মল পালিতই মুখ খুললে প্রথম। বললে—আরে তুই?
দীপঙ্কর বললে—আমি সনাতনবাবুর সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই—
নির্মল পালিত মা-মণির মুখের দিকে একবার চাইলে।
মা-মণি বললে—কী দরকার?
দীপঙ্কর বললে—আমার বিশেষ জরুরী একটা দরকার আছে—
অন্যদিনের চেয়ে দীপঙ্করের মুখটা যেন আরো গম্ভীর, আরো করুণ দেখালো!
মা-মণি বললে—কী দরকার তোমার বলো?
দীপঙ্কর যেন এতক্ষণে মা-মণিকে দেখতে পেয়েছে। সামনে গিয়ে পায়ের ধূলা নিয়ে মাথায় ঠেকালে। বললে—সনাতনবাবুর সঙ্গেই আমার দরকার ছিল—
—তা তো ছিল, কিন্তু দরকারটা কীসের?
—আমি একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করবো!
মা-মণি বললে—সে তো বুঝলুম, কিন্তু কীসের দরকার, সেইটে জিজ্ঞেস করছি—
দীপঙ্কর বললে—আমি তো বলেছি, দরকার আমার তাঁর সঙ্গে!
—আরে, এ তো দেখছি বড় আল্ল্টপকা মানুষ! আমি বলছি কীসের দরকার আর তুমি বলছো বিশেষ দরকার!
তারপর নির্মল পালিতের দিকে ফিরে বললে—শুনলে তো বাবা, শুনলে তো?
নির্মল পালিত সবই শুনেছিল। এতক্ষণে কাছে এল। বললে—কীরে, কী দরকার বল্ না? এই প্রপার্টি সম্বন্ধে কিছু বলবি? প্রপার্টি সম্বন্ধে কিছু যদি বলতে চাস তো আমাকে বলতে পারিস্। ঘোষ-ফ্যামিলির প্রপার্টি আমিই দেখাশোনা করি। বাড়ি কিনবি?
দীপঙ্কর আরো গম্ভীর হয়ে উঠলো। বললে—সনাতনবাবু কি নেই বাড়িতে? আর থাকলে তাঁর সঙ্গে কি দেখা করতে দেওয়ার নিয়ম নেই?
মা-মণি নির্মল পালিতের দিকে চেয়ে বললে—তুমি বাবা একটু বুঝিয়ে বলো তো একে যে, এ-বাড়ির মালিক আমি, আমাকে না-জিজ্ঞেস করে এ-বাড়ির ভেতরে কারো সঙ্গে কথা বলা যায় না—
হঠাৎ শম্ভু কাছে এসে দাঁড়াল। বললে-দাদাবাবু আপনাকে ভেতরে ডাকছেন একবার—
—কে ডাকছে রে শম্ভু?
শম্ভু বললে—আজ্ঞে; দাদাবাবু! দাদাবাবু নিজের ঘর থেকে নতুন-দাদাবাবুর গলা শুনতে পেয়েছে —
—শুনলে তো বাবা, শুনলে তো! শুনলে তো ছেলের কান্ড? আমি আর কী বলবো বলো, এরকম করলে মানুষের কি মাথার ঠিক থাকে! আর আমি একলা মানুষ, কত দিকে মাথা দেব! আমার এই সম্পত্তিই হয়েছে কাল! তোমার বাবা এই সর্বনাশটা আমার করে গিয়েছেন বাবা—যা ইচ্ছে করুক ওরা, আমার কী!
নির্মল পালিত বললে—আপনি কোনও দিকে কান দেবেন না মা-মণি, আমি যতক্ষণ আছি, ততক্ষণ আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, এই দলিলটাতে সই করে দিন—এই তিনটে জায়গায়—
ততক্ষণে দীপঙ্কর একেবারে সোজা সনাতনবাবুর শোবার ঘরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বললে—কেমন আছেন সনাতনবাবু?
—ভালো আছি দীপুবাবু। আপনি কেমন আছেন? দেখলেন তো আপনাকে আমি বলেছিলাম ওয়ার বাধবে। এ আর কেউ রোধ করতে পারবে না! রোধ করতে পারবে কী করে, বলুন?
দীপঙ্কর চুপ করে রইল খানিকক্ষণ!
সনাতনবাবু বলতে লাগলেন—কেবল হিটলারের দোষ দিচ্ছে চার্চিল সাহেব! কিন্তু হিটলারের কী দোষ বলুন। হিটলার না-থাকলেও লড়াই বাধতো। ছোট ছোট হিটলারে দেশ যে একবারে ভরে গেছে মশাই, কেউ কাউকে বিশ্বাস করছি না, কেউ কারোর উন্নতি সহ্য করতে পারছি না, কেউ কারোর দুঃখ বুঝছি না। আমাদের হাড়েই ঘুণ ধরেছে যে—
দীপঙ্কর বললে—আমি একটা কাজের কথা বলতে এসেছি আপনার সঙ্গে—
—তা এটাও তো কাজের কথাই দীপুবাবু, এটা ভাবছেন কাজের কথা নয়! এত বড় কাজের কথা আর আছে কী, বলুন তো! সমস্ত পৃথিবীসুদ্ধ লোকের মন-প্রাণ নিয়ে কাড়াকড়ি চলছে, আর আপনি বলছেন কাজের কথা নয় এটা!
দীপঙ্কর বললে—কাজের কথা তো বটেই। কিন্তু আরো জরুরী কাজের কথা বলতে এসেছি আমি!
—দেখুন দীপুবাবু, এ-যুদ্ধ আমাদের ঘর-সংসার সব বদলে দেবে, সব ভেঙে দেবে, এই আমি বলে রাখলুম। আমাদের ভালোটাও ভাঙবে, আমাদের খারাপটাও ভাঙবে! এ- যুদ্ধটাও আমাদের তাই দরকার ছিল—আমার তো তাই মনে হয়। আপনি কী বলেন!
তারপর দীপঙ্করের গম্ভীর মুখটার দিকে নজর পড়তেই সনাতনবাবু বললেন— আপনি কি আপিস থেকে আসছেন? খুব কান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে!
দীপঙ্কর বললে—আমি সতীর কথা বলতে এসেছিলাম, মিসেস ঘোষের কথা—
—সতীর কথা!—সনাতনবাবু যেন অবাক হয়ে গেলেন। বললেন—কিন্তু তিনি তো নেই দীপঙ্করবাবু, তিনি তো বাড়িতে নেই। জানেন দীপঙ্করবাবু আপনি শুনে অবাক হয়ে যাবেন, তিনি একদিন এ-বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন! এখানে আর তিনি থাকেন না!
দীপঙ্কর বললে—সে আমি জানি। জানি বলেই তো এসেছি —
সনাতনবাবু বললেন—আপনি জানেন? কিন্তু তিনি কেন চলে গেলেন বলুন তো! আমি তো অনেক করে থাকতে বললাম, কিন্তু তিনি আমাকে তাঁর সঙ্গে চলে যেতে বললেন! কিন্তু আমি কী করে যাই? আপনিই বলুন!
তারপর একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন—তিনি বড় ভালমানুষ ছিলেন, জানেন দীপঙ্করবাবু, এমন ভালো সচরাচর দেখা যায় না। আমি তো বিয়ের দিন থেকেই দেখে আসছি, বড় ভালো মানুষ ছিলেন। আমি তাঁকে বরাবর বলতাম, লেখাপড়ার মধ্যে মনকে ডুবিয়ে রাখতে, লেখাপড়ার মত বন্ধু তো আর নেই জগতে! কিন্তু তাঁকে আমি দোষ দেই না দীপঙ্করবাবু! তাঁর কোনও দোষ নেই, তিনি বড় ভালো মানুষ ছিলেন—
তারপর আরো যেন কী বলতে যাচ্ছিলেন—দীপঙ্কর তার আগেই বললে—সব আমি জানি
—আপনি সব জানেন?
সনাতনবাবু যেন দীপঙ্করের কথার মধ্যে সতীর কাজের সমর্থন পেয়ে অকূলে কূল পেলেন। বললেন—আপনিও জানেন তিনি কি-রকম ভালো মানুষ ছিলেন? আপনি জানেন?
দীপঙ্কর বললে—জানি বৈকি সনাতনবাবু, সতীর মত স্ত্রী পাওয়া যে-কোনও পুরুষের পক্ষে সৌভাগ্য!
সনাতনবাবুর মুখে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠল এতক্ষণে । বললেন—তাহলে তো আপনিও জানেন দেখছি! আর জানবেন নাই-বা কেন? আপনি তো ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছেন! কিন্তু আরো অনেক জিনিস জানি, যা আপনিও জানেন না দীপঙ্করবাবু!
—কী জিনিস?
সনাতনবাবু বললেন—স্ত্রীলোকের সমস্ত ভূষণ তাঁর মধ্যে আছে দীপঙ্করবাবু। শাস্ত্রে যে-সব গুণ থাকলে স্ত্রীলোককে স্ত্রী-রত্ন বলা হয়, তার সমস্তগুলি তাঁর মধ্যে বর্তমান । আপনি ঠিকই বলেছেন, যে-কোনও পুরুষের পক্ষেই অমন স্ত্রী পাওয়া সৌভাগ্য!
—কিন্তু তিনি এখন কোথায় আছেন, জানেন আপনি?
সনাতনবাবু বললেন—না তো!
দীপঙ্কর বললে—আপনি হয়তো শুনে অবাক হয়ে যাবেন, তিনি এখন আমাদের আপিসে চাকরি করছেন ।
-তাই নাকি? সে তো বড় বিচিত্র অভিজ্ঞতা!
দীপঙ্কর বললে—সেই কথাই আমি আপনাকে জানাতে এসেছি, এমন এক জায়গায় চাকরি করছেন যেখানে চাকরি করলে মানুষের মনুষ্যত্বে কলঙ্ক লাগে, এখন আপনি আপনার যা-বিবেচনা হয় করুন!
সনাতনবাবু যেন মহা-সমস্যায় পড়লেন। বললেন—কিন্তু দীপঙ্করবাবু, আমার তো বিবেচনা হচ্ছে ভালোই করেছেন তিনি। সংসারের মধ্যেই কি কম আবিলতা মনে করেন! যত ছোট বা যত বড়ই সংসার হোক, তার মধ্যে থেকেও তো মনুষ্যত্বকে নিষ্কলঙ্ক রাখবার উপায় নেই আজ, আর চাকরি করলেই যত দোষ !
–তা হলে আপনিও তার চাকরি করা সমর্থন করেন?
সনাতনবাবু বললেন—না, তা করি না! আমি তো তাঁর বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়াই সমর্থন করি না। আপনাদের আপিসেই তো তিনি চাকরি করেন, তা আপনি একবার দেখা হলে তাঁকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবেন?
–বলুন, কী জিজ্ঞেস করবো?
সনাতনবাবু বললেন—এই কেন তিনি চলে গেলেন? আমি নিজে তো কোনও দোষ করিনি!
দীপঙ্কর বললে— আপনি তো নিজেই সেই কথাটা জিজ্ঞেস করতে পারেন!
সনাতনবাবু বললেন—তা পারি বৈ কি! আমি নিজেও জিজ্ঞেস করতে পারি
—আপনার অসুখটা সেরে গেলে একদিন আপিসে যাবেন। আমি একদিন তাঁর সঙ্গে আপনার দেখা করিয়ে দেব! আপনার শরীরটা তার আগে একটু ভালো হোক !
সনাতনবাবু বললেন—আপনি তো ভালো প্রস্তাবই করেছেন। তা শরীর আমার এমন কিছু খারাপ নয়, আমি কালকেই যেতে পারি। ট্যাক্সি করে যেতে হবে। আমাদের গাড়িগুলো মা-মণি বিক্রি করে দিয়েছেন, আপনি জানেন তো! তিনি চলে যাবার পর এ- বাড়ির সব কিছু বদলে গিয়েছে, আপনি তাঁকে বলবেন—
–সে তো আপনি গিয়েও বলতে পারেন!
–তা আমিও গিয়ে বলতে পারি! আমার বলতে কীসের আপত্তি! আমার সঙ্গে তো তাঁর কোনও মনোমালিন্য হয়নি দীপঙ্করবাবু যে আমি বলতে পারবো না। আপনি আপিসে যাবার সময় আমাকে নিয়ে যাবেন। আমি সব বলবো। আপনার সঙ্গে যা-যা কথা হলো সব বলবো! আমার বলতে আপত্তি কীসের!
দীপঙ্কর বললে—আপনি তাকে চাকরি করতে বারণ করবেন সনাতনবাবু! আমি বারণ করেছি, কিন্তু আপনি বারণ করলে সে কিছুতেই এড়াতে পারবে না। আপনার কথা অমান্য করতে পারবে না সতী! আপনি তাকে চাকরি করতে বারণ করবেন, বাড়িতে ফিরে আসতে বলবেন। আমার কথা সে না শুনুক, আপনার কথা শুনবেই, আপনার কথা ফেলতে পারবে না কিছুতেই—
সনাতনবাবু বললেন—তা বলবো, কিন্তু আপনি উঠলেন কেন, বসুন না—
দীপঙ্কর চলে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছিল, আবার বসলো। দীপঙ্করের মনে হলো একদিন অনেক দিন আগে এই বাড়িতে আসতেই তার কেমন রোমাঞ্চ হয়েছিল, আর আজ সমস্ত বাড়িটা যেন শূন্য হয়ে গেছে। যেন খাঁ খাঁ করছে সমস্ত বাড়িটা। ঘরের জানলা দিয়ে বাগানটার দিকে চেয়ে দেখলে। বাগানে সেই ফুলের কেয়ারি নেই। অনেক ঘাস গজিয়ে জায়গাটাকে জঙ্গলে পরিণত করেছে।
সনাতনবাবু বললেন—আপনার জলযোগের ব্যবস্থা করতে বলি শম্ভুকে, আপনি আপিস থেকে আসছেন—
দীপঙ্কর আপত্তি করলে। বললে—ব্যস্ত হবেন না, আমি এখান থেকে বাড়ি চলে যাবো—
সত্যি বাড়িতেই বা কে আছে দীপঙ্করের। সেই মা তো আর নেই। কে-ই বা তার জন্যে পথের দিকে চেয়ে বসে থাকবে মা’র মতো! দীপঙ্কর সনাতনবাবুর দিকে চেয়ে দেখতে লাগলো। একদিন এই ঘরেই সতী থাকতো। এই ঘরেই সতী শুতো, এই ঘরেই বাস করতো। এই ঘরেই খিল বন্ধ করেই সনাতনবাবুকে ঘরে ঢুকতে দেয়নি সতী। সতীর জীবনের কতদিনের ইতিহাস এই ঘরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এই ঘরেই দিনের পর দিন, রাতের পর রাত একলা কেটেছে সতীর। এই ঘরের ভেতরেই যেন সতীর সান্নিধ্যের উত্তাপ লেগে আছে।
অনেক দিন পরেও দীপঙ্করের এই ঘটনাটার কথা মনে পড়তো। এতদিন পরে এই দিনকার কথা ভাবতে গিয়ে আবার একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল হৃৎপিন্ড ভেদ করে। এমনি করেই বোধহয় একদিন মানুষের সব স্বপ্ন-সৌধ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এমনি করেই বোধহয় অলক্ষ্য কাল এসে সব কামনা-বাসনাকে গ্রাস করে। এমনি করেই একদিকে ভাঙে, আর একদিক গড়ে তোলবার জন্যে! কিন্তু প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের এত বড় স্বপ্নটাকে ভেঙে মহাকালের কী লাভ হলো! কার উপকার হলো? সনাতনবাবুর, না দীপঙ্করের, না সতীর—কার?