কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২০
২০
কিন্তু দীপঙ্কর কী জানতো ঠিক তখনই, সেই মুহূর্তেই আর একটা স্বপ্ন প্যালেস-কোর্টের করিডোর অতিক্রম করে একেবারে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের মোড়ে এসে বাসা বাঁধছে! দীপঙ্কর কি জানতো সেই সতীর সর্বাঙ্গ জুরে ঘৃণার আর প্রতিশোধের বহ্নি লেলিহান হয়ে উঠেছে! তা জানলে দীপঙ্কর এমন শান্ত হয়ে বসে থাকতে পারতো না সনাতনবাবুর রোগশয্যার সামনে।
সতী গাড়িতে হেলান দিয়ে হা-হা করে হেসে উঠলো।
মিস্টার ঘোষাল পাশে বসে চুরোট টানছিল। বললে—হাসছো যে!
সতী হঠাৎ মিস্টার ঘোষালের দিকে ঝুঁকে পড়লো একটা ঝাঁকুনি খেয়ে। বললে— তোমাদের সেন-সাহেবের কথা ভাবছি—
মিস্টার ঘোষাল বললে—একটা আস্ত কাউয়ার্ড—আই শ্যাল ট্র্যান্সফার হিম্—
সতী বললে—তুমি পারবে তো ট্র্যান্সফার করতে?
মিস্টার ঘোষাল বললে—নিশ্চয় পারবো, এমন জায়গায় ট্র্যান্সফার করে দেব, যেখান থেকে আর কলকাতায় না আসতে পারে—
সতী বললে—যেন কখনও ওর মুখ না-দেখতে হয় আমাকে—
গাড়িটা সোজা আসছিল। হঠাৎ মিস্টার ঘোষাল জিজ্ঞেস করলে—এইটেই তো প্রিয়নাথ মল্লিক রোড, এই বাঁদিকে!
সতী ততক্ষণে আবার গম্ভীর হয়ে গেছে বলতে গিয়ে তার মুখে যেন কথা আটকে গেল।
—তোমার শ্বশুর-বাড়ি কোনটা?
সতী তখনও সেই দিকে চেয়ে ছিল একদৃষ্টে। এইখান থেকেই একদিন বিতাড়িত হয়ে চলে যেতে হয়েছে তাকে। এইখানেই একদিন চূড়ান্ত অপমানের ধৈর্য-পরীক্ষা হয়ে গেছে তার ওপর দিয়ে। এই বাড়িতেই একদিন তার ভাগ্য-দেবতার স্থান সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন তার বাবা। সতীই কি একদিন জানতো আবার একদিন এইখানেই তাকে ফিরে আসতে হবে চরম প্রতিশোধের দন্ড হাতে নিয়ে।
—কোটা তোমার শ্বশুর-বাড়ি? ডান দিকের এইটে?
সতী তখনও সেইদিকে চেয়ে আছে। গেটে আর সেই দারোয়ান নেই। অন্ধকারে ভেতরটা স্পষ্ট দেখা গেল না। একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। সতী চিনতে পারলে- ব্যারিস্টার পালিতের গাড়ি হয় তো।
—চারদিকে তো অন্ধকার দেখছি, লোকজন কেউ নেই বুঝি ভেতরে! সব চলে গেছে কলকাতা ছেড়ে?
সতী শুধু বললে—না—
—তাহলে? মেম্বর ক’জন বাড়িতে?
সতী তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিলে। বললে—ওদের কথা ছেড়ে দাও—এখন থেকে ওরা কেউ নয় আর আমার—এখানে থামতে বলো—
গাড়িটা থামলো। মিস্টার ঘোষাল নামলো। ঠিক উল্টোদিকের বাড়িটা। রাস্তার সামনের দিকে বারান্দা। ওপরে দু’খানা ঘর, নিচেও দু’খানা। বাড়িওয়ালা পেছনের অংশে থাকে। কড়া নাড়তেই ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। বললেন—আসুন, আসুন, আপনাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলুম—
মিস্টার ঘোষাল চুরোটের ধোঁয়া ছেড়ে বললে—আমাদের আসতে একটু দেরি হয়ে গেল—
—তাতে কী হয়েছে, আপনি তো অ্যাভান্স দিয়ে গেছেন, আমিও নিশ্চিন্ত হয়ে আছি। আর এ-সময়ে তো টেনেন্ট পাওয়াই যায় না। সবাই কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছে এখন, আপনারা হলে তবু বাড়িটা দেখা-শোনা করবার একজন লোক পাওয়া যাবে!
সতীও ভেতরে ঢুকলো। ভদ্রলোক আগে আগে চললেন। এ-পাড়ার বহুদিনের বাসিন্দা। যেতে যেতে বললেন—সবাই চলে গেছে তো পাড়া থেকে আমিও ফ্যামিলি পাঠিয়ে দিয়েছি বাইরে—। এ-পাড়ায় তো লোক নেই কেউ আর। আছি শুধু আমরা আর সামনের ঘোষেরা—
—ঘোষেরা? কোন্ ঘোষেরা?
ভদ্রলোক বললেন—সনাতন ঘোষ বলে এক ভদ্রলোক। তিনি আছেন আর তাঁর বিধবা মা আছেন বাড়িতে, আর কেউ নেই, ছেলের বউ ছিল, তা সে-বউও শুনেছি নাকি আর নেই। বলতে গেলে পাড়া একেবারে খাঁ খাঁ করছে। এখানে থাকতেও ভয় করে স্যার—
সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠবার রাস্তা। ভদ্রলোক হাতে চাবির গোছা নিয়ে উঠতে লাগলেন সিঁড়ি দিয়ে। বললেন—নিচেয় কীচেন, আর বাথরুম, আর ওপরে অ্যাটাচড্ বাহ্ আর দুঃখানা বেড-রুম্—
মিস্টার ঘোষাল পেছনে উঠতে উঠতে বললে—ওতেই আমাদের পার্পাস্ সার্ভড় হয়ে যাবে—
ভদ্রলোক বললেন—কেন যে আপনারা প্যারেস-কোর্টের মত ফ্ল্যাট ছেড়ে এখানে আসছেন কে জানে, তার তুলনায় এ অবশ্য কিছুই না—
মিস্টার ঘোষাল বললে—তা হোক, এখানে আমরা একটু লুলি থাকতে পারবো, মানে ঢিলে-ঢালাভাবে! দরকার হলে মাঝে-মাঝে গানের আসর বসাবো—। মিসেসের আবার গান-বাজনার শখ আছে কি না—
—ও, তাই বলুন!
ততক্ষণে দু’টো ঘরের দরজা খুলে দিয়েছেন ভদ্রলোক। সতী সোজা প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের দিকের ছোট বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। সামনের বাড়িটার সমস্তটা স্পষ্ট দেখা যায় এখান থেকে। ওই গেট, গেট পেরিয়ে ভিতরে গিয়ে বাঁদিকে সরকারবাবুর ঘর। তারপর বসবার বৈঠকখানা। বৈঠকখানা ঘরে আলো জ্বলছে। ব্যারিস্টার পালিত বোধহয় শাশুড়ীর সঙ্গে পরামর্শ করছে ওখানে বসে বসে। কেমন করে জব্দ করা যায় সতীকে, সেই মতলবই আঁটছে বোধহয়। তারপরেই কিছুদূর গিয়ে লাইব্রেরী-ঘর। ঘরটা অন্ধকার। দোতলার সমস্ত জানলাগুলো বন্ধ। তেতলার ঘরটায় আলো জ্বলছে। নিজের ঘরটা এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। শুধু বোঝা যায় হয়ত কেউ আছে। হয়ত তিনিই আছেন।
—ঘর সম্বন্ধে বলবার কিছু নেই, পুবমুখো ঘর, আলো-বাতাস পাবেন।
মিস্টার ঘোষাল কাছে এল। বললে—কী হলো? তুমি কিছু বলছো না যে?
সতী বললে—আমি আর কী বরবো?
মিস্টার ঘোষাল বললে—এই ঘরেই আসর পাতা যাবে, এই ঘর থেকেই তো ও- বাড়ির সব কিছু ডাইরেক্ট দেখা যাবে!
ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি বললেন—ওখানে পর্দা ঝুলিয়ে রাখবেন, তাহলেই আর কিছু দেখা যাবে না—
সতী অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাসলো। এখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকতে পারলেও যেন খানিকটা হাল্কা হতো মনটা! যেন গালাগালি দিলেও মনটা পরিতৃপ্ত হতো। অনেক কাঁটা, অনেক কলঙ্ক জমা হয়ে আছে ভেতরে। সব পরিষ্কার হয়ে যেত এখানে দাঁড়িয়ে চেঁচাতে পারলে।
বললে—এখান থেকে গান গাইলে ওদের বাড়িতেও শোনা যাবে তো?
ভদ্রলোক বললেন—আপনারা তো আর দিনরাত গান-বাজনা করছেন না?
মিস্টার ঘোষাল বললে—যদি তাই-ই করি, তাতেই বা কী! আমরা নিজেদের বাড়িতে নাচবো গান গাইবো—যা খুশি আমাদের করবো—ওদের কী!
ভদ্রলোক বললেন—তা করতে পারবেন, ইচ্ছে হলে করতে পারেন বৈ কি। আর ওদের যদি অসুবিধে হয় তো আপনারা দরজা বন্ধ করে দিয়ে গাইবেন—ওরা শুনতে পাবে না!
সতী হঠাৎ মুখ ফেরালো। বললে—কেন? ওদের কি ভয় করে চলতে হবে?
ভদ্রলোক বললেন—না না ভয়ের কথা হচ্ছে না, ওদের ভয় করতে যাবেন কেন আপনারা?
—তাহলে কেন বললেন ও-কথা আপনি? আমরা ভাড়া দিয়ে থাকবো না? আমরা এখানে যা-খুশি করবো। ওদের যদি অসুবিধে হয় তো ওরা বাড়ি ছেড়ে চলে যাক্!
ভদ্রলোক বললেন—না না, সে কথা নয়, ও-বাড়িতে তো কেউ থাকে না। থাকবার মধ্যে থাকে কেবল বুড়ি-মা আর তার ছেলে। বহুকালের লোক ওরা—এককালে ওদের স্টিভেডোরের ব্যবসা ছিল—লোক ওরা খুব ভালো!
—কে আপনাকে বললে, লোক ভালো? কে বললে?
ভদ্রলোক কেমন যেন বিব্রত হয়ে পড়লেন। কী বলবেন ভেবে পেলেন না।
সতী আবার বলতে লাগলো-আপনি আমার চেয়ে ওদের বেশি চেনেন? আমার চেয়ে ওদের বেশি জানেন? আপনি আমাকে চেনাতে এসেছেন ওদের? ওরা লোক ভালো?
মিস্টার ঘোষাল ততক্ষণে ভাড়া দিয়ে রসিদ নিয়ে পকেট পুরো নিয়েছে। বললে—আপনাকে কে বললে ওরা লোক ভালো? আপনি জানেন ওদের?
দু’দিক থেকে তাড়া খেয়ে ভদ্রলোক আত্মরক্ষার আর কোনও উপায় বার করতে পারলেন না। বললেন—ওঁরা তো পাড়ার কোনও ব্যাপারেই থাকেন না কিনা তাই বলছি—
সতী তখনও থামেনি। বললে-ওরা যদি ভালো লোক হবে তো ওদের বাড়ির বউ বাড়ি ছেড়ে চলে যায়?
ভদ্রলোক বললেন-আমরা তো অত খবর জানতে পারি না।
—তাহলে কেন বলছেন ওরা লোক ভালো! ওদের বাড়ির ভেতরে গিয়ে আপনি দেখেছেন, না শুধু বাইরে থেকে গাড়ি দেখেছেন, চাকর-বাকর দেখেছেন আর বিচার করেছেন! জানেন ওদের অন্দর-মহলে কত রকম অত্যাচার হয়? জানেন ওদের বাড়িতে বউ হয়ে এলে তার জীবন নষ্ট হয়ে যায় চিরকালের মত? তার ইহকাল-পরকাল-চিরকাল কেঁদে কাটাতে হয়?
বলতে বলতে সতী হঠাৎ যেন সংবিৎ হারিয়ে ফেললে। উত্তেজনায় কাঁধের শাড়িটা খসে গেল অজ্ঞাতে। যেন এক মুহূর্তে উন্মাদ হয়ে উঠলো সতী! যেন অতীত-বর্তমান- ভবিষ্যৎ সমস্ত তার একাকার হয়ে গেল এক নিমেষে।
মিস্টার ঘোষাল সামলে নিলেন। বললেন—চুপ করো, ওঁর সঙ্গে অত কথা বলবার দরকার কী?
সতী বললে—কেন চুপ করবো? চুপ করে থাকবার জন্যে কি ওঁর বাড়ি ভাড়া নিয়েছি? আমি এ-বাড়ির ছাদে উঠে চেঁচাবো, সকলকে জানিয়ে দেব আমি কে। সকলকে প্রচার করে দেব আমি ঘোষ-বাড়ির বউ—
–আঃ–
মিস্টার ঘোষাল আবার সামনে এসে দাঁড়িয়ে মিসেস ঘোষের মুখ বন্ধ করবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তার আগেই সতী চুপ করে গেছে। হঠাৎ দেখা গেল সতীর ঘরের জানলায় যেন কার মুখ দেখা গেল। সনাতনবাবু! হয়ত তিনিই টের পেয়েছেন। হয়ত তিনি সতীর গলা চিনতে পেরে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়েছেন।
সতীর দৃষ্টিকে অনুসরণ করে মিস্টার ঘোষালও চেয়ে দেখলে সেই দিকে। বললে— কে ও? মিস্টার সেন না!
সতীও যেন এতক্ষণে চিনতে পারলে। দীপু না? দীপু ওখানে কেন এই সময়ে?
কিন্তু একটি মুহূর্ত। তারপরেই মুখটা ভেতরে সরে গেল।