কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২১
২১
একতলার বৈঠখানা ঘরে নির্মল পালিত তখন কাগজপত্র ছড়িয়ে মা-মণিকে বলছিল— নিজের চোখে আপনি সমস্ত দেখে নিন্—নিজের প্রপার্টি নিজের চোখে দেখাই ভালো মা- মণি—
মা-মণি বললেন—আমার কি পোড়া চোখ আছে যে আমি দেখবো বাবা, ও-সব আমায় দেখাচ্ছো কেন? আমি ও-সব কী-ই বা বুঝি?
নির্মল বললে—কিছু বুঝতে যে আপনাকে হবেই মা-মণি! আপনার প্রপার্টি আপনি না বুঝে নিলে বুঝবে কে?
—না বাবা আমার ও-সব বুঝে দরকার নেই। আর আমিই যদি অত বুঝতে পারবো তো তুমি আছো কী করতে? আর আমার কি মনের ঠিক আছে বাবা। আমার মন যে পড়ে রয়েছে অন্য জায়গায়—
—অন্য জায়গায়? কোথায়?
মা-মণি বললেন—সেই যে ছোক্রা ওপরে ছেলের কাছে গেল, সে তো এখনও ফিরলো না! কানে কী ফুস্-মন্তর দিচ্ছে কে জানে
তারপর উঠলেন। বললেন—দাঁড়াও বাবা, তুমি বোস, আমি ওপরে গিয়ে দেখে আসি এতক্ষণ ধরে কী শলা-পরামর্শ দিচ্ছে কানে। একে আমার বাতের জ্বালা, তার ওপর হয়েছে এই এক ঝঞ্ঝাট—
বলে মা-মণি উঠে ঘরের বাইরে গেলেন।
ঘরের মধ্যে বসে কথা বলতে বলতে হঠাৎ দীপঙ্করের মনে হলো যেন কোথা থেকে সতীর গলার শব্দ আসছে। তবে কি সতীও এসেছে এ-বাড়িতে! ঠিক সতীর গলার শব্দের মতই বটে! এখন এখানে এসেছে! দীপঙ্কর জড়সড় হয়ে বসলো। এক্ষুণি হয়ত এ-ঘরে ঢুকে পড়বে! কিন্তু আবার মনে হলো, ভেতরে নয়, বাইরে। বাইরে কোথা থেকে আওয়াজটা আসছে। ঠিক অবিকল সতীর মত গলা। দু’জনের গলার শব্দ কি একরকম হতে পারে! হঠাৎ পাশের জানলাটায় গিয়ে দাঁড়াল দীপঙ্কর। একটা দোতলা বাড়ির বারান্দায় যেন দু’-তিনজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। অল্প অন্ধকারে স্পষ্ট চেনা যায় না। তবু তীক্ষ্ম নজর দিয়ে দীপঙ্করের মনে হলো সতীই যেন। আর সতীর পাশে? সতীর পাশে যেন মিস্টার……
—কানে কী এত ফুস্-মন্তর দিচ্ছ শুনি?
হঠাৎ দীপঙ্কর পেছন ফিরলো। ফিরেই দেখলে সামনেই সতীর শাশুড়ী। সতীর শাশুড়ী আবার বললেন—তখন থেকে বসে বসে কী এত ফুস্-মন্তর দেওয়া হচ্ছে আমার ছেলেকে?
দীপঙ্কর তাড়াতাড়ি কাছে সরে এসে বললে—এ আপনি কী বলছেন? শুনেছিলাম সনাতনবাবুর অসুখ, তাই দেখতে এসেছিলাম—
—তা দেখতে কি এই দশ ঘন্টা লাগে বাবা! চোখে তো এখনও চশমা ওঠেনি, তবু এত কীসের দেখা।
দীপঙ্কর বললে—এইবার আমি যাচ্ছিলাম—
—তা যাচ্ছিলাম তো যাও। যাই-যাই করেও দশ ঘন্টা কাটিয়ে দিলে! এতক্ষণ কী শলা-পরামর্শ হচ্ছিল শুনি?
দীপঙ্কর সহজভাবেই উত্তর দিলে—শলা-পরামর্শ আবার কী হবে মা-মণি!
—হয় হয় বাবা হয়। আমি বুড়ো মানুষ হলে কী হবে, কোথায় কার সঙ্গে কী শলা- পরামর্শ হয় সব আমার কানে আসে, আমি সব টের পাই! বুড়ো হয়েছি বলে এখনও চোখ-কানের মাথা খেয়ে বসিনি—
দীপঙ্কর বললে—ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি—
বলে উঠে দাঁড়াল। ঘর থেকে বেরিয়ে চলে যাচ্ছিল দীপঙ্কর, হঠাৎ সনাতনবাবু বললেন—আপনি তাহলে আমাকে আপনাদের ওখানে একদিন নিয়ে যাচ্ছেন দীপঙ্করবাবু—
দীপঙ্কর বললে—হ্যাঁ—আপনি তৈরি হয়ে থাকবেন—
মা-মণি হঠাৎ আকাশ থেকে পড়লেন যেন। বললেন—কোথায়? কোথায় নিয়ে যাবে?
কথাগুলো যে কাকে উদ্দেশ করে বলা হলো বোঝা গেল না। দীপঙ্কর দরজার দিকে যেতেই সতীর শাশুড়ী আবার জিজ্ঞেস করলেন—কোথায় নিয়ে যাবে শুনি? কোথায়?
কিন্তু ততক্ষণে দীপঙ্কর সোজা বেরিয়ে এসেছে। সতীর শাশুড়ীর প্রশ্নের উত্তর সনাতনবাবু দিলেন কি না তা আর জানা হলো না। সোজা তেতলার সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে চারদিকে চেয়ে দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল আবার। একদিন এই বাড়ির ভেতরেই বহুকাল আগে একবার এসেছিল, সেদিন এখানে সযত্ন পারিপাট্যের ছোঁয়াচ ছিল, আজ যেন সব হতশ্রী। বারান্দার কোণে, সিঁড়ির দু’পাশে ধুলো জমেছে! নিচের সিঁড়ির শেষ ধাপের কাছেও একটা পাখি ছিল। খাঁচাটা খালি পড়ে আছে আজ। তারপর বারান্দা আর বাগান পেরিয়ে সোজা প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে এসে থামলো!
.
বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক বললেন—তাহলে কবে থেকে আসছেন আপনারা?
মিস্টার ঘোষাল বললে—ধরে নিন আজ থেকেই—আজ থেকেই নিয়ে নিলুম— আপনি তো ভাড়া পেয়ে গেলেন—
গাড়িতে উঠে মিস্টার ঘোষাল বললে—কী ভাবছো?
সতী বললে—কই, ভাবছি না তো কিছু
মিস্টার ঘোষাল বললে—তুমি বলেছিলে বলেই ভাড়া নিলুম—তোমার জেদটা রইল—
তবু সতী কিছু কথা বলে না। এতদিন এত জল্পনা-কল্পনা, এতদিন ধরে এত প্রতিশোধ নেবার স্পৃহা সব যেন আজ হঠাৎ শিথিল হয়ে গেছে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের বাড়িটার সামনে এসে।
মিস্টার ঘোষাল আর একটা চুরোট ধরালে। বললে—তুমি যা চেয়েছিলে সব তো দিলাম, তবু মুখ ভার করে রইলে কেন?
সতী উত্তর দেবার আগেই গাড়িটা ব্রেক কষে একবার হর্ণ বাজালে। রাস্তার মধ্যেই কে যেন ছিল। সে সরে যেতেই গাড়িটা আবার সোজা হাজরা রোডে গিয়ে পড়লো। মিস্টার ঘোষাল বললে—ঘর চলো—
এক মুহূর্ত শুধু। ব্রেক কষে থেমে আবার সোজা ধুলো উড়িয়ে চলে যাওয়া। ব্ল্যাক্- আউটের অন্ধকার। তবু স্পষ্ট আন্দাজ করতে পারলে দীপঙ্কর। স্পষ্ট আন্দাজ করতে পারলে সতী। আর তারপরেই দীপঙ্কর খানিকক্ষণ সেই রাস্তার ধারেই নির্বোধের মত দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর সংবিৎ ফিরে পেয়ে আবার চলতে লাগলো আস্তে আস্তে।
হাজরা পার্কের ভেতরে তখন কিছু ভিড় জমেছে। আলো নেই। ব্ল্যাক্-আউটের রাতে বাইরে আলো জ্বালানো নিষেধ। তবু কয়েকজন জড়ো হয়েছে সেখানে। জোর বক্তৃতা চলছে। বক্তাকে ঘিরে অনেক লোক চুপ করে লেকচার শুনছে।
ভদ্রলোক বলছেন—বন্ধুগণ, আমরা আজ ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে বসবাস করছি। আমাদের মাথার ওপর যুদ্ধ, আর আমাদের নিজেদের ঘরে মধ্যে বিভেদ। স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস্-এর প্রস্তাব আমরা নাকচ করে দিয়েছি আপনারা জানেন। আজ যদি আমরা চল্লিশ কোটি ভারতবাসী একমত হতে পারতুম, আজ যদি মহম্মদ আলি জিন্না আমাদের কংগ্রেসকে সমর্থন করতেন, তাহলে কি আজ ক্রিপস্-সাহেব এমন করে আমাদের ধাপ্পা দিয়ে খালি হাতে চলে যেতে পারতেন! তবু আমি বলছি, আমাদের ভয় করবার কিছু নেই; আমরা কংগ্রেসসেবীরা মহাত্মা গান্ধীকেই আমাদের নেতা বলে মেনে নিয়েছি—মহাত্মাজী ওয়ার্ধার মিটিং-এ আমাদের বলেছেন, তাঁর অবর্তমানে তাঁর শূন্য স্থান শ্রীরাজাগোপালাচারীকেও দিতে চান না, সর্দার প্যাটেলকেও দিতে চান না। দিতে চান পন্ডিত জওহরলাল নেহরুকে। পণ্ডিতজী বাঙলার বড় আদরের নেতা—আজ যখন বাঙলা দেশ নেতাহীন, সুভাষবাবু নিরুদ্দেশ, শরৎ বসুও জেলে, তখন পন্ডিতজীর মত নেতা থাকতে বাঙালীর ভয় কী…….
অনেক দূর থেকেও কথাগুলো কানে আসছিল দীপঙ্করের। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে গিয়েও হঠাৎ কী যেন সন্দেহ হলো। আর পার্কের কাছে ফিরে এল। তারপর পার্কের ভেতরে ঢুকে কাছে গিয়ে দেখলে।
—এই যে যুদ্ধ বেধেছে, এ হিংসা, এ ষড়যন্ত্র, এ অন্যায় আর অত্যাচারের ফল। মানুষ আজ সৎ হতে ভুলে গেছে, মানুষ আজ অহিংসার পথ ভুলে গেছে, মানুষ আজ সত্য কথা বলতেও ভুলে গেছে!
দীপঙ্কর অবাক হয়ে দেখলে—বক্তৃতা দিচ্ছে ফোঁটা। ফটিক ভট্টাচার্যি! একটা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ফোঁটা বক্তৃতা দিচ্ছে, আর প্রাণমথবাবু তারই পাশে চুপ করে বসে আছেন। ম্রিয়মাণ, বিষণ্ণ, অসহায়ের মত চেহারা। আর তাঁর পাশেই ছিটে। ফোঁটা যেন আরো ফরসা হয়েছে, আরো স্বাস্থ্যবান। ফরসা ধপধপে খদ্দরের ধুতি-পাঞ্জাবি-চাদর গায়ে। কী চমৎকার সৌম্য শান্ত চেহারা, কি উদাত্ত কণ্ঠ। কথা শুনলেই ভক্তিতে গদগদ হয়ে মাথা নিচু করতে ইচ্ছে করে! ছিটেকেও আর চেনা যায় না।
আর দাঁড়াতে ইচ্ছে হলো না দীপঙ্করের। সোজা বেরিয়ে হাজরা রোড পার হয়ে একেবারে নেপাল ভট্টাচার্যি লেনের মধ্যে গিয়ে ঢুকলো। একে বস্তি, তার ওপর ব্ল্যাক্- আউট। কিরণের মা কি জানে যে, কিরণ ফিরে এসেছে? বাড়িতে ক্ষীরোদা একলা রয়েছে, এ-সময়ে যদি কিরণের মা দীপঙ্করের কাছে গিয়ে থাকে তো অনেক সুবিধে হয়। তা ছাড়া, এই বস্তির মধ্যে একলা পড়ে থেকে লাভ কী! কে দেখবার আছে? যদি একটা অসুখ বিসুখ হয়, তখন?
কিন্তু কিরণদের বাড়িটার সামনে গিয়েই দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল। চার পাঁচটা পুলিস বাড়ির সদর দরজার সামনে বেঞ্চির ওপর বসে পাহারা দিচ্ছে।
দীপঙ্কর ভেতরে ঢুকতে যেতেই তারা বাধা দিলে।
বলে—কাঁহা যানা হ্যায় বাবু?
দীপঙ্কর বললে—ভেতরে মাঈজীর সঙ্গে দেখা করবো—
পুলিসদের মধ্যে একজন এদিয়ে এসে বললে—কোন্ মাঈজী?
দীপঙ্কর বললে—কিরণবাবুর মা—
তারা ভেতরে যেতে দিলে না। শেষ পর্যন্ত কিরণের মা-ই বাইরে এল। বললে— দীপু! তুমি?
দীপঙ্কর বললে—মাসীমা, আপনার সঙ্গেই একটা কথা বলতে এসেছিলুম, কিন্তু চারদিকে পুলিস-পাহারা দেখছি—
মাসীমা বললে—হ্যাঁ বাবা, দেখ না, বাড়ির বাইরেও যেতে পারিনে, বাড়ির ভেতরে থেকেও শান্তি নেই, ক’দিন থেকে যে কী হয়েছে বুঝতে পারছিনে, কেন এমন করছে তা-ও কেউ বলতে পারছে না, –আমি ক’দিন ধরে বড় ভাবনায় পড়েছি বাবা—
দীপঙ্কর পুলিসদের দিকে ফিরে জানতে চাইলে কেন তারা এখানে পাহারা দিচ্ছে। এর কারণ কী? তারা জানালে—তাদের ওপর যেমন হুকুম হয়েছে তেমনি করছে।
মাসীমা বললে—তুমি বাবা দীপু এদের একটু বলে দাও না, কেন এরা এ-রকম করছে! কিরণ তো নেই এখানে, তাকে কতদিন দেখিনি—সে বেঁচে আছে কি না তাও জানি না, তবু কেন এত দুর্ভোগ বল দিকিনি বাবা? আমি কী করেছি? কার কী ক্ষতি করেছি?
দীপঙ্কর একটু চুপ করে রইল। তারপর বললে-আপনি মাসীমা আমার বাড়িতে চলুন—যাবেন?
মাসীমা বললে—না বাবা, আমি কোথাও যাবো না, এখানেই মরবো আমি—আমি এখানেই মরবো—এখানেই মরে পরে থাকবো—
দীপঙ্কর আর কথা বাড়ালো না। বললে—আপনি ভেতরে যান মাসীমা, আমি এখন আসি, আবার আসবো–
মনে আছে, সেদিন আর বেকিক্ষণ দাঁড়ায়নি সেখানে দীপঙ্কর। মাসীমার মুখের চেহারা দেখে কেমন ভয় হয়েছিল মনে। বোধ হয় মাসীমা আর বেশিদিন বাঁচবে না। মনে হয়েছিল কিরণের মা’র মনে। এতটুকু শান্তি দেবার ক্ষমতাও তার নেই। নিজেকে তাই বড় অপদার্থ মনে হয়েছিল তার। কিরণের মা’র উপকার করা যেন কিরণেরই উপকার করা। কিরণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে দীপঙ্কর, কিরণের মা’র উপকার করলে তার যেন কিছুটা ক্ষালন হতো। যেন কিরণেরই উপকার সে করতে এসেছিল এখানে।
কিন্তু কিছুই করা হলো না। অসহায় দুর্বলের মত, অপরাধীর মত দীপঙ্কর আস্তে আস্তে আবার নেপাল ভট্টাচার্যি লেন পার হয়ে চলে এল বড়-রাস্তায়।