কড়ি দিয়ে কিনলাম ২.২৩
২৩
সত্যিই তো, তাদের কী দোষ। তারা কী করবে। জীবনের এই উদার বিস্তারের মধ্যে আমরা যতই বিস্তীর্ণ হবো, ততই তো আমাদের আনন্দ, আবার ততই তো আমাদের আঘাত সহ্য করতে হবে। আনন্দকে যদি স্বীকার করে নিয়ে থাকি, তাহলে আঘাতকে ও এড়ালে চলবে না তো—! যে সৃষ্টিকার্যটি নিঃশব্দে সারা ভুবনময় চিরদিন ধরে চলে আসছে, ধ্বংসের অঙ্কুরটি তো তার মধ্যেই চির-নিহিত আছে। এসব জেনেও দীপঙ্কর সেদিন প্রথমে হতবাক হয়ে গিয়েছিল খবরটা শুনে। তাই প্রথমে বিশ্বাস হয়নি ক্লার্কের কথাগুলো। তাই বার-বার প্রশ্ন করে ঘটনার সত্যতা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হতে চেয়েছিল। তাহলে? সমস্ত আশ্রয়গুলো নির্মূল হয়ে গেলে কোথায় আশ্রয় পাবে সতী? কোথায় সান্ত্বনা পাবে সে?
—হুজুর!
আপিসের নির্জন কামরার মধ্যে এতক্ষণ দীপঙ্কর যেন আত্ম-সংবিত হারিয়ে ফেলেছিল। কোথায় কত দূরে কোন্ এক অত্যন্ত পরিচিত আত্মীয়রে যেন অন্তৰ্ধান হয়েছে, তারই বিয়োগ দীপঙ্করকে কয়েক ঘণ্টার জন্যে মুহ্যমান করে দিয়েছিল একেবারে। অথচ পাশেই রয়েছে সতী। একেবারে পাশের ঘরেই। সেই সতীও জানে না কোন্ অপঘাত তার অজ্ঞাতে চরম বিপর্যয় ডেকে এনেছে তার জীবনে। শুধু সতী নয়, কেউই জানে না। লক্ষ্মীদিও জানে না হয়ত!
—হুজুর!
এতক্ষণে মুখ তুলে চাইলে দীপঙ্কর। মধু দাঁড়িয়ে আছে সামনে। দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে—কী রে?
—ক্রফোর্ড সাহেব ডেকেছেন হুজুর।
সেদিন ক্রফোর্ড সাহেব হয়ত আশা করেছিল দীপঙ্কর তার কাছে অনুনয়-বিনয় করবে। হয়ত তার ট্র্যান্সফার ক্যানসেন্ড করবার জন্যে দরবার করবে। সদাশিব ক্রডোর্ফ সাহেব শুধু বললে—তোমার কবে যেতে সুবিধে হবে সেন?
দীপঙ্কর বললে—যেদিন আপনি বলবেন।
সাহেব বোধহয় সান্ত্বনা দিতে চেয়েছিল। বললে—তোমার বোধহয় সুবিধেই হলো সেন, এ-সময়ে ক্যালকাটা ইজ এ ডেঞ্জার জোন্, ডেঞ্জার জোন্ ছেড়ে যাওয়াই হয়ত ভালো তোমার পক্ষে!
সাহেব চেয়েছিল দীপঙ্কর প্রতিবাদ করে দরখাস্ত করবে। কিন্তু কিছুই করেনি দীপঙ্কর। এ ট্যান্সফার সে মাথা পেতেই নিয়েছে। আপিসের হুকুম বলে নয়। এ সতীর দেওয়া শাস্তি বলে সে মাথা পেতে নিয়েছে। সতী তাকে মমতা দেয়নি। সতী তাকে সান্নিধ্য দেয়নি, তাতে দীপঙ্করের মনে মনে যে ক্ষোভ জমে উঠেছিল, সতীর ঘৃণা পেয়ে সতীর শাস্তি পেয়ে যেন তার সমস্তটুকু ধুয়ে মুছে গেল।
—তোমার যদি ময়মনসিংএ যেতে কোনও অসুবিধে থাকে তো তুমি অ্যাপীল করতে পারো-ইউ ক্যান অ্যাপীল—আমি কসীডার করবো তোমার অ্যাপ্লিকেশন্ সেন!
আশ্চর্য! ক্রফোর্ড সাহেব জানতো বাঙালীরা কলকাতা শহর ছেড়ে বাইরে যেতে চায় না, তাই বার বার অনুরোধ করেছিল সেদিন। কিন্তু তবু দীপঙ্কর কিছুতেই রাজী হয়নি। অভয়ঙ্কর সোজা এসে ঢুকেছিল ঘরের মধ্যে। সেও বুঝতে পেরেছিল এ ট্র্যান্সফার অন্যায়, এ ট্র্যান্সফার অবৈধ, অকারণ। দীপঙ্কর ক্লার্ক থেকে বড় হয়েছে, সেইটেই হয়ত তার একমাত্র অপরাধ। কিন্তু আর কোনও অপরাধের রেকর্ড তার পার্সোন্যাল ফাইলে নেই। দিল্লীর বোর্ড থেকে শুরু করে জেনারেল ম্যানেজার পর্যন্ত সবাই জানে সেন এফিসিয়্যান্ট অফিসার। ডি-টি-আই হিসেবেও এফিসিয়্যান্ট ছিল, এখন অফিসার হিসেবেও এফিসিয়্যান্ট। স্টাফের কাছে পপুলার। স্টাফরা ভালবাসে। ক্রফোর্ড সাহেব বেশী কাজ দেখে না, ঘোষাল ওয়াগন আর এস্টাবলিশমেন্ট নিয়েই ব্যস্ত। ট্র্যাফিকের কাজ সেনকেই সব করতে হয়। আর কেউ নেই।
অভয়ঙ্কর বলেছিল—কিন্তু দিস্ ইজ রং, দিস্ ইজ আওয়ারেন্টেড—ইউ মাস্ট প্রোটেস্ট—
দীপঙ্কর হেসেছিল। বলেছিল—আমি প্রোটেস্ট করবো না—
—কিন্তু কেন? হোয়াই? তোমার কি ভয় করছে প্রোটেস্ট করতে?
দীপঙ্কর বলেছিল—না, ভয় করছে না, ভাল লাগছে, এই ইনসাল্ট আমার ভাল লাগছে—
—তার মানে?
অভয়ঙ্কর কিছু বুঝতে পারেনি। বুঝতে পারবেই বা কী করে! এ দীপঙ্করের এক অদ্ভূত আস্বাদ। সতীর সমস্ত ইনসাল্ট যেন দীপঙ্করের কাছে আশীর্বাদ। আর তাই-ই তার আনন্দ। সতী তাকে আরো আঘাত করুক। আরো অপমান করুক। তার আঘাতের মধ্যে দিয়েও যেন দীপঙ্কর সতীর সান্নিধ্য অনুভব করতে পারে। মমতা না দিক, আঘাতের মধ্যে দিয়েই তাকে মর্যাদা দিক, তাকে আপন আত্মীয় করুক।
সেই আনন্দের কথাটা বলতেই বোধহয় দীপঙ্কর সেদিন আবার লক্ষ্মীদির বাড়িতে গিয়েছিল। সেই লক্ষ্মীদির বাড়ি। সেখানে তখন আরো পরিবর্তন হয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত ঐশ্বর্য সেখানে তখন আকাশের মত নিচু হয়ে নেমে এসেছে লক্ষ্মীদির মাথায়। লক্ষ্মীদি শুধু হুকুম করে। একদিন যে ঐশ্বর্য সতীর করায়ত্ত হয়েছিল ভুবনেশ্বর মিত্রের অর্থের যৌতুকে, সেই ঐশ্বর্যের সবটুকু আশীর্বাদের মত লক্ষ্মীদির মাথায় এসে নেমেছে। লক্ষ্মীদি ঘুম থেকে ওঠে দেরি করে। তারপর চা খায়। তারপর ব্রেকফাস্ট। পাড়ার লোকেরা অবাক হয়ে চেয়ে দেখেছে, বাড়িটা কেমন ভাঙা-বাড়ি ছিল, আর কেমন রাতারাতি হঠাৎ একটা প্রাসাদ হয়ে উঠেছে। ভেতরের অনেক বিলাসের প্রাচুর্য বাইরের জগতে উঁকি-ঝুঁকি মারে। সবটা দেখা যায় না, বেশির ভাগটাই আন্দাজ করে নিতে হয়। বড় বড় গাড়ি এসে দাঁড়ায় বাড়ির গেটের সামনে। বড় বড় সম্ভ্রান্ত লোক নামে। তারপর ভেতরে ঢুকে যায় তারা। কোট-ট্রাউজার পরা সম্ভ্রান্ত লোকদের চেহারা দেখলেই চেনা যায়। লক্ষ্মীদি তাদের অভ্যর্থনা করে আমন্ত্রণ করে। লক্ষ্মীদির সঙ্গ পেয়ে তারা ধন্য হয়ে যায়।
কেউ বলে—আজকাল হুইস্কিতে বড় ভেজাল চলছে—
তখনি টনক নড়ে ওঠে লক্ষ্মীদির। বলে—ভেজাল! ভেজাল তো হতে পারে না। আমি তো ওল্ড কাস্টমার, আমাকে ভেজাল প্রভিসন দেবে কেন? আচ্ছা দেখছি—
বলে তখনই ফোন করে দেয় স্টোরে। মিসেস দাতারের বাড়িতে হুইস্কি সাপ্লাই করা হয়েছে অমুক তারিখে। সে হুইস্কি কবেকার ইনডেন্ট, কোন্ কোম্পানীর সাপ্লাই, সব খোঁজ-খবর নেওয়া হয়। হুলুস্থুল পড়ে যায় দোকানে। মিসেস দাতার আমাদের পুরোন কাস্টমার। ওয়ারের শুরু থেকেই তার বাড়িতে মাল যাচ্ছে, এরকম কম্প্লেন হওয়া অন্যায়। এমনি করে শুধু হুইস্কি নয়। সব কিছুই মিসেস দাতারের বাড়িতে সচ্ছল। সব কিছুই উদার। টাকার জন্যে চিন্তা নেই, শুধু পিওর মাল দরকার। পিওর মাল দাও, পেমেন্ট দেব ক্যাশ। মিসেস দাতারের কাছে পেমেন্টের জন্যে কেউ ভাবনা করে না। বিরাট মিলিটারি কন্ট্রাক্টর। যুদ্ধ যদি চলে আরো কিছুদিন, মিসেস দাতার আরো উদার হবে, আরো সচ্ছল হবে! টি একটু একটু বেশী বয়েল হয়ে গেলে মিসেস দাতারের মেজাজ বিগড়ে যায়। বলে—কী যে করে এরা সব, এখনও চা তৈরি করতে শিখলে না—
তারপর ডাকে—কেশব—
কেশব তখনও আছে। কেশবের পদমর্যাদা বেড়েছে মাইনে বেড়েছে এ-বাড়িতে। সে দৌড়ে এসে বলে—কী মা?
লক্ষ্মীদি বিছানায় শুয়ে শুয়েই বলে-এ চা কে করেছে রে? এখনও চা করতে শেখেনি? আকবর বুঝি?
সামান্য একটু চা, সেই চা খারাপ হলেই লক্ষ্মীদির মাথায় এখন বজ্রাঘাত হয়। বজ্রাঘাত হয় বাড়ির বাবুর্চি, বয়, খানসামা, চাকর—সকলের মাথায়! তারপর হুইস্কি, চা, সোডা, লেমনেড, ডিনার ব্রেকফাস্ট—সব কিছুর দিকেই মিসেস দাতারের তীক্ষ্ম নজর। মিস্টার দাতার চুপ করে থাকেন। তার পোশাক-পরিচ্ছদেও এখন আরো জৌলুস এসেছে। কোথা থেকে টাকা আসছে, কে টাকা জোগাচ্ছে, সব দেখতে পান। তাঁর নামেই কারবার। যে ফ্যাক্টরি তাঁর নেই, সেই ফ্যাক্টরি থেকেই লক্ষ-লক্ষ টাকার অর্ডার সাপ্লাই হচ্ছে। তিনিই চেক সই করছেন, তিনিই চেক রিসিভ করছেন। তিনিই সব। তাঁর নামেই ব্যাঙ্ক য়্যাকাউন্ট। লক্ষ্মীদি কেউ না, কিছু না। কিন্তু তবু যখন সুধাংশু আসে বাড়ির সবাই তটস্থ হয়ে থাকে। সুধাংশুর হুইস্কিতে একটু সোডার প্রপোরশন কম হলে চলবে না, সুধাংশুর চা’য়ে একটু কম চিনি হলে চলবে না। সুধাংশুর জন্যেই এই বাড়ি, এই গাড়ি, এই ঐশ্বর্য, এই সুখ, এই টাকা, এই সব কিছু। সবাই টেবিলে বসে আছে, হঠাৎ খবর এল। সুধাংশুর গাড়ির হর্ন-এর শব্দ শুনেই সবাই বুঝতে পারে।
—কী হলো সুধাংশু, এত দেরি যে?
সকলেরই মুখ এই একটি মানুষের মুখের দিকে। এই একটি মানুষকে ঘিরেই সকলের সব উৎসব, সব আয়োজন।
—আর বলেন কেন মিসেস দাতার, এবার গভর্নমেন্ট আমাকে খেয়ে ফেলবে। হোল্ সাউথ-ইস্ট এশিয়ার সাপ্লাই সেন্টার হয়ে গেছে আমাদের আপিসটা, কাজ করে করে আর পারছি না।
মিসেস দাতার বলে—সত্যিই তো, তুমি আর কতদিক সামলাবে, কিন্তু এ-রকম করলে যে তোমার হেলথ ব্রেক করবে—আরো গোটা কয়েক অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার নাও—
সুধাংশু বলে—সে তো নিয়েছি, কিন্তু যেমন হয়েছে আমাদের রটন গভর্নমেন্ট, তেমনি হয়েছে আমাদের রটন অ্যাসিস্ট্যান্টস্—কারোর যদি একটু বুদ্ধি থাকে—ওয়ান আউন্স অব ব্রেন থাকে—রট—রট—
মিসেস দাতার বলে—কেন, আজকেও বুঝি কনফারেন্স ছিল?
—কনফারেন্সের কথা ছেড়ে দিন মিসেস দাতার, এই মুসলিম লীগ মিনিস্ট্রি হয়েছে যেমন, তার মিনিস্টাররাও হয়েছে তেমনি— খাজা হাবিবুল্লোর সঙ্গে কথা বলতে বলতে আজ আর মাথা ধরে গেছে। কিছু বোঝে না—ইংরিজী ভাষাটাও এর ভালো করে শেখেনি, অথচ মিনিস্টার হয়েছে—।
তারপর হঠাৎ বললে—ভাবছি দিল্লীতে চলে যাবো—
দিল্লীতে! সবাই চমকে উঠলো। মিসেস দাতার বললে—দিল্লীতে?
সুধাংশু ততক্ষণে চায়ে চুমুক দিয়ে সিগ্রেট ধরিয়েছে। বললে—দিল্লীতে না গেলে কাজের বড় অসুবিধে হচ্ছে, বার বার দিল্লীতে যেতে-আসতে অনেক সময় নষ্ট হচ্ছে, কেউ তো কিছু কাজ জানে না—সমস্ত রটন্ হয়ে গেছে, এ ওয়ার যে এরা কেমন করে জিবতে বুঝতে পারছি না।
চৌধুরীও এতক্ষণ সব শুনেছিল সে যেন আঁতকে উঠলো। বললে—ওয়ার কি শেষ হয়ে যাবে না কি?
মিসেস দাতারও চমকে উঠলো। বললে—বলছো কী, সুধাংশু, ওয়ার শেষ হয়ে যাবে?
সুধাংশু চায়ে আর একবার চুমুক দিয়ে বললে-আমি যদি ঠিকমত সাপ্লাই না দিতে পারি তো ওয়ার তো শেষ হয়ে যাবেই—ওয়ার করবে সোলজাররা কী খেয়ে?
মিসেস দাতার বললে—না, না, সে কি? ওয়ার যেন শেষ করতে দিও না, আরো কয়েকটা বছর অন্ততঃ চালিয়ে নিয়ে যাওয়া চাই—তুমি যে আমাকে ভয় পাইয়ে দিলে দেখছি সুধাংশু—
চৌধুরী বললে—আমিও ভয় পেয়ে গেছি, তিনশো টাকা অ্যালাওয়েন্স হঠাৎ স্টপ হয়ে গেলে খাবো কী?
সুধাংশু বললে—সেই অবস্থাই হয়ে উঠেছে—কেউ কিছু কাজ করবে না, সবাই ডিস্-অনেস্ট হয়ে উঠেছে, কীসে আরো একস্ট্রা উপায় করবে তাই ভাবছে—সে গভর্নমেন্ট থেকে আরম্ভ করে ডাউন টু মিনিস্টারস্—
মিস্টার দাতার এতক্ষণ শুনছিলেন সব কথা। বললেন—ওয়ার কি সত্যিই থেমে যাবে সুধাংশুবাবু?
সাধারণত এ-সব আলোচনার সময় মিস্টার দাতার কথা বলেন না। তিনি সেজেগুজে চুপ করে বসে থাকার দলে। কিন্তু তাঁকে কথা বলতে শুনে সুধাংশু একটু অবাক হলো। বললে-আপনার কিছু ভয় নেই মিস্টার দাতার—অন্তত আমি যতদিন সাপ্লাইতে আছি—
মিস্টার দাতার বললে—না, আপনারা তো সেসব দিন দেখেননি সুধাংশুবাবু, ট্রেড- ডিপ্রেসনের ভিক্টিম যে আমি—অনেক ভুগেছি—তখন এখনকার মত ক্যাশে পেমেন্ট হতো না তো—দু বছর তিন বছর পর্যন্ত ক্রেডিট পড়ে থাকতো পার্টির কাছে—
এমনি করেই প্রতিদিন এ-বাড়িতে আড্ডা হয়। বাইরে যখন ব্ল্যাক আউট, যখন মিলিটারি লরী রাস্তা কাঁপিয়ে লোক চাপা দিয়ে ছুটে বেড়ায় বাইরে, যখন যুদ্ধ কবে শেষ হবে তাই নিয়ে আলোচনা করে গৃহস্থেরা, তখন এখানে হুইস্কিতে ভেজাল হলে হুলুস্থুল পড়ে যায়, চায়ে চিনি কম হলে খানসামার চাকরি চলে যায়, তখন যুদ্ধ হঠাৎ শেষ হয়ে যাবে শুনলে সবাই চমকে ওঠে।
তারপর যখন রাত আরো গভীর হয়, এ-পাড়ার রাস্তায় মিলিটারি লরীর আওয়াজ আরো বাড়ে, তখন চলে তাস। দল বেঁধে তাস খেলা শুরু হয়। হুইস্কির বোতল খোলা হয় নতুন করে। সিগারেটের টিন খোলা হয় নতুন করে।
মিসেস দাতার সুধাংশুর হাতটা চেপে ধরে। বলে—আর খেও না সুধাংশু, এর পরে আর ড্রাইভ করতে পারবে না—
সুধাংশু হাসে। বলে—কী বলছেন মিসেস দাতার, আপনি আমাকে এখনও চিনলেন না—
মিসেস দাতার বলে—আর চিনে দরকার নেই তোমাকে—
সুধাংশু তবু হাসে। বলে—আপনি ভয় পাবেন না মিসেস দাতার, বর্ন ইন এইটিন এইট্টি অ্যান্ড স্টিল গোয়িং স্ট্রং—আমি খাঁটি স্কচ—ডাইরেক্ট ফ্রম ব্রুয়ারী, হোয়াইট হর্স- রেড লেবেল—ব্ল্যাক-মার্কেটে আমার দাম পঁচাত্তর টাকা পার বট —
মিসেস দাতার বলে–আস্তে, একটু আস্তে সুধাংশু—
সুধাংশু বলে—কেন, আস্তে কেন মিসেস দাতার, আমি কাউকে ভয় করি না কি?
মিসেস দাতার বলে—পাশের ঘরে যে মানস আছে—
—মানস!
এতক্ষণ কারোরই খেয়াল ছিল না। সুধাংশু বললে—তা মানস কবে যাবে?
কোথায় যাবে? ও তো আর কোথাও যেতে চাইছে না!
—পাঠিয়ে দিন! জোর করে পাঠিয়ে দিন আপনি! অক্সফোর্ড কেম্ব্রিজ যেখানে হোক পাঠিয়ে দিন। আমি পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতে পারি—
মিসেস দাতার বললে—কিন্তু এখন পাঠাই কী করে আমি? ওকে সেই যুদ্ধের মধ্যে পাঠিয়ে কি আমিই থাকতে পারবো?
সুধাংশু বললে কিন্তু এখানে আপনার চোখের সামনে অত বড় ছেলে থাকলে ফুর্তি জমবে কী করে মিসেস দাতার? ছেলের সামনে কি ফুর্তি জমে? আপনিই বলুন?
ওদিকে ভেতরে মিস্টার দাতার নিজের বিছানার ওপর চিত হয়ে চুপ করে শুয়ে ছিল। অন্ধকার চারদিকে। মাঝে মাঝে অনেক দূর থেকে অ্যান্টি-এয়ার-ক্র্যাফ্ট বন্দুকের আওয়াজ আসছে। হঠাৎ ঘরের ভেতরে কার পায়ের শব্দ পেয়েই চমকে উঠলো।
—কে?
—এ কি, তুমি ঘুমোও নি এখনও? রাত তো অনেক হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়। আবার তোমার শরীর-খারাপ হবে দেখছি—
মিস্টার দাতার বললে—তুমি ঘুমোবে না?
মিসেস দাতার বললে—আমি কী করে ঘুমোই, ওরা যে এখনও রয়েছে—
–ওরা কখন যাবে?
মিসেস দাতার বললে—তা ওরা না গেলে কি ওদের জোর করে তাড়িয়ে দেব বলতে চাও? তুমি যে কী বল তার ঠিক নেই। আমি কি ওদের চলে যেতে বলতে পারি?
—না; আমি কি তাই বলেছি? বলছিলুম যে ওদের কি ঘুমও পায় না?
—যাক, তোমার সঙ্গে আমি আর তর্ক করতে পারি না।
দাতারবাবু কিছু বললে না। খানিক চুপ করে রইলো। তারপর আবার বললে—তুমি কি কোথাও বেরোচ্ছ নাকি এখন?
মিসেস দাতার শাড়ি বদলাচ্ছিল। বললে—হ্যাঁ, একটু মাঠের দিকে বেড়াতে যেতে বলছে সুধাংশু—
—তা বলে এত রাত্তিরে? এখন তো অনেক রাত!
মিসেস দাতার বললে—ওরা বায়না ধরেছে এখন, না গেলে চলে?
দাতারবাবু একটু, চুপ করে থেকে বললে—একটা কথা তোমাকে বলছিলুম—
—কী কথা বলো, আমার আবার দেরি হয়ে যাচ্ছে, শিগগির বলো।
দাতারবাবু বললে—আমাদের তো অনেক টাকা হয়ে গেল, সেদিন ব্যাঙ্কের পাস- বইটা দেখছিলুম, আর এখন টাকার দরকারই বা কী!
—তুমি যে কী বলো! তোমার দেখছি মাথাটা এখনও ভাল করে সারেনি। টাকার দরকারের আবার শেষ আছে নাকি? যে-কষ্ট আমরা করেছি, তোমার মনে না-থাক, আমার তো মনে আছে। তুমি ঘুমোবার চেষ্টা কর দিকিনি। আমি চললুম—
দাতারবাবু আর কথা বললে না। লক্ষ্মীদি নতুন শাড়িটা গায়ে জড়ালে। মুখে, গালে, গলায় পাউডার, স্নো ঘষলে। তারপর বললে—মানস যদি ওঠে, তাহলে যেন বোল না আবার কোথায় গেছি আমি, —
—কখন আসবে?
—মানস টের পাবে না। মানস ঘুম থেকে ওঠবার আগেই আমি ফিরে আসবো- যাই, কেমন?
—খানিক পরেই বাইরের রাস্তায় সুধাংশুবাবুর গাড়ির ইঞ্জিনটা গর্জন করে উঠলো। হৈ হৈ শব্দ করতে করতে দল-বল বেরিয়ে গেল। দাতারবাবু শুনতে পেলে লেভেল— ক্রসিং-এর কাছে গিয়ে গাড়িটা জোরে জোরে হর্ন বাজাচ্ছে। বোধহয় গেটটা বন্ধ। সেই মাল-গাড়িটা এই সময়ে রোজ আসে। রোজ রাত্রে দাতারবাবু জেগে-জেগে মাল-গাড়ির শব্দটা শোনে। প্রথমে ঝিক্-ঝিক্ ক্ষীণ শব্দ। তারপর শব্দটা আরও স্পষ্ট হয়, আরও তীক্ষ্ম হয়। ক্রমে আরও স্পষ্ট, আরও তীক্ষ্ণ। তারপর একেবারে হুড়মুড় করে এসে পড়ে বাড়িটার কাছাকাছি। তখন মাটি কাঁপে, বাড়িটাও কাঁপে। দাতারবাবুও থর থর কাঁপে বিছানায় শুয়ে শুয়ে। তার মনে হয় আবার বুঝি তার মাথার মধ্যে সমস্ত গোলমাল হয়ে যাবে আগেকার মত। একদিন টাকার অভাবে মাথাটা গোলমাল হয়ে গিয়েছিল, এখন আবার টাকার প্রাচুর্যে সব গোলমাল হয়ে যাবে।
এমনি রোজ। রোজ রোজ এমনি করে বেরিয়ে যায় মিসেস দাতার শেষ রাত্রের দিকে। গড়িয়াহাট লেভেল-ক্রসিং-এর কাছে গিয়ে সুধাংশুর গাড়িটার হর্ন বেজে ওঠে। অধৈর্য হয়ে ওঠে সুধাংশুর রক্ত। অধৈর্য হয়ে ওঠে রেড-লেভেল হুইস্কি। অধৈর্য হয়ে ওঠে উনিশ শো বিয়াল্লিশ সাল।